Banner
সত্তরের দশক বাঙালি ও সমাজবিপ্লব ─ শ্রীশুভ্র

লিখেছেনঃ শ্রীশুভ্র, আপডেটঃ April 13, 2017, 12:00 AM, Hits: 2177

 

বাংলার ইতিহাসে সত্তরের দশকের ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা সঠিকভাবে অনুধাবন করতে আমাদের অপেক্ষা করতে হতে পারে আরও কয়েক দশক। এবং সেই প্রাসঙ্গিকতার প্রেক্ষিতে বাংলার বর্তমান অবস্থার মূল্যায়ন করতে পারার মধ্যেই বাংলার ভবিষ্যতের রূপরেখার গতিপ্রকৃতি নির্ভরশীল। যদিও আমাদের সাম্প্রতিক সময়ে দাঁড়িয়ে এই বিষয়টি সম্বন্ধে হয়তো আমরা অধিকাংশ বাঙালিই বিশেষ ওয়াকিবহাল নই। তাই অনেকেরই মনে হতেই পারে চার চারটি দশক অতিক্রম করে চলে এসে আজকে আবার সত্তরের দশকের দিকে পিছন ফিরে দেখার প্রয়োজনই বা কি।

 

প্রয়োজন অবশ্যই আছে। আছে বাংলা ও বাঙালির ভবিষ্যতের স্বার্থেই। অতীতের অর্জন ও ভ্রান্তি দুইয়ের থেকেই ঠিক মতো শিক্ষা নিতে না পারলে বর্তমান টালমাটাল হয়ে ওঠে। ঠিক যেমনটি হয়েছে এই বাংলায়। এই বাংলায় বলতে আমরা, যে ভৌগলিক অঞ্চলটি বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর আবহমান কালব্যাপি বসবাসের ভুখণ্ড সেই সমগ্র দেশটিকেই বলছি। ইতিহাসের ঘটনা প্রবাহে আজ যে ভুখণ্ড আর অখণ্ড নাই। না থাক, তাতে পরিস্থিতির পার্থক্য ঊনিশবিশ হলেও বিশেষ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নয়।

 

বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বরং দুটি আলাদা মানচিত্রের দুই ভিন্ন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যবর্তী অন্তর্লীন মিলটুকু। এই মিলটুকু ঠিকমতো বুঝতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে সেই সত্তর দশকেই। সত্তরের দশক দুই বাংলাতেই একটি বিশেষ যুগসন্ধিক্ষণ। কাঁটাতারের এপারে নকশাল আন্দোলন। আর তার সামূহিক ব্যর্থতা। আর ওপারে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম। এই দুটি ঘটনাই বাংলার সমাজজীবনে পরবর্তী সময়ে বিশেষ প্রভাব ফেলেছে। যার পরিণতি আজকের বাংলা। কাঁটাতারের দুই পারেই।

 

এপার বাংলায় যখন নকশাল আন্দোলনের হাত ধরে বাংলার ছাত্র ও যুবসমাজের মেধাবী ছেলেমেয়েদের একটা বড় অংশই সমাজবদলের স্বপ্ন দেখতে শুরু করছিল, ঠিক সেই সময়েই ওপার বাংলার যুবসমাজ ও বুদ্ধিজীবীদের অধিকাংশই স্বাধীন দেশগঠনের স্বপ্ন নিয়ে স্বাধীনতার সংগ্রামের লক্ষ্যে মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিল দিনে দিনে। কাঁটাতারের দুই পারেই বাঙালি মনীষা ও মেধার একটা বড়ো অংশই প্রচলিত রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার পরিবর্তনের লক্ষ্যে একটু একটু করে সঙ্ঘবদ্ধ হতে শুরু করেছিল। এই অবস্থারই চুড়ান্ত পরিণতি সত্তরের দশকের প্রথম ভাগ। সমাজবদলের স্বপ্নদেখা তরুণ যুবশক্তিকে রাষ্ট্রযন্ত্র প্রশাসনিক তৎপরতায় কঠোর ভাবে দমন করতে চূড়ান্ত সফল হওয়ায় এপারে দেখা দিল মেধার আকাল। যে ফাঁক দিয়ে মধ্যমেধার ক্ষমতায়নের যুগ শুরু হয়ে গেল, সত্তরের দশকের শেষ ভাগ থেকেই। আর প্রায় একই ঘটনা ঘটলো ওপারেও। একটু অন্যভাবে। আন্তর্জাতিক বিরুদ্ধ শক্তি যখন দেখল, পাকিস্তানের পক্ষে আর কোনভাবেই বাংলাদেশকে পরাধীন করে রাখা সম্ভব হচ্ছে না, তখনই তারা ওপার বাংলাকে মেধাশূন্য করতে বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা ধরিয়ে দিল রজাকার আলবদরদের হাতে। দেশ স্বাধীন হলো বটে, কিন্তু জাতি ও সমাজকে দশেকের পর দশকে ধরে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো মেধা পেল না বাংলাদেশ। ফলে সেখানেও মধ্যমেধার দাপাদাপি শুরু হয়ে গেল রাষ্ট ও সমাজের সর্বস্তরে। যার চূড়ান্ত রূপ আজকের বাংলাদেশ।

 

বস্তুত এভাবেই সত্তরের দশকই বর্তমান বাংলার রূপরেখা ঠিক করে দিলো কাঁটাতারের দুই পারেই। নিশ্চিন্ত হলো তারা যারা বাংলার ক্ষমতার বৃত্তকে নিজস্ব সম্পত্তি করে রাখতে সফল হলো দুই পারেই।এতো গেল ইতিহাসের কথা। অতি সাম্প্রতিক ইতিহাস। কিন্তু লক্ষ্য করার বিষয় এই ঘটনার মূল অভিঘাতটাই পড়লো বাংলার মেধা ও মনীষার ধারাবাহিকতায়। পুরো একটা প্রজন্মের মেধা নষ্ট করে দেওয়া সুসম্পন্ন হলো নিপূণ সাফল্যে।

 

স্বাধীন ভারতের জনসাধারণের ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে স্বাধীনতার সুফলকে সর্বস্তরে সমান ভাবে পৌঁছিয়ে দেওয়ার এক ইউটোপিয়া থেকেই সমাজবদলের জন্যে সমাজবিপ্লবের পথে এগোতে চেয়েছিল একদল তরুণ প্রজন্ম। তাদেরকে কি ভাবে একদিকে বিভ্রান্ত করে ভুল পথে পরিচালিত করা হয়েছিল এবং অন্যদিকে রাস্ট্রীয় দমন পীড়নের প্রশাসনিক তৎপড়তায় সমূলে নিকেশ করা হয়েছিল সেটা ঐতিহাসিকদের বিচার্য বিষয়। এবং সেই ইতিহাসের নৈতিকতাও ভাবীকালের বিচার্য বিষয়। যেকোন সমাজ ব্যবস্থায় ও রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতায়নের কেন্দ্রে যারা অধিষ্ঠিত থাকে, তারা যে কখনোই কোন অবস্থায় তাদের ক্ষমতাচর্চার সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইবে না, সেটাও ইতিহাসেরই বিধান। সেখানে কি বুর্জোয়া কি প্রলেতারিয়েত সকল শক্তিরই ধর্ম ও প্রকৃতি সমান। তাই স্বাধীনতার নামে খিড়কির দোর দিয়ে ক্ষমতাহস্তান্তরে যারা রাষ্ট্রশক্তির ক্ষমতার কেন্দ্রে গিয়ে অধিষ্ঠিত হয়েছিল তারা যে তাদের হকের সম্পত্তি হাতছাড়া করবে না সেটা সতঃসিদ্ধ। আর তাই সমাজবদলের স্বপ্নে মশগুল মেধাগুলি হাতে বন্দুক তুলে নিয়ে আশা করছিল ক্ষমতার ভারসাম্যে সহজেই ফাটল ধরানো সম্ভব হবে। বা আরও একটু সঠিক ভাবে বললে বলা যেতে পারে, তেমনটাই তাদের বোঝানো সম্ভব হয়েছিল। তরুণ প্রজন্মের ধর্মই হল চটজলদি সমাধানের আশা করা। কিন্তু সেদিন তাদেরকে সঠিক দিকনির্দশনা দেওয়ার মতো কোন নেতৃত্বই ছিল না ধারে কাছে। যার ফল ফলল হাতে নাতে, যে সমাজবদলের স্বপ্নে বিভোর হয়েই তারা স্বশস্ত্র বিপ্লবের নেশায় বুঁদ হয়েছিল, সেই বিপ্লবের পথেই তারা প্রথমেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লো সাধারণ জনসাধারণের নিত্যদিনের জীবনসংগ্রামের কাছে থেকেই। ফলে জনবিচ্ছিন্ন সেই আন্দোলনকে সমূলে বিনাশ করতে রাষ্ট্রশক্তিকে বিশেষ বেগ পেতেও হলো না। আর তাদের সেই কাজে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জুটে গেল গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রসাদভোগী সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলিরও। ফলে সম্পূর্ণ সমাজচ্যূত হয়ে আন্দোলনের অভিমুখ ঘুরে গেল সম্পূর্ণ ব্যর্থতার দিকেই। আর সেই সাথেই মেধাহীন মধ্যমেধার দিগন্তে পা রাখল এপার বাংলা। কারণ একটা গোটা প্রজন্মের শ্রেষ্ঠ মেধাই বিনস্ট হয়ে গেল এইভাবে। আর সেই শূন্যস্থান ভরাট করতে উঠে এল মধ্যমেধার দাপাদাপি। সমাজের সর্বস্তরেই এর প্রভাব পড়লো ব্যাপক ভাবে। নকশাল আন্দোলনের সামূহিক ব্যর্থতার সরাসরি প্রভাব পড়লো ছাত্র ও যুবসমাজের চেতনায়। সত্তরের পরবর্তী দশকগুলিতে ছাত্রসমাজের পাখির চোখ হয়ে উঠলো নিজের আখের গোছানো। যে যেভাবে পারে। স্বদেশ চেতনা, জনসাধারণের জীবনজীবিকার প্রশ্নে সম্পদের অসম বন্টন, ধনতান্ত্রিক অর্থনীতির গোড়ার গলদ ও শোষণের দিকগুলি সম্বন্ধে এক চরম উদাসীনতার জন্ম হতে থাকল ছাত্র যুবমানসে।  আর কালক্রমে সেটাই হয়ে দাঁড়ালো যুবশক্তির সাধারণ প্রকৃতি। স্থাণু হয়ে দাঁড়িয়ে গেল এপার বাংলার সমাজজীবন।

 

এপার বাংলায় এইসব ঘটনার ঘনঘটার মধ্যেই ওপার বাংলাকেও নিষ্ঠুর চক্রান্তে করে দেওয়া হল মেধাশূন্য। একাত্তরের যে অর্জন স্বাধীন বাংলাদেশ তার মূল্য শোধ করতে হলো সারা দেশের মেধাগুলির হত্যার মাধ্যমে। আলবদর আলশামস সহ পাকপন্থী শক্তিগুলির মাধ্যমে এই হত্যাযজ্ঞ সংঘঠিত হলো নিপূণ কুশলতায়। যার ফলে সদ্য স্বাধীন দেশটিকে সমাজের সর্বস্তরে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো আর কেউই অবশিষ্ট রইল না বিশেষ। আর সেই শূন্যস্থানই ভরাট করতে উঠে এলো সদ্য স্বাধীন দেশের সকল সুবিধাবাদী স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলিই। সমাজের সর্বত্র তারা বিনা বাধায় হাতে পেয়ে গেল ক্ষমতাচর্চার চাবিকাঠিগুলি। ফলে ওপারেও এপারের মতোই শুরু হয়ে গেল মধ্যমেধার দাপাদাপি। স্বার্থান্বেষী ও সুবিধাবাদী নানান গোষ্ঠীর পারস্পরিক রেষারেষি ও সংঘাতের মঞ্চ হয়ে উঠলো স্বাধীন বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর হত্যা সহ জাতীয় চার নেতার হত্যলীলার মধ্যে দিয়েই উদ্বোধন হলো যে মঞ্চের। বাংলাদেশের জনসাধারণ বঞ্চিত হলো মুক্তিযুদ্ধের সুফল থেকে।

 

আজকের বাংলাদেশের মানুষকে বুঝতে হবে, দেশ স্বাধীন করতে পারলেই দেশ গড়া যায় না। দেশ গড়তে গেলে সবার আগে দরকার সঠিক দিশার সমাজবিপ্লব। বস্তুত স্বাধীন বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ কোন সমাজবিপ্লবের পথে সংঘঠিত হয়নি। তাই সেই স্বাধীন দেশের ননীমাখন খাওয়ার কুৎসিত প্রতিযোগিতাই বিগত সাড়ে চার দশকের বাংলাদেশের মূল ইতিহাস। সেই ইতিহাসের মোড় ঘুড়িয়ে দেওয়ার চেতনা জাগিয়ে তোলা আজকের বাংলাদেশ আর সম্ভব নয় সহজে। সকলেই ব্যস্ত আখের গোছাতে। বাংলাদেশ তাদের কাছে একটা সরকারী তহবিল স্বরূপ মাত্র। দেশ বলতে যে চেতনা সমাজবিপ্লব গড়ে ওঠার মূল অনুঘটক, সেই চেতনাই সাড়ে চারদশকব্যাপী মধ্যমেধার দাপাদাপিতে অবলুপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশে।

 

কাঁটাতারের উভয় পারেই এইভাবেই মেধাহীন মধ্যমেধার দাপাদাপিতে বাংলার সমগ্র ভূখণ্ডই আজ দিশাহারা দিগভ্রান্ত। এপারে জনবিচ্ছিন্ন নকশাল আন্দোলন ও ওপারে সমাজবিপ্লবহীন স্বাধীনতা দুই পারেই জাতি হিসাবে বাঙালিকে ব্যর্থ করে রেখেছে আজ অব্দি। প্রকৃত সমাজবিপ্লব ছাড়া একদা পরাধীন কোন জাতির পক্ষেই মাথাতুলে দাঁড়ানো সম্ভব নয়। সেই সমাজবিপ্লব কবে কোন পথে আসবে সেটা নির্ভর করে জাতির সাধারণ প্রকৃতির উপর। তার পথ ঠিক হয় স্বদেশ চেতনার নিরিখে দেশীয় প্রয়োজনের ভিত্তিতেই। বিদেশ থেকে ধার করা কোন তত্ব বা পন্থাতেই সম্ভব নয় কোন সমাজবিপ্লবকে সার্থক করে তোলা। আর সেটা যতদিন না হচ্ছে বা হবে ততদিনই ভুগতে ও খোঁড়াতে হবে সমগ্র বাংলাকেই কাঁটাতারের দুই পারেই।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ