লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ August 24, 2015, 12:00 AM, Hits: 1102
প্রকৃতির কোলে মানুষ যখন আদিম শিকারী ও খাদ্য সংগ্রাহকের জীবনে ছিল তখন যেমন তার বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত ছিল গোষ্ঠীবদ্ধতা বা যুথবদ্ধতা তেমন আজ সভ্যতার শিখরে পৌঁছেও মানুষের বেঁচে থাকার পূর্বশর্ত হচ্ছে গোষ্ঠীবদ্ধতা বা যুথবদ্ধতা। এটাই তার সমাজবদ্ধতা। যে কোনও নামে হোক মানুষ টিকে থাকে গোষ্ঠীর আশ্রয় নিয়ে। যদি কোনও মানুষের পিছনে কোনও ধরনের গোষ্ঠীগত বা সামাজিক সমর্থন বা আশ্রয় না থাকে তবে তার পক্ষে টিকে থাকা সম্ভব হয় না। একা মানুষ কী করতে পারে? তাই সভ্যতা নির্মাণেরও পূর্বশর্ত এই গোষ্ঠীবদ্ধতা।
এই গোষ্ঠীবদ্ধতা বিভিন্ন রূপ নিয়ে থাকে। এক সময় আদিম জীবনে এটা ছিল উপজাতি এবং গোত্র। এখন এটা পরিবার, সমাজ, জাতি এবং বিভিন্ন নামে ও প্রক্রিয়ায় গোষ্ঠী, যেমন রাজনৈতিক দল, কোনও সামাজিক সংগঠন, ক্লাব, ধর্ম সম্প্রদায় ইত্যাদি যে কোনওটি হতে পারে। একই মানুষ ভিন্ন ভিন্ন প্রক্রিয়ায় ও ভাবে এই ভিন্ন ভিন্ন ধরনের গোষ্ঠীতে আবদ্ধ থাকতে পারে। যেমন একজন বাঙ্গালী জাতির মানুষ শুধু বাঙ্গালী নয়। তার একটা পরিবার থাকতে পারে। সে একটা বিশেষ রাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারে। সে একটা বিশেষ রাজনৈতিক দলের সদস্য হিসাবেও সমাজে ক্রিয়াশীল হতে পারে। সে জীবিকার প্রয়োজনে কোনও একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকতে পারে। সে একটি বিশেষ ধর্ম সম্প্রদায়ের সদস্য হিসাবেও ভূমিকা রাখতে পারে। এভাবে একজন ব্যক্তি বহু ধরনের গোষ্ঠীর আশ্রয় ও পরিচয় নিয়ে সমাজে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে। আবার ব্যক্তি তার গোষ্ঠী পরিবর্তনও করতে পারে, নূতন বা ভিন্ন গোষ্ঠীর আশ্রয় নিতে পারে। তবে সর্বাবস্থায় এক এক সময়ে ব্যক্তির এক এক ধরনের গোষ্ঠীরূপ প্রধান হয়ে উঠতে বা দেখা দিতে পারে। এখন কোনও না কোনও রূপে গোষ্ঠীবদ্ধ হয়েই মানুষকে সমাজে বেঁচে থাকতে এবং কাজ করতে হয়। যদি সে আপাতত দৃষ্টিতে একা বা নিঃসঙ্গও হয় তবু সে বেঁচে থাকে গোষ্ঠী বা বৃহত্তর সমাজের আশ্রয়ে বা আবেষ্টনেই। আর তাই তার ব্যক্তি হিসাবে যে কোনও ভূমিকাই শেষ বিচারে সামাজিক ভূমিকা হিসাবে দেখা দেয়।
আগে যখন দিগন্ত বিস্তৃত প্রচুর নির্জন অরণ্য ছিল তখন হয়ত সমাজ থেকে বহুদূরে অরণ্যের ভিতরে গিয়ে কেউ একা সন্ন্যাস জীবন যাপন করতে পারত। কিন্তু সেটা তো অসামাজিক এবং অনিশ্চিত জীবন। এখন সেই জীবনও কারও পক্ষে আর বেছে নেওয়া সম্ভব না। তবু কিছু মানুষ চায় সমাজকে অস্বীকার করে একা তার মত করে বেঁচে থাকতে। বাস্তবে সে হয়ত সমাজের সবকিছু না মেনে চলতে পারে তবে গোটা সমাজের বিরুদ্ধে একা দাঁড়িয়ে সে টিকতে পারে না। যদি পারে তবে বুঝতে হবে সমাজ একটা গোষ্ঠী হিসাবে তার এই ধরনের ভিন্নতাকে মেনে নিয়ে তাকে আশ্রয় দিচ্ছে বলে সে টিকে থাকছে। তেমন ক্ষেত্রে হয়ত দেখা যাবে সমাজের কিছু ব্যক্তি তাকে কোনও না কোনও ধরনের সংরক্ষণ বা পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে। সেটা দানের মাধ্যমে হোক, আশ্রয় ও খাদ্য প্রদানের মাধ্যমে হোক অথবা অন্য কোনও ভাবে হোক। এভাবে দেখা যাচ্ছে মানুষ একা হলেও একা নয়। তার একাকীত্ব একটা আপেক্ষিক ব্যাপার মাত্র। আর যেহেতু সে বেঁচে থাকে সমাজের সাহায্য এবং আশ্রয় নিয়ে সেহেতু সমাজের প্রতিও তার কিছু না কিছু দায়বদ্ধতা থাকে।
যাইহোক, আমাদেরকে গোষ্ঠী তথা সমাজের আশ্রয় নিয়েই বাঁচতে হবে। কিন্তু এই গোষ্ঠীর প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা যদি না থাকে তবে এই অনিশ্চিত ও প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে কী পরিণতি হতে পারে? সুতরাং আমরা রাষ্ট্রের আশ্রয় খুঁজি, যার থাকে প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা। অতীতের উপজাতির যে দায়িত্ব ছিল তার সদস্যদের প্রতি সভ্যতার পর সেই দায়িত্ব নিবার কথা রাষ্ট্রের।
এই রাষ্ট্রের প্রয়োজন একই সমাজ বা রাষ্ট্রের অন্য ব্যক্তি বা মানুষের আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষা, নিরাপত্তা লাভ এবং সম্পদ ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য, ব্যক্তির আত্মবিকাশের সুযোগ করে দেওয়ার জন্য। এই রাষ্ট্রের প্রয়োজন অন্য সমাজ বা রাষ্ট্রের হাত থেকে আমাদের ব্যক্তিগত ও সামষ্টিক নিরাপত্তার জন্য। এই রাষ্ট্রের প্রয়োজন আমাদের গোষ্ঠীগত পরিচয় নিয়ে পৃথিবীতে মর্যাদার সঙ্গে দাঁড়াবার জন্য। এই গোষ্ঠীগত পরিচয়টাই এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক জাতিগত পরিচয় হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু রাষ্ট্র যদি আমাদের নিরাপত্তা বিধান ও আত্মবিকাশের সুযোগ প্রদান না করে এবং মর্যাদার সঙ্গে ও ভালভাবে বেঁচে থাকার দায়িত্ব না নেয় তখন তার কোনও প্রয়োজন কি থাকে? থাকে না। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রতি আমাদের আনুগত্য অবশ্যই শর্তাধীন।