লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 24, 2020, 12:00 AM, Hits: 818
বাংলাদেশে যে একটা পরিবর্তন আসছে সমস্ত লক্ষণ দেখে তেমনটাই মনে হচ্ছে। এবং সেই পরিবর্তনটা ছোটখাটো নয়, বরং বড় ধরনের হবে বলে মনে হচ্ছে। পরিবর্তন সরকার, রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রেই ঘটতে পারে। সাম্প্রতিক কালে ক্যাসিনো কাণ্ড, মধ্যপ্রাচ্যে শ্রমশক্তি রফতানীর নামে ভয়াবহ দুর্বৃত্তপনা ও অমানবিকতার সব প্রকাশ, বিশেষত সেখানে যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহারের জন্য বাংলাদেশের নারীদের নিয়ে যে ভয়াবহ বাণিজ্য গড়ে উঠেছে তার প্রকাশ, করোনা মহামারীকালে হাসপাতাল, ডাক্তার, মন্ত্রণালয় ইত্যাদির যে সকল ভয়ঙ্কর দুর্নীতির ঘটনা বাংলাদেশের রাষ্ট্র এবং বহির্বিশ্বকে তোলপাড় করছে সেগুলি বাংলাদেশের সরকার ও রাষ্ট্রের এক ভয়াবহ অধঃপতনের চিত্রকেই সর্বসমক্ষে উন্মোচিত করেছে।
এসব ঘটনা এখন যারা কিছু সংবাদ রাখেন তারা সকলে জানেন। আমি সে কারণে সেসবের বিস্তারিত বিবরণে না গিয়ে মূল প্রসঙ্গে আমার আলোচনাকে সীমাবদ্ধ রাখছি। শুধু উপরে বর্ণিত কয়েকটি ঘটনা নয়, বরং আরও অনেক ঘটনার প্রকাশ সমাজ ও রাষ্ট্রের অধঃপতিত দশাকে তুলে ধরছে। এমন একটা পরিস্থিতির দায় নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশী সরকারের উপর এসে পড়ে। কারণ রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যেভাবে হোক তারাই নিয়েছে। এখন ভালো হলে যেমন তার কৃতিত্ব তেমন মন্দ হলেও তার দায় তাদেরকেই সবচেয়ে বেশী নিতে হবে। এবং দেখাও যাচ্ছে সকল দুর্নীতি ও দুষ্কৃতির সঙ্গে মূলত সরকার এবং রাষ্ট্রের উপর তলার লোকজনই সংশ্লিষ্ট। অবশ্য রাষ্ট্র ক্ষমতার জোরে অনেক অন্যায়, অপরাধ ও দুষ্কৃতির দায়কে অস্বীকার করা যেতে পারে। কিন্তু শাক দিয়ে আর কত মাছ ঢাকা যাবে?
সুতরাং বলতে ইচ্ছা করে যে, পাপের ভরা পূর্ণ হয়েছে। তা না হলে এতকাল ধরে সংঘটিত ঘটনাগুলি এখনই এসে এত স্বল্প সময়ের মধ্যে এভাবে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে? এর আগেও সংঘটিত কিছু অপ্রীতিকর কিংবা অপরাধমূলক ঘটনার প্রকাশ জনমতকে ক্ষুব্ধ করেছে। কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি সেসকলেরই মাত্রা ছাড়িয়েছে। বিশেষত করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতি দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতির ভয়াবহতাকে চরম পর্যায়ে নিয়ে গেছে। স্বাস্থ্যখাতের সঙ্কটের প্রশ্ন নাই বা তুললাম। দেশের অর্থনীতিও ধ্বসে পড়ছে। লক্ষ, লক্ষ এবং কোটি, কোটি মানুষ কর্মচ্যুত, কর্মহীন এবং নিরন্ন ও আশ্রয়হীন হয়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে। সরকার এই পরিস্থিতিকে সামাল দিতে পারছে না। স্বাভাবিকভাবে এ কথা মনে করা যুক্তিসঙ্গত যে, সরকার পরিবর্তন হবে।
অবর্ণনীয় সন্ত্রাস ও দমননীতি দিয়ে সরকার এ পর্যন্ত সকল বিরোধিতাকে দমন করে রেখেছে। রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাস ও নিয়ন্ত্রণের কারণে এমনকি সংবাদপত্রেও বহু সংবাদ ও মতের প্রকাশ ঘটে না। কিন্তু যোগাযোগ ও প্রচারমাধ্যমে ইন্টারনেট প্রযুক্তির ব্যবহারের এই কালে খুব কম সংবাদ এবং মতামতকে চেপে রাখা সম্ভব হয়। জনমত ঠিকই তার পথ করে নেয় এবং নিচ্ছেও। যেহেতু পরিবর্তনের সপক্ষে জনমত গড়ে উঠছে সেহেতু পরিণতিতে পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে।
কীভাবে হবে, কখন হবে সেটা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তবে এই অবস্থার পরিবর্তনের প্রয়োজনে সরকার পরিবর্তন হবে। অবশ্য সরকার যদি এই অবস্থার সত্যিকারের পরিবর্তনের জন্য পদক্ষেপ করে তবে হয়ত সরকার পরিবর্তন হবে না। কিন্তু তা-ই কি? এতকাল ধরে দুর্বৃত্তায়নের যে ব্যবস্থা সরকার গড়ে তুলেছে সেটাকে হঠাৎ করে এখন এসে কি পরিবর্তন করা যায়? শেখ মুজিবের অভিজ্ঞতা ভুলে যাওয়া কি উচিত হবে?
বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর তিন বৎসর কাল দলকে তথা দলের নেতা-কর্মীদেরকে উন্মত্ত লুণ্ঠন ও দুর্বৃত্ত্পনার পথ ধরে চলতে দিবার পর রাশ টানতে গিয়ে দলেরই লোকদের হাতে মুজিবের কি পরিণতি হয়েছিল তা কি আমাদের জানা নাই?
শেখ হাসিনাও হয়ত একটা পর্যায়ে রাশ টানতে চাইবেন। হয়ত এখনই সেটা চাইছেনও। কিন্তু এতকাল ধরে দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির যে সৌধ গড়েছেন তার ভিতরে বসে সেটাকে কি ভাঙ্গা সম্ভব? লোক দেখানোর জন্য কিছু ডালপালা ছাটা যেতে পারে। সেটা অনেক সময় অপরিহার্যও হয়ে পড়ে। কিন্তু মূলে হাত দেওয়া তো ভিন্ন জিনিস।
যাইহোক, পরিস্থিতির অনিবার্য গতিধারায় হাসিনা নেতৃত্বাধীন সরকারকে যেতে হবে বলে মনে হচ্ছে। হয়ত একটা গণ-আন্দোলনের আঘাতেই তাকে যেতে হবে। হয়ত শুধু অভ্যন্তরীণ নয়, আন্তর্জাতিক শক্তিসমূহের সংযোগও তাতে ঘটবে। আমার মনে এখন এই রকম সম্ভাব্য পরিবর্তনের পূর্বকালে যে প্রশ্ন জাগছে সেটা হল যদি সরকার পরিবর্তন হয়ও তাতে কী লাভ হবে?
হয়ত বলা হবে হাসিনার সরকার অবৈধভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সরকার বলেই দেশের এই অবস্থা। সুতরাং অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা সরকার প্রতিষ্ঠিত হলেই দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে আর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে সব সমস্যার সমাধান হবে। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা কী বলে?
বেশী দূরে যাবার দরকার নাই। ১৯৯০-এর গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী কালে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের নেতৃত্বাধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯১-তে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবার সুযোগ নাই। কিন্তু পরবর্তী কালের সরকারগুলি জাতিকে কেমন জনকল্যাণমূলক এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা উপহার দিয়েছে?
আসলে আমাদের সমস্যা হচ্ছে আমরা সমস্যার মূলে দৃষ্টি না দিয়ে ডালপালা নিয়ে মাতামাতি করতে পছন্দ করি। সুতরাং যে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ব্যবস্থা জনকল্যাণ এবং গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণকে অসম্ভব করে রাখে সেদিকে আমরা দৃষ্টি দিই না। একটা ধর্মাচ্ছন্ন, পশ্চাৎপদ ও ভাগ্যবাদী সমাজ তথা জনগণের প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে কীভাবে একটা উন্নত, ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ, স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক নেতৃত্ব নির্বাচনমূলক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উঠে আসতে পারে এবং ক্ষমতায় আসীন হতে পারে?
অন্যদিকে, ব্রিটিশ প্রবর্তিত যে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ বহিরাগত চরিত্রবিশিষ্ট আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র আজ অবধি বিদ্যমান আছে তার উপর নির্ভর করে কীভাবে একটা জনকল্যাণবাদী ও গণতান্ত্রিক সরকার তার ভূমিকা পালন করতে পারে?
ইউরোপ-আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া তথা পাশ্চাত্যের গণতন্ত্রের মহিমায় মুগ্ধ হয়ে যারা নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ দেশে এতকাল ধরে গণতন্ত্রের সৌধ নির্মাণের কল্পনা করেছেন তাদেরকে আমি একটু কষ্ট করে পাশ্চাত্য দেশগুলির সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যকেও বিচার করতে বলব? পাশ্চাত্যের জনসমাজ কি আমাদের দেশের জনসমাজের মত ধর্মাচ্ছন্ন, পশ্চাৎপদ এবং ভাগ্যবাদী? কিংবা এমন অজ্ঞ-মূর্খ এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিচার-বুদ্ধিহীন? স্বাভাবিকভাবে এদের দ্বারা যারা নির্বাচিত হবে তারা তো এদেরই উপযুক্ত প্রতিনিধি হবে।
অন্যদিকে, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা পাশ্চাত্য দেশগুলিতে আছে তা কি উপনিবেশিকতার ধারাবাহিকতাকে ধারণ করে? মোটেও না। কারণ ইউরোপ কারও উপনিবেশ ছিল না। উত্তর আমেরিকা কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মত দেশগুলির রাষ্ট্রগুলি যাদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত তারাও নিজেরাই ইউরোপীয় উপনিবেশ স্থাপনকারী। অর্থাৎ তারা নিজেরা যেমন স্বাধীন মানুষ তেমন তারা নিজেদের জন্য যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছে সেটাও স্বাধীন মানুষদের রাষ্ট্র। সেটা মোটেই আমাদের রাষ্ট্রের মত ব্রিটিশ উপনিবেশিক শাসকদের আমাদের দেশের জনগণকে দমন, দলন ও লুণ্ঠনের প্রয়োজনে গড়ে তোলা বহিরাগত চরিত্রবিশিষ্ট আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র নয়। কালের ধারায় ছোটখাটো কিছু পরিবর্তন হলেও আমাদের রাষ্ট্র তার গঠন প্রকৃতি ও চরিত্র বিচারে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ তথা বহিরাগত চরিত্রবিশিষ্ট আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্র ছাড়া আর কিছুই নয়। আমাদের রাষ্ট্রের আইন-আদালত, প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইত্যাদির দিকে দৃষ্টি দিলেই সেটা স্পষ্ট হয়। হ্যাঁ, ভুলভাবে, ভুল সময়ে শেখ মুজিব উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রকে বদলাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ঐ যে বললাম ওটা ভুলভাবে এবং ভুল সময়ে। তার আরও অনেক ভুল এবং ত্রুটি ছিল। সেগুলির খেসারত তিনি দিয়েছেন প্রাণ দিয়ে।
আমার মনে হয়েছে এই সরকার ক্ষমতাকে আর বেশী সময় ধরে রাখবার সামর্থ্য হারিয়েছে। যদি একটা গণ-আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার বিদায় নেয় তবে কি নির্বাচন ও দুর্বৃত্তায়নের যে ধারাবাহিকতার চক্র দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেটা অব্যাহত রইবে, নাকি এই চক্র ভাঙ্গবে? এমনিতে তো ভাঙ্গবে না, বরং যারা সরকার পরিবর্তন ঘটাবে গণ-আন্দোলনের সেই নেতৃত্বকারী শক্তিকেই কাজটা করতে হবে। তবে তার আগে সমস্যাটাকে বুঝতে চাইতে হবে।
রচনা : ২৪ জুলাই, ২০২০