লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী , আপডেটঃ October 7, 2018, 12:00 AM, Hits: 1037
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে শাসক দল আওয়ামী লীগ ও তাদের নেতৃত্বে গঠিত মহাজোট ইতোমধ্যেই নির্বাচনি প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে। একই সঙ্গে ক্ষমতাবহির্ভুত বুর্জোয়া শাসক শ্রেণির প্রধান অংশ বিএনপি সহ অপর অংশগুলো নিজ নিজ রাজনৈতিক কর্মসূচি হাজির করেছে। তারা দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন’ অনুষ্ঠানের দাবিতে আন্দোলন তৎপরতা শুরু করেছে। একই প্রশ্নে বামপন্থীদের মধ্যে আকারের দিক থেকে বড় একটা অংশ ‘বাম গণতান্ত্রিক জোট’শিরোনামে একটি নির্বাচনি জোট গঠন করেছে এবং নির্বাচন প্রশ্নে তাদের বক্তব্য হাজির করেছে। সেখানে নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার এবং বর্তমান সংসদ ভেঙ্গে দিয়ে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা করে তার অধীনে ‘অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ’ নির্বাচনের দাবি জানিয়েছে। বিএনপি জামায়াতের নির্বাচন বিষয়ক কর্মসূচির সঙ্গে এই দাবির কোনো মৌলিক বিরোধ নাই। অপরদিকে বামপন্থী কমিউনিস্টদের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ এই প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতির বিপরীতে আলাদা কোনো কর্মসূচি হাজির করেনি।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংগ্রাম বিষয়ক গুরুতর তত্ত্বগত বিভ্রান্তির কারণে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতির বিপরীতে মেহনতি জনগণের স্বার্থ রক্ষক তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হাজির করা সম্ভব হয়নি। বুর্জোয়াদের প্রতিক্রিয়াশীল অন্তবর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতির বিপরীতে মেহনতিদের কী ধরণের কর্মসূচি হবে, সে সম্পর্কে বাংলাদেশে ক্রিয়াশীল কমিউনিস্ট ও বামপন্থী গ্রুপ সমূহের চিন্তাভাবনা ও অবস্থান মেহনতিদের স্বার্থের রাজনীতি বিকাশের সহায়ক নয়।
বুর্জোয়া রাজনৈতিক দলগুলো এসব দাবি উত্থাপন করলেই বর্তমান সরকার যে মেনে নেবে তা ভাবা বোকার স্বর্গে বাস করার শামিল। তবে ছাড় দিয়ে কিংবা আপোষ ফমুর্লায় নির্বাচনে গেলে সেটা ভিন্ন কথা। কিন্তু এসব দাবি প্রতিষ্ঠা করতে চাইলেও গণঅভুত্থান ভিন্ন পথ নাই। কিন্তু অভুত্থানই যদি করতেই হয়, তাহলে বুর্জোয়া দাবি কেন, মজুরশ্রেণির দাবিই যুক্ত হওয়া দরকার তাদের নিজস্ব রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিতে। পৃথিবীতে মজুরশ্রেণির অংশগ্রহণ ছাড়া অভুত্থান কেন, বড় কোনো আন্দোলই সফল হয়নি। প্রতিটি আন্দোলন অভুত্থানের নেতৃত্ব ও প্রতিনিধি থাকে।
আমাদের মতে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি হল একটি রাজনৈতিক ইস্যু। তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর ও খনিজ সম্পদ রক্ষা, সুন্দরবন রক্ষা, ফুলবাড়ি কয়লা খনি আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন হল অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সাংস্কৃতিক ইস্যু।
রাজনৈতিক আন্দোলন হল ক্ষমতা দখল বিষয়ক। অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলন স্বয়ংক্রিয়ভাবে কখনোই রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপান্তরিত হয় না। বড়জোর সেটা রাজনৈতিক আন্দোলনকে পরিপুষ্ট করতে পারে মাত্র। উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে রাজনৈতিক ইস্যুর চেয়ে অর্থনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক আন্দোলনই বেশি গুরুত্ব পেয়ে আসছে। অথচ হওয়ার কথা তার উল্টোটাই, অর্থাৎ রাজনৈতিক ইস্যুটিই বেশি গুরুত্ব পাওয়ার দাবি রাখে।
আমাদের মতে, প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকার হল বুর্জোয়াদের সমঝোতার সরকার। নির্বাচন কমিশনের সংস্কারের দাবিও হল এই সমঝোতার অংশ। কোনো কমিউনিস্টের পক্ষে এই প্রতিক্রিয়াশীল দাবি উত্থাপিত হওয়া সঙ্গত নয়। অপরদিকে, এই রাজনৈতিক ইস্যুকে ‘বুর্জোয়াদের আভ্যান্তরীণ বিরোধ’ বলে এড়িয়ে গিয়ে বিশুদ্ধ গণঅভ্যুত্থানের কিংবা সশস্ত্র গণঅভ্যুত্থানের স্লোগান তোলার অর্থ হল বিরাজমান রাজনৈতিক ইস্যু থেকে নিজদের দূরে সরিয়ে রাখা, প্রকারন্তরে এটাও একটি তত্ত্বগত বিভ্রান্তি এবং শেষ বিচারে প্রতিক্রিয়াশীল স্লোগান।
আমাদের মতে, বুর্জোয়া প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে তার গুণগত বিপরীত ব্যাপক মেহনতি মানুষের স্বার্থরক্ষক একটি রাজনৈতিক কর্মসূচি হাজির করা দরকার। সেই কর্মসূচিকে কেন্দ্র করেই মেহনতি শ্রেণির রাজনীতি বিকশিত হতে পারে।
প্রকৃতপক্ষে প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া তত্ত্ববাধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার রাজনীতি হল বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক বিরোধের ফল, এটা শাসক বুর্জোয়া বা সাম্রাজ্যবাদের চক্রান্তের ফলাফল নয়। কমিউনিস্টদের কর্তব্য হল, প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিপরীতে মেহনতিদের স্বার্থ রক্ষক বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠার বক্তব্য হাজির করা। বুর্জোয়াদের সমঝোতার সরকার ও নির্বাচনি সংস্কারের দাবির বিপরীতে মেহনতিদের গণতান্ত্রিক সংবিধান পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের কর্মসূচি হাজির করা।
নতুন গণতান্ত্রিক সংবিধান পরিষদের নির্বাচনের ভিত্তিতে মেহনতি জনগণের, নিপীড়িত নারী সমাজ ও ক্ষুদ্র জাতি সমূহের জনগণের সংগ্রামের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক ও সামাজিক-সংস্কৃতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে মেহনতিদের গণতান্ত্রিক সংবিধান প্রতিষ্ঠা করার কর্মসূচি হাজির করা।
বাংলাদেশের শত্রু জেনারেল ইয়াহিয়া খানের অধীনে পাকিস্তানের ঐক্য সংহতি রক্ষার জন্য লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডিন্যান্স বা এলএফএম অধীনে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত কমিটির দ্বারা প্রণীত হয়েছিল বাহাত্তরের সংবিধান। ওই সংবিধানের মূলনীতি, প্রস্তাবনা ও ঘোষণায় মুক্তিযুদ্ধের আলোকিত শব্দমালা সন্নিবেশিত থাকলেও সেখানে বজায় রাখা হয়েছে ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অনুচ্ছেদ সমূহ। বাহাত্তরের সংবিধান বহন করছে উপনিবেশিকতার জঞ্জাল। এই সংবিধান প্রণেতাদের অথরিটি নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। মুক্তিযুদ্ধের ৪৫ বছর পরও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ সম্ভব হলে নিশ্চয়ই এতদিন পরে হলেও বাহাত্তরের সংবিধান প্রণয়ণের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা জরুরি। এছাড়া বাহাত্তরের সংবিধান হল বাংলাদেশের ব্যক্তিমালিকানা ভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখা এবং বুর্জোয়া শাসক শ্রেণির স্বার্থ রক্ষার দলিল।
এই সময়ের কমিউনিস্টদের কর্তব্য হল, বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা হাজির করা। সেই রূপরেখা অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তব্য হল ঃ-
১. অস্থায়ী বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক শিল্প-কারখানা গড়ে তোলা, বন্ধ শিল্প কারখানা চালু করা, সকল বৃহৎ শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, বীমা জাতীয়করণ করা, ভূমি জাতীয়করণ করা, কৃষকের কাজে জমি লিজ প্রদান করা, যৌথ কৃষি সমবায় গঠন, বৃহৎ ব্যবসা-বাণিজ্য জাতীয়কারণ করা।
২. শহরাঞ্চলে ও গ্রামাঞ্চলে সকল প্রাপ্ত বয়স্ক নর-নারীর সঙ্গতিশীল মজুরি প্রদান, অফিসারের বেতন ও মজুরের বেতন ক্রমশ সমান সমান করার পদক্ষেপ গ্রহণ এবং সকল নাগরিকের বাসস্থানের ব্যবস্থা মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ।
৩. তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃব্য হল যুদ্ধাপরাধীদের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা, তাদের ভোটাধিকার বাতিল করা এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। একই সঙ্গে দুর্নীতিবাজ ও জনগণের সম্পদ আত্মসাৎকারী রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, এনজিও লর্ড ও ধর্মীয় পীরদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা। অভিযোগ প্রমাণিত হলে শাস্তির পাশাপাশি তাদের যাবতীয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ভোটাধিকার বাতিল করা এবং নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা।
৪. বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃব্য হল,ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ, নারীপুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা, সকল জাতি ও ভাষার সম অধিকার প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্যবাদের সকল পুঁজি বাজেয়াপ্ত করা, সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে অসম চুক্তি বাতিল করা। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ গ্রহণ। এছাড়া কোরবানীর চামড়া, ফেৎরা ও ধর্মীয় অনুদানের টাকা জমা রাখার জন্য জাকাত ফান্ড গঠন করবে। সেই অর্থ ভিক্ষুক, পতিতা, হিজড়া ও নদী ভাঙ্গনে সর্বশান্ত হওয়া মানুষদের পুনর্বাসন ও কর্মসংস্থানে ব্যয় করার পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।
৫. বাহাত্তর থেকে এ পর্যন্ত বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ড ও গুমের ঘটনায় শ্বেতপত্র প্রকাশ করা ও তার বিচারকাজ সম্পন্ন করা।
৬. স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে অংশ গ্রহণকারী সকল শ্রেণি-পেশার দাবিদাওয়া সমূহ, যেমন সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ১০ দফা, শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ৫ দফা, ১৭টি কৃষক সংগঠনের ১১ দফাসহ তেলগ্যস বিদ্যুৎ বন্দর খনিজ সম্পদ রক্ষার আন্দোলন, ফুলবাড়ির কয়লা খানির আন্দোলন, সুন্দরবন রক্ষার আন্দোলন, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন, কোটাসংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক আন্দোলনে উত্থাপিত দাবি সমূহ বাস্তবায়নের সুনিদ্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ।
৭. ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত সকল গোপন চুক্তি প্রকাশ করা, অমর্যাদাকর ও অসম চুক্তি বাতিল করা, অভিন্ন নদীর পানির হিস্যার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের শরান্নপন্ন হওয়া, সীমান্ত হত্যা ও চোরাচালান বন্ধে সুনিদ্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কর্তৃব্য হল, এসব দাবি সমূহ বাস্তবায়ন করা এবং দেশিয় শাসক শ্রেণি, সাম্রাজ্যবাদ,ভারতীয় আধিপত্যবাদ, ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তি ধ্বংস করে দেওয়া। একই সঙ্গে দুর্বৃত্ত শ্রেণির মূলোৎপাটন করেই নির্বাচনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বিদ্যমান বুর্জোয়া স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদে যে আন্দোলনের সংস্থা গড়ে উঠবে, সেই সংস্থার প্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত হতে পারে বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার। সেই সরকারের অধীনেই কেবল গণতান্ত্রিক নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকার কর্তৃক ব্যাপক মেহনতি জনগণের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক সামাজিক সাংস্কৃতিক কর্মসূচিগুলো বাস্তবায়নের পর গণতান্ত্রিক নির্বাচনের অধীনে সংবিধান সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে। নির্বাচিত পরিষদ উল্ল্যেখিত কর্মসূচির ভিত্তিতে ব্যাপক মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষক সংবিধান প্রণয়ন করবে। সংবিধান প্রণয়নের পর সংবিধান পরিষদ একটি গণসংসদ গঠন করবে। গণসংসদ উচ্চকক্ষে বিভিন্ন পেশাজীবী সহ প্রবাসীদের নির্বাচিত প্রতিনিধির বিধান রাখবে।
মেহনতিদের গণসংসদ বিপ্লবী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পদক্ষেপ সমূহ এগিয়ে নেবে, সকল নাগরিকের জন্য বিনামূল্যে কিংবা নাম মাত্র মূল্যে স্বাস্থাসেবা, শিক্ষা, খাদ্য, বাসস্থান, কাজের অধিকার ও বিনোদনের ব্যবস্থা নিশ্চিত করবে। একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসেবে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রায় নেতৃত্ব দেবে, একই সঙ্গে সারাবিশ্বের মেহনতি নরনারী ও নিপীড়িত জাতিসমূহের লড়াইয়ের সঙ্গে ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠাা করবে। একটি নতুন বাংলাদেশে মাথা তুলে দাঁড়াবে।