Banner
নৈতিকতার অবসান এবং রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ ─ শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ May 7, 2019, 12:00 AM, Hits: 1465

 

বিষয়সূচি :

(১) আওয়ামী লীগ-বিএনপি : এক কালপর্বের অবসান

(২) ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ

(৩) রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুইটি গল্প

(৪) রাষ্ট্রের অস্তিত্বের নৈতিক ভিত্তি

(৫) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণটা কী

 

 

(১) আওয়ামী লীগ-বিএনপি : এক কালপর্বের অবসান

আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এই উভয় দলের পর্যায়ক্রমিক নৈতিক মৃত্যু বাংলাদেশের ইতিহাসের এক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসাবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে।  ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতা বহির্ভূত যে অবস্থাতেই থাকুক এই দুই দলই এক দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের রাজনীতির গতিধারার প্রধান নির্ধারণকারী শক্তি ছিল।

আমার বিবেচনায় গত ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮-এর জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এমন পদ্ধতি অবলম্বন করেছিল যার ফলে রাজনৈতিক দল হিসাবে তার মৃত্যু ঘটেছে। এটা রাজনৈতিক দল হিসাবে আওয়ামী লীগের আত্মহত্যা।

তবে ৩০ ডিসেম্বর দিনপূর্ব মধ্যরাতের ভোটে বিএনপি-কে হারানো হলেও বিএনপি-এর রাজনৈতিক মৃত্যু তখনও ঘটে নাই বলে আমি ধারণা করি। একই কথা প্রযোজ্য বিএনপি-কে নিয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সম্পর্কেও। কিন্তু বর্তমান সংসদকে অবৈধ ঘোষণা এবং তাকে প্রত্যাখ্যান করার পর সেখানে প্রথমে গণ-ফোরামের নির্বাচিত সাংসদ এবং অতঃপর বিএনপি-এরও সাংসদদের যোগদান নৈতিকতার বিচারে প্রকৃতপক্ষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট এবং বিএনপি-এর রাজনীতিরও আর জায়গা রাখল না।

এই সিদ্ধান্তের ফল হচ্ছে, যে নির্বাচনকে তারা মধ্যরাতের ভোট ডাকাতি কিংবা মধ্যরাতের নির্বাচন বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এবং ‘মধ্যরাতের নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সংসদকে’ অবৈধ বলে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সেই প্রত্যাখ্যানকেই প্রত্যাখ্যান করা। যে কৌশলের কথা বলা হোক এটা নিঃসন্দেহে বিএনপি-এর সীমাহীন রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের ফল।

তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? এক দীর্ঘ সময় আওয়ামী লীগের বাইরে কিংবা বিকল্প হিসাবে সাধারণ মানুষের কাছে বিএনপিই ছিল একমাত্র দৃশ্যমান শক্তি। সেই শক্তি কি নাই হয়ে গেল না? এটা অবশ্য হঠাৎ করে হয় নাই। আসলে অনেক দিন ধরেই সমাজের অবতলে বিএনপি-এর এই নাই হবার প্রস্তুতি চলছিল। বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে এখন সেটা চূড়ান্ত রূপ নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছে মাত্র।

যাইহোক, যে ঘটনা যেভাবে ঘটুক দেশের রাজনীতিতে বিরাট পটপরিবর্তন হল। দলীয় সন্ত্রাস, দুর্নীতি, অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও খুনাখুনী, রাষ্ট্রশাসনের সর্বস্তরে নৈরাজ্য ও বিশৃঙ্খলা, নারী নিগ্রহের ভয়াবহ বিস্তার, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, ধনী-দরিদ্রের মধ্যে সম্পদের দ্রুত বর্ধমান বৈষম্য এবং জননিরাপত্তা জনিত পরিস্থিতির ভয়ঙ্কর অবনতি ইত্যাদি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থার কোনও জায়গাই রাখছে না। এই রকম এক পরিস্থিতিতে প্রধানত রাষ্ট্রশক্তির জোরে মধ্যরাতে ভোট অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল স্বাভাবিকভাবে রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে আওয়ামী লীগের জন্য নৈতিকভাবে কোনও অবস্থান এমনকি তার দলের সাধারণ সমর্থকদের মধ্যেও রাখে নাই। গায়ের জোর অথবা বন্দুকের ভয় দেখিয়ে মানুষকে কিছু সময়ের জন্য চুপ করিয়ে রাখা যেতে পারে, কিন্তু তার পিছনে কোনও নৈতিক আবেদনের শক্তি যেমন থাকে না তেমন এই চুপ করে থাকাটা দীর্ঘস্থায়ীও হয় না।

এই রকম পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থাকে ব্যবহার করে সাধারণ ভোটারদের অজ্ঞাতে মধ্যরাতের ভোটের অনুষ্ঠান দ্বারা আওয়ামী লীগ সরকার যেটা করেছে সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসাবে নিজের মৃত্যু ঘটানো। এই ঘটনা দ্বারা আওয়ামী লীগ এমনকি তার নিজস্ব বা দলীয় ভোটারদের নিকটও এই বার্তা পৌঁছে দিল যে রাজনীতিতে তাদেরও আর কোনও প্রয়োজন তার অর্থাৎ লীগের কাছে নাই। কারণ ভোটে জিতবার জন্য ভোটারের ভোটের দরকার হয় না। ব্যালট পেপারে সিল দেওয়ার লোক থাকলেই হল। একই সঙ্গে দলীয় কর্মীদের কাছেও লীগের নেতৃত্ব এই বার্তা পৌঁছে দিল যে তারাও দলের ক্ষমতা রক্ষার জন্য অপরিহার্য নয়। অপরিহার্য হচ্ছে পুলিশ, প্রশাসন ইত্যাদি। সুতরাং এই এক মধ্যরাতের ভোট দিয়েই এ দেশের রাজনীতির এক বিরাট পালাবদলের সূচনা অন্তত হল। কারণ ক্ষমতার জন্য ভোটার বা জনসমর্থন কোনওটারই প্রয়োজন নাই। সুতরাং জননির্ভর দলেরও প্রয়োজন নাই। কিছু মাস্তানী বা সন্ত্রাসের জন্য হেলমেট এবং হাতুড়ি জাতীয় কিছু বাহিনী পুষলেই হল। তবে ক্ষমতার মূল ভিত্তি থাকল পুলিশ ও প্রশাসন তথা আমলাতন্ত্র। বর্তমান শাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলা হয়েছে মূলত আমলাতন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের ছত্রছায়ায় থাকা কিছু রাজনীতিক এই উভয়ের ঐক্য বা সম্মিলনের মাধ্যমে ।

জনবিচ্ছিন্ন এবং সম্পূর্ণরূপে আমলা-পুলিশ নির্ভর এই শাসনকে কতটা রাজনৈতিক বলা চলে সেটা প্রশ্নসাপেক্ষ। আর এই কারণে আমি বলছি যে এই নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ যেটা করেছে সেটা হচ্ছে রাজনৈতিক দল হিসাবে আত্মহত্যা।

কিন্তু ঠিক একই কাজ কি বিএনপিও করল না? যে ধরনের নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে লীগ সরকার একটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে সেই ধ্বংসপ্রাপ্ত ব্যবস্থার মধ্যে ঢুকে এবং এভাবে তাকে বৈধতা দিয়ে কি বিএনপি লাভবান হবে? বরং যে মর্যাদার জায়গাটা সে রক্ষা করতে পারত এবং আত্মানুসন্ধানের মাধ্যমে তার রাজনীতির পুনর্বিন্যাস সাধনে আত্মনিয়োগ করতে পারত সেই সুযোগও সে হারালো।

আসলে সব শেষের তো একটা শুরু থাকে। আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়া হিসাবে সামরিক শাসকের অনুবর্তী হয়ে এবং ধর্ম ও ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতার আশ্রিত হয়ে যে ভুল প্রক্রিয়ায় এবং ভুল রাজনীতি নিয়ে বিএনপি জন্ম নিয়েছিল এটা সেই ভুলেরই পরিণতি। হয়ত ভুলটা অনেক বেশী দীর্ঘ সময় টিকেছিল। যাইহোক, সে আলোচনায় এখন আর নাই বা গেলাম। এখানে এটুকু বলি যে, লীগ এবং বিএনপি উভয়ের নৈতিক কিংবা রাজনৈতিক মৃত্যুর সঙ্গে এ দেশের রাজনীতির এক বিরাট অধ্যায়েরও মূলত সমাপ্তি ঘটল। হয়ত আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটতে কিছু দেরী হবে। তবে আমার ধারণা সেটা বেশী দূরেও নাই।

 

(২) ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ

আমার ধারণা বাংলাদেশ এখন এমন এক ক্রান্তিকালে প্রবেশ করেছে যা দেশের জন্য শুভ পরিণতি বয়ে আনতে পারে আবার এ দেশের জন্য বিরাট ধ্বংসও নিয়ে আসতে পারে। এখন সময়টা আসলে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্তের যে উত্থান প্রক্রিয়া ইংরেজ আমলে বিশেষ করে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে শুরু হয়েছিল সেটা পাকিস্তান আমলে নূতন একটি পর্যায়ে উত্তীর্ণ হয় বিশেষত ভাসানী, সোহরাওয়ার্দী এবং অতঃপর মুজিবের নেতৃত্বে। মুসলিম লীগ থেকে একটা পর্যায়ে এল আওয়ামী লীগ। একটা পর্যায়ে সেখান থেকে বেরিয়ে এল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা সংক্ষেপে ন্যাপ।

বাংলাদেশ পরবর্তী কালে আওয়ামী লীগের অপশাসন এবং লুণ্ঠনের ফলে লীগ শাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ঘটে। এই প্রতিক্রিয়ায় ১৯৭৫ সালে মোশতাক নেতৃত্বাধীন লীগ নেতৃত্বের একাংশের সঙ্গে যোগসাজশে ঘটে সামরিক বাহিনীর একাংশ কর্তৃক অভ্যুত্থান এবং মুজিব হত্যা। মোশতাকের শাসন হল ক্ষণস্থায়ী। শেষ পর্যন্ত সেনাপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করেন।

ক্ষমতায় এসে জিয়া তার শাসনকে রাজনৈতিক রূপ দিতে চেয়ে বিএনপি গঠন করলেন। এ কাজে তার প্রধান সহায়ক হল ভাসানীর মৃত্যু-পরবর্তী কালের ন্যাপ, যা ছিল তখন মশিউর রহমান (যাদু মিয়া)-এর নেতৃ্ত্বাধীন। এভাবে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গড়ে উঠা এ দেশের বামপন্থী তথা সমাজতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান স্রোতধারা জিয়ার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা পুঁজিবাদী, ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক এবং সেনা আশ্রিত একনায়কী রাজনীতির স্রোতধারায় বিলীন হল। বিশেষত বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র চেতনাকে খর্ব করার জন্য ইসলামকে করা হল তার রাজনীতির অন্যতম নিয়ামক। এই ইসলামী রাজনীতিকে দেওয়া হল বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মোড়ক। এভাবে পাকিস্তান কালে বাঙ্গালী জাতির যে স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তার পরিণতিতে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল আওয়ামী লীগকে বিরোধিতা করতে গিয়ে বিএনপি-এর রাজনীতি হল সেই স্বাধীনতা আন্দোলন এবং যুদ্ধের আদর্শ ও উত্তরাধিকার খর্বকারী রাজনীতির ধারক।

জিয়ার মৃত্যুর পর এবং এরশাদ কর্তৃক ক্ষমতাচ্যুত হবার পর খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে টানা নয় বৎসর স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বিএনপি কিছুটা রাজনৈতিক চরিত্র অর্জন করলেও তার মূল একনায়কী চরিত্র এবং ধর্মীয় এবং আরও নির্দিষ্ট করে বললে ইসলামী রাজনীতি পরিহার করতে পারে নাই। দল যেমন সম্পূর্ণ রূপে একনায়কী এবং এক পরিবারকেন্দ্রিক রয়ে গেল তেমন রয়ে গেল ধর্মাশ্রিত।

এদিক থেকে অনেকে আওয়ামী লীগকে অপেক্ষাকৃত ভালো মনে করেন। ঘটনা হচ্ছে লীগ যা বলে সেটা বিশ্বাস করে না। এটা তার প্রতারণার হাতিয়ার। ভালোর সঙ্গে মন্দের মিশাল দিতেও তা ওস্তাদ। সুতরাং তার ঝুলিতে ধর্মনিরপেক্ষতার সঙ্গে থাকে ধর্মও। গণতন্ত্রের বুলি কপচালেও দল পরিচালনায় তা বিএনপি-এর মতই আপাদমস্তক একনায়কী। বস্তুত লীগের সকল কর্মকাণ্ডের মূল লক্ষ্য একটাই – ক্ষমতায় থেকে লুঠ করে অর্থ-সম্পদ ও বিত্ত সঞ্চয় করা এবং যতটা সম্ভব সেসব বিদেশে পাচার করা এবং সেই সঙ্গে তাদের ছেলেমেয়েদেরকেও বিদেশের বিশেষত পাশ্চাত্যের নিরাপদ জীবনে পাঠিয়ে দেওয়া। সেই কাজটাই তাদের ব্যাপক অংশ এতকাল করেছে। এখনও করছে।

এদিক থেকে বিএনপি ভালো। তাকে সহজে বুঝা যায়। কারণ তার মধ্যে ভণ্ডামী তুলনায় অনেক কম। যারা বামপন্থী রাজনীতি থেকে এসেছিল তারা অনেকে অবশ্য চক্ষুলজ্জা হারিয়ে উন্মত্ত লুটতরাজে অংশ নিতে পারে নাই। কিন্তু তাতে কী? সহজে ক্ষমতার সঙ্গে থাকতে চেয়ে অতীতের আদর্শভিত্তিক রাজনীতিকে পরিত্যাগ করে যে রাজনীতির চর্চা তারা করেছে সেটার ফল কী হতে পারে? যে দলে দ্বিতীয় প্রধান নেতা হিসাবে তারেকের মত দুর্নীতিপরায়ণ নেতার উত্থান হতে পারে সে দলের কাছ থেকে এমনিতেও আশা করার বিশেষ কিছু থাকে না। তবু লীগের শাসনের বিকল্প একটা কিছু অন্তর্বর্তী সময়ের জন্য আসুক যার ফলে দেশকে নূতন পথে নেওয়া সম্ভব হতে পারে এমন একটা আশা অনেকেই করেছিলেন। গত ৩০ ডিসেম্বর মধ্যরাতের ভোটের পর সেই আশা প্রায় সবটাই চলে গিয়েছিল। সংসদে বিএনপি-এর পাঁচ সদস্যের যোগদানে বাকীটুকুও শেষ হল। এবং এটা খুবই ভালো হল। কারণ ভুলের ধারা থেকে সঠিক কিছু বের করে আনবার চেষ্টাটা আর কাউকে করতে হবে না। অন্তত জাতীয় রাজনীতিতে বিকল্প গঠনের পথে থাকা পর্বতপ্রমাণ বাধাটা আর থাকল না।  

বস্তুত ইংরেজ শাসন কাল থেকে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে শুরু হয়ে বাঙ্গালী মুসলমানদের সমাজ বিকাশের যে ধারা একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে এতকাল এগিয়ে চলেছিল তার একটা পর্যায় সম্পূর্ণ হল। এখন প্রশ্ন যেটা দেখা দেয় সেটা হচ্ছে এখন কী হতে পারে? এই পর্যায়ে পৌঁছাবার পর বাংলাদেশ কোন দিকে যাবে? যেমনই হোক তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত নেতৃত্ব সম্পূর্ণ রূপে দেউলিয়া হয়ে গেছে। বাংলাদেশের বাঙ্গালী কি নূতন নেতৃত্ব গড়তে পারবে? নূতন এবং বিকল্প নেতৃত্ব গড়বার মত শক্তি কি এই জাতির ভিতর আছে? যদি তা না থাকে তবে কি রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ আদৌ টিকবে?

 

(৩) রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে দুইটি গল্প

এই প্রসঙ্গের আলোচনায় গল্পের মত করে দুইটা ঘটনার উল্লেখ করি। এটা গল্পের মত শুনালেও গল্প নয়। উপরন্তু গল্পের মত করে বলা ঘটনা দুইটা একটা সমূহ বিপদের দিকে আমাদের দৃষ্টিকে নিবার জন্য সহায়ক হতে পারে।

প্রথম গল্পটা ডঃ আকবর আলী খানের। তার পরিচয় সম্পর্কে বিশেষ কিছু বলার অপেক্ষা রাখে না। পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের এই কর্মকর্তা সচিব হিসাবে অবসর গ্রহণ করেন। পরবর্তী কালে তিনি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টাও হয়েছিলেন। তার সঙ্গে আমার পরিচয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবন থেকে। আমরা একই এসএম হলে থাকতাম। তার রুম আমার রুমের কাছাকাছি ছিল। তিনি ছিলেন আমার এক বৎসরের সিনিয়র। তার প্রচুর অধ্যয়ন এবং বুদ্ধিদীপ্ত আলোচনার জন্য আমি মাঝে মাঝে তার কক্ষে যেতাম এবং অনেক সময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা আমরা ইতিহাস, অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের আলোচনায় কাটিয়ে দিতাম।

যাইহোক, আমি ১৯৬৬ সালে কৃষক আন্দোলন করতে গ্রামে চলে গেলে আর তিনি পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দিলে স্বাভাবিকভাবে আমাদের মধ্যে সম্পর্ক থাকবার কারণ ছিল না। এরপর এল ১৯৭১। আমরা যার যার মত করে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করি।

আমি সেই সময় প্রকাশ্যে ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ আর গোপনে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি করতাম। তবে পূর্ব থেকেই বিভিন্ন প্রশ্নে আমার কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে মতবিরোধ ছিল। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর আমি কমিউনিস্ট রাজনীতি পরিত্যাগ করি। সেই সময় আকবর আলী খান থাকতেন ধানমণ্ডীর এক বাসায় তার এক ভাইয়ের সঙ্গে। আমি মাঝে মাঝে আকবর আলী খানের কাছে যেতাম সেই সময়। যতদূর মনে পড়ে এটা ১৯৭২ সালের কথা। তখন সেখানে মাঝে মাঝে ডঃ কামাল সিদ্দকীও আসতেন। তাকেও অনেকে চিনবেন। এক সময় তিনি ছিলেন খালেদা জিয়া যখন প্রধান মন্ত্রী তখন প্রধান মন্ত্রীর সচিবালয়ের মুখ্যসচিব। এখন লন্ডন প্রবাসী। কামাল ছিলেন আমার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একই বর্ষের ছাত্র। তবে আমাদের বিষয় ছিল ভিন্ন। তার ছিল রসায়ন বা কেমিস্ট্রি আর আমার ছিল রাষ্ট্রবিজ্ঞান। যাইহোক, আমরা একই সংগঠন (ছাত্র ইউনিয়ন) করতাম। ফলে আমাদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বের সম্পর্কও গড়ে উঠেছিল।

১৯৭২-এর কথা বলছি। তখন আমি বিশেষ করে কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার রাজনীতি নিয়ে যথেষ্ট তিক্ত। পার্টির রাজনীতি পরিত্যাগের পর ছাত্র জীবনের সূত্র ধরে পুরাতন বন্ধু বা কিছু ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে নূতন করে যোগাযোগ করছিলাম। ফলে কিছুদিন আকবর আলী খানের বাসায় যাতায়াত এবং আড্ডা ছিল। যেদিন গল্পগুজবে বেশী রাত হত সেদিন কখনও কামাল এবং আমি দুইজনই আকবর আলী খানের বাসায় খেয়ে পাশাপাশি দুই খালি বিছানায় ঘুমাতাম। এখানে বলে রাখা উচিত হবে যে, তারা দুইজনই ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা। এবং তখন তারা দুইজন ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বা ডেপুটি সেক্রেটারী। আমার মত তারা দুইজনই তখন অবিবাহিত। ফলে আড্ডা দেওয়ায় বাধা ছিল না। সেই সময় অল্প কিছুদিন নূতন করে সম্পর্ক গড়ে উঠলেও জীবনের গতিধারায় স্বাভাবিকভাবে সেটা টিকে নাই। ফলে যোগাযোগও নাই বহুকাল। যাইহোক, সেই সময়কার আকবর আলী খানের একদিনের কথা আজও আমার কানে খুব বাজে।

তিনি একদিন আলোচনায় বাংলাদেশের অবস্থা বলতে গিয়ে খুব হতাশা প্রকাশ করেন। তার ভাষায় আগামী কুড়ি বৎসর পর বাংলাদেশের কী অবস্থা হবে সেটা ভাবতেও তার গা শিউরে উঠে। তিনি বড় জোর কুড়ি বৎসর পর্যন্ত কল্পনা করতে পারেন। তিনি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অবস্থা বুঝাতে গিয়ে একটা উপমা দিলেন। সেটা এই রকম যে, ব্রিটিশরা একটা টিনের মজবুত বাড়ী তৈরী করে রেখে গিয়েছিল। পাকিস্তান কালে তার কোথায়ও চাল আলগা হয়ে গেছে। কোথায়ও ঝড়োবাতাসে উড়ে গেছে। ঘরের খুঁটিগুলোও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে। অথচ এই বাড়ী নূতন করে তৈরী করা বা মেরামতের কোনও যোগ্যতা আমাদের রাষ্ট্রশাসকদের নাই। এই অবস্থায় এই রাষ্ট্রের কী পরিণতি হতে পারে ভেবেই তিনি আতঙ্ক প্রকাশ করছিলেন।

এটা আমি ১৯৭২ সালের কথা বলছি। সেদিক থেকে দেখলে আমরা অনেক বেশী সময় পার করেছি। প্রায় অর্ধশতাব্দী। অর্থাৎ তার কল্পনার সীমার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশী সময়। তবে হ্যাঁ, রাষ্ট্র পরিচালনার কেন্দ্রে থাকায় তারা অনেক কিছু দেখতে এবং বুঝতেও পারেন যেটা বাইরে যারা থাকে তাদের পক্ষে অনক ক্ষেত্রেই দেখা বা বুঝা সম্ভব বা সহজ হয় না।

এবার আর একটা গল্পে আসি। এটা এরশাদের শাসনকালের কথা। আমার সালটা ঠিক মনে নাই। এটা ১৯৮৩ হতে পারে আবার ১৯৮৪-ও হতে পারে। যে সময়ই হোক, তাতে অসুবিধা নাই গল্পটা বলতে এবং এর মর্মও বুঝতে। যার কথা বলছি তিনি সেই সময় ছিলেন এক মন্ত্রণালয়ের উপসচিব বা ডেপুটি সেক্রেটারী পদমর্যাদার কর্মকর্তা। অথবা সেই সময় হয়ত তিনি যুগ্মসচিবের পদে উঠেছিলেন। আমার এখন ঠিক মনে নাই। অবশ্য তাতে তার গল্পের তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধা হবে না। ভদ্রলোক আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। কালেভদ্রে হঠাৎ মাঝেমধ্যে দেখা-সাক্ষাতের বেশী কিছু সম্পর্ক ছিল না। এই মুহূর্তে তার নামও মনে আনতে পারছি না। যাইহোক, এই গল্পের জন্য তার প্রয়োজনও নাই। তিনি একদিন কী মনে করে হঠাৎ আমাদের বাসায় আমার কাছে উপস্থিত হলেন। বেশকিছু কাল পরে দেখা। স্বাভাবিকভাবে অনেক কথা হল। স্বাভাবিকভাবে দেশের কথাও হল। তখন তিনি রাষ্ট্রশাসনের দুরবস্থা প্রসঙ্গে যে কথা বললেন, সেটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ, ‘বাংলাদেশ থাকবে না।’ আমি বললাম, ‘থাকবে না মানে? এ দেশ যাবে কোথায়?’ তার সাফ উত্তর, ‘ভারত নিয়ে যাবে।’ অর্থাৎ ভারত দখল করবে। আরও অনেক কথা বললেন। সারাংশ হচ্ছে বাংলাদেশকে আমরা রক্ষা করতে পারব না। আমি যখন বললাম যে, এত বড় দায়কে ভারত দখল করে নিয়ে কি বিপদে পড়বে না? ভারত বাংলাদেশকে দখল করলে এই কোটি কোটি মানুষ তো ভারতের ভিতর ঢুকে পড়ে ভারতেরই বিপদ ঘটাবে। আমার কথা শুনে একটু চিন্তা করে বললেন, ‘ভারত না নিলেও এ দেশ যে থাকবে না সেটা আমি বলতে পারি। এ দেশের টিকে থাকার কোনও কারণই নাই।’

তারপর যে কথা বলে এ প্রসঙ্গের ইতি ঘটালেন সেটাও চমকপ্রদ, ‘যাইহোক, আমার কোনও চিন্তা নাই। আমার সব কয়টা ছেলেকে বিদেশে সেটেল করিয়েছি।’ এরপর চাকুরী থেকে অবসর নিবার পর বাকী জীবন যে মক্কার কাবাশরীফে আল্লাহ আল্লাহ করে কাটাবেন সে কথাও বললেন।

তারপর আর কখনও তার সঙ্গে দেখা হয় নাই, তার খোঁজ করার সুযোগও আর হয় নাই। অনেক আগেই তার অবসর নিবার কথা। জানি না এখন তিনি মক্কায় নাকি আর কোথায়ও।

যাইহোক, এই দুই গল্পের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব সম্পর্কে রাষ্ট্রের ভিতরেরই হতাশা বাঙ্ময় হয়েছে। কেউ হয়ত সাতচল্লিশ বছর আগে আর কেউ হয়ত পঁয়ত্রিশ-ছত্রিশ বছর আগে রাষ্ট্রের ভিতরের অভিজ্ঞতা থেকে রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ অস্তিত্ব সম্পর্কে ভয় বা অনাস্থা প্রকাশ করেছিলেন। এ ধরনের আরও কথা আমি শুনেছি। কিন্তু এই দুইজনের বক্তব্যের গুরুত্ব আমার কাছে অনেক বেশী বলে এখানে আমি তাদের গল্পই বললাম।

আমার মাঝে মাঝে এই দুইজনের কথাগুলো মনে হয়। এই নিবন্ধ লিখার সময় আরও বেশী করে মনে হচ্ছে। এখন নূতন করে আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে আসলে কি এ দেশ টিকতে পারবে?

 

(৪) রাষ্ট্রের অস্তিত্বের নৈতিক ভিত্তি

ভালো কিংবা মন্দ যেমন হোক যে কোনও সমাজের যেমন তেমন রাষ্ট্রেরও টিকে থাকবার একটা খুব বড় শর্ত হচ্ছে সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের নৈতিক কর্তৃত্ব বা মোরাল অথরিটি থাকা। এটাকে আমরা সাধারণ ভাষায় গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব বলতে পারি।

বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি তথা রাষ্ট্রের জন্য সেই মোরাল অথরিটি হিসাবে যারা এতদিন ক্রিয়াশীল ছিল তাদের অস্তিত্ব ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। আমরা কেউ মানি বা না মানি বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে প্রথমে আওয়ামী লীগ এবং অতঃপর ন্যাপের উত্তরাধিকারকে যেভাবেই হোক অধিকার করে বিএনপি রাজনীতিতে এই মোরাল অথরিটির জায়গাটাকে দখল করেছিল। উভয়ের মন্দ দিকই হয়ত বেশী। তবু রাষ্ট্রটাকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য একটা নৈতিক আবেদন তাদের ছিল। বিগত নির্বাচন এবং পরবর্তী ঘটনাধারার মধ্য দিয়ে তাদের সেই অবস্থান ধ্বংস হয়েছে। হয়ত এটার প্রয়োজনও ছিল। কারণ পুরাতনের অবসান না হলে নূতন আসবে কী করে?

কথাটা খুব সত্য। এবং শুনতেও খুব চটকদার। কিন্তু এর মধ্যে খুব বিপদের একটা দিকও আছে। পুরাতন নেতৃত্বের অবসান হয়ে নেতৃত্ব শূন্যতা দেখা দিলেই কি নূতন নেতৃত্ব গড়ে উঠে?

আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া কিংবা লিবিয়ার যে ভয়াবহ ধ্বংসের চিত্র আমাদের সামনে প্রতিনিয়ত পরিস্ফুট হচ্ছে তা কি উৎসাহব্যঞ্জক কিছু? নূতন এবং ইতিবাচক নেতৃত্বের শক্তির বিকাশের কোনও লক্ষণ কি সেই সব দেশে দেখা যাচ্ছে? নাকি সবই ক্রমবর্ধমান ধ্বংস এবং মৃত্যুর আবর্তে তলিয়ে যাচ্ছে? কিংবা দৃষ্টি দেওয়া যাক নাইজেরিয়া, সুদান, আলজিরিয়ার দিকে। দীর্ঘকালের অরাজকতার অবসানের কোনও লক্ষণ কি এসব দেশে আছে?

বলা হবে এগুলি সবই মুসলিম দেশ। আর ইসলামী সংস্কৃতির মধ্যে সহিংসতা এমনই একটি উপাদান যা একবার মুক্ত হলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন হয়। তখন ব্যাপক যুদ্ধ দ্বারা একপক্ষের জয় এবং অপর পক্ষের নির্মূলীকরণ দ্বারা পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক করা যেতে পারে। অবশ্য কিছুকালের জন্য।  কিন্তু কঙ্গো বা রুয়ান্ডার মত আফ্রিকার অমুসলিম দেশগুলির অবস্থাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে? এইসব রাষ্ট্রের ভয়াবহ সামাজিক নৈরাজ্য এবং গৃহযুদ্ধের জন্য সংকীর্ণ উপজাতীয় সংস্কৃতিকে দায়ী করতে হবে, যা থেকে আফ্রিকার এই রাষ্ট্রগুলি বেরিয়ে আসতে পারে নাই। ফলে এগুলি পড়ে আছে আদিম উপজাতীয় সংস্কৃতির সঙ্কীর্ণ এবং সহিংস চর্চার মধ্যে। ইসলামের সমস্যাও অনেকটা একই রকম। এটা বুঝতে হবে যে ইসলাম যে বেদুইন যাযাবর এবং যোদ্ধাদের উপর ভর করে প্রসারলাভ করেছিল তাদের উপজাতীয় সহিংস মানস মুসলিম সমাজকে ধর্মচর্চার মাধ্যমে প্রভাবিত করে রাখে এবং যে কোনও ফাঁক পেলে সেখান দিয়ে বিস্ফোরিত হয়ে সমাজকে অধিকার করতে পারে।

যাইহোক, এ প্রসঙ্গে এই মুহূর্তে আমার আলোচনাকে দীর্ঘ করতে চাই না। বরং বাংলাদেশ যে সম্ভাব্য আসন্ন বিপদের মুখে দাঁড়িয়েছে আমি সেই বিষয়টাকেই এখানে তুলে ধরতে চাই।

এ প্রসঙ্গে আমি খুব আশার কথা যেমন বলতে চাইব না তেমন নিরাশার কথাও বলব না। বরং আমি কিছুটা নৈর্ব্যক্তিকভাবে আলোচনাটাকে এগিয়ে নিতে চেষ্টা করব। আসলে বাংলাদেশে এখন আমরা যে পরিস্থিতিতে পৌঁছেছি তাতে নির্মোহ বিচার-বিশ্লেষণের প্রয়োজন খুব বেশী।

 

(৫) বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় ক্ষতির কারণটা কী

যে কোনও ব্যবস্থার শক্তিমত্তার সবচেয়ে বড় উপাদান হচ্ছে তার মধ্যকার নৈতিকতা বা মোরালিটির বোধ। এই জায়গা ভেঙ্গে পড়লে সেই ব্যবস্থাকে রক্ষা করা যায় না। এইজন্য শুধু অর্থ দিয়ে রাজনৈতিক দল বলে কথা নয়, কিছুই করা যায় না। বস্তা বস্তা টাকা উজাড় করে দিলেই বা কী? টাকা ফুরালেই আর কাউকে খুঁজে পাওয়া যায় না। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পিছনে একটা মোরালিটির জায়গা ছিল। পাকিস্তানের যেমন ছিল ধর্ম বা ইসলাম বাংলাদেশের জন্য তেমন সেটা হচ্ছে ধর্মমুক্ত জাতীয়তাবাদ। বস্তুত পাকিস্তান কালে ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক পাকিস্তানকে ভেঙ্গে পূর্ব বঙ্গে ধর্মীয় পরিচয় থেকে মুক্ত এবং জাতি পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সেটারই পরিণতি ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।

এই জায়গায় আওয়ামী লীগের দ্বৈততা বা দ্বিচারিতা এবং বিএনপি-এর মুক্তিযুদ্ধের মোরালিটির বিরোধিতা। অবশ্য বিএনপি-এর প্রসঙ্গে বলা হতে পারে সেটাও মুক্তিযুদ্ধের দল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত আদর্শের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে মুক্তিযুদ্ধ করলে সেটা কেমন মুক্তিযুদ্ধ হয়? ইসলাম ভিত্তিক এক পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ইসলাম ভিত্তিক দুই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ — তা-ই তো? অবশ্য ধর্মকে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিয়ে আওয়ামী লীগও একই কাজ করেছে।  

আসলে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি কেউই যে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত শক্তি নয় সেই কথাই স্পষ্টভাবে বলতে হবে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবের ভূমিকার পুনর্মূল্যায়ন আজ সময়ের ঐকান্তিক দাবী। মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া জিয়ারও এইজন্য পুনর্মূল্যায়ন হওয়া আবশ্যক। জিয়া হলেন সেই দলের লোক যারা পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাদের বাঙ্গালী নিধনের ধাক্কায় প্রাণ বাঁচাতে  হঠাৎ করে বাঙ্গালীর জাতীয় মুক্তি যু্দ্ধে যোগ দেন। এটা আমাদের দুর্ভাগ্য যে আদর্শিকভাবে পূর্বপ্রস্তুতিহীন এবং ইসলামী চেতনার ঊর্ধ্বে উঠে লোকবাদী বাঙ্গালী হতে না পারা এই লোকদের হাতেই স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব এবং স্বাধীনতা পরবর্তী কালে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ গেছে। এবং বিশেষ করে ষাটের দশকে যারা তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতির একটি লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিল তাদের সমস্ত অবদানকে অস্বীকার করা হয়েছে। আমার বিভিন্ন লেখায় এই সমস্যার উপর আলোকপাত করেছি। এই আলোচনার জন্য জরুরী মনে না করায় এখানে সেই প্রসঙ্গে যাচ্ছি না। তবে প্রয়োজনে বারান্তরে পুনরায় আলোচনা করা যাবে।

যাইহোক, বাংলাদেশে আজ যে ভয়ঙ্কর নেতৃত্বশূন্যতা চলছে সেটা বিশেষত লীগ এবং বিএনপি এই দুই দলের মোরাল অথরিটি হিসাবে ভূমিকা হারাবার ফল। যেভাবে হোক লীগ এখন ক্ষমতায় আসীন। সুতরাং তার কিছু সুবিধা আছে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় থাকার। তার জন্য পুলিশ এবং প্রশাসনই যথেষ্ট হতে পারে। কিন্তু বিএনপির পক্ষে সে কথা প্রযোজ্য নয়। তাকে পেতে হবে রাস্তায় লীগের দলীয় এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের শক্তিকে মোকাবিলার শক্তিকে। সেটা যে আমজনতা নয় সেটা অতীতে বহুবার প্রমাণিত হয়েছে, এখনও প্রমাণিত হল। এ দেশের বাস্তবতায় সেটা হল আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়। এরা কেন বিএনপিকে সমর্থন দিবে? বিএনপির ইসলামী রাজনীতির আবেদন পশ্চাৎপদ আমজনতার কাছে থাকতে পারে, কিন্তু আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মের কাছে থাকবে কেন? সুতরাং বিএনপি তার রাজনীতিতে তরুণ প্রজন্মকে পায় নাই। ফলে লীগের সন্ত্রাসকে মোকাবিলা করার শক্তিও পায় নাই। এই শক্তিকে পাবার সব সম্ভাবনা তার শেষ হয়েছে। সুতরাং আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপিও নয়, বরং সম্পূর্ণ নূতন শক্তির উত্থানের জন্য জাতিকে অপেক্ষা করতে হবে। এখন প্রশ্ন, সেই নূতন শক্তির উত্থানের বাস্তবতা কি বাংলাদেশে আছে?

আমার বিবেচনায় দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের প্রশ্ন বাদ দিয়ে ধরলেও নৈতিকতার বিচারে বাংলাদেশের সবচেয়ে ক্ষতি করেছে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি। সেটা তারা করেছে ধর্ম বিশেষত ইসলামকে উস্কে দিয়ে। তারা পরস্পর বিরোধী দুই জায়গায় দাঁড়িয়ে একই কাজ করেছে। কেউ জামাতকে আশ্রয় করে করেছে, কেউ হেফাজত এবং খেলাফতকে নিয়ে কিংবা অন্য বিভিন্নভাবে করেছে। এভাবে তারা উভয়ে বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তি বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের চেতনার বিরুদ্ধ শক্তি হিসাবে দাঁড়িয়েছে। হয়ত একই কাজের জন্য জেনারেল এরশাদকেও দায়ী করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গনে একজন ‘ক্লাউন’ বা ভাঁড়ের বেশী মর্যাদা যাকে দেওয়া যায় না তাকে এই আলোচনায় টানাটা সমীচীন বলে আমি মনে করি না। এ দেশের রাজনীতির মূলধারায় যে দুই দল এতকাল কাণ্ডারী হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিল তাদেরকে হিসাবে নিয়েই আমার এই আলোচনা।

রাজনীতিতে নৈতিক অবস্থানের বিচারে এরা এখন গেছে। তাহলে কে? এখন পর্যন্ত কেউ মঞ্চে প্রবেশ করে নাই বলে কেউ করবে না সে কথা বলা যায় না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে নূতন শক্তির জন্য পথ কি খোলা রাখা হয়েছে?

আপাত দৃষ্টিতে সরকার ও প্রশাসন তার সব পথ বন্ধ করে রেখেছে। আমরা ছাত্রদের কোটা সংস্কার আন্দোলন এবং নিরাপদ সড়ক দাবীর আন্দোলনে সরকারী পুলিশ বাহিনীর পাশাপাশি দলীয় হাতুড়ি ও হেলমেট বাহিনীর তাণ্ডব দেখতে পেয়েছি। নৃশংসতা দিয়ে এই ধরনের সকল আন্দোলনকে দমিয়ে রাখায় সরকার সফল।

এ হল রাস্তার আন্দোলন বন্ধ করার পদ্ধতিগত দিক। অন্যদিক হল চিন্তা প্রকাশের উপর হামলার দিক। মত প্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি এই সরকারের বিরূপ মনোভাব এবং আক্রমণাত্মক আচরণ সম্পর্কে এখানে বিশদ আলোচনার কোনও প্রয়োজনই নাই। এটা সর্বজনবিদিত। কথায় কথায় ধর্মানুভূতিতে আঘাত কিংবা মানহানির অভিযোগ এনে যখন তখন যার তার বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন, মামলা দায়ের এবং জেলে প্রেরণ করা হচ্ছে। কিন্তু এটা ইন্টারনেটের যুগ। বিভিন্ন অনলাইন মাধ্যম আছে। আছে অগণিত ওয়েবসাইট, আছে ফেসবুক-টুইটার, আছে ইউটিউব। দেশের ভিতরে না হয় কিছু মানুষের কণ্ঠরোধ করা গেল। কিন্তু বিদেশ থেকে সরকার এবং ধর্মের বিরুদ্ধে যে হাজার হাজার প্রবাসী বাঙ্গালী লিখছে এবং বলছে তাদের কণ্ঠ রোধ করা যাবে কীভাবে? অবশ্য সরকারের দমননীতির ফলে আপাতত দেশের ভিতরে সরকারের বিরুদ্ধে নূতন কোনও সামাজিক শক্তির উত্থান সুকঠিন হয়ে আছে।

কিন্তু এর বিপজ্জনক একটা দিক আছে। সেটা হচ্ছে সমাজের ভিতর থেকে ধর্মমুক্ত এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রচিন্তার বিকাশের পথ রুদ্ধ হওয়ায় যে পথ খোলা আছে সেই ধর্মের পথে তথা ইসলামী রাজনীতির পথে সমাজের সঞ্চিত আবেগের চালিত হবার সম্ভাবনা। এই সম্ভাবনাকে খাটো করে দেখতে নাই। ধর্মের প্রশ্নে ইরাক, সিরিয়ার মত মোটামুটি উদার এবং অনেকের ভাষায় সেক্যুলার রাষ্ট্রগুলি কীভাবে ইসলাম কায়েমের ধ্বংসযজ্ঞে তলিয়ে গেছে সেটা তো এখন সবার দেখা। এ দেশেও ইসলামী রাজনীতির উত্থান ঘটা অসম্ভব ভাবলে ভুল করা হবে। যদি তা ঘটে তবে তাতে অবশ্য লীগ-বিএনপি কারো্ও জায়গা থাকবে না।

আওয়ামী লীগ-বিএনপি-এর মত ভেজাল ইসলামী শক্তির পরিবর্তে খাঁটি ইসলামী শক্তির উত্থান ঘটলে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটা হবে সেটা হচ্ছে ষাটের দশকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন এবং তার পরিণতিতে একাত্তরে সংঘটিত জাতীয় মুক্তি যু্দ্ধের চেতনার সরাসরি বিরোধী শক্তির হাতে বাংলাদেশের নূতন নেতৃত্ব যাওয়ায় নৈতিকতা বা মোরালিটির অবলম্বন হারানো রাষ্ট্রের অস্তিত্বের অবসান। আজকের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপে ভূ-খণ্ড হয়ত থাকবে। কিন্তু রাষ্ট্রটার কী দশা হবে তা বলা কঠিন। ইরাক-সিরিয়া-লিবিয়া কিংবা আফগানিস্তানের দিকে তাকিয়ে আমরা হয়ত তার একটা কল্পচিত্র আঁকতে পারি। তবে ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আসা এই দেশের ভিতরে বর্তমান সঙ্কট থেকে উত্তরণের শক্তি নিহিত থাকা যুক্তিসঙ্গত বলেই ধারণা করি।

৫-৬ মে, ২০১৯

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ