লিখেছেনঃ জন জে, ও’নীল, আপডেটঃ August 25, 2010, 5:36 AM, Hits: 44004
আমাদের যুগের একটা অত্যন্ত শক্তিশালী কল্পকথা হচ্ছে, ক্রুসেড ছিল শান্ত এবং সংস্কৃতিবান ইসলামী জাহানের বিরুদ্ধে বিনা উস্কানিতে বর্বর ইউরোপের হামলা।
প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দী ছিল ইসলামী সম্প্রসারণের মহান যুগ। আমাদের বলা হয় যে, একাদশ শতাব্দী নাগাদ - প্রথম ক্রুসেডের কাল - ইসলামী জাহান ছিল শান্ত ও স্থিতিশীল, এবং এর মোদ্দা কথা হচ্ছে ক্রুসেডাররা ছিল আক্রমণকারী। অবশ্যই ক্রুসেডারদেরকে পশ্চাৎপদ ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন ইউরোপ থেকে আগত বর্বর যাযাবর হিসাবে ধারাবাহিকভাবে চিত্রিত করা হয়। যারা একাদশ শতাব্দীতে নিকট প্রাচ্যের সংস্কৃতিবান ও নগরকেন্দ্রিক বিশ্বে হামলা চালিয়েছিল।
এই জনপ্রিয় ভাষা প্রায়ই টেলিভিশনে এবং সংবাদ-পত্রের নিবন্ধে প্রয়োগ করা হয়। আমি অবশ্য আমার ‘হোলি ওয়ারিঅর্সঃ ইসলাম এন্ড দ্য ডিমাইজ অফ ক্ল্যাসিক্যাল সিভিলাইজেশন’-এ দেখিয়েছি যে, ইসলামের আবির্ভাবের আগে ‘পবিত্র যুদ্ধ’ সম্পর্কে খ্রীষ্টানদের কোন ধারণাই ছিল না। মুসলমানদের কাছ থেকেই ইউরোপীয়রা এ ধারণা গ্রহণ করেছে। আমি আরো দেখিয়েছি যে, ক্রুসেডগুলো খ্রীষ্টান ইউরোপের পক্ষ থেকে মোটেই বিনা উস্কানিতে আগ্রাসন ছিল না; বরং ছিল একাদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে গোটা ইউরোপ দখলের লক্ষ্যে পরিচালিত মুসলিম অগ্রাভিযান মোকাবেলায় পশ্চাদ্বাহিনীর তৎপরতার অংশ। ইউরোপ এমন হুমকি এর আগে কখনও প্রত্যক্ষ করে নাই।
হোলি ওয়ারিঅর্স পুস্তকে প্রদত্ত তথ্য সত্ত্বেও, মধ্যযুগীয় ইতিহাসবিদদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ এ মর্মে একমত ছিলেন যে, ক্রুসেড পরিচালনার জন্য ইসলামের দিক থেকে হুমকি ছিল না বললেই চলে; আসলে মুসলমানরা ছিল অভ্যাসগত সহিংসতা ও লুণ্ঠনের সংস্কৃতিতে আচ্ছন্ন আদিম ও বর্বর ইউরোপের সুবিধাজনক টার্গেট। বলা হয়, ইউরোপীয় যোদ্ধা শ্রেণীর ‘শক্তি’ অভ্যন্তরীণ ধ্বংস সাধনের পরিবর্তে পোপের নির্দেশে ইসলামী জাহানের সহজ টার্গেটের বিরুদ্ধে নিয়োজিত হয়েছিল। দৃষ্টান্ত স্বরূপ, মারক্যুস বুল ‘অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব দি ক্রুসেড্স্’ গ্রন্থে ক্রুসেডের মূল পরীক্ষা করতে গিয়ে এই ধারায় চিন্তা করেছেন। প্রায় ১০ হাজার শব্দের এক নিবন্ধে বুল মুসলিম হুমকির বিষয় একেবারেই বিবেচনায় নিতে পারেন নাই। তিনি বরং তা শুধু নাকচ করার উদেশ্যে এর উল্লেখ করেছেনঃ
‘‘ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে লড়াইয়ের (ইসলাম ও খ্রীষ্টান ধর্মের মধ্যে) প্রেক্ষাপট যেসব প্রতিষ্ঠানের কাছে দৃশ্যমান ছিল সেগুলির মধ্যে প্রধান ছিল পোপের শাসন পরিষদ। এর ছিল গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক, ভূগোল সম্পর্কে ধারণা, এবং খ্রীষ্টান দুনিয়া ও এর উপর বাস্তব বা কাল্পনিক হুমকি সম্পর্কে ব্যাপক দৃষ্টিভঙ্গীর দীর্ঘ ঐতিহাসিক ঐতিহ্য। এ বিষয়টির উপর জোর দেওয়া উচিত; কারণ, ক্রুসেডের সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে প্রায়ই ভুলভাবে ১০৯৫ সালের আগের দশকগুলোর সেসব ঘটনাকে গুলিয়ে ফেলা হয় যখন খ্রীষ্টান ও মুসলমানগণ পরস্পরের আক্রমণের মধ্যে ছিল। একটা ধারণা সদাসর্বদা প্রয়োগ করা হয় যে, প্রথম ক্রুসেড ছিল একাদশ শতাব্দীতে ধর্মযুদ্ধের চরিত্র লাভ করা একের পর এক যুদ্ধের পরিণতি; এই যুদ্ধগুলিকে ‘‘পরীক্ষামূলকভাবে’’ কার্যকর বলা যায় যা ইউরোপীয়দের কাছে ক্রুসেডের অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্য হাজির করেছিল। এটা অগ্রহণযোগ্য দৃষ্টিভঙ্গী।’ (মারক্যুস বুল, ‘অরিজিনস’, জনাথন রাইলি-স্মিথ সম্পাদিত দি অক্সফোর্ড হিস্ট্রি অব দি ক্রুসেড্স, পৃঃ১৯)
আমরা প্রশ্ন করতে পারি, কোন যুক্তিতে বুল স্পেন, সিসিলি এবং আনাতোলিয়ায় একাদশ শতাব্দীতে সংঘটিত আগেকার খ্রীষ্টান-মুসলিম সংঘাতগুলোকে প্রথম ক্রুসেড থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখছেন? এর উত্তর কিছুতেই গ্রহণযোগ্য হবার নয়। তিনি বলেছেন, ‘১০৯৫-৬ সালে পোপ দ্বিতীয় উরবানের ক্রুসেডের আহ্বানকে যে জনগণ সম্প্রদায়গত ব্যবস্থার উপর আঘাত হিসাবে দেখেছিল তা ভাবার জন্য বহু তথ্য-প্রমাণ আছে।এটা কার্যকর হবে বলে মনে করা হয়েছিল, কারণ পূর্ববর্তী প্রচেষ্টাগুলি থেকে এটি ছিল ভিন্ন।’ (প্রাগুক্ত)। অবশ্যই এটা ভিন্ন ছিলঃ পোপ কন্সটান্টিনোপলের উদ্দেশ্যে মার্চ করার জন্য এক বিশাল বাহিনী গঠন করতে ইউরোপের রাজন্যবর্গ ও যাজকদের এক মহাসম্মেলন ডেকেছিলেন। অভিলাষ ও ব্যাপকতার বিচারে এটা ছিল নূতন। কিন্তু এ জন্য স্পেনে এবং সিসিলিতে এবং আনাতোলিয়ায় আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাবলীর সঙ্গে এর যোগসূত্র খারিজ করে দেওয়া হাস্যকর। এ ধরনের বক্তব্য শুধু এমন এক পূর্বধারণা থেকে আসতে পারে যা কোন না কোন ভাবে ক্রুসেডারদেরকে আক্রমণকারী হিসাবে দেখতে চায় এবং সে কারণে খ্রীষ্টানরা ১০৯৫ পূর্ববর্তী দশকগুলোতে স্পেনে এবং গোটা ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল জুড়ে যে ন্যায়সঙ্গত আত্মরক্ষামূলক যুদ্ধ চালিয়ে আসছিল তা থেকে ক্রুসেডরাদেরকে বিচ্ছিন্ন করতে চায়।
আসল তথ্য হচ্ছে, প্রথম ক্রুসেডের পূর্ববর্তী ২০ বছরের মধ্যে গোটা আনাতোলিয়া খ্রীষ্টান বিশ্বের হস্তচ্যুত হয়। এই অঞ্চল ইউরোপের দ্বার- প্রান্তে অবস্থিত এবং আয়তনে ফ্রান্সের চেয়ে বড়। ১০৫০ সালে সেলজুক নেতা তোগরুল বেগ আনাতোলিয়ার খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ শুরু করেন যারা এতদিন পর্যন্ত খলীফাদের ক্ষমতা প্রতিহত করেছিল। আমাদেরকে বলা হয় যে, সেই যুদ্ধে ১লাখ ৩০ হাজার খ্রীষ্টান মারা গিয়েছিল। কিন্তু ১০৬৩ সালে তোগরুল বেগের মৃত্যুর পর খ্রীষ্টানরা তাদের স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করে । অবশ্য এ স্বাধীনতা ছিল স্বল্পস্থায়ী । তোগরুল বেগের ভাইপো আল্প্ আর্স্লান নিজেকে সুলতান ঘোষণা করলে আবার যুদ্ধ শুরু হয়। ১০৬৪ সালে আর্মেনিয়ার প্রাচীন রাজধানী আনি ধ্বংস হয়ে যায়। আর্মেনিয়ার শেষ স্বাধীন শাসক কার্স্-এর যুবরাজ ‘‘তাওরাস পার্বত্য এলাকায় কিছু জমির পরিবর্তে আনন্দের সঙ্গে সম্রাটকে (বাইজেন্টাইন) তার রাজ্য হস্তান্তর করেন। (স্টিভেন রনচিম্যান, দি হিস্ট্রি অফ দি ক্রুসেড্স্; ১ম খণ্ড, কেমব্রিজ, ১৯৫১, পৃঃ ৬১)। এই সময়ে গোটা আর্মেনীয় জাতি শত শত মাইল দক্ষিণ ও পশ্চিমে গিয়ে কার্যকরভাবে বসতি স্থাপন করে।
কিন্তু তুর্কী হামলা চলতে থাকে। ১০৬৫ সাল থেকে এডেসার বিশাল সীমান্ত দুর্গ অবরোধ হয়ে দাঁড়ায় সাংবৎসরিক ঘটনা। ১০৬৬ সালে তারা আমানুস পবর্তমালার গিরিপথ দখল করে নেয়। পরবর্তী বসন্তকালে তারা সিসেরিয়ার কেপাডোসিয়ান নগর লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে ফেলে। পরবর্তী শীতকালে মেলিটেইন এবং সেবাস্তিয়ায় বাইজেন্টাইন বাহিনীর পরাজয় ঘটে। এসব বিজয়ের ফলে আল্প্ আর্স্লান গোটা আর্মেনিয়ার নিয়ন্ত্রণ লাভ করেন। এর এক বছর পর তিনি সাম্রাজের আরো গভীরে আক্রমণ চালান। ১০৬৮ সালে নিওসিসারিয়া ও অ্যামোরিয়াম, ১০৬৯ সালে আইকোনিয়াম এবং ১০৭০ সালে ঈজিয়ান উপকূলবর্তী কোনি আক্রান্ত হয়।(প্রাগুক্ত)।
এসব ঘটনায় অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে যায় যে, তুর্কীরা তখন সাম্রাজ্যের গোটা এশীয় অংশের জন্য হুমকি হয়ে উঠেছিল । কন্সটান্টিনোপলের অবস্থান দিনদিন বিপন্ন হয়ে উঠেছিল। রাজকীয় সরকার পাল্টা ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। সেনাবাহিনীর প্রতি সম্রাট দশম কন্সটেন্টাইনের অবহেলা এই বিপর্যয়ের জন্য বহুলাংশে দায়ী। এ বিপর্যয় গোটা সাম্রাজ্যকে গ্রাস করতে উদ্যত হয়। রাজমাতা ইউডোসিয়ার তত্ত্বাবধানে বালক পুত্র ৭ম মিখাইলকে রেখে তিনি ১০৬৭ সালে মারা যান। পরের বছর ইউডোসিয়া প্রধান সেনাপতি রোমানাস ডাইওজিনেসকে বিয়ে করলে ডাইওজিনেস সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। রোমানাস একজন বীর সৈনিক এবং আন্তরিকভাবে দেশ প্রেমিক ছিলেন। তিনি দেখলেন যে, সেনাবাহিনী পুনর্গঠন এবং চূড়ান্তভাবে আর্মেনিয়া পুনরুদ্ধারের উপর সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা নির্ভর করছে। (প্রাগুক্ত)। সিংহাসনে বসার চার মাসের মধ্যে রোমানাস এক বিশাল কিন্তু অনির্ভরযোগ্য সেনাবাহিনী গড়ে তুলে শত্রুকে মোকাবিলা করতে অগ্রসর হন। গিবন লিখেছেন, ‘তিনটি প্রাণপণ যুদ্ধে তুর্কীদের ইউফ্রেটিসের অপর তীরে হটিয়ে দেওয়া হয়। চতুর্থ এবং শেষ যুদ্ধে রোমানাস আর্মেনিয়া পুনরুদ্ধার করতে চেয়েছিলেন।’’ (ডিক্লাইন এন্ড ফল, অধ্যায়ঃ ৫৭)। এখানে অবশ্য মানযিকার্টের যুদ্ধে (১০৭১) তিনি পরাজিত ও বন্দী হন। এভাবে সমগ্র আনাতোলিয়া চিরকালের জন্য হস্তচ্যুত হয়।
এই ঘটনাবলী সততার সঙ্গে পর্যালোচনা করলে কোন রকম সন্দেহ থাকে না যে, আক্রমণকারী ছিল আল্প্ আর্সলান এবং তার তুর্কী বাহিনী। রোমানাস ডাইওজিনেসের আর্মেনিয়া অভিযান ছিল গোটা আনাতোলিয়া হারানো প্রতিহত করতে বাইজেনটাইনদের সর্বশেষ পাল্টা আক্রমণ। যদিও সদ্য প্রকাশিত চেম্বার্স ডিকশনারী অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রিতে যুদ্ধটির বর্ণনা এভাবে দেওয়া হয়েছেঃ বাইযেনটাইন সম্রাট চতুর্থ রোমানাস ডাইওজিনেস (১০৬৮- ৭১) তার সাম্রাজ্য আর্মেনিয়া পর্যন্ত প্রসারিত করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ভান হ্রদের কাছে মানযিকার্টের যুদ্ধে আল্প্ আর্স্লানের অধীন (১০৬৩- ৭২) সেলজুক তুর্কীদের হাতে পরাজিত হন, যিনি তখন আনাতোলিয়ায় পূর্ণাঙ্গ অভিযান চালান।’’ (ব্রুস লেনম্যান সম্পাদিত চেম্বার্স ডিকশনারি অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি, লন্ডন, ২০০০, পৃঃ ৫৮৫)।
উপরে আমরা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে ভুল তথ্য সমাবেশের এক নিপুণ দৃষ্টান্ত দেখলাম। সেখানে আক্রান্তকে আক্রমণকারী এবং আক্রমণকারীকে আক্রান্ত হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে।
এক বছর পর আল্প্ আর্স্লান নিহত হন। তার ছেলে মালেক শাহ (১০৭৪-১০৮৪) এশিয়া মাইনর এবং কার্যত বাইযেনটাইনের অবশিষ্ট এশীয় ভূখণ্ডের সবটুকু দখলের কাজ সম্পূর্ণ করেন। এ সমস্ত বিজয়ের ফলে মার্মারা সাগরের দক্ষিণ তীরের নিসিয়া দুর্গ তুর্কীদের দখলে চলে যায় এবং কন্সটান্টিনোপলের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে।
তখনকার এ সমস্ত প্রধান রাজনৈতিক ঘটনা প্রথম ক্রসেডের সূচনা ঘটায়। ৩৫ বছর সময়ের মধ্যে তুর্কীরা খ্রীষ্টান এলাকার এক বিশাল অংশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ফেলেছিল, যার আয়তন ছিল ফ্রান্সের চেয়ে বড়। তুর্কীরা তখন ইউরোপের একেবারে দরজার কাছে পৌঁছে গিয়েছিল। আমরা এটা ভাবতে অভ্যস্ত যে, ক্রুসেড ছিল প্রথমত এবং প্রধানত পবিত্রভূমি ও জেরুজালেম পুনরুদ্ধারের জন্য খ্রীষ্টানদের প্রচেষ্টা; কিন্তু এটা ভুল। তখন সম্রাট আলেক্সিয়াস কম্নেনাস পোপের কাছে তার বিখ্যাত আবেদন জানিয়েছিলেন। এ আবেদন জেরুজালেম মুক্ত করার জন্য ছিল না, বরং ছিল তার সাম্রাজ্যের দরজা থেকে তুর্কীদের বিতাড়িত করার জন্য, সাম্প্রতিক সময়ে অর্ধচন্দ্রের অনুসারীদের দ্বারা বিধ্বস্ত ও দখলকৃত এশিয়া মাইনরের বিশাল খ্রীষ্টান এলাকা মুক্ত করার জন্য। এ কথা সত্য যে, তুর্কীরা তখন সিরিয়া/প্যালেস্টাইনের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সেখানে এক বর্বর রাজত্ব কায়েম করেছিল। এতে খ্রীষ্টান তীর্থ যাত্রী ও সে অঞ্চলের স্থানীয় খ্রীষ্টানরা অবর্ণনীয় দুর্ভোগের সম্মুখীন হচ্ছিল। পিটার দি হারমিট এবং অন্যরা এর যে বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন তা সাধারণ ইউরোপীয়দের মধ্যে ক্রুসেডীয় আন্দোলনের পক্ষে জোরালো আবেগময় উপাদান যুগিয়েছিল। তবে অন্তত গোড়ার দিকে তীর্থযাত্রীদের স্বস্তি দেওয়া ক্রুসেডারদের মূল লক্ষ্য ছিল না। যাইহোক, প্যালেস্টাইনে তুর্কী শাসনের ববর্র ধরন ছিল তাদের দখলকৃত গোটা খ্রীষ্টান অঞ্চলে তাদের আচরণের অনুরূপ। গিবন গোটা নিকট প্রাচ্যে তাদের শাসনের চরিত্র বিস্তারিত তুলে ধরেছেন এভাবেঃ
‘প্রাচ্যদেশীয় খ্রীষ্টানগণ এবং লাতিন তীর্থ যাত্রীরা বিলাপ করার দশায় পতিত হয়। আগে নিয়মিত সরকারের আমলে খলীফাদের সঙ্গে যে সমঝোতা ছিল তার ব্যত্যয় ঘটিয়ে উত্তরের বহিরাগতরা তাদের উপর নির্মম অত্যাচারের স্রোত বইয়ে দেয়। মহান সুলতান তার দরবারে এবং শিবিরে পারস্যের শিল্পকর্ম ও ভব্যতা কিছুটা হলেও গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু তুর্কী জাতির, বিশেষ করে পশুচারী উপজাতিগুলোর শরীর থেকে তখনও মরুভূমির অগ্নিময় নিঃশ্বাস বের হচ্ছিল। নিসিয়া থেকে জেরুজালেম পর্যন্ত এশিয়ার পশ্চিম প্রান্তের দেশগুলো বিজাতীয় ও স্থানীয় শত্রুতার শিকার হয়। অনিশ্চিত সীমান্ত বিপজ্জনকভাবে নিয়ন্ত্রণকারী প্যালেস্টাইনের মেষ-পালকগণ বাণিজ্যিক ও ধর্মীয় স্বাধীনতার মধ্যে ধীরগতিতে মুনাফা অর্জন করার মত অতটা ধৈর্যশীল ছিল না। তাদের তেমন অবসর বা ক্ষমতা ছিল না। অশেষ দুর্ভোগ পার হয়ে যে তীর্থ যাত্রীরা জেরুজালেমের প্রধান ফটক পর্যন্ত পৌঁছাতে পারত, তারা পবিত্র সমাধিতে শ্রদ্ধা জানানোর অনুমতি লাভের আগেই ব্যক্তিগত লুণ্ঠন অথবা সরকারী নির্যাতনের শিকার হত, প্রায়ই তারা অনাহারে এবং রোগ-ব্যাধিতে ভুগত। নিজস্ব ববর্রতার এক ধরনের উন্মাদনা দ্বারা তুর্কীরা প্রত্যেক গোষ্ঠীর যাজকদের অপমান করতে উদ্বুদ্ধ হত। গোষ্ঠীর লোকজনের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য তাদের যাজককে চুল ধরে টেনে নিয়ে গিয়ে ভূগর্ভস্থ অন্ধকার কারাকক্ষে আটক রাখা হত; এবং চার্চ অব দি রিসারেকশনে ঐশ প্রার্থনা প্রায়শই বাধাগ্রস্ত হত দখলদার প্রভুদের গুণ্ডামীর কারণে।’ (অধ্যায়ঃ ৫৭)
ইউরোপের সাধারণ কৃষকরা হয়ত প্রাচ্যের বিপদ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন ছিল না। কিন্তু শাসক শ্রেণীর এবং চার্চের পক্ষে উদ্বিগ্ন হওয়া ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। তারপরও ইউরোপের তৎকালীন কৃষক ও কারিগর শ্রেণী যদি আনাতোলিয়া সম্পর্কে সামান্য জেনে থাকে তবে মুসলিম হুমকি সম্পর্কে তাদের কিছুটা ধারণা থাকার কথা। মারকুস বুল তারা কিছুই জানত না বলে যে মন্তব্য করেছেন সেটা গ্রহণযোগ্য নয়। দশম শতাব্দীর শেষ দিকে উত্তর স্পেনে তৃতীয় আব্দুর রহমান এবং আল-মনসুরের অগ্রাভিযানের ফলে দক্ষিণ ফ্রান্সে বন্যার মত খ্রীষ্টান শরণার্থীরা আসতে থাকে। একাদশ শতাব্দীতেও দক্ষিণ ফ্রান্সে অব্যাহত থাকা মুসলিম হামলার কারণে শরণার্থীরা মধ্য ও উত্তর ফ্রান্সে পালিয়ে আসে। এই লোকগুলো পশ্চিম ইউরোপের বিপদ সম্পর্কে সতর্কবার্তা ছড়িয়ে দেয়। নিশ্চিতভাবে বলা যায়, ইসলাম এবং মুসলমানরা আসলে কী বিশ্বাস করে সে সম্পর্কে ইউরোপীয় কৃষক ও শ্রমিক শ্রেণীর সঠিক কোন ধারণা ছিল না। কিন্তু সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়। তারা ভাল করে জানত যে মুসলমানরা খ্রীষ্টানদের শত্রু। তারা এও জানত যে মুসলমানরা অমুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শরু করেছে এবং নারী ও শিশুদের দাস বানাচ্ছে। মুসলমানরা সমগ্র স্পেন দখল করে নিয়েছে এবং ফ্রান্সের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছে।
এ বিষয়টির উপর বারবার জোর দেওয়া উচিত। বাস্তবতা হচ্ছে, শান্তি ও সহাবস্থান থেকে অনেক দূরে সরে গিয়ে দশম শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ইসলাম আবরো আগ্রাসী হয়ে উঠে। মুসলিম বাহিনী রাজ্য দখলের জন্য অবিশ্বাসীদের বিরুদ্ধে ইসলামী জাহানের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত যুদ্ধ শুরু করে। পশ্চিমে স্পেন এবং পূর্বে ভারত আক্রান্ত হয়। এই নূতন আগ্রাসন শুধু পূর্বের ও পশ্চিমের সীমান্তে সীমিত ছিল না, ইসলামের গোটা সীমান্ত জুড়ে তা ছড়িয়ে পড়ে। আর্মেনিয়া, জর্জিয়া ও বাইজেন্টিয়ামের খ্রীষ্টান রাজত্ব নিশ্চিহ্ন হওয়ার উপক্রম হয়। সিসিলি এবং অন্যান্য ভূ-মধ্যসাগরীয় এলাকায় মুসলিম বাহিনী খ্রীষ্টানদের বিরুদ্ধে লড়াই বাধায়। এই নূতন ইসলামী আগ্রাসনের অনেক দিক, বিশেষ করে একাদশ শতাব্দীর শুরুতে স্পেন ও ভারতে যা ঘটেছিল, আগেকার অষ্টম শতাব্দীর ইসলামী সম্প্রসারণের কথা মনে করিয়ে দেয়। এগুলো এমনই অনুরূপ ছিল যে, এমনকি ইসলাম সম্পর্কে অসতর্ক পর্যবেক্ষকরা এ ধর্মের আবির্ভাব কাল নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভুগতে পারেন। তারা মনে করতে পারেন যে, ইসলামের জন্ম তারিখ ভুল করে কয়েক শতাব্দী পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল। দৃষ্টান্তস্বরূপ, আমাদের বলা হয় যে, ভারতে মূল ইসলামী আগ্রাসন শুরু হয় তুর্কী-ভাষী আফগান শাহজাদা গযনীর মাহ্মুদের বিজয় অভিযানের মধ্য দিয়ে। তিনি উত্তর ভারতে ১৭ বার আক্রমণ চালান। এসব হামলা ১০০১ সালে শুরু হয় এবং তার মৃত্যুর মাত্র ৪ বছর বা এই রকম সময় আগে ১০২৬ সালে শেষ হয়। আমাদের মনে রাখতে হবে, এসব হামলায় ভারতে জানমালের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছিল। ১০২০ সাল নাগাদ সিন্ধু উপত্যকা, আফগানিস্তান ও পারস্যের অধিকাংশ এলাকা মাহমুদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। একাদশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে সংঘটিত এসব হামলার মধ্যে তিন শতাব্দী আগে মুহাম্মদ বিন কাসিমের পরিচালিত আগ্রাসনের প্রায় হুবহু প্রতিফলন দেখা যায়। কাসিম প্রায় একই অঞ্চল নিয়ে এক ইসলামী সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন (৭১০ খ্রীষ্টাব্দ নাগাদ)।
এটা অদ্ভূত যে, গযনীর মাহ্মুদ এবং তার পূর্বসূরীর নামের মধ্যে মিল রয়েছে। গযনীর ‘ন’ কাসিম থেকে এটাকে পৃথক করেছে। ‘ন’ না থেকে ‘ম’ থাকলে গযনীকে কাসমিও লেখা যেত। গজনী আর কাসমি খুব পৃথক নয়।
ইসলামী জাহানের পশ্চিম প্রান্তে আমরা একই লক্ষণ দেখতে পাই। রুনচিমান লিখেছেন, ‘দশম শতাব্দীতে স্পেনের মুসলমানরা খ্রীষ্টান জগতের জন্য প্রকৃত হুমকি হয়ে উঠে।’ তৃতীয় আব্দুর রহমানের মধ্যে মুহাম্মদের অনুসারীরা এমন এক নেতা পেয়ে যায় যিনি অষ্টম শতাব্দীর সাফল্যের পুনরাবৃত্তি ঘটানোর অঙ্গীকার করেছিলেন। কর্ডোভা খিলাফতের প্রতিষ্টাতা হিসাবে তিনি জাঁকজমক ও সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে এক নূতন যুগের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তার বাহিনী যুদ্ধ করে খ্রীষ্টানদের উত্তরে হাটিয়ে দিয়েছিল। তিনি যেসব যুদ্ধ করেছিলেন সেগুলো দ্বারা দুই ধর্মবিশ্বাসীদের সীমান্ত চিহ্নিত হয়েছিল। সবচেয়ে ভয়ঙ্কর যুদ্ধ হয় ডুউরো নদীর তীরে সালামানকা ও ভল্লাদলিদের মাঝখানে সিমানকাসে (৯৩৯ খ্রীঃ)। ভয়ঙ্কর এই যুদ্ধে তাকে থামিয়ে দেওয়া হয়। এসব এলাকা দু’শতাব্দী আগে মুসলমানরা দখল করে নিয়েছিল। পরে অবশ্য খ্রীষ্টানরা সেগুলো পুনরুদ্ধার করে। অনেক ক্ষেত্রে তৃতীয় আবদুর রহমান ছিলেন তার পূর্বসূরীর অনুরূপ। এমনকি অষ্টম শতাব্দীর মুসলিম বিজেতা প্রথম আবদুর রহমানের সঙ্গে তার নামের মিল রয়েছে। এই নূতন আগ্রাসন আল-মনসুরের (৯৮০-১০০২ খ্রীঃ) অধীনে অব্যাহত থাকে। তার আমলে মুসলিম শক্তি উত্তরাঞ্চলসহ গোটা স্পেন দখল করে নেয়। তিনি লিওন, বার্সিলোনা ও সান্তিয়াগো ডি কম্পোসটেলা জ্বালিয়ে দেন এবং তার প্রায় তিন শতাব্দী আগেকার মুসলমান পূর্বসূরীদের মত পিরেনীসের উপর অভিযান পরিচালনা করেন। আমাদের বলা হয়, আল-মনসুরের আমলের মত ‘এতটা বিপর্যয়ে খ্রীষ্টানরা আগে কখনও পড়ে নাই।’ ( লুইস বার্ট্রান্ড, দি হিস্ট্রি অফ স্পেন, ২য় সংস্করণ, লন্ডন, ১৯৪৫, পৃঃ ৫৭)।
আল-মনসুরের আক্রমণই শেষ পযর্ন্ত খ্রীষ্টান ইউরোপের জাগরণ ঘটায়। তারা রিকনকুইসতা অভিযান শুরু করে। নাভারের তৃতীয় সানশো এবং নরমান ব্যারন রজার ডি টনি ১০২০ সাল থেকে এর নেতৃত্ব দেন। এসব ঘটনা ৭১৮ সাল নাগাদ কভাডোঙ্গায় ডন পেলাইয়োর বিজয়ের মধ্য দিয়ে পূর্বকালে সূচিত রিকনকুইসতার কথা মনে করিয়ে দেয়।
পাঠকরা অবাক হয়ে ভাবতে পারেন, একাদশ শতাব্দীতে ইসলামী আগ্রাসনের এই ‘পুনরুজ্জীবনের’ সঙ্গে সপ্তম ও অষ্টম শতাব্দীর ইসলামী অভিযানসমূহের এমন হুবহু মিল কেন? এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা করা যাবে। এখন যে বিষয়ের উপর জোর দেওয়া প্রয়োজন সেটা হচ্ছে, প্রচলিত বিশ্বাসের বিপরীতে দশম ও একাদশ শতাব্দী ছিল ইসলামের ব্যাপক সম্প্রসারণের কাল। খ্রীষ্টান বিশ্ব সংলগ্ন ইসলামী সীমান্তের সর্বত্র এই সম্প্রসারণ অনুভূত হচ্ছিল। এটা সুস্পষ্ট যে, ক্রুসেড ছিল এই আগ্রাসন থামানোর চেষ্টার এক অংশ।
(নিবন্ধটি John J. O’Neill-এর The Crusades: A Response to Islamic Aggression-এর বাংলা অনুবাদ। মূল ইংরাজী নিবন্ধটি ইসলাম ওয়াচে [ www.islam-watch.org] ১৯ ফেব্রুয়ারী ২০১০-এ প্রকাশিত হয়। লেখক Holy Warriors: Islam and the Demise of Classical Civilization নামক গ্রন্থের প্রণেতা। -- বঙ্গরাষ্ট্র)