লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ January 30, 2021, 12:00 AM, Hits: 1353
“বাংলাদেশি রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তার সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালী সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতর সংস্কৃতির উন্মেষ-বিকাশ-লালনে বামপন্থী সংস্কৃতিসেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিল তিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা যে শ্রম, মেধা এবং যত্ন ব্যয় করেছেন, সে কাহিনী এখন প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। তাদের সাফল্যের পরিমাণ হয়ত আশানুরূপ ছিল না কিন্তু সূচনাটি করেছিলেন এবং অনেকদিন পর্যন্ত সংস্কৃতিকে লালন করেছেন। সংস্কৃতিতে উত্তাপ, লাবণ্য এবং গতি সঞ্চার করার ব্যাপারে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা অনেক কিছু দিয়েছেন। সেই সব মহান অবদানের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করার প্রয়োজন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
“বামপন্থী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকেই বাংলাদেশের জাতীয়তার বোধটি প্রথম অঙ্কুরিত এবং মুকুলিত হয়। বাঙালী জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতাকর্মীরাই নির্মাণ করেছিলেন। সেজন্য তাদের জেল-জুলুম কম সহ্য করতে হয়নি। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ দলটির কাছ থেকেও তাদের কম নিগ্রহ ভোগ করতে হয়নি। পাকিস্তানের সংহতি বিনাশকারী, বিদেশি গুপ্তচর, ইসলামের শত্রু এই ধরণের অভিযোগ বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীদের বিরুদ্ধে হামেশাই উচ্চারিত হত। এসব লাঞ্ছনা সহ্য করেও বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীরা রাষ্ট্রের ভ্রূণ রোপন করতে পেরেছিলেন। বর্তমানের বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা যেটুকু সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে করেন, তার পেছনে রয়েছে বামপন্থী রাজনীতির বিপুল পরিমাণ অবদান। বামপন্থী রাজনীতিই শ্রমিক-কৃষক-নিম্নবিত্তসহ সমস্ত নির্যাতিত মানুষকে অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে, সংগঠিত করেছে এবং আন্দোলনে টেনে এনেছে। বাংলাদেশের দুর্ভাগ্য বামপন্থী আন্দোলন এখন রাজনৈতিকভাবে সম্পূর্ণ উত্থানরহিত। বামপন্থী রাজনীতির মুমূর্ষু অবস্থা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ভাগ্যকে তমসাচ্ছন্ন করে রেখেছে।” (সাম্প্রতিক বিবেচনায় বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, আহমদ ছফা। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, পৃ. ৩৫-৩৬)
উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন চলতি বছরে শতবর্ষে পা দিল। এই দীর্ঘ পথ পরিক্রমা ফিরে দেখলে, এটা সকলেরই চোখে পড়বে যে, এই শতবর্ষে এই ভূখণ্ড দুই দুইবার স্বাধীনতা লাভ করেছে। সাতচল্লিশে এবং একাত্তরে। দুই দুইটি গণঅভ্যুত্থান হয়েছে। ঊনসত্তর ও নব্বইয়ে। সশস্ত্র ও নিরস্ত্র, সহিংস ও অহিংস, নির্বাচনী সংসদীয় পন্থা, নির্বাচন বিরোধী সহ নানামুখী আন্দোলন হয়েছে। এসকল ঘটনা প্রবাহে সবচেয়ে সাহসী, সবচেয়ে অগ্রসর, সবচেয়ে শিক্ষিত, সবচেয়ে উন্নত চরিত্রের তরুণ-তরুণীরা কমিউনিস্ট আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন। তা সত্ত্বেও এই অঞ্চলে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে রাজনৈতিক আন্দোলন সাফল্য লাভ করেনি। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান আর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হলেও, সেই সব আন্দোলনে এই অঞ্চলে ক্রিয়াশীল কমিউনিস্টগণ কতটুকু লেনিনীয় পথ অনুসরণ করতে সক্ষম হয়েছেন, তা বিচারমূলক পর্যালোচনার সময় এখন।
ইতিহাস নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দাবি করে, ইতিহাস নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট কর্তব্য দাবি করে। এই শতবর্ষে এত এত ঘটনায় ইতিহাস নিদিষ্ট কোন কর্তব্য কমিউনিস্টগণ পালন করতে পেরেছেন, সেই বিচার বিশ্লেষণ করা দরকার, সেটা করবেন পণ্ডিতজনেরা। ইতিহাসবিদ যারা আছেন তারা এর ব্যাখ্যা করবেন। এই লেখাতে জাতীয় মুক্তি ও শ্রেণিমুক্তি সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর সংক্ষিপ্ত আলোচনা করার চেষ্টা করবো।
কমিউনিস্ট রাজনীতির শতবর্ষের প্রথম পর্ব ১৯২১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত, এই ৫০ বছর ছিল জাতীয় মুক্তির কালপর্ব। ওই সময় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠা ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান করেছে এ অঞ্চলের মানুষ। সেখানে রুটি-রুজি-জমি-কাজ ও মজুরির প্রশ্নকে ছাপিয়ে সামনে চলে এসেছিল জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন। এই অর্ধশতককালে জাতীয় মুক্তির প্রশ্ন ও শ্রেণির প্রশ্নকে কিভাবে মেলাতে হবে তার সমীকরণ টানতে পারেননি এই অঞ্চলের কমিউনিস্টগণ। শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে জাতীয় সংগ্রামের মেলবন্ধন ঘটাতে নিদারুণভাবে ব্যর্থ হয়েছেন তারা। একাত্তরে ভারতের পূর্বাঞ্চলজুড়ে পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ঊড়িষ্যা, অন্ধ্র রাজ্যব্যাপী চারু মজুমদারের নেতৃত্বে নকশালপন্থীরা তীব্র তেজে জ্বলে উঠেছিল। আর একই সময়ে পূর্ব বাংলায় আছড়ে পড়েছিল জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের প্লাবন। পূর্ববাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্টদের উপর তখন চারু মজুমদারের ব্যাপক প্রভাব। শুধু তাই নয় তখনকার চীনপন্থী বলে পরিচিত প্রধান দুইটি পার্টি, পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (মতিন, আলাউদ্দিন, টিপু বিশ্বাস প্রমুখ) এবং পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি এমএল (সুখেন্দু দস্তিদার, হক, তোয়াহা প্রমুখ) যুদ্ধকালের সেই উত্তাল সময়ে চারু মজুমদারের রাজনৈতিক লাইন দলে অনুমোদন করে। তখনকার ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধী খুব দক্ষতার সঙ্গে, তার শ্রেণির স্বার্থে, কমিউনিস্ট আন্দোলনের ‘বিপদ’ থেকে রক্ষা পেতে এবং ভারতের বৃহৎ পুঁজির স্বার্থে শ্রেণি সংগ্রাম ও পূর্ববাংলায় গড়ে ওঠা জাতীয় সংগ্রামকে বিচ্ছিন্ন রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, এই দুই সংগ্রামকে পরস্পর বিরোধী রাখতে পেরেছিলেন। সেটার রেশ এখনো বাংলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে ক্রিয়াশীল। ইন্দিরা গান্ধী এই দুই আন্দোলনকে যে বিচ্ছিন্ন এবং বিরোধাত্মক অবস্থানে রাখতে পেরেছিলেন, সেটা তার নীতিকৌশল ও পদক্ষেপেই শুধু নয় কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভেতরকার ভূলচিন্তা লেনিনীয় চিন্তার ভূলব্যাখ্যা এবং ভুল পদক্ষেপের কারণেও দুই আন্দোলনকে বিরোধাত্মক জায়গায় রাখতে পেরেছিলেন।
কী সেই ভূলচিন্তা ও পদক্ষেপ? পূর্ববাংলায় ক্রিয়াশীল কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সব সময় জাতীয় মুক্তি আন্দোলন ও শ্রেণির আন্দোলনকে পরস্পরের বিরোধী হিসেবেই দেখতে চেয়েছেন।
চারু মজুমদার বলেছেন, ‘কমিউনিস্টরা জাতীয় সংগ্রামের নেতা হবে না, তাদের প্রধান কাজ শ্রেণি সংগ্রাম গড়ে তোলা, জাতীয় আন্দোলন নয়।’
‘শ্রেণি সংগ্রামের বিভেদ দূর করার জন্য কমিউনিস্টদের ঘোষণা করতে হবে যে, প্রত্যেকটি জাতিসত্তার আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এমনকি বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার রয়েছে। এই আওয়াজ খণ্ড জাতিগুলিকে একটা শোষণ থেকে আরেকটি শোষণের খপ্পরে পড়ছি না — এই বিশ্বাস দেবে এবং তখনই কেবল তারা শ্রেণি সংগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারে। আমরা যদি জাতীয় আন্দোলনের নেতা হওয়ার চেষ্টা করি তাহলে আমরা সেই নেতা হতে পারব না। আমরা বিভিন্ন জাতিসত্তার লেজুড়ে পরিণত হব।..’
বদরুদ্দীন উমর চারু মজুমদারের এই বক্তব্যের সমালোচনা করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, ‘জাতীয় সংগ্রাম ও শ্রেণি সংগ্রামকে সম্পূর্ণ গুলিয়ে ফেলে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে কমিউনিস্টদের ভূমিকা সম্পর্কে এখানে চারু মজুমদারের এই বক্তব্যের মধ্যে যে হতবুদ্ধিতা সহজেই লক্ষণীয় সেই হতবুদ্ধিতাই ১৯৭১ সালের যুদ্ধকালীন অবস্থায় মার্কসবাদী-লেনিনবাদীদের পেয়ে বসেছিল। তার বশবর্তী হয়েই তাঁরা একই সঙ্গে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীসহ মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, আওয়ামী লীগসহ ভারতীয় সম্প্রসারণবাদ ও সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ এবং দেশিয় শ্রেণিশত্রুদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলেন।’
এদিকে জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে লেনিনের দুই ধরণের বক্তব্য রয়েছে। একজায়গায় তিনি জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা করেছিলেন। সেই বিরোধিতা ছিল সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির কিংবা পররাজ্য গ্রাস করার প্রবণতা থেকে সৃষ্ট জাতীয়তাবাদের বিরোধিতা। তিনি বলেছিলেন ‘জাতীয়তাবাদ যত শোভন যত দরকারিই হোক না কেন, তার সঙ্গে কোনো আপোষ নাই।’
আমরা জানি, ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ পর্যায়’ শিরোনামে লেনিন একটি গুরুত্বপূর্ণ বই লিখেছিলেন। বইটি যতটা না পাণ্ডিত্যপূর্ণ তার চেয়ে অনেক বেশি বাস্তবমুখি। সাম্রাজ্যবাদ যুদ্ধ বিগ্রহের জন্য দায়ি। যা যুদ্ধ ক্ষেত্রে একদেশের শ্রমিকদের অন্য দেশের শ্রমিকদের হত্যা করতে প্ররোচিত করে। এর সবই করে জাতীয়তাবাদের জজমা তুলে। একমাত্র উপায়ে শ্রমিকরা এই পরিস্থিতি এড়াতে পারে তা হলো শ্রমিকরা যদি তাদের প্রভুদের দিকে তাক করে বন্দুকের নল ঘুরিয়ে দেন। অন্যভাবে বলতে গেলে বলা যায় সাম্রাজ্যবাদ শ্রমিকদের সামনে একটি মাত্র পছন্দের রাস্তা খুলে দেয়। তা হলো, হয় নিজেদের ও সাথী শ্রমিকদের ধ্বংস কর নয়তো ধনতান্ত্রিক ব্যবস্থার মূলোচ্ছেদ করো। এই প্রেক্ষাপটে ভ ই লেনিন জাতীয়তাবাদের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সতর্ক করেছেন।
অপরদিকে, নিপীড়িত জাতিসমূহের লড়াই চলছে, সেখানে তিনি সেই জাতীয় মুক্তির লড়াইকে সমর্থন করেছেন। আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার বা জাতি সমূহের মুক্তি বা জাতীয় মুক্তির লড়াই প্রগতিশীল। এই লড়াইয়ের ভেতর সুপ্ত রাখতে হয় শ্রেণি সংগ্রামের ভ্রূণ। এর বিপরীতে বুর্জোয়ারা এই লড়াই করে জাতীয়তাবাদের জায়গা থেকে, সেখানে থাকে জাত্যাভিমান। নিজ জাতির শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করার বাতিক। কমিউনিস্টরা নিজ দেশে জাতীয় মুক্তির লড়াই করেন। সেখানে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে একটা দ্বান্দ্বিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। সুযোগ থাকলে সেই লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। অন্য দেশের নিপীড়িত জাতির লড়াইকে সমর্থন করেন। সেটা সমর্থন করেন সেই জাতির সবচেয়ে অগ্রসর অংশের মাধ্যমে। লেনিন দেখিয়েছেন, “সমাজতন্ত্রীদের উচিত বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক জাতীয় মুক্তি আন্দোলনগুলির মধ্যস্থ সর্বাধিক বিপ্লবী উপাদানগুলিকে সমর্থন করা।” যদিও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে মুজিব-ইন্দিরা বলয়ের শক্তিকে রাশিয়ার সমর্থন কখনো লেনিনীয় পথ নয়।
জাতীয়তাবাদের বিরোধিতাকারী পূর্ববাংলার কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা জাতীয় মুক্তির লড়ায়ের সঙ্গে শ্রেণি সংগ্রামের মেলবন্ধন ঘটানোর সূত্র বের করার দায় অনুভব করেননি। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের সঙ্গে কোন সমীকরণে মিলতে হবে, তার একটা সূত্র দেখিয়েছেন লেনিন।
আর এখানে আমাদের কমিউনিস্টগণের বক্তব্য অবস্থান কর্মসূচিতে ছিল বালখিল্যতা ও অসামঞ্জস্যতায় ঠাসা। কখনো বাম হঠকারী, কখনো ডান সুবিধাবাদী।
জাতীয় মুক্তির আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন কমিউনিস্টদের একাংশ সেই আন্দোলনের সঙ্গে এভাবে একাত্ম হয়েছেন যে, তারা জাতীয় সংগ্রামকে এতটাই গুরুত্ব দিয়েছেন যে, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদীদের থেকে নিজেদের আর পার্থক্য রাখেন নি। বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী নেতাকে নিজেদের নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছেন। পাশাপাশি তারা শ্রেণিসংগ্রামকেও করে তুলেছেন গুরুত্বহীন। যারা মাত্র মাসখানেক আগে জাতীয় মুক্তির লড়াইকে ‘বাঙ্গালী বিরোধী জিগির’ এবং ‘বিচ্ছিন্নবাদ’ বলে সেখান থেকে নিরাপদ দূরে থেকেছেন, ছয় দফাকে বলেছেন সিআইয়ের দলিল। অপরদিকে, কেউ কেউ বিশুদ্ধ শ্রেণি সংগ্রামকে সংগঠিত করতে গিয়ে জাতীয় সংগ্রামকেই এতটাই গুরুত্বহীন করে তুলেছেন যে, জাতীয় মুক্তির মূলশ্রোতধারা থেকে ছিটকে পড়েছেন। চাই কি একাত্তরে, কিংবা সাতচল্লিসে। এখানে সংক্ষেপে একেবারে শুরুর দিকে লেনিন বনাম এমএন রায় বিতর্কের কথা উল্ল্যেখ করছি। যেখান থেকে একাত্তরেও শিক্ষা নিতে পারেননি।
ভারতের মত দেশে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের বিকাশের প্রশ্নে লেনিনের অবস্থান কী ছিল, তা আরো একবার দেখা যাবে এমএন রায়ের ‘পরিপুরক থিসিসে’ তার সংশোধনে। লেনিনের ‘বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক জাতীয় আন্দোলনের’ জায়গায় লেখা হয়েছিল ‘মেহনতীদের শ্রেণি সংগ্রাম’। পরে লেনিন তা কেটে দেন (‘কমিউনিস্ট’, ৭ নং, ১৯৬৭)। সোজাসুজি লেনিন বলেছেন, পশ্চাৎপদ দেশে ‘যে কোনো জাতীয় আন্দোলন’ হতে পারে কেবল ‘বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক’। (খণ্ড ৪১, ২৪২-২৪৩ পৃ:)।
প্রাচ্যের কমিউনিস্টদের নিকট তিনি আবেদন করেন : ‘এসব জাতিকে যা জাগিয়ে তুলছে, না জাগিয়ে পারে না, এবং যার একটা ঐতিহাসিক ন্যায্যতা আছে, সেই বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের ওপর ভিত্তি করতে হবে আপনাদের। সেই সঙ্গে আপনাদের মেহনতী ও শোষিত জনগণের কাছে যাবার রাস্তা পাততে হবে..’।
১৯২০ সালে কমিন্টার্নের দ্বিতীয় কংগ্রেসের জাতীয় ও উপনিবেশিক কমিশনে যে আলোচনা হয়, তাতে রায়ের প্রতিবাদ করেন লেনিন (সভার বিবরণী অনুসারে) বলেন, ‘জারতন্ত্রের বিরুদ্ধে অভিযানের সময় আমরা রাশিয়ার উদারনৈতিক মুক্তি আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়েছিলাম। ভারতীয় কমিউনিস্টরা বুর্জোয়া-গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সঙ্গে মিশে না গিয়ে তাকে সমর্থন করতে বাধ্য’(‘ভ ই লেনিন ও কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক’ ১৯৭০, ৬৫পৃ)
কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিকের দ্বিতীয় কংগ্রেসে (১৯ জুলাই-৭ আগস্ট, ১৯২০) এসব প্রশ্নে লেনিনের উপস্থাপনা ছিল কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক এবং কমিউনিস্ট দলগুলি উপনিবেশ এবং পশ্চাৎপদ দেশগুলিতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলনকে অবশ্যই সমর্থন জানাবে তবে এই শর্তে, তা হলো সর্বহারা আন্দোলনের স্বচ্ছতা ও স্বাধীনতা, যত ভ্রূণ আকারেই থাকুক না কেন, তা বজায় রাখতে হবে। ‘এই শর্তে যে, সেখানকার কৃষক ও ব্যাপক মেহনতী জনগণকে বিপ্লবী প্রেরণায় শিক্ষিত ও সংগঠিত করার কাজে ওই আন্দোলনের প্রতিনিধিরা আমাদের বাধা দেবে না।’ অপরদিকে লেনিনীয় তত্ত্বের বিরোধিতা করে ওই কংগ্রেসে উপস্থিত ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি এমএন রায়ের মত ছিল, ‘শোষক দেশগুলির বুর্জোয়া শ্রেণি এবং উপনিবেশগুলির বুর্জোয়া শ্রেণির মধ্যে এক ধরনের বোঝাপড়া তৈরি হয়েছে, যার ফলে প্রায়শই দেখা যায় যে, শোষিত দেশগুলির বুর্জোয়া শ্রেণি জাতীয় আন্দোলনের সমর্থক হয়েও সাম্রাজ্যবাদী বুর্জোয়া শ্রেণির সঙ্গে সম্পূর্ণ সহমত পোষণ করে। অর্থাৎ সমস্ত বিপ্লবী সংগ্রাম এবং বিপ্লবী শ্রেণির বিরুদ্ধে দমনমূলক ব্যবস্থা নিতে তাদের সঙ্গে হাত মেলায়।’
বিশ শতকজুড়ে উপনিবেশিক দেশগুলোতে জেগে ওঠে জাতিগত মুক্তির তীব্র আকাঙ্ক্ষা। দেশে দেশে জাতিগত মুক্তির লড়াই প্রবল হয়ে ওঠে। তীব্রতর হয়ে উঠে জাতীয়তাবাদী আবেগ আর স্বাধীনতার জন্য জীবনবাজী রেখে লড়বার সাহস। ঠিক সেই সময় এমএন রায়ের এই ধরনের তত্ত্বায়নের প্রভাবে ভ্রূণেই শ্রেণি সংগ্রামের সঙ্গে জাতীয় সংগ্রামের মেলবন্ধনের সুযোগটি মার খেয়ে যায়। কমিউনিস্ট আন্দোলন পিছিয়ে আসে লেনিনীয় পথ থেকে।
একই ভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে ও জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধেও কমিউনিস্টদের একাংশ একই ধরণের রাজনৈতিক লাইন অনুসরণ করেছিলেন। তারাও লেনিন থেকে শিক্ষা নিতে পারেননি। স্বাধীনতার রাজনীতি অনুধাবন করতে সক্ষম হননি উভয় অংশই। অর্থাৎ সময়টা ছিল জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ের অধীনস্থ করেই শ্রেণি সংগ্রামকে এগিয়ে নেওয়ার কালপর্ব।
পুর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মনিসিংহ) ১৯৭১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারিতে, স্বাধীনতা ঘোষণার মাস খানেক আগে গৃহীত ছয় দফা প্রস্তাবের ওপর নজর দিলেই তা পরিস্কার হয়ে যাবে। তিন নাম্বার প্রস্তাবে আছে,‘কিছু উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী তথাকথিত স্বাধীন পূর্ব বাংলার নামে অবাঙ্গালী বিরোধী জিগির তুলিয়া এবং মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের আওয়াজ তুলিয়া জনগণের মনে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরোধী মনোভাব গড়িয়া তুলিয়া অবস্থাকে আরো জটিল ও ঘোরালো করিয়া তুলিয়াছে।’
এর পঞ্চম নাম্বার প্রস্তাবের শেষের দিকে আছে, ‘এই পরিস্থিতিতে পূর্ব বাঙলায় আমাদের কর্তব্য হইবে, বাঙ্গালীদের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি অনুসারে জনগণের এই সংগ্রামে শরীক থাকা এবং ওই নীতির ভিত্তিতে সকল গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করিয়া এই সংগ্রামকে সঠিক গণতান্ত্রিক পথে পরিচালিত করিতে প্রচেষ্টা করা। এই ক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার জনগণকে বুঝাইতে হইবে যে, এই সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষী জাতির জনগণ ও অবাঙ্গালী জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বরং উহা পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের সমশত্রু সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও একচেটিয়া পুঁজির বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং এই সংগ্রাম সারা পাকিস্তানের বিভিন্ন ভাষাভাষীর জাতির জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের অঙ্গ। এই সংগ্রামে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানের সহাযোগিতা ও সমর্থন চাই এবং তাহাদের জাতীয় অধিকার ও গণতন্ত্রের সংগ্রাম আমরা সমর্থন করি। এই সংগ্রামের সফলতার জন্য উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের অবাঙ্গালী বিরোধী জিগির এবং মওলানা ভাসানীর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ বিরোধী জিগিরের মুখোশও আমাদের খুলিয়া দিতে হইবে।’
বোঝা যাচ্ছে, পাকিস্তানের রাষ্ট্র ও সরকার যে এই অঞ্চলের জনগণের প্রধান শত্রু, সেটা অনুধাবন করতে সক্ষম হয়নি পার্টি। তার পরির্বতে সাম্রাজ্যবাদকে প্রধান শত্রু বিবেচনা করে জনগণের লড়াইয়ের পশ্চাৎপদ অংশের অনুগামী হয়ে থেকেছেন তারা।
প্রায় একই ধরনের তত্ত্বগত বিভ্রান্তি লক্ষ্য করা গেছে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধে কমিউনিস্টদের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে। ওই অংশ সম্পর্কে বদরুদ্দীর উমরের লেখা ‘একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙলাদেশে কমিউনিস্টদের রাজনৈতিক ভূমিকা’ গ্রন্থের ভূমিকায় তিনি বলেছেন,
“১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ পাকিস্তান সামরিক বাহিনী আমাদের জনগণের ওপর যে সর্বাত্মক আক্রমণ করেছিল সেটা ছিল যুদ্ধ ঘোষণারই নামান্তর। কাজেই তারা সেই আক্রমণের মাধ্যমে আমার ওপর যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছিল সে যুদ্ধে তাদের বিরুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যে কোনো গণতান্ত্রিক ও বিপ্লবী শক্তি, গ্রুপ বা পার্টির পক্ষে ছিল অপরিহার্য কর্তব্য। এই কর্তব্যের কথাই এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে তখন আমাদের পার্টি নেতাদের মুখে শোনা গিয়েছিল। ঢাকার বাইরে যাওয়ার আগে ১ লা এপ্রিল সুখেন্দু দস্তিদার, আব্দুল হক প্রভৃতি তৎকালীন কয়েকজন পার্টি নেতার সাথে যে আলাপ হয় তাতে তাঁরা যে শুধু যুদ্ধে অংশগ্রহণের কথাই বলেছিলেন তাই নয়। ভাসানী ন্যাপসহ বিভিন্ন বাম দল, এমনকি আওয়ামী লীগের সাথেও ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করার কথাও সে সময় প্রাথমিকভাবে আলোচনা হয়েছিল।
এপ্রিলের ১৪ তারিখে আমি ছিলাম ধলুইতলা নামে যশোর জেলার এক গ্রামে। ঐদিন সন্ধ্যায় রেডিও পাকিস্তানের এক খবরে শুনলাম চৌ এন লাই, চীনা প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তান সরকারের কাছে পাঠানো এক বাণীতে বলেছেন যে, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সুখ সমৃদ্ধি পাকিস্তানের অখণ্ডতার ওপর নির্ভরশীল। দ্বিতীয়ত যারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করছে তারা হলো মাত্র মুষ্টিমেয় লোক।’ রেডিও পাকিস্তান প্রচারিত এই সংবাদ শুনে আমি শুধু স্তম্ভিতই হলাম না, খুব ভীতও হলাম।.. .. .. চৌ এন লাইয়ের বক্তব্য শোনার পর আমি পরদিনই ঢাকায় রওনা দিলাম।... ঢাকায় ফিরে যা দেখলাম এবং সুখেন্দু দস্তিদার ও অন্যদের যে বক্তব্য শুনলাম তার থেকে স্পষ্ট বোঝা গেল যে আমাদের সর্বনাশ হয়েছে। নিজের দেশের সুনির্দিষ্ট বাস্তব পরিস্থিতির সঠিক বিশ্লেষণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়ে পার্টি নেতারা চীনের বক্তব্য অনুযায়ী রাতারাতি এমন অবস্থান গ্রহণ করলেন যাতে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে আওয়ামী লীগ ও মুক্তিবাহিনী এবং পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীর পারস্পরিক সংঘর্ষ তাঁদের লাইন অনুযায়ী হয়ে দাঁড়ালো দুই কুকুরের যুদ্ধ!”
মুক্তিযুদ্ধে বিভক্ত কমিউনিস্টদের অধিকাংশ গ্রুপের ছিল বিভ্রান্তিমূলক তত্ত্বগত অবস্থান। যা তাদের কর্মীদের অসীম সাহস ও অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখে। এত বিভক্তি ও এত বিভ্রান্তি সত্ত্বেও এসব হতোদ্যম বামপন্থার সম্মিলিত সামরিক তৎপরতা ছিল মুক্তিযুদ্ধকালের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। নরসিংদীর শিবপুরে কাজী জাফর, মান্নান ভূঁইয়া, জুনোদের যুদ্ধ; বরিশালের পেয়ারা বাগানে সিরাজ সিকদারের প্রতিরোধ যুদ্ধ, চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতা কমরেড আহমদ হোসেনের নেতৃত্বে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঘটনার মত অসংখ্য ঘটনা এখনো চাপা পড়ে আছে, তেমন আলোচনায় আসেনি। ভারত থেকে ট্রেনিং নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফেরার আগে দেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ জারি রেখেছিল বামপন্থীরাই। ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপ, ন্যাপ, কমিউনিস্টদের বিভিন্ন গ্রুপ দলীয় পরিচয় অগ্রাহ্য করে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে।
বস্তুত, বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ হল সীমাবদ্ধতাসহ প্রগতিশীল লড়াই। মুক্তিযুদ্ধে আপাত বিজয় সম্পন্ন হয়েছে। পরাধীন বা প্রায় উপনিবেশিক দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার হিস্যা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও লোভনীয় পদ-পদবি নিয়ে বিদেশি-বিজাতীয় শাসকদের সঙ্গে স্থানীয় উঠতি বুর্জোয়াদের কখনো বৈরী কখনো অবৈরী দ্বন্দ্ব থাকে। সেকারণে তারা জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে সীমিত আকারে প্রগতিশীল ভূমিকা রাখে। কিন্তু স্বাধীন দেশে ওই বুর্জোয়া শ্রেণি রাষ্ট্রযন্ত্র হাতে পেয়ে লুটেরা ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিতে পরিণত হয়। প্রকাশ পায় তাদের গণবিরোধী চরিত্র। ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ-ভারত স্বাধীন হওয়ার পর জওহর লাল নেহেরুর সরকার, পাকিস্তানে নবাবজাদা লিয়াকত আলি খানের সরকার এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনের পর শেখ মুজিবুর রহমানের সরকারের বেলায় এ বিশ্লেষণ সর্বাংশে মিলে যায়। যুদ্ধপূর্ব সময়ে যাদের সীমিত পর্যায়ে যে প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল, শাসনক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা মেহনতী জনগণের প্রধান প্রতিপক্ষের কাতারে চলে যায়। আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়ন এবং যুদ্ধপূর্ব ভূমিকার নির্মোহ বিচারমূলক পর্যালোচনা ছাড়া এই সময়ের কমিউনিস্ট আন্দোলন দানা বাঁধবে না। এখানে কমিউনিস্ট আন্দোলন সম্পর্কে কমরেড আইউব রেজা চৌধুরীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “বাংলাদেশে কমিউনিস্ট আন্দোলনে তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক অবস্থানের দিক থেকে দীর্ঘদিন যাবত দুটি প্রাধান্যমূলক ধারা ক্রিয়াশীল রয়েছে। একটি হল মণি সিংহ ধারা (মণি সিংহ-খোকা রায়-অনিল মুখার্জি-বারীন দত্ত)। অপরটি হল আব্দুল হক ধারা (আব্দুল হক-মোহাম্মদ তোয়াহা-সুখেন্দু দস্তিদার-অজয় ভট্টাচার্য)। বাংলাদেশে এ সময়ে মণি সিংহ ধারার প্রধান বৈশিষ্ট হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের (একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ) শ্রেণিসমন্বয়মূলক বা লেজুড়বৃত্তিমূলক মূল্যায়ন। বাংলাদেশের বুর্জোয়া পার্লামেন্ট ও বুর্জোয়া নির্বাচনের ভূমিকার অতি ইতিবাচক মূল্যায়ন। অপরদিকে বাংলাদেশে এসময়ে আব্দুল হক ধারার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের (একাত্তরের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধ) যান্ত্রিক বা নেতিবাচক মূল্যায়ন। বাংলাদেশে বুর্জোয়া পার্লামেন্ট ও বুর্জোয়া নির্বাচনের ভূমিকার অতি নেতিবাচক মূল্যায়ন। বাঙলাদেশের পুঁজিবাদের বিকাশের ধারার বিশ্লেষণ ও মূল্যায়নে অক্ষমতা।
বাঙলাদেশে রুশপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সুনির্দিষ্ট রূপ হল মণিসিংহ ধারা। বাঙলাদেশে চীনপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সুনির্দিষ্ট রূপ হল আব্দুল হক ধারা।
..... বাঙলাদেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের বেশির ভাগ অংশ এখনো হয় মণি সিংহ ধারা নতুবা আব্দুল হক ধারারই অন্তর্ভুক্ত।”
তিনি আরো বলেছেন, “চীনপন্থী রাজনীতি ছিল মূলত যান্ত্রিক ও হঠকারী। (কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রগতিশীল উপাদনসহ)। অপর কথায় চীনপন্থী রাজনীতি ছিল মূলত বাম তরফের সংশোধনবাদী।”
“..রুশপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতি ছিল মূলত: শ্রেণি সমন্বয়মূলক ও আপোষমূলক (সাধারণভাবে কিছু কিছু প্রগতিশীল উপাদান সহ)। অপরকথা রুশপন্থী রাজনীতি হল ডান তরফের সংশোধনবাদী। এখানে আরও উল্লেখ করা প্রয়োজন রুশপন্থী কমিউনিস্ট রাজনীতির সঙ্গে ভারতপন্থী রাজনীতি ছিল বিশেষভাবে সম্পর্কিত বা জড়িত।”
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী থেকে প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অবসান হয়েছে। বর্তমান যুগ হল পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগ। পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগে একটি স্বাধীন দেশের বুর্জোয়া শ্রেণিই হল সেই দেশের শ্রমিক, গরীব কৃষক এবং অর্থনীতির সূচকে নিচের দিকে গড়াতে থাকা ক্ষয়িষ্ণু মধ্যবিত্তের প্রধান শত্রু। তাই দেশীয় শাসক শ্রেণিকে উচ্ছেদের লড়াই হল প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম। তেল গ্যাস বিদ্যুৎ বন্দর খনিজ সম্পদ ও সুন্দর বন রক্ষার লড়াই হল রাজনৈতিক চরিত্র বিশিষ্ট সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই এবং পরিবেশ রক্ষার সংগ্রাম। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলন, নারীর ওপর নিগ্রহের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলন হল সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রাম। সাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ হল মেহনতী জনগণের নিকৃষ্ট শত্রু। ভারতীয় আধিপত্যবাদ বিরোধী লড়াইও অন্যতম মূল লড়াই। প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রামের অধীনস্থ করেই এসব সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হবে। আর প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম হল দেশিয় শাসকশ্রেণির উচ্ছেদের লড়াই।
দেশিয় বুর্জোয়া শ্রেণির (মুসলিম লীগ) হাতে প্রথমে ব্রিটিশ পরে আওয়ামী লীগের হাতে পাকিস্তান উচ্ছেদ হয়। শাসন ক্ষমতা হাতে পেয়েই এই শ্রেণিটি শোষণ-নির্যাতনমূলক ব্যবস্থার পূনরুজ্জীবন ঘটায় এবং অবাধ লুটতরাজ জারি রাখে। যে কাজটি সাম্রাজ্যবাদীরা করতো বাইরের দেশ থেকে এসে, একই কাজ নিজ দেশে আরো নিষ্ঠুর, আরো পাশবিক, আরো হিংগ্রভাবে করা শুরু করে দেশীয় এই শাসকেরা। এ কথাটি শ্রীলঙ্কাসহ উপমহাদেশের সকল দেশের ক্ষেত্রেই খাটে। দেশিয় শাসকেরা ব্রিটিশ ও পাকিস্তানের ফেলে দেওয়া পচাগলা রাষ্ট্রের পুনরুজীবন ঘটায়। সেই রাষ্ট্র হল প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদী যুগের ইতিহাসের আবর্জনা। এই রাষ্ট্র ও সরকার তথা দেশিয় শাসকদের উচ্ছেদের কর্তব্য হল প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম।
এই শ্রেণিটিই জারি রেখেছে শোষণ, লুটতরাজ, চুরিচামারি আর নির্যাতন। তাদের ওপর ভর করেই জারি আছে সাম্রাজ্যবাদের শোষণ ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদ। তাদের উচ্ছেদ ছাড়া সাম্রাজ্যবাদের ও ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের উচ্ছেদ সম্ভব নয়। এই দেশীয় শাসক শ্রেণি উচ্ছেদের ধারায় এসব দেশের সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন জয়যুক্ত হতে পারে। শুধু শোষণ-লুণ্ঠন ও নির্যাতনই নয়, এদের অযোগ্যতা ও অব্যবস্থাপনা মানুষকে তিলে তিলে ধ্বংস করছে। এই শাসকশ্রেণির হাতে ঘুষ-দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনা, যানজট, জলজট এবং ধর্মীয় উম্মাদনায় মানুষ হত্যা সহ নানা অপকর্ম সংঘটিত হচ্ছে। নদী, পাহাড়, বন, বাতাস, পানি, মাটি সবকিছুই দূষিত, দখল ও উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, জার্মান ফ্রান্স ইতালী ব্রিটেন প্রভৃতি উন্নত পুঁজিবাদী দেশে এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি খুঁজে পাওয়া যাবে না। সেসব দেশে ব্যাপক শোষণ থাকলেও জনগণের অনেক মৌলিক চাহিদার দায় নিতে রাষ্ট্র অনেকটা সক্ষম হয়েছে। তাই বিপ্লবের দায় কম অনুভব করছে সেসব দেশের জনগণ, এমনকী মেহনতী জনগণও। ওইসব দেশের জনগণের মধ্যে সমাজতন্ত্র সম্পর্কে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছে সেখানকার শাসকশ্রেণি। সবমিলে বিপ্লবের ভরকেন্দ্র এখন প্রচ্যের দেশ সমূহ বিরাজ করছে।
জাতীয় মুক্তির কালপর্বে যে সকল উপনিবেশিক দেশে কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের পতন ঘটে, সেখানে সমাজতন্ত্র অভিমুখি বিপ্লব সাধিত হয়েছে। যেমন চীন, ভিয়েতনাম ইত্যাদি। এই কালপর্বে এশিয়া, আফ্রিকা, ল্যাটিন আমেরিকায় দেখা গেছে ইউরোপের মত কমিউনিস্ট ইশতেহারে বর্ণিত ‘কমিউনিজমের ভুত’। অপরদিকে, যেসব উপনিবেশিক দেশে জাতীয় মুক্তির লড়াইয়ে কমিউনিস্টরা নেতৃত্ব দিতে সফল হননি, সেখানে সময় তাদের জন্য বসে থাকেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর পৃথিবী থেকে প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অবসান ঘটে। সেইসঙ্গে জাতীয় মুক্তির কালপর্বে সমাজতন্ত্র অভিমুখী বিপ্লবের সুযোগ কালের গর্ভে বিলীন হয়ে যায়। ইতিহাস পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদের যুগে প্রবেশ করে।
আমাদের মতে, প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদের অবসানের পর, ইতিহাস নতুন কর্তব্য দাবি করছে। এই যুগে জাতীয় মুক্তির প্রশ্নের চেয়ে শ্রেণি মুক্তির প্রশ্নটি জরুরি। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াই হল জাতীয় সংগ্রাম আর দেশিয় শাসকশ্রেনির উচ্ছেদের লড়াই হল শ্রেণি মুক্তির প্রশ্ন। শ্রেণি সংগ্রামের অধীনস্থ করে এই যুগে জাতীয় সংগ্রামের অপূরিত কর্তৃব্য এগিয়ে নেওয়ার যুগ। এই যুগ অতীত আন্দোলনের ভুলভ্রান্তি বিচ্যুতি চিহ্নিত করার যুগ। একই সঙ্গে কমিউনিস্ট আন্দোলনের অগ্রগতি ইতিবাচক দিকগুলো চিহ্নিত করার যুগ। এখন তত্ত্বগত পুর্ণগঠনের সময়। এই কাজে ইতিহাস আর বেশি সময় দেবে না কমিউনিস্টদের।
এই যুগ হল লেনিনোত্তর বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিপ্লবী পুনর্গঠনের যুগ। লেনিনোত্তর বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিচারমূলক পর্যালোচনা ও সারসংকলনের যুগ। সোভিয়েত ইউনিয়নে সমাজতন্ত্র পতন থেকে শিক্ষা নেওয়ার যুগ। এই যুগ হল কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনরুত্থান ও পুনরুজ্জীবনের যুগ। লেনিনোত্তর রাশিয়া ও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির ভ্রান্ত রাজনৈতিক তত্ত্বগত লাইনকে বিচারমূলক পর্যালোচনা করে কমিউনিস্ট আন্দোলনের রেনেসাঁ সৃষ্টির যুগ।