লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ December 16, 2022, 12:00 AM, Hits: 1201
এক
আমরা এখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী ভাষ্যের যুগে বাস করছি। এই যুগের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের গণভাষ্য এখনও নির্মিত হয়নি। বহু প্রশ্নের মিমাংসার জন্য এটা জরুরি। মুক্তিযুদ্ধের গণভাষ্য নির্মাণের ধারায় বর্তমানের এই অবর্ণনীয় দুর্দশা থেকে মুক্তি এবং উন্নত বাংলাদেশের দিকে অভিযাত্রার পথ খুঁজে পেতে পারে সাধারণ মানুষ। কারণ মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী ভাষ্যের ওপর ভর করেই বর্তমান সরকার শোষণ-লুণ্ঠন-নির্যাতন-নিপীড়ন, বিরোধীমত দমন, গুম-খুন, দুর্নীতি-অনিয়ম এবং অর্থ পাচার সহ যাবতীয় অপকর্ম করে চলেছে। আওয়ামী লীগ মুক্তিযুদ্ধের নামে দেশ চালাচ্ছে, কিন্তু তাদের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতার কোনো বিরোধ দেখা যাচ্ছে না। তাদের এইসব অপপদক্ষেপের জন্য কোনো অবস্থাতেই আমাদের কখনও মুক্তিযুদ্ধকে গুরুত্বহীন করলে চলবে না, বরং অতি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধের কাছে যেতে হবে, যেখানে মুক্তির জন্যই জনগণ যুদ্ধটা করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণি গোষ্ঠীর একই উদ্দেশ্যে ছিল না। কারো উদ্দেশ্য ছিল পাঞ্জাবিদের তাড়িয়ে ক্ষমতা নিয়ে শোষণ ও লুটতরাজে মেতে উঠে ব্যাপক ধন সম্পত্তির মালিক হওয়া। দেশকে বাপ দাদার তালুক সম্পত্তি বানানো। তাদের এই উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। এজন্য তারা মুক্তিযুদ্ধের একটি ভাষ্যও নির্মাণ করেছে। এটাই মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী ভাষ্য। এই ভাষ্যে তারা বামপন্থীদের একটা বড় অংশের নীরব সমর্থন উপভোগ করে আসছে। উল্লেখ্য, এই ভাষ্যের সাথে ইতিহাস ঐতিহ্যের কিছু বিষয় ছাড়া বিএনপি, জাতীয় পার্টির মূলগত কোনো প্রভেদ নাই।
অপরদিকে, মুক্তিযুদ্ধে কারো উদ্দেশ্য ছিল পাঞ্জাবিদের তাড়িয়ে শোষণহীন লুণ্ঠনহীন সুখী সমৃদ্ধ, ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এদের উদ্দেশ্য সফল হয়নি, তাদের করণীয় অপূরিত। তারা মুক্তিযুদ্ধের কোনো ভাষ্য নির্মাণ করেননি। এটা নির্মাণ করা জরুরি। বিষয়টি আলোচনায় আনতেই এই লেখার সূত্রপাত।
আমরা জানি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ ও জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুধু নয় মাসের সামরিক তৎপরতা নয়। এই যুদ্ধ হল, ষাটের দশকের উত্থানপর্বের পরিণতি। এই উত্থান পর্বের প্রাথমিক সোপান গড়ে তোলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে তদানিন্তন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাঙলায় বামপন্থী ছাত্র সংগঠন। তাদের নেতৃত্বেই একটি বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের উত্থান ঘটতে থাকে। দ্বিজাতি তত্ত্বের পাকিস্তানের মুসলিম আত্মপরিচয়ে সন্তষ্ট থাকতে পারেনি ওই তরুণ প্রজন্ম। সময়টা ছিল ভিন্ন আত্মপরিচয়ের সন্ধানকাল। নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্নে তারা বিভোর ছিলেন। একই সময়ে ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে মওলানা ভাসানী সালামালেকুম বলে যে জাতীয় মুক্তির লড়াই শুরু করেছিলেন, সেটা তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষাকে মায়ের মত ছায়া দিয়েছিল।
প্রথম থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির নেতাকর্মীদের ওপর দমন-পীড়ন নীতি গ্রহণ করে পাকিস্তানের সরকার। কমিউনিস্টরা প্রথমে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে কাজ করার সিদ্ধান্ত নেয়। এতে দলটির নেতৃত্ব কমিউনিস্টদের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পায়। আওয়ামী লীগের ওপর কমিউনিস্টদের প্রভাব পড়ে। এতে আওয়ামী লীগের মধ্যে কিছুটা অসাম্প্রদায়িক বৈশিষ্টের বিকাশ ঘটে, পাকিস্তানের ওপর থেকে মোহ ভাঙতে শুরু করে এবং গণমুখি চরিত্রের নেতৃত্বের সঙ্গে বিশেষভাবে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে কমিউনিস্টদের একটি গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়। আর মওলানাও সামন্তবাদ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী নেতা হয়ে উঠেন। তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্র সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। এতে তার সঙ্গে আওয়ামী লীগের অপরাংশের বিরোধ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এভাবে মওলানা ভাসানী বনাম হোসেন শহীদ সুহরাওয়ার্দীর দ্বন্দ্ব রাজনীতিতে সামনে চলে আসে। যা পরবর্তিতে ভাসানী-মুজিব দ্বন্দ্বে রূপ নেয়। তবে স্বাধীনতার প্রশ্নে মুজিবের ব্যাপারে ভাসানী নমনীয় অবস্থান গ্রহণ করেন।
দুই
কাগমারী সম্মেলনে ভাসানীর ‘স্লাামালেকুম’ বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের একটি মাইলস্টোন। এর কিছুদিন পরেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব বিভাজিত হয়ে পড়ে। ৫৪’র যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনের পর ১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টির মোর্চায় কিছুদিনের জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন সুহরাওয়ার্দী। তার মন্ত্রিসভা ১৯৫৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত স্থায়ী ছিল।
“১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল সভায় ভাসানী ও সুহরাওয়ার্দীর মধ্যে ছোটখাট সংঘাত হয়েছিল। ভাসানী তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, ১৯৫৬ সালের সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের অধিকার স্বীকৃত হয়নি। সুতরাং, সংবিধান পরিবর্তন ও সংশোধন করে পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসনের সংস্থান রাখার জন্য আওয়ামী লীগকে সক্রিয় হতে হবে। তিনি রাজনৈতিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসনের দাবি জানিয়েছিলেন। তিনি এটাও বলেছিলেন, যদি পূর্ব পাকিস্তানকে আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন প্রদান না করা হয়, তবে এমন দিন আসতে পারে, যেদিন পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানকে বিদায় বলার মতো মনোভাব সঞ্চারিত হতে পারে।’
‘সুহরাওয়ার্দী, তার ভাষণে পূর্ব পাকিস্তানের নেতার মত বক্তব্য না রেখে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষীদের প্রতিনিধি হিসেবে বক্তৃতা করেছিলেন। তিনি বলেন যে, সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তাকে ৯৮ শতাংশ স্বায়ত্বশাসনের সংস্থান করা হয়েছে। সুতরাং এই দাবির কোনো ভিত্তি নাই। পূর্ব পাকিস্তান যে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষীদের দ্বারা শোষিত হচ্ছে, এটাও তিনি অস্বীকার করে বলেন যে :‘আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্ষমতায় আছে, পশ্চিম পাকিস্তানও অভিযোগ করতে পারে যে তারা শোষিত হচ্ছে।’ ওই সভায় আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমেদ, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। তারা কেউই প্রতিবাদ করেননি।”
বোঝা গেল সুহরাওয়ার্দী কখনই পাকিস্তানের কাঠামো ভাঙতে চাননি, এসব প্রশ্ন তিনি বরাবরই বিরোধীতা করতেন। তিনি সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদের সেবক ছিলেন। আর ভাসানী ছিলেন ঠিক তার উল্টোটা। বিরোধ ছিল অমিমাংসেয়। ফলে আওয়ামী লীগ ভাঙল। ভাসানী ন্যাপ গঠন করলেন। কমিউনিস্টরা যোগ দিলেন নতুন দল ন্যাপে। তখন আর দলের ভেতর থেকে স্বাধিকার আন্দোলনে আর কোনো বাধাই থাকল না। বাধা থাকল না সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্তবাদ বিরোধী লড়াইয়ে। দলের ভেতর থেকে না থাকলেও বাধা আসতে থাকে সাবেক দল আওয়ামী লীগ থেকে। শুধু স্বাধিকারের লড়াইয়ের কারণে ওই সময় আওয়ামী লীগের নির্যাতন ও নিপীড়ন সইতে হয়েছে কমিউনিস্ট ও ন্যাপকে।
এ ব্যাপারে আহমেদ ছফা বলেছেন।
“বাংলাদেশি রাজনীতি সংস্কৃতির যা কিছু উজ্জ্বল অংশ তার সিংহভাগই বামপন্থী রাজনীতির অবদান। ভাষা আন্দোলনের পরবর্তী সময়ে বামপন্থী রাজনীতির উত্তাপ থেকেই বাঙালী সংস্কৃতির নবজন্ম ঘটেছে। সামন্ত সংস্কৃতির প্রভাবমুক্ত একটি নতুনতর সংস্কৃতির উন্মেষ বিকাশ লালনে বামপন্থী সংস্কৃতিসেবীদের যে বিরাট সাফল্য এবং ত্যাগ; তিল তিল করে সংস্কৃতির আসল চেহারাটি ফুটিয়ে তোলার কাজে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা যে শ্রম, মেধা ও সময় ব্যয় করেছেন, সে কাহিনী এখন প্রায় বিস্মৃতিতে বিলীন হতে চলেছে। তাদের সাফল্যের পরিমাণ হয়ত আশানুরূপ ছিল না কিন্তু সূচনাটি করেছিলেন এবং অনেকদিন পর্যন্ত সংস্কৃতিকে লালন করেছেন। সংস্কৃতিতে উত্তাপ, লাবণ্য এবং গতি সঞ্চার করার ব্যাপারে বামপন্থী সংস্কৃতিকর্মীরা অনেক কিছু দিয়েছেন। সেই সব মহান অবদানের কথা শ্রদ্ধাবনত চিত্তে স্মরণ করার প্রয়োজন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে।
বামপন্থী রাজনৈতিক সংগ্রাম থেকেই বাংলাদেশের জাতীয়তার বোধটি প্রথম অঙ্কুরিত এবং মুকুলিত হয়। বাঙালী জাতীয়তার প্রাথমিক সোপানগুলো বামপন্থী রাজনীতির নেতাকর্মীরাই নির্মান করেছিলেন। সেজন্য তাদের জেল জুলুম অত্যাচার নির্যাতন কম সহ্য করতে হয়নি। সেই সময়ে আওয়ামী লীগ দলটির কাছ থেকেও তাদের কম নিগ্রহ ভোগ করতে হয়নি। পাকিস্তানের সংহতি বিনাশকারী, বিদেশি গুপ্তচর, ইসলামের শত্রু এই ধরণের অভিযোগ বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীদের বিরুদ্ধে হামেশাই উচ্চারিত হত। এসব লাঞ্ছনা সহ্য করেও বামপন্থী রাজনীতির নেতা এবং কর্মীরা রাষ্ট্রের ভ্রূণ রোপন করতে পেরেছিলেন। বর্তমানের বাংলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষেরা যেটুকু সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক অধিকার ভোগ করে করেন, তার পেছনে রয়েছে বামপন্থী রাজনীতির বিপুল পরিমাণ অবদান। বামপন্থী রাজনীতিই শ্রমিক কৃষক নিম্নবিত্ত সমস্ত নির্যাতিত মানুষকে অধিকার আদায়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে, সংগঠিত করেছে এবং আন্দোলনে টেনে এনেছে।” (সাম্প্রতিক বিবেচনায় বুদ্ধিবৃত্তির নতুন বিন্যাস, আহমদ ছফা। খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, পৃ. ৩৫-৩৬)
তিন
ভাসানীর নেতৃত্বে কমিউনিস্টরা স্বাধীকার আন্দোলনের যে জমিন নির্মাণ করেছিলেন এবং তখনকার পূর্ববাংলার রাজনীতির যে গতিমুখ ঠিক করেছিলেন, তার ধারাবাহিকতা রক্ষা হয়নি, উল্টো লাইনচ্যুৎ হয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে মধ্যষাটে তারা বিভ্রান্তি-বিচ্যুতি-বিভাজনের প্যাকে পরে যান। এটাই ইতিহাসের সবচেয়ে বড় দুঃসংবাদ, ভোগান্তি ও দুর্দশার মূল কারণ।
স্বাধীকার আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভাসানী ৬৫ সালে জুন মাসের প্রথম সপ্তাহেই ১৪ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর কিছুদিন পর ১৯৬৬ সালে রুশ-চীন মহাবিতর্কে কমিউনিস্ট পার্টিও চীনপন্থী ও রুশপন্থী নামে বিভাজিত হয়। এর প্রভাবে ন্যাপও বিভাজিত হয়। ন্যাপ ও কমিউনিস্টদের একাংশ মওলানার পক্ষে, আরেকাংশ বিপক্ষে অবস্থান নেয়। পক্ষে অবস্থান নিলেও কমিউনিস্টদের ওই অংশ মওলানার স্বাধীকারের রাজনীতি ছেড়ে চীনের গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরাও রাজনীতি শুরু করেন। শ্রেণিসংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রামের মেলবন্ধনের করণীয় হারিয়ে ফেলে পর্যায়ক্রমে খন্ড বিখন্ড হতে হতে রাজনীতিতে প্রাসাঙ্গিকতা হারাতে থাকেন। ভাসানীর স্বাধীকার ধারার সম্ভবনার মৃত্যু ঘটে। এমন এক পর্বে ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের নেতৃত্বে শুরু হয় বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারার ৬ দফার আন্দোলন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফার ওপর সওয়ার হয়ে ৬ দফা পৌঁছে যায় জনগণের কাছে। ৬ দফার আন্দোলন পায়ের নীচে পেয়ে যায় ভাসানীর নির্মিত তৈরি জমিন। প্রবল মুক্তি আকাক্সক্ষী জনগোষ্ঠীর সামনে দিশা হিসেবে আবির্ভূত হয় ৬ দফা। অপরদিকে, ভাসানীর সেই স্বাধীকার আন্দোলনের উজ্জ্বলতা ফিকে হতে থাকে। তার স্বাধীকারের আন্দোলন গ্রাস করে নিতে থাকে ’৬৬ র ছয় দফার আন্দোলন।
অপরদিকে, ছাত্রলীগের নিউক্লিয়াসপন্থীদের তৎপরতায় স্বাধীনতার রাজনীতির নতুন পর্ব শুরু হয়। ছাত্রলীগের এই অংশটিই শেখ মুজিবুর রহমানের কাল্ট গড়ে তোলে এবং তার মাধ্যমেই আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে প্রতিস্থাপন করে। ছয় দফা নিয়ে প্রথম হরতাল সফল করে ছাত্রলীগের এই অংশই।
স্বভাবতই: ভাসানীর আন্দোলনের সকল অর্জন গিয়ে জমা পড়ে শেখ মুজিবুর রহমানের ঝুলিতে। যার ধারাবাহিকতায় ঊনসত্তরের গণঅভ্যূত্থান পরবর্তিতে সত্তরের নির্বাচনের ভূমিধ্বস বিজয় শেখ মুজিবুর রহমানকে বিশালাকার রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত করে। আর শেখ মুজিবের নামে ও নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়।
অপরদিকে, আওয়ামী লীগের পক্ষে ছিল রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে ভারতের এবং রাশিয়ার সার্বিক সহযোগিতা। কমিউনিস্টরা জানপ্রাণ দিয়ে স্বাধীকার ও স্বাধীনতার রাজনৈতিক জমিন প্রস্তুত করলেও, মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিতে প্রধানত: উপরোক্ত ঘটনাই শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগকে নেতৃত্বের আসনে পৌঁছে দেয়।
অপরদিকে, পূর্ববাংলায় ক্রিয়াশীল সহযোগী কমিউনিস্ট পার্টিকে এড়িয়ে সেই সময়ে ইন্দিরা মুজিব বলয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়ায় তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন। আর রুশপন্থী বলে কমিউনিস্টদের পরিচিত অংশটি সেখানে অনুঘটকের কাজ করে মাত্র। তখনকার সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের কাশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের লড়াইকে সমর্থন করেনি। এই কৌশল মার্কসবাদ লেনিনবাদের সঙ্গে সঙ্গতিশীল নয়।
অপরদিকে, রাশিয়ার সঙ্গে বিরোধের জের ধরে গণচীন বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের বিপক্ষে অবস্থান নেয়। এর প্রভাব পড়ে চীনপন্থী নামে পরিচিত কমিউনিস্টদের আরেকাংশের ওপর। চীন কশ্মিরের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে অবস্থান নেয়। এটাও দেশটির পররাষ্ট্রনীতির কৌশল, যা মার্কসবাদ লেনিনবাদের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে রাশিয়া ও চীনের অবস্থান এবং দেশের বিভক্ত কমিউনিস্টদের অধিকাংশ গ্রুপের তত্ত্বগত অবস্থান ছিল বিভ্রান্তিমূলক। যা তাদের কর্মীদের অসীম সাহস ও অপ্রতিরোধ্য আকাঙ্ক্ষাকে দমিয়ে রাখে। এত বিভক্তি ও এত বিভ্রান্তি সত্ত্বেও এসব হতোদ্যম বামপন্থার সম্মিলিত সামরিক তৎপরতা ছিল অপরিমেয়। যশোর, নড়াইল, খুলনা, সাতক্ষীরার বিস্তৃীর্ণ এলাকা ৬ মাস মুক্ত রেখে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল পূর্বপাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল) এর নেতাকর্মীরা। চট্টগ্রাম দক্ষিণ জেলায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় নেতা কমরেড আহমদ হোসেনের নেতৃতে শক্তিশালী প্রতিরোধ যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টির নেতা সিরাজ সিকদারের নেতৃত্বে বরিশালের পেয়ারা বাগানে, কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ববাংলার সমন্বয় কমিটির নেতৃত্বে নরসিংদীর শিবপুর, বাগেরহাট পিরোজপুর এবং বরিশালে; সিরাজগঞ্জে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির ইসলামাইল গ্রুপের নেতৃত্বে, রাজশাহীতে মাইতি গ্রুপের নেতৃত্বে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছে। এছাড়া রংপুর, পাবনা, টাঙ্গাইল, নোয়াখালীতে প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়েছে। কোথাও পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (এমএল), কোথাও পূর্ববাংলা সর্বহারা পার্টি ও কোথাও পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে এসব প্রতিরোধযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। এমন অসংখ্য ঘটনা এখনো চাপা পড়ে আছে। কুমিল্লার বেতিয়ারায় ন্যাপ সিপিবি ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীরা পাক হানাদারদের হামলায় শহীদ হয়েছেন। ২৫ মার্চের ক্রাকডাউনের পর অন্তত ছয়মাস দেশে প্রতিরোধ যুদ্ধ জারি রেখেছিল বামপন্থী কমিউনিস্টরাই। ছাত্র ইউনিয়নের সকল গ্রুপ, ন্যাপ, কমিউনিস্টদের বিভিন্ন গ্রুপ দলীয় পরিচয় অগ্রাহ্য করে সাধারণ মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সাহসের সঙ্গে যুদ্ধ করেছে। এছাড়া ভারত ফেরত মুক্তিযোদ্ধাদের গুরুত্বপূর্ণ অংশের কমিউনিস্ট বিরোধী অবস্থানের কারণে বামপন্থীদের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মূলশ্রোতে ভূমিকা রাখা দূরহ হয়ে উঠে। এসব নিয়ে এখনো বিস্তৃত গবেষণার দাবি রাখে। মুক্তিযুদ্ধের এসব ভাষ্য এখনো নির্মিত হয়নি।
চার
বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী ধারার সবচেয়ে এগিয়ে থাকা অংশ কারা? প্রধান নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বন্দিত্ব বরণ করে পাকিস্তানে থাকায় আওয়ামী লীগের মধ্যে দুইটি ধারা স্পষ্ট। এক. তাজ উদ্দিন ধারা, দুই. খন্দকার মোস্তাক আহমেদ ধারা। এরমধ্যে তাজ উদ্দিনের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। তিনিই মুজিব নগর সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী। অপরদিকে, স্বাধীনতার প্রশ্নে নির্ভরযোগ্য না হলেও খন্দকার মোস্তাক আহমেদই আওয়ামী লীগের মূল লোক।
অপরদিকে ছাত্রলীগের মধ্যেও ছিল দুই ধারা। সিরাজুল আলম খানের নেতৃত্বে স্বাধীনতাপন্থী ধারা এবং শেখ ফজলুল হক মণির নেতৃত্বে স্বাধীকারপন্থী ধারা। ৭২’র ১০ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান দেশে আসার পর বছরটাও গড়াতে দেননি, তিনি তাজ উদ্দিনকে বরখাস্ত করেন এবং সিরাজুল আলম খানের অংশকে দূরে ঠেলে দেন এবং তাদের আলাদা হতে বাধ্য করেন। খন্দকার মোস্তাক এবং শেখ ফজলুল হক মণির ধারাই বর্তমানের আওয়ামী ধারা। মুক্তিযুদ্ধচলাকালে এই দুই নেতৃত্বের কাজই ছিল তাজ উদ্দিনকে বাগড়া দেওয়া এবং কখনও কখনও চরম বিরোধে জড়িয়ে পড়া। আর মোস্তাক তো পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করার জন্য দেন দরবারও করেছিলেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমসহ জাসদ-সিপিবি-ওয়ার্কার্স পার্টি সেই সময় মূলত ছয় দফার ধারায় মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। বিশেষত ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাসদ যুদ্ধোত্তর একটি সময় পর্যন্ত সতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখার চেষ্টা করে গেছে। এই সময়কালে মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ান এতটা হালে পানি পায়নি। সম্প্রতি জাসদ ও ওয়ার্কার্স পার্টি সেই সতন্ত্র অবস্থান পরিত্যাগ করে জঙ্গিবাদ মোকাবেলার নামে বর্তমানের আওয়ামী ধারায় নিজেদের বিলিয়ে দিয়েছে। এতে আওয়ামী বয়ান এখন বাধাহীনভাবে সুপ্রতিষ্ঠিত। এরমধ্যে অপর দলগুলোর আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয়তা ও দুর্বলতা আগের মতই অটুট রয়েছে। সবমিলে মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে আওয়ামী লীগের একচ্ছত্র প্রভাব তৈরি হয়েছে। তারা এখন যা বলছে, তাই সত্য হয়ে যাচ্ছে। হেফাজতের মত চরম সাম্প্রদায়িক ও প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির পৃষ্ঠপোষক হয়েও আওয়ামী মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নহীন থাকছে।
অপরদিকে, ছয় দফার মুক্তিযুদ্ধের বাইরে যারা মুক্তিযুদ্ধে করেছেন। তারা মুক্তিযুদ্ধের সতন্ত্র ভাষ্য নির্মাণ করতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে তারা মুক্তিযুদ্ধকে ধারণ করার প্রশ্নে উদাসীন থেকেছেন। সেক্ষেত্রেও আওয়ামী লীগ সুবিধার জায়গায় থাকে। মুক্তিযুদ্ধে তত্ত্বগত বিভ্রান্তির বিচারমূলক পর্যালোচনা ও আত্মসমালোচনা ছাড়া ওই কাজ করা তাদের জন্য দুরহ।
বাস্তবতই মুক্তিযুদ্ধের দুই ভাষ্য। আওয়ামী ভাষ্য এবং গণভাষ্য। আমরা এখন আওয়ামী ভাষ্যের যুগে বাস করছি। আওয়ামী ভাষ্য দিয়ে ক্ষমতায় গিয়ে লুটপাট করা যায়। অর্থ পাচার করা যায়। দুর্নীতি ও অনিয়ম করা যায়। জাতিগত সংখ্যালঘুদের ওপর হামলা ও উচ্ছেদ করা যায়। বিরোধী মতকে দমন করা যায়, তাদের ওপর নির্যাতন করা যায়। গণদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী উন্নয়নের নামে লুণ্ঠন করা যায়। রাষ্ট্রীয় সম্পদ ও জাতীয় সম্পদ লুট করা যায়। দেশে অরাজকতা তৈরি করা যায়। সাম্প্রদায়িকতার সঙ্গে সমঝোতা করা যায়। কিন্তু গণভাষ্যের মুক্তিযুদ্ধে শুধু নিপীড়িতের স্বার্থই দেখা সম্ভব।
মুক্তিযুদ্ধের গণভাষ্য নির্মিত হয়নি। এটা নির্মাণ করা দরকার। তার প্রধান শর্ত হল,
১. কমিউনিস্টদের আত্মসমালোচনা গ্রহণ করা।
২. ভাসানী কেন পারলেন না, তার কারণ নির্মোহভাবে অনুসন্ধান করা।
৩. মুক্তিযুদ্ধের আওয়ামী বয়ানের স্বরূপ উম্মোচন করা।
কাজটিতে এখনই হাত লাগানো জরুরি। কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুণরুত্থানের স্বার্থেই এটা জরুরি। আমরা কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুনরুত্থানে আস্থাশীল।