লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 10, 2021, 12:00 AM, Hits: 1083
(১)
শুধু বাংলাদেশের অভিজ্ঞতার দিকে তাকিয়ে যে এই প্রশ্ন মনে জাগা উচিত তা-ই নয়, বরং সমগ্র মুসলিম পৃথিবীর অভিজ্ঞতাও আমাদেরকে এই প্রশ্নের সম্মুখীন করে।
পাকিস্তান কালে ষাটের দশকের বিকাশমান পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণ-অভ্যুত্থান এবং তার ধারাবাহিকতায় সংগঠিত ১৯৭১ সালের পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিতর দিয়ে আমাদের ক্রমবর্ধমান প্রত্যাশার করুণ পরিণতি যখন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেখতে থাকি তখন এই প্রশ্ন আরও প্রবল হয়ে দেখা দেয়। ১৯৯০ সালে আর একটি গণ-অভ্যুত্থান বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পরবর্তী কালের বিরাট আশা জাগানীয়া ঘটনা ছিল। তারও পরিণতি নিদারুণ ব্যর্থতা।
প্রকৃতপক্ষে, আপাত দৃষ্টিতে প্রতিটি সফল গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের, এমনকি জনগণ সম্পৃক্ত যুদ্ধেরও পরিণতি হয়েছে সমাজের অধিকতর পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার পথে নূতন যাত্রার সূচনা, যা একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অংশ হিসাবে সর্বজনীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে বৈধতা লাভ করেছে। এটা কখনও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে কখনও বিএনপি-এর নেতৃত্বে ঘটেছে। কিন্তু যার নেতৃত্বেই ঘটুক প্যাটার্নটা অপরিবর্তনীয়।
(২)
এবার দৃষ্টিটা একটু বাইরের দিকে দেওয়া যাক। কিছুকাল আগে পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মহিমায় মুগ্ধ গণতন্ত্রীরা ২০১১ সালে সংঘটিত আরব দেশগুলির ‘আরব বসন্ত’ নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। এরপর মিসর, সিরিয়া, লিবিয়া ইত্যাদি দেশের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। অধিকাংশ জায়গায় উগ্র ইসলামপন্থীরা প্রাধান্যে চলে এসেছে। গৃহযুদ্ধের আঘাতে সিরিয়া, লিবিয়া বিধ্বস্ত। তিউনিসিয়া এখন পর্যন্ত কী করে মৌলবাদী ইসলামী শক্তির বাইরে টিকে আছে তা জানি না। ২০১১ সালের গণ-অভ্যুত্থানে মিসরে হোসনি মোবারকের পতনের পর নির্বাচনের মাধ্যমে গোপন মৌলবাদী ইসলামী দল ‘মুসলিম ব্রাদারহুড’-এর সঙ্গে সংযুক্ত মুরসির দল ‘ফ্রীডম এন্ড জাস্টিস পার্টি’ ২০১১-২০১২ সালের সাধারণ নির্বাচনে জয়যুক্ত হয়। এর পর ২০১২ সালে মুরসি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, যে আরব বসন্তের গণ-আন্দোলনের আঘাতে হোসনি মোবারকের পতন ঘটে সেই আন্দোলনের অগ্রবাহিনী ছিল উদারপন্থী তরুণ প্রজন্ম। যখন তাদের আন্দোলনের পরিণতিতে জনগণের বিশাল জাগরণ ঘটে তখন তারা তলিয়ে যায় ইসলামবাদী শক্তির জোয়ারে। নির্বাচনের মাধ্যমে ইসলামবাদী মুরসির সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়। এরপর মিসরকে ইসলামবাদী উত্থান থেকে রক্ষা করার জন্য মিসরের সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। ২০১৩ সালে জেনারেল সিসি-এর নেতৃত্বাধীন সেনাবাহিনী মুরসির ইসলামবাদী সরকারকে উৎখাত করে চরমপন্থী ইসলামী শক্তির হাত থেকে মিসরকে রক্ষা করেছে। এরা কতদিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে তা বলা কঠিন। তবে এ ব্যাপারে সন্দেহ নাই যে, মিসরে সেনাবাহিনীর বাইরে জেনারেল সিসি-এর ক্ষমতার এক প্রধান উৎস বিশেষত পাশ্চাত্যের সমর্থন।
এবার একটু তুরস্কের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। এটা ভাবতে কি কষ্ট হয় না যে, মোস্তফা কামাল পাশার দেশ তুরস্কে নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমেই আজ দীর্ঘদিন ধরে ইসলামবাদী এরদোগান সরকার ক্ষমতায় আসীন? ২০০২ সালের সাধারণ নির্বাচনে ভূমিধস জয়ের পর থেকে এরদোগান নেতৃত্বাধীন ‘জাস্টিস এন্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টি’ বা সংক্ষেপে একেপি তুরস্কের ক্ষমতায় আছে। এভাবে মোস্তফা কামালের এবং সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে দীর্ঘদিন ধরে ধর্মমুক্ত হিসাবে যে রাষ্ট্রকে গড়ে তুলা হয়েছিল আজ তা হয়েছে ধর্মাশ্রিত। এবং সেটা হয়েছে শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে কিংবা নির্বাচনমূলক প্রক্রিয়ায় এবং বিপুল জনসমর্থন নিয়েই।
ইতিহাসের এ ধরনের অভিজ্ঞতা অবশ্য সাম্প্রতিক কালের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সুতরাং এখানে ইরানের অভিজ্ঞতার উল্লেখও অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ইরানে সম্রাট বা শাহের স্বৈরতান্ত্রিক শাসন উৎখাত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে সেখানে তুদে পার্টির ভূমিকা সম্পর্কে অনেকেই জানেন। এরা ছিল মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট। জনগণের একটা অংশ, বিশেষত শহরের শ্রমিক ও শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে, এদের শক্ত ভিত্তি ছিল। শাহের শাসন উচ্ছেদের আন্দোলনে তাদের ছিল অগ্রণী ভূমিকা। এই আন্দোলনে তাদের সমান্তরালে ছিল খোমেনীর অনুসারী শিয়া ইসলামবাদীরা। গণ-আন্দোলনের পরিণতিতে যখন ব্যাপক জনগণের অংশগ্রহণে জন-জোয়ার এবং গণ-অভ্যুত্থান ঘটেছে তখন কিন্তু কমিউনিস্টরা তলিয়ে গেছে। ১৯৭৯ সালে শাহতন্ত্র উচ্ছেদ হয় এবং ইসলামবাদীরা ক্ষমতা দখল করে। ইরানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘোষণা করা হয়। এরপর শুরু হয় ইসলাম-বিরোধী হিসাবে তুদে পার্টির নেতা, কর্মী ও সমর্থক নিধন প্রক্রিয়া। এভাবে ইসলামী প্রতিবিপ্লবের বিজয়ের অল্প কিছুদিনের মধ্যে তুদে পার্টিকে নিশ্চিহ্ন করা হল। এখন বহুকাল ধরেই ইরান একটি শিয়া ইসলামী শরীয়া শাসিত রাষ্ট্র।
ইসলাম শাসিত তথা মুসলিম অধ্যুষিত সমাজে আমজনতার শক্তিকে মুক্ত করার পরিণতি প্রগতিশীলদের জন্য কী পরিণতি বয়ে আনতে পারে তার অনেক দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। ইন্দোনেশিয়া, আলজেরিয়াসহ দেশে দেশে তার অনেক দৃষ্টান্ত ছড়িয়ে আছে। আমি সেগুলিতে আর না গিয়ে শুধু আফগানিস্তানের প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করব। আফগানিস্তানে মার্কসবাদীরা সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলও করেছিল। মজার ব্যাপার হল তাদের পার্টির নাম যেমন কমিউনিস্ট পার্টি ছিল না তেমন তারা শেষ পর্যায়ে ১৯৯০ সালে আফগানিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্রও ঘোষণা করেছিল। কিন্তু এসব কৌশলে কাজ হয় নাই। ১৯৯২ সালে মুজাহিদদের হাতে তাদের পতন হয়।
তাদের বেশ কিছু ভুলের মধ্যে ভয়ানক একটা ভুল ছিল ভূমি সংস্কার করতে গিয়ে তারা যেমন ভূস্বামীদেরকে বৈরী করেছিল তেমন মোল্লা নিয়ন্ত্রিত বিশাল কৃষক ও গ্রামীণ জনতাকে পুরাপুরি মোল্লাদের হাতে ছেড়ে দিয়েছিল। অর্থাৎ ভূমি সংস্কার প্রকৃতপক্ষে এমন জনতার শক্তিকে মুক্ত করেছিল যে জনতা ছিল ধর্মাচ্ছন্ন এবং মোল্লা নিয়ন্ত্রিত। এছাড়া নারীর অবস্থার উন্নয়নে সরকারের উদ্যোগও মোল্লা নিয়ন্ত্রিত জনগণকে ক্ষিপ্ত করেছিল।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য এই অবস্থার সুযোগ নেয়। আর এভাবে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে একদিকে যেমন সোভিয়েত সমাজতন্ত্র এবং আফগান আধুনিকায়ন ও সামাজিক অগ্রগতির শক্তির জোট দাঁড়ালো, অপর দিকে তেমন এর বিপরীতে দাঁড়ালো পাশ্চাত্যের গণতন্ত্র এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামবাদী শক্তির জোট।
তারপরের ইতিহাস সবার জানা। আফগানিস্তান পাশ্চাত্য গণতন্ত্রের মহিমায় এখন একটা ধ্বংসস্তূপ। পাশ্চাত্য গণতন্ত্র এবং ইসলামের মধ্যকার মিলনের মধুচন্দ্রিমার কাল শেষ হয়ে এখন সেটা পরস্পর নিধনের মল্লভূমি। আফগানিস্তানের ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে এখন ইসলামের মুজাহিদীন দলে দলে কালাশনিকভ আর স্ট্রিঙ্গার ক্ষেপণাস্ত্র কাঁধে নিয়ে পদচারণা করছে, পাশ্চাত্যের নিশানা খুঁজছে; আর আকাশ পথে তাদের সন্ধানে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের বিমান ও ড্রোন ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ছে, ঘুরছে, বোমা ফেলছে। পাশ্চাত্যের জন্য এ যেন এক অন্তহীন, লক্ষ্যহীন এবং অর্থহীন রক্তাক্ত যুদ্ধ। মুসলমানদের জন্য এ যুদ্ধের অর্থ, লক্ষ্য সবই স্থির, নিশ্চিত হয়ে আছে। তারা মার্কিন এবং পাশ্চাত্য কাফেরদের সাহায্য নিয়ে মার্কসবাদী এবং সোভিয়েত কাফেরদের বিরুদ্ধে যে জিহাদ ক’রে বিজয়ী হয়েছিল সেই জিহাদই এখন তারা করছে মার্কিন বা পাশ্চাত্য কাফেরদের বিরুদ্ধে। তারা মনে করে এই জিহাদে জয়ী হলে তারা হবে গাজী এবং বিশ্বব্যাপী ইসলামী শাসন কায়েমকারী। ফলে আসবে মালে গণীমতের অফুরন্ত সম্পদ ও দাস-দাসী, যার নিশ্চয়তা বিধান কুরআন-হাদীসের বিধান মোতাবেক তাদের ধর্ম করেছে। জিহাদে মৃত্যুবরণ করলে তারা হবে জান্নাতবাসী। ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন অথবা জান্নাত লাভের নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে তারা মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত।
বিশেষ করে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক পৃথিবী এমন এক অবস্থায় পৌঁছেছে যে সেখান থেকে পিছাবার কোনও পথ তারা পাচ্ছে না। এখান থেকে পিছানো মানে এমন এক যুদ্ধঘাঁটি পিছনে ফেলে যাওয়া যা কাজ করবে আগামী দিনে পাশ্চাত্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরেও মুজাহিদদের অব্যাহত যুদ্ধ পরিচালনার এক অফুরন্ত শক্তি-ভাণ্ডার হিসাবে। তখন এ বিপদ থেকে বাঁচবার জন্য মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের লালনভূমি পাশ্চাত্যের সামনে পরমাণু বোমার সাহায্যে আফগানিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করা এবং এভাবে সেখানকার নারী-শিশুসহ প্রায় পৌনে চার কোটি মানুষকে হত্যা করা ছাড়া আর কোন্ উপায় থাকবে? অবশ্য এই সংখ্যার মধ্য থেকে পাকিস্তান ও ইরানের আশ্রয় শিবিরে থাকা প্রায় ত্রিশ লক্ষ আফগান শরণার্থী বাদ যাবে। প্রচ্ছন্নভাবে এই হুমকি অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প অতিসম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী ইমরানের সঙ্গে আলোচনায় দিয়েছেনও। এ সংবাদ আশা করি অনেকেই রাখেন। আফগানিস্তানের আয়তন, ভূ-প্রকৃতি, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান, ইতিহাস-ঐতিহ্য এবং জনমিতি সম্পর্কে যাদের কিছু ধারণা আছে তারা বুঝবেন আফগানিস্তান থেকে পিছু হটা পাশ্চাত্যের জন্য কতখানি বিপজ্জনক হতে পারে। আফগানিস্তানের এই সুবিধাজনক অবস্থানের কারণে লাদেন অনেকদিন পর্যন্ত আফগানিস্তানকে তার সদর দফতর হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের পর এটা পরিবর্তিত বিশ্বপরিস্থিতিতে সমগ্র পৃথিবীর সকল জিহাদী শক্তির সদর দফতর বা রাজধানীতে পরিণত হতে পারে। ‘ইসলামিক স্টেট’ বা আইএস কর্তৃক ইরাক-সিরিয়ায় ইসলামিক খিলাফত প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা সেখানে অনেক বেশী শক্তি নিয়ে পুনরুজ্জীবিত হতে পারে।
(৩)
মুসলিম সমাজকে বুঝতে হলে আগে ইসলাম ধর্মকে বুঝতে হবে। এর জন্য কিছু প্রাথমিক জ্ঞানের জন্য কুরআন, হাদীসের নির্মোহ অধ্যয়ন অত্যাবশ্যক। যারা আরও ব্যাপক অধ্যয়ন করতে চাইবেন তারা সিরাসহ ইসলামী শাস্ত্র ও ইতিহাস অধ্যয়ন করবেন। তবে আমি প্রাথমিক ধারণার জন্য কুরআন এবং কিছু করে হলেও হাদীসের অধ্যয়ন সবচেয়ে জরুরী মনে করি। এছাড়া তাদেরকে বুঝতে হবে ইসলামের বিকাশ ও প্রসারের ইতিহাসকে। তাহলে তারা বুঝবেন মানুষ হলেও মুসলমান কেন অন্য সকল ধর্মাবলম্বী থেকে এত ভিন্ন হয়। ব্যক্তির ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু সামাজিক মুসলমান অর্থাৎ সমাজগতভাবে মুসলমান ভিন্ন মন, মনন ও চরিত্রের। খ্রীষ্টান, বৌদ্ধ কিংবা হিন্দুসহ যে কোন সমাজের পাশে রাখলে সামাজিকভাবে মুসলমানদের বহু ভিন্নতাই ধরা পড়ে।
বিশেষত এটা বুঝতে হবে যে মানব সভ্যতায় বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন সমাজ বা জাতির যে ভূমিকাই থাক আধুনিক যন্ত্র সভ্যতার জন্ম ও বিকাশ হয়েছে পশ্চিম ইউরোপে। পশ্চিম ইউরোপ আধুনিক সভ্যতার জন্ম দিতে পারল, অথচ অন্যরা যে পারল না এর কারণ নিশ্চয় পশ্চিম ইউরোপের সমাজের ভিতরই নিহিত আছে যেমন অন্যদের ব্যর্থতার কারণও তাদের সমাজের ভিতরই নিহিত আছে। পশ্চিম ইউরোপে আধুনিক সভ্যতার উদ্ভবের জন্য নিশ্চয় বিভিন্ন ফ্যাক্টর ক্রিয়াশীল ছিল। সে সবের মধ্যে একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল খ্রীষ্টধর্ম, বিশেষত সেখানকার ক্যাথলিক মতাবলম্বী খ্রীষ্টধর্ম, এবং অপর একটি খুব গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর ছিল সেখানকার সামন্তবাদ। যাইহোক, বিষয়টি বিস্তারিত আলোচনা দাবী করে যেটা এখানে সম্ভব নয়। তবে খুব সংক্ষেপে এখানে আমি খ্রীষ্টধর্মকেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর বলব। এটাও মনে রাখতে হবে যে, যতদিন পশ্চিম ইউরোপে খ্রীষ্টধর্ম এবং তার প্রধান প্রতিষ্ঠান হিসাবে রোমান ক্যাথলিক চার্চ আধিপত্য করেছে ততদিন সেখানে আধুনিক সভ্যতার উদ্ভব ঘটে নাই। কিন্তু তার পরেও এটাই ঘটনা যে, পশ্চিম ইউরোপে খ্রীষ্টধর্মের গর্ভ থেকেই আধুনিক ও ধর্মমুক্ত সভ্যতার উদ্ভব ঘটেছে অন্য কোথায়ও থেকে নয়। অর্থাৎ খ্রীষ্টধর্মের ভিতর এমন কিছু উপাদান ছিল যা সমাজ বিকাশের একটা পর্যায়ে খ্রীষ্টধর্মের আধিপত্য থেকে সমাজকে মুক্ত হয়ে আরও এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছিল। যেমন একটা উদাহরণ দিই। এক স্বামী, এক স্ত্রীর বিধান অন্য কোনও ধর্মে পাওয়া যায় না। এই একটা মাত্র ঘটনার গুরুত্ব যে মানব জাতির জন্য কতখানি তা এক কথায় বলে বুঝানো যাবে না। এটা প্রকৃতপক্ষে আধুনিক সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ গঠনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পূর্বশর্ত। এ ধরনের আরও কিছু রীতিনীতি ও বিশ্বাস খ্রীষ্টধর্মে আছে যেগুলি আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের উপযোগী উপাদানসমূহকে সমাজের গর্ভে লালন করেছে। সুতরাং বাহিরের বা বহিঃশক্তির হস্তক্ষেপে নয়, বরং বিভিন্ন দ্বন্দ্ব এবং যন্ত্রণাদায়ক ও রক্তপাতময় সংঘাতের মধ্য দিয়ে হলেও সমাজ অভ্যন্তর থেকেই স্বাধীনভাবে পশ্চিম ইউরোপে আধুনিক সভ্যতার জন্মলাভ সম্ভব হয়েছে।*
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* এই বিষয় নিয়ে আমি ‘ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা’য় (লিংক : http://www.bangarashtra.net/article/1169.html) আলোচনা করেছি । এ প্রসঙ্গে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে ‘প্রথম অধ্যায় : পশ্চিম ইউরোপের অভিজ্ঞতা’। এটি ‘বঙ্গরাষ্ট্রের’ ‘গ্রন্থাগার’ বিভাগের ধর্ম বিষয়ক গ্রন্থে দেওয়া আছে।
-------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এটা লক্ষ্যণীয় যে, পুঁজিবাদের পথ ধরে হোক আর সমাজতন্ত্রের পথ ধরে হোক পৃথিবীর বিরাট অঞ্চলের খ্রীষ্টান অথবা বৌদ্ধ ধর্ম অধ্যুষিত দেশগুলি আধুনিক সভ্যতার পথ ধরে মর্যাদাপূর্ণভাবে এগিয়ে চলেছে। সমগ্র ইউরোপের দেশগুলি, উত্তর আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড থেকে শুরু করে এদিকে এশিয়ার চীন, জাপান, দুই কোরিয়া, ভিয়েৎনাম ইত্যদি বিপুল সংখ্যক দেশ এখন আধুনিক পৃথিবীতে মর্যাদার জায়গা তৈরী করে আছে। এদের পাশে যে কোনও একটা মুসলিম দেশকে দাঁড় করানো যাক তো!
পৃথিবীর এই যে বিশাল অঞ্চলের উত্থান এর সব কয়টিই কিন্তু খ্রীষ্টান অথবা বৌদ্ধ পটভূমি থেকে আগত। এটা ঠিক যে এখন তারা প্রায় কেউই আর ধর্মের শাসনে নাই। এই দুই ধর্মের শাসন থেকে মানুষ অনেক আগে বের হয়ে আসতে পেরেছিল। অর্থাৎ সামাজিক নিয়ন্ত্রণ রক্ষার ক্ষেত্রে এই দুই ধর্মে কিছু ছাড় বা দুর্বলতা ছিল বলে ধর্ম থেকে মুক্তির মাধ্যমে আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথে তাদের পক্ষে যাত্রা করা ইসলামী সমাজের তুলনায় অন্তত কম কষ্টসাধ্য হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে কেউ হয়ত হিন্দু ধর্মের প্রসঙ্গে কথা তুলবেন। তাদের সমস্যা ঠিক মুসলিম সমাজের মত না হলেও সেটাও যথেষ্ট প্রকট। বিরাট আয়তন, জনসংখ্যা এবং সম্পদের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ভারত কতখানি পিছিয়ে আছে সেটা তার দিকে দৃষ্টি দিলে বুঝা যায়। অবশ্য পাশ্চাত্যের অনুসরণে সেখানে নির্বাচনমূলক সরকার পরিবর্তনের প্রক্রিয়া কোনও ছেদ ছাড়াই ১৯৪৭ থেকে চালু আছে। তা সত্ত্বেও ভারত এবং ইউরোপকে পাশাপাশি রেখে বিচার করলে আধুনিক ও উন্নত সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণে এতটা কালেও ভারতের অর্জন কতটুকু সেই প্রশ্ন সঙ্গতভাবে করা যাবে। তবে ঐ প্রসঙ্গে এখানে আমি যেতে চাই না আমার আলোচনাকে এ পর্যায়ে বেশী ছড়িয়ে দিতে না চেয়ে।
আমি যে কথা ইতিপূর্বে বলেছি সে কথার জের টেনে বলব ধর্ম হিসাবে ইসলাম আধুনিক সভ্য সমাজ নির্মাণের পরিপন্থী। আর সেই কারণে আজ অবধি কোনও মুসলিম সমাজ বাইরের হস্তক্ষেপ ছাড়া স্বাধীনভাবে আধুনিক সভ্যতা নির্মাণ করতে পারছে না। গণতন্ত্রও নয়। ইউরোপীয় কায়দার নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা বরং দেশ ও সমাজকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আরও পিছনের দিকে নিচ্ছে। এটা বুঝতে হবে মুসলিম সমাজের এই ব্যর্থতা তার গরিষ্ঠ জনগণ তথা সমাজেরই অক্ষমতা। এই অক্ষমতা এসেছে তার ধর্ম অর্থাৎ ইসলাম থেকে।
ধর্মের প্রভাবে এবং ধর্মের কারণে মুসলিম সমাজে সাধারণ মানুষ হয় পশ্চাৎপদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল। এখানে উদারনীতি, লোকবাদ কিংবা ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যের ধারণা সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য থেকে বহিরারোপিত এবং এগুলি উপর তলার শিক্ষিত শ্রেণীর মধ্যে সীমিত। সামাজিকভাবে এগুলি শিকড়হীন এবং ভাসমান। সাধারণ মানুষ এসবের ধার ধারে না। সাধারণ অশিক্ষিত, অর্ধশিক্ষিত এবং এমনকি বহু সাধারণ শিক্ষিত মানুষদের ভাবাদর্শিক নেতা হিসাবে মোল্লারা যা বলে সেটাকে সর্বদা বাস্তবে অনুসরণ করতে না পারলেও সেটাই তাদের চেতনায় সত্য পথ হিসাবে সদাজাগ্রত থাকে। এমনকি বিপুল সংখ্যক শিক্ষিত মানুষ নানানভাবে শুধু যে ইসলাম নিয়ে গর্ব করে তা-ই নয়, উপরন্তু পশ্চাৎপদ ও প্রকৃতপক্ষে অশিক্ষিত মোল্লাদেরকে লালন কিংবা পৃষ্ঠপোষকতা দান করে। এই মানুষদের নিকট থেকে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ধর্মীয় কিংবা পরমত সহিষ্ণুতা, ব্যক্তির স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এসব আশা করাই মূর্খতা। ইসলামে এসবের কোনও জায়গা্ই নাই। ইসলাম যেমন অত্যন্ত দৃঢ়বদ্ধভাবে অন্ধবিশ্বাস বা ঈমান এবং মানুষের সর্বাত্মক দাসত্ব বা বান্দাত্বের ধর্ম তেমন সেটা যে সমাজ প্রতিষ্ঠা করে সেটা হচ্ছে অন্ধবিশ্বাস ও দাস মানসিকতার সমাজ।
এই রকম সমাজে গণ-আন্দোলন যতক্ষণ আধুনিক শিক্ষিত মানুষদের বিশেষত সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন ছাত্র ও তরুণদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে ততক্ষণ তা প্রগতিশীল চরিত্র বজায় রাখলেও রাখতে পারে। কিন্তু এটা যখন ব্যাপকতর জনগণকে সম্পৃক্ত করে তখন স্বাভাবিকভাবে প্রথম পর্যায়ে নেতা যারাই থাক আন্দোলনের গতিধারায় জনগণের পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল মনন ও চরি্ত্রের প্রকৃত প্রতিনিধিরাই নেতা হিসাবে আবির্ভূত হয়। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় এরা আধুনিক যুগের চাপে, বিশেষত পাশ্চাত্যের তুষ্টির প্রয়োজনে কিছুটা উদারনীতির ভাব ধরলেও তাদের মূল সুর হয় জনগণের প্রতিক্রিয়াশীল ও ইসলামী মননের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এবং সেটাই ক্রমশ প্রাধান্যে চলে আসে।
এই ছক বা প্যাটার্ন আমাদের দেশের ক্ষেত্রেও বিস্ময়করভাবে প্রযোজ্য। আর সব অভিজ্ঞতা বাদ দেওয়া যাক। শুধু ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের কথাই ধরা যাক। এর সূচনা ঘটে ১৯৬৮ সালের ৬ ডিসেম্বর তারিখে মওলানা ভাসানীর ডাকে এবং তার নেতৃত্বে। ভাসানী একজন পীর বা ধর্মীয় নেতা হলেও বাস্তবে ছিলেন ধর্মবিশ্বাসমুক্ত কমিউনিস্ট কিংবা সমাজতন্ত্রীদের নেতা। ভাসানী নেতৃত্বাধীন গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের ঝটিকা বাহিনী ছিল তার সঙ্গেকার বামপন্থী ছাত্র ও যুব সমাজ। যখন গণ-অভ্যুত্থানের ধাক্কায় কারারুদ্ধ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারীতে মুক্ত হলেন এবং ২৫ মার্চে আইয়ুব সরকারের পতন হল তখন বাস্তবে কী ঘটল? কার হাত থেকে নেতৃত্ব কার হাতে চলে গেল? কেন এমনটা হল এখন কি তা নিয়ে নূতনভাবে চিন্তা করার সময় হয় নাই? হ্যাঁ, আমি নূতন করেই সবকিছু ভাবতে বলছি। এমনকি আমি নিজেও অনেক কিছু নূতন করে ভাবতে চাইছি। তার কিছু আজকের আলোচনায় নিয়ে এলাম।
রচনা : ২৪ জুলাই, ২০১৯