লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 31, 2015, 12:00 AM, Hits: 1476
পঞ্চায়েত সম্পর্কে বলতে গেলে বলতে হয় যে, অনেকে পঞ্চায়েতকে শুধু গ্রাম শাসনের এক আনুষ্ঠানিক কিংবা আইনী প্রতিষ্ঠান হিসাবে বিবেচনা করেন। বলা যায় তাদের কাছে এটা গ্রাম সরকারের এক বিশেষ ভারতীয় বা উপমহাদেশীয় রূপ। ফলে ব্রিটিশ শাসন কালে তার আনুষ্ঠানিক অস্তিত্বের প্রমাণ দেখতে না পেয়ে অনেকে পঞ্চায়েতের স্বরূপ এমনকি অস্তিত্ব নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন। বিশেষত ইউরোপীয় পণ্ডিতদের মধ্যে এই ধরনের প্রশ্ন রয়েছে। যেন পঞ্চায়েত একটা ‘মিথ’ বা অতিকথা মাত্র।
তবে আনুষ্ঠানিকভাবে না হয়ে সামাজিক সম্মতির ভিত্তিতে যদি কোনও ব্যবস্থা সমাজে ক্রিয়াশীল হয় তবে কি সেটার প্রতিষ্ঠান হিসাবে গুরুত্ব থাকবে না? এই আনুষ্ঠানিকতার গুরুত্ব যদি এতই বেশী হয় তবে ব্রিটেনকে কি কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবেই স্বীকৃতি দেওয়া যাবে? কারণ তার তো একটা লিখিত সংবিধানই আজ পর্যন্ত তৈরী হল না। তাহলে তার রাষ্ট্র চলছে কী করে? শত শত বৎসর ধরে সামাজিক মতৈক্যের ভিত্তিতে গড়ে উঠা প্রথা বা বিধিবিধানই হচ্ছে সে দেশের সংবিধান। এই রকম লিখিত সংবিধানহীন এক রাষ্ট্র এক সময় পৃথিবীর অন্যতম বৃহত্তম সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল। এক সময় বলা হত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যায় না। আসলেই যেত না।
সুতরাং আইনী রূপ ছিল কিনা তা দিয়ে অর্থাৎ রাষ্ট্রের আইনী ও দালিলিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ভূমিকা রাখা না রাখা দিয়ে পঞ্চায়েতের অস্তিত্ব কিংবা গুরুত্বকে বিচার করা ভুল হবে।
পঞ্চায়ত বা পঞ্চায়েত ছিল প্রাচীন দক্ষিণ এশিয়া তথা ভারতবর্ষের জন-সমাজের আাত্মশাসনের একটা বিশেষ ব্যবস্থা। গ্রাম পর্যায়ে আধুনিক নির্বাচনমূলক স্থানীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, যেমন ইউনিয়ন পরিষদ, ইত্যাদি দৃষ্টান্ত থেকে পঞ্চায়েত সম্পর্কে কিছু ভুল ধারণাও আমাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে। যেমন ধারণা করা হয় যে পঞ্চায়েত শুধু গ্রামে সীমাবদ্ধ ছিল। কিংবা প্রতি গ্রামে রাষ্ট্র কর্তৃক মনোনীত লোকদের নিয়ে অথবা সেখানকার অধিবাসীদের সম্মতির ভিত্তিতে গঠিত একটি কমিটি ছিল যার উপর ছিল রাষ্ট্র কর্তৃক অর্পিত শান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা এবং খাজনা আদায়সহ গ্রামের যাবতীয় সামাজিক কর্মকাণ্ড দেখাশুনা বা পরিচালনার ভার।
প্রকৃতপক্ষে পঞ্চায়েত শুধু গ্রাম নয়, অধিকন্তু শহর ও নগরসহ সমাজের সবখানেই রাষ্ট্রযন্ত্র বহির্ভূত জনগণের স্বশাসনের একটা রূপ ছিল। তবে রাষ্ট্রের কেন্দ্র স্বরূপ নগর বা শহর থেকে দূরে অবস্থিত গ্রামগুলিতে তার ভূমিকা ছিল অনন্য এবং অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ও স্বচ্ছন্দ। প্রাক-মুসলিম যুগে ভারতবর্ষের কোন কোন অঞ্চলে বা রাজ্যে গ্রাম শাসনে পঞ্চায়েতকে রাজা বা রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত ও আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে দেখতে পাওয়া গেলেও সর্বত্র ও সর্বদা এবং এমনকি সাধারণভাবে ব্যাপারটা তেমন ছিল না।
বস্তুত, পঞ্চায়েতকে রাষ্ট্রের মত আইনী এবং আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে কিংবা রাষ্ট্রের অঙ্গ হিসাবে দেখলে ভুল করা হবে। যে সকল গোষ্ঠী বা বর্ণজাতি সমাজে বাস করত তাদের মধ্যকার প্রভাবশালী ও ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের নিয়ে গ্রাম, শহর ও নগরের পাড়া বা মহল্লা ইত্যাদির বিভিন্ন বিষয় ও সমস্যা দেখাশুনার জন্য যে ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠত সেটা হচ্ছে পঞ্চায়েত। পঞ্চায়েত সদস্যদের সংখ্যা যেমন নির্দিষ্ট ছিল না তেমন দায়িত্বও নির্দিষ্ট ছিল না, মেয়াদও নির্দিষ্ট ছিল না। পঞ্চায়েতে ব্যক্তির ভূমিকা ছিল বৈকি। তবে সেটা সাধারণত কোনও গোষ্ঠী বা বর্ণজাতির প্রতিনিধি হিসাবে। অর্থাৎ গোষ্ঠী বা বর্ণজাতির বাইরে তাদের কোনও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব সাধারণভাবে স্বীকৃত ছিল না। বিশেষত ব্রিটিশ শাসনের পূর্বকালে উপমহাদেশে বর্ণজাতি ব্যবস্থার দোর্দণ্ড প্রতাপকে অস্বীকার করে ব্যক্তির দাঁড়াবার মত পরিস্থিতি ছিল না। ধর্ম বিশেষ করে বর্ণজাতিভেদমূলক প্রথা ও রীতিনীতি দ্বারা সামাজিক জীবন পরিচালিত হত। ফলে পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণের একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল।
চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে শ্রম ও পেশার সঙ্গে সম্পর্কিত বর্ণজাতিভেদমূলক সামাজিক বিভাজন হিন্দুদের মধ্যে তো ছিলই এমনকি নিম্নবর্গের কিংবা সাধারণ মুসলিম জনগোষ্ঠীরও এর বাইরে যাবার উপায় ছিল না। এ ঘটনা মোগল যুগে ভারতে আগত ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্ণিয়েরেরও চোখ এড়ায় নাই। তার ভ্রমণ বৃত্তান্তে তিনি এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন। বাংলায়ও যে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে এ ধরনের গোষ্ঠীগত ও মর্যাভিত্তিক শ্রেণীগত বিভাজন ছিল, এমনকি সেটা যে ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠিত হবার পরেও অনেক দিন পর্যন্ত ছিল সে বিষয়টি সমাজতাত্ত্বিক নজমুল করিমের Changing Siciety in India and Pakistan নামক গ্রন্থ থেকে আমরা জানতে পারি। (এ বিষয়ে আমার লিখা বই ‘বাঙ্গালী জাতির সঙ্কটের উৎস ও তার প্রতিকার সন্ধান-এ কিছু আলোচনা আছে। পৃঃ ২৩-২৪)
অবশ্য পাকিস্তান আমলেও আমি তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের কোন কোন এলাকায় মুসলমানদের মধ্যে এ ধরনের বিভাজন লক্ষ্য করেছিলাম। যেমন পাবনায় মুসলমান তাঁতী সম্প্রদায়কে সাধারণভাবে জোলা হিসাবে অভিহিত করা হত। এদের অবস্থান ছিল অনেকটা ‘জাতের’ মত। সাধারণ মুসলমান কৃষকরাও জোলাদের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক করত না। জোলাদের বৈবাহিক সম্পর্ক সাধারণত নিজেদের মধ্যেই হত। এ ধরনের আরও দৃষ্টান্ত আমার জানা বা দেখা আছে।
আসলে বর্ণজাতিভেদ শ্রম-কর্ম বিভাজন ও মর্যাদার স্তর বা শ্রেণী বিন্যাসের এমন একটি ভারতীয় রূপ যা ধর্ম বিশ্বাসের সঙ্গে জড়িত হয়ে একটি অপরিবর্তনীয়তা লাভ করেছে। তবে ইসলামে এই ধরনের সামাজিক বিভাজনের জায়গা না থাকায় এই ব্যবস্থা ধর্মীয় বিধানের সমর্থন লাভ করে নাই। ফলে এটি ছিল নিছক সামাজিক প্রথা নির্ভর। সুতরাং ব্রিটিশ শাসন প্রবর্তনের পর যখন এর অর্থনৈতিক উপযোগ ফুরিয়েছে তখন মুসলিম সমাজে এই ব্যবস্থার অবসান ঘটানো সহজতর হয়েছে। কিন্তু হিন্দু সমাজের ক্ষেত্রে ব্যাপারটা তেমন না হওয়ায় অর্থনীতিতে এর ভূমিকা আর না থাকলেও সমাজ থেকে এটির মূলোচ্ছেদ করা অত সহজ হচ্ছে না।
যাইহোক, ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত বর্ণজাতিভেদমূলক ব্যবস্থা সমাজে প্রতিষ্ঠিত থাকায় এই ব্যবস্থার শীর্ষে থাকা ব্রাহ্মণ বর্ণজাতি সমাজে আলাদা গুরুত্ব লাভ করত। বিশেষত তখনও পর্যন্ত হিন্দুদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা অনেক বেশী থাকায় (১৮৭২ সালের আদমশুমারী অনুযায়ীও বাংলায় হিন্দুরা ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ।) উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র বর্ণজাতিভেদমূলক সমাজ ব্যবস্থায় ব্রাহ্মণ যে পঞ্চায়েতেও বিশেষ মর্যাদা ভোগ করত তেমনটাই মনে হয়।
তবে পঞ্চায়েত যে সর্বদা ও সর্বত্র ব্রাহ্মণদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হত তা নয়। যে সব বর্ণজাতি গ্রামে বা এলাকায় সম্পদ, ভূমি মালিকানা, বাইরের যোগাযোগ, রাষ্ট্রীয় সংযোগ বা সমর্থন ইত্যাদি কারণে শক্তিশালী বা প্রভাব-প্রতিপত্তিশালী হত পঞ্চায়েতে স্বাভাবিকভাবে তাদের প্রতিনিধিদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হত। আবার গ্রাম বা এলাকার বিভিন্ন বিষয় নিষ্পত্তির জন্য শুধু যে উচ্চ বর্ণজাতির মধ্যে পঞ্চায়েত সীমিত থাকত তাও নয়। নিম্ন বর্ণজাতির প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিরাও পঞ্চায়েতে ভূমিকা রাখতে পারত।
এভাবে গ্রাম পঞ্চায়েত হয়ে উঠত গ্রামের সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বকারী প্রতিষ্ঠান, যেখানে গ্রামের গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত। তবে সাধারণত যে কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের মধ্যে সর্বোচ্চ পরিমাণ ঐক্যমত বা মতৈক্য প্রতিষ্ঠার উপর গুরুত্ব দেওয়া হত। স্বাভাবিকভাবে যে কোনও সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ধর্ম এবং প্রথা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত।
আর একটা বিষয় বুঝতে হবে, পঞ্চায়েত রাষ্ট্রের মত বলপ্রয়োগের ক্ষমতা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠান ছিল না। কিন্তু তাই বলে তার ক্ষমতাকে খাটো করে দেখার উপায় ছিল না। ক্ষেত্র বিশেষে হয়ত তা বলপ্রয়োগ করত। কিন্তু তার বিধান লঙ্ঘনের সর্বোচ্চ শাস্তি সাধারণত ছিল সমাজ চ্যুত বা একঘরে করা। এটা সে কালে ছিল ভয়ঙ্কর শাস্তি, যা ব্যক্তি বা পরিবারের জন্য মৃত্যুর সমান বা সহজ মৃত্যুর চেয়েও ভয়ঙ্কর হতে পারত।
যাইহোক, পঞ্চায়েত ছিল প্রথাভিত্তিক এমন এক প্রতিষ্ঠান যার সদস্যদের মেয়াদ, সদস্যপদ ইত্যাদি নির্দিষ্ট না থাকলেও গ্রাম বা মহল্লা কিংবা নির্দিষ্ট স্থান বা ক্ষেত্রের ব্যবস্থাপনা, বিচার ইত্যাদি পরিচালনার মাধ্যমে তা সামাজিক স্থিতি ও ভারসাম্য রক্ষায় অসাধারণ কার্যকরতার পরিচয় দিয়েছিল। পুরোহিত, কৃষক, কারিগর, ধোপা, নাপিত এবং নদীর ঘাট পারাপারের নৌকার মাঝি থেকে শুরু করে গ্রাম বা নির্দিষ্ট এলাকার প্রতিটি পরিবার ও মানুষের জীবন ও জীবিকার নিশ্চয়তা বিধান এবং কর্মকাণ্ডের গতিধারা নিয়ন্ত্রণের জন্য ঐ এলাকার সবাই মিলে এমন এক জীবন্ত ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলত যা ছিল অত্যন্ত কার্যকর ও শক্তিশালী।
গ্রামের যে নাপিত সে জানত বৎসরে কত মণ ধান সে পাবে। একইভাবে ঘাটের মাঝিও ফসল উৎপন্ন হলে তার জন্য নির্দিষ্ট পাওনা ফসল পেত। বিনিময়ে গ্রামের লোকদের নদী পার করে দিত সারা বৎসর। তাঁতীও জানত সে তার বস্ত্র উৎপাদনের বিনিময়ে কী পরিমাণ ফসল বা অন্যান্য বিনিময় পাবে। এইভাবে মোটামুটি সর্বসম্মত মতের ভিত্তিতে গ্রামের সকল লোকের সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনার যে সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেছিল তাকে আমরা পঞ্চায়েত বলতে পারি। অনুরূপভাবে কোন বর্ণজাতির বা বিশেষ এলাকার তাৎক্ষণিক বা বিশেষ সমস্যা সমাধানের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে ঐ বর্ণজাতি বা এলাকার গণ্যমান্যদের যে সভা হত সেটাও পঞ্চায়েত হিসাবে চিহ্নিত হতে পারত। এদিক থেকে দেখলে এখন গ্রামে যেসব সালিশ হয় সেগুলির মধ্যেও রয়েছে সে কালের পঞ্চায়েতের কিছু জের।
বর্তমানের রাষ্ট্রীয় আইন-আদালত-পুলিশ-প্রশাসন যেমন আমাদের গ্রাম সমাজের সালিশ ব্যবস্থাকে ক্রমেই বিলুপ্তির দিকে ঠেলে দিচ্ছে তেমন ব্রিটিশ শাসন ব্যবস্থাও জনসমাজের পঞ্চায়েত-নির্ভর স্বশাসন ব্যবস্থাকে উচ্ছেদ করেছে। তবে ব্রিটিশ শাসন পূর্বকালে পঞ্চায়েত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান না হলেও রাষ্ট্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক যে বিরোধাত্মক ছিল তা নয়। বলা যায় অনেক ক্ষেত্রে উভয়ের সম্পর্ক ছিল পারস্পরিক সহযোগিতা বা সমন্বয়ের। রাষ্ট্র অনেক ক্ষেত্রে সমাজের প্রথা ও বিধিবিধানে হস্তক্ষেপ করত না। তার শাসন ও নিরাপত্তায় বিঘ্ন না ঘটালেই হল। ফলে বহিরাগত মুসলিম শাসকরাও পঞ্চায়েতের মতামতকে অনেক সময় গুরুত্ব দিত। এ ধরনের ঘটনার সাক্ষ্য আমরা মধ্যযুগের লেখা ইতিহাস থেকেও জানতে পারি।
প্রকৃতপক্ষে এ দেশ ও উপমহাদেশের জন-সমাজের নিজস্ব শক্তির উপর ভর করে পঞ্চায়েত দাঁড়িয়ে ছিল। এটা ছিল জন-সমাজের নিজস্ব শক্তি ও গতিশীলতার অভিব্যক্তি। এটা ছিল রাষ্ট্রের স্বৈরতা ও অযাচিত হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে জন-সমাজের আত্মরক্ষার এক অত্যন্ত কার্যকর হাতিয়ার। ব্যক্তির স্বতন্ত্র ভূমিকা না থাকলেও সমাজে এক ধরনের গণতান্ত্রিকতা রক্ষায় পঞ্চায়েতের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তবে এই গণতান্ত্রিকতায় সংখ্যালঘু-গুরুর তুলনায় জোর দেওয়া হত ঐক্যমতের উপর। স্বাভাবিকভাবে প্রভাবশালী ব্যক্তি এবং বর্ণজাতি বা গোষ্ঠীগুলিই এই ধরনের স্বশাসনমূলক ব্যবস্থায় প্রাধান্য বজায় রাখত। তবু এটা ছিল সমাজের স্বশাসনমূলক ব্যবস্থা যেখানে সমাজের সকল অংশই তাদের মতামতের কম-বেশী প্রকাশ ঘটাতে পারত। ব্রিটিশ শাসন যখন জন-সমাজের নিজস্ব শক্তিকে ভেঙ্গে ফেলেছে তখন তার স্বশাসনের ব্যবস্থা হিসাবে পঞ্চায়েতও ক্রমে গেছে। যেহেতু পঞ্চায়েত রাষ্ট্রের আনুষ্ঠানিক বা আইনী প্রতিষ্ঠান ছিল না সেহেতু তার ক্ষয় ও ক্রমবিলুপ্তি এমন নীরবে ঘটেছে যে তা নিয়ে কোনও হৈ চৈ হয় নাই।
উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলিকে ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা জয় করেছে যুদ্ধ তথা বলপ্রয়োগ করে। যুদ্ধের মাধ্যমে জয় বলে তার ইতিহাস লেখা হয়েছে। কারণ অস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ সহজে দৃষ্টিগোচর হওয়ায় তার বিবরণ ও ফলাফলও সহজে লিপিবদ্ধ হতে পারে। কিন্তু উপমহাদেশ ও বঙ্গের জন-সমাজের পঞ্চায়েতমূলক স্বশাসন ব্যবস্থা মোটেই তেমন কোনও বলপ্রয়োগের বা অস্ত্রের ক্ষমতার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠে নাই যাকে ধ্বংস বা জয় করতে যুদ্ধের প্রয়োজন হয়। পঞ্চায়েতে জনসমাজের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা নিহিত থাকলেও সেটা ছিল গৌণ এক দিক। বরং জনসমাজের সদস্যদের তথা জনসাধারণের স্বেচ্ছাসম্মতি ছিল পঞ্চায়েতের মূল ভিত্তি। এ ক্ষেত্রে অবশ্য প্রথাগত ধর্ম বা বর্ণজাতিভেদমূলক বিশ্বদৃষ্টি অন্যতম নির্ধারক উপাদান হিসাবে ক্রিয়াশীল ছিল। ফলে সমাজের স্থবিরতা ও পশ্চাৎপদতা রক্ষায়ও পঞ্চায়েত ব্যবস্থার ভূমিকা অনস্বীকার্য। এইভাবে তা ছিল নিম্নবর্ণ এবং নারীর প্রতি অগণতান্ত্রিক ও বৈষম্য মূলক সামাজিক ব্যবস্থাকে অনড়তা ও স্থিতি দানেরও একটি কার্যকর হাতিয়ার। অবশ্য এই হাতিয়ার ছিল জনগণের সমর্থনপুষ্ট। কারণ জনগণও এই ধরনের সামাজিক ব্যবস্থা চাইত।
কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতার দিক থাকা সত্ত্বেও একই সঙ্গে প্রথা নির্ভর এই সামাজিক প্রতিষ্ঠান যে জনসমাজের নিজস্ব শক্তি ও ক্ষমতার স্ফুরণ ও বিকাশকে রক্ষা, লালন ও প্রকাশ করেছে সে সত্যকেও অস্বীকার করা যায় না। নওয়াবী আমলে বাংলার কুটীর শিল্পের বিস্ময়কর বিকাশ যে পঞ্চায়েতের রক্ষাব্যূহ থাকাতেই সম্ভব হয়েছিল সেটা সহজেই অনুমান করা যায়।
পঞ্চায়েতের মাধ্যমে উপমহাদেশের জনসমাজের স্থানিক ও গোষ্ঠীগত আত্মশাসনের ক্ষমতার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল তাকে বলদর্পী এবং স্বৈরতান্ত্রিক মোগল রাষ্ট্রও নিজ স্থিতির স্বার্থে সাধারণভাবে মেনে নিয়েছিল। আপাত দৃষ্টিতে মোগলদের মত চরম স্বৈরতান্ত্রিক না হয়েও ব্রিটিশ আমলাতান্ত্রিক-উপনিবেশবাদী শাসকরা পঞ্চায়েতের অবসান ঘটাতে পেরেছিল। কারণ, উপনিবেশ শাসনের জন্য তাদের ছিল অধিকতর শক্তিশালী রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং উন্নততর প্রযুক্তি ও যন্ত্র। তারা তাদের প্রবলতর শাসন যন্ত্র, প্রযুক্তি এবং রেল লাইন, টেলিগ্রাফ ইত্যাদির মাধ্যমে উপমহাদেশের জনসমাজের যা কিছু নিজস্ব ছিল সবগুলিকেই ধ্বংস এবং আত্মসাৎ করল।
জনসমাজের আত্মশক্তি ও স্বকীয় গতিশীলতার অবসানের সঙ্গে প্রথা নির্ভর পঞ্চায়েতমূলক স্বশাসন ব্যবস্থারও অবসান হল। কিন্তু উৎপাদন ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে শ্রম ও কর্ম বিভাজনের ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণজাতি প্রথার ভূমিকা বিদায় নিলেও সমাজ রক্ষা ও নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হিসাবে বর্ণজাতি প্রথা রয়ে গেল। বাস্তবে সমাজ যখন তার শক্তি হারিয়ে নিঃস্ব হল এবং তার সামনে আর কোন উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখল না তখন তা অধিকতর দৃঢ়তার সঙ্গে আশ্রয় নিল তার অতীতের ভাবাদর্শের জগতে, তার ধর্মের জগতে।
পঞ্চায়েত ছিল উপমহাদেশের জনসমাজের স্বশাসনের এমন একটি ব্যবস্থা যার উৎস আমরা হাজার হাজার বৎসর পূর্বে খুঁজে পেতে পারি। হয়ত পঞ্চায়েতমূলক শাসন ছিল সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র্র ও সমাজ শাসনের মূল রূপ। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ সিন্ধু সভ্যতার গণতান্ত্রিকতা ও অহিংস বৈশিষ্ট্যের প্রতি যে ইঙ্গিত দেয় সেটা আবার রাষ্ট্র শাসন এবং জনসমাজের স্বশাসনের একটি রূপ হিসাবে পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থার প্রতিও ইঙ্গিত দেয়। এটাও একটা চমকপ্রদ আলোচনার বিষয় হতে পারে। বারান্তরে সে চেষ্টা করা যাবে।