লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ September 2, 2021, 12:00 AM, Hits: 997
আলোচ্যসূচী :
(১) আফগানিস্তান এবং ভিয়েতনামে মার্কিন পরাজয়ের স্বরূপ কি অভিন্ন?
(২) আফগান যুদ্ধে মার্কিন পরাজয় এবং তালিবান বিজয়ের ফলাফল
(৩) আফগান অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
(৪) ইসলামের সঙ্কট
(৫) ভাবাদর্শের শক্তিমত্তা
(৬) নূতন কালের বিপ্লব
(১) আফগানিস্তান এবং ভিয়েতনামে মার্কিন পরাজয়ের স্বরূপ কি অভিন্ন?
আফগানিস্তানে তালিবান হিসাবে পরিচিত ইসলামী জিহাদী শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নেতৃ্ত্বাধীন যুক্তরাজ্য, কানাডা ইত্যাদি রাষ্ট্র সমন্বয়ে গঠিত ন্যাটো সামরিক জোট শোচনীয় পরাজয় বরণ করেছে। বিশেষ করে মার্কিন সামরিক শক্তির এই পরাজয়কে প্রায় সবাই ভিয়েতনাম যুদ্ধে ১৯৭৫ সালে মার্কিন পরাজয় এবং পলায়নের সঙ্গে তুলনা করছেন।
কিন্তু আসলে কি এই দুই পরাজয় এবং প্রায় একই ধরনের পলায়ন তুলনীয়? এটা ঠিক যে, ভিয়েতনামীদের জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ এক অর্থে ছিল জাতীয়তাবাদী যুদ্ধ্ — একটা জাতির স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব এবং অখণ্ড সত্তা প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। কিন্তু একই সঙ্গে এই যুদ্ধ ছিল মার্ক্সীয় সমাজতান্ত্রিক আদর্শ দ্বারা অনুপ্রাণিত, যার মধ্যে ছিল বিশ্বব্যাপী সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নও। অর্থাৎ ভিয়েতনাম যুদ্ধ ছিল একই সঙ্গে জাতীয় স্বাধীনতা এবং সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য নিয়ে সংগঠিত এবং পরিচালিত। এভাবে এর মধ্যে একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদ এবং আন্তর্জাতিকতাবাদ এই দুই আদর্শের সমন্বয় ঘটেছিল।
কিন্তু শুধু এইটুকুতে ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ ছিল না। তখন পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতৃত্বকারী পরাশক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমান্তরালে সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল প্রায় সমরূপ শক্তিধর প্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি। অপর দিকে, ভিয়েতনাম সীমান্ত সংলগ্ন বিশাল চীনও দীর্ঘ বিপ্লবী যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৪৯ সালে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল। এমন অবস্থায় আদর্শিক কারণেও ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সমগ্র সমাজতান্ত্রিক শিবিরের সমর্থন ও সাহায্য পুষ্ট। সুতরাং এক অর্থে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পুঁজিবাদী বিশ্বের সমন্বিত শক্তির বিরুদ্ধে ভিয়েতনামের যুদ্ধ ছিল সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্বেরও যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে তাই ভিয়েতনামে মার্কিন পরাজয়কে শুধু ভিয়েতনামের হাতে মার্কিন পরাজয় হিসাবে অভিহিত করলে সবটা বলা হয় না। এটা এক অর্থে ছিল ভিয়েতনামের ভূমিতে সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কাছে পুঁজিবাদেরও পরাজয়। সেই সঙ্গে অবশ্যই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের কাছে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের নবরূপে আবির্ভূত দখলদারিরও পরাজয়। অর্থাৎ যে কথা একটু আগেই বলেছি, ভিয়েতনামের মুক্তিযুদ্ধ ছিল একই সঙ্গে জাতীয়তাবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক আদর্শে উজ্জীবিত আন্তর্জাতিকতাবাদী।
কিন্তু আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয়কে কী বলা যাবে? এটাকে কি দুই পরাশক্তির মধ্যে সংগঠিত প্রক্সিওয়ারে মার্কিনের পরাজয় বলা যাবে? না, সেটা বলা যাবে না। ১৯৮৯ সালে আফগানিস্তান থেকে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের সঙ্গেও ২০২১-এর আগস্টে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে তুলনা করা যাবে না। তখন সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধটা জিহাদীদেরকে সামনে রেখে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্ব সংগঠিত করেছিল। সেখানে একদিকে পশ্চিমা বিশ্বের সমগ্র শক্তি ও সম্পদ এবং সেই সঙ্গে সমগ্র মুসলিম বিশ্বেরও জিহাদ তথা ইসলামী ধর্মযুদ্ধের শক্তির সমাবেশ ঘটেছিল। উপরন্তু আফগান জিহাদীদের জন্য ছিল পশ্চাদভূমি কিংবা আশ্রয়স্থান হিসাবে আফগানিস্তানের বিরাট সীমান্ত জুড়ে অবস্থিত পাকিস্তান। এবং ছিল মুসলিম বিশ্বের নেতৃত্বদানকারী সৌদী আরবের পেট্রো-ডলারের অফুরান প্রবাহ।
বলা হচ্ছে বিগত ২০ বছরে আফগানিস্তান যুদ্ধে মার্কিনের প্রায় ৩ হাজার সেনা নিহত এবং ২.২৬ ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় হয়েছে। সমগ্র পাশ্চাত্যের ব্যয় সম্ভবত ৩ ট্রিলিয়ন ডলারের অধিক। ২০০১ সালে আফগানিস্তানের তালিবান হিসাবে কথিত জিহাদী সরকারকে উৎখাত করে মার্কিন দখলদারিত্বে যে সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় শেষ দিকে তাদের প্রায় ৩ লক্ষ ৩০ হাজার সেনা ছিল, যারা ছিল অত্যাধুনিক অস্ত্রসজ্জিত ও সুপ্রশিক্ষিত। অথচ মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের সময়সীমা ৩১ আগস্টের আগেই মার্কিন সমর্থিত আফগান সরকার তালিবানের ৭০ হাজার যোদ্ধার নিকট পরাজয় বরণ করল। রাজধানী কাবুল পতনের আগেই আফগান প্রেসিডেন্ট বিমানে করে দেশ ছেড়ে পালালেন। সঙ্গে চার গাড়ি নগদ অর্থও নিলেন। তবে বিমানে জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় একটি গাড়ীর অনেক অর্থ বিমান বন্দরে রেখে যেতে বাধ্য হন। বুঝাই যায় এই চার গাড়ীর অর্থ আফগান মুদ্রার পরিবর্তে ছিল মার্কিন ডলার।
এই সমগ্র যুদ্ধে যেটা বিস্ময়কর সেটা হল এই যে, আফগান জিহাদীরা বিগত ২০ বৎসর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে আন্তর্জাতিক কোনও বৃহৎ শক্তির সাহায্য এবং সমর্থন ছাড়াই। ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার পরাজয়েও একটা সান্ত্বনা পেতে পারে যে, ভিয়েতনামের মতো ক্ষুদ্র দেশের কাছে এটা তাদের হার নয়। বরং বিশাল এবং তখনও পরাক্রান্ত পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃত্বাধীন সমাজতান্ত্রিক শিবিরের নিকট ছিল এটা তার পরাজয়। হয়ত শুধু ভিয়েতনাম একা হলে তাকে পিষে ফেলে দিতে পারত।
কিন্তু আফগান জিহাদীদের পিছনে পরাশক্তি দূরের কথা কোনও রাষ্ট্রও কি ছিল? এটা ঠিক যে, সমগ্র পৃথিবীর ইসলামের উম্মা (সম্প্রদায়) ও জিহাদের (ইসলামের ধর্মীয় যুদ্ধ) চেতনায় উদ্বুদ্ধ মুসলিমদের ব্যাপক সমর্থন এবং কিছু ক্ষেত্রে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত জিহাদী মুসলিমরাও মার্কিন বিরোধী গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু বাহির থেকে আগত কিছু সংখ্যক জিহাদীর অংশগ্রহণ থাকলেও এটা ছিল প্রধানত আফগান জিহাদীদের যুদ্ধ। একই সঙ্গে এটা উল্লেখ্য যে, সব জিহাদী যে একক বা ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বাধীনে যুদ্ধ করেছিল তা নয়। জিহাদে তালিবান নামে অভিহিত গোষ্ঠীর প্রাধান্য থাকলেও এখানে আইএস জিহাদীদের আলাদা ভূমিকা ছিল, যেটা এখন তাদের স্বতন্ত্র এবং অনেক ক্ষেত্রে তালিবান বিরোধী ভূমিকা থেকে বেরিয়ে আসছে। এছাড়া আছে উত্তরের পানশির উপত্যকায় সমবেত নর্দার্ন অ্যালায়েন্স হিসাবে পরিচিত জিহাদী গোষ্ঠীর ভূমিকা। বিভিন্ন সংগঠন এবং গোষ্ঠীতে বিভক্ত হলেও ইসলামী চেতনা সবার জিহাদে এক ধরনের ঐক্যও এনেছিল। কারণ জিহাদটা ছিল ‘কাফের’ আমেরিকা এবং পাশ্চাত্যের বিরুদ্ধে।
এটা ঠিক যে, আফগানিস্তানের পার্বত্য ভূ-প্রকৃতি জিহাদীদের দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা যুদ্ধের জন্য সহায়ক ছিল। কিন্তু সেটাই যথেষ্ট ছিল না এই যুদ্ধজয়ের জন্য। দরকার ছিল এমন মনোবলের যাতে অতিক্ষুদ্র শক্তি নিয়েও মহাশক্তিকে এভাবে পরাজিত এবং বিতাড়ন করা যায়। এর তুলনা যেন হাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইঁদুর কিংবা বেজীর জয় এবং পরাজিত হাতির প্রাণ বাঁচানোর জন্য ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন হতে পারে।
মার্কিনের তুলনায় অতিক্ষুদ্র এক দেশ ভিয়েতনামের যুদ্ধে জাতীয়তাবাদ যেমন ছিল প্রেরণার উৎস তেমন প্রেরণার অন্যতম উৎস ছিল সমাজতন্ত্রের আদর্শ হিসাবে মার্কসবাদ। এই দুই আদর্শকে সমন্বিত করে ভিয়েতনামীরা অসাধ্য সাধন করেছিল পরাশক্তি মার্কিন বাহিনীকে পরাজিত এবং বিতাড়ন করে।
আফগান জিহাদীদের ক্ষেত্রে কোন্ আদর্শ ছিল মূল চালিকা শক্তি, যা তাদেরকে এমন বিজয়ের পথে এভাবে নিয়েছে? জাতীয়তাবাদ অবশ্যই ছিল। সেটা হল আফগান জাতীয়তাবাদ। তবে এ কথা বুঝতে পারতে হবে যে, আজকের তালিবান নামে কথিত জিহাদীদের উত্থান কিন্তু মোটেই জাতীয়তাবাদের পতাকা হাতে নিয়ে নয়। বরং তাদের নিকট কাফের হিসাবে চিহ্নিত মার্কসবাদী আফগান সরকারের বিরুদ্ধে ইসলামের পতাকা হাতে নিয়ে তাদের উত্থান। ১৯৬৫ সালে গঠিত মার্কসবাদী-লেনিনবাদী আদর্শের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পিপলস ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান (আফগানিস্তানের জন-গণতান্ত্রিক দল) ১৯৭৮ সালের এপ্রিল মাসে আফগানিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করার পর সমাজের আধুনিকায়নের স্বার্থে সংস্কারমূলক কার্যক্রম শুরু করলে প্রতিক্রিয়াশীল এবং পশ্চাৎপদতার শক্তিসমূহ দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করে। আফগান সরকারের ব্যর্থতা ঘটতে থাকলে ১৯৭৯-এর ডিসেম্বর মাসে আফগান কম্যুনিস্ট সরকারের সমর্থনে সোভিয়েত সামরিক হস্তক্ষেপ ঘটে। এই ঘটনা মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যকে আফগানিস্তানে হস্তক্ষেপের সুযোগ এনে দিল। এবার আফগানিস্তান সোভিয়েত ও মার্কিন দুই পরাশক্তির শক্তি পরীক্ষার ক্ষেত্রে পরিণত হল।
মার্কিন নেতৃত্বাধীন সমগ্র বিশ্বশক্তি একজোট হয়ে জিহাদীদের শক্তি সংগঠিত ও সংহত করার উপর সর্বশক্তি নিয়োগ করল। এ কাজে পাকিস্তান জিহাদীদের জন্য তার ভূমি যেমন ছেড়ে দিল তেমন তার রাষ্ট্রও বিভিন্নভাবে পাশ্চাত্যের সহায়ক হয়ে আফগানিস্তানে জিহাদীদের সাফল্যে বিরাট ভূমিকা রাখল। বস্তুত পাকিস্তান ছিল সেই সময় মুজাহিদীন অর্থাৎ জিহাদী যোদ্ধাবৃন্দ নামে কথিত জিহাদীদের সোভিয়েত সেনা এবং আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য এমন এক পশ্চাদভূমি যেখানে তাদের জন্য আশ্রয়, অস্ত্র এবং সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল অবারিত। জিহাদে যোগ দিতে আসা হাজার হাজার জিহাদীর জন্য পাকিস্তান হল আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
আফগান মার্কসবাদী সরকারের সহায়তায় সোভিয়েত সেনার প্রবেশ ঘটবার পর জিহাদ বা ইসলামী যুদ্ধের সঙ্গে আফগান জাতীয়তাবাদের সম্মিলন ঘটাটা স্বাভাবিক হল। এভাবে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আফগান যুদ্ধ সমাজতন্ত্র ও পুঁজিবাদের মধ্যকার যুদ্ধ রূপে আবির্ভূত হল। এই যুদ্ধে আধুনিক সভ্যতা নির্মাণে একটা সমাজের অগ্রযাত্রার পথ হিসাবে সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ আধুনিক সভ্যতা বিরোধী ইসলামের সঙ্গে দৃঢ় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করল। সভ্যতার বিরুদ্ধে জন্ম নেওয়া ইসলাম যখন ক্ষয় এবং পতনের দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছিল তখন পাশ্চাত্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে তার পুনরুত্থান ঘটালো।
ভিয়েতনামে মার্কিন পরাজয় পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের পরাজয় হতে পারে কিন্তু আধুনিক সভ্যতার অগ্রগমনের শক্তির পরাজয় ছিল না। আজকের ভিয়েতনামের দিকে দৃষ্টি দিলে সে কথা বুঝা যায়। শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সামাজিক ন্যায়বিচার কোনটাতে তা পিছিয়ে আছে?
কিন্তু মার্কিন সমর্থন ও সাহায্য পুষ্ট জিহাদী কিংবা তালিবানের উত্থানের পর কোন দিকে আফগানিস্তান অগ্রসর হয়েছে? শিক্ষা, সংস্কৃতি, সামাজিক ন্যায়বিচার, শিল্প, কৃষি, মানবাধিকার, নারীর অধিকার কোনওটাতেই কি সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহার এবং মার্কসবাদী সরকারের পতন এবং জিহাদীদের ক্ষমতা দখলের পর আফগানিস্তানের অগ্রগতি হয়েছে? হয় নাই। বরং প্রকৃতপক্ষে মার্কিন হস্তক্ষেপ গোটা আফগানিস্তানকে মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, ইসলামবাদী শক্তিসমূহের প্রতি সর্বাত্মক পৃষ্ঠপোষকতা দ্বারা এমন এক ফ্র্যাঙ্কেস্টাইনকে লালন-পালন করেছে যা আজ তাকে ভয়ঙ্কর শিক্ষা দিয়েছে। এই পরাজয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর উপর তথা পাশ্চাত্য পৃথিবীর মর্যাদা এবং মনোবলের উপর যে ভয়ানক আঘাত পড়েছে তার ধাক্কা পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ এবং তাদের অনুগত ও অধীনস্থ এবং নানানভাবে তাদের উপর নির্ভরশীল পৃথিবীর দেশগুলি কীভাবে সামলায় সেটা এখন দেখবার বিষয়।
বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বের এক নম্বর পরাশক্তি এবং পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী বিশ্বের নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই পরাজয় এবং সেই সঙ্গে আফগান তালিবানের বিজয়ের সম্ভাব্য ফলাফল এবং তাৎপর্য ইত্যাদি নিয়ে স্বাভাবিকভাবে আলোচনা ও বিতর্ক চলছে। আমিও এখানে বিষয়গুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করতে চেষ্টা করব। প্রথমে দেখা যাক সম্ভাব্য ফলাফল কী হতে পারে।
(২) আফগান যুদ্ধে মার্কিন পরাজয় এবং তালিবান বিজয়ের ফলাফল
আফগান যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কানাডা, ব্রিটেন ইত্যাদি শক্তিবর্গের এই পরাজয় এবং পড়ি কি মরি করে ঊর্ধ্বশ্বাসে পলায়ন এমন একটা ‘শক ওয়েভ’ পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের উপর দিয়ে প্রবাহিত করতে শুরু করেছে যা তার নৈতিক শক্তিকে বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন করবে। এটা ভবিষ্যতে তার রাজনীতি ও অর্থনীতির উপরেও প্রভাব ফেলবে বলে ধারণা করি। সব মিলিয়ে এটা মার্কিন বিশ্বনেতৃত্বকেও মারাত্মক আঘাত হানতে পারে। ফলে মার্কিন-কেন্দ্রিক পাশ্চাত্যেরও শক্তিকে ভয়ানকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে।
এটা মনে করলে ভুল হবে যে, মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বী চীন এবং রাশিয়া এই অবস্থার সুযোগ নিতে চাইবে না। চীন এখন প্রায়-পরাশক্তিতে রূপান্তরিত বললে সম্ভবত বেশী বাড়িয়ে বলা হবে না। যে দেশ মঙ্গল গ্রহে যান পাঠাতে এবং সেখানকার ভূমিতে সেটা চালাতে পারে তাকে প্রায়-পরাশক্তি না বলে উপায় কী? তাছাড়া চীনের সামরিক শক্তির পাশে অর্থনৈতিক শক্তিও এখন বিপুল। রাশিয়ায় সোভিয়েতের ভাঙ্গনের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে যে দুর্বলতা এবং বিপর্যয় ঘটেছিল সেটাও এখন রাশিয়া অনেকটা কাটিয়ে উঠেছে। আগের পর্যায়ে রাশিয়া এখনও যায় নাই। তবু তারও এখন যথেষ্ট শক্তি।
আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয় বিশ্বক্ষমতা তথা বিশ্বরাজনীতির ক্ষেত্রে এক ধরনের শূন্যতা তৈরী করেছে। এই শূন্যতা পূরণে চীন এবং সেই সঙ্গে রাশিয়াও সচেষ্ট হবে না এটা মনে করার কারণ নাই। এটা ঠিক যে, চীন এবং রাশিয়া উভয়ের মধ্যে দ্বন্দ্বও ছিল এবং আছে। কিন্ত বিশেষ করে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদের নেতা মার্কিনের সঙ্গে দ্বন্দ্বের কারণে উভয়ের মধ্যে ঐক্যও থাকবে। সবচেয়ে বড় কথা সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন যেমন নাই তেমন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ববিপ্লবের পতাকাবাহী চীনও আর নাই। আজকের রাশিয়ায় যেমন পুঁজিবাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তেমন সমাজতান্ত্রিক চীনেও ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’র মাধ্যমে রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা তত্ত্বাবধানে ব্যক্তিপুঁজির ব্যাপক বিকাশ হয়েছে। এই ব্যক্তিপুঁজি এখন রাষ্ট্রীয় পুঁজির আশ্রয়ে চীনের বাইরেও সম্প্রসারণশীল। এই বাস্তবতায় পাশ্চাত্যের বাজারে হানা দেওয়া এখন চীন বা রাশিয়ার জন্য কষ্টকর ব্যাপার না। সেটা তারা দিচ্ছেও।
আফগানিস্তানও বা এর বাইরে থাকবে কেন? বরং মার্কিনের সদ্য পরাজয়ের স্মৃতিবাহী আফগানিস্তানে চীন-রাশিয়া নিজেদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়গুলি অর্জনে মনোযোগী হতে পারে। এক দিক থেকে দেখলে আফগানিস্তান থেকে মার্কিন পলায়ন তাদের জন্য নূতন সুযোগ এনে দিয়েছে।
তবে যে ঘটনাই ঘটুক এ কথা মনে রাখতে হবে যে, তালিবানের বিজয়ের মূল ভিত্তি হল একটা আদর্শ, আর সেটা হচ্ছে ইসলাম ধর্ম। প্রধানত এই আদর্শের প্রতি অঙ্গীকার নিয়েই তাদের দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধ এবং তাতে বিজয়। যদি ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে কম্যুনিস্ট সরকার কর্তৃক ক্ষমতা দখলের পর থেকে তাদের এই জিহাদী যুদ্ধের সূচনা ধরা যায় তবে বলতে হবে ৪৩ বৎসর বা অর্ধশতাব্দীর কাছাকাছি কাল ধরে তারা এই ইসলামী আদর্শের বাস্তবায়নের জন্য যুদ্ধ করেছে। যদি কম্যুনিস্ট সরকারের পতনের পর ১৯৯২ থেকে ২০০১ সালে মার্কিন আগ্রাসন ও দখল পর্যন্ত মধ্যবর্তী প্রায় নয় বৎসর সময়কে জিহাদী শক্তির ক্ষমতায় থাকার সময় হিসাবে ধরা যায় তবে বলতে হবে আফগানিস্তানে মাঝখানের এই নয় বৎসর সময় বাদ দিয়ে প্রায় ৩৫ বৎসর ধরে জিহাদী শক্তি ইসলামের জন্য এবং ইসলামের নামে যুদ্ধ করে পুনরায় ক্ষমতা দখল করেছে।
এ কথাও মনে রাখতে হবে, তাদের আজকের এই জিহাদী যুদ্ধের পিছনে রয়েছে সমকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দুই দুইটি পরাশক্তির পরাজয়ের ইতিহাস। আফগানিস্তানের তালিবানের ভবিষ্যৎ পদক্ষেপ ঠিক কী ধরনের হবে তা নির্দিষ্ট করে এখনই বলা সম্ভব না হলেও এই ইতিহাসকে মনে রাখতে হবে। তাহলে অন্তত ভবিষ্যৎ গতিধারা সম্পর্কে কিছুটা হলেও আঁচ করা যেতে পারে।
শুধু যে আফগান তালিবানের নিকট এই জয় কুফরি এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে ইসলাম এবং মুমিন বা মুসলিমদের জয় তা-ই নয়, বরং সমগ্র পৃথিবীর বিশ্বাসী মুসলিমদের নিকটও এটা কুফরি এবং কাফেরদের বিরুদ্ধে ইসলাম এবং মুসলিমদের জয় হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। কেন আমি এ কথা বলছি তা যারা ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক ধারণাও রাখেন তারা সকলে বুঝবেন।
মুসলিম কবি ইকবাল বলে গেছেন, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়, হর্ কারবালা কি বাদ।’ ইতিহাস তো একই গতিতে চলে না। সুতরাং প্রকৃত বিশ্বাসী মুসলিমরা মনে করে, ইসলামের মাঝে মাঝে বিপর্যয় হলেও শেষ পর্যন্ত তার জন্য আছে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত চূড়ান্ত বিজয়, যে বিজয় অনুযায়ী সমগ্র পৃথিবী ইসলামের অধীনস্থ হবে। এই বিশ্বাস ইসলামের ধর্মবিশ্বাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। সমগ্র পৃথিবীকে ইসলাম তথা মুসলিমদের অধীনস্থ করবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জিহাদের সমাপ্তি হতে পারে না। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের নিয়মে সাময়িক বিরতি হতে পারে, অগ্রগমনের পর প্রতিকূল পরিস্থিতিতে কিছুকালের জন্য পশ্চাদগমনও হতে পারে, কিন্তু সমাপ্তি নয়। সুতরাং ইসলামে ঘোষিত কেয়ামত বা শেষ বিচারের পূর্ব পর্যন্ত প্রতিটি বিশ্বাসী কিংবা খাঁটি মুসলিম বাস্তবে যা-ই করুক চেতনায় জিহাদী। যে মুসলিমরা এই কথার বিরুদ্ধতা করবে তারা হয় ইসলামের মূলসত্যের কিছুই জানে না অর্থাৎ ইসলামের বিষয়ে অজ্ঞ বা মূর্খ, নয় মিথ্যাচারী-প্রতারক, যাদের উদ্দেশ্য হল উপযুক্ত সময়ের অপেক্ষায় থেকে শান্তির কথা বলে অ-মুসলিমদেরকে প্রতারিত করা। যুদ্ধ-নির্ভর ধর্ম হিসাবে এই মিথ্যাচার বা প্রতারণাকে ধর্মীয় বৈধতা দেওয়ার জন্য একটা ইসলামী শব্দও আছে — তাকিয়া। ইসলামের জন্য এই তাকিয়ার আশ্রয় নেওয়াও বৈধ।
নিম গাছে আম বা সুমিষ্ট ফল প্রত্যাশা করে লাভ নাই। তালিবান কী জিনিস সেটা আশা করি এখানে আর ব্যাখ্যার প্রয়োজন নাই। এদের অতীত এবং বর্তমান জানা হয়েছে। সুতরাং ভবিষ্যৎ গতিধারা খুব বেশী যে ভিন্ন হবে না সে কথা বলা যায়।
অনেকে এই তালিবান সেই তালিবান নয়, কিংবা সময়ের সঙ্গে এদের এখন অভিজ্ঞতা হয়েছে, সুতরাং এরা আর অতীতের মতো হবে না কিংবা করবে না ইত্যাদি ভেবে সান্ত্বনা পাচ্ছেন। তাদের সান্ত্বনা কিংবা আশাবাদ প্রসঙ্গে আমি শুধু এই উপমা দিয়ে আমার ধারণা প্রকাশ করতে চাই, সময়ের সঙ্গে বাঘ কিংবা গরু অনেক অভিজ্ঞতার অধিকারী হয় বলে যে নিজেদের জীবনধারা এবং মৌল আচরণ বদলাতে পারে তা নয়। যে ‘ডিএনএ’ নিয়ে তাদের জন্ম সেই ডিএনের বিধান অস্বীকার করে ভিন্ন রকম হবার উপায় তাদের থাকে না।
আর একটা কথা এ প্রসঙ্গে বলি, আইএস বা ইসলামিক স্টেট সিরিয়া বা ইরাকে যা করতে পারে নাই তালিবান এখন পর্যন্ত সেটাতে সফল হয়েছে। আইএস চেয়েছিল ইসলামের খিলাফত প্রতিষ্ঠা করতে। তাদের অধিকৃত অঞ্চলে খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণাও দিয়েছিল। ঘোষণা দিলেও বিশেষত রাশিয়ার বিমান আক্রমণ এবং সিরিয়ার ভূমিতে সিরীয় সরকারী বাহিনীর আক্রমণে তাদের খিলাফত চূর্ণ হয়ে গেছে। প্রধানত ইরান সমর্থিত শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীর আক্রমণে ইরাকেও তারা ধ্বংস হয়েছে।
খিলাফতের ঘোষণা আফগানিস্তানে তালিবান দেয় নাই। কাবুল জয়ের পর দিয়েছে ইসলামী আমিরাতের ঘোষণা। মর্মবস্তুতে উভয়ই এক জিনিস। আর তারা নমনীয় যত প্রতিশ্রুতি দিক, তারা সবকিছুর ভিত্তি হিসাবে শরীয়ার কথা ঘোষণা করেছে। শরীয়া কী জিনিস সেটা কি বলে দিতে হবে? তারা যে যাত্রা শুরু করেছে সেই যাত্রা আঁকাবাঁকা পথ ধরে হলেও তার মঞ্জিল যে শরীয়া তথা ইসলামী অনুশাসন পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠা করা সে ঘোষণা তালিবান দিয়েছে।
এই মঞ্জিলকে খারিজ করে কি তালিবান অগ্রসর হতে পারবে? উপরের নেতৃত্ব বাস্তবতার বিচারে কিছু ছাড় দিতে চাইলেও সেটা কতটা পারবে? মূলত মাদ্রাসা পড়ুয়া আধুনিক শিক্ষা ও যুগচেতনার বিচারে যারা পশ্চাৎপদ, প্রতিক্রিয়াশীল, মূর্খ, অজ্ঞ এবং অন্ধ ছাড়া আর কিছু নয় সেই তালিবান (ছাত্রবৃন্দ) এবং সেই সঙ্গে মূলত গ্রামীণ ধর্মান্ধ, পশ্চাৎপদ এবং দরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে যে যোদ্ধা বাহিনী গঠিত হয়েছে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং চেতনার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তালিবান নেতৃত্ব চাইলেও কি সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যযুগ অভিমুখী যাত্রার মুখ উল্টা দিকে ঘুরিয়ে সেটাকে আধুনিক সভ্যতা অভিমুখী করতে পারবে?
এ কথা বুঝতে হবে যে, তালিবান নেতৃত্ব মুখে যে কথাই বলুক এটা তাদের নিকট যেমন তেমন সমগ্র পৃথিবীর প্রায় ১৮০ কোটি মুসলমানের উম্মার নিকট ইসলামের বিজয় হিসাবে পরিগণিত হচ্ছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা এখন আটশত কোটির কাছাকাছি। সেই আটশত কোটির মধ্যে যদি দুইশত কোটির কাছাকাছি মানুষ একটা বিশ্বাস নিয়ে দাঁড়ায় তবে তার গুরুত্ব এবং তাৎপর্য কতটা এবং কী ধরনের হতে পারে সেটা বুঝার চেষ্টা করতে হবে।
বস্তুত আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল এখন ক্রমবর্ধমানভাবে মুসলিমদের মনে তাদের স্বপ্ন এবং আকাঙ্ক্ষার খিলাফতের রাজধানী হয়ে উঠতে থাকবে। বিশেষত বর্তমানে ইসলাম থেকে সৌদী আরবের ক্রমবর্ধমান বিচ্যুতির কালে আফগানিস্তান অনেকের নিকট হয়ে উঠবে ইসলামী উম্মার আশা-ভরসার কেন্দ্র বা রাজধানী। এতবড় বিজয়ের মধ্য দিয়ে নির্মিত স্বপ্নের এই রাজধানীর তালিবানী অধিকর্তারা কীভাবে এই আশা-ভরসাকে নাকচ বা উপেক্ষা করে আফগানিস্তানের সঙ্কীর্ণ সীমানার মধ্যে নিজেদের দৃষ্টিকে আবদ্ধ করবে? সেটা কি সম্ভব, আর সম্ভব হলেও কতটা সম্ভব? এ প্রশ্নের উত্তর পেতে অবশ্য বেশী সময় লাগবে না।
সবকিছুর পুনরাবৃত্তি হয় না। সুতরাং টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পুনরাবৃত্তি হয়ত আর হবে না। কিন্তু আগামী দিনগুলিতে আমাদের মনকে বহু অঘটন দেখবার জন্য প্রস্তুত রাখতে হবে।
মুসলিম পৃথিবীতে বহু রাষ্ট্রে বিভাজন থাকলেও মুসলিম উম্মার ঐক্য বোধ এক অত্যন্ত শক্তিশালী বাস্তবতা হয়ে আছে। মুসলিম রাষ্ট্রের বাইরেও পৃথিবীর যেখানেই মুসলিমরা তাদের মুসলিম পরিচয় নিয়ে বাস করুক এই উম্মা বা ইসলামী সম্প্রদায়ের ঐক্য চেতনা তাদেরকে মানসিকভাবে এক দৃঢ় ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ রাখে। এই ঐক্যের মর্মে আছে ইসলাম ধর্ম। সুতরাং পৃথিবীর যে কোনও প্রান্তে কোনও ধরনের ইসলামী জাগরণ পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুক সকল সাধারণ মুসলিম চেতনাকে আন্দোলিত করে। আফগানিস্তানে তালিবানের বিজয় এবং তার ফলাফলকে আমাদের এই দিক থেকেও বিবেচনা করতে হবে।
অন্যদিকে, মুসলিম রাষ্ট্রগুলির উচ্চবর্গ কিংবা উপরতলার শাসক শ্রেণী যারা সাধারণভাবে পাশ্চাত্য শিক্ষা-সংস্কৃতির প্রভাবে এবং অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক কারণে মৌল ইসলাম অনুসরণের পরিবর্তে পাশ্চাত্যের জীবনাচরণের সঙ্গে কিছুটা হলেও সঙ্গতি রেখে চলে তাদের সঙ্গে নীচ তলার আমজনতার বিরাট পার্থক্য থাকে। এর ফলে সমাজে এক ধরনের দ্বন্দ্ব এবং অসঙ্গতি থাকে। জনমানস এক ধরনের সঙ্কটে ভুগে। তাদের ধর্মে যেগুলি নিষিদ্ধ কিংবা অপরাধ সেগুলিকে তারা আচরিত হতে দেখে। এটা তাদের মানসিক জগতে এক ধরনের শূন্যতাও তৈরী করে। আমি ধারণা করি আফগানিস্তানে তালিবান বিজয় তাদের এই শূন্যতা পূরণে অনেকটা সহায়ক হবে।
তালিবানের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য সবাইকে যে আফগানিস্তানে যেতে হবে তার কোনও মানে নাই। আজকের ইন্টারনেট বা ডিজিটাল প্রযুক্তির যুগে সে কাজ তারা ঘরে বসেও করতে পারবে। এর জন্য তাদেরকে যে আফগান ভাষা জানতে হবে তাও না। সে ব্যবস্থাও মার্কিন এবং ইউরোপীয়রা আফগানিস্তান ছেড়ে পালাবার আগে করে রেখে এসেছে। তারা রেখে এসেছে বহুসংখ্যক দোভাষী। এখন নূতন বিশ্বপরিস্থিতে এই দোভাষীরা নূতন ফ্রন্টে তালিবানের এমন অস্ত্র হতে পারে যে অস্ত্র দিয়ে তারা আফগানিস্তানে থেকে তাদের জিহাদকে বিশ্বপরিসরে নূতন পর্যায়ে উত্তীর্ণ করবে।
যাইহোক, সবকিছু যে সরল রেখায় অগ্রসর হবে তা ভাবা ঠিক হবে না। আমরা আগামী দিনের সব ঘটনাকে এখনই অনুমান করতেও পারব না। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন শক্তিকে ব্যবহার করে তালিবান কীভাবে পদক্ষেপ করবে তা এখনই বলা সম্ভব নয়। তবে এটুকু বলা যায় চীন, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্টের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব বিশ্বপরিস্থিতে অনেক জটিল উপাদান যুক্ত করতে পারে। স্বাভাবিকভাবে চীন এবং রাশিয়া মার্কিন এবং পাশ্চাত্যের এই পরাজয় এবং বিপর্যয়কে পুরাপুরি কাজে লাগাতে চাইবে।
এ ছাড়া আছে দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে ভারতের ভূমিকার প্রশ্ন। তালিবান কি তার নিকটবর্তী অমুসলিম সংখ্যাগুরু অধ্যুষিত ভারতে জিহাদের বিস্তার চাইবে না? সেখানে আছে প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর। এটা যে কোনও জিহাদী শক্তির জন্য সফ্ট টার্গেট হতে পারে। বাস্তবে সেটা তা হয়েও আছে। এর সঙ্গে আবার জড়িয়ে আছে কাশ্মীর দখলে পাকিস্তানের স্বার্থ। এছাড়া ভারতের বিভিন্ন রাজ্যেও প্রচুর মুসলিম আছে। বর্তমানে ভারতের মোট জনসংখ্যা প্রায় ১৪০ কোটি। এক হিসাব অনুযায়ী ২০২০ সালে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল প্রায় ২৩ কোটি ৩০ লক্ষ। এ থেকেই ভারত অভ্যন্তরীণ জিহাদের জন্য কতটা অনুকূল ক্ষেত্র হতে পারে সেটা সহজে অনুমান করা যায়। আমি এই জন্য অভ্যন্তরীণ জিহাদ শব্দ ব্যবহার করছি যে, এই জিহাদের জন্য আফগানিস্তান থেকে তালিবান কর্তৃক জিহাদ পরিচালনার প্রয়োজন নাই, তালিবানের বর্তমান বিজয়ও ভারতের মুসলিমদের এক বৃহৎ অংশকে স্বাধীনভাবে জিহাদ সংগঠনে অনুপ্রাণিত করতে পারে।
আফগানিস্তানে তালিবান বিজয়ের ফলাফল পর্যালোচনা করতে গিয়ে সংক্ষেপে বলি যে, ১৫ আগস্টে তালিবান কর্তৃক কাবুল দখলের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী পৃথিবী এক রকম থাকবে না। বহুকিছু আমরা এখন ধারণা করতে পারব না। তবে সম্ভাব্য কিছু বিষয়ে আমরা ধারণা করতে পারি। এটা ঠিক যে, আফগানিস্তানে সেনা পাঠাবার পূর্বেই সোভিয়েত ব্যবস্থায় ক্ষয় ও সঙ্কট গভীর হযেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙ্গতে আরও কিছু সময় লাগত। অফগানিস্তানে সোভিয়েত ব্যর্থতা ১৯৯১ সালে সংঘটিত এই ভাঙ্গনকে ত্বরান্বিত করেছিল। অবশ্য তার আগে ১৯৮৯ সালে পূর্ব ইউরোপের কম্যুনিস্ট শিবিরে ভাঙ্গন হয়েছিল।
কিন্তু এটাও সম্ভব বা ত্বরান্বিত হয়েছিল সোভিয়েত অর্থনীতির অবক্ষয়ের ফলে। এই অবক্ষয়ের মূল কারণ ছিল সমাজতন্ত্রের নামে নিরঙ্কুশভাবে এককেন্দ্রিক ‘কমান্ড ইকনমি’। বিপ্লবের প্রথম পর্যায়ে এ ধরনের অর্থনীতির যে কার্যকরতাই থাকুক ব্যাক্তমালিকানার সম্পূর্ণ অনুপস্থিতির কারণে এটা এক সময়ে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক স্থবিরতা সৃষ্টি করতে বাধ্য। এটাই সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে ঘটেছিল। চীন বেশী সময় এই ভুল করে নাই। এক দশক ব্যাপী পরিচালিত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ফলে ঘটা চীনের অর্থনীতির বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে দেং জিয়াও পিং-এর নেতৃত্বে চীন ‘সমাজতান্ত্রিক বাজার অর্থনীতি’র নামে এমন এক মিশ্র অর্থনীতির পথ গ্রহণ করল যেখানে রাষ্ট্রীয় মালিকানার অধীনেই ব্যাক্তমালিকানায় অর্থনীতির বিকাশের পথ খুলে দেওয়া হল। এ পথেই চীন আজকের অসাধ্য সাধন করছে। ভিয়েতনামও বিপ্লবের পর একদলীয় রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে প্রাথমিক সামাজিক-অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের পর রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করেই ব্যক্তিমালিকানায় অর্থনীতির বিকাশের পথ খুলে দিয়েছে। ভিয়েতমামের আজকের অসাধ্য সাধনও এ পথেই।
যাইহোক, অভিজ্ঞতা থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ন শিক্ষা নিয়ে পথ পরিবর্তন করতে পারে নাই। তার খেসারত তাকে দিতে হয়েছে মার্কসীয় সমাজতান্ত্রিক শিবির এবং ব্যবস্থার ধ্বংস দ্বারা। বস্তুত এই ব্যবস্থার ধ্বংস ছিল সময়ের ব্যাপার মাত্র। তবে দশ বৎসরের আফগান যুদ্ধে সোভিয়েতের বিপুল অর্থ ও লোক ক্ষয় এবং শেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসরণ এই ধ্বংসকে ত্বরান্বিত করেছিল।
আফগান যু্দ্ধে পাশ্চাত্যের এই পরাজয় এবং পলায়ন পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ এবং তার অধীনস্থ বিশ্ববাজার ব্যবস্থার জন্য কী পরিণতি ঘটাবে তা এখনই বলা না গেলেও তার জন্য যে বড় ধরনের সঙ্কট অপেক্ষা করছে সে কথা বলা যায়।
আর একটা কথা নিশ্চিত করে বলা যায় যে, পৃথিবী ইসলামী পুনরুত্থান প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে। এর অর্থ হচ্ছে জিহাদ বা জিহাদী তৎপরতার বিস্তার। বিশেষত জিহাদী শক্তির বিজয়ের ফলে ইসলামের মর্মে যুদ্ধসহ যে বৈশিষ্ট্যসমূহ নিহিত রয়েছে সেগুলি মুক্ত হবে। ইসলামকে মুসলিমরা এবং ইসলাম তোষণকারীরা শান্তির ধর্ম বললেও এটা আপাদমস্তক যুদ্ধ ও জবরদস্তির ধর্ম ছাড়া আর কিছুই নয়। এটা এসেছে মূলত যুদ্ধ করে এবং প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে যুদ্ধ জয় এবং বাধ্যতামূলকভাবে ধর্মান্তরকরণের পথ অনুসরণ করে। বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, হিন্দু, ইহুদী, শিখ পৃথিবীর এই কয়টি প্রধান ধর্মের মতো স্বেচ্ছাসম্মতির মাধ্যমে প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। অন্যান্য ধর্মের অনুসারীরা কোনও কোনও ক্ষেত্রে যুদ্ধ বা হিংসার আশ্রয় নিলেও সেগুলি মূলত শান্তিপূর্ণভাবে ধর্মপ্রতিষ্ঠার পরবর্তী কালের ঘটনা। এই পরিবর্তন আবার অনেক ক্ষেত্রেই বিরুদ্ধ ধর্ম বা রাষ্ট্র শক্তির দীর্ঘ পীড়ন অথবা আগ্রাসনের প্রতিক্রিয়াজাত। যেমনটা আমরা খ্রীষ্টান ধর্মের ক্ষেত্রে দেখি। খ্রীষ্টধর্মের প্রতিষ্ঠার পর প্রায় তিনশত বৎসর রোমের পেগান শাসকরা ধর্মীয় মতবাদের কারণে খ্রীষ্টানদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার চালিয়েছিল এবং রোমান সাম্রাজ্যের অগণিত খ্রীষ্টানকে নৃশংসভাবে হত্যা করেছিল। এই হত্যার ক্ষেত্রে রোমান পেগান শাসকদের একটা প্রিয় পন্থা ছিল ক্রুশবিদ্ধ করে ঝুলিয়ে রেখে এবং এভাবে দিনের পর দিন নৃশংস যন্ত্রণা দিয়ে হত্যা করা।
এর পরবর্তী কালে আসে আরব মুসলিম শক্তির আগ্রাসন। আরব মুসলিম আক্রমণকারীরা পশ্চিম এশিয়া ও মিসর থেকে খ্রীষ্টধর্মকে প্রায় নির্মূল ক’রে খ্রীষ্টান ইউরোপের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এই বাস্তবতায় মূল ধর্মে যু্দ্ধের স্থান না থাকলেও পরবর্তী কালে দীর্ঘ নির্যাতনের প্রতিক্রিয়ায় কিংবা আত্মরক্ষার প্রয়োজনেও খ্রীষ্টধর্ম মারমুখী রূপ ধারণ করেছে তথা আক্রমণাত্মক হয়েছে। মুসলিম শক্তির অত্যাচার ও আক্রমণাত্মকতা থেকে আত্মরক্ষার জন্য একইভাবে আমরা নানকের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত শিখ হিসাবে পরিচিত পাঞ্জাবের একটি অহিংস ধর্মকে সশস্ত্র বা জঙ্গী ধর্ম হয়ে উঠতে দেখি। কিন্তু শিখ ধর্ম মর্মগতভাবে বলপ্রয়োগে ধর্মান্তরকরণের বিরোধী। ফলে পাঞ্জাব, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চল, বেলুচিস্তান এবং জম্মু-কাশ্মীরসহ পশ্চিম ভারতের বিরাট অঞ্চলে শিখ রাষ্ট্রের বিস্তার হলেও আমরা ইসলামের মতো জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণের বিধিবদ্ধ প্রক্রিয়া দেখতে পাই না। এটা বিস্ময়কর যে, এত বৃহৎ অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত এই সাম্রাজ্যের মাত্র ১০% জনসংখ্যা ছিল শিখ এবং বাকী ৯০% ছিল মুসলিম এবং হিন্দু। ইংরেজদের সঙ্গে যুদ্ধে ১৮৪৯ সালে শিখ রাষ্ট্রের চূর্ড়ান্ত পরাজয় এবং বিলুপ্তি ঘটে। ইহুদী ধর্মে উগ্রতা থাকলেও প্যালেস্টাইনের বাইরে তার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ধর্মীয় অনুমোদন যেমন ছিল না তেমন অন্যান্য জাতি বা ধর্মের মানুষদের ধর্মান্তরকরণের বিধানও তা রাখে নাই। এদিক থেকে হিন্দুদের সঙ্গে ইহুদীদের যথেষ্ট মিল।
এই সকল ধর্মের বিপরীতে প্রকৃতপক্ষে অব্যাহত কিংবা ধারাবাহিক ধর্মযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এবং সেই সঙ্গে বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরকরণের মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার। এই ধর্মযুদ্ধ হল জিহাদ। জিহাদের মধ্য দিয়ে ইসলামের প্রতিষ্ঠা ও বিস্তার হওয়ায় জিহাদের চেতনা সাধারণভাবে মুসলিম চেতনাকে অধিকার করে থাকে। যুদ্ধ জয় এবং সহিংসতা ও বলপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত সমাজের গঠন পদ্ধতির মধ্যেই রয়েছে যুদ্ধবাদী চেতনার প্রাধান্যের বাস্তবতা। সবকিছু নিষ্পত্তির প্রধান কিংবা কখনও একমাত্র পদ্ধতি হয়ে উঠে যুদ্ধ, হত্যা কিংবা বলপ্রয়োগ। যুক্তি নয়, ভিন্ন মতের প্রতি সহিষ্ণুতা নয়, বরং বলপ্রয়োগ অথবা ভীতি প্রদর্শনের সক্ষমতা হয়ে উঠে সামাজিক সংহতি কিংবা নিয়ন্ত্রণ রক্ষার প্রধান কিংবা একমাত্র উপায়। এই রকম এক অবস্থায় সকল মুসলিম সমাজে সর্বদা যুদ্ধ ও হিংসার সংস্কৃতি নানানভাবে সমাজকে অধিকার করে থাকে। বিধর্মী বা কাফের না পেলে যে কোনও ছুতা তৈরী করে মুসলিমরা নিজেদের মধ্যেই খুনাখুনি করবে। ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে এই কথা কতখানি সত্য তা স্পষ্ট হয়। ইসলামের এই হিংস্রতার হাত থেকে এমনকি ইসলামের নবী মুহাম্মদের দুই আপন দৌহিত্র হাসান ও হোসেন পর্যন্ত রেহাই পান নাই। কোনও অমুসলিমের হাতে তারা নিহত হন নাই। মুসলিমরাই তাদেরকে খুন করেছিল। বড় ভাই হাসানকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করিয়েছিলেন ইসলামের খলীফা মোয়াবিয়া এবং ছোট ভাই হোসেনকে কারবালার প্রান্তরে অস্ত্রাঘাতে হত্যা করান মোয়াবিয়া-পুত্র খলীফা ইয়াজিদ।
এভাবে ইসলাম এক বিস্ময়কর স্ববিরোধ মুসলিমদের জন্য সৃষ্টি করে। একই সঙ্গে সকল অমুসলিমের বিরুদ্ধে তাদের দৃঢ়বদ্ধ ঐক্যের পাশাপাশি থাকে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ ও হিংসার প্রবণতা। আসলে ইসলামের মর্মে রয়েছে যুদ্ধের প্রবণতা। যখন বিরোধী শক্তির প্রবল চাপের ভিতরে থাকবে তখন মুসলিম সমাজ শান্তিপূর্ণ থাকতে পারে। কিন্তু সেই চাপ না থাকলে তাকে যুদ্ধ করতে হবে। যার বিরুদ্ধে হোক, যে কোনও ছুতায় হোক তাকে যুদ্ধ করতে হবে।
সুতরাং আফগান তালিবানের বিজয়ের ফলে ইসলামের ভিতরকার এই যুদ্ধবাদী প্রবণতা মুক্ত হতে বাধ্য। একটু আগেই যে কথা বলেছি, মুসলিমরা যখন কাফের পায় না তখন এই যুদ্ধপ্রবণতা থেকে নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ ও সামরিক সংঘাতে লিপ্ত হতে বাধ্য হয়। আফগানিস্তানেও তা-ই হবে। এই অবস্থাকে সামাল দেওয়ার জন্য অথবা অন্তত কিছুটা হলেও সংযত করার জন্য তালিবানকে আফগানিস্তানের বাইরে জিহাদকে উস্কে কিংবা চালান দিতে হবে। তাতেও আফগানিস্তান কতটা শান্তিপূর্ণ থাকবে তাতে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। সময়ের সঙ্গে এবং পোড় খেয়ে যতই অভিজ্ঞ ও কৌশলী হোক যে আদর্শ থেকে এদের উদ্ভব এবং যে গতিধারায় এদের বিকাশ ও সাফল্য তার যে নিজস্ব নিয়ম আছে সেটাকে লঙ্ঘন করবার ক্ষমতা এদের হবে না। মধ্যযুগীয় অন্ধত্বের আদর্শের যে পতাকা হাতে নিয়ে তারা আধুনিক সভ্যতার বিপরীতমুখী যাত্রা নূতন করে শুরু করেছে সেই যাত্রা তাদেরকে যেখানে নিবার গতিবিদ্যার নিজস্ব নিয়মে সেখানেই তাদেরকে যেতে হবে।
তবে যুগটা আধুনিক সভ্যতার জয়যাত্রার। এ যুগে কোথায়ও মধ্যযুগীয় একটা আদর্শের সাময়িক জয় হলেও সেটা দিয়েই সামগ্রিক ঘটনাধারার বিচার করা ভুল হবে। সুতরাং একদিকে যেমন ইসলামের মধ্যযুগ অভিমুখী যাত্রা নূতন উদ্যমে শুরু হবে, অপর দিকে তেমন তার বিরুদ্ধেও মুসলিম সমাজের ভিতর থেকেই ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তির নবউত্থান ও নবযাত্রা শুরু হবে। এই নবউত্থানকে এতকাল পাশ্চাত্য থেকে নানান বুলির ছদ্মাবরণে যে বাধা প্রদান করা হত সেই বাধা দানের নৈতিক এবং বস্তুগত কোনও ধরনের শক্তি আর সেভাবে থাকবে বলে মনে হয় না।
তবে চীন বা রাশিয়া কী করে সেটা এখন দেখবার বিষয়। অবশ্য রাশিয়ার চেচনিয়া এবং চীনের উইঘুরের বাস্তবতা বিবেচনা করলে তাদের দিকে থেকেও ইসলাম তথা ইসলামী শক্তির তোষণ ও পৃষ্ঠপোষকতার সম্ভাবনা উড়িয়ে না দিলেও এখন পর্যন্ত কম দেখি। যদি একদিকে পাশ্চাত্য এবং অপর দিকে চীন এবং রাশিয়া নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও ইসলামের সরাসরি পৃষ্ঠপোষকতায় সকল শক্তি নিয়ে না নামে, যেটা এতকাল পাশ্চাত্য করেছিল, তবে বলা যায় ইসলামী পৃথিবী থেকেই ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তির উত্থান এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
তবে আমার ধারণা ইসলাম সংরক্ষণ ও প্রসারের শক্তি এবং ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তির মধ্যে নবতর সংঘাতের একটা কাল আমাদের সামনে অপেক্ষা করছে। আমি অনুমান করি আধুনিক সভ্যতার নূতন অগ্রদূত হিসাবে এই শক্তি পৃথিবীতে আবির্ভূত হবে। যেহেতু তার উত্থান ঘটবে মূলত ইসলামী তথা মুসলিম সমাজের ভিতর থেকে সেহেতু ইসলামের ভিতরকার আন্তর্জাতিকতা তথা উম্মার প্রেরণাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে তা নিজেও আরেক ধরনের আন্তর্জাতিকতার আবেদনকে গ্রহণ করতে বাধ্য হবে। অর্থাৎ বিশেষ জাতিকে অবলম্বন করে ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তির উত্থান ও প্রতিষ্ঠা ঘটলেও তা হবে কোনও না কোনও ধরনের আন্তর্জাতিক বিপ্লবের প্রকাশ। আফগানিস্তানে জিহাদী শক্তির বিজয় যেমন শুধু আফগান জিহাদের বিজয় নয়, অধিকন্তু সমগ্র ইসলাম তথা মুসলিম উম্মার বিজয় ব্যাপারটা অনেকটা তেমন হবে বলে আমি ধারণা করি। তবে আফগানিস্তানে জিহাদী শক্তির বিজয় যেখানে সভ্যতার পশ্চাদমুখী যাত্রা তথা প্রতিক্রিয়ার শক্তির বিজয় এটা সেখানে তার বিপরীতে হবে সভ্যতার অগ্রগমনের শক্তির বিজয়।
যাইহোক, আফগানিস্তানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের পরাজয়ের ফলাফলের পাশাপাশি তার শিক্ষাগুলিকেও আমাদের অনুধাবন করার চেষ্টা করা দরকার। এ প্রসঙ্গে মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ব্যর্থতার অভিজ্ঞতা থেকেও শিক্ষা নেওয়া দরকার। যারা ইসলাম থেকে মুক্তির ও নূতন সমাজ নির্মাণের পথান্বেষী তাদের জন্য এর প্রয়োজন খুব বেশী। সুতরাং এখন আমরা সেই প্রসঙ্গে যাই।
(৩) আফগান অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা
আফগান বিপ্লব সংঘটিত হয় ১৯৭৮ সালে যখন মার্কসবাদী সরকার সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়ে ক্ষমতা দখল করে। তারপর তারা ভূমি সংস্কার এবং বিশেষ করে নারীর শিক্ষা ও অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ বিভিন্ন সংস্কারমূলক কাজে হাত দেয়। কিন্তু মার্কসবাদী সরকার ক্ষমতায় আসার পর বড় ভূস্বামী, উপজাতীয় নেতৃত্ব এবং মোল্লা শ্রেণী ইসলাম রক্ষার নামে দ্রুত প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলে। মার্কসবাদীরা ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি না বললেও যেহেতু মার্কসবাদ নিজে ধর্মবিশ্বাসমুক্ত একটি মতবাদ সুতরাং এদের শাসনের বিরুদ্ধে নাস্তিকতা বা ধর্মদ্রোহের অভিযোগ তুলে জিহাদের ডাক দেওয়া সহজ হল। জিহাদীদের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব না থাকলেও সামাজিক প্রভুত্ব ও ভূমিমালিকানার প্রশ্নে স্বার্থের অভিন্নতা এবং নারীশিক্ষা ও সমঅধিকারের মতো বিষয়ের প্রশ্নে দৃষ্টিভঙ্গীগত ঐক্য জিহাদীদের লড়াইয়ে এক ধরনের অভিন্নতা দিল। এদের তৎপরতার মুখে মার্কসবাদী তথা কমিউনিস্ট সরকার বিপন্ন এবং রক্তক্ষয়ী অন্তর্দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হলে আফগান কম্যুনিস্ট শাসন রক্ষায় ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে সোভিয়েত সেনা প্রবেশ করে।
আফগানিস্তানে আফগান-সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে এবার জিহাদীদের পক্ষে সমস্ত শক্তি নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য এবং সৌদী আরব ও পাকিস্তানসহ বহুসংখ্যক মুসলিম রাষ্ট্র। আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের ১,৬৪০ মাইল (২,৬৪০ কিলোমিটার) দীর্ঘ সীমান্ত তৎকালে মুজাহিদ বা মুজাহিদীন (মুজাহিদবৃন্দ) নামে পরিচিত আফগান জিহাদী এবং সেই সঙ্গে আফগান শরণার্থীদের জন্য খুলে দেওয়া হল। আফগানিস্তান থেকে যেমন, তেমন সমগ্র পৃথিবী থেকে পাকিস্তানের মাটিতে সমবেত হল আফগান ও সোভিয়েত সেনার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য দলে দলে জিহাদী। তাদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্র পাশ্চাত্যের দেশগুলি এবং বিশেষত মার্কিন মিত্র সৌদী আরবসহ তেল সমৃদ্ধ আরব দেশগুলি তাদের অর্থভাণ্ডার উন্মুক্ত করে দিল। এর সঙ্গে থাকল অত্যাধুনিক বিভিন্ন অস্ত্রের সরবরাহ এবং সেগুলি ব্যবহারের জন্য প্রশিক্ষণ। এইসব অস্ত্রধারী প্রশিক্ষিত হাজার হাজার জিহাদী যোদ্ধা যুদ্ধ করল। বস্তুত, এটা ছিল মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ এবং ইসলামী জিহাদীদের সম্মিলিত যুদ্ধ। এভাবে আফগান বিপ্লবের বিরুদ্ধে এটা ছিল পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ এবং মধ্যযুগীয় একনায়কী স্বৈরতন্ত্র, জবরদস্তি এবং যুদ্ধের ধর্ম ইসলামের ঐক্যবদ্ধ যুদ্ধ। এভাবে পাশ্চাত্য এবং ইসলামের মধ্যকার ঐক্য আমরা দেখলাম। পাশ্চাত্য এই যুদ্ধ পরিচালনা করল গণতন্ত্রের নামে। অথচ গণতন্ত্রের সঙ্গে ইসলামের সামান্যতম সম্পর্কও নাই।
এটা ঠিক যে, আফগান বিপ্লব প্রথমেই উদার গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারে নাই। একটা পশ্চাৎপদ ও স্বৈরতান্ত্রিক সমাজের বিপ্লবী রপান্তরের সময় সেটা সম্ভব নয়। সুতরাং সেটা আশা করাই ভুল। এমনকি আজকের ইউরোপকেও মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে পা ফেলার সময় রক্তপাতময় বহুসংখ্যক যুদ্ধ এবং ধর্মীয় ও সামন্তবাদী স্বৈরতার বিরুদ্ধে পাল্টা স্বৈরতা প্রতিষ্ঠার অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আসতে হয়েছে। এই প্রক্রিয়ায় উঠে আসা ইউরোপের দেশগুলি নিজ নিজ দেশে পুঁজিবাদের বিকাশের পাশাপাশি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। এভাবে তারা পাশ্চাত্য বহির্ভূত সমাজগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তির ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে এনে সমগ্র পৃথিবীতে নিজেদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় তারা উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা এবং অস্ট্রেলিয়ার আদি অধিবাসীদের প্রায় সম্পূর্ণ বিনাশ ঘটিয়ে সেইসব দেশকে নিজেদের আবাস ভূমিতে পরিণত করেছে। এ ছাড়া এশিয়া ও আফ্রিকার বিপুল সংখ্যক দেশ অধিকার করে সেগুলির সম্পদ লুণ্ঠন করেছে এবং কোটি কোটি মানুষকে হত্যা করেছে। এশিয়া, আফ্রিকার কথা বাদ দিয়ে শুধু বাংলার একটি গণহত্যার দৃষ্টান্তই দেওয়া যাক। ১৭৫৭ সালে রবার্ট ক্লাইভ কর্তৃক পলাশীর যুদ্ধে নওয়াব সিরাজ উদ্দৌলার বিশ্বাসঘাতক সেনাপতি মীর জাফরের সহায়তায় বাংলা জয়ের অল্পদিন পর বাংলা সন ১১৭৬-এ (১৭৬৯-’৭০ খ্রীষ্টাব্দ) মন্বন্তর বা মহাদুর্ভিক্ষ ঘটিয়ে বাংলার তৎকালীন ৩ কোটি মানুষের মধ্যে ১ কোটি মানুষের মৃত্যু ঘটানো হল। আমরা জানি, এই দুর্ভিক্ষ ছিল সম্পূর্ণরূপে কৃত্রিমভাবে সংগঠিত একটা দুর্ভিক্ষ। একদিকে দখলদার ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কর্মকর্তা-কর্মচারীদের উন্মত্ত লুণ্ঠন ও দুর্নীতি এবং কর ও খাজনা আদায়ের নামে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী অধিকৃত রাষ্ট্রের নির্বিচার লুণ্ঠন এই মহাদুর্ভিক্ষ বা মন্বন্তরের জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী ছিল। এভাবে বিজয়ের পর পরই ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের প্রথম বলি হল এক কোটি বঙ্গবাসী।
এককোটি বাঙ্গালীকে হত্যা করার পর ব্রিটেন হাত দিল বঙ্গের কুটীর শিল্পের উপর এবং তাকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিল। এ প্রসঙ্গে একটি মাত্র উদাহরণ দিই। যে মসলিন বস্ত্র ছিল পৃথিবীর বিস্ময় এবং আজও যার সূক্ষতা ও মসৃণতা কিংবদন্তীর উপাখ্যান হয়ে আছে তার উৎপাদনকে তারা একেবারে ধ্বংস করে দিল। আজ মসলিন বস্ত্র একটা হারিয়ে যাওয়া বিস্ময়ের নাম মাত্র।
এভাবেই সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী রূপ গ্রহণ ক’রে পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী সভ্যতা বিশেষত প্রাচ্যের জনগণকে পরাজিত, ধ্বংস, অধীনস্থ এবং লুণ্ঠন ও শোষণ করে দাঁড়িয়েছে। কালের ধারায় পরিবর্তন আসে। ফলে ব্রিটেন, ফ্রান্স, স্পেন ইত্যাদি দেশের পুরাতন ধরনের প্রত্যক্ষ শাসন ও শোষণ মূলক সাম্রাজ্য কিংবা উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার কাল শেষ হয়েছে। এই পুঁজিবাদী পাশ্চাত্য প্রাচ্যে পুরাতন ধরনের প্রত্যক্ষ শাসন তথা সাম্রাজ্য এবং উপনিবেশ রক্ষা করতে না পারলেও তারা তাদের অধীনস্থ দেশগুলিতে উপনিবেশিক যে রাষ্ট্র কাঠামো এবং অধস্তন সুবিধাভোগী শ্রেণী গড়ে তুলেছিল সেইসব দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা তাদের এই অধস্তন শ্রেণীর হাতে তুলে দিয়ে গেল। এই ব্যবস্থায় প্রত্যক্ষ শাসনের ঝামেলা থাকল না। অথচ যে রাষ্ট্র্র তারা রেখে এসেছিল তার দ্বারা দূর থেকেও বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা যায়। এবার স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে সাম্রাজ্যবাদীদের যে অধস্তন শ্রেণী রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হল তারা হল তাদের প্রাক্তন প্রভুদের স্বার্থ সংরক্ষক। সেটা হল তারা তাদের নিজেদের স্বার্থেই।
তারা পেল এমন এক উপনিবেশিক রাষ্ট্রযন্ত্র যেটা তৈরী করা হয়েছিল মূলত দেশী জনগণকে দমন করে রেখে বিদেশী প্রভুদের শোষণ ও লুণ্ঠনকে নিশ্চিত ও অব্যাহত রাখার জন্য। বিদেশী উপনিবেশিক প্রভুরা উপনিবেশের দেশীদের নিজেদের অধীনে রেখে যে সেনাবাহিনী, পুলিশ, প্রশাসন ও বিচার বিভাগ সমন্বিত রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল সেটা এখন স্বাধীন হিসাবে পরিগণিত দেশের স্থানীয় শাসকদের অধীনে গিয়ে দেশী শাসক শ্রেণী কর্তৃক দেশী শাসিত জনগণকে দমন ও শোষণের যন্ত্র হিসাবে কাজ করে চলল। সেটাই এই রাষ্ট্রের জন্য স্বাভাবিক হল। কারণ এ কাজ করার জন্যই উপনিবেশিক প্রভুরা এই রাষ্ট্রকে গড়ে তুলেছিল। প্রভু বদলেছে তো কী হয়েছে? উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্র তো তার নিজ চরিত্র বদলাতে পারে না।
নির্বাচনমূলক ব্যবস্থা থাকুক বা না থাকুক তাতে কিছুই যায় আসে না। গণতন্ত্রের নামে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের শাসন থাকলে তারা উপনিবেশিক ব্যবস্থার উত্তরাধিকার স্বরূপ এই তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্রে উপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে চলে। যদি নির্বাচনের পরিবর্তে সেনা শাসনের অধীনে রাষ্ট্র পরিচালিত হয় তবে এই একই কাজ করে সেনা শাসকরা।
শুধু এইটুকু বললে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রের তাৎপর্যকে বুঝানো যাবে না। উপনিবেশিক শাসকরা যাবার সময় আর একটি জিনিসকে রেখে দিয়ে গেছে। সেটা হচ্ছে তাদের সাম্রাজ্যবাদী-উপনিবেশবাদী পুঁজির অধীনে দেশী ব্যক্তিমালিকানাধীন পুঁজি। এই পুঁজি বলতে শুধু শিল্প নয়, এটা হতে পারে আধুনিক বিশ্ববাজার ব্যবস্থার সঙ্গে সংযুক্ত যে কোনও ধরনের বৃহৎ ব্যবসা বা বাণিজ্য এবং সেই সঙ্গে বিশেষ করে বৃহৎ ভূমিমালিকানা। এই সব মিলিয়ে উপনিবেশবাদীরা তাদের অধস্তন একটা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত একটা অর্থনৈতিক শ্রেণীকেও রেখে গেছে।
এই সবটা মিলে আমাদের মতো দেশে উপনিবেশবাদ প্রত্যক্ষভাবে বিদায় নিবার পরেও তার আধিপত্য, নিয়ন্ত্রণ এবং শোষণ অব্যাহত রেখেছে। এভাবে পাশ্চাত্যের এমন সাম্রাজ্য বহাল আছে যাকে চোখে দেখা না গেলেও যা ক্রিয়াশীল রয়েছে ভিন্ন রূপে এবং ভিন্ন মাধ্যমে। বিদেশীদের বদলে স্বদেশী শাসকরাই পুরাতন ব্যবস্থাকে অব্যাহত রেখে ভিন্ন রূপের তথা ছদ্মবেশী উপনিবেশবাদকে বহাল রেখেছে। পাশ্চাত্য সরাসরি আর দৃশ্যমান রূপে আমাদের দেশের মতো দেশগুলির ঘাড়ের উপর চেপে নাই। কিন্তু এখান থেকে কী তারা পায় না? শুধু বাণিজ্যের মাধ্যমে সুবিধা নয়। আমাদের মতো দেশগুলি তাদের পুঁজি বিনিয়োগেরও ক্ষেত্র, যার ফলে তাদের কাছে যায় মুনাফা। এছাড়া যায় শ্রমশক্তি এবং মেধা। প্রতি বছর তাদের দেশে যায় বিপুল সংখ্যক মানুষ তাদের জন্য প্রয়োজনীয় শ্রমশক্তি এবং মেধার যোগান দিতে। এছাড়া সাবেক উপনিবেশগুলির উচ্চবর্গ কিংবা শাসক শ্রেণীর লোকজন বৈধ ও অবৈধসহ নানাবিধ উপায়ে যে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে তার একটা বড় অংশ পাশ্চা্ত্যের দেশগুলিতে পাঠিয়ে দেয়। অনেকে তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে সেই সব দেশেই স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পাঠায়। প্রকৃতপক্ষে পাশ্চাত্য এখন সাবেক উপনিবেশসমূহের অর্ধ-বিত্তবানদের অনেকেরই দ্বিতীয় আবাসভূমি বা ‘সেকেন্ড হোম’। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন একটা ধ্রুপদী দৃষ্টান্ত। এই অবস্থা যদি সাম্রাজ্যবাদ এবং উপনিবেশবাদের নবতর রূপ না হয় তাহলে সেটা আর কী হতে পারে? এভাবে পাশ্চাত্য যা দেয় তার চেয়ে বহুগুণ ফিরে পায় আমাদের মতো দেশগুলি থেকে। অথচ এসব দেশে এখন আর তাদের সৈন্যসামন্ত পুষবার ঝামেলা করতে হয় না। বরং বহু ঝক্কি-ঝামেলা থেকে মুক্ত থেকে সাবেক উপনিবেশগুলিকে লুণ্ঠন করে যাওয়া যায়।
উপনিবেশিক কালে পরাধীনতা সত্ত্বেও প্রাথমিক লুণ্ঠন ও ধ্বংসের পরবর্তী কালে সভ্য ইউরোপীয় দেশগুলি কিছু নিয়ম-নীতি প্রতিষ্ঠা করেছিল, যা তারা নিজেরাও সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী কঠোরভাবে পালন করে যেত। বলা যায় এক অর্থে তাদের শাসনে সততা ও নিয়মানুবর্তীতা যথেষ্ট দৃশ্যমান ছিল। খুচরা ঘুষ-দুর্নীতি তারা যেমন সচরাচর করত না তেমন এগুলিকে প্রত্যক্ষভাবে প্রশ্রয়ও তারা দিত না। যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা তারা তাদের উপনিবেশিক শাসনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করেছিল সেটাই মূলত যথেষ্ট ছিল তাদের শোষণমূলক ব্যবস্থাকে সচল রাখার জন্য। রাষ্ট্রটা ছিল একটা নির্দিষ্ট আইনী ব্যবস্থা বহাল রেখেই এই শোষণের ব্যবস্থা অব্যাহত রাখার জন্য ক্রিয়াশীল।
কিন্তু দেশী শাসক শ্রেণীর হাতে এই রাষ্ট্র পরিচালনার ভার হস্তান্তরের পর এই রাষ্ট্র এবার দেশী শাসক শ্রেণী এবং তাদের সহচরবৃন্দের অর্থ-বিত্ত সংগ্রহের যন্ত্রে পরিণত হল। সুতরাং রাষ্ট্রযন্ত্র হল যাবতীয় ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে অর্থ-বিত্ত সংগ্রহের হাতিয়ার। এই অবস্থায় উপনিবেশিক কালেও সমাজে যেটুকু ন্যায়-নীতি বোধ ছিল সেটুকুও লোপ পেতে থাকল। দূরে যাবার দরকার নাই। আমাদের বাংলাদেশ তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পাকিস্তান কালে সাধারণ মানুষ এমনই বলত না, ‘এর চেয়ে ব্রিটিশ আমল ভালো ছিল।’ তারা এ খেদোক্তি করত ব্রিটিশ শাসন কালের অভিজ্ঞতা থেকে। বাংলাদেশ হবার পর বহুদিন পর্যন্ত একটু বয়স্ক মানুষদের অনেকের নিকট থেকে শুনেছি, ‘এর চেয়ে পাকিস্তান আমল ভালো ছিল।’
আসলে দেশী শাসনে একটা সমাজের ক্রমিক অধঃপাতের বাস্তবতাই সাধারণ মানুষের এ ধরনের খেদোক্তি থেকে বেরিয়ে আসে। উত্তর উপনিবেশিক কালে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রগুলির এটা একটা সাধারণ পরিণতি যেটা আমরা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে দেখি। বস্তুত পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলির পুঁজি গঠন এবং শিল্পায়ন প্রক্রিয়ার সঙ্গে আমাদের মতো দেশগুলির অধিকাংশেরই সঙ্গতি খুঁজে লাভ নাই। পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে পুঁজি গঠন ও শিল্পবিপ্লবের আদিপর্বেও যে ধরনের নিয়ম-নীতি ছিল তার কিছুই আমাদের মতো দেশগুলিতে নাই। তাই এখানে শিল্প বলতে হবে পাশ্চাত্য বাজারের যোগানদার গার্মেন্ট শিল্পের মতো শিল্প-কারখানাকে, যেগুলি প্রকৃতপক্ষে দর্জিশিল্প ছাড়া আর কিছু না। এর লভ্যাংশের এক বৃহৎ অংশও অন্যদের দ্বারা বিভিন্ন বৈধ ও অবৈধ সূত্রে অর্জিত অর্থের মতো পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের ব্যাংকে জমা হবে অথবা সেখানে জমি ও বাড়ী কেনায় বিনিয়োগ হবে। সুইস ব্যাংক হোক আর বিভিন্ন দেশ হোক প্রাচ্যের এই ধরনের অর্থ গ্রহণের জন্য উন্মুখ হয়ে থাকে। সুতরাং পাশ্চাত্য কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত নূতন বিশ্বব্যবস্থায় সময়ের প্রয়োজনে এবং তাদেরও প্রয়োজনে সাবেক উপনিবেশগুলিতে কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও দুর্নীতি ও দুর্বৃত্তায়নের পঙ্কে নিমজ্জিত হওয়াই হচ্ছে এগুলির সাধারণ পরিণতি।
পাশ্চাত্যের জন্য উত্তর-উপনিবেশিক শোষণ-লুণ্ঠনের যে বিশ্বব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত রয়েছে তার নেতৃত্বে এখন আছে মার্কিন যু্ক্তরাষ্ট্র। আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয় এই ব্যবস্থাকে সরাসরি আঘাত না করলেও এই দীর্ঘ যুদ্ধ এবং অবশেষে পরাজয়ে তার যে অর্থনৈতিক ও নৈতিক ক্ষতি হয়েছে সেটা সম্ভবত আর পূরণ হবে না। যেমনই হোক পৃথিবী যে আর পূর্বের অবস্থায় ফিরবে না সে কথা বলা যায়।
ইতিপূর্বে যে কথা বলেছি তার পুনরুক্তি করে বলি দেশে দেশে ইসলাম তথা ইসলামী শক্তির পুনরুত্থান ঘটবে এবং তার বিপরীতে ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তিরও উত্থান ঘটবে। এভাবে ইসলাম এমন এক সঙ্কটের মুখোমুখী হবে যা তা ইতিপূর্বে কখনই হয় নাই। আমার এ কথার তাৎপর্য ব্যাখ্যা সাপেক্ষ। সে প্রসঙ্গে এখন আসা যাক।
(৪) ইসলামের সঙ্কট
ইসলামের সঙ্কট প্রসঙ্গে প্রথমেই এ কথা বলা দরকার যে, ইসলাম প্রধানত স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ধর্ম নয়। মদীনায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামের নবী মুহাম্মদ তার ধর্ম প্রতিষ্ঠা ও প্রসারের জন্য যুদ্ধ এবং বলপ্রয়োগের যে পথ গ্রহণ করেন সেটা ইসলামের মর্মমূলে প্রোথিত হয়ে আছে। কুরআন, হাদীসসহ ইসলামের সকল গ্রন্থ এবং বিধিবদ্ধ বিধানসমূহ দ্বারা ইসলামকে রাজনৈতিক ও সামরিক ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ইসলাম সর্বদা যুদ্ধ তথা জিহাদ করে না। কিন্তু সেটা তার কৌশল মাত্র। যখন পরিস্থিতি অনুকূল থাকে না তখন ইসলাম তথা মুসলিমরা কৌশল হিসাবে সাময়িকভাবে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বা আবেদনের মাধ্যমে ধর্মপ্রসার বা প্রচারের পথ নিতে পারে।
আজকের সভ্যতার যুগে মুসলিমরা তুলনায় শক্তিহীন। সুতরাং ধর্মীয় বিধানের বহুকিছু যেমন বাস্তবায়নের ক্ষমতা তাদের নাই তেমন ইতিহাসের বহুকিছু পুনরাবৃত্তির ক্ষমতাও তাদের নাই। কিন্তু প্রকৃত মুসলিমদের লক্ষ্য ইসলামকে একমাত্র সত্য ধর্ম হিসাবে সমস্ত বিশ্বে প্রতিষ্ঠা করা। যদি শান্তিপূর্ণ পন্থায় কাজ না হয় তবে উপযুক্ত পরিস্থিতির জন্য অপেক্ষা করা এবং সেটা আসা মাত্র অ-মুসলিম সমাজ, রাষ্ট্র বা জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে জিহাদে তথা ধর্মযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়া ইসলামের সাধারণ নিয়ম। এই নিয়ম অনুযায়ী অ-মুসলিমদেরকে পরাজিত করতে পারলে তাদেরকে অধীনস্থ করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে তাদেরকে বাধ্য করা হয় অথবা সবাইকে বাধ্য করতে না পারলে অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসাবে ইসলামী রাষ্ট্রে তাদেরকে দ্বিতীয় শ্রেণার মানুষ হিসাবে এমনভাবে জিজিয়া কর প্রদানে বাধ্য করা হয়, যা যে কোনও মানুষের জন্য অত্যন্ত অসম্মানজনক। শুধু তা-ই নয়, হত্যা, লুণ্ঠন, দাস-দাসীকরণ এবং বাধ্যতামূলক ধর্মান্তরকরণের পরেও যারা অমুসলিম রয়ে যায় তাদের সকলের জন্য মুসলিম রাষ্ট্রে নির্ধারিত করা থাকে অসম্মানের জীবন, যার বোঝা থেকে পরিত্রাণ পাবার জন্য অনেক ক্ষেত্রে অধীনস্থ অ-মুসলিমরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ভারতের মতো কিছু জায়গায় মুসলিমরা এই পন্থায় তেমন একটা সফল না হলেও ইসলাম অধিকৃত সকল সমাজের এ্টাই সাধারণ চিত্র।
অবশ্য ভারতের ক্ষেত্রে ভারতীয় সভ্যতার নিজস্ব শক্তির বিষয়টিকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। প্রাথমিক অভিযানের বাড়াবাড়ির পর বহিরাক্রমণকারী বিজয়ী মুসলিমরা অধীনস্থ ভারতীয় জনগণের উৎপাদনশীলতা এবং সেবাদানের সক্ষমতাকে হিসাবে নিয়ে ধর্মান্তরকরণের ধর্মীয় বিধানকে অনেক ক্ষেত্রে শিথিল অথবা লঙ্ঘন করেছে। সেসব ক্ষেত্রে. একদিকে, ধর্মীয় প্রশ্নে ভারতীয় অমুসলিম জনগণের অবিশ্বাস্য দৃঢ়তা, এবং অন্যদিকে, অর্থনৈতিক লাভালাভ বিবেচনা বহিরাগত এবং বিজেতা মুসলিম শাসকদেরকে নমনীয় করত। সে ক্ষেত্রে বাড়তি হিসাবে জিজিয়া কর নিয়ে তারা সন্তুষ্ট থাকত। অবশ্য মোগল সম্রাট আকবর অ-মুসলিম প্রজাদের উপর আরোপিত জিজিয়া কর বাতিল করেন, যা তার উত্তরসূরি ধর্মান্ধ মুসলিম শাসক আওরঙ্গযেব পুনরায় প্রবর্তন করেন। আওরঙ্গযেবের আরও কিছু ধর্মীয় কর্মকাণ্ড বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু প্রজাদেরকে বৈরী ও বিদ্রোহী ক’রে মোগল সাম্রাজ্যের পতনকে অনিবার্য করে। যাইহোক, সেসব এখানে আমাদের আলোচ্য বিষয় নয়।
ইসলামের মৌল গ্রন্থাদির বিধান এবং ঐতিহাসিক দৃষ্টান্ত এবং সেই সঙ্গে ইসলামী সমাজ তথা মুসলিমদের নিত্যদিনের আচরণের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা ইসলামকে চিনতে পারি। এটা যে একটা রাজনৈতিক ও সামরিক ধর্ম এটা বুঝা কঠিন কিছু নয়। কালে কালে দেশে দেশে বিভিন্ন জন চেষ্টা করেছে ইসলামের ভিন্ন ব্যাখ্যা দিতে কিংবা তার এই রাজনৈতিক-সামরিক এবং জবরদস্তির রূপকে নমনীয় করতে, কিন্তু সেসব চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে ইসলামের জিহাদী রূপের প্রত্যাবর্তন দ্বারা। বরং এই সকল চেষ্টা শেষ পর্যন্ত ইসলামের জিহাদী এবং আদিরূপের প্রত্যাবর্তনেরই সহায়ক হয়। কারণ ইসলামের পুনর্জাগরণ যখন শুরু হয় তখন মৌল ইসলামই প্রত্যাবর্তন করে। যা আছে কুরআন-হাদীসে, যা আছে যুগযুগান্তের ইসলাম প্রতিষ্ঠা, বিস্তার ও চর্চার ইতিহাসের অঙ্গীভূত হয়ে তাকে ইসলামের নাম নিয়ে বদলানো যাবে কী করে? এসব ভিন্নধর্মী প্রয়াস শেষ পর্যন্ত চিহ্নিত হয় কুফরি কিংবা ইসলাম থেকে বিচ্যুতি হিসাবে। মুসলিমরা শেষ পর্যন্ত ইসলামকে তার আদিরূপে ফিরে পেতে চায়। যে কথা ইতিপূর্বে বলেছিলাম তার পুনরাবৃত্তি করে ইসলামের কবির ভাষায় বলি, ‘ইসলাম জিন্দা হোতা হ্যায়, হর কারবালা কি বাদ।’
কিন্তু সেটা কি আর সম্ভব? ইসলামকে আধুনিক সভ্যতার যুগে আর আদিরূপে ফিরে পাওয়া সম্ভব না। কারণ আধুনিক সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত কোনও রাষ্ট্রেই আর ইসলামকে তার মূল রূপে অনুশীলন সম্ভব না। নানান ভান করা যায়, ভণ্ডামিপূর্ণ ব্যাখ্যা করা যায় ইসলাম নিয়ে, কিন্তু তার মৌল রূপের অনুশীলন আর সম্ভব নয়। ইসলামিক স্টেট ইরাক-সিরিয়ায় খিলাফত প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তার কিছু বাস্তবায়নের চেষ্টা করতে গিয়ে সমস্ত বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ও ধিকৃত হয়ে এবং বিশেষ করে রুশ-সিরীয় বাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়েছে। আজকের যুগে ইসলামী বিধান অনুযায়ী মালেগণীমতের অনুশীলনের মাধ্যমে দাস-দাসীকরণ কিংবা তাদের বাজারজাতকরণ, বন্দী নারীদেরকে বিলিবণ্টনের মাধ্যমে ধর্ষণ, ধর্মান্তরিত হতে অস্বীকৃতি জানালে অ-মুসলিমদেরকে পাইকারিভাবে হত্যা এবং পরিশেষে জিজিয়া করের অধীনে নিক্ষেপ, চুরির জন্য হাত কাটা, কথিত ব্যভিচারের শাস্তি হিসাবে একশ’ চাবুকের আঘাত কিংবা পাথর ছুঁড়ে হত্যা করা সম্ভব নয়। সৌদী আরবের মতো মধ্যযুগীয় ইসলামী রাষ্ট্রও বাজারে দাস-বিক্রী করতে সাহস করবে না। কারণ তখন পাশ্চাত্যসহ সকল উন্নত দেশ এ ধরনের ইসলামী নিয়মের শিক্ষা সৌদী সরকারকে হাতেনাতে পাইয়ে দিবে।
আসলে ইউরোপের হাতে বিগত কয়েক শত বৎসর ধরে মুসলিম পৃথিবী পরাজিত ও অধীনস্থ। ইসলামে যা-ই থাক সবকিছু চর্চার ক্ষমতা ইসলামী সমাজ বা রাষ্ট্রগুলির নাই। বিশেষত পাশ্চাত্য যতটুকু অনুমোদন করে ততটুকু মুসলিম সমাজগুলি পালন করার সাহস করে। আর সেটুকু পালন করলে পাশ্চাত্যের সমস্যা নাই, বরং সুবিধা। কারণ পাশ্চাত্য খুব ভালোভাবে জানে যে, ধর্ম হিসাবে ইসলাম তাদের আধিপত্য ও শোষণের স্বার্থে খুবই অুনকূল। ইসলাম সভ্যতার অগ্রগতির পথে নিদারুণ বাধা অর্পণকারী ধর্মবিশেষ। সকল ধর্মই এক অর্থে সভ্যতা বিরোধী। কিন্তু্ সামরিক-রাজনৈতিক ধর্ম হওয়ায় ইসলাম যেভাবে সভ্যতার অগ্রগমনের পথে বাধা অর্পণ করে অন্য ধর্মগুলি সেভাবে বাধা অর্পণে সক্ষম নয়। ফলে রাষ্ট্র শাসন থেকে অপসারণ করলে অন্য ধর্মগুলি সমাজের অগ্রগতির পথে সেভাবে বাধা দেয় না যেমনটা ইসলাম দেয়। ইসলাম মর্মমূলে সামরিক ও রাজনৈতিক ধর্ম হওয়ায় তার মর্মে থাকে ব্যক্তির জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামী অনুশাসন অনুসরণের তাগিদ। এই তাগিদকেও তা বাধ্যমূলক করতে চায় তার বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী। পরাজিত ইসলাম বাইরের অ-মুসলিম পৃথিবীর সামনে নতজানু হয়ে থাকলেও নিজ সমাজের ভিতর হয়ে থাকে হিংস্র এবং আক্রমণাত্মক। ইসলামের কোনও ধরনের সমালোচনা কিংবা বস্তুনিষ্ঠ আলোচনা ও বিতর্ক এই সমাজে সম্ভব নয়। কারণ তার জন্য যে শুধু রাষ্ট্র নিবর্তনমূলক আইন প্রয়োগ করতে পারে তাই নয়, অধিকন্তু ধর্মীয় বিধান অনুযায়ীই যে কোনও বিশ্বাসী মুসলিম তাকে যে কোনও সময় হত্যা করতে পারে।
মোট কথা, ইসলাম ধর্ম তার সমাজকে স্বাধীনভাবে চিন্তায় অক্ষম, ফলে বন্ধ্যা করে। এই অবস্থা পাশ্চাত্যের সাবেক উপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলি এবং তাদের সহযোগী পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলির জন্য বিপুল সুবিধা এনে দেয়। উপনিবেশিক কালের অবসান হলেও মুসলিম রাষ্ট্র বা সমাজগুলি হয়ে থাকে নানানভাবে পাশ্চাত্যের অধীস্থ বাজার, যে বিষয়ে ইতিপূর্বে আমি আলোচনা করেছি।
এ পর্যন্ত পাশ্চাত্যের জন্য ইসলাম ঠিক আছে। তবে ইসলাম যদি চৌদ্দশত বৎসর পূর্বের তার আদিরূপে ফিরতে চায় তবে তার আপত্তি আছে। স্বাভাবিক নিয়মে কাফের হিসাবে তারা তার প্রথম ও প্রধান টার্গেট হবে। অন্যদিকে, পাশ্চাত্য ইসলামের বহু মূল্যবোধ ও বিধিবিধানকে মেনে নিতে পারে না। যেমন, দাসপ্রথা, নারীর বন্দীদশা ইত্যাদি। অথবা সুদপ্রথা নির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা নিষিদ্ধকরণ। ফলে পাশ্চাত্য তাদের নিজেদের স্বার্থেই এমন মৌল বা খাঁটি ইসলাম বিরোধী।
অন্যদিকে, যে মুসলিম অধস্তন শ্রেণীকে তারা মুসলিম রাষ্ট্রগুলির শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করে গিয়েছিল সেই শ্রেণীগুলিও মুসলিম হলেও পাশ্চাত্য সভ্যতার বহুবিধ সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলতে চায়। তারা পাশ্চাত্যের উদার জীবনের বহু সুখ-সুবিধা যেমন ভোগ করে চলতে চায় তেমন সর্বদা ইসলামের আবেদন তাদের জনগণকে দিতে চায়। ফলে তারা হয় এক আশ্চর্য রকম আত্মপ্রতারণা ও পরপ্রতারণার শিকার। মুসলিম সমাজে পড়ে থাকলেও তাদের মন এবং জীবনের এক বড় অংশ পড়ে থাকে পাশ্চাত্যের দেশগুলিতে। নিজেদের দেশে বৈধ ও অবৈধ উপায়ে অর্জিত অর্থের এক বৃহৎ অংশই তারা পাচার করে পাশ্চাত্যের নানান দেশে। কারণ সেখানে আছে স্বাধীন জীবনাচরণের সুযোগ এবং নিরাপত্তা। এগুলির কোনওটিরই নিশ্চয়তা তাদের স্বদেশের জীবনে নাই। বিশেষত যে সমাজে সবকিছু নির্ধারিত হয় জবরদস্তি এবং হিংসা বা ‘ভায়লেন্সের’ মাধ্যমে এবং যে সমাজে অর্থ-বিত্ত সংগ্রহের প্রধান পদ্ধতি ক্ষমতার অপব্যবহার তথা দুর্নীতি সেই রকম সমাজে নিরাপত্তা বোধের অভাব যে উচ্চবর্গ তথা এলিটদের মধ্যে প্রবল হবে তাতে আশ্চর্য হবার কী আছে? নিরাপত্তা বোধের অভাব এই রকম সমাজে অবশ্য সর্বত্র পরিব্যাপ্ত থাকে। কারণ এখানে প্রকৃতপক্ষে ন্যায়-নীতি কোথাওই থাকে না। যেটা থাকে সেটা হচ্ছে বুলি, যা ভণ্ডামি ছাড়া কিছু না। এখানে ক্ষমাতাসীন শাসকদের জন্য ধর্ম হচ্ছে শাসিতদেরকে প্রতারণার হাতিয়ার। শাসকরা চিরকালই ধর্মর বুলি আওড়ালেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধর্মীয় বহুবিধান লঙ্ঘন করেই ভোগ-বিলাসে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকে। সুতরাং ইসলাম তাদের হাতিয়ার।
কিন্তু শাসিতদের জন্যও ইসলাম ধর্ম আরেক অর্থে হাতিয়ার যে, এটা তাদের দুঃখজর্জর এবং নিরাপত্তাহীন ও অনিশ্চিত জীবনের আশ্রয়স্থল। যে সুখ এ জীবনে সাধারণত তাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে, ধর্মীয় বিধিবিধান যতটা সম্ভব অনুসরণ ক’রে তার প্রত্যাশা তারা করে মৃত্যু পরবর্তী তাদের কাল্পনিক জীবনে।
এভাবে ইসলামের ধর্মীয় বন্ধন শাসক ও শাসিত তথা সমগ্র সমাজকে এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে বেঁধে রাখে। শাসকদের নিকট ইসলামের প্রয়োজন শাসিতদের উপর নিজেদের স্বৈরতান্ত্রিক, অনৈতিক বা দুর্নীতিগ্রস্ত শাসন জারি রাখার জন্য আর শাসিতদের নিকট প্রয়োজন এই দুর্গত জীবনকে মেনে নিবার যৌক্তিকতা ও প্রেরণা লাভ করার জন্য, যেটা আবার সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখায় তাদের শাসকদেরকে সহায়তা করে।
মুসলিম সমাজগুলির এই স্থিতাবস্থা পাশ্চাত্য আধিপত্যের পক্ষে কাজ করে। এভাবে ধর্ম বিশেষ করে ইসলাম ধর্ম হয়ে থাকে মুসলিম বিশ্বের উপর পাশ্চাত্যের উন্নত দেশগুলির আধিপত্য রক্ষার সহায়ক হাতিয়ার। সুতরাং পরোক্ষ সাম্রাজ্যবাদ ও আধিপত্যবাদ রূপে আবির্ভূত পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কৌশলে বিশ্বব্যাপী ইসলামের সংরক্ষণে ভূমিকা পালন করে এসেছে। যে কথা বলেছি অধীনস্থ ইসলাম তথা মুসলিম সমাজ পাশ্চাত্য আধিপত্য সংরক্ষণের জন্য সহায়ক।
কিন্তু যুগটা ইসলাম বলে কথা নয়, সকল ধরনের অন্ধবিশ্বাস নির্ভর ধর্ম বিরোধী। সুতরাং মুসলিম পৃথিবীর ভিতর থেকেও ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তির জাগরণ ঘটাটা স্বাভাবিক। এই জাগরণ শুধু যে ধর্ম বা ইসলাম বিরোধী হবে তা-ই নয়, উপরন্তু ইসলাম থেকে মুক্ত হয়ে তা উন্নত সমাজ ও অর্থনীতি গড়তে গিয়ে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীও হবে। এর প্রধান শর্ত হবে সাম্রাজ্যবাদী ব্যবস্থার সংরক্ষক উপনিবেশিক কাঠানোবদ্ধ রাষ্ট্র উচ্ছেদ এবং একই সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে দেশী পুঁজির অধীনতামূলক যোগসূত্র ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে বৃহৎ ব্যক্তিপুঁজিকে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় আনা এবং বৃহৎ ভূমি মালিকানার অবসান ঘটিয়ে ভূমি সংস্কার ঘটানো।
কিছু সংখ্যক মধ্যপ্রাচ্যের দেশ যেমন লিবিয়া, সিরিয়া, ইরাক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের নামে এটুকু করে সমাজকে একটা পর্যায় পর্যন্ত নিতে সক্ষম হলেও তারা যেমন অধিকতর অগ্রসর হতে পারে নাই তেমন নানান অজুহাতে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গের প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষ সামরিক আক্রমণের শিকার হয়ে বিধ্বস্ত হয়েছে। মুসলিম রাষ্ট্রগুলির এই ব্যর্থতার প্রত্যক্ষ কারণ বাইরের সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপ হলেও অভ্যন্তরীণ কারণও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। সেটা হচ্ছে এইসব সমাজে যে পরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল তা ছিল মূলত সমাজের উপরিতলের পরিবর্তন। কিন্তু সমাজতল ছিল অপরিবর্তিত।
ইসলাম তথা ধর্মবিশ্বাস থেকে সমাজতলকে মুক্ত করা যায় নাই। সে চেষ্টাও করা হয় নাই। ফলে সমাজের উপরিতল যেমন রয়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক তেমন অবতল বা নীচতলার জনগণও রয়েছিল স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপযোগী। শুধু তাই নয়, ইসলামের নিয়মে সমাজে হিংসা ও হানাহানির সংস্কৃতি প্রাধান্য পাওয়ায় রাষ্ট্রশাসকদেরকেও সর্বদা কঠোরতার অনুশীলন করতে হয়। অথচ আজকের যুগে দীর্ঘকাল এ ধরনের দমনমূলক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা যায় না। বিশেষ করে যে নামে হোক সমাজতন্ত্রের মানবিক এবং সাম্য বা সমতার যে আদর্শগুলির প্রচার করা হয় সেগুলি প্রচারের ফলে স্বৈরতন্ত্রের দীর্ঘ অনুশীলন শাসকদের জন্যও সঙ্কট তৈরী করে। অথচ ইসলামী সমাজে স্বৈরতার চর্চা ছাড়া সামাজিক স্থিতি বা শৃঙ্খলা রক্ষাও করা যায় না, অথচ যার দীর্ঘ অনুশীলন সমাজতন্ত্রের আদর্শ বিরোধী। সুতরাং সমাজতান্ত্রিক ধাঁচে গঠিত মুসলিম রাষ্ট্রগুলি এক অমীমাংসেয় দ্বন্দ্বের শিকার হয়েছিল। পাশ্চাত্য এর সুযোগ নিয়ে ইরাক, সিরিয়া এবং লিবিয়াকে বিধ্বস্ত করেছে। অবশ্য সিরিয়া গৃহযুদ্ধে বিধ্বস্ত হলেও রাশিয়ার সাহায্যে রাষ্ট্র হিসাবে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। রাষ্ট্রীয় সীমানা থাকলেও ইরাক-লিবিয়ার জন্য এ কথা প্রযোজ্য নয়।
অর্থাৎ যে কোনও বিচারে ইসলাম যে কোনও মুসলিম সমাজের প্রকৃত স্বাধীনতা ও অগ্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে।
তার আর একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে আফগানিস্তান। আফগানিস্তানও তার মতো করে কম্যুনিস্ট নেতৃত্বে আধুনিক সভ্যতা নির্মাণের পথ ধরে এগিয়ে যেতে চেষ্টা করেছিল। মজার ব্যাপার মার্কসবাদের আদর্শ নিয়ে গঠিত হলেও কম্যুনিস্ট পার্টি যেমন তার নাম কম্যুনিস্ট না দিয়ে পিপল্স ডেমোক্র্যাটিক পার্টি অব আফগানিস্তান বা আফগানিস্তানের জন-গণতান্ত্রিক দল দিয়েছিল তেমন ইসলামের বিরুদ্ধে কোনও যুদ্ধ ঘোষণাও করে নাই। এটা ঠিক যে, নারীর শিক্ষা ও অধিকারসহ এমন কিছু কর্মসূচী বাস্তবায়নের চেষ্টা করেছিল যেগুলি ইসলামের বিরুদ্ধে যায়। এ ধরনের অনেক কিংবা কাছাকাছি কর্মসূচী তুরস্কের কামাল পাশাসহ অনেক রাষ্ট্রনায়কই ক্ষমতা দখলের পর গ্রহণ করেছেন। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়ার মতো দেশগুলির নূতন রাষ্ট্রশাসকরা সমাজতন্ত্রের অনুসারী হলেও তারা ধর্মবিরোধী হিসাবে চিহ্নিত ছিলেন না। বরং লিবিয়ার নেতা গা্দ্দাফির মতো কেউ কেউ ইসলামের নামেই সমাজতন্ত্রের অনুশীলন করেছেন। কিন্তু অনেক দিন পর্যন্ত তাদের সমস্যা হয় নাই।
এর একটা বড় কারণ কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদী হিসাবে অন্যদের পরিচয় না ঘটা। ফলে তাদের বিরুদ্ধে জন-উত্থান ঘটানো যায় নাই। পাশ্চাত্যকে অনুকূল সুযোগ পেতে দীর্ঘ সময় নিতে হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও এইসব দেশের মিত্র সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙ্গন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে।
কিন্তু আফগান বিপ্লবী পার্টির সমস্যা হল তার আদর্শিক পরিচয়ের প্রকাশ্যতা। ফলে ধর্মমুক্ত দর্শনের অনুসারী হিসাবে মুসলিম জনগণের নিকট তাদেরকে কাফের বা বিধর্মী বা ধর্মদ্রোহী হিসাবে পরিচিত করাটা শত্রুপক্ষের পক্ষে সহজ হল।
তালিবানের পূর্বসূরি মুজাহিদীন বাহিনী বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত থাকলেও সকলেই কাফের সরকার উৎখাতের অভিন্ন লক্ষ্য নিয়ে পরিচালিত জিহাদে যোগ দিল। ধর্মবিশ্বাসীদের দ্বারা নাস্তিক হিসাবে কথিত সোভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক আফগান কম্যুনিস্ট সরকারের সমর্থন ও রক্ষায় সেনাবাহিনী পাঠানোয় মার্কন যুক্তরাষ্ট্রসহ সমগ্র পাশ্চাত্য দ্বারা সমর্থন ও সাহায্য পুষ্ট হয়ে এই জিহাদ বিশ্বজনীন রূপ নিল। সুতরাং পৃথিবী ব্যাপী গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রচারক আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এবার সরাসরি ইসলামী জিহাদের বিশ্বনেতা ও সেনাপতি হিসাবে আবির্ভূত হল।
আজকের যে তালিবানের হাতে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র এবং তার নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য সামরিক শক্তির এমন করুণ পরাজয় সেই তালিবান কিন্তু আর কেউ নয় মুজাহিদীন নামে পরিচিত প্রথম পর্যায়ের সেই জিহাদীদেরই কিছু পরবর্তী রূপ মাত্র, যাদের জন্ম সেই জিহাদের আদিপর্বেই। অর্থাৎ আজকের আফগান জিহাদ সেই জিহাদেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। ‘কাফের’ আফগান মার্কসবাদী সরকার এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আরেক ‘কাফের’ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করে যাদের উত্থান ও জয়যাত্রা পরবর্তী সময়ে তারা সেই ‘কাফের’ মার্কিন নেতৃত্বের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করল এবং অবশেষে তাকে আফগান ভূমিতে শোচনীয়ভাবে পরাস্ত করল।
ভিন্ন কাল এবং প্রেক্ষিত হলেও এ যেন ইসলামের সেই আদিপর্বে প্রত্যাবর্তন, যখন মদীনা এবং আরবে ইসলামের প্রাথমিক বিজয় সম্পূর্ণ করার পর ইসলাম কর্তৃক পারস্য এবং রোমান বাইজেন্টাইন সমকালীন এই দুই পরাশক্তিকে পরাস্ত এবং অধিকার করা হল। এর সঙ্গে অনেকটা তুলনীয় হতে পারে এখনকার যুগে প্রায় সমকালীন দুইটি পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে পর্যায়ক্রমে পরাজিত করা। এটা ঠিক যে ইসলামের বাহিনী আদিপর্বে পারস্য এবং বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যকে পরাজিত করতে আর কোনও শক্তির সাহায্য নেয় নাই। বরং তারা এককভাবেই কাজটা করেছিল। তবে এখনকার যুগে ইসলামী বাহিনী পরাশক্তি সোভিয়েতকে পরাজিত করতে যুক্তরাষ্ট্রের সাহা্য্য নিলেও যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদেরকে পরাজিত করতে কারও সাহায্য নেয় নাই। পরমাণু শক্তিধর এবং মিসাইল, রকেট, যুদ্ধবিমান, ট্যাংক, ড্রোন ইত্যাদি যাবতীয় আধুনিক মারণাস্ত্র সজ্জিত একটা মহাশক্তির বিরুদ্ধে হতদরিদ্র এবং পায়জামা-কুর্তা-স্যান্ডেলধারী একটা জনগোষ্ঠী শুধু কিছু বন্দুক বা রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ করে জয়ী হয়েছে! অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটা সত্য।
জিহাদ এখনও আফগানিস্তানে সীমাবদ্ধ হয়ে থাকলেও সেখানে সীমাবদ্ধ থাকবে কেন? যাদের জন্ম এবং সাফল্য জিহাদের ব্রত নিয়ে কোনও দেশের গণ্ডীর মধ্যে তাদেরকে সীমাবদ্ধ রাখা যাবে কেন। তাদের ধর্মই কোনও দেশের সীমানায় জিহাদকে আবদ্ধ রাখতে নিষিদ্ধ করেছে। দুই দুইটা পরাশক্তির পরাজয়ের পর এখন কি পৃথিবী তাদেরকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে না? এই ডাককে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা তাদের কতদিন থাকবে?
কিন্তু বিশ্বপরিস্থিতি তাদের পক্ষে নয়। যে সময়ে ইসলামের উত্থান ঘটেছিল সেটা ছিল পৃথবীর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সভ্যতার সঙ্কট, ক্ষয় এবং ধ্বংসের কাল। প্রাগৈতিহাসিক সিন্ধু, মিসর এবং ব্যাবিলনের সভ্যতা অনেক কাল পূর্বে ধ্বংসপ্রাপ্ত। গ্রীস এবং রোমান সভ্যতাও তখন বিগত হয়েছে। আসলে বহুদূরবর্তী চীন বাদে আর সর্বত্র তখন সভ্যতায় ক্ষয় এবং অবসাদ নেমে এসেছিল। হাজার হাজার বৎসর ধরে চাষাবাদের ফলে ভূমি ক্ষয়, ভূমির লবণাক্ততা এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে সীমিত সম্পদের উপর অতিরিক্ত চাপ ইত্যাদি নানাবিধ কারণে সভ্যতায় সঙ্কট বা বিপর্যয় নেমে এসেছিল। এ যেন সভ্যতার রাত্রি। বর্বরতার উত্থানের জন্য এটা ছিল এক উপযুক্ত সময়। এমনই একটা সময়ে আরবের মরুপ্রান্তর থেকে বর্বর যাযাবর বেদুইনদের উপর ভর করে যে ধর্ম উঠে এল তা ছিল সভ্যতার সঙ্কটের এমনই এক পরিস্থিতির উপযোগী। সুতরাং ঝড়ের গতিতে তার উত্থান এবং প্রসার।*
-------------------
* ইসলামের উত্থানের পিছনে প্রাচীন পৃথিবীর সভ্যতার সঙ্কটের ভূমিকা সম্পর্কে আমি নিম্নলিখিত গ্রন্থ দুইটিতে উল্লেখ করেছি :
ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা
(Link : http://www.bangarashtra.net/article/852.html )
ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা
(Link : http://www.bangarashtra.net/article/1169.html )
------------------
কিন্তু সভ্যতার সেই সঙ্কট কাল সেই অর্থে বহুকাল ধরে নাই। মাঝে মাঝে স্বাভাবিক নিয়মে তার কিছু সমস্যা কিংবা সঙ্কট ঘটলেও সেগুলি সমাধান-অযোগ্য কিংবা প্রতিকার-অযোগ্য নয়। সুতরাং ইসলামের পুনরুত্থান কিংবা এ ধরনের কোনও হিংস্র আদর্শের উত্থান আজকের যুগে অসম্ভব।
তবে আদর্শের যে একটা নিজস্ব শক্তি থাকে সেটা আফগানিস্তানে তালিবান নামে কথিত আফগান জিহাদী বা মুজাহিদদের নিকট সমগ্র পাশ্চাত্য শক্তিজোটের পরাজয়ে প্রমাণিত হয়েছে। এই জয় না টিকতে পারে, কিন্তু সাময়িক হলেও অবিশ্বাস্য এই জয় থেকে আমরা শিক্ষা নিব না কেন? এই শিক্ষা হচ্ছে আদর্শ বা ভাবাদর্শের শক্তিমত্তাকে বুঝতে পারা।
(৫) ভাবাদর্শের শক্তিমত্তা
হতে পারে যে, ইসলাম মানুষকে বর্বর করে, তার চেতনাকে পশুপ্রায় চেতনার পর্যায়ে নামায়। তবু যেমনই হোক এটা একটা আদর্শ তথা ভাবাদর্শ দেয়। আদর্শের শক্তির গুরুত্ব এই উপমহাদেশের দিকে তাকালেও আমরা বুঝতে পারি। বহিরাগত মুসলিম শক্তি প্রায় সাড়ে পাঁচশত বৎসর এক নাগাড়ে ভারতবর্ষের অধিকাংশ জায়গা শাসন করার পরেও ভারতবর্ষের বেশীর ভাগ মানুষ হিন্দুধর্মকে প্রাণপণে আঁকড়ে ধরে থেকেছে। বহিরাগত মুসলিমরা চেষ্টার ত্রুটি করে নাই তাদেরকে মুসলিম করতে। কিন্তু হিন্দুদের মরণপণ প্রতিরোধের মুখে শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে শাসনজাত সুযোগ-সুবিধা নিয়ে সন্তুষ্ট থেকেছে।
অবশ্য এটা ভারতের কৃষিসমাজের শক্তির ফলেও সম্ভব হয়েছে। সুতরাং ধর্মান্তরকরণ হয়েছে আফগানিস্তানসহ উপমহাদেশের উত্তর-পশ্চিমের সেই সব অঞ্চলে যেখানে ভূপ্রকৃতির কারণে কৃষিসমাজ দুর্বল ছিল এবং সমাজ ছিল অনেকটা অস্থিতিশীল এবং যথেষ্ট পরিমাণে পশুপালন নির্ভর। উপমহাদেশের পূর্বপ্রান্তের বঙ্গের পূর্বদিকের নদীবিধৌত অস্থির ভূমিতে কৃষিসমাজ থাকলেও অব্যাহত নদীভাঙ্গনের দরুণ তা ছিল খুব বেশী অস্থিতিশীল। অব্যাহত নদী ভাঙ্গন এবং নূতন নূতন চর গঠনের ফলে জনবসতির অবিরাম ছত্রভঙ্গ হওয়া ছিল সাম্প্রতিক কালের পূর্ব পর্যন্ত এ বঙ্গের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। এই রকম পরিস্থিতিতে বিজয়ী শাসকদের ধর্ম ইসলাম এখানকার মানুষদের এক বৃহৎ অংশকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়। অর্থাৎ বঙ্গে ধর্মান্তরকরণ কৃষি-নির্ভর সমাজের অস্থিতিশীলতা তথা দুর্বলতার কারণে সম্ভব হয়েছিল বলে মনে হয়।
তা সত্ত্বেও এখানে মুসলিম যুগে ইসলাম কতটা বিস্তার লাভ করেছিল সে ব্যাপারে সন্দেহ করার কারণ আছে। কারণ ব্রিটিশ শাসনকালে ১৮৭২ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম যে লোকগণনা হয় তখনও বঙ্গে মুসলিমরা সংখ্যালঘু ছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে মুসলিম আধিপত্য না থাকায় হিন্দুদের ব্যাপক সংখ্যায় ইসলাম গ্রহণের কারণ ছিল না। সুতরাং মুসলিম সংখ্যাবৃদ্ধির একটি প্রধান কারণ হিসাবে আমরা মুসলিম জন্মহারের প্র্র্রাবল্যকে চিহ্নিত করতে পারি। অর্থাৎ এ ক্ষেত্রে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রধান কারণ হিসাবে ইসলাম থেকে ধর্মান্তরকরণকে গণ্য করতে পারি না।*
----------------------
* বঙ্গে ইসলামীকরণের বিষয়ে আমার আলোচনার জন্য
‘বাঙ্গালী মধ্যবিত্তের উত্থান’
(Link : http://www.bangarashtra.net/article/414.html)
- এর প্রথম অধ্যায় দ্রষ্টব্য।
----------------------
যাইহোক, মূল প্রসঙ্গে ফিরে বলি যত দুর্বলতা কিংবা ত্রুটি থাকুক একটা সমাজের ভাবাদর্শ হিসাবে হিন্দুধর্মের যে শক্তি ছিল সেটা উপমহাদেশে হিন্দু সমাজকে রক্ষা করেছিল। ভাবাদর্শের শক্তি না থাকলে শুধু কৃষির শক্তি দ্বারা হিন্দু সমাজ আত্মরক্ষা করতে পারত না। একটা সমাজের উৎপাদনশীলতা, ইতিহাস-ঐতিহ্য তার আত্মরক্ষার ভিত্তি হিসাবে কাজ করে, তাকে আত্মরক্ষার শক্তি যোগায়। কিন্তু সেটুকুই যথেষ্ট নয়। একটা সমাজের অস্তিত্ব রক্ষার প্রেরণা যোগাবার জন্য, লড়াইয়ের মানসিক শক্তি যোগাবার জন্য একটা ভাবাদর্শও লাগে। নতুবা শুধু বস্তুগত উপকরণ দিয়ে কোনও সমাজ আত্মরক্ষা করতে পারে না। আর সব ভাবাদর্শের মতো ইসলামের ব্যাপারটাও তা-ই।
যদি একটা অন্ধকার সময়ের ধর্ম হিসাবেও একে বিবেচনা করা যায় তবু এটা একটা ভাবাদর্শ বা আদর্শ। যারা এর সুবিধাভোগী অথবা এতে স্বস্তি ও শান্তি কিংবা আশ্রয় খুঁজে পেতে চায় তাদেরকে এই ধর্মই একটা আদর্শ হিসাবে বেঁচে থাকার কিংবা লড়াই করার প্রেরণা যোগায়।
এখন কেউ যদি ইসলামকে মোকাবিলা করতে চায় তবে শুধু অস্ত্র বা অর্থ দিয়ে যে সেটা সম্ভব নয় সেটা বহু দেশের মতো আফগানিস্তানের অভিজ্ঞতা দিয়েও নূতন করে প্রমাণিত হয়েছে। সেখানে যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা দেশগুলি অস্ত্র সজ্জিত হয়ে ট্রিলিয়ন ট্রিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছিল। গণতন্ত্রের নামে নির্বাচনের মাধ্যমে একটা অনুগত বা তাঁবেদার সরকারও প্রতিষ্ঠা করেছিল। কিন্তু কোনও আদর্শনিষ্ঠ নেতৃত্ব গড়তে পারে নাই। কারণ আদর্শ বা ভাবাদর্শ এভাবে গড়া যায় না। এ বিষয় আমাদের বুঝা দরকার যে ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত সেনা প্রত্যাহারের পরও আফগান কম্যুনিস্টরা সকল বিভ্রান্তি ও আত্মঘাতী দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও একক শক্তিবলে সমগ্র পুঁজিবাদী বিশ্বশক্তিকে মোকাবিলা করে প্রায় দুই বৎসর টিকেছিল। অথচ মার্কিন পোষ্য আশরাফ গনীর সরকার দুই দিনও টিকে নাই। প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা শুনেই যে পরিমাণে অর্থ পারা যায় সাথে নিয়ে প্রেসিডেন্ট গনী দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। অর্থাৎ গনী সরকার ও তার অধীনস্থ সেনাবাহিনীর আদর্শের শক্তির দুর্দশাটা কিছুটা হলেও ধারণা করা যায়। সুতরাং বিপুল সমরাস্ত্র সজ্জিত তিন লক্ষ হোক আর সাড়ে তিন লক্ষ হোক সেনা কোনও কাজে লাগে নাই। বুঝা গেল শুধু অস্ত্র এবং অর্থ দিয়ে আদর্শ বা ভাবাদর্শের শক্তি গড়া যায় না।
আসলে ইসলামের শক্তিকে মোকাবিলা করার জন্য যেটার সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন সেটা হচ্ছে ইসলামের বিকল্প আদর্শ, যেটা ধর্ম না হলেও ইসলামের পাল্টা জীবনাচরণের আদর্শ বা বিধিবিধান দিতে পারবে। আজকের যুগে ইসলামকে মোকাবিলা করার বিষয়টা আরও বেশী করে সামনে চলে আসবে। কারণ আফগানিস্তানে ইসলামের অগ্রাভিযানের যে যাত্রা শুরু হয়েছে তা সেখানেই থেমে থাকবে না। ফলে ইসলামকে মোকাবিলা যারা করতে চান কিংবা তার থেকে মুক্তির পথ সন্ধান করতে চান তাদের জন্য আজ ইসলামকে চেনা, জানা ও বুঝার গুরুত্ব অনেক বেশী।
এটা ঠিক যে, ইসলামের একটা পুনরুত্থান ঘটবে। কিন্তু সেটা তার বিরুদ্ধে সমগ্র পৃথিবী থেকেও এক নবতর প্রতিরোধ গড়বে। আমার মনে হয় না আমেরিকা বা ইউরোপের ইসলামকে নিয়ে এতকালের খেলার সাধ আর থাকবে। বিশেষ করে যে পরিমাণ মুসলিম সেখানে প্রবেশ করেছে তারা যদি জিহাদের ইসলামী আদর্শ নিয়ে নবউদ্যমে জাগে, যে সম্ভাবনা যথেষ্ট, তবে ইউরোপ-আমেরিকার বহু বচন ও প্রবচন অতীতের বিষয়ে পরিণত হবে।
অন্যদিকে, বিপদে পড়বে সমগ্র মুসলিম পৃথিবীর রাষ্ট্রগুলির উচ্চবর্গ বা শাসক শ্রেণী, যারা ইসলামের নানান ব্যাখ্যা এবং অপব্যাখ্যা দিয়ে পাশ্চাত্য সভ্যতার সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলে। এরা নিজেদের কখনও মডারেট মুসলিম, কখনও খাঁটি ঈমানদার মুসলিম পরিচয় দিলেও নিজেদের জীবন যাপনের ক্ষেত্রে যতটা সম্ভব পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করে চলতে চায়। আসলে যুগের ধারাকে অস্বীকার করার ক্ষমতা এদের হয় না। তা হলে তারা সমগ্র পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পশ্চাৎপদ জীবনে পতিত হবে। সুতরাং ইসলামে প্রাণীর ছবি বা চিত্র নির্মাণ নিষিদ্ধ হলেও তারা নিজেদের ছবি সংযুক্ত পাসপোর্ট নিয়ে হজ করতে যায়। একটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। আসলে এদের প্রায় সকল কর্ম ও অপকর্মে থাকে বিভিন্নভাবে ইসলামের নাম ব্যবহার। এটা একটা ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু না।
আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয় এবং তালিবান বিজয় এই ভণ্ডামির উপরে একটা বড় ধরনের আঘাত হানবে। ইসলামী জাগরণ সমাজের নীচতলাকে যতই আলোড়িত করুক আধুনিক জীবনের সুযোগ-সুবিধায় অভ্যস্ত উচ্চবর্গ বা এলিট শ্রেণী ইসলাম তথা ধর্মের পশ্চাৎপদতায় যেতে চাইবে না। এর ফলে তাদের এক বৃহৎ অংশ এতদিনের দ্বিচারিতা বা ভণ্ডামির অবসান ঘটিয়ে ইসলামের পাল্টা আদর্শের সন্ধান করবে। নতুবা তাদেরকে ইসলামের আদি যুগে প্রত্যাবর্তনের জন্য প্রস্তুত হতে হবে।
মুসলিম সমাজের একটা বৈশিষ্ট্য আমাদের বুঝতে হবে। সেটা হচ্ছে, যে মুসলিম এলিট বা উচ্চবর্গ মুসলিম সমাজকে নেতৃত্ব দেয় কিংবা নিয়ন্ত্রণ করে তারা কিন্তু মোল্লা নয়। বরং তারা রাজনীতিক, পুঁজিপতি কিংবা ব্যবসায়ী এবং সামরিক-বেসামরিক আমলা ইত্যাদি। পাশ্চাত্যের উপনিবেশিক শাসনকালে পুরাতন মুসলিম উচ্চবর্গের পরিবর্তে এদের আধুনিক সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পুনর্গঠন ঘটেছে। এই উচ্চবর্গ গঠনের একটা গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ হচ্ছে পাশ্চা্ত্য কর্তৃক প্রবর্তিত ধর্মমুক্ত তথা লোকবাদী আধুনিক শিক্ষা।
মোল্লারা এদের বিপরীতে মক্তব-মাদ্রাসা থেকে আরবী এবং ইসলামী শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে তাদের সাধারণত কোনও প্রকার সম্পর্ক থাকে না। ফলে আধুনিক সমাজ ও সভ্যতার সঙ্গে তাদের দূরত্ব দুরতিক্রম্য, কখনও বা অনতিক্রম্য। সমাজে এরাই ইসলামের বার্তাবাহক হিসাবে কাজ করলেও সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ এদের হাতে থাকে না। তবে জনমানসের উপর ধর্মচর্চার মাধ্যমে এদের গভীর প্রভাব থাকে। অথচ সামগ্রিকভাবে এরা সমাজের উচ্চবর্গের অধীনস্থ শ্রেণী হিসাবে ভূমিকা পালন করে। ফলে নামায-রোযাসহ ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন বা চর্চার নেতৃত্ব বা দায়িত্ব এদের হাতে থাকলেও সামাজিক নেতৃত্বে এদের তেমন কোনও ভূমিকা থাকে না। বলা যায় মুসলিম শাসক শ্রেণী কিংবা উচ্চবর্গ এদেরকে ব্যবহারের সামগ্রী হিসাবেই ব্যবহার করে। অনেক সময়ে তারা মোল্লা শ্রেণীকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যও করে। জনগণও এদেরকে সাধারণত সামাজিক কিংবা রাজনৈতিক নেতৃত্বে দেখবার উপযুক্ত মনে করে না। বাংলাদেশসহ সমগ্র উপমহাদেশের অভিজ্ঞতা এই বক্তব্যের সপক্ষে সাক্ষ্য দেয়। অন্যান্য দেশেও আমরা সাধারণত এই বাস্তবতাই প্রত্যক্ষ করি।
তাহলে আফগানিস্তানে কী এমন ঘটল যে, মূলত মোল্লা শ্রেণীর নেতৃত্বে জিহাদ ঘটল এবং তারা ক্ষমতা দখল করল? এই ঘটনা শিক্ষিত এবং নাগরিক সমাজের দুর্বলতার পরিচায়ক। অপরদিকে, কম্যুনিস্ট সরকার কর্তৃক ভূমি সংস্কারসহ কিছু কর্মসূচী দ্বারা সমাজের বিদ্যমান নেতৃত্বকে আঘাত করায় সমাজের প্রচলিত নেতৃত্ব কাঠামোতে যে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছিল সেই শূন্যতা মোল্লারা পূরণ করেছিল বলে অনুমান করি।
অবশ্য তারপরেও মোল্লাদের নেতৃত্বকারী ভূমিকায় আরোহণ বিস্ময় জাগায়। এ ঘটনা আমাদের আফগান শাসক বাদশাহ্ আমানুল্লাহ (শাসনকাল : ১৯১৯-১৯২৯) তার দশ বৎসরের শাসনকালে তুরস্কের নেতা কামাল পাশার দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে সামাজিক যে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন তার ব্যর্থতার কথা মনে করিয়ে দেয়। মোল্লা সমর্থিত বিদ্রোহের পরিণতিতে তিনি সিংহাসন ত্যাগ করে দেশ ছেড়ে ইউরোপে চলে যান। তবে তার যুদ্ধমন্ত্রী মোহাম্মদ নাদির শেষ পর্যন্ত শক্তহাতে বিদ্রোহীদেরকে দমন করে আফগানিস্তানে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।
এই বিদ্রোহের ঘটনায় বাদশাহ আমানুল্লাহ্ কর্তৃক সূচিত আফগান সমাজের আধুনিকায়নের উদ্যোগ একটা ধাক্কা খেলেও সেটা থেমে থাকল না, বরং পরবর্তী সময়ে কিছু ধীর গতিতে হলেও এগিয়ে গেল। বিগত একশত বৎসরে আফগানিস্তান খুব বেশী না হলেও অনেকটা এগেয়েছিল। দেশে কিছু সংখ্যক আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল যেগুলি থেকে আধুনিক ও লোকবাদী শিক্ষা নিয়ে বহুসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী বেরিয়ে এসেছে। শিল্পায়ন তেমন একটা না হলেও নগরায়ন কিছু হয়েছিল। একটা শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী যে গড়ে উঠেছিল সেটা স্পষ্ট। এই শ্রেণী থেকে আসা লোকজনের একটা অংশ দেশের অধিকতর ও দ্রুততর আধুনিকায়ন ঘটাতে চেয়ে মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে বিশ্বাসী হল এবং জন-গণতান্ত্রিক দল নামে পার্টি গঠন করল। এই তরুণ প্রজন্মের অপর একটা অংশ বিপ্লবী চেতনা নিয়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দিল। পিডিপিএ বা আফগানিস্তানের জন-গণতান্ত্রিক দল এদের সাহায্যেই ক্ষমতা দখল করল। তাদেরও পরিণতি হল অনেকটা বাদশাহ আমানুল্লাহর মতো।
এ কথা জানলে অনেকে বিস্মিত হবেন যে, আমানুল্লাহর আধুনিক সংস্কারের উদ্যোগকে ব্রিটিশরাও ব্যর্থ করতে চেয়েছিল। তাদের অধীনে তখন ভারত। এখান থেকে তাদের এজেন্টরা আফগানিস্তানের মোল্লাদেরকে নানানভাবে উস্কানি দিয়েছিল কিংবা সহায়তা যুগিয়েছিল। অর্থাৎ আফগানিস্তানে নিজ শক্তিবলে আধুনিক সভ্যতা গড়ে তোলার পথে পাশ্চাত্য সব সময় বাধা দিয়েছে। যাইহোক, এটা ভিন্ন প্রসঙ্গ। যে কোনও সমাজের স্বাধীন বিকাশ কিংবা উন্নয়নের পথে বাহির থেকে বাধা আসা অস্বাভাবিক নয়। তবে তার সাফল্যের জন্য ভিতরে অনুকূল পরিবেশ থাকতে হয়, নতুবা এ ধরনের বাধা সচরাচর সফল হয় না।
আফগানিস্তানে আধুনিকায়নের পথে বারবার বাধা এল প্রধানত মোল্লা নিয়ন্ত্রিত গ্রামীণ জনগণের কাছ থেকে। প্রথমেই যে মোল্লাদের নেতৃত্ব ছিল তা নয়। বিদ্যমান সামাজিক শক্তি কিংবা নেতৃত্বের সহযোগী হিসাবে তাদের ভূমিকা একটা সময় পর্যন্ত কার্যকর ছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে তারা সামনে এল। কম্যুনিস্ট এবং সোভিয়েত বিরোধী জিহাদে আমরা এই বিন্যাস দেখতে পাই। মুজাহিদীন হিসাবে পরিচিত যেসব নেতার নাম আমরা দেখেছি তারা সাধারণভাবে মাদ্রাসা শিক্ষক বা ছাত্র ছিল না। মাদ্রাসার শিক্ষক-ছাত্রদের নিয়ে গঠিত তালিবান আন্দোলন ছিল ক্ষমতা দখলের পর বিশৃঙ্খল মুজাহিদীন আন্দোলনের নৈরাজ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার ফল। সুতরাং জিহাদী আন্দোলনে পুরাতন মুজাহিদীন নেতৃত্বের ব্যর্থতার ফল হিসাবে তালিবান তথা ম্রাদ্রাসার ছাত্রদের দ্বারা গঠিত নেতৃত্বকে দেখতে হবে। উদ্দেশ্য সবারই এক। সেটা হল ইসলাম তথা শরীয়া বা শরীয়তী ব্যবস্থা কায়েম করা।
ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্ব এবং নেতৃত্বের দৃঢ়তা না থাকায় শরীয়া প্রতিষ্ঠার কার্যক্রমের তুলনায় পুরাতন জিহাদী তথা মুজাহিদরা লুটপাট, ধর্ষণ, হত্যা এবং অপহরণে অধিকতর মনোনিবেশ করেছিল। এই অরাজক অবস্থার সুযোগ নেয় পাকিস্তানের সেনা তথা তার গোয়েন্দা বিভাগ আইএসআই এবং তারা মাদ্রাসা শিক্ষক মোল্লা ওমরের নেতৃত্বে তালিবান জিহাদীদের ক্ষমতা দখলে বিভিন্নভাবে সাহায্য করে।
মোল্লাদের শাসন যে ইসলামী শাসনের মূল রূপ নয় এটা অনেকেই বুঝেন না বা জানেন না। ইসলাম প্রতিষ্ঠার পর প্রকৃতপক্ষে একজনই ছিলেন একই সাথে ইসলামের মোল্লা এবং শাসক। তিনি হলেন ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ। তিনি যা বলে বা দিয়ে গেছেন সেটাই ইসলামের শেষ কথা। এরপর আর কোনও পরিবর্তন ইসলামের বিশ্বাস অনুযায়ী ঘটানো যাবে না। মোল্লাদের কাজ হল তার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত বিধান প্রচার করা। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষমতা তাদের হাতে নয়। সেটা শাসক তথা রাজনীতিকদের হাতে। ইসলামী পৃথিবীতে পাশ্চাত্য আধিপত্য প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত ইসলামের ঐতিহ্য অনুযায়ী রাষ্ট্র-ক্ষমতার অধিকারী সামরিক একনায়করা হত শাসক।
মুহাম্মদের মৃত্যুর পর থেকে ক্রমে শাসক এবং মোল্লার মধ্যে ক্ষমতা ও দায়িত্বের বিভাজন বৃদ্ধি পায়। ধর্মচর্চার নির্দিষ্ট দায়িত্ব গেল মোল্লাদের হাতে, কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার কাজ গেল রাষ্ট্র-শাসকদের হাতে। এ কাজে মোল্লাদের ভূমিকা হল সহায়কের। তার বেশী না। ধর্মচর্চায় যে সময় এবং মনোযোগ দরকার হয় সেটা দিতে গিয়ে মোল্লাদের পক্ষে আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ডে সেভাবে শ্রম বা সময় কোনটাই দেওয়া সম্ভব হয় না। এভাবে জনমতে প্রভাব রাখলেও সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা না থাকায় সামাজিক ক্ষেত্রে তাদের নেতৃত্বকারী ভূমিকা সেই অর্থে থাকল না। এ ক্ষেত্রে বরং তাদের ভূমিকা ধর্মচর্চার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করা এবং ধর্মীয় বিষয়াদির ব্যাখ্যা ছাড়া আর বেশী কিছু না। এই কারণে আমরা মুসলিম সমাজে সাধারণত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, ভূস্বামী, সামরিক কর্মকর্তা ইত্যাদিকে নেতৃত্ব বা ক্ষমতায় দেখতে পাই।
অর্থাৎ এ দিক থেকে দেখলে বলতে হবে মুসলিম সমাজের সনাতন নেতৃত্ব ও কর্তৃ্ত্বের বিন্যাসকে আফগান জিহাদ অনেকটা বদলে দিয়েছে। যেভাবে দেখা যাক, এটা সমাজের চরম পশ্চাৎপদ অংশ হিসাবে মোল্লা শ্রেণী এবং তাদের ধর্মীয় অনুসারী হিসাবে হতদরিদ্র ও পশ্চাৎপদ গ্রামীণ জনসাধারণ কর্তৃক সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল হয়ে দেখা দিয়েছে।
ইসলামিক স্টেট বা আইএস-এর নেতৃত্বে ইরাক-সিরিয়ায়ও ইসলামের আদিরূপ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। কিন্তু সেখানে মোল্লাদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকলেও নেতৃত্ব এককভাবে তাদের হাতে ছিল না। আইএস-এর নেতৃ্ত্ব কাঠামোতে সাবেক সেনা সদস্যসহ সমাজের বিভিন্ন শ্রেণীর প্রতিনিধিত্ব ঘটেছিল। বিশেষ করে মার্কিন আগ্রাসনে বিধ্বস্ত ইরাকের সাবেক সেনাসদস্যদের এক বড় অংশ ছিল আইএসের সঙ্গে।
অর্থাৎ আফগানিস্তানে জিহাদের বিজয়ের তাৎপর্য ভিন্ন। বিশেষত আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রভাবে সাবেক উপনিবেশগুলির মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবর্গের ভিতরে ইসলাম নিয়ে যে ধরনের বিভ্রান্তিমূলক আচরণ দেখা যায় তা থেকে মোল্লা শ্রেণীর অবস্থান থাকে অনেক দূরে। তারা জানে আসল ইসলাম কী। ইসলামের যুগোপযোগী ব্যাখ্যা অথবা সংস্কার সাধনের চেষ্টা তারা করে না। কারণ তারা জানে তাহলে ইসলামই থাকে না। তারা অবস্থার চাপে, বিশেষত রাষ্ট্র-শাসকদের চাপে এবং ভয়েও বহুকিছু মেনে নেয়, ইসলামের নমনীয় ব্যাখ্যায়ও কখনও সম্মতি জানায়। কিন্তু উচ্চবর্গ কিংবা মধ্যবিত্তের বিপরীতে তারা সব সময়ে স্বপ্ন দেখে ইসলামের আদিপর্বে প্রত্যাবর্তনের। কারণ সেখানেই যে তাদের বিচারে প্রকৃত শান্তি আছে শুধু তা-ই নয়, অধিকন্তু সেটাই তাদের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী আল্লাহ্ কর্তৃক নির্ধারিত পরিণতি। তারা আপোস যেটুকু করে সেটুকু করে ইসলামী ‘তাকিয়া’ হিসাবে। তারা জানে এ সবই জিহাদের ভিতরকার সাময়িক পশ্চাদপসরণ স্বরূপ; এবং যুদ্ধ শেষে ইসলাম তার আদিরূপে প্রতিষ্ঠিত হবেই।
যাইহোক, পাশ্চাত্য বিজয় এবং পরাধীনতার কালে মুসলিম উচ্চবর্গ নূতন বিশ্বপরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চ’লে নিজেদের সুখ-সুবিধা রক্ষার পথ নিলেও সেটা যে অন্যায় অথবা বড় জোর সাময়িক পশ্চাদপসরণ মাত্র এই বোধ যেমন মোল্লা শ্রেণীর মধ্যে সদাজাগ্রত থাকে তেমন মসজিদে নিয়মিত ধর্মচর্চা এবং বিভিন্ন স্থানে ধর্মপ্রচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তারা এই বোধকে অব্যাহতভাবে সমাজেও জীবিত রাখে।
এই রকম এক অবস্থায় আফগানিস্তানে ইসলাম রক্ষা ও প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব উচ্চবর্গের বিভিন্ন গোষ্ঠীর হাত থেকে মোল্লা শ্রেণী নিজেদের হাতে নিয়েছে। এভাবেও বলা যায় যে, সাধারণ মুসলিম জনগণ বিশেষত দরিদ্র, অশিক্ষিত ও পশ্চাৎপদ গ্রামীণ জনগণ তাদেরকেই এই দায়িত্ব দিয়েছে।
ইসলাম চর্চার সার্বক্ষণিক দায়িত্ব যারা পালন করে তাদের হাতে এবার একটি মুসলিম সমাজ এবং সেই সঙ্গে তার রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এবং নেতৃত্ব গেল। ইসলামের তাকিয়া তারাও অনুসরণ করবে। যুদ্ধের স্বাভাবিক নিয়মে তারাও আগাবে এবং পিছাবেও। কিন্তু আধুনিক যুগের চৌহদ্দির মধ্যে বাস করার বাধ্যবাধকতা অনুভব ক’রে পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত মুসলিম শ্রেণীগুলি যেভাবে আপোসমুখী হয়ে চলে সেটা হওয়া তাদের পক্ষে তেমন একটা সম্ভব হবে না।
একদিকে, এত বড় বিজয়ের একটা প্রভাবকে বুঝতে হবে। এই ঘটনা ইসলামের বিজয় যে আল্লাহ কর্তৃক নির্ধারিত হয়ে আছে মুসলিমদের সেই বিশ্বাসকে আরও দৃঢ়বদ্ধ করবে। এবং পৃথিবীর সকল ‘কাফের’ শক্তির পরাজয় এবং ধ্বংস যে শুরু হয়েছে এই বোধ এখন শুধু আফগানিস্তানের নয়, উপরন্তু সারা দুনিয়ার মুসলিমদের এক বিরাট অংশের মধ্যে বিস্তৃত এবং দৃঢ়বদ্ধ হবে। বিশেষত সমাজের নীচতলা এবং দরিদ্র শ্রেণীগুলির মধ্যে এই বোধের বিস্তার এখন স্বাভাবিক। আর এ কথাও তো সত্য যে, মুসলিম জনগোষ্ঠী পৃথিবীতে সাধারণভাবে সবচেয়ে পশ্চাৎপদ, অশিক্ষিত এবং দরিদ্র। এদের ভাগ্যবাদী এবং হিংস্র ধর্মই যে এর জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী সে কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এই পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা এবং দারিদ্র্য আবার ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করে। এভাবে সমাজের ক্ষেত্রে এটা একটা অশুভ চক্র সৃষ্টি করে রেখেছে। চক্রটা এমন — ইসলাম → পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা এবং দারিদ্র্য → ইসলাম → পশ্চাৎপদতা, অশিক্ষা এবং দারিদ্র্য → ইসলাম।
সভ্য পৃথিবীর প্রভাবে এবং প্রয়োজনেও মুসলিম সমাজগুলি খুব ধীর গতিতে হলেও উন্নয়নের পথ ধরে কিছু করে অগ্রসর হচ্ছে। যদিও যুগের গতির তুলনায় এই গতি কিছুই নয়। শুধু তা-ই নয়, এই অবস্থা তাদের জন্য অনেক ক্ষেত্রে পরাধীনতার সমার্থক হয়ে দেখা দিচ্ছে। কারণ স্বচ্ছন্দ গতিতে অগ্রসর হতে না পারায় তারা বরং ভিন্ন সমাজ বা রাষ্ট্রের লুণ্ঠন কিংবা শোষণের সহজ শিকার হয়ে থাকছে। তারা বিশ্বব্যবস্থার বাইরে যেতে পারছে না, অথচ এই ব্যবস্থায় থাকবার কারণে তাদেরকে উন্নত দেশগুলির সঙ্গে অসম সম্পর্কের অধীনে থাকবার সব রকম মূল্যই দিতে হচ্ছে। মুসলিম সমাজগুলির অবস্থা যেন এমন যে, তাদের পায়ের সঙ্গে শিকল দিয়ে বাঁধা আছে এমন এক ভারী পাথর যা নিয়ে তারা প্রতিযোগিতার পৃথিবীতে দৌড় প্রতিযোগিতা করতে বাধ্য হচ্ছে। এই পাথর তাদের স্বচ্ছন্দ ও স্বাধীন ভাবে চলার প্রতিবন্ধক হয়ে তাদেরকে পৃথিবীর অগ্রযাত্রায় পিছিয়ে রাখছে, অন্যদের স্বেচ্ছাচার এবং খেলার সামগ্রী করে রাখছে। এই ভারী পাথর হল তাদের ধর্ম ইসলাম, যা তাদের চলার গতিকে অবিরাম বাধাগ্রস্ত করে রেখেছে।
সুতরাং ইসলাম থেকে মুক্তির জন্য আজকের সবচেয়ে বড় প্রয়োজন ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝার চেষ্টা করা। আফগানিস্তানে সর্বশেষ মার্কিন পরাজয় এই প্রয়োজনকে এখন সবার সামনে নিয়ে এসেছে। মোল্লাদের মতো অন্ধ অনুশীলনের পরিবর্তে জিজ্ঞাসু এবং সজীব মন নিয়ে কুরআন, হাদীসসহ মৌল ইসলামী গ্রন্থসমূহ এবং ইসলামের ইতিহাসের গভীর ও ব্যাপক অধ্যয়ন আজকের সময়ের দাবী। তা থেকে মুক্তির প্রশ্ন তো তার পরেকার কথা! ইসলামকে না বুঝলে, তার সমস্যা কোথায় কীভাবে তা না বুঝলে তা থেকে মুক্তির পথ সন্ধান হবে কী করে?
(৬) নূতন কালের বিপ্লব
আফগানিস্তানে মার্কিন পরাজয় ইসলাম থেকে মুক্তির আন্দোলন সংগঠনের জন্য মুসলিম পৃথিবীর সামনে এক অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। কারণ এক দীর্ঘ সময় ইসলামকে সব রকমভাবে বেঁচে থাকবার রসদ যুগিয়েছিল পাশ্চাত্য এবং বিশেষত তার নেতা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। সেই কাজ তারা যে আর অন্তত পূর্বের মতো করে করতে পারবে না সে কথা বলা যায়।
সুতরাং সবদিক থেকেই এখন মুসলিম পৃথিবীতে নূতন বিপ্লবের কাল আসন্ন। এই বিপ্লব ইউরোপের গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব থেকে শিক্ষা নিলেও কোনওটারই অন্ধ অনুশীলন করবে না। বিশেষ করে মার্কসবাদী আদর্শের ব্যাখ্যা অনুযায়ী অর্থনীতিকে একটা সমাজের প্রধান নির্ণায়ক মনে করে তার ভাবগত বা আদর্শিক উপাদানকে গৌণ এমনকি অগ্রাহ্য করার মানসিকতা থেকে তা মুক্ত হবে। সবচেয়ে বড় কথা ইসলামী সমাজের মতো ভয়ঙ্কর পশ্চাৎপদ ও বর্বর সমাজের গড় চেতনাকে হিসাবে না নিয়ে নীচতলার শ্রমজীবী জনতা কিংবা শ্রমিক শ্রেণী সমাজ বিপ্লব বা পরিবর্তনের মূল বা প্রধান শক্তি এই ভ্রান্ত ধারণার বশবর্তী হয়ে আত্মঘাতী পথে তা যাবে না। বস্তুত মুসলিম সমাজের যাবতীয় পশ্চাৎপদতার প্রধান উৎসই হচ্ছে নীচতলার ধর্মভীরু ও ভাগ্যবাদী শ্রমজীবী জনগণ। এই জনগণকে ধর্ম এবং ভাগ্যবাদ থেকে মুক্ত করার কাজটা্ই আসল কাজ। সেটা বাদ দিয়ে শুধু অর্থনীতির লড়াইয়ে নামিয়ে তাদেরকে বিপ্লবের শক্তিতে পরিণত করার চিন্তাটাই ভ্রান্ত। আসলে ইউরোপের অভিজ্ঞতা কিংবা প্রাচ্যের বৌদ্ধ সমাজগুলির বিপ্লব ও আধুনিকায়নের অভিজ্ঞতা দিয়ে আমাদের সমাজের বাস্তবতাকে ধারণা করতে চাওয়ায় এই ভ্রান্তি।
বস্তুত মুসলিম সমাজে পরিবর্তন অথবা বিপ্লবের মূল শক্তির অবস্থান বিশেষত আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্য শ্রেণীর মধ্যে। তাকে কীভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রচলিত ব্যবস্থা বা কাঠামো থেকে মুক্ত করে বিপ্লবী পরিবর্তনের শক্তিতে পরিণত করা যাবে সেটা হওয়া উচিত যারা সমাজ পরিবর্তন চান তাদের চিন্তার বিষয়।*
-----------------------
* সমাজ পরিবর্তন এবং বিপ্লবের সমস্যা নিয়ে আমি বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধে আলোচনা করেছি। যেমন,
মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ
(Link: http://www.bangarashtra.net/article/395.html )
মার্কসবাদ ও বিপ্লব বিতর্ক : ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ প্রসঙ্গে ডঃ লেনিন আজাদ ও শামসুজ্জোহা মানিকের পত্রালাপ
(Link: http://www.bangarashtra.net/article/413.html )
ধর্ম ও শ্রেণীতত্ত্বের যাঁতাকলে বাঙ্গালী জাতি
(Link: http://www.bangarashtra.net/article/398.html )
শ্রেণীতত্ত্ব ও বিপ্লব
(Link: http://www.bangarashtra.net/article/409.html )
ইত্যাদি
-----------------------
পাশ্চাত্য যতই বেজার হোক ইসলামী সমাজের আধুনিক, সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজে রূপান্তরের একটি পূর্বশর্ত হল অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত ব্যক্তিমালিকানার পরিবর্তে রাষ্ট্রীয় মালিকানার প্রতি অগ্রাধিকার দান। অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির একটা ব্যবস্থা অনুসরণের বিষয় এটা। এ ছাড়া আমরা যদি প্রথমেই ব্যক্তিমালিকানায় অর্থনীতি গড়ার পথ অনুসরণ করতে যাই তবে স্বাধীনতা পরবর্তী কাল থেকে বাংলাদেশে যেভাবে একটি দুর্বৃত্তায়িত অর্থনীতি, রাজনীতি ও সমাজ গড়ে উঠেছে সেই অবস্থাই অব্যাহত থাকবে। অবশ্য পাকিস্তান কালে গণতন্ত্রের নামে ব্যক্তিপুঁজির পথের অনুসারী আওয়ামী লীগের দুর্বৃত্তায়নের পথ অনুসরণ করা ছিল স্বাভাবিক। ইউরোপের সৎ, নীতি ও নিয়ম নিষ্ঠ ব্যক্তির পরিবর্তে ভিন্ন চরিত্রের ব্যক্তিকে যদি পুঁজি ও রাষ্ট্র গঠনের দায়িত্ব দেওয়া যায় তাহলে যা হবার তা-ই হয়েছে এ দেশে। ক্ষমতা হাতে পেয়েই আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা উন্মত্ত লুঠতরাজে নেমে পড়ল। শেখ মুজিব বললেন, ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি।’
আমাদের মতো ধর্মের কাঠামোবদ্ধ সমাজ এবং উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রে পুঁজিবাদী গণতন্ত্রের পথ অনুসরণকারী নেতার পক্ষে এমন চোরের খনি পাওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং সেটাই তিনি পেয়েছিলেন। শেষ কালে তার সম্বিত ফিরল। ভুল সময়ে এবং ভুল পদ্ধতিতে হলেও তিনি পথ পরিবর্তন করে সমাজতন্ত্রে যেতে চাইলেন। ততদিনে রাষ্ট্র এবং সমাজের সর্বত্র দুর্নীতি ও লুণ্ঠনের মাধ্যমে একটা লুম্পেন ও দুর্বৃত্ত উদীয়মান ধনিক শ্রেণী দাঁড়িয়ে গেছে। তিনি পথ পরিবর্তন করতে চাইলেও তারা তা করতে দিবে কেন? মূলত তারাই তাকে মারল। রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী হয়ে তার উত্তরসূরিরা গণতন্ত্রের নামে কিংবা বাজার অর্থনীতি এবং উন্নয়নের নামে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর প্রথম তিন বছর যে পথে তিনি সবাইকে চলতে দিয়েছিলেন সেই পথ ধরেই দেশকে আজ এখানে নিয়ে এসেছে।
আমাদের নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই আমরা দেখেছি গণতন্ত্রের নামে পুঁজিবাদের পথ কীভাবে একটা সমাজ কিংবা দেশের অধঃপাত ঘটায়। এক অর্থে দোষটা গণতন্ত্র বা ব্যক্তিপুঁজির নয়। বিশেষ করে ব্যক্তিপুঁজি সম্পর্কে বলতে হয় প্রথমে সীমিত আকারে পুঁজির প্রয়োজন থাকলেও যথেষ্ট সতর্কতার প্রয়োজন হয় আমাদের সমাজের মতো সমাজগুলিতে। একদিকে, সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বের সঙ্গে অধীনতামূলক সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ লুম্পেন ও দুর্বৃত্ত পুঁজির কবল থেকে দেশী পুঁজিকে মুক্ত করার জন্য, এবং অপর দিকে, ক্ষমতাসীনদেরকে সম্পত্তি সংগ্রহের অভ্যাস থেকে মুক্ত রাখার জন্য একটা পর্যায় পর্যন্ত সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের আদর্শ এবং কর্মপন্থার প্রয়োজন এখানে খুব বেশী। আমাদের সমাজের মতো একটা পশ্চাৎপদ সমাজের আধুনিক সমাজে উত্তরণের জন্য এটা একটা পর্যায়, যেটা পরিস্থিতি অনুযায়ী স্বল্পকাল স্থায়ী অথবা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে।
একই সঙ্গে এই প্রাথমিক পর্যায়ের জন্য বহুদলীয় গণতন্ত্রও ক্ষতিকর হতে পারে। বস্তুত জনগণ গণতন্ত্রের উপযোগী না হলে সেখানে কখনই বহুদলীয় গণতন্ত্র টিকসই হতে পারে না। শুধু তা-ই নয়, এটা গণতন্ত্র অভিমুখে সমাজের যাত্রার জন্যও ক্ষতিকর হতে পারে।
মুসলিম সমাজে গণতন্ত্রের চর্চা বাস্তবতা বর্জিত কল্পনা মাত্র। পশ্চাৎপদ, একনায়কী এবং স্বৈরতন্ত্রী সংস্কৃতি ও আদর্শের অব্যাহত চর্চা প্রকৃত গণতন্ত্রের কোনও জায়গাই রাখে না এখানে। নিয়মিত সময়ের ব্যবধানে নির্বাচন পাশ্চাত্যকে তুষ্ট করতে পারে। কিন্তু প্রকৃত গণতন্ত্রের পরিবর্তে দেশগুলি নৈরাজ্য, দুর্নীতি এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার দিকে যাত্রা করে; পরিণতিতে গণতন্ত্রের ভড়ংও এক সময়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। মনে হয় এর জন্য পাকিস্তান বা মধ্যপ্রাচ্যের দৃষ্টান্তের প্রয়োজন নাই, বাংলাদেশের দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। এই রকম সমাজের গণতন্ত্রায়নের প্রকৃত উপায় হচ্ছে এমন একটা দলের শাসন প্রতিষ্ঠা করা যার অভ্যন্তরে থাকবে গণতন্ত্র। অর্থাৎ এটা হবে একদলীয় গণতন্ত্র।*
-------------------------------------------
* বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সমস্যা এবং পথ সম্পর্কে আমি বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করেছি। সংক্ষিপ্ত পাঠের জন্য উল্লেখযোগ্য হতে পারে :
বাংলাদেশে গণতন্ত্রের সমস্যা
(Link : http://www.bangarashtra.net/article/403.html )
-----------------------
বস্তুত যে কোনও ব্যবস্থা বা ‘সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বড় শর্ত তার উপযোগী মানুষ তৈরী করা। কারণ ব্যবস্থা বা সিস্টেমকে রক্ষা বা পরিচালনা করে মানুষ। এখন ব্যবস্থার উপযোগী মানুষ তৈরীর কাজ বাদ দিয়ে শুধু উপর বা বাহির থেকে ব্যবস্থা চাপিয়ে দিলে সেই ব্যবস্থা টিকবে কেন? বাংলাদেশের দিকে তাকালে মানুষ তৈরীর গুরুত্বটা বুঝবার কথা। আর এই মানুষ তৈরীর জন্য তার উপযোগী আদর্শ তৈরীর প্রশ্নটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এটা ঠিক যে, আদর্শ বিমূর্তভাবে তৈরী হতে পারে না। তার জন্য প্রাথমিক ধারণাও যথেষ্ট নয়। বরং প্রয়োজন সেই ধারণা প্রয়োগের জন্য সংগ্রামের অভিজ্ঞতার। বিশেষ করে নূতন সামাজিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রামের গুরুত্ব অপরিমেয়। নূতন মানুষ তৈরী হয় এই সংগ্রামের আগুনে পোড় খেয়ে।
মুসলিম বিশ্বে এতকাল একটা খুব বড় সমস্যা ছিল যতই অমানবিক এবং বর্বর হোক ইসলামের কোনও ধরনের সমালোচনা করার অবস্থা সমাজের ভিতরে না থাকা। ইসলামের চরিত্র এবং ভূমিকা নিয়ে যে কোনও প্রশ্ন কিংবা সমালোচনামূলক বক্তব্য অথবা বিশ্লেষণ এখানে মৃত্যু অথবা নির্যাতন ডেকে আনতে পারে। শুধু যে জিহাদী ব্যক্তির দিক থেকে আঘাত আসতে পারে তা-ই নয়, রাষ্ট্রও এ ক্ষেত্রে জিহাদীর ভূমিকা নিতে পারে। পাকিস্তানের মতো ব্ল্যাসফেমী আইন না থাকলেও বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগে দীর্ঘ মেয়াদী কারাদণ্ডের বিধান রাখা আছে।
এই অবস্থায় মুসলিম সমাজে সামাজিক সঙ্কটের মূল কারণ সন্ধানের কাজ যেমন বন্ধ থাকে তেমন বিকল্প পথ বা আদর্শ সন্ধানের পথও বন্ধ থাকে। ফলে সমাজ গতিশীল এবং উদ্ভাবনশীল বা সৃজনশীল না হয়ে হয় স্থবির এবং বন্ধ্যা। এর সুযোগ নেয় উন্নত অ-মুসলিম বিশ্ব, বিশেষত পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ।
তবে ইন্টারনেটের ব্যবহার এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছে। কারণ মুসলিম সমাজ বা রাষ্ট্রের ভিতর থেকে সমালোচনা করা না গেলেও অ-মুসলিম দেশ বিশেষত পাশ্চাত্য দেশগুলির গনতান্ত্রিক পরিবেশকে ব্যবহার করে ইন্টারনেটের সাহায্যে ইসলাম সম্পর্কে যে কোনও নির্মোহ আলোচনা বা সমালোচনা বেশ কিছুদিন ধরেই মুসলিম সমাজেরও ভাবজগতে পরিবর্তন ঘটাতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরে জিহাদী শক্তি কর্তৃক টুইন টাওয়ার ধ্বসের পর থেকে পাশ্চাত্যও এ ধরনের প্রচারকে অনুমোদন দিচ্ছে।
বস্তুত বিগত দেড় হাজার বছরেও যে বিপদে ইসলাম কখনই পড়ে নাই সেই বিপদ তার জন্য নিয়ে এসেছে ইন্টারনেট। ইসলামের সত্যকে এতকাল যেভাবে মিথ্যা দিয়ে ঢেকে রাখা যেত ইন্টারনেট প্রযু্ক্তির ব্যবহার সেটাকে অসম্ভব করেছে। ইসলামের ভিতরের লুকিয়ে রাখা সত্য যেগুলি এতকাল বলা বা শুনা যেত না সেগুলি আর গোপন থাকছে না। ফলে ইসলামের ভিতরে আবদ্ধ মানুষরাও এখন সেসব জানতে শুরু করেছে।
এতকাল ইসলাম মোকাবিলা করেছে বাইরের শত্রুকে। কিন্তু তার ভিতরের সমাজ নিয়ে তা ছিল অনেকটা নিশ্চিন্ত। কিন্তু বিশেষ করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইসলামের সত্যের অব্যাহত প্রচার তার অধীনস্থ সমাজ-মানসকে নাড়া দিতে শুরু করেছে। যে সত্য বলা এতকাল অসম্ভব এবং নিষিদ্ধ ছিল সেটাকে কোনও জিহাদী রাষ্ট্রশক্তি কিংবা জিহাদী সামাজিক শক্তি দিয়ে বন্ধ করা অসম্ভব। স্বাভাবিকভাবে ইসলামী পৃথিবীতেও নূতন চিন্তার ঢেউ কিছু করে ধাক্কা দিতে শুরু করেছে। একদা যেমন ঘটেছিল বিজয়ী পাশ্চাত্য শক্তির হাতে পরাজয়ের ফলে ইসলামী সমাজের অচলায়তনে ভাঙ্গন জনিত কিছু করে পরিবর্তন — ঘটনাটা আর ঠিক সেই পর্যায়ে সীমিত থাকছে না। ভিতর থেকেও স্বাধীনভাবে ইসলাম থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা বাঙ্ময় হতে শুরু করেছে। এই ঘটনা ভিতর থেকেই সামাজিক পরিবর্তনের গতিধারাকে বেগবান করতে চলেছে।
এই পরিবর্তনের গতিধারার মাঝখানে আফগানিস্তানে সম্প্রতি ঘটল যেন বিপরীতমুখী ঘটনা — পাশ্চাত্যের উপর ইসলাম তথা জিহাদী শক্তির বিজয়। এটা ঠিক যে, এই বিজয় ইসলামের বিলুপ্তি অভিমুখী ভবিষ্যৎ গতিধারায় পরিবর্তন ঘটাতে পারবে এ কথা মনে করার কোনও কারণ নাই। কিন্তু এই বিজয়ের ফল কিছু ক্ষেত্রে সাময়িকভাবে ইসলামী উত্থানের পক্ষে যাবে। তবে সেটা বরং ইসলামের অবসানকে যে ত্বরান্বিত করবে সে কথা মনে করার কারণ আছে।
এই বিজয়ের ফলে একদিকে মুসলিমদের মধ্য থেকে একটা বৃহৎ অংশ আদি ইসলাম প্রতিষ্ঠার নূতন প্রেরণায় জেগে উঠলেও তার বিপরীতে মুসলিম পৃথিবী থেকেই জাগবে ইসলাম থেকে মুক্তির নব শক্তি। কারণ একদিকে আফগানিস্তানে জিহাদের বিজয়-পরবর্তী সময়ে ইসলামের আদি অধ্যায়ের দিকে তথা সভ্যতার পশ্চাৎমুখী যাত্রায় যেমন মুসলিম বিশ্বের বিশেষত নীচতলার মুসলিমদের এক বৃহৎ অংশ যোগ দিবে তেমন মুসলিম পৃথিবীর উচ্চবর্গের এক বৃহৎ অংশ সমূহ-বিপদ দেখে তার হাত থেকে বাঁচতে চেয়ে ইসলামের বিকল্প আদর্শ খুঁজবে। অর্থাৎ মুসলিম উচ্চবর্গের বৃহৎ অংশ জনগণের ভয়ে হোক আর জনগণের ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যে হোক ইসলাম নিয়ে এতদিনকার মতো খেলার পরিবর্তে এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজতে বাধ্য হবে। অনুমান করি পাশ্চাত্যও ইসলামের নব উত্থানের রূপ দেখে আতঙ্কিত হয়ে ইসলাম থেকে মুক্তির শক্তির সহায়ক না হলেও এই শক্তির বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা না নিতে পারে। ইসলাম থেকে মানবতার মুক্তির জন্য এইটুকুই যথেষ্ট হবে যদি চীন বা রাশিয়া পাশ্চাত্যকে জব্দ করতে চেয়ে পাশ্চাত্যের অনুসরণে ইসলামী উত্থানের সপক্ষে কোমর বেঁধে নেমে না পড়ে।
অবশ্য তেমন সম্ভাবনা কিছু থাকলেও সেটা প্রবল মাত্রার কিছু হবে বলে মনে হয় না। কারণ এই ইসলাম অ-মুসলিম কাউকেই তেমন একটা ছাড় দিয়ে চলতে পারবে বলে মনে হয় না। ইসলামের মতো পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শের কাঠামোতে আবদ্ধ চেতনা তার প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং পশ্চাৎপদতার কারণেই আধুনিকতার শক্তিগুলির মোকাবিলায় দাঁড়াতে সক্ষম হবে না। আফগানিস্তানের মতো কিছু এলাকায় কিছু সময়ের জন্য সফল হলেও আজকের যুগে পরাজয়্ এবং বিলুপ্তি হচ্ছে তার নিয়তি।
এ প্রসঙ্গে সবশেষে বলি, ইসলাম বলে কথা নয়, কোনও বর্বরতাপূর্ণ ব্যবস্থাই যা প্রতিষ্ঠিত হয় যুদ্ধের মাধ্যমে তাকে অপসারণের জন্য শেষ পর্যন্ত যুদ্ধই হয় পথ। যুদ্ধ দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনও ব্যবস্থাকে যারা শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিস্থাপিত করতে চান তারা ভুল করেন। এ ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ কোনও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠারও চূড়ান্ত পথ হচ্ছে যুদ্ধ। এই যুদ্ধ যেখান থেকে যে-ই পরিচালনা করুক শান্তির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা তাকেই বলতে হবে। ভিতর থেকে যদি এই যুদ্ধ করতে হয় তবে তার নাম হল বিপ্লব। এখন প্রশ্ন হতে পারে ইসলামকে প্রতিস্থাপিত করার শক্তি আসবে কোথা থেকে — ভিতর থেকে, নাকি বাহির থেকে? বাইরের শক্তির ভূমিকা থাকলেও অনুমান করি বস্তুর বিকাশের নিয়ম অনুযায়ী শেষ পর্যন্ত এই শক্তি আসবে ভিতর থেকে। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে এটা হবে একটা বিপ্লব। ইসলামের বিশ্বজনীন রূপকে মোকাবিলা করতে গিয়ে হবে নূতন ধরনের বিশ্ববিপ্লব।
১৮ আগস্ট – ২৮ আগস্ট, ২০২১