লিখেছেনঃ মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার, আপডেটঃ July 20, 2019, 12:00 AM, Hits: 861
শুরুর কথা
শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক ড. জাফর ইকবাল একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। সেটা নানান জাতীয় দৈনিকে ছাপা হয়েছে। জাফর ইকবাল বরেণ্য লেখক, সরকার ও রাষ্ট্রের প্রীতিভাজন বুদ্ধিজীবি, তাঁর লেখা দেশের সকল পত্রিকা একযোগে প্রকাশ করলেও অবাক হবার কিছু থাকেনা। এই আলোচিত প্রবন্ধটিতে তিনি নিজ থেকেই তাঁর কিছু “বিভ্রান্তি” কে কবুল করছেন। তিনি এটাও কবুল করছেন যে এই “বিভ্রান্তি” তাঁর বয়সজনিত হতে পারে। হতেও পারে, বয়স তো বহু মানুষের চিন্তার স্বচ্ছতা কমিয়ে দেয়, বয়স মানুষকে বিভ্রান্ত করে বৈকী। সেক্ষেত্রে দায়িত্ববান মানুষ এটা বুঝতে পারলে, এই ধরনের কাজ থেকে অবসর নেবার কথা ভাবতে পারেন।
সে যাই হোক, অধ্যাপক ইকবাল শুধু যে নিজে বিভ্রান্ত হচ্ছেন তা নয়, বরং তিনি তাঁর সেই বিভ্রান্তি সারা দুনিয়াতে ছড়িয়ে দিচ্ছেন, মুশকিল হচ্ছে অধ্যাপক ইকবালের গুনমুগ্ধ মানুষের সংখ্যা লক্ষ লক্ষ, যাদের কাছে বিভ্রান্ত অধ্যাপক ইকবালের জানাশোনাটাই দুনিয়ার সবচাইতে গ্রহনযোগ্য জ্ঞান হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। প্রায় চার পাঁচটি মৌলিক বিষয়ে তিনি তার বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দিয়েছেন সবার মাঝে তবে একটি বিষয়ে তিনি বিভ্রান্তির সবচাইতে ভয়াবহ নজির স্থাপন করেছেন, সেটা হচ্ছে তিনি ধর্ষণ নিয়ে বাংলাদেশ ও সুইডেনের মাঝে তুলনা করে উপসংহার টেনেছেন যে বাংলাদেশের অবস্থা সুইডেনের চাইতে ভালো। তিনি আরও বিভ্রান্তি ছড়িয়েছেন ক্রস ফায়ার নিয়ে, সাম্প্রতিক সময়ে গ্যাসের দাম বৃদ্ধি বিষয়ক আন্দোলন নিয়ে এবং রিকশা চালকদের আনন্দ নিয়ে। প্রতিটি বিষয়েই তাঁর বিভ্রান্তি কি আসলেই বিভ্রান্তি ব্যক্তিগত বিভ্রান্তি নাকি জনগনের মাঝে এই সকল বিভ্রান্তি ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াস সেটাই একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হতে পারে। তবে আজকের লেখায়, আমি কেবল একটি বিভ্রান্তি নিয়ে এখানে লিখছি।
মূল “বিভ্রান্তি”
ধর্ষণ বিষয়ে অধ্যাপক ইকবাল তাঁর যুক্তিকে কিভাবে সাজাচ্ছেন আসেন একটু দেখি, অধ্যাপক ইকবালের লেখা থেকে হুবুহু তুলে দিচ্ছি –
“কিছু দিন হলো খুনের খবরের সাথে শুরু হয়েছে ধর্ষণের খবর। শুধু ধর্ষণ নয়, অনেক সময় সংঘবদ্ধ ধর্ষণ (ইস! কী ভয়ঙ্কর একটা শব্দ!)। সেখানেই শেষ নয়, ধর্ষণ-সংঘবদ্ধ ধর্ষণের পর হত্যাকাণ্ড। খবরের কাগজ পড়তে হলে নয় মাসের বাচ্চা থেকে শতবর্ষী বৃদ্ধাকে ধর্ষণের খবর পড়তে হয়। আজকাল ধর্ষক হিসেবে শিক্ষকেরাও এগিয়ে এসেছেন, বিশেষ করে মাদ্রাসার শিক্ষক। মাঝে মাঝে মনে হয় একটা ভয়ঙ্কর রোগে সবাই আক্রান্ত হয়ে গেছে। এই খবরগুলো পড়ে পড়ে ক্লান্ত হয়ে একবার মনে হলো, পৃথিবীর অন্য দেশের মানুষেরা এই সমস্যাকে কীভাবে সমাধান করে সেটা একটু দেখি। আমাদের দেশে স্কুল কলেজে ছেলেমেয়েদের ঠিক করে বড় করি না, পরিবার ছেলেমেয়েদের ঠিক করে মানুষ করতে পারে না, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক কিছু গোলমাল করে। বিচার করা যায় না। শুধু তা-ই না, বড় বড় মাস্তান এবং গডফাদাররা নয়ন বন্ডদের পুষে পুষে বড় করে, রাজনীতির মানুষেরা এদের ব্যবহার করে। কাজেই আমাদের সমস্যার শেষ নেই। খুন ধর্ষণ যদি ভয়ঙ্কর রোগ হয়ে থাকে তাহলে আমরা শুধু রোগাক্রান্তদের চিকিৎসা করার চেষ্টা করছি। কিন্তু দক্ষ দেশগুলো নিশ্চয়ই এই রোগটি ছড়িয়ে পড়তেই দিচ্ছে না। পৃথিবীর পরিসংখ্যানে চোখ বুলাতে গিয়ে আমি পুরোপুরি বিভ্রান্ত হয়ে গেছি। যে দেশগুলোর সবকিছু ঠিক করে করার ক্ষমতা আছে এবং আমার জানামতে সবকিছু ঠিকভাবে করে, তাদের অনেকের পরিসংখ্যান আমাদের থেকে ভালো নয়, অনেকের পরিসংখ্যান আমাদের থেকেও খারাপ। হতে পারে সব দেশের পরিসংখ্যান ঠিকভাবে আসেনি। কোনও কোনও দেশে ধর্ষণ রিপোর্ট করা সহজ, কোনও কোনও দেশে কঠিন। স্ক্যান্ডিনিভিয়ান দেশগুলোর সামাজিক অবস্থা নিয়ে আমার সবসময়েই একটা উচ্চ ধারণা ছিল। পরিসংখ্যান দেখতে গিয়ে আমার সেই ধারণায় চোট খেয়ে গেল, সুইডেনে ধর্ষণের হার আমাদের দেশের ধর্ষণের হার থেকে ছয় সাতগুণ বেশি। না, তথ্যটা দেখে আমি স্বস্তি পাইনি, বরং হতবুদ্ধি হয়ে আছি, অপেক্ষা করে আছি সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টা বিশ্লেষণ করে আমাকে বোঝাবেন। আমার পক্ষে এটা বোঝার কিংবা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই। বিভ্রান্ত হয়ে আছি”।
উপরের অনুচ্ছেদ টিতে অধ্যাপক ইকবাল বিষয়টিকে বেশ আগ্রহউদ্দীপক ভাবে সাজিয়েছেন। এই অংশটুকুর হয়তো প্রতিটি বাক্যকে ব্যবচ্ছেদ করা যায়, কিন্তু শুধুমাত্র নির্দিষ্ট করে একটি বিষয়ে আমার ব্যাখ্যা সীমাবদ্ধ রাখছি আজকের জন্যে।
আমাদের দেশে কেনো ধর্ষণের মহামারি হচ্ছে এর কারণগুলো অধ্যাপক ইকবালের অজানা নয়, কিন্তু তিনি তারপরেও বিভ্রান্ত হচ্ছেন। কেনো? কারণ সুইডেনের ধর্ষণের হার বাংলাদেশের চাইতেও “ছয় সাতগুন” বেশী, সেটা তাঁকে বিভ্রান্ত করছে কারণ সুইডেন তাঁর মতে সব কিছু “ঠিক ঠাক করা” একটা দেশ, সেই দেশটির যদি এই অবস্থা হয় তাহলে আমরা তো ভালোই আছি, তাহলে এইটা নিয়া এতো শোরগোল এর কারণ টা কি? ওনার লেখা থেকে যদি কেউ এমন করে ভাবতে শুরু করেন সেটাকে তিনি কি ঠ্যাকাতে পারবেন? যদিও তিনি খুব আন্তরিক ঢং এ বলছেন –
“সুইডেনে ধর্ষণের হার আমাদের দেশের ধর্ষণের হার থেকে ছয় সাতগুণ বেশি। না, তথ্যটা দেখে আমি স্বস্তি পাইনি, বরং হতবুদ্ধি হয়ে আছি, অপেক্ষা করে আছি সমাজবিজ্ঞানীরা বিষয়টা বিশ্লেষণ করে আমাকে বোঝাবেন। আমার পক্ষে এটা বোঝার কিংবা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা নেই। বিভ্রান্ত হয়ে আছি”।
জাফর ইকবাল বিজ্ঞানের শিক্ষক। তিনি শুধু শিক্ষক নন, একজন গবেষকও বটে। বিজ্ঞানের গবেষণার অত্যন্ত উজ্জ্বল অভিজ্ঞতা আছে তাঁর। তিনি তার ছাত্রদের দিয়ে নান ধরনের গবেষণা করিয়ে নেন। তো সেই অভিজ্ঞতা থেকে স্যারের সম্পর্কে কি এই প্রশ্ন গুলো করা যায়?
তিনি নিশ্চিত ভাবেই জানেন এসব। কিন্তু তারপরেও তিনি বিভ্রান্ত হচ্ছেন ও অন্যান্যদের বিভ্রান্ত করছেন। কেনো করছেন? আমরা সত্যিই জানিনা।
সন্দেহাতীত ভাবেই জাফর ইকবাল ব্যস্ত মানুষ, পত্রিকার কলাম লেখার জন্যে কোনো কিছুকেই খুব গভীর ভাবে জানার দায় তাঁর নেই, বাস্তবত থাকার দরকারও নেই হয়তো। কিন্তু এই লেখায় আমরা একটু গোড়া থেকেই জানবো, গভীর ভাবে জানবো, সুইডেনে কিভাবে যৌন হয়রানীমূলক অপরাধ গুলোকে চিহ্নিত ও নথিবদ্ধ করা হয় এবং সুইডিশ পরিসংখ্যানের সাথে বাংলাদেশের সংখ্যার তুলনা করাটা কতটা উদ্দেশ্যমূলক আর কতটা সঙ্গত। আর যদি তুলনা করতেই হয়, তাহলে কিভাবে সেই তুলনাটা করা যায়? যদিও অধ্যাপক ইকবাল বিষয়টা বোঝার জন্যে সমাজবিজ্ঞানীদের দ্বারস্থ হতে চেয়েছেন, কিন্তু বাস্তবত, সুইডেনের সাথে বাংলাদেশের ধর্ষণের মতো অপরাধের তুলনা করাটা কি ভয়ংকর রকমের অবাস্তব ও স্থুলতা সেটা ব্যাখ্যা করার জন্যে সমাজ বিজ্ঞানীদের দরকার নেই, দরকার একজন সাধারণ মানুষের বুদ্ধিবৃত্তিক সততা এবং খানিকটা প্রযুক্তিগত সুবিধা, ধরুন ঘন্টা দুয়েকের জন্যে ইন্টারনেট সুবিধা, আর কিছুই নয়। আমি আমার দুই ঘন্টার ইন্টারনেট ঘোরাঘুরি থেকে আপনাদেরকে ব্যাখ্যা করবো কেনো বিষয়টি অতো জটিল নয়, তবে তার আগে অধ্যাপক ইকবালের বোঝাপড়ার “সততা” কে বোঝার জন্যে কয়েকটি প্রশ্ন করা জরুরী।
কিছু সাধারণ সম্পর্কিত প্রশ্ন
এইযে অধ্যাপক জাফর ইকবাল বললেন যে “সুইডেনে ধর্ষণের হার আমাদের দেশের ধর্ষণের হার থেকে ছয় সাতগুণ বেশি”। এর প্রেক্ষিতে কয়েকটি প্রশ্ন করা যেতে পারে।
- এই দুটি দেশের তুলনামূলক উপাত্ত তিনি কোথায় পেলেন? তিনি কি কারো কাছ থেকে শুনেছেন? গুগোল বা উইকিপেডিয়া থেকে পেয়েছেন? কোনো গবেষণাপত্র থেকে পেয়েছেন? কোনো চরম ডান বা বামপন্থী প্রোপাগান্ডা থেকে পেয়েছেন? উৎসটি কি? তিনি এসবের কিছুই লেখেননি। পাদটীকাও দেন নি। কেবল উল্লেখ করেছেন। আচ্ছা সে না হয় হলো কিন্তু –
- বাংলাদেশের ধর্ষণের হার কতো? সুইডেনে ধর্ষণের হার কতো? অর্থাৎ আমরা কিভাবে জানবো যে বাংলাদেশের চাইতেও সুইডেনে ছয় – সাত গুন বেশী ধর্ষণ হয় যদি আমরা সংখ্যাগুলো না দেখি? না জানি?
- বাংলাদেশের কি ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বিষয়ক জাতীয় কোনো পরিসংখ্যান আছে? যাকে আমরা বলি Population based survey, তেমন কিছু কি আছে বাংলাদেশে? বাংলাদেশের ধর্ষণের ঘটনাগুলোর যে সংখ্যা আমরা জানি সেসবের সূত্রগুলো কি? কোনো জাতীয় জরিপ? পুলিশের রিপোর্ট? নাকি পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ?
- পুলিশ কি বাংলাদেশে ধর্ষণের মামলা নেয়? নিতে চায়? এমন কি নারী পুলিশ সদস্যের ধর্ষণের অভিযোগও কি নেয় পুলিশ? বাংলাদেশে কতটি ধর্ষণের অভিযোগ পুলিশ পর্যন্ত যায় তার কোনো হিসাব অধ্যাপক ইকবালের জানা আছে? শুধু গুগোল করে দেখুন কত হাজার হিটস আপনার কম্পিউটার স্ক্রিনে ভেসে ওঠে পুলিশের অসহযোগিতার।
- বাংলাদেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা কি? যৌন হয়রানির সংজ্ঞা কি? সেটা কি সুইডেনের মতো বা প্রায় একই রকমের?
- বাংলাদেশের মেয়েরা যৌন হয়রানি বা ধর্ষণের ঘটনা কতটা রিপোর্ট করে? পুলিশ কি মামলা নেয়? কিংবা মামলা নেয়ার সাথে সাথে সেটা জাতীয় ভাবে কোথাও রেকর্ড করা হয়?
- বাংলাদেশের “একটি ধর্ষণ” এর ঘটনা বলতে আসলে কি বোঝায়?
অর্থাৎ আপনি যদি তুলনামূলক কোনো সিদ্ধান্ত টানেন তাহলে তো অন্তত দুই দেশের পরিসংখ্যানের সংখ্যাগত উপস্থাপনাটি দরকার, তাইনা? ধরুন সুইডেনে ২০১৭ সালে ৬,৪% মানুষ রিপোর্ট করেছেন যে তাঁরা “যৌনহয়রানি”র শিকার হয়েছেন আর এর মাঝে ১,৪% মানুষ রিপোর্ট করেছেন যে তাঁরা ধর্ষণের স্বীকার হয়েছেন, আমরা যদি ধরে নেই যে সুইডেন ও বাংলাদেশে যৌন হয়রানি রিপোর্ট একই রকমের হয়ে থাকে, সুইডেন ও বাংলাদেশে ধর্ষণের সংজ্ঞা একই রকমের (ড ইকবালের মুখের দিকে তাকিয়ে আমরা এই উন্মাদ অনুমানটি না হয় করেই নিলাম), তাহলে ড ইকবালের দাবী মতে বাংলাদেশে যৌন হয়রানির হার হচ্ছে ০,৯% আর ধর্ষণের হার হচ্ছে ০,২%। বুঝলাম, কিন্তু এর সুত্রটি কোথায়? অধ্যাপক ইকবাল ঠিক কোথা থেকে জানলেন বাংলাদেশের যৌন হয়রানির আর ধর্ষণের এই পরিসংখ্যান ? উপরের এই সকল প্রশ্নের কোনো উত্তর কি দরকার দুই দেশের তুলনা করার আগে? না, ভদ্রলোকের লেখায় এসবের কোনো উত্তর নেই, আকারে – ঈঙ্গিতেও নেই।
অপরাধের সংজ্ঞা ও তথ্যের স্বচ্ছতা
যাক, অধ্যাপক ইকবালের বিভ্রান্তি থেকে বেরিয়ে আসি এবার। এবারে কেবল সুইডেন প্রসঙ্গ নিয়ে লিখি। সুইডেনে শুধু ধর্ষণ ও যৌন হয়রানীর নয়, প্রায় সকল ধরনের অপরাধের পরিসংখ্যান রয়েছে ১৯৫০ সাল থেকে। আসলে পরিসংখ্যান রয়েছে প্রায় একশো বছরের কিন্তু ১৯৫০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সকল অপরাধ পরিসংখ্যান পাবলিকের জন্যে উন্মুক্ত ডিজিটাল মিডিয়ায়। সকলের জন্যে মানে সারা দুনিয়ার সকলের জন্যে উন্মুক্ত। অর্থাৎ অধ্যাপক জাফর ইকবালও যদি সিলেটে বসে সুইডেনের গত সত্তুর বছরের অপরাধ পরিসংখ্যান পেতে চান, তিনি তা পেতে পারেন। তরুন পাঠকদের মাঝে যারা খুব আগ্রহী তাঁরা এই ওয়েবসাইট থেকে এই সকল তথ্য পেতে পারেন শুধু কতটা অপরাধ তা নয়, কি কি ধরনের অপরাধ, কতজন সন্দেহভাজন হিসাবে আটক হয়েছিলেন, কতজন শাস্তি পেয়েছিলেন, কি ধরনের শাস্তি পেয়েছিলেন সকল হিসাব – নিকাশ – পরিসংখ্যান পাবেন এই একটি সাইট থেকে। শুধু যে তথ্যটি গোপন করা হয় তা হচ্ছে এই মানুষগুলোর নাম। কেননা সুইডেনে শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীকেও সমাজেরই একজন হিসাবে গন্য করা হয় তাই তাঁর শাস্তি পরবর্তী জীবনের জন্যেই তাঁর নামটি গোপন করা হয়। যাইহোক – আমরা আলোচনা করবো শুধুমাত্র “যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ” বিষয়ে। সুইডেন প্রসঙ্গে যাওয়ার আগে আসেন খুব সংক্ষেপে দেখে নেই বাংলাদেশে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের সংজ্ঞা কি রকমের। প্রথমত বলে নেয়া ভালো, বাংলাদেশে “যৌন হয়রানি” হচ্ছে নারীর জীবনের নৈমিত্তিক বিষয়, প্রতিদিনের, প্রতিবেলার বিষয়, নারীর পক্ষে যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রমান করা এতোটাই কঠিন যে যৌন হয়রানির নিমিত্তে গলায় ছুরি ধরার পরেও কর্তৃপক্ষ যেখানে যৌন হয়রানির প্রমান পান নাই, এমন ঘটনাও ঘটেছে সাম্প্রতিক সময়ে। যদিও ধর্ষণ বিষয়ে কিছুটা আইন আছে, যৌন হয়রানি বিষয়ক আইন গুলো খুবই অস্পস্ট এবং একেবারেই সাম্প্রতিক।
এবারে আসুন দেখে নেই বাংলাদেশের ধর্ষণ বিষয়ে আইনের সংজ্ঞা কি (সূত্র )। প্রথমে যেসব আইনে ধর্ষণজনিত বিধিবিধান রয়েছে সেগুলো দেখা যাক।
- নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ ( সংশোধনী ২০০৩)
- দণ্ডবিধি, ১৮৬০
- সাক্ষ্য আইন, ১৮৭২, ৪. ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৬০
এই তিনটি উৎস থেকে ধর্ষণের সংজ্ঞা যা পাওয়া যায় তা হচ্ছেঃ
“যদি কোন পুরুষ বিবাহ বন্ধন ব্যতীত ষোল বৎসরের অধিক বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতি ছাড়া বা ভীতি প্রদর্শন বা প্রতারণামূলকভাবে তার সম্মতি আদায় করে, অথবা ষোল বৎসরের কম বয়সের কোন নারীর সাথে তার সম্মতিসহ বা সম্মতি ব্যতিরেকে যৌন সঙ্গম করেন, তাহলে তিনি উক্ত নারীকে ধর্ষণ করেছেন বলে গণ্য হবেন” । (সূত্র)
দণ্ডবিধির ৩৭৫ ধারা অনুযায়ী পাঁচটি অবস্থায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলা যায়,সেগুলো হলো—
১. নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে
২. নারীর সম্মতি ছাড়া
৩. মৃত্যু বা জখমের ভয় দেখিয়ে
৪. নারীর সম্মতি নিয়েই, কিন্তু পুরুষটি জানে যে সে ওই নারীর স্বামী নয় এবং পুরুষটি তাও জানে, নারীটি তাকে এমন একজন পুরুষ বলে ভুল করেছে যে পুরুষটির সঙ্গে তার আইনসঙ্গতভাবে বিয়ে হয়েছে বা বিবাহিত বলে সে বিশ্বাস করে।
৫. নারীর সম্মতিসহ কিংবা সম্মতি ছাড়া যদি সে নারীর বয়স ১৬ বছরের কম হয়। অর্থাত্ ১৬ বছরের চেয়ে কম বয়সী মেয়ের সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করলে তা ধর্ষণ বলে গণ্য হবে।
বাংলাদেশের এই আইনী সংজ্ঞায়ন কে মাথায় রেখে দেখা যাক সুইডেনে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের বিষয়টিকে কিভাবে দেখা হয় আইনী দিক থেকে।
সুইডেনে যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ
সুইডেন “যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ” বা Sexual Offence (SO) কে তাঁদের দন্ডবিধির অনুচ্ছেদ ছয় (Ch. 6) দিয়ে সংজ্ঞায়িত করে থাকে। এই ক্যাটেগরির মাঝে অনেকগুলো যৌন অপরাধ কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়ে থাকে। যার মাঝে খুব সাধারণ যৌন হয়রানি থেকে শুরু করে ভয়ংকর আক্রমণাত্মক ধর্ষণ পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত। সুইডেনে যেহেতু বানিজ্যিক ভাবে যৌনতা (বাংলায় যাকে বলা হয়ে থাকে “বেশ্যাবৃত্তি”) কেনাটা বেআইনী, তাই যে কেউ অর্থের বিনিময়ে যৌনতা খরিদ করলে সেটাও যৌন হয়রানিমূলক অপরাধের মধ্যে পড়ে। নিচে সামগ্রিক ভাবে যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ বা Sexual Offence এর আওতায় যে সমস্ত অপরাধ পড়ে তার তালিকাটি দেয়া হলো।
আগ্রহীরা প্রাসঙ্গিক আইনী ব্যাখ্যাটি এখান থেকে ইংরাজি তরজমা হিসাবে পড়তে পারবেন। উপরে বর্ণিত প্রতিটি অপরাধের আলাদা করে ব্যাখ্যা দেয়া আছে সুইডিশ আইন ও তার ব্যাখ্যায়।
মনোযোগী পাঠক মাত্রই খেয়াল করবেন যে যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ মানেই ধর্ষণ বা রেইপ নয়। এই বিষয়টি আমরা পরে আরও ভালো করে দেখবো যখন আমরা পরিসংখ্যানগুলো উপস্থাপন করবো। অর্থাৎ যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ গুলোর মাঝে মোট ১৭ টি ভিন্ন ভিন্ন অপরাধ অন্তর্ভুক্ত এবং এর মাঝে পাঁচটি (৫) অপরাধ ধর্ষণ হিসাবে সংজ্ঞায়িত এবং বাকী ১২ টি অপরাধ ধর্ষণ নয় কিন্তু যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ। প্রতিটি যৌন হয়রানিমূলক অপরাধের সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করে দেয়া হয়েছে যা সময়ের ধারায় নানান সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে (বাস্তবত আরও বিস্তৃত হয়েছে)। ধরা যাক পাবলিক ট্রান্সপোর্ট এ বা ব্যস্ত শপিং মলের সিড়িতে কিংবা কোনো ব্যস্ত সড়কের ফুটপাথে একজন নারীর বা পুরুষের শরীরে ভিন্ন কোনো মানুষের যেকোনো ধরনের অযাচিত স্পর্শ Sexual Offence (SO) হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে এবং পুলিশ সেটা অপরাধ হিসাবে গন্য করে থাকে। পনেরো বছরের নীচে কোনো শিশুকে আদর করার ছলে কোলে তুলে নেয়া কিংবা তার গাল টিপে দেয়া ধরনের বিষয়গুলো প্রায়শই Sexual Offence (SO) হিসাবে গন্য হয় সুইডিশ সমাজে। শুধু তাইই নয়, যেকারো অসম্মতিতে ইন্টারনেটে, ফোনে, এসএমএস কিংবা ভিন্ন যেকোনো মাধ্যমে অযাচিত যৌনতা নির্ভর যোগাযোগ যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ হিসাবে গন্য হয়ে থাকে। সেজন্যেই সুইডেনে একটা কথা প্রচলিত আছে – “সুইডেনে যে সকল বিষয়কে যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এই সকল অভিজ্ঞতার জন্যে ভিকটিমের বিশেষত নারীর স্বভাব নষ্ট হিসাবে চিহ্নিত করা হয়”।
তবে হ্যাঁ ১৯৫০ সাল থেকে সাম্প্রতিক সময়ের মাঝে যৌন হয়রানির সংজ্ঞা বদলেছে বহুবার, যৌন হয়রানির সংজ্ঞা কঠিন ও সংরক্ষনবাদী হয়েছে, শুধুমাত্র সংজ্ঞাগত পরিবর্তনের কারণেও এই সময়ের মাঝে যৌন হয়রানির সংখ্যা বেড়েছে গুনোত্তর ধারায়। আরও একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হচ্ছে সুইডেন ইউরোপের অন্যতম দেশ যেখানে ১৯৬৫ সাল থেকে বৈবাহিক ধর্ষণ বা “Marital rape” কে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ ইন্টিমেইট পার্টনার বা স্বামী – স্ত্রী, বন্ধু-বান্ধবী, সঙ্গীদের মাঝে যে কারো দ্বারা জোর পূর্বক, কিংবা ফুসলিয়ে যৌন সম্পর্ক ঘটানোকে ধর্ষণ হিসাবে গন্য করে শাস্তি দানের বিধান করা হয়েছে। ম্যারাইটাল রেইপ এর সংজ্ঞা এতোটাই শক্ত যে এতে কোনো বল প্রয়োগের বা জবরদস্তির ঘটনা না থাকলেও ধর্ষণ বলে বিবেচিত হতে পারে। এমন কি ঘুমন্ত স্ত্রীকে শারীরিক ভাবে জাগিয়ে তোলা বা শারীরিক ভাবে জাগিয়ে তুলে সঙ্গমে লিপ্ত করাটাও ধর্ষণ বলে গন্য হতে পারে যদি স্ত্রী পরে দাবী করেন যে তাঁর অংশগ্রহন তাঁর ইচ্ছার বিরুদ্ধে ছিলো। নিজ স্ত্রীর বা সঙ্গীর শারীরিক অসুস্থতার সময়ে তাঁকে সঙ্গমে বাধ্য করাও ধর্ষণ হিসাবে গন্য হয়। প্রেমিক বা প্রেমিকাকে তার কোনো অস্বাভাবিক অবস্থায় (মাতাল কিংবা অবচেতন অবস্থায়) সঙ্গমে লিপ্ত করলে সেটা ধর্ষণ বলে গন্য হবে। আবার ২০০৫ সাল থেকে ধর্ষণের সংজ্ঞা আরও বিস্তৃত করা হয়। টেকনোলজির যুগের কারণে শুধুমাত্র শারীরিক ভাবে সঙ্গমে বাধ্য করাটাই ধর্ষণ নয়, “similar” একই রকমের যৌনতা নির্ভর কর্মকাণ্ডকেও ধর্ষণ বলে বিবেচনা করা হতে পারে। বিনা সম্মতিতে কাউকে শারীরিক ভাবে ঘনিষ্ঠ হতে বাধ্য করাটাও ধর্ষণ বলে গন্য হতে পারে। সুইডেনে ধর্ষণ বা রেইপ বলে গন্য হবার জন্যে পুরুষের “লিঙ্গ”র কোনো ভুমিকা নেই। অর্থাৎ নারী যৌনাঙ্গে পুরুষের যৌনাঙ্গ প্রবেশ, স্পর্শ এ জাতীয় কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। এটা ছাড়াও কেউ ধর্ষণের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারে।
ধর্ষণ প্রসঙ্গে “সম্মতি” ধারণাটিও দারুন রকমের আলাদা দেশে দেশে। এমন কি সম্মতিকে সংজ্ঞায়িত করা হয় বিভিন্ন ভাবে। সম্মতির প্রসঙ্গটিও সুইডেনে অনেক জটিল। অর্থাৎ কোনো একজন নারী বা একজন পুরুষ একবার সম্মতি দেয়া মানেই সে সম্মতির উপর ভিত্তি করে একাধিকবার সঙ্গম করা যেতে পারে তা নয়। বরং এমনটাও হতে পারে, কোনো একজন নারী সম্মতি দেবার পরে তাতক্ষনিক ভাবেই এমন কি সঙ্গমের মধ্যবর্তী সময়েও সম্মতি তুলে নিতে পারেন। এ প্রসঙ্গে উদাহরণ দেয়া যেতে পারে সুইডেনে উইকিলিকস প্রতিষ্ঠাতা জুলিয়ান আসাঞ্জ এর বিরুদ্ধে করা ধর্ষণের মামলা কে। দুজন নারী, দুজনেই স্বীকার করেছেন যে তাঁরা আসাঞ্জের সাথে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হয়েছিলেন সম্মতির ভিত্তিতেই কিন্তু আসাঞ্জ ক্রমশই আক্রমণাত্মক হয়ে ওঠার কারণে এবং আসাঞ্জ যথাযথ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ব্যবহার করতে না চাইলে তাঁরা তাদের সম্মতি তুলে নেন কিন্তু ততক্ষনে আসাঞ্জকে তাঁরা প্রতিহত করতে পারেননি বিধায় পুরো বিষয়টি সম্মতির মাধ্যমে শুরু হলেও তাঁরা মনে করেন এটা ধর্ষণ ছিলো। বলাই বাহুল্য, এই দুজন মহিলার ফ্ল্যাটে আসাঞ্জ কে তাঁরা প্রায় দশদিনের জন্যে আতিথেয়তা করেছেন। এঁদের উদ্যোগেই জুলিয়ান আসাঞ্জ সুইডেনে এসেছিলেন বক্তৃতা করতে। শুধুমাত্র “যথাযথ সম্মতির” প্রশ্নেই জুলিয়ান আসাঞ্জ এর বিরুদ্ধে এই দুই নারী ধর্ষণ মামলা করেন। যে যুক্তিতে এই দুই নারী আসাঞ্জ এর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনেছেন, সেই যুক্তি হয়তো পৃথিবীর বহু দেশেই আইনী ভাবে “গ্রহনযোগ্য” নয়। আগ্রহীরা এখান থেকে জুলিয়ান আসাঞ্জ এর বিরুদ্ধে অভিযোগ টি বিস্তারিত পড়তে পারেন এবং এ থেকে বোঝা যাবে সুইডেনে যেভাবে “ধর্ষণ” কে সংজ্ঞায়িত করা হয়, পৃথিবীর খুব কম দেশেই এভাবে ধর্ষণ কে সংজ্ঞায়িত করা হয়।
সংজ্ঞাগত ভিন্নতা ও পরিসংখ্যানে তার প্রভাব
দুইটি দেশের যৌন হয়রানি ও ধর্ষণের এই আইনী ব্যাখ্যা থেকে কয়েকটি ভিন্নতা রয়েছে এবং সেই তফাৎগুলো পরিসংখ্যানে কতটা প্রভাব ফেলতে পারে সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন, যা হয়তো অধ্যাপক ইকবালের মতো উচ্চ শিক্ষিত মানুষ বুঝতে পারবেন।
প্রথমত – বাংলাদেশের আইনে কেবল পুরুষ ধর্ষণ করে, নারীকে। নারী ধর্ষণ করেন না। কিংবা পুরুষ পুরুষকে ধর্ষণ করেন না। এই সংজ্ঞা যদি সুইডেনে প্রয়োগ করা হয়, তাহলে অনেক ধর্ষণের অভিযোগ “ধর্ষণ” বলে গন্য হবে না, কেননা এর মাঝে রয়েছে যেখানে পুরুষ পুরুষের বিরুদ্ধে, নারী নারীর বিরুদ্ধে ও পুরুষ নারীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ করেছে। সুইডেনে ১৯৮৪ সাল থেকে ধর্ষণের সংজ্ঞাকে “জেন্ডার নিউট্রাল” করা হয়েছে। অর্থাৎ ধর্ষণ যে কেউ করতে পারে। পুরুষ কিংবা নারী। পুরুষ পুরুষ কে, নারী – নারীকে কিংবা অন্যান্য ভাবেও। এখন ভেবে দেখুন তো সাম্প্রতিক সময়ে যেভাবে মাদ্রাসা শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কোমলমতি শিশুদের বলাৎকারের খবর পাওয়া যাচ্ছে, এটা যদি ধর্ষণ হয় এবং যদি এর ব্যাপক রিপোরটিং হয় তাহলে বাংলাদেশের ধর্ষণ এর পরিসংখ্যানটি কেমন হবে?
দ্বিতীয়ত – বাংলাদেশের আইনী সংজ্ঞায় ধর্ষণ ঘটে যদি “সম্মতি” ছাড়া “সঙ্গম” ঘটে। অর্থাৎ এখানে পুরুষের “যৌনাঙ্গ” ব্যবহারের প্রশ্নটি একটি শর্ত। সুইডেনে ধর্ষণের সংজ্ঞায় পুরুষ বা নারী কারো “যৌনাঙ্গ”র ব্যবহার কোনো আবশ্যিক শর্ত নয় ধর্ষণের ক্ষেত্রে। অর্থাৎ ধর্ষণের ঘটনায় যদি “সঙ্গম” কিংবা অন্যান্য যেকোনো যৌনতায় অংশ নিতে কাউকে বাধ্য করা হয়, সেটাও ধর্ষণ বলে গন্য হয়।
তৃতীয়ত – বাংলাদেশের আইনে বৈবাহিক ধর্ষণ বলে কোনো ধারনাই নেই। কিন্তু সুইডেনে বৈবাহিক সম্পর্কের মাঝে কিংবা ইন্টিমেইট রিলেশন বা ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মাঝেও অসম্মতিতে বা জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক বা একই ধরনের প্রচেস্টা কে ধর্ষণ হিসাবে গন্য করে সুইডেন। ঘুমন্ত স্ত্রীর সাথে সঙ্গম কিংবা শারীরিক ভাবে অসুস্থ স্ত্রী বা স্বামীর সাথে সঙ্গম এখানে ধর্ষণ বলে গন্য হয়ে থাকে।
ভেবে দেখুন তো বাংলাদেশে যদি বৈবাহিক ধর্ষণকে অপরাধ হিসাবে চিহ্নিত করা হয় যেখানে স্ত্রীর সম্মতি ছাড়া যৌন সঙ্গম কে “ধর্ষণ” বলে গন্য করা হবে, তাহলে বাংলাদেশের ধর্ষণের সংখ্যাগত পরিবর্তনটা কেমন হবে? কিংবা কর্মক্ষেত্রের প্রভাব খাটিয়ে যৌন সুবিধা গ্রহন কে যদি “ধর্ষণ” হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, তাহলে শ্রমজীবী নারীদের মাঝে ধর্ষণের অভিযোগের সংখ্যাটি কেমন হবে?
আন্তর্জাতিক তুলনা
এবারে আসি অধ্যাপক জাফর ইকবালের আসল পয়েন্ট সংখ্যাতাত্ত্বিক তুলনা। অর্থাৎ ঠিক কিভাবে বাংলাদেশের ধর্ষণের হার সুইডেনের তুলনায় এতো কম। সুইডিশ কর্তৃপক্ষের এই বিষয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে কেনো সুইডিশ ড্যাটাকে আন্তর্জাতিক তুলনায় ব্যবহার করাটা খুবই ভুল ধারণা দেবে। সুইডিশ কর্তৃপক্ষ তিনটি প্রধান কারণ উল্লেখ করেছে এক্ষেত্রে –
১ – সুইডেনে “ধর্ষণ” এর সংজ্ঞা অনেক বিস্তৃত। সুইডেনে ধর্ষণ বলে গন্য হতে পারে এমন অনেক অপরাধ বহু দেশে ধর্ষণ নয়। যেমন বৈবাহিক ধর্ষণ এখনও বহু দেশে ধর্ষণ নয়। সমকামী সঙ্গীদের মাঝে ধর্ষণের ঘটনা এখনও বহুদেশে ধর্ষণ হিসাবে গন্য নয়, বরং সমকামীতার অন্য রকমের ভয়ংকর শাস্তি রয়েছে। পুরুষের উপরে পুরুষের কিংবা পুরুষের উপরে নারীর যৌন নির্যাতন কিংবা নারীর উপরে নারীর যৌন নির্যাতন পৃথিবীর বহু দেশে ধর্ষণ হিসাবে গন্য নয়, কেবল পুরুষ কর্তৃক নারীর উপরে ধর্ষণ হয়ে থাকে সেসব দেশে।
২ – সুইডেনে ঠিক যে অর্থে একটি “অপরাধ” কে লিপিবদ্ধ করা হয়, পৃথিবীর বহু দেশে এই ধরনের ঘটনাগুলোকে “অপরাধ” হিসাবে লিপিবদ্ধ করা হয়না। সুইডেনে এই ধরনের যেকোনো ঘটনা পুলিশে রিপোরটেড হলেই সেটাকে একটি “অপরাধের ঘটনা” বা “Crime Incidence” লিপিবদ্ধ করা হয়। যেকোনো ধরনের তদন্তের আগেই। পৃথিবীর বহু দেশে এই ধরনের অভিযোগকে “অপরাধ” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়না, যথাযথ তদন্তের আগে। একারনেই মূলত দেখা যাবে যতগুলো অভিযোগ কে “অপরাধের ঘটনা” হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, শেষ পর্যন্ত তার কেবল একটা অংশই চুড়ান্ত বিচারিক প্রক্রিয়ায় গন্য করা হয়।
৩ – সবচাইতে বড় তফাৎটি হচ্ছে, সুইডেনে একই ব্যক্তির করা অপরাধের ঘটনাগুলোকে আলাদা আলাদা অপরাধ ঘটনা বা Crime Incidence হিসাবে নথিবদ্ধ করে থাকে। যেমন ধরা যাক – কোনো একজন স্ত্রী যদি তাঁর স্বামীর বিরুদ্ধে বৈবাহিক ধর্ষণের অভিযোগ করে, তাহলে পুলিশ তাঁকে জিজ্ঞাসা করবেন তাঁর স্বামী কতবার তাঁকে ধর্ষণ করেছেন বলে তিনি মনে করেন, এবং ভিক্টিম যদি উল্লেখ করেন যে তিনি গত তিন বছর ধরে তাঁকে সপ্তাহে অন্তত একবার করে ধর্ষণ করেন, সেক্ষেত্রে অপরাধী একজন হলেও তাঁর বিরুদ্ধে ১৫০ টি ধর্ষণের “অপরাধ ঘটনা” বা Crime Incidence হিসাবে নথিবদ্ধ হবে। এজন্যেই সুইডেনের অপরাধির সংখ্যা খুব সামান্য হলেও তার তুলনায় অপরাধ সংখ্যা অনেক বেশী। এই একটি তফাৎও বহু দেশের সাথে সুইডেনের অপরাধের সংখ্যাগত তফাৎ গড়ে দেয়।
এছাড়াও –
৪ – সবশেষে রিপোরটিং বায়াস তো আছেই। অর্থাৎ সুইডেনে যৌন হয়রানি মূলক অপরাধ গুলোর রিপোরটিং পৃথিবীর বহু দেশের চাইতে অনেক বেশী।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি যে অধ্যাপক ইকবালের মতো অত্যন্ত উচ্চ শিক্ষির একাডেমিক মানুষও এই ধরনের বিষয়গুলোকে এড়িয়ে গেছেন এবং স্বতঃপ্রণোদিত ভাবে বিভ্রান্তি উৎপাদন করেছেন।
আরও আগ্রহী পাঠকদের জন্যে সুইডেনের সংবাদ মাধ্যমের একটি প্রতিবেদন পড়ে দেখতে পারেন।
সুইডিশ পরিসংখ্যান
এবারে আসুন যৌন হয়রানি ও ধর্ষণ বিষয়ক সুইডিশ পরিসংখ্যান দেখে নেয়া যাক। এই প্রবন্ধের শুরুতেই লিখেছিলাম যে অধ্যাপক ইকবাল তার দাবীর স্বপক্ষে কোনো সূত্র উল্লেখ করেন নি। তিনি কেবল হাওয়ার ছুরি ঘোরানোর মতো বাংলাদেশের ধর্ষণের হারের সাথে সুইডেনের ধর্ষণের হারের তুলনা করেছেন। এই অনুচ্ছেদে আমি সুইডিশ পরিসংখ্যান তুলে ধরছি। যে কেউ এই ওয়েবসাইটে গেলে সাম্প্রতিক সময়ের পরিসংখ্যান ওয়েবসাইটের পাতাতেই পাবেন। আর যারা আরও আগের পরিসংখ্যানের বিষয়ে আগ্রহী তাঁরা ওয়েবসাইটটির ডাউনলোড অংশে গিয়ে বিগত চল্লিশ বছরের পূরনাঙ্গ ডাটা উপাত্ত পেতে পারেন। আমি ১৯৭৫ সাল থেকে ২০১৮ সালের উপাত্ত এখানে উপস্থাপন করছি। এই বিয়াল্লিশ বছরের পরিসংখ্যানে দেখুন নীল রঙের রেখাটি হচ্ছে মোটের উপরে যৌন হয়রানিমূলক অপরাধের বার্ষিক সংখ্যা, এখানে ২০১৮ সালে মোট ২২ ৪৭৬ টি যৌন হয়রানিমূলক অপরাধ নথিবদ্ধ হয়, কিন্তু যদি আমরা যৌন হয়রানিমূলক অপরাধের দায়ে শাস্তি পাওয়া লোকের সংখ্যা দেখি (উপর থেকে তৃতীয় রেখা, লাল রঙের) তাহলে দেখা যাবে যৌন হয়রানি মূলক অপরাধের দায়ে শাস্তিপ্রাপ্ত হয়েছেন ১৩৭৪ জন মানুষ। একই ভাবে যদি সবুজ রঙের দ্বিতীয় গ্রাফটি দেখি, ২০১৮ সালে ধর্ষণের অপরাধ হিসাবে নথিবদ্ধ হয়েছিলো প্রায় আট হাজার ঘটনা কিন্তু যদি শাস্তি প্রাপ্ত অপরাধির সংখ্যা দেখি তাহলে তা ২২৪ জন।
তাহলে মোট অপরাধের সংখ্যার সাথে অপরাধীর সংখ্যার এই বিরাট ভিন্নতার কারণ কি? ধরুন মোটের উপরে যৌন হয়রানির অপরাধ নথিবদ্ধ হয়েছে প্রায় ২২ হাজার পাঁচশো কিন্তু শাস্তিপ্রাপ্ত অপরাধীর সংখ্যা ১৩৭৪ জন আর ধর্ষণের অপরাধ নথিবদ্ধ হয়েছে প্রায় আট হাজার কিন্তু শাস্তি প্রাপ্ত ব্যক্তির সংখ্যা হচ্ছে ২২৪ জন। কেনো? প্রধানত দুইটি কারণ রয়েছে –
এক) একজন অপরাধীর করা অনেক গুলো অপরাধ কে আলাদা আলাদা ক্রাইম ইনসিডেন্স হিসাবে নথিবদ্ধ করা আর
দুই) অনেক অভিযোগ তদন্তে প্রমান করতে ব্যর্থ হওয়া বা মিথ্যা অভিযোগ বলে প্রমানিত হওয়া। তদন্তে প্রমান করতে ব্যর্থ হলেও সেই অভিযোগ গুলোকে পরিসংখ্যান থেকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়না।
এখন যদি অপরাধীর সংখ্যা দিয়ে বা ভিকটিমের সংখ্যা দিয়ে যৌন হয়রানির সংখ্যাকে বিবেচনা করা হয়, ঠিক যেভাবে পৃথিবীর বহু দেশে করা হয়ে থাকে, তাহলে সুইডেনের হিসাব টা কেমন? সেটা নিশ্চিত ভাবেই বেড়েছে, কিন্তু এই গ্রাফের নীচের দিকের দুইটি রেখাই বলছে সেই রেখাটি বাংলাদেশের যৌন হয়রানি আর ধর্ষণের সাথে তুলনীয় হতে পারে কিনা সেটা ভেবে দেখে যেতে পারে। এই গ্রাফের নীচের দুইটি রেখা হচ্ছে ঐতিহাসিক ভাবে যৌন হয়রানির দায়ে সাজা প্রাপ্ত আসামীর সংখ্যা ও ধর্ষণের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত আসামীর সংখ্যা। অভিযোগের সংখ্যা ও আসামীর সংখ্যা ঐতিহাসিক ভাবেই সুইডেনে সবসময়ই আলাদা। এর মূল কারণটি হচ্ছে অপরাধ এখানে হিসাব করা হয় কতটি ঘটনা কতবার হয়েছে, একজন ধর্ষক যদি দুই বছর ধরে একজনকে ধর্ষণ করে, সেটা একটা ঘটনা নয়, সেটা এমনও হতে পারে যে ৪০০ টি ঘটনা হিসাবে নথিবদ্ধ হতে পারে। কিভাবে অপরাধ কে গননা করা হয়, অপরাধের সংজ্ঞা কি এসবই প্রধান পার্থক্যটি গড়ে দেয় যা অধ্যাপক জাফর ইকবাল কে আপাত ভাবে এক ধরনের “স্বস্তি” দিচ্ছে। বাংলাদেশের সাথে সুইডেন বা ভিন্ন যেকোনো দেশের তুলনা করতে হলে আমাদের সততার সাথে উপরের প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে হবে। নিশ্চিত করতে হবে যে আমরা আপেলের সাথে মুলার তুলনা করছি না। এটাই অধ্যাপক জাফর ইকবালের প্রধান বিভ্রান্তি।
কয়েকটি কেইস ও কয়েকটি প্রশ্ন
এবারে আসুন বাংলাদেশের প্রেক্ষিত থেকে কয়েকটি ঘটনা বা কেইস দেখে নেয়া যাক এবং তারপরে আমরা নিজেদেরকে কিছু প্রশ্ন করি আমাদের নিজেদের ভাবনার জন্যে।
কেইস – ১
নিউজ ২৪ এর শব্দ প্রকৌশলী আরমান সুমন টানা আট বছর নিজের সৎ কন্যাকে ধর্ষণ করেছেন। বাংলাদেশে এই ঘটনাটিকে কিভাবে রেকর্ড করা হবে? আমি প্রায় নিশ্চিত এটাকে বাংলাদেশে “একটি” ধর্ষণের ঘটনা হিসাবে রেকর্ড করা হবে, কেননা ভিকটিম যখন অভিযোগ করবেন, তখন তিনি এটাকে একটি অপরাধ হিসাবেই উল্লেখ করবেন। বেশীরভাগ দেশেই এভাবেই রেকর্ড করা হয়। কিন্তু সুইডেনে কিভাবে রেকর্ড করা হয়? সুইডেনে ভিক্টিম কে পুলিশ জিজ্ঞাসা করেন অভিযুক্ত অপরাধী আপনাকে কতবার ধর্ষণ করেছেন? যদি ভিক্টিম একদম গুনে গুনে সংখ্যাটি বলতে না পারেন, তাঁকে জিজ্ঞাসা করা হয় আনুমানিক কতবার হবে, তিনি হয়তো উত্তর দিলেন প্রতি সপ্তাহেই তাঁকে এই নির্যাতনের শিকার হতে হতো, সেক্ষেত্রে পুলিশ আট বছরে মোট প্রায় চারশোবার ধর্ষণের ঘটনা হিসাবে রেকর্ড করবেন। অর্থাৎ, ভিক্টিম অভিযোগ করছেন একবারই কিন্তু তিনি তার উপরে ঘটে যাওয়া মোট আক্রমনের সংখ্যা ঘোষণা করছেন এবং প্রতিটি ঘটনাকে একটি আলাদা ঘটনা বা incidence বলে রেকর্ড করা হচ্ছে । বাংলাদেশে কিভাবে রেকর্ড করা হয়?
কেইস – ২
বিবিসি’র সংবাদ বলছে – “নারীদের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন বলছে বাংলাদেশে ২০১৬ সালে এক হাজারেরও বেশি নারী ও কন্যা শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে”। দেখুন এখানে ভিক্টিমের সংখ্যা দিয়ে ধর্ষণের সংখ্যাকে নির্ধারণ করা হচ্ছে। অথচ এমন টা হতেই পারে এই ভিক্টীমদের মাঝে অনেকেই একাধিকবার শিকার হয়েছেন এই পাশবিক নির্যাতনের।
কেইস – ৩
প্রথম আলোর মতো জাতীয় পত্রিকা রিপোর্ট করছে এভাবে –
“বাংলাদেশে গত বছর মোট ১ হাজার ২৫১টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে গণধর্ষণের শিকার হয়েছে ২২৪ জন নারী ও শিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ৫৮ জনকে। গত বছর ধর্ষণসহ অন্যান্য নির্যাতনের মোট ঘটনা ঘটেছে ৫ হাজার ২৩৫টি।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের লিগ্যাল এইড উপপরিষদে সংরক্ষিত ১৪টি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদের ভিত্তিতে সংস্থাটির পক্ষ থেকে নারী ও শিশু নির্যাতনের এ তথ্য দেওয়া হয়েছে”।
সংবাদটি খেয়াল করে দেখুন ২২৪ জন নারী ও শিশু গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এবং এই ঘটনাগুলোকে কেবল “মাথা গুনে” হিসাব করা হচ্ছে অথচ সুইডেন তো বটেই পৃথিবীর যেকোনো সভ্য দেশে এই গণধর্ষণের ঘটনা গুলোকে ঘটনার সংখ্যা দিয়ে হিসাব করা হবে, ভিকটিমের সংখ্যা দিয়ে নয় এবং সেই অর্থে হয়তো এই ২২৪ জন নারী ও শিশুর উপরে প্রায় হাজার বার ধর্ষণের ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
আগ্রহউদ্দীপক হচ্ছে দেখুন – এই হিসাবের বা এই পরিসংখ্যানের সূত্রটি কি? বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ হচ্ছে একটি বেসরকারী সংস্থা তাদের অফিসে ১৪ টি সংবাদপত্র নেয়া হয় সেই সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদের উপরে ভিত্তি করে ষোলো কোটি মানুষের জাতীয় পরিসংখ্যান নির্ধারণ করা হচ্ছে। আগ্রহউদ্দীপক নয়?
কেইস – ৪
বাঙলা ট্রিবিউন পত্রিকাটি আরেকটি মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা “অধিকার” এর সূত্রে আমাদেরকে জানাচ্ছেন যে ২০০১ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত মোট ধর্ষণ হয়েছে “১৩ ৬৬৮ টি” যদিও অধিকার এর মূল ওয়েব সাইটে গিয়ে তাদের পরিসংখ্যান দেখলে দেখা যাবে এটা আসলে “১৩ ৬৬৮ টি” নয়, বরং “১৩ ৬৬৮ জন” নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন। আরও অবাক করা বিষয় হচ্ছে বাঙলা ট্রিবিউন রিপোর্ট করছে গন ধর্ষণের ঘটনা হয়েছে “২ ৫২৯ টি” যদিও অধিকারের মূল পরিসংখ্যান বলছে আসলে গণ ধর্ষণের শিকার হয়েছেন “২ ৫২৯ জন”। যারা গন ধর্ষণের ন্যূনতম অর্থ জানেন তাঁরা জানবেন যে শুধুমাত্র ভিকটিমের মাথা গুনে গণধর্ষণ বা ধর্ষণের সংখ্যাকে রিপোর্ট করাটা শুধু ভুল ও অমানবিকই নয়, এটা প্রমান করে ধর্ষণের ঘটনা কে রিপোর্ট করার ক্ষেত্রে আমাদের সমাজ, রাষ্ট্র ও উচ্চ শিক্ষিত মানুষেরা এখনও কি বিপুল পিতৃতান্ত্রিক ও আদিম।
বাঙলা ট্রিবিউনের এই একই প্রতিবেদক তার প্রতিবেদন টি শেষ করেছেন এভাবে –
“লেখাটি শেষ করব একটি দুঃখজনক সংবাদ দিয়ে। ময়মনসিংহে মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগে বাবা গ্রেফতার । আলাল হুদা নামের এক ব্যক্তি তার ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ুয়া মেয়েকে বিগত ৭ মাস ধরে ধর্ষণ করেছে। লোকলজ্জার ভয়ে এতদিন ঘটনাটি চাপিয়ে রাখলেও অবশেষে স্ত্রীর দায়ের করা মামলায় পুলিশ আলাল হুদাকে গ্রেফতার করেছে। কোন যুক্তি দিয়ে এই নির্মমতাকে ব্যাখ্যা করবেন”?
বলুন তো এই আলাল হুদার বিরুদ্ধে ঠিক কতটি ধর্ষণের অপরাধ নথিবদ্ধ হবে বাংলাদেশে? একটি ধর্ষণের ঘটনা? নাকি ৫০ বা ১০০ টি?
কেনো সুইডেনের সাথে তুলনা?
এই প্রশ্নটি হয়তো অনেকের কাছে বিস্ময়কর মনে হতে পারে, কিন্তু এই প্রশ্নটি দিয়েই আমি আমার লেখাটি শেষ করতে চাই। কেনো অধ্যাপক ইকবাল বাংলাদেশের ধর্ষণের হার কে সুইডেনের সাথে তুলনা করছেন? কেনো স্ক্যান্ডিনেভিয়ার আরও তিনটি দেশ ফিনল্যান্ড, ডেনমার্ক কিংবা নরওয়ের সাথে তুলনা করলেন না? কিংবা আরও নারীবান্ধব দেশ আইসল্যান্ড এর সাথে তুলনা করলেন না? কিংবা ইউরোপের প্রধান দেশগুলো যেমন ফ্রান্স, ব্রিটেন, জার্মানি এদের সাথে তুলনা করলেন না? কেনো সুইডেন?
এর দুইটা কারণ আছে।
প্রথমত – আসলে বাংলাদেশকে সুইডেনের সাথে তুলনা করার উদ্দেশ্য টা কি হতে পারে? সেটা অধ্যাপক ইকবালের লেখায় খুব স্পষ্ট। তিনি এক ধরনের আরাম পেতে চেয়েছেন, এক ধরনের মানসিক শান্তি পেতে চেয়েছেন। সরকার ও বাংলাদেশ রাষ্ট্রকেও একটু আরাম দিতে চেয়েছেন। অর্থাৎ সুইডেনের মতো দেশ যারা সবকিছু “ঠিক ঠাক” করে থাকে, তাদের দেশেও যদি “এতো ধর্ষণ” হয়, তাহলে আমাদের দেশে হলে ক্ষতি কি? এটাই ছিলো অধ্যাপক ইকবালের উদ্দেশ্য এবং তিনি নিশ্চিত ভাবেই তার উদ্দেশ্য হাসিল করতে পেরেছেন। গোটা দশেক পত্রিকা এক যোগে তার লেখা সারা দেশে ছড়িয়ে দিয়েছেন।
দ্বিতীয়ত – তিনি যেহেতু পপুলার লেখক, তাই পপুলার উৎস ছাড়া হয়তো ওনার খোঁজ খবর নেয়ার সুযোগ হয়ে ওঠেনা। সুইডেন কে বিশ্বের “রেইপ ক্যাপিটাল” বানানোর একটা আন্তর্জাতিক প্রচারনা চলছে। এই প্রচারনার পেছনে মূলত রয়েছে ইউরোপের চরম ডানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো, ইউরোপের ডানপন্থী মিডিয়া এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও তার ভক্তকুল। এই প্রচারনাটি প্রথম শুরু করেন ইংল্যান্ডের চরম ডানপন্থী নেতা নাইজেল ফারাশ। এর পরে নানান ডানপন্থী দলগুলো সুইডেনের অপরাধ ও যৌন হয়রানিমূলক অপরাধের বৃদ্ধির সাথে সুইডিশ মুসলিম ইমিগ্র্যান্ট কমিউনিটিকে যুক্ত করার একটি প্রচারনা তৈরী করে। এই প্রচারনা শক্তি এতোটাই যে এর সাথে আমেরিকার ফক্স নিউজ সহ বেশ কিছু বিশ্বমানের প্রোপাগান্ডা চ্যানেলগুলো যুক্ত হয়ে পড়ে। ওয়াশিংটন পোস্ট এর এই প্রতিবেদনটিতে তার খানিকটা পাওয়া যাবে। ওয়াশিংটোন পোস্ট এর এই আর্টিকেল টি বরং সকল রকমের অপরাধ মূলক ঘটনার পরিসংখ্যান ও তথ্যের স্বচ্ছতাকেই এই ডানপন্থী প্রচারনার মূল কারণ বলে উল্লেখ করেছে। যেহেতু অপরাধ বিষয়ে সুইডেনের সকল তথ্যই খোলামেলা, সেটাকে ব্যবহার করে ইউরোপের ডানপন্থীরা এই প্রোপাগান্ডা চালিয়ে যাচ্ছে। আমাদের প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবি বলে দাবিদার জাফর স্যার কি শেষ পর্যন্ত বর্ণবাদী – ডানপন্থীদেরদের প্রোপাগান্ডার ফাঁদে পা দিলেন? স্যার, সুইডেন বা অন্য যেকোনো দেশের সাথে তুলনা করার আগে অন্তত উপরের এই প্রশ্ন গুলোর উত্তর আপনাকে খুঁজতে হবে। আপনার সময় না হলে অন্তত আপনার ছাত্রদের বলুন। কারো সময় না হলে ভবিষ্যতের আগ্রহী তরুনদের উপরে ছেড়ে দিন। তবুও অসত্য প্রচারের বাহন হবেন না। সত্য উদ্ঘাটনের দায় না নিতে পারলেও, অন্তত অসত্য প্রচার করবেন না, প্লিজ।
বুদ্ধিজীবির দায়
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমেরিটাস অধ্যাপক ড সিরাজুল ইসলাম চৌধূরী উল্লেখ করেছেন যে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীরা আসলে সরকারের “চামচাগিরি” করছেন। অধ্যাপক ইসলামের এই পর্যবেক্ষণটি খুবই দুর্ভাগ্যজনক হলেও এটাই আমাদের বাস্তবতা এখন।
দুর্ভাগ্য হচ্ছে অধ্যাপক জাফর ইকবালের মতো অতি উচ্চ শিক্ষিত মানুষের, টেকনোলজি ব্যবহারের সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা পেয়েও মূল উৎস গুলো ঘেঁটে না দেখে সস্তা দক্ষিনপন্থী প্রোপাগান্ডার কাছে নিজেদেরকে সমর্পণ করেন এবং সারা দেশ ব্যাপি সেই সকল ডানপন্থী প্রোপাগান্ডা ছড়িয়ে দেন নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে। এটা দুঃখজনক। ব্যক্তিগত ভাবে আমি অধ্যাপক ইকবালের লেখা পড়ে বিভ্রান্ত হয়নি, কেননা আমি জানি কিভাবে সত্য উদ্ঘাটন করতে হয়। তবে আমার সবচাইতে বড় বিভ্রান্তি হচ্ছে – “অধ্যাপক ইকবালের মতো একজন মানুষ কি করে এই মানের সস্তা কাজটি করতে পারলেন”? কেবল আওয়ামী প্রীতি একজন অতি উচ্চশিক্ষিত অধ্যাপকের “বুদ্ধিবৃত্তিক দায়” কে এভাবে ভুলিয়ে দেয়? দিতে পারে?
সম্ভবত আমাদের সবচাইতে বড় জাতিগত দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজে কোনো “পাবলিক ইন্টেলেকচুয়াল” বা “গন-বুদ্ধিজীবি” নেই। আমাদের “বুদ্ধিজীবী” মানুষদের কোনো নীতিগত দায় নেই তাদের বুদ্ধিবৃত্তির প্রতি। জনগন বা বা দেশের প্রতি তো নয়ই। বুদ্ধিজীবী হিসাবে আমাদের এখানে যারা আছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই অধ্যাপক জাফর ইকবালের মতো, বয়সের ভারে “বিভ্রান্ত” যাঁদের সেবার একমাত্র প্রাপক হচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আর নিপীড়ক রাষ্ট্র।
আহা কি নিদারুন অপচয় আমাদের বুদ্ধিবৃত্তির।
সূত্র :
https://sarowar-blog.com