Banner
ট্রাম্প-প্রিয়া কথোপকথন এবং সংখ্যালঘু বিলুপ্তির কিছু উপাত্ত — জাহান শ. তিমির

লিখেছেনঃ জাহান শ. তিমির, আপডেটঃ July 22, 2019, 12:00 AM, Hits: 2842

 

 

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক প্রিয়া সাহার ভিডিও কথোপকথন শুনলাম, ন্যূনতম ইংরেজি জ্ঞান নিয়ে যা বুঝলাম তাতে করে মনে হলো প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল করা ছিল উদ্দেশ্যমূলক।

কয়েক মিনিটে বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে প্রিয়া সাহার বক্তব্যকে যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতা মনে করছেন আর তাঁর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করার খায়েশ রাখছেন, তারা বুঝিয়ে দিচ্ছেন সংখ্যালঘুদের জন্যে কতটা বিপদজনক ও নিরাপত্তাহীন পরিবেশ আজ দেশে বিরাজমান।

মার্কিন প্রেসিডেন্টের সাথে বিভিন্ন দেশের সংখ্যালঘুদের সঙ্গে একজন একটিভিস্ট হিসাবে প্রিয়া সাহাও কথা বলার সুযোগ পান, তিনি তাঁর দেশের, এমনকি সংখ্যালঘু নিপীড়নে বিগত বা বর্তমান কোনো সরকারের বিপক্ষে কিছুই বলেননি।

তিনি ৩৭ মিলিয়ন সংখ্যালঘু উবে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন, তিনি সময় কাল ধরেও বলেননি ৩৭ লক্ষ মানুষ উবে যাওয়ার কথা এবং বাংলাদেশে বসবাসরত ১৮ মিলিয়ন সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা নিশ্চিত সমেত নিজ দেশে বসবাস করতে চেয়েছেন, বিচারহীনতার কথা, ব্যর্থতার কথা তুলে ধরেছেন।

আমরা প্রায়শঃই দেখেছি, দেখি, মার্কিনি বা বিদেশিদের কাছে দেশের বিরুদ্ধে অসত্য অভিযোগ ও নালিশ রেখে গেছেন বা যান ডক্টর ইউনুছ, খালেদা জিয়া সহ আরো অনেকে, এমনকি লিখিতভাৱেও অনেককে এসব করতে দেখেছি, তাদের বিরুদ্ধে সেসব নিয়ে কোনো তদন্ত /মামলা হয়েছে কি?

প্রিয়া সাহা ভিটেবাড়ি ছাড়া হয়েছেন আরো অসংখ্যের মতো। ৩৭ মিলিয়ন সংখ্যালঘু উবে গেছে, গেছেই তো, স্বীকার করতে লজ্জা লাগলে তো চলবে না ! চলেন আবার একটু বিশদে যাই।

বাংলাদেশে ১৯৪১ সালে হিন্দু জনসংখ্যা ছিল শতকরা ২৮ ভাগ। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের অব্যবহিত পরে তা শতকরা ২২ ভাগে এসে দাঁড়ায়। এরপর থেকেই সংখ্যালঘুদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার এবং নিপীড়নের ধারাবাহিকতায় দেশটিতে ক্রমশ হিন্দুদের সংখ্যা কমতে থাকে। ১৯৬১ সালে ১৮.৫%, ১৯৭৪ সালে কমে দাঁড়ায় ১৩.৫%, ১৯৮১ সালে ১২.১%, এবং ১৯৯১ সালে ১০%-এ এসে দাঁড়ায়। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে হিন্দুদের শতকরা হার কমে ৮ ভগের নিচে নেমে এসেছে বলে অনুমিত হয়। ২০১১ সালে পরিচালিত জরিপ বলছে, ২০০১ সাল থেকে ২০১১ সালের মধ্যে প্রায় ১০ লাখ হিন্দু বাংলাদেশ ত্যাগ করেছে।

১৯৬৪ সাল থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ৫ দশকে মোট ১ কোটি ১৩ লাখ হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। অর্থাৎ প্রতি বছর গড়ে ২ লাখ ৩০ হাজার ৬১২ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ নিরুদ্দিষ্ট বা দেশত্যাগে বাধ্য হয়েছেন। আর প্রতিদিন দেশ ছেড়েছেন গড়ে ৬৩২জন ।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাতের ‘বাংলাদেশে কৃষি-ভূমি-জলা সংস্কারের রাজনৈতিক অর্থনীতি’ শীর্ষক এক গবেষণায় এই তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটিতে উল্লেখ করা হয়েছে, এই নিরুদ্দেশ প্রক্রিয়ার প্রবণতা বজায় থাকলে আগামী দু’তিন দশক পরে এদেশে হিন্দু ধর্মাবলম্বী কোনো মানুষ আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। অর্থনীতিবিদ আবুল বারকাত বলেন, ‘হিন্দুদের প্রায় ২৬ লাখ একর জমি জবরদখলে রয়েছে। অর্পিত সম্পত্তির আইনের জেরে প্রতিদিন গড়ে ৬৩০ জন হিন্দু বাংলাদেশ ছাড়ছেন।’

যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক আন্তর্জাতিক কমিশনের (ইউএসসিআইআরএফ) ২০১৭ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, বাংলাদেশে অবৈধ ভূমি অধিগ্রহণের বিষয়টি সাধারণভাবে ভূমি দখল হিসেবে পরিচিত। এসব ক্ষেত্রে মালিকানাজনিত ব্যাপক বিরোধের কথা বলা হয়। বিশেষ করে হিন্দু ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীরা এর শিকার হন।

১৯৮৭ সাল,ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার (বর্তমান বিজয়নগর উপজেলা) নিদারাবাদ গ্রাম, অপহৃত হয়েছিলেন শশাঙ্ক দেবনাথ । তার আর খোঁজ মিলেনি। এরপরে ১৯৮৯ সাল, গ্রামের প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে ধুপাজুড়ি বিল। নৌকায় করে সেই বিল দিয়ে প্রতিদিনই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা ছিল ওই গ্রামের শিক্ষক আবুল মোবারকের।

একদিন বিকালে স্কুল থেকে ফেরার পথে বিলের পানিতে দুর্গন্ধযুক্ত তেল ভাসতে দেখেন। তিনি নৌকার গতিপথটা একটু ঘুরিয়ে নেন। হঠাৎ নৌকার তলদেশে কী একটা আটকে যাওয়ায় ঢুলে ওঠে তার নৌকা! এবার মাঝির বৈঠায় খটখট শব্দ! সন্দেহ হয় শিক্ষক আবুল মোবারকের। তার নির্দেশমতো মাঝি বৈঠা দিয়ে পানির নিচে খোঁচাখুঁচি করতেই ভেসে ওঠে ড্রাম!

তিনি ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের খবর দিলেন। ড্রাম খুলতেই স্তব্ধ সবাই। তিন তিনটি লাশ! সন্ধান চলে আরও। মিলেও যায়। আরেকটি ড্রামে টুকরো টুকরো করে রাখা আরও তিনজনের লাশ! লাশ ছয়টি শনাক্ত হলো।

এরা আর কেউ নন, একই গ্রামের নিরীহ শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী ও পাঁচ অবুঝ সন্তানের লাশ এগুলো। শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজাবালা (৪৫), মেয়ে নিয়তি বালা (১৭), প্রণতি বালা (১০), ছেলে সুভাস দেবনাথ (১৪), সুপ্রসন্ন দেবনাথ সুমন (৫) ও দুই বছরের সুজন দেবনাথ। শশাঙ্কের এক মেয়ে সুনিতী শ্বশুরবাড়ি থাকায় তিনি বেঁচে যান প্রাণে।

ব্রাম্মন বাড়ীয়ার বিরজা বালার জ‌মি দখল কর‌তে এক রা‌তে পু‌রো প‌রিবার‌কে নৌকায় তু‌লে নি‌য়ে মে‌রে ড্রা‌মে ভ‌রে বর্ষার বি‌লে পু‌তে ফে‌লে। দি‌নে প্রচার ক‌রে, বিরজা বালা প‌রিবার ভার‌তে চ‌লে গে‌ছে।

শশাঙ্কের সম্পত্তির ওপর লোভ ছিল পাশের গ্রামের কসাই তাজুল ইসলামের। এ কারণেই প্রথমে অপহরণ করে শশাঙ্ককে হত্যা করে সে। দুই বছর পর তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জনকে হত্যা করে ড্রামে চুন মিশিয়ে তাতে লাশ ভরে বিলে ফেলে দেওয়া হয়। সে সময় দুই বছরের শিশুকেও হত্যা করতে হাত কাঁপেনি খুনিদের।

২০০১ সালের নির্বাচনের পর প্রথম সপ্তাহেই বরিশাল ও ফরিদপুর অঞ্চলে স্মরণকালের ভয়াবহ নির্যাতন হয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর। বিজয়ী বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের নেতা-কর্মীরা সংখ্যালঘুদের উপর ভয়াবহ অত্যাচার, নির্যাতন ও নিপীড়ন শুরু করে।

তাদের ঘরবাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও উপাসনালয় ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজ, শারীরিক হামলার মাধ্যমে জখম, হত্যা, ধর্ষণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তর ও বিয়ে, জায়গা-জমি দখল, মিথ্যা মামলায় জড়ানো ইত্যাদি এমন কোনো অমানবিক ও পাশবিক নির্যাতন নেই যা তখন সংখ্যালঘুদের উপর পরিচালনা করা হয়নি। ২০০৬ ও পরবর্তীতে ২০০৮-এর নির্বাচনেও এ দেশের সংখ্যালঘুরা কমবেশি নির্যাতনের শিকার হয়েছে।

২৮শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৩ ৷ যুদ্ধাপরাধের দায়ে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর যখন আনন্দের বন্যায় ভেসে যাচ্ছে শাহবাগ, ঠিক তখনই দেশের বিভিন্ন প্রান্তে জামায়াত-শিবিরের সশস্ত্র ক্যাডাররা রাস্তায় নেমে পড়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর জন্য৷

কোনো কারণ ছাড়াই অবর্ণনীয় অত্যাচারের শিকার হলো অমুসলিম জনগোষ্ঠী৷ ভেঙে ফেলা হলো প্রতিমা, জ্বালিয়ে দেয়া হলো মন্দির ৷ মাত্র ৯ দিন পরে চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে হামলা করেছে জামায়াত-শিবির৷ সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে শীল পাড়ার মানুষগুলো ৷ ঘর-বাড়ি, হাঁড়ি-পাতিল, কাপড়-চোপড়সহ সব কিছু জামায়াত-শিবির কর্মীদের ধরিয়ে দেয়া আগুনে পুড়ে ছাই ৷

খুলনার কয়রায়৷ প্রায় ২০ দিন পরে আমাদী গ্রামের ধোপাপাড়ার মানুষরা জানিয়েছিলেন, জামাত-শিবির হামলা চালিয়ে তাঁদের সব কিছু লুট করে তারপর আগুনে পুড়িয়ে দিয়েছে বাড়িঘর৷ হিন্দু নারীদের একা পেয়ে মারধর করে ঘরে আটকে বাইরে থেকে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল এবং বাচ্চাগুলোকে আগুনে ছুঁড়ে ফেলার চেষ্টাও করেছিল হামলাকারীরা ৷

অমিয় দাশের চার বছরের বাচ্চা মেয়েটাকে আগুনে ছুঁড়ে মারতে গেলে ওর মা এসে কেড়ে নিয়ে বাঁচিয়েছিল৷ তারপর মা-কেই বেঁধে পেটানো হয়৷ বৃদ্ধা শ্বাশুড়িকেও ছাড়েনি জামায়াত-শিবির৷ হামলার সময় হামলাকারীরা চিৎকার করে বলেছে,

‘‘পুজা মারাও শুয়োরের বাচ্চারা,পুজা মারাও ৷ পুজা করিয়ে দিচ্ছি তোদের জন্মের মতো৷''

এরপর একে একে যশোরের অভয়নগর, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল৷

তারপর দশম নির্বাচন, যশোর, সাতক্ষীরা, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, গাইবান্ধা, সীতাকুণ্ড, বগুড়া, মাগুরা, সাতক্ষীরা ও সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জসহ বহু জায়গাতে আবার হয়েছিল নৃশংস হামলা।

হাজারাইলের ঋষি পাড়ার খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষেরা। যেখানে নির্বাচনে ভোট দেওয়ার কারণে স্বামী ও শ্বশুরকে বেধে রেখে চোখের সামনেই ধর্ষণ করেছে সদ্য বিবাহিত বউকে। শাশুড়ি ধর্মের বাপ ডেকেও বাচাতে পারে নাই ছেলের বউকে। ঠিক একই কায়দায় আরেক পরিবারের ছেলে ও বাবাকে বেধে রেখে ধর্ষণ করা হয় শাশুড়ি আর বউকে।

‘নৌকা’য় ভোট দেওয়ার ‘পাপের শাস্তি’ ভোগ করতে হয়েছে। নৌকায় ভোট না দেওয়ার অপরাধেও। ‘শুধুমাত্র জামায়াত শিবির বিএনপি নয়, পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে দেখা গেছে, আওয়ামী লীগের প্ল্যাকার্ডধারীরাও আছেন নির্যাতকের তালিকাতে।

১৬ই ডিসেম্বর, ২০১৪৷ রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলায় আনারস বাগান নিয়ে বিরোধে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অর্ধশতাধিক বাড়িঘর ও দোকানে অগ্নিসংযোগ করে একদল বাঙালি৷ বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় উপজেলার ৩টি গ্রামের মোট ৬১টি পরিবার ৷ রাঙামাটির ওই প্রত্যন্ত গ্রামগুলোতে পুড়িয়ে দেয়া হয় বাড়িঘর-দোকানপাট, নতুন তোলা আমন ধান ৷ এমনকি গুরুত্বপূর্ণ দলিল, সার্টিফিকেট এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও রক্ষা করতে পারেনি অসহায় মানুষগুলো৷ অভিমানে, ক্ষোভে তাৎক্ষণিকভাবে সরকারি ত্রাণ ফিরিয়ে দেয় !

উল্লেখ্য, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদ ২০১৬ সালের এপ্রিলে রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে পরিসংখ্যান তুলে ধরে জানায় যে, ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালের প্রথম তিন মাসেই প্রায় তিনগুণ সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। গত তিন মাসে ৮২৫০টি নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে নিহত, আহত, অপহরণ, জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত, গণধর্ষণ, জমিজমা, ঘরবাড়ি, মন্দির, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ ও উচ্ছেদের ঘটনা রয়েছে।

সংগঠনটি আরো জানায়, এসব ঘটনায় অপরাধীরা বেশির ভাগ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতাকে ব্যবহার করেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তারা স্থানীয় প্রশাসনকে প্রভাবিত করে ঘটনার পরবর্তী কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণে সেই সব স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে। এমনকি মামলা চলাকালীন অবস্থায় অথবা আদালতের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে সম্পত্তি দখলের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।

পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে গৌড়ীয় মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়কে হত্যার মধ্য দিয়ে মন্দিরের পুরোহিত ও সেবায়েত হত্যাকাণ্ডের শুরু। আইন ও সালিশ কেন্দ্র বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ২০১৬ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল । আটটি জাতীয় দৈনিক ও নিজেদের অনুসন্ধান থেকে প্রতিবেদনটি চূড়ান্ত করে আসক।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০১৬ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত হিন্দুধর্মাবলম্বীদের ১৯২টি বাসস্থান, ২টি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, ১৯৭টি প্রতিমা, পূজামণ্ডপ ও মন্দিরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ, ৫টি জমি ও বসতবাড়ি দখলের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় ৬৭ জন আহত ও ৭ জন নিহত হন।

এর বাইরে পঞ্চগড়, গোপালগঞ্জ, টাঙ্গাইল, ঝিনাইদহ, পাবনা, যশোর ও বগুড়ায় মঠের অধ্যক্ষ ও সেবায়েতরা খুন হন। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে যশোরের কেশবপুর থেকে প্রবীণ মল্লিক নামের একজন মন্দিরের সেবায়েত নিখোঁজ হওয়ার ১৩ দিন পর বাড়ির পাশ থেকে তাঁর লাশ উদ্ধার হয়।

এ ছাড়া ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের পর সহিংসতায় সাতক্ষীরার আশাশুনির চার গ্রামের ১০০ হিন্দু পরিবার ঘরছাড়া হয়। ২৯ মে কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে পরাজিত প্রার্থীর সমর্থকেরা হিন্দুধর্মাবলম্বীদের শতাধিক বাড়িঘর, মন্দির ভাঙচুর করাসহ পিটিয়ে ৩০ জনকে আহত করেন।

ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানার অজুহাতে সংখ্যালঘু নির্যাতন সাম্প্রতিক সময়ে আরেক মাত্রা পেয়েছে, ভুয়া ফেসবুক অ্যাকাউন্ট তৈরি করে ধর্মীয় উত্তেজনা সৃষ্টি, তারপর দেশ দেখেছে রামুতে হাজার বছরের ঐতিহ্যবাহক বৌদ্ধমন্দির ছাই হয়ে যেতে, দেখেছে একই ধারায় যশোরের অভয়নগর ও পাবনার সাঁথিয়ায় ফেসবুকের ভুয়া অ্যাকাউন্টকে ভিত্তি করে নির্যাতন। দেখছে কয়েদখানাতে অমুসলিম ভিড় বাড়ছে !

ধর্মীয় অবমাননা’র ধুয়া তুলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি ঘটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলায়।

একই অভিযোগ তুলে নারায়ণগঞ্জে শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে সংসদ সদস্যের সামনে কান ধরে ওঠবস করানোর ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে শ্যামল কান্তির বিরুদ্ধে ধর্মীয় অবমাননার অভিযোগের কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি।

২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ১১টি ঘটনার বিশ্লেষণ করে এএলআরডি থেকে ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও উচ্ছেদের একটি সারসংক্ষেপ তুলে ধরা হয়। বলা হয়, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ও প্রভাবশালী ব্যক্তিরা নিজ স্বার্থের জন্য হামলা, হত্যা ও নির্যাতন করেছেন। প্রশাসন প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই নীরব ভূমিকা পালন করে। এসব ঘটনার বিচার না হওয়ার কারণে নিরাপত্তাহীনতা বাড়ছে ও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।

বেসরকারি সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন ফর ল্যান্ড রিফর্ম অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (এএলআরডি) গতবছরে ডিসেম্বরে আয়োজিত এক গোলটেবিলে ২০১২ সাল থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ঘটে যাওয়া ১১টি ঘটনার বিশ্লেষণ করে এ কথা বলা হয়।

“২০১৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে -৯৮ জন সংখ্যালঘু হত্যা করা হয়েছে , ১০০৯ জনকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে, ১৮ জনকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে, ২৬টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে, ২২জন নিখোঁজ রয়েছেন , ২০৯টি প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়েছে, ৩৬৬টি মন্দিরে পূজা বন্ধ করা হয়েছে , ৩৮ জনকে অপহরণ করা হয়েছে, ৩৫৭ জনকে জখম করা হয়েছে, ৯৯জনকে চাঁদাবাজি-মারধর ও আটকে রেখে নির্যাতন, ১৬৫টি লুটপাটের ঘটনা , ১৩টি বসতঘর-ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা হয়েছে, ৮৬টি সম্পত্তি দখলের ঘটনা ঘটেছে, ৬১টি ভূমি দখল, ২১০টি উচ্ছেদে ঘটনা ঘটেছে, ৩২৬টি উচ্ছেদের তৎপরতার ঘটনা ঘটেছে, ৩৪৩১টি উচ্ছেদের হুমকি, ৭১১টি দেশ ত্যাগের হুমকি, ১৪১টি মন্দিরে হামলা, ভাঙচুর, চুরি ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে, ২,৩২৮ বাড়িতে হামলা, ভাঙচুর, চুরি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে , জোরপূর্বক ধর্মান্তরিত বা ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা এক হাজার ২৫১টি''।

খুন - গুম - জবর দখল ও খেদানো ছাড়াও যেটি হয় সেটি হেনস্থা ! গত বছর, ২০১৮ ,দক্ষিণ বাংলাদেশের কক্সবাজারের পেকুয়ায় মাছ চুরির অভিযোগ ৭ জেলেকে আটকে রেখে মাথার চুল কেটে শারীরিক নির্যাতন চালিয়েছিল একটি প্রভাবশালী মহল। এতেও ক্ষান্ত না হয়ে জেলেদের কাছ থেকে জোরপূর্বক নিজ ধর্মের বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য করতে বাধ্য করা হয়। নির্যাতনের খবর ও ভিডিও প্রকাশ হলেও এ বিষয়ে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি স্থানীয় প্রশাসন।

স্থানীয় ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, পেকুয়ার পেচু মিয়া বাড়ীর পুকুরে মাছ ধরার জন্য চট্টগ্রামের পটিয়া থেকে মজুরিভিত্তিক একদল জেলে আনেন যারা হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত । মিয়া বাড়ির কারবারি ও রাজাখালী ইউনিয়নের বদিউদ্দীনপাড়ার বদু মেম্বার মাছ ধরা শেষে জেলেদের মজুরি না দিয়ে উল্টো মাছ চুরির অভিযোগ তোলেন, মেম্বারের নির্দেশে তাদের আটকে রেখে একই এলাকার আতিক, আব্দুল কাদের, ওসমান গণিসহ বেশ কয়েকজন ব্যক্তি নির্যাতন চালান। এ সময় তাদের মাথা ন্যাড়া করে ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে ঘুরানো হয়। পরে পুলিশের মধ্যস্থতায় নির্যাতিত জেলেরা মুক্তি পায়, কারো কোনো বিচার হয়নি । ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে পেকুয়া থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জহিরুল ইসলাম খান।

২০১৮ সালের আগস্ট মাসে, ফরিদপুরের নগরকান্দায় জমি নিয়ে সংখ্যালঘু পরিবারের উপর হামলা করার খবর পাওয়া গেছে। উপজেলার লস্কারদিয়া কালিবাড়ি বাজারে স্বপন কুমার সেনের দোকানঘর জোরপূর্বক দখল করতে আসে একই গ্রামের রহিমের ছেলে এস্কেন্দার । এসময় স্বপন ও তার স্ত্রী মালতি বাধা দিলে হামলা শুরু ।

এ হামলায় মালতি রানী সেন গুরুতর আহত হন । আহতবস্থায় তাকে ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ট্রমা সেন্টারে ভর্তি করা হয়েছে। স্বপন কুমার সেন অভিযোগ করে বলেন, আমার ঐ জায়গার কাগজপত্র আছে । এস্কেন্দার র কোন কাগজ না থাকা সত্ত্বেও তারা জোরপূর্বক দোকানঘর দখল করার জন্য লোকজন নিয়ে হামলা করেছে ।

আগস্টের ২৪ তারিখে বান্দরবানের লামা উপজেলায় দুই ত্রিপুরা কিশোরীকে ধর্ষণের অভিযোগে তিনজনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, যাদেরকে বিজিবি সদস্য বলা হয়েছে এজাহারে। বৃহস্পতিবার লামা থানায় দায়ের করা ওই মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, ‘রবিউল নামে বিজিবির এক নায়েক এবং মারুফ ও সুমন নামের দুই সৈনিক’ বুধবার রাতে পাশাপাশি বাড়ির দুই কিশোরীকে ধর্ষণ করে। অন্যদিকে স্থানীয় বিজিজির পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, ওই নামে কোনো সদস্য ফাঁসিয়াখালী ইউনিয়নের বনফুর বিজিবি ক্যাম্পে নেই। সাংবাদিক বা বাইরের কাউকে এ সময় ভিকটিমদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়া হয়নি।

আগস্ট মাসের ১৯ তারিখে বাগেরহাটের চিতলমারীতে নিখোঁজের এক সপ্তাহ পর ডোবা থেকে এক কলেজছাত্রের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। ছাত্রটি হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত।
হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ৭শ বিঘা জমির চারপাশে জোরপূর্বক বেড়া দিয়ে ঘিরে অবৈধ দখলের চেষ্টা চলছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার জোয়ারিয়া এলাকায়।

আগস্ট মাসের ২৩ তারিখে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পাইকপাড়ায় পাশের মুসলিম বাড়িতে ঈদের দিনে কাজ করতে না যাওয়ায়, মালিক রাগান্বিত হয়ে পেট্রোল দিয়ে এক মহিলার বাড়ি পুড়িয়ে দেয়ার হুমকি সহ মহিলাকে নির্যাতন করা হয়, নির্যাতনকারী মুসলিম এবং নির্যাতিতা সনাতন ধর্মাবলম্বী ।

আগস্ট মাসের ২২ তারিখে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী, হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় ৭শ বিঘা জমির চারপাশে জোরপূর্বক বেড়া দিয়ে ঘিরে অবৈধ দখলের চেষ্টা চলছে গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার জোয়ারিয়া এলাকায়।

আগস্ট মাসের ১৯ তারিখে প্রাপ্ত সংবাদ অনুসারে, কুমিল্লার মেঘনা উপজেলায় ভাওরখোলা গ্রামে জোরপূর্বক হিন্দু সম্পত্তি দখলের অভিযোগ উঠেছে। জানা গেছে ১৯৭০ সালের হোমনা সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের নাম ব্যবহার করে একখানা ভূয়া দলিল সৃজন করে ভাওরখোলা নিবাসী এক হিন্দু পরিবারের ৭৮ শতক বাড়িসহ মন্দিরের জায়গা দখল করে নেয়া হয়েছে ।

জানা যায়, দখলকারীরা মেঘনা উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও বর্তমান আ'লীগ সভাপতির প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মদদপুষ্ট, ফলে ভয়ে আইনের আশ্রয় নিতে পারছে না অত্যাচারিত সম্প্রদায়ের মানুষ ।

১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবস পালনের জন্য চাঁদা না দেয়ায় আশুলিয়ায় স্বর্ণের দোকানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে আশুলিয়া থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা র বিরুদ্ধে। এ সময় হামলাকারীরা দোকানে থাকা জ্যোতি লাল ঘোষ ও তার ছেলে বিজয় চন্দ্র ঘোষকে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও পিটিয়ে জখম করে। এরপর দোকানে থাকা স্বর্ণালঙ্কার, রৌপ্য ও নগদ টাকাসহ প্রায় ১০ লাখেরও বেশি টাকার মালামাল লুট করে নিয়ে যায়।

১৫ ই আগস্ট, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় কুমিল্লা-সিলেট মহাসড়কের সুহিলপুর থেকে সমীর বণিক (৪৫) নামে এক স্বর্ণকারের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। রাত সাড়ে ১০টার দিকে মহাসড়কের পাশে মুলিহাটি থেকে স্থানীয়রা তাকে উদ্ধার করে। সমীরের আত্মীয় ও জেলা শহরের লাখিবাজারের স্বর্ণ মেলা শিল্পালয়ের মালিক ইন্দ্রজিত বণিক জানান, সমীর শায়েস্তাগঞ্জে স্বর্ণের কাজ করতো। প্রায় সময় সে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে স্বর্ণ, রুপা ও গোল্ড প্লেটের গহনা শায়েস্তাগঞ্জে নিয়ে যেত। বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকেও সমীর গোল্ড প্লেটের গহনা নিয়ে শায়েস্তাগঞ্জে ফিরছিল।

১২ ই আগস্ট, ধামরাইয়ে কুটিরচর গ্রামের প্রভাবশালী কয়েকটি শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক হাজি আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে ৬০-৭০ জন সন্ত্রাসী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে কার্তিক মনিদাসের বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার মা আরতি মনিদাস, শাশুড়ি সোনা মনিদাস ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে কনিকা মনিদাসকে মারপিট করে ঘর থেকে বের করে দেয়। এরপর বসত ঘর ও একটি দোকান ভেঙে তছনছ করে দখল করে নেয় সন্ত্রাসীরা। এরপর সেখানে ইট দিয়ে প্রাচীর দিয়ে দখল করে নেন আজিজ।

দখলের তাণ্ডব দেখে কার্তিকের প্রতিবেশী মুদি দোকানদার প্রদীপ চক্রবর্তী (৪৫) হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান। এর আগে কার্তিকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করে আজিজের ছেলে জাহিদুল ইসলাম। এ মামলায় সোমবার রাতে কার্তিককে গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠায় পুলিশ।

৯ ই আগস্ট, ময়মনসিংহে জেলা পরিষদ কর্তৃক রাজ বিজয় সিংহ দুরধরীয়া শিব মন্দির ও বিগ্রহ বুলডেজার দ্বারা গুড়িয়ে দেয়া ও মন্দির পুন:নির্মাণে বাধা দেয়ার প্রতিবাদে ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক বরাবর স্মারকলিপি প্রদান করা হয়েছে ।

বিনা নোটিশে রাঙ্গামাটির ঘাগড়া বাজারে বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল সেনের বাড়ি ঘর গুড়িয়ে দিয়েছে বলে অভিযোগ । গত ৮ আগষ্ট বুধবার বিরোধকৃত সরকারী খাস জায়গায় কোন প্রকার নোটিশ ছাড়াই আদালতের আদেশে উচ্ছেদ করে অনিল সেনের সেমি পাকা ঘর ঘুড়িয়ে দিয়েছে প্রসাশনের লোকজন। এমনকি এক ঘন্টাও সময় না দিয়ে নিজের ঘরবাড়ি ভেঙে স্বপরিবারে উচ্ছেদ করা হলো বীর মুক্তিযোদ্ধা অনিল সেনকে।

বাড়ীর সমস্ত মালামাল ঠাকুর ঘর সহ সমস্ত জিনিষপত্র ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে রাস্তায়। বাড়ীর টিনের চাল কেটে বাড়ীর ওয়াল ফেলে দিয়েছে। একজন মুক্তিযোদ্ধার সবচাইতে সম্মানের অর্জন সেই মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট এবং স্বারককে চরম অবমাননা করে ছুড়ে ফেলে দেওয়া হয় । অনিল বাবু সহ আশেপাশের উপস্থিত স্থানীয় অনেকে প্রতিবাদ এবং বাধা দিতে গেলে তাদের ১৪৪ ধারার ভয় এবং হুমকি দেখিয়ে চুপ থাকতে বাধ্য করা হয়।

এমনকি ভিডিও করার সময় মোবাইল পর্যন্ত কেড়ে নেওয়া হয়। এঘটনার পর অনিল সেনের স্ত্রী মারাত্মক অসুস্থ হয়ে রাঙ্গামাটি সদর হাসপাতালে চিকিৎসাধীন বলে সূত্রে প্রকাশ । অমানবিক ঘটনাটি ঘটেছিলো রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালি উপজেলার ঘাগরা এলাকায়। পরবর্তীতে বসতবাড়ির ব্যবস্থা সহ নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার ঘোষণা প্রদান করেন জেলা প্রশাসক এ. কে. এম. মামুনুর রশিদ।

১০ ই আগস্ট বাংলাদেশ মাইনরিটি ওয়াচের কর্মীবৃন্দ গোপালগজ্ঞ জেলার কোটালীপাড়া উপজেলায় উপ জেলা নির্বাহি অফিসারের কক্ষে হামলার শিকার হন ।

আগস্টের ৮ এ নাটোরের বড়াইগ্রামে তিন প্রভাবশালী বখাটে যুবকের নির্মম নির্যাতনের পর লজ্জায় ও অপমানে আত্মহত্যা করেছেনা সংখ্যালঘু খ্রিস্টান পরিবারের এক গৃহবধূ। মিথ্যা অপবাদ দিয়ে শারীরিক নির্যাতন ও শ্লীলতাহানি করে তা মোবাইলে রেকর্ড করে রাখে অপরাধীরা ।

৬ ই আগস্ট এ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ৭নং ওয়ার্ডের শিবপাহাড়স্থ দীর্ঘ ২ শত বছরের প্রাচীনতম সর্বজনীন শিব মন্দির ও নাথ শ্বশানের জমি জবর দখলের অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় চিহ্নিত ভূমিদস্যু রশিদ আহমদের পুত্র মুরাদ উদ্দিন ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা দীর্ঘদিন ধরেনাথশ্বশান মন্দিরের জমি জবর দখল করে প্লট হিসেবে বিক্রির পায়তারা চালাচ্ছে।

এরই প্রেক্ষিতে নাথশ্মশান মন্দিরের নামীয় বিএস ৩২২২ দাগের বাট্টা ৪২৬৮ এর ২০শতক জমি জোর পূর্বক জবর দখল করে ঘেরা-বেড়া দিয়েছে। মন্দিরের ওই জমিতে হিন্দুদের লাশ রেখে আধ্যশ্রাদ্ধেয় করা হত। কিন্তু দখলবাজরা তা উপেক্ষা করে দীর্ঘ ২শত বছরের নাথশ্মশান মন্দিরের ২০ শতক জমি জবর দখলে নিয়েছে।

আগস্টে এছাড়া, চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ুয়া আদিবাসী দুই ধর্ষিতা শিশু কৃত্তিকা ত্রিপুরারা কোনো খবরে ঠাঁই পায় না, বরিশালের এক গ্রামে জমি দখলের অভিপ্রায়ে পরিবারটিকে আতংকিত করার উদ্দেশ্যে সংখ্যালঘু পরিবারটির কিশোরীটিকে কয়েকদিন ধরে ধর্ষণ করার খবর প্রকাশ পেলেও কোনো অপরাধ মামলাভুক্ত হয়নি, রংপুরে হরিজন কলোনিতে নির্যাতন ও উচ্ছেদের অভিযোগ পাওয়া গেছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কয়েকজন নিরীহ ও ইন্টারনেট টেকনিক্যাল বিষয়ে অনভিজ্ঞ যুবকের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্মের নবীর বিরুদ্ধে কটূক্তির কারণে মিথ্যা মামলা সাজানো হয়েছে, সারা দেশে ভিটা দখল ও ধর্মান্তরিত করার অভিপ্রায়ে মফস্বল শহর ও গ্রামগুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত কয়েকজন কিশোরীর ওপরে নির্যাতন ও অপহরণ করার খবর পাওয়া গেছে। ২০১৮ র সারা বছরের চিত্র নিয়ে অদূর ভবিষ্যতে থাকবে আমাদের ধারাবাহিক প্রতিবেদন।

২০১৮ র শুরুতে বাংলাদেশ হিন্দু মহাজোট রাজধানী ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এক লিখিত বক্তব্যে একটি পরিসংখ্যান তুলে ধরে, ২০১৭ সালে হত্যা ও মরদেহ উদ্ধার হয়েছে ১০৭টি, ২০১৬ সালে তা ছিল ৯৮টি। গত বছর হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে ৭৭৫ জনকে, নিখোঁজ হয়েছেন ৩১ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ২২, হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছিল ১ হাজার ৪৬৬ জনকে। দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছে ১৭২ জনকে, দেশত্যাগের হুমকি দেয়া হয়েছে ৬১০ জনকে। ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ২ হাজার ২০৯ জন। ধর্ষণ করা হয়েছে ২৫ জনকে, জোরপূর্বক ধর্মান্তর করা হয়েছে ২৩ জনকে, ২০১৬ সালে এ সংখ্যা ছিল ৮৬।

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর কেবলমাত্র ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ সালের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত সংখ্যালঘুদের দেশান্তরের ধারায় ছেদ পড়ে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চারনেতাকে নৃশংসভাবে হত্যার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের চরিত্র ১৮০ ডিগ্রি ঘুরিয়ে দিয়ে পাকিস্তানি ভাবধারায় দেশপরিচালনা শুরু হয়, শুরু হয় অমুসলিম বিতাড়নের প্রয়াস, যা কখনো সরবে কখনো নীরবে এখনো চলছে।

পরিশেষে, আমাদের দেশে অমুসলিমদের সমস্যার কথা শুনলে সাথে সাথে ভারতের কথা কেন বলা হয় না, ভারতে এই হচ্ছে সেই হচ্ছে বলে দয়া করে নিজেদের ক্ষতস্থান ঢাকতে ব্যস্ত হবেন না। ভারত বা পাকিস্তান বা যেকোনো দেশেই সংখ্যালঘুদের ওপরে অত্যাচার নিপীড়ন চালানো অমানবিক, লজ্জাজনক! কিন্তু আমাদের দেশের মতো সংখ্যালঘুর নিজ মাটি নিজ দেশত্যাগের যে পরিসংখ্যান, তার অংশবিশেষও ভারতে এমনকি পাকিস্তানেও পাওয়া যাবে না!

সুতরাং,আমাদের দেশের অবক্ষয়, হাহাকার, যন্ত্রণা, অমানবিকতার দিকেই আমাদের নজর দেয়া বাঞ্ছনীয় ।

তবে হ্যাঁ, সম্প্রীতির জন্যে মানুষ যখন ধর্মের ওপরে উঠে মনুষ্যত্বকে স্থান দেয়, তখন সেই মানুষ এবং মানব সম্প্রদায়ের কোনো সীমানা দেশ রাষ্ট্র থাকে না, সেই সকল মহৎ কাজের, মহৎ মনের মানুষ মুসলিম বা যে সম্প্রদায়েরই হোক, আমরা সবাই তা তুলে ধরবো, সেটাই মরমে বাঁশি বাজাবে।

______________

সংগৃহীত : সূর্যবার্তা নিউজ (http://surjobartanews.com)

লিংক:  shorturl.at/lsMNU

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ