লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ July 27, 2019, 12:00 AM, Hits: 1520
ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং কোরানের বাণী হচ্ছে ইসলামের শান্তির ভিত্তি। অথচ কোরানের অনেক আয়াতের বক্তব্য আপাতঃদৃষ্টিতে আপত্তিকর, অনৈতিক, এমনকি বর্বরতামূলক মনে হয়। যেমনঃ
কোরান ৯/৫ — “অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা কর, বন্দী কর এবং অবরোধ কর। তাদের সন্ধানে ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসে থাক। তবে যদি তারা অনুতপ্ত হয়, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও।”
কোরান ৮/১২ — “আমি (আল্লাহ) কাফেরদের মনে ভীতির সঞ্চার করে দেব। আঘাত হান তাদের গর্দানের উপর এবং তাদেরকে কাট গিটে গিটে।”
সমালোচকরা এ ধরনের আয়াতগুলো উদ্ধৃত করলে শিক্ষিত মডারেট মুসলমানরা সেগুলোর প্রেক্ষাপটবিহীন উদ্ধৃতির অভিযোগ তুলে দোষারোপ করে যে, ইসলাম-বিদ্বেষীরা কোরানের শান্তির বাণীকে বিকৃত করার ইচ্ছাকৃত অভিপ্রায়ে প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে এসব আয়াতের উদ্ধৃতি দেয়… যেন প্রেক্ষাপটসহ উদ্ধৃতি দিলেই আয়াতগুলোর আপাতঃ বর্বরতাসূচক বক্তব্য শান্তিমূলক হয়ে উঠবে।
সেই মডারেট মুসলিমরাই ইসলামকে শান্তির খনি প্রমাণ করতে পুরো কোরান থেকে বেছেবেছে গোটা তিনেক আয়াত উদ্ধৃত করে প্রেক্ষাপটের তোয়াক্বা না করেই। অথচ প্রেক্ষাপট যুক্ত করলে সে আয়াতগুলোর মর্মার্থ আরও খারাপ প্রতীয়মান হয়। এ রচনায় ইসলামের সমালোচকদের প্রেক্ষাপট-বিহীন আয়াতের উদ্ধৃতি আয়াতগুলোর মর্মার্থ জঘন্য করে তোলার জন্য, না মুসলিমদের প্রেক্ষাপট-বিহীন আয়াতের উদ্ধৃতি খারাপ আয়াতের মর্মার্থ ভাল করে তোলার জন্য — সেটা আলোচিত হবে।
সমালোচকদের প্রেক্ষাপট বিহীন উদ্ধৃতি আয়াতগুলোর মর্মার্থ কে আদৌ বিকৃত করে না
কিছুদিন আগে বুয়েট থেকে পাশ করা এক মেধাবী এঞ্জিনিয়ার বন্ধু, যে এক বা একাধিক বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় থেকেও স্কলারশীপ নিয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেছে, তার সাথে ধর্মের ব্যাপারে আলাপ হচ্ছিল। বন্ধুটি আমার জানাশুনা মুসলিমদের মাঝে সবচেয়ে সহনশীল ও উদার মনের এবং সেই সাথে নিয়মিত রোজা-নামাজ আদায় করে। তার দাবী যে, সে একাধিকবার মনোযোগ সহকারে বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষাতেই কোরান পড়েছে। শুধু তাই নয়, সে ক্যারন আর্মস্ট্রং, রেজা আসলান ও অন্যান্য ইসলাম-পছন্দ লেখকদের অনেক বই পড়েছে এবং আমাকেও এ ধরনের এক গাদা বই উপহার দিয়েছে ইসলামের প্রকৃত মর্মার্থ অনুধাবনের জন্য।
আমার মত ইসলাম-বিদ্বেষীরা কিভাবে কোরানের কিছু আয়াতের প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতি দিয়ে কোরানের মর্মার্থ কে বিকৃত করে সে অভিযোগ তুলল বন্ধুটি। আমি যখন লিখলাম, “পৌত্তলিকরা ইসলাম প্রত্যাখ্যান করলে কোরান তাদেরকে গণহারে হত্যার নির্দেশ দিয়েছে” এবং এ প্রসঙ্গে কোরান ৯/৫ আয়াতটির উদ্ধৃতি দিলামঃ “অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হলে মুশরিকদের যেখানে পাও হত্যা কর, বন্দী কর এবং অবরোধ কর। তাদের সন্ধানে ঘাঁটিতে ঘাঁটিতে ওঁৎ পেতে বসে থাক। কিন্তু যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও” — তখন সে আমার বিরুদ্ধে আয়াতটির প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতির অভিযোগ তুলে লিখে পাঠালোঃ
“কোরান সম্পর্কে মিথ্যে ধারনার মূলে রয়েছে কোরানের প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতি। যেমন তুমি যখন কোরান ৯/৫ আয়াতটির উদ্ধৃতি দিলে, তখন পরবর্তী আয়াতটি অগ্রাহ্য করলে, যাতে পৌত্তলিকদেরকে শুধু আশ্রয় নয়, নিরাপদ স্থানে পৌছে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছ (৯/৬ — “পৌত্তলিকদের কেউ তোমাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করলে তাদেরকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পারে। এবং তাকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দাও।”
আমি অন্য পাঠকদের কাছ থেকওে ঠিক একই ভাষায় প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতি দিয়ে আয়াতটির মর্মার্থ বির্কত করার অভিযোগ পেয়েছি বহুবার। সমালোচকরা কোরানের অর্থ বিকৃত করার অভিপ্রায়ে এ ধরনের প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতি দেয় কিনা, সে ব্যাপারে একটা রচনা লেখার কথা ভেবেছি অনেকবার। এবার কাছের একজন বন্ধুর কাছ থেকে অভিযোগটি পাওয়ার পর রচনাটি লিখে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলাম।
উল্লেখ্য, ১২-১৩ বছর আগে একজন মডারেট মুসলিম হিসেবে আমি নিজেই মুক্তমনা, ফ্রেইথফ্রিডম (faithfreedom.org) ইত্যাদি ওয়েবসাইটে ইসলামের সমালোচনাকারী লেখকদের বিরুদ্ধে কোরানের অপব্যাখ্যা বা প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতির অভিযোগ তুলতাম। তখনও আমি কোরান-হাদিস পড়ে দেখি নি। কিন্তু পরে যখন কোরান-হাদিস ঘাটতে শুরু করলাম এবং তাফসীর থেকে কোরানের কিছু আয়াতের প্রেক্ষাপট খুটিয়ে দেখতে লাগলাম, তখন বেশকিছু আয়াতের মর্মার্থ আপাতঃদৃষ্টিতে যা মনে হয়, তার চেয়ে আরও জঘন্য প্রতিপন্ন হতে লাগল।
কোরানের আয়াতের প্রেক্ষাপট থাকতে পারে কি? আমার বন্ধুটি সহ অন্যান্য মুসলিমরা কোরান ৯/৫ আয়াতটির প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতির অভিযোগ তুলে প্রেক্ষাপট হিসেবে পরবর্তি আয়াতটির উদ্ধৃতি দেয়। মজার ব্যাপার হচ্ছেঃ মুসলিমরা দাবী করে যে, ইসলাম হচ্ছে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। তাহলে কোরানের আয়াতগুলো কি জীবন বিধান বা পথ নির্দেশনার বাণী, নাকি এক আয়াত আরেক আয়াতের প্রেক্ষাপট? আর কোরান ৯/৬ যদি ৯/৫ আয়াতের প্রেক্ষাপট হয়, তাহলে কোরান ৯/৭ কি ৯/৬ আয়াতের প্রেক্ষাপট? একইভাবে কোরান ৯/৮ কি ৯/৭ আয়াতের প্রেক্ষাপট? ইত্যাদি!
প্রেক্ষাপট হচ্ছে অবস্থা বা পটভূমি, যার ভিত্তিতে কোন বক্তব্য দেওয়া হয় বা ঘটনা ঘটে। অথচ কোরানের ৮৫/২১ ও ১৫/৯ আয়াত দুটি দাবী করছে যে, কোরান হচ্ছে স্বয়ং আল্লাহর হাতে লৌহ-মাহফুজে লিখিত ও বেহেস্তে সংরক্ষিত মূল কোরান (mother book)-এর অনুলিপি। ইসলামী পণ্ডিতরা দাবী করে যে, আল্লাহ লৌহ-মাহফুজে কোরান লিপিবদ্ধ করেছিলেন বিশ্ব সৃষ্টিরও আগে। কোরানের এ দাবী যদি সত্যি হয়, তাহলে সপ্তম শতকে মক্কায় কি ঘটছিল, বা পৌত্তলিকরা কি বলছিল, তা কিভাবে কোরানের আয়াতগুলোর প্রেক্ষাপট হয়। অতীত-ভবিষ্যৎ সহ বিশ্ব-ব্রমাণ্ডের সকল জ্ঞানের অধিকারী আল্লাহ অবশ্যই জানেন মানুষের জীবন চলার বিধান বা পথ-নির্দেশনা কী হবে। তাকে সপ্তম শতাব্দীতে শুধুই আরব দেশে ঘটিত ঘটনাবলীর প্রেক্ষাপটে বিশ্বের সব মানুষের জন্য জীবনবিধান রচনা করতে হয় কি?
সঠিক অর্থে একটা বিশেষ সময়ে ও অঞ্চল বা জনগোষ্ঠীর জীবনে ঘটিত পটিভূমি কোরানের আয়াতগুলোর প্রেক্ষাপট হতে পারে না, কেননা আল্লাহ কোন বিশেষ সময় ও অঞ্চলে ঘটিত ঘটনার পটভূমিতে কোরান রচনা করতে পারেন না। অথচ কোরানের সুরাগুলো নাজিল হওয়ার ধারাবাহিকতায় পড়লে এবং নাজিলের সময়ে নবীর ব্যক্তিগত অবস্থা বিবেচনা করলে স্পষ্ট হয়ে উঠে যে, কোরানের আয়াত বা সুরাগুলো মূলত নবীর ব্যক্তিগত অবস্থা, কামনা-বাসনা ও চাওয়া-পাওয়ার ভিত্তিতে রচিত হয়েছিল। হাদিস, নবীর জীবনী (সিরাত) ও তাফসীর গ্রন্থে কোরানের অনেক আয়াতের বা পুরো সুরার প্রেক্ষাপট বর্ণিত হয়েছে। এবং যেসব আয়াত বা সুরাগুলো আপাতঃদৃষ্টিতে কিছুটা মানবিক বা সহনশীল মনে হয়, সেগুলোকে প্রেক্ষাপট-সহ পড়লে তা আর মনে হয় না, বরং তাদের বক্তব্য আরও জঘন্য হয়ে উঠে।
প্রেক্ষাপট কোরানের ৯/৫ আয়াতকে শান্তির বাণী বানায় কি? আয়াতটি সম্পর্কে কোরানের সুবিখ্যাত তাফসীরকারক ইবনে কাসির লিখেছেনঃ
'এ মহিমান্বনিত আয়াতটিকে বলা হয় তলোয়ারের আয়াত, যার সম্পর্কে আদ-দাহহাক বিন মুজাহিম বলেছেন, “এটা নবী ও পৌত্তলিকদের মাঝে বিদ্যমান সকল চুক্তিপত্র ও সকল বোঝাপড়া বাতিল করে দেয়।”'
৯/৫ আয়াতটি বলছেঃ “পবিত্র মাসগুলো পার হতেই পৌত্তলিকদেরকে যেখান পাও হত্যা কর… তবে যদি তারা তওবা করে, নামায কায়েম করে, যাকাত দেয়, তবে তাদের পথ ছেড়ে দাও।”
নবীর যুগে আরব পৌত্তলিকরা বছরের চারটি মাসকে (রজব, জুল কাদাহ, জুল হিজ্জাহ ও মহররম) পবিত্র মাস হিসেবে গণ্য করতো এবং সে মাসগুলোতে হানাহানি, রক্তপাত ইত্যাদি থেকে বিরত থাকতো। সুতরাং আয়াত ৯/৫-এর প্রেক্ষাপট-বিহীন অর্থ হচ্ছেঃ
পবিত্র মাস চারটি পার হলেই পৌত্তলিক কাফেরদেরকে যেখানে পাও হত্যা কর… এবং এমতাবস্থায় তারা যদি তওবা করে দৃশ্যত নামাজ-যাকাত ইত্যাদি কায়েম করে, অর্থাৎ ধার্মিক মুসলিম হয়ে যায়, তাহলে তাদেরকে ছেড়ে দাও।
দেখা যাক, ইবনে কাসির আয়াতটির ব্যাখ্যায় কি বলেছেনঃ
"আল্লাহ তারপর বলছেন, ‘পবিত্র চারটি মাস — যখন পৌত্তলিকদের সাথে যুদ্ধ করা নিষিদ্ধ এবং যা তাদের জন্য এবং যা তাদের জন্য করুনার সময় — অতিক্রান্ত হলেই পৌত্তলিকদের সাথে যুদ্ধ করো, তাদেরকে যেখানে পাও হত্যা করো (তবে কাবা প্রাঙ্গন বাদ দিয়ে)। এবং তাদের কিছু সংখ্যককে জবাই করো, বাকীদেরকে বন্দী করে রাখো। তারা তোমাদের নাগালে আসার জন্য অপেক্ষা না কোরে তাদের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ো এবং তাদের নিজস্ব এলাকা বা দূর্গে তাদেরকে আটকে রাখো, তাদের সম্পর্কে খোজখবর সংগ্রহের জন্য রাস্তাঘাটে গোয়ান্দা লাগাও, যাতে তারা কোনঠাসা হয়ে পড়ে। এভাবে তৎপরতা চালালে তাদের কাছে মৃত্যুবরণ কিংবা ইসলাম গ্রহণ বিনা অন্য উপায় থাকবে না। আর যদি তারা অনুতপ্ত হয়, নামাজ আদায় করে, এবং যাকাত দেয়, তাহলে তাদের রাস্তা মুক্ত করে দাও। … খলিফা আবু বকর এই আয়াত অনুসারে যাকাত না-প্রদানকারীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতেন। আয়াতটি কাফেরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ জায়েজ করেছে, যতক্ষণ-না তারা ইসলাম গ্রহণ করে এবং ইসলামের আচার-কানুন মেনে চলে।"
উপরে উল্লেখিত আয়াতটির প্রেক্ষাপট-বিহীন অর্থ আর ইবনে কাসিরের ব্যাখ্যায় এর অর্থ প্রায় একই থেকে যাচ্ছে, কিংবা ইবনে কাসিরের ব্যাখ্যায় অধিক জঘন্য হয়ে উঠছে, নয় কি?
এখন দেখা যাক, মুসলিমদের দাবীকৃত প্রেক্ষাপট আয়াত ৯/৬ কি বলছে, এবং তা ৯/৫ আয়াতের অর্থ পরিবর্তন করে কি না? কোরান ৯/৬ বলছেঃ “পৌত্তলিকদের কেউ তোমাদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করবে, তাদেরকে আশ্রয় দাও, যাতে সে আল্লাহর বাণী শুনতে পারে। এবং তাকে নিরাপদ স্থানে পৌছে দাও।”এটা সুস্পষ্ট যে, আয়াতটি জীবন-বিপন্ন পৌত্তলিকদের মুসলিমদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনার কথা বলছে। তার মানে দাড়ায়ঃ আগের ৯/৫ আয়াতে দেওয়া নির্দেশের ভিত্তিতে মুসলিমরা যখন পৌত্তলিকদেরকে হত্যা করা শুরু করবে, এমতাবস্থায় জীবন বাচাতে তাদের কেউ যদি মুসলিমদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করে, যার ফলে তার ইসলামের বাণী গ্রহণের সুযোগ হতে পারে, তাহলে তাকে আশ্রয় দাও, নিরাপত্তা দাও। ৯/৬ আয়াতটির ব্যাখ্যায় ইবনে কাসির লিখেছেনঃ
"আল্লাহ নবীকে বলেন, যদি কোন পৌত্তলিক (মুশরিক) — যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে এবং যাদের রক্ত ও ধন-সম্পত্তি তোমাদের জন্য বৈধ করা হয়েছে — তোমাদের কাছে নিরাপত্তা চায়, তাহলে তার অনুরোধ মঞ্জুর কর, যাতে সে আল্লাহর বাণী পবিত্র কোরান শুনার সুযোগ পায়। তাকে কোরান আবৃত্তি করে শোনাও, ইসলামের বিশেষ অংশ তার সামনে তুলে ধরো যা আল্লাহর সত্যতা প্রমাণিত করবে। এবং তাকে তার দেশ, বাড়ি বা নিরাপদ জায়গায় পৌছে দাও। …আয়াতটি বলছে, ‘আমরা এ ধরনের কাফেরকে পিরাপত্তা দিচ্ছি যাতে সে আল্লাহর ধর্ম সম্পর্কে জানার সুযোগ পায়, যার ফলে আল্লাহর ধর্ম তার বান্দাদের মাঝে বিস্তারের সুযোগ হয়।”"
মোটকথা হচ্ছেঃ ৯/৬ আয়াতটির যদি ৯/৫ আয়াতের সাথে আদৌও কোন সম্পর্ক থেকে থাকে, তাহলে প্রেক্ষাপট নয়, বরং পরিণাম, কেননা ৯/৫ আয়াতে নির্দেশিত মুশরিকদেরকে গণহারে হত্যার মুখে পতিত হওয়ার পর যদি তাদের কেউ ইসলামের বাণী শুনার আগ্রহ ব্যক্ত করে আশ্রয় প্রার্থনা করে, তাহলে তাকে আশ্রয় ও নিরাপত্তা দানের কথা বলা হয়েছে আয়াতটিতে। সুতরাং বলা যায়, ৯/৫ আয়াতটি প্রকৃতপক্ষে ৯/৬ আয়াতের প্রেক্ষাপট। কাজেই ৯/৬ আয়াতকে ৯/৫ আয়াতের প্রেক্ষাপট হিসেবে উপস্থাপন বা দাবী অর্থহীন বা অসাধু প্রচেষ্টা মাত্র।
প্রশ্ন হচ্ছেঃ যেসব পৌত্তলিকরা তাদের ধর্মে অটুট থাকবে, এবং মুসলিমদের কাছে প্রাণভিক্ষা চাবে না, তাদের ধর্মের বাণী শুনতে চাবে না, তাদের কী হবে? ৯/৫ আয়াতের অর্ডার অনুযায়ী যেখানে পাও হত্যা বৈ আর কিছুই নয়। সুতরাং ৯/৬ আয়াতের বক্তব্য কোনক্রমেই ৯/৫ আয়াতের বর্বরতামূলক বক্তব্যকে এক বিন্দুও পরিবর্তিত করে না।
অবশ্য ইবনে কাসির ও মওদুদী প্রমুখ তাফসীরকারকগণ আয়াতটির দ্বিতীয় এক ব্যাখ্যায় বলেছেন যে, আয়াতটি বহির্দেশ বা বহিরাঞ্চল থেকে যারা মুসলিমদের কাছে আসবে, যাদেরকে ইসলামী বিধানে ‘মুস্তামিন’ বলা হয়, তাদের কথা বলছে। এ প্রসংগে ইবনে কাসির লিখেছেনঃ
"…এই আয়াতটি “তাদের কথা বলছে, যারা তোমাদের কাছে আসে তোমরা কি বলো ও তোমাদের কাছে কি নাজিল করা হয়েছে, তা শুনতে (ও মুহাম্মদ)। সুতরাং সে নিরাপত্তা পাবে যতক্ষণ সে তোমাদের কাছে আসবে, আল্লাহর বাণী শুনবে এবং অতঃপর নিরাপদ স্থানে চলে যাবে, যেখান থেকে সে এসেছে।”
আয়াতটি যদি বিদেশী আগন্তুকদের কথা বলছে, তাহলে ৯/৫ আয়াতে যুদ্ধ ঘোষণাকৃত পৌত্তলিকদের সাথে ৯/৬ আয়াতে উল্লেখিত কাফের ব্যক্তির কোন সম্পর্কে নেই। অর্থাৎ ৯/৫ ও ৯/৬ আয়াতের বক্তব্য গুলো পরষ্পর সম্পর্কহীন। সেক্ষেত্রে, ৯/৬ আয়াতটি ৯/৫ আয়াতের বক্তব্যকে পরিবর্তিত বা প্রভাবিত করার প্রশ্নই উঠে না।
সুতরাং ৯/৫ ও ৯/৬ আয়াত দুটি একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত হোক বা না-হোক, তাতে ৯/৫ আয়াতে দেওয়া পবিত্র মাস পার হতেই পৌত্তলিকদের গণহারে হত্যার আদেশে কোনই পরিবর্তন হয় না, বড় জোর ৯/৬ আয়াতটি ৯/৫ আয়াতের কাফের হত্যার বক্তব্যকে সমর্থন দেয়, দৃঢ়তর করে। সুতরাং ৯/৫ আয়াতটির সাথে ৯/৬ আয়াতটি উদ্ধৃত করা হোক বা না-হোক, ৯/৫ আয়াতের বর্বরতামূলক বক্তব্য বর্বরতামূলকই থেকে যায়, শান্তির বাণী হয়ে উঠে না।
কোরানকে শান্তির বাণী প্রমাণে মুসলিমদের প্রেক্ষাপট-বিহীন আয়াতের উদ্ধৃতি
শুরুতে বলা হয়েছে, যেসব মুসলিমরা সমালোচকদের বিরুদ্ধে কোরানের আয়াতের প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতির অভিযোগ তোলে, তারাই কোরান থেকে গোটা-তিনেক আয়াতের প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতি দেয়। আয়াতগুলো হচ্ছেঃ
· (কোরান ৫/৩২) “যে কেউ প্রাণের বিনিময়ে প্রাণ অথবা পৃথিবীতে অনর্থ সৃষ্টি করা ছাড়া কাউকে হত্যা করে সে যেন সব মানুষকেই হত্যা করে। এবং যে কারও জীবন রক্ষা করে, সে যেন সবার জীবন রক্ষা করে।”
· (কোরান ২/২৫৬) “ধর্মের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই।”
· (কোরান ১০৯/৬) “তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার”
ইসলামকে পরম শান্তির ধর্ম প্রমাণে মুসলিমরা উপরোক্ত আয়াতগুলোকে এভাবে উদ্ধৃত করার মাধ্যমে দুই পর্যায়ে প্রতারণার আশ্রয় নেয়ঃ (১) আয়াতগুলোর প্রেক্ষাপট-বিহীন উদ্ধৃতি, (২) আয়াতগুলোর কাটছাট করে উদ্ধৃতি। এ দ্বৈত প্রতারণার ফলে আয়াতগুলোর মর্মার্থ আসল বক্তব্যের তুলনায় ভাল বা মানবিক মনে হয়। এখানে ২/২৫৬ ও ১০৯/৬ আয়াত দু’টো সংক্ষেপে এবং ৫/৩২ আয়াতটি কিছুটা বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
কোরান ২/২৫৬ — আয়াতটি নাজিল হয়েছিল ৬২৫ সালে নবীর মদীনা থেকে বানু নাদির ইহুদী গোত্রটিকে বহিস্কারের প্রেক্ষাপটে। প্রথমে দেখা যাক পুরো আয়াতটি কি বলছেঃ
"ধর্মের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে সত্যপথ অপকর্মের পথ থেকে পৃথক হয়ে গেছে। যারা কুপথ বর্জন করবে এবং একমাত্র আল্লাহতে বিশ্বাস স্থাপন করবে, তারা ধরবে সুদৃঢ় হাত যা ভাংবার নয়। আল্লাহ সবই শুনেন ও জানেন।" (কোরান ২/২৫৬)
দেখুন, আয়াতটিকে কাটছাট করে উদ্ধৃত করে প্রতারক মুসলিমরা এর বক্তব্যকে কতটা সুন্দর করে তোলে? আয়াতটির বক্তব্যের বড় অংশ হচ্ছেঃ মুসলিমদের পথ সত্যপথ, অমুসলিমদের পথ অপকর্মের (কুকর্মের) পথ, যা মুসলিমদের কাটছাট উদ্ধৃতিতে বাদ পড়েছে। যেসব মডারেট মুসলিমরা আয়াতটিকে এভাবে কাটছাট করে উদ্ধৃতি দেয়, তাদেরকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় — তোমরা কি মনে করো খৃষ্টান, ইহুদী, বৌদ্ধ ও হিন্দুরা সবাই অপকর্ম কর বেড়ায়, তাদের বেশীরভাগই না-সূচক উত্তর দেবে।
এখন দেখা যাক, আয়াতটির প্রেক্ষাপট কি? আয়াতটি নাজিলের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণে ইবনে কাসির নিম্নোক্ত হাদিসটি (সুনান আবু দাউদ ১৪/২৬৭৬) উদ্ধৃত করেছেনঃ
"ইসলাম-পূর্ব যুগে যখন আনসার মহিলাদের সন্তান বাচতো না, তখন তারা পণ করতো তাদের কোন সন্তান বেচে থাকলে তাকে ইহুদী হিসেবে বড় করবে। যখন নবী (সঃ) বানু নাদের গোত্রটিকে মদীনা থেকে বহিস্কার করেন, তখন আনসার পরিবারের কিছু সন্তান ইহুদীদের মাঝে বড় হচ্ছিল। এবং তারা বলল, “আমরা আমাদের সন্তানদেরকে যেতে দেব না।” তখন আল্লাহ নাজিল করলেন, “ধর্মের ব্যাপারে কোন জবরদস্তি বা বাধ্য-বাধকতা নেই। নিঃসন্দেহে সত্যপথ অপকর্মের পথ থেকে পৃথক হয়ে গেছে…”"
প্রেক্ষাপট বিবেচনা করলে আয়াতটির মোটামুটি অর্থ দাঁড়ায়ঃ ইসলাম যেহেতু সত্যপথ এবং ইহুদীদের পথ অপকর্মের, কাজেই মুসলমান আনসারদের সন্তানদেরকে ইহুদী হিসেবে বড় হতে বাধ্য করা ঠিক না। কাজেই আয়াতটি নাজিলের মাধ্যমে আনসারদের সন্তানকে ইহুদীদের কাছ থেকে মুসলিম বাবা-মার কাছে ফিরিয়ে আনা হল, যদিও তাদের বাবা-মা তাদেরকে ইহুদী হিসেবে বড় করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিল। (মুসলিমরা যদি মনে করে আয়াতটির এ মর্মার্থ সঠিক নয়, তাহলে উপরোক্ত প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে আয়াতটির ভিন্ন অর্থ দাড় করানোর মুসলিমদেরকে চ্যালেঞ্জ করা হচ্ছে।)
এই যদি হয় আয়াতটির মূল মর্মার্থ এবং সেই সাথে আয়াতটিতে অমুসলিমদের ধর্মের পথকে অপকর্মের বা কুপথ বলায় আয়াতটির বক্তব্য আদৌও ভাল কিছু বা শান্তিমূলক নয়, বরং অনেকাংশে তার বিপরীত।
কোরান ১০৯/৬ — “তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার”। এই আয়াতটি “আল-কাফিরুন” বা “বিধর্মী” শীর্ষক সুরার অংশ। ইবনে কাসিরের তাফসীর মতে, নবীর সাথে ধর্মীয় বিবাদ মীমাংসাকল্পে মক্কার পৌত্তলিক নেতৃবৃন্দ প্রস্তাব করে যে, মুসলিমরা ইসলামের পাশাপশি তাদের পিতৃধর্ম মেনে চললে পৌত্তলিকরাও ইসলাম মেনে চলবে এবং সে প্রস্তাবটি নাকচ করে দিতে আল্লাহ নাজিল করলেনঃ “বলুন, হে কাফেরকূল… তোমাদের ধর্ম তোমাদের, আমার ধর্ম আমার।”
আয়াতটির সঠিক মর্মার্থ অনুধাবনে করতে হলে মক্কায় নবীর সাথে পৌত্তলিক কুরাইশদের বিবাদের প্রেক্ষাপট বোঝা জরুরী। আয়াতটি নাজিল হয় ৬১৫ সালের দিক। এ সময়ে নবীর শিষ্যসংখ্যা ছিল মাত্র ৮০-৯০ জন। এর আগেই নবী মক্কাবাসীর ধর্ম, ঈশ্বর ও সংস্কৃতিকে অপমান করে আসছিল। এ প্রসঙ্গে ইবনে ইসহাক লিখেছেনঃ
"নবী যখন আল্লাহর নির্দেশ অনুযায়ী খোলামেলা ইসলাম প্রচার শুরু করলে আমার জানামতে জনগণ (কুরাইশরা) তার বিরুদ্ধাচরণ করে নি, যতক্ষণ-না নবী তাদের ঈশ্বরদেরকে অপমান করা শুরু করলেন। এতে তারা খুবই কষ্ট পেলো এবং নবীকে শত্রু হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নিলো।" (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ১১৮)
এক পর্যায়ে রাগান্বিত কুরাইশ নেতারা নবীর চাচা ও অভিবাবক আবু তালেবের কাছে গিয়ে নবীকে তাদের ঈশ্বর, ধর্ম, আচার-সংস্কৃতি ও পূর্বপুরুষদের অবমাননা করা থামাতে বললেও নবী থামলেন না (ইবনে ইসহাক, পৃঃ ১১৯)। এ রকম উত্তপ্ত ধর্মীয় বিবাদের পটভূমিতে মক্কার পৌত্তলিক নেতাগণ নবীকে ডেকে এনে দুপক্ষ একে অপরের ধর্ম মেনে চলার প্রস্তাব করলে তা নাকচ করে দিতে এই আয়াতটি নাজিল হয়। মক্কার দুই মতের মানুষের মিলেমিশে শান্তিতে বসবাসের জন্য বাহুবলে অত্যন্ত দুর্বল নবীর প্রতি কুরাইশ নেতাগণের এ প্রস্তাবটি অবশ্যই যথেষ্ট উদারতা, সহনশীলতা ও শান্তিপ্রিয়তার পরিচয় বহন করে। এবং কোরানের এ কথিত সর্বোচ্চ শান্তির বাণীটি কুরাইশদের সে বদান্যতামূলক প্রস্তাবটিকে নাকচ করে দিল, মক্কার জনতাকে শুধুই ধর্মীয় মতানৈক্যের কারণে চিরতরে বিভক্ত করে দিল, শান্তিপূর্ণ সহবাসের সুযোগ প্রত্যাখ্যান করে অন্তহীন বিবাদ ও সঙ্ঘাতের পথ উন্মুক্ত করে দিল। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, আপাতঃদৃষ্টিতে সর্বোচ্চ শান্তির বার্তা বহনকারী এ আয়াতটিকে নাজিল হওয়ার প্রেক্ষাপটে বিবেচনা করলে, তা শান্তি ও সম্প্রীতির প্রতীক না-হয়ে বরং অশান্তি, বিভাজন ও সংঘাতের প্রতীক হয়ে উঠে।
কোরান ৫/৩২ — ইসলাম বা কোরানকে প্রকৃত শান্তির প্রতীক হিসেবে উপস্থাপিত করতে মুসলিমরা সবচেয়ে বেশী উদ্ধৃত করে এই আয়াতটি এবং কাটছাট করে ও প্রেক্ষাপট বাদ দিয়ে, যার ফলে এর মর্মার্থ ব্যাপক বদলে যায়। যেমন উপরোক্ত বন্ধুটি আয়াতটির উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে আমাকে লিখলোঃ
…তুমি যখন কোরানের ৯/৫ আয়াত সম্পর্কে এমন নেতিবাচক মন্তব্য করছো, তখন কি ৫/৩২ আয়াতটি সম্পর্কে ভেবে দেখেছো, যা বলছেঃ “…যদি কেউ হত্যা বা দুনিয়াতে অনর্থ সৃষ্টির কারণ বিনা কাউকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করলো, আর কেউ যদি একটি জীবন বাঁচালো, সে যেন সব মানুষের জীবন বাচাঁলো…”
মজার ব্যাপার হচ্ছে, কোরানে যদিও ৯/৫ আয়াতের মত অনেকগুলো রয়েছে, যা মুসলিমদেরকে অমুসলিম ও তাদের দোসরদের উপর অবাদ নির্যাতন, সন্ত্রাস, নির্মমতা, এমনকি বর্বরতা, চর্চার আদেশ দিয়েছে, সেখানে কোরানের এই একটি মাত্র আয়াত (৫/৩২) দিয়ে মুসলিমরা কোরান ও ইসলামকে শান্তির ফুয়ারা প্রমাণ করতে চায়। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে, অসাধুতা চর্চা না করে যদি আয়াতটির পুরো উদ্ধৃতি দেওয়া হয় এবং আগে-পীছের আয়াতের সাথে মিলিয়ে পড়া হয়, তাহলে আয়াতটির অর্থ একেবারেই বদলে যায়। এমনকি আমরা দেখব যে, আল্লাহ আয়াতটি ইহুদী ধর্মগুরুদের নৈতিক বিধানের গ্রন্থ তলমুদ থেকে চুরি করে নিয়েছেন। প্রথমে দেখা যাক, পুরো আয়াতটি কি বলছেঃ
“সে কারণে আমরা ইহুদীদের জন্য বিধান দিয়েছিলাম যে, যদি কেউ হত্যা বা দুনিয়াতে অনর্থ সৃষ্টির কারণ বিনা কাউকে হত্যা করে, তাহলে সে যেন পুরো মানবজাতিকে হত্যা করলো, আর কেউ যদি একটি জীবন বাচালো, সে যেন সব মানুষের জীবন বাচালো। তথাপি যদিও তাদের কাছে আমাদের পয়গম্বরগণ এসেছে সুস্পষ্ট নিদর্শনাবলী নিয়ে, তারপরও তাদের অনেকে পৃথিবীতে সীমা লংঘন করতে থাকে।” (৫/৩২)
যদিও আমার বন্ধুটি আমাকে ৯/৫ আয়াতটির সাথে পরের ৯/৬ আয়াতটি উল্লেখ না-করার ব্যাপারে অভিযোগ তুলেছে, সে নিজেই ৫/৩২ আয়াতটির কাটছাট করে উদ্ধৃতির পাশাপাশি আগের ও পরের আয়াতগুলো বাদ দিয়েছে, যা আয়াতটির সঠিক মর্মার্থ অনুধাবনের জন্য অপরিহার্য এবং তা আয়াতটির বক্তব্য ব্যাপক বদলে দেবে। বিষয়গুলো একে একে আলোচনা করা হবে।
১) কাটছাট করে উদ্ধৃতি দিয়ে ৫/৩২ আয়াতের মর্মার্থ বিকৃতকরণঃ লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে, আমার বন্ধুটি আয়াতটির প্রথম অংশ — “সে কারণে আমরা ইহুদীদের জন্য বিধান দিয়েছিলাম যে…” — কেটে দিয়েছে, যা স্পষ্ট করে বলছে যে, আয়াতটির হত্যা সম্পর্কিত বিধান আল্লাহ ইহুদীদের উপর অর্পন করেছিলেন। লক্ষ্য করুন যে, পুরো আয়াতটি অতীত কালের (পাস্ট টেন্স) ভাষায় লিখিত, কাজেই আয়াতটির বিধান কেবলই ইহুদীদের জন্য প্রযোজ্য। এর বিধান মুসলিমদের উপর প্রযোজ্য হতে হলে আয়াতটি বর্তমান বা ভবিষ্যত কালের (প্রেজেন্ট বা ফিউচার টেন্স) ভাষায় লিখিত হতে হবে। কাজেই, এই আয়াতের বিধান আদৌও মুসলিমদের উপর প্রযোজ্য নয়।
২) পরবর্তি ৫/৩৩ আয়াতটি বাদ দিয়ে ৫/৩২ আয়াতের উদ্ধৃতিঃ এ প্রসঙ্গে মুসলিমদের জন্য প্রযোজ্য হচ্ছে বর্তমান-ভবিষ্যৎ কালের ভাষায় রচিত পরবর্তি আয়াতটি (৫/৩৩), যাতে অনুরূপ অপরাধের শাস্তির বিধান বর্ণিত হয়েছেঃ
"যারা আল্লাহ ও তাঁর রসূলের ধর্মের বিরুদ্ধে প্রয়াস করে এবং দেশে অনর্থ সৃষ্টি করতে সচেষ্ট হয়, তাদের শাস্তি হবেঃ হত্যা, বা শূলে চড়ানো অথবা হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা কিংবা দেশ থেকে বহিষ্কার করা। এ হল তাদের জন্য পার্থিব লাঞ্ছনা আর পরকালে তাদের জন্যে রয়েছে কঠোর শাস্তি।" (কোরান ৫/৩৩)
কোরান কী অপূর্ব শান্তির খনি? আজ বিশ্বের বেশীরভাগ দেশ মৃত্যুদণ্ডই উঠিয়ে দিয়েছে, তা অপরাধী যত বড় গর্হিত অপরাধই করুক না কেন। অথচ পরম শান্তির খনি পবিত্র কোরান এ আয়াতে অপরাধীদেরকে শূলে চড়িয়ে হত্যা বা হাত-পা বিপরীত দিকে থেকে কেটে ফেলার চরম বর্বরতামূলক বিধান স্বর্গ থেকে নামিয়ে এনেছে, যার বৈধতা থাকবে অনন্তকালের জন্য। এবং এমন চরম বর্বরতামূলক শাস্তির জন্য কী অপরাধ করতে হবেঃ আল্লাহ ও তার নবীর ধর্মের বিরোধিতা করা অথবা “দেশে অনর্থ সৃষ্টি” করা। দেখা যাক, “দেশে অনর্থ সৃষ্টি” বলতে কোরান কী বোঝাচ্ছে? কোরানের ৭/১০৩ আয়াতের এ ব্যাপারে সুস্পষ্ট ধারনা দেওয়া হয়েছেঃ
"তারপর আমরা আমাদের বাণীসহ মুসাকে পাঠালাম ফেরাউন ও তার সভাসদদের নিকট এবং তারা সেগুলো অন্যায়ভাবে প্রত্যাখ্যান করলো। কাজেই দেখ, যারা অনর্থ সৃষ্টি করেছে তাদের কী পরিণতি হয়েছে?"
আয়াতটি বলছে যে, ফেরাউন ও তার সভ্যবর্গ কর্তৃক আল্লাহ বাণী প্রত্যাখ্যান মানেই হলো দুনিয়াতে অনর্থ সৃষ্টি। সুতরাং কেউ ইসলাম ধর্ম বা আল্লাহর বাণী কোরান প্রত্যাখ্যান করলেই, তা হবে দুনিয়াতে অনর্থ সাধনের সামিল এবং তাদের শাস্তি হবে শূলে চড়িয়ে হত্যা, হাত-পা বিপরীত দিক থেকে কেটে ফেলা বা নির্বাসিত করা। উল্লেখ্য বিশ্বের সকল ধর্মনিরপেক্ষ দেশ-সহ ও জাতিসংঘের সংবিধানে কেউ ইসলাম-সহ যে কোন ধর্ম গ্রহণ করবে কি করবে না তা ব্যক্তির মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃত। অথচ ইসলামের ক্ষেত্রে কেউ এ মানবাধিকারটি চর্চা করলে তাকে শূলে চড়িয়ে হত্যা করা হবে বা হাত-পা কেটে দেওয়া হবে কোরানের বিধানে। বর্বরতা আর কাকে বলে?
৩) প্রেক্ষাপট আয়াত ৫/২৭-৩১ বাদ দিয়ে ৫/৩২ আয়াতের উদ্ধৃতিঃ ৫/৩২ আয়াতের আগের কয়েকটি আয়াত মূলত এই আয়াতটির প্রেক্ষাপট হিসেবে কাজ করে এবং আয়াতটির মর্থার্থ বোঝার জন্য জরুরী। অথচ মুসলিমরা সে আয়াতগুলো বাদ দিয়ে এ আয়াতটির উদ্ধৃতি দেয়। দেখা যাক, সে আয়াতগুলো কি বলছেঃ
· আপনি তাদেরকে আদমের দুই পুত্রের কাহিনী পড়ে শুনান, যখন তারা উভয়েই আল্লাহর কাছে উৎসর্গ নিবেদন করেছিল, এবং আল্লাহ একজনেরটা গ্রহণ করেছিলেন, অপরজনেরটা করনে নি। সে বললঃ “আমি তোমাকে হত্যা করব।” এবং সে জবাব দিলঃ “আল্লাহ কেবল ধার্মিকদের কাছে থেকেই উৎসর্গ গ্রহণ করেন।” (৫/২৭)
· তুমি আমাকে হত্যা করতে হাত উঠালেও আমি তোমাকে হত্যা করতে হাত উঠাব না। কেননা, আমি বিশ্বজগতের পালনকর্তা আল্লাহকে ভয় করি। (৫/২৮)
· আমি চাই, তুমি আমার পাপ ও তোমার পাপ নিজ মাথায় চাপিয়ে নাও, যাতে তুমি দোযখীদের অন্তর্ভূক্ত হও। এটাই অপকর্মকারীদের শাস্তি। (৫/২৯)
· অতঃপর তার হৃদয় ভ্রাতৃহত্যায় প্রবৃত্ত হলো, তাকে হত্যা করল এবং ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেল। (৫/৩০)
· আল্লাহ এক কাক প্রেরণ করলেন। সে মাটি খনন করছিল যাতে তাকে শিক্ষা দেয় যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ কিভাবে আবৃত করবে। সে বললঃ আফসোস, আমি কি এ কাকের সমতুল্যও হতে পারলাম না যে, আপন ভ্রাতার মৃতদেহ আবৃত করি। অতঃপর সে অনুতাপ করতে লাগল। (৫/৩১)
৫/৩২ আয়াতের পূর্ববর্তি এই আয়াতগুলো আদম-এর দুই পুত্রের মাঝে বিবাদের কথা বলছে, যার ফলশ্রুতিতে এক ভাই আরেক ভাইকে হত্যা করেছিলো। এটা ঘনিষ্ট জনের মাঝে ঘটিত বিবাদ। সুতরাং পরবর্তি ৫/৩২ আয়াতে খুব সম্ভব এ ধরনের হত্যার কথাই বলা হয়েছে — ভাইয়ের হাতে হত্যা কিংবা ঘনিষ্ট আত্মীয় বা আপন সম্প্রদায়ের সদস্যদের হাতে হত্যা। ইবনে কাসির আয়াতটির ব্যাখ্যায় ঠিক এমন কথাই বলেছেনঃ
সাইয়িদ বিন জুবায়ের বলেন, “যে আরেক মুসলিমের রক্তপাতে প্রবৃত্ত হয়, সে যেন সকল মানুষের রক্তপাতে প্রবৃত্ত হলো। যে কোন মুসলিমের রক্তপাত রহিত করে, সে যেন সব মানুষের রক্তপাত রহিত করলো।” অধিকন্তু ইবনে জুরাইয়েজ জানায় যে আল-আরাজ বলেছিল যে মুজাহিদ আয়াতটির (যেন সে সমগ্র মানবজাতিকে হত্যা করল) ব্যাখ্যায় বলেনঃ “যে একজন বিশ্বাসীকে (মুসলিমকে) ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে, আল্লাহ দোজখকে তার বাসভূমি বানায়, সে তার উপর রাগান্বিত হবে, তাকে অভিশাপ দেবে, এবং তার জন্য ভয়ঙ্কর শাস্তির ব্যবস্থা করবে যা হবে সব মানুষকে হত্যার সমান…”
পূর্ববর্তি আয়াতগুলোর বক্তব্যের সাথে ইবনে কাসিরের তাফসীর মিলিয়ে পড়লে, এটা সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে, ৫/৩২ আয়াতটি কেবলই এক মুসলিম দ্বারা আরেক মুসলিমের হত্যার কথা বলছে, কাফের বা বিধর্মীদের হত্যার কথা বলছে না। এবং সেটাই যুক্তিযুক্ত, যখন আল্লাহ কেবলমাত্র ইসলাম ধর্মকে প্রত্যাখ্যান করার কারণে কোরানের বহু আয়াতে বিধর্মীদেরকে তিরস্কার, হুমকি, জবাই বা নির্বাসিত করার নির্দেশ দিয়েছেন। এমনকি আল্লাহ পৌত্তলিকদেরকে গণহারে হত্যা করতে নির্দেশ দিয়েছেন মুসলিমদেরকে, যা উপরে আলোচিত হয়েছে। তাহলে একজন মাত্র পৌত্তলিককে হত্যার অপরাধ সমগ্র মানবজাতিকে হত্যার সমান হয় কিভাবে? আল্লাহ কি এত বড় বির্বোধ হতে পারেন?
৪) আয়াত ৫/৩২ আল্লাহর বাণী নয়, ইহুদী ধর্মগুরুদের কাছ থেকে চুরি করাঃ
৫/৩২ আয়াতের মূল উৎস কোরান নয়, তা ইহুদী ধর্মগুরুদের বিধান থেকে চুরি করা। এটি ইহুদী আসমানী কিতাব তৌরিতেও নেই, না আছে খৃষ্টান বাইবেলে। ইহার মূল উৎস ইহুদী তলমুদ, যা শত শত বছর ধরে (খৃষ্টপূর্ব ৫৩৬ অব্দ থেকে ৭০ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে) ইহুদী ধর্মগুরুদের দ্বারা সংগৃহিত নৈতিক ও সামাজিক বিধান। কোরানের ৫/৩২ আয়াতের বাণী মিশনা স্যানহেড্রিন নামক তল্মুদ গ্রন্থের নিম্নোক্ত অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যটিতে উল্লেখিত আছে (ব্যাবীলোনিয়ান তলমুদ, অধ্যায় ৪, মিশনা ৩):
"এটা অনুধাবন করতে পার যে, দেওয়ানি (সিভিল) ও ফৌজদারি (ক্রিমিনাল) মামলার মাঝে ব্যবধান রয়েছে। দেওয়ানী মামলায় কেউ আর্থিক ভর্তুকি দিয়ে নিষ্কৃতি পেতে পারে, কিন্তু ফৌজদারী মামলার ক্ষেত্রে হত্যাকৃত ব্যক্তি ও তার সকল উত্তরসূরীদের রক্তের দায় হত্যাকারী উপর অর্পিত হয়। কেইন-এর ক্ষেত্রে আমরা একই ঘটনা দেখি, যে আপন ভাইকে হত্যা করেছিল। জেনেসিস ৪/১০ বলছেঃ “তোমার ভাইয়ের রক্তগুলোর কণ্ঠস্বর মাটি থেকে কেদে উঠছে আমার কাছে।” আয়াতটি “রক্তের কণ্ঠস্বর” না বলে বলছে “রক্তগুলোর কন্ঠস্বর” – যার মানে তার নিজের ও সকল উত্তরসূরীর রক্ত। […] সুতরাং মানুষকে এককভাবে সৃষ্টি করা হয়েছে এ শিক্ষাদানের জন্য যে, যে একজন মানুষের আত্মাকে ধ্বংশ করলো, ধর্মগ্রন্থ মতে সে যেন সমস্ত দুনিয়াকে ধ্বংশ করলো, আর যে ইহুদীদের একটিমাত্র আত্মাকে বাঁচালো, সে যেন সমগ্র দুনিয়াকে বাঁচালো।"
(You may also be aware of the fact that there is no similarity between civil and criminal cases. In civil cases one may repay the money damage and he is atoned; but in criminal cases the blood of the person executed, and of his descendants to the end of all generations, clings to the originator of his execution. So do we find in the case of Cain, who slew his brother. It reads [Gen. iv. 10]: “The voice of the ‘bloods’ of thy brother are crying unto me from the ground.” It does not read “blood,” but “bloods,” which means his blood and the blood of his descendants. [According to others it reads “bloods” in the plural, because his blood was scattered all over the trees and stones.] Therefore the man was created singly to teach that he who destroys one soul of a human being, the Scripture considers him as if he should destroy a whole world, and him who saves one soul of Israel, the Scripture considers him as if he should save a whole world.)
লক্ষ্য করুণ, ৫/৩২ আয়াতের আগের আয়াতগুলোর মত তলমুদের এ অনুচ্ছেদটি আদম সন্তান আবেল ও কেইন-এর মাঝে বিবাদের কথা বলছে। সুতরাং এটা সুস্পষ্ট যে, কোরানের ৫/৩২ আয়াতটি মূলত তলমুদের উপরোক্ত অনুচ্ছেদের শেষ বাক্যটির পুনরাবৃত্তি। ইহা আল্লাহ বা ইহুদী-খৃষ্টান ঈশ্বরের বাণী নয়, বরং ইহুদী ধর্মগুরুগণ কর্তৃক তৌরিত-এর একটি আয়াতের (জেনেসিস ৪/১০) ব্যাখ্যা মাত্র। বিশেষত ৭০ খৃষ্টাব্দে ফিলিস্তিন থেকে রোমান শাসকদের দ্বারা উৎখাত হওয়ার পর পরবাসে ইহুদী ধর্মগুরুরা এই নৈতিক শিক্ষাটি ঘনঘন উল্লেখ করতো হানাহানি থেকে দূরে থাকার নিমিত্তে। মদীনাতেও ইহুদী ধর্মগুরুরা অবশ্যই এই কথাগুলো চর্চা করতেন। নবী মুহাম্মদ (সঃ) মদীনায় পৌঁছে মারামারি, যুদ্ধ, হত্যা ও লুটপাটে প্রবৃত্ত হওয়ার পর ইহুদীরা নবী তাদের ধর্মের এ গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটির কথা বারবার বলারও সমূহ সম্ভাবনা। যাহোক, এটা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, ৫/৩২ আয়াতটি মূলত তলমুদ গ্রন্থ থেকে চুরি করে নিয়ে আল্লাহ পবিত্র কোরানের স্বর্গীয় আয়াত হিসেবে চালিয়ে দিয়েছেন।
শেষ কথা
এ আলোচনা থেকে জোর দিয়েই বলা যায় যে, কোরানের বর্বরতামূলক আয়াতগুলোকে প্রেক্ষাপট (এবং তাফসীর) সহ যাচাই করলেও সেগুলোর মর্মার্থের কোনই পরিবর্তন হয় না। এ প্রসঙ্গে একটা অতিত অভিজ্ঞতা উল্লেখ্য — মডারেট মুসলিম হিসেবে ১২-১৩ বছর আগে এক সমালোচককে কোরানের আপাতঃ খারাপ আয়াতগুলোকে প্রেক্ষাপটের আলোকে বিচার করতে বললে, সে উত্তর দেয়ঃ প্রেক্ষাপট যুক্ত করলেই “হত্যার নির্দেশ” “চুম্মা খাওয়ার নির্দেশ” হয়ে উঠতে পারে না।
অন্যদিকে, মুসলিমরা ইসলামকে শান্তির ধর্ম এবং কোরানকে শান্তির বাণী প্রতীয়মান করতে যে গোটা-তিনেক আয়াত (৫/৩২, ১০৯/৬, ২/২৫৬) কাটছাট করে ও প্রেক্ষাপট-বিহীন ভাবে উদ্ধৃত করে, সেগুলোকে পুরোপুরি উদ্ধৃত করলে ও প্রেক্ষাপট-সহ বিচার করলে তাদের আপাতঃ সুন্দর মর্মার্থ আরও খারাপ, এমনকি বর্বরতামূলক, হয়ে উঠে।
এক কথায়, কোরানের আয়াতগুলোকে প্রেক্ষাপট-বিহীন ভাবে বিচার করাই ভাল; প্রেক্ষাপট-সহ বিচার করলে ইসলাম আরও অশান্তির, বর্বরতার ধর্ম হয়ে উঠে।
সূত্রঃ
১) ইবনে কাসির তাফসীর, আয়াত ৯/৫-৬,
২) মওদুদী তাফসির, আয়াত ৯/৬ —
৩) ইবনে কাসির তাফসীর, আয়াত ১০৯/৬
৪) ইবনে কাসির তাফসীর, আয়াত ৫/৩২
২০ ডিসেম্বর, ২০১৫