লিখেছেনঃ মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, আপডেটঃ July 8, 2019, 12:00 AM, Hits: 931
কওমি মাদ্রাসা কি শিক্ষা ব্যবস্থা? কওমি মাদ্রাসাকে আমি কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা মনে করি না। এমন কি কওমি মাদ্রাসার যারা বুদ্ধিবৃত্তিক নেতা, তারাও এটাকে নিছক একটা শিক্ষা ব্যবস্থা মনে করেন না। কওমি মাদ্রাসা সকল অর্থেই একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফরম। ইসলামী জাগরণের একটি রাজনৈতিক "টুল"। যারা কওমি মাদ্রাসার ইতিহাস পড়েছেন, তাদের এই সত্যটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। অন্তত দুইটি অর্থে এই নেটওয়ার্ক ভিত্তিক ব্যবস্থাটি একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক "টুল" —
১ — কওমি মাদ্রাসা হচ্ছে ভবিষ্যতের ইসলামী আন্দোলনের কর্মীবাহিনী। যাদেরকে চাইলেই সারাদেশ থেকে এনে শাপলা চত্বরে কিংবা আরও বড় কোনো মহাসমাবেশে জড়ো করা যাবে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করার জন্যে। যাদেরকে চাইলেই পহেলা বৈশাখের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া যাবে, জাতীয় সঙ্গীতের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া যাবে, এনজিও'র বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া যাবে, নারীর উন্নয়ন নীতির বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া যাবে, জাফর ইকবালের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া যাবে, তসলিমা নাসরিনের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া যাবে, নাস্তিকদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়া যাবে। ভেবে দেখুন, সারা দেশ জুড়ে এতো সংগঠিত আর কোনো বাহিনী আছে কি?
২ — কওমি মাদ্রাসা হচ্ছে ভবিষ্যত ইসলামিক বাংলাদেশের শরীয়া ভিত্তিক (এটাকে আপনি নানান নামে ডাকতে পারেন — কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক ইত্যাদি) যে শাসন ব্যবস্থা গড়ে উঠবে তার জনশক্তি সরবরাহের উৎস। যারা শরীয়া আইন পড়েছেন তাঁরা জানেন এর পূর্ণ বাস্তবায়নের জন্যে দরকার ইসলামী বিপ্লব, প্রথাগত সংসদীয় পদ্ধতিতে শরীয়া আইনের প্রবর্তন যথেষ্ট সহজ নয়, ইন ফ্যাক্ট শরীয়া ধারনাটিও গনতান্ত্রিক প্রথার সাথে বিরোধাত্মক। সুতরাং শরীয়া আইন প্রবর্তনের জন্যে যে দরকারী ইসলামী বিপ্লবটি করা আবশ্যক, কওমি মাদ্রাসা হচ্ছে সেই বিপ্লবের কর্মী বাহিনীর যোগানদার। কওমি মাদ্রাসা থেকে ডাক্তার, ইনজিনিয়ার, অর্থনীতিবিদ, গণিতবিদ, নৃতত্ত্ববিদ, ইতিহাসবিদ, একাউন্টেন্ট তৈরী হয় না, তৈরী হয় হাদিস বিশেষজ্ঞ, কেবল হাদিস বিশেষজ্ঞ। এই পঞ্চাশ লক্ষ হাদিস বিশেষজ্ঞ দিয়ে বাংলাদেশ কি করবে? একটা বিরাট কাজ আছে এঁদের, যখন বাংলাদেশে শরীয়া আইন জারী হবে, তখন সমাজের প্রতিটি স্তরে দরকার হবে এই সকল হাদিস বিশেষজ্ঞ। পাকিস্তানের দিকে দেখুন, ইরানের দিকে দেখুন, সৌদী আরবের দিকে দেখুন। কওমি মাদ্রাসার লক্ষ লক্ষ ছাত্রদের তৈরী করা হচ্ছে সেই ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্যে। আর কোনো "মহৎ উদ্দেশ্য" আছে কি, কওমি মাদ্রাসার?
যারা রাজনীতি বোঝেন ও রাজনীতি করার অধিকার সম্পর্কে জানেন, তাদের এই দুটি বিষয়ে মৌলিক নীতিগত আপত্তি থাকার কথা নয়। কেউ যদি সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব করার স্বপ্ন দেখতে পারেন তাহলে ভিন্ন কোনও একজন ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্নও দেখতে পারেন। কিন্তু যা জানা দরকার, সেটা হচ্ছে এই কথিত শিক্ষা ব্যবস্থার রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সম্পর্কে। কওমি মাদ্রাসাকে আমাদের দেশ শিক্ষা ব্যবস্থা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়, ইসলামী শরীয়া কায়েমের আন্দোলন হিসাবে চিহ্নিত করে না। এটা কওমি মাদ্রাসা নেতাদের সাফল্য এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের, সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। অন্য কোনো রাজনৈতিক শক্তি সারাদেশ ব্যাপী মানুষের ও ভবিষ্যৎ কর্মী বাহিনীর এই বিশাল সমাবেশ গড়ে তুলতে পারেনি "শিক্ষা ব্যবস্থা"র নামে, কওমি মাদ্রাসা পেরেছে "শিক্ষা ব্যবস্থা"র ছদ্মবেশে হলেও, এটা জানা দরকার।
কওমি মাদ্রাসায় শিশুদের উপরে শারীরিক ও যৌন নির্যাতন অনেক পুরোনো প্রবণতা, এতোদিন রিপোর্টেড হতো না, এখন হচ্ছে। এটা হয়তো প্রধান প্রবণতা নয়, কিন্তু এটা যথেষ্ট মাত্রায় বিদ্যমান। এর মূল কারণ কওমি মাদ্রাসার কাঠামোতেই রয়েছে। এই হুজুরেরা সমকামী নন, এরা ধর্ষক ও যৌন নিপীড়ক, যার প্রধান কারণ — কওমি মাদ্রাসার সংস্কৃতি। প্রথমত, এই শিক্ষক নামের পাশবিক মানুষগুলোর প্রবল যৌন অবদমিত জীবন, আর দ্বিতীয়ত, এই হুজুরদের তাদের ছাত্র-ছাত্রীদের উপরে অসীম ক্ষমতার অধিকারী হওয়া। এই দুইটি বিষয় বদলে দেয়া গেলে কওমি মাদ্রাসায় যৌন নির্যাতন কমিয়ে আনা সম্ভব। এই কওমি হুজুরদেরকে স্বাধীনভাবে বাসাবাড়ি নিয়ে বসবাসের সুযোগ করে দিন, মাদ্রাসা কম্পাউন্ড থেকে বের করে দিন। এই হুজুরদেরকে ক্লাস ভিত্তিক করে দিন, এরা কেবল ক্লাস নেবেন, স্বল্প সময়ের জন্যে, কোনো ছাত্র-ছাত্রীর উপরে কর্তৃত্ব করার ক্ষমতা থাকবে না। আর ছাত্র-ছাত্রীদের উস্তাদের “খেদমত” করার প্রথাটি বাতিল করে দিন, দেখবেন রাতারাতি কমে আসবে এই সকল যৌন নিপীড়নের ঘটনা।
কিন্তু রাজনৈতিক "টুল" হিসাবে কওমি মাদ্রাসার যে ভুমিকা তার কি হবে?
আমি শুধু যেটা বলছি, কওমি মাদ্রাসা কোনো শিক্ষা ব্যবস্থা নয়, এটা একটা উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক প্রকল্প। যারা শুধুমাত্র কওমি মাদ্রাসায় শিশু বলাৎকার নিয়ে ভাবছেন, তাদের ভাবনার জন্যে এই পয়েন্টটি হাজির করলাম, ভেবে দেখুন।
কওমি মাদ্রাসা শুধুমাত্র শিশুর প্রতি যৌন নির্যাতনের ঘটনারই জন্ম দিচ্ছে না, বরং আরও ভয়ংকর রাজনৈতিক প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। এই ভয়ংকর রাজনৈতিক প্রকল্প থেকে শিশুরা তো বটেই, বাংলাদেশের কেউই রেহাই পাবেন না।