লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ December 18, 2018, 12:00 AM, Hits: 1194
আজকের লেখার বিষয়বস্তু সম্পর্কে প্রথমেই একটু ধারণা দিয়ে রাখা উচিত হবে। ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে একটি গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযু্ক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় আমাকে গ্রেফতার করে জেলে নেয়। সেই অভিজ্ঞতার আলোয় আজকের এই লেখা। এখন লেখার শিরোনামের তাৎপর্য স্পষ্ট করার জন্য একটু অতীতে ফিরি।
আমার ছেলেবেলায় তখনও প্রায় সারাদেশ গ্রাম ছাড়া আর কিছু ছিল না। খুব ছেলেবেলায় ঢাকা শহর দেখি নাই। কিন্তু মফস্বল শহর হিসাবে যেগুলিকে দেখতাম সেগুলিও তখন সামান্য কিছু সংখ্যক পাকাবাড়ী বা দালান সম্বলিত গঞ্জ বা গ্রাম ছাড়া আর তেমন কিছু ছিল না। এই রকম গ্রাম দেশে আমজনতার সাহিত্য চর্চার প্রধান মাধ্যম ছিল পুঁথি সাহিত্য।
হাট-বাজারে রাস্তার ধারে সুর করে পুঁথি বিক্রেতারা সেই সব পুঁথির কোন কোনটি থেকে পড়ে শুনাত। মানুষ ভিড় জমিয়ে সেসব শুনত এবং পছন্দমত বই বা পুঁথি কিনে নিয়ে যেত। স্কুলে যাতায়াতের সময় কিংবা বিকালে হাট-বাজারে বেড়াবার সময় কখনও কখনও সেসব চোখে পড়ত।
কত রকম পুঁথি বাজারে বিক্রী হত। কিছু কিছু নাম এখনও মনে আসে। এই যেমন ছহি বড় খাবনামা। এতে থাকত স্বপ্নের গুণাগুণ বর্ণনা, কী স্বপ্ন দেখলে কী হয় এই রকম আর কী! মনোযোগ দিয়ে পুঁথি যে পড়তাম তা নয়। তবে অস্বীকার করব না, একেবারে কৌতূহল যে ছিল না তা নয়। আর একটা বইয়ের তখন খুব কদর ছিল। নাম ইউসুফ-জোলেখার প্রেম কাহিনী বা এই ধরনের কিছু। একটু বড় হয়ে পুঁথি সাহিত্যে নয় তবে আধুনিক সাহিত্যে কাহিনীটা পড়েছিলাম। কাহিনীটা বাঙ্গালী মুসলমান পাঠকদের অনেকেরই জানবার কথা। সে কালের মুসলমানদের নিকট নবী ইউসুফ এবং জোলেখার প্রেম কাহিনী বেশ আকর্ষণীয় বিষয় ছিল।
আমি বিভিন্ন বিষয়ে মোটামুটি পড়তাম। তবে পুঁথি সাহিত্যের প্রতি ততটা আকর্ষণ বোধ করতাম না। ভাল লাগলে কিংবা কৌতূহল কিংবা কৌতুক অনুভব করলেও কখনও কিছু পড়তাম। কিছু পঙ্ক্তি এখনও স্মরণ করি। এই যেমন, ‘এইসা জোরে তেগ মারে, কাটিয়া দু’খান করে, গিরিয়া পড়িল মর্দ জমিনের পর।’ কিংবা কবির কল্পনা শক্তি এবং রসবোধের তারিফ করতে হয় যখন তিনি বলেন, ‘লাখে লাখে সৈন্য মরে কাতারে কাতার, শুমার করিয়া দেখে চল্লিশ হাজার।’
পুঁথি লিখার বিষয়ও ছিল বিচিত্র। সাম্প্রতিক যে সব ঘটনা জনমনে নাড়া দিত কিংবা খুব আদি রসাত্মক হত সে ধরনের ঘটনা নিয়েও পুঁথি লিখা এবং পাঠ হত। মোট কথা ওটা ছিল বেশ খানিকটা পুঁথি সাহিত্যের আধিপত্যের যুগ।
সেটা ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অল্প কাল পরের কথা। তার পর থেকে এ বঙ্গের বাঙ্গালী তথা বাঙ্গালী মুসলমান অনেক এগিয়েছে। শিক্ষায়, সম্পদে। এক সময় বাঙ্গালী মুসলমানদের হাতে একটা রাষ্ট্রও এসেছে। গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। সুতরাং সাহিত্য, সংস্কৃতিতেও অনেক এগোবার কথা।
এখনও হয়ত প্রান্তিক জনসমাজের কিছু মানুষের মনের চাহিদা মিটানোর জন্য ছাপা এবং বিক্রীও হয় ছহি বড় খাবনামা কিংবা ইউসুফ-জোলেখা প্রেমকাহিনী মার্কা পুঁথি বা বইপত্র। আমার ঠিক জানা নাই। তবে আমার চোখে পড়ে না অনেক কাল। তবে পাঠকরাও তো আর সে কালে পড়ে থাকে নাই। ছহি বড় খাবনামা কিংবা ইউসুফ-জোলেখার জায়গা নিয়েছে আরও উন্নত পর্যায়ের বা আধুনিক কালের শিক্ষা-সংস্কৃতি-রুচির সঙ্গে কিছুটা হলেও তাল মিলিয়ে লিখা কবিতা, গল্প, উপন্যাস।
তবে আম-পাঠকদের রুচি এখনও ছহি বড় খাবনামা কিংবা ইউসুফ-জোলেখার পাঠক পর্যায় থেকে খুব একটা এগোয় নাই বলেই মনে হয়। অবশ্য সময় খুব বড় ফ্যাক্টর। সুতরাং এখন এসেছে আধুনিক নগর জীবনের জটিল বিন্যাসের প্রতিফলন হিসাবে গল্প, উপন্যাস। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অগ্রগতির এই যুগে রাক্ষস-খোক্কস কিংবা রাজপুত্র-রাজকন্যারা অনেকটাই অচল। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তাদের জায়গা নিয়েছে সায়েন্স ফিকশন। কবিতাও এখন আর পুঁথি সাহিত্যের জায়গায় পড়ে নাই। কবিতায় সম্ভবত বাংলাদেশ অনেকটা এগিয়েছে। তবে গল্প-উপন্যাসের ক্ষেত্রে কতটা এগিয়েছে তা বলা কঠিন। এখানকার সাম্প্রতিক কালের অনেক বিখ্যাত কিংবা জনপ্রিয় লেখকের বই পড়ার পর অনেক দিন ধরে আমি গল্প-উপন্যাস পড়া প্রায় বন্ধ করে দিই। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর লাল সালু এখন যেন ইতিহাসের বিষয়বস্তু। এমন কি শক্তিশালী লেখক আহমদ ছফাও বাজার চাহিদা কতটা পূরণ করতে পেরেছেন তা বলা কঠিন।
বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ সাহিত্য চর্চায় যে এখনও অনেক পিছিয়ে সে কথা না বললেও চলে। তার পাঠক যেমন তার লেখকও যে তেমন হবে সেটাই স্বাভাবিক। এখন সাহিত্য বলা যাক আর জ্ঞান বলা যাক সেই জগতের রথীরা যে এই বাস্তবতার সঙ্গে তাল মিলিযে রথযাত্রা করবেন সেটাই স্বাভাবিক। আপত্তিটা সেই জায়গায় নয়। আপত্তিটা সেখানে যেখানে তারা জ্ঞানের জগতে বিচার-বুদ্ধির কাণ্ডারী হবার দাবীদার হন এবং যুক্তিনিষ্ঠ, উন্নত ও স্বাধীন চিন্তার বিরুদ্ধে মোল্লা ও সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পুলিশ ও বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।
আমি এ কথা বলি না যে সাহিত্যিকদের বা সাহিত্যের মূল্য নাই। বরং তার মূল্য অপরিমেয়। আমাদের কল্পনার জগৎ কে প্রসারিত বা সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে গল্প-উপন্যাস-কবিতার ভূমিকা বিরাট। এগুলির পাঠ আমাদের অনেক বোধকে উন্নত করে। বিশেষত সাহিত্য আমাদেরকে মানবিক হতেও শিখায়। অবশ্য সে ধরনের সাহিত্যও হতে হয়। এখন ছহি বড় খাবনামা কিংবা ইউসুফ-জোলেখার সঙ্গে যদি লা মিজারেবল কিংবা লাঞ্ছিত-বঞ্চিত বা ওয়ার এন্ড পিসকে মিশিয়ে খিচুড়ি পাকানো হয় তবে নিদারুণ ভুল হবে। তবে আমাদের সমাজ ওয়ার এন্ড পিস দূরের কথা পদ্মা নদীর মাঝি বা পথের পাঁচালি থেকেও অনেক দূরে পড়ে আছে। এমন কি লাল সালুর পথ থেকেও পা পিছলে তা আরও অনেক দূর অতীতে পড়ে আছে। সমাজ আগায় পিছায়। এটা প্রকৃতির নিয়ম। সুতরাং দুঃখ পেলেও মানতে হয়।
পশ্চিম বঙ্গের দিকে তাকালেও বিস্মিত হতে হয়। ঐ বঙ্গ যে এক সময় বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ কিংবা শরৎচন্দ্র, মানিক, বিভূতিভূষণের মত কবি-সাহিত্যিকদের জন্ম দিতে পেরেছিল আজকের পশ্চিম বঙ্গের সাহিত্যের দিকে দৃষ্টি দিলে কি সে কথা বিশ্বাস করা সহজ হয়? অবনতি হয়ত দুই বঙ্গেই। হয়ত কোথায়ও কিছু বেশী, কোথায়ও কিছু কম।
তবে বিশ্বমানের দিকে তাকালে আমার মনে হয় না আমাদের সাহিত্য খুব সমৃদ্ধ। না, আমি বস্তা বস্তা লেখার কথা বলছি না। হুগো, বালজাক, পুশকিন, ডস্টয়েভস্কি, টলস্টয় এদের সাহিত্যকর্মের পাশে বাংলা সাহিত্য কর্মকে দাঁড় করালে হীন বোধ না করলেও অনেক ক্ষেত্রেই খুব গৌরব বোধ করার কারণও আমি দেখি না। তবু এক কালে গর্ব করবার মত অনেক সাহিত্যকর্মই ছিল। এখন সেসবও প্রায় কিছুই নাই। আর গৌরবের সামগ্রী যা আছে তাও তো মূলত ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসনাধীন কালের বঙ্গের সাহিত্যে সীমাবদ্ধ। বুঝা যায় সাহিত্যে যেমন তেমন আমাদের জ্ঞানকাণ্ডেও তার প্রকাশ ঘটেছে। অর্থাৎ চিন্তা-চেতনার জায়গায়।
বিশেষত এই বঙ্গে আসা যাক। আর তখন আমাদের সীমাহীন দরিদ্রদশা দেখতে পাই। যেমন সেটা সাহিত্যে তেমন সেটা বিচার-বুদ্ধি তথা জ্ঞানকাণ্ডের জায়গায়ও। বিচার-বুদ্ধি উন্নত না হলে যে সাহিত্যও উন্নত হয় না তার প্রমাণ আমাদের সাহিত্য। এখন মোটামুটি সাহিত্য জগতে সামান্য কিছু ব্যতিক্রম বাদে আধিপত্য করছেন ছহি বড় খাবনামা কিংবা ইউসুফ-জোলেখার কেচ্ছাকাহিনীর কাছাকাছি পর্যায়ের সাহিত্যের লেখক-বুদ্ধিজীবীগণ। তাতে হয়ত সমস্যা হত না। তারা থাকতেন তাদের সাহিত্য চর্চার জায়গা নিয়ে, তার প্রকাশক এবং পাঠকদের নিয়ে। যারা বুদ্ধিচর্চার বা জ্ঞানকাণ্ডের জায়গায় থাকতে চাইছেন তারা থাকতেন তাদের মত করে।
কিন্তু সমস্যাটা বাধে তখন যখন ছহি বড় খাবনামা কিংবা ইউসুফ-জোলেখার পর্যায় থেকে একটু এগিয়ে কলম ধরা সাহিত্যিকরা জ্ঞানকাণ্ড বা বিচার-বুদ্ধির জায়গারও কাণ্ডারী হতে চান। বলার অধিকার তো সবার আছে। তবে বলার পর তার পরবর্তী ফলাফল নিয়েও চিন্তা করতে হয়। কিন্তু আমাদের আধুনিক ছহিবড় খাবনামা এবং ইউসুফ-জোলেখার লেখক-বুদ্ধিজীবীদের যে সেই বোধটুকুও নাই সেটা মাঝে মাঝে বেশ বুঝা যায়।
জ্ঞানকাণ্ডের জগতে আধুনিক ছহিবড় খাবনামা আর ইউসুফ-জোলেখা মার্কা সাহিত্যের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের এমনই তাণ্ডব দেখলাম ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারীর একুশে বই-মেলার সময়। আমি আমার প্রকাশনী প্রতিষ্ঠান ‘ব-দ্বীপ প্রকাশন’ থেকে ‘ইসলাম বিতর্ক’ নামে ইংরাজী থেকে ইসলাম বিষয়ক বিভিন্ন পণ্ডিতের কয়েকটি প্রবন্ধের বাংলায় অনূদিত একটা সঙ্কলন গ্রন্থ প্রকাশ করেছিলাম। এই গ্রন্থ প্রকাশ এবং বিক্রীর কারণে কয়েকটা ইসলামী সংগঠন ধর্মানুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে আমাকে গ্রেফতার এবং বইটি বাজেয়াপ্তের জন্য সরকারের নিকট দাবী করে এবং কেউ কেউ তার জন্য চরমপত্রও দেয়। সরকার তাতে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দিয়ে ২০১৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারীতে আমাকে গ্রেফতার করে।
এটা আমার কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত হলেও আমি বিস্মিত হই নাই। কারণ ইসলামী জঙ্গীবাদীদের জন্য সেটা স্বাভাবিক আচরণ হতে পারে। ইসলামী রাজনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আওয়ামী লীগ সরকারের আচরণও স্বাভাবিক হতে পারে। বিশেষত লীগ-বিএনপিসহ বিদ্যমান সকল রাজনৈতিক শক্তির সমালোচনায় আমার অনেক লেখা আছে যেগুলির কারণে সরকার তার ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটাবার সুযোগকে হাতছাড়া করতে না চাইতে পারে।
কিন্তু বিস্ময়কর আচরণ হচ্ছে ‘ছহিবড় খাবনামা’ এবং ইউসুফ-জোলেখা মার্কা আধুনিক পুঁথিসাহিত্যের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের প্রতিনিধিত্বকারীদের সেই মুহূর্তের প্রতিক্রিয়া। তারা ‘ইসলাম বিতর্ক’কে একটি অশ্লীল গ্রন্থ হিসাবে অভিহিত করে ফরমান জারী করলেন এবং পাঠকদের গ্রন্থটি না পড়ার জন্য বলে দিলেন। আসলে কি তারা গ্রন্থটির প্রবন্ধগুলি পড়েছিলেন কিংবা তার বিষয়বস্তু জেনেছিলেন? হয়ত জেনেছিলেন আর তাই তাদের এত ক্রোধ।
হ্যাঁ, ধর্মনেতাদের অশ্লীল কাণ্ড নিয়ে কথা বলাও অশ্লীলতা। রাধা-কৃষ্ণের কৃষ্ণ গোপিনীদের স্নানের সময় তাদের বস্ত্র হরণ করলে সেটা অশ্লীল হয় না আর সেই বিষয়টি বললেই সেটা অশ্লীল হয়! চমৎকার বিচার-বুদ্ধি কিংবা কাণ্ডজ্ঞানের অধিকারী আমাদের আধুনিক পুঁথিসাহিত্যের লেখক-বু্দ্ধিজীবীবৃন্দ! ইসলামী জিহাদীদের এরা স্বগোত্রীয় নয় কি? এদের মধ্যে বিবাদটা কীসের? হালুয়া-রুটি খাওয়াখাওয়ির, সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্তির?
যাইহোক, আধুনিক ‘ছহিবড় খাবনামা’ কিংবা ইউসুফ-জোলেখা মার্কা সাহিত্যের কাণ্ডারীদের বিবেক বা বিবেচনা সম্পর্কে এ কথাগুলি বলতে বাধ্য হলাম গত ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারী বই মেলার সময় ‘ইসলাম বিতর্ক’ প্রকাশ ও বিক্রীর অভিযোগে আমার উপর এবং সেই সঙ্গে বইটির ছাপখানার মালিক ফকির তসলিম উদ্দীন কাজল এবং ইংরাজী The Aryans and the Indus Civilization এবং বাংলা গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র আমার সহ-লেখক শামসুল আলম চঞ্চলের উপর রাষ্ট্রের যে তাণ্ডব নেমে আসে সে কথা স্মরণ করে।
ধরে নেওয়া যাক আমার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কারণ সরকারের ছিল। যদিও আমি মনে করি সংবিধান আমাকে মত প্রকাশের জন্য এইটুকু অধিকার দিয়েছে। ঠিক আছে ধর্মোন্মাদরা সে কথা মানবে না। তাদের সঙ্গে সরকার এবং এইসব মডারেট মুসলমান কিংবা ধর্মনিরপেক্ষ লেখক-বুদ্ধিজীবী সহমত পোষণ করে আমার গ্রেফতারের আয়োজন করবে। কিন্তু মুদ্রকের কী দোষ? এটা কী ধরনের আইন যে, কোনও বই প্রকাশের জন্য ছাপাখানার মালিককে মামলার শিকার হয়ে জেলে যেতে হবে? ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের তৈরী এই রকম ঘৃণ্য উপনিবেশবাদী আইন যে কথিত স্বাধীন দেশে চলতে পারে সেই দেশের স্বাধীনতার চরিত্র এবং প্রকৃত রূপ সম্পর্কে কি প্রশ্ন তোলা উচিত নয়? এই হাস্যকর রকম অসভ্য আইন এটাই দাবী করে যে প্রকাশের আগে ছাপাখানার মালিককে প্রত্যেকটা বই পড়ে নিশ্চিত হতে হবে যে এটাতে আইন বিরুদ্ধ কিছু নাই। এটা কি অসম্ভব একটা দাবী নয়?
আমি এটা বুঝি যে আমার গ্রেফতারের সংবাদে জিহাদী বা ধর্মোন্মাদ ইসলামবাদীদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছহি বড় খাবনামা মার্কা আধুনিক পুঁথি-সাহিত্যের লেখক-বুদ্ধিজীবীগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। কারণ ধর্মোন্মাদদের পাশাপাশি তারাও আমার গ্রেফতারের জন্য সরকারকে নৈতিক সমর্থন এবং উৎসাহ যুগিয়েছিলেন। অনুমান করি তারা আরও খুশী হয়েছিলেন এ কথা ভেবে যে আওয়ামী লীগ সরকার শুধু আমাকে নয় সেই সঙ্গে গ্রন্থের মুদ্রক এবং আমার গবেষণামূলক দুইটি গ্রন্থের অন্যতম লেখককেও জেলে নিয়ে তার শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছে। এ কথা দুঃখের সঙ্গে হলেও বলতে হয় যে, যে গ্রন্থের জন্য আমার বিরুদ্ধে তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে মামলা সেই গ্রন্থের সঙ্গে শামসুল আলম চঞ্চলের কোনও সম্পর্ক ছিল না। এমন কি ব-দ্বীপ প্রকাশনের সঙ্গেও তার আনুষ্ঠানিক কোনও সম্পর্ক ছিল না। অথচ ব-বদ্বীপ প্রকাশনের বিপণন কর্মকর্তা হিসাবে দেখিয়ে সরকার তাকে গ্রেফতার এবং তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করে। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে বুদ্ধির ব্যাপারীদের ইসলাম বিতর্কের বিরুদ্ধে এত ক্রোধ সেই ব্যাপারীরা কিন্তু তার গ্রেফতার এবং তার বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের বিরুদ্ধে টু শব্দ পর্যন্ত উচ্চারণের প্রয়োজন বোধ করে নাই।
ইতিহাস এবং বিশেষত সিন্ধু সভ্যতা সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক পণ্ডিত মহলে পরিচিত এবং খ্যাতনামা গবেষক ও লেখক শামসুল আলম চঞ্চলের মত একজন পণ্ডিত ব্যক্তিকে বিনা কারণে এবং মিথ্যা অভিযোগে সাধারণ আসামীর মত জেলে নেওয়ায় এইসব ছহিবড় খাবনামা মার্কা লেখক-বুদ্ধিজীবী কুল থেকে কোনও প্রতিবাদ অবশ্য আশা করা যায় না। কারণ সিন্ধু সভ্যতা কিংবা ঋগ্বেদ সম্পর্কে জ্ঞান-গরিমার ক্ষেত্রে উচ্চতায় তারা চঞ্চলের হাঁটুর সমানও যে নয় সেই সম্পর্কেও কোনও ধারণা তাদের আছে বলে মনে হয় না। তারা কী করে জানবে যে, সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ক বর্তমান পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘরের সাবেক মহাপরিচালক ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল আর্যপ্রশ্ন এবং সিন্ধু সভ্যতার উপর চঞ্চলের পাঠানো The Indus Civilization and the Aryans নামে মৌলিক গবেষণা পত্রের জন্য কী উচ্ছ্বসিত ভাষায় তার সমর্থন জানিয়ে সেটি প্রকাশের জন্য তাগিদ দিয়ে চঞ্চলের নিকট তার সরকারী প্যাডে পত্র পাঠিয়েছিলেন সেই ১৯৯৪ সালে। ডঃ মোগলের চিঠিটির প্রতিচিত্র নীচে দেওয়া হল।
এখানে আরও বলে রাখা যায় যে, মোগলের নিকট পাঠানো গবেষণা পত্রের ভিত্তিতে চঞ্চল এবং আমি ইংরাজীতে The Aryans and the Indus Civilization নামে একটি বই লিখি, যা ১৯৯৫ সালে ঢাকা থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এবং মোগলসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ের খ্যতিসম্পন্ন বিভিন্ন পণ্ডিতের নিকট প্রেরণ করা হয়। আমার সন্দেহ হয় ইতিহাসের একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে বাংলায় লিখা এবং ব-দ্বীপ প্রকাশন থেকে ২০০৩ সালে প্রকাশিত ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ নামে গবেষণা গ্রন্থের নামটিও এরা কখনও শুনেছেন কিনা।
যাইহোক, এসব ক্ষোভের কথা। কিন্তু কথাগুলো উঠে আসে এমন ঘটনার প্রেক্ষিতে যে ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে আছে শুধু মূর্খ মোল্লা এবং ইসলামবাদীরা নয়, উপরন্তু জড়িয়ে আছে এইসব মূর্খদের সহযোগী এবং সহযাত্রী হিসাবে এই সমাজের পণ্ডিত, বুদ্ধিজীবী এবং লেখক হিসাবে পরিচিত মহলের প্রতিনিধিত্বকারী কিছু সংখ্যক ব্যক্তির নামও। অবশ্য এরা নিজেদেরকে মডারেট মুসলমান হিসাবে দাবী করে। মডারেট মুসলমান কী জিনিস এদের কারবার দেখলেই সে কথা বুঝা যায়। এই মডারেট মুসলমান লেখক অথবা বুদ্ধিজীবীগণ জ্ঞানকে যে জ্ঞান দিয়ে, যুক্তিকে যে যু্ক্তি দিয়ে এবং লেখনীকে যে লেখনী দিয়ে পরাজিত করতে হয় সেই নিয়মে বিশ্বাস করেন না। অর্থাৎ জিহাদীদের সঙ্গে তাদের মৌল কোনও পার্থক্য নাই। ধর্মোন্মাদ জিহাদী আর তাদের তোষণ ও পোষণকারী সরকারের একটি অঙ্গ হিসাবে তারা তাদের ভূমিকা পালন করতে অভ্যস্ত। তাতে অবশ্য তাদের ভাগে বস্তুগত অনেক কিছুই জোটে।
ইসলামের প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে গিয়ে আমি বাংলাদেশের সাংবিধানিক অধিকারের মধ্যে থেকেই ‘ইসলাম বিতর্ক’ প্রকাশ করি। এই সত্য প্রকাশের পদক্ষেপ মূর্খতাজীবী এবং অন্ধত্বজীবীদের স্বার্থে আঘাত হানতে পারে। সুতরাং আমার বিরুদ্ধে তাদের আক্রোশের যুক্তি বুঝা যায়। কিন্তু চঞ্চলের বিরুদ্ধে তাদের এবং তাদের প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের আক্রোশের কারণ কী? ইতিহাসের প্রচলিত ধারণা এবং তত্ত্বকে নস্যাৎ করে আমার সঙ্গে মৌলিক গ্রন্থ রচনা করা? একইভাবে এইসব লেখকরা কি একজন মুদ্রক বা ছাপাখানার মালিকের এ ক্ষেত্রে অসহায়তার কারণ বুঝতে চাইবেন না? কোনও ছাপাখানার মালিকের পক্ষে কি বই ছাপবার আগে প্রতিটি বই পড়ে যাচাই-বাছাই করা সম্ভব? এই রকম অসভ্য উপনিবেশিক আইনের বিরুদ্ধে তাদের কণ্ঠ থেকে কখনই কোনও উচ্চারণ শুনা যায় না কেন? নাকি তাদের ছহি বড় খাবনামা আর ইউসুফ-জোলেখার প্রেমকাহিনী মার্কা ‘পুঁথি’ ছাপতে লেখক-প্রকাশক-মুদ্রক কাউকেই ভাবতে হয় না?
২০১৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারীর ঘটনা। ‘ইসলাম বিতর্ক’ প্রকাশের জন্য আমাকে, চঞ্চলকে এবং কাজলকে জেলে নেওয়া হল। আমাকে জেলে রাখা হল ২০১৬ সালের ৩১ অক্টোবর পর্যন্ত সাড়ে আট মাস সময়। সাড়ে আট মাস পর আমি আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাই। তার আগে চঞ্চল এবং কাজলও জামিনে মুক্তি পান। তবে মামলা এখনও চলছে।
পুলিশ আমাকে গ্রেফতারের সময় ‘ইসলাম বিতর্ক’ ছাড়াও আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহের বই-পত্রসহ ব-দ্বীপ প্রকাশনের বিপুল পরিমাণ বই-পত্র আমার বাসগৃহ, ব-দ্বীপ প্রকাশনের কার্যালয় এবং বাংলা একাডেমীর একুশে বই মেলায় ব-দ্বীপ প্রকাশনের দোকান থেকে বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে যায়। আর বাংলা একাডেমী কর্তৃপক্ষ আমার বইয়ের দেকানটি বন্ধ করে দেয়। পুলিশ আমার বাসগৃহ থেকে বিপুল সংখ্যক বই-পত্রের সঙ্গে নিয়ে যায় ব্যক্তিগত ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিসসহ আমার প্রায় নূতন কেনা কম্পিউটারও। সেসব কোনও কিছুই আর ফেরত পাই নাই। এ থেকেই সরকার এবং পুলিশের আমার বিরুদ্ধে আক্রোশের পরিমাণ বুঝা যায়। শুধু তাই নয়, ২০১৬-এর ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে আমাকে গ্রেফতারের সঙ্গে পুলিশ ব-দ্বীপ প্রকাশনের অফিস সিলগালা করে বন্ধ করে দেয়। এভাবে ২০০২ সাল থেকে পরিচালিত ব-দ্বীপ প্রকাশন ২০১৬ সালে বন্ধ হয়ে যায়।
২০১৬-এর ফেব্রুয়ারীর পর ২০১৯-এ আরেক ফেব্রুয়ারী আসছে। এই মাস শুধু বাংলা একাডেমীর একুশে বই মেলার মাস নয়। এটা এ দেশের বাঙ্গালী জাতির বাঙ্গালী হিসাবে নিজেকে চিনতে শিখবার মাস। ২০১৬-এর ফেব্রুয়ারীর পর প্রায় তিন বৎসর কেটে গেছে। আর কয়দিন পর আসবে আর এক ফেব্রুয়ারী। মাঝখানে প্রায় তিন বৎসরে আমার জীবনে অনেক কিছু উলট-পালট হয়েছে। ব-দ্বীপ প্রকাশন বন্ধ। তার সঙ্গে সম্পর্কিত আর্থিক ক্ষতির বিষয়টিকে আলোচনায় নাই বা আনলাম। আমার সঙ্গে লেখক-গবেষক শামসুল আলম চঞ্চল এবং শব্দকলি প্রেসের মালিক ফকির তসলিম উদ্দীন কাজল তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭(২) ধারায় অভিযু্ক্ত হয়ে কিছুকাল কারাবাস করে এখন আদালতে হাজিরা দিয়ে চলেছেন।
এখন আমার মনে হচ্ছে আর এক ফেব্রুয়ারীর পূর্বক্ষণে আমার এই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এ দেশের জ্ঞান ও বুদ্ধিবৃত্তির জগতে প্রতিষ্ঠিত কিছু সংখ্যক মানুষের মুখোশ উন্মোচন করা দরকার। কারও নাম ধরবার দরকার নাই। তারা গণ্য এবং নগণ্য যে কেউ হতে পারে। তবে তাদেরকে প্রতিষ্ঠার সিংহাসন থেকে উৎখাত না করলে এ দেশে প্রকৃত জ্ঞানচর্চা এবং সত্যের সাধনা দাঁড়াতে পারবে না। এটা শুধু তাদের নিন্দা ও সমালোচনা করেই যে করা সম্ভব তা নয়। এর জন্য অন্ধকার পথে জ্ঞানের আলোর মশাল জ্বেলে প্রকৃত জ্ঞান ও সত্য সাধকদের এগিয়ে আসতে হবে। যত দুষ্কর এবং ঝুঁকিপূর্ণ হোক সত্যকে খুঁজবার এবং প্রকৃত জ্ঞানকে তুলে ধরবার উদগ্র বাসনা এবং প্রবল সাহস থাকতে হবে।
সেই ধরনের মানুষদের অস্তিত্বও দেখতে পেয়েছি সরকার ও জিহাদীদের সমন্বিত তাণ্ডবের সেই কালে। সেই ত্রাসের কালে আমাদের মুক্তির দাবীতে ঢাকার রাজপথে দাঁড়িয়েছিলেন কিছু সংখ্যক অকুতোভয় ছাত্র এবং যুবক, যাদের মধ্যে প্রকাশকও ছিলেন। জ্ঞান সাধনার পথে আলোর মশাল ধরে রাখতে চাওয়া সেই সাহসীদেরকে আমি স্যালুট জানাই।