লিখেছেনঃ শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ April 19, 2019, 12:00 AM, Hits: 900
(পুনঃপ্রকাশ উপলক্ষ্যে : কয়েক দিন আগে ইকুয়েডরের দূতাবাস থেকে জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে ব্রিটেন কর্তৃক গ্রেফতারের পর তাকে নিয়ে পুনরায় বিশ্বজুড়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। গ্রেফতার এড়াতে প্রায় সাত বৎসর পূর্বে তিনি লন্ডনস্থ ইকুয়েডরের দূতাবাসে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এরপর তাকে নিয়ে যে বিতর্কের ঝড় উঠেছিল সেই বিতর্কের সূত্র ধরে আলমগীর হুসেনের লিখা ‘অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে মাতামাতি ও এক সাম্রাজ্যবাদী দালালের ভাবনা’ ২০১২ সালের ৩১ আগস্ট তারিখে বঙ্গরাষ্ট্রের নিবন্ধ বিভাগে প্রকাশ করা হয়। এই নিবন্ধের উত্তরে শামসুল আলম চঞ্চল ‘জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে আলমগীর হুসেনের নিবন্ধের জবাবে’ শিরোনামে একটি নিবন্ধ লিখলে সেটি ২০১২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর তারিখে বঙ্গরাষ্ট্রের নিবন্ধ বিভাগে প্রকাশ করা হয়। বর্তমানে অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে নূতন করে যে বিতর্ক শুরু হয়েছে তার প্রেক্ষিতে আলমগীর হুসেনের নিবন্ধ পুনঃপ্রকাশ করার পর শামসুল আলম চঞ্চলের নিবন্ধটিও নিম্নে পুনঃপ্রকাশ করা করা হল। — বঙ্গরাষ্ট্র, ১৯ এপ্রিল ২০১৯)
ওয়েব সাইট নবযুগ (www.nabojug.com) ও বঙ্গরাষ্ট্র-এ আলমগীর হুসেনের লেখা নিবন্ধ “আসাঞ্জকে নিয়ে মাতামাতি ও এক সাম্রাজ্যবাদী দালালের ভাবনা” পড়ে মনে কিছু ভাবনার উদয় হল। প্রথমেই তাঁর দীর্ঘ লেখাটির মূল কথাগুলো সংক্ষেপে এখানে বলে নিই। লেখক আলমগীর হুসেন মনে করেন জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ উদার গণতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্বের প্রতিভূ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় গুপ্ত তথ্য ফাঁস করে মহা অন্যায় করেছেন। আমেরিকা, ইংল্যান্ড, সুইডেনের মত দেশগুলো গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতার পূণ্যভূমি। অ্যাসাঞ্জ পাশ্চাত্যের বিশেষত আমেরিকার বিরুদ্ধে তার রাষ্ট্রীয় গোপনীয়তা-বিরোধী জিহাদ চালিয়ে গেলেও চীন বা রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় গুপ্ততথ্য চুরি ও প্রকাশের ব্যাপারে একেবারেই উদাসীন। রাশিয়া, চীন, ইকুয়েডর, বাংলাদেশ, মালয়েশিয়া, ইত্যাদি যে কোন দেশের চেয়েও বাক স্বাধীনতা যুক্তরাষ্ট্র, সুইডেন, ইংল্যাণ্ড, ইত্যাদি দেশে বহুগুণ বেশী। লেখক মনে করেন, সৃষ্টিশীল কলায় – যেমন সাহিত্য ও গানে পাশ্চাত্যের বাক-স্বাধীনতা সম্পর্কিত আইনে, সবচেয়ে বেশী ছাড় দেওয়া হয় এবং তার লক্ষ্য যদি কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি হন, তাহলে ছাড়ের পরিমাণ সর্বোচ্চ। বাক-স্বাধীনতা পশ্চিমা বিশ্বের সংবিধানেই সর্বাধিক গুরুত্ব পেয়েছে, অ্যাসাঞ্জের কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও রাষ্ট্রগুলির পারস্পরিক সম্পর্ক পরিচালনায় গোপনীয়তা চর্চা আগের মতই চলছে এবং চলবে। পৃথিবীর সব দেশই নিজ-নিজ প্রয়োজনমত গোপনীয়তা চর্চা করে যাচ্ছে – হোক সে আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, একুইডর কিংবা চীন। অ্যাসাঞ্জ নভেম্বর ২০১০-এ আমেরিকান দূতবার্তা প্রকাশ করা শুরু করে ইরাক ও আফগানিস্তান যুদ্ধ বন্ধের লক্ষ্যে তার ক্রুসেড হিসাবে। কিন্তু ইরাক ও আফগানিস্তানে আমেরিকা ও ন্যাটোর কর্মতৎপরতা ঠিক সেভাবেই চলছে। এই হল আলমগীর হুসেনের লেখার সংক্ষিপ্তসার, এক কথায় যার মূল বক্তব্য হল, যেহেতু যুক্তরাষ্ট্র গণতন্ত্র আর বাক স্বাধীনতার পুণ্যভূমি, সেই হেতু তা আমাদের আদর্শ। তাই যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কিছু বলা হবে অন্যায়।
প্রথমত: আলমগীর হুসেন বর্তমান বাক স্বাধীনতার তথাকথিত পুণ্যভূমি পশ্চিমা বিশ্বের গুরু আমেরিকা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বাক স্বাধীনতার প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরা প্রয়োজন বলে মনে করি। এটি একটি সম্পূর্ণ ভুল ধারণা যে প্রতিটি ক্ষেত্রেই আমেরিকায় অভ্যন্তরীণ বাক স্বাধীনতা আছে। আমেরিকা শুধুমাত্র সেই সব ক্ষেত্রেই সহনশীল যেখানে আমেরিকার রাষ্ট্র ব্যবস্থার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন না হচ্ছে। এটি বোঝার জন্য মার্কসবাদ ও ইসলাম এই দু’টি রাজনৈতিক-সামাজিক দর্শন ও রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতি আমেরিকার মনোভাব ও দৃষ্টিভঙ্গী জানা প্রয়োজন। ইসলাম কঠোরভাবে একটি এককেন্দ্রিক ও স্বৈরাচারী ধর্ম হওয়া সত্ত্বেও আমেরিকা ইসলামের প্রতি সহনশীল ও উদার। সেখানে মসজিদ নির্মাণ ও ধর্ম পালনে ইসলামের জন্য কোন বাধা নেই। কিন্তু মার্কসবাদী তত্ত্ব নিয়ে সীমিত পরিসরে কিছু কর্মকাণ্ড পরিচালনা ছাড়া সেখানে কি মার্কসবাদী দল গঠনের কোন স্বাধীনতা আছে? সেখানে সংবিধানে প্রত্যেকের নিজস্ব মত প্রকাশের স্বাধীনতার নামে ধর্মীয় স্বাধীনতা থাকলেও মার্কসবাদী মতবাদ প্রচারের ও দল গঠনের কোন স্বাধীনতা নাই। নিজ দেশে আমেরিকাকে তার রাষ্ট্রযন্ত্রকে নির্মমভাবে ব্যবহার করতে দেখা গেছে মার্কসবাদী তত্ত্বের প্রচারকে একেবারে শুরুতেই ধ্বংস বা খুবই সীমিত করে রাখার জন্য। অনেক সময় কমিউনিস্ট অথবা শ্রমিক আন্দোলনের নেতা-কর্মীদের গুম অথবা খুন করা হত। বিশ্ববিখ্যাত চলচ্চিত্র অভিনেতা ও পরিচালক চার্লি চ্যাপলিনকে পর্যন্ত কমিউনিস্ট সন্দেহে মার্কিন রাষ্ট্র দ্বারা হয়রানির শিকার হতে হয়েছিল। অথচ তিনি তা ছিলেন না। আমরা জানি বিশ শতকের ষাটের ও সত্তরের দশকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় আমেরিকার পুলিশ, এফবিআই ও অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সংস্থা কীভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিপক্ষের জনমতকে দমনের জন্য নির্দয় হয়েছিল ও সেই সাথে দেশের ভিতর দানা বাঁধতে থাকা মার্কসবাদী আন্দোলনকে অঙ্কুরেই দমন করেছিল। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মহাগুরু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তার নিজ জনগণের জন্য বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের আসল চেহারা এখানেই প্রকাশ হয়ে পড়ে।
এটি মোটেও সত্য নয় যে মার্কসবাদী তত্ত্ব গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের বিরোধী বলে আমেরিকা এই তত্ত্বের প্রবলভাবে বিরোধী। মার্কসবাদী তত্ত্ব এক সময় বিশ্ব জুড়ে উপনিবেশিক ও নয়া-উপনিবেশিক রাষ্ট্রসমূহের জনগণের জন্য তাদের দেশকে বিদেশী নিয়ন্ত্রণ মুক্ত হবার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার হাতিয়ার হিসাবে দেখা দিয়েছিল। ফলে যে সব দেশ মার্কসবাদী তত্ত্বকে গ্রহণ করে স্বাধীনভাবে শিল্পায়ন ও সমৃদ্ধির পথে যেতে চাইছিল বা অন্যান্য মার্কসবাদী বা সমাজতন্ত্রী রাষ্ট্রের সাথে জোট বাঁধতে চাইছিল স্বাভাবিকভাবেই সেই সব দেশের এই পথ ও পদ্ধতি আমেরিকার বিশ্বব্যাপী নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাকে ও তার জন্য প্রয়োজনীয় নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে বিপদাপন্ন করছিল। সুতরাং আমেরিকা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে ক্রম প্রসারমাণ মার্কসবাদী তত্ত্ব ও তার ব্যবস্থাকে নির্মূলের জন্য বিপুল শক্তি নিয়ে বিশ্বব্যপী ষড়যন্ত্র আর আগ্রাসন চালিয়ে গেছে ও এখনও অব্যাহতভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
মার্কসবাদী তত্ত্বের বিপক্ষে প্রবল ঘৃণা ও বিদ্বেষের জন্য আমেরিকার যুক্তি হল এই তত্ত্ব গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী এবং এই তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে গণতন্ত্র বিপন্ন হয় ও মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়। ধরা যাক মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট তত্ত্ব অনুযায়ী রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হলে সেখানে গণতন্ত্র থাকে না ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটে থাকে। অথচ বর্তমান বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত অপর একটি রাষ্ট্র ব্যবস্থা ও তার তত্ত্বের দিকে যদি চোখ ফেরানো যায় তা হলে সেক্ষেত্রে আমেরিকার সম্পূর্ণ একটি ভিন্ন চরিত্র দেখতে পাওযা যাবে। ইসলাম একটি ভয়ঙ্কর স্বৈরাচারী, এক কেন্দ্রিক, মানবিকতা ধংসকারী ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বিরোধী তত্ত্ব হওয়া সত্ত্বেও এবং বিভিন্ন ইসলামী সমাজসহ ইসলামী সমাজের কেন্দ্র সৌদী আরবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের এত অসংখ্য ঘটনা ঘটার পরও মানবাধিকারের গুরু আমেরিকার ইসলামের প্রতি সহনশীল হতে ও রাষ্ট্র হিসাবে ইসলামী দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় বাখতে কোন সমস্যা হয় না। এক সময় আমেরিকায় প্রকাশ্যে মার্কসবাদের চর্চা সম্ভব ছিল না, সেখানে মার্কসবাদী বই তো দূরের কথা রাশিয়ায় প্রকাশিত যে কোন বইয়ের সেখানে প্রবেশের উপর কড়াকড়ি বিদ্যমান ছিল। অথচ সেখানে ইসলামী বই প্রকাশ ও বিক্রী এবং ইসলাম ধর্ম পালন ও প্রচারের প্রতিষ্ঠান হিসাবে মসজিদ নির্মাণের অনুমতি দিতে কোন সমস্যা হয় নাই কখনও। আমেরিকার দ্বিমুখী নীতির এটি একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। আমেরিকার বাক স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের রূপও তেমনই দ্বিমুখী নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত।
সাধারণভাবে ইসলামী দেশসমূহের শাসকরা নিজ দেশে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক স্বার্থকে রক্ষা করে। ইসলাম ধর্মের কারণে ইসলামী সমাজের জনগণ পশ্চাৎপদ হয় বলে এই সব সমাজের উপর ইসলামী শাসকদের নিয়ন্ত্রণ হয় অনেক সহজ। নিজ সমাজে পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ হিসাবে ইসলামী সমাজের শাসকরা কাজ করে বলে পাশ্চাত্যের জন্য মধ্যপন্থী ইসলামী শাসকরা গ্রহণযোগ্য। সুতরাং আমেরিকার কাছে ইসলাম ভাল ও গ্রহণযোগ্য যতক্ষণ পর্যন্ত না ইসলাম তাকে আঘাত করে বা ধ্বংস করতে চায়। মডারেট বা মধ্যপন্থী ইসলাম পাশ্চাত্য ও আমেরিকাকে সমর্থন করে, তাই আমেরিকার কাছে তা ভাল বা গ্রহণযোগ্য। অপর দিকে মার্কসবাদী তত্ত্ব যেমন তেমনি এই তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক পৃথিবী আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে ও মর্যাদার সাথে দাঁড়াবার প্রেরণা যোগায়। তাই আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের জন্য মার্কসবাদী বা সমাজতন্ত্রের তত্ত্ব বিপদজনক। এখানেই ভন্ডামীর খোলস ভেঙ্গে তাদের আসল রূপ বেরিয়ে পড়ে।
এবার দেখা যাক মানবাধিকারের মহাগুরু ও বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্রের মহান রক্ষাকর্তা আমেরিকার আরেক চেহারা। আমেরিকার কীর্তিকলাপ প্রকাশ করে আমেরিকা দেশে দেশে তার নিজস্ব বিশ্ব ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করার জন্য যে ষড়যন্ত্র, প্রতারণা ও আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে তার সামান্য কিছু তথ্যই সম্প্রতি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ প্রকাশ করতে পেরেছেন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে আমেরিকা বিশ্বব্যাপী যে নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে চাইছে ও করে চলেছে, তার অসংখ্য নমুনা ল্যাটিন আমেরিকা, আফ্রিকা আর এশিয়ার দেশগুলোতে আমেরিকার অসংখ্য কার্যকলাপ থেকে জানা যায়। বিশ্বব্যাপী তথাকথিত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য আমেরিকার মহান ভূমিকার কথা জানা যায় পুলিৎজার পুরষ্কার পাওয়া সাংবাদিক টিম ওয়েইনারের লেখা বই “লিগেসি অব অ্যাশেজ: দি হিস্ট্রি অব সিআইএ” থেকে। সেখানে অসংখ্য ঘটনার বিশদ বিবরণ দেওয়া আছে যেগুলোর মধ্যে আছে আমেরিকার বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের আমলে তাঁদের নির্দেশে কিউবার প্রেসিডেন্ট ফিডেল ক্যাস্ট্রোকে হত্যার অসংখ্য চেষ্টা করার কথা আর আছে বেলজিয়ামের আগ্রাসনের কারণে কঙ্গোর নেতা প্যাট্রিস লুমুম্বা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে সামরিক সাহায্য নিলে আমেরিকা কর্তৃক সিআইএ-কে ব্যবহার করে তাঁকে হত্যা করে তাদের বশংবদ জোসেফ মোবুতুকে ক্ষমতায় বসানোর কথা। এছাড়াও আছে আমেরিকার আফগান মুজাহিদীন বাহিনীকে বিপুল অর্থ আর অস্ত্র দিয়ে তৎকালীন সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নিয়োজিত রাখার কথা। স্বাধীন দেশ পানামার শাসক জেনারেল ম্যানুয়েল নরিয়েগাকে সেদেশের মাটিতে আক্রমণ অভিযান চালিয়ে বন্দী করে আমেরিকায় নিয়ে যায় তথাকথিত বিচার করার জন্য, আর নিকট অতীতে স্বাধীন দেশ ইরাক আর আফগানিস্তানে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে দেশ দুটিকে পরনির্ভরশীল আর বশংবদ করার জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই করেছে আমেরিকা, যার পিছনে আছে অর্থ, অস্ত্র আর ষড়যন্ত্র। বইটিতে সি,আই,এ,-এর মূলত ব্যর্থতার ইতিহাস তুলে ধরতে গিয়ে রাশিয়া, চীন, কিউবাসহ বিভিন্ন দেশে আমেরিকার সফল ও ব্যর্থ সামরিক অভিযান পরিচালনার অসংখ্য বিবরণ দেওয়া হয়েছে। এক কথায় সিআইএ-এর জন্মের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে দেশে নাশকতামূলক তৎপরতা, ষড়যন্ত্র, প্রতারণা, বিপুল অর্থ ব্যয়ের মাধ্যমে দেশে দেশে দুর্নীতিবাজ ও দেশদ্রোহী শক্তিকে ক্ষমতায় বসানো, জাতীয় নেতাদের হত্যা ও হত্যা প্রচেষ্টা, ইত্যাদির মাধ্যমে গণতন্ত্রের মহান পুজারী আমেরিকা গত প্রায় ষাট বৎসর যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে এসেছে তারই চমকপ্রদ বিবরণ পাতায় পাতায় দিয়েছেন সে দেশেরই সাংবাদিক টিম ওয়েইনার। বইটি পড়লে এক সন্ত্রাসী রাষ্ট্রের বিশ্বব্যপী যে সন্ত্রাস পরিচালনার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় তাতে আমেরিকাকে সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদার চেয়েও ভয়ংকর ও নির্মম মনে হয়। উৎসাহী পাঠক বইটির বাংলা অনুবাদ সংগ্রহ করে পড়তে পারেন১।
আমরা কেন ভুলে যাব ১৯৪২ সালে আমেরিকার পার্ল হারবারের নৌঘাঁটিতে জাপানের বিমান আক্রমণ ও ব্যপক ক্ষতির প্রতিশোধ নিতে আমেরিকা যে জাপানের দুটি শহর হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে ১৯৪৫ সালে পারমাণবিক বোমা ফেলে লক্ষ লক্ষ সাধারণ নাগরিককে হত্যা করেছিল সেই ঘটনা? সেটা কি যুদ্ধের কোনও রীতিতে পড়ে? সামরিক স্থাপনায় হামলার জবাব এভাবে অসামরিক জনবসতিতে দেওয়া কি কোনও ন্যায়-নীতির সংজ্ঞায় পড়ে? হিরোশিমায় তাৎক্ষণিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৭০ হাজার থেকে ১ লক্ষ জন। নাগাসাকিতে তাৎক্ষণিক মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৩৯ হাজার। ১৯৫০ সাল নাগাদ এই বোমার কারণে দুই নগরে মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩,৪০,০০০। হিরোশিমায় দুই লক্ষ এবং নাগাসাকিতে এক লক্ষ চল্লিশ হাজার। বিশ শতকের পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে আমেরিকা ভিয়েতনামে তাদের সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য অসংখ্য সাধারণ মানুষ হত্যা করেছিল। এই পরাশক্তি ভিয়েতনামে চল্লিশ লক্ষ অসামরিক মানুষকে হত্যা করেছিল। এছাড়া ছিল হানাদারদের হাতে আরও দশ লক্ষাধিক স্বাধীনতা যোদ্ধার মৃত্যু।২ ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর সন্দেহভাজন আল কায়দার সন্ত্রাসীরা আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরের টুইন টাওয়ারে যে হামলা চালিয়ে প্রায় তিন হাজার সাধারণ নাগরিককে হত্যা করেছিল তাকে কি হিরোশিমা-নাগাসাকির গণহত্যা কিংবা ভিয়েতনামে পরিচালিত গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করা চলে? টুইন টাওয়ারের হামলা holocaust বা ব্যপক হত্যাকাণ্ড হলে হিরোশিমা-নাগাসাকি বা ভিয়েতনামের গণহত্যা কী নামে অভিহিত হবে?
আসলে আমেরিকা সন্ত্রাসী সংগঠন আল কায়েদার চেয়েও বিপদজনক। কারণ আল কায়েদা বাক স্বাধীনতা, মানবাধিকার বা গণতন্ত্রের কথা বলে না, বলে জিহাদের মাধ্যমে ইসলামী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে। আর ইসলাম তত্ত্বগতভাবে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না। কাজেই আল কায়েদা বা এই জাতীয় ইসলামী সংগঠনের ভাবাদর্শ বুঝে আমোদের প্রতারিত হবার ভয় নাই। কিন্তু আমেরিকা অনেক বেশী কৌশলী। সে নিজের ভণ্ডমীকে আড়াল করতে জানে। তাই সে অনেক বেশী বিপদজনক। আমেরিকার গণতন্ত্র আর বাক স্বাধীনতার আড়ালে লুকিয়ে আছে তার ভয়ংকর আগ্রাসী ও সন্ত্রাসী রূপ। এবং মানুষ হত্যা এবং ধবংসের ক্ষমতা আল কায়েদার চেয়ে আমেরিকার তুলনাহীনভাবে বেশী। কাজেই আমেরিকা যখন কোন দেশে গণতন্ত্র আর মানবাধিকারের কথা বলে তখন এর আড়ালে তার অসৎ উদ্দেশ্য আছে বলে মনে করা স্বাভাবিক।
এখন অ্যাসাঞ্জ যদি আমেরিকার গুপ্ত তথ্য প্রকাশ করেন, যে তথ্যসমূহ থেকে দেশে দেশে আমেরিকার ষড়যন্ত্র আর নাশকতার বার্তা বিশ্ববাসী জানতে পারে, তা থেকে তো সকলেই উপকৃত হয়। এই গুপ্ত তথ্য তো আমাদের মত দুর্বল দেশগুলোর জন্য জানা একান্ত প্রয়োজনীয় যে দেশগুলোর বিরুদ্ধে আমেরিকা নানা ধরণের ষড়যন্ত্র আর অন্তর্ঘাত করে চলেছে। এতে আমেরিকা অ্যাসাঞ্জের উপর ক্ষিপ্ত হতে পারে তার কুৎসিৎ রূপটা প্রকাশিত হয় বলে, কিন্তু আমরা কেন ক্ষিপ্ত হব? আলমগীর হুসেনের বক্তব্য অনুসারে তাহলে আমাদের স্বার্থ আর আমেরিকার স্বার্থ কি এক? এতে আমাদের স্বাধীন অস্তিত্ব থাকল কোথায়?
একটি বিষয় মনে রাখা দরকার যে, আমেরিকা পৃথিবীতে মহা ক্ষমতাধর শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করায় তার স্বার্থের সাথে অনেকেই জড়িয়ে আছে। বিশেষত পৃথিবীর বেশীর ভাগ রাষ্ট্র পরিচালকরা আমেরিকার সাথে সুসম্পর্ক রাখে আমেরিকার উপর প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে নির্রশীল থাকতে হয় বলে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য ও অভিবাসনের ফলে সারা পৃথিবীর বিপুল সংখ্যক মানুষ আমেরিকার উপর নির্ভরশীলও বটে। এত কিছুর পরও পৃথিবীর সিংহভাগ মানুষ আমেরিকার বিরোধী, বিশেষত তার বিশ্বব্যাপী আগ্রাসী প্রবণতার জন্য। বিশ্বব্যাপী অ্যাসাঞ্জের জনপ্রিয়তার উৎস সেখানেই খুঁজতে হবে। অ্যাসাঞ্জের সমালোচনা থাকতে পারে, তার সকল কর্মকাণ্ড গ্রহণযোগ্য না হতে পারে, কিন্তু আমেরিকার গোপন তথ্য, যে তথ্যসমূহের বড় অংশই অপর দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও ষড়যন্ত্রের সাথে সম্পর্কিত, সেগুলো প্রকাশ করে অ্যাসাঞ্জ পৃথিবীর দুর্বল দেশগুলোর পক্ষে কাজ করেছেন।
আলমগীর হুসেন লিখেছেন রাশিয়া, চীন, বা সিরিয়ার মত দেশগুলো যেখানে কোন গণতন্ত্র বা মানবাধিকার নাই সেসব দেশের রাষ্ট্রীয় গুপ্ত তথ্য অ্যাসাঞ্জ প্রকাশ করছেন না। একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, অ্যাসাঞ্জ যদি তাই করতেন তাহলে তাকে মানবতার পরম মিত্র হিসাবে আমেরিকা ও পাশ্চাত্য ব্যাপকভাব সম্মানিত করত। হয়ত তাকে তথাকথিত শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখার জন্য তাদের সর্বোচ্চ সম্মান নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত করত!
আমাদের মনে রাখতে হবে যে, গণতন্ত্র, শিল্পায়ন আর সমৃদ্ধির পথ খুঁজতে গিয়ে আমরা যেমন আমেরিকা ও পাশ্চাত্যকে সমালোচনা করব তেমনি রাশিয়া বা চীনের মত দেশগুলোর সমাজব্যবস্থাকে আদর্শ মনে করে তাদেরকে বিনা সমালোচনায় মেনে নিব না। আসলে আমাদের এই শিক্ষাই নিতে হবে যে, যে সমস্ত দেশ ও জাতি তাদের উন্নয়ন ঘটিয়ে পৃথিবীর বুকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তারা প্রত্যেকে স্বাধীন পথে লড়াই করেই হয়েছে। আমেরিকার আজকের আমেরিকা হবার ইতিহাসের পিছনে আছে দীর্ঘ লড়াই, আত্মগৌরববোধ আর নিজস্ব ও স্বাধীন পথে বড় হবার চেষ্টা। এ কথা ভুললে চলবে না যে ইংল্যান্ডের উপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আমেরিকার জনগণের আছে দীর্ঘ সংগ্রাম আর লড়াইয়ের ইতিহাস। অষ্টাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে প্রধানত ইংল্যান্ড আর স্ক্যান্ডিনেভীয় দেশগুলোর অভিবাসীদের নিয়ে আমেরিকানরা উত্তর আমেরিকা মহাদেশে তাদের স্বতন্ত্র পরিচিতি নিয়ে দাঁড়ায়। স্বাতন্ত্র্য আর আত্মগৌরববোধ নিয়ে দাঁড়াতে চেয়ে আমেরিকানরা তাদের উপনিবেশিক শাসনের অনেক কিছুই ত্যাগ করে। ইংল্যান্ডের ভাষা তারা নিয়েছে। অথচ সেটাও তারা হুবহু নেয় নাই। তাই ইংল্যান্ডের ইংরাজী থেকে তাদের ইংরাজীতেও পার্থক্য। অনেক বড় বিষয় ছাড়াও ছোটখাটো অনেক বিষয়েও আমেরিকা তার উপনিবেশিক ঐতিহ্যের সঙ্গে ছেদ ঘটিয়েছে। আমেরিকার সংবিধানে ইউরোপীয় দেশগুলোর রাষ্ট্রদর্শন ও সংবিধানের ঐতিহ্যের প্রভাব থাকলেও তা স্বকীয় একটি সংবিধান হিসাবেই ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এভাবে আমেরিকানরা নিজস্ব পথে আমেরিকান হিসাবেই পৃথিবীতে নিজেদের মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করেছিল। এক্ষেত্রে আমাদের আমেরিকানদের কাছ থেকে শিখবার আছে।
দালালী করে অন্যের স্বার্থ রক্ষার জন্য কাজ করা যেতে পারে, কিন্তু তাতে নিজ জতির স্বার্থ রক্ষা করা যায় না। আমরা যদি সমৃদ্ধি, কল্যাণ আর মর্যাদার সাথে পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে চাই তবে আমাদেরকেও আমেরিকানদের মতই লড়াইয়ের মাধ্যমে, স্বাধীন ও নিজস্ব পথে এবং আত্মগৌরববোধ নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে। সে পথ কারও অনুকরণ বা দালালীর পথ হবে না – সে আমেরিকা-ইউরোপ হোক আর চীন বা রাশিয়া হোক। নতুন পথ নির্ধারণ করতে গিয়ে নিশ্চয়ই আমরা অন্যদের অভিজ্ঞতাকে নিব, অন্যদের জ্ঞানকে নিব, কিন্তু আমাদের প্রয়োজনে, আমদের মত করে। এটাই হবে আমাদের সমৃদ্ধ জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের মূলমন্ত্র।
সূত্র:
১। বইটির বাংলা অনুবাদের নাম “লিগেসি অব অ্যাশেজ: সিআইএ’র ৬০ বছরের ইতিহাস”, প্রকাশকঃ আলমগীর সিকদার লোটন, ঢাকা, ২০১২ সালে প্রকাশিত বইটির মূল্য ৭০০ টাকা।
২। The Agence France Presse (French Press Agency) news release of 4 April 1995 concerning the Vietnamese Government's release of official figures of dead and wounded during the Vietnam War.
The Hanoi government revealed on April 4 that the true civilian casualties of the Vietnam War were 2,000,000 in the north, and 2,000,000 in the south. Military casualties were 1.1 million killed and 600,000 wounded in 21 years of war. These figures were deliberately falsified during the war by the North Vietnamese Communists to avoid demoralizing the population.
Note: Given a Vietnamese population of approximately 38 million during the period 1954-1975, Vietnamese casualties represent a good 12-13% of the entire population. To put this in perspective, consider that the population of the US was 220 million during the Vietnam War. Had The US sustained casualties of 13% of its population, there would have been 28 million US dead.