Banner
নেপাল ও বাংলাদেশের রাষ্ট্র ( রিপাবলিক) গঠন প্রক্রিয়ার মিল-অমিল (পরিবর্ধিত) — হাবিবুর রহমান

লিখেছেনঃ হাবিবুর রহমান, আপডেটঃ February 13, 2018, 12:00 AM, Hits: 1726


 
ভুমিকা

আমাদের এই  অঞ্চলে ( দক্ষিণ এশিয়া ) সশস্ত্র গণযুদ্ধ বা  গণঅভ্যুত্থান  হয়েছে  অনেকগুলো। এসব গণযুদ্ধ বা  গণঅভ্যুত্থান কোথাও সফল হয়েছে, কোথাও  ব্যর্থ হয়েছে। কোথাও আবার নির্বাচন গণ অভ্যুত্থান ও গণযুদ্ধ সংগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করেছে। তবে সশস্ত্র বিপ্লব বা গণযুদ্ধ অথবা গণ অভ্যুত্থান শেষে গণপরিষদ বা সংবিধান সভার নির্বাচন হয়েছে এবং সেই সভা ডেকে গঠনতন্ত্র বা সংবিধান প্রণয়ন তথা রাষ্ট্রগঠনের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়েছে এবং এরপর গণভোটে কনষ্টিটিউশন বা সংবিধানের গণ-অনুমোদন নেয়া হয়েছে – এভাবে নিয়ম পদ্ধতি মেনে কোথাও রাষ্ট্রগঠন হয় নাই। এই দিক থেকে নেপালের রাজতন্ত্র উপড়ে ফেলে নতুন রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠন আমাদের এ অঞ্চলে সবার চেয়ে ব্যতিক্রম।

একটা গণপরিষদ বা সংবিধান সভার মাধ্যমে নতুন রিপাবলিক গড়া - এই পুরো প্রক্রিয়াটা দুটো ভাগে ভাগ করা যায়।  প্রথম ভাগ হল সশস্ত্র যুদ্ধ বা গণঅভ্যুত্থান ঘটানোর পর ক্ষমতা নেয়া। আর দ্বিতীয় ভাগ হল নির্বাচনের মাধ্যমে সংবিধান সভা গঠন করে রাষ্ট্রগঠন সম্পন্ন করা। নেপাল ব্যতীত এই অঞ্চলের অন্যদেশগুলোতে এভাবে দুটো প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে রাষ্ট্রগঠন সম্পন্ন হয় নি। যেমন ভারত বা পাকিস্তানের বেলায় ১৯৪৭ সালে এটা হয়েছে আপোষে, ঔপনিবেশিক শাসকের হাত ধরে, ক্ষমতার হস্তান্তর নিয়ে এক টেবিলে বসে আলোচনা করে। এই আপোষ ধারার সবচেয়ে অসুবিধা বা দুর্বলতার  দিক হল, এতে পুরানো রাষ্ট্রের বহু দায়, আবর্জনা ও কালাকানুন নতুন রাষ্ট্রের ভিতর ঢুকে যায়। অর্থাৎ রাষ্ট্রের প্রকৃত রূপান্তর ঘটে না। অবশ্য বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। দেশটি  গণঅভ্যুত্থান ও সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের ভিতর দিয়ে জন্ম নিলেও এবং এরপর গণপরিষদ গঠন করে (যদিও প্রশ্নবিদ্ধ ) সংবিধান প্রণয়ন করা হলেও নতুন রাষ্ট্রকে পুরনো উপনিবেশিক রাষ্ট্রের (ব্রিটিশ ও পাকিস্তান) সকল কালাকানুন আর নানান আবর্জনার দায় বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। বলতে গেলে পুরনো রাষ্ট্র প্রায় অবিকল বহাল থেকে গেছে।

রাষ্ট্রের সকল সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ও জাতিসত্ত্বা তথা সকল নাগরিকের রায়ে সংবিধান সভা গঠন, বিশেষ করে ‘কনষ্টিটিউট’ শব্দের অর্থ বুঝে রাষ্ট্রগঠনের কাজ সম্পন্ন করা রাষ্ট্রনীতিতে একটি বিশেষ গুরুত্বপুর্ণ অধ্যায়। রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের একসাথে মিলে একটা একক  রাজনৈতিক সত্ত্বা হয়ে ওঠা – এটাকেই কনষ্টিটিউট বা গঠন করা বলে। এরই লিখিত বা গাঠনিক দলিল হল কনষ্টিটিউশন বা গঠনতন্ত্র। আর গঠনতন্ত্র বা সংবিধান প্রণীত হয় কনষ্টিটিউশনাল এসেম্বলি বা সংবিধান সভায়।

আমরা দেশ স্বাধীন করা বুঝি। কিন্তু এর পরেও রাষ্ট্রগঠন বলে আলাদা অধ্যায় আছে তা এদেশের খুব কম রাজনীতিকের কাছে স্পষ্ট। বরং দেশ স্বাধীন মানে সব হয়ে গেছে ভাবি। তেমনি, এই সংবিধান সভা বা গণপরিষদ আমাদের বহুল পরিচিত পার্লামেন্ট বা সংসদ নয়, তাও অনেক রাজনীতিবিদের কাছে স্পষ্ট নয়। এই দুইয়ের গুরুত্বপুর্ণ ফারাক হল, সংবিধান সভার নির্বাচন হয় সংবিধান বা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন ও অনুমোদন হয়ে যাবার পর ঘোষণা হয়ে গেলে এই পরিষদ চিরদিনের মত বিলুপ্ত হয়ে যায় বা ভেঙ্গে যায়। বিপরীতে পার্লামেন্ট বা সংসদের ভুমিকা এরপর থেকে শুরু হয়। সংবিধান সভা বা গণপরিষদে গৃহীত শাসনতন্ত্র অনুযায়ী  সংসদ  নির্বাচন  অনুষ্ঠিত  ও  সদস্য  নির্বাচন  করা হয়।  এরপর  সংখ্যাগরিষ্ঠরা সরকার  গঠন করে, আর নির্বাচিত সদস্যরা সংসদে বসে ঐ গৃহীত সংবিধান বা শাসনতন্ত্রের অধীনে থেকে আইন প্রণয়ন করে থাকে। তাঁদের সংবিধান বদলের ক্ষমতা থাকে না। এছাড়া গণপরিষদ ও  সংসদের সদস্য কারা হবেন, কত জন হবেন তা সাধারণত এক হয় না। রাষ্ট্রের সকল সম্প্রদায়, গোষ্ঠী ও জাতিসত্ত্বা এবং নারীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে সাধারণত সংবিধান সভার সদস্য সংখ্যা বেশি রাখতে হয়। কিন্তু  সংসদ নির্বাচনের বেলায় এই বাড়তি আসনগুলো থাকে না। যেহেতু রাষ্ট্রের গঠন উপাদান হল নাগরিক-মানুষ, তাই রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়ায় সমাজের কোন অংশকে উপেক্ষা করা বা বাদ দেয়া যায় না। তাই সংবিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে  শুধুমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় নেয়ার সুযোগ নেই।

এ নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে নেপালে কি প্রক্রিয়ায় এবং কোন রাজনীতি গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন তথা রিপাবলিক গঠনে মূল ভুমিকা পালন করেছে। পাশাপাশি বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জনগণের রিপাবলিক গঠনের আকাংখা কেন পরিণতি পেল না তা সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।

 

ক. নেপাল

১. ভুমিকা

The constitution of Nepal, 2072 সংবিধান সভায় গৃহীত হলে ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর নেপাল পৃথিবীর সর্বকনিষ্ঠ রিপাবলিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর মধ্য দিয়ে ১৭৬৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ২৪০ বছরের শাহ রাজবংশের শাসন চূড়ান্তভাবে অবসান ঘটলো। প্রসঙ্গত গোর্খা রাজা পৃথ্বী নারায়ন শাহ অনেকগুলো যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ২৪টি ছোট ছোট রাজ্যকে একত্র করে নেপালকে একটি অখণ্ড রাষ্ট্রীয় সংহতি দান করেন। এজন্য তাঁকে আধুনিক নেপালের প্রতিষ্ঠাতাও বলা হয়। স্বাভাবিকভাবেই রাজতন্ত্রে রাজা রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী থাকেন। কিন্তু ১৮৪৬ সালে ব্রিটিশ সহায়তায় প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী জং বাহাদুর রানা একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে বসেন। এ সময় থেকে রাজার নামে দেশ পরিচালিত হলেও নির্বাহী ক্ষমতা, বিচারিক ক্ষমতা ও আইন প্রণয়ন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর এক্তিয়ারে চলে যায়। তিনি রাজ আদেশ নিয়ে এটাও প্রতিষ্ঠা করেন, রানা বংশ হতে বংশপরম্পরায় প্রধানমন্ত্রী হবেন। এ ব্যবস্থা চলে এক শ’ বছরের অধিক, ১৯৫১ সাল পর্যন্ত। ১৯৫১ সালে এসে রানাদের একচ্ছত্র শাসনের অবসান ঘটে। এরপর কয়েক বছর দুই পরিবারের ক্ষমতা ভাগাভাগির ভিত্তিতে নেপাল শাসিত হয়। ১৯৬০ সালে রানা  শাসনের চূড়ান্ত অবসান ঘটে। এরপর শাহ বংশ তথা রাজার একচ্ছত্র ক্ষমতায় দেশ শাসিত হতে থাকে যা চলে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত। ১৯৯০ সালে এসে সাংবিধানিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সময় রাজার অধীনে থেকে বহুদলীয় সংসদীয় সরকার দ্বারা দেশ পরিচালিত হতে থাকে। ২০০৮ সালে এসে এই সাংবিধানিক রাজতন্ত্রেরও  অবসান ঘটে। নেপাল রিপাবলিক রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়।

 

২. নেপালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম ও সংবিধান

নেপালে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম দীর্ঘ দিনের। ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণে এই সংগ্রাম শুরু মূলত বিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি থেকে। আর এ সংগ্রাম চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে ২০০৬ সালের সফল গণঅভ্যুত্থানে রাজতন্ত্রের অবসানের মধ্য দিয়ে। নেপালের জনগণের আন্দোলনকে মোটাদাগে দুইভাগে ভাগ করা যায়। ১. রাজতন্ত্রের অধীনে বহুদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন এবং ২. রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। নেপালের সংবিধানের ধরনও আন্দোলনের রূপ ও প্রকৃতির সাথে সম্পর্কিত। সব মিলিয়ে নেপালে ৭টি সংবিধান প্রণীত হয়েছে। এই ৭টি সংবিধানের মধ্যে ৫টিতেই রাজতন্ত্র বহাল রাখা হয়েছে। এসময় আন্দোলনের নেতৃত্বপ্রদানকারী সংগঠনসমূহ রাজতন্ত্রের অধীনে বহুদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠাকে মুখ্য করেছিল। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল মূলত নেপালি কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-ইউএমএল (সর্বশেষ পরিবর্তিত নাম)। অন্যদিকে শেষ ২টি সংবিধানে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এসময় রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আন্দোলন মুখ্য ছিল এবং  আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিল মূলত ইউনিফায়েড কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-মাওইস্ট, সংক্ষেপে ইউসিপিএন-মাওইস্ট (সর্বশেষ পরিবর্তিত নাম)। এরা সাধারণভাবে মাওবাদী হিসেবে পরিচিত।

আবার সংবিধানগুলোর তৈরি প্রক্রিয়া দুই ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে পরে অগণতান্ত্রিক ও আধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তৈরি সংবিধানসমূহ। এরমধ্যে প্রথম ৪টি সংবিধান সম্পূর্ণ অগনতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় তথা জনগণের কোন ধরনের  অংশগ্রহণ ও মতামত ছাড়াই প্রণীত হয়েছে। আর ৫ ও ৬ নং সংবিধান প্রণয়ন আধা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে বলা চলে। শুধু মাত্র ৭ম সংবিধান প্রণয়নে সংবিধান সভা গঠনসহ পুরো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়েছে।

 

২.১ রাজতন্ত্রের অধীনে বহুদলীয় সরকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলন

বিশ শতকের শুরু থেকে রানা স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে নেপালি জনগণের ক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে। তিরিশ দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে ভারতে বসবাসরত প্রবাসী নেপালিদের দ্বারা রানা শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম বিদ্রোহ শুরু হয়। একই সময়ে নেপালের ভিতরে রানা শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে রাজার সমর্থনপুষ্ট নেপাল প্রজা পরিষদ। তবে রানারা নেপালের ভিতরের আন্দোলন শক্ত হাতে দমন এবং নিশ্চিহ্ন করে দেয়। ১৯৪৬ সালে ভারতে প্রবাসী নেপালিরা গঠন করে নেপালি ন্যশনাল কংগ্রেস। ১৯৪৮ সালে গঠিত হয় নেপাল ডেমোক্রেটিক কংগ্রেস। এই দুই সংগঠন একত্রিত হয়ে গঠিত হয় আজকের নেপাল কংগ্রেস। ১৯৪৯ সালে ভারতেই গঠিত হয় কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-সিপিএন। যদিও আরও অর্ধ ডজন নেপালি রাজনৈতিক পার্টি ছিল, তবে এই দুই পার্টি আন্দোলন গড়তে মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

নেপালের জনগণের গণতান্ত্রিক আকাংখা ও গড়ে উঠা রাজনৈতিক আন্দোলন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী পদ্ম শমশের জং বাহাদুর রানা ২৮ এপ্রিল ১৯৪৭ সালে ১৩ সদস্যের ‘রিফর্ম কমিটি’ গঠন করেন। এই কমিটি নেপালের প্রথম সংবিধান Government of Nepal Act, 1948 প্রণয়ন করে  যা ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল থেকে কার্যকর হয়। জনগণের আকাংখার স্বীকৃতি দিতে নয়, রানা শাসনের সাংবিধানিক রূপ দিতে এটি প্রণয়ন করা হয়েছিল। এই সংবিধান দ্বারা রাজতন্ত্রের অধীনে থেকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ন্ত্রিত সংসদীয় ব্যবস্থা চালু করা হয়। এতে দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার সদস্যদের মনোনীত করার একক ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে অর্পণ করা হয়। তিনি আইনসভার সদস্যদের সিদ্ধান্ত রদ বা পরিবর্তন করার ক্ষমতাও রাখেন। তবে এ সংবিধানের স্থায়ীত্বকাল ছিল মাত্র ২ বছর।

রানাদের শক্তির অন্যতম উৎস ছিল ব্রিটিশ ভারত। কিন্তু স্বাধীন ভারতের নেহেরু সরকার রানাদের উপর থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করে এবং নেপালি কংগ্রেসকে সমর্থন দেয়। তখন থেকে রানা শাসন বিরোধী আন্দোলন বেগবান হওয়া শুরু করে। ১৯৫০ সালে নেপাল কংগ্রেস সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করে। তারা রাজা ত্রিভুবনকে তাদের মিত্র হিসেবে পেয়ে যায়। আন্দোলনের অংশ হিসেবে একই বছরের নভেম্বর মাসে রাজা পরিবারসহ ভারতে আশ্রয় নেন। নেপালি কংগ্রেস সীমান্ত শহর বীরগঞ্জ দখল করে নেয়। নেপালের বিভিন্ন অঞ্চলেও সরকারের বাহিনীর সাথে বিদ্রোহীদের যুদ্ধ সংঘটিত হতে থাকে। পাশাপাশি ভারতীয় কূটনৈতিক চাপ চলতে থাকে। অবস্থা  বেগতিক দেখে প্রধানমন্ত্রী মোহন শমশের রানা পিছু হটেন। ১৯৫১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি দিল্লীর মধ্যস্থতায় রাজা, রানা এবং নেপাল কংগ্রেসের আপোষ চুক্তি হয়। চুক্তিতে বলা হয় রাজা তাঁর ক্ষমতা ফিরে পাবেন, রানা ও নেপাল কংগ্রেস যৌথভাবে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবে এবং ১৯৫২ সালের মধ্যে নির্বাচিত সংবিধান সভা গঠন করে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন করা হবে। একে নেপালি জনগণের বিজয় হিসেবে দেখা এবং ‘পঞ্চাশের বিপ্লব’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। কমিউনিস্টরা এ আন্দোলনে শরিক থাকলেও একে বিপ্লব বলতে নারাজ ছিল। চুক্তি মোতাবেক মোহন শমশের রানাকে প্রধানমন্ত্রী এবং  নেপালি কংগ্রেস নেতা বি পি কৈরালাকে  স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। রাজা ত্রিভুবন সংবিধান সভার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করে মন্ত্রী সভার সদস্য সমন্বয়ে ১০ সদস্যের সংবিধান ড্রাফটিং কমিটি গঠন করেন। ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে রাজা Interim Government of Nepal Act, 1951 জারী করেন। এটি ছিল তৎকালীন নেপালের ক্ষমতার তিন ভাগীদার - রাজা, রানা এবং নেপালি কংগ্রেস পার্টির আপোষ ফর্মুলার ফল। এর মাধ্যমে প্রায় ১১০ বছর পর রাজা তাঁর ক্ষমতা পুনরুদ্ধার করেন। এতে প্রথম সংবিধানে প্রদত্ত প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতা হ্রাস করা হয় এবং প্রধানমন্ত্রী নিয়ন্ত্রিত আইনসভা ব্যবস্থাও বাতিল করা হয়। প্রতিষ্ঠা করা হয় স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা। তবে রাজা তাঁর জীবদ্দশায় সংবিধান সভা গঠনের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেন নি। উল্টো রানা ও নেপালি কংগ্রেসের মধ্যকার বিবাদের সুযোগে তিনি ধীরে ধীরে সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করা শুরু করেন।

১৯৫৫ সালে রাজা ত্রিভুবন মারা গেলে সিংহাসনে বসেন মহেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ। তিনিও কৌশলে নির্বাহী ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে থাকেন। এ কৌশলের অংশ হিসেবে রাজা মহেন্দ্র পিতা প্রতিশ্রুত সংবিধান সভার নির্বাচন নয়, তাঁর তৈরি সংবিধানের অধীনে পার্লামেন্ট নির্বাচন ঘোষণা করেন। অবশ্য নেপালি কংগ্রেসও সংবিধান সভার নির্বাচনে আগ্রহী ছিল না। এ দল বিশেষজ্ঞদের দ্বারা সংবিধান প্রণয়নকে যথাযথ মনে করেছে। বিপরীতে বিভিন্ন কমিউনিস্ট দল ও গ্রুপগুলো সংবিধান সভা নির্বাচনে আগ্রহী ছিল, তবে তারা শক্ত প্রতিপক্ষ হিসেবে আবির্ভূত হতে পারেনি। যাহোক, রাজা মহেন্দ্র ১৯৫৮ সালের ২ জানুয়ারি ৫ সদস্যের সংবিধান ড্রাফ্‌টিং কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি ১১ মাসে খসড়া তৈরি করে যা পার্লামেন্ট নির্বাচনের মাত্র ৭ দিন আগে The Constitution of the Kingdom of Nepal, 1959 নামে জারী করা হয়। এর মাধ্যমে নেপালের জনগণ প্রথমবারের মতো বহুদলীয় ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠনের সুযোগ পায়। সাধারণভাবে এটাকে গণতান্ত্রিক সংবিধান মনে করা হলেও এ সংবিধানে রাজাকে সংবিধান এড়িয়ে শাসন করার বিশেষ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। রাজাকে এমনসব ক্ষমতা দেয়া হয় যা মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। প্রকৃত পক্ষে এ সংবিধান দুটো ক্ষমতা কেন্দ্র ( রাজা ও প্রধানমন্ত্রী ) তৈরি করে। তথাপি এর অধীনে নেপালি কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপালসহ কয়েকটি দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। ১০৯ আসনের পার্লামেন্টে নেপালি কংগ্রেস ৭৪ আসন পেয়ে সরকার গঠন করে। বিপি কৈরালা প্রধানমন্ত্রী হন। তবে এ সরকার মাত্র দেড় বছর ( মে ১৯৫৯ – ডিসেম্বর ১৯৬০ ) দেশ শাসনে সুযোগ পেয়েছিল। সংবিধানে প্রদত্ত ক্ষমতা বলেই রাজা মহেন্দ্র ১৫ ডিসেম্বর, ১৯৬০ সংবিধান বাতিল করেন,পার্লামেন্ট বিলুপ্ত ঘোষণা করেন, সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন এবং নির্বাহী ক্ষমতাসহ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা নিজ হাতে নিয়ে নেন।

প্রায় ২ বছর সংবিধানবিহীন দেশ চালানোর পর রাজা মহেন্দ্র  নতুন একটি সংবিধান প্রণয়নের লক্ষে ১৯৬২ সালের মে মাসে ৬ সদস্যের  সংবিধান ড্রাফ্‌টিং কমিশন গঠন করেন। এই কমিশন ১ মাস ৭ দিনে সংবিধানের খসড়া জমা দেন। ১৯৬২ সালের ১৬ ডিসেম্বর রাজা  The Constitution of Nepal, 1962 জারী করেন। এটা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তনের সংবিধান হিসেবে পরিচিত।  ১৯৬২ সালের সংবিধান রাজাকে শুধু সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করে নাই, তাঁকে সংবিধানের ঊর্ধ্ব স্থাপন করেছে। এতে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা নামক নির্বাচিত স্থানীয় পরিষদ গঠনের ব্যবস্থা রাখা হয়। পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা  জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচন করত,  অনেকটা আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের অনুরূপ। সংসদ স্বাধীনভাবে আইন প্রণয়ন করতে পারত না। প্রধানমন্ত্রী সম্পূর্ণরূপে রাজার নিয়ন্ত্রণে ছিলেন। এভাবে এ সংবিধানের মাধ্যমে নিরুঙ্কুশ রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। পরবর্তীতে, ১৯৮০ সালে রাজা বিরেন্দ্র বীর বিক্রম শাহ সংবিধান প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করেন। এতে জনগণের নিকট থেকে জানতে চাওয়া হয়, সংশোধিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা না দলীয় ভিত্তিতে আইনপ্রণেতা নির্বাচন ব্যবস্থা হবে। সংশোধিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থায় জনগণকে সরাসরি আইনপ্রণেতাদের নির্বাচন করার অধিকার দেয়া হয়। এতে সংশোধিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থা তথা রাজা জয়লাভ করেন। এই সংবিধান ২৮ বছর কার্যকর ছিল।

১৯৮৯ সালের শেষ দিকে এসে বেআইনি থাকা রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বাতিল ও অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে বহুদলীয় নির্বাচনের দাবী উত্থাপন করে। তারা রাজাকে ১৯৯০-এর ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত সময় বেঁধে দিয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম গড়ে তোলার হুমকি প্রদান করে। উল্লেখযোগ্য রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো হল নেপালি কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি অফ নেপাল-ইউএমএল এর নেতৃত্বে ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট, ইউসিপিএন-মাওইস্ট দলসহ ছোট ছোট কমিউনিস্ট দলের ইউনাইটেড ন্যাশনাল পিপলস ফ্রন্ট ইত্যাদি। ১৮ জানুয়ারি নেপালি কংগ্রেসের কনভেনশন থেকে রাজাকে ১ মাসের সময় দিয়ে আলটিমেটাম দেয়া হয়। আলটিমেটাম শেষে নেপালি কংগ্রেস ও ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিরোধী যৌথ আন্দোলনের ডাক দেয়। ফেব্রুয়ারিতে র‍্যাডিকাল লেফটদের ইউনাইটেড ন্যাশনাল পিপলস ফ্রন্ট নিজস্ব কর্মসূচি নিয়ে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়। ৫০ দিন ধরে চলা পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিরোধী ঐতিহাসিক জনআন্দোলনে সমগ্র নেপাল উত্তাল হয়ে উঠে। এপ্রিলে এসে এটি গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয় যা নেপালের প্রথম গণঅভ্যুত্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ৬ এপ্রিল ইউনাইটেড ন্যাশনাল পিপলস ফ্রন্ট সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেয়। এইদিন বিকেলে কাঠমণ্ডুর কেন্দ্রে, তুন্দিখেল এলাকায় বিশাল গণসমাবেশ ঘটে। এই জনসমাবেশের একটি অংশ রাজপ্রাসাদ আক্রমণ করে রাজা মহেন্দ্রের মূর্তি ভাংচুর করে। এসময় পুলিশের গুলিতে অসংখ্য মানুষ মারা যায়। তবে এতে শাসকেরা ভীত হয়ে পরে এবং ৮ এপ্রিল রাজা বীরেন্দ্র প্রায় ৩০ বছরের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা বিলুপ্ত করতে সম্মত হন। প্রথমত, তিনি কংগ্রেস নেতা কৃষ্ণ প্রসাদ ভট্টরাইকে প্রধানমন্ত্রী করে বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিত্বে (কংগ্রেস ৩ জন, বাম ফ্রন্ট ৩ জন, রাজ প্রতিনিধি ২ জন এবং স্বতন্ত্র ২ জন) অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করেন। দ্বিতীয়ত, অন্তর্বর্তী সরকারের পরামর্শ অনুযায়ী ৯ সদস্যের Constitutional Recommendation Commission গঠন করেন।

রাজা সংবিধান প্রণয়নের ভিত্তি হিসেবে দুটি মৌলিক নীতি ঘোষণা করেন, ১. সাংবিধানিক রাজতন্ত্র ও ২. বহুদলীয় গণতন্ত্র। অনেক বাধাবিপত্তি পার হয়ে The Constitution of the Kingdom of Nepal, 1990 গৃহীত হয়। এতে রাজার ক্ষমতা হ্রাস করে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের অধীনে বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। রাজা রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। রাজা প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক তবে সেনা চলাচলে নিরাপত্তা কাউন্সিলের অনুমোদনের প্রয়োজন হতো। রাজাকে আরও কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়, যেমন উচ্চকক্ষের ৬০ সদস্যের ১০ জন রাজা মনোনয়ন দেবার অধিকারী ছিলেন। সংবিধানে কার্যত বিভিন্ন জনজাতি বা নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীর স্বীকৃতি  দেয়া হয় নি। এভাবে এ সংবিধানে এমনসব অসঙ্গতি ছিল যা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বিচ্যুত করার জন্য যথেষ্ট। বস্তুত সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের এ মডেলটি ছিল ভণ্ডামি ও ত্রুটিপূর্ণ। তাই রাজার কাছ থেকে জনগণকে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবার দাবী অসম্পূর্ণ থেকে যায়, জন আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়। নেপালি কংগ্রেস, সিপিএন (ইউএমএল) বা মডারেট কমিউনিস্ট এবং রাজতান্ত্রিক দলগুলো এ সংবিধান মেনে নিলেও র‍্যাডিক্যাল কমিউনিস্ট ও সংখ্যালঘু গ্রুপগুলো এ সংবিধান প্রত্যাখান করে। যাহোক এ সংবিধানের অধীনে ১৯৯১ সালের মে মাসে অনুষ্ঠিত প্রথম নির্বাচনে নেপালি কংগ্রেস ১১০ আসন পেয়ে প্রথম, ৬৯ আসন পেয়ে সিপিএন (ইউএমএল) দ্বিতীয় এবং ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট ৯ আসন পেয়ে তৃতীয় হয়। এখানে উল্লেখ্য, ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া ও প্রণীত সংবিধান মেনে না নিলেও নির্বাচনে অংশ নিয়েছিল।

গিরিজা প্রসাদ কৈরালার প্রধানমন্ত্রিত্বে  নেপালি কংগ্রেস সরকার গঠন করে। তবে এই নির্বাচিত সরকার পুরো টার্ম পূরণ করতে পারেনি। দলগুলোর ভেতরকার  বিবাদ, বিশেষ করে নেপালি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে প্রধানমন্ত্রী কৈরালা সংসদ ভেঙ্গে দেন। ১৯৯৪ সালের নভেম্বরে অনুষ্ঠিত মধ্যবর্তী নির্বাচনে সিপিএন (ইউএমএল) ৮৮ আসন পেয়ে প্রথম, নেপালি কংগ্রেস ৮৩ আসন পেয়ে দ্বিতীয় এবং রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রী পার্টি ২০ আসন পেয়ে তৃতীয় হয়। দলনেতা মনমোহন অধিকারীর প্রধানমন্ত্রিত্বে  সিপিএন (ইউএমএল) সংখ্যালঘু সরকার গঠন করে। তবে এ সরকার দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে নেপালি কংগ্রেস নেতা শের বাহাদুর দেউবা রাষ্ট্রীয় প্রজাতন্ত্রী পার্টি ও তরাই ভিত্তিক নেপাল সৎভাবনা পার্টি মিলে কোয়ালিশন সরকার গঠন করে।

অন্যদিকে ১৯৯৫ সালের মার্চ মাসে ইউসিপিএন (মাওবাদী) তাদের তৃতীয় প্লেনামে নেপালের জনগণের মুক্তির  লক্ষ্যে নির্বাচন নয়, জনযুদ্ধ গড়ে তুলতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বর মাসে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি জনযুদ্ধ সংগঠনের বিস্তারিত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে। এই পরিকল্পনা মতে ১৯৯৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি মাওবাদী ৯ জন সাংসদ ৪০ দফা দাবীর এক স্মারকপত্র প্রধানমন্ত্রীর কাছে পেশ করেন এবং দাবী পূরণ না হলে ১৩ ফেব্রুয়ারি থেকে জনযুদ্ধ শুরু করার ঘোষণা দেন। দাবী নিয়ে কোন আলোচনা না হওয়ায় ঘোষণা অনুযায়ী ১৩ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ৩০০ জন নারী-পুরুষের এক সশত্র দলের গোর্খা জেলায় অবস্থিত Small Farmers Development Office-SFDP  কার্যালয় দখল করে নেয়ার মধ্য দিয়ে শুরু হয় ১০ বৎসর ব্যাপী ঐতিহাসিক জনযুদ্ধ। শুরু হয় নেপালের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দ্বিতীয় অধ্যায়, রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আন্দোলন।

 

২.২ রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আন্দোলন

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে ইউসিপিএন (মাওবাদী) রাজতন্ত্রের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিলেও তারা কখনই রাজতন্ত্র মেনে নেয়নি। বরং রাজতন্ত্র বিলোপ করে রিপাবলিক রাষ্ট্র গঠনে নেপালের যে  রাজনৈতিক  শক্তি  অন্তত  চিন্তা-ভাবনার  দিক  থেকে  এককভাবে সকলকে  প্রভাবিত  করতে  সক্ষম  হয়, নেপাল রাষ্ট্রের বিপ্লবী রূপান্তরের মূল চালিকা  শক্তি, তাঁরা মাওবাদী কমিউনিস্ট।  অবশ্য যখন রাজতন্ত্রের পতন সন্নিকটে তখন অন্য দলগুলো রিপাবলিক গঠনের দাবিতে সামিল হয়েছিল। নেপালের এখনকার প্রধান তিন রাজনৈতিক দল হল  নেপালি কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল,  (CPN–UML ),  ইউনিফায়েড  কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল-মাওইস্ট (UCPN-Maoist)। মাওবাদিরা  বাকি  দুই  দলকে  রাজনৈতিক  সংগ্রামের  করণীয়  ও  লক্ষ্য  বিষয়ে   তাদের সাথে সামিল  করতে  সক্ষম  হয়েছিল  যে  আশু কর্তব্য  হল – রাজতন্ত্রের  উৎখাত এবং  একটা  রিপাবলিক  গড়া। মাওবাদিদের  সফলতা  হল  রাষ্ট্রগঠন  ধারণাকে  প্রথমে রাজনীতিকদের  মধ্যে  জনপ্রিয়  করতে পেরেছিল। ফলে পুরো  জনগোষ্ঠিকে  রাষ্ট্রগঠন  ও  শাসনতন্ত্র প্রণয়নের  কাজের  গুরুত্ব  বুঝানো সহজ হয়েছিল। কেন  এটা  করণীয়  ও  গুরুত্বপুর্ণ   তাও  জনগণের নিকট স্পষ্ট  করতে পেরেছিল।  এভাবে  পুরো  জনগোষ্ঠিকে  তারা  এই  একই  লক্ষ্যে  ধাবিত করতে  পেরেছিল। এক্ষেত্রে তারা প্রকাশ্য ও গোপন, গণআন্দোলন ও গণযুদ্ধ – সকল পদ্ধতি অনুসরণ করেছিল। বস্তুত ১৯৯৬ সালে মাওবাদিরা  ঘোষণা দিয়ে অস্ত্র হাতে নিলে রাজতন্ত্রের অধীনে থেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতির বাস্তব পতন শুরু হয়। তাই নেপালের রিপাবলিক গঠনের রাজনৈতিক সংগ্রাম বুঝতে ইউসিপিএন (মাওইস্ট)–এর রণনীতি ও রণকৌশলও এ নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে।
নেপালের  আভ্যন্তরীণ  রাজনীতি  ও  এর  আন্তর্জাতিক  সম্পর্ক  সরাসরি  তার   ভৌগলিক অবস্থান তথা স্থলবেষ্টিত নেপাল হবার  সঙ্গে  জড়িত।  স্থলবেষ্টিত বলে অন্যদেশ তথা ভারতের  ভিতর  দিয়ে  যাওয়া  ছাড়া  সরাসরি  সমুদ্রে  বা  সমুদ্র বন্দর  ব্যবহারের  কোন  উপায়  নেপালের  ছিল না।  তাই মাওবাদিদের রণকৌশল বুঝতে  ভৌগলিক কারণ থেকে উদ্ভুত বিভিন্ন অধীনতামূলক চুক্তি এ নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে উল্লেখ্য, নেপালে রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ থাকাকালীন অবস্থায় বেশিরভাগ দলের সদর দফতর ভারতে অবস্থিত ছিল এবং কেন্দ্রীয় কমিটির অনেক নেতাই ভারতে অবস্থান নিয়েছিল।  পার্টি কংগ্রেস, কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং ভারতে অনুষ্ঠিত হতো।

 

ক. ভৌগলিক অবস্থানের রাজনীতি

নেপালের উত্তর  দিক চীন এবং বাকি তিন দিক ভারত দ্বারা ঘেরা। চীন সীমান্তের  পুরোটাই তিব্বত মালভূমির মধ্যে অবস্থিত ও হিমালয় পর্বতমালা দ্বারা  বেষ্টিত। ব্রিটিশ  যুগে এটা  প্রায় অগম্য অঞ্চল ছিল। এ কারণেই  নেপাল  ভারতের  সঙ্গে  এক প্রকার  অদৃশ্য  অথচ  ব্যবহারিক–বাস্তবিক  অর্থেই  ঔপনিবেশিক  সম্পর্কে  জড়িয়ে  পড়ে  আছে। ইতিহাস বলে ভারত  যতই  অসংখ্য  রাজার  রাষ্ট্রের  বদলে  সংগঠিত  একক কোন  কেন্দ্রীয়  শাসনের  অধীনে  বড়  রাষ্ট্র  হয়ে  হাজির  হয়েছে  ততই  সেই  একক  ভারত  নেপালকে  স্থলবেষ্টিত  দেশ  হিসেবে  হাজির  করে  সুবিধা  নিয়েছে।  নেপাল বাধ্য হয়েছে অধীনতামূলক চুক্তি করতে।  নেপালের  জনগণের  লড়াই  সে  কারণে একই সাথে  নেপালের  ভৌগলিক  অবস্থান  দ্বারা  নির্ধারিত  অধীনতামূলক  সম্পর্ক  থেকে  মুক্তিরও  লড়াই । তাই নেপালের রিপাবলিক গড়ার আন্দোলন ও মাওবাদীদের রণকৌশল বুঝতে এদিকটাও বিচার করতে হবে।

নেপালের অধীনতামূলক চুক্তিগুলো হল-

সুগৌলি চুক্তি ১৮১৬

১৮১৪-১৬ সালের  এংলো-নেপালিজ  যুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বিজয়লাভ  করলে  বৃটিশদের  সাথে  চুক্তি সাপেক্ষে  বাস্তবে  করদ  রাজ্যের  মত  নেপালকে  সীমিত  স্বাধীনতা  মেনে  নিতে  হয় যা সুগৌলি  চুক্তি  ১৮১৬  নামে পরিচিত।  ঐ  চুক্তি  অনুসারে  নেপালের  প্রায়  এক-তৃতীয়াংশ ভুমি – বিশেষত  যেগুলো  কোম্পানীর  চোখে  ষ্ট্রাট্রেজিক  গুরুত্বসম্পন্ন  বলে  মনে  করা  হয়েছিল  সে  ভুমিগুলো  বৃটিশ-ভারত  নিজের  সাথে  রেখে  দেয়।

নেপাল-ভারত  চুক্তি  ১৯২৩

বৃটিশদের  প্রবল  ক্ষমতা  ও  আধিপত্যের  মুখে নেপালের শাসকরা  বৃটিশ  নীতি  সমর্থন  করে  তাদের  খুশি  করার  বিনিময়ে  নিজের  কাজ  উদ্ধারের  রাস্তা  ধরে।   ১৮৫৭ সালের    সিপাহী  বিদ্রোহের  সময়  নেপাল  ব্রিটিশদের পক্ষে   বিদ্রোহ  দমনে  যোগ  দিলে ভীষণ  খুশি  হয়ে  বৃটিশরা দখল  করা  ভুমির  উল্লেখযোগ্য  অংশ ফেরত  দিয়ে  দেয়।  এভাবে  প্রথম  বিশ্বযুদ্ধে  বৃটিশ  সরকারকে  দেয়া  সমর্থন  ও  সহযোগিতার কারণে আরও  কিছু  অঞ্চল  ফিরে পায় নেপাল। । স্বাক্ষরিত  হয় তুলনামূলক  শিথিল  সাত  দফার   নেপাল-ভারত চুক্তি ১৯২৩ । এই  চুক্তিতে নেপালকে  স্বাধীন  দেশ  হিসেবে  মেনে  নেওয়া  হলেও স্বাধীন নিরাপত্তা  নীতি প্রতিষ্ঠার অধিকার দেয়া হয় নি। এজন্য চুক্তিতে বলা হয়, নেপাল বৃটিশদের স্বার্থহানি ঘটাতে পারবে না ত বটেই, যাতে তা না ঘটে তারও তদারকি  করতে হবে নেপালকেই।  নেপাল  বৃটিশ-ভারতের  ভিতর  দিয়ে  অস্ত্রশস্ত্রসহ যে কোন  মালামাল  আমদানী  করতে পারবে – যতক্ষণ  বৃটিশ-ভারত  মনে  করবে  নেপালের  আচরণ  বন্ধুত্বপুর্ণ  এবং  ভারতের  জন্য  তা  হুমকি  নয়।

ভারত-নেপাল  মৈত্রী ও বন্ধুত্ব চুক্তি ১৯৫০

১৯২৩ সালের  চুক্তির কার্যকারিতার  মেয়াদ  ছিল  ৩১ জুলাই ১৯৫০ পর্যন্ত।  বৃটিশরা ১৯৪৭ সালে  ভারত  ছেড়ে  চলে গেলে  স্বভাবতই  চুক্তির  আইনী  দায়  এবং  দায়িত্বের  মালিক  হয়  নেহেরুর  ভারত।  বৃটিশ  সাম্রাজ্যবাদ  নেপালের  সাথে  চুক্তির  ক্ষেত্রে  যে  নীতিগত  দিক  অনুসরণ  করেছিল  স্বাধীন  ভারত  সবজায়গায় হুবহু একই নীতি  অনুসরণ  করে।  পুরনো  চুক্তির  নীতিগত  আদলে  নতুন  করে  ১৯৫০ জুলাইতে  দশ  পয়েন্টের ‘ভারত-নেপাল  মৈত্রী ও বন্ধুত্ব চুক্তি’  সাক্ষরিত হয়।  কিন্তু  মূল ভাব একই – “সন্তুষ্টি  বা  ভারতের  নিরাপত্তার”  কথা  তুলে নেপালকে  ভারতের  মুখাপেক্ষি  করে  রাখা,  ভারতের  স্বার্থের  অধীনস্থ করে   নেপালের স্বার্থকে গৌণ করে রাখা।

এভাবে নেপালের স্থলবেষ্টিত দশাকে জিম্মি করে ভারত দাসত্বের চুক্তি চাপিয়ে দেয় যা নেপালের অর্থনীতি ভারতীয়দের নিয়ন্ত্রণে নেয়া সহজ করে দেয়। এ অবস্থা নেপালের জনগণকে প্রচণ্ড ভারত বিরোধী করে তুলে। মাওবাদীরাও তাদের ৪০ দফা কর্মসূচিতে ১৯৫০ সালের  চুক্তি  বাতিলের কথা  উত্থাপন করেছিল। তাঁরা  ভারতকে  নিজ  রাষ্ট্রস্বার্থের  বিরুদ্ধে প্রধান  শত্রু  মনে  করত। কিন্তু এই জনপ্রিয় দাবিকে তাঁরা মুখ্য করে সামনে আনে নি।  বরং তাদের রিপাবলিক গড়ার আন্দোলনে ভারতকে পাশে পাওয়ার রণকৌশল অবলম্বন করেছিল।

 

খ. সংবিধান সভা দ্বারা সংবিধান প্রণয়নের আন্দোলন

নেপালে সংবিধান সভার মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের দাবী অনেক পুরনো। ১৯৫০ সালের রানা শাসন বিরোধী আন্দোলনে সংবিধান সভার মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের দাবী প্রথম জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়। রাজা ত্রিভুবন অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের সময় প্রতিশ্রুতি দেন যে এই সরকার ১৯৫২ সালের মধ্যে সংবিধান সভা নির্বাচন আয়োজন করবে। তবে রাজা বা অন্তর্বর্তী সরকার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি।

নেপালি কংগ্রেস সংবিধান সভার  দাবী থেকে সরে এলেও সিপিএন এই দাবী বারেবারে উত্থাপন করেছে। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত সিপিএন কংগ্রেসে নির্বাচিত  সংবিধান সভার মাধ্যমে রিপাবলিক নেপাল গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করা হয়। ১৯৬১ সালের প্লেনামে চরমপন্থী নেতা মোহন বিক্রম সিংহ গ্রুপ সংবিধান সভা নির্বাচনের লাইন তুলে ধরেন। সিপিএন-চতুর্থ কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে তিনি সংবিধান সভা নির্বাচনের দাবী পার্টির প্রধান কর্মসূচি করে নিয়ে আসেন। ১৯৬২ সালে রাজা মহেন্দ্র সংবিধান প্রণয়নের উদ্যোগ নিলে বিভিন্ন কমিউনিস্ট দল ও গ্রুপগুলো নির্বাচিত সংবিধান সভার  মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের পক্ষে বক্তব্য প্রদান করে। ১৯৯০ সালের গণআন্দোলনে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট নির্বাচিত সংবিধান সভার মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়নের দাবীটি পুনরায়  মুখ্য করে সামনে নিয়ে আসে। অন্যদিকে নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএন (ইউএমএল)-এর ইউনাইটেড লেফট ফ্রন্ট সাংবিধানিক রাজতন্ত্রের পক্ষাবলম্বন করে। এখানেই শেষ নয়, সংবিধান সভার মাধ্যমে সংবিধান প্রণয়ন ও রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে জনযুদ্ধ শুরু করে মাওবাদী কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট। বিশেষ করে ২০০১ সাল থেকে তারা এটাকে একমাত্র ইস্যু করে বসে। যার ফল হল রাজতন্ত্রের পতন এবং সংবিধান সভার  মাধ্যমে রিপাবলিক নেপাল প্রতিষ্ঠা। সংবিধান সভা দ্বারা সংবিধান প্রণয়নের দাবী উত্থাপনের অর্ধ শতাব্দীরও বেশি বছর পর পূরণ হল নেপালের জনগণের সংবিধান সভার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার আকাঙ্খা।

 

গ. জনযুদ্ধ

রাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৯৬ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি মাওবাদীরা সশত্র সংগ্রাম শুরু করে যা জনযুদ্ধ নামে সারা বিশ্বে পরিচিতি পেয়েছে। ১০ বছর স্থায়ী এই জনযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে ২০০৬ সালের ২১ নভেম্বরের ঐতিহাসিক শান্তি চুক্তির মধ্য দিয়ে। নেপালের জনযুদ্ধ বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিতঃ

প্রথমত, তারা ৯৫ সালের শেষ দিক থেকে যুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্টের ব্যানারে সারা দেশে অসংখ্য বিশাল বিশাল গণমিছিল ও গণসমাবেশ করে জনযুদ্ধের আদর্শিক বাতাবরণ তৈরি করে। এরপর ঘোষণা দিয়ে ব্যাপক জনগণকে সাথে নিয়ে একযোগে দারিদ্র্য পীড়িত পাহাড় ঘেরা দুর্গম প্রত্যন্ত অঞ্চলের অনেকগুলো স্থানে ( মূলত পশ্চিম, পূর্ব ও মধ্য নেপাল যেখানে পার্টির শক্ত অবস্থান রয়েছে) আক্রমণের মধ্য দিয়ে জনযুদ্ধ শুরু করে। এর পরের পনের দিন নেপালের বিভিন্ন যায়গায় ৫০০০ এর অধিক আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। অর্থাৎ নেপালের ক্ষেত্রে জনযুদ্ধ শুরু হয়েছে গণ বিদ্রোহের ভেতর দিয়ে।  পাশাপাশি তারা লক্ষ লক্ষ লিফলেট বিলি করেছে যাতে আক্রমণের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়। এতে আরও বলা হয় সরকার তাদের দাবী মেনে নিলে তারা যুদ্ধ থেকে সরে যাবে। ফলে তাদের যুদ্ধ করার উদ্দেশ্য আক্রান্ত এলাকার জনগণের নিকট স্পষ্ট করা সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, তারা গ্রামাঞ্চলে জনযুদ্ধ আর শহরে গণআন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান গড়ে তোলার লাইন গ্রহণ করে যা ‘প্রচণ্ড পথ’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। অন্যভাবে বললে, এটা চীন বিপ্লবের দীর্ঘস্থায়ী জনযুদ্ধের লাইনের সাথে রুশ বিপ্লবের গণঅভ্যুত্থানের লাইনের ফিউশন।

তৃতীয়ত, তারা আন্তরিকভাবে বারবার শান্তি আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে এবং এ জন্য যুদ্ধ বিরতি দিয়েছে যা কখনো একতরফাও ছিল। এর মাধ্যমে জনগণকে এই বার্তা দেয়া হয়েছে তারা সংঘাত নয় শান্তি চায়। তাদের দাবী মেনে নিলে তারা অস্ত্র ছেড়ে দিতে প্রস্তুত।  অবশ্য নিজেদের গুছিয়ে নেয়ার জন্যও তাদের যুদ্ধবিরতির প্রয়োজন ছিল। আবার এই সুযোগে তারা সারা দেশে গণসমাবেশের আয়োজন করে জনগণের নিকট নিজেদের বক্তব্য তুলে ধরেছে।

চতুর্থত, মাওবাদীদের চিন্তায় যুক্তফ্রন্টের ধারণা গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করেছে। শুধু সমমনা দলগুলো নিয়ে ফ্রন্ট নয়, বিভিন্ন নির্যাতিত ও বঞ্চিত জনজাতির আন্দোলন সংগঠনের সাথেও বিপ্লবী ফ্রন্ট গড়ে তুলেছে। জনযুদ্ধের বিভিন্ন পর্যায়ে এসব জনজাতি, দলিত সম্প্রদায়ের মুক্তিকামী সংগঠন গড়ে উঠেছে। এদের আকাঙ্খা ধারণ করতেই তারা এথনিক ফেডারেল রাষ্ট্র গড়ার প্রস্তাবনা হাজির করেছে। পাশাপাশি তারা শ্রেণি, পেশা, নারী ও ছাত্রদের ফ্রন্ট গড়ে তুলেছে।

পঞ্চমত, নিয়ন্ত্রিত এলাকায় বিকল্প প্রশাসন তথা গণসরকার গঠন। মাওবাদীদের আক্রমণের মুখে বিভিন্ন জেলার গ্রামাঞ্চল থেকে পুলিশ বাহিনী প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয় সরকার। স্থানীয় সরকারের সকল স্তরের প্রশাসনের ক্ষেত্রেও একই পরিনিতি ঘটে। এসব অঞ্চলে সমান্তরাল বিকল্প গণশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলে তারা। নির্বাচনের মাধ্যমে এসব জনপ্রতিনিধিত্বশীল স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়।

ষষ্ঠত, রাজা বীরেন্দ্রের আমলে তাদের আক্রমণের লক্ষ্য ছিল শুধু পুলিশ বাহিনী, রাজকীয় নেপাল আর্মি নয়। তারা রাজা বীরেন্দ্রের বিরুদ্ধে কোন বক্তব্য রাখেনি। বস্তুত, রাজা বীরেন্দ্র মাওবাদিদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে দেন নি। সেনা অভিযান চালানোর প্রধানমন্ত্রী কৈরালার অনুরোধ পর্যন্ত রাখেননি। তবে রাজা জ্ঞানেন্দ্র ক্ষমতায় এলে তারা নেপাল আর্মিকেও তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু করে।

 

ঘ. শান্তি আলোচনা ও যুদ্ধবিরতি

ক. ২০০১ সালের আগস্টে মাওবাদী দ্বারা ১৭ জন পুলিশ কর্মকর্তাকে হত্যা করার পরের দিন প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে আলোচনার প্রস্তাব দেন। একে স্বাগত জানিয়ে মাওবাদীরাও যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। জনযুদ্ধ শুরুর ৫ বছর পর এই প্রথম উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে যা তিন মাস স্থায়ী হয়। শুরু হয় প্রথম শান্তি আলোচনা। তিন দফা বৈঠক হবার পর নভেম্বরে কোন সমযোতা ছাড়াই আলোচনা ভেঙ্গে গেলে পার্টি এককভাবে যুদ্ধবিরতি ভেঙ্গে দেয়।

খ. ২০০৩ এর জানুয়ারিতে মাওবাদী গেরিলারা স্ত্রীসহ পুলিশ বাহিনীর প্রধানকে হত্যা করে। এর  ৩ দিন পর সরকার ও পার্টি প্রকাশ্য ঘোষণা দিয়ে যুধবিরতি কার্যকর করে। এপ্রিলে দ্বিতীয় দফা শান্তি আলোচনা শুরু হয়। এবারও তিন দফা আলোচনা হয়। আগস্টে তৃতীয় দফা আলোচনা চলাকালীন সময়ে নেপাল আর্মি ১৯ জন মাওবাদী ও সাধারণ জনগণকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করলে আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। এর এক সপ্তাহ পর পার্টি প্রধান ওয়েব সাইটের মাধ্যমে সাত মাস ধরে চলা যুদ্ধবিরতি ও দ্বিতীয় পর্যায়ের শান্তি আলোচনার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।

গ. ২০০৫ সালে সেপ্টেম্বরে রাজা জ্ঞানেন্দ্র জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বৈঠকে যোগদান করতে নিউইয়র্ক সফরের পরিকল্পনা করলে মাওবাদী পার্টি তিন মাসের একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে। আবার ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিলে তা প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেয় পার্টি। এবং প্রস্তুতি হিসেবে পার্টি একতরফা যুদ্ধবিরতি প্রত্যাহার করে। আবার ২০০৬ এর এপ্রিলে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট শুরুর একদিন আগে পার্টি কাঠমণ্ড ভ্যালীতে একতরফা যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করে।

ঘ. তৃতীয় পর্যায়ের শান্তি আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে। ২০০৬ সালের ২৬ মে  শুরু হওয়া এ আলোচনায় কয়েক দফা বৈঠক হয়। শান্তি চুক্তিতে পৌঁছানোর লক্ষে জুনের ১৬ তারিখে সাত দলীয় জোটের সাথে সিপিএন(এম) পার্টির ঐতিহাসিক ৮ দফা সমযোতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। নভেম্বরের প্রথম দিকে দুই পক্ষ ৬ দফার এক ঐতিহাসিক চুক্তিতে সম্মত হয় এবং ২১ নভেম্বর বহু প্রত্যাশিত এই সর্বব্যাপক শান্তি চুক্তি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মধ্য দিয়ে ১০ বছর ব্যাপী সশত্র জনযুদ্ধের সমাপ্তি টানা সম্ভব হয়।

 

ঙ. রাজাকে একা করে বিরোধী রাজনৈতিক শক্তিকে রিপাবলিক গড়ার আন্দোলনে সামিল করার রণকৌশল

মাওবাদীরা ১৯৯৬ সালে যখন জনযুদ্ধ শুরু করে তখন নেপালে ক্ষমতার ভাগীদার বা স্টেক হোল্ডাররা ছিল এ রকমঃ এক. রাজা ও রাজতন্ত্রপন্থী  রাজনৈতিক দলসমুহ। দুই.  সাংবিধানিক রাজতন্ত্রী দল;  মূলত নেপালি কংগ্রেস ও ওর ভাঙা দলছুট অংশ, সিপিএন (ইউএমএল) এবং ছোটখাট নানান কমিউনিস্ট বা লিবারেল দল। তিন. রাজতন্ত্র উচ্ছেদের লক্ষ্যে সশস্ত্র মাওবাদী দল;  চার. স্থলবেষ্টিত নেপালের উপর ছড়ি ঘুরানো ভারত। আর ৫. আমেরিকার নেতৃত্বে পশ্চিমা স্বার্থ। – এভাবে পাঁচটা পক্ষ।

দেখা যায় ২০০৫ সালের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এই পাঁচ পক্ষের চার পক্ষই একদিকে এবং মাওবাদীর বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ থাকতে পেরেছিল। কিন্তু মাওবাদীরা এক সফল রণকৌশলের মধ্য দিয়ে ঐ চারপক্ষীয় জোটে ভাঙন আনতে সক্ষম হয়। এই চারপক্ষীয় জোট অকার্যকর হয়ে উঠলে তাঁরা নেপালের  রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ে এক গ্রান্ড এলায়েন্স বা মহাজোট  তৈরি করে। আর ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র রাজার পক্ষ ছেড়ে দিয়ে মাওবাদীদের পক্ষভুক্ত হয়ে যায়। অবশ্য ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য তাদের নীতির কারণেও রাজতন্ত্রের পক্ষ নেয়া যুক্তিসিদ্ধ ছিল না।

২০০১ সালের ২৬ নভেম্বর রাজা জ্ঞানেন্দ্র সারা দেশে আর্মি নামিয়ে দিয়েও মাওবাদীদের অগ্রগতি রোধে অক্ষম হন। যতই দিন যাচ্ছিল ততই স্পষ্ট হচ্ছিল রাজা গৃহযুদ্ধ থামাতে পারবেন না, নেপালি জনগণের ইস্পিত শান্তি আনার ক্ষমতা তাঁর নেই। আর এটাকে পুঁজি করে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রী তথা প্রকাশ্য রাজনৈতিক দলগুলো সংসদে রাজার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো শুরু করে। বিরোধীরা যাতে সংসদে রাজার বিরুদ্ধে নিন্দার ঝড় না তুলতে পারেন তাই ২০০২ সালের ২২মে প্রধানমন্ত্রী সংসদই ভেঙ্গে দেন। এরফলে রাজার সাথে রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক দলগুলোর বিরোধ প্রকট হওয়া শুরু হয়। ২০০৩ সালের শেষাশেষি এসে রাজার সাথে প্রকাশ্য দলগুলোর বিরোধ চরমে উঠে। আমেরিকান সেক্রেটারি অব ষ্টেট ক্রিস্টিনা রোকা ২০ ডিসেম্বর ২০০৩ নেপালে এসে প্রকাশ্য দলগুলোর পারস্পরিক খেয়াখেয়ি, ঈর্ষা, পারস্পরিক অনাস্থা-বিরোধ মিটাতে উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হন। ২০০৫ সালে রাজা জ্ঞানেন্দ্র রাষ্ট্রের প্রধান  নির্বাহি তথা প্রধানমন্ত্রী হলে সাংবিধানিক রাজতন্ত্রী দলগুলোর জন্য নিয়মতান্ত্রিক দল হিসেবে কার্যকর থাকার শর্ত ও সুযোগ রুদ্ধ করে দেয়া হয়। ফলে এসব দল অস্তিত্ব সংকটে পড়ে যায়। এ অবস্থা ভারত এবং যুক্তরাষ্ট্রের দিক থেকে রাজার পক্ষে সমর্থন যুগিয়ে তাকে টিকিয়ে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে।

এদিকে মাওবাদীরা নিজেদেরকে সকলের কাছে ব্যবহারিকভাবে গ্রহণযোগ্য করতে নিজেদের অবস্থান পরিস্কার করে ফেলেছিল। পাশাপাশি  রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক দলগুলোর  (মূলত নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএন-ইউএমএল) সাথে ঐক্যের কমন পয়েন্টগুলো কি হতে পারে তা স্পষ্ট করে বলা শুরু করেছিল। আইনী দলগুলোর মধ্যে বড়, বিশেষত নেপালী কংগ্রেস আর সিপিএন(ইউএমএল) রাজার উপর সম্পুর্ণ আস্থা হারিয়ে ফেলায় চাইছিল মাওবাদীদের সাথে সম্পর্ক করতে। এক্ষেত্রে ভারতীয়রাও কিছু ভুমিকা রেখেছিল। এসব কিছু মিলিয়ে নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণ শুরু হয়। আর নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে সবচেয়ে নির্ধারক ভুমিকা রেখেছিল মাওবাদীদের নতুন ধরণের রাজনীতি।

কমিউনিস্টদের নিয়ে সাধারণ ধারণা হল, তাদের রাজনীতি একটি ‘ব্যক্তি মালিকানা উচ্ছেদ’কেন্দ্রিক রাজনীতি। ক্লাসিকাল রিপাবলিক প্রতিষ্ঠা নয়, জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করাই তাদের লক্ষ্য। রাষ্ট্র ও শাসনতন্ত্র কী, কেমন হবে তা তাদের আলোচ্য বিষয় নয়।। অন্যদিকে, নেপালের মাওবাদীরা প্রথমত মালিকানা উচ্ছেদকেন্দ্রিক রাজনীতিকে প্রধান করেনি। বরং অদ্ভুতভাবে নতুন রাষ্ট্র তথা রিপাবলিক গঠন (কনষ্টিটিউট) করার দিকে ছিল এদের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু।  কখনই ভুলে নাই যে তারা রাজতন্ত্র উচ্ছেদ করে একটা রিপাবলিক গড়তে চায় – এটাই ঐ স্তরে তাদের মূল করণীয়। সাধারণত কমিউনিষ্টরা নিজেদের পরিচিত করিয়ে এসেছে অর্থনৈতিক কর্মসুচির ভাবনা দিয়ে। আর ঠিক ততোধিক রাষ্ট্রগড়ার বিষয়টাকে উপেক্ষায় ফেলে রেখে এসেছে। নেপালের মাওবাদীরা  বিষয়টাকে প্রথম উল্টো দেখিয়েছেন। দ্বিতীয়ত মাওবাদীরা বিভেদমূলক পরিচয়ের উর্ধে সকলকে বলতে দেয়া, কাউকে উপেক্ষায় ফেলে না রাখা এমন ইনক্লুসিভ রাষ্ট্রগঠনের ধারণা হাজির করেছে। বহুদলীয় পদ্ধতি মেনে নিয়েছে। তৃতীয়ত এরা সাম্রাজ্যবাদ বা আধিপত্যবাদ রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু করেনি। এসব কারণে যুক্তরাষ্ট্র মাওবাদী অবস্থানকে সমর্থন করতে উৎসাহী হয়েছিল।

ভারত সরকারও আমেরিকার গৃহীত নেপালের স্বার্থবিরোধ নিষ্পত্তি মিটাবার ফর্মুলার মধ্যেই নিজের স্বার্থ দেখেছিল। ভারতের উদ্বেগের দিকটা ছিল মাওবাদী দল শুরুতে যে ৪০ দফা দাবি জানিয়েছিল তাতে স্পষ্ট করে ভারত সম্পর্কে মূল্যায়ন করে বলা হয়েছিল “ভারত নেপালি রাষ্ট্রস্বার্থের প্রধান শত্রু”। আর বিশেষ করে ১৯৫০ সালের ভারত-নেপাল মৈত্রী চুক্তিকে দাসত্ব চুক্তি বলে তা রদ করার দাবি করা হয়েছিল। স্বভাবতই এমন খোলাখুলি মুল্যায়ন ভারতের জানা থাকা সত্ত্বেও তারা মাওবাদীদের ঐ বক্তব্যকে প্রধান করে দেখে নাই। সবার আগে রাজতন্ত্র উচ্ছেদ – মাওবাদীদের এই নিষ্ঠা ভারতের উদ্বেগ কমিয়ে দিয়েছে। ভারতের মাওবাদী রাজনীতি ও আন্দোলন ভারতের সরকারগুলোর কাছে এক বিরাট উদ্বেগজনক মাথাব্যাথা। কিন্তু নেপালের মাওবাদীর সাথে এটা নামে এক হলেও, ভারতের মাওবাদ থেকে নেপালের মাওবাদ বৈশিষ্টমূলক ভাবে আলাদা। ভারত দেখেছিল, নেপালের মাওবাদীরা যদি ক্ষমতায় আসে এবং বহুদলীয় পদ্ধতি, পপুলার ভোট ইত্যাদির ভিতরে থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করে তবে এই মাওবাদের সাথে ভারতের কার্যকর সম্পর্ক গড়া ভয়ের নয়, বরং ভারতের জন্য খুবই দরকারি। আর ঠিক এর বিপরীতে নেপালের মাওবাদ যদি সশস্ত্র ও মাঠে থেকে যায়, আর যদি তা ভারতের মাওবাদের সঙ্গে মিলে যায় সেটা ভারতের জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি কঠিন ও জটিল করে তুলতে পারে। এটা ভারতের স্বার্থের দিক থেকে এক বিরাট অর্জন। এটাও একটা কারণ, ভারত আমেরিকার অবস্থানের পক্ষ নিয়েছিল। এক কথায় বললে মাওবাদীদের রাজনৈতিক কৌশল আর অগ্রাধিকার প্রয়োগ সঠিক ছিল বলেই তারা রাজাকে একা করতে পেরেছিল। বস্তুত ভারত বিরোধিতা করলে নেপালের বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিবর্তনের সম্ভাবনা যতই পরিপক্ক হয়ে থাক না কেন তা বাস্তব হতে পারা কঠিন ছিল।

নেপাল বিপ্লবে ভারতের নির্ধারক অবদান ছিল, ১২ দফা তৈরির ব্যাপারে সাত দলীয় জোট আর মাওবাদীদের প্রধান নেতাদের মধ্যে সরাসরি মুখোমুখি আলাপের আয়োজক হিসেবে ভুমিকা। এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ  সাক্ষাতের পরে বাস্তবত রাজতন্ত্র উচ্ছেদের মঞ্চ তৈরি হয়ে যায়। ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর  উভয় পক্ষের মধ্যে ১২দফা চুক্তি সাক্ষরের মধ্য দিয়ে সকল রাজনৈতিক দলের এক মৈত্রী জোট গড়ে ওঠে। এই জোট রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে সক্ষম হয় যা রাজার পরাজয়ের কাল হয়ে ওঠে।

রাজতন্ত্র  সমূলে উৎপাটন এবং রিপাবলিক প্রতিষ্ঠায় সকল রাজনৈতিক শক্তিকে  ঐক্যবদ্ধ করে ক্ষমতার নতুন মেরুকরণ ঘটানোয় মাওবাদীদের ছিল মুখ্য ভূমিকা। এজন্য তাদেরকে রাজার বিকল্প এক ভাগাভাগি ক্ষমতার অংশ হতে সাতদলের সাথে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে রাজি হতে হয়েছে। বহুদলীয় গণতন্ত্রের নীতি অবলম্বন করতে হয়েছে । অস্ত্র ছেড়ে দিয়ে দলকে প্রকাশ্যে আনার প্রয়োজন হয়েছে। যখন নেপালের ৭০ ভাগ গ্রাম এলাকা তাদের  নিয়ন্ত্রণে, ক্ষমতার দিক দিয়ে তাঁরা চালকের আসনে তখন দলকে প্রকাশ্য করা, ৭ দলের সাথে ক্ষমতা ভাগাভাগি করার কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। অনেক বাধাবিপত্তি, বাঁক বদলের মধ্য দিয়ে মাওবাদীদের রাজনতিক সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়েছে। জটিল ও ঝুঁকিপূর্ণ  সময়ের ভিতর দিয়ে  যেতে হয়েছে, সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। এসব ক্ষেত্রে দল ভাঙ্গার সমূহ সম্ভাবনা থাকে, কিন্তু এসময় তাদের দল ভাঙ্গেনি। সবাই একমত হয়েই এসব সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছিল।

 

চ. দ্বিতীয় গণঅভ্যুত্থান

২০০৫ সালের ১ জানুয়ারী রাজা জ্ঞানেন্দ্র একইসাথে রাষ্ট্রের প্রধান  নির্বাহি তথা প্রধানমন্ত্রী  হয়ে বসেন এবং জরুরি অবস্থা জারী করেন। সংবিধান ভূলুণ্ঠিত করে রাজার ক্ষমতা নেয়ার প্রতিবাদে পেশাজীবী সংগঠন বিশেষ করে নেপাল বার এসোসিয়েশন ও নেপাল সাংবাদিক ফেডারেশন আন্দোলন শুরু করে। ধীরে ধীরে প্রায় গোপনে চলে যাওয়া রাজনৈতিক দলগুলো আন্দোলনে শরিক হতে থাকে।  ছাত্র সংগঠনগুলোও এ আন্দোলনে যোগ দেয়। এ অবস্থা সশস্ত্র মাওবাদী এবং রাজতন্ত্রী সাংবিধানিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের শর্ত সৃষ্টি করে। তারা ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর ১২ দফা শর্তে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়তে সম্মত হয়। প্রধান প্রধান দফাগুলো হল – রাজতন্ত্রের বিলোপ সাধন, বিলুপ্ত সংসদ পুনর্বহাল, সকল দল মিলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন, সংবিধান সভার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রণয়ন এবং যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সরকার সারা দেশে পৌরসভা নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা জারী করে। মাওবাদীরা সাত দলীয় জোটের গোপন কৌশলগত সমর্থন নিয়ে এই নির্বাচন প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নেয়। তারা  কয়েকটি পৌরসভায় আক্রমণ চালায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন প্রার্থীকে হত্যা করে। ফলে ৭৫ ভাগ আসনে কোন প্রার্থী থাকেনি আর ভোটারের উপস্থিতি ২১ শতাংশের নিচে দাঁড়ায়। সকল দল মিলে ২০০৬ সালের ৬ এপ্রিল থেকে ৪ দিনের সাধারণ ধর্মঘট এবং ৮ তারিখে কাঠমণ্ডুতে গণসমাবেশ আহবান করে।  ৪ দিনের সাধারণ ধর্মঘট ১৯ দিন পর্যন্ত চলে যা গণঅভ্যত্থানে রূপ নেয়। ২১ এপ্রিল কাঠমণ্ডু ও ললিতপুরকে ঘিরে থাকা রিং রোডে নেপালের ইতিহাসে স্মরণাতীতকালের বৃহত্তম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। ২৪ এপ্রিল রাজা জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়া এবং বিলুপ্ত প্রতিনিধি পরিষদ পুনরজ্জীবনের ঘোষণা দেন। জিপি কৈরালাকে প্রধানমন্ত্রী করে ৭ দলীয় অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। পুনরুজ্জীবিত প্রতিনিধি পরিষদের বৈঠকে সংবিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, রাজার বিশেষ অধিকার বিলুপ্ত করা হয়, রাজকীয় নেপাল আর্মির নাম পরিবর্তন করে নেপাল আর্মি ও সেনাবাহিনী প্রধান নিয়োগের ক্ষমতা কেবিনেটের হাতে ন্যস্ত করা হয় এবং নেপালকে সেক্যুলার রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করা হয়। জুনের ১৬ তারিখে মাওবাদী দল ও  সাত দলীয় জোটের মধ্যেকার স্বাক্ষরিত ৮ দফা সমযোতা চুক্তি  মোতাবেক ৬ সদস্যের  Interim Constitution Drafting Committee গঠন করা হয়। পরে সদস্য সংখ্যা বাড়িয়ে ১৫ জন করা হয়। ৭ দল এবং মাওবাদীদের মধ্যকার বিভিন্ন চুক্তির আলোকে ICDC অন্তর্বর্তী সংবিধান প্রণয়ন করে। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় প্রণীত অন্তর্বর্তী সংবিধান ৭ দল এবং মাওবাদীদের প্রতিনিধি কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয় ০৮ ডিসেম্বর ২০০৬ সালে, জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের বিশেষ প্রতিনিধি আয়ান মার্টিনের উপস্থিতিতে। ২০০৭ সালের ১৫ জানুয়ারি প্রতিনিধি পরিষদ সর্বসম্মতিক্রমে অন্তর্বর্তী সংবিধান অনুমোদন করে। একই সাথে রাজতন্ত্রীপন্থী সাংসদ বাদে আগের প্রতিনিধি পরিষদের সকল সাংসদ, মাওবাদীদের থেকে ৭৩ জন সদস্য, এবং ৮টি দল থেকে ৪৮ জন সদস্য নিয়ে মোট ৩২৯ সদস্যের নতুন আইন সভা গঠন করা হয়।

মোটাদাগে অন্তর্বর্তী সংবিধানের ভুমিকাঃ

-    কী কী শর্তে ক্ষমতাসীন সাত দলীয় সরকারের সাথে মাওবাদীরা যুক্ত হবে অন্তর্বর্তী সংবিধান হল তার ভিত্তি।

-    মাওবাদীরা সরকারে যুক্ত হয়ে কী কী কাজ সম্পন্ন করবে এবং কীসের ভিত্তিতে কেন করবে তার দিশা এই অন্তর্বর্তী সংবিধান।

-    অন্তর্বর্তী সংবিধান অনুযায়ী অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান কাজ হল একটা পুর্ণ  সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে সংবিধান সভার সদস্য কতজন হবেন, কারা হবেন তা ঠিক করে সেই নির্বাচন আয়োজন করা।

-    সংবিধান প্রণয়নে কি ধরনের কমিটি হবে, কমিটিগুলো কোন পদ্ধতি-প্রক্রিয়া অনুসরণ করবে তাঁর রূপরেখা তৈরি করা।

 

ছ. সংবিধান সভা গঠন ও সংবিধান প্রণয়ন

নানা বাঁধাবিপত্তিতে, বিশেষত মধেশি আন্দোলন এবং নেপালি কংগ্রেস ও মাওবাদীদের নীতিগত বিরোধের জেরে, যথা সময়ে সংবিধান সভার নির্বাচন করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ২০০৭ সালের ২৩ ডিসেম্বর সব দল একমত হয়ে ২৩ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করতে সক্ষম হয়। এতে সংবিধান সভার প্রথম সভায় সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় নেপালকে ফেডারেল রিপাবলিক করার জন্য অন্তর্বর্তী সংবিধানে সংশোধনী আনার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সিদ্ধান্ত হয় সংবিধান সভার সদস্য হবেন ৬০১ জন। এরমধ্যে নির্বাচিত সদস্য ৫৭৫ জন এবং অনির্বাচিত ২৬জন। আবার নির্বাচিত ৫৭৫ জনের মধ্যে ২৪০ আসনে সরাসরি নির্বাচন এবং ৩৩৫ আসন সংখ্যানুপাতিক হারে অংশগ্রহণকারী দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করা হবে। ২৮ ডিসেম্বর তৃতীয় সংশোধনী বিল হিসেবে সংসদে সর্বসম্মতিতে অনুমোদিত হয়। ২০০৮ সালের ১০ এপ্রিল নেপালের প্রথম সংবিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এতে মাওবাদীরা সবমিলিয়ে পেয়েছিল ২২০টি বা ৩৮% আসন, যেটা সর্বোচ্চ। আর এর সবচেয়ে কাছাকাছি ফল হল ১১৫ আসনলাভকারী  নেপালী কংগ্রেসের।  তৃতীয় হয়েছিল সিপিএন (ইউএমএল), তাদের আসন সংখ্যা ১০৮টি। চতুর্থ হয়েছিল মদেশি জন অধিকার ফোরাম, তাদের আসন সংখ্যা ৫৪টি। সমঝোতা অনুযায়ী ২৮ মে সংবিধান সভার প্রথম অধিবেশনেই  নেপালকে ফেডারেল রিপাবলিক হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়।

মাওবাদীদের নেতৃত্বে সিপিএন (ইউএমএল), মধেশি জন অধিকার ফোরাম ও অন্যান্য ৪টি ছোট পার্টি নিয়ে সর্বদলীয় সরকার গঠিত হয়। কিন্তু ফেডারেল রাষ্ট্রের কয়টা প্রদেশ হবে, প্রদেশের সীমানা কী হবে তা নিয়ে বিরোধ এমন তুঙ্গে পৌছানো হয় যাতে মনে হয় নেপালের প্রধান রাজনৈতিক সমস্যা বা দ্বন্দ্ব সংঘাত ছিল রাজতন্ত্র উৎখাত নয়, প্রাদেশিক সীমানা ঠিক না হওয়া।  ভারত সীমান্ত সংশ্লিষ্ট কিছু সমতলি অংশ কিভাবে প্রদেশে অন্তর্ভুক্ত হবে-একটা না দুটোতে, কোন কোন জেলা কোথায় নেয়া হবে, নাগরিকত্বের সংজ্ঞা কী হবে এগুলো বড় ইস্যু হিসেবে হাজির করা হয় যাতে প্রতিবেশী দেশ ভারতের স্পষ্ট ইন্ধন ছিল। মধেশি অধ্যুষিত তরাই অঞ্চলের এক নেতা একবার বলেই বসল ভারতকে জামিনদার থাকতে হবে। সব মিলিয়ে এমন পরিস্থিতি তৈরি করা হল যে, প্রথম সংবিধান পরিষদ তার চার বছরের সময়সীমার মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন শেষ করতে পারল না। ফেডারিলজমের প্রকৃতি ও প্রদেশের সংখ্যার তর্কে আটকে স্থবির হয়ে থাকা সংবিধান পরিষদ (দুই বার বাড়িয়ে)  চার বছরের আয়ুসীমা শেষে ২০১২ সালের মে মাসে  আপনি ভেঙ্গে যায়।

তবে ভারত নেপালে  তাদের স্বার্থ রক্ষার উপনিবেশিক পথ অনুসরণ করতে গিয়ে নেপালের প্রধান তিনটা দলের সাথেই সম্পর্ক চরম অবনতিতে নিয়ে যায়। প্রথমে মাওবাদীদের সাথে, ফেডারিল্যেজমের তর্ক  উস্কে দিয়েছিল যাতে মাওবাদীরা সংবিধান প্রণয়ন শেষ করতে না পারে। একাজে বাকী দুদলের প্রচ্ছন্ন সমর্থন নিয়েছিল। এতে কেবল মাওবাদীরাই ফেল করে নাই, নেপালের পুরো রাজনৈতিক প্রক্রিয়াই দিশাহীন চরে আটকে যায়। হতাশায় ডুবে যায় পুরো নেপাল। বহু কষ্টে সুপ্রিম কোর্ট থেকে নতুন দিক নির্দেশনা বের করে ২০১৩ সালের নভেম্বরের ১৯ তারিখে  দ্বিতীয়বার সংবিধান সভার নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব হয়। এবারের নির্বাচনে মাওবাদীরা মাত্র ৮০ আসন পেয়ে তৃতীয় হয়। নেপালী কংগ্রেস ১৯৬ আসন পেয়ে প্রথম এবং ইউএমএল ১৭৫ আসন পেয়ে দ্বিতীয় হয়।

এবার শুরুতেই মাওবাদী নেতা প্রচণ্ডের উদ্যোগে প্রধান তিন দল  একমত হয়ে শপথ নেয় যে তারা একজোট হয়ে প্রথম কাজ সংবিধান প্রণয়ন সম্পন্ন করবে। কারণ একটা পুরো জনগোষ্ঠির রাজনৈতিক হতাশায় ডুবে  যাওয়া কী জিনিষ তা সবাই উপলব্দি করে ফেলেছিল। এটা যেন মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা। ততদিনে এই তিন রাজনৈতিক দলের সাথেই ভারতের সম্পর্ক শেষ। ২০১৪ সালের জানুয়ারীতে দ্বিতীয় গণপরিষদ বা সংবিধান সভার প্রথম অধিবেশন বসে। আর দুবছর শেষ হবার আগেই, ২০১৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর  সংবিধান প্রণয়ন সম্পন্ন হয়ে ঘোষণা হয়ে যায়। গৃহীত সংবিধানের পক্ষে ৫৩৮ জন এবং বিপক্ষে ৬০ জন ভোট দেয়। ৩ জন অনুপস্থিত থাকে। এতে মধেশি ৯৪ জন সদস্যের ৬৭ জন পক্ষে ভোট দেয়, বিরোধিতা করেন ৩৭ জন।

সংবিধান প্রণয়নের জন্য ৫টি থিমেটিক কমিটি গঠন করা হয়। প্রত্যেকটি থিমেটিক কমিটি একটি Concept paper এবং একটি Draft report তৈরি করে সাংবিধানিক কমিটির নিকট জমা দেয়। ১টি থিমেটিক কমিটির কাজ ছিল ওয়ার্কশপ, সেমিনার, সভাসহ বিভিন্ন ভাবে জনগণের মতামত সংগ্রহ করা। বস্তুত সংবিধান প্রণয়নে জনগণের সকল অংশকে সম্পৃক্ত করতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নেয়া হয়েছে। প্রত্যেকটি থিমেটিক কমিটির উপস্থাপিত রিপোর্টের ওপর ব্যাপক বিতর্কের মধ্য দিয়ে সংবিধান সভা যে সুপারিশ ও দিকনির্দেশনা প্রণয়ন করে তাঁর ভিত্তিতেই সাংবিধানিক কমিটি চূড়ান্ত খসড়া সংবিধান তৈরি করেছে। অর্থাৎ এই সংবিধান প্রণয়নে নিচতলা থেকে উপরে আসার পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ নয়, জনগণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।

 

The Constitution of Nepal 2072

নতুন সংবিধান জারীর মধ্য দিয়ে নেপাল ফেডারেল ডেমোক্রেটিক রিপাবলিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে। এতে ৩৫টি অধ্যায়, ৩০৮টি অনুচ্ছেদ এবং ৯টি তফসিল রয়েছে। এই  সংবিধানে ৭টি প্রদেশভিত্তিক একটি ফেডারেল শাসন কাঠামোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কেন্দ্রে দ্বিকক্ষ এবং প্রদেশে এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদ থাকবে। দুই কক্ষের একটি প্রতিনিধি পরিষদ এবং অপরটি জাতীয় পরিষদ। জাতীয় পরিষদের মোট ৫৯ সদস্যের মধ্যে ৭ প্রদেশ থেকে ৫৬ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন এবং প্রেসিডেন্ট ৩ জন সদস্য মনোনয়ন দিবেন। অপরদিকে মিশ্র নির্বাচন ব্যবস্থায় ২৭৫ আসনের প্রতিনিধি পরিষদ গঠিত হবে। এরমধ্যে ১৬৫ আসনে সরাসরি ভোট হবে। আর ১১০ জন সদস্য নির্বাচিত হবেন বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে।

ফেডারেল পার্লামেন্ট প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। প্রেসিডেন্ট হবেন রাষ্ট্রপ্রধান এবং প্রধানমন্ত্রী সরকার প্রধান। তবে রাষ্ট্রপতির হাতে আলাদাভাবে কিছু কর্ম, কর্তব্য ও ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে নির্বাহী ক্ষমতা মন্ত্রীপরিষদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। সেটা করতে গিয়ে তাঁরা প্রধানমন্ত্রী শব্দটি পর্যন্ত উচ্চারণ করেনি।

সংবিধানে ঘোষণা করা হয়েছে নেপাল হবে বহুজাতির, বহু ধর্মের, বহু বর্ণের এবং বহু ভাষীর রাষ্ট্র। তাঁরা সবাই সংখ্যানুপাতে সংসদে নির্বাচিত হবে। এজন্য সংবিধানে আরও বলা হয়েছে অনগ্রসর, জাতিগত সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করে এমন আইন দ্বারা নির্দিষ্ট শর্তে দল ও সংসদ গঠন করতে হবে। তেমনি বৈষয়িক ও সাংস্কৃতিক কোন প্রতিবন্ধকতা যাতে না থাকে তাই  নেপালে উচ্চারিত সকল মাতৃভাষা জাতীয় ভাষা হিসেবে গণ্য করা হয়েছে।

এ সংবিধান প্রবর্তনের মধ্য দিয়ে হিন্দু রাষ্ট্র নেপাল সেক্যুলার রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। সেক্যুলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করতে এই সংবিধানে ধর্মীয় ও লৈঙ্গিক সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সমকামী, উভকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যা এই অঞ্চলে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বলা হয়েছে ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা রক্ষা করা হবে এবং প্রাচীন যুগ থেকে প্রচলিত ধর্ম,  সংস্কৃতি সুরক্ষা দেয়া হবে।

এ সংবিধানে দল ও সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়েছে। যে  ১১০ জন সদস্য বিভিন্ন দলের প্রাপ্ত ভোটের অনুপাতে নির্বাচিত হবেন তার এক তৃতীয়াংশ হতে হবে নারী সদস্য।

সব মিলিয়ে এই সংবিধানে inclusive democracy’র ধারণা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে যেখানে নাগরিকগণ সার্বভৌম এবং নেপাল রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক।

 

সহায়ক গ্রন্থ ও নিবন্ধ

১. নেপাল বিপ্লব, শেখর রহিম, শ্রাবন প্রকাশনী, ঢাকা, বাংলাদেশ।

২. A kingdom under siege, Deepak Thapa & Bandita Sijapati, the print house, Kathmandu, Nepal.

৩. Self-Determination & Constitution Making Process, Surendra Bhandari, Springer, Singapore.

৪. চিন্তন (ষষ্ঠ ও সপ্তম সংখ্যা), সম্পাদক দীপক বক্সী, কলকাতা, ভারত।

৫. The Constitution of Nepal, 2016 (2072).

৬. জনযুদ্ধের নেপাল, অনুবাদ ও সম্পাদনা – দিলীপ গুহ ও সন্দীপন মিত্র, নিউ হরাইজন বুক ট্রাস্ট, কলকাতা, ভারত।

৭. The Worker, No. 12, 2009 & 13, 2010, Organ of the UCPN (Maoist), Nepal.

. Nepal: Culture, History & People – Britanica.com

 

খ. বাংলাদেশ

১. ভূমিকা

বাংলায় কখন রাষ্ট্রের উদ্ভব হল তা নিশ্চয় করে বলা যায় না। তবে রামায়ন, মহাভারত, পুরাণ ও অন্যান্য সূত্র থেকে অনুমান করা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৫০০ অব্দের আগে থেকেই বাংলায় রাজতন্ত্র বিরাজ করছিল। রাজতন্ত্রের নিঃসংশয় পরিচয় পাওয়া যায় গ্রীক ও লাতিন বিবরণে। এতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে বাংলায় গঙ্গারিডাই বা গঙ্গারাষ্ট্র নামে সামরিক দিক দিয়ে এক শক্তিশালী জাতি বা রাষ্ট্রের উল্লেখ পাওয়া যায়। গঙ্গারাষ্ট্র ছাড়াও সমসাময়িক বাংলায় আরও কতগুলি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য ছিল বলে মনে করা হয়। বাংলার অন্তত একাংশের রাষ্ট্র-বিন্যাসের একটু আভাস মিলে বগুড়ার অদূরে মহাস্থানগড়ের শিলালিপিতে, আনুমানিক খ্রিস্টীয় তৃতীয়-দ্বিতীয় শতকে। এ সময় বাংলায় একক কোন রাষ্ট্র ছিল না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। মৌর্য আমলে উত্তরবঙ্গ মৌর্যরাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল যার কেন্দ্র ছিল পুণ্ড্রনগর, বর্তমান বগুড়া জেলার মহাস্থানে। গুপ্ত আমলে (আনুমানিক ৩০০-৫০০ খ্রিস্টাব্দ) প্রাচীন বাংলার অধিকাংশ এলাকা গুপ্ত সাম্রাজ্যভুক্ত হয়। ষষ্ঠ শতকে এসে বিশেষ করে পূর্ববঙ্গে স্বাধীন রাষ্ট্রের পত্তন হতে দেখা যায়। তবে অষ্টম শতকে এসে পাল সাম্রাজ্যের অধিনস্থ হয় প্রায় পুরো বাংলা। তবে অখণ্ড বাংলার বর্তমান রূপ প্রতিষ্ঠা হয় মোঘল শাসনামলে। আজকের বাংলাদেশ এই অখণ্ড বাংলার পূর্ব অংশ যা ১৯৭১ সালে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আবির্ভূত হয়, ষাট দশকের আগেও যা পূর্ববাংলা নামে পরিচিত ছিল। মৌর্য পূর্ব শাসন ব্যবস্থার রূপ এখনো জানা যায় নি। মূলত মৌর্য আমল থেকে পরবর্তী রাষ্ট্র শাসনের রূপ জানা সম্ভব হচ্ছে। রাজবংশের পরিবর্তনের সাথে শাসন ব্যবস্থার কিছু পরিবর্তন আমরা দেখতে পাই। তবে ব্রিটিশ পূর্ব সময়কালে পৃথক আইন সংস্থা বা শাসনতন্ত্র দেখতে পাই না।

 

২. ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমল

পূর্ববাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশ আধুনিক শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার সাথে পরিচিত হয় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তৈরি ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে। এতে কোম্পানির শাসনের অবসান ঘটে এবং ভারত সরাসরি ব্রিটিশ উপনিবেশে পরিণত হয়। ১৮৬১ সালের ১ আগস্ট ‘ভারতীয় কাউন্সিল আইন’ ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পাস হয়। এ আইন দ্বারা গভর্নর জেনারেলকে আইন প্রণয়ন ক্ষেত্র ব্যতীত সকল ক্ষেত্রে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করা হয়। পূর্বতন আইন কিছুটা সংশোধন করে ১৮৭০ সালে নতুনভাবে ভারত শাসন আইন প্রণয়ন করা হয়। এতে গভর্নর জেনারেলকে অধিকতর অনুন্নত এলাকার জন্য আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। তবে ১৮৯২ সালে ভারতীয় কাউন্সিল আইন পাসের মাধ্যমে সর্বপ্রথম ভারতের সাংবিধানিক ইতিহাসে প্রতিনিধিত্বমূলক সংস্থার জন্ম দেয়া হয়। অবশ্য বড় ধরনের শাসন-সংস্কার প্রস্তাব করা হয় ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনে। এই আইনে দ্বৈত শাসন প্রবর্তন করা হয় যেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে ভারতীয়দের আইন প্রণয়নের ক্ষমতা দেয়া হয়। এই আইনে সম্প্রদায় ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা রাখা হয়। এতে রাজার প্রতিনিধি হিসেবে গভর্নর জেনারেল খুবই উচ্চ মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হন। আগের মতই ভারতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী ক্ষমতা গভর্নর জেনারেল-ইন-কাউন্সিলের ওপর ন্যস্ত রাখা হয়। গভর্নর জেনারেল  আইন পরিষদ বিলুপ্ত ঘোষণা করতে, বিশেষ পরিস্থিতিতে মেয়াদ বৃদ্ধি করতে অথবা কোন বিল বা এর সংশোধনী আলোচনা থেকে আইন পরিষদকে নিবৃত্ত করতে পারতেন। আইন পরিষদ কর্তৃক পাসকৃত কোন বিল গভর্নর জেনারেলের পূর্ব সম্মতি ছাড়া আইনের মর্যাদা লাভ করত না। তাঁর আইন প্রণয়নেরও ক্ষমতা ছিল।

ভারতের রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠার যাত্রা শুরু হয় ঔপনিবেশিক শাসকদের অনুপ্রেরুনাতে। একজন ইংরেজ, এলান অক্টোভিয়ান হিউমের উদ্যোগে ১১৮৫ সালে প্রথম রাজনৈতিক দল ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস গঠিত হয়। তেমনি, ঔপনিবেশিক শাসকদের অনুপ্রেরুনাতেই ১৯০৬ সালে গঠিত হয় ভারতীয় মুসলিম লীগ। এখানে উল্লেখ্য, এই দুই দল, এমনকি কমিউনিস্ট পার্টি  গঠনে বাংলার রাজনীতিবিদগণ মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ভারতবর্ষের স্বাধীনতা অর্জনে এই দুই দলের ভূমিকা প্রধান। ইংরেজ শাসন আমলে  বাংলায় আরও দুটো জনপ্রিয় পার্টি গঠিত হয়েছিল। একটি হল কৃষক-প্রজা পার্টি এবং অন্যটি স্বরাজ পার্টি। এ দল দুটো উপরোক্ত দুটি দলের নেতাদের দ্বারা গঠিত হয়েছিল।

ব্রিটিশ ভারতের শাসনতান্ত্রিক বিবর্তনের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন। এই আইনে কেন্দ্রীয় শাসনের জন্য একটি ফেডারেল সরকার এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। প্রদেশে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হলেও কেন্দ্রে দ্বৈত শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়। দ্বি-কক্ষ বিশিষ্ট আইন সভা গঠন করা হয়। তবে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক আইন সভাকে এটি পরিবর্তনের ক্ষমতা দেয়া হয় নি। এ আইনের অধীনে গভর্নর জেনারেল নির্বাহী, আইন প্রণয়ন এবং অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের শাসনকার্য তাঁর নামে পরিচালিত হতো। বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের সময় তিনি মন্ত্রীপরিষদের পরামর্শ নিতেন, তবে তা বাধ্যতামূলক ছিল না। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন ছিল ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের ভিত্তি।

এ ভূখণ্ডের জনগণ শাসনতন্ত্র বা সংবিধান প্রণয়ন এবং রাষ্ট্র গঠনের  লক্ষ্যে প্রথমবার গণপরিষদ নির্বাচনে অংশ নেয় ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ ভারতের অখণ্ড বাংলা প্রদেশের অংশ হিসেবে। সম্প্রদায় ভিত্তিতে গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে পূর্ববাংলার জনগণ, প্রধানত মুসলিম জনগোষ্ঠী (৯৬%) পাকিস্তান রাষ্ট্রভুক্ত হবার জন্য মুসলিম লীগের পক্ষে রায় প্রদান করে । ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে হিন্দু-মুসলিম বিভক্তি স্পষ্ট হয়ে যায়। এমন অবস্থায় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রি জন অ্যাটলি ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ঘোষণা দেন যে, ১৯৪৭ সালের জুন মাসের মধ্যে ভারতীয়দের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে।  এ ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য ভারতের ভাইসরয় হিসেবে লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে নিয়োগের সিদ্ধান্তও ঘোষণা করা হয়।

মাউন্টব্যাটেন ক্ষমতা হস্তান্তরের যে রূপরেখা তৈরি করেন তার বৈশিষ্ট্য ছিল—

•    সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব ভারতীয়দের নির্বাচিত গণপরিষদের ওপর হস্তান্তর;

•    ভারত অখণ্ড রাখার জন্য আলাপ আলোচনার উদ্যোগ ব্রিটিশ সরকার নেবে না বলে ঘোষণা প্রদান;

•    কোন অঞ্চল ইতোমধ্যে গঠিত গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সংবিধান গ্রহণে অনিচ্ছুক হলে নতুন গণপরিষদ গঠনের ব্যবস্থা;

বাংলা, পাঞ্জাব, উত্তরপশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানের ক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিভক্তির ব্যবস্থা রাখা এবং এই বিভক্তির ভিত্তিতে সীমানা নির্ধারণে একটি সীমানা কমিশন গঠন ইত্যাদি  এবং

•    এসব কার্যাবলী সম্পন্ন হলে ক্ষমতা হস্তান্তর।

কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় দলই মাউন্টব্যাটেন পরিকল্পনা গ্রহণ করে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ১৮ জুলাই ‘দি ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট-১৯৪৭’ পাস হয়। এই আইন অনুযায়ী ভারতবর্ষকে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন ডোমিনিয়নে ভাগ করা হয়। নতুন সংবিধান প্রণয়ন না হওয়া পর্যন্ত প্রত্যেক ডোমিনিয়নের সরকারসমূহ প্রয়োজনীয় পরিবর্তনসহ ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনানুযায়ী পরিচালিত হবে বলে নির্ধারিত হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন প্রয়োজনে পরিবর্তনের ক্ষমতা ১৯৪৮ সালের ৩১ মার্চ পর্যন্ত ব্রিটিশ গভর্নর জেনারেলের হাতে রাখার ব্যবস্থা করা হয় এবং নির্ধারিত হয় এ মেয়াদের পর থেকে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন করবে গণপরিষদ বা সংবিধান সভা। জিন্নাহ পাকিস্তান ডোমিনিয়নের প্রথম গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৪ আগস্ট করাচিতে উপস্থিত হয়ে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট নতুন রাষ্ট্র পাকিস্তানের উদ্বোধন ঘোষণা করেন।

এখানে প্রণিধানযোগ্য, স্বাধীন ভারত ও পাকিস্তান শুধু ব্রিটিশদের প্রণীত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে যাত্রা শুরু করে নাই, ব্রিটিশদের তৈরি যাবতীয় আইনও তার সঙ্গী হয়েছিল, যেসব আইন তৈরি হয়েছিল প্রধানত উপনিবেশের জনগণকে শাসন করার জন্য। নতুন ‘স্বাধীন’ রাষ্ট্রদ্বয়ও ওইসব আইনকে ধারণ করে নিয়েছিল তার নিজ নিজ ‘স্বাধীন’ সত্তায়। অর্থাৎ ব্রিটিশরা যখন ভারত-পাকিস্তানকে স্বাধীনতা দিয়ে গেছে তখন শুধু ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন বা ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট দিয়ে যায় নি, তাদের উপযোগী আইন, বিচার ব্যবস্থাও দিয়ে গেছে। আরও দিয়ে গেছে তাদের অনুসরণ/ গোলামী করার শিক্ষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা। উপরোক্ত শাসনতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা ও আইনগত কাঠামো নিয়েই পূর্ববাংলার জনগণ পাকিস্তান রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়।

 

৩. পাকিস্তান ঔপনিবেশিক আমল

বাংলাদেশের স্বাধীনতার পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব বাংলা ২৩ বছর পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অংশ ছিল। এই পুরো সময়টা ছিল বস্তুতপক্ষে একটি সংবিধান তৈরি তথা রিপাবলিক গঠনের সংগ্রামের কাল। কিন্তু আমাদের রাজনৈতিক ইতিহাস বর্ণনার সময় অনেকেই সংবিধানের জন্য সেই সংগ্রামের কথা বাদ দিয়ে ক্ষমতাকেন্দ্রিক সংগ্রামের আলোকেই পুরো ঘটনাবলীকে পর্যালোচনা করে থাকেন।

পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে গণপরিষদ কর্তৃক নতুন সংবিধান প্রণয়নের পূর্ব পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আলোকেই রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়ে ঐকমত্য ছিল। আরও ঐকমত্য ছিল যে ১৯৪৬ সালের নির্বাচিত সদস্যদের নিয়ে গঠিত গণপরিষদ অথবা নতুন করে নির্বাচিত গণপরিষদ সংবিধান প্রণয়নের কার্য সম্পাদন করবে। প্রসঙ্গত এখানে উল্লেখ্য পাকিস্তান ডোমিনিয়নে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৪৬ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যেসব  সদস্য পরিবর্তীকালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হন তাদের নিয়ে গঠিত হয় পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদ বা সংবিধান সভা। মোট ৭৪ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদের যাত্রা শুরু হয়। পরবর্তীতে এর সদস্য সংখ্যা ৫জন বৃদ্ধি করে ৭৯ তে উন্নীত করা হয়। এর মধ্যে পূর্ব বাংলার সদস্য সংখ্যা  ছিল মোট ৪৪ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সদস্য সংখ্যা ছিল মোট ৩৫ জন।  যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলের সভাপতিত্বে করাচিতে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান সভা তথা গণপরিষদের প্রথম অধিবেশন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ১০ আগস্ট এবং শেষ হয় ১৪ আগস্ট।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের আরেকটি বড় বিষয় ছিল সেখানে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র কাঠামোর রূপরেখা, কেন্দ্রের সাথে প্রদেশের সম্পর্ক, কেন্দ্রীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক পরিষদের ক্ষমতার ভাগাভাগির তৈরি করাই ছিল। তাই আশাকরা অসঙ্গত ছিল না যে ১৯৩৫ সালের শাসনতন্ত্রের প্রয়োজনীয় পরিবর্তন সাপেক্ষে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সংবিধান প্রণয়ন হয়তো দুরূহ হবে না। কিন্তু সে আশাবাদ ভুল প্রমাণিত হয়। পাকিস্তানের প্রথম গণপরিষদের প্রথম ৭ বছরে মাত্র ১৬টি অধিবেশনে ১১৬ দিন মিলিত হয়। এরমধ্যে ১৩টি হয় জরুরি কিছু আইন প্রণয়নের জন্য। যাহোক, প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলি খানের উদ্যোগে প্রথমবারের মতো সংবিধান প্রণয়নের জন্য Objective Resolution  গৃহীত হয়। এই প্রস্তাবে রাষ্ট্রের উদ্দেশ্য হিসেবে ধর্মভিত্তিক ফেডারেল রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব করা হয়। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের ক্ষমতা চর্চার প্রস্তাবের সঙ্গে মৌলিক অধিকার ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা প্রদানের কথাও বলা হয়। পাকিস্তানের সকল অঞ্চলসমূহকে নিয়ে গঠিত যুক্তরাষ্ট্রের সকল ইউনিটসমূহকে স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। এই রিপোর্ট পাস হওয়ার পর মূলনীতি নির্ধারক কমিটি গঠন করা হয়। তবে ১৯৫০ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রি লিয়াকত আলি খান গণপরিষদে একটি অন্তর্বর্তীকালীন রিপোর্ট পেশ করেন যেখানে ফেডারেল ব্যবস্থাকে দুর্বল করে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়। এতে পূর্ববাংলায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ও আন্দোলনের শুরু হয়। একই বছরের অক্টোবরে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, সাংবাদিক সমন্বয়ে ‘গণতান্ত্রিক ফেডারেশন সংগ্রাম কমিটি’ গঠিত হয়। কমিটির ডাকে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে ৪-৫ নভেম্বর ঢাকায় এক মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলন থেকে মূলনীতি নির্ধারক কমিটির প্রস্তাবের বিপরীতে একটি খসড়া সংবিধানের প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেখানে উল্লেখযোগ্য দাবীসমূহ – রাষ্ট্রের নাম হবে পাকিস্তান যুক্তরাষ্ট্র; যার দু’টি অংশ থাকবে, দু’টি প্রাদেশিক সরকার থাকবে। এবং এটি হবে সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র। এই প্রস্তাবনায় বলা হয়, প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে একটি এককক্ষ বিশিষ্ট সংসদ থাকবে। প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকার ভোটারদের তাদের সংসদ সদস্যকে সংসদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার ক্ষমতা থাকবে। মন্ত্রীসভা তার কাজের জন্য সংসদের নিকট দায়বদ্ধ  থাকবে। উপরোক্ত খসড়া সংবিধানের প্রস্তাবের পক্ষে ১২ নভেম্বর হরতাল পালিত হয়। এ পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রি লিয়াকত আলি খান তাঁর প্রস্তাব প্রত্যাহার করে নেন। পরিবর্তীকালে খাজা নাজিমউদ্দিন সংবিধানের খসড়া চূড়ান্ত করে ১৯৫২ সালে আগস্টে তা গণপরিষদে পেশ করেন। তবে আইন পরিষদে সংখ্যানুপাতে প্রতিনিধিত্বের পরিবর্তে সমান প্রতিনিধিত্বের প্রস্তাবের কারণে পূর্ববাংলার জনগণ তা  মেনে নেয় নি। ১৯৫৩ সালে খাজা নাজিমউদ্দিন-এর স্থলাভিষিক্ত হয়ে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী সমগ্র পাকিস্তানকে ২টি ইউনিট হিসেবে ভাগ করার প্রস্তাব দেন  যা ‘মোহাম্মদ আলী ফর্মুলা’ বলে পরিচিত। এ প্রস্তাব দুই অঞ্চলের রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে কিছুটা ভারসাম্য এনে দেয়। এ ফর্মুলায় পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি প্রদেশের প্রস্তাব করা হয়। দুই কক্ষ বিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করা হয়। উচ্চ কক্ষে ৫টি প্রদেশের সমান প্রতিনিধিত্ব (মোট ৫০ জন ) দেয়ার কথা বলা হয়। নিম্নকক্ষে জনসংখ্যার ভিত্তিতে আসন সংখ্যা ( মোট ৩০০ জন ) নির্ধারণের সুযোগ রাখা হয় এবং উভয়কক্ষে মোট আসন সংখ্যা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাঝে সমান রাখা হয়। উচ্চ কক্ষের সদস্যগণ পরোক্ষ এবং নিম্ন কক্ষের সদস্যগণ প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হবেন। এটাও ঠিক করা হয় যে, রাষ্ট্রপ্রধান যদি এক অংশের হয় তবে প্রধানমন্ত্রী হবেন অন্য অংশ হতে।

মোহাম্মদ আলী ফর্মুলার ভিত্তিতে তৈরি রিপোর্ট ১৯৫৪ সালের ২১ সেপ্টেম্বর গণপরিষদে ২৯-১১ ভোটে গৃহীত হয়। এই রিপোর্টে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র  বলা হয়। গণপরিষদের অনুমোদন ছাড়া গভর্নর জেনারেলের অধ্যাদেশ জারীর ক্ষমতা বাতিল করা হয়। মন্ত্রীপরিষদ গঠন ও ভেঙ্গে দেয়ার ক্ষমতা গভর্নর জেনারেলের পরিবর্তে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত করার প্রস্তাব করা হয়। গণপরিষদকে পাকিস্তানের যে কোন অংশের জন্য সাংবিধানিক আইন প্রণয়নের ক্ষমতা প্রদান করা হয়। এতে আরও বলা হয়, এভাবে প্রণীত কোন সাংবিধানিক আইন কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে ২২০-ক ধারা নামে নতুন একটি ধারা সংযোজন করা হয় যাতে হাইকোর্ট ও ফেডারেল কোর্টের রিট ইস্যু করার ক্ষমতা রাখা হয়। এছাড়া ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১০ নং ধারা সংশোধন করা হয় যার ক্ষমতা বলে গভর্নর জেনারেল প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর পদ থেকে বরখাস্ত করতে পারত।

গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ২৪ অক্টোবর এক অধ্যাদেশ বলে গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে জরুরি অবস্থা জারী করেন। এভাবেই প্রথম গণপরিষদের অপমৃত্যু হয় এবং  ঔপনিবেশিক প্রভুদের তৈরি একক নিরুঙ্কুশ ক্ষমতা ব্যবস্থা কিছুটা কমানোর চেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। পাকিস্তানে শাসনতন্ত্র গড়ার অগ্রগতি ভেস্তে যায় এবং পূর্ববাংলার জন্য তা বিশেষ হতাশার কারণ হয়ে দেখা দেয়।

তবে গণপরিষদ ভেঙ্গে দেওয়ায় পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আইনি লড়াই শুরু হয়। সিন্ধুর মুখ্য আদালত অভিমত প্রদান করেন, ১৯৫৪ সালের ৫ম সংশোধনী আইনের মাধ্যমে বৈধভাবে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের ১০ নং ধারা সংশোধন করা হয়েছে এবং গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সাংবিধানিক আইনে গভর্নর জেনারেলের সম্মতির প্রয়োজন নেই। কিন্তু ফেডারেল কোর্ট সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে সিদ্ধান্ত প্রদান করে যে গভর্নর জেনারেলের সম্মতি না থাকাতে গণপরিষদ কর্তৃক প্রণীত সাংবিধানিক আইনসমূহ আইনের মর্যাদা লাভ করে নাই। অর্থাৎ গভর্নর জেনারেলের গণপরিষদ ভেঙ্গে দেয়া আইনসম্মত হয়েছে।

১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন এবং ইন্ডিয়ান ইন্ডিপেন্ডেন্স অ্যাক্ট (যা একত্রে পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন সংবিধান হিসেবে বিবেচিত হতো) নতুন করে গণপরিষদ গঠনের কোন বিধান ছিল না। ফলে পাকিস্তানের সাংবিধানিক ইতিহাসে চরম শূন্যতার সৃষ্টি হয়। তবে পাকিস্তানের ফেডারেল কোর্ট গভর্নর জেনারেলকে একটি নতুন গণপরিষদ গঠন করার পক্ষে রায় প্রদান করলে এর অবসান ঘটে।  ১৯৫৫ সালের মে মাসে ৮০ জন সদস্য নিয়ে পাকিস্তানের দ্বিতীয় গণপরিষদ গঠিত হয়। এরমধ্যে ৭২ জন পরোক্ষ ভোটে নির্বাচিত এবং ৮ জন ছিল দেশীয় রাজ্য ও উপজাতি এলাকা থেকে মনোনীত। মোট সদস্যের অর্ধেক অর্থাৎ ৪০ জন পূর্ব অংশের এবং পশ্চিম অংশের ৪০ জন। দলওয়ারী সদস্য সংখ্যা এরূপ – মুসলিম লীগ ২৫ জন, ইউনাইটেড ফ্রন্ট ১৬ জন, আওয়ামী লীগ ১২ জন, ফিরোজ খান নুন গ্রুপ ৩ জন, পাকিস্তান কংগ্রেস ৪ জন, শিডিউল কাস্ট ফেডারেশন ৩ জন, ইউনাইটেড প্রোগ্রেসিভ পার্টি ২ জন এবং অন্যান্য ১৫ জন। উদ্বোধনী অধিবেশন বসে ১৯৫৫ সালের ৭ জুলাই মারীতে। ৮ সেপ্টেম্বর পশ্চিম অংশের সকল প্রদেশকে এক ইউনিট তথা পশ্চিম পাকিস্তান ধরে একটি বিল পাস করা হয় এবং পূর্ববাংলার নাম বদলে পূর্বপাকিস্তান রাখা হয়। ১৯৫৬ সালের ৮ জানুয়ারি সংবিধানের খসড়া প্রকাশ করা হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি .সংবিধান পাস হয়, আর তা কার্যকর হয় ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ। এভাবে  প্রতিষ্ঠার সুদীর্ঘ ৯ বছর পর পাকিস্তান একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হয়। যদিও এটি কার্যকর হওয়ার আড়াই বছরের মাথায় বাতিল করা হয়। ১৯৫৬ সালের সংবিধান পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করে। গভর্নর জেনারেলের স্থলে প্রেসিডেন্ট রাষ্ট্রপ্রধান হন, তবে একজন মুসলমান নাগরিকই কেবল পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হতে পারবে। এটি ছিল পৃথিবীর অন্যতম দীর্ঘ লিখিত সংবিধান। এ সংবিধানে মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা ও যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা রাখা হয়। কায়েম করা হয় মন্ত্রীপরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা। কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের মধ্যে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অনুকরণে ক্ষমতা ভাগ করে দেয়া হয়। নারীদের জন্য ১০টি অতিরিক্ত আসন ১০ বছরের জন্য সংরক্ষিত রাখা হয়। জাতীয় সংসদে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সমান প্রতিনিধিত্ব ( মোট ৩০০ আসন ) রাখা হয়। সুপ্রিম কোর্টকে সংবিধানের রক্ষাকর্তা, ব্যাখ্যাদান ও সংবিধান পরিপন্থি আইন বাতিলের ক্ষমতা দেয়া হয়। ইসলামী বিধি বিধান বিরোধী কোন আইন পাস করার অধিকার আইন সভার ছিল না।

কিন্তু দীর্ঘ ৯ বছরের প্রচেষ্টায় যে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয় তার আয়ুষ্কাল ছিল মাত্র আড়াই বছর। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তৎকালীন প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা সামরিক বাহিনীর সহায়তায় সংসদীয় সরকারকে উৎখাত করে পাকিস্তানে সামরিক আইন জারী করেন। সংবিধান বাতিল ঘোষণা করা হয়। এইভাবে একটি সাংবিধানিক অধ্যায়ের অবসান ঘটে। পাকিস্তান আবার সংবিধান ফিরে পাওয়ার পুরনো সংগ্রামে ফিরে যায়, সঙ্গে পূর্ববাংলাও।

১৯৬০ সালে জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দেশ থেকে বের করে দিয়ে নিজেই প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন এবং একটি সংবিধান কমিশন গঠন করেন। কমিশনকে দায়িত্ব দেয়া হয় ১৯৫৬ সালের সংবিধানের ব্যর্থতার কারণ উদঘাটন এবং ভবিষ্যতের সংবিধানের সুপারিশ প্রণয়ন করার। কমিশন পাকিস্তানে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার ব্যর্থ হয়েছে বলে রিপোর্ট এবং পাকিস্তানকে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার জন্যে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় ব্যবস্থার পক্ষে অভিমত দেয়। কমিশন আরও মতামত দেয় যে, পাকিস্তানের জনগণ সেদেশের প্রেসিডেন্ট এবং আইনসভার সদস্য নির্বাচিত করার যোগ্য নয় সেজন্য উচ্চ পদসমূহের নির্বাচনে ভোটদানের ক্ষমতা সীমিত করা উচিৎ। এভাবে কমিশন ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর তত্ত্ব উপস্থাপন করে। কমিশন প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থার সুপারিশসহ দ্বি-কক্ষ আইনসভার প্রস্তাব করে। পাকিস্তানের এক অংশ থেকে প্রেসিডেন্ট এবং অপর অংশ থেকে ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুপারিশ করে। এই রিপোর্ট প্রেসিডেন্ট পরীক্ষা নিরীক্ষা শেষে বাতিল করে দেয় এবং সংবিধান প্রণয়নের জন্য অপর একটি কমিটি গঠন করে।

নতুন কমিটির খসড়া প্রণয়ন শেষে প্রেসিডেন্ট ১৯৬২ সালের ১ মার্চ সংবিধান ঘোষণা করেন এবং ৮ জুন থেকে তা কার্যকর হয়। ’৬২ সালের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ব্যবস্থা রাখা হয় এবং প্রেসিডেন্টকে করা হয় অবাধ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি আইনসভা ও বিচার বিভাগের এখতিয়ার বহির্ভূত ছিলেন। বিচার বিভাগের ক্ষমতা অতিমাত্রায় সংকুচিত করা হয়। ‘মৌলিক গণতন্ত্র’-এর নামে নির্বাচনী অধিকারও খর্ব করা হয়। কেননা এ সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের নাগরিকগনের সরাসরি ভোটে রাষ্ট্রপতি, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হতেন না। তাঁরা নির্বাচিত হতেন ইউনিয়ন কাউন্সিলের ৮০ হাজার সদস্যের ভোটে। জাতীয় পরিষদের মোট সদস্য সংখ্যা নির্ধারণ করা হয় ১৫৬ জন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৭৫ জন করে ১৫০ জন, আর মহিলাদের জন্য ৬ টি সংরক্ষিত আসন। প্রাদেশিক সরকারের নির্বাহী করা হয় প্রেসিডেন্ট মনোনীত গভর্নরকে। গভর্নরের সহায়তার জন্য একটা মন্ত্রীপরিষদ ছিল। প্রত্যেক প্রদেশে এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা রাখা হয়। তবে গভর্নরের সম্মতি ছাড়া আইনসভার বিল পাস হতে পারতনা। মৌলিক অধিকার অংশে বলা হয়েছিল রাষ্ট্র ইসলাম পরিপন্থী কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। আর প্রস্তাবনায় ইসলামী সাম্য, স্বাধীনতা, গণতন্ত্র ইত্যাদির কথা ছিল।  আইয়ুব খানের সংবিধান জনপ্রিতিনিধি নয়, একদল তথাকথিত বিশেষজ্ঞ এই শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেন। ।

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা আন্দোলন, শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানির গণসংগ্রাম, শ্রমিকদের মজুরির লড়াই ইত্যাদি সব মিলে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে গণঅভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। এতে আইয়ুব খানের  পতন ঘটে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা দেন যতশীঘ্র সম্ভব প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে এবং জনপ্রতিনিধিদের কাজ হবে দেশের শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। নির্বাচনের জন্য তিনি লিগাল ফ্রেম ওয়ার্ক (এল এফ ও) জারী করেন। এল এফ ও’র প্রধান দিক ছিল ১৯৬১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী আসন বণ্টন এবং সেভাবে জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের ১৬২ ছিল পূর্ব পাকিস্তানে, আর ১৩৮টি ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। মহিলাদের ১৩টি আসনের ৭টি পূর্ব পাকিস্তানের এবং ৬টি পশ্চিম পাকিস্তানের ছিল। অধিবেশন শুরুর ১২০ দিনের মধ্যে পরিষদ শাসনতন্ত্র বিল নামক বিলের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করবে এবং তা করতে ব্যর্থ হলে পরিষদ বাতিল হয়ে যাবে। শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার পর তা প্রেসিডেন্টের অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে। শাসনতন্ত্র অনুমোদনের পূর্ব পর্যন্ত জাতীয় পরিষদ কাজ করবে ‘আইন পরিষদ’ হিসেবে।  শাসনতন্ত্র  বিলে প্রেসিডেন্ট অনুমোদন না দিলে জাতীয় পরিষদ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। এল এফ ও’র কোন বিষয়ে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের প্রয়োজন হলে তা করবেন প্রেসিডেন্ট  এবং প্রেসিডেন্টের ব্যাখ্যাই চূড়ান্ত। এ বিষয়ে কোন আদালতে চ্যালেঞ্জ করা যাবে না। প্রেসিডেন্ট এল এফ ও’র যে কোন ধারা সংশোধন বা পরিবর্তন করতে পারবেন এবং এ বিষয়ে জাতীয় পরিষদের হস্তক্ষেপমূলক ক্ষমতা থাকবে না। নির্বাচনকে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে রেফারেন্ডাম হিসেবে ঘোষণা করে অংশ নেয়। ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসনে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৩৮টি  আসনের মধ্যে ৮১টি আসনে পিপিপি জয়লাভ করে। ফলাফল পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠীর প্রতিকূলে যাওয়ায় অধিবেশন আহবানের ক্ষেত্রে প্রেসিডেন্ট টালবাহানা শুরু করেন। ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেও পরে তা স্থগিত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের পর থেকে দেশ কার্যত শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনাধীনে চলে আসে। এরপর পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী পর্যাপ্ত সেনা মোতায়নের জন্য আলাপ-আলোচনার নাটক শুরু করে। এ কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর ২৫ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং ‘ অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পশ্চিমা সেনাবাহিনী নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করে। বাঙালী সৈন্য, বিডিআর, পুলিশসহ গোটা জাতি প্রতিরোধ শুরু করে। ২৬ মার্চ এম এ হান্নান এবং ২৭ মার্চ জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন। শুরু হয় সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ।

 

৪. বাংলাদেশ আমল

শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপ্রধান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান এবং তাজউদ্দীন আহম্মদকে প্রধানমন্ত্রী করে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। ১০ এপ্রিল রাতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহম্মদের ভাষণ প্রচার করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র গৃহীত হয়। এভাবেই বাংলাদেশ তাঁর স্বতন্ত্র সাংবিধানিক একটি প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে বা বাংলাদেশের সাংবিধানিক যাত্রার সুচনা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটিতে বলা হয় ’৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণ আওয়ামী লীগকে বিপুলভাবে নির্বাচিত করেছিল, কিন্তু প্রেসিডেন্ট প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে একটি বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ শুরু করেন। তৎপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রনাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। সেখানে নতুন রাষ্ট্রের লক্ষ্য-উদ্দেশ্যকে বিবৃত করা হয়েছে এভাবে; “ যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে রায় দিয়েছেন, সে মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করে পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য বিবেচনা করে বাংলাদেশকে একটি সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র ঘোষণা করছি।’’ এছাড়া এ ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রের আইন প্রণয়নসহ সকল অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অধিকারী করা হয় রাষ্ট্রপ্রধানকে। মূলত মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে ঐ ঘোষণাপত্রটিই ছিল নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান। এটি ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারী পর্যন্ত বহাল ছিল।

দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জন করে। ১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারী করেন। এই আদেশের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের সময়কালের সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করা হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে রাষ্ট্রপতির কাছে সকল ক্ষমতা অর্পণ করা হয়েছিল। নতুন আদেশে তা পরিবর্তন করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ন্যস্ত করা হয়। রাষ্ট্রপতি সম্পর্কে বলা হয় রাষ্ট্রপতি তাঁর সকল কাজ প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী করবেন। অস্থায়ী সংবিধান আদেশে অপরাপর বিষয়ের সঙ্গে গণপরিষদ বা সংবিধান সভার একটি সংজ্ঞা দেয়া হয়। যার মূল বিষয় ছিল এটা আইনসভা হিসেবে কাজ করবে। ১২ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নেন।

বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংবিধান প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ২২ মার্চ বাংলাদেশ গণপরিষদ আদেশ আইন জারী করা হয় এবং এটিকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকেই কার্যকর বলে ঘোষণা করা হয়। এই আইন বলে পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে ১৯৭০ সালে নির্বাচিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অংশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। অর্থাৎ পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য যারা ইয়াহিয়া খানের এল এফ ও’র আওতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন, তাদের স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। অন্যদিকে প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যরা প্রদেশের আইন প্রণয়নের রায় নিয়েছিলেন,  শাসনতন্ত্র প্রণয়ন নয়। যাহোক, ঐ দুই পরিষদের মোট সদস্য ৪৬৯ জন হলেও ৪৩০ জন সদস্য নিয়ে গণপরিষদের যাত্রা শুরু হয় এবং শেষ অব্দি টিকে থাকেন ৪০৩ জন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগ বা সরকার দলীয় সদস্য হলেন ৪০১ জন। অর্থাৎ বিরোধী দলীয় সদস্য ছিলেন মাত্র ২ জন। মৃত্যু, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের জন্য বহিস্কার এবং দল থেকে বহিষ্কার ইত্যাদি কারণে মোট ৬৬ জন সদস্যের সংবিধান প্রণয়নে অংশ ছিল না। এ হিসাবে ১ কোটিরও বেশি দেশবাসীর সংবিধানে প্রতিনিধিত্ব ছিল না। তাছাড়া, এই আইনে গণপরিষদকে শুধুমাত্র সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়। এর বাইরে কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা তাদের ছিল না।

একই দিন অর্থাৎ ২২ মার্চ রাষ্ট্রপতি কর্তৃক বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য ( সদস্যপদ বাতিল ) আদেশ আইন জারী করা হয়। এতে রাজনৈতিক দলের সংজ্ঞা দিয়ে বলা হয়, যদি কোন গণপরিষদ সদস্য তিনি যে দলের মনোনয়নে নির্বাচিত হয়েছেন সে দল থেকে পদত্যাগ করেন বা দল তাঁকে বহিষ্কার করে তবে তাঁর সদস্যপদ বাতিল হবে এবং এ বিষয়ে কোন আদালতে কোন প্রশ্ন উত্থাপন করা যাবে না।

এ দুটি আদেশ জারীর পরপরই সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৯ এপ্রিল সংসদীয় দলের নেতা, স্পীকার ও ডেপুটি স্পীকার নির্বাচন করা হয়। ১০ এপ্রিল গণপরিষদের উদ্বোধন করা হয়। ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে প্রধান করে ৩৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি সংবিধান প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল থেকে ৩ অক্টোবর পর্যন্ত এই কমিটি বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক করে। গণপরিষদের প্রথম বৈঠকে দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ তথা জনগণের কাছ থেকে সংবিধান বিষয়ে প্রস্তাব আহ্বান করা হয়। ৮ মে’র মধ্যে ৯৮টি প্রস্তাব পাওয়া যায়। ১০ জুনের মধ্যে কমিটি খসড়া তৈরি করতে সক্ষম হয়। সংবিধানকে ‘পূর্ণাঙ্গ ও সুন্দর’ করার জন্য ড. কামাল হোসেন ভারত ও ইংল্যান্ড সফর করেন। এছাড়া একজন ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করা হয়। ১১ অক্টোবর খসড়া চূড়ান্ত করা হয়। ১৮ অক্টোবর থেকে গণপরিষদে সংবিধান বিলের ওপর আলোচনা শুরু হয় এবং ৩০ অক্টোবর সমাপ্ত হয়। ৩১ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সংবিধানের অনুচ্ছেদওয়ারি আলোচনা চলে। ৪ নভেম্বর সংবিধান বিল পাস হয়। ১৪ ডিসেম্বর গণপরিষদ সদস্যগণ এতে স্বাক্ষর করেন। ১৬ ডিসেম্বরকে সংবিধান প্রবর্তন দিবস ঘোষণা করা হয়।

 

৫. বাংলাদেশ সংবিধান  ১৯৭২

এ নিবন্ধে মূল বা অসংশোধিত সংবিধান নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধান এ পর্যন্ত ১৬ বার সংশোধন করা হয়েছে। এতে সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করা হয়েছে, মূলনীতি পরিবর্তন করা হয়েছে। এসব পরিবর্তন বা তার ফলাফল  নিয়ে এখানে আলোচনার সুযোগ নেই। তবে এটা বলা যেতে পারে মূল সংবিধানে পরিবর্তনের যে ধরনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে তা গণতান্ত্রিক সংবিধানের বৈশিষ্ট্যের সাথে যায় না।

১৯৭২ এর সংবিধান  ১১টি অধ্যায়, ১১৫টি অনুচ্ছেদ এবং ৪টি তফসিলে বিভক্ত। এ সংবিধানের প্রধান প্রধান বৈশিষ্ট্য হল-

১. ১৯৭২ এর সংবিধান বাংলাদেশকে গণপ্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করেছে।

২. এটি বাংলাদেশের জন্য একটি এককেন্দ্রিক সরকারের ব্যবস্থা করেছে।

৩. এই সংবিধান বাংলাদেশে একটি মন্ত্রী পরিষদ শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে।

৪. ১৯৭২ এর সংবিধান গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের আদর্শকে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করেছে।

৫. এই সংবিধান বাংলাদেশের জন্য একটি এককক্ষ বিশিষ্ট আইনসভার ব্যবস্থা করেছে। এটি গঠিত হবে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত ৩০০ সদস্য নিয়ে।

৬. এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসেবে হবে বাঙালী।

৭. এই সংবিধান অনুযায়ী প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ।

৯. এই সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা প্রদান করা হয়েছে। এইসব মৌলিক অধিকারের মধ্যে অন্যতম হল চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতা, মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ ইত্যাদির কারণে কোন প্রকার বৈষম্যমূলক আচরণ থেকে মুক্ত থাকার স্বাধীনতা ইত্যাদি।

১০. এই সংবিধান প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং অন্য কোন আইন যদি এই সংবিধানের সহিত অসমঞ্জস হয়, তাহা হইলে সেই আইনের যতখানি অসামঞ্জস্যপূর্ণ, ততখানি বাতিল হইবে।

কিন্তু ১৯৭২ সালের সংবিধান গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবেঃ-

•    বাংলা ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করা হয়েছে। সংবিধানে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙ্গালী বলিয়া পরিচিত হইবেন। এভাবে, বাঙ্গালী ছাড়া অন্য ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে।

•    রাষ্ট্রপতিকে কিছু বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যত এসবের কিছুই স্বাধীনভাবে করার ক্ষমতা সংবিধান তাঁকে দেয়নি। যা কিছু তিনি করেন, তার সবই করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে।

•    যদিও বলা হয়েছে মন্ত্রীপরিষদ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকবে, কিন্তু কার্যত গোটা সংসদই দলীয় প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুধু দায়বদ্ধ নয়, একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হতে সংবিধান অনুযায়ী বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী সংসদকে যে ধরনের আইন প্রনয়নের নির্দেশ দিবেন, জাতীয় পরিষদ সে ধরনের আইন প্রণয়ন করতে বাধ্য।

•    আদালত স্বাধীন নয়। নিম্ন আদালত পুরোপুরি আইন মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রাধীন। উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগ ও বরখাস্তের ক্ষমতা চূড়ান্ত বিচারে নির্বাহী বিভাগের হাতে রাখা হয়েছে।

•    সংবিধানের প্রস্তাবনা এবং প্রথম থেকে তৃতীয় অধ্যায় পর্যন্ত পাঠ করলে মনে হবে বাংলাদেশের সংবিধান মোটামুটি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান। এতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য অনেক কল্যাণ আর অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু সংবিধানের চতুর্থ ভাগ থেকে শেষ পর্যন্ত অর্থাৎ বাস্তবায়ন অংশ নিবিড় ভাবে পড়লে দেখা যাবে এসব কল্যাণ আর অধিকার যাতে কার্যকর করা না যায় তেমন ব্যবস্থাও এ সংবিধানে রাখা আছে।

•    সংবিধানে যেসব সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান গঠনের কথা বলা আছে যেমন নির্বাচন কমিশন, মহা হিসাবরক্ষক ইত্যাদি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন নয়। বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ, বেশিরভাগ নির্বাচনে নিরপেক্ষ থাকতে পারে নি।   

সহায়ক গ্রন্থ ও নিবন্ধ

১. বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সরকারের ক্রমবিকাশ, হারুন-অর-রশিদ, হাসিনা প্রকাশনা, ঢাকা, বাংলাদেশ।

২. বাংলাদেশের সংবিধান পর্যালোচনা

৩. বাংলাদেশের সংবিধান, ১৯৭২

৪. বাঙ্গালীর ইতিহাস – আদিপর্ব, নীহাররঞ্জন রায়

৫. সাংবিধানিক ক্রমবিকাশ – বাংলাপিডিয়া

 

গ. মোটাদাগে বাংলাদেশ ও নেপালের রাষ্ট্র গঠন প্রক্রিয়া এবং গঠিত রাষ্ট্রের  মিল–অমিল

১. গণপরিষদ বা সংবিধান সভা

বাংলাদেশের জনগণ এপর্যন্ত ২ বার গণপরিষদ গঠনের নির্বাচনে অংশ নিয়েছে। প্রথম গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ব্রিটিশ ভারতের অখণ্ড বাংলা প্রদেশের অংশ হিসেবে। সম্প্রদায় ভিত্তিতে গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং এসময় সার্বজনীন ভোটাধিকার ছিল না। আর দ্বিতীয় গণপরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানের একটি প্রদেশের (পূর্ব পাকিস্তান) অংশ হিসেবে। এই নিবন্ধের প্রধান আলোচ্য দ্বিতীয় গণপরিষদ যা বাংলাদেশের গণপরিষদ হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

পাকিস্তান রাষ্ট্র কাঠামোর অধীনে নির্বাচিত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান অংশের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের বাংলাদেশের গণপরিষদ গঠিত। এর সদস্য ছিল ৪০৩ জন। মুলত একদলীয় সদস্য দ্বারা এটি গঠিত হয়েছে। কেননা ৪০৩ জন সদস্যের মধ্যে ৪০১ জন ছিল আওয়ামী লীগ দলীয়। বাকি ২ জনের ১ জন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির ( মোজাফফর ) ও একজন স্বতন্ত্র সদস্য ছিলেন।

বাংলাদেশের গণপরিষদের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, এর কোন আইন প্রণয়নের ক্ষমতা ছিল না। মন্ত্রিসভার ওপর কোন নিয়ন্ত্রণ ছিল না, ছিলনা সরকারের ওপর তদারকির ক্ষমতা। এ সময় অধ্যাদেশ জারী করে শাসনকার্য পরিচালনা করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই ছিল আইনের উৎস।

বাংলাদেশের গণপরিষদের আর একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল এর সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের অধিকার ছিল না। বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য ( সদস্যপদ বাতিল ) আদেশ আইন দ্বারা গণপরিষদ সদস্যদের স্বাধীন মতপ্রকাশের পথ রুদ্ধ করা হয়। অর্থাৎ একটি নিয়ন্ত্রিত গণপরিষদ বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেছে।

নেপালের প্রথম গণপরিষদ সদস্য সংখ্যা মোট ৬০১ জন। এর মধ্যে নির্বাচিত ৫৭৫ জন আর অনির্বাচিত ২৫জন। প্রথম গণপরিষদ নির্বাচনে প্রধান তিন দল যথাক্রমে নেপালি কংগ্রেস পার্টি পেয়েছিল ১১৫ টি আসন ,  কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল ইউএমএল (CPN–UML ) পেয়েছিল ১০৮টি  আসন এবং ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওইস্ট সেন্টার (UCPN-Maoist) পেয়েছিল ২২০ টি আসন। আর দ্বিতীয় গণপরিষদ নির্বাচনে নেপালি কংগ্রেস পার্টি পেয়েছিল ১৯৬টি আসন,  কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল ইউএমএল (CPN–UML ) পেয়েছিল১৭৫টি আসন এবং ইউনাইটেড কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওইস্ট সেন্টার (UCPN-Maoist) পেয়েছিল ৮০টি আসন। নির্বাচিত ৫৭৫ জনের মধ্যে ২৪০ জন সরাসরি নির্বাচিত এবং ৩৩৫ জন অংশগ্রহণকারী দলগুলোর ভোট প্রাপ্তির অনুপাতে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

নেপালের গণপরিষদ ছিল গণ-অভিপ্রায়, গণ-ইচ্ছার  আধার। শাসনকার্য পরিচালনার যাবতীয় আইন প্রণয়নের অধিকারী ছিল নেপালের গণপরিষদ।  সরকার তথা মন্ত্রীপরিষদ গণপরিষদের নিকট জবাবদিহি করতে বাধ্য ছিল। অন্যদিকে আইন দ্বারা গণপরিষদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মত প্রকাশের সুযোগ বন্ধ করা হয় নি।

 

২. সংবিধান

এই নিবন্ধে আলোচিত নেপাল সংবিধান ২০৭২ নেপালের ৭ম সংবিধান। নেপালের প্রথম সংবিধান ১৯৪৮ সালের ১ এপ্রিল এবং সর্বশেষ সংবিধান ২০১৫ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে কার্যকর হয়েছে। এ হিসাবে নেপালের জনগণ সাংবিধানিক ব্যবস্থায় প্রায় ৭০ বছর পার করেছে। এরমধ্যে প্রায় ৬১ বছর ছিল রাজতান্ত্রিক সংবিধানের কালপর্ব।

অন্যদিকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জনগণ সাংবিধানিক প্রক্রিয়ার আওতায় এসেছে ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশদের তৈরি ১৮৫৮ সালের ভারত শাসন আইন বাস্তবায়নের পর থেকে। এ হিসাবে বাংলাদেশের জনগণের শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার অভিজ্ঞতার বয়স দেড়শতেরও বেশি।

নেপাল সংবিধান ২০৭২ প্রণয়ন ও কার্যকর করতে সময় লেগেছে ৬ বছর। এ সংবিধান প্রণয়নে নেপালের সকল জাতি সত্তা, অবহেলিত জনগোষ্ঠী ও সকল ধর্মের নাগরিকদের মতামত নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ সংবিধান ১৯৭২ প্রণয়ন ও কার্যকর করতে সময় লেগেছে মাত্র ১১ মাস। বাংলাদেশে বিভিন্ন জাতিসত্তাসহ সাধারণ জনগণের মতামত নেয়ার কোন প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয় নি।

বাংলাদেশের সংবিধানের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ব্রিটিশ আমলে রাষ্ট্রের প্রধান নির্বাহী তথা গভর্নর জেনারেলকে যে সর্বময় ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে তা শেষ পর্যন্ত ( ১৯৭২ সালের সংবিধান) বহাল থেকেছে। মাঝে ১৯৫৬ সালের সংবিধানে কিছুটা ক্ষমতার ভারসাম্য আনা হয়েছিল। কিন্তু এ সংবিধান মাত্র আড়াই বছর স্থায়ী হয়। এসব সংবিধান দ্বারা কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্র গঠিত হয়েছে।

নেপালে প্রধান নির্বাহীর একক সর্বময় ক্ষমতা যেমন ছিল, তেমনি বারেবারে ক্ষমতার ভাগাভাগি হতে দেখা যায়। নেপালের সর্বশেষ সংবিধানে নির্বাহী ক্ষমতা মন্ত্রীপরিষদের হাতে ন্যস্ত করা হয়েছে। এক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী শব্দটি একবারের জন্যও উচ্চারণ করা হয় নি। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট সাংবিধানিক প্রধান হলেও তাঁর হাতে কিছু ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইন পরিষদ ও বিচার বিভাগের স্বাধীনভাবে কাজ বিধান করা হয়েছে। তাই বলা যায় এটি একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান।

নেপালের সর্বশেষ সংবিধান গৃহীত হওয়ার পর প্রথম স্থানীয়, জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদ অনুষ্ঠিত হয়েছে। রাষ্ট্রের আচরণ কেমন হবে তা দেখার সুযোগ এখনো আসেনি। তবে নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতা নিয়ে কোন প্রশ্ন উত্থাপিত হয় নি। সংবিধানে নেপালের সকল জাতি-ধর্ম-বর্ণের সমান মর্যাদা দেয়া হয়েছে, সকল ভাষার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। সংবিধানে অনগ্রসর, জাতিগত সংখ্যালঘু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া সমকামী, উভকামী ও তৃতীয় লিঙ্গের সুরক্ষার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে যা এই অঞ্চলে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।

অন্যদিকে বাংলাদেশের সংবিধানে শুধুমাত্র বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্র ভাষা করা হয়েছে,  বাঙ্গালী ছাড়া অন্য ক্ষুদ্র জাতি গোষ্ঠীর অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়েছে। বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে কিছু বিষয়ে ক্ষমতা প্রয়োগের অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু কার্যত এসবের কিছুই স্বাধীনভাবে করার ক্ষমতা সংবিধান তাঁকে দেয়নি। যা কিছু তিনি করেন, তার সবই করেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শক্রমে।

যদিও বলা হয়েছে মন্ত্রীপরিষদ যৌথভাবে সংসদের কাছে দায়ী থাকবে, কিন্তু কার্যত গোটা সংসদই দলীয় প্রধান তথা প্রধানমন্ত্রীর কাছে শুধু দায়বদ্ধ নয়, একান্ত অনুগত ও বাধ্যগত হতে সংবিধান অনুযায়ী বাধ্য।

এটি একটি চাতুরীতে ভরা সংবিধান। সংবিধানে বলা হয়েছে ক্ষমতার মালিক জনগণ। অথচ প্রয়োগের মালিক প্রধানমন্ত্রী যিনি জনগণের নিকট কোনভাবেই দায়বদ্ধ নন। এতে রাষ্ট্রের নাগরিকদের জন্য অনেক কল্যাণ আর অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু এসব কল্যাণ আর অধিকার যাতে কার্যকর করা না যায় তেমন ব্যবস্থাও এ সংবিধানে রাখা আছে।

এই সংবিধানে সকল ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। প্রকৃত অর্থে এই সংবিধান দ্বারা প্রধানমন্ত্রী শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৭০-এর সাথে অনুচ্ছেদ ১৪২ মিলিয়ে পড়লে দেখা যাবে যিনি প্রধানমন্ত্রী তিনি যদি দলীয় প্রধান হন, আর তার দলের যদি দুই-তৃতীয়াংশ আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকে তবে তিনি সংবিধান সংশোধনের এমন অপরিমেয় ক্ষমতা ভোগ করতে পারবেন যা পৃথিবীর কোন গণতান্ত্রিক দেশের প্রধাননির্বাহী কল্পনাও করতে পারেন না। বস্তুত ১৯৭২ এর সংবিধান পুরোপুরি একটি অগনতান্ত্রিক সংবিধান।

 

৩. জনগণের রাষ্ট্র বা রিপাবলিক

বাংলাদেশের জনগণের একটি রিপাবলিক প্রতিষ্ঠার আকুতি দীর্ঘ দিনের। এর প্রকাশ আমরা যেমন দেখতে পাই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে, তেমনি দেখতে পাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। এত ত্যাগ-তিতিক্ষা, লড়াই-সংগ্রাম পরেও জনগণের এ আশা পূরণ হয় নি। অথচ শাসকেরা ধোঁকা দিতে নাম দিয়েছে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ বা পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ। একটি জনগণের বা রিপাবলিক গঠন মানে জনগণের একসাথে মিলে একটা একক রাজনৈতিক সত্তা হয়ে ওঠা। সংবিধান প্রণয়নের প্রায় ৪৬ বছর পরেও বাংলাদেশের জনগণ একটি একক রাজনৈতিক সত্তা হয়ে ওঠাতো দূরের কথা নিজেদেরকে আরও বহুভাবে বিভাজিত করেছে।  যেমন আদিবাসী – বাঙালী, বাঙালী-বাংলাদেশী ইত্যাদি।

একটি জনগণের রাষ্ট্র বা রিপাবলিক হওয়ার মৌলিক বৈশিষ্ট্য হল রাষ্ট্র ক্ষমতার মালিক জনগণ। এ রাষ্ট্রে ব্যক্তি তথা জনগণ সার্বভৌম। এ বিচারে বাংলাদেশ রিপাবলিক নয়। কেননা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতা একটি পদ তথা সরকার প্রধানের হাতে ন্যস্ত রাখা হয়েছে। ক্ষমতা চর্চায় আমরা এটাই প্রতিষ্ঠিত দেখতে পাই।

অন্যদিকে অসংখ্য জাতিসত্তার দেশ নেপাল একটি একক রাজনৈতিক সত্তা হয়ে ওঠার পথে অনেকদূর অগ্রসর হয়েছে বলে ধরা যায়। বৃহৎ প্রতিবেশী দেশ ভারতের ( যার সাথে অধীনতামূলক চুক্তি রয়েছে ) নানান অপচেষ্টা ভণ্ডুল করে একটি একক রাজনৈতিক সত্তার দিকে অগ্রসর হচ্ছে নেপাল। যদিও মদেশি জনগোষ্ঠীর অসন্তোষ পুরোপুরি দূরীভূত হয়নি। তবে নেপাল যে একটি পলিটিকাল কম্যুনিটি হতে চলেছে তার একটি নিদর্শন দ্বিতীয় গণপরিষদের শেষ দিনে দলীয় প্রধানসহ সকল সদস্যদের একসাথে ফটোসেশন। বাংলাদেশে এ ধরনের ফটোসেশন কল্পনাও  করা যায় না। বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ইতোমধ্যে নেপাল নতুন সংবিধানের অধীনে স্থানীয়, প্রাদেশিক ও ফেডারেল পার্লামেন্টের নির্বাচন অনুষ্ঠান করেছে। নেপালের স্থিতিশীল রাষ্ট্র হওয়ার দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথে এটি  বিজয় হিসেবে ধরা হচ্ছে। সংবিধানে পরিস্কারভাবে নেপালের জনগণের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাষ্ট্রের আচরণ গণতন্ত্রসম্মত কি না তা দেখার সুযোগ এখনো আসেনি। আগামি দিনের নেপালের রাজনীতি বলে দেবে  গণতন্ত্রের চর্চা কতখানি সঠিক ও বাস্তবসম্মত হচ্চে। সে পর্যন্ত আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ