লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ October 3, 2024, 12:00 AM, Hits: 347
প্রবাস থেকে দেশে আসবার পর শেখ হাসিনার মাফিয়া সরকারের আজ্ঞাবহ বিচারকের দ্বারা মিথ্যা ও হাস্যকর এক মামলায় কারাদণ্ডাদেশপ্রাপ্ত সাংবাদিক মাহমুদুর রহমান এখন কারাবন্দী হয়েছেন। এই মামলায় তিনি একা নন, শফিক রেহমানের মতো প্রখ্যাত সাংবাদিকও সাজাপ্রাপ্ত। পলাতক প্রধান মন্ত্রী হাসিনার পুত্র মার্কিন প্রবাসী জয়কে হত্যার চক্রান্ত নাকি তারা করেছিলেন! যাইহোক, এই হাস্যকর ও ফালতু এক মামলার বিষয়বস্তু নিয়ে আলোচনা করার কোনও প্রয়োজন বোধ করি না। আমার প্রশ্ন হল এ ধরনের মামলাগুলি ডঃ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের শাসনকালেও কীভাবে টিকে থাকে?
প্রশ্ন শুধু মাহমুদুর রহমানকে নিয়ে নয়, বরং প্রশ্ন হল বিগত সরকারের আমলে করা সকল রাজননৈতিক মামলা কেন এতদিনেও বাতিল করা হয় নাই? তার মানে কি এই যে, এই সরকার বিগত স্বৈরাচারী ও মাফিয়া সরকারের সকল উত্তরাধিকারকে রক্ষা করে চলতে চায়? আর তাই বিগত সরকারের আমলে বিরোধী দল-মতের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলাগুলি যেমন বহাল আছে তেমন দণ্ডাদেশগুলিও আজ অবধি বহাল আছে। সুতরাং বিএনপি নেতা খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান আজও দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত হয়ে আছেন। তবে এই মুহূর্তে সরকারের দিকভ্রষ্টতাকে চোখে আঙুল দিকে দেখিয়ে দিল আইনের তামাশা করে মাহমুদুর রহমানকে কারাগারে প্রেরণ। আমি মাহমুদুর রহমানের কিছু চিন্তা কিংবা মতামতকে সমর্থন করি না। কিন্তু সেটা তার বিশ্বাসের জায়গা। এই বিশ্বাসকে ধারণ ও প্রচার করার অধিকার তার আছে।
কিন্তু শুধু এইটুকু বললেই তার সম্পর্কে অনেকটাই বলা হয় না। একদিকে তিনি যেমন বিগত সরকারের মাফিয়াদের মত দুর্নীতিগ্রস্ত ও দুর্বৃত্ত নন, অন্যদিকে অনেক মূল্য দিয়ে একজন সৎ ও নিজ বিশ্বাসের প্রতি অটল ব্যক্তি হিসাবে তিনি এই সমাজে প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছেন। এই সততা ও নীতিনিষ্ঠার মূল্য এই সমাজে কতটা সেটা আমি অনুভব করি। তিনি আরও অনেকের মতো শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনের সুবিধা ভোগের পরিবর্তে তার বিরুদ্ধে লড়াই করে বিপুল দুর্ভোগ ও ক্ষয়ক্ষতি বরণ করেছেন। বাংলাদেশে তিনি যতদিন ছিলেন ততদিন তিনি শেখ হাসিনার লুটপাটতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে অকুতোভয়ে লড়াই করে গেছেন। এ দিয়েও তার মূল্যায়ন করতে হবে।
আমি মনে করি আমাদের সমাজে একটা বড় সমস্যা হচ্ছে মুক্তচিন্তার পরিবেশ না থাকা। সমাজের সুস্থ বিকাশের জন্য বিভিন্ন চিন্তার প্রকাশ ও প্রচারের প্রয়োজন আছে। এই কারণেও তার কারাবাস আমাকে খুব আহত করেছে। কোন অধিকারে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার তার মামলা বাতিল না করে তাকে জেলে নিয়েছে?
তার কারাবাসের সাফাই গেয়ে আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুলের বক্তব্য শুনে আমার শুধু একটা কথাই মনে হল যে, তিনি ‘বাঙ্গালকে হাইকোর্ট’ দেখাতে চাইছেন। মানুষকে এত বোকা মনে করেন কেন তিনি? তিনি কোন আইনের দোহাই দিতে চান? এ কথা কি তিনি ভুলে গেছেন যে, এই সরকার ও তার উপদেষ্টা পদের বৈধ ভিত্তি জুলাই-আগস্ট ছাত্র-জনতার বিপ্লবী অভ্যুত্থান? যে সংবিধানকে যথেচ্ছ ব্যবহার করে মাফিয়া সর্দার হাসিনা প্রায় ষোলো বৎসর একটানা ক্ষমতা দখল করে রেখেছিলেন ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে তার দেশ ছেড়ে পলায়নের সঙ্গে বাস্তবে তার সংবিধান ও তার যাবতীয় আইন কিংবা বিধিবিধানের মূল্য কতটুকু থাকে? বাস্তবে বাতিল অথবা বাতিল হওয়ার যোগ্য পুরাতন সংবিধান ও বিধিবিধানের পরিবর্তে এখন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও তার সঙ্গেকার জনতার অভিপ্রায়ই বাস্তবে বাংলাদেশের সকল আইনের নূতন ও একমাত্র উৎস হয়েছে। আর তাই যে পদ্ধতিতেই গঠিত হোক অন্তর্বর্তী সরকার এ দেশের একমাত্র ও সর্বজনগ্রাহ্য বৈধ সরকার। আসিফ নজরুল যে আজ আইনের মারপ্যাঁচ দেখাচ্ছেন সেটার উদ্দেশ্য কি ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মহিমাকে অন্তর্ঘাত করা? কী উদ্দেশ্য তার, নাকি তার সরকারেরও?
এই সরকারের সাফল্য আমি চাই। কারণ এটা একটা স্বাধীন ও বিপ্লবী অভ্যুত্থানের ফসল। এক অর্থে এই বিপ্লবী অভ্যুত্থানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য ১৯৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের চেয়েও অনেক বেশী। কারণ ১৯৭১-এর বিপ্লবী যুদ্ধও এক অর্থে স্বাধীন ছিল না। বরং তা ছিল কংগ্রেসী ভারতের আশ্রিত ও আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ভারতীয় সরকার ও রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সুতরাং পরাধীন এই মুক্তিযুদ্ধ লক্ষ্য অর্জনে এভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ৫৩ বৎসর পর আমরা এবার এমন একটা অভ্যুত্থান পেলাম যা স্বাধীন। কোনও বহিঃশক্তির অধীনতায় থেকে আমাদের এবারকার লড়াই ও অভ্যুত্থান পরিচালিত হয় নাই। আমি মনে করি এখনও বিপ্লব সম্পূর্ণ হয় নাই। তবে আমি মনে করি ’৭১-এর পর এবার আমাদের দ্বিতীয় বিপ্লব সূচিত হয়েছে এবং তার সূচনা স্বাধীনভাবে হয়েছে। সুতরাং এই আশা করা যৌক্তিক যে, এবার তা ’৭১-এর মতো ব্যর্থ হবে না। তবে এই বিপ্লবকে সফল করতে আসিফ নজরুলের মতো উপদেষ্টাদের মতলব সম্পর্কে সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। এবং সেই সঙ্গে আমরা যারা ডঃ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের সাফল্য কামনা করি তাদের এই সরকারের প্রতিটি পদক্ষেপ সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। বড় ধরনের ভুল করার কোনও সুযোগ এই সরকারের নাই।
এই আলোচনার শেষে বলতে চাই অনতিবিলম্বে দণ্ডাদেশ বাতিল করে সাংবাদিক মাহমুদুর রহমানকে নিঃশর্তভাবে মুক্তি দিতে হবে এবং বিগত মাফিয়া সরকারের আমলে বিএনপি নেতা ও কর্মীসহ বিরোধীদের বিরুদ্ধে করা সকল নিপীড়নমূলক রাজনৈতিক মামলা ও সেগুলির রায় বাতিল ঘোষণা করতে হবে।
৩ অক্টোবর, ২০২৪