লিখেছেনঃ সুষুপ্ত পাঠক, আপডেটঃ July 30, 2019, 12:00 AM, Hits: 4304
১৯৫২ সালের ‘ভাষা সৈনিকরা’ বাংলা ভাষার ‘জনক’ বিদ্যাসাগরের নামটি কখনো উচ্চরণ করেনি। যে কারণে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা তাদের ইতিহাস শুরু করেছে বিদ্যাসাগরকে বাদ দিয়ে। বাংলা ভাষাটা গড়ে উঠেছিলো যার হাত ধরে সেই বিদ্যাসাগর না থাকলে কি ৫২-র একুশে ফেব্রুয়ারি কখনো আসত? বাংলা ভাষার প্রতি গভীর মমত্ব থেকে বিদ্যাসাগর ভাষাটিকে গড়ে তুলেছিলেন। পক্ষান্তরে পূর্ববঙ্গের মুসলমানরা ভাষা আন্দোলন করেছিলো চাকরি হারানোর ভয় থেকে। বিষয়টি স্বীকার করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশে ‘মুসলমান বাঙালী’ জাতীয়তাবাদের অন্যতম প্রচারক আহমদ ছফা স্বয়ং।
গতকাল ২৯ জুলাই ছিলো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যুবার্ষিকী। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলেমেয়েরাও বিশেষ কিছু জানে না। কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি তারা মনে করে বিদ্যাসাগর হিন্দু ধর্মের একজন পণ্ডিত ছিলেন। মাথায় টিকি রাখতেন আর খড়ম পরতেন…। বিদ্যাসাগর সম্পর্কে এরকম ধারণা তৈরি হতে পরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশে কাজ করা হয়েছিলো। ১৯৪৭ সালে মুসলমানদের জন্য পৃথক দেশ পাকিস্তান সমর্থন করার সময় থেকে বাঙালী মুসলমান নিজেদের বাঙালী উত্তরাধিকার মুছে ফেলতে সচেষ্ট হতে থাকে। পাকিস্তান আমলে বিদ্যাসাগরকে অস্বীকার করার প্রবণতা বহু পরিমাণে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বেড়ে যাবার মূলে ছিলো আহমদ ছফাদের তৎপরতায়। ছফার পশ্চিমবঙ্গ বিরোধিতা ডানপন্থী জাতীয়তাবাদকে উৎসাহিত করেছিলো। বাংলাদেশের গবেষক মোহম্মদ আবদুল হাই মিজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকায় লিখেছিলেন, “পাকিস্তান আমলে শাসকগোষ্ঠী বিদ্যাসাগরকে চিহ্ণিত করেছিল ‘ব্রিটিশপোষ্য’ বাংলা ভাষাকে ‘সংস্কৃতায়ন’ করার প্রধান পুরোধা হিসাবে। …স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বিদ্যাসাগর আমাদের আলোচনা-সমালোচনায় নতুন কোনো মাত্রালাভ করেননি।লেখক গবেষক শিক্ষার্থিদেরও বিদ্যাসগরকে নিয়ে তেমন উৎসাহ নেই। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় সমূহে বিগত ছাব্বিশ বছরে এম-ফিল পি-এইচডি পর্যায়ে যতোগুলি গবেষণামূলক কাজ হয়েছে তাতে বিদ্যাসাগর স্হান লাভ করেননি। ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র, সাহিত্য সংকলন, দৈনিক পত্রিকার সাহিত্য সাময়িকী ইত্যাদি কাঙ্খিত ক্ষেত্রে বিদ্যাসাগরকে নিয়ে আলোচনা খুব একটা চোখে পড়ে না’। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯১ সালে বিদ্যাসাগরের মৃত্যু শতবার্ষিকীতে হায়াৎ মামুদ আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘কি দুঃখ, কি লজ্জা যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মৃত্যু শতবার্ষিকীর দিনটি প্রায় অলক্ষ্যে এসে চলে গেল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গসাহিত্যের অধ্যাপক কেন্দ্রিক একটি সারস্বত গোষ্ঠীর ঘরোয়া আলোচনাসভা এবং একটি দৈনিক ‘সংবাদ’-এর মেয়েদের পাতায় ও ড. আনিসুজ্জমানের একটি রচনাতে ছাড়া তাঁকে আর কেউ আর কোথাও স্মরণ করেছেন বলে আমার জানা নেই ।”
১৮৫৫ সালে বিদ্যাসাগরের ‘বর্ণপরিচয়’ দিয়ে বাংলা ভাষা চর্চা হিন্দু মুসলমান উভয়ে শুরু করলেও বাঙালী মুসলমান বিদ্যাসাগরকে সচেতন প্রচেষ্টার মাধ্যমে বাদ দিতে চেয়েছে। এই প্রচেষ্টা দুইভাবে ঘটেছে। ইসলামিক ফান্ডামেন্টালিস্টদের ভয়-ভীতি প্রদর্শন, অন্যটি ঘটেছে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের হাত ধরে। পাকিস্তান আমলে ফরুখ আহমদ, কায়কোবাদ, গোলাম মোস্তফাদের মত প্রভাবশালী কবি-সাহিত্যিকদের বাধায় রবীন্দ্রনাথ-বিদ্যাসাগরকে বাদ দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হবার পর আহমদ ছফার ভারত বিরোধিতা পক্ষান্তরে পাকিস্তান আমলের এন্টি বিদ্যাসাগর মুভমেন্টকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলো। ছফা বলেছিলেন, রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে তিনি প্রশ্ন করতেন কেন তিনি মুসলিম সমাজ নিয়ে কিছু লিখেননি। এ ধরণের প্রশ্ন করে আসলে রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক ও মুসলিমদের প্রতি অবজ্ঞা প্রমাণ করতে চাওয়া হয়েছিলো। ছফার শিষ্য সলিমুল্লাহ খান সেই কাজটা করেছেন একদম রাখঢাক ছাড়াই। রবীন্দ্রনাথকে সাম্প্রদায়িক, বাংলা সাহিত্যের যা মূলত পশ্চিমবঙ্গের লেখকদের লেখা ৯৫ ভাগ সাহিত্যকে তিনি হিন্দুয়ানী (সাম্প্রদায়িক) বলে চিহ্নিত করেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে কেন্দ্র করে বাঙালীর অভিন্ন উৎস ও ঐতিহ্য দৃঢ় করা যেখানে প্রয়োজনীয় ছিলো সেখানে ছফার ভারত বিরোধিতার নামে পাকিস্তান আমলের মত বিভাজনকে আরো দৃঢ় করেছিলো। পাকিস্তানের শাসকরা চেয়েছিলো দুই বাংলার বাঙালীরা যেন ভাষা ও সাহিত্যের উত্তোরাধিকার সূত্রে নিজেদের মধ্যে ঐক্য অনুভব না করে। বরং ধর্মের প্রভাবে যেন পাঞ্জাবী-পাঠানদের ইতিহাস ঐতিহ্যকেই যেন গ্রহণ করতে পারে। ষাটের দশকের সংস্কৃতিকর্মীরা ও লেখকরা পাকিস্তানীদের সেই চক্রান্ত উচ্ছেদ করে রবীন্দ্র জয়ন্তী উৎযাপন করেছিলো। রবীন্দ্র সংগীত চর্চা, ছেলেমেয়েদের নাম বাংলায় রাখা, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিকদের সঙ্গে পত্র পত্রিকার মাধ্যমে যোগাযোগ বৃদ্ধির চেষ্টার মাধ্যমে ধর্ম ভিত্তিক পাকিস্তানের দ্বিজাতি তত্ত্ব থেকে বেরিয়ে প্রগতিশীল বাঙালী জাতিসত্তার যে প্রচেষ্টা ছিলো ছফার মুসলিম বাঙালী জাতীয়তাবাদ তাকে দুর্বল করে যা পরবর্তীকালে ডানপন্থীদের সুযোগ করে দিয়েছিলো।
বিদ্যাসাগরের বিরুদ্ধে বামপন্থীদের প্রচেষ্টা চোখে পড়ার মত। বদরুদ্দিন উমার বিদ্যাসাগরকে কোলকাতা কেন্দ্রিক হিন্দু উচ্চবর্ণের সংস্কার হিসেবে চিহ্নত করে বলেন, কেন তিনি মুসলিম সমাজ নিয়ে কাজ করেননি। কবি মলয় রায়চৌধুরী এরকম প্রচেষ্টাকে জবাব দিয়েছেন তার প্রবন্ধে এভাবে, ‘আমি মুসলমান পাড়ায় বসবাস করে, মুসলমান প্রতিবেশির বাড়িতে অহরহ যাওয়া-আসার মাধ্যমে যে জীবনধারা সম্পূর্ণ জানতে পারিনি, তা কেমন করেই বা ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর জানবেন, যিনি মুসলমানদের সমাজে বসবাস করেননি, কেবল বীরসিংহ গ্রামের মুসলমান চাষিদের দেখে থাকবেন। পাঁচ বছর বয়সে তিনি পাঠশালায় ভর্তি হন, এবং আমি নিশ্চিত যে তাঁর কোনো মুসলমান সহপাঠী ছিল না। তাঁর সময়ে কলকাতায় যে বৈভবশালী মুসলমানরা থাকতেন তাঁরা প্রায় সকলেই উর্দুভাষী’ (মলয় রায়চৌধুরীর প্রবন্ধ, ঈশ্বরচন্দ্রের পাকিস্তানিফিকেশন, প্রকাশকাল এপ্রিল ২৯, ২০১৮) ।
এরকম যুক্তি তো বেগম রোকেয়া প্রসঙ্গে বলা চলে কেন তিনি কেবল মুসলিম নারীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেছিলেন? তখনো তো পূর্ববঙ্গের হিন্দু নারীরা কঠিন শাস্ত্রীয় শাসনে নির্যাতিত হচ্ছিল। ছফা নিজে হিন্দু সমাজ নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন? কেউ কখনো জিজ্ঞেস করে কেন হুমায়ূন আহমদ হিন্দু সমাজ নিয়ে উপন্যাস লিখেনি? তাহলে কেন রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে নিয়ে এরকম প্রশ্ন উঠে?
কারণটা যে সাম্প্রদায়িক তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই সাম্প্রদায়িকতা কেবল ইসলামপন্থিরা করেছে বললে অর্ধসত্য বলা হবে। এই সাম্প্রদায়িকতা রচিত হয়েছিলো প্রগতিশীল বলে দাবীদারদের হাত ধরেও। এর বাইরে যারা বাংলাদেশে কিছু করতে গিয়েছিলেন তাদের কপালে জুটেছিলো ‘ভারতের দালাল’ আখ্যা। আশির দশকে বাংলাদেশে ‘বিদ্যাসাগর সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ নামের একটি সংগঠন থাকার কথা জানাচ্ছেন মলয় রায়চৌধুরী। এই সংগঠনের লোকজনকে ‘হিন্দুদের দালাল’ ‘ভারতের দালাল’ বলে ছত্রভঙ্গ করে দেয়া হয়েছিলো। জানা যায় ফোনে বিদ্যাসাগর সোসাইটির লোকজনদের হুমকি দিতো কোন ইসলামিক গ্রুপ বা এরকম কেউ। একই সঙ্গে মনে রাখতে হবে বাত্য রাইসু, সাজ্জাদ শরীফদের মত গোষ্ঠি তখনই বাংলাদেশে শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যারা রবীন্দ্রনাথ, সত্যজিৎ, ঋত্বিকদের সঙ্গে এখানকার বাংলা ভাষীদের অভিন্ন ঐক্য ও ঐতিহ্যকে অস্বীকার করে মুসলিম বাংলা বাঙালী প্রজেক্ট খাড়া করেছে। এই প্রজেক্ট পাকিস্তান আমলে আবুল ফজলদের হাতে প্রতিষ্ঠা হলেও ষাটের দশকে মার খেয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হবার পর ছফার হাত ধরে রাইস-সলিমুল্লাহ খানদের হাতে আবার বেগ পেতে থাকে। যে কারণে বিদ্যাসাগর বাংলাদেশে বিস্মৃত এক নাম! বাংলাভাষা যার হাতে গড়ে উঠেছিলো তাকে বাদ দিয়ে এদেশে ইতিহাস লেখা হয়েছে…।
গ্রীসের সক্রেটিস, এরিস্টটলদের নাম সারা বিশ্ব জানলেও বাংলার বিদ্যাসাগরকে সারা বিশ্বের কাছে পৌঁছাতে দেয়নি স্বয়ং বাঙালীরাই। তিনি এই অঞ্চলের রেঁনেসার জনক। বাঙালী বামপন্থিরা তাকে বুর্জোয়া বলে বাতিল করে দিয়েছে। তার মূর্তি ভেঙ্গে তারা খতমের বিপ্লব সফল করতে চেয়েছে। মুসলমানরা তাকে ‘হিন্দু’ পরিচয়ে পরিত্যাগ করেছে। মলয় রায়চৌধুরী লিখেছেন, ‘বিদ্যাসাগরের হিন্দুত্ব নিয়েও আক্রমণাত্মক লেখালিখি নজরে পড়ে বাংলাদেশের কোনো-কোনো সাইটে, এমনকি কম বয়সে তাঁর টাক পড়ে যাওয়া সত্বেও তাঁরা দাবি করেন যে বিদ্যাসাগর টিকি রাখতেন’।
বামপন্থী এবং মুসলমানরা মিলিতভাবে বিদ্যাসাগরকে সক্রেটিসের মত এদেশে মডেল হতে দেয়নি। বিদ্যাসাগর রেনেসাঁর প্রতীক। চে গুয়েভারা নয়, বদ্ধ দুয়ার ভাঙ্গার সবচেয়ে কাছের উদাহরণ বিদ্যাসাগর যার ছবি টিশার্টে স্থান পায়নি। বিদ্যাসাগরের মত মুক্তচিন্তক, ধর্মহীন, প্রগতিশীল অথচ দেশীয় সংস্কৃতি সম্পর্কে সজাগ একজন ব্যক্তিত্বই তো আজকের তরুণদের আদর্শ হতে পারে। বিদ্যাসাগর হিন্দু ধর্মের বিধবা বিবাহ রদ করার জন্য তাকে হিন্দু ধর্ম সংস্কারক বলাটা মিথ্যে নয়, কিন্তু তার কাজের ব্যাপ্তি এখানেই চিহ্নিত নয়। সমাজ পরিবর্তনের আশায় তিনি বসে থাকেননি। সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের বিশ্বাসকে সম্মান করার কথা তিনি বলেননি। তিনি তার সময়ের চেয়ে অগ্রবর্তী হয়ে বিরুদ্ধ স্রোতের বিরুদ্ধে লড়েছিলেন। এমন একজন বীর কোন জাতি সম্প্রদায়ে সীমাবদ্ধ থাকেন না। তিনি সবার। বিশেষত বাংলাদেশ তাকে পরিত্যাগ করে তার অধ:পতন কোন কিছুতে এড়াতে পারবে না।
সংগৃহীত : pathoksusupto.wordpress.com