লিখেছেনঃ মো. শহীদুল্লাহ, আপডেটঃ January 6, 2023, 12:00 AM, Hits: 1462
এক
আফগানিস্তান মধ্য এশিয়ার দেশ। দেশটির উত্তরে রয়েছে অধুনাবিলুপ্ত সোভিয়েত ইউনিয়নের তুর্কিস্তান, উজবেকিস্তান, তাজিকিস্তান। পশ্চিমে ইরান এবং পূর্ব-দক্ষিণে পাকিস্তান। আফগাস্তিানের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে রয়েছে চীনের সিংকিয়াং প্রদেশের উইঘুর ও কাশ্মিরের বিতর্কিত অঞ্চল হুন্জা। দেশটি মালভূমি ধরনের পার্বত্যময় দেশ। আয়তন ৬ লাখ ৪৭ হাজার ৫ শ’ বর্গ মাইল। রাজধানী কাবুল।
এই লিখাটি যখন লিখছি তখন আফগানিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতা তালেবান নেতাদের হাতে, বিশ বছর পর এবার তারা বলতে গেলে বিনারক্তপাতেই রাজধানী কাবুলের নিয়ন্ত্রণ হাতে পেয়েছেন। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত এক চুক্তি অনুয়াযী তালেবান নেতারা ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট কাবুলের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তবে কাবুলের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগেই দেশটির ষাট-পয়ষট্টি ভাগ এলাকা তারাই শাসন করছিলেন। গত ২০ বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্র তথা পাশ্চাত্য শক্তির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক পরিকল্পনা ও পরামর্শ মত যে কয়জন আফগান নেতাকে দেশটির ক্ষমতার বসানো হয়, তারা জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাননি। উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া হাইব্রিড নেতাই থেকে গেছেন। তাছাড়া হামিদ কারজাই ও আশরাফ গনির সরকার ছিল সমাজের উপর তলার সুবিধাভোগী শহুরে এলিটদের সরকার। এ সব সরকারের নেতা, মন্ত্রী ও সামরিক-বেসামরিক আমলারা ছিলেন আখের গোছানো ও পকেট ভরার তালে। তাদের জীবন ছিল ভোগ-বিলাসে ভরা। তাদের দুর্নীতি ও বিদেশে মুদ্রা পাচার এখন আফগানিস্তানের মানুষের কাছে সুবিদিত। এসব কারণে আফগান জনগণ তালেবান নেতাদেরকেই তাদের শাসক হিসাবে মেনে নিয়েছে। হামিদ কারজাই বা আশরাফ গনিদের নেতা হিসাবে গ্রহণ করেনি। আশরাফ গনি যেভাবে হেলিকপ্টার ভর্তি টাকা নিয়ে দেশ ছাড়লেন তাতেই কিন্তু বোঝা যায় তিনি কী ধরনের নেতা ছিলেন!
দোহা-চুক্তি মোতাবেক তালেবান নেতাদের ওপর কিছু বিষয় মেনে চলার দায় বর্তেছে। সেগুলো হচ্ছে — নারীর শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন বন্ধ না করা। ধর্মীয় ও মাজহাবগত সংখ্যালঘু এবং ভিন্নমতের মানুষ ও সামাজিক সংগঠনকে মতপ্রকাশের এবং সংগঠন করার স্বাধীনতা নিশ্চিত করা। সরকার ও প্রশাসনে বিভিন্ন জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা। অন্যদিকে যে আফগানরা এনজিও, জাতিসংঘ মিশন এবং গত ২০ বছর ধরে সরকারি-বেসরকারি অফিসে কাজ করেছেন তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধমূলক শাস্তি না দেওয়া। এ ছাড়া তালেবান নেতারা এবার ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়েছেন, নিজ দেশের বাইরে তাদের কোনো এজেন্ডা নেই, আফগানিস্তানের মাটিতে কোনো সন্ত্রাসী বা জিহাদি গোষ্ঠীকে তারা ঠাঁই দেবেন না।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে- তালেবান সরকার কী এসব শর্ত মানবে? যদি মানে তা হলে বুঝতে হবে গত বিশ বছরে তালেবান নেতৃত্ব অনেক বাস্তববাদী হয়েছে। নিজ দেশ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানামুখী ঘটনার অভিঘাতে তারা নিজেদের পাল্টিয়েছেন। পরিবর্তনশীল জাতীয়-আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির সঙ্গে খাপখাইয়ে চলতে শিখেছেন। অন্য দিকে গভীর সংশয় রয়েছে, তালেবান মোটেই পাল্টায়নি, যা তাই আছে। আফগানিস্তানের সমাজে এবং বহির্বিশ্বে এই যে সংশয়, এর যে বাস্তবতা নেই তা দৃঢ়তার সাথে বলা যাচ্ছে না। কারণ সরকার গঠনের পর তালেবান নেতারা দেশটিতে নারী অধিকার ও শিক্ষা এবং সংখ্যালঘুদের প্রতিনিধিকে সরকারে স্থান দেওয়ার ব্যাপারে কোনো ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়নি। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে দেশ চলবে ইসলামের শরিয়াহ মোতাবেক এবং তালেবান মোল্লাদের শাসন পরিষদের (রাহবারি শুরা) নীতি-আদর্শ অনুযায়ী। সুন্নি মোল্লাদের এই শাসন পরিষদে অন্য মুসলিম জাতি-গোষ্ঠীর প্রতিনিধিকে স্থান দেওয়া হয়নি। এমন কী তালেবানের মধ্যেও যারা একটু বাস্তববাদী ও উদার প্রকৃতির নেতা, তারা কিন্তু তালেবান মন্ত্রীসভা কিংবা শাসন পরিষদে স্থান পাননি। গণ-প্রজাতান্ত্রিক আফগানিস্তানের নাম পাল্টিয়ে রাখা হয়েছে ‘আফগানিস্তানের ইসলামি আমিরাত’। এতেই বুঝা যাচ্ছে, রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পাওয়ার জন্য তালেবান নেতারা দোহা-চুক্তিতে উদারবাদী অনেক শর্ত স্বীকার করে নিলেও বাস্তবে তারা সেদিকে যাবেন না। আরেকটা কথা এখানে বলে রাখা ভালো, তালেবান নেতারা যদি দোহা-চুক্তির শর্ত না মানে তাহলে তাদেরকে দিয়ে সেসব শর্ত মানানোর দাবার ঘুঁটি এখন আর যুক্তরাষ্ট্র বা পাশ্চাত্য শক্তির হাতে খুব বেশি নেই। কারণ চীন ও পাকিস্তানের মত শক্তিধর দেশ তালেবানের সঙ্গে রয়েছে। রাশিয়ার পুতিন প্রশাসনও তালেবানের দিকেই ঝুঁকে আছে। রাশিয়া জানিয়ে দিয়েছে, অন্য দেশের ক্ষতি না করে তালেবান যেভাবে পারে সেভাবে তাদের দেশ পরিচালনা করুক, এতে অন্য দেশের মাথা ঘামানো উচিত নয়। আফগানিস্তানকে নিয়ে বিশ্বের পরাশক্তিগুলোর ভূ-রাজনৈতিক টানাপোড়েন কিংবা স্বার্থ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করা আমার এই লিখার উদ্দেশ্য নয়। তাই এ বিষয়ে আর কথা বাড়াচ্ছি না।
যে বুদ্ধিবৃত্তিক তাগিদ থেকে আমার এই লেখা, তা খোলাসা করার জন্য আমি আফগানিস্তানের ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরম্পরা তুলে ধরছি। এবং ওই সব বিষয়ে যৎকিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ উপস্থাপন করছি, যা পাঠককে তালেবান এবং এ ধরনের রাজনৈতিক গোষ্ঠীর মতাদর্শ এবং শাসনতান্ত্রিক আচরণ বুঝতে সহায়তা করবে।
দুই
ইতিহাসের কথা : প্রাচীন ভারতে সিন্ধু সভ্যতাকেন্দ্রিক বৈদিক সাহিত্যে গান্ধার নামে দেশের বর্ণনা রয়েছে। এই গান্ধার নামের জনপদ এখনকার আফগানিস্তানের অনেক এলাকা জুড়ে ছিল। এই গান্ধার বা কান্দার-ই বর্তমানে কান্দাহার প্রদেশের রাজধানী কান্দাহার নগর। দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর। এছাড়া খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতকের ভারতীয় জ্যোতির্বিদ বরাহ-মিহির সংস্কৃত ভাষায় লেখা এক বইয়ে কোনো এক দেশ বুঝাতে ‘আভাগানা’ শব্দটি প্রথম ব্যহার করেন। সেই আভাগানা দেশই কালের পরিক্রমায় বর্তমান আফগানিস্তান হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
‘মহাভারত’ বৈদিক ধর্ম শাস্ত্রের সঙ্গে সম্পর্কিত পৌরাণিক কাহিনীর মহাকাব্য। এই গ্রন্থে গান্ধার দেশের মানুষজনকে অসংস্কৃত ও আর্যসংস্কৃতিবিরোধী বলা হয়েছে। গান্ধারবাসীদের আচার-আচরণকে হীন ও নিচ বলা হয়েছে। বিশেষ করে গান্ধারের নারীদের সম্মানের চোখে দেখত না হস্তিনাপুরের (বর্তমান দিল্লি ও এর আশ পাশ এলাকা) শাসক ও সমাজপতি ব্রাহ্মণরা। এই সব বর্ণনা থেকে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে বৈদিক আর্যসমাজের সঙ্গে গান্ধারবাসীদের সুসম্পর্ক ছিল না। পারস্পরিক নিন্দাবাদ ও রেষারেষিই ছিল বেশি।
আফগানিস্তানের মানুষ প্রাচীনকালে বৌদ্ধ ধর্ম ও জরথুস্ট্র ধর্ম পালন করতো। এ দু’টি ধর্মই অহিংসা ও মঙ্গলসাধনার ধর্ম। বৌদ্ধ ধর্মের মর্মকথা হচ্ছে — এই দৃশমান জগৎ আসলে মনুষ্যমনের চিন্তাজনিত বিভ্রমিক সত্তা। যা আসলে শূন্যগোলক এবং মানুষের জন্য মায়াজাল ছাড়া অন্য কিছু নয়। এই মায়াজালের মোহে পড়লেই সর্বনাশ, মানবাত্মার নির্বাণ সম্ভব নয়, আটকে পড়তে হবে জীবনচক্রের ঘূর্ণিপাকে, তাই জীবে দয়া করা এবং অহিংস শ্রমণের জীবনযাপন করাই মানুষের পরম কর্তব্য হওয়া উচিত।
আহুর মাজদা, যিনি কিনা মঙ্গলের দেবতা, তার উপাসনা করাই জরথুস্ট্রীয় ধর্মের মূলকথা। এই আহুর মাজদার বিপরীত চরিত্রের অন্য এক দেবতা আছেন, নাম আহরিমান, যার কাজই হচ্ছে মানুষের অমঙ্গল সাধন করা, তার মন হিংসা ও শঠতায় ভরপুর। এই আহরিমানের অমঙ্গল-কর্ম ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে বাঁচার জন্য ঐশিবাণী প্রাপ্ত দেবতা আহুর মাজদাকে খুশি করার মঙ্গলধর্মী আধ্যাত্মিক আচরণ এবং স্তুতি নিবেদনই হচ্ছে জরথুস্ট্রীয় ধর্ম। এই যে অহিংসা ও মঙ্গল-সাধনার ধর্ম, তাও কিন্তু সে সময়ের গান্ধারবাসীদের শান্তি ও সুস্থিতি দিতে পারেনি। তখনও আফগান সমাজে দ্বন্দ্ব, কলহ, লাঠালাঠি ছিল। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীগুলো রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লিপ্ত থাকত।
আফগানিস্তানের বিরাট আয়তনের অঞ্চল ছিল ভারতের মৌর্য সম্রাজ্যের (খ্রিস্টপূর্বাব্দ ৩২১ থেকে ১৮৫) অধীন। মৌর্য বংশের অশোক থেকে শুরু করে পরবর্তী শাসকরা ছিলেন বৌদ্ধ। সে সময় তাদের পৃষ্ঠপোষকতায় আফগানিস্তানে বৌদ্ধ ধর্ম প্রসার লাভ করেছিল। ৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে আফগানিস্তান পারস্যের শাসকদের অধীনে আসে। সে সময় দেশটির প্রজারা শাসক-মনোনীত জরাথুস্ট্রীয় ধর্ম ব্যাপকভাবে গ্রহণ করেছিল ।
গ্রিসের মহাবীর আলেকজান্ডার খ্রিস্টপূর্ব ৩৩০ অব্দে পারস্য সম্রাট তৃতীয় দারিয়ুসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ওই সময় তিনি বিরাট সেনাবাহিনী নিয়ে আফগানিস্তানে প্রবেশ করেছিলেন উত্তরের বলখ প্রদেশের ওপর দিয়ে। এই বলখ অঞ্চলের প্রাচীন নাম ব্যাক্ট্রিয়া, বিদেশি আক্রমণকারীরা এই অঞ্চল দিয়েই বার বার আফগানিস্তানে সামরিক অভিযান চালিয়েছেন। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় আফগানিস্তানের বলখ প্রদেশ. উজবেকিস্তান ও তাজিকিস্তান নিয়ে একটি গ্রিক-রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আলেকজান্ডারের অন্যতম প্রধান সেনাপতি সেলুকাস ছিলেন এই রাজ্যের প্রথম গ্রিক শাসক। এই গ্রিক-রাজ্যটিই আফগানিস্তানের ইতিহাসে ব্যাক্ট্রিয়া নামে পরিচিত। আলেকজান্ডার পরিচিত বাদশাহ সেকান্দর নামে, তিনি ব্যাক্ট্রিয়ার রাজা অক্সিয়ারটেসকে পরাজিত করে তার কন্যা রাজকুমারী রোকসানাকে বিয়ে করেছিলেন। ব্যাক্ট্রিয়ায় গ্রিক শাসন তিনশ’ বছর টিকে ছিল। আফগানিস্তানের ব্যাক্ট্রিয়া দখল এবং সেখানে শাসন কাজ চালাতে গিয়ে মহাবীর আলেকজান্ডার ও তার অনুসারীরা স্থানীয় গোত্রপতি এবং উপজাতীয় যোদ্ধাদের কাছ থেকে কঠিন সামরিক প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিলেন। এই অভিজ্ঞাতা থেকেই আলেকজান্ডার বলেছিলেন, “It's impossible to conquer the Afghanistan..।” অন্যদিকে অ্যাংলো-আফগান যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবিস্তারকারীরা বলেছিলেন, “Afghanistan is a graveyard of Empires”।
ব্রিটিশ সাংবাদিক জ্যামস ফারগুসন, পেশাগত কারণে তিনি আফগানিস্তানে কাটিয়েছেন বহু বছর। তিনি তালেবান নেতা এবং আফগানিস্তানের সমাজকে খুব কাছে থেকে পর্যবেক্ষণ করেছেন। সংবাদ সংগ্রহের কাজে বার বার নিয়েছেন জীবনের ঝুঁকি। কাবুল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অ্ধ্যাপক উস্তাদ রাফিহ স্বাধীনচেতা পশ্তুভাষী পাঠানদের বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঐতিহ্য বুঝাতে এই সাংবাদিককে বলেন, “Tow thousand five hundred years ago, Darius the Great came here from Iran. The pashtuns resisted and never surrendered. Then Alexander the Great arrived from Macedonia. His advance from the West was like the wind - until he got to Afghanitan. He was stuck here for many years. Then fifteen hundred years ago, the Arabs came. We accepted their religion , but not their traditions, and we refused to be colonized. Nine hundred years ago, it was Genghis khan. We killed his grandson. Then you British came , 150 years ago. You had 60,000 troops and the best artillery, but it was Pashtuns who surrounded Kabul and killed 17,000 of you as you tried to escape. The rulers of your Empire thought this was an accident: they couldnÕt accept such a defeat, so they attacked again, in 1880. We killed 12,000 of you that time, at Maiwand. The same with the Soviets in 1979: most of their original army was destroyed. What makes you think that it will be different for America this time? Source: James Fergusson's Book, Taliban: The true story of the World's fiercest guerilla fighters, p-134.”
৬৫১ খ্রিস্টাব্দে কাদিসিয়ার যুদ্ধে ইসলামি আরব সম্রাজ্যের সেনাপতিরা পারস্য জয় করেন, অবসান ঘটে জরাথ্রুস্ট ধর্মকেন্দ্রিক সাসানীয় সাম্রাজ্যের। এর অনেক যুগ পরে আরব শাসকরা আফগানিস্তান দখল করেন। তবে দুর্গম ও পাহাড় পর্বত বেষ্টিত দেশ আফগানিস্তান খুব সহজে আরবদের অধীনতা মেনে নেয়নি। গন্ধাবের জুনবিল উপ-জাতিকে পরাজিত করতে আরব সেনাপতিদের অন্তত ১৫ হাজার সৈনিক নিহত হয়। আফগানিস্তানকে আরবের ইসলামি খিলাফতের অধীনে আনতে কমপক্ষে ২০০ বছর লেগেছিল। অবশেষে পারস্যের সেনাপতি ইয়াকুব ইবন আল লাইস কাবুল জয় করেন।
গজনির সুলতান মুহম্মদ মাহমুদের (৯৯৭-১০৩০খ্রি.) আগে হিন্দুশাহী সাম্রাজ্য কাবুল শাসন করেছে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে আফগানিস্তানের বামিয়ান উপত্যকায় হানা দেয় মঙ্গোলরা। তারা স্থানীয়দের প্রবল বাধার মুখে পড়ে। চেঙ্গিস খানের এক পৌত্র বামিয়ানবাসীর প্রতিরোধ যুদ্ধে নিহত হন। সেই ক্রোধে চেঙ্গিসের নৃশংস সৈনিকরা বামিয়ানের বাসিন্দাদের ওপর ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায়। এলাকাটি মঙ্গোলরা দখল করে নেয়। প্রসঙ্গত, আজকের আফগানিস্তানে যে হাজারা শিয়া মুসলিম রয়েছে তাদের বেশির ভাগ মঙ্গোল রক্তের উত্তরসূরি।
এক পর্যায়ে মঙ্গোল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে। আফগানিস্তানে দেখা দেয় স্বাধীনতার বিদ্রোহ এবং বিচ্ছিন্নতাবাদ। আফগান সাম্রাজ্যের এমনি এক পটভূমিতে মধ্য এশিয়ার ফারগানা রাজ্যের দিগ্বিজয়ী জহির উদ্দিন মুহাম্মদ বাবর আফগানিস্তান বিজয় করেন। ভারতের দিল্লি বিজয়ের আগে বাবর ২০ বছর ধরে আফগানিস্তান শাসন করেন। ১৭৩৮ সাল পর্যন্ত হিন্দুকুশ পর্বত মালার বেশির ভাগ এলাকা মুঘল শাসনে ছিল। তবে মুঘল শাসন আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করতে পরেনি। আফগানিস্তানে মুঘল নিয়ন্ত্রণ ছিল শহর ও ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্রিক স্থানগুলোতে। এই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হতো আফগান উপজাতীয় গোত্রপতিদের নানা প্রকার পারিতোষিক ও সুযোগ-সুবিধা দিয়ে। তারপরও আফগানিস্তানে মুঘল শাসকরা বার বার উপজাতীয় বিদ্রোহের মোকাবিলা করেছেন। কবি কুশল খান কট্টাকের নেতৃত্বে আফগানিস্তনের যে বিরাট বিদ্রোহ হয়, তা মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব দমন করতে পারেননি। তিনি আফগানিস্তানে প্রবেশ করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। মুঘল শাসকদের আফগানিস্তান বিস্তৃত ছিল গজনি থেকে বামিয়ান পর্যন্ত।
এরপর পরস্য সাম্রাজ্যের সাফাভিদ বংশের শাসকদের অধীনে আসে আফগানিস্তান। এই সাফাভিদ সাম্রাজ্যের সেনাপতিদেরও স্বাধীনচেতা যোদ্ধা আফগান উপজাতীয়দের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ-বিগ্রহ করতে হয়। সাফাভিদ শাসকরাই আফগানিস্তানে ইসলামের শিয়া মাজহাব প্রচার করেন। শিয়ারা এখন আফগান জনগোষ্ঠীর ১২%।
আফগানিস্তানে একের পর এক উপজাতীয় বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে সাফাভিদ সাম্রাজ্যের পতন হয়। এরপর ইরানি সম্রাট নাদের শাহ আফশার বা নাদের শাহর (শাসন কাল: ১৭৩৬-১৭৪৭খ্রি.) শাসনাধীন হয় আফগানিস্তান। আবারও নাদের শাহের বিরুদ্ধে আফগানদের যুদ্ধ, নাদের শাহকে পরাজিত করে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় আসেন আহমেদ শাহ দুররানি(রাজত্ব কাল: ১৭৪৭-১৭৭২), তিনি আফগানিস্তানে দুররানি রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আহমদ খান আবদালি নামেও পরিচিত। এই শাসক আফগানিস্তানকে একটি স্থিতিশীল রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন।
এভাবে আফগানিস্তানের ইতিহাসে রাষ্ট্র ক্ষমতার বড় বড় পালা বদলগুলো বিবেচনায় নিলে দেখা যায় দেশটি বারবার বিদেশি আক্রমণ ও দখলদারির শিকার হয়েছে। কিন্তু শেষ বিচারে আফগানরা তাদের মাতৃভূমিতে বিদেশিদের বরদাস্ত করেনি। এবারও আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সৈন্য প্রত্যাহার ও আশরাফ গানির সরকারের পতনের মধ্য দিয়ে সে কথারই প্রমাণ ঘটলো।
তিন
আফগানিস্তানকে বলা হয় চির স্বাধীন দেশ। দেশটিতে ১৯৭৩ সাল পর্যন্ত ছিল রাজতন্ত্র। রাজা জহির শাহের চাচাত ভাই সাবেক প্রধানমন্ত্রী জেনারেল মুহাম্মদ দাউদ খান ১৯৭৩ সালে এক সামরিক অভ্যুত্থানে ফ্রান্সে চিকিৎসাধীন জহির শাহকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। দাউদ খান ক্ষমতায় ছিলেন ১৯৭৩-’৭৮ সাল পর্যন্ত। তার রাজনৈতিক দলের নাম ছিল ন্যাশনাল রেভুলিউশরনারি পার্টি অব আফগানিস্তান। তিনিও ক্ষমতাচ্যুত ও নিহত হন এক সামরিক অভ্যুত্থানে।
আরব, ইরান ও তুর্কি সম্রাটরা আফগানিস্তানকে একটি ইসলামি আমিরাত বা সালতানাত হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন হাজার বছরের সামরিক ও ইসলামিকরণের চেষ্টায়। এরপর থেকে কোনো বিদেশি শক্তি এই দেশটিকে কোনো দিন সার্বিকভাবে পদানত রাখতে পারেনি। ভারতের ব্রিটিশ শাসকরা তিন বার (১৮৩৯-১৮৪২খ্রি.) চেষ্টা করেও আফগানিস্তান দখল করতে পারেননি। ১৮৮০ সালে অ্যাংলো আফগান যুদ্ধে ইংরেজরা আফগান আমির আব্দুর রহমানকে একটি চুক্তি করতে বাধ্য করেন। ওই চুক্তির বলেই আফগান ভূ-খণ্ডের বেলুচিস্থান এবং সুন্নি মুসলিম পশতুন জনগোষ্ঠীর বাসভূমি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ব্রিটিশ-ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার মার্টিমার ডুরান্ড ব্রিটিশ-ভারত ও আফগানিস্তানের মধ্যে ২ হাজার ৬৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত রেখা টেনে দেন। এই সীমান্ত রেখাই ডুরান্ড লাইন হিসেবে খ্যাত। আফগানিস্তান এই ডুরান্ড লাইন এখনো মেনে নেয়নি। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির সময় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ (এখন পাকিস্তানের পাখতুন খোয়া প্রদেশ) পাকিস্তানের ভাগে পড়ে। পকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে এই ডুরান্ড লাইনবিষয়ক আপত্তি এখনো অমীমাংসিত রয়ে গেছে। এই ডুরান্ড লাইন নিয়ে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে বর্তমান সুসম্পর্ক ভেঙে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। রয়েছে যুদ্ধের ঝুঁকি।
আফগানিস্তান সম্পর্কে নির্মোহ ও অসাধারণ বর্ণনা আছে মুঘল সম্রাট জহিরুদ্দিন মুহম্মদ বাবরের আত্মজীবনী বাবরনামায়। আফগানিস্তানকে তিনি তার দেখা স্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর দেশ বলে বর্ণনা করেছেন। তার লেখায় ভূয়সী প্রশংসা রয়েছে আফগানিস্তানের উর্বর জমি, সুরক্ষিত দুর্গের এবং ফুল ও ফলের বাগানের। এতো প্রশংসা করার পরও সম্রাট বাবর বলেছেন আফগানিস্তনের সমাজের সর্বত্র লুকানো আছে বিশ্বাসঘাতকতার ফাঁদ। এই বিশ্বাসঘাতকতা ঘটতে পারে যে করো মাধ্যমে। এমন কী রক্ত সম্পর্কের ভাই বেরাদরদের মধ্যেও। দিল্লীতে মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার পর বাবর বসবাস করতেন আফগানিস্তানের কাবুল শহরে। তিনি সেখানেই মারা যান। কাবুলে তাকে কবর দেওয়া হয়। মৌলবাদী তালেবান জঙ্গিরা ১৯৯২ সালে ক্ষমতা দখলের পর সম্রাট বাবরের সমাধি সৌধ ধ্বংস করেছিল। এরপর ধ্বংস করেছিল দেশটিতে থাকা ইতিহাসের প্রাচীন স্থাপনা ও নিদর্শনগুলো। সেসবের মধ্যে বামিয়ানের বৌদ্ধ মূর্তি ধ্বংসের ঘটনা সবচেয়ে আলোচিত। যারপর নাই ঘৃণিত ও নিন্দনীয়।
চার
আফগানিস্তানে এক মুক্তমনের বাদশাহ ছিলেন গাজী আমানুল্লাহ, তিনি নারী শিক্ষার উদ্যোগ নিয়েছিলেন, কয়েক জন আফগান ছাত্রীকে তুরস্কে পাঠিয়ে ছিলেন ডাক্তারি পড়ার জন্য। এই কাজে তার পাশে ছিলেন তার স্ত্রী রানি সুরাইয়া। এই বিদুষী নারী আফগানিস্তানে নারীমুক্তির স্বপ্ন দেখতেন। তিনি বোরকা পরা ছেড়ে দিয়ে শালীন পোষাকে জনসমক্ষে বের হতেন, আমানুল্লাহর সঙ্গে রাজকার্যে অংশ নিতেন। পর্দাপ্রথা মানতেন না। এসব কারণে আফগান মোল্লারা বাদশাহ আমানুল্লা ও রানি সুরাইয়াকে কাফের বলে ফতুয়া দেন। তারা বাদশাহ আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে সশস্ত্র জিহাদ ঘোষণা করেন। এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে দেশের উত্তরাংশের এক তাজিক গোত্রপতি ও ডাকাত সরর্দার বাচ্চা-ই-সাকাও বিশ্বাসঘাতকতা করে ১৯২৯ সালের ১৭ জানুয়ারি বাদশাহ আমানুল্লার সিংহাসন দখল করে নেন। তিনি হাবিবুল্লাহ গাজি নাম ধারণ করে দেশে শাসন দণ্ড হাতে নেন। দেশে সন্ত্রাস ও নৈরাজ্যের স্বর্গরাজ্য কায়েম করেন। এর ফলে আফগানিস্তানে বাদশাহ আমানুল্লার গৃহীত সামাজিক আধুনিকায়ন ও নারীমুক্তির সংস্কার মুখ থুবড়ে পড়ে। বাদশাহ আমানুল্লা ও রানি সুরাইয়ার ব্যাপারে বিস্তারিত বর্ণনা আছে সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘দেশ-বিদেশে’ নামক গ্রন্থে। আফগান সমাজে মোল্লা-মৌলবিদের ভয়ংকর প্রভাব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করার প্রয়োজনে এই প্রবন্ধে আমি আমানুল্লাহ কীভাবে রাজ্যহারা হলেন তা নিয়ে আরো আলোচনা করবো।
পাঁচ
উপমহাদেশের ইতিহাসে এক সুপরিচিত ঘটনা বালাকোটের যুদ্ধ। ১৮৩১ সালের ৬ মে ব্রিটিশ ভারতের মানশেরা জেলার বালাকোটে (এই জায়গাটি এখন পাকিস্তানের পাখতুনখোয়া প্রদেশে) ইসলামের ওয়াহাবি মতের অনুসারি জেহাদি ধর্মনেতা সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভি এবং শাহ ইসমাইল দেহলভির সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে শিখ ধর্মের অনুসারী মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের বাহিনীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই লড়াইয়ে জিহাদি নেতারা ভারত থেকে ব্রিটিশ শাসন হটিয়ে ইসলামি শরিয়াভিত্তিক খেলাফত কায়েমের ঘোষণা দিয়েছিলেন। যুদ্ধে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভির দ্রুত করুণ পরাজয়ের অন্যতম কারণ ছিল আফগান গোত্রপতিদের বিশ্বাসঘাতকতা ও অসহযোগিতা। পাঠান গোত্রপতিরা প্রথমে সাইয়েদ আহামাদ ব্রেলভিকে আশ্রয় দেন। তার দলভুক্ত হয়ে মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার ওয়াদা করেন। কিন্তু এক পর্যায়ে ইসলামের শরা-শরিয়তের ব্যাখ্যা এবং অনুসরণ নিয়ে আফগান সমাজপতিদের সঙ্গে সাইয়েদ আহামাদ ব্রেলভির মতবিরোধ দেখা দেয়। এমনই এক প্রেক্ষাপটে ওই গোত্রপতিদের একাধিক নেতা মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের কাছ থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে গুপ্তচর হিসেবে কাজ করেন। এই অর্থলোভীরাই সাইয়েদ আহামাদ ব্রেলভির গতিবিধি, রণকৌশল ও মূল ঘাঁটির অবস্থান রঞ্জিত সিংয়ের সৈনিকদের জানিয়ে দেয়। এরপর শিখ ও ইংরেজ সেনাদের আক্রমণে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভি, শাহ ইসমাইল দেহলভি এবং তাদের আট শত সৈনিক নিহত হয়। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী মহারাজা রঞ্জিত সিংয়ের পক্ষে যুদ্ধ করেছিল।
আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা। তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। জার্মানির নেতা অ্যাডলফ হিটলার ব্রিটেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামী নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু জার্মানির নেতা হিটলারের সঙ্গে হাত মিলিয়ে স্বাধীনতার লড়াই করছেন। তখন নেতাজির দলের যোদ্ধাদের জন্য বিরাট অঙ্কের আর্থিক সহায়তা করে জার্মান সরকার। কাবুলের জার্মান রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে এই টাকা ভারতে পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। এই ওই বিরাট অঙ্কের টাকা আফগান-ভারত সীমান্তের এক যুদ্ধবাজ গোত্রপতির মাধ্যমে নেতাজির দলের লোকদের কাছে পাঠানোর ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু ওই মধ্যস্থতাকারী আফগান গোত্রপতি সেই টাকা নেতাজির লোকের কাছে না পাঠিয়ে নিজেই আত্মসাৎ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সময় ১৯৪১ সালের এপ্রিল মাসে নেতাজি সুভষচন্দ্র বসু কলকাতা থেকে আত্মগোপনে চলে যান। তিনি প্রথমে আফগানিস্তান পৌঁছান। দেশটির রাজধানী কাবুলে জার্মান দূতাবাসের সহায়তায় তিনি জার্মানিতে পাড়ি জমান। তথ্য সূত্র: নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবর্ষ ও অক্ষশক্তি, বইটির লেখক: সুধী প্রধান।
ছয়
আফগানিস্তানের সমাজ ও রাজনীতির ইসলামীকরণ বুঝতে হলে গুরুত্ব দিতে হবে আমির আবদুর রহমান রাজ্য শাসনে কীভাবে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করেছিলেন। ওই ঘটনার এক শতাব্দী পর আফগানদের রাশিয়াবিরোধী যুদ্ধ, যুক্তরাষ্ট্রবিরোধী যুদ্ধ এবং এসব যুদ্ধের মতাদর্শ। তাছাড়া আফগানিস্তানের সমাজ ও রাজনীতিতে ইসলামি জিহাদিদের আরো গোড়ার কথা জানতে হবে। দেশটির বড় দাগের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন সম্পর্কেও জানতে হবে। সেক্ষেত্রে বাদশাহ গাজী আমানুল্লাহ খানের রাজনৈতিক সংস্কার এবং এর পরিণতিতে তাকে কীভাবে দেশছাড়া হতে হয়েছিল, তা উপলব্ধি করতে হবে। সেই ঘটনার সঙ্গে জানতে হবে আফগানিস্তানে বামপন্থি সরকারগুলোর পতনে ইসলামি জিহাদিদের ভূমিকা।
সাত
আফগানিস্তানের সমাজে ইসলামিকরণ: আরবের নবী আবদুল্লাহ বিন মুহম্মদের প্রতিষ্ঠিত মদিনা নামক ইসলামি রাষ্ট্রের দ্বিতীয় খলিফা উমর ইবনুল খাত্তাব ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে ইরান ( প্রাচীন নাম পারস্য) দখল করেন। এর ফলে উপজাতি ও ক্ষুদ্র গোষ্ঠীপতি শাসিত আফগান সমাজের দোরগোড়ায় ইসলামি দিগ্বিজয়ীদের যুদ্ধ ডংকা বেজে ওঠে। আরব শাসকরা ক্রমশ আফগানিস্তান দখল করেন। সেই হিসাবে সপ্তম ও দশম শতাব্দীর মধ্যেই আরব ও ইরানি সেনাপতিরা আফগানিস্তান পুরো মাত্রায় দখল করে নেন। তখন থেকেই আফগানিস্তানের সমাজ থেকে জরথুস্ট্র, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মকে জিহাদি নিষ্ঠুরতায় উচ্ছেদ করা হয়। অন্যদিকে রাজধর্ম হিসেবে ইসলাম ধর্ম সমাজে শিকড় গাড়তে শুরু করে। কারণ সেই যুগে রাজা বা শাসকের ধর্মই ছিল প্রজা বা শাসিতের ধর্ম। কিন্তু তারপরও উপজাতীয় গোত্রপতি শাসিত আফগানিস্তানে ইসলাম ধর্ম সার্বিকভাবে প্রভাব বিস্তার করতে অন্তত এক হাজার বছর লেগেছে। কারণ প্রাচীন সভ্যতার সাক্ষ্যবহনকারী এই দেশটির সমাজ চলত উপজাতীয় সমাজের নিয়ম-কানুন ও রীতি-রেওয়াজ অনুযায়ী। এ সব সামাজিক নিয়ম-কানুন ও রীতি-রেওয়াজ আফগানিস্তানে ইসলাম প্রবেশের হাজার বছর আগে থেকেই বলবৎ ছিল। এসব রীতি-রেওয়াজ গ্রিক, ইরান, আরব ও ইউরোপের প্রাচীন সমাজের আইন-কানুনের মতই অমানবিক, বর্বর ও নিষ্ঠুর প্রকৃতির ছিল। ওই সব সামাজিক রীতি-রেওয়াজ ছিল পুরুষতান্ত্রিক ও নারী বিদ্বেষী। উপজাতি গোষ্ঠী ও গোত্রের সম্মান রক্ষাই ছিল ওইসব সামাজিক রীতি-রেওয়াজ ও বিশ্বাসের প্রাণভোমরা। পাশতুনদের এই উপজাতীয় নিয়ম-কানুন পাশতুনওয়ালি বলে পরিচিত। এই পাশতুন ভাষাগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তাদের বংশীয় গৌরবের বিষয়। এই বংশ গৌরব বা সম্মান বজায় রাখার জন্য তারা প্রাণ দিতে কিংবা অন্য কাউকে হত্যা করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। এ ক্ষেত্রে তারা যুক্তি ও মানবতার ধার ধারে না। প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় এসব সামাজিক ও শরিয়তি নিয়ম-রীতি আফগানিস্তানে আজও বিদ্যমান আছে। তালেবান হচ্ছে এসব নিয়ম-রীতি বজায় রাখার জিহাদি সংগঠন।
আফগানিস্তানে খ্রিস্টপূর্বাব্দে কমবেশি হাজার বছরের বৌদ্ধ-শাসন এবং ভারতে সিন্ধু সভ্যতার বৈদিক যুগে দেশটির কিয়দাংশে হিন্দু রাজাদের রাজত্ব ছিল। সে সময় দেশটিতে জরথুস্ট্র, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের মানুষ বাস করতো। এরও আগে প্রায় তিন হাজার বছর ধরে আফগানিস্তানের গোত্রকেন্দ্রিক উপজাতীয় সমাজের মানুষ মোকাবিলা করেছিল শক, হান, সিথিয়ান, ইন্দো-পারথিয়ান, গ্রিক, মোঙ্গোল, উজবেক ও পারস্য সাম্রাজ্যের নৃ-পতিদের আক্রমণ। এসব বিদেশি আক্রমণের শিকার হয়ে নিজেদের আত্মরক্ষা করতে গিয়ে আফগানিস্তানের জনগণ প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সমর কুশলী হয়েছে, রপ্ত করেছে যুদ্ধ জয়ের গেরিলা রণকৌশল। অন্যদিকে বিদেশিদের প্রতি আফগানদের রয়েছে ভীষণ নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। দেশটির ইসলামি সমাজ বাইরের পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতেই পছন্দ করে। এই বিছিন্নতার কারণেই আফগানিস্তানের সমাজে আধুনিক দুনিয়ার জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং মানবিক জীবনের আলোকরশ্মি তেমন একটা প্রবেশ করতে পারেনি। চার দিকে বিশাল বিশাল পর্বতমালা দিয়ে বেষ্টিত হওয়ার কারণে ইউরোপের বুদ্ধিমুক্তির আন্দোলন(রেনেসাঁ), রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লব এবং চীন বিপ্লবের বিজ্ঞানমনস্ক বস্তুবাদী সমাজদর্শন ও রাজনীতি দেশটির মোল্লাতন্ত্র নিয়ন্ত্রিত মসজিদ-মাদরাসাকেন্দ্রিক সমাজ মননে প্রবেশ করতে পারেনি। আফগান উপজাতীয় সমাজ আজও প্রাচীন ধ্যান-ধারণা থেকে মুক্ত নয়।
এ লেখায় ইতোমধ্যেই বলেছি, সপ্তম থেকে দশম শতাব্দী এই ৪০০ বছরে আফগানিস্তানের মানুষ ইসলামকে গ্রহণ করলেও তাদের জীবন ও সমাজ চলত নিজ নিজ উপজাতি ও গোত্রের প্রথা, রেওয়াজ ও নিয়মবিধি মোতাবেক। সর্বাংশে ইসলামি শরিয়ত সম্মত উপায়ে নয়। আফগানিস্তানের সমাজে শিকড় বিস্তারকারী ইসলাম ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার শুরু হতে অন্তত এক হাজার বছর লেগেছে। এবং তা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায় বাদশাহ আমানুল্লার পিতামহ আমির আবদুর রহমানের (১৮৮০-১৯০১ খ্রি.) শাসনামলে। তিনি রাজ্য শাসনের ক্ষেত্রে ইসলামকে ভাবাদর্শিক হাতিয়ার হিসেবে রাষ্ট্রধর্মের মর্যাদা দেন। তার সময়ই ইসলামের শরিয়াভিত্তিক শাসন ও জীবনাচার মোল্লা-মৌলোবিদের মাধ্যম্যে গ্রামে গ্রামে শিকড় ঘেড়ে বসে।
আফগানিস্তানের পূর্বদিকের প্রদেশের নাম ছিল কাফিরিস্তান। এই দুর্গম প্রদেশের বাসিন্ধারা ছিল পৌত্তলিক। তারা পুতুল পূজা করতো এবং লোকজ বিশ্বাস ও আচার-অনুষ্ঠানই ছিল তাদের সংস্কৃতি। নিজেরাই মদ তৈরি করতো এবং মদ পান করে আনন্দ-উল্লাস ছিল তাদের সমাজে স্বাভাবিক ব্যাপার। আমির আব্দুর রহমান ১৮৯০ সালে এই প্রদেশে প্রশাসনিক শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করেন। এ সময় তার সামরিক আক্রমণে হাজার হাজার কাফির (মূর্তিপূজক) নিহত হয়। অনেকে আমির আবদুর রহমানের অনুগত মোল্লা-মৌলবির হাতে বায়াত গ্রহণ করে ইসলাম ধর্মে দীক্ষা নিয়ে প্রাণ রক্ষা করেন। তখন এই কাফিরিস্তানের নামকরণ করা হয় নুরিস্তান, অর্থাৎ আলোর দেশ। এই কাফিরিস্তান থেকে নুরিস্তান হওয়া প্রদেশের মুসলমানরা এখন অতিমাত্রায় কট্টর মোল্লাবাদী।
আমির আব্দুর রহমানের ইসলামিকরণের ফলে দেশের নিরক্ষর উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর ওপর মোল্লা-মৌলবিদের ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি হয়। এক কথায় দেশটির গ্রাম থেকে শহর পর্যন্ত মোল্লাতন্ত্র জগদ্দল পাথরের মত চেপে বসে। এই মোল্লারাই আমির আবদুর রহমানের নাতি বাদশাহ গাজী আমানুল্লাহর প্রগতিশীল সমাজ সংস্কারের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করেছিল। মোল্লাদের ওই জিহাদের কারণেই আমানুল্লাহকে তার আধুনিকা স্ত্রী রানি সুরাইয়াকে নিয়ে দেশ ত্যাগ করতে হয়েছিল। বাদশাহ আমানুল্লাহ ও রানি সুরাইয়াকে দেশ ছেড়ে ভারতের বোম্বাই (এখন মুম্বাই) নগরীতে আশ্রয় গ্রহণ করতে হয়। ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বাণিজ্য নগরী বোম্বাইয়ে কিছুদিন থাকার পর বাদশাহ আমানুল্লাহ রানি সুরাইয়াকে নিয়ে ইতালির রোমে নির্বাসন জীবনে চলে যান। তার বড় ভাই যুবরাজ এনায়েতুল্লাহ আশ্রয় নেন ইরানে।
আমির আবদুর রহমানের এই যে সমাজ ও রাষ্ট্রকে ইসলমিকরণ, এর ১৩০ বছরের মধ্যেই আফগান সমাজে ইসলামি সমাজশক্তি এক দানবীয় চেহারা নেয়। যা পরবর্তীতে আফগানিস্তানের গণমুখী ও প্রগতিশীল সমাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবর্তন ইসলামের নামে জিহাদের রণধ্বনি তুলে রুখে দেয়। দেশটির সমাজ মননে এই জিহাদের ওপর ঈমানি দায়িত্ব বোঝানোর জন্য জ্যামস ফার্গুসনের বই থেকে উদ্বৃতি দিচ্ছি। এই ভাষ্য আবদুল্লাহ নামের এক তালেবান কমান্ডারের। ওই তালেবান কমান্ডার ফারগুসনকে এক আলাপচারিতায় বলেন, “...We are against war,’ he explaind. Ô It creates nothing but widows and destruction, But jihad is different, it is our moral obligtion to resist you foreingers.’ ...‘ One year, a hundred years, a million years, ten million years - it is not inportant. We will never stop fighting. At Judgment Day, Allah will not ask ‘‘what did you do for your country?’’ Did you fight for your religion?” সূত্র: ফারগুসনের আগে উল্লিখিত বই, পৃ.১২১।
আট
বাদশাহ আমানুল্লাহ কাহিনী : বাদশাহ গাজী আমানুল্লাহ খান আফগানিস্তানের সিংহাসনে বসেন ১৯১৮ সালে। ১৯১৯ সালে ব্রিটিশদের সঙ্গে আমানুল্লাহর যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে তিনি ব্রিটিশ বাহিনীকে খাইবার গিরি পথ পার হতে দেননি। ব্রিটিশ সেনারা পশ্চাদপসারণ করে আশ্রয় নেন তাদের উপনিবেশ ভারতে। এরপর বাদশাহ আমানুল্লাহ নিজ দেশকে পরিবর্তনশীল পৃথিবীর রাষ্ট্রীয় বিধি-বিধানের সঙ্গে খাপ-খাইয়ে নেওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ১৯২৩ সালের অক্টোবরে মোস্তফা কামাল আতাতুর্ক তুরস্ককে গণ প্রজাতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ঘোষণা করেন। প্রসঙ্গত, এর আগে তুরস্ক ছিল উসমানীয় সাম্রাজ্যের ইসলামি খেলাফত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে এই সাম্রাজ্যের শাসকরা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেন এবং ব্রিটেনের মিত্র উদীয়মান আরব জাতীয়তাবাদীদের কাছে পরাজয় বরণ করেছিলেন।
তুরস্কে মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের ক্ষমতা গ্রহণের ৬ মাস আগেই বাদশাহ আমানুল্লাহ আফগানিস্তানের জন্য একটি সংবিধান রচনা করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল আফগানিস্তানকে ব্রিটেনের মতো সাংবিধানিক রাজতন্ত্রে পরিণত করা এবং দেশ শাসনের দায়িত্ব জন প্রতিনিধিদের হাতে ছেড়ে দেওয়া। কিন্তু বাদশাহ আমানুল্লাহ সফলতা অর্জন করতে পারেননি। দেশের মোল্লা-মৌলবিরা তার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেছিলেন। এই জিহাদে ভারতের ব্রিটিশ শাসকরা দিয়েছিল উসকানি। ব্রিটিশ রাজশক্তি ও দেশের মোল্লাতন্ত্রের সঙ্গে বাদশা আমানুল্লাহর দ্বন্দ্ব বিরোধ খোলাসা করার জন্য একটু বিস্তারিত আলোচনা করা দরকার। প্রথমে আসি ব্রিটিশদের সঙ্গে বিরোধ প্রসঙ্গে, ১৯১৯ সালে আমানুল্লাহ শুধু ব্রিটিশদের পরাজিতই করেননি, তিনি সোভিয়েত রাশিয়ার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ক‚টনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলেন। আমানুল্লাহ এ সময় সোভিয়েত ইউনিয়নের সহায়তা নিয়ে তার বিমানবাহিনীকে শক্তিশালী করার কাজে হাত দিয়েছিলেন। সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ শাসকরা আমানুল্লার এই রাশিয়া ঘেষাঁ নীতি সহ্য করেননি। জেনে রাখা দরকার, গোটা ঊনবিংশ শতক ধরে মধ্য এশিয়ায় প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে রাশিয়ার সম্রাটদের সঙ্গে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের শাসকদের তীব্র-বিরোধ ছিল। কূটনৈতিক শাস্ত্রের ইতিহাসে এই বিরোধকে ‘দ্য গ্রেট গেম’ বলা হয়। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের এই গ্রেট গেমের-ই শিকার হয়েছিলেন বাদশাহ আমানুল্লাহ। এসব কারণে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করার জন্য মোল্লাদের শিরমণি হজরত শোবরাজের অনুসারিদের ইন্ধন যুগিয়েছিল কাবুলের ব্রিটিশ লিগেশন। আগেই বলেছি, নারী শিক্ষা ও নারীর সামাজিক ও পারিবারিক ক্ষমতায়নের সামান্য চেষ্টা চালিয়েছিলেন বাদশাহ আমানুল্লাহ ও তার বিদুষী রানি সুরাইয়া তার্জি। এ কারণে তারা দেশের মোল্লাদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। দেশের প্রাচীনপন্থি চিন্তার মোল্লা ও গোত্রপতিরা বাদশাহ আমানুল্লাহ ও রানি সুরাইয়াকে কাফের বলে ফতোয়া দেন।
১৯২৮ সালের সেপ্টেম্বরে দেশের পূর্বাঞ্চলীয় জালালাবাদ শহর এবং খাইবার গিরি পথের চারদিককার পার্বত্য জনপদের পাশতুন শিনওয়ারি ও খুগিয়ানি উপজাতির সরদার ও স্থানীয় মোল্লারা আমানুল্লার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করেন। তাদের আধ্যাত্মিক নেতা ছিলেন রাজধানী কাবুলের হজরত শোরবাজার। ওই সময়ে আফগানিস্তানের পাশতুন জনগোষ্ঠীর ওপর শোরবাজারসহ অন্য মোল্লাদের ধর্মীয় নিয়ন্ত্রণ ছিল ব্যাপক ও প্রবল। মোল্লা শোর বাজারের কথায় তারা জীবন দিতেও দ্বিধাবোধ করতো না।
হজরত শোরবাজার ফতোয়া দিলেন, “মেয়েদের জন্য স্কুল কলেজ চালু করা, পর্দা প্রথা তুলে দেওয়া, পুরুষদের বহুবিবাহ বন্ধ করার কারণে বাদশাহ আমানুল্লাহ কাফের হয়ে গেছেন। অন্যদিকে বোরকা না পরার জন্য রানি সুরাইয়া বিধর্মী হয়ে গেছেন। দেশের সিংহাসন থেকে আমানুল্লাহকে সরিয়ে দিতে জিহাদ করা এখন দেশের মুসলিমদের জন্য ফরজ হয়ে গেছে। এই ফতুয়ায় উত্তেজিত হয়ে শত শত অশিক্ষিত পশতুন উপজাতির আফগান আমানুল্লার বিরুদ্ধে জিহাদে অংশ নিয়ে কাবুলের দিকে অগ্রসর হয়েছিল। তারা আমানুল্লাহর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করা তাদের ঈমানি দায়িত্ব মনে করেছিল। এই পশতুনওয়ালিদের জিহাদ বা বিদ্রোহ দমনের জন্য বাদশাহ আমানুল্লাহ তার ভায়রা ভাই আহমেদ আলিকে সেনানায়কের পদবী দিয়ে বিপুলসংখ্যক সৈন্য ও গোলাবারুদসহ জালালাবাদে পাঠালেন। কিন্তু বিধি বাম! আহমেদ আলি জালালাবাদ পৌঁছে বিদ্রোহ দমন তো দূরের কথা, তিনি নিজেকে আফগানিস্তানের বাদশাহ ঘোষণা করলেন। এতে আমানুল্লাহ সামরিক দিক থেকে বিরাট ক্ষতির মুখে পড়লেন। অস্ত্র, গোলা-বারুদ ও সৈন্যের অভাবে রাজধানী কাবুল রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হলো না। রাজধানী দখল করলেন বাচ্চা-ই-সাকাও নামের এক ডাকাত সরর্দার। তিনি ছিলেন তাজিক গোত্রের মানুষ এবং এক ভিস্তিওয়ালার পুত্র (পানি বহনকারী শ্রমজীবী) পুত্র। এই শিক্ষা-দীক্ষাহীন দস্যু সরদার বাচ্চা-ই-সাকাও ধর্মান্ধ গোত্রপতিদের সমর্থ পেয়ে আফগানিস্তানের সিংহাসনে বসেন।
নয়
আফগানিস্তানে বামঘেষাঁ রাজনৈতিক পদক্ষেপ : সোভিয়েত রাশিয়াপন্থি নেতা নুর মোহাম্মদ তারাকি মধ্যপন্থী একনায়ক প্রেসিডেন্ট মুহাম্মদ দাউদ খানকে সামরিক অভ্যুত্থানে সরিয়ে দিয়ে ১৯৭৮ সালের এপ্রিলে ক্ষমতায় আসেন। মোহাম্মদ তারাকি ছিলেন আফগানিস্তানের পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টির(পিডিপিএ) নেতা। আফগানিস্তানে পিডিপিএ প্রথম রাজনৈতিক দল। এর প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব ছিলেন নুর মোহাম্মদ তারাকি (জন্ম ১৯১৭ খ্রি.)। তিনি ছিলেন পাঠান গোত্রের মানুষ, তার বাবা ছিলেন মেষ পালক। নিজ দেশে সরকারি চাকরি শুরু করেন অল্প বয়সে। সেই সুবাদে তিনি ব্রিটিশ শাসিত ভারতের বন্দরনগরী মোম্বাই সফরের সুযোগ পান। এখানেই তিনি ভারতীয় কমিউনিস্টদের মাধ্যম্যে মার্কস-লেনিনের সমাজচিন্তা ও রাষ্ট্র দর্শেনের সঙ্গে পরিচিত হন। ক্ষমতাসীন হয়ে তিনি আফগান সমাজের প্রগতিমুখী সংস্কারে হাত দিয়েছিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো আফগানিস্তানের শেষ বাদশাহ জহির শাহ (১৯৩৩-১৯৭৩), তার ৪০ বছরের শাসনকালে দেশের মানুষের জন্য সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করেননি। তার সময় শহরে আধুনিক শিক্ষা গ্রহণের সামান্য সুযোগ ছিল। দেশে শিক্ষার হার ছিল ১০%, এই শিক্ষিত মানুষরা ছিলেন আশরাফ বা অভিজাত পরিবারের। গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছায়নি। এই অবস্থায় দেশের মানুষজন গ্রামের মক্তব ও মাদরাসায় সামান্য ইসলামি শিক্ষা পেতেন। সেই শিক্ষা ছিল আরবি, উর্দু ও ফরসি ভাষায় ইসলাম ধর্মের কোরান ও হাদিস শিক্ষা। পাশাপাশি অতিরঞ্জিত বয়ানে শিক্ষা দেওয়া হতো প্রাচীন ও মধ্যযুগের আরব ও তুর্কি বীর সেনানিদের যুদ্ধাভিযানের গল্প-কাহিনি। এছাড়া পরকালকে কেন্দ্র করে এই নামাজি-কালামি শিক্ষা সেসময় আফগান জনগণের মধ্যে কোনো জীবনধর্মী জ্ঞানস্পৃহা সৃষ্টি করেনি। এ কারণে ইউরোপের রেনেসাঁ ও শিল্পবিপ্লব-উত্তর যুগে বিকশিত আধুনিক যুক্তিবাদী দর্শন এবং বিজ্ঞান শিক্ষার সামন্যতম সুযোগও গ্রামে বসবাসকারী আফগানরা পাননি। এ সব কারণে দেশের মানুষের ওপর মোল্লা ও মৌলবিদের নিয়ন্ত্রণ ছিল খুব বেশি। মোল্লা-মৌলবিরা যখন যে ফতুয়া দিত দেশের সমাজপতিরা তাই মেনে নিত এবং সে অনুযায়ী ইসলাম রক্ষার জিহাদে নেমে পরতো। এমনি এক সামাজিক পটভূমিতে পিডিপিএ ক্ষমতায় এসে সমাজের ব্যাপক বিপ্লবী সংস্কার শুরু করে। এগুলোর মধ্যে ছিল — রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে মসজিদ ও মোল্লাদেব প্রভাব খর্ব করা, শরিয়া আইন বাতিল করা, কন্যা শিশুদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা, নারীর জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা। এছাড়াও দেশের ভূমিব্যবস্থায় বিদ্যমান সামন্ততান্ত্রিক (জমিদারী, তালুকদারী, জোতদারী ও অতি চড়া হারের সুদের ব্যবসা) প্রথার গণমুখী সংস্কারের হাত দেয় পিডিপিএ সরকার। এতে যারপর নেই ক্ষুব্ধ হয়েছিল ভূমি মালিক, মোল্লাতন্ত্রের সুবিধাভোগী ধর্মব্যবসায়ী আলেম-ওলামা এবং সুদখোর মহাজনরা। তারা ইসলাম গেল, ইসলাম গেল, আওয়াজ দিয়ে রাশিয়াপন্থি সরকারের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করল। আফগানিস্তানের ওই সময়কার অবস্থা লেখক ও বামপন্থি সমাজতাত্তি¡ক বদরুদ্দীন উমর ব্যাখ্যা করেছেন এ ভাবে,‘ ‘‘ আফগানিস্তানে সোভিয়েটপন্থী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে উৎপাদন ব্যবস্থায়, বিশেষতঃ ভূমি সংস্কারের মাধ্যমে ভূমি ব্যবস্থায়, যে পরিবর্তনের সূচনা করেছিলো তার বিরোধিতাই ছিল তালেবান ও তাদের পূর্ববর্তী গুলবুদ্দীন হিকমতেয়ার, রাব্বানী প্রভৃতির নেতৃত্বে পরিচালিত সোভিয়েটপন্থী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনের মূল ভিত্তি। বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে যেমন প্রতিবিপ্লবীদের ক্ষেত্রেও তেমনি, এই ধরনের পরিবর্তন বিদ্যমান উৎপাদন ব্যবস্থার বিরোধিতা ও তার সাথে সম্পর্কিত শক্তি বা শক্তিসমূহের সাথে সংঘর্ষ ছাড়া সম্ভব নয়।
সোভিয়েটপন্থী সরকার ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে মোল্লাদের মালিকানাধীন বিশাল ভূসম্পত্তি জাতীয়করণ করে সাধারণ কৃষকদের মধ্যে বণ্টনের ব্যবস্থা শুরু করায়, মোল্লারা স্বাভাবিকভাবে তার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগঠিত করতে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে তাদের কৌশল ছিল ভূমি মালিকানাকে আল্লাহর দান হিসেবে এবং ভূমি সংস্কারক সরকারকে নাস্তিক হিসেবে অভিহিত করে নিজেদের ভূমিস্বার্থ রক্ষার সংগ্রামকে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদ বা ধর্মযুদ্ধ হিসেবে আখ্যায়িত করা। মোল্লাতন্ত্রের প্রভাবে অশিক্ষা-কুশিক্ষায় নিমজ্জিত দরিদ্র আফগান কৃষকরা এই প্রচারণার দ্বারা বিভ্রান্ত হয়েই মোল্লাতন্ত্র ও তালেবানদের পক্ষে দাঁড়ায়। এই ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই তারা সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামে মোল্লাদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়। তাদের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে ওঠে তালেবান প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি।’’ ( সূত্র: ‘বাংলাদেশে ইসলামী মৌলবাদীদের রাজনৈতিক ভূমিকা’ শীর্ষক তৃতীয় আব্দুল করিম সাহিত্যবিশারদ স্মারক বক্তৃতা। বক্তা: বদরুদ্দীন উমর। এই বক্তব্যটি পুস্তিকারে প্রকাশ করেছে সমাজ-রূপান্তর অধ্যয়ন কেন্দ্র। প্রথম প্রকাশ অক্টোবর, ২০০৫, পৃ. ১৪)
পিডিপিএ সরকারকে টিকিয়ে রাখার জন্য ১৯৭৯ সালের ২৪ ডিসেম্বর আফগানিস্তানে মোতায়েন করা হয় ৩০ হাজার রুশ সেনা। এসময় নুর মুহাম্মদ তারাকির গণমুখী ভূমিসংস্কার, নারীশিক্ষার কর্মসূচি এবং দেশটিতে রুশ সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিরুদ্ধে কড়া অবস্থান নেয় পাকিস্তান, সৌদি আরব, যুক্তরাষ্ট্র, ইরান ও পাশ্চাত্যবিশ্ব। এসব দেশ তখন অস্ত্র, অর্থ ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে আফগান জিহাদিদের সহায়তা করে। পাকিস্তানে তখন ক্ষমতায় ছিলেন ইসলামি মৌলবাদীদের পৃষ্ঠপোষক সেনা শানক জেনারেল জিয়াউল হক। পাকিস্তান তখন আফগান্তিানের জিহাদিদের অভয়ারণ্য। এই অবস্থার মধ্যেই নুর মুহাম্মদ তারাকিকে হটিয়ে দিয়ে ক্ষমতায় আসেন হাফিজুল্লাহ আমিন। প্রগতিবাদী হাফিজুল্লাহ আমিনকেও এক সেনা-গণঅভুত্থানে ক্ষমতা থেকে বিদায় নিতে হয়। ক্ষমতায় আসেন রুশপন্থি বামগণতান্ত্রিক নেতা বাবরাক কারমাল। এই বাবরাক কামরালের রাজনৈতিক উত্তরসূরি ছিলেন ড. নজিবুল্লাহ।
নূর মুহাম্মদ তারাকি, বাবরাক কামরাল ও ড. নজিবুল্লাহ রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে আফগানিস্তানে সমাজতান্ত্রিক ধারার প্রগতিশীল রাজনীতি ও অর্থনীতি গড়তে চেয়েছিলেন। সে সময় তাদের সরকারের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ হয় আফগানিস্তানের ভূস্বামী, সুদের ব্যবসায়ী, মাদরাসার শিক্ষক-ছাত্র এবং মোল্লা মৌলবিরা। এই চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের রাজনৈতিক জোটটি ছিল ইসলাম ধর্মের মধ্যযুগীয় খিলাফত বা আমিরাত প্রতিষ্ঠার রাজনৈতিক শক্তি। এদের মতাদর্শ হচ্ছে মানুষকে ধর্ম নামের আফিমের নেশায় ডুবিয়ে রেখে সামন্ততান্ত্রিক ও যুদ্ধবাজ গোষ্ঠীপতিদের শাসন-শোষণ বজায় রাখা এবং নারীদের ঘরবন্দি দাসি-বান্দির পর্যায়ে রাখা। গণতন্ত্র, সামাজিক প্রগতি, নারীর অধিকার ও মানুষের বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতাবিরোধী এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকেই সমর্থন দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, সৌদি আরব, চীন ও ইরান। পাকিস্তানের মাটিতে লালিত-পালিত হয় গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ও বুরহানুদ্দিন রব্বানির মুজাহেদিন বাহিনী। এই মুজাহিদ বাহিনীর নেতারা জনমত তাদের পক্ষে আনার জন্য আওয়াজ তুলল আফগানিস্তান নাস্তিক কমিউনিস্টদের হাতে চলে গেছে। রুশ সেনারা রাজধানী কাবুলের দখল নিয়েছে। অতএব মোমিন ও মুত্তাকিদের মাতৃভূমি ‘দারুল হরব’ হয়ে গেছে। ইসলামের ওয়াহাবি আলেমদের রাষ্ট্রচিন্তা অনুযায়ী ‘বিধর্মী শাসিত মানবরচিত আইন মোতাবেক পরিচালিত রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রে কুরআন ও সুন্নাহ মানা হয় না। আলেমদের রাষ্ট্র শাসনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে। এমন রাষ্ট্রকে দারুল হরব বলা হয়।’ আফগানিস্তানের কাঠমোল্লারা ফতোয়া দিল কমিউনিস্ট রাশিয়ার সমর্থিতরা দেশ চালাচ্ছে, দেশে মোতায়েন করা হয়েছে ৩০ হাজার বিধর্মী সেনা। সুতরাং দেশ দারুল হরব-এ পরিণত হয়েছে। খাঁটি মোমিনদের এখন দায়িত্ব হচ্ছে নিরাপদ স্থানে হিজরত করে ইসলাম রক্ষার জিহাদে সামিল হওয়া। এই ফতোয়ায় অনুপ্রাণিত হয়ে আফগানিস্তানের ৩০ লাখ মানুষ ইসলামি প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে হিজরত করেছিল। ২ লাখ আশ্রয় নেয় শিয়া মোল্লাদের শাসিত দেশ ইরানে।
এই আফগানরা পাকিস্তানের কওমি ও খারেজি মাদরাসাগুলো থেকে পেয়েছে জিহাদের ভাবাদর্শিক শিক্ষা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাছ থেকে গ্রহণ করেছে সামরিক প্রশিক্ষণ। এসব কাজের টাকা এসেছে মধ্যপ্রাচ্য ও আমেরিকা থেকে। আফগানরা প্রায় সবাই সুন্নি মাজহাবের মুসলিম হওয়ার কারণে ইরানের শিয়া মোল্লাতন্ত্রের প্রভাব তাদের ওপর তেমন একটা নেই। তবে দেশটির শতকরা ৯ জন হাজারা গোত্রের শিয়া মুসলিম। এ কারণে আফগানিস্তানের ব্যাপারে একেবারে নীরব থাকতে পারেনি ইরান।
দশ
আফগানিস্তানের রাজনীতিতে নুর মুহাম্মদ তারাকি, হাফিজুল্লাহ আমিন, বাবরাক কারমাল ও ড. নজিবুল্লাহর শাসনকাল খুবই গুরুত্ব বহন করে। রুশপন্থি এই সমাজগণতন্ত্রী চার নেতা দেশ চালিয়েছেন ১৪ বছর (১৯৭৮-’৯২)। দেশটির এই কালপর্বকে ধনতান্ত্রিক বুর্জোয়া বিকাশের প্রাথমিক পর্যায় হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। কিন্তু বড়ই পরিতাপের বিষয়, এই বাম ধাঁচের বুর্জোয়া সামাজিক সংস্কারকেও কমিউনিস্টদের ধর্মবিরোধী সমাজতান্ত্রিক শাসন বলে ফলাও করে প্রচার চালায় যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান ও ইউরোপের ক্ষমতাশালী দেশগুলো। সৌভিয়েত ইউনিয়নের পতনের আগপর্যন্ত সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিবাদের মধ্যে ঠাণ্ডা লড়াই জারি থাকার কারণে রুশপন্থি এই ৪ আফগান রাজনীতিকের প্রগতিশীল রাজনৈতিক রূপান্তর মোটেই সহ্য করেনি যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, পাকিস্তান, সৌদি আরব ও ইরান। এমনই এক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের আধুনিক অস্ত্র, কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার এবং পাকিস্তানের আশ্রয় ও সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়ে গড়ে ওঠে নির্মম সন্ত্রাসী ও মধ্যযুগীয় রাজনৈতিক ইসলামের জিহাদি চেতনার মুজাহিদ ও তালেবান বাহিনী। ১৯৮৫ সালে পাকিস্তানের পেশওয়ার শহরে সাতটি গেরিলা গ্রুপ এক সভায় মিলিত হয় এবং গঠন করে ইসলামিক ইউনিটি অব আফগান ওয়ারিয়ারস (আইইউএডবলিউ)। ইসলাম রক্ষার এই সশস্ত্র জিহাদি জোট তখন বিশ্বে মুজাহিদিন হিসাবে পরিচিতি পায়। এই মুজাহিদ ও তালেবান বাহিনীর সম্মিলিত আক্রমণে ১৯৯২ সালে প্রেসিডেন্ট নজিবুল্লাহ সরকারের পতন হয়। তিনি রাজধানী কাবুলে জাতিসংঘ কার্যালয়ে আশ্রয় নেন। ১৯৯৬ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর কাবুলের জাতিসংঘ অফিস থেকে ধরে এনে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে তাকে হত্যা করে তালেবান জিহাদিরা। নজিবুল্লাহর লাশ রশি দিয়ে ট্রাকের সঙ্গে বেঁধে কাবুলের রাস্তায় রাস্তায় টেনে-হিঁচড়ে জনসাধারণকে দেখানো হয়। শেষে তার লাশ কাবুলে এক সড়কের বৈদ্যুতিক খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে রাখা হয়। সে সময় কাবুলসহ সারা আফগানিস্তানে ত্রাসের রাজ্য এবং মগের মুল্লুক কায়েম করে মুজাহিদ ও তালেবান যোদ্ধারা। প্রতিষ্ঠা পায় গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ও বুরহানুদ্দিন রব্বানির শরিয়াভিত্তিক ইসলামি শাসন। নারীদের স্কুলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। সরকারি-বেসরকারি খাতের কর্মজীবী, ব্যবসায়ী, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার নারীদের কর্মচ্যুত করা হয়। তাদেরকে ঠেলে দেওয়া হয় কিম্ভুৎকিমাকার কালো বোরকার ভেতর। তারা আটকা পড়েন পুরুষতন্ত্র ও শরিয়াকেন্দ্রিক ইসলামি ফ্যাসিবাদের চার দেওয়ালে ঘেরা অন্ধকার গৃহে ।
এগার
আফগানিস্তানের রণক্ষেত্রে ১৫ হাজার রুশ সৈন্য নিহত হয়। পরাজয়ের কালিমা মাথায় নিয়ে রুশ সেনারা ১৯৮৯ সালে কাবুল ত্যাগ করেন। দ্রুত পতন হয় নজিবুল্লাহর সরকারের। এরপর জিহাদি মুজাহিদিন ও তালেবান নেতারা ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের সরকার গড়ে দেশ চালাতে পারেননি। শুরু হয় তাদের নিজেদের মধ্যে হত্যা-পাল্টাহত্যার ভয়ংকর রাজনীতি। প্রায় চার বছর ধরে চলে মুজাহিদিন ও তালেবান বাহিনীর মধ্যে গৃহযুদ্ধ। এর পরিণতিতে পাকিস্তান, সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের তালিবানি শক্তি ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে। শুরু হয় তালেবান নেতা মোল্লা ওমরের যুগ। দেশের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় আফগানিস্তানের ইসলামিক আমিরাত। মোল্লা ওমরের অনুসারীরা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ার ও বুরহান উদ্দিন রব্বানির মৌলবাদী জিহাদিদের চেয়ে আরো কড়া ব্র্যান্ডের ইসলামি জিহাদি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। মোল্লা শাসিত আফগানিস্তান থেকে ইমলামি জিহাদের লেলিহান অগ্নিশিখা ছড়াতে থাকে বহির্বিশ্বে। তখন আরব, উত্তর আফ্রিকা, চেচনিয়া ও মধ্য এশিয়ার ভিন্ন দেশ থেকে জঙ্গি তরুণরা ‘ইসলাম বাঁচানোর’ এই জিহাদে যোগ দেয়, বাদ যায়নি বাংলাদেশও। ওই সময়ে আমরা বাংলাদেশে রণধ্বনি শুনেছি ‘আমরা সবাই তালেবান’ বাঙলা হবে আফগান। এই যে মৌলবাদী জোশ ও জৌলুস, তা শুধু রণহুঙ্কারেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ক্রমশ আরো বীভৎস যুদ্ধংদেহী চেহারা নেয়। আফগানিস্তান থেকে সামরিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মওলানা মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীরা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে রাখেন। ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলায় হতাহতের ঘটনা ঘটে। তালেবান ভাবাদর্শের জঙ্গিদের বোমা হামলায় ঝালকাঠিতে আদালতের এজলাস রক্তাক্ত হয়, বিচারক নিহত হন। সিরিজ বোমায় কেঁপে ওঠে দেশের ৬৩টি জেলা। বাঙালি সংস্কৃতির পাদপীঠ রাজধানী রমনার বটমূলে ছায়ানটের পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে, গুলিস্তানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি), যশোরে উদীচীর সমাবেশে এবং টাঙ্গাইলে বাউল ফকিরদের গানের আসরে বোমা হামলা চালায় মৌলবাদী জঙ্গিরা। জঙ্গিদের বোমায় রক্তাক্ত হয় ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপের সাগর সৈকত। এই জঙ্গিদের তৎপরতার কারণে বড় ধরনের হুমকির মধ্যে পড়ে ভারতের জননিরাপত্তা। ইংল্যান্ডের পাতাল রেলে এবং ফ্রান্সে অপেরা হাউসে জঙ্গি হামলা করে হতাহতের ঘটনা ঘটায় জিহাদি ইমলামি জঙ্গিরা। এর আগেই আফগানিস্তানে মোল্লা ওমরের জিহাদিরা হাম্বলি মাজাহাবের সুন্নি ইমাম আবু আহমদ তাঈ মিঞার (১২৬৩-১৩২৪ খ্রি.) অনুসারী সালাফি বলে পরিচিত আরব জঙ্গি গোষ্ঠীর সঙ্গে যুক্ত হয়। এই সালাফি ধর্মান্ধ মৌলবাদী মুসলিম গ্রুপগুলো পাশ্চাত্যের গণতান্ত্রিক, বিজ্ঞানমনস্ক, ব্যক্তিস্বাতন্ত্রিক এবং নারী-পুরুষের সমান অধিকারের সমাজ, রাষ্ট্রব্যববস্থা ও মুক্তসংস্কৃতির প্রতি বিরাট সন্ত্রাসী চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়।
সৌদি আরবের বৈশ্বিক সন্ত্রাসী ও নৈরাজ্যবাদী ওসামা বিন লাদেনের অনুসারীরা বিমান হামলা চালিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টার টুইনটাওয়ার ধ্বংস করে দেয়। এই হামলায় আড়াই হাজারের বেশি বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হয়। আহত হয় ছয় হাজার মানুষ। এর অব্যবহিত পরেই প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ “ওয়ার অন টেরর” ঘোষণা করেন। এই যুদ্ধের প্রধান টার্গেট করা হয় আল কায়দা নেতা ওসামা বিন লাদেনকে।
ইতিহাসের কী নির্মম পরিহাস! এক সময় যুক্তরাষ্ট্রের অস্ত্রে সজ্জিত আফগানিস্তানের তালিব-নেতা মোল্লা ওমর ১৯৯৬ সালে ওসামা বিন লাদেনকে আফগানিস্তানে আশ্রয় দেন। মোল্লা ওমরের এক কন্যাকে বিবাহ দেওয়া হয় আল কায়দা নেতা ধনকুবের লাদেনের কাছে। মোল্লা ওমরের প্রশাসন লাদেনকে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করে। এমনি এক প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ তার ইউরোপীয় সামরিক মিত্রদের সঙ্গে মিলে ২০০১ সালে আফগানিস্তানে সামরিক হামলা পরিচালনা করেন, তার এই যুদ্ধের রণধ্বনি ছিল ‘এনডিউরিং ফ্রিডম’। প্রেসিডেন্ট বুশের সামরনিক শক্তি তালেবান নেতাদেরকে কাবুলের সিংহাসন থেকে হটিয়ে দেয়। সেই থেকে এবার ক্ষমতায় আসার আগপর্যন্ত ২০ বছর ধরে ক্ষমতার বাইরে ছিলেন তালেবান নেতারা। তবে তারা দেশটির প্রায় ষাট ভাগ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে আসছিলেন। এই বিশ বছর ধরে দেশ চালিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের পছন্দের শাসকরা। হামিদ কারজাই এবং সম্প্রতি দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া আশরাফ গনিও ছিলেন পাশ্চাত্য সামরিক শক্তির সমর্থনপুষ্ট আফগান প্রেসিডেন্ট। এই দুই দশক ধরে আফগানিস্তানের সমাজে অনেক সংস্কার সাধন করা হয়। এই কালপর্বে দেশটিতে পাশ্চাত্য ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা, সংস্কৃতি, অধুনিক বিচারব্যবস্থা, নারীর শিক্ষা ও অধিকার এবং গণপ্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা জনপ্রিয় করার জন্য লাখ লাখ ডলার খরচ করা হয়। এই বিপুল অঙ্কের অর্থ এসেছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য দুনিয়া থেকে। আফগান সমাজে আধুনিকায়নের এই দুই দশকের বিপুল পদক্ষেপের ফলে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন হয়েছে।
স্মরণ করা দরকার যে, ২০০১ সালে যখন তালিবান শাসনের অবসান ঘটে, তখন রাষ্ট্রের আইন, বিচার ও নির্বাহী বিভাগ পরিচালনার আধুনিক বিধি-বিধান বলতে কিছুই ছিল না আফগানিস্তানে। এরপর থেকে ধীরে ধীরে চালু হয়েছে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, তৈরি হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান, ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থা, সমন্বিত পরিবহণ, স্বাস্থ্য এবং শিক্ষাব্যবস্থা। এই সমস্ত প্রক্রিয়া এবং প্রতিষ্ঠানগুলির ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা ছিল না তা নয়। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক এসব গণমুখী কাজ যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্যের অর্থ সহায়তার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এগুলোর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন দেশটিতে মোতায়েন করা ন্যাটো বাহিনীর কর্মকর্তারা। প্রযুক্তিগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক সহায়তাও তারাই দিয়েছেন। এর ফলে তালিবানি জিহাদের নিষ্ঠুরতা ও অমানবিক শরিয়াতন্ত্রের দুঃসময় ভুলে সীমিত আকারে হলেও স্বাধীন জীবন যাপনের স্বাদ পেয়েছিলেন আফগানিস্তানের নারী-পুরুষরা। এ কারণে বিংশ শতকের নব্বইয়ের দশকে দেশ ছেড়ে যাওয়া অনেক মানুষ স্বদেশে ফিরেছিলেন ২০০১ সালের পর। তাঁদের ছিল পাশ্চাত্যে শিক্ষা ও কর্মের অভিজ্ঞতা। তাদের কর্মদক্ষতার ফলসরূপ শিল্প-বাণিজ্য এবং স্বাস্থ্য সেবায় চোখে পড়ার মত উন্নতি হয়। বিরাট পরিবর্তন আসে শিক্ষাক্ষেত্রে। আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের শেষে ২০০০ সালে নারী এবং পুরুষের সাক্ষরতার হার ছিল যথাক্রমে ৪৩ এবং ১৩ শতাংশ; ২০১৮ সালে সেটি হয় যথাক্রমে ৫৫ এবং ৩০ শতাংশ। ২০০১ সালে স্কুলের সংখ্যা ছিল ৩ হাজার , ২০২০ সালে সেই সংখ্যা বেড়ে হয় ২০ হাজার। ২০০৩-০৪ সালে আফগানিস্তানে বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠরত ছাত্র এবং ছাত্রীর সংখ্যা ছিল যথাক্রমে ২৩ হাজার ৬০০ এবং ৭ হাজার ২০০। বহু গুণ বেড়ে ২০২০ সালে সেই সংখ্যা দাঁড়ায় যথাক্রমে ১ লাখ ৩৬ হাজার ৯০০ এবং ৪৯ হাজার। আপাতদৃষ্টিতে সংখ্যাটি বিশাল কিছু নয়। কিন্তু দু’দশক আগের তালিবানি শাসনের সঙ্গে তুলনা করলে শিক্ষাক্ষেত্রে মহিলাদের অংশগ্রহণ বেড়েছে বহু গুণ। একই কথা প্রযোজ্য বুদ্ধিবৃত্তিক পেশার ক্ষেত্রেও। এর আগের তালিবানি জমানায় মহিলাদের পেশাগত স্বাধীনতা প্রায় ছিলই না। সেখানে দেশটির ২০০০ সালের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে ৭১ হাজার আফগান নারী পেশায় শিক্ষক।
মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতাও বেড়েছিল তালিব-নেতাদের শাসনমুক্ত এই দুই দশকে। নব্বইয়ের দশকে তালিবানি শরিয়াতন্ত্রের মুখপাত্র হিসেবে আফগানিস্তানে শুধুমাত্র ছিল সরকারি শরিয়ত রেডিয়ো। অথচ ২০২১-এর অগস্ট মাসে আফগানিস্তানে সরকারি বেতার এবং রেডিয়ো ছাড়াও অন্তত ১৭৪টি বেসরকারি রেডিয়ো এবং ৮৩টি টিভি স্টেশন চালু ছিল। এ ছাড়াও ১২টি আন্তর্জাতিক টেলিভিশন সম্প্রচারকারী সংস্থাকে আফগানিস্তানে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হয়। এ সব সামাজিক সূচক বিবেচনায় নিয়ে নির্দ্বিদায় বলা যায় আফগানিস্তানের মানুষ, বিশেষ করে নারীরা — গত দুই দশকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিগত শিক্ষা, চাকরি ও ব্যবসা করার অধিকার, মত প্রকাশের স্বাধীনতার স্বাদ পেয়েছিল। ফলে সে দেশের মানুষের একটি অংশের, বিশেষ করে উচ্চবিত্ত নারীদের মনন এবং চিন্তনে বড় রকমের আধুনিকায়ন হয়েছে। দেশটির মানুষের অন্তর্জগতের এই পরিবর্তন ও স্বকীয়তা আবারো প্রবল বাধার মুখে পড়ে তালেবান নেতাদের সরিয়াভিত্তিক শাসনে। একারণেই তালিব-নেতারা ক্ষমতা দখলে পর এবার কমবেশি ৬ লাখ আফগান নর-নারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমিয়েছে। কাবুল বিমানবন্দর থেকে আফগানদের দেশ ছাড়ার বিপজ্জনক দৃশ্য বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করেছেন।
এতো চেষ্টার পরও এখন দেখা যাচ্ছে আফগানিস্তানের সমাজে প্রগতিশীল ও ধনতান্ত্রিক বিকাশ গভীরে শিকড় গাড়তে পারেনি। এতে এখন একটা বিষয় পরিষ্কার হয়েছে — পশ্চিমা ধাঁচের ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যভিত্তিক এবং নারীর ক্ষমতায়নের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গ্রহণ করার মত বুদ্ধিসম্পন্ন জীবনবোধে উন্নীত হয়নি দেশটির সিংহভাগ নারী-পুরুষের মমনজগত। তাই এখনো তাদের পছন্দ শরিয়াভিত্তিক ইসলামি সমাজ ও রাষ্ট্র। জনগণের এই পছন্দেরই প্রতিফলন হয়েছে তালেবান নেতাদের পুনরায় ক্ষমতা দখলের মধ্য দিয়ে। এই কথা বলছি এই কারণে যে, তালেবানের নতুন প্রজন্মের নেতারা এবার ক্ষমতা দখল করেছে বলতে গেলে বাঁধাহীনভাবে। দেশের কোনো গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক শক্তি তালেবানের কাবুল দখলের বিরুদ্ধে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সামান্য প্রতিরোধও গড়ে তুলতে পারেননি। আফগানিস্তান আবারো প্রমাণ করলো বিদেশিদের পৃষ্ঠপোষকতায় কোনো ইসলামি সমাজে অধুনিক জ্ঞাননির্ভর পরিবর্তন সাধন করা কত দুঃসাধ্য! এই আর্থ-রাজনৈতিক কাজ, কেন এতো দুরূহ, তা বুঝতে হলে সংস্কৃতিতে সামন্তবাদী এবং অর্থনীতিতে অবিকশিত পুঁজিবাদী আফগান-সমাজের জ্ঞানকাঠামো এবং খারেজি ও কওমি মাদরাসার শিক্ষার বিষয়গুলো উপলব্ধি করতে হবে।
বার
তালিব আরবি শব্দ, এর অর্থ শিক্ষার্থী। তালিব-এর বহু বচন তালিবান, যার অর্থ ছাত্ররা। তবে এই আভিধানিক শব্দার্থ দিয়ে তালেবানকে বোঝা এখন মোটেই ঠিক হবে না। আফগানিস্তানের তালেবানকে বুঝতে হবে পাকিস্তানের মাদরাসায় ইসলামি জিহাদের দীক্ষা পাওয়া ছাত্রদের দ্বারা গঠিত একটি জিহাদি ইসলামি পার্টি হিসেবে, যারা এখন রাজনৈতিক ইসলামের বিজয়ী নেতা। এই তালেবান নেতারা হচ্ছেন তাদের দেশে কিংবা পাকিস্তানের খারেজি ও কওমি মাদরাসায় জঙ্গিবাদের পাঠগ্রহণ করা সাবেক তালেবান নেতা। এদের প্রথম প্রজন্মকে সামরিক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ দিয়েছেন পাকিস্তানের তখনকার সেনা কর্মকর্তা হামিদ গুল। এ সম্পর্কে জ্যাসম ফারগুসনের আফগানিস্তান ও তালিবান বিষয়ক বইয়ে বর্ণনা রয়েছে। তার ভাষায়, “In need , the fomer ISI chief Liutenant General Hamid Gul, who headed the department from 1987 to 1989, is known in Pakistan as ‘ the father of the Taliban’ and remains openly supportive of their cause to this day.”
এই তালেবান নেতাদের জীবনদৃষ্টি, সমাজ ও রাষ্ট্রবিষয়ক চিন্তা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেতে হলে আমাদের দেশের মাওলানা আল্লামা শাহ শফী, মওলানা জুনায়েদ বাবুনগরী এবং ইসলামি জিহাদের তরুণ তুর্কি মওলানা মামুনুল হকদের চিন্তা কাঠামো ও কাজকর্ম বিচার-বিশ্লেষণ করতে হবে। এদের সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তা বোঝার জন্য হেফাজতে ইসলামির ১৩-দফা পড়তে হবে, যা তারা বিএনপির মদদে শেখ হাসিনা সরকারের কাছে ২০১৩ সালে মতিঝিলের শাফলা চত্বরে উপস্থাপন করেছিল। তখন এই ১৩ দফার উচ্চসিত প্রশংসা করে সমর্থন করেছিলেন কবি ও লেখক ফরহাদ মজহার।
আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের কওমি ও খারেজি মাদরাসাগুলোতে আসলে কী শিক্ষা দেওয়া হয়? এক. কুরআন ও হাদিস অধ্যয়ন এবং আরবি, উর্দু ও ফরসি ভাষার চর্চা। এ ছাড়া মনগড়া বয়ানে পড়ানো হয় প্রাচীন ও মধ্যযুগের ধর্মযুদ্ধগুলো প্রসঙ্গে।
দুই. ইসলামি সমাজের জন্য দরকারি নীতি-আদর্শ এবং শরিয়াতন্ত্রের মাসলা-মাসায়েলের খুঁটিনাটি, এর সঙ্গে পড়ানো হয় বেহেস্ত ও দোজখ সম্পর্কে।
তিন. এর বাইরে শিক্ষা দেওয়া হয় ইসলামের ইতিহাস (পড়ুন আরব জাতির ইতিহাস)। এর অন্তর্ভুক্ত থাকে আরবে ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার আগের ধর্ম ও নবী-রাসুল এবং তাদের ন্যায়নিষ্ঠা, গৌরব গাথা ও বীরত্ব এবং অলৌকিকত্ব সম্পর্কে। এই ইতিহাস(!) চর্চার পাশাপাশি বেশি জোর দিয়ে পড়ানো হয় মদিনা রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা, মদিনা-সনদ, খোলাফায়ে রশেদ্বীন (ইসলামের চার খলিফার শাসন কাল, ৬৩২-৬৬১ খ্রিস্টাব্দ) এবং তুরস্কে ওসমানীয় খেলাফত এবং ইউরোপ ও উত্তর আফ্রিকায়(মিসর) আরব মুসলিমদের যুদ্ধ বিজয় , সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা ও গৌরবের (!) ফুলানো-ফাঁপানো বয়ান। এ ক্ষেত্রে ইসলামের মুহাদ্দেস ও ওয়াজিয়ানরা ‘তাক্বিয়া’ অনসরণ করে থাকেন। তাক্বিয়া হচ্ছে নবী, রাসুল ও আমিরুল মোমেনিন এবং ইসলামি রাষ্ট্রের সেনাপতিদের গরুতর দোষ-ত্রুটি গোপন রাখা। এই তাক্বিয়াভিত্তিক সংকীর্ণ ও যুক্তিহীন মানসিকতা থেকেই ইসলামি রাষ্ট্রের পতন এবং দুর্দশার জন্য অভ্যন্তরীণ সামাজিক উপাদান বিবেচনায় নেওয়া হয় না। বরং কোমলমতি ছাত্র-ছাত্রীদের শিখানো হয় ইসলামি সমাজের দুর্দশা, আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া, অভ্যন্তরীণ কলহ-কোন্দল এবং ইসলামের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় সাম্রাজ্যগুলোর পতন হয়েছে ইহুদি-নাছারাদের ষড়যন্ত্রে ও সামরিক আক্রমণে। একারণে ইহুদি, খ্রিস্টান ও বিধর্মীরাই ইসলামের চিরশত্রু। এদের সঙ্গে কখনোই আপস বা সহাবস্থান হতে পারে না। এই বিধর্মীদের সব সময় ঘৃণা করা এবং শক্তি থাকলে এদের বিরুদ্ধে আল্লাহর পথে জিহাদ করাই একজন প্রকৃত মুসলিমের প্রধান কর্তব্য। হ্যাঁ স্বীকার করছি, ইসলামে সুফিবাদী ও মানবতাবাদী সম্প্রদায় আছে। অন্য ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের সঙ্গে মিলেমিশে চলার রীতি-রেওয়াজও রয়েছে, কিন্তু এখনে আমি বলছি রাজনৈতিক ইসলামের কথা। যা এখন আমরা আফগানিস্তানে দেখছি। প্রসঙ্গত পাকিস্তান, ভারত ও বাংলাদেশেও এই সালাফি আদর্শের মৌলবাদীরা রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন।
তের
এবার আফগানিস্তানে তালেবান নেতারা অতি সহজে ক্ষমতা দখল করতে সমর্থ হয়েছেন। এর মূলে রয়েছে কাতারের রাজধানী দোহায় যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে তাদের সমঝোতা চুক্তি। এই চুক্তির সারমর্ম হচ্ছে — তালেবান নেতারা তাদের জিহাদি ইমলাম দেশের বাইরে ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ করবেন না। তারা দেশটির ভূখণ্ড অন্য দেশের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার জন্য কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবেন না। সরকার গঠন করবেন অন্তর্ভুক্তিমূলক চিন্তার আলোকে। সমাজে ভিন্নমতের মানুষ, সম্প্রদায় ও নারীদের অধিকার ক্ষুণ্ন করে এমন প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিবেন না। মেনে চলবেন সার্বজনীন মানবাধিকার। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তালেবান নেতারা কি এই অঙ্গীকার মেনে চলবেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার আগে আমাদেরকে জানতে হবে অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ ও রাষ্ট্র বলতে কী বুঝায়? অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজের প্রথম শর্ত হচ্ছে ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-জাতীয়তা নির্বিশেষে দেশের সকল মানুষ আইনের দৃষ্টিতে রাষ্ট্র ও শাসকদের কাছে সমান অধিকার ভোগ করবেন। এই নিশ্চয়তা দেশের সংবিধানে থাকতে হবে। পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী ও দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের জীবন-জীবিকা এবং জান-মালের নিরাপত্তার সুরক্ষা শাসননীতিতে থাকবে। গণতান্ত্রিক উপায়ে সংগঠিত হওয়ার এবং বাক-ব্যক্তির স্বাধীনতার গ্যারান্টি দেশের শাসনতন্ত্রে লিপিবদ্ধ থাকবে। দেশকে হতে হবে প্রজাতান্ত্রিক এবং নির্বাচন কমিশনের মাধ্যমে চার-কিংবা পাঁচ বছর পর পর অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোটে সরকার পরিবর্তনের সুযোগ সাংবিধানে থাকতে হবে। সমকামী, লেসবিয়ান ও ধর্মচিন্তামুক্ত সংখ্যালঘু মানুষদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রশাসনিক, বিচারিক ও আইনিব্যবস্থা সমাজে ও রাষ্ট্রে থাকবে। এখন আলোচনায় আসি, তালেবান নেতারা অন্তর্ভুক্তিমূলক গণতান্ত্রিক ও মানবিক সমাজের সঙ্গে এক মত হওয়ার বুদ্ধিভিত্তিক সক্ষমতা রাখেন কী রাখেন না। আমার বিবেচনায় কওমি ও খারেজি মাদরাসায় শিক্ষিত তালেবান নেতারা অন্তর্ভুক্তিমূলক সামাজিক আচরণ এবং রাষ্ট্রচিন্তার সঙ্গে ঐকমত্য পোষণ করতে পারবেন না। কারণ রাজনৈতিক ইসলামের জিহাদি চিন্তার পোকা তাদের মাথায় গিজগিজ করছে। এমনি ভয়ংকর, প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রাচীনপন্থি চিন্তায় বেহুস কোনো যোদ্ধাগোষ্ঠীর নেতাদের কেউ যদি অন্তর্ভুক্তিমূলক রাষ্ট্র ও সংবিধানের কথা বলেন,তা হলে সঙ্গেসঙ্গেই তিনি মুনাফেক হিসেবে চিহ্নিত হবেন, তাকে বিধর্মী বলে ফতোয়া দেবেন তারই সহযোদ্ধারা — সাবেক তালেবান নেতারা। তাকে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে বাঁচতে হবে। নচেৎ তাকে ধর্ম রক্ষার নামে শিরোশ্ছেদ করা হবে।
তালেবান নেতারা দেশ শাসনের লক্ষ্যে সর্ব্বোচ নীতিনির্ধারণী পরিষদ (রাহবারি শুরা বা লিডারশিপ কাউন্সিল) গঠন করেছেন। এই শাসনপরিষদের প্রধান করা হয়েছে মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দকে। তিনি এক সময় তালেবান সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মোহাম্মদ ওমরের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। এই পরিষদ কান্দাহার থেকে পরিচালিত হয়। প্রাচীন এই শহরকে তালেবানের আঁতুড়ঘর বলা হয়। আফগানিস্তানের তালেবান শাসনের প্রথম মেয়াদে (১৯৯৬-২০০১) মোল্লা মোহাম্মদ হাসান আখুন্দ কান্দাহারের গভর্নর ছিলেন। এই শাসন আমলেই তিনি দেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং উপ-প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। এই নেতার সারা দেশেই সুনাম ও পরিচিতি রয়েছে। ২০ বছর ধরে তিনি তালেবানের রাহবারি শুরা’র দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি যতটুকু না শমর কৌশুলী তার চেয়ে বেশি পরিচিত ধর্মীয় ও রাজনৈতিক নেতা হিসাবে।
লক্ষ্য করার বিষয়, তালেবানের শাসনপরিষদে কিন্তু কোনো নারীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বরং দেশটির তালেবান সরকার নারী ও শিশুমন্ত্রণালয় বন্ধ করে দিয়েছে। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শ্রেণিকক্ষে পর্দা টানিয়ে নারী ও পুরুষ শিক্ষার্থীদের পৃথক করা হয়েছে। এক তালেবান নেতা নারীদের প্রতি অসভ্য এবং কুরুচিপূর্ণ বক্তব্য দিয়েছেন। বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে ওই নেতা বলেন, “যে নারীরা হিজাব পরেন না, তারা হচ্ছেন কেটে ফালি করে রাখা তরমুজের মত...।” মানবসমাজের অর্ধেকই হচ্ছে নারী, সমাজ-সভ্যতার বাঁকে-বাঁকে নারীদের অবদানের কথা লিখে শেষ করা যাবে না। অথচ দেখুন, এই নারী সমাজের প্রতি তালেবান নেতার এই ধর্ষকামী মন্তব্যই ইঙ্গিত দিচ্ছে, তালেবান প্রশাসন দেশটিকে কী ধরণের অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার দিকে এগুচ্ছে!
তালেবান সরকারের শিক্ষামন্ত্রী শেখ মৌলবি নুরুল্লাহ মুনির ইতোমধ্যেই বলেছেন, “পিএইচডি বা মাস্টার্স ডিগ্রির কোনো মূল্য তাদের কাছে নেই। কারণ তাদের দলভুক্ত তালিব-নেতা বা কোনো মোল্লার এ ধরনের উচ্চশিক্ষা নেই, এমনকি তারা উচ্চ বিদ্যালয়ের গণ্ডিও পার হননি। তাতে কি কোনো সমস্যা হয়েছে? হয় নি। তারাই এখন দেশে সেরা।” এই যে মারাত্মক মূর্খতা এবং অভদ্র আত্মগৌরব, কিংবা নিজেদের শ্রেষ্ঠ ভাববার মানসিকতা, এর সঙ্গে কিন্তু জার্মানির অ্যাডলফ হিটলার এবং ইতালির বেনিতা মুসোলিনির ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রচিন্তা ও সমাজদর্শনের শতভাগ মিল রয়েছে। তাহলে চিন্তা করুন, এই মোটা মাথার গোঁয়ার-গোবিন্দ তালিব-নেতাদের দ্বারা কি গণতান্ত্রিক, নারীবান্ধব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার এবং সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব?
ভারতের কলকাতার সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায় জানবাজ নামের এক আফগান যুবককে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন। কাবুলিওয়ালার বাঙালি বউ হয়ে তিনি পাড়ি জমিয়েছিলেন শ্বশুরবাড়ি আফগানিস্তানে। তালেবান সম্পর্কে তার বয়ান,‘‘ ... তালেবানরা অনগ্রসর, চরম মৌলবাদী ও রক্ষণশীলতার প্রতীক। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কে, অর্থনৈতিক ও মানবিক ভাবধারার উন্নয়ন এবং বিকাশ ইত্যাদি ব্যাপারে তারা হাজার বছর পিছিয়ে ...।’’ প্রসঙ্গত, লেখার জন্য তথ্য উপাত্ত সংগ্রহের ইচ্ছা নিয়ে স্বজনদের নিষেধ সত্ত্বেও দ্বিতীয়বার আফগানিস্তানে যান। এবার তালেবান সৈন্যরা তাকে আটক করে। নির্যাতনের পর এই সাহসী নারীকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এই লেখাটি যখন লিখছি তখন নতুন প্রজন্মের জিহাদি তালেবান নেতারা বছরাধিককাল আগে দ্বিতীয় বার আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করেছেন। এর মধ্যেই তারা বালক-বালিকাদের সহশিক্ষা বন্ধ করে দিয়েছেন। নারীদের জন্য স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিষিদ্ধ করেছেন। পুরুষ-শাসিত আফগান সমাজ নারী-শিক্ষা, নারীর কর্মসংস্থান, চলাফেরার স্বাধীনতা ও আর্থ-রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন একদমই সহ্য করে না। এই অতি-আধুনিক যুগেও আফগানদের নারীর প্রতি কেন এই বিরূপতা? কেন এই অবিশ্বাস ও নিষ্ঠুরতা?
এই প্রশ্নের জবাবে ব-দ্বীপ প্রকাশনের প্রকাশক, লেখক ও সমাজগবেষক শামসুজ্জোহা মানিক বলেন :
আজকের আফগানিস্তানের তালিবান উত্থানের তাৎপর্য বুঝতে হলে মূল যে বিষয়টা বুঝা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে আমার কাছে মনে হয় সেটা হল আফগান সমাজে নারীর অবস্থান। প্রকৃতপক্ষে আফগান সমাজে নারী গৃহবন্দী থাকবে কি থাকবে না এই প্রশ্নই শতাব্দী কালেরও অধিককাল ধরে আফগান রাজনীতিতে সকল সংঘাতের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে আছে। যারা নারীকে গৃহবন্দী করে রাখতে চায়, বাইরে গেলে আপাদমস্তক কালো বোরখামুড়ি এবং পুরুষ প্রহরায় রাখতে এবং শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখতে চায় তাদেরই প্রতিনিধি হচ্ছে আজকের তালিবান। আজ থেকে শত বৎসর পূর্বে এক স্বাপ্নিক রাজা আমানুল্লাহ আধুনিক ও উন্নত আফগানিস্তান গড়ার লক্ষ্যে কিছু রাজনৈতিক ও সামাজিক সংস্কারে হাত দেন। তিনি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে জন-প্রতিনিধিত্বমূলক ব্যবস্থা গড়ার উদ্যোগও নেন। তবে তিনি নারীদের বন্দীদশা থেকে মুক্ত এবং শিক্ষায় শিক্ষিত করতে গিয়ে দেশব্যাপী প্রবল গণ-বিদ্রোহের সম্মুখীন হন। বিদ্রোহের মুখে তিনি ১৯২৯ সালে ক্ষমতা ত্যাগ করে ভারত হয়ে ইউরোপে চলে যান। তার ব্যর্থতা এবং দেশত্যাগের সঙ্গে আফগানিস্তানের আধুনিকায়ন প্রচেষ্টা মুখ থুবড়ে পড়ে। দীর্ঘ বিরতির পর আধুনিকায়নের লক্ষ্যে আর একটি উদ্যোগ নেয় কম্যুনিস্ট বা মার্কসবাদীরা যা চলেছিল ১৯৭৮ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত। তাদের ব্যাপক সংস্কার কর্মসূচীর মধ্যে বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ ছিল নারীর শিক্ষা এবং অধিকার প্রতিষ্ঠা এবং ভূমি সংস্কার। এই সকল সংস্কার কর্মসূচীর বিরুদ্ধে মোল্লা শ্রেণীর নেতৃত্বে যে ব্যাপক বিদ্রোহ ঘটে তাতে বিপুল সাহায্য-সহযোগিতা করে মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ। পাশ্চাত্যের সাহায্যপ্রাপ্ত ইসলামী মুজাহিদীন বাহিনী ১৯৯২ সালে ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ইসলামবাদীদের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ২০০১ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তালিবান শাসিত আফগানিস্তান আক্রমণ করে দখল করে নেয়। কিন্তু তালিবান বাহিনী সারাদেশ ব্যাপী প্রতিরোধ যুদ্ধ গড়ে তুলে। তালিবান বাহিনীর বিজয় এবং মার্কিন বাহিনীর পরাজয় ও পলায়নের সঙ্গে ২০২১ সালের আগস্টে আফগানিস্তানে ২০ বৎসরের মার্কিন দখলদারির অবসান ঘটে।
এই সঙ্গে অবসান ঘটে বিদেশীদের অধীনে হলেও আধুনিকায়নের পথে আফগানিস্তানের যেটুকু যাত্রা হয়েছিল সেই যাত্রারও। তালিবান বিজয় পরবর্তী সামান্য সময়েই আফগানিস্তান পুরাপুরি একটি মধ্যযুগীয় সমাজে নিজেকে রূপান্তরিত করেছে, যার কেন্দ্রে রয়েছে গৃহবন্দী, বোরখাবন্দী এবং পশুসম মর্যাদার অধিকারী আফগান নারী সমাজ। যে সমাজের অর্ধেক অংশ পশুপ্রায়, নিরক্ষর, অধিকারবিহীন, পুরুষের ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত প্রাণী সেই সমাজের অবস্থা কী হতে পারে তা সহজেই কল্পনা করা যায়। সবচেয়ে বড় কথা মানুষের জন্ম যে শুধু নারী দেয় তা-ই নয়, উপরন্তু তাকে লালন এবং শিক্ষিতও করে মূলত নারী। সেই নারীর এমন হীন দশা থেকে কী রকম জাতি জন্ম নিতে পারে তা সহজেই বুঝা যায়। কিন্তু শতাব্দী কালের অভিজ্ঞতা থেকে একটা বিষয় বেরিয়ে আসে যে আফগান নারীদের পদদলিত এবং বন্দী করে রাখবার মধ্যে রয়েছে আফগান পুরুষ তথা আফগান সমাজের আবেগের সবচেয়ে বড় উৎস। আর তাই এই জায়গাতেই অর্থাৎ অবরুদ্ধ ও অবদমিত নারীত্ব প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে সমগ্র আফগান সমাজের ব্যাপক অংশই হিংস্রভাবে ঐক্যবদ্ধ।
এটা ঠিক যে, নারীর জন্য এমনই এক মানবেতর ও দমনমূলক জীবন-দর্শন হিসাবে কাজ করেছে ইসলাম ধর্ম। কিন্তু সেখানে প্রশ্ন আসবে এমন ধর্মের উত্তরাধিকার নিয়েও মুসলিম দেশগুলি যেখানে কিছু করে বেরিয়ে আসছে নারীর বিরুদ্ধে ইসলামের এই দাসত্বের নিগড় থেকে সেখানে আফগানিস্তান কেন পারছে না? আজ থেকে এক শতাব্দী আগে তুরস্কে নারীর মুক্তির পথে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল সেখানে ইসলামের সকল প্রতাপ থাকা সত্ত্বেও আজ অবধি সে যাত্রা রুদ্ধ হয় নাই। ইসলামের কেন্দ্র সৌদী আরবের নারীরাও এখন সংস্কারের মুক্ত হাওয়ায় প্রাণভরে মুক্ত নিঃশ্বাস নিতে শুরু করেছে। দেশে দেশে ইসলামবাদীরা ক্ষুব্ধ হচ্ছে, কোথায়ও ক্ষিপ্তও হচ্ছে। কিন্তু নারীদেরকে আার আগের অবস্থায় নিতে পারছে না। ইরান তো এখন হিজাব ও বোরখা থেকে মুক্তির দাবীতে নারী বিদ্রোহের জোয়ারে প্লাবিত হচ্ছে। ইসলামবাদী শাসকরা এর মধ্যে শত শত প্রতিবাদীর প্রাণ কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু নারীর বিপ্লবের পথ ধরে ইরানের নূতন বিপ্লবের পথে জয়যাত্রা যে শুরু হয়েছে সেই আশাবাদ ব্যক্ত করা যায়।
কিন্তু আফগানিস্তান বার বার প্রত্যাবর্তন করেছে তার ভয়ঙ্কর মধ্যযুগের অন্ধকারের দিকে। এখান থেকে যারাই তাকে আধুনিকতার আলোর দিকে নিতে চেয়েছে তাদের বিরুদ্ধেই তার হিংস্র প্রত্যাঘাত। কিন্তু কেন? এটা বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় যে, অন্যান্য প্রশ্নে আফগান সমাজ কিছু ছাড় দিলেও নারীর প্রশ্নে তার সামান্য নমনীয়তাও নাই। পুনরায় প্রশ্ন, কেন?
আমার ধারণা, এ প্রশ্নের উত্তর শুধু ইসলাম ধর্মে নাই, সেই সঙ্গে আছে আফগানিস্তানের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যেও। ইসলাম ধর্ম এই ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মধ্যে তার দৃঢ় ভিত্তি পেয়েছে মাত্র। আর তখন আমাদেরকে দৃষ্টি দিতে হয় অন্ততপক্ষে দুই হাজার বছর আগে শুরু হওয়া শক এবং কিছু পরবর্তী কালে ঘটা হুন হানাদারদের ভারতে আক্রমণ অভিযানগুলির দিকে। মধ্য এশিয়ার মরুচারী-পশুচারী যাযাবর ও অর্ধযাযাবর জনগোষ্ঠীগুলি এই সময় পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের কৃষিসমৃদ্ধ ও সভ্য স্থিতিশীল সমাজগুলির জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক হয়ে দেখা দিয়েছিল। খ্রীষ্টীয় প্রথম কয়েক শতাব্দীতে ইউরোপের রোমান সাম্রাজ্য পর্যন্ত হুন আক্রমণে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এশিয়ায় ইরানসহ বিশাল ভূভাগ হুন আক্রমণ অভিযানগুলিতে বিপন্ন হয়ে পড়ে। সমৃদ্ধ ও উন্নত সভ্যতার অধিকারী ভারতও এইসব যাযাবরের আক্রমণ অভিযান থেকে পরিত্রাণ পেল না। তবে ভারতে আসবার আগে তাদের পার হয়ে আসতে হত পার্বত্যভূমি আফগানিস্তান।
এক সময় আফগানিস্তান ছিল ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। আজ হতে প্রায় পৌনে পাঁচ হাজার বছর আগে সূচিত সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত ছিল আফগানিস্তানের দক্ষিণ-পূর্ব অংশ। এই সভ্যতার অবসান হয় ১,৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে । অর্থাৎ সুদীর্ঘ কাল পূর্বে এক মহান ভারতীয় সভ্যতার অংশ ছিল আজকের আফগানিস্তান। সিন্ধু সভ্যতার পতনের পরও বহুকাল পর্যন্ত ভারতীয় সভ্যতা ও সংস্কৃতি দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত ছিল আফগানিস্তান। সুতরাং আফগানিস্তান ছিল বহুকাল পর্যন্ত বৌদ্ধধর্ম দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। এর সাক্ষী হিসাবে সেদিনও বিদ্যমান ছিল বামিয়ান পর্বতগাত্রে ক্ষোদিত মহাকায় বুদ্ধ মূর্তিগুলি। ধর্মোন্মাদ তালিবান কামান দেগে এগুলিকে ধ্বংস করেছে।
প্রকৃতপক্ষে শক-হুন প্রভৃতি বহিরাক্রমণকারীরা ভারতে প্রবেশের পূর্বেই আফগানিস্তানের সমাজ ও সভ্যতার ব্যাপক ধ্বংসসাধন করে। বিপুল সংখ্যক স্থানীয় মানুষ তাদের হাতে নিহত হয় এবং সেই সঙ্গে তাদের নারীরা তাদের লুণ্ঠন ও অপহরণের শিকার হয়। একই পরিণতি বরণ করতে হয় ভারতের উত্তর-পশ্চিমের বিশাল ভূভাগের মানুষদেরকেও। এটা ঠিক যে, ভারতীয়দের প্রতিরোধও ছিল, ছিল অনেক বিজয়ও। কিন্তু শত শত বৎসরের ক্রমাগত অভিযানকে সর্বদা প্রতিরোধ যেমন করা যায় নাই তেমন ক্ষয়-ক্ষতিকে এড়ানোও যায় নাই। বিদেশী আক্রমণকারীদের সহজ লক্ষ্যবস্তু হয়েছে অর্থ-সম্পদ এবং নারী। ভারতে যখন তারা টিকতে পারে নাই কিংবা দৃঢ় প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছে তখন স্বাভাবিকভাবে তারা দুর্গম আফগানিস্তানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। এই আফগানিস্তান হয়েছে ক্রমে সকল হানাদারের নিরাপদ আশ্রয়স্থল।
পরবর্তী মুসলিম হানাদাররা দেখা দিল পূর্ববর্তী এই শক-হুন প্রভৃতি হানাদারদের উত্তরসূরি হিসাবে। ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে এরা শত শত বছর ধরে এসেছে। এবার তারা আক্রমণ ও লুণ্ঠন অভিযানের জন্য একটা ধর্মীয় দর্শনের পতাকা উড়িয়েছে। ইসলামের ধর্মীয় বিধান অনুযায়ী বিধর্মী বা অমুসলিম ভারতীয়দের উপর তাদের সকল আক্রমণ, হত্যা, লুণ্ঠন, নারী অপহরণ ও ধর্ষণ বৈধ। ইতিহাসে কয়েকটি নাম আমাদের বহু পরিচিত হয়ে আছে; যেমন, মুহাম্মদ বিন কাসিম, সুলতান মাহমুদ, মুহাম্মদ ঘুরী, বক্তিয়ার খলজী, তৈমুর লং, নাদির শাহ, আহমদ শাহ আবদালী, ইত্যাদি। কাসিম বাদে আর সবাই এসেছে আফগানিস্তান পার হয়ে। যারা ফিরেছে তারা সবাই ফিরেছে বিপুল সম্পদ এবং বন্দী পুরুষ ও নারী সাথে নিয়ে। এবং অধিকাংশই স্থায়ী আবাস গেড়েছে আফগানিস্তানে। ঊষর পার্বত্য ভূমিতে পুরুষ বন্দীর প্রয়োজন খুব সীমিত। সুতরাং বন্দীদের খুব বেশী অংশই হয়েছে নারী। শত শত বছর বিভিন্ন সময়ে এভাবে আফগানিস্তান থেকে মুসলিম হানাদাররা ভারতের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে এবং ফিরবার সময় সম্পদের সঙ্গে যে যেভাবে পারুক নারীদের বন্দী করে নিয়ে গেছে। ১১৭৫ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদ ঘুরী ভারতে সফলভাবে আক্রমণ অভিযান শুরুর মাধ্যমে ভারতে কয়েক শত বছরের স্থায়ী মুসলিম শাসনের ভি্ত্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ফলে লুণ্ঠন অভিযানের ধারাবাহিকতা ও প্রচণ্ডতা তুলনায় হ্রাস পায়। কিন্তু ভারতে শত শত বৎসরের মুসলিম শাসনের তুলনামূলক স্থিতিশীলতার কালেও এই ঐতিহ্য কম-বেশী আফগান জীবনে প্রভাব বিস্তার করে রেখেছে। কালের গতিধারায় এই লুণ্ঠিত ও ধর্ষিত নারীরা গঠন করেছে আফগান সমাজের প্রধান ভিত্তি। কারণ তারা জন্ম দিয়েছে সন্তান।
শত শত বছর ধরে স্বজন ও স্বদেশ থেকে জোর করে ধরে আনা এই নারীদের জীবনের বাস্তবতাকে মাথায় নিয়ে চিন্তা করতে হবে। জবরদস্তি করে ধরে আনা এই নারীরা আফগান পুরুষদের মনের উপর এক প্রবল চাপও সৃষ্টি করেছিল। এই নারীরা কখন কোন পুরুষের হাত ধরে পালাবে এই ভয়ও আফগান পুরুষদের মনে সর্বদা থাকাটা স্বাভাবিক ছিল। সুতরাং ইসলামের অনুশাসন ব্যবহার ক’রে নারী অবরোধের এক নিশ্ছিদ্র ব্যবস্থা আফগান সমাজ গড়ে তুলেছে, যার ফলে ইসলাম ধর্মের প্রশ্নে আফগান সমাজ (পুরুষতান্ত্রিক সমাজ) এত প্রচণ্ডভাবে রক্ষণশীল এবং এমন হিংস্রভাবে আক্রমণাত্মক। আমার ধারণা আফগান সমাজের বাস্তবতা এবং সমস্যা বুঝতে চাইলে তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রায় অনালোচিত এই দিকের উপর আলোকপাত করার বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে।
চৌদ্দ
১৯৭৯ সালে আয়াতুল্লা খোমেনির নেতৃত্বে ইসলাম ধর্মের শিয়া মাজহাবের কাঠ মোল্লারা ইরানের শাসক রেজা শাহ পেহলভিকে সিংহাসন থেকে হটিয়ে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে দেশটির প্রেসিডেন্ট হন আবুল হাসান বনি সদর। তিনি ছিলেন ইরানের শিয়া জিহাদিদের মিত্র। তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবে খোমেনি পক্ষকে অনেক সাহায্য করেছিলেন। সেই সুবাদেই তিনি বিপ্লব-উত্তর ইরানের প্রথম প্রেসিডেন্ট মনোনীত হন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর কট্টরপন্থি শিয়া মোল্লাদের সঙ্গে তার রাজনৈতিক মতভেদ বাড়তে থাকে। শুরু হয় ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। এক পর্যায়ে অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি ফ্রান্সে পালিয়ে গিয়ে জান ও ইজ্জত রক্ষা করেন। ইরানের রেজা শাহকে ক্ষমতা থেকে হটানোর আন্দোলনে মাকর্সবাদী তুদে পার্টি ছিল আয়াতুল্লাহর সমর্থক। কিন্তু ইসলামি বিপ্লবে আয়াতুল্লারা (শিয়া ধর্মীয় নেতা) বিজয়ী হওয়ার পর রাষ্ট্রের জিহাদি ঘাতক বাহিনী ব্যবহার করে মাকর্সবাদী তুদে পার্টির লোকদের কিভাবে নির্মূল করা হয়েছে তা এখন এক সুবিদিত ইতিহাস।
আফগানিস্তানের জনগোষ্ঠীকে জাতিগত ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে চার ভাগে ভাগ করা যায়। পাশতুন বা পাখতুন, তাজিক, উজবেক ও হাজারা। দেশটিতে পাশতুন বা পাঠানদের হার জনসংখ্যার ৬০ %, তাজিক ৩১%, উজবেক ৫%, হাজারা ৩% । জনসংখ্যার অবশিষ্ট ১% এর মধ্যে রয়েছে হিন্দু, শিখ ও ইহুদি। এছাড়া মধ্য এশিয়ার অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও ধর্মের মানুষও সামান্য সংখ্যায় রয়েছে। আফগানিস্তানে বিশটিরও অধিক ভাষা প্রচলিত আছে। তবে দুটি ভাষা প্রধান পশ্তু ও ফারসি। ফারসি ভাষা ইরানের রাষ্ট্রভাষা। আফগানিস্তানের শিক্ষাব্যবস্থায় পশ্তু ও ফারসি ভাষা শেখার ব্যবস্থা রয়েছে। দেশটির ৭৫ ভাগ মানুষ পশ্তু ও ফারসি ভাষা ব্যবহার করেন। তবে আফগানিস্তানে ইদানিং উর্দু ও হিন্দি ভাষার প্রচলন বেড়েছে। ১৯৩৬ সালে পশ্তু ভাষাকে আফগানিস্তানের রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেওয়া হয়।
আফগানিস্তান একটি আধা-সামন্ততান্ত্রিক (কেউ বলবেন পুরো মাত্রায়) দেশ। এমন একটি সমাজ ও দেশে পাশ্চাত্য ধরনের গণতন্ত্র ও নারী অধিকার আশা করা যায় না। তাছাড়া প্রত্যেক রাষ্ট্রিক সমাজের জনগোষ্ঠীর চিন্তা ও সাংস্কৃতিক বিকাশ বৈশিষ্ট্য এক রকম এবং এক ধাঁচের হয় না। তাই আফগানিস্তানে অন্তর্ভূক্তিমূলক গণতন্ত্র ও সমাজ প্রতিষ্ঠা পেতে আরো অনেক বছর লাগবে। সেই সময়টুকু বিশ্ব নেতারা কি আফগানিস্তানের সাধারণ মানুষকে বর্জন করবেন? তাদের অভুক্ত রেখে মারবেন? যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্য পরাশক্তিগুলোর বর্তমান আচরণ কিন্তু এমনই। আমি এই মনোভাবের পক্ষে নই। তাছাড়া বাইরে থেকে বল প্রয়োগে কি আফগানিস্তানে গণতন্ত্র ও নারী অধিকার আসবে? আপাতত সেই সম্ভাবনা দেখছি না। আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্র ও পাশ্চাত্য শক্তির ব্যর্থতা কী সেই শিক্ষা দেয়নি? ‘পাকা কাঁঠালের রসালো কোষ পেতে হলে জৈষ্ঠ্য মাস পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। চৈত্র মাসে আধা-পরিপক্ক কাঁঠাল গাছ থেকে পেড়ে কৃতিমভাবে পাকালে সেই কাঁঠালের কোষে রস থাকবে না, সুঘ্রাণও মিলেবে না।’ ওই যে বাউল গানের কলি ‘‘... কিলাইলে কি কাঁঠাল পাকে, ইলিশ মাছ কি বিলে থাকে...’’। আফগানিস্তানকে সেদেশের মানুষ ও নেতাদের চিন্তা অনুযায়ী বিকাশ হওয়ার সুযোগ দেওয়া উচিত। কারণ তালেবান নেতারা তো ওয়াদা করেছেন আফগানিস্তানের মাটি কোনো সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে প্রতিবেশী দেশ এবং বহির্বিশ্বে ইসলামি সন্ত্রাসবাদ রফতানিতে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। তবে হ্যাঁ, তারা যদি তাদের দেওয়া কাতারের দোহা-ওয়াদা ভঙ্গ করেন, তা হলে অন্য কথা।
সহায়ক গ্রন্থ
১. আফগানিস্তান অতীত ও বর্তমান, লেখক : ড. গোলাম কিবরিয়া ভূঁইয়া
২. কাবুলীওয়ালার বাঙালি বউ, লেখক : সুস্মিতা বন্দ্যোপাধ্যায়
৩. Taliban: The true story of the World's fiercest guerilla fighters, James Furgosson.
৪. দেশে-বিদেশে, সৈয়দ মুস্তবা আলী
৫. নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবর্ষ ও অক্ষ শক্তি, লেখক: সুধী প্রধান।
৬. এ ছাড়া এই লেখাটির জন্য সম্প্রতি প্রকাশিত দেশি-বিদেশি দৈনিক ও ম্যাগাজিন থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে।