Banner
গারো জনজাতি এবং সিন্ধু সভ্যতা — শামসুজ্জোহা মানিক

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ April 14, 2022, 12:00 AM, Hits: 981

 

(১)  আলোচনার সূত্রপাত

প্রথমেই বলি যে, এখানে আমি গারোদের নিয়ে বিস্তারিত কোনও আলোচনা যেমন করতে যাচ্ছি না তেমন সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত বিশদ কোনও আলোচনায়ও এখানে যাব না। বিশেষত সিন্ধু সভ্যতা প্রসঙ্গে বিভিন্ন লেখায় শামসুল আলম চঞ্চলের সঙ্গে আমার যৌথভাবে কিংবা আমার একক অনেক আলোচনা থাকায় এখানে খুব প্রয়োজন না হলে এ প্রসঙ্গে তেমন কোনও আলোচনায় যাব না। তবে সিন্ধু সভ্যতা এবং গারো জনজাতি সংক্রান্ত আজকের আলোচনাকে হয়ত ভবিষ্যতের বৃহত্তর কোনও আলোচনার জন্য একটা সূত্রপাত হিসাবে বিবেচনা করা যাবে, তার বেশী নয়। সুতরাং এটা হবে খুব সংক্ষিপ্ত একটা আলোচনা, যার উদ্দেশ্য অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।

(২) কারা গারো?

প্রথমে জানা যাক গারো হিসাবে আমরা কোন জনজাতি বা জাতিসত্তাকে জানি। আমরা বাঙ্গালীরা যাদেরকে সাধারণত গারো জনজাতি বা গারো জাতিসত্তার মানুষ হিসাবে চিনি তারা কিন্তু নিজেদেরেকে গারো বলে না। সেটা গারো ভাষায় মান্দি। হ্যাঁ, গারো জনজাতির মানুষরা নিজেদেরকে সাধারণত মান্দি বলে। কখনও বা মান্দির উচ্চারণ মান্দে হতে পারে। মান্দি শব্দের অর্থ হল মানুষ। আর একটা শব্দ তারা কখনও নিজেদের পরিচয় হিসাবে ব্যবহার করে। সেটা হচ্ছে আচিক। আচিক এসেছে পাহাড় থেকে। গারো ভাষায় আচিক অর্থ পাহাড়। গারোরা পাহাড়ের মানুষ। সুতরাং আচিক। অবশ্য গারোরা শুধু পাহাড়ের অধিবাসী নয়। গারো পাহাড়ের বাইরেও চারপাশের সমতল অঞ্চলে তাদের বসবাস রয়েছে। এ প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে যে, আমার মনে হয়েছে গারো জাতি অর্থে আচিক শব্দের ব্যবহার তুলনায় সাম্প্রতিক। সম্ভবত তরুণতর এবং শিক্ষিত গারোদের মধ্যে আচিক নামের ব্যবহারের অধিক প্রবণতা দেখা দেয়।

ভারতের মেঘালয় রাজ্য ছাড়াও ভারতের আসাম এবং বাংলাদেশসহ এক বিস্তীর্ণ সমতলূভূ  অঞ্চলেও তাদের বসবাস বহুকাল ধরে ছিল এবং এতসব রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরেও আজ অবধি কমবেশী আছে। ব্রিটিশ শাসনামলে তৎকালীন ময়মনসিংহ জিলার অন্তর্ভুক্ত টাঙ্গাইলের মধুপুর গড় ও বনাঞ্চল এবং উত্তরের শেরপুর-নেত্রকোণা অঞ্চলের বিভিন্ন থানায় বহুসংখ্যক গারো বসবাস করত। ১৯৯৮-’৯৯ সালে মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানের সময়ে আমি শুনেছিলাম ব্রিটিশ শাসনকালে তৎকালীন ময়মনসিংহ জিলার ৭ কিংবা ৮টা থানা প্রধানত গারো জনজাতি অধ্যুষিত ছিল। সংখ্যাটা এখন আমি স্মৃতি থেকে বলছি। এই সংখ্যা ৯টাও হতে পারে। সেই সময় থানাগুলির নামও শুনেছিলাম, যদিও এখন সবগুলির নাম মনে নাই। তবে ১৯৪৭ খ্রীষ্টাব্দে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ধর্মীয় কারণেও প্রচণ্ড রকমভাবে স্বাধীন নারী-বিদ্বেষী ও পুরুষতান্ত্রিক বাঙ্গালী মুসলিম সম্প্রদায়ের আগ্রাসন এবং বৈরী আচরণের কারণে গারোদের বৃহদাংশ ক্রমবর্ধমানভাবে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানভুক্ত ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে পার্শ্ববর্তী ভারতের প্রধানত মেঘালয় রাজ্যে চলে যেতে থাকে। এর ফলে এখন এক কালের গারো অধ্যুষিত এলাকাগুলির অধিকাংশই গারো-শূন্য হয়ে পড়েছে। তবু এখনও নেত্রকোণা ও শেরপুরসহ উত্তরের কয়েকটি জিলার বিভিন্ন গ্রামে কিছু করে গারো দেখতে পাওয়া যায়। রাজধানী ঢাকা নগরেও কিছু সংখ্যক গারো নারী এবং পুরুষ বিভিন্ন কর্মোপলক্ষ্যে বাস করেন। সুতরাং বাংলাদেশে গারো জনজাতি যে খুব অপরিচিত একটা জনগোষ্ঠী তা নয়। বিশেষ করে মাতৃতান্ত্রিক সমাজ হিসাবে গারোদের পরিচিতি তাদের জন্য একটা ভিন্ন ধরনের কৌতূহল সৃষ্টি করে রেখেছে।

এখন গারোদের সম্পর্কে আলোচনায় প্রথমেই বলা উচিত হবে যে, যে নামে গারোরা নিজেদের পরিচয় তুলে ধরতে বেশী পছন্দ করে সেই মান্দি শব্দই হয়ত গারো জনজাতির জন্য প্রযোজ্য হওয়া উচিত। তবু দেশী-বিদেশী সকল অ-গারোর নিকট গারোরা গারো হিসাবে পরিচিত। শব্দটা কোথা থেকে এসেছে তা আমার জানা নাই। তবে আমার জানা মতে বাইরের লোকদের দেওয়া নাম হলেও এই নামের মধ্যে তাদের প্রতি উপেক্ষা বা বিদ্বেষ নিহিত নাই। সুতরাং একজন বাঙ্গালী লেখক হিসাবে আমিও তাদেরকে গারো হিসাবে উল্লেখ করেই এই আলোচনার সূত্রপাত করছি।

প্রথমেই উল্লেখ করা উচিত হবে যে, গারোদের সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা বা ধারণা যে খুব দীর্ঘ সময়ের তা নয়। তাদের সম্পর্কে আমার যে আগ্রহ বা কৌতূহলই থাক তাদের সম্পর্কে আমার মাঠ পর্যায়ের অভিজ্ঞতা খুব অল্প সময়ের জন্য। ১৯৯৮-’৯৯ সাল সময়ে বৎসরাধিক কাল আমি বিশেষ করে বর্তমান নেত্রকোণা এবং শেরপুর জিলার গারো অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চলে আমার অনুসন্ধান পরিচালনা করি। অবশ্য এর বাইরে ছিল গারোদের উপর লিখিত বইপত্র পাঠ। বাংলাদেশে গারোদের সমাজ, ইতিহাস সংক্রান্ত বইপত্রের স্বল্পতা অবশ্য আমার এ সংক্রান্ত পাঠের ক্ষেত্রে একটা বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা ছিল। তবু বিভিন্ন সময়ে যেটুকু পেতাম পড়ার চেষ্টা করতাম। তবে মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান পরিচালনার সময়টাতে আমি গারো অধ্যুষিত গ্রামাঞ্চল ছাড়াও ঢাকা এবং ময়মনসিংহ শহরের মতো শহরে অবস্থিত গারো জনজাতির লেখক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র-ছাত্রী, গৃহিণীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের গারোদের সঙ্গে প্রচুর আলাপ-আলোচনা করি। আসলে এই সময়ে আমি আমার সর্বশক্তি নিয়োগ করে এই বিস্ময়কর জনজাতিকে আবিষ্কারের চেষ্টা করি।

আমার জীবনের আরও অনেক কাজ ছিল। আর এ সবই তো আমার একক উদ্যোগ এবং প্রয়াস। স্বাভাবিকভাবে বৎসর কালের সঞ্চয় মনের ভিতরে রেখে আমাকে আমার জীবনের যাত্রাপথে এগিয়ে যেতে হয়েছে। তবে গারোদের উপর অনুসন্ধান থেকে আমার যে উপলব্ধি জন্মে তার ফল স্বরূপ সেই সময় আমি দুইটি প্রবন্ধ লিখি। একটির নাম ‘একজন অ-গারোর দৃষ্টিতে গারো জাতিসত্তা’, এবং অপরটির নাম ‘ঘুমন্ত এক জাতির জাগরণের অপেক্ষায়’। ১৯৯৯ সালে লিখা এ প্রবন্ধ দুইটি সম্ভবত ২০০০ সালের প্রথম দিকে বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।*

------------------------------------------------

*  প্রবন্ধ দুইটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ দেওয়া আছে। লিংক ˸

একজন অ-গারোর দৃষ্টিতে গারো জাতিসত্তা ─ শামসুজ্জোহা মানিক (পুনঃপ্রকাশিত)

লিংক ˸ http://www.bangarashtra.net/article/1528.html

ঘুমন্ত এক জাতির জাগরণের অপেক্ষায় ─ শামসুজ্জোহা মানিক (পুনঃপ্রকাশিত)

লিংক ˸ http://www.bangarashtra.net/article/1529.html

-----------------------------------------------

মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের কাল ফুরালেও গারো জনজাতি নিয়ে আমার আগ্রহ ফুরায় নাই। গারোদের উপর অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে আমার যে বিস্ময় জাগে তা সর্বদা আমাকে অধিকার করে থেকেছে। আধুনিক কালে নারীবাদ নিয়ে বিশ্বব্যাপী যে নূতন ভাবনা এবং আন্দোলন তা থেকে উঠে আসা অনেক প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে চেয়ে গারোদের উপর আমার এই অনুসন্ধান। তাতে আমি দেখতে পেয়েছি এক বিস্ময়কর জনজাতিকে। আগামী কালের মানব জাতিকে দেখতে ও বুঝতে চেয়ে আমি বারবার আমার কল্পনায় গারো জনজাতির কাছে ফিরতে চেয়েছি। বই-পত্রের সীমাবদ্ধ পাঠ ছাড়াও তাদের উপর আমার স্বল্পকালীন মাঠ পর্যায়ের যে অভিজ্ঞতা তা আমার জন্য অমূল্য পাথেয় হয়ে থেকেছে। সুতরাং গারো জনজাতির উপর আমার মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের কাল হিসাবে ১৯৯৮-’৯৯ ছিল আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ কাল।

ঐতিহ্যিকভাবে গারো সমাজ মাতৃতান্ত্রিক বা নারী শাসিত। সুতরাং গারো সমাজের উপর অনুসন্ধানের ফলে আমি যে শুধু বিদ্যমান মাতৃ বা নারী শাসনের বৈশিষ্ট্য এবং সমস্যাগুলি সম্পর্কে কিছু প্রাথমিক ধারণা লাভের সুযোগ পেয়েছিলাম তা-ই নয়, উপরন্তু আগামী পৃথিবীর সমাজে নারীর অবস্থান ও ভূমিকা সংক্রান্ত বিষয়গুলি সম্পর্কেও নূতন করে চিন্তার সুযোগ লাভ করি। এবং সর্বদা গারোদের প্রসঙ্গ মাথায় কম-বেশী কাজ করে। পুরুষতন্ত্রের বিপরীত একটা সমাজ এটা, যেটা এত প্রতিকূলতার মধ্যেও এই সেদিনও বাংলাদেশের উত্তরের প্রান্তবর্তী কিছু এলাকায় যথেষ্ট শক্তি নিয়ে টিকে ছিল এবং আজও ভারতের মেঘালয় রাজ্যে যথেষ্ট শক্তি নিয়ে টিকে আছে।

এটা ঠিক যে, আমি পশ্চাৎপদ আদিম জীবনে প্রত্যাবর্তনের চেষ্টার পক্ষপাতী নই। কিন্তু তার উন্নততর উপাদানসমূহের পুনঃপ্রতিষ্ঠার বিষয়টাকে আমি সর্বদা গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করি। বর্তমানে আমাদের জীবনে যা আছে তার সব যে শ্রেষ্ঠ কিংবা কল্যাণকর তা নয়। বরং আমাদের বর্তমানের বহু কিছুই অগ্রহণযোগ্য, অকল্যাণকর এবং বর্জনীয়। সুতরাং আমাদের আগামী যাত্রার জন্য আমাদেরকে বর্তমানের বহুকিছুকে প্রত্যাখ্যান করে সামনের দিকে পা বাড়াতে গিয়ে অতীতের দিকে দৃষ্টি দিতে হয়। কারণ সেখান থেকে পেতে হয় অভিজ্ঞতার শিক্ষা এবং সেখানে ইতিবাচক কিছু থাকলে তা হয়ে উঠে ভবিষ্যতের দিকে পথযাত্রার পাথেয়।

আমাদের ভবিষ্যৎ যাত্রার অনেক অভিজ্ঞান কিংবা প্রেরণা লুকিয়ে থাকে কখনও বা আমাদের অনেক দূর অতীতের মধ্যে। সুতরাং অতীতের মধ্যে আমাদের মাতৃতন্ত্রের ইতিহাস যদি কোথায়ও লুকিয়ে থাকে সেটাকে খুঁজতে এবং বুঝতে চেয়ে এবং সেই সঙ্গে আধুনিক সভ্যতায় নারীর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নসমূহের উত্তর পেতে চেয়ে গারোদের উপর আমার ১৯৯৮-’৯৯ সালের মাঠ পর্যায়ের কাজটুকু। 

নূতন অনেক উপলব্ধিতে পৌঁছানো এবং আমার অনেক নিজস্ব উপলব্ধির দৃঢ়বদ্ধতা অর্জনের জন্য এটা ছিল আমার জীবনের এক শ্রেষ্ঠ সময়। মানুষের সামাজিক প্রগতি অর্জনের গতিপ্রকৃতি সংক্রান্ত অনেক প্রশ্নের উত্তর আমি এই সময়কার আমার কাজ থেকে পাই। এটা ছিল আসলে আমার জন্য বিস্ময়কর আবিষ্কারের কাল।

আমার জন্য এমন আর এক বিস্ময়কর আবিষ্কারের কাল ছিল ১৯৮৯-’৯০ সাল যখন আমি ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার শুরুর জায়গায় পৌঁছাতে চেয়ে হিন্দুদের আদি ধর্মগ্রন্থ হিসাবে পরিচিত ঋগ্বেদ পাঠ করি। ঋগ্বেদ এবং সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার সংক্রান্ত যেটুকু তথ্য তখন পর্যন্ত আমার জানা ছিল তার ভিত্তিতে ১৯৯০ সালে লিখি ‘ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান’।*

---------------------------------------

*  সম্প্রতি এটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রকাশিত হয়েছে।

লিংক ˸ http://www.bangarashtra.net/article/1514.html

--------------------------------------

ঋগ্বেদ পাঠ নিয়ে বিভিন্ন লেখায় আমার অনেক আলোচনা থাকায় এখানে তা নিয়ে নূতন করে আর তেমন করে আলোচনা করব না। এখানে শুধু এটুকু বলব যে, ঋগ্বেদ পাঠ দিয়ে আমি শুধু যে ভারতবর্ষের নূতন ইতিহাস আবিষ্কার করেছি তাই নয়, উপরন্তু ‍সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কেও নূতন উপলব্ধিতে পৌঁছেছি। ইতিমধ্যে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারগুলির অনেক নূতন তথ্য আমাদের জ্ঞান এবং উপলব্ধিকে বিরাটভা্বে সমৃদ্ধ করেছে। তবে আমার জন্য সিন্ধু সভ্যতা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের পুনরাবিষ্কার ও পুনর্মূল্যায়নের জন্য ঋগ্বেদ পাঠ ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।

(৩) গারোদের প্রশ্নে আলোচনায় সিন্ধু সভ্যতার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু?

সঙ্গত কারণে প্রশ্ন আসবে যে, প্রাচীন পৃথিবীর অত্যুন্নত নগর সভ্যতার সঙ্গে অল্প কিছুকাল আগে পর্যন্ত প্রায় আদিম পর্যায়ে টিকে থাকা একটি মাতৃতান্ত্রিক সমাজের তুলনা খুঁজা কিংবা যোগসূত্র সন্ধানের চিন্তাটা কতটা যৌক্তিক? অথচ সিন্ধু সভ্যতা এবং গারো সমাজের কতকগুলি বৈশিষ্ট্যের অভিন্নতা আমার ভিতরে সেই চিন্তার জন্ম দিয়েছে।

আমরা গারো সমাজের অহিংস প্রবণতার প্রাধান্য সম্পর্কে জানতে পারি। যতদূর বুঝি মাতৃতন্ত্রের কারণে গারোরা সাধারণত শান্তিপ্রিয় বা অনাগ্রাসী ছিল। গারোরা যুদ্ধ করত সাধারণত আত্মরক্ষার প্রয়োজনে। চতুর্দিকের সহিংস এবং যুদ্ধপ্রবণ পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ও রাষ্ট্রগুলির আবেষ্টনে থেকে যুদ্ধ না করে গারোদের উপায় ছিল না। সমাজ মাতৃতান্ত্রিক এবং শান্তিপ্রিয় হলেও পুরুষ যোদ্ধারা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা। আসলে গারো সমাজের মাতৃতন্ত্র তথা নারীর কর্তৃত্বনির্ভর সমাজ ব্যবস্থাকে হাজার হাজার বৎসর ধরে বাইরের পুরুষতন্ত্রের আক্রমণ ও আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেছিল পুরুষ গারো যোদ্ধারাই। এই পুরুষ যোদ্ধাদের পরাক্রম সম্পর্কে পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট সমাজগুলিও ভীত থাকত। তবে সাধারণভাবে গারোরা ছিল শান্তিপ্রিয়, যে কথা একটু আগেই বলেছি। বুঝাই যায় যে, নারী চরিত্রের মধ্যে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী শান্তিপ্রিয়তার যে প্রাধান্য থাকে তার প্রভাবে গারো সমাজ তেমনভাবে যুদ্ধংদেহী না হয়ে বরং হত শান্তিপ্রিয়।*

-------------------------------------------

* গারো যোদ্ধাদের নিয়ে কিছু আলোচনা করেছি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ সম্প্রতি প্রকাশিত ‘নারীর ক্ষমতায়ন, নাকি নারীর ক্ষমতা প্রতিষ্ঠা? ˸ গারো সমাজের অভিজ্ঞতা কী বলে?’ নামক প্রবন্ধে। লিংক ˸ http://www.bangarashtra.net/article/1520.html

-------------------------------------------

গারো যোদ্ধারা বীরত্বের জন্য খ্যাতিমান ছিল। শত্রু যোদ্ধাদের হত্যা করে তাদের মাথা কেটে নিয়ে যেত বলে তাদেরকে নৃমুণ্ডশিকারী হিসাবে ভয়ের চোখেও দেখা হত। আসলে তারা তাদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজকে রক্ষা করত তাদের বীরত্ব দিয়ে। এদিক থেকে বিবেচনা করলে বলতে হবে গারো মাতৃতন্ত্রের রক্ষাকারী শক্তি ছিল গারো পুরুষরা। নারীদের অধীনে যে অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল সেটাকে হাজার হাজার বৎসর ধরে বাহুবলে রক্ষা করেছিল গারো পুরুষরা। অর্থাৎ এই ব্যবস্থা গড়ার শক্তি যদি নারীরা হয়ে থাকে তবে বহিরাক্রমণ থেকে রক্ষার শক্তি ছিল পুরুষরা। এটা ক্ষমতা ও দায়িত্বের এক বিস্ময়কর বিভাজন এবং সমন্বয় সাধন, যা স্মরণাতীত কাল থেকে টিকে থেকেছিল ১৮৭২-’৭৩-এ ব্রিটিশ সেনাবাহিনীর আক্রমণ অভিযানের মুখে স্বাধীন গারো গ্রামগুলির পরাজয়ের পূর্ব পর্যন্ত। এই সময়ে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী গারো পাহাড়সহ গারোদের সমগ্র বাসভূমি নিজেদের অধিকারভুক্ত করে এবং স্বাধীন গারো সত্তার অবসান ঘটায়।

গারো জনজাতির ইতিহাস আমাদের সামনে তুলে ধরে এমন এক জনজাতির ইতিহাস যারা প্রবলভাবে স্বাধীনতাপ্রিয় এবং আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন হলেও মূলত ছিল শান্তিপ্রিয়। এই শান্তিপ্রিয়তার একটা পরিণতি হল রাষ্ট্র গঠনের প্রতি তাদের অনীহা। ফলে বৃহৎ অঞ্চলে গারোদের বসবাস থাকলেও তাদের কোনও কেন্দ্রীয় কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব যেমন ছিল না তেমন ছিল না কোনও স্থায়ী সেনাবাহিনী। যখন প্রয়োজন হত তখন গারো গ্রামগুলির প্রতিনিধিরা একত্র হয়ে যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নিত। কিন্তু গারোদের প্রতিটি গ্রাম ছিল স্বাধীন। মাতৃতন্ত্রের অভিন্ন সংস্কৃতি বা রীতিনীতি ও প্রথা সকল গারোকে ঐক্যবদ্ধ রাখত। সুতরাং অন্যান্য পিতৃতান্ত্রিক সমাজের ক্ষেত্রে যেমন দৃঢ়বদ্ধ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব বা কর্তৃত্ব দেখা যায় গারোদের ক্ষেত্রে তেমন কিছু ছিল না। গারো মাতৃতান্ত্রিক সংস্কৃতির এক অভিন্ন বদ্ধনে আবদ্ধ হলেও প্রতিটি গ্রাম ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন। এই কারণে কোনও কোনও গারো গবেষক প্রতিটি গারো গ্রামকে এক একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র বা ‘রিপাবলিক’ বলেছেন (দ্রষ্টব্য : Milton S. Sangma, History and Culture of the Garos)।

এটা বুঝা যায় গারো ঐক্যবোধের মূল শক্তি নিহিত ছিল তাদের মাতৃতান্ত্রিক প্রথা ও রীতিনীতির মধ্যে, যা তারা গড়ে তুলেছিল হাজার হাজার বছরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। এটাও নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, গারো গ্রামগুলি পরিচালিত হত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। সমাজ মাতৃতান্ত্রিক হলেও এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে মাতৃতান্ত্রিক ঐতিহ্য ও প্রথাকে গুরুত্ব দেওয়া হলেও গ্রামের সকল প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষ একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করত। এটাও লক্ষ্যণীয় যে, যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠতার পরিবর্তে মতৈক্যের উপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হত। গারোদের মধ্যে ভারতীয় সমাজে স্মরণাতীত কাল ধরে চলে আসা পঞ্চায়েতমূলক শাসন ব্যবস্থার এই বৈশিষ্ট্যের উপস্থিতি যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ।

আমার অনুমান সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতির মধ্যে নারী এবং পুরুষ প্রাধান্যও প্রতিফলিত হয়। আমার বিবেচনায় নারী সাধারণত দ্বন্দ্ব বা যু্দ্ধের পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছাবার পক্ষপাতী। অর্থাৎ আপোস বা ঐক্যমত বা মতৈক্য হচ্ছে এ ক্ষেত্রে মীমাংসা বা অভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রধান পদ্ধতি। পুরুষের ক্ষেত্রে সেটা হতে পারে বলপ্রয়োগের ক্ষমতা তথা যুদ্ধের সক্ষমতা বা যুদ্ধ। সংখ্যাগরিষ্ঠতা দ্বারা প্রতিপক্ষকে হারানোর মধ্যে রয়েছে যুদ্ধজয়ের অনুরূপ একটা পদ্ধতি। প্রাচীন ভারতের প্রজাতন্ত্র বা গণরাজ্যগুলিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ঐক্যমতে পৌঁছানো না গেলে সংখ্যাগরিষ্ঠতা তথা ভোটাভুটির মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া হত বলে জানা যায়। কিন্তু ভারতবর্ষে বহুপ্রাচীন কাল থেকে ভোটাভুটির পরিবর্তে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ঐক্যমতে পৌঁছাবার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হত। পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ ও সভ্যতার ভিতর যে যুদ্ধ ও হিংসা প্রবলরূপে রয়েছে তা এভাবে পাশ্চাত্য পদ্ধতির গণতন্ত্র চর্চার মাধ্যমেও প্রতিফলিত হয় কিনা সেই বিষয়টিকে আমি ভাবতে বলব। গণতন্ত্রের এই পদ্ধতিতে অভিন্ন সিদ্ধান্তে বা ঐক্যমতে পৌঁছাবার জন্য আলাপ-আলোচনার পরিবর্তে সংখ্যার উপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া হয় বলে মনে হয়। যুদ্ধের চেয়ে অবশ্য সাধারণভাবে এটাই গ্রহণযোগ্য। তবে এর ভিতরে সম্ভবত যুদ্ধের প্রেরণা থাকে। নারীরা নিজেরা তো সাধারণভাবে যুদ্ধ বা হিংসা বিমুখ। সুতরাং হয়ত মাতৃতান্ত্রিক গারো সমাজে এই পদ্ধতির প্রাধান্য।

ভারতবর্ষেও ঐতিহাসিক কাল থেকে এই পদ্ধতি বেশী প্রচলিত। আমার অনুমান সিন্ধু সভ্যতাতেও রাষ্ট্র ও সমাজ শাসনে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে মতৈক্যে পৌঁছাবার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হত। এই প্রথাই সম্ভবত ব্রিটিশ শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত বংশগত এবং যুদ্ধ-নির্ভর রাজতান্ত্রিক শাসনের বাইরে বিদ্যমান গ্রাম-পঞ্চায়েত শাসনে অনুসৃত হত।

সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহের হিসাব অনুযায়ী সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের সময়কে মোটামুটি ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে ধরা হয়। সে হিসাবে সিন্ধু সভ্যতার পতন হয় আজ থেকে প্রায় ৪ হাজার বছর আগে। কিন্তু একটা সভ্যতার মৃত্যু হলেও তার ধারাবাহিকতা নানানভাবে থেকে যায়। এভাবেও বলা যায় সভ্যতার বস্তুগত রূপের এক ধরনের অবসান বা মৃত্যু হলেও সভ্যতার ঠিক মৃত্যু নয়, বরং অনেকাংশে রূপান্তর ঘটে। অনেক ক্ষেত্রে সভ্যতার বস্তুগত রূপ ভাবগত রূপ নিয়ে বেঁচে থাকে। এ যেন বস্তুর ভাবে রূপান্তর। অর্থাৎ সভ্যতা হারিয়ে গেলেও তা অনেকটা সময় বেঁচে থাকতে পারে তার সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে। সিন্ধু সভ্যতার মতো বিশাল, সুউন্নত, অবিশ্বাস্যভাবে অহিংস, মানবিক এবং পরাক্রান্ত সভ্যতার ক্ষেত্রে এ কথা আরও বেশী প্রযোজ্য।

আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও পশ্চিম ভারতে দশ কিংবা কোনও কোনও প্রত্নতাত্ত্বিকের মতানুযায়ী বারো লক্ষধিক বর্গকিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত একটা সভ্যতার ক্ষমতা-কেন্দ্র কোনটা ছিল? মহেঞ্জোদাড়ো, লা্খাঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, রাখিগাড়ী, ধোলাভিরা ইত্যাদি ‍বৃহৎ আকৃতির নগরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আছে আরও বহুসংখ্যক নগর এবং গ্রাম। বড়-ছোট নগর এবং গ্রামসহ এ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতার যে সকল বসতি পাওয়া গেছে সেগুলির সংখ্যা ৩ হাজারের বেশী। কিন্তু এই সমগ্র সভ্যতায় সর্বত্র কম-বেশী সমরূপতা বা বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে অভিন্নতা থাকলেও সমস্ত সভ্যতায় ক্ষমতা এবং সম্পদের অতিকেন্দীভবনের চিহ্ন নাই। অর্থাৎ মূলত অভিন্ন পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্র্রণে সভ্যতা গঠিত হলেও এবং একটা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা শাসনের উপস্থিতি সর্বত্র অনুভব করা গেলেও তার প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তির অস্তিত্ব কোথায়ও দেখা কিংবা অনুভব করা যায় না। এটা স্পষ্ট যে, এই সভ্যতায় সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী কোনও ব্যক্তি কোথায়ও ছিল না। অর্থাৎ যতই কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ থাকুক সমগ্র রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ও পরিচালিত হত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে। এবং সেই সঙ্গে শান্তিপূর্ণভাবে। অর্থাৎ প্রাচীন গ্রীস বা রোমের মতো যুদ্ধ ও হিংসা নির্ভর গণতন্ত্রও এটা ছিল না।

ফলে এটাও বুঝা যায় যে, গ্রীস বা রোমের মতো মানুষকে দাস করে জবরদস্তির মাধ্যমে শ্রমশোষণও এখানে করা হত না। তার মানে এই নয় যে, ধনী-গরীব ছিল না। ধনী-গরীব যেমন ছিল তেমন সভ্যতার নিয়মে শ্রমবিভাজনও ছিল। তবে অন্য সকল সভ্যতা থেকে কম সুবিধাভোগী ও শ্রমজীবীদের জন্য তা ছিল অনেক সহনীয়। যে কারণে সিন্ধু সভ্যতার ধনী এবং দরিদ্র হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন বহু সংখ্যক নরকঙ্কালের উপর পরীক্ষা চালিয়ে দেহবিজ্ঞানীরা আশ্চর্য হয়ে লক্ষ্য করেছেন যে, অন্য সকল সভ্যতায় ধনী এবং দরিদ্রদের কঙ্কালে পুষ্টিমানে যে ধরনের পার্থক্য দেখা যায় তেমন কিছু সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে দেখা যায় না।

এটাও নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, সিন্ধু সভ্যতার নগরগুলিতে কোথায়ও বস্তির চিহ্ন নাই। প্রত্যেক নগরবাসী ছোট-বড় যেমন হোক ইট দ্বারা তৈরী বাসগৃহে বাস করত।

নগর সভ্যতার সঙ্গে অতীতের গ্রামীণ গারো সমাজের তুলনা করা চলে না। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে গারো সমাজ বিন্যাসকে কিংবা তার কিছু বৈশিষ্ট্যকে মিলাতে গেলে ভুল হতে পারে। তবে কিছু বৈশিষ্ট্যের অভিন্নতা মনোযোগ আকৃষ্ট করে বৈকি! এমনই একটা বৈশিষ্ট্য হল দৃশ্যমান দৃঢ়বদ্ধ কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকা সত্ত্বেও একটা সমাজের ঐক্য ও সংহতি প্রতিষ্ঠা। গারো সমাজের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব না থাকা সত্ত্বেও তারা নিজেদের সাংস্কৃতিক ঐক্যকে ধরে রেখেছে হাজার হাজার বৎসর। উপজাতীয় কর্তৃত্বের মতো এর জন্য তাদের কোনও উপজাতীয় প্রধান বা কেন্দ্রীয় পরিচালনা পরিষদের প্রয়োজন হয় নাই। বুঝা যায় এটা নারীর নিয়ন্ত্রণ এবং প্রাধান্যকে খর্ব করে বলে সমাজ এ ধরনের কোনও কর্তৃত্ব গড়ে তুলে নাই। শুধু তা-ই নয়, এ ধরনের চেষ্টা কেউ করলে মাতৃতন্ত্রকে রক্ষার স্বার্থে তাতে বাধা দিয়েছে। এটা বুঝা যায় যে, মাতৃতন্ত্রের মূল শক্তি গৃহকেন্দ্রিক অর্থনীতিতে ছিল।

সুতরাং গারো সমাজ চারপাশের দৃষ্টান্তে প্রভাবিত না হয়ে এই সেদিন পর্যন্ত লাঙ্গল ভিত্তিক বৃহদায়তন কৃষিকে প্রত্যাখ্যান করে জুমচাষমূলক কৃষি অর্থনীতিকে আঁকড়ে ধরে থেকেছিল। এটাকে উদ্যান কৃষিও বলা যায়। বনের কোনও একটি স্থানের গাছপালা কেটে সেগুলিকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে শাবল, খুন্তি, কোদাল বা এই ধরনের কোনও ধারালো জিনিস দিয়ে মাটি খুঁড়ে এবং নরম করে সেখানে বিভিন্ন রকম শস্য বা ফসলের বীজ পুঁতে দিয়ে ফসল লাভ পর্যন্ত অপেক্ষা করা হয়। এই পদ্ধতিতে এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জমিতে ফসল ফলানো হয়।

তবে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের মধ্যে মাতৃতন্ত্র নাই। চাকমাসহ আদিবাসীরা যে ধরনের চাষ পদ্ধতিতে অভ্যস্ত হোক তারা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। কিন্তু বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল কিংবা ভারতের মেঘালয়ের গারোরা মাতৃতান্ত্রিক। যুগের প্রভাবে এখন যে পরিবর্তন আসুক গারোরা অল্পদিন পূর্ব পর্যন্ত উদ্যান কৃষি বা জুমচাষকে আঁকড়ে ধরে থেকেছিল। আসলে লাঙ্গল চাষ অনেক বেশী দেহশক্তি দাবী করে, যেটা নারীদের সচরাচর থাকে না। অন্যদিকে এ ধরনের কৃষিতে নারীদেরকে গৃহ থেকে দূরে যেতে হতে পারে। প্রাচীন প্রযুক্তির কালে নারীদের কর্মক্ষেত্র গৃহ-কেন্দ্রিক এবং খুব বেশী হলে তার গ্রাম-কেন্দ্রিক হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। সুতরাং মাতৃতন্ত্রকে রক্ষার প্রয়োজনে সে কালে সমাজ একটা পর্যায়ের পর অর্থনীতি বা উৎপাদন ব্যবস্থাকে আর আগাতে দেয় নাই। এই রকম বাস্তবতায় নারীর নিয়ন্ত্রণাধীনে অর্থনীতিকে ধরে রাখবার প্রয়োজনে গৃহ এবং গ্রামের সীমাবদ্ধ আয়তনের মধ্যে কৃষি এবং পশুপালনের ভূমিকাকে দেখতে হবে। আমার ধারণা সে কালে গৃহ এবং গ্রাম থেকে বেশী দূরবর্তী এলাকায় নারীর পক্ষে সেভাবে ভূমিকা রাখা সম্ভব ছিল না বলে গারোদের মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কিংবা রাষ্ট্র গড়ে উঠতে পারে নাই। অথচ সকল গারো যে যেখানে থাকুক মান্দি পরিচয় সচেতন ছিল এবং পার্শ্ববর্তী অন্যান্য পুরুষতান্ত্রিক সমাজ থেকে নিজেদের স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় সদা তৎপর ছিল। এটাকে বলা যায় মাতৃতন্ত্র-কেন্দ্রিক সামাজিক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি তাদের এক অভিন্ন বন্ধনে বেঁধেছিল। সুতরাং কয়েক হাজার বর্গকিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত এক অঞ্চলে বসবাসকারী সকল গারো সকল বিচ্ছিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্য সত্ত্বেও এক অভিন্ন পরিচয় এবং সংস্কৃতির মাধ্যমে নিজেদের মধ্যে ঐক্য অনুভব করত।

এই বাস্তবতায় গারো ঐক্যের জন্য আর কোনও সামাজিক প্রতিষ্ঠান বা শক্তির প্রয়োজন হয় নাই। যেমন স্থায়ী সেনাবাহিনী, রাষ্ট্র বা সরকার কিংবা ধরা যাক আদিম পর্যায়ে থাকবার সময়ে উপজাতীয় পরিষদ বা নেতা। এ জাতীয় কোনও কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়াই স্মরণাতীত কাল থেকে গারো সমাজ প্রায় সমধর্মী বৈশিষ্ট্য ও স্বাধীন সত্তা নিয়ে টিকেছিল।

আদিম গারো সমাজের সঙ্গে এ ক্ষেত্রে প্রাচীন কালের অত্যুন্নত সিন্ধু সভ্যতার যেন বিস্ময়কর মিল। দশ-বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত এক মহাসভ্যতায় বিস্ময়করভাবে অনেক অভিন্নতা বা সমরূপতা খুঁজে পাওয়া যায়। নগর পরিকল্পনায় যেমন যথেষ্ট সাদৃশ্য দেখা যায় তেমন সর্বত্র দেখা যায় একই লিপিমালা, ওজন, দৈর্ঘ্যের মাপ এবং বিভিন্ন ব্যবহার্য সামগ্রীর মধ্যে সাদৃশ্য বা সমরূপতা। বুঝা যায় অসাধারণভাবে শক্তিশালী একটা কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান বা সংস্থা থেকে সমগ্র সভ্যতাকে সংগঠন, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হয়েছে। অথচ তার কঠোর হস্তের উপস্থিতি কোথায়ও দেখা যায় না। প্রত্নতন্ত্রের রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী খ্রীষ্টপূর্ব ২৬০০ অব্দকাল থেকে খ্রীষ্টপূর্ব ১৯০০ অব্দকাল পর্যন্ত ৭ শত বৎসর কাল স্থায়ী এই সভ্যতায় একটা কেন্দ্রীয় শাসনের অস্তিত্ব সম্পর্কে ধারণা করা গেলেও কোনও শাসক ব্যক্তির অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায় না। অনুমান করা যায় রাষ্ট্র বা সভ্যতার প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিবৃন্দ একটা কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে নির্দিষ্ট নিয়মে রাষ্ট্র বা সভ্যতাকে পরিচালনা করত।

তবে বৃহৎ নগরগুলির আয়তনের নৈকট্য থেকে সেই কেন্দ্র কোনটা ছিল সেটা ধারণা করা কঠিন হয়। হয়ত জনপ্রতিনিধিরা যখন যেখানে একত্র হত সেটাই তখন রাজধানী হিসাবে পরিগণিত হত।

বিশেষত সেই কালে অত বৃহৎ সভ্যতায় নারীর ভূমিকার প্রাধান্য থাকবার কারণ ছিল না। সুতরাং বুঝা যায় সে কালের নিয়মে সেখানে পুরুষ প্রাধান্য থাকবার কথা। কিন্তু সেখানে নারীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকবার সম্ভাবনাকে অস্বীকার করা যায় না। বিশেষত সিন্ধু সভ্যতার অহিংস বৈশিষ্ট্য বিস্ময় জাগায়। আর সকল পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতা থেকে এই সভ্যতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। সেখানে যুদ্ধাস্ত্রের পরিমাণ এত কম এবং সেগুলি এত নিম্নমানের যে প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন যে, সিন্ধু সভ্যতায় স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না এবং ফলত রাষ্ট্রই ছিল না।*

--------------------------------------

* দেখুন ˸ Jim G. Shaffer and Diane A. Lichtenstein, ‘The concepts of “cultural tradition” and “paleoethnicity” in South Asian archaeology,’ in, The Indo-Aryans in Ancient South Asia: Language, Material Culture and Ethnicity (1997), pp. 134-137.

--------------------------------------

আমি অবশ্য এমন ধারণার সঙ্গে একমত নই। সিন্ধু সভ্যতা প্রধানত যুদ্ধ নির্ভর না হওয়া মানে এই নয় যে, তার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা ছিল না। প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা না রাখা মানে আশপাশের ভিন্ন জনগোষ্ঠীর মানুষদেরকে সিন্ধু সভ্যতার বিপুল সম্পদ লুণ্ঠনের জন্য আক্রমণে প্ররোচিত করা। সুতরাং সভ্যতা রক্ষার জন্য সভ্যতার কেন্দ্রে না হলেও প্রান্তে স্থায়ী প্রতিরক্ষা নিশ্চয় ছিল। এখনও তার রূপ স্পষ্ট নয় মানে এই নয় যে, বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার সামরিক সক্ষমতা তার ছিল না।

এদিক থেকে দেখলে গারো সমাজের সঙ্গে তার মিল। গারো সমাজ অবশ্য স্থায়ী বা নিয়মিত সেনাবাহিনী রাখত না। কিন্তু তাতে কী হয়েছে? প্রতিটি সক্ষম গারো পুরুষই ছিল এমন যোদ্ধা যে গ্রাম সমাজের ডাকে মুহূর্তের মধ্যে ‍যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। এই অবস্থায় যতই শান্তিপ্রিয় হোক গারো গ্রামগুলিতে যুদ্ধের জন্য সদাপ্রস্তুত যুববাহিনী থাকত। এটা সহজবোধ্য যে, এছাড়া তাদের পক্ষে আগ্রাসী ও আক্রমণাত্মক পুরুষতন্ত্রের হাত থেকে তাদের স্বাধীনতা এবং মাতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব হত না।

আরও আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতার প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা সম্পর্কে হয়ত ধারণা করা যাবে। তবে গারো সমাজের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা একটা শান্তিপ্রিয় সমাজের প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা সম্পর্কে অস্পষ্ট হলেও একটা ধারণা নিতে পারি। অর্থাৎ যুদ্ধবাদী না হলেও সিন্ধু সভ্যতা বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষায় সক্ষম সভ্যতা ছিল।

এমন অনুমান করা কি অযৌক্তিক হবে যে, মাতৃতন্ত্র থেকে অনেকটা অগ্রসর হলেও মাতৃতন্ত্রের বেশ কিছু প্রভাব ও বৈশিষ্ট্যকে ধারণ ক’রে যারা বৃহদায়তন কৃষি এবং নগর সভ্যতা নির্মাণ করেছিল তাদের সভ্যতা হল সিন্ধু সভ্যতা? সুতরাং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি দ্বারা ফুটে উঠেছে এমন নম্র গণতান্ত্রিকতা, শান্তিপ্রিয়তা এবং সম্পদ ও ক্ষমতা বণ্টনে এতটা ভারসাম্যপূর্ণ সভ্যতার চিত্র!

সমগ্র উপমহাদেশ সিন্ধু সভ্যতার ভাষা ও সংস্কৃতি দ্বারা আজও গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে আছে। যেমন বাংলা ভাষা। সংস্কৃত ভাষার আদিরূপ বৈদিক ভাষা যে ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রধান এবং সর্বজনীন ভাষা সে সম্পর্কে আমার সন্দেহ নাই। এ নিয়ে আমি আমার বিভিন্ন লেখায় আলোচনা করেছি। সুতরাং এ বিষয়ে এখানে আর আলাচনা করব না। এখানে শুধু এইটুকু বলি যে, আমাদের এই বাংলা ভাষা গঠনে সংস্কৃত তথা বৈদিক ভাষার ভূমিকা অপরিমেয়। অবশ্য ভারতবর্ষের প্রায় সকল প্রধান ভাষা সম্পর্কে এ কথা প্রযোজ্য।

ভাষার প্রশ্ন যখন এল তখন বলি যে, গারো জনজাতির উপরেও আমি বৈদিক ভাষার প্রভাব দেখতে পেয়েছি। আমার মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধানের সময়ে গারো ভাষা সম্পর্কে আমি যেটুকু খোঁজ নিয়েছিলাম তা থেকে অবশ্য গারো ভাষা সম্পর্কে তেমন কোনও সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায় না। তবে গারো ভাষার কিছু শব্দের মধ্যে আমি বৈদিক ভাষার ছায়া দেখতে পেয়েছি। যেমন আমার সন্দেহ হয়েছে যে, গারো জনজাতির পরিচয় সূচক নাম মান্দি বৈদিক মনু কিংবা মনুষ্য থেকে আগত কিনা। গারো ভাষায় ধর্মকে বলা হয় থরম। বুঝা যায় ধর্ম থেকে ধরম, এবং ধরম থেকে থরম শব্দ এসেছে। আমার কাছে এখন সবচেয়ে ইঙ্গিতবাহী মনে হচ্ছে গারোদের নামের ক্ষেত্রে বৈদিক বা সংস্কৃত শব্দসম্ভারের প্রাধান্য।

গারোরা মায়ের পদবী ধারণ করে। ফলে প্রত্যেকের নামের শেষে মাতৃসূত্রে প্রাপ্ত পদবী ব্যবহার হয়। যেমন দ্রং, রিছিল, স্নাল, ম্রং ইত্যাদি। কিন্তু তাদের নামগুলি হয় সাধারণত বৈদিক বা সংস্কৃত শব্দজাত, যেগুলিকে বাংলা নামের মতো মনে হতে পারে। যেমন সঞ্জীব, অঞ্জন, উত্তম, সুষমা, চিত্রা, অনন্যা ইত্যাদি।

আরও তো আদিবাসী এ দেশে আছে। যেমন সাঁওতাল, মুন্ডা ইত্যাদি। তাদের ক্ষেত্রে এমনটা কম ঘটে। অর্থাৎ তারা যে শুধু তাদের পদবীতে ভিন্ন তা-ই নয়, তাদের নামেও নিজ ভাষার শব্দ ব্যবহারে সচেতন। আমার ধারণা বিশেষ করে আদিবাসী জনজাতিগুলি নিজেদের ভাষা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষায় বেশী রক্ষণশীল হয়। সুতরাং নিজেদের নামের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে রক্ষণশীলতা লক্ষ্যণীয়।

কিন্তু গারোদের মধ্যে এমনটা নয় কেন? কোথায়ও থেকে তারা বৈদিক ভাষার উত্তরাধিকার নিয়ে এসেছিল বলে কি তাদের নামকরণে বৈদিক বা সংস্কৃতজাত শব্দসম্ভারের এমন প্রভাব? অর্থাৎ গারো জনজাতি কি সিন্ধু সভ্যতার উৎসজাত কোনও জনগোষ্ঠী যারা সেখান থেকে যে উত্তরাধিকার নিয়ে এসেছে তার কিছুটা হলেও আজ অবধি ধারণ করে চলেছে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির মধ্য দিয়ে?

প্রাণী জগতে পিছনে ফিরবার দৃষ্টান্ত আছে। যেমন আমরা যেগুলিকে তিমি মাছ বলি সেগুলি এক সময় পানি থেকে উঠে আসা ডাঙ্গার প্রাণী ছিল। অনেক লক্ষ বছর ডাঙ্গায় থাকবার পরেও এক সময় তারা পানিতে ফিরে গিয়ে জলজ প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। তবে ডাঙ্গায় অর্জিত কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতো ফুসফুস এবং তার ব্যবহার নিয়ে গেছে। মানুষও তো অবস্থার চাপে সামনে যেমন যায় তেমন পিছনেও যায়।

হয়ত আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার পতন কালে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মতো কোনও একটা জনগোষ্ঠী বহুপথ পাড়ি দিয়ে গারো পাহাড় এবং সংলগ্ন অঞ্চলকে তাদের চূড়ান্ত আশ্রয় হিসাবে বেছে নিয়ে এখানে নিজেদের জীবনকে পুনর্গঠন করেছে। এবং হয়ত পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতাকে প্রত্যাখ্যান করতে গিয়ে তা ফিরে গেছে মাতৃতন্ত্রে, অথচ অর্জন করেছে চারপাশের পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতার আবেষ্টনকে মোকাবিলা করে হাজার হাজার বছর ধরে টিকে থাকবার সক্ষমতা।

ধর্মের প্রসঙ্গ যখন উচ্চারিত হয়েছে তখন খুব সংক্ষিপ্তভাবে বললে এ কথা বলতে হয় যে, গারোরা এখন বেশীর ভাগ খ্রীষ্টান হলেও ব্রিটিশ অধিকারের পূর্ব পর্যন্ত তাদের মধ্যে ‘সাংসারেক’ হিসাবে পরিচিত যে ‘থরম’ বা ধর্মবিশ্বাস ছিল তাকে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ইত্যাদি ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে মিলানো যায় না। প্রকৃতির শক্তিতে বিশ্বাসনির্ভর কিছু আচার-অনুষ্ঠানের সমষ্টি ছিল এটা। মেঘালয়ে সাংসারেক ধর্ম বিশ্বাসী কতজন আছে তা জানি না। তবে বিশেষত খ্রীষ্টধর্ম প্রসারের ফলে বাংলাদেশের গারোদের মধ্যে এটা বিলুপ্তপ্রায় ধর্ম। আমি অনেক বয়সী ২/৩ জন গারো পুরুষ এবং নারী পেয়েছিলাম যারা তখনও তাদের পূর্বপ্রজন্মের ধর্ম বা ‘সাংসারেক থরমকে’ ধরে রেখেছিলেন। পরবর্তী প্রজন্মের প্রায় কেউ আর সাংসারেক নাই। এ প্রসঙ্গে আমার স্বীকার করতে দ্বিধা নাই যে, সেই সময় আমি সাংসারেক ধর্মকে বুঝবার উপর বিশেষ গুরুত্ব দিই নাই। ফলে এর গভীরে যেমন যাই নাই তেমন এ সংক্রান্ত অনেক তথ্য এখন ভুলেও গেছি। ফলে গারোদের আদি ধর্ম নিয়ে এ ক্ষেত্রে আমার বেশী কথা না বলাই সঙ্গত হবে।

দুইটি দুই ভিন্ন কালের দুই প্রান্তে থাকা দুইটি ভিন্ন বিষয় হলেও এই উভয়ের মধ্যে একটা চমৎকার যোগসূত্রের সম্ভাবনা নিয়ে আমার একটা সাম্প্রতিক ভাবনাকে প্রকাশ করতে চেয়ে এই প্রবন্ধটি লিখলাম।

ভারতীয় উপমহাদেশের পটভূমিতে তুলনায় একটি ক্ষুদ্র জনজাতি হলেও গারোদের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ভূমিকাকে আমার ক্ষুদ্র মনে হয় না। এটা লক্ষ্যণীয় যে, ঐতিহাসিক কাল থেকে উপমহাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় উত্তর-পূর্বাঞ্চলে নারীর মর্যাদা ও নিরাপত্তা অনেক বেশী বিদ্যমান। এমনকি নাগা-মিজোদের মতো ‍পিতৃতান্ত্রিক এবং যুদ্ধপ্রবণ জনজাতিগুলির ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য। আমি অনুমান করি প্রধানত গারো সমাজের অস্তিত্ব বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী নারীর কম-বেশী মর্যাদাসূচক অবস্থান রক্ষার ক্ষেত্রে সাংস্কৃতিক ভরকেন্দ্র হিসাবে কাজ করেছে। ফলে শত্রুপক্ষের নারীও এখানে যে মর্যাদা ও নিরাপত্তা ভোগ করে অন্যত্র সেটা খুব কমই দৃষ্টিগোচর হয়।

(৪) পার্বত্য চট্টগ্রামের অভিজ্ঞতা

পার্বত্য চট্টগ্রামের চাকমাসহ জনজাতিগুলি সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতাও এই ধারণার পক্ষে যায়। সেখানে আমি ২০০০ সালের দিকে প্রায় এক বৎসর কাল ‘আদিবাসী উন্নয়ন কেন্দ্র’ নামে একটি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক বা কনসালট্যান্ট হিসাবে কাজ করি। ১৯৮৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পরবর্তী কালে পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির অন্যতম নেতা এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য রূপায়ণ দেওয়ান এটি প্রতিষ্ঠা করলে আমি তাতে যুক্ত হই। এখানে বলা যেতে পারে যে, পার্বত্য চট্টগ্রাম জন-সংহতি সমিতির কিছু সংখ্যক নেতার সঙ্গে আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবন থেকেই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। সেই সম্পর্কের সূত্র ধরে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তির পর সেখানে আমার যাওয়া এবং বছরকাল থাকা। এই সময় আমি পাহাড়ীদের জীবন সম্পর্কে জানবার কিছু সুযোগ পাই। তবে আজকের আলোচনার প্রসঙ্গ সেটা নয়। এখানে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলি যে সেখানে সব জনজাতি কম আর বেশী পিতৃতান্ত্রিক। বিশেষত সেখানকার প্রধান জাতিসত্তা চাকমারা স্পষ্টরূপে পিতৃতান্ত্রিক। ব্রিটিশ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত পার্বত্য চট্টগ্রামে তাদের স্বাধীন এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র ছিল। কিন্তু পিতৃতান্ত্রিক সমাজ হওয়া সত্ত্বেও চাকমা নারীদের সামাজিক নিরাপত্তা যথেষ্ট পরিমাণে রক্ষিত ছিল। ফলে নারীর অবরোধ যেমন ছিল না তেমন নারী ধর্ষণ জাতীয় অপরাধের জন্য ছিল কঠোর দণ্ডের প্রয়োগ। অবশ্য ধর্ষণ জাতীয় অপরাধ এইসব জনজাতির মধ্যে সচরাচর ঘটত না। সত্যি কথা বলতে কি বাঙ্গালী মুসলিম অভিবাসী কিংবা বহিরাগতরা সেখানে এসব অপরাধের বিস্তার ঘটিয়েছে।

এভাবে মুসলিম অভিবাসন বা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বের বৃহৎ অঞ্চল ব্যাপী নারীর মর্যাদার যে চিত্র আমরা দেখি সেটা আফগানিস্তান কিংবা বর্তমান পাকিস্তান এবং পশ্চিম ভারতসহ এক বিস্তীর্ণ ভূভাগে অকল্পনীয়। এর সঙ্গে পার্বত্য ভূমি কিংবা উপজাতীয় সমাজ ব্যবস্থা থাকা না থাকার সম্পর্ক নাই। কিংবা অন্তত প্রত্যক্ষ কোনও সম্পর্ক নাই সমাজের যুদ্ধপ্রবণতার সঙ্গেও। বরং এটা সম্পর্কিত দীর্ঘকাল ধরে গড়ে তুলা সামাজিক মূল্যবোধ বা সংস্কৃতির সঙ্গে। অনুমান করি এই সংস্কৃতির শক্তির কারণে উপমহাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের জন-জাতিগুলি জঙ্গী বা যোদ্ধা হলেও সাধারণভাবে নারীর প্রতি এতটা শ্রদ্ধাশীল এবং সংবেদনশীল।

তবে এখানে অবস্থিত মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলগুলি নারীর দুর্গত অবস্থাকে সর্বাধিক পরিমাণে তুলে ধরে। যেমন বাংলাদেশ। সেটা আবার সংশ্লিষ্ট অঞ্চল বা সমাজের উপরও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এর মর্মে আছে বিশেষত মুসলিমদের ধর্ম হিসাবে ইসলাম। সেটা অবশ্য ভিন্ন আর এক আলোচনার বিষয়। এই আলোচনার সঙ্গে সম্পর্কিত না হওয়ায় এখানে সে প্রসঙ্গে যাব না।

লেখাটা শেষ করবার আগে বলি গারো জনজাতি সম্পর্কে আমি যেসব কথা শুনেছিলাম কিংবা পড়েছিলাম তার কিছু বক্তব্যের প্রতিফলন এখানে ঘটে নাই। যেমন গারোদের উৎসস্থান সম্পর্কে যে সব বক্তব্য আছে তাতে তিব্বত সংক্রান্ত বক্তব্য সর্বাধিক জনপ্রিয়। অর্থাৎ এ মতটাই বেশী প্রচলিত যে, গারোরা তিব্বত থেকে আগত। কিন্তু আমি সেসব আলোচনায় যাই নাই। আসলে মাতৃতন্ত্রের বিষয়কে আর একটু ভিন্ন আঙ্গিক থেকে দেখতে চেয়েছি। সে ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতা আমার নিকট বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দিয়েছে। হয়ত উপমহাদেশের প্রায় দুই প্রান্তের দুই কালের দুই জনগোষ্ঠীর মধ্যে একটা হারানো যোগসূত্র আছে। না থাকলেই বা কী? অন্তত বিষয়টা নিয়ে একটু নূতনভাবে ভাবতে ক্ষতি তো নাই?

৪ এপ্রিল – ১১ এপ্রিল, ২০২২

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ