Banner
কোন আইনের শাসন চাই? – হাবিবুর রহমান

লিখেছেনঃ হাবিবুর রহমান, আপডেটঃ October 15, 2015, 12:00 AM, Hits: 1631

 


বিচারপতি, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজের প্রতিনিধি ও আইনজীবীদের অনেকেই দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। তারা মনে করেন দেশে যে সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বিরাজ করছে তা আইনের শাসন না থাকার ফলশ্রুতি। তারা আরও মনে করেন, দেশে প্রচুর ভাল আইন আছে কিন্তু তার প্রয়োগ নেই। এর পাশাপাশি অনেকের বক্তব্য হল বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডসহ বিচারহীনতার সংস্কৃতি আমাদের জীবনকে অসহনীয় অবস্থার মধ্যে নিক্ষেপ করেছে। এদের মতে আইনের শাসন এবং আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা পুনরুদ্ধার ছাড়া সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়।

 

আইনের শাসন অবশ্যই কাম্য। কিন্তু আইনের শাসনের দাবী জানাতে গিয়ে যে প্রশ্নটি আগে করা জরুরী তা হল আইনটি কেমন। আমরা কোন আইনের শাসনের কথা বলছি? এটা কি সাধারণ নাগরিকের মৌলিক মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে, না কি এটা গণবিরোধী কালো আইন তথা অগণতান্ত্রিক আইন? আবার যে প্রশ্নটা করা আরও জরুরী তা হল, কাদেরকে টিকিয়ে রাখার জন্য আইনটি প্রণয়ন করা হয়েছে। বা ব্যাপক সাধারণ জনগণের পক্ষে আইনের আশ্রয় নেবার কতখানি সক্ষমতা রয়েছে? এর চেয়েও বড় প্রশ্ন হল, আইন তৈরির আইন তথা সংবিধান ব্যাপক সাধারণ জনগণের স্বার্থ রক্ষা করে কি না তথা গণতান্ত্রিক সংবিধান কি না ।

 

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৪৯ নং অনুচ্ছেদ অনুযায়ী সংবিধান গৃহীত হওয়ার অব্যবহিত পূর্বে যে সকল আইন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বিদ্যমান ছিল, কার্যক্ষেত্রে তা সক্রিয় থাকুক বা না থাকুক, তার সব কিছুরই কার্যকারিতা অব্যাহত থাকবে। যেসব আইন ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল তাদের  ঔপনিবেশিক শাসন নিরুঙ্কুশ করা, অর্থনৈতিক লুণ্ঠন আর আন্দোলনকারীদের দমন-পীড়নের জন্য, যা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী একই উদ্দেশে, বাংলাদেশেও সেগুলো হুবহু কার্যকর করা হয়। যা ছিল ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মূলমন্ত্র, যে আকাঙ্ক্ষায় দেশের মানুষ পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, যে সমাজ গড়বে বলে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতা মুক্তিযুদ্ধে জীবন দিয়েছে, সে আকাঙ্ক্ষাগুলো সংবিধানের প্রস্তাবনায়, মূলনীতিতে লেখা হয়েছে ঠিকই, তবে কার্যক্ষেত্রে এসে ঔপনিবেশিক আমলের সকল অগণতান্ত্রিক আইন-কানুন বহাল রেখে এবং সেই সাথে নতুন কিছু অগণতান্ত্রিক আইন যুক্ত করে পাকিস্তান রাষ্ট্রটাই স্বাধীন দেশে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর একটি উদাহরণ হল ১৮৯৮ সালে ব্রিটিশ প্রবর্তিত ফৌজদারি কার্যবিধি যার কার্যকারিতা আজ অবধি অব্যাহত আছে। ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৬(৩) ধারার আড়ালে থেকে যদি পুলিশ গুলি করে কাউকে খুন করে আর তা যদি প্রশাসনিক তদন্তে যথাযথ বলে প্রতীয়মান হয়, তবে তা হবে আইনের প্রতিপালন মাত্র। এভাবে আজকাল হরহামেশাই এনকাউন্টার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে গল্প আমরা দেখি এবং এতদসংক্রান্ত যেসব প্রেসনোট জনগণের উদ্দেশ্যে প্রকাশিত হয় তার সবকিছুরই আইনগত ভিত্তি সংবিধানেই রয়েছে। এরকম ফৌজদারি কার্যবিধি, দণ্ডবিধি, পুলিশ রেগুলেশন বা অন্য কিছু যা ব্রিটিশরা তৈরি করেছিল এখানকার জনগণকে শাসন আর আন্দোলনকারীদের দমন-পীড়নের জন্য, যা অব্যাহত রেখেছিল পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী একই উদ্দেশ্যে, বাংলাদেশেও তা হুবহু কার্যকর আছে।

 

বাংলাদেশের সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদ ‘মৌলিক অধিকার’ ( তৃতীয় ভাগ ) অধ্যায়ের অন্তর্ভুক্ত। সংবিধান ও আইনের দিক থেকে যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হোল এই অনুচ্ছেদ কিন্তু মৌলিক অধিকার রক্ষার বিধান নয়, বরং উল্টোটা। রাষ্ট্র কখন মৌলিক অধিকার হরণ করবে সেসব বিধানেরই একটি। এটিই দায়মুক্তির সাংবিধানিক বিধান বা সংসদে ইনডেমনিটি বিল প্রণয়নের সাংবিধানিক ক্ষমতা। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণ যদি কোন অঞ্চলে শৃঙ্খলা রক্ষা বা পুনর্বহালের প্রয়োজনে কোন কার্য করে তবে তাকে আইনের মাধ্যমে দায়মুক্ত করা যাবে। ‘শৃঙ্খলা রক্ষা’র জন্য যদি কাউকে হত্যাও করা হয়, তবু শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীকে আইনের মাধ্যমে দায়মুক্ত করা যাবে। সংবিধানের ৪৬ অনুচ্ছেদটির বলে এনকাউন্টার, ক্রশফায়ারের নামে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের যে হোলি খেলা চলছে এদেশে তা কিন্তু ঔপনিবেশিক ভারত শাসন আইন থেকে নেয়া। ভারত ও পাকিস্তানের গণপরিষদ এটি হুবহু নকল করেছিল, বাংলাদেশের সংবিধানেও সেই ভাষাই আছে শুধু ‘মার্শাল ল’ কথাটা নাই।

 

বাংলাদেশে স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট বা বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ বিভিন্ন গণবিরোধী আইন বহাল আছে। স্পেশাল পাওয়ার অ্যাক্ট কালাকানুন হিসেবে ব্যাপক পরিচিতি পেয়েছে। এবং এই আইনটি বাতিলের দাবিও বহুদিনের। এই আইনের বলে পুলিশ  ইচ্ছে করলে বা সন্দেহের বশে যে কাউকে আটক করতে পারে, নির্দোষ নাগরিকদের জেলের ভাত খাইয়ে আনতে পারে।  যারা এই আইনে জেলে ঢুকেছেন তাদের শতকরা নিরানব্বই ভাগের আটকাদেশ উচ্চ আদালতে অবৈধ বলে প্রমাণিত হয়েছে। কেননা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমলা বা পুলিশ কোন কারণ দেখাতে পারে না।  অবশ্য উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার আর্থিক সক্ষমতা দরিদ্রদের থাকে না। তাই এই আইনে টাকাওয়ালাদের জেলে রাখা যায় না। কিন্তু যারা গরিব, উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হওয়ার আর্থিক সক্ষমতা যাদের নেই তাদেরকে ঠিকই জেলে রাখা যায় দীর্ঘ দিন। আর সংবিধানের আলোকেই এসব আইন সংসদ প্রণয়ন করেছে।

 

বাংলাদেশ পৃথিবীর বহুল দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের একটি। দুর্নীতিতে পাঁচবার শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ। বর্তমানে সূচকের কিছুটা উন্নতি হলেও তা উল্লেখ করার মত নয়। দুর্নীতির কারণে প্রতিবছর ক্ষতি হচ্ছে জিডিপি’র প্রায় ২ - ২.৫%। আবার  টিআইবি’র সমীক্ষা অনুসারে বাংলাদেশে দুর্নীতির প্রধান ক্ষেত্র হচ্ছে সরকারী ব্যয়। অথচ আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রের আয়ব্যয়কে প্রশ্নের ঊর্ধ্বে, আদালতের এখতিয়ারের বাইরে রাখা হয়েছে। রাষ্ট্রের বিভিন্ন বৃহৎ আর্থিক প্রকল্পের দায়মুক্তির বিধান করা হয়েছে। এভাবে আইনের হাত ধরেই এদেশে বিকশিত হয়েছে লুটপাট ও দুর্নীতির কালো অর্থনীতি। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকে এ ধারাই ধীরে ধীরে পুষ্ট হয়ে আজ সর্বগ্রাসী রূপ নিয়েছে। এই কালো অর্থনীতি বজায় রাখা ও পুষ্ট করার জন্যই একটি দুর্বৃত্তায়িত অগণতান্ত্রিক  রাজনীতি বিকাশ লাভ করেছে।

 

আইন যদি লুটেরাদের হয়, আইন যদি গণবিরোধী হয় এবং সংবিধান যদি সেইসব আইনের পৃষ্ঠপোষকতা করে তবে দেশে তথাকথিত ‘আইনের শাসন’ যত প্রতিষ্ঠিত হবে ততবেশি দেশের নিরাপরাধ সাধারণ মানুষ আইনি নির্যাতনের শিকার হবে। আর তার বিপরীতে লুটেরা, খুনি, দুর্নীতিবাজরা রাষ্ট্রীয় ও আইনি মদতে বড় থেকে আরও বড় সম্পদশালী হবে, ক্ষমতাশালী হবে। সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য হ্রাস না পেয়ে বরং বাড়তে থাকবে। বাড়তে থাকবে ধনী-গরিবের বৈষম্য।

 

এদেশে ব্যাপক মানুষের মধ্যে আইন সম্পর্কে রয়েছে চরম বিভ্রান্তি। আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রত্যেকটি বিষয়ই যে আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হয়, অত্যন্ত সুকৌশলে তা জনগণের কাছ থেকে আড়াল করা হয়। প্রায়শই ‘আইনের শাসন’ আর ‘ন্যায় বিচার’কে সমার্থক করে প্রচার করা হয়। এ বিভ্রান্তি থেকে আমাদের মুক্ত হতে হবে। ভালো আইন যেমন আছে, তেমনি গণবিরোধী আইনও আছে। একটি দেশের সংবিধানের আলোকে আইন তৈরি করা হয়। অর্থাৎ সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক কোন আইন প্রণয়ন করা যায় না। ফলে কোন রাষ্ট্রে গণবিরোধী আইন বহাল বহাল থাকা মানে ঐ রাষ্ট্রের সংবিধান মৌলিক মানবাধিকার বিরোধী। আবার সংবিধান গণবিরোধী হলে এর আলোকে প্রণীত আইন গণবিরোধী হয়ে থাকে। বাংলাদেশের বিদ্যমান সংবিধান ও আইনের অধীনে থেকে কেউ যদি আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার দাবি জানান তবে তিনি প্রকৃত অর্থে অগণতান্ত্রিক শাসন ও কালো অর্থনীতি বজায় রাখার পক্ষে অবস্থান করেন। তার যত সদিচ্ছা থাকুক না কেন, আসলে তিনি দেশে সামাজিক অস্থিরতা ও নৈরাজ্য বিরাজে সহযোগিতা করছেন। তিনি বাংলাদেশের অগণতান্ত্রিক শাসক শ্রেণীর হাতে তৈরি অগণতান্ত্রিক আইনের শাসন কায়েম করার জন্যই বদ্ধপরিকর হয়ে উঠেছেন। সুতরাং আমরা যদি প্রকৃত আইনের শাসন চাই, তবে গুম-খুন-নির্যাতনকারী, জনসম্পদ-জনঅধিকার ও জাতীয় সম্পদ লুটপাটকারীদের মদত দেয়ার ঔপনিবেশিক আইন নয়, প্রবলের অত্যাচার থেকে দুর্বলকে রক্ষা এবং জনগণের সম্পদের পাহারাদারদের পৃষ্ঠপোষকতা করার গণতান্ত্রিক আইন প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

 

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল পঠিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অঙ্গীকার করা হয়েছিল সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলা হবে। বাংলাদেশের রাষ্ট্র, রাজনীতি, আইন ও বিচার ব্যবস্থার গোড়ায় গলদ হচ্ছে শুরু থেকে সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার কায়েম ও চর্চার উপযোগী গণমানুষের রাষ্ট্র গড়ে তোলার প্রক্রিয়া দাঁড় করানো হয় নি, বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা যায় নি। সুতরাং ব্যাপক গণমানুষের পক্ষের আইনের শাসন কায়েম করার জন্যই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত অঙ্গীকার বাস্তবায়ন আমাদের জন্যে প্রধান কর্তব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।  
 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ