লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ October 19, 2015, 12:00 AM, Hits: 1604
মোড় পরিবর্তনের মুখে পৃথিবী
পৃথিবী কি বড় ধরনের পরিবর্তনের দিকে মোড় নিল? ১৯৯১-তে চূড়ান্তভাবে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন ও বিলুপ্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে যে একমেরুকৃত বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তা কি এবার ভেঙ্গে যাচ্ছে? গত ৩০ সেপ্টেম্বর, ২০১৫-তে সিরিয়ায় আইএস বা ইসলামিক স্টেটের ঘাঁটিগুলির উপর রাশিয়ার সফল বিমান হামলা শুরুর পর এই প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবে বিশ্বজুড়ে উঠেছে।
চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে আরবে প্রবর্তিত ধর্মের পথ ধরে ভয়ঙ্কর ও নৃশংস খুন, ধর্ষণ, দাসকরণ, বিশেষত অমুসলিম নারীদেরকে ধরে নিয়ে গিয়ে যৌনদাসী হিসাবে বাজারে কেনাবেচা এবং ভিন্ন ধর্ম ও শিয়া মুসলিমসহ ভিন্ন মতাবলম্বীদের উপর নির্যাতনের চিত্র সারা পৃথিবীতে তুলে ধরে আইএস শুধু আতঙ্ক নয়, উপরন্তু সারা পৃথিবীর কাণ্ডজ্ঞান সম্পন্ন মানুষের ঘৃণাও কুড়িয়েছে। ইরাক ও সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন তাদের দখলে। পাশ্চাত্যের বিশেষত মার্কিন অস্ত্রে বলীয়ান হয়ে তারা এখন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নানানভাবে এই অস্ত্র তারা সংগ্রহ করেছে। যে রণসম্ভার আমেরিকানরা ইরাকে রেখে গিয়েছিল তার বিরাট অংশই তাদের হাতে। সিরিয়ায় বাশার আল আসাদ সরকারকে হঠাবার জন্য সেখানে তার বিরোধীদের হাতে আমেরিকা এবং পাশ্চাত্য সামরিক জোট তথা ন্যাটো যে বিপুল অস্ত্র দিয়েছিল সেগুলিরও প্রায় সবটা আইএস কিংবা আল কায়েদা সংশ্লিষ্ট আল নুসরার হাতে। আল নুসরা যে আল কায়েদার সংশ্লিষ্ট সেটা জানা সত্ত্বেও পাশ্চাত্য তাদেরকে সব রকম সাহায্য করে। কারণ আমেরিকা যে কোনও মূল্যে সিরিয়ার স্বাধীন চেতা আসাদ সরকারের পতন ঘটাতে চেয়েছে।
শুধু সিরিয়া নয়, উপরন্তু সিরিয়া এবং ইরাকের বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন আইএস-এর অধিকারে, যারা সেখানে এখন খেলাফত প্রতিষ্ঠা করেছে এবং শরীয়া বা খাঁটি ও আদি ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সেই আইন অনুযায়ী তাদের খেলাফতী রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। তাদের নৃশংসতা ও অমানবিকতা সম্পর্কে এখানে নূতন করে কিছু বলার নাই। আধুনিক প্রচার মাধ্যমের কারণে এটা বিশ্বব্যাপী সবার জানা।
আইএস-এর উত্থানের পিছনে সরাসরি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা শক্তিবর্গের হাত কতটা ছিল সেটা নিশ্চিত করে বলা যায় না। তবে এটা ঠিক যে ইরাক, সিরিয়া ও লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডের পরিণতি হচ্ছে সংক্ষেপে এবং সাধারণভাবে পরিচিত ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস-এর উত্থান। মার্কিন নেতৃত্বাধীন শক্তিবর্গ গণবিধ্বংসী অস্ত্রভাণ্ডারের মিথ্যা অজুহাত তুলে সাদ্দামের ইরাক আক্রমণ করে এবং ইরাককে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করে। এরপর মার্কিন সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট সাদ্দামকে বন্দী ক’রে তাদের অনুগত সরকারের মাধ্যমে বিচারের প্রহসন করে বন্দী সাদ্দামকে ফাঁসী দেয়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশে দেশে সরকার পরিবর্তন ঘটাতে চেয়ে ২০১০-এ তিউনিসিয়ায় সূচিত আরব বসন্ত নামক সরকার বিরোধী গণ-অভ্যুত্থানগুলিকে উস্কে দিল। পরিণতিতে মিসর এবং তিউনিসিয়ায় সরকার পরিবর্তন হল। কিন্তু আরও পূর্বে সংঘটিত ইরাকের ঘটনা ছিল ভিন্ন। ২০০৩ সালে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর আক্রমণ ঘটিয়ে সাদ্দাম সরকারের শুধু পতন ঘটানো হল না সেই সঙ্গে বাথ সমাজতান্ত্রিক পার্টির নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে ইরাকে যে উন্নত অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল তাকে প্রায় পুরাপুরি ধ্বংস করে ফেলা হল। শক্তিশালী বাথ পার্টিকে ক্ষমতাচ্যুত করে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়া হল। সেই সঙ্গে বিরাট ও শক্তিশালী ইরাকী সেনাবাহিনীকেও ছত্রভঙ্গ করা হল।
এখানে আর একটা বিষয় বলা উচিত হবে যে, সাদ্দাম ছিলেন সুন্নী মুসলমান এবং তার শাসনামলে বাথ পার্টি এবং ইরাকের শাসন ক্ষমতায় সুন্নীদের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু বাথ পার্টির শাসনামলে ইরাক ছিল মূলত সেকিউলার কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ। তবে রাষ্ট্রে সুন্নীদের প্রাধান্য থাকায় শিয়াদের ক্ষোভ ছিল। শিয়ারা ছিল ইরাকের জনসংখ্যার প্রধান অংশ। মার্কিন আগ্রাসনে বাথ পার্টি এবং সাদ্দামের পতনের পর রাষ্ট্র শাসনে শিয়াদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। মজার ব্যাপার হল এই শিয়ারা রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়ে এবং মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর মার্কিন-শত্রু শিয়া ইরানের সঙ্গে হাত মিলায়। এভাবে বলা যায় ইরাকে শেষ পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের কূটনীতি ব্যর্থ হয়।
যাইহোক, মার্কিন আগ্রাসনে ইরাকের সামগ্রিক অর্থনীতি, অবকাঠামো এবং সামাজিক বিপর্যয়ের ফলে ইরাকে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয় তা পূরণ করে সুন্নীদের নিয়ে গঠিত আইএস, এবং বঞ্চিত ও বিপর্যস্ত সুন্নী জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ ও রোষের ভিত্তির উপর দাঁড়ায় আইএস-এর চরম প্রতিক্রিয়াশীল ও অমানবিক ধর্মীয় রাজনীতি। বাথ পার্টির সেকিউলার ও আধুনিক রাজনীতির জায়গা নিল চরম পশ্চাৎপদ ও ভয়ঙ্কর প্রতিক্রিয়াশীল ইসলামী রাজনীতি।
একদিকে, ইরাকে যখন আইএসের উত্থান ঘটছে, অপর দিকে, সিরিয়ায় তখন পাশ্চাত্যের সাহায্য ও সমর্থন পুষ্ট হয়ে বাথ পার্টির আসাদ সরকার বিরোধীরা সশস্ত্র বিদ্রোহ করে। ক্রমে দেখা গেল এই বিদ্রোহের নিয়ন্ত্রণও প্রধানত আইএসের হাতে চলে গেছে। তার আগে অবশ্য লাদেন অনুসারী আল কায়েদার সংশ্লিষ্ট আল নুসরাও এই বিদ্রোহে ছিল এবং এখনও তারা আছে। পাশ্চাত্য এদের সবাইকে অকৃপণভাবে অর্থ ও অস্ত্র সরবরাহ করেছিল। পরবর্তী কালে দেখা যাচ্ছে এই সব অর্থ ও অস্ত্র দ্বারা সবচেয়ে লাভবান হয়েছে আইএস। অবশ্য বাজারে ব্যাপক প্রচার আছে যে সিরিয়ায় আইএসের মূল অস্ত্র সহায়তাকারী হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ন্যাটো বা পাশ্চাত্য। এ সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে এখনও কিছু বলা না গেলেও এইটুকু বলা যায় যে আইএসের ভূমিকার ফলে আসাদের পতন ত্বরান্বিত হলে তারা খুশী হত।
এখানে অবশ্য মধ্যপ্রাচ্যের আর একটি বাস্তবতাকে আমাদের হিসাবে নেওয়া দরকার। সেটা হচ্ছে শিয়া-সুন্নীর বিরোধ। এটা একটা ঐতিহাসিক বিরোধ। বিশেষত মতবিরোধের কারণে প্রায় চৌদ্দশত বৎসর যাবত শিয়াদের উপর সুন্নীদের দিক থেকে ভয়ঙ্কর অত্যাচার হয়েছে। এসব ইতিহাস যখন পড়া যায় তখন শরীর শিহরিত হয় এবং মন ব্যথিত হয়। তখন বুঝা যায় ইসলাম কী জিনিস! এবং তা মানব জাতিকে কী উপহার দিয়েছে! এক সময় ইউরোপেও খ্রীষ্টানদের মধ্যে ক্যাথলিক-প্রোটেস্ট্যান্ট দ্বন্দ্ব-সংঘাতে লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারিয়েছিল। কিন্তু সেই সহিংসতা যে মুসলমানদের সহিংসতার সঙ্গে তুলনীয় নয় নির্মোহভাবে ইতিহাস পড়লে সেটা বুঝা যায়।
উমাইয়া ও আব্বাসীয় শাসনামল থেকে তুর্কী খলীফাদের শাসনামল পর্যন্ত অগণিত শিয়াকে হত্যা করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের বাড়ীঘর ও সম্পদ লুণ্ঠন, ধর্ষণ এবং দাসকরণ তো স্বাভাবিক ব্যাপার ছিল। কারণ তাদেরকে সুন্নী মত অনুযায়ী কাফের হিসাবে বিবেচনা করা হত। বিশেষত ইরাক ও ইরান অঞ্চলে এমন সব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে যাতে লক্ষ লক্ষ শিয়া নিহত হয়। এর পরেও কিন্তু ইসলামের শিয়া মতবাদের প্রসারকে রোধ করা যায় নাই। বর্তমানে শুধু যে ইরান শিয়া অধ্যুষিত তা-ই নয়, অধিকন্তু আরও অনেক দেশে জনসংখ্যার এক উল্লেখযোগ্য অংশ শিয়া মতাবলম্বী মুসলমান, যারা ইসলামের নবী মুহাম্মদের পরই তার চাচাত ভাই এবং জামাতা আলীকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়। একটু আগেই ইরাকে শিয়া মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার কথা বলেছি। ইরাকে এখন সুন্নীদের পাশ্চাত্য বিরোধী রাজনীতি শিয়া বিরোধী রাজনীতিতে পরিণত হয়েছে। অন্যদিকে, সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদ সেখানকার সংখ্যালঘু শিয়া সম্প্রদায়ের সমর্থনের উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছেন। সিরিয়ায় সুন্নীরা সংখ্যাগুরু।
অনেক বিশ্লেষক ধারণা করেন পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ প্রত্যক্ষভাবে আইএস-কে সমর্থন বা সাহায্য না করলেও সিরিয়ায় শিয়া সমর্থনপুষ্ট আসাদ সরকারকে উৎখাত করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে পাশ্চাত্য অনুসারী সৌদী আরব, কাতার, কুয়েত ও আরব আমীরাতের সুন্নী রাজতন্ত্রগুলি আইএসকে বিপুল পরিমাণ অর্থ এবং অস্ত্র সাহায্য করেছে। আইএস যে বিশেষ করে সৌদী আরবের রাষ্ট্রীয় সাহায্য লাভ করেছে শুধু তা-ই নয়, উপরন্তু সেখানকার ধনী ব্যক্তিদেরও অনেকের নিকট থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য লাভ করেছে বলে মনে করা হয়। বলা হয় যে, অন্যান্য ধনী আরব দেশগুলির ধনীরাও তাকে অর্থ দিয়েছে। তবে এখন আইএস-এর হাতে বিপুল অর্থ। কারণ তার হাতে ইরাক-সিরিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চল এবং বিশেষ করে ইরাকের তেলক্ষেত্রগুলির একটি বড় অংশ চলে গেছে। এই তেলের সবচেয়ে বড় ক্রেতা এখন পশ্চিম ইউরোপ। তেল থেকে এখন আইএস-এর বিপুল আয়। নিয়মিত কর আদায় এবং তেল বিক্রির অর্থ ছাড়াও বিভিন্ন সূত্রে আসা বিপুল অর্থ এখন তাদের হাতে। ফলে তারা এখন ইসলামের নবী মুহাম্মদ ও খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ অনুসরণ করে খাঁটি ইসলামী কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করছে। ইসলামের প্রকৃত আদর্শের অনুসরণে রাষ্ট্র পরিচালনা করলে তার রূপ ও চরিত্র কেমন হতে পারে তা কিছুটা আফগানিস্তানে মুজাহিদীন আর তালেবান আর আরও ভালভাবে ইরাক-সিরিয়ায় আইএস দেখিয়েছে। এদিকে আইএস-এর প্রভাব বিশেষ করে সুন্নী ইসলামী জগতের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে। লিবিয়া ও নাইজিরিয়াসহ উত্তর আফ্রিকার দেশগুলিতে ভয়ঙ্করভাবে ইসলামী জঙ্গীবাদের উত্থান ও প্রসার ঘটছে।
এমন এক অবস্থায় আইএস-এর বাড়বাড়ন্ত অবস্থাকে দমন করার সংকল্প ঘোষণা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার অনুগত পশ্চিম ইউরোপের শক্তিবর্গ। গত বৎসর অর্থাৎ ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বর মাস থেকে এ বৎসর অর্থাৎ ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশেষ করে মার্কিন বাহিনী সিরিয়ায় আইএস-এর সামরিক অবস্থানগুলির উপর কয়েক হাজার বার বিমান হামলা চালায়। এই এক বৎসর সময়ে আইএস-এর শক্তি তাতে এতটুকু হ্রাস পায় নাই, এমনকি তার আদৌ তেমন কোন ক্ষতি হয়েছে বলেও জানা যায় না। বরং সিরিয়া সরকারের পক্ষ থেকে অনেক বার বলা হয়েছে এইসব আক্রমণের অনেকগুলিরই লক্ষ্য ছিল সিরিয়ার সরকারের নিজস্ব সামরিক ঘাঁটি বা স্থাপনাসমূহ। ঘটনা যেটাই হোক পাশ্চাত্য বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে সিরিয়া সরকারকে যত রকমভাবে সম্ভব হেনস্থা করতে এবং তার পতন ঘটাতে যথাসাধ্য করেছে তাতে সন্দেহ নাই। নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের ন্যায়-নীতি বোধ কতটা সেটা আমরা সবাই জানি।
মধ্যপ্রাচ্যে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিতে মার্কিন স্বার্থ
এখন যে প্রশ্ন আমাদের সামনে আসে তা হল সিরিয়ার আসাদ সরকারের পতন ঘটাবার জন্য পাশ্চাত্যের এবং বিশেষত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এমন মরীয়া হবার কারণ কী। এ নিয়ে অনেক ব্যখ্যা-বিশ্লেষণ হয়েছে। সেগুলি থেকে যে বিষয়টি সহজে বোধগম্য সেটা হল মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের আধিপত্য নিশ্চিত করা। মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য চারটি বেয়াড়া রাষ্ট্র ছিল। অন্য সবই মার্কিন নিয়ন্ত্রণাধীন। বেয়াড়া চারটি রাষ্ট্র হল ইরাক, ইরান, সিরিয়া এবং লিবিয়া। এর মধ্যে ইরাক, লিবিয়াকে সরাসরি সামরিক হামলা চালিয়ে ধ্বংস করা হয়েছে। ইরাকের অবস্থা কিছুটা বলেছি। তবে লিবিয়া নিয়ে তেমন আলোচনা করি নাই। ২০১১ সালে ভিতর থেকে গাদ্দাফির বিরুদ্ধে সশস্ত্র বিদ্রোহ সংগঠিত ক’রে এবং বাহির থেকে বিমান হামলা চালিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ লিবিয়াকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করেছে। ইসলামী জঙ্গীবাদ, উপজাতীয় সহিংসতা এবং রাষ্ট্র বা কেন্দ্রীয় সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতায় আক্রান্ত লিবিয়ার দুর্গতি নিয়ে এখানে নূতন করে আলোচনা অনাবশ্যক।
যাইহোক, আমেরিকার অগ্রাভিযানের পথে বাধা হয়েছিল সিরিয়া। ২০০৩-এ ইরাকে যেভাবে বিনা বাধায় অভিযান চালানো গিয়েছিল এমনকি ২০১১-তে লিবিয়ায়ও যেভাবে ন্যাটোর বিমান হামলা চালিয়ে ধ্বংসলীলা চালানো গিয়েছিল সিরিয়ায় সেটা আর পারা যায় নাই প্রধানত রাশিয়ার বাধার কারণে। ১৯৯১-এ সোভিয়েতের পতনের সময় থেকে রাশিয়ার অর্থনীতি ও রাজনীতিতে বিপর্যয় ঘটে। তার ফলে রাশিয়ার পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বলিষ্ঠ কোনও ভূমিকা নেওয়া সম্ভব হয় নাই। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার দৃঢ় মিত্র আসাদ ও সিরিয়া রক্ষার জন্য রাশিয়া তার সর্বোচ্চ শক্তি নিয়োগে প্রস্তুত ছিল। সুতরাং এখানে আমেরিকা সরাসরি হামলা না করে ফ্রী সিরিয়ান আর্মি, আল নুসরা ইত্যাদি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে জন্ম দেয় অথবা লালন করে। এদের কাজ হবে বিদ্রোহের নামে সিরিয়াকে ভিতর থেকে শেষ করে দেওয়া। এই প্রক্রিয়ায় একটা পর্যায়ে আইএস-এর উত্থান ও প্রসার ঘটে। হতে পারে যে আইএস-ও মার্কিন সৃষ্টি। অনেক বিশ্লেষক দৃঢ়তার সঙ্গে সে কথা বলেনও। সাম্প্রতিক বেরিয়ে আসা তথ্যও সেই দিকেই ইঙ্গিত দেয়।
যাইহোক, সিরিয়া রক্ষায় রাশিয়া যে শুধু দৃঢ় ছিল তা-ই নয়, ইরানেরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। কারণ আমেরিকার পরবর্তী লক্ষ্যবস্তু ছিল ইরান। মধ্যপ্রাচ্যে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সিরিয়ার পর প্রধান বাধা ছিল ইরান। সিরিয়াকে দখল করতে পারলে ইরানকে আক্রমণ ও দখল করা সহজতর হত।
কিন্তু কেন ইরানকে দখল এত জরুরী? এটা ঠিক যে ইরান পাশ্চাত্য বিরোধী। পাশ্চাত্যের অবরোধ সত্ত্বেও তেল সমৃদ্ধ ইরানের উন্নয়ন উল্লেখযোগ্য। মধ্যপ্রাচ্যে বর্তমানে ইরান অর্থনীতি এবং সামরিক ক্ষেত্রে সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্র। এই রকম এক শক্তিশালী রাষ্ট্রের অবস্থান পাশ্চাত্যের আধিপত্যের জন্য নানাবিধ সমস্যা সৃষ্টি করলেও সেটা পাশ্চাত্যের জন্য হুমকি সৃষ্টি করে না। ইসরাইলের জন্য ইরানকে যেভাবে হুমকি বলা হয় সেটারও বাস্তব কতটা ভিত্তি আছে সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। হয়ত এসবেরই মূল্য প্রচার-যুদ্ধের জন্য।
তাহলে ইরানকে লক্ষ্যবস্তু করার কারণ কী ছিল? ইরানের ক্ষমতা নাই পাশ্চাত্যকে হুমকির সম্মুখীন করা। ইরান যতই বাগাড়ম্বর করুক সেই শক্তি ইরানের হবার কারণ নাই। আর এখন তো পরমাণু অস্ত্র না করার চুক্তিতেও ইরান স্বাক্ষর করেছে। সুতরাং পরমাণু অস্ত্রের ঝুঁকিও ইরানের দিক থেকে এখন নাই।
অনেক বিশ্লেষক মনে করেন আসল লক্ষ্যবস্তু ইরান নয়, বরং চীন। চীনের উত্থানে আতঙ্কিত আমেরিকা ইরানকে কব্জা করতে চেয়েছিল। ইরানকে কব্জা করতে পারলে মধ্যপ্রাচ্যের তেল পাবার উপায় চীনের জন্য বন্ধ করে দেওয়া যেত। আর তেল বন্ধ করতে বা তেল প্রাপ্তির সহজ উৎসগুলিকে কব্জা করতে পারলে বাইরের তেলের উপর নির্ভরশীল চীনের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে রাখা যেত। এই কারণে রাশিয়ার সঙ্গে চীনও দৃঢ়ভাবে সিরিয়া এবং ইরানের পক্ষে আগাগোড়া ভূমিকা রেখে আসছে।
সিরিয়ায় আসাদ সরকরের পতন হলে সেখানে যে বৃহত্তর বিশৃঙ্খলা ও মানবিক বিপর্যয় ঘটত তার সুযোগ নিয়ে ইরানে হস্তক্ষেপ ঘটানো সহজতর হতে পারত। এটা হতে পারত আমেরিকার জন্য একটা লাভ। অপর দিকে, ইসলামী জঙ্গীদের সাফল্যে ভবিষ্যতে রাশিয়ার অভ্যন্তরে মুসলিম অধ্যুষিত চেচনিয়া এবং দাগেস্তানের মত কিছু অঞ্চলে ইসলামী জঙ্গীবাদকে চালান দেওয়া সহজ হত। কিন্তু সঠিক মুহূর্তে সিরিয়ায় আইএস জঙ্গীদের উপর রাশিয়ার সফল বিমান হামলা আমেরিকার এত কালের সব পরিকল্পনা ও আয়োজনকে তছনছ করে দিল। এক বছরের বিমান হামলায় আমেরিকা যা করতে পারে নাই সাত দিনেরও কম সময়ের বিমান হামলায় রাশিয়া তা করেছে। আইএস-এর বহু সংখ্যক সামরিক স্থাপনা এখন বিধ্বস্ত, বহু আইএস সন্ত্রাসী নিহত এবং আরও বহু সংখ্যক পলায়নপর। কিছু সংখ্যক আইএস জঙ্গী সিরিয়া ছেড়ে পালাতেও শুরু করেছে। রাশিয়ার যা করার ছিল তা মোটামুটি করেছে। রাশিয়া স্থল বাহিনী যে পাঠাবে না সেটা স্পষ্ট করে রেখেছে। আফগানিস্তানের ভুল এখানে করবে না। এখন নামবে সিরিয়ান সেনাবাহিনী। নেমেছেও। এর সঙ্গে যুক্ত হতে শুরু করেছে ইরানের সেনাবাহিনী। এদিকে ইরাকেও চলছে আইএস-এর বিরুদ্ধে আক্রমণ। তবে সিরিয়ায় কয়েক দিনের মধ্যে লক্ষাধিক ইরানী সেনার নামবার কথা।
সুন্নী-শিয়া, আরব-অনারব দ্বন্দ্ব
এটা স্পষ্ট যে ইরাক-সিরিয়ার সুন্নী জঙ্গী সন্ত্রাসীদের দিন ঘনিয়ে আসছে। এটাও স্পষ্ট যে মধ্যপ্রাচ্যে যে সংঘাত চলছে তার মধ্যে রাজনীতি যেমন আছে তেমন প্রকাশ্যে বা গোপনে নানান ভাবে জড়িয়ে আছে ধর্ম। প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে নবী মুহাম্মদের মৃত্যুর পর পরই রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত শুরু হয় সেটাকে অবলম্বন করে আরব ও ইরানীদের দ্বন্দ্ব সুন্নী ও শিয়ার আড়াল নিয়ে এগিয়ে গেছে। আরব ও ইসলামের তরবারিকে মোকাবিলা করতে ইরান ব্যর্থ হয় এবং সভ্য ইরানীদেরকে বলপ্রয়োগে বাধ্য করা হয় বর্বর আরবদের ধর্ম ইসলামকে গ্রহণ করতে। ইরান বাধ্য হয়েছে ইসলামকে গ্রহণ করতে। ইরান ইসলাম গ্রহণ করেছে। কিন্তু সেই সঙ্গে মুহাম্মদের বংশ বা কুরাইশ উপজাতির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে ব্যবহার করে ক্রমে একটা ‘কিন্তু’ দাঁড় করিয়ে নিজ স্বাতন্ত্র্যকে কিছুটা হলেও রক্ষা করেছে। সেই কিন্তুটা হচ্ছে শিয়া মতবাদ।
ইরানীরা তাদের ধর্ম হারিয়েছে, তাদের ভাষার বর্ণমালা হারিয়েছে, তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছুকে হারিয়েছে। কিন্তু তাদের ভাষাকে অন্য অনেক জাতির মত হারিয়ে আরব হয়ে যায় নাই। ইরাক থেকে উত্তর আফ্রিকা পর্যন্ত বিস্তীর্ণ ভূভাগের বিপুল সংখ্যক মানুষের ভাষা আরবী হয়েছে। সুপ্রাচীন সভ্যতার উত্তরাধিকারী ইরাক ও মিসরও তাদের মাতৃভাষা ত্যাগ করে আরবী ভাষাকে গ্রহণ করেছে বা করতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু পারস্য বা ইরানী ভাষা আরবী লিপিতে লেখা হলেও ইরানীরা প্রাণ দিয়ে হলেও তাদের ভাষাকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রসঙ্গে এইটুকু বলি ইরানী ভাষায় লিখবার জন্য উমাইয়া শাসন আমলে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডে বিশেষ ভূমিকা ছিল ইরাকের এবং পারস্যের কিছু অংশের গভর্নর আল-হাজ্জাজ বিন ইউসুফের (৬৬১ খ্রীঃ- ৭১৪ খ্রীঃ)। কিন্তু এত হত্যা ও নির্যাতন করেও ইরানী ভাষাকে ধ্বংস করা সম্ভব হয় নাই।*
-----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* ইরানী পণ্ডিত ইয়াহ্ইয়া আরমাজানী বলছেন, ‘উমাইয়া খলিফাদের মধ্যে সবচাইতে দেশহিতৈষী ছিলেন বোধ হয় আবদ আল-মালিক, যিনি তাঁহার ভৃত্য ইরানের শাসনকর্তা হাজ্জাজের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আদেশ জারি করেন যে, অতঃপর শাসনকার্যের সমস্ত নথিপত্র পারস্য ও গ্রীক ভাষার পরিবর্তে আরবীতে লিখিত হইবে। তিনি আরবী অক্ষরযুক্ত নতুন মুদ্রা চালু করেন এবং জনসাধারণকে চিঠিপত্র আরবী ভাষায় লিখিতে বাধ্য করেন। কথিত আছে যে, পারস্য ভাষায় লিখিবার অপরাধে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেন।’
─ মধ্যপ্রাচ্য : অতীত ও বর্তমান ─ ইয়াহ্ইয়া আরমাজানী, মুহাম্মদ ইনাম-উল-হক অনূদিত, প্রকাশক : বাংলা একাডেমী, ঢাকা, দ্বিতীয় প্রকাশ : জুন, ১৯৮৪, পৃষ্ঠা : ১০৬।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
আমার মনে হয় আপাতত এইটুকু বিবরণই যথেষ্ট হতে পারে শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বের তাৎপর্য বুঝবার জন্য। সমাজ ও ইতিহাসের গতি বড় বিচিত্র। মানুষের মনোজগতে বিভিন্ন ঘটনার অভিঘাত কীভাবে শত শত বা হাজার হাজার বৎসর ধরে কত বিচিত্র রূপ নিয়ে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে তা ভাবলে বিস্মিতই হতে হয়।
সুন্নী ও শিয়ার ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব এখন মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা এবং রাশিয়া-চীনের মধ্যে দ্বন্দ্বের সঙ্গে জড়িয়ে জটিল রূপ ধারণ করেছে। এ বিষয়ে সন্দেহ নাই যে এই দ্বন্দ্ব আগামী দিনগুলিতে আরও জটিলতর ও ব্যাপকতর রূপ নিবে। বিশেষত শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব ইরান ও সৌদী আরবের মধ্যকার চূড়ান্ত সংঘাতে পরিণতি নিতে পারে। এই দ্বন্দ্বের ভিতরে ধর্ম থাকলেও রাজনীতিও আছে। অনেক সময় সেটাই প্রধান হয়ে উঠে। এই রাজনীতির মূলে আবার আছে আরব-অনারবের ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব।
যাইহোক, সংখ্যালঘু হলেও সৌদী আরবেও শিয়া আছে। তাদের উপর সুন্নী সন্ত্রাসীদের বোমা হামলা চলছেও। এদিকে ইয়েমেনে সৌদী নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর হামলা চলছে হুতি বাহিনীর উপর, যারা শিয়া এবং যারা এখন ইয়েমেন নিয়ন্ত্রণ করছে। এতকাল আমরা শিয়াদের দিক থেকে প্রত্যাঘাত কম দেখলেও পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে সেটা ব্যাপক আয়তনে ঘটতে পারে। বিশেষত সৌদী আরব এবং ইরানের মধ্যে এটা একটা নির্ধারক যুদ্ধে পরিণত হতে পারে। অবশ্য সৌদী আরবে এখন বহুসংখ্যক মার্কিন সেনা মোতায়েন রয়েছে। সৌদী আরবকে রক্ষায় তারা কতটা ভূমিকা রাখবে বা রাখতে পারবে সেটা সময় বলবে। এর মধ্যে আবার ইসরাইলের ভূমিকাকেও আমাদেরকে হিসাবে নিতে হবে। এখন ইসরাইল সৌদী আরবের পাশে আছে।
ইসরাইল
মধ্যপ্রাচ্যের দ্বন্দ্বে শুধু আমেরিকার ভূমিকাকে দেখলে চলবে না। আসলে আমেরিকার বৃহৎ বা কর্পোরেট পুঁজির এক বৃহৎ অংশের মালিক ইহুদীরা। পাশ্চাত্যের উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় থেকে সরাসরি সামনে থেকে ভূমিকা না রাখলেও এই উপনিবেশ ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার অন্যতম সুবিধাভোগী হয়েছে ইহুদী সম্প্রদায়ের একটি অংশ। প্রায় দুই হাজার বছর ইহুদী সম্প্রদায়ের হাতে রাষ্ট্র ছিল না। এক সময় তাদের বাসভূমি প্যালেস্টাইন থেকেও তাদের উৎখাত করা হয়েছিল। প্রায় দুই হাজার বছর রাষ্ট্রহীন হয়ে তারা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে গেছে। ইসলামের উত্থানের পর মূল আরব ভূখণ্ড থেকে তাদেরকে উৎখাত করা হয়। খ্রীষ্টানদের ইহুদীদের প্রতি বিদ্বেষ থাকলেও বিভিন্ন সময়ে তারা ইউরোপের দেশে দেশে বসতি গেড়ে থেকেছে। স্বাভাবিকভাবে তাদের ধর্ম তাদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সহায়ক হয়েছে। সংখ্যায় খুব সামান্য হলেও এটাই তাদেরকে ইউরোপের খ্রীষ্টীয় সমাজের মধ্যে বিলীন হতে দেয় নাই। তারা সেখানকার সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন থাকলেও ব্যবসা ও শিল্প উৎপাদনসহ অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড এবং শিক্ষামূলক ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনায় নিজেদেরকে নিয়োজিত করেছিল। খুব ক্ষুদ্র গোষ্ঠী হলেও এভাবে তারা ক্রমে ইউরোপের সমাজে বিশেষত উপরের তলায় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরী করে। বলা যায় ইউরোপীয় জ্ঞান ও বুদ্ধির অনেকটাই তাদের অবদান।
ইউরোপে রাষ্ট্র এবং ইউরোপের বাইরে উপনিবেশ বা সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব ও দায় তারা নেয় নাই, কিন্তু বুদ্ধিবৃত্তি বা জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বব্যবস্থার সুবিধা তারা ভোগ করেছে। এদেরই একটা অংশ আমেরিকায় অভিবাসন করে। বিশেষত হিটলারের উত্থানের পর তার ইহুদী নিধনযজ্ঞের (হিটলারের নির্দেশে ইউরোপে ষাট লক্ষ ইহুদীকে হত্যা করা হয়) ফলশ্রুতিতে জার্মানী ও ইউরোপের বেঁচে যাওয়া বহুসংখ্যক ইহুদী আমেরিকা তথা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসতি করে। এদের একটা অংশ বর্তমান মার্কিন অর্থনীতির অন্যতম প্রধান নিয়ন্ত্রণকারী। সুতরাং সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদী বিশ্বব্যবস্থার ধারাবাহিকতা হিসাবে বর্তমান বিশ্বপুঁজি বা বিশ্ব বাজার ব্যবস্থাকে দেখলে ইহুদী এবং সেই সঙ্গে ইহুদীদের বর্তমান রাষ্ট্র ইসরাইলের ভূমিকাকে বুঝতে সুবিধা হবে। এই কারণে ইরান-নীতির মত কিছু প্রশ্নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ইসরাইল-রাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব ঘটলেও সেটা বড় কোনও দ্বন্দ্বের রূপ নিবে এমন মনে করা অন্তত এখন পর্যন্ত ঠিক হবে না। ইহুদী স্বার্থ তথা ইসরাইলী স্বার্থ এখন পর্যন্ত সাধারণভাবে পাশ্চাত্য এবং আরও বিশেষভাবে মার্কিন স্বার্থ নির্ভর। অবশ্য ইহুদী বলতে আমি এখানে ঢালাওভাবে সব ইহুদী কিংবা সাধারণ ইহুদীদেরকে বুঝাচ্ছি না। ইহুদীদের নির্ধারক এবং নেতৃত্বকারী অংশটিকে বুঝাচ্ছি।
যাইহোক, এই আলোচনায় আমি ইহুদীদের বিষয়টাকে আনলাম বিশ্বপ্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতিকে বুঝবার সুবিধার জন্য। ইহুদীদের সঙ্গে এই মুহূর্তে সৌদী আরবের সখ্য দেখে ইহুদীদের সঙ্গে ইসলামের দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের সুদীর্ঘ ইতিহাসকে ভুললে চলবে না। এই মুহূর্তে ইসরাইলের স্বার্থ আমেরিকার সঙ্গে বাঁধা; সেটা কিন্তু সত্যের একটা দিক মাত্র। ইসলামের সঙ্গে তার দ্বন্দ্ব শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্বের মত কিংবা আরও কিছু বেশী প্রাচীন। মদীনায় মুহাম্মদের অভিবাসনের কিছু পর থেকেই ইহুদী উৎসাদন শুরু হয়। কাজেই এই ঐতিহাসিক দ্বন্দ্ব কখন কী রূপ নিবে এবং কোন দিকে মোড় নিবে তা বলা কঠিন। জীবন সর্বদা স্থূল অর্থনীতির নিয়মে চলে না। কাজেই সব সময় অর্থনীতির সমীকরণ সঠিক হয় না।
তবে এখন পর্যন্ত ইসরাইল এবং মার্কিন স্বার্থ এবং অবস্থান অভিন্ন। যদিও ইসরাইল ইরানের সঙ্গে মার্কিন সমঝোতার বিরোধিতা করেছে কিন্তু তাতে ইসরাইলের কর্মনীতি বদলাবার কারণ ঘটে নাই।
রাশিয়া
আমরা মধ্যপ্রাচ্যের একটা জটিল পরিস্থিতিকে বুঝবার প্রয়োজনে রাজনীতি, অর্থনীতি, ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ইতিহাসের কিছু বিষয়কে খুব সংক্ষেপে এখানে পর্যালোচনা করেছি। এখানে আমরা দেখছি রাশিয়ার ভূমিকার তাৎপর্য। ১৯৯১-এ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর থেকে হিসাব করলে প্রায় পঁচিশ বৎসর রাশিয়া বিশ্ব রাজনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে নাই। বুঝা যায় যে এক বিরাট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ভাঙ্গনের পর বিপর্যয়ের ধাক্কা কাটাতে রাশিয়ার অনেক সময় লেগেছে। তবে এই পঁচিশ বৎসরে রাশিয়া যে নিজের সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতির অনেক কিছু সফলভাবে পুনর্গঠন করেছে সেটা সিরিয়ায় তার সাম্প্রতিক ভূমিকায় বুঝা গেল।
অবশ্য তার বাধ্যতাও ছিল। সিরিয়ার পতন হলে আইএস যে আরও পরাক্রমশালী হত তা-ই নয়, মধ্যপ্রাচ্য আরও খণ্ড-বিখণ্ড হত, এবং বিশেষত শিয়া নির্যাতন আরও ভয়াবহ হতে পারত, ফলে শিয়া-সুন্নীর বিরোধও তীব্রতর হতে পারত, যেটা ইরানে মার্কিন হস্তক্ষেপকে সহজতর করত। অন্যদিকে, এটা রাশিয়ায় ইসলামী জঙ্গী উত্থানকে নূতন শক্তি যোগাত। একই সঙ্গে এটা চীনের গলা টিপে ধরার পথ মুক্ত করে দিতে পারত। সেই সঙ্গে এটা ভারতের উপর মার্কিন নিয়ন্ত্রণকে দৃঢ়তর করার সুযোগ করে দিত। সুতরাং রাশিয়া বা চীন কেউ দেরী করে নাই। তবে এই ঘটনায় আর একটা বিষয় স্পষ্ট হয়েছে, চীনের অর্থনীতি যতই শক্তিশালী হোক বিশ্ব রাজনীতির নেতৃত্ব দিবার যোগ্যতা তার এখনও হয় নাই। কিংবা সামরিক শক্তিতেও তা এখনও রাশিয়ার সমকক্ষ হয়ে উঠে নাই। তাছাড়া ভৌগোলিক অবস্থান এবং দূরত্বও একটা বিষয় বটে। রাশিয়া মধ্যপ্রাচ্যের অনেক নিকটবর্তী। ফলে সেদিক থেকে তার বিপদের সম্ভাবনা এবং সুবিধা দুইই বেশী।
যাইহোক, রাশিয়া যে অনেক দিন ধরেই মধ্যপ্রাচ্যে হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল সেটা এখন স্পষ্ট। কিন্তু তা আঘাত যখন হেনেছে তখন বিদ্যুৎ গতিতে ও প্রচণ্ড শক্তিতে হেনেছে। এবং আমেরিকা ও পশ্চিম ইউরোপকে হতভম্ব করেছে।
বিশেষত আমেরিকাকেও এখন আর আগের মত পরাক্রান্ত ভাববার কারণ নাই। আফগানিস্তান ও ইরাকে যুদ্ধ করতে গিয়ে তার যে বিপুল অর্থ ব্যয় হয়েছে তাতেই এখন তা নাকাল। আধুনিক প্রযুক্তি নির্ভর যুদ্ধ প্রচণ্ডভাবে ব্যয়বহুল। অন্য আর একটা বিষয়কে হিসাবে নিতে হবে। আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপের বিলাসিতায় এবং সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগে অভ্যস্ত মানুষরা সেই যুদ্ধ করতে চাইতে পারে যে যুদ্ধে মৃত্যুর ঝুঁকি নাই বা থাকলেও খুব কম। আফগানিস্তান, ইরাকের মরতে ভয় পায় না এমন সব যোদ্ধাদের হাতে কিছু আধুনিক অস্ত্র থাকলেই তাদের মোকাবিলায় তারা কয়দিন দাঁড়াবে? ভিয়েৎনামের পর আমেরিকার শিক্ষা হয়েছে আফগানিস্তান এবং ইরাকে। সুতরাং আমেরিকা আকাশ থেকে যাই করুক মাটিতে সহজে নামতে চায় নাই। কাজেই আইএস এবং অন্য জঙ্গীদেরকে দিয়ে মাঠটা আর একটু তৈরী করে নিতে চেয়েছিল।
কিন্তু রাশিয়া সুযোগটা দেয় নাই। শুধু তাই নয়. আফগানিস্তানের শিক্ষা তার মনে আছে। সুতরাং সিরিয়ার সরকারের সমর্থনে আকাশ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র এবং বিমান হামলা চালালেও মাটিতে তার সেনা অভিযান পরিচালনা করে নাই। সেটা যে তা করবে না রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সেটাও স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন। অর্থাৎ কোনও ধরনের ইসলামী আবেগ জাগাবার জায়গা তিনি রাখেন নাই। ময়দানে লড়াই হবে, জিহাদ হবে, তবে সেটা হবে মুসলমানে মুসলমানে। প্রধানত সুন্নীতে আর শিয়াতে, কিছু ক্ষেত্রে সুন্নীতে সুন্নীতেও।
রাশিয়া-চীন-ইরান-ইরাক-সিরিয়া একদিকে। তাদের সঙ্গে আছে লেবাননের শিয়া মিলিশিয়া হেজবুল্লাহ, ইরাক-সিরিয়ার কুর্দী জাতির যোদ্ধারা, হয়ত সঙ্গে আছে তুরস্কেরও কুর্দী যোদ্ধারা। কুর্দীদের অধিকাংশ সুন্নী হলেও তাদের একাংশ শিয়া এবং কিছু খ্রীষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী। তবে জাতিগতভাবে কুর্দীরা আইএস বিরোধী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছে। যুদ্ধ ছড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে ইয়েমেনে যুদ্ধ বিস্তৃত হয়েছে। সেটা সৌদী আরবের ভিতর সম্প্রসারিত হচ্ছে। সেখানে অবশ্য এখন পর্যন্ত এক পক্ষে শিয়া, অপর পক্ষে সুন্নী দাঁড়ালেও সৌদী এবং অন্যান্য রাজতন্ত্র বিরোধী সুন্নীরা শিয়াদের সঙ্গে সম্মিলিত হয়ে সৌদী এবং উপসাগরীয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল হতে পারে।
যদি যুদ্ধ ছড়ায় তবে আমেরিকা এবং পাশ্চাত্য কী করবে? মধ্যপ্রাচ্যে যেটুকু অস্থিরতা দেখা দিয়েছে তার ধাক্কায় এখনই শরণার্থীর স্রোত ইউরোপে আছড়ে পড়ছে। কয়েক লক্ষ মানুষকে ইউরোপ জায়গা দিচ্ছে। নিশ্চয় এতে তার শ্রমের চাহিদা পূরণ হচ্ছে। কিন্তু একটা পর্যায় পর্যন্ত এটা লাভজনক হতে পারে। তার পরে? হঠাৎ করে ইসলাম ধর্ম ও ইসলামী সংস্কৃতির এই বাড়তি জনজোয়ার ইউরোপের সমাজের জন্য অভিশাপ হিসাবে দেখা দিবে। কাজেই দীর্ঘস্থায়ী অস্থিরতা ও যুদ্ধ ইউরোপের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যের ভারসাম্য বিনষ্টিকরণে ইউরোপ নিজেই তো আমেরিকার কর্মকাণ্ডের সঙ্গী হয়েছিল। এখন চাইলেই কি এই অবস্থা থেকে বের হওয়া যাবে?
প্রশ্ন, পৃথিবীতে বিগত পঁচিশ বছর একক পরাশক্তি হিসাবে প্রায় একচেটিয়াভাবে দাপিয়ে বেড়ানো আমেরিকা কি রাশিয়া-চীনের অগ্রগমনকে এভাবে চুপচাপ মেনে নিবে। সেটা মানা মানে গোটা মধ্যপ্রাচ্য হাতছাড়া হওয়া। এরপর থাকে পাকিস্তান এবং ভারত। এবং এশিয়া ও আফ্রিকার অন্য দেশগুলি। এখনও পর্যন্ত কাগজে-কলমে পৃথিবীর একক পরাশক্তি হিসাবে গণ্য আমেরিকা শান্তভাবে তার সাম্রাজ্যের পতন দেখবে এটা মনে করার কারণ কি আছে?
কমিউনিজমের পুনরুত্থান ঘটছে কি?
এখানে এই আলোচনায় একটা বিষয় স্পষ্ট করা দরকার যে রাশিয়ার এই পুনরুত্থানকে কমিউনিজম বা ধ্রুপদী সমাজতন্ত্রের পুনরুত্থান মনে করার কোনও কারণ নাই। এই রাশিয়া কমিউনিস্ট রাশিয়া নয়। যেমন আজকের চীনও কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত হলেও তার সঙ্গে ধ্রুপদী বা চিরায়ত মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের সম্পর্ক নাই। রাশিয়ায় এখন সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ নাই। রাশিয়া এখন মূলত একটি ব্যক্তিপুঁজিবাদী রাষ্ট্র। চীনে সমাজতন্ত্রের নামে রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদ এবং কমিউনিস্ট পার্টির নামে একদলীয় শাসন থাকলেও সেখানে ব্যক্তিপুঁজিবাদের বিপুল বিকাশ হয়েছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির লক্ষ্য কমিউনিজমও আর নাই। সুতরাং চীনকে কমিউনিস্ট আদর্শের রাষ্ট্র আর বলা যাবে না।
এই বাস্তবতায় এক কালের সোভিয়েত-চীনের সঙ্গে পাশ্চাত্য এবং আমেরিকার দ্বন্দ্বের মধ্যে সমাজ ব্যবস্থাগত এবং আদর্শগত যে দ্বন্দ্ব ছিল সেটা এখন খুঁজে লাভ নাই। এখন এক অর্থে দ্বন্দ্বটা রাষ্ট্রের স্বার্থের, অর্থনীতির স্বার্থের। অবশ্য সেখানে কিছু সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক বিষয় জড়িত থাকতে পারে। তবে মূল বিষয়টা রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত, যার ভিত্তিমূলে আবার থাকে রাষ্ট্র গঠনকারী প্রধান বা মূল জনগোষ্ঠী হিসাবে প্রধান নৃতাত্ত্বিক জাতির স্বার্থ।
বিভিন্ন কারণে উদ্ভূত আন্তর্জাতিক বৃহৎ শক্তিগুলির নিজেদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব যখন স্থানীয় পর্যায়ের দ্বন্দ্বের সঙ্গে জড়িয়ে যায় তখন পরিস্থিতি জটিল হয়ে উঠতে এবং আন্তর্জাতিক মাত্রা নিতে পারে। মধ্যপ্রাচ্যে সেই ঘটনা ঘটেছে। সেখানকার স্থানীয় রাজনীতি ও দ্বন্দ্ব এখন বিশ্ব রাজনীতি ও দ্বন্দ্বের অংশ হয়েছে। এভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উঠে এসেছে ধর্মের বিষয় এবং শিয়া-সুন্নী দ্বন্দ্ব। আর এভাবে নূতনভাবে এবং নবতর গতি ও শক্তি নিয়ে ক্রিয়াশীল হয়েছে ধর্মীয় দ্বন্দ্ব এবং সেই সঙ্গে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠী ও জাতির দ্বন্দ্বেরও ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। স্থানীয় এই বিভিন্ন ধরনের দ্বন্দ্বগুলি বাহিরের বিভিন্ন বৃহৎ শক্তির দ্বন্দ্বের সঙ্গে মিলে গিয়ে নূতন মাত্রা ও ব্যাপ্তি লাভ করছে।
রাশিয়ার বাধ্যবাধকতা এবং ভবিষ্যৎ গতিধারা
এই আলোচনায় মনে হয় মধ্যপ্রাচ্যে তথা সিরিয়ায় রুশ হস্তক্ষেপের তাৎপর্য আরও স্পষ্ট করা দরকার। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির পর পাশ্চাত্যের সোভিয়েত বিরোধী কর্মনীতি রাশিয়া বিরোধী কর্মনীতিতে পরিণত হয়। সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলি বিশেষত পূর্ব ইউরোপের রাষ্ট্রগুলির কয়েকটিতে ন্যাটোর সামরিক জোটকে সম্প্রসারিত করা হয়। উদ্দেশ্য রাশিয়াকে চতুর্দিক থেকে ঘেরাও এবং কোণঠাসা করে আমেরিকার তাবেদারে পরিণত করা। শুধু তা-ই নয়, অধিকন্তু পারলে তাকে ভেঙ্গে ফেলা। এর জন্য মুসলিম অধ্যুষিত চেচনিয়া ও দাগেস্তান হতে পারে সহজ জায়গা। তাছাড়া মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী জঙ্গীবাদের উত্থানের ফলে মধ্য এশিয়ার মুসলিম প্রধান সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রগুলিকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ব্যবহার করা আমেরিকার পক্ষে সহজ হতে পারে। এটা একই সঙ্গে চীনের মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেও অনুপ্রবেশের সুযোগ করে দিতে পারে। চীনের উত্তর-পশ্চিমাংশে ১৬ লক্ষ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত জিনজিয়াং প্রদেশে বসবাসকারী মুসলিম উইঘুরদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী এবং ইসলামী জঙ্গীবাদী কর্মকাণ্ডের প্রসার চীনের জন্য এখনই সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
বিশেষত ২০১৪ সালে ইউক্রেনে রুশপন্থী সরকারের পতন ঘটিয়ে সেখানে ন্যাটোর সম্প্রসারণের জন্য আমেরিকা এবং পশ্চিম ইউরোপ যা করেছিল তাতে করে পাশ্চাত্যের হস্তক্ষেপের বিপদ থেকে আত্মরক্ষার জন্য ইউক্রেনে হস্তক্ষেপ করাকে রাশিয়া অপরিহার্য মনে করে। প্রায় সাথে সাথে সেখানে পাশ্চাত্যপন্থী ইউক্রেন সরকারের বিরুদ্ধে রুশপন্থীদের বিদ্রোহ ঘটে। অবশ্য পাশ্চাত্য এবং পাশ্চাত্যপন্থী ইউক্রেনীয়দের দাবী যে রুশ সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা সেনাবাহিনীর পোশাক পরিবর্তন করে ভিন্ন পোশাকে ইউক্রেনে প্রবেশ করে এবং রুশভাষীদের সঙ্গে মিশে গিয়ে যুদ্ধ শুরু করে। তবে ঘটনা যেমনটাই ঘটুক ইউক্রেনের জনসংখ্যার এক বিরাট অংশ রুশ ভাষী। প্রায় পাঁচ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় এক কোটি রুশ বা রাশিয়ান। ২০১৪-তেই এই রুশভাষী বিদ্রোহীরা এক বৃহৎ এলাকা দখল করে স্বাধীনতা ঘোষণা করে এবং রাশিয়ায় যোগদান করে। এভাবে রাশিয়াকে ঘেরাও ও কাবু করার মার্কিন কর্মনীতি ও কৌশল ইউক্রেনে মার খায়। মাঝখানে ইউক্রেনই ভেঙ্গে গেল।
এরপর বেশী দিন যায় নাই। ইউক্রেনের সমস্যা গুছিয়ে নিতে রাশিয়ার বেশী দিন লাগে নাই। কিছু কম বা কিছু বেশী এক বছর। তারপর সিরিয়ায় রাশিয়া চমক দিল। অর্থাৎ বিশ্বরাজনীতিতে উদ্যোগ এই মুহূর্তে আর আমেরিকার হাতে নাই। এটা এখন রাশিয়ার হাতে। এখন অনেক কিছুই নির্ভর করছে রাশিয়ার ভূমিকার উপর। নিজের তৈরী ফাঁদে এখন আমেরিকা। বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যে যে কোণঠাসা অবস্থায় আমেরিকা এখন পড়েছে তা থেকে সহজে বের হতে পারবে বলে মনে হয় না। তবে শেষ কথা বলার সময় হয় নাই। শুধু এইটুকু বলা যায় যে, ১৯৯১ থেকে পৃথিবীতে একক পরাশক্তি হিসাবে মার্কিনের পক্ষে যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেটা আর থাকল না। প্রকৃতপক্ষে, একমেরু বিশ্বব্যবস্থার অবসান হল। আগামীতে দ্রুত আরও অনেক পরিবর্তন হবে। এই দ্রুত ও প্রবল পরিবর্তনের স্রোতে পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশের মত রাষ্ট্রগুলি যে ভেসে যাবে সে কথা বলা যায়। কোন গন্তব্যে যাবে সে কথা বলা এখনও সম্ভব নয়। তবে প্রত্যেকে এখন থেকেই যার যার মত করে গন্তব্য ঠিক করে নিতে চেষ্টা করবে। স্বাভাবিকভাবে প্রত্যেকে যার যার স্বার্থ, সামর্থ্য ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী সেটা করতে চাইবে।
যদিও শেষ কথা বলার সময় এখনও হয় নাই তবে মধ্যপ্রাচ্যে যে দ্বন্দ্ব ও সংঘাত চলছে তার বিস্তৃতির সঙ্গে পৃথিবীতে যেমন দীর্ঘ অস্থির সময় চলবার সম্ভাবনা আছে তেমন এর মধ্য দিয়ে একটা নূতন আদর্শিক শক্তির উত্থান ঘটবার সম্ভাবনাও আছে। একটা নূতন আদর্শকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা নূতন শক্তির হস্তক্ষেপ ছাড়া পুরাতন দ্বন্দ্ব ও সংঘাতের নিরসন সম্ভব নয়। সুতরাং মানব জাতি নিজ প্রয়োজনে যে সে দিকে যাবে তেমনটা আমরা আশা করতে পারি।
রচনা : ১৭-১৮ অক্টোবর, ২০১৫