লিখেছেনঃ আব্দুস সালাম সর্দার, আপডেটঃ April 17, 2018, 12:00 AM, Hits: 1594
‘‘রাজনীতি হচ্ছে রক্তপাতহীন যুদ্ধ আর যুদ্ধ হচ্ছে রক্তপাতময় রাজনীতি। রাজনীতি যখন স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারে না যুদ্ধই তখন তার সমাধান দেয়।’’ — মাও সে-তুং
(প্রথম পর্ব)
গঙ্গা নদীর উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে আগ্রাসনবাদী, আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর পানি আগ্রাসনের নীলনক্সা প্রস্তুত ছিল চল্লিশের দশকে হিংসা-প্রতিহিংসা-জিঘাংসার মধ্য দিয়ে ভারত-পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই। এই নীলনক্সা রচিত হচ্ছিল ভারতবর্ষের এক-জাতি বনাম দ্বি-জাতি তত্ত্বের দ্বন্দ্ব-বিরোধ, কংগ্রেস-মুসলিম লীগ সংঘাত, হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা-সংঘর্ষ এবং বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিপজ্জনক-ধ্বংসাত্মক নীলনক্সা প্রভৃতি ঘটনাধারার ভিতর দিয়েই।
ভারত ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ আরাম্ভ করে ’৬০-এর দশকেই। ১৯৭৪ সালে ১৬ মে ফারাক্কা বাঁধ চালু করার সময় “ইন্দিরা-মুজিব” ঘোষণা মোতাবেক ১৮ এপ্রিল ১৯৭৫ ভারত ১১,০০০-১৬,০০০ কিউসেক ও বাংলাদেশ ৪৪,০০০ কিউসেক এভাবে পানি ভাগাভগি হয়। কিন্তু মুজিব পরবর্তী কালে ভারত ইচ্ছামত পানি সরিয়ে নিতে থাকে। এর প্রতিবাদে আফ্রো-এশিয়া-ল্যাটিন আমেরিকার মজলুম জননেতা Prophet of Violence (বিদ্রোহের নবী), Fire Eater (আগুন খেকো) মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী বিশ্ব জনমত জাগিয়ে তুলতে ১৯৭৬ সালের ১৬ মে ফারাক্কা অভিমুখে লংমার্চ-এর ডাক দেন। ফারাক্কা বাঁধের অদূরে ভারত সীমান্তে চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসার্ট-এ এক বিশাল জনসমাবেশে “ফারক্কা বাঁধ মরণ ফাঁদ - ভেঙে দাও” ঘোষণার মধ্য দিয়ে লংমার্চ স্থগিত করা হয়। ঐক্যবদ্ধ দেশবাসী এই ফারাক্কা মিছিলে সর্বাত্মকভাবে যোগদান করে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে তিনি চিঠিও লেখেন। এই ঐতিহাসিক, অভূতপূর্ব প্রতিবাদী লংমার্চ ও প্রতিরোধী জনসমাবেশের জোরালো সমর্থনের প্রতিক্রিয়ায় ঐ বছরই ৫ নভেম্বর “জিয়া-দেশাই” গঙ্গা পানি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ তাই ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বাঙালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা।
এই চুক্তি মোতাবেক বাংলাদেশের ৩৪,০০০ কিউসেক পানি পাওয়ার গ্যারান্টি ছিল। জিয়া পরবর্তী ভারত সে চুক্তি বহাল রাখেনি। এরশাদ আমলে সমঝোতা চুক্তি হলেও ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত তার কিছুই প্রতিফলন ছিল না এবং ভারত গঙ্গা নদীর প্রায় সব পানি প্রত্যাহার করে নিয়ে গেলে বাংলাদেশে এই প্রবাহ একেবারে ১০,০০০ কিউসেকে নেমে আসে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হলে ভারতের সাথে আবার ৩০ বছর মেয়াদী গঙ্গা পানি চুক্তি হয়। এই চুক্তিতে ন্যূনতম ২৭,৬৩৩ কিউসেক পানি পাওয়ার কথা থাকলেও ভারত তা মানেনি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ সীমান্ত নদী মিলিয়ে মোট নদীর সংখ্যা প্রায় ১,২০০ (বার শত)। সীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৭ টি। ফারাক্কা, গজলডোবা, টিপাইমুখসহ অভিন্ন ৫৪ টি নদীর উজানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে ভারতের পানি আগ্রাসনের কারণে বাংলাদেশ আজ মরুভূমিপ্রায়, বিপর্যস্ত পরিবেশ-প্রকৃতি। বাংলাদেশের নদীর প্রবাহ ও ব্যবহার নিয়েই বাঙালীর ইতিহাস ও জীবন গঠিত। নদীর প্রবাহ ঋতুর পরিবর্তনের সাথে পরিবর্তনশীল এবং নদী প্রবাহের সাথে অর্থনীতি ওপ্রোতভাবে জড়িত।
ভারত অভিন্ন নদীগুলির উপর ড্যাম ও ব্যারেজ নির্মাণই শুধু নয়, সে আন্তঃনদীসংযোগ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ক’রে পূর্বাঞ্চলের নদীগুলির অববাহিকা থেকে বিপুল পরিমাণ জলরাশি পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতের নদীগুলির অববাহিকায় নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্পের অধীনে ইতোমধ্যে নির্মিত গজলডোবা ব্যারেজ ও মহানন্দা সংযোগ খালের মাধ্যমে ভারত তিস্তার সমুদয় জলরাশি সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এই প্রকল্প প্রকৃতি বিরুদ্ধ। এই প্রকল্প শুধু বাংলাদেশ নয় একেবারে সমগ্র বঙ্গীয় সমতলে ধ্বংসযজ্ঞ ডেকে আনবে।
সুদূর অতীত কাল থেকেই পৃথিবীতে মানব সভ্যতা গড়ে উঠেছে বড়বড় নদীর তীরে। আমাজন নদীর মোহনায় এর মূল প্রবাহের প্রসারতা (৮০ কি.মি)। কঙ্গোনদী গড় প্রবাহের (৪১.২০০ কিউবিক মিটার/সেকেন্ড) দিক থেকে দ্বিতীয়। গড় পানি প্রবাহের দিক থেকে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের মিলিত প্রবাহ বিশ্বের তৃতীয় (৩৮.১২৯ কিউবিক মিটার)। তবে আমাজন ও কঙ্গো নদীর অববাহিকায় গভীর বনাঞ্চল থাকায় এর তীরবর্তী স্থানগুলিতে তেমন কোন ঐতিহাসিক সভ্যতা গড়ে ওঠেনি। পক্ষান্তরে গঙ্গানদীর অববাহিকায় যেসব সভ্যতা ও সাম্রাজ্য গড়ে ওঠে তার আড়াই-তিন হাজার বছরের ইতিহাস রয়েছে। গঙ্গা নদীর অববাহিকায় গড়ে ওঠে ষড়ঋতু ভিত্তিক কৃষি সভ্যতা। এই সভ্যতায় বছরব্যাপী আউশ, আমন ও রবিশস্যের তিন ফসলী কৃষিপঞ্জিকা পৃথিবীর আর কোথাও নেই। গঙ্গা নদীর মোহনা পৃথিবীর বৃহত্তম বদ্বীপ অঞ্চল (প্রশস্ততা ৩৫০ কিমি)। তবে মানবসমাজের আগ্রাসনে উপকূলবর্তী সুন্দরবনের বিস্তৃতি অনেক সংকুচিত হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ নদীর একটি গঙ্গানদী তার উৎপত্তিস্থল থেকে বঙ্গপোসাগরে পতিত হওয়া পর্যন্ত প্রায় ২,৫৫০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছে। ভারত, চীন, নেপাল ও বাংলাদেশে গঙ্গা নদীর অববাহিকা প্রায় ১০,৮৭,৩০০ বর্গ কিলোমিটার জুড়ে বিস্তৃত। বাংলাদেশে এ এলাকা ৫২,৭৪৮ বর্গ কিলোমিটার। এই নদীর অববাহিকায় ভারতের উত্তর প্রদেশ, বিহার ও অন্যত্র সুদূর অতীত থেকে মানব সভ্যতা ও চাষাবাদ গড়ে ওঠে। তাদের চাষের জমি থেকে জৈব পদার্থ ও পলি ধুয়ে এসে গঙ্গা নদীর মাধ্যমে বাঙলার ব-দ্বীপে জমা হয়েছে। এই কারণে গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের মাটিতে পলি ও কাদার পরিমাণ বেশি। নদীবাহিত জৈব পদার্থ ব-দ্বীপের মাটিকে উর্বর করেছে ও সাগরের মোহনায় মাছের খাবার তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বাঙলাদেশের ৫৭ টি সীমান্ত নদীর মধ্যে ৫৪টি ভারতের সাথে ও ৩টি মিয়ানমারের সাথে। বাংলাদেশ-ভারত অভিন্ন সীমান্ত নদী যথাক্রমে রাইমহল, ইছামতি ও কালিনদী, কোদলা ও বেতলা, ভৈরব, কপোতাক্ষ, মাতাভাঙ্গা, গঙ্গা, পাগলা, আত্রাই, পুনর্ভবা, টাঙ্গন, তুল্লাই, নাগর, কুলিক, মহানন্দা, ডাহুক, করতোয়া, তালমা, ঘোড়ামারা, দেওনাই, যমুনেশ্বরী, বুড়িতিস্তা, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, ব্রহ্মপুত্র, জিঞ্জিরাম, চিল্লাখালি, ভোগাই, নিতাই, সোমেশ্বরী, যদুকাটা, রক্তি জালুখালি, ধামালিয়া, নওয়াগাঙ, উমিয়েও, ঢালা, পিয়াইন, সুটাং, শারীগোয়াই, সুরমা, কুশিয়ারা, সোনাইবরদল, জুরি, মনু, ধলাই, গোপলালুংলা, খোয়াই, সুটাঙ, সোনাই, হাওড়া, বিজনী, সালদা, গোমতী, কাকড়ী, ডাকাতিয়া, সেলোনিয়া, মুহুরী, ফেনী, কর্ণফুলী, শংখ, মাতামুহুরী ও নাফ।
পৃথিবীর উপরিভাগের ৭১% সাগর ও মহাসাগর। বিশ্বে যত পানি আছে তার ৯৭% সমুদ্রের লোনা পানি। বাকী ২.৫-২.৭৫% মিঠা পানি। যার ১.৭৫-২% হিমবাহ বরফ ও তুষার এবং ০.৭-০.৮% ভূগর্ভস্থ পানি। মাত্র ০.০১% ভূপরিস্থ মিঠা পানি যা নদী, খাল, বিল ও হ্রদে আছে। আবার মিঠা পানির হ্রদগুলি হচ্ছে ৮৭% ভূপরিস্থ পানির আধার, যার ২৯% আফ্রিকার হ্রদ গুলিতে, ২০% রাশিয়ার বৈকাল হ্রদে, ২১% উত্তর আমেরিকার হ্রদ গুলিতে এবং ১৪% পৃথিবীর অন্যান্য হ্রদ গুলিতে বিদ্যমান। বাতাসে আছে ০.০৪% পানি। এই হিসাবে বাতাস থেকে খুব অল্প পরিমাণ পানিই বৃষ্টিপাতের ফলে পৃথিবীর নদী দিয়ে বয়ে যায়। যেহেতু পানির উপর নির্ভর করেই ভূপরিস্থ মানুষ, পশু-পক্ষী ও অন্যান্য জীব এবং গাছপালা বেঁচে আছে, সেহেতু নদীর প্রবাহ প্রত্যেকটি দেশ/অঞ্চলের জীব পরিবেশের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। নদী বিছানো বা নদী মাতৃক বাংলাদেশের কথা এখানে সর্বোচ্চ মাত্রায় অপরিহার্য। বাংলাদেশের মোট এলাকা ১,৪৮,৪০০ বর্গ কিলোমিটার। সর্বমোট ১৭ টি অববহিকায় সারাদেশের এলাকা বিভক্ত হয়ে আছে।
ভারত পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিনাজপুরে মহানন্দার পানি, দক্ষিণ দিনাজপুর জেলায় আত্রাই ও পুনর্ভবা নদীর পানি, নদীয়ায় ভৈরব নদীর পানি এবং উত্তর চব্বিশপরগণায় বেতনা ও কোদলা নদীর পানি বাঁধ দিয়ে প্রত্যাহার করে। ফেণী নদীর পানি পাম্প দিয়ে তোলে, গোমতী নদীর পানি ড্যামের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করে, বিজলী, খোয়াই, মনু এবং বরাক নদের কিছু উপনদীর পানি জলকাঠামো দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেচ ও শহরে জল সরবারহের জন্য প্রত্যাহার করে।
উজানে বিভিন্ন নদীর পানি প্রত্যাহার হয়ে যাওয়ার কারণে বাঙলাদেশের নদীগুলি শুকিয়ে যাচ্ছে। ভারত তিস্তা নদীর উপর গজলডোবার কাছে ১৯৮২ সালে একটি ব্যারেজ নির্মাণ করে। এরপর তিস্তা থেকে মহানন্দা সংযোগ খাল ও মহানন্দা ডাহুক সেচ খালের মাধ্যমে পশ্চিম বঙ্গ ও বিহারে তিস্তা নদীর সমুদয় তলানী প্রবাহ সরিয়ে নিয়ে গেছে। এখন বাংলাদেশের তিস্তা নদীতে কিছু পাহাড়ী উপনদীর পানিই কেবল আসে। নদীর প্রবাহ পথে হস্তক্ষেপের ফলে দেশে দেশে ভাটির অঞ্চলের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ভারত গঙ্গার উপর ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ করায় ভাটিতে বাঙলাদেশের গঙ্গা শুকিয়ে গেছে। কর্ণাটক কাবেরী নদীর উপর ড্যাম নির্মাণ করে পানি আটকে রাখায় তামিলনাড়ুর সমভূমি অঞ্চলের মানুষ পানি পাচ্ছে না। তাই বিরোধ সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে যেসব নদী একাধিক দেশের উপর দিয়ে বয়ে গেছে সেসব নদীর উজানে ড্যাম বা ব্যারেজ নির্মানের কারণে ভাটির দেশ জোর আপত্তি জানাচ্ছে। বাঙলাদেশের যে সকল নদী আন্তর্জাতিক তার অনেকগুলির উজানে ভারত ও চীন ড্যাম নির্মাণ করে চলেছে। উজানের দেশগুলির এই কর্মকাণ্ড ভাটির দেশকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। ১৯৬০ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সিন্ধু অববাহিকার নদীগুলির পানি ভাগাভাগি নিয়ে চুক্তি এবং ১৯৯৬ সালের ১২ ডিসেম্বর ভারত-বাংলাদেশ গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি ভাটির দেশের ক্ষতি করে চলেছে। তাই “ফারাক্কা বাঁধ মরণ ফাঁদ - ভেঙে দাও” মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চের এই স্লোগান এক যুগান্তকারী ঘোষণা।
তিস্তা নদীর পানি ব্যবহারের বেলায় জাতিসংঘের ১৯৯৭ সালের কনভেনশনটি অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই কনভেনশনে ‘অববাহিকা’, ‘পানির অধিকার’, ‘ন্যায্যতার সাথে পানি ব্যবহার’, ‘অববাহিকার অন্তর্ভুক্ত দেশের ক্ষতি ও ক্ষতিপূরণ’, ‘পানির ব্যবহার নিয়ে বিরোধ’, ‘আন্তর্জাতিক আদালত’, ‘পরিবেশ রক্ষা’ ইত্যাদি বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ আছে। উল্লেখ্য যে, এই কনভেনশনে পানি প্রত্যাহার, পানি সরানো, নদী সংযোগ, পানি বণ্টন, পানি জমানো বিষয়ক Withdrawal, Divert, Transfer, Distributes, Storage, ইত্যাদি কথা নেই। এক দেশ কর্তৃক অন্য দেশের ক্ষতি না করাই মূল কথা।
ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে ১৯৬০ সালের সিন্ধু পানিচুক্তি এবং ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিচুক্তি নদীর পানি প্রত্যাহার বা পানি সরানো বিষয়ক যা এই কনভেশন অনুযায়ী সিদ্ধ নয়। কারণ এই চুক্তির ফলে সিন্ধু ও গঙ্গা অববাহিকায় পকিস্তান ও বাংলাদেশের জনজীবন, প্রকৃতি ও অর্থনীতি অনন্তকালের মত ক্ষতিগ্রস্ত ও বিপদগ্রস্ত হয়েছে।
একালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী বলে বিবেচিত স্টিভেন ইউলিয়াম হকিং মানবজাতিকে যে বার্তা দিয়ে সেদিন ১৪ মার্চ ২০১৮ অনন্ত বিদায় নিলেন তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য বার্তা, “আগামী ১০০ বছরের মধ্যে বিশ্বের পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে ব্যর্থ হলে ৬০০ বছরের মধ্যে অর্থাৎ ২৬০০ সালে পৃথিবীর মানবজাতি-সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে।” পরিবেশ দূষণের সবচেয়ে ক্ষতিকর পন্থা পানি দূষণ। পানি দূষণের কারণে বিশুদ্ধ পানির অভাবে দূষিত পানি পান করে দুরারোগ্য রোগ বিস্তারের ফলে জলজপ্রকৃতি-ভূপ্রকৃতি, মানব সভ্যতা, পশুপাখি-গাছপালা, লতাগুল্ম বিশ্বপরিস্থিতি যেন ধ্বংসের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ইউনেসকোর প্রতিবেদন মোতাবেক বিশ্বের ৩৬০ কোটি অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক মানুষ বছরে অন্তত এক মাস পানি সংকটে ভোগেন। আর এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে এ সংখ্যা প্রায় ৬০০ কোটি পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে বাংলাদেশের সাড়ে নয় কোটি মানুষই বিশুদ্ধ পানি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দেশের সবচেয়ে বেশী পানি যে উপকূলীয় এলাকায় সেখানে বিশুদ্ধ খাবার পানির সংকট ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর যেসব দেশ সবচেয়ে ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে বাঙলাদেশ তার মধ্যে একটি। লবণাক্ততার আগ্রাসনে নষ্ট হচ্ছে মিষ্টি পানির সব উৎস।
(দ্বিতীয় পর্ব)
আজকের বাংলাদেশ অবিভক্ত ভারতবর্ষের অংশ। প্রাচীন সভ্যতার লীলাভূমি ভারতবর্ষ। পৃথিবীর জনসংখ্যার একপঞ্চমাংশেরও বেশি মানুষ এখানে বসবাস করে। বহু বিচিত্র জনগোষ্ঠী, ভাষা, ধর্ম, গোত্র, বর্ণ, দেহগঠন, সংস্কৃতি এবং জাতিসত্তার মানুষের এই উপমহাদেশ প্রাকৃতিকভাবেও বৈচিত্র্যমণ্ডিত। সমভূমি এবং বন্ধুর পার্বত্য ভূমি, জলাভূমি, অরণ্য এবং মরুভূমি, বন্যা এবং খরা, উত্তরে বরফ-আচ্ছাদিত পর্বতশিখর ও উচ্চভূমিতে তুষারপাত আর দক্ষিণে মালভূমিতে দাবদাহ এই উপমহাদেশের এক প্রকৃতিমঞ্জুরী। এই বৈচিত্র্যের কারণেই ভারতবর্ষ এক দেশ হিসাবে টিকে থাকতে পারে নাই। ইতোমধ্যেই অনেক দেশে বিভক্ত হয়েছে। ভবিষ্যতে ভারত হয়তো আরো অনেক দেশে বিভক্ত হয়ে উপমহাদেশ ভিত্তিক ‘জাতিরাষ্ট্রসংঘ’ গঠিত হতে পারে। তারপরেও বর্তমানকালে হিন্দুস্থান বা ভারতরাষ্ট্রের শাসকগোষ্ঠী প্রতিবেশী দেশসহ ভারতের অভ্যন্তরে ভিন্নভিন্ন জাতিসত্তা, ধর্ম ও ভাষাভাষী জনগোষ্ঠীর সমাজ-অবতলে আগ্রাসনবাদী, আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী, স্বৈরতান্ত্রিক নির্যাতন- নিপীড়ন, খবরদারি-নজরদারির যে অপতৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে, মওলানা ভাসানীর ফারাক্কা লংমার্চ তাই ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর সেই পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতীকচিহ্ন।
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারী টাঙ্গাইলে কাগমারী সম্মেলনে ঘোষণা করেন, “পূর্ব বাঙলার জনগণের উপর যে ভাবে অর্থনৈতিক শোষণ ও বিজাতীয় শাসন চলছে তাতে এমন একদিন আসবে যেদিন পূর্ব বাঙলার জনগণ পশ্চিম পাকিস্তানকে ‘আস্সালামুআলায়কুম’ বলতে বাধ্য হবে।” স্বাধীনতা-উত্তরকালে পল্টনের জনসভায় মওলানা ভাসানীর মন্তব্য, “দিল্লী সরকার আর মাড়োয়ারী ব্যবসায়ীরা পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের স্থান দখল করতে চাইছে। যুদ্ধের পর পাকবাহিনীর কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া অস্ত্র, গোলাবারুদ, কামানবন্দুক সব ওরা নিয়ে গেছে; আমাদের হিস্যা বুঝিয়ে দেয়নি। মুক্তিযুদ্ধকালে আমাকে নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে। এখন আওয়ামী লীগ সরকার লুটপাট বাহিনীর পৃষ্ঠপোষক হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের লুটপাট আর ভারতীয় নীলনক্সার বিরুদ্ধে কথা বললেই জুলুম নির্যাতন নেমে আসে। ২৩ বছর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করেছে ২৫ হাজার কোটি টাকা আর নয় মাসের যুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী এদেশ থেকে লুণ্ঠন করে নিয়ে গেছে ৭৫ হাজার কোটি টাকা। বিজাতীয় দখলদার পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী জাতিরাষ্ট্র গঠনের প্রথম মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্নদ্রষ্টা ও ঘোষক যেমন মওলানা ভাসানী তেমনি আগ্রাসনবাদী, আধিপত্যবাদী, সম্প্রসারণবাদী ভারতীয় শাসকগোষ্ঠীর পানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে “ফারাক্কা বাঁধ মরণ ফাঁদ-ভেঙে দাও” স্লোগানের ভিত্তিতে ফারাক্কা লংমার্চ মওলানা ভাসানীর দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের ঘোষণা। প্রথম মুক্তিযুদ্ধের অর্জন খণ্ডিত বাঙ্গালী জাতিরাষ্ট্র। দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের অর্জন হতে পারে ত্রিশ কোটি বাঙালীর বৃহৎ অখণ্ড স্বাধীন বাঙালী জাতিরাষ্ট্র।
ফারাক্কা সংকট, নদী সংকট, পানি সংকট, পরিবেশ সংকট, প্রকৃতি সংকট প্রভৃতি বাঙলাদেশের জাতীয় সংকট। জাতীয় সংকট মোকাবিলার শক্তিভিত আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় মর্যাদা। আত্মবিশ্বাস ও জাতীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠার শক্তিভিত জাতীয়তাবাদ। বাঙালী জাতিরাষ্ট্রের শক্তিভিত বাঙালী জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ, আগ্রাসনবাদ, আধিপত্যবাদ ও সম্প্রসারণবাদী শোষণ-নিষ্পেষণের নিকষকালো অন্ধকার তাড়াতে বাতিঘর (Light House)। বাঙলাদেশের শক্তিভিত বাঙালী জাতীয়তাবাদ। মার্ক্সবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ বোঝে, জাতীয়তাবাদ বোঝে না। যারা জাতীয়তাবাদ বোঝে না তাদের আন্তর্জাতিকতাবাদ কোন কাজে লাগে না, ভারত উপমহাদেশের কমিউনিস্টরা আজও তা বুঝতে পারেনি। মওলানা ভাসানী গণতান্ত্রিক বাঙালী জাতীয়তাবাদী। মার্ক্সবাদকে ধর্মীয় গোঁড়ামী মতবাদ বিবেচনা করায় কমিউনিস্টরা হারিয়ে যাচ্ছে। কমিউনিস্টরা জাতীয়তাবাদ বুঝলে বাঙালী জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দখল করতে পারতো। এমনকি ’৪০ এর দশকে ভারতের মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্বের ভূমিকা অর্জন করতে পারতো, ভারতবর্ষের বিপজ্জনক সাম্প্রদায়িক বিভক্তি হতো না। এই উপমহাদেশ আজকের সাম্প্রদায়িক ডামাডোলে ক্ষতবিক্ষত হতো না। অবিভক্ত ভারতবর্ষই হতে পারতো পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ জাতিরাষ্ট্রসংঘ।
বিএনপির বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ বাঙালী জাতীয়তাবাদের মৃত্যুঘণ্টা। বিএনপি-এর বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ প্রকৃতপক্ষে ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ, এটা ইসলামী সাম্প্রদায়িকতাবাদ, যার কোনও ভবিষ্যৎ নেই। ভারতীয় জাতিরাষ্ট্র টিকে থাকতে পারেনি। ভারত ভেঙ্গেছে, আরো ভাঙ্গতে পারে। পাকিস্তানী জাতিরাষ্ট্র ভেঙ্গে গেছে, আরো ভাঙ্গতে পারে। এমনকি রুশ সাম্রাজ্য সমাজবাদী ইউনিয়ন বানিয়েও টিকিয়ে রাখতে পারেনি।
ভাসানী পরবর্তী আওয়ামী লীগের চরিত্রগত বৈশিষ্ট্য হয়ে গেছে ইসলাম আশ্রিত উগ্র বাঙালী জাতীয়তাবাদী। তা গণতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদী চরিত্র হারিয়ে ফেলেছে। আওয়ামী লীগ বুলিসর্বস্ব ধর্ম নিরপেক্ষতাও হারিয়েছে রাষ্ট্রক্ষমতার মসনদে বসেই। বর্তমানের আওয়ামী লীগ হেফাজতে ইসলামের কাছে আত্মসমর্পণ করে সাম্প্রদায়িক খড়গ-এর তলায় মাথা দিয়ে নিরাপত্তা খুঁজছে। বাংলাদেশের ৪৭ বছরের স্বাধীনতায় আদর্শচ্যুতি ভয়ঙ্কর, দুর্নীতির আরোহণ উচ্চ শিখরে। ত্রিমুখী শিক্ষানীতির কারণে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা এখন বিপজ্জনকভাবে ইসলামী সাম্প্রদায়িক। শাসক গোষ্ঠীর দুর্বৃত্তায়ন, শোষণ এবং লুণ্ঠনের প্রয়োজনে একদিকে ধর্ম অপর দিকে রাষ্ট্রীয় স্বৈরতন্ত্রের অপ্রতিহত চর্চা চলছে দেশে। যেমন জার্মান আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বেরটেলসম্যান স্টিফটুং-এর গবেষণা সমীক্ষায়, “বাঙলাদেশ এখন স্বৈরশাসনের অধীন এবং সেখানে এখন গণতন্ত্রের ন্যূনতম মানদণ্ড পর্যন্ত মানা হচ্ছে না।”
(তৃতীয় পর্ব)
বাঙলাদেশের নদী ব্যবস্থাপনায় প্রথম আঘাত আসে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ধ্বংসাত্মক-বিপজ্জনক-ক্ষতিকর নদী ব্যবস্থাপনায়। এরপর ষাটের দশকে স্বৈরশাসক আইউব খানের সবুজ বিপ্লবের নামে ক্ষতিকর বাঁধ, আশির দশকে স্বৈরশাসক এরশাদ আমলে বিশ্বব্যাংকের বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ নদী ব্যবস্থায় প্রভূত পরিমাণ ক্ষতি সাধন করেছে। গত দুই দশকে শিল্প-কলকারখানা ও বাণিজ্য প্রসারের অজুহাতে নদীর দখল ও দূষণ ঘটেছে বিপজ্জনক হারে। এই মুহূর্তে সংবাদপত্রের বিবরণে প্রকাশ নাব্যসংকটে বন্ধ হয়ে গেছে দক্ষিণ অঞ্চলের ২৮টি নৌ-রুট। খরস্রোতা ব্রহ্মপুত্র এখন মরাখাল। সিলেটের পিয়াইন নদীর কান্না কেউ শোনে না। বগুড়ায় দখল-দূষণের কবলে প্রধান নদীগুলো। জামালপুরের অস্তিত্ব সংকটে ঝিনাই, সূবর্ণখালী। পঞ্চগড়ের অধিকাংশ নদী এখন মরাখাল। যশোর-খুলনার সেই ভয়াল ভৈরবের এখন মরণদশা। হেঁটে পাড়ি দিচ্ছে মনুষ ব্রহ্মপুত্র, যমুনা। কুড়িগ্রামের ১৬ নদী পানিশূন্য। নীলফামারীর ২২ নদী আবাদী জমি। দিনাজপুরের পুনর্ভবায় খেলার মাঠ। সাতক্ষীরার ২৭ নদী অস্তিত্ব সংকটে। মানিকগঞ্জের পদ্মায় কোথাও ধূধূ বালুচর, কোথাও চাষাবাদ। হারিয়ে যাচ্ছে নাটোরের ৩২ নদনদী। মাদারীপুরের নদীগুলো বেহাল, হুমকিতে নৌপথ। দখলে রুগ্ন ডাকাতিয়া। হারিয়ে যাচ্ছে কালাডুমুর। নওগাঁর সাত নদীই এখন মরাখাল। অস্তিত্ব সংকটে ময়মনসিংহের অর্ধশত নদনদী। চুয়াডাঙ্গার মাথাভাঙা, কুষ্টিয়ার কুমারনদী, মাগুরার মধুমতী, ফরিদপুরের গড়াই, ঝিনাইদহের নবগঙ্গা, চিত্রা, বেগবতী এ সকল স্রোতস্বিনী নদী এখন প্রায় জলশূন্য।
আমি বলতে চাই আন্তর্জাতিক পানি দিবস ২২ মার্চ, ১৬ মে ফারাক্কা দিবসকে বাঙলাদেশের পানি দিবস ঘোষণা করা উচিৎ।
পুনরায় এ কথা বলি আমাদের জীবন-জীবিকা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি সবকিছুর সঙ্গে নদী ও পানি বিশেষভাবে সম্পর্কযুক্ত। হাজার বছর ধরেই উপরে বর্ণিত নদনদী আমাদের কৃষি, প্রকৃতি ও অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, নদী রক্ষা করতে না পারলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কোনভাবেই রক্ষা পাবে না।
(ভৌগোলিক তথ্যসুত্র : বাংলাদেশের নদনদী, মঃ ইনামুল হক)
মোবাইল : ০১৭৯৮৫৬৬২৭৬
রচনা : ০৮/০৪/২০১৮ইং