লিখেছেনঃ হাবিবুর রহমান, আপডেটঃ October 18, 2018, 12:00 AM, Hits: 2791
বাংলাদেশে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭৩ সালে। তখন থেকেই বাংলাদেশের নির্বাচনগুলো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আসছে (তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো ব্যতীত, বিরোধী দল নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেয়নি এবং কারচুপির অভিযোগ তুলেছে)। যেমন নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষ থাকে না। স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় না। নির্বাচনের ফলাফলে কালো টাকা ও পেশী শক্তির প্রভাব থাকে। আমলাতন্ত্র ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করে। এটা প্রণিধান যোগ্য, এদেশে ক্ষমতাসীন দলের অধীনে নির্বাচনে কখনোই ক্ষমতাসীন দল পরাজিত হয় নাই। মোদ্দা কথা, এখানে নির্বাচনী ফলাফলে জনগণের মতামত প্রতিফলিত হতে পারে না। তবে মতামত প্রতিফলিত না হওয়ার দুটো দিক রয়েছে। প্রথমত নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতার দিক, ক্ষমতা চর্চার দিক। যেমন নির্বাচন কমিশন কালো টাকা, পেশী শক্তি ও কারচুপি মুক্ত নির্বাচন আয়োজনে যথেষ্ট সক্ষম নয় এবং সরকারের হস্তক্ষেপের কারণে নিরপেক্ষ থাকতে পারে না। এ যাবত বাংলাদেশে যতগুলো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে তার মধ্যে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনের নির্বাচন যতটা স্বচ্ছ নির্বাচন হিসেবে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে, দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো সেরকম স্বীকৃতি পায় নি। দ্বিতীয় হল নির্বাচনের পদ্ধতিগত দিক বা electoral system যার আলোচনা খুব একটা হয় নি। এ বিষয়টি সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের গোচরে আসেনি। এ নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে, তাই প্রথম বিষয় এখানে আলোচনা করা হচ্ছে না।
আধুনিক বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের নির্বাচন পদ্ধতি চালু রয়েছে। প্রতিটি নির্বাচন পদ্ধতি আবার বৈচিত্র্যে ভরা। দেশে দেশে একই পদ্ধতির ভিন্ন বৈশিষ্ট্য বিদ্যমান। সংখ্যার বিচারে নির্বাচন পদ্ধতিকে প্রধান তিন ভাগে ভাগ করা যায়, যথাঃ ১. নির্বাচনী এলাকা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচন, ২. সংখ্যানুপাতিক বা দলকেন্দ্রিক নির্বাচন ও ৩. মিশ্র পদ্ধতির নির্বাচন। এখানে শুধুমাত্র পপুলার ভোটে তথা জনগণের সরাসরি ভোটে সংসদ নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
১. নির্বাচনী এলাকা বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচন ব্যবস্থা – এই ব্যবস্থায় রাষ্ট্রকে নির্দিষ্ট সংখ্যক নির্বাচনী আসন এলাকায় বিভক্ত করা হয়। প্রার্থীরা একটি নির্দিষ্ট আসনের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে থাকেন। নির্দিষ্ট আসনের নির্বাচকমণ্ডলী ঐ আসন থেকে সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থী তথা একজন ব্যক্তিকে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করে থাকে। অর্থাৎ এটি ব্যক্তি নির্বাচন করার ব্যবস্থা। এলাকাভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হল সংসদে সকল নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব থাকে না। অর্থাৎ অন্য প্রার্থীদের পক্ষে ভোট প্রদানকারী নাগরিকদের রাষ্ট্রপরিচালনায় (প্রতিনিধির মাধ্যমে) অংশগ্রহণ থাকে না।
আসনভিত্তিক প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থাকে আবার প্রধান দুইভাগে ভাগ করা যায়, এক – Plurality system, দুই– Majoritarian system.
Plurality system বা First Past the Post পদ্ধতি - এই ভোট ব্যবস্থায় একটি আসনের প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীদের মধ্যে যিনি সবচেয়ে বেশি ভোট পাবেন, অর্থাৎ যিনি এগিয়ে থাকেন তিনি ঐ আসনের জন্য নির্বাচিত ঘোষিত হন। যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও বাংলাদেশসহ পৃথিবীর ৫৮টি রাষ্ট্রে এইধরনের নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটাভুটি হয়ে থাকে। এর বেশিরভাগ রাষ্ট্রই একসময় ব্রিটিশ বা আমেরিকান উপনিবেশ ছিল।
Plurality system বা First Past the Post পদ্ধতিতে প্রতিনিধি নির্বাচন ব্যবস্থার বড় দুর্বলতা হল সংসদে সকল নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব থাকে না। এমন কি প্রায়শই সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের প্রতিনিধিত্বও থাকে না। এতে তিন বা ততোধিক প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে একজন প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের ৫০% শতাংশের বেশি ভোট তথা সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় না পেয়েও নির্বাচিত হয়ে থাকেন। ধরা যাক মোট প্রদত্ত ভোট ১০০। তিনজন প্রার্থী নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। এদের মধ্যে প্রথমজন পেলেন ৪০ ভোট, দ্বিতীয় জন পেলেন ৩৫ ভোট এবং তৃতীয়জন পেলেন ২৫ ভোট। এক্ষেত্রে যিনি সর্বাধিক সংখ্যক অর্থাৎ ৪০ ভোট পেয়েছেন তিনি বিজয়ী হন। এর মানে ঐ আসনের সংখ্যালঘিষ্ঠ ভোটারের (৪০%) রায়ে তিনি নির্বাচিত হলেন। কেননা, বাকি দুইজনের প্রাপ্ত মোট ভোট হল ৬০ (৩৫+২৫) যা বিজয়ী প্রার্থীর থেকে অনেক বেশি। একইভাবে এই ব্যবস্থায়, মোট প্রদত্ত ভোটের অর্ধেকেরও কম ভোটে তথা সংখ্যালঘিষ্ঠ নাগরিকের রায়ে সরকার গঠিত হতে পারে। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।
বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে। সবচেয়ে কম বিতর্কিত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নির্বাচনের একটি হল ১৯৯১ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়ে সরকার গড়ে বিএনপি। তারা আসন পায় ১৪০টি। অথচ প্রায় ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় ৮৮টি। পাকিস্তানের উদাহরণও ভিন্ন নয়। পাকিস্তানের সর্বশেষ নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ভাবে বিতর্ক নেই। এই নির্বাচনে ইমরান খানের পিটিআই ভোট পেয়েছে ৩২ শতাংশ। কিন্তু তারা আসনের ৪৩ ভাগ অর্থাৎ ১১৬টি আসন পেয়েছে। অন্যদিকে প্রতিদ্বন্দ্বী পিপিপি ও মুসলিম লীগ পিটিআইয়ের চেয়ে ৬ ভাগ বেশি ভোট পেলেও ৯টি আসন কম পেয়েছে। হিসাবে দেখা যায়, প্রতি ১০ জন ভোটারের মধ্যে ৪ জনেরও কম ইমরানের প্রার্থীদের পছন্দ করেছে। অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটার পিটিআই বিরোধীদের ভোট দিয়েছে। অর্থাৎ ইমরানের সরকার সংখ্যালঘিষ্ঠ নাগরিক সমর্থিত সরকার। পৃথিবীর সর্ববৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশের দাবীদার ভারতও এর ব্যতিক্রম নয়। সর্বশেষ লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি ৩১ শতাংশ ভোট পেয়ে সরকার গড়েছে। অনেকগুলো দল নিয়ে তাদের যে জোট সেটা ভোট পেয়েছে মোট ৩৮.৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রায় ৬২ ভাগ ভোটার তাদের বিপক্ষে ছিল। এসব তথ্য থেকে আমরা দেখতে পাই, এ ব্যবস্থায় জনমতের প্রকৃত প্রতিফলন নাও ঘটতে পারে, সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় নিয়ে সরকার নাও গঠিত হতে পারে। তেমনি এই ব্যবস্থায় একটি নির্দিষ্ট আসনের ক্ষেত্রেও প্রকৃত জনমতের এধরনের অন্যায্য প্রতিফলন ঘটতে পারে। অথচ গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতে সরকার গঠন করার কথা।
Majoritarian system – এটিও নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক নির্বাচন ব্যবস্থা এবং একজন ব্যক্তিকে প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়ে থাকে। তবে এই ব্যবস্থায় একজন প্রার্থীকে জয়ী হতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠের রায় নিশ্চিত করতে হয়। প্রথম রাউন্ড নির্বাচনে একটি আসনের কোন প্রার্থী প্রদত্ত ভোটের ৫০ শতাংশের বেশি ভোট না পেলে পুনরায় নির্বাচন সংগঠিত করা হয়। এ ব্যবস্থায়ও বৈচিত্র্য রয়েছে, বিভিন্ন মডেল দেখা যায়। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রথম রাউন্ডএ সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া ২ জন প্রার্থীকে দ্বিতীয় রাউন্ডএ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার সুযোগ দেয়া হয়। অর্থাৎ দ্বিতীয় বারেই ফয়সালা হয়ে যায়। ২০ টি রাষ্ট্রে এ ধরনের ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এ ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতে প্রার্থী নির্বাচিত ও সরকার গঠন করা সম্ভব হয়। তবে এ ব্যবস্থায় সংসদে সকল নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয় না।
২. সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা – এই ব্যবস্থায় কোন দল নির্বাচনে কত শতাংশ ভোট পেল, তার ভিত্তিতে সংসদে তার আসন ও অবস্থান নির্ধারিত হয়। নির্বাচকমণ্ডলী কোন ব্যক্তিকে নয়, দলকে ভোট প্রদান করে থাকে। তাই এ পদ্ধতিতে ব্যক্তি বিশেষ নয়, দলকেই নির্বাচনে অংশ নিতে হয়। সারাদেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায় আনুপাতিক হারে পার্লামেন্টে সে পরিমাণ আসন সে দলের হিসসায় যায়। অন্ততপক্ষে একটি আসন পেতে যে পরিমাণ ভোটের প্রয়োজন হয় সে পরিমাণ ভোট না পেলে ঐ দলকে আসন বণ্টনের প্রক্রিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করা হয় না। এভাবে আসন বণ্টনের পর যে দল সবচেয়ে বেশি সংখ্যক আসন পায় সে দলকে সরকার গঠনের অনুরোধ জানানো হয়। দ্বিতীয় বৃহত্তম আসন সংখ্যার অধিকারী দল সংসদে প্রধান বিরোধী দলের মর্যাদা লাভ করে। তবে সরকার গঠন করতে সর্বাধিক সংখ্যক আসন প্রাপ্ত দলকে কমপক্ষে ৫১% আসন লাভ করতে হয়। এমন সংখ্যক আসন না পেলে সর্বাধিক সংখ্যক আসন প্রাপ্ত দলকে নিকটতম সমমনাদের সাথে কোয়ালিশন বা জোট করে সরকার গঠন করতে হয়। নির্বাচনের আগে প্রত্যাশিত দলকে গলাবদ্ধ খামে তাদের মনোনীত বা বাছাই করা ব্যক্তিদের তালিকা নির্বাচন কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দিতে হয়। অবশ্য কোন কোন দেশে তালিকা প্রকাশ্য থাকে। নির্বাচনে একটি দল যতসংখ্যক আসন লাভ করে, ঐ দলের তালিকার প্রথম থেকে ক্রম অনুসারে ততসংখ্যক ব্যক্তিকে সদস্য হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ পদ্ধতিও দুইভাবে বাস্তবায়িত হতে দেখা যায়। এক. পুরো দেশকে একক ইউনিট হিসাবে ধরে সংসদ সদস্য নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। সারাদেশের গণনায় একটি দল যে সংখ্যক ভোট পায় আনুপাতিক হারে পার্লামেন্টে সে পরিমাণ আসন সে দলের হিসসায় যায়। দুই. সারা দেশকে কতগুলো বৃহৎ নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত করা হয়। প্রতিটি এলাকায় প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলো স্বতন্ত্রভাবে ঐ এলাকার জন্য প্রার্থীর তালিকা ঠিক করে থাকে। ঐ এলাকার ভোট গণনায় যে দল যে সংখ্যক ভোট পায় আনুপাতিক হারে পার্লামেন্টে সে পরিমাণ আসন সে দলের হিসসায় যায়। সকল এলাকার প্রার্থী যোগ করে একটি দলের মোট প্রার্থী সংখ্যা নির্ধারিত হয়। আমাদের পাশের দেশ শ্রীলংকায় এধরনের সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা চালু রয়েছে। শ্রীলংকার মডেলে প্রত্যেক নির্বাচনী জেলায় থাকে একাধিক সদস্য বাছাইয়ের সুযোগ। কোন জেলায় কতজন সংসদ সদস্য থাকবে সেটা নির্ধারণ করা আছে। জনসংখ্যা অনুপাতে সংসদ সদস্য ৪ থেকে ১৯ জন পর্যন্ত হয়ে থাকে। অবশ্য সর্বোচ্চ প্রতিনিধিত্বের লক্ষ্যে শ্রীলংকার জাতীয় নির্বাচনে দুই স্তরের আনুপাতিক ভোটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। মোট ২২৫ জন সদস্যের মধ্যে ১৯৬ জন ২২টি নির্বাচনী জেলা থেকে নির্বাচিত হন। বাকি ২৯ আসন সারা দেশে প্রাপ্ত ভোটের আনুপাতিক হারে দলগুলোর মধ্যে বণ্টন করে দেয়া হয়। জার্মানি, রাশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা, সুইডেন, নেদারল্যান্ডসসহ ৮৯ দেশে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচন পরিচালিত হচ্ছে। এরমধ্যে ৮০টি দেশে তালিকাভিত্তিক সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থা বিদ্যমান।
৩. মিশ্র পদ্ধতি – এতে সংসদ সদস্যদের একাংশ নির্বাচনী এলাকা বা ব্যক্তিভিত্তিক, অপরাংশ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থায় নির্বাচিত হয়ে থাকে। এক্ষেত্রে ভোটারদের একইসাথে দুটি ভোট প্রদান করতে হয়। ভোটার এক ভোট দেয় নির্বাচনী এলাকার প্রার্থীকে, এক ভোট দেয় দলকে। এলাকাভিত্তিক প্রাপ্ত আসন এবং আনুপাতিক হারে প্রাপ্ত আসন মিলে একটি দলের প্রাপ্ত মোট আসন সংখ্যা নির্ধারিত হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন প্রাপ্ত দল সরকার গঠন করে। বর্তমানে পৃথিবীর ৩৪টি দেশে মিশ্র পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আমাদের পাশের দেশ নেপালে এমন ব্যবস্থা চালু আছে। নেপালের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ‘প্রতিনিধি সভা’র ২৭৫ সদস্যের মধ্যে ১৬৫জন ১৬৫টি নির্বাচনী এলাকা থেকে বাংলাদেশের মতই নির্বাচিত হয়ে থাকে। এসময় পুরো দেশকে একটি আসন ধরে দলগুলোর নামেও ভোট হয়। দলগুলোর ভোটের হিস্যা থেকে আনুপাতিক হারে প্রতিনিধি সভার বাকি ১১০ জন নির্বাচিত হয়। এভাবেই গঠিত হয় ২৭৫ আসনের প্রতিনিধি সভা যেখানে প্রত্যেক দলকে এক তৃতীয়াংশ নারী আসন দ্বারা পূরণ করতে হয়। আবার বিভিন্ন জন জাতির প্রতিনিধিত্বও নিশ্চিত করতে হয়।
বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতি – বাংলাদেশে ৩৩০ সদস্যের এককক্ষ বিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত আছে। এর মধ্যে ৩০০ আসন সরাসরি জনগণের ভোটে নির্বাচিত এবং ৩০টি সংরক্ষিত নারী আসন। এখানে Plurality system বা First Past the Post পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। এদেশে তত্ত্বগতভাবে প্রতিষ্ঠিত যে নির্বাচন হচ্ছে এমন একটি প্রক্রিয়া যেখানে ভোটের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতে কোন প্রার্থীকে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়। স্বভাবতই এটাও প্রতিষ্ঠিত যে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মতামতে সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রকৃত সত্য হল, এ ব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের রায়ে একজন প্রার্থী নির্বাচিত হবে বা সরকার গঠিত হবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। উপরে এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের নির্বাচনগুলো পর্যালোচনা করলে এ চিত্রই বেরিয়ে আসে। বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর স্বচ্ছতা নিয়ে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রশ্ন ও বিতর্ক রয়েছে। সবচেয়ে কম বিতর্কিত ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত তত্তাবধায়ক সরকারের অধীনস্থ তিনটি নির্বাচন। এগুলো হল যথাক্রমে ১৯৯১, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের ৩১ শতাংশ পেয়ে সরকার গড়ে বিএনপি। তারা আসন পায় ১৪০টি। অথচ প্রায় ৩২ শতাংশ ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় ৮৮টি। যদি ভোটের অনুপাতে আসন বণ্টন করা হতো তাহলে বিএনপি আসন পেত ৯৩টি, আওয়ামী লীগ পেত ৯৬টি। ১ শতাংশ বেশি ভোট পাওয়ার পরেও আওয়ামী লীগ বিএনপির চেয়ে ৫২টি আসন কম পেয়েছিল। তেমনি ২০০১ সালের নির্বাচনের ফলাফলের দিকে নজর দিলে দেখা যায় যে ৪০.২১% ভোটে পেয়ে আওয়ামী লীগ আসন পায় মাত্র ৬২টি বা ২১% আসন। আর বিএনপি-জামায়াত জোট ৪৫.১৫% ভোটে পেয়ে আসন পেয়েছে ২০৮টি অর্থাৎ ৬৯%। এই নির্বাচনে মাত্র ৪.৯৪% বেশি ভোট পেয়ে আওয়ামী লীগের প্রাপ্ত আসনের চেয়ে ১৪৬টি বেশি অর্থাৎ ২৩৫% বেশি আসন পায় বিএনপি-জামায়াত জোট। এসময় বিএনপি এককভাবে ভোট পেয়েছিল ৪১ শতাংশ এবং আসন পায় ১৯৩টি। ১ শতাংশেরও কম ভোট পেয়েও বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগ ১৩১টি আসন কম পায়।
আবার ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩৭.৪% ভোট পেয়েছিল, আর আসনের সংখ্যা ছিল ১৪৬টি। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.৬% ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল ১১৬টি। ভোটের ব্যবধান ৩.৮%। কিন্তু আওয়ামী লীগ বিএনপি থেকে ৩০টি আসন বেশি লাভ করে। তেমনি ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৪৯% ভোট পেয়েছিল, তার প্রাপ্ত আসন সংখ্যা ছিল ২৩০টি। অন্যদিকে বিএনপি পেয়েছিল ৩৩.২% ভোট, আর আসন সংখ্যা ছিল মাত্র ৩০টি। ভোটের ব্যবধান প্রায় ১৬%। অথচ আসনের ব্যবধান ২০০টি।
বিদ্যমান নির্বাচন ব্যবস্থায় ছোট দলগুলোর ক্ষেত্রে এইরূপ বঞ্চনা আরও মারাত্মক। যেমন ২০০১ সালের নির্বাচনে মোট প্রদত্ত ভোটের ৪.২৯ শতাংশ ভোট পেয়ে জামায়াত ১৭টি আসন পায়। কিন্তু জাতীয় পার্টি ৭.২৬ শতাংশ ভোট পেয়েও আসন লাভ করে ১৪টি। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ঐ নির্বাচনে জাতীয় পার্টি আসন পেত ২২টি। ২০০১ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী আরেক ছোট দল সিপিবি ১ লক্ষ ১৯ হাজার ভোট পেয়ে কোন আসন লাভ করেনি। সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে সিপিবি ১টি আসন লাভ করতে পারত। ভোটের আনুপাতিক হারে আসন দেয়া হলে অন্যান্য ছোট দলগুলোরও আসন পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। অবশ্য সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে নির্বাচন হলে ছোট দলগুলো আরও বেশি ভোট পাবে। কেননা প্রার্থী না থাকার কারণে অনেক আসনেই তাদের সমর্থকদের ভোট বড় দলগুলো পেয়ে থাকে।
তাই বর্তমান সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটের যে সংজ্ঞা দেয়া হয়েছে তার মধ্যে বড় ধরনের একটি ভাওতাবাজি রয়েছে। আসলে সংখ্যাগরিষ্ঠ তখনই বলা যাবে যখন ১০০ জনের মধ্যে অন্তত ৫১ জন কারো পক্ষে থাকবে বা সমর্থন করবে। তেমনি প্রদত্ত ভোট ১০০% ধরে সরকার গঠনে কমপক্ষে ৫১% ভোট পেতে হবে, উপরের বিশ্লেষণে দেখা গেল সরকার গঠন করা দলগুলো এই পরিমাণ ভোট পায় নি। ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার নামে প্রতারণা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আমাদের মতো দেশে ব্যক্তিভিত্তিক নির্বাচনের আরেকটি কুফল হল, দলের কর্মসূচি নয়, নির্বাচনী মেনিফেস্ট নয়, উন্নয়ন কাজের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ভোটারদের আকৃষ্ট করা হয়। জেতার জন্য প্রার্থী সবধরনের অপকর্ম করতে দ্বিধাবোধ করে না। তাই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানে কালো টাকা ও পেশী শক্তি মুক্ত নির্বাচন একটি জাতীয় দাবী হয়ে আছে।
আমাদের জনগণের মনে ভোট নষ্ট হয়ে বা পচে যাওয়ার একটি ধারণা বিরাজ করছে। তারা মনে করে, যে প্রার্থী জিতবে না, তাকে ভোট প্রদান মানে ভোট নষ্ট করা। এ ধারণা থেকে তারা সম্ভাব্য বিজয়ী প্রার্থীকে ভোট দিয়ে থাকে।
সংঘাত এদেশের রাজনীতির বিশেষ দিক যার শুরু স্বাধীনতার পর থেকেই। নির্বাচনী সংঘাত দিন দিন বেড়ে চলেছে। ব্যক্তিকেন্দ্রিক নির্বাচনে জয়-পরাজয় একমাত্র বিষয় হয়ে দাঁড়ায় যা বৈরী সম্পর্ক গড়ে তুলতে সাহায্য করে।
বিদ্যমান ব্যবস্থায় পোড় খাওয়া রাজনীতিবিদ নয়, দুর্নীতিপরায়ণ আমলা–ব্যবসায়ীরা টাকার জোরে দলের নমিনেশন পেয়ে যায় এবং সংসদ সদস্য হয়ে যায়।
জনগণের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলনে সংসদ ও সরকার গঠনে নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার সময়ের দাবী হয়ে উঠেছে। অনেক ছোট দল, রাজনৈতিক গ্রুপ এবং ব্যক্তি বিকল্প হিসেবে সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতির প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এ পদ্ধতির ইতিবাচক দিকগুলো নিম্নরূপঃ প্রথমত, সংখ্যানুপাতিক পদ্ধতিতে সকল ভোটের মূল্যায়ন হয়, তাই ভোট পচা বা নষ্ট হবার চিন্তা থাকবে না। ভোটারগণ দলের কর্মসূচি বুঝে ভোট দানে উৎসাহী হবেন। ফলে রাজনীতি হবে কর্মসূচি কেন্দ্রিক। দ্বিতীয়ত, এ পদ্ধতিতে সকল নাগরিকের ভোটের মূল্যায়ন হয়, দলগুলো আনুপাতিক হারে আসন লাভ করে এবং ব্যক্তির জয়-পরাজয় মুখ্য থাকে না। ফলে সংঘাত, রেষারেষি থাকবে না বা কমে যাবে। তৃতীয়ত, জনমতের মতামতের প্রকৃত প্রতিফলন ও মূল্যায়ন ঘটে। তাই নেতৃত্ব ও রাজনৈতিক দলগুলোর জনমত ও জনগণের প্রতি অধিক দায়বদ্ধতা তৈরি হয়। চতুর্থত, ছোট ছোট দল নির্বাচনে আসন লাভের সম্ভাবনা বেশি থাকে। পঞ্চমত, সংসদ সদস্যদের কাজ আইন প্রণয়ন, উন্নয়ন কাজ নয়। সংখ্যানুপাতিক নির্বাচনে এলাকার উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দেয়ার সুযোগ কমে যায়, তাই সাংসদগণের আইন প্রণয়নকে মুখ্য কাজ হিসেবে বেছে নেয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। ষষ্ঠত, ব্যক্তি, নেতা ও পরিবারকেন্দ্রিক রাজনীতির বিপরীতে যৌথ নেতৃত্বের চর্চা ও গুরুত্ব বাড়বে। সপ্তমত, আইনসভায় সকল ভোটারের প্রতিনিধিত্ব থাকে। ফলে কেউ হারে না, সবাই বিজয়ী হয়।
বিশেষ দ্রষ্টব্যঃ বাংলাদেশের সংবিধানে একজনের হাতে রাষ্ট্রক্ষমতা অর্পণ করা আছে। এই ক্ষমতা কাঠামো অক্ষুণ্ন রেখে কোন প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার থেকে ইতিবাচক ফলাফল আশা করা দুরূহ।