Banner
উপমহাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রগুলির আধুনিকায়নের সমস্যা — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 16, 2020, 12:00 AM, Hits: 921

 

১। ধর্মের সমস্যা

বহু বিষয়েই সম্পূর্ণরূপে পরস্পর বিরোধী দুই ধর্ম ইসলাম এবং হিন্দু ধর্মে বিশ্বাসী মুসলিম এবং হিন্দু এই দুই ধর্ম-সম্প্রদায়ই যে আধুনিক সভ্যতার চাহিদা পূরণে কতখানি ব্যর্থ তা উপমহাদেশের তিন রাষ্ট্র বাংলাদেশ, ভারত এবং পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টি দিলেই বুঝা যায়। এই তিন রাষ্ট্র তাদের জন্মের পর থেকে মূলত পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করে নিজেদের অগ্রগতির পথ নির্মাণের চেষ্টা করে আসছে। বাংলাদেশে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ১৯৭৫-এর ২৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে সমাজতন্ত্রের নামে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করা হলেও সেটা ছিল ক্ষণস্থায়ী একটা ঘটনা। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্টে এক সামরিক অভ্যুত্থানে শেখ মুজিব নিহত হন এবং সেই সঙ্গে বাকশালও বিলুপ্ত হয়। মুজিব বেঁচে থাকলে কী হতে পারত সেসব নিয়ে গবেষণা করে লাভ নাই। বরং গোটা উদ্যোগটাই ছিল ব্যর্থ এবং পরিত্যক্ত। আসলে সমাজতন্ত্রের নামে যে পদ্ধতিতে, যে পরিস্থিতিতে এবং যে সময়ে বাকশালের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল তার যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সঠিকতা ই্ত্যাদি নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলা যায়। বস্তুত এই ধরনের যে কোনও উদ্যোগের সাফল্যের সম্ভাবনা মুজিব নিজেই তার পূর্বেকার তিন বৎসরাধিক শাসনকালে ধ্বংস করেছিলেন। যাইহোক, সামগ্রিকভাবে উপমহাদেশের এই তিন রাষ্ট্রই যেটা করছে সেটা হচ্ছে ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের রেখে যাওয়া রাষ্ট্রের হাল ধরে রেখে এখানে ব্রিটিশ তথা পাশ্চাত্য প্রবর্তিত আধুনিকতার চর্চাকে এগিয়ে নেওয়া।

ব্রিটিশ শাসকরা বিদায় নিয়েছে ১৯৪৭ সালে। সেই হিসাবে প্রায় পৌনে এক শতাব্দী হয়ে গেল। এর মধ্যে আবার ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব বাংলা স্বাধীন হয়ে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নাম নিয়ে রাষ্ট্রও হল। এই সমগ্র কালপর্বে বাংলাদেশের অর্জনই বা কতটুকু? বস্তুত বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও ভারতকে পাশ্চাত্যের যে কোনও দেশের পাশে রেখে জীবনের মান, ব্যক্তির মতপ্রকাশ ও জীবনাচরণের স্বাধীনতা, মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং শিল্প-প্রযুক্তির মান ইত্যাদি দিয়ে বিচার করলেই বুঝা যায় উপনিবেশিক ব্রিটিশ শাসকরা বিদায় নেওয়ার এতটা কাল পার হবার হবার পরেও এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলাবার শত চেষ্টা সত্ত্বেও এই উপমহাদেশের রাষ্ট্র বা সমাজগুলি কতটা পিছিয়ে আছে সেটা। বিশেষ করে বাংলাদেশের কথাই ধরা যাক। বাংলাদেশে দুর্নীতি, নারী নিগ্রহ, ধর্ষণ ও হত্যা এবং সামাজিক ও রাষ্ট্রিক যে ভয়াবহ সার্বিক অধঃপাতের চিত্র প্রতিদিন সংবাদপত্র এবং বিভিন্ন সামাজিক প্রচারমাধ্যম থেকে বেরিয়ে আসে তা কি ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা কিংবা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের মত দেশগুলিতে কল্পনা করা যায়?

ইউরোপ, আমেরিকার মানুষ কি উন্নত জীবনের আশায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান কিংবা ভারতে অভিবাসী হবার জন্য হুড়াহুড়ি করে নাকি উল্টাটা? বিশেষত বাংলাদেশ তো দেশত্যাগের প্রেরণায় সমৃদ্ধ রাষ্ট্রের দাবীদার হতে পারে।

যাইহোক, আমার মনে হয়েছে আধুনিক সভ্যতা নির্মাণে এই উপমহাদেশের ব্যর্থতার মূল কারণ হচ্ছে একদিকে ধর্ম, অপর দিকে ব্রিটিশ প্রবর্তিত উপনিবেশিক রাষ্ট্র-কাঠামো। ধর্মের প্রসঙ্গে বলতে হয়, আপাতদৃষ্টিতে পরস্পর বিরোধী হলেও সমাজকে পশ্চাৎপদতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা, রক্ষণশীলতা এবং বহুদিক থেকেই অমানবিকতায় ধরে রাখার জন্য দায়ী ইসলাম এবং হিন্দু এই দুই ধর্ম।  

সুতরাং উপমহাদেশের বিশেষত তিন রাষ্ট্র বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানে যত বাড়ছে ধর্মের দাপট তত বেশী করে ঘটছে এই তিন রাষ্ট্রের সমাজ ও জনগণের পশ্চাদযাত্রা এবং জীবনের সার্বিক অধঃপতন। অর্থাৎ ধর্মের চর্চা মোটেই সমাজের জন্য কল্যাণ বয়ে না এনে বরং উল্টাটাই করছে।

 

২। রাষ্ট্রের সমস্যা

অন্যদিকে, ব্রিটিশের রেখে যাওয়া যে রাষ্ট্র-কাঠামো এই উপমহাদেশে আজ অবধি বিদ্যমান রয়েছে সেটি প্রতিটি মানুষের জন্য সামাজিক মর্যাদা, নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান ও মানুষের সামগ্রিক কল্যাণ সাধন, অর্থনৈতিক ‍উন্নয়ন এবং যুগের ধারার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির যথাযথ উন্নয়ন ঘটাবার কাজে কী নিদারুণভাবে ব্যর্থ সেটা বোধ হয় চক্ষুষ্মান কাউকে বলে দিতে হবে না। অথচ আজকের যুগে রাষ্ট্র হচ্ছে সমাজের উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি। কিন্তু সেই রাষ্ট্রের প্রশ্রটি বুদ্ধিবৃত্তিক এবং রাজনৈতিক আলোচনায় অনেকাংশেই উপেক্ষিত একটি বিষয় হয়ে আছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদীদের রেখে যাওয়া জনগণকে পায়ের নীচে দাবিয়ে রাখবার উদ্দেশ্যে গড়ে তোলা রাষ্ট্র কাঠামোর পরিবর্তন ছাড়া যে একটা স্বাধীন, ন্যায়-নীতিভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত এবং উন্নত জাতি ও সমাজ গঠন অসম্ভব সেই চিন্তা করবার সময় কি আজও আসে নাই? আর এই রাষ্ট্র কাঠামো মানে রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ তথা আইন-আদালত, পুলিশ-প্রশাসন, সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদি সবকিছুকেই বুঝতে হবে। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসন অবসানের এতকাল পরেও আমরা ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠিত শাসন ব্যবস্থার সবকিছুকেই আজ অবধি বহন করে চলেছি। নির্বাচনমূলক সরকারের কাজ হল এই রাষ্ট্র-কাঠামো তথা শাসন ব্যবস্থাকেই রক্ষা ও পরিচালনা করা। এভাবে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র-কাঠামো দ্বারা নির্বাচনমূলক সরকার ব্যবস্থা নিজেই আবদ্ধ হয়ে থাকে। একদিকে, সংখ্যাগুরু ভোটার বা জনগণের ধর্মাচ্ছন্নতা ও পশ্চাৎপদতা, এবং অন্যদিকে, উপনিবেশিক ধারায় সংগঠিত রাষ্ট্র ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্বকারী সরকারের নিকট থেকে কীভাবে আমরা আধুনিক কালোপযোগী যৌক্তিক, ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ, গণতান্ত্রিক ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গী ও আচরণ আশা করতে পারি?

বস্তুত যে সঙ্কটের আবর্তে বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের রাষ্ট্রগুলি ঘুরপাক খাচ্ছে সেখান থেকে মুক্ত হবার পথে যাত্রার পূর্বশর্ত হচ্ছে অলৌকিক বিশ্বাস-নির্ভর ধর্ম (উপমহাদেশের বাস্তবতায় ইসলাম ও হিন্দু) এবং ব্রিটিশদের রেখে যাওয়া উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র (যেটি মূলত আমলাতান্ত্রিক এবং জনগণের নিকট বহিরাগত চরিত্র বিশিষ্ট) আমাদের জন্য যে সকল সমস্যা সৃষ্টি করে রেখেছে সেগুলিকে বুঝতে চাওয়া। সমস্যা ও তার কারণ বুঝলে সমাধানের পথও বের করা সম্ভব হতে পারে। সাধারণভাবে উপমহাদেশ এবং বিশেষ করে আমাদের দেশের ধর্ম ও রাষ্ট্রের সমস্যা সম্পর্কে আমি বিভিন্ন সময়ে আলোচনা করেছি। ভবিষ্যতে আরও আলোচনার প্রয়োজন আছে। তবে আজ এখনকার মত এইটুকু বলে ধর্ম ও রাষ্ট্রের সমস্যার দিকে দৃষ্টিটাকে আর একবার নিতে চাইলাম।    

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ