জন্ম থেকে আজ অবধি অস্তিত্বের সঙ্কট তাড়া করছে বাংলাদেশকে। এই সঙ্কট কমার পরিবর্তে দিনে দিনে বরং বেড়েই চলেছে। একটা সঙ্কট সমাধান হওয়ার আগেই আরও নূতন নূতন সঙ্কট ঘিরে ধরছে তাকে। স্বাধীনতার পর দৃশ্যমান বস্তুগত উন্নয়ন হয়েছে অনেক; কিন্তু সে তুলনায় নৈতিক এবং আত্মিক অধোগতি হয়েছে অনেক বেশী। সমাজের সর্বত্র ঘুষ, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য, অন্যায়, অত্যাচারের ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে। এই অবস্থার সুযোগ নিয়ে লাগামহীন ভোগ-বিলাস-সম্ভোগে ডুবে আছে দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের মাধ্যমে অর্জিত বিপুল অর্থ-বিত্তের মালিক মুষ্টিমেয় কিছু মানুষ, আর এই অবস্থার শিকার হয়ে নিদারুণ দুর্ভোগ পোহাচ্ছে সমাজের অর্ধেক অংশ নারী, দুর্বল-অসহায় এবং ধর্মীয় ও জাতিগত সংখ্যালঘু মানুষ।
যে সব প্রতিশ্রুতি ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে ষাটের দশকে বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, যার পরিণতিতে ১৯৭১ সালে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধ সংঘটিত হয় - সেই সব প্রতিশ্রুতি কিছু সংখ্যক ক্ষমতাধরের দেশ ও জাতির সম্পদ লুটপাটের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে এবং সেই সব আকাঙ্ক্ষাও তাদের দ্বারা পদদলিত হয়েছে। ষাটের দশকের স্বাধীনতা আন্দোলন এবং ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার ফসল ’৭২-এর সংবিধানের চার মূলনীতি - জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, সেক্যুলারিজম - ’৭৫ সাল পর্যনত শুধুমাত্র কাগজে সীমাবদ্ধ হয়ে ছিল। ’৭৫-এর পর চারটি মূলনীতির দু’টি মূলনীতি সরিয়ে ফেলে পাকিস্তানী ভাবাদর্শ ফিরিয়ে আনা হয়। ষাটের দশকে সূচিত বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন ’৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল সেটি নেতৃত্বের দুর্বলতা ও বহিঃশক্তির প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপের কারণে অপূর্ণাঙ্গ হয়ে রয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশ রাষ্ট্র বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও যুদ্ধের মূল চেতনাকে ধারণ করতে পারে নাই। এর ফলেই চার মূলনীতি থেকে বিচ্যুতি।
বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও যুদ্ধের চেতনার সঙ্গে বিচ্ছিন্নতা থেকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি-সমাজ-রাজনীতি সর্বত্র আদর্শহীনতা ও দেশপ্রেমহীনতার বিস্তার হয়। এই আদর্শহীন-দেশপ্রেমহীন রাজনীতির সঙ্গে নানা বিদেশী চক্র মিলে এ দেশকে দানবিক শোষণ ও লুটপাটের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছে। এই সব দেশী-বিদেশী চক্র বাংলাদেশকে আজ এমন এক পরিস্থিতিতে নিয়ে গেছে যার ফলে আজ তার অস্তিত্ব হুমকির সমমুখীন। দিন যত যাচ্ছে এই অস্তিত্বহীনতার ঝুঁকি তত বাড়ছে। এই অবস্থা থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করার জন্য বিপুল উদ্যোগ ও বিশাল কর্মযজ্ঞের প্রয়োজন। আমরা বঙ্গরাষ্ট্রকে এই উদ্যোগ ও কর্মযজ্ঞের অংশ হিসাবে গড়ে তুলতে চাই। আমরা চাই বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও যুদ্ধের চেতনার পুনর্জাগরণ ঘটুক - আকাঙ্ক্ষার বাস্তবায়ন হোক। বাংলাদেশে রাজনীতিসহ সমাজের সর্বস্তরে আদর্শ ও নীতি-নৈতিকতা প্রতিষ্ঠিত হোক।
আমরা একই সঙ্গে মনে করি, বাঙ্গালীর স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ও যুদ্ধের চেতনার ভিত্তিতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পূর্ব শর্ত হচ্ছে সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে নারীর নিজস্ব প্রতিনিধিত্বমূলক শাসন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করা, ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতির যে বিভক্তি ঘটেছিল তাকে নাকচ করা এবং বাঙ্গালীর পুনরেকত্রীকরণকে লক্ষ্য হিসাবে ঘোষণা করা।
আমরা আরও মনে করি, বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ বাঙ্গালী হলেও এ দেশে আরও অন্যান্য সংখ্যালঘু জাতিসত্তা বাস করে। সেই সব জাতিসত্তার নিজস্ব ভাষা-সংস্কৃতি রক্ষা করে আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার ভোগ করার অধিকার মেনে নেওয়া বাঙ্গালী জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অন্যতম নৈতিক দাবী।
২৩ নভেম্বর, ২০০৮