লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ March 28, 2018, 12:00 AM, Hits: 1477
আমাদের সমাজকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এগিয়ে নিবার কাজটা যে কত কঠিন বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটা বুঝা যায়। যে সমাজের মানুষদের নিজেদের বুদ্ধি-বিবেচনার উপর আস্থা এত কম সেই সমাজ কী করে প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে স্বাধীন এবং স্বচ্ছন্দভাবে অগ্রসর হবে? আসলে আমরা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে বা বুঝতেই ভয় পাই। বরং আমাদের চিন্তার ভারটাও সম্পূর্ণটাই অন্যের উপর ছেড়ে দিতে চাই। বিশেষত বাইরের সমাজের কারও উপর। কোনও সমস্যা দেখা দিলে সমাজের প্রায় সকল মানুষ মনে করে যে, সমাধানের চিন্তাটাকে আসতে হবে বাইরের সমাজ থেকে। যারা শক্তিমান, আধিপত্যকারী, বাইরের সমাজের সেই সব ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানসমূহই হচ্ছে আমাদের সমাজের বুদ্ধি এবং চিন্তা-চেতনার দিশারী। অবস্থাটা জ্ঞানের সর্বোচ্চ থেকে সর্বনিম্ন পর্যায় পর্যন্ত প্রায় একই রকম। আমজনতার ক্ষেত্রে এই মানসিকতার অপরিশীলিত বা স্থূল রূপ হচ্ছে সব চিন্তা বা সমাধানের ভার অদৃশ্য ও কাল্পনিক আল্লাহ বা ভগবানের উপর অর্পণ করা। আল্লাহ বা ভগবানকে তো আর চোখে দেখা যায় না। সুতরাং তার কাছে তদবীরের জন্য লাগে পীর বা গুরুকে।
এখন একটা ঘটনায় আসি। আমি ১৯৮৯ সালের ৯ নভেম্বর থেকে ২০ নভেম্বর সময়ের মধ্যে লিখি ‘মার্কসবাদের সঙ্কট এবং বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’। গ্রন্থটিতে মার্কসবাদের উপর একটি সমালোচনামূলক আলোচনা করি। এখানে মার্কসবাদের কিছু মৌলিক ভ্রান্তির পাশে তার ইতিবাচক ভূমিকা নিয়েও আলোচনা করি। সেই সঙ্গে এতে আমাদের সমাজে বিপ্লবের সমস্যা এবং পথ নিয়ে মার্কসীয় বৃত্ত থেকে বেরিয়ে স্বাধীনভাবে পথ খুঁজার চেষ্টা করি।
লেখাটাকে আমি প্রয়াত সাহিত্যিক আহমদ ছফাকে পড়তে দিই। সেই সময় তিনি ‘উত্তরণ’ নামে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। তিনি এটিকে তার পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেন। সম্ভবত ঐ সময়ে অথবা এর অল্প কিছু সময় পর আমি পাণ্ডুলিপির একটি ফটোকপি আমার এক বন্ধুকে পড়তে দিই। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে আমার কয়েক বৎসরের কনিষ্ঠ বা জুনিয়র। তার আচরণ, পড়াশুনা এবং বুদ্ধিমত্তা বা মেধার কারণে আমি তাকে পছন্দ করতাম। তাছাড়া আমার প্রতি তার শ্রদ্ধা এবং সহানুভূতিও আমাকে তার ঘনিষ্ট হতে সাহায্য করেছিল। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক। তার নামটা বলব না। কারণ কোনও ব্যক্তি বিশেষকে খাটো করা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। তার ঘটনাটা উল্লেখের মাধ্যমে আমি শুধু আমাদের সমাজের বুদ্ধিবৃত্তির একটি গভীর সমস্যাকে চিহ্নিত করতে চাইছি।
যাইহোক, আমার স্নেহভাজন সেই অধ্যাপক ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’ পড়ে তার উপর তার মতামত জানাতে গিয়ে প্রথমে বেশ প্রশংসা করলেন বইটার। তারপর একটা সময় অল্প কিছুক্ষণের জন্য থেমে হঠাৎ করে আবেগের সঙ্গে যা বললেন তা আজও আমার হুবহু মনে আছে, ‘কিন্তু মানিক ভাই, মার্কস কি এমনি এমনি মার্কস হয়েছেন?’ তারপর ভক্তি আপ্লুত কণ্ঠে যা বললেন তা মোটামুটি এই রকম, ‘মার্কস দশ বৎসর ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পড়েছিলেন। আর এই দশ বৎসর চেয়ারে বসে পড়তে পড়তে মার্কসের পিঠে কুঁজ গজিয়ে গেছিল।’
এ কথার কী উত্তর হতে পারে? এখন আমি দশ বৎসর ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পড়িও নাই আর আমার পিঠে কুঁজও গজায় নাই! স্বাভাবিকভাবে ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’ সম্পর্কিত আলোচনাও মূলত এখানেই ফুরালো। এরপর সামান্য কিছু যে আলোচনা হল তাতে তিনি মার্কসবাদের যেটুকু ভ্রান্তি বা সমস্যা আছে তার সম্পূর্ণ দায় মার্কসবাদের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এঙ্গেলসের উপর চাপিয়ে দিয়ে মার্কসকে দায়মুক্ত করলেন। আমার লেখার যুক্তির আঘাতে মার্কসবাদের প্রতি তার অন্ধ ও অচল আস্থায় যে ভাঙ্গন ঘটেছিল সেটাকে হঠাৎ ফিরে পাবার স্বস্তি এখন তার মনে। তার ব্যক্তি জীবনে মার্কসবাদের অনুশীলন কতটুকু ছিল সে প্রশ্ন না করেও বলা যায় যে, তার ভক্তি বা বিশ্বাসের জায়গাটাকে রাখতে চেয়েছিলেন অচল এবং অনড়। সেখানে তার মনে কোনও প্রশ্নের কাঁটা বিঁধতে দিয়ে মনের শান্তি নষ্ট করতে তিনি আর রাজী ছিলেন না।
এখানে আমি যার প্রসঙ্গ ধরে কথাটা বললাম তিনি যে শুধু এ দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত বিদ্বান ব্যক্তি তা-ই নয়, উপরন্তু পাশ্চাত্যেও তার বিদ্যা বা পাণ্ডিত্যের স্বীকৃতি আছে। পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সুযোগও তার হয়েছে। এমন ব্যক্তির বিচারের মানদণ্ড যদি এমন হয় তাহলে বলবার আর কী থাকে? তার কথার ভাব থেকে মনে হওয়া স্বাভাবিক যে মার্কসের বক্তব্যের সমালোচনা বা বিচারমূলক আলোচনা করবার যোগ্যতা অর্জনের আগে আমাকে অন্তত কুড়ি বৎসর ব্রিটিশ মিউজিয়ামে পড়তে এবং পিঠে নিদেনপক্ষে দুইটা কুঁজ গজাতে হবে। প্রসঙ্গক্রমে এটা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, আমি যখন ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ’ লিখি তার দুই বৎসর পর সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন ঘটে। সোভিয়েতের আনুষ্ঠানিকভাবে বিলুপ্তি ঘটে ১৯৯১-এর ২৬ ডিসেম্বর। তত্ত্বের বা মতবাদের নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণ দূরে থাক দৃশ্যমান হয়ে উঠছে এমন দেওয়ালের লিখনও এরা পড়তে পারে না।
যাইহোক, এই ঘটনার উল্লেখ আমি করলাম অন্ধ ভক্তিবাদ সর্বোচ্চ শিক্ষার অধিকারী এবং সুপণ্ডিত ব্যক্তিদেরও দৃষ্টিকে কীভাবে আচ্ছন্ন করে সেই দৃষ্টান্ত দিবার জন্য। পণ্ডিতদের যখন এমন অবস্থা তখন সাধারণ মানুষদের দশা কী হতে পারে তার উল্লেখ করা নিষ্প্রয়োজন। এই রকম দৃষ্টিভঙ্গী থাকলে স্বাধীনভাবে চিন্তা বা বিচারের ক্ষমতা থাকবার প্রশ্নই উঠে না। এই দৃষ্টিভঙ্গী মার্কসকে এমন এক অতিমানবীয় সত্তায় পরিণত করে যার কোনও ভুল থাকতে পারে না। কিংবা তার মতবাদে ভুল কিছু থাকলেও এই দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী সেটা বলা যাবে না কিংবা সেটাকে একেবারে অস্বীকার করা না গেলে তার জন্য দায়ী হিসাবে কোনও নন্দ ঘোষকে খুঁজে বের করতে হবে।
বস্তুত এটাই হচ্ছে আমাদের সমাজের বাস্তবতা। এই রকম এক সমাজে চেতনার বিচারে একজন গ্রাম্য অশিক্ষিত কৃষক কিংবা অশিক্ষিত রিকশাওয়ালার সঙ্গে একজন উচ্চশিক্ষিতের পার্থক্য সামান্য থাকে। প্রায় সবাই অন্ধ ভক্তিবাদী অথবা গুরুবাদী। আমাদের মুসলিম সমাজের ভাষায় গুরুকে বলা যায় পীর। এখন এই সমাজের মানুষদের খুব বেশী রকমই দরকার হয় পীরের। এই পীররা কখনও প্রবল ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তি অথবা প্রতিষ্ঠান কিংবা রাষ্ট্রের অবয়ব নিয়ে দেখা দেয়। দরিদ্র, অশিক্ষিত কিংবা অর্ধশিক্ষিতদের পীররা দেশের চৌহদ্দির মধ্যে থাকলেও শক্তিমান এবং শিক্ষিত বা উচ্চশিক্ষিতদের পীররা দেশের সীমানার বাইরে এমন দূরত্বে অবস্থান করে যেখানে যেতে হয় বিমানে করে।
বস্তুত আমরা বাস করি দাস মানসিকতাসম্পন্ন অন্ধ ভক্তিবাদী সমাজে। এখানে স্বাধীন বিচার-বুদ্ধি নিয়ে দাঁড়ানো সুকঠিন। বিচার-বুদ্ধি স্বাধীন না হলে আমরা স্বাধীন হব কেমন করে? সাম্রাজ্যবাদ বলা যাক, আধিপত্যবাদ বলা যাক তার প্রকৃত লালনভূমি বা ভিত্তিভূমি কিন্তু আমাদের চেতনা বা বুদ্ধিবৃত্তির এই দীন দশা। কাজেই শুধু বিদেশীদের গালি দিয়ে বা দোষ দিয়ে লাভ নাই। আমরা মূর্খ বা মূঢ় কিংবা বিচার-বুদ্ধিহীন হলে তার সুযোগ নিবার মত মানুষ বা সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের অভাব পৃথিবীতে হবে কেন?
রচনা : ২৭ মার্চ ২০১৮