লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ October 29, 2019, 12:00 AM, Hits: 990
অজ্ঞাত ও উপেক্ষিত রানু মণ্ডলের প্রতিভার স্বীকৃতি লাভের পর পশ্চিম বঙ্গ বা ভারতের আর একটি ঘটনা আমাকে খুব নাড়া দিয়েছে। প্রথমটি ছিল আনন্দদায়ক একটি ঘটনা। কিন্তু দ্বিতীয়টি আমাকে মর্মাহত এবং ক্ষুব্ধ করেছে। সেটি হচ্ছে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ রাজ্যের একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং কংগ্রেসের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়কে গত ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় তার বাসস্থান থেকে পুলিশ ও তৃণমূল কংগ্রেসের দলীয় বাহিনী কর্তৃক তুলে নিয়ে সারারাত ধরে তার উপর অকথ্য শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালানো। তার অপরাধ তিনি তার ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমে তৃণমূল কংগ্রেস তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নেতৃত্বাধীন পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের নানান কাজের সমালোচনা করেন।
আজকের এই ইন্টারনেটের যুগে স্থানের দূরত্ব যোগাযোগের পথে বাধা হয়ে থাকে না। বিভিন্ন দেশের সংবাদ জানবার জন্য যেমন আমি বিভিন্ন অনলাইন সংবাদপত্র পাঠ করি তেমন বিশেষত বাংলা ও ইংরাজী বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকেও বিভিন্ন সংবাদ ও মতামত জানতে চেষ্টা করি। ইদানীং আমি অনেকটা সময় দিই ইউটিউবের ভিডিও থেকে বিভিন্ন জনের আলোচনা ও বক্তব্য শুনায়। কয়েক মাস ধরে আমি পশ্চিম বঙ্গের ‘বাংলার বার্তা’ নামক সংবাদ প্রতিষ্ঠানের প্রধান সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের ইউটিউব বক্তব্য নিয়মিতভাবে শুনি। এখন আমার যে কয়জন সবচেয়ে পছন্দের ইউটিউবার আছেন তাদের মধ্যে তিনি একজন। বিশেষত পশ্চিম বঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপরে তার বক্তব্যকে আমি খুব গুরুত্ব দিই। তার তথ্যনির্ভর এবং যুক্তিনিষ্ঠ আলোচনা-সমালোচনা আমাকে মুগ্ধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে তার বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমি পশ্চিম বঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে জীবন্তভাবে অনুভব করি। সত্যি কথা বলতে কি বাচনভঙ্গী এবং তথ্যনির্ভরতার কারণে তাকে আমার একজন অসাধারণ বক্তা মনে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমি বলে রাখতে চাই যে, তার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীকে আমি যে ধারণ করি তা নয়। যেমন তিনি ভারতীয় কংগ্রেস করেন। আমি ভারতের জন্য কংগ্রেসের রাজনীতির তেমন একটা ইতিবাচক দিক আছে সেটা মনে করি না। কিন্তু সেটা আমার একটা ব্যক্তিগত অভিমত। বাংলাদেশের জন্য যেমন তেমন ভারতের জন্যও আমার একটা নির্দিষ্ট বা বিশেষ রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গী আছে। আমার এই দৃষ্টিভঙ্গীর কারণে আমি বাংলাদেশ এবং ভারতের মূলধারার রাজনীতির সমালোচক।
এ প্রসঙ্গে খুব সংক্ষেপে বলতে গিয়ে বলতে হয় যে, বাংলাদেশ এবং ভারতে যে রাষ্ট্র বিদ্যমান রয়েছে সেটা ব্রিটিশ প্রবর্তিত উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছু নয়। অর্থাৎ উপনিবেশিক রাষ্ট্র কাঠামো রক্ষার মাধ্যমে যেটা করা হয়েছে সেটা হচ্ছে বাংলাদেশ এবং ভারত উভয় রাষ্ট্রেই ব্রিটিশ প্রবর্তিত পরশাসনের ঐতিহ্য বা ধারাধাহিকতাকে রক্ষা করা। একই সঙ্গে এই উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রের সামাজিক ভিত্তি হিসাবে ক্রিয়াশীল রয়েছে ধর্ম, বাংলাদেশের বাস্তবতায় ইসলাম এবং ভারতের বাস্তবতায় প্রধানত হিন্দু ধর্ম। আমার বিবেচনায় আজকের যুগে উন্নত শিল্প-সভ্যতা গড়ার পথে উপনিবেশিক রাষ্ট্র-কাঠামোর উত্তরাধিকার এবং ধর্ম বাংলাদেশের জন্য যেমন সবচেযে বড় বাধা হয়ে আছে তেমন একইভাবে এ কথা প্রযোজ্য ভারত-রাষ্ট্র সম্পর্কেও। এ কথা না বললেও চলে যে, পাকিস্তানও এই বাস্তবতার বাইরে নাই।
পর-শাসনের উত্তরাধিকার স্বরূপ এই রাষ্ট্রব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আনা ছাড়া যেমন প্রকৃত স্বাধীন ও মুক্ত মানুষের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয় তেমন পশ্চাৎপদতা ও রক্ষণশীলতার উৎসস্বরূপ বিদ্যমান ধর্মগুলি থেকে সমাজকে মুক্ত করা ছাড়াও আধুনিক শিল্প-সভ্যতার উপযোগী উন্নত চেতনাসম্পন্ন মানুষ সৃষ্টি করা সম্ভব নয়। বর্তমান উন্নত বিশ্বের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে তো কোনও সভ্য দেশ বলারই উপায় নাই। ভারতকেও কি তেমন একটা সভ্য বলার উপায় আছে? সেখানে মানুষের যে দুর্গত জীবনের চিত্র আমরা প্রতিনিয়ত দেখতে পাই তা থেকে ভারতকে নিয়েও গর্ব করার তেমন কিছু আমি দেখি না। পাশ্চাত্যের যে কোনও একটি দেশের পাশে যদি নিত্যদিনের ভারতের সমাজ ও রাষ্ট্রকে স্থাপন করা যায় তবে বুঝা যাবে ভারত আজও কোন্ অন্ধকারে ডুবে আছে।
কিন্তু এ সম্পর্কে কোনও চিন্তা-চেতনা যে খুব একটা দৃশ্যমান তা মনে হয় না। আসলে উপমহাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক দৈন্য আজ অবধি আমার নিকট খুব প্রকট মনে হয়। সমাজ-বাস্তবতার গভীরে গিয়ে সমস্যার মূল এবং সেই সঙ্গে তার সমাধান সন্ধানের চেষ্টা তেমন একটা চোখে পড়ে না। চিন্তার জগতে একদিকে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে আছে ধর্ম বিশেষত ইসলাম এবং হিন্দু এই দুই ধর্ম, অপর দিকে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে আছে পাশ্চাত্য থেকে আসা নানান ধরনের জ্ঞানতত্ত্ব। পাশ্চাত্য থেকে আসা সবচেয়ে বিপ্লবী বা পরিবর্তনবাদী যে জ্ঞানতত্ত্ব এই উপমহাদেশে একটা দীর্ঘ সময় যথেষ্ট প্রভাব রেখেছিল সেটা হচ্ছে মার্কসবাদ। তবে সোভিয়েত সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার পতনের পর থেকে এখন মার্কসবাদের প্রভাবও ক্ষয়প্রাপ্ত হয়েছে। অবশ্য উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে মার্কসবাদ সমাজ পরিবর্তনে সঠিক দিশা দানে ব্যর্থ। কেন ব্যর্থ সেই অনুসন্ধানও এখানে সেভাবে নাই। একদল মার্কসবাদের বিশ্বপরিসরে ব্যর্থতা দেখে সেটা পরিত্যাগ করে বিদ্যমান ব্যবস্থার নিকট আত্মসমর্পণ করেছে, অপর দল কোনও জিজ্ঞাসা না রেখে অন্ধবিশ্বাস নিয়ে মার্কসবাদকে আঁকড়ে ধরে পড়ে থেকে ক্রমিক বিলুপ্তির পথে এগিয়ে চলেছে। আসলে স্বাধীনভাবে কিংবা নূতনভাবে চিন্তা করবার মতো মানুষের নিতান্ত অভাব এই উপমহাদেশে।
বস্তুত বুদ্ধিবৃত্তির মূলধারায় আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে পাশ্চাত্য প্রবর্তিত সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ধারার অনুকূল চিন্তাধারা, যা উপমহাদেশে পাশ্চাত্যের বাজার ব্যবস্থাকে নানানভাবে রক্ষা করছে। ফলত নূতন রূপে বজায় রয়েছে পাশ্চাত্যের শোষণ, লুণ্ঠন এবং আধিপত্য। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ঘটছে আমজনতার বুদ্ধিবৃত্তিক বা আদর্শিক ভিত্তি স্বরূপ ধর্মের ক্রমিক প্রভাব বৃদ্ধি। এই উপমহাদেশে পাশ্চাত্যের ধর্মমুক্ত ও বিজ্ঞানভিত্তিক জ্ঞানতত্ত্বের সঙ্গে ধর্ম সম্মিলিত হয়ে এক কিম্ভূত-কিমাকার পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। অবশ্য এই পরিস্থিতি নূতন করে যে তৈরী হয়েছে তা নয়। এই পরিস্থিতি ব্রিটিশ শাসনকাল থেকে চলে আসছে। এর ফলে ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে ঘটেছিল বঙ্গ এবং ভারতের রাজনৈতিক বিভক্তি। বিভিন্ন মোড় পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতসহ প্রায় সমগ্র উপমহাদেশে ধর্ম এখন রাজনীতিতে নূতন শক্তি নিয়ে দেখা দিচ্ছে। বস্তুত সমাজ বাস্তবতা না বুঝে পাশ্চাত্যের নির্বাচনমূলক গণতন্ত্রের অন্ধ ও যান্ত্রিক অনুকরণ এমন পরিণতিই আমাদের জন্য অনিবার্য করেছে। চরম পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মের প্রভাব ও নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত একটা বিজ্ঞানমনস্ক ও গণতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা না করে এবং উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রকে রক্ষা করে তার উপরে গণতন্ত্রের নামে একটা নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চাইলে যা হবার তা-ই হয়েছে।
অবশ্য কিছুদিন যাবৎ ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাংলা ভাষায় ধর্মের শাসনের বিরুদ্ধে এক নূতন ও প্রবল বুদ্ধিবৃত্তিক লড়াই শুরু হয়েছে। যেখান থেকেই এই লড়াই পরিচালিত হোক এই লড়াইয়ের মূলভূমি বা কেন্দ্র হচ্ছে বাংলাদেশ। বিভিন্ন ওয়বসাইট এবং ফেসবুক, ইউটিউব ইত্যাদি এখন এই লড়াইকে অপ্রতিহত শক্তি ও গতি দান করছে। জিহাদীদের কোনও সন্ত্রাসী হামলা কিংবা রাষ্ট্রের কোনও দমনমূলক ব্যবস্থা ধর্ম থেকে মানুষের মুক্তির নবতর লড়াইকে স্তব্ধ করতে পারছে না। আসলে ইন্টারনেটের শক্তির সামনে জিহাদীদের কিংবা রাষ্ট্রের সন্ত্রাস পরিচালনার শক্তি আজকের দিনে অসহায় হয়ে পড়ছে। সুতরাং ধর্মের অন্ধত্বের বিরুদ্ধে চিন্তার নবজাগরণকে রোধ করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
তবে বাঙ্গালীর ধর্ম থেকে মুক্তির এই লড়াই এখন পর্যন্ত চিন্তার ক্ষেত্রে একটা ক্ষুদ্র গণ্ডীর ভিতরে সীমাবদ্ধ হয়ে আছে। এটা এখনও সমাজ, অর্থনীতি এবং বিশেষত রাষ্ট্র সংক্রান্ত চিন্তা তথা রাজনীতি বর্জিত। অর্থাৎ এখন পর্যন্ত ধর্ম-চিন্তা রাষ্ট্র-চিন্তা বা রাজনীতি-চিন্তার সঙ্গে সমন্বিত হতে পারে নাই। ফলে রাষ্ট্র-সমাজ-অর্থনীতির গভীরে গিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান সমস্যাগুলির মূল সন্ধানের চেষ্টা এখানে যেমন তেমন একটা দেখা যায় না তেমন এই ধরনের আলোচনা বা বিতর্কে বিকল্প সন্ধানও চোখে তেমন একটা পড়ে না। অর্থাৎ ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনা বা বিতর্কের গুরুত্বকে খাটো না করেও বলা যায় যে, এখন পর্যন্ত ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনায় সমাজ, অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের বিষয় বা সমস্যাগুলি অনেকটা অস্পৃশ্য রয়ে গেছে। বলা চলে যারা ধর্ম নিয়ে নূতনভাবে ভাবছেন রাজনীতি এবং সমাজের অন্যান্য দিকগুলি সাধারণভাবে তাদের বিবেচনার বাইরে থেকে যাচ্ছে। আবার যারা রাজনীতি নিয়ে ভাবছেন বা বলছেন তারা যেমন রাষ্ট্র-কাঠামোর সমস্যা নিয়ে সাধারণত ভাবতে বা বলতে চান না তেমন সমাজ ও রাষ্ট্রের গতিধারায় ধর্ম কীভাবে নিয়ন্ত্রণ বজায় রেখে উন্নত ও গণতান্ত্রিক সমাজ এবং রাষ্ট্র গঠনকে অসম্ভব করে রাখছে সেই দিকেও নিজেদের চিন্তা বা আলোচনাকে নিতে চান না। এর ফলে রাজনীতি নিয়ে যে ধারণাগুলি সমাজে জায়গা করে আছে সেগুলিও গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে চলে। কিছু ভিন্ন চিন্তা থাকতে পারে। তবে সেগুলি এখনও চিন্তাচর্চার মূলধারায় জায়গা করে নিতে পারে নাই।
বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতি-চিন্তায় এ নিয়ে কোনও জিজ্ঞাসা যেমন নাই তেমন ভারত কিংবা পশ্চিম বঙ্গের রাজনীতি-চিন্তার মূলধারায়ও আমি সেটা দেখতে পাই না। যাইহোক, সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বুদ্ধিদীপ্ত মানুষের কাছ থেকেও যে আমি তেমন কোনও জিজ্ঞাসা দেখতে পেয়েছি তা নয়। তবে সেই প্রসঙ্গ আমার এই আলোচনার বিষয় নয়। এখানে পশ্চিম বঙ্গের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ এবং সাহসী উপস্থাপনা বা বয়ানের জন্য আমি যে তাকে উচ্চমূল্য দিই সে কথাই বলতে চাই। আমার কাছে তার মূল্য একজন চিন্তাবিদ হিসাবে নয়, বরং এমন একজন সাংবাদিক হিসাবে যিনি অমিত সাহস, বস্তুনিষ্ঠা এবং অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পশ্চিম বঙ্গের পরিস্থিতি শুধু পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীদের নিকট নয়, উপরন্তু সমস্ত পৃথিবীর বাঙ্গালীদের নিকট তুলে ধরছেন। বস্তুত পশ্চিম বঙ্গ যে কতটা অধঃপাতে গেছে তার প্রমাণ লাভের জন্য ভিন্ন দৃষ্টান্তের প্রয়োজন নাই। তার মতো একজন মর্যাদাবান মানুষের সঙ্গে মমতা নেতৃত্বাধীন পশ্চিম বঙ্গ রাজ্য সরকারের এমন অমানুষিক, বর্বর, ঘৃণ্য ও নিন্দনীয় আচরণ থেকেই পশ্চিম বঙ্গের ভয়ঙ্কর অবস্থা বুঝাটা আমাদের জন্য যথেষ্ট।
আমাদের এ কথা বুঝতে হবে যে, যে কোনও সমাজের দৈন্যের সবচেয়ে বড় উৎস হচ্ছে তার চিন্তার দৈন্য। উন্নত চিন্তা থেকে আসে উন্নত জীবন। এবং অনুন্নত বা অধঃপতিত চিন্তা থেকে আসে অনুন্নত বা অধঃপতিত জীবন। একটা সমাজের উন্নত চিন্তার বিকাশ হতে পারে বিভিন্ন চিন্তার দ্বন্দ্ব এবং মিলনের মিথষ্ক্রিয়ার মধ্য দিয়ে। এর জন্য অপরিহার্য ব্যক্তির মতপ্রকাশের স্বাধীনতা। এখন যে সমাজ ধর্মের প্রভাবে হোক আর রাষ্ট্র পরিচালনায় দুর্নীতি বা লুটপাট অথবা স্বৈরশাসনের প্রয়োজনে হোক চিন্তার স্বাধীনতাকে ধ্বংস করে, ভিন্ন মত বা চিন্তার প্রতি অসহিষ্ণু এবং আক্রমণাত্মক হয় সেই সমাজ নিজের উন্নত ভিত্তি নির্মাণের সম্ভাবনাকে নিজেই ধ্বংস করে। এ কথা বুঝবার জন্য দূরে যেতে হবে না। বাংলাদেশে বাস করে এই কথা কতখানি যথার্থ তা বুঝতে আমাদের এতটুকু কষ্ট হয় না।
বাংলাদেশের বাঙ্গালী হিসাবে আমি পশ্চিম বঙ্গ নিয়ে যে বেশী ভাবব সেটা অন্তত আমার জন্য খুব স্বাভাবিক। বাঙ্গালী জাতি সংক্রান্ত আমার ভাবনার মধ্যে পশ্চিম বঙ্গের অবস্থানও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সুতরাং যত দূরে থাকি, কিছু করতে পারি, আর না পারি আমার মনের একটা বড় জায়গায় থাকে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর সুখ-দুঃখের ভাবনা।
আমি সর্বশেষ ২০০৩ অথবা ২০০৪ সালে পশ্চিম বঙ্গে গিয়েছিলাম। কথাটা সেই সময়কার। একটা আলাপের শেষ সময়ে বিদায় নিবার আগে আমাকে কলকাতা জেলা আদালতের একজন আইনজীবী যে কথা বলছিলেন সেটা বহুবার আমার মনে হয়েছে। তিনি বামপন্থী হলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন বামফ্রন্টের সমালোচক ছিলেন। তার বক্তব্য ছিল যে, বামফ্রন্ট পশ্চিম বঙ্গের সমস্যা সমাধানে এমনইভাবে ব্যর্থ হয়েছে যে আজ হোক কাল হোক তাকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হবে। এবং বামফ্রন্ট বা সিপিএম ক্ষমতা থেকে বিদায় নিলে সেই জায়াগায় আসবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল তৃণমূল কংগ্রেস। তার শেষ কথাটা ছিল এরকম, ‘বামফ্রন্ট যে চলে যাবে সেটা আমি বলতে পারি। আর বামফ্রন্ট গেলে ক্ষমতায় যে মমতা আসবে সেটাও নিশ্চিত করে বলা যায়। কিন্তু আমি এ কথা বলতে পারি যে, মমতা ক্ষমতায় এলে পশ্চিম বাংলা বাসযোগ্য থাকবে না।’
আমি যখন পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন সংবাদ পড়ি কিংবা ইউটিউব চ্যানেলে সেখানকার বিভিন্ন জনের বিভিন্ন বয়ান শুনি তখন সেই এডভোকেট ভদ্রলোকের কথা বারবার মনে হয়। আর সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপর সরকারী পুলিশ এবং তৃণমূলের গুণ্ডা বাহিনীর নির্যাতনের ঘটনা পড়ে এবং ইউটিউবের বিভিন্ন চ্যানেলে তার উপর নিগ্রহের বিবরণ শুনে আমার বারবার মনে হয়েছে আসলে কি পশ্চিম বঙ্গ মানুষের বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে, যেমনটা হয়েছে আমাদের এই বাংলাদেশ?
বাস্তব যত অধঃপতিত হোক, যে মানুষরা পৃথিবীকে মানুষের বাসোপযোগী করবার জন্য যার যার মতো করে লড়াই করেন তাদের জন্য শ্রদ্ধা ও অনুরাগ না রাখবার উপায় কোথায়? সুতরাং সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায়ের লড়াইয়ের প্রতি আমি আমার সর্বান্তঃকরণ শ্রদ্ধা নিবেদন করছি এবং সেই সঙ্গে তার প্রতি এমন নিকৃষ্ট ও ঘৃণ্য আচরণের জন্য ধিক্কার জানাচ্ছি পশ্চিম বঙ্গের তৃণমূল কংগ্রেসের রাজ্য সরকারকে।