লিখেছেনঃ আর্য সারথী, আপডেটঃ June 23, 2018, 12:00 AM, Hits: 2183
মানবসভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের ক্ষেত্রে বরাবরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে নদ-নদী। তাই আমাদের সংস্কৃতির অনেকটা জুড়ে নদীর প্রবল কিন্তু ছন্দময় স্রোতের স্পর্শ পাই।সংস্কৃতির উৎসমুখ হিসেবে ভূমিকা রাখা নদী যেন আমাদের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে আছে। আমাদের প্রাচ্যের ইতিহাস অনুধ্যানের মাধ্যমে আমরা আমাদের আত্মপরিচয় লাভ করতে পারি। সেই আত্মপরিচয় নির্মাণে কিন্তু নদীগুলোর ভূমিকা অসামান্য।আমরা যদি আমাদের এই ভারতবর্ষীয় অঞ্চলের ইতিহাস ও সভ্যতার গতিধারার সার্বিক বিচার করি তাহলে আমাদের ফিরে যেতে হবে প্রায় ৫৫০০ বছর আগে সিন্ধু নদের তীরে, অনুধাবন করতে হবে সিন্ধু সভ্যতা। সিন্ধু নদ বিধৌত অঞ্চলে সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল বলে এর নাম সিন্ধু সভ্যতা। শুরুটা সিন্ধুতে হলেও ব্যাপারটা সেখানে সীমাবদ্ধ থাকেনি।বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে এর প্রভাব ছিল। এই সভ্যতার আয়তন এখনও পর্যন্ত নির্ণীত হয়েছে ১৫ লক্ষ বর্গমাইল। পশ্চিমে বালুচিস্তানের পর্বতমালা, উত্তরে জম্বু, দক্ষিণে আরব সাগর ও নর্মদা উপত্যকা অবধি বিস্তার এবং পূর্বে গঙ্গানদীর উপত্যকা অবধি। ওই সময় এত বিশাল এলাকা জুড়ে একই সভ্যতার হাজিরি কিন্তু বিস্ময়কর। এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যে শক্তিশালী ঐক্য ও যোগাযোগ তৈরি হয়েছিল তা বলাটা অমূলক নয়। বরং ইতিহাসে ঘটনাটা অনন্য।
আমাদের এই অঞ্চলের ইতিহাস, দর্শন ও জীবনাচার অনেকটাই রাজক্ষমতাবিমুখ। ফলে এখানে বিশাল সাম্রাজ্য ছিল এই কল্পনাও করা যায় না। এদেশের রাজশক্তির কর্তৃত্ব সাধারণ মানুষ মানেনি, সমাজের উপর রাজশক্তির হাজিরি অনুমোদন পায়নি। রাজার কাজ শুধু প্রজার হিতে কাজ ও প্রজার নিরাপত্তা দান। আর বিশেষ কাজ ছিল কর আদায়। তাই এই অঞ্চলে কোনো বৃহৎ সাম্রাজ্য টেকেনি।তাই সিন্ধু সভ্যতার যুগেও এতবড় সাম্রাজ্য তৈরি অসম্ভব।
এই অঞ্চলের মানুষের ঐক্য ছিল সাংস্কৃতিক। আমরা জানি এই অঞ্চলের মানুষের সাংস্কৃতিক ভিন্নতা ব্যাপক। তখনতো আর জাতীয়তাবাদ এর যুগ ছিল না, তাও আমরা কিভাবে একতার কথা বলছি সে প্রশ্ন আসে। আসলে একতার জায়গাগুলো ছিল:
১) প্রকৃতি-পরিবেশকে নিজের বিপরীতে গণ্য না করে প্রকৃতির অংশ বলে মনে করা।
২) শান্তিপূর্ণ ও শৃঙখলাপূর্ণ জীবনযাপন।
৩) বিরোধী মতের সাথে সহাবস্থান।
৪) রাজশক্তি থেকে দূরত্ব রেখে চলা।
৫) নিজের প্রাত্যহিক কর্মের মধ্যদিয়ে ধর্মাচরণ করা।
৬) অপরের ভাল জিনিশটা গ্রহণ করা।
এগুলোই ঐক্যের মূল।
সিন্ধু সভ্যতার বিশালতা ও এখনও পর্যন্ত প্রাপ্ত নিদর্শন আমাদের মাথায় জেঁকে বসায় ঔপনিবেশিক জ্ঞানতত্ত্ব ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। আমাদের শুরু করতে হচ্ছে নবমূল্যায়ন। প্রাচীনকাল বলতেই যে অসভ্যতা এবং প্রাচ্য বলতেই যে কিছুই না থাকার ছবি ভেসে উঠত সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার তাকে সরাসরি খারিজ করে দিয়েছে।
এই সভ্যতা নব্য-প্রস্তর যুগের সভ্যতার ধারাবাহিক পরিণতিতে উদ্ভুত তাম্র-প্রস্তর সভ্যতা। এই সভ্যতা কারা বানিয়েছে তা আজও ঠিক করে জানা যায়নি।এখান থেকে যে নরকঙ্কাল পাওয়া গেছে তার আলোকে বলা যায় এখানে ৪ ধরনের মানুষ বাস করতেন।যথা:
১) নিষাদ(ককেশীয়)
২) দ্রাবিড় (বৈদিক সাহিত্যে এদের নাম পণি)
৩) কিরাত (মোঙ্গলীয়)
৪) আল্পীয় আর্য (পণ্ডিতদের ধারণা অনুসারে এরাই অসুর। কারণ এরা এদের দেবতাকে অসুর বলত)
পণ্ডিতরা হরপ্পা ও মোহেন-জো-দারোর সবটা না খুঁড়েই আশ্চর্য হয়েছেন।নগর দুটি এত পরিপাটি ও উন্নত ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।সেখানে গণিত, জ্যামিতি ও ধাতুবিজ্ঞান এর ব্যাপক প্রসার ঘটেছিল।স্থাপত্যকর্ম দেখলে এই ধারণা আরও শক্তিশালী হয়। সোনা, রূপা ও তামার ব্যবহার তারা খুব বেশি করত।এমনকি তারা টিন ও তামার মিশ্রণ যে মিশ্রণ তৈরি করতে পারে তাও জানত তারা।পাথরের ব্যবহারও ছিল ব্যাপক।হরিণের শিং, হাতির দাঁত, ঝিনুক চিনামাটি ইত্যাদির ব্যবহার। তখন মৃৎশিল্প খুব উন্নত ছিল।তারা পোশাকের ক্ষেত্রে কার্পাস তুলা ব্যবহার করত। তাদের লিখন পদ্ধতি ছিল। একে বলে সিন্ধুলিপি এটি ব্রাহ্মী লিপির জননী। পণ্ডিতগণ সিন্ধু সভ্যতার ইতিহাসকে ৫ টি পর্যায়ে ভাগ করেন।তিনটিই গ্রামীণ সভ্যতার পর্যায়। ৪র্থ ও ৫ম হলো নগর সভ্যতা ও ধ্বংসের পর্যায়।তবে পণ্ডিতরা গ্রামীণ সভ্যতাকে প্রাক্ হরপ্পীয় সভ্যতা বলেন।
বিভিন্ন আবিষ্কার হতে জানা যায় সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মাচরণে তন্ত্র, যোগ, টোটেমবাদ, ইন্দ্রজাল ও দেব-দেবী পূজার প্রভাব ছিল। তার মধ্যে আদিপিতা ও আদিমাতার পূজা উল্লেখযোগ্য। এদের সাথে বর্তমানে হর-পার্বতীর মিল পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো মূর্তির পাশাপাশি যেমন লিঙ্গ-যোনি প্রতীক দ্বারা পূজা হয় তখনও তাই হতো। তাদের মাঝে আমরা বৃক্ষপূজা, সর্পপূজা ও সূর্যপূজাও ছিল।
তাদের দেহ সৎকারের ক্ষেত্রে তিনটি পদ্ধতি ছিল বলে জানা যায়। যথা:
১) দাহ
২) সমাধি ও
৩) দাহ সমাধি।
সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী প্রাকৃতিক বিপর্যয়। শেষদিকে পরিবেশ দূষণ চরম মাত্রায় পৌছে যায়। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ব্যাপকভাবে বিনষ্ট হতে থাকে। এর ফলে ঘনিয়ে আসে এই সভ্যতার পতন।
সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার আজও করা যায়নি। অনেক কিছু থেকে যাচ্ছে আমাদের অজানা। তাই এই সভ্যতা সম্পর্কে লিখতে গিয়ে শেষ কথা লেখার সময় এখনও আসেনি।