লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ December 9, 2021, 12:00 AM, Hits: 940
(১)
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর তারিখে রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ইতরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পথে বাংলাদেশের যে যাত্রা শুরু হয়েছিল তা যে এখন মোটামুটি পূর্ণতা অর্জন করেছে তার প্রমাণ হচ্ছে অতীব কলঙ্কিত ও কদর্য চরিত্রের অধিকারী মুরাদ হাসান নামক এক ব্যক্তির প্রতিমন্ত্রীর পদে নিয়োগ এবং সেই পদে এতদিন তার অধিষ্ঠান। বিএনপি প্রধান খালেদা জিয়া এবং বিশেষ করে তার নাতনি জায়মা রহমান সম্পর্কে অবিশ্বা্স্য রকমভাবে নোংরা ও ইতর উচ্চারণের পরেও তাকে বহাল তবিয়তে স্বপদে বহাল রাখা হয়েছিল। তবে নায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে ফোনের সংলাপে উচ্চারণের অযোগ্য তার অশ্রাব্য কথা এবং ডিজিডিএফআইসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সংস্থাকে দিয়ে তাকে তুলে এনে ধর্ষণের হুমকি সম্বলিত তার ফোনালাপ প্রকাশ হবার পর তাকে আর স্বপদে রাখার অবস্থা প্রধান মন্ত্রীর ছিল না। এটা তাৎপর্যপূর্ণ যে, দুই বৎসর আগের ফোনালাপ এতদিন পর ফাঁস হল কানাডা থেকে প্রচারিত একটি বাংলা ইউটিউব চ্যানেল ‘নাগরিক টিভি’ থেকে। কারও কারও অনুমান যে, রাষ্ট্রীয় সংস্থার যারা ফোন ট্যাপ করে তারাই এতদিনে এসে ফোনালাপ ফাঁস করার জন্য নাগরিক টিভির নিকট অডিওটা পৌঁছে দিয়েছে। যদি তা হয়ে থাকে তবে এ্টাকে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলতে হবে।
তবে ফোনালাপটি রাষ্ট্রের ভিতরের এক ভয়ঙ্কর অবস্থার চিত্র আমাদের সামনে প্রকাশ করেছে। এটা শুধু ক্ষমতার অপব্যবহারের এক ভয়ঙ্কর প্রকাশ নয়, উপরন্তু নারী প্রধানমন্ত্রী শাসিত রাষ্ট্রে নারীর অবিশ্বাস্য রকম দুর্গত ও অসহায় অবস্থাকে প্রকাশ করছে। অর্থাৎ চাইলে এ দেশে শুধু পুরুষকে তুলে নেওয়া নয়, যে কোনও নারীকেও পছন্দ হলে রাষ্ট্রীয় বাহিনী ব্যবহার করে তুলে আনার হুমকি দেওয়া যায়। এখন এ দেশে এই হুমকি কীভাবে এবং কতটা বাস্তবায়িত হয় বা হতে পারে সেটাকে এখন কল্পনার উপর ছেড়ে দেওয়া যাক।
বিভিন্ন সময়ে ক্ষমতাসীনদের কার্যকলাপ দ্বারা সমাজ ও রাষ্ট্রের সার্বিক অধঃপতনকে বুঝাবার জন্য এখন এদেশে একটা শব্দ বহুল পরিচিত এবং বহুল ব্যবহৃত। সেটা হচ্ছে দুর্বৃত্তায়ন। বস্তুত বিগত পঞ্চাশ বছরে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্র দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ফলত দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে। এই অবস্থায় ন্যায়-নীতি বর্জিত এবং দুর্নীতিগ্রস্ত লোকরাই যে প্রাধান্যে এসে সমাজ ও রাষ্ট্রকে অধিকার করবে সেটাই স্বাভাবিক। এমন একটা অবস্থাকে বুঝাবার জন্য দুর্বৃত্তায়ন শব্দটার ব্যবহার। এবং সেটা অনেক কাল ধরে।
তবে আমার মনে হয়েছে শুধু দুর্বৃত্তায়ন শব্দ দ্বারা বাংলাদেশের সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতির বাস্তবতাকে বুঝানো যায় না। যারা ক্ষমতা কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করছে তারা সাধারণভাবে নিজেরা দুর্বত্ত অথবা নিজেদের ক্ষমতা রক্ষার স্বার্থে দুর্বৃত্তায়নের পৃষ্ঠপোষক। কিন্তু শুধু এই দুর্বৃত্ত শব্দটি এই দুর্বৃত্ত ক্ষমতাধারীদের স্বরূপ তুলে ধরার জন্য যথেষ্ট্ নয়। এদের জন্য আর একটা শব্দ একই সঙ্গে প্রযোজ্য, সেটা হল ইতর। বস্তুত এমন একদল লোক বিগত পঞ্চাশ বছরে ক্ষমতা দখল করে বসে আছে যারা, তারা যে যেখান থেকেই আসুক না, সবাই হয় নিজেরা ইতর অথবা নিজেরা তা না হলেও ইতরদের পৃষ্ঠপোষক। তারা নিজেরা যেমনই হোক কতকগুলি ইতরকে ক্ষমতার উচ্চতর জায়গাগুলিতে অধিষ্ঠিত করে রাষ্ট্র ও সমাজের ক্রমবর্ধমান দুর্বৃত্তায়ন এবং ইতরায়নের যাত্রার পথ অবারিত করে দিয়েছে। এভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের শুধু দুর্বৃত্তায়ন হয় নাই, সেই সঙ্গে হয়েছে ইতরায়ন। নিম্নমানের ও নিম্নরুচির ই্তরশ্রেণীর দুর্বৃত্তরা ক্ষমতায় গেলে সমাজের কী দশা হতে পারে তা আজকের বাংলাদেশকে দিয়েই বুঝা যায়। তবু যদি বুঝা্য় ফাঁক বা ঘাটতি থেকে থাকে তবে সেটা সাংসদ এবং প্রতিমন্ত্রী পদে অধিষ্ঠিত হয়ে মুরাদ হাসান বুঝিয়ে দিয়েছেন। আরও অনেকে সেটা বুঝিয়ে দেন বৈকি। তবে মুরাদ ধরা খেয়েছেন বলে তার কথাটা এভাবে বলা যাচ্ছে।
(২)
আমি লেখার শুরুতে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সঙ্গে ইতরতন্ত্রের পথ ধরে বাংলাদেশের অগ্রগমনের সম্পর্কের কথা বলেছিলাম। দুর্বৃত্তয়ান যে তখনই শুরু হয়েছিল সেটা স্পষ্ট। তার স্বীকৃতি স্বয়ং শেখ মুজিব দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পরই তার সেই উচ্চারণ ‘যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি চাটার দল’ কিংবা ‘সবাই পায় সোনার খনি, আমি পেয়েছি চোরের খনি’ একটা নিদারুণ সত্যের স্বীকারোক্তি। তার মানে রাজনীতিতে তিনি যাদেরকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা করেছিলেন সবাই না হলেও তাদের প্রায় সবাই অথবা বিপুল সংখ্যাগুরুই তার ভাষায় ‘চোর’ এবং ‘চাটার দল’। এদেরকে সঙ্গে নিয়েই তার রাজনীতির পথযাত্রা এবং সমাপ্তি।
এই পথের ভুল কোথায় কীভাবে তা নিয়ে অনেক আলোচনা এ দেশে অনেকে করেছেন, আমিও আমার মতো করে কিছুটা হলেও করেছি। সেইসব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনায় এই মুহূর্তে আমি আর যাব না। তবে প্রয়োজনে ভবিষ্যতে তা করা যেতে পারে। এ মুহূর্তে আমি বলব আওয়ামী লীগ এবং মুজিবের রাজনীতির যে ভুল ছিল তার খেসারত তাকে দিতে হয়েছে তার প্রাণ দিয়ে।
শেখ মুজিবের প্রথম সমস্যা ছিল তিনি যাদেরকে নিয়ে রাজনীতির পথযাত্রা করেছিলেন তাদের অধিকাংশই লুম্পেন, প্রতারক ও লোভী চরিত্রের কারণে কোনও উৎপাদনশীল অর্থনীতি, ন্যায়-নীতিনিষ্ঠ সমাজ এবং নিয়মানুবর্তী রাষ্ট্র গড়ার শক্তি ছিল না। এদের নিয়ে তিনি প্রথম থেকেই পুঁজিবাদী অর্থনীতি গড়তে গিয়েছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর সংবিধানে সমাজতন্ত্র মূলনীতি হিসাবে জায়গা পেলেও বাস্তবে তিনি পুঁজিবাদই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। সুতরাং তার নেতা-কর্মীদের উন্মত্ত লুঠতরাজকে বেলাগাম করলেন। ভাবলেন এভাবে প্রাথমিক পুঁজি গঠনের পর এরা যাবে উৎপাদনশীলতায়। লুম্পেন ও দুর্বৃত্তদের পুঁজি বা সম্পদ দিয়ে যে উৎপাদনশীল অর্থনীতি এবং ন্যায়-নীতি ভিত্তিক কোনও কিছু গড়া যায় না সেটা বুঝলেন অনেক দেরীতে। তখন সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে বাকশাল করলেন। এবার তার সহচররা ভয় পেল। কারণ সময় নির্ধারণ এবং পদ্ধতি ভুল হলেও বাকশালের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র অভিমুখী যাত্রার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সুতরাং সমাজের সর্বস্তরের ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে প্রকৃতপক্ষে তার এতদিনের বিশ্বস্ত সহচররাই তাকে মারল।
এক অর্থে, শেখ মুজিবুর রহমান ইতিহাসের এক ট্রাজিক চরিত্র। হ্যাঁ, এক অর্থে তিনি সফল। কারণ তিনি নায়ক হতে চেয়েছিলেন। সেটা হয়েওছিলেন। কিন্তু বিরাট খ্যাতি এবং অবিশ্বাস্য প্রতিপত্তির অধিকারী হয়েই তিনি তার সহকর্মী এবং অধীনস্থদের হাতে সপরিবারে নিহত হন। সুতরাং তিনি ব্যর্থতার পথযাত্রী। তার ট্রাজেডি এখানেও যে তিনি যা করতে চেয়োছলেন তাকে করতে হয়েছে তার বিপরীতটা। তিনি যা হতে চেয়েছিলেন তাকে হতে হয়েছে তা থেকে বিপরীতটা।
ছয় দফা কর্মসূচী দিয়েছিলেন তিনি পাকিস্তানের ক্ষমতার মসনদে বসতে চেয়ে। সেটা তিনি হয়ত হতে পারতেন। কিন্তু তৎকালীন সমাজের অভ্যন্তরে এমন কিছু শক্তির উত্থান ঘটেছিল যাকে তিনি আগে থেকে বুঝতে যেমন পারেন নাই তেমন তার উপর তার নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার ক্ষমতাও তার ছিল না। এর আগে ২১ দফা কর্মসূচীর ম্যান্ডেট নিয়ে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে তার গুরু সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হয়ে ২১ দফা কর্মসূচীর প্রতি তাদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করেন। তখন তিনি তার গুরুকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন দিলেন। ২১ দফা কর্মসূচী ছিল তাদের নিকট প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি। এর বেশী কোনও মূল্য তাদের নিকট ২১ দফার ছিল না। সুতরাং এবার ৬ দফার ক্ষেত্রেও তা হতে পারত।
কিন্তু এবার তা হল না। সোহরাওয়ার্দীর মতো পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হওয়া তার হল না। একুশ দফার মতো ছয় দফা বিসর্জন দেওয়া দূরের কথা, ছয় দফা নিয়েও তার পক্ষে পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাওয়া সম্ভব ছিল না। তখন বিশেষ করে বামপন্থী ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মের উদ্যোগে পূর্ব বাংলায় স্বাধীনতার শক্তি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে, ছয় দফার প্রশ্নে ছাড় দেওয়া তার পক্ষে যেমন সম্ভব ছিল না তেমন এমনটাই মনে হয় যে, পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর পক্ষেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় বাঙ্গালীদের আধিপত্য মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। আসলে পাকিস্তানের বিভক্তি আওয়ামী লীগের ভূমিধ্বস বিজয়ের পরই নির্ধারিত হয়ে গিয়েছিল। পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণীর পক্ষ থেকে পাকিস্তান ভাঙ্গার প্রধান কারিগরের ভূমিকাটা নিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।
এ নিয়ে নূতন করে এবং দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে এবং হওয়া দরকারও। তবে এখানে সে বিষয়ে দীর্ঘ আলোচনা না করে সংক্ষেপে বলি, একদিকে ১৯৭০-এর নির্বাচনে পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়, অপর দিকে স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতির শক্তি হিসাবে বিশেষত বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের উত্থান এমন এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে যা একটা যুদ্ধ এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠা অনিবার্য করে। প্রশ্ন ছিল স্বাধীনতার যুদ্ধ কার নেতৃত্বে হবে এবং কীভাবে হবে।
এটা একটা চমকপ্রদ পরিস্থিতি। বামপন্থী ছাত্র এবং তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি দ্বারা সমগ্র পূর্ব বাংলাকে কাঁপিয়ে বেড়াচ্ছে। অথচ তারা নেতৃত্বহীন। যে পুরাতন কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ছায়ায় তাদের বেড়ে উঠা তাদের সঙ্গে এই প্রশ্নে তাদের ছিল বিরাট দূরত্ব এবং প্রবল দ্বন্দ্ব। নেতৃত্ব যে কোনও ধরনের জাতি-রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতির বিরোধী ছিল। কারণ তাদের রাজনীতির মূল বিবেচনা ছিল অর্থনৈতিক শ্রেণীর প্রশ্ন তথা ধনী-গরীব, শ্রমিক-মালিকের প্রশ্নকে ঘিরে আবর্তিত। তারা বরং জাতির প্রশ্নকে তাদের দরিদ্র ও শ্রমিক তথা শ্রমজীবী শ্রেণী ভিত্তিক রাজনীতির জন্য বিপজ্জনক মনে করত। ফলে এই প্রজন্ম ছিল প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বহীন। সেকালের বিশাল নেতা মওলানা ভাসানী ছিলেন ১৯৫৭ সালে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠনের পর থেকে পাকিস্তান কালের প্রায় শেষ পর্যায় পর্যন্ত এই কমিউনিস্ট নেতৃত্ব দ্বারাই পরিবেষ্টিত এবং তাদের উপর নির্ভশীল। অথচ কমিউনিস্টরাও শ্রেণা বিপ্লব করবে বলে ১৯৬৯ সাল থেকে তাকে এবং জাতীয় রাজনৈতিক দল ন্যাপ পরিত্যাগ করে যেতে থাকে, যা ১৯৭০-এ সম্পূর্ণ রূপ নেয়।
পূর্ব বাংলার রাজনীতির জন্য সেটা ছিল অত্যন্ত জটিল এবং তুঙ্গ মুহূর্ত। কারও হিসাব অনুযায়ী কিছু যেন অগ্রসর হচ্ছিল না। অথচ দেশ নিশ্চিতভাবে একটা বিস্ফোরণ এবং যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল।
হ্যাঁ, যুদ্ধ হল। মুজিব যে যুদ্ধ চান নাই সেটা স্পষ্ট তার সকল কর্মকাণ্ড দ্বারা। তার ঘোষিত আন্দোলন ছিল অহিংস ও অসহযোগ। কিন্তু একটা পর্যায়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যেমন তার ধার ধারল না তেমন পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী সদস্যদের বিরাট অংশও তার ধার ধারল না। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দমন অভিযান শুরু করলে ছাত্র ও জনতার পাশাপাশি তারা প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করল, যা পরিণত হল স্বাধীনতা যুদ্ধে। তাতে যোগ দিল পুলিশ, ইপিআর বাহিনীরও বিরাট অংশ। মুজিব ঘরে বসে থাকলেন। কিন্তু কারও নেতৃত্বের ধার না ধেরে যুদ্ধ দেশের ভিতর থেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হয়ে গেল। ভারত এমন পরিস্থিতির অপেক্ষায় ছিল। মুজিব ঘরে থেকে পাক বাহিনীর নিকট ধরা দিলেও পলাতক আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ভারতে আশ্রয় নিলে ভারতের আশ্রয় এবং নিয়ন্ত্রণে শুরু হল স্বাধীনতার জন্য প্রতিরোধ যুদ্ধের অসংগঠিত ও স্বতঃস্ফূর্ত পর্যায়ের পরিবর্তে স্বাধীনতা যুদ্ধের নূতন ও সংগঠিত পর্যায়।
এভাবে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা হলে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে ফিরে শেখ মুজিব তার প্রধান মন্ত্রী হলেন। ফলে পাকিস্তান রক্ষা যেমন হল না তেমন পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হওয়াও তার হল না। অন্যদিকে, তিনি কোনও দিন সমাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না, বরং তিনি ছিলেন পুঁজিবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক এবং সমাজতন্ত্রের বিরোধী। অথচ স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানের চার মূলনীতির এক নীতি হিসাবে সমাজতন্ত্রের কথা বলতে হল।
তবে বাস্তবে করতে গেলেন পুঁজিবাদ। লুটপাট দিয়ে তো উৎপাদনশীল পুঁজিবাদও হয় না। বিশেষত তার দল বা নেতা-কর্মীদের দিয়ে উৎপাদনশীল কোনও কিছুই হয় না। পুঁজিবাদ কিংবা সমাজতন্ত্র কোনওটাই নয়। এই লোকগুলির বেশীর ভাগ চরিত্রে শুধু লোভী, লুঠেরা এবং দুর্বৃত্ত নয় উপরন্তু আচার-আচরণে আত্মসম্মানজ্ঞানহীন ইতরও বটে। এই শ্রেণীরই একটা প্রতীক হিসাবে ইদানীং কালে উপস্থিত হয়েছে সদ্য বিদায় নেওয়া প্রতিমন্ত্রী ডাঃ মুরাদ হাসান।
শেখ মুজিব এই প্রকৃতির নেতা-কর্মীদের বাগ মানাতে গিয়ে করতে গেলেন সমাজতন্ত্র, তাও আবার অনেক দেরীতে এবং ভুলভাবে, এবং সর্বোপরি যাদেরকে তিনি বলছেন চোর এবং চাটার দল তাদেরকেই সাথে নিয়ে। এরা কিন্তু বুঝতে ভুল করে নাই তিনি কীভাবে তাদেরকে অচেনা এবং অনিশ্চিত এবং সর্বোপরি তাদের দ্বারা এতকালের বিশ্বাসের বিপরীত এবং অনুসৃত পথেরও বিপরীত পথের যাত্রায় নিতে চাচ্ছেন। সেনাবাহিনীর ক্ষুব্ধ লোকদের সাহায্য নিয়ে তার সবচেয়ে বিশ্বাসভাজন সহযোগী মোশতাকের নেতৃত্বে তারা তাকে হত্যা করল।
(৩)
রক্তাক্ত অভ্যুথান এবং হত্যার মধ্য দিয়ে শেখ মুজিবের অধ্যায়ের অবসান হল। যাদের সাহায্য নিয়ে তিনি নেতৃত্বের শীর্ষে আরোহণ করেছিলেন প্রকৃতপক্ষে তার সেই সহকর্মীদের হাতেই তার মৃত্যু হল। সেই সঙ্গে মৃত্যু হল কেবল প্রস্ফুটিত হতে থাকা সমাজতন্ত্রের স্বপ্নেরও। এই স্বপ্ন আগেও অনেকে, যেমন কমিউনিস্টরা, এ দেশে দেখেছিল এবং তার জন্য প্রাণপাতও করেছিল। এ দেশে সমাজতন্ত্রের স্বপ্নকে জনমনে মূলত তারাই বিস্তৃত করেছিল। এ দেশের রাজনীতির এক মহীরুহ মওলানা ভাসানীও এক সময় এ স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু মুজিব প্রথম এই স্বপ্রকে বাস্তবায়নের দায়িত্ব রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করলেন। হয়ত যুগান্তকারী পথে এ দেশের যাত্রা হতে পারত। কিন্তু হল না কিছুই। মুজিবের মৃত্যু এবং বাকশালের অবসান শুরুতেই এক বিশাল স্বপ্নের পথে রাষ্ট্রের যাত্রার সমাপ্তি ঘটালো। সত্যি কথা বলতে কি, রাষ্ট্রকে হাতে নিয়ে এত বড় স্বপ্ন বাঙ্গালী কখনও দেখে নাই। অকালেই সেই স্বপ্ন ভঙ্গ হল। এ যেন দীর্ঘ ও অনিশ্চিত কালের জন্য বাংলা ও বাঙ্গালীর স্বপ্নচারিতার অবসান।
মুজিবের মৃত্যু এবং বাকশাল বিলপ্তির পর পুঁজিবাদের পথ ধরে অর্থনীতি ও রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের জন্য মোশতাক তথা আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক নেতৃত্বের ব্যর্থতার সুযোগ নিয়ে বিভিন্ন পটপরিবর্তন ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত জেনারেল জিয়ার নেতৃত্বে সেনাবাহিনী রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করল। মুজিবের সমাজতন্ত্র অভিমুখী অনিশ্চিত ও দ্বিধান্বিত যাত্রার পরিবর্তে জেনারেল জিয়ার পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ অভিমুখী যা্ত্রা হল তুলনায় কিছু সুস্থির। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪-এর পুরাটা সময় এবং ১৯৭৫-এর অনেকটা পর্যন্ত আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী-অনুসারীরা উন্মত্ত লুণ্ঠনের মাধ্যমে যে অর্থ-বিত্ত কিংবা পুঁজি সংগ্রহ করেছিল সেটাকে এখন তারা ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগের সুযোগ পেল। এভাবে তুলনায় একটা সুস্থিরতার মধ্য দিয়ে কিছু করে পুঁজির বিকাশ হল।
কিন্তু মনে রাখতে হবে এই পুঁজি যেমন জন্মগতভাবে পুরাপুরি লুঠেরা এবং লুম্পেন তেমন তার বিকাশের মধ্য দিয়ে সমাজের অসৎ, লুম্পেন, ইতর, দুর্বৃত্ত এবং লুঠেরা চরিত্র বিশিষ্ট ধনিক শ্রেণীরই উত্থান ঘটা সম্ভব। পাশ্চাত্যের উন্নত চরিত্রের কোনও পুঁজিপতি কিংবা ধনিক শ্রেণীর মতো শ্রেণীর উত্থান এ দেশে এই পদ্ধতিতে ঘটা সম্ভব নয়। একইভাবে এ দেশে এই প্রক্রিয়ায় কোনও প্রকৃত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থারও বিকাশ ঘটা সম্ভব নয়। এটা ঘোষণার ব্যাপার নয় যে, গণতন্ত্রের ঘোষণা দিয়ে ভোট করলেই একটা সমাজ এবং রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয়ে যাবে।
বস্তুত মোশতাক ও জিয়ার কাজকে প্রতিবিপ্লব বলা ছাড়া আর কিছু বলার উপায় নাই। মুজিব বিপ্লব করতে না পারেন, কিন্তু দেশকে বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাতে এবং সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে নিতে চেয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ এবং সেনাবাহিনী এই দুই জায়গার যে যেখান থেকেই আসুন মোশতাক এবং জিয়া বিপ্লবের সেই স্বপ্নকে চূর্ণ করেছেন। যে ইতর এবং দৃর্বৃত্ত শ্রেণীকে তারা রক্ষা এবং বিকশিত করেছিলেন সেই শ্রেণীর ভূমিকা দিয়েই তাদেরকে বিচার করতে হবে।
মুজিবের অনেক সীমাবদ্ধতা এবং ত্রুটি ছিল। কিন্তু অনেক দেরীতে হলেও তিনি এই দুর্বৃত্ত শ্রেণীর হাত থেকে রাষ্ট্রের পরিত্রাণের পথে পা দিতে চেয়েছিলেন। এ পথে উপনিবেশিক কাঠামোবদ্ধ রাষ্ট্রের পরিবর্তে অন্তত একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের ভিত্তি নির্মিত হতে পারত। যেভাবেই দেখা যাক, সমাজতন্ত্রের সীমিত হোক, অসীমিত হোক, প্রয়োগ ছাড়া আমাদের মতো দেশগুলিতে সেটা সম্ভব নয়। তিনি সেই সমাজতন্ত্রের পথে দেশকে নিতে চেয়েছিলেন। তার পদ্ধতি এবং সময় নির্ধারণ নিয়ে সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু তার এই চাওয়াকে অস্বীকার করা যায় না। এক বিশাল কর্মযজ্ঞে তিনি বাঙ্গালী জাতিকে নিবার পথে অন্তত যাত্রা শুরু করতে চেয়েছিলেন, তাও একটা রাষ্ট্রের ক্ষমতা হাতে নিয়ে। সেটা হল না।
যাইহোক, মুজিবের মৃত্যুর সঙ্গে সনাতন যে পথে রাষ্ট্রের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে সেই পথে যাত্রার পরিণতিতে দেশ আজকের এই জায়গায় পৌঁছেছে যেখানে প্রধানত মুরাদের মতো লোকরাই রাষ্ট্র ও সমাজের ক্ষমতার জায়গাগুলাকে দখল করে আছে। এটা আসলে ব্যক্তির ব্যাপার নয়, বরং সমষ্টির ব্যাপার। সুতরাং এক মুরাদকে সরালেই বা কী? তাতে বাস্তবতার কতটুকু হেরফের হবে?
তাহলে পরিত্রাণের পথ কী? নির্বাচন? যতই সুষ্ঠু এবং অবাধ নির্বাচন হোক, তাতে কী হবে? প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা বহাল রেখে নির্বাচনের প্রক্রিয়ায় যেই আসুক, তাতে কি এই দুর্বৃত্ত এবং ইতর শ্রেণীর হাত থেকে সৎ, ন্যায়-নীতি ও নিয়ম নিষ্ঠ লোকদের হাতে ক্ষমতা যাবে? পঞ্চাশ বৎসরের অভিজ্ঞতা থেকেও কি আমরা কিছু শিখব না? তার আগের অভিজ্ঞতার কথা না হয় বাদ দিলাম! সহজ পথে চলতে চেয়ে আমরা কি একই ভ্রান্তির চক্রে আবর্তিত হতে থাকব? একবার এ দল, আর একবার ও দল। তাতে লাভ কী?
৭-৯ ডিসেম্বর, ২০২১