লিখেছেনঃ — অভিরূপ মুখোপাধ্যায়, শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ July 5, 2023, 12:00 AM, Hits: 1221
(ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার গতিধারা বিষয়ে সম্প্রতি শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চলের সঙ্গে ভারতের পশ্চিম বঙ্গ থেকে অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের বেশ কয়েকটি পত্রবিনিময় হয়। পত্র বিনিময়ের গুরুত্ব বিবেচনা করে এগুলির মধ্য থেকে তাদের লিখা সর্বশেষ পত্র দুইটি ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রকাশ করা হল। নিম্নে শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম কর্তৃখ প্রেরিত যৌথ পত্রের উত্তরে অভিরূপ মুখোপাধ্যায় ২৫ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে যে উত্তর দেন সেটি এবং সেটির উত্তরে মানিক ও চঞ্চল উভয়ে তাকে ৩০ জুন, ২০২৩ তারিখে যে উত্তর দেন সেটি এখানে প্রকাশ করা হল। প্রথমে ২৫ এপ্রিল তারিখে পাঠানো অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের পত্রটি এবং অতঃপর ৩০ জুন, ২০২৩ তারিখে পাঠানো শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চলের পত্রটি প্রকাশ করা হল। —বঙ্গরাষ্ট্র)
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়ের পত্র । প্রেরণ তারিখ : ২৫ এপ্রিল, ২০২৩
প্রিয় মানিক ও চঞ্চলবাবু,
গত ১৭ মার্চ, ২০২৩ তারিখের যৌথপত্রে আপনারা ভারতের গ্রাম-সমাজ সম্পর্কে নিজস্ব অভিমত দিয়েছেন। বলতে গেলে আমি একমত আপনাদের বক্তব্যের সাথে। সেই সাথে আমার নিজের কিছু মতের সংশোধন ও পরিমার্জন করে নেব।
আমি একমত আপনাদের সাথে যে, 'স্বয়ংসম্পূর্ণ' গ্রাম বলে বাস্তবে কিছু দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমের শিক্ষিত সমাজ একপ্রকারে আমাদেরকে বিপথে চালানোর চেষ্টা করেছে। মার্কসের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, তিনি ভারত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ব্রিটিশ রিপোর্টের ওপরই নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে মধ্যবয়স্ক মার্কস ভারতের গ্রাম অথবা সার্বিক বিচারে এশিয়ার গ্রাম-সমাজ সম্পর্কে যা মন্তব্য করবেন, তার নেতিবাচক সমালোচনায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থের হিসেব দেখতে পাওয়া যাবে। সে-ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগবে, ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে ফেলার এত তাগিদ ছিল কেন ব্রিটিশদের? কৃষির পতন ঘটানো তাদের লক্ষ্য ছিল না, কারণ উপনিবেশের কৃষির রক্ত চুষেই ব্রিটিশ নাগরিকদের বিলাস ব্যসন চলত। ফলে ভারতের ব্রিটিশ প্রভুরা অন্য উদ্দেশ্যেই পূর্ব ভারতের গ্রামীণ কাঠামোর পতন ঘটাতে চেয়েছিল। এই প্রসঙ্গেই আলোচনায় আসবে পঞ্চায়েতের কথা। মানিকবাবুর একটি রচনা আছে 'বঙ্গরাষ্ট্র'-এ; সেটি হল 'ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পঞ্চায়েত'। কয়েকটি গ্রাম সংঘবদ্ধ স্থানীয় প্রশাসনের মতো কাজ করত এই পঞ্চায়েত। এখন সর্বক্ষেত্রে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে ব্রিটিশ সরকার আর কৃষিভিত্তিক জনসমাজের মাঝে প্রশাসনিক বাধা হয়ে দাঁড়াবে এই পঞ্চায়েত। একটা স্থানীয় প্রশাসনের মতো কাজ করায় এলাকার মানুষকেই ঠকিয়ে অন্যায় কিছু হাসিল করে নেওয়া পঞ্চায়েতের অধিকর্তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার ওপর ছিল জনমতের বিপুল চাপ। ব্রিটিশরা প্রথমত স্থানীয় পরিসরে স্বায়ত্তশাসন রাখতে চায়নি, দ্বিতীয়ত, দেশীয় জনমতের ভিত্তিতে ব্রিটিশরা সরকার বসায়ওনি। আমার অনুমান, প্রধান শত্রু এই আপাত স্বনির্ভর সমাজের শিরদাঁড়া ভেঙে ফেলার মনোভাবকে কার্যকরী করতে গিয়ে পঞ্চায়েতের অস্তিত্বের কথা সরকারিভাবে চেপে গিয়েছিল ব্রিটিশরা। আর নিরিবিলি গ্রামবাংলার পঞ্চায়েতি কাঠামোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে 'স্বয়ংসম্পূর্ণ, একক' গ্রামের ধুয়ো তুলল সাদা চামড়ার বানিয়ারা। ফলে তাত্ত্বিকভাবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, কারণ স্বনির্ভর গ্রামের অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে তা থাকার কথা নয়। বড়োজোর 'অধিক পরিমাণে যোগাযোগ' তৈরি করা, তথা সরকারি স্বার্থে রেলপথ বসানোর ছুতোটাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ব্রিটিশরা 'বিচ্ছিন্ন' গ্রামের গল্প ফাঁদে বলে আমার বিশ্বাস।
এবার আমি আসব একটু অতীতের আলোচনায়। সব ব্যাপারে নিশ্চিত না-হলেও কিছু সংশয় নিয়েই শুরু করব ভারতবর্ষের সাবেকি গ্রামব্যবস্থা নিয়ে আমার বক্তব্য।
প্রথমে বলব গ্রামের স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিষয়ে। বিচ্ছিন্ন গ্রাম আদৌ সম্ভব কিনা, সেটা পরীক্ষা করে মেপে দেখার বিষয়। কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণতার অর্থ হল নিজের এলাকার মধ্যেই চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করে নেওয়া। আর ভারতের গ্রাম-সমাজ, অর্থাৎ একটা বড়ো এলাকার গ্রামসমষ্টির মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী যোগান পাওয়া যেত কমবেশি। এই হিসেবে একটি মাত্র গ্রাম না-হোক, একটা গ্রামসমষ্টির এলাকাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, একক সমাজ বলা যেতে পারে না? জীবনধারণ আর ভোগের জিনিস উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে এই স্থানীয়করণের প্রবণতা অন্ত্যকালীন সিন্ধু সভ্যতার বিনগরায়নের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকতে পারে। তাহলেও সাধারণ কিছু বিষয় (ধর্মীয় উৎসব বা বড়ো আকারের বাণিজ্য) বাদ দিলে একেকটি পঞ্চায়েত ও আরও সংকীর্ণ অর্থে একেকটি গ্রামীণ এলাকাকে দৈনন্দিন জীবনযাপনের নিরিখে কি 'আঞ্চলিক পৃথিবী' বলা যায় না? স্বয়ংসম্পূর্ণতার যুক্তিটাকে আমি গ্রাম থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পঞ্চায়েতের আধারে প্রতিস্থাপন করলাম মাত্র।
দ্বিতীয় বক্তব্য বলব গ্রামের উদ্ভবের বিষয়ে। এটা খুবই সঠিক বক্তব্য যে, গ্রাম বলতে মূলত চাষবাস এবং কিছু আনুষঙ্গিক বৃত্তির ওপর নির্ভরশীল সমাজ বোঝায়। পরবর্তীতে আমরা একাধিক গ্রামের মধ্যেকার প্রশাসনিক ঐক্য হিসেবে পঞ্চায়েতকেও দেখছি। সবশেষে সমাজের থেকে আরও ওপরে রাজাদের সরকারি কাঠামোও খুঁজে পাচ্ছি। পঞ্চায়েত সেই হিসেবে সমাজের প্রথার সাথে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকত যে, পঞ্চায়েতকে আলাদা করে গভর্নমেন্ট বলে মনে হবার কথা নয়; তার চেয়ে একে সমাজের স্বশাসন বলাই সঙ্গত। এ ছাড়াও বলব, লিখিত সংবিধান সমাজ আর প্রশাসনের তফাতকে পরিষ্কার করে তোলে। কিন্তু সমাজের প্রথা থেকেই যদি প্রশাসনের ভিত্তি তৈরি হয়, যা মুখের কথায়, কাজের ভাষায় পরিচালিত হবে, তবে সেই স্বশাসনে লিখে রাখার মতো, লিখিত নির্দেশ না মানলে বলপ্রয়োগের মতো ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়বে না। আমাদের পঞ্চায়েত কি সে-রকমই সামাজিক সংঘ ছিল না? তাহলেও প্রশ্ন আসে একাধিক গ্রামের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য আনার কোনো প্রয়োজন ছিল? একেকটা গ্রামের মধ্যেই কি সমস্তরকম বৃত্তির সমাবেশ ঘটানো যেত না; অন্য গ্রাম থেকে দ্ৰব্য সরবারহের প্রয়োজন ছিল? পঞ্চায়েতের মধ্য দিয়ে গ্রামগুলির সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা পেল, অথচ গ্রামগুলি পরস্পরের সাথে মিশে গিয়ে পঞ্চায়েতটাই একটা বিরাট গ্রাম-তল্লাট হয়ে উঠতে পারল না কেন? একেকটি পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় প্রত্যেকটা গ্রামেরই কমবেশি একটা নিজস্ব নাম, মন্দির বা সাধারণের চাষের জমি নিয়ে এত পৃথক অস্তিত্ব ধরে রাখা কী করে সম্ভব হল, ঐক্য-ভারসাম্য-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাই যদি পঞ্চায়েতের লক্ষ্য হয়ে থাকে? রাজার রাষ্ট্রকে আলোচনায় আনছি না; বলপ্রয়োগের জন্য সৈন্যবাহিনীর আস্ত বৃত্তিই সেখানে উপস্থিত। পঞ্চায়েতের শাস্তিমূলক ভিত্তি বড়োজোর একঘরে করে দেওয়া। ব্রাহ্মণদের সমাজের সাথে 'খাপ খাইয়ে' নেবার চালাকিই শুধু পঞ্চায়েতের অস্তিত্বের পেছনে দায়ী? পঞ্চায়েত নাম হয়তো ছিল না সেই যুগে, অন্য নাম থাকতে পারে গ্রামগুলির সমবায়ের। আমার উত্তরের এই পিডিএফ ফাইলটির সাথে বিশ শতকের বাংলার এক বিস্মৃত পণ্ডিত, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের দুটি রচনা একটি পিডিএফ ফাইলে পাঠালাম। পরবর্তী বৈদিক যুগে সমিতি বা সভা কীভাবে গ্রাম ও নগরের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখত, বেদের সংহিতা ও অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ উদ্ধৃত করে তিনি সেগুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। তার সমিতির ধারণা আরও প্রাচীন। উপজাতীয় ধরনের কাঠামো সেটা। তখনও ব্রাহ্মণদের 'সমাজপতি' (সমাজে থেকেই সমাজ বশে থাকলে 'রাষ্ট্রপতি' হবার কি প্রয়োজন?) হবার যুগ আসেনি। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি গ্রাম ও পঞ্চায়েতের উদ্ভব ও পারস্পরিক সম্পর্ক আরও প্রাচীন প্রথার উত্তরাধিকার বহন করে। কিন্তু এতে করে পৃথক পৃথক গ্রামের অস্তিত্বের সমস্যাটা ব্যাখ্যা করা যায় না।
কৃষিই আমাদের পরিচিত গ্রামগুলির ভিত্তি। কিন্তু বিভিন্ন আঞ্চলিক সমাজ দেখা যায়, যেখানে গ্রামের অস্তিত্ব বর্তমান, কিন্তু কৃষির চল নেই সেভাবে। চাষবাসের চল থাকলেও সেটা গৌণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাহলে গ্রাম বলতে যা বুঝি, ছোটো আকারের এই সামাজিক সংগঠন কি অ-কৃষিজাত সমাজ থেকে এসেছে, যারা সিন্ধু সভ্যতার বাইরের অস্ট্রাল বা আরণ্যক আদিবাসী ধরনের সমাজ? কিন্তু আপনাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পঞ্চায়েতের গঠন সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত স্বায়ত্তশাসনের উত্তরসূরী। তাহলে একটা সাহসী প্রশ্ন করা যায়: সিন্ধু সভ্যতার বাইরের জনগোষ্ঠী যদি গ্রাম-সমাজের আদি উদ্ভাবক হয়ে থাকে আর পঞ্চায়েত কাঠামো যদি সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত স্বশাসনকে নির্দেশ করে, তাহলে গ্রামসমষ্টির ওপর পঞ্চায়েতের শাসনকে কি কৃষি-বহির্ভূত জাতিকে কৃষির অনুসারী করে তোলার শাসনপ্রণালী বলা যেতে পারে? এই যুক্তি ধরে নিলে অঞ্চলের বিচারে সম্প্রসারণমুখী সিন্ধু কৃষিজনতা আর গঙ্গাপারের সংকোচনমুখী স্থানীয় চাষিদের তফাতটা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। শুধু তা- ই নয়, পঞ্চায়েতের মোড়কে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্রাহ্মণদের কৃষি বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাবার তাৎপর্যকেও ধরা যাবে।
পঞ্চায়েতের অস্তিত্ব আর পরবর্তীকালে তাতে ব্রাহ্মণদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাটা বললাম। তাহলে আরেকটি বিষয় উঠে আসে। তা হল: গ্রামের একেকটি পাড়ায় একেকটি সামাজিক বৃত্তি অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল। বর্ণভেদের মধ্যে যে বৈশ্য বর্ণ আছে, তারাই মূলত অর্থনৈতিক বর্ণ; কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য তাদের কাজ। অন্য দুটি এলিট বর্ণের কথা বাদ দিলেও শূদ্রের অস্তিত্ব মনুস্মৃতির আগে অনেক রচনাতেই পাওয়া যায় না। আম্বেদকর বা রামশরণ শর্মা বলেন শূদ্ররা নাকি ক্ষত্রিয়দের সাথে আদি রাজা ছিল। পরে ব্রাহ্মণরা নাকি তাদের বংশগুলোকে সমাজচ্যুত করে। কিন্তু সমাজের মধ্যে যে হীন জাতিভেদ ছিল এককালে, সেটা পেশাগত ভেদাভেদ ছাড়া আর কী? চামার ঘূণিত নয়, চামারের কাজ ঘৃণিত। আবার বংশপরম্পরায় একেকটা পেশা চলে আসছে, তাই ব্যক্তিবিশেষ তো বটেই, গোটা চামার সম্প্রদায়টাই ঘূণিত হবে। এভাবেই কি পেশার আধারে বর্ণজাতিভেদ প্রথা আরও প্রবল রূপ নেয়নি? আমি এখানে আরেকটা দিক তুলে ধরব। ব্রাহ্মণরা যদি এতটা ভেদাভেদের জন্ম দিয়ে থাকায় সফল হয়, তাহলে গ্রামনির্ভর ভারতের সমাজে এতটা ঐক্যবদ্ধতা কী করে সম্ভব? রাজা থাকলে তবেই 'বিভাজন আর শাসন'-এর নীতি খাটা সম্ভব। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ব্রাহ্মণরা রাজা হত না, হতে চাইতও না বিশেষ। তাহলে একটা সম্ভাবনা বেরিয়ে আসে যে, পঞ্চায়েত বা গ্রাম-সমাজে মহল্লাভিত্তিক বংশগত পেশা অনেক আগে থেকেই ছিল; ব্রাহ্মণরা কোনোভাবে কোনো একটা যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ওই সমাজের মধ্যে ভেদাভেদের বীজ বপন করায় সফল হয়েছিল। বাংলার বৌদ্ধ আমলে সে-রকম গ্রাম সমাজ দেখি আমরা; সেন আমলের বামুনদের লাফঝাঁপে বর্ণজাতির ভেদ আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এই দিক থেকে পাল আমল থেকে সেন আমলে গ্রাম-সমাজের বৈষয়িক গঠনের পরিবর্তনটাকে আলোচনা করা যেতে পারে। তার সাথে মুসলিম আগ্রাসনে ব্রাহ্মণরা সাময়িকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় গ্রাম-সমাজে বর্ণভেদ শিথিল হয়ে পড়ে ঐক্যবদ্ধতার শক্তি আরও বেড়ে উঠেছিল কিনা, এ বিষয়ে গভীর গবেষণা প্রয়োজন।
☆ ☆ ☆
এবার অন্য প্রসঙ্গে যাব একটু। সিন্ধু সভ্যতার আলোচনায় আসার আগে কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছি আমি। কমিউনিস্ট ধারায় যে-সমস্ত ধারণা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে, সিন্ধু সভ্যতার আলোকে তার অন্তত দুটো বিষয়ের পুনর্মূল্যায়ন করব।
১) ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ প্যারিস শহরের পৌর এলাকায় ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনলাভ করার পর প্যারিসের শ্রমিকদের ঘর থেকে উঠে আসা প্রতিনিধি সরাসরি পৌরসভাকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। ফাটকাবাজদের কেন্দ্রীভূত ফরাসি রাজতন্ত্রকে উপেক্ষা করে গোটা ফরাসি সাম্রাজ্যকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের নিরিখে ভেঙে উৎপাদনশীল সমাজ হিসেবে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করে প্যারিসের শ্রমিকরা। ফলস্বরূপ ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং ৫০,০০০ শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ নির্বিশেষে পাইকারি হারে কমিউনার্ডদের কচুকাটা করার পর ভার্সাইয়ের অস্থায়ী সরকার প্যারিস পুনর্দখল করে। ৭২ দিনের মাথায় প্যারিসের শ্রমিক সরকারের পতন ঘটে। এরপর পৃথিবীতে আর কখনও শ্রমিকরা সরকারে আসেনি সরকারি; যাও বা এসেছে, সে-সব শহুরে বাবু সমাজের কৃপার অনুদান হাত পেতে নিয়ে। তাই মার্কসের বলা শ্রমিক পার্টি দেখি না ইতিহাসে একটাও, যা দেখি, তা হল কমিউনিস্ট পার্টি। শ্রমিক আর কমিউনিস্ট এক বস্তু নয়।
এবার আসি প্যারি কমিউনের সরকারি নীতির জায়গায়। গ্রাম থেকে মহাজনদের শেষ করে দেওয়া থেকে শহরের বড়ো আকারের কারখানায় নির্বাচনভিত্তিক অধিকর্তা নিয়োগ, রাষ্ট্র-শিক্ষা-গির্জাকে পৃথক করা এবং সর্বোপরি ফরাসি সাম্রাজ্যকে সাধারণ উৎপাদক জনতার ভোটাভুটির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা, যার ফলশ্রুতিতে লোকায়ত ধরনের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হত বলে আমার মনে হয়েছে। প্যারিসের কমিউন প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে হাজার হাজার বছর আগের লুপ্ত সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত স্বশাসনের শক্তি কাজ করছিল কি? এটা কমিউনিজমের তত্ত্বকে সিন্ধু সভ্যতার লোকবাদী আদর্শের নিরিখে পুনর্বিচারের চেষ্টা আমার।
২) কমিউনের পেছনে সিন্ধু লোকায়তিক রাষ্ট্রের ঐতিহ্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল বলে আমার ইদানিং মনে হয়। ফরাসি ইতিহাস প্রসঙ্গে আমার দ্বিতীয় বক্তব্যে সেই কথার আরেকটু বেশি প্রতিধ্বনি পাবেন আপনারা।
ফরাসি বিপ্লবের সময় সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে সাম্য আর ন্যায়পূর্ণ সমাজ গঠনের দাবি রাজনীতির প্রকাশ্য ময়দানে জায়গা করে নেয়। রুশোর কথা বলব। তাঁর 'সামাজিক চুক্তি'র ধারণা অনুসারে, মানুষ সভ্যতা তৈরি করেছিল এক সহযোগিতাপূর্ণ বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে, কিন্তু ক্রমেই সেটা অন্যায়ের সমাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপরে ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রের ধারণাও বিকাশলাভ করে, যাকে মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিকরা সমালোচনা করেছেন যথেষ্ট পরিমাণে। সিন্ধু সভ্যতা প্রসঙ্গে আপনারা যা আলোচনা করেছেন, তাতে সহযোগিতা বা 'সামাজিক চুক্তি'র মধ্য দিয়ে সভ্যতার নির্মাণ একমাত্র এই ভারতীয় উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়াতেই হওয়া সম্ভব। কিন্তু মার্কসীয় তত্ত্ব ফরাসি বিপ্লবের সমকালীন ধারণার বিপরীতে বলে যে, সভ্যতার ভিত্তিই হল অল্পসংখ্যকের হাতে গরিষ্ঠের দাসত্ব। তখনকার যুগে আজকের যতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছিল না আমাদের কাছে। কিন্তু আজ তো আছে! অর্থনৈতিক বৈষম্য আর সামরিক বলপ্রয়োগের ওপর সভ্যতা আর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে রয়েছে বরাবর- এঙ্গেলসের বহুপ্রচারিত এই মার্কসীয় ধারণাকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দিয়েই খণ্ডন করার সময় এসে যায়নি কি?
আমি বলছি না ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র বা রুশো প্রমুখের বক্তব্যকে নিয়ে মাতামাতি করতে। তবে এটাও কি অস্বীকার করা যাবে যে, সিন্ধু সভ্যতার লোকায়তিক রাষ্ট্রের আদর্শ বহু সহস্র বছর ধরে টিকে থেকেছে পৃথিবীতে আর প্রথম ফরাসি বিপ্লব ও প্যারি কমিউনের মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে যার সমাজতান্ত্রিক বহিঃপ্রকাশ?
আজকের মতো এটুকুই বলব। আপনাদের উত্তরের আশায় থাকব। আপনারা দুজনে সুস্থ থাকবেন। আপনাদের কুশল কামনা করে আজকের মতো বিদায় নেব।
ইতি,
অভিরূপ মুখোপাধ্যায়
২৫এপ্রিল ২০২৩
E-mail : avirup2000.official@gmail.com
২৫ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে অভিরূপ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রেরিত পত্রের উত্তর
প্রেরণ তারিখ : ৩০ জুন, ২০২৩
প্রিয় অভিরূপ বাবু,
আপনার সর্বশেষ পত্রসহ ইতিপূর্বেকার আপনার বিভিন্ন পত্রে আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। আশা করি সেগুলির মধ্যে সবগুলির না হলেও অনেকগুলি প্রশ্নের উত্তর আমরা দিয়েছি। আপনার বিভিন্ন সময়কার প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে গিয়ে আমাদেরকে সমাজ, রাষ্ট্র ও সামাজিক কর্তৃত্ব গঠন ইত্যাদি বহুবিধ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়েছে। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার সমান্তরালে গঠিত হলেও বহু বিষয়ে প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে শ্রেণী, কর্তৃত্ব, সামাজিক নেতৃত্ব গঠন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়েছে। বিষয়গুলি নিয়ে সুদীর্ঘ কাল আমরা ভেবেছি এবং প্রচলিত গণ্ডী ভেঙ্গে বেরিয়ে আমাদের মতো করে উত্তর বের করার চেষ্টা করেছি। শামসুজ্জোহা মানিকের লিখা মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ (http://bangarashtra.net/article/395.html) যদি পড়ে থাকেন তবে সেখানে মার্কসবাদের কেন্দ্রে অবস্থিত এই বিষয়গুলি সম্পর্কে তার যে বক্তব্য পড়েছেন সে সম্পর্কে আমরা উভয়ে মূলত একমত পোষণ করি।
আমাদের কাছে সবই আপেক্ষিক বা relative. ন্যায়, সাম্য, সুবিচার ইত্যাদি সব ধারণা কিংবা বাস্তবতাই আপেক্ষিক। অতএব শ্রেণীহীন নিরঙ্কুশ সাম্যের ধারণাও ভ্রান্ত। দুইটি প্রাণ যখন পরস্পর যুক্ত বা সম্পর্কিত হয় তখন তাদের সম্পর্কের মধ্যে কম অথবা বেশী অসমতা দেখা দেয়। কারণ সবার ক্ষমতা হুবহু সমান হয় না সব ব্যাপারে। নারী, পুরুষের সম্পর্কই দেখুন না! এক ক্ষেত্রে নারী শ্রেষ্ঠ হতে পারে, অপর ক্ষেত্রে পুরুষ। সভ্যতায় এসে সম্পর্কের জটিলতা এবং অসমতা অবিশ্বাস্য রকমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পারস্পরিক প্রয়োজন যেমন বহু মানুষকে একত্র করে তেমন তাদের মধ্যকার পরস্পর বিরোধী প্রবণতা বা প্রয়োজন তাদেরকে বিভক্ত বা পরস্পর বিরুদ্ধও করতে পারে। এভাবে সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র গঠিত হয়, আবার বিভক্তও হয়। সমাজ, জাতি কিংবা রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে আমরা গোষ্ঠী গঠনের প্রক্রিয়াও বলতে পারি। আসলে গোষ্ঠীবদ্ধতা বা গোষ্ঠী গঠন এবং তার ভাঙ্গনের মাধ্যমে নবতর গোষ্ঠী গঠনের গতিধারায় নিহ্তি রযেছে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। মজার ব্যাপার হচ্ছে পুরাতন বা বিদ্যমান গোষ্ঠী ভাঙ্গতে গিয়ে মানুষকে প্রথমে এক অর্থে একা বা ব্যক্তি হতে হয়, আবার নবতর গোষ্ঠী গঠন করতে গিয়ে আপেক্ষিক বা তুলনামূলক অর্থে হলেও একটা পর্যায়ের জন্য তার ব্যক্তিসত্তাকে গৌণ করতে এমনকি বিসর্জন দিতে হতে পারে।
এই অবস্থায় আমরা নিরঙ্কুশ বা বিশুদ্ধ সত্য কোথায় খুঁজে পাব বলুন? তবু আমরা আপেক্ষিক বা তুলনামূলক অর্থে কিংবা একটা সময়ের জন্য তাকে খুঁজি। আসলে মানুষ বলে কথা নয়, বরং কোনও প্রাণই বিশুদ্ধ সত্তা নয়। সুতরাং মানুষের শুদ্ধ সত্তার সন্ধান করেও লাভ নাই। তবু সেটা আপেক্ষিক বা তুলনামূলক বিচারে আছে বা থাকে বৈকি! তবে ঐ যে বললাম তাকে দেখতে হবে আপেক্ষিক অর্থে।
☆ ☆ ☆ ☆ ☆
যাইহোক, আমাদের অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাস পাঠ থেকে আমরা আপেক্ষিক অর্থে একটা আদর্শ বা শুদ্ধ সভ্য সমাজ হিসাবে সিন্ধু সভ্যতাকে দেখতে পেয়েছি। আপেক্ষিক অর্থে হলেও এ ধরনের একটা বিস্ময়করভাবে সাম্য, ন্যায়, শান্তি ও গণতান্ত্রিক চর্চা ভিত্তিক সভ্যতার ভিত্তিটা যেমন একদিনে নির্মিত হয় নাই তেমন তার অস্তিত্বও সম্ভব হয়েছিল বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিতে। এ বিষয়ে আমরা আমাদের যৌথ গ্রন্থ সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রার দ্বিতীয় খণ্ডে আলোচনা করেছি। আশা করি সেটা পড়েছেন।
সুতরাং সিন্ধু সভ্যতাকেও দেখতে হবে বিশেষ কাল ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে। প্রাচীন পৃথিবীতে এমন সভ্যতা নজিরবিহীন। কারণ আর কোথায়ও এমন একটি প্রাচুর্যপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণভাবে গড়বার মতো বাস্তবতা ছিল না। এ বিষয়ে সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রায় আলোচনা করায় এ প্রসঙ্গে আর বেশী কথা বলব না। অন্যদিকে, নদীর দুই তীরবর্তী বাঁধ ছাড়াও নদীর মাঝ বরাবর জলকপাটযুক্ত বাঁধ দিয়ে নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশাল ভূভাগকে শস্যভাণ্ডার রূপে গড়ে তুলবার সুযোগও আর কোথায়ও ছিল না। এমনকি সেটা সিন্ধু সভ্যতার ভূমিসংলগ্ন বিশাল গঙ্গা অববাহিকতাতেও ছিল না। এ বিষয়ে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ এ পর্যন্ত দুই খণ্ডে প্রকাশিত সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রায় ( http://bangarashtra.net/article/1538.html এবং http://bangarashtra.net/article/1546.html) আলোচনা করায় এখানে তার পুনরুক্তি ঘটাতে চাইছি না।
স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধে লৌহাস্ত্র ও বিশেষত অশ্বের ব্যবহার প্রবর্তনের পর শান্তিপূর্ণ ধারায় গড়ে উঠা সিন্ধু সভ্যতার অবসান এমনিতেই অনিবার্য হয়েছিল। অপর দিকে, নদীখাতে পলি সঞ্চয়জনিত কারণে নদীর মাঝবরাবর স্লুইসগেট বা জলকপাটসমূহ অকার্যকর হওয়া, একই কারণে বারবার নদীখাত পরিবর্তন, কোথায়ও জলাবদ্ধতা ও বন্যা, কোথায়ও জলশূন্যতা ও মরুকরণ এবং ভূমির লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে ক্রমবর্ধমানভাবে ফসল উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি কারণে এক সময় বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবর্তিত কৃষিব্যবস্থায় সঙ্কট ও বিপর্যয় দেখা দিলে সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্বের ভিত্তি ভেঙ্গে পড়ে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি পৃথিবীর বৃহত্তম ও মহত্তম ব্রোঞ্জ সভ্যতার পতনকে অনিবার্য করে তুলেছিল।
খ্রীষ্টপূর্ব ১,৯০০ অব্দে অর্থাৎ আজ হতে ৩ হাজার ৯ শ’ বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার অবসান হয়েছে। কিন্তু তার সুগভীর প্রভাব তাকে আবেষ্টন করে থাকা বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ কখনই পুরাপুরি অতিক্রম করতে পারে নাই। সিন্ধু সভ্যতার অহিংসা, সাম্য ও গণতন্ত্রের ভাবপ্রেরণা নিয়ে অনেক পরবর্তী কালে গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মতো ধর্মগুলি। বিশেষত বৌদ্ধ ধর্ম এক সময় উপমহাদেশের সীমানা পার হয়ে আন্তর্জাতিক ধর্মে পরিণত হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার অহিংস চেতনা কিংবা গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনার বিষয়গুলি নিয়ে আমরা সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রার ১ম (http://bangarashtra.net/article/1538.html) ও ২য় (http://bangarashtra.net/article/1546.html) খণ্ডে মোটামুটি বিশদ আলোচনার চেষ্টা করেছি।
এটা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, মুসলিম আগ্রাসন ও শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত সময়ে রাজতন্ত্র গড়ে উঠলেও সেভাবে দর্শনীয় রাজপ্রাসাদের চিহ্ন পাওয়া যায় না। এটা কি বিস্ময়কর নয় যে, রাজধানী পাটলীপুত্রে অবস্থিত আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত সুবিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী সম্রাট অশোকের রাজপ্রাসাদও ছিল কাষ্ঠনির্মিত। এই ঘটনা এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে যে, রাজতন্ত্রের যুগেও ভারতীয়দের শাসনকালে রাজা ও প্রজায় খুব বেশী ব্যবধান ছিল না, যে ব্যবধানটি পরবর্তী সমগ্র মুসলিম শাসনকালের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। সুতরাং মুসলিম শাসনকালে রাজপ্রাসাদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ ও জাঁকালো এবং দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত। অর্থাৎ প্রাক-মুসলিম যুগে রাজা ও প্রজা তথা রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্কের মধ্যে বৈষম্য যে অনেকটাই সংযত ছিল সেটা এই স্থাপত্য নির্মাণের বৈশিষ্ট্য থেকেই অনুমান করা যায়। এ কালে বরং বিশালায়তনের বৌদ্ধ বিহার বা মঠ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা হিন্দু মন্দিরগুলির স্থাপত্য নিদর্শন অনেক ধ্বংসের পরেও আজ অবধি নানানভাবে তাদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে আমাদেরকে বিস্ময়াভিভূত করে। এ প্রসঙ্গে মুসলিম হানাদার ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী কর্তৃক ধ্বংপ্রাপ্ত বঙ্গসংলগ্ন নালন্দা বৌদ্ধ বিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা যায়, যার গ্রন্থাগার ছিল নয়তলা ভবনবিশিষ্ট এবং তাতে ছিল নব্বই লক্ষ গ্রন্থ বা পাণ্ডুলিপি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বখতিয়ার খলজী যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস এবং নিরস্ত্র ছাত্র-শিক্ষক ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গণহারে হত্যা করে তখন সেটা ছিল দেশ-বিদেশ থেকে আগত দশ হাজার ছাত্র, দেড় থেকে দুই হাজার শিক্ষক এবং আজ আমাদের নিকট অজ্ঞাত সংখ্যক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী পদচারণা মুখর শিক্ষা ও সেই সাথে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।* বঙ্গের বরেন্দ্রভূমির পাহাড়পুর কিংবা কুমিল্লার ময়নামতীর বৌদ্ধ বিহার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ধ্বংসস্তূপ আজ আমাদের একই সাথে ব্যথিত ও বিস্মিত করে। বহিরাগত হানাদার মুসলিম শাসকদের অগণিত ধ্বংসকাণ্ডের পরেও ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত বহুসংখ্যক প্রাচীন হিন্দু মন্দির কিংবা সেগুলির পুনরুদ্ধারকৃত স্থাপত্য ভারতবর্ষের সমাজশক্তির অন্তর্নিহিত দিকটিকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে।
--------------------------
* নালন্দা ধ্বংসের সময় ১২০৫ খ্রীষ্টাব্দ, যা প্রত্নতাত্ত্বিক এইচডি সংকালিয়ার উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ Lokesh Chandra, Nalanda University, in, Purātattva, No. 46, Indian Archaeological Society, New Delhi, 2016, p. 189.)
--------------------------
এটা আমাদের নিকট স্পষ্ট যে, মুসলিম আগ্রাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক কালে ভারতীয় সমাজের প্রাণশক্তির প্রকাশ ঘটেছিল প্রধানত তার ধর্ম তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিস্ময়কর হলেও তার সমান্তরালে কিংবা আশ্রয়ে গড়ে উঠা লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে। সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্র রাজকীয় সুখ-সম্ভোগ ও আড়ম্বর আয়োজনের পিছনে অর্থ-সম্পদ ও সময় ব্যয়ের পরিবর্তে সেই অর্থ-সম্পদ ও সময় ব্যয় করেছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে বৌদ্ধ-জৈন বিহার ও তৎসংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদ্যালয় এবং একইভাবে হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের পিছনে। অবশ্য হিন্দু মন্দিরের পাশে অতিকায় বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। এ থেকে এটি বুঝা যায় যে, ধর্ম চর্চা ও শিক্ষার বাইরে শিক্ষার অন্যান্য শাখার প্রতি হিন্দু সমাজের আকর্ষণ ও মনোযোগের ঘাটতি ছিল। সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে তাদের মনোযোগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমাদের সামনে সেভাবে নাই বলাই উচিত হবে।
☆ ☆ ☆ ☆ ☆
ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক যুগের এই বৈশিষ্ট্য তার সামাজিক দুর্বলতাকেও উন্মোচিত করে বলে আমরা মনে করি। সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির প্রতি তুলনামূলক অবহেলা। আমরা অনুমান করি রাষ্ট্রশক্তি তথা যুদ্ধনির্ভর রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতি উপেক্ষার উত্তরাধিকারও ভারতবর্ষ লাভ করেছে সিন্ধু সভ্যতার নিকট থেকে।
সমাজতলের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে রাষ্ট্র তথা সমরশক্তির গুরুত্বকে খাটো করে দেখার মাশুল উপমহাদেশকে দিতে হয়েছে প্রথম দিকে বিশেষত শক-হুন ইত্যাদি বহিরাগত হানাদার এবং পরবর্তী কালে মুসলিম হানাদারদের অধীনতা বরণ ক’রে। এটা ঠিক যে, হিন্দু ধর্মকে অবলম্বন করে ভারতীয় উপমহাদেশ তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছুকে রক্ষায় সমর্থ হয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে দিতে হয়েছে বিপুল মূল্য। ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে আরব হানাদার মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় ও লুণ্ঠনকে* হিসাবে ধরলে ইংরেজদের হাতে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় পর্যন্ত সহস্রাধিক বৎসর কাল ভারতের এক বৃহদাংশ বহিরাগত মুসলিম শাসন, শোষণ ও লুণ্ঠনের নিগড়ে আবদ্ধ থেকেছিল।
--------------------------
* সিন্ধুর প্রাচীন ইতিহাস চাচনামাহ্-র মূল গ্রন্থে এই সময়কে ৭৩ হিজরী সন হিসাবে বলা হয়েছে। মূল অনুবাদক ৭১১ খ্রীষ্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী (অনূদিত), চাচনামাহ্ঃ সিন্ধের প্রাচীন ইতিহাস, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪, পৃঃ ১৩০, ১৩১, ১৯৯।)
--------------------------
অবশ্য মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু জয়ের পর মুসলিম আগ্রাসনের ঢেউগুলি কিছু কালের জন্য স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে মুহাম্মদ ঘুরীর নেতৃত্বে মুসলিম আগ্রাসনের যে নবতরঙ্গ ভারতের উপর আছড়ে পড়ে* সেটা ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজদের বাংলা জয় পর্যন্ত সময়কে ধরলে প্রায় পাঁচশত পঁচাশি বৎসর কাল স্থায়ী হয় এবং এরপর ইংরেজদের নিকট ভারতের নবরূপের পরাধীনতা প্রায় দুইশত বৎসর কাল স্থায়ী হয়।
--------------------------
* ঐতিহাসিক কাশিম ফিরিশতা উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মদ ঘুরী ৫৬৭ হিজরী বা ১১৭২ খ্রীষ্টাব্দে মুলতান অধিকার কারেন। এই হিসাবে পাঁচ শত পঁচাশি বৎসর হয়। দেখুনঃ মুহাম্মদ কাশিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, Translation of Ferista’s History of Muslim Conquest of India, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৭, পৃঃ ১৩২।
--------------------------
মুসলিম ও ইংরেজদের বহিরাগত শাসন ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ ছিল না, তা নয়। কিন্তু তারপরেও এটা বাস্তবতা যে, সাফল্যের তুলনায় ব্যর্থতার পরিমাণই অনেক বেশী। ইংরেজ শাসনের অবসানের পিছনে ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর নায়ক সুভাষ চন্দ্র বসুর যে ভূমিকাই থাকুক এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের সামগ্রিক বিপর্যয় সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য নেতাজী সুভাষ বসুর বীরোচিত ভূমিকা ইংরেজ শাসনের অবসানকে ত্বরান্বিত যে করেছিল সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। তা না হলে ইংরেজ শাসকরা কখন ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিত তা বলা সম্ভব নয়।
সুদীর্ঘ কালব্যাপী বহিরাক্রমণ ও শাসন প্রতিরোধে উপমহাদেশের সামগ্রিক ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করণীয় বলে আমরা মনে করি। এটা সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিষয়ও বটে। আর এ ক্ষেত্রে এ ধরনের বহিরাক্রমণ প্রতিরোধে অন্যান্য সমাজের সফল দৃষ্টান্তগুলি আমাদের সামনে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয়।
আমাদের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে প্রথমে আমরা ইউরোপের পশ্চিম ও পূর্ব এই দুই প্রান্তের দুইটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরব। একটি স্পেন, অপরটি রাশিয়ার অভিজ্ঞতা। তারিক ইবনে যিয়াদ ও মুসা ইবনে নোসিরের নেতৃত্বে ৭১০-৭১১ খ্রীষ্টাব্দে আরব মুসলিম হানাদার বাহিনী সমুদ্র পার হয়ে স্পেন দখলের অভিযান শুরু করে।*
--------------------------
* Muhammad Abdullah Enan, Decisive Moments in the History of Islam, Published by Shaikh Muhammad Ashraf, Kashmiri Bazar, Lahore, 1940, p. 44.
--------------------------
একটা সময় মুসলিম বাহিনী প্রায় সমগ্র আইবেরীয় উপদ্বীপ জয় ক’রে ফ্রান্সের সীমানায় প্রবেশ করে। তবে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর নিকট আরব মুসলিম বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর তাদের অগ্রাভিযান থেমে যায়। কিন্তু স্পেন আরব পদানত থাকে সাত শতাব্দীর অধিক কাল। আরব মুসলিমদের অধিকারে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রয়ে যায় স্পেনের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত গ্রানাডা। ঐ বৎসর স্পেনের খ্রীষ্টান শক্তির হাতে গ্রানাডা দুর্গের পতন হলে স্পেন তথা ইউরোপের পশ্চিম প্রান্তে মুসলিম আধিপত্যের চির অবসান ঘটে। এর পরের অভিজ্ঞতা ইসলামের জন্য ছিল ভয়াবহ। চার্চের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্পেনে অবস্থিত প্রতিটি মুসলিমের সামনে তিনটি বিকল্প দেওয়া হল। ইসলাম ত্যাগ করে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ, স্পেন ত্যাগ করে মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর আফ্রিকায় গমন, অথবা মৃত্যুবরণ। যারা প্রথম দুই বিকল্পের একটিও গ্রহণ করল না তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা হল। এখন আমরা যেমনই মনে করি, স্পেন তথা পশ্চিম ইউরোপ ইসলামের সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যন্ত নিষ্ঠুর পন্থা বেছে নিয়েছিল।
১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ পশ্চিম ইউরোপ ও বিশেষত স্পেনের জন্য জয়যাত্রা সূচনার বৎসর। এই বৎসরে গ্রানাডা দখলের মাধ্যমে স্পেন থেকে মুসলিম শাসনের শেষ চিহ্নকেই শুধু উচ্ছেদ করা হল না, অধিকন্তু এই বৎসর অর্থাৎ ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনের প্রতিনিধি হিসাবে ক্রীস্টোফার কলম্বাস ভারত পৌঁছাবার সমুদ্র-পথ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকা মহাদেশে পৌঁছাবার পথ আবিষ্কার করেন। বিশেষত এই পরবর্তী ঘটনার ফল হল শুধু স্পেন নয়, অধিকন্তু সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের জন্য যুগান্তকারী। এরপর বিকাশমান ইউরোপীয় শক্তি সমস্ত পৃথিবী ব্যাপী তাদের সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ স্থাপনের অভিযান শুরু করল।
এ হল পশ্চিম ইউরোপের ঘটনা। এবার আমাদের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য বল্কান অঞ্চলের উপর আলোচনা না করে আমরা রাশিয়ার অভিজ্ঞতার দিকে একটু দৃষ্টি দিব। মোঙ্গলিয়ায় চেঙ্গিসের উত্থানের পর বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত রাশিয়া মোঙ্গল অধিকারভুক্ত হয়। মোঙ্গলরা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বত্র রক্তপিপাসু এবং ধ্বংসাত্মক নীতি অনুসরণ করতে পছন্দ করত। রাশিয়ায়ও তার ব্যতিক্রম হয় নাই। রাশিয়ায় মোঙ্গল আধিপত্য প্রায় আড়াইশ’ বছর স্থায়ী হয়। শেষ দিকের মোঙ্গল শাসকদের মধ্যে যারা রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের উপর আধিপত্য বজায় রেখেছিল গোল্ডেনহোর্ড হিসাবে পরিচিত মোঙ্গলদের সেই অংশটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এদেরকে তাতারও বলা হয়। ১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দে রুশ বাহিনী গোল্ডেন হোর্ড বাহিনীকে পরাজিত করে রুশ অঞ্চল থেকে বিতাড়ন করে। মুসলিমদের ব্যাপকভাবে খ্রীষ্টান ধর্মের অন্তর্ভুক্তকরণ, মসজিদসমূহকে গীর্জায় রূপান্তরিতকরণ ইত্যাদি নানান ভাবে রাশিয়ার মুসলিমদের বিরাট অংশকে রুশ খ্রীষ্টান সমাজের অংশ করে নেওয়া হয়। মুসলিমদের উপর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অত্যাচার হয় ইভান দি টেরিবল্ বা ভয়ঙ্কর ইভান হিসাবে খ্যাত রুশ জারের সময়।* বলা হয় যে, অর্ধোন্মাদ এই সম্রাটের শাসনকালে রুশ জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ তার বিভিন্ন সময়কার নির্দেশে নিহত হয়। সুতরাং মুসলিম মোঙ্গল বংশধরদের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করতে কষ্ট হয় না। এভাবে রুশ জাতি ও সমাজ তাদের মতো করে বহিরাক্রমণকারী জাতি ও সমাজের আধিপত্য ও অস্তিত্বের সমস্যার সমাধান করে। অথচ স্পেনের মতো রাশিয়ার মানুষরাও মূলত ছিল খ্রীষ্টান, যা কিনা ধর্মীয় তত্ত্ব অনুযায়ী মূলত শান্তিবাদী। স্পেনে যেমন রাশিয়াতেও তেমন খ্রীষ্টানরা বৈদেশিক হনাদার ও তাদের উত্তরাধিকারীদের হাত থেকে নিজ ভূমিকে মুক্ত করতে যীশু খ্রীষ্টের শান্তি ও প্রেমের বাণীর কোনও ধার ধারে নাই।
--------------------------
* শাসনকাল ১৫৩৩-১৫৮৪। এই সম্রাটকে ইভান ৪-ও বলা হয়। দেখুনঃ Daniel C. Waugh, The Golden Horde and Russia, in, Genghis Khan and the Mongol Empire, ed., William Fitzhugh, Morris Rossabi and William Honeychurch, University of Washington Press, 2009, p. 179.
--------------------------
এবার আমরা বহিরাক্রমণকারী কিংবা বহিরাগত শাসনকারীদের সমস্যা সমাধানে চীনের ভূমিকার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। চেঙ্গিস খানের দখল অভিযানের পর চীন কম-বেশী দেড় শত বৎসর মোঙ্গল অধিকারে ছিল।*
--------------------------
* উত্তর চীনে চিন রাজবংশের শাসনের সময় ১২১৫ খ্রীষ্টাব্দে মাঞ্চুরিয়া ও পিকিং অঞ্চল মোঙ্গলরা দখল করে নেয়। এই সময়কে চীনে মোঙ্গল শাসনের শুরু ধরা যায়। ১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে চু ইউয়ান-চ্যাং-এর নেতৃত্বে চীনা বাহিনী মোঙ্গলদের কাছ থেকে ইউয়ান নামে পরিচিত মোঙ্গল রাজবংশের রাজধানী পিকিং (বর্তমান বেইজিং) দখল করে। এই মধ্যবর্তী সময়টি ১৫৩ বৎসর। দেখুনঃ Jacques Gernet, A History of Chinese Civilization, Second Edition, Originally published in French in 1972, First published in English by Cambridge University Press, Cambridge, 1982, p.360, 361, 390.)
--------------------------
চেঙ্গিস চীন আক্রমণ ও দখল অভিযানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালান তাতে চীনের দশ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে দুই কোটি মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু চীনাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে এক সময় (১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে) মোঙ্গল শাসকরা পরাজিত ও উৎখাত হয়। এরপর ছিল চীনাদের প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। চীনে থাকা প্রতিটি মোঙ্গলকে চীনারা হত্যা করে। শুধু তাই নয়, বর্বর হানাদার শাসনের প্রতি চীনাদের ঘৃণা এমনই ভয়ঙ্কর ছিল যে, সমগ্র চীনে মোঙ্গলদের দ্বরা নির্মিত যত স্থাপনা বা ভবন ছিল সবগুলিকেই ধ্বংস করা হয়। শুধু তা-ই নয়, মাটির তলদেশ থেকে ভিত্তিমূলে থাকা ইট বা প্রস্তরখণ্ডগুলিকেও উপড়ে ফেলা হয়। অর্থাৎ সমগ্র চীনে মোঙ্গল শাসনের কোনও স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত চীনারা রাখে নাই।
কিন্তু এখানেই চীনারা ক্ষান্ত হয় নাই। এরপর হাজার হাজার বছর ধরে মোঙ্গলিয়ার মরুভূমি থেকে উঠে আসা যাযাবর ও হানাদার মোঙ্গল সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধানের জন্য চীনারা যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা হল অভূতপূর্ব ও অত্যন্ত নির্দয়। চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ করেও মোঙ্গল আক্রমণ সমস্যার কোনও স্থায়ী সমাধান বের করা যায় নাই। সুতরাং এবার মোঙ্গল সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য মোঙ্গলিয়ার সমগ্র মোঙ্গল জনগোষ্ঠীকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় তিন লক্ষ সৈন্য দিয়ে মোঙ্গলিয়ার বিশাল ভূমিকে পরিবেষ্টন করা হল। একজনের হাত ধরে অপরজন দাড়িয়ে এই পরিবেষ্টন বা বেড় তৈরী করা হল। এই বেড় তখন সম্পূর্ণ হল যখন প্রথম চীনা সৈনিকের হাতের সঙ্গে সর্বশেষ চীনা সৈনিকের হাত মিলিত হল। এভাবে সমগ্র মোঙ্গলিয়াকে ঘেরাও করার পর ক্রমে এই বেড়কে সংকীর্ণ করে আনা হল। এবং এই বেড়ের ভিতরে যত মানুষ পাওয়া গেল তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা হল। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হল না। এভাবে দশ লক্ষ মোঙ্গলীয়কে হত্যা করা হল। অর্থাৎ মোঙ্গলীয় জাতির বংশধারা বা উত্তরাধিকার পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করা হল।
এভাবে মোঙ্গলিয়াকে জনশূন্য করা হল। কিন্তু সেটা আবার ভবিষ্যতে নূতন যাযাবর এবং বর্বর জনগোষ্ঠীর আবাস হয়ে উঠতে পারে। সেটা যাতে না হয় সে জন্য ঐতিহাসিক কাল ধরে চীনের অধিকারে থাকা এবং চীনের প্রতি অনুগত অন্তর্মোঙ্গলিয়া থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মোঙ্গলদেরকে বহির্মোঙ্গলিয়া হিসাবে কথিত মূল মোঙ্গলিয়ায় পুনর্বাসন করা হল। শুধু এইটুকু নয়, বসতিস্থাপনকারী বৌদ্ধ মোঙ্গলদের উপর একজন বৌদ্ধ ধর্মগুরু হিসাবে লামাকে প্রতিষ্ঠা করা হল, যে থাকবে চীনের প্রতি দায়বদ্ধ। মোঙ্গলিয়ার ইতিপূর্বেকার অধিবাসীরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল না। তারা ছিল প্রকৃতির বিভিন্ন অলৌকিক শক্তির পূজারী। এদেরকে পেগানও বলা যায়। যাইহোক, এভাবে চীনারা মোঙ্গলিয়া থেকে চীনের উপর আক্রমণকারী কোনও শক্তির উত্থান সম্ভাবনা চিরতরে রোধ করতে চেয়েছিল।
এটা বিস্ময়কর যে, খ্রীষ্টান ইউরোপ এবং বৌদ্ধ চীন উভয় ক্ষেত্রেই মরুচারী, যাযাবর বা অর্ধযাযাবর আরব কিংবা মোঙ্গল মুসলিম এবং মরুচারী, যাযাবর পেগান মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে প্রায় একই ধরনের নির্মূলীকরণের কর্মকৌশল গ্রহণ করতে দেখা গেছে, যা বৃহদায়তনে প্রযোজ্য হয়েছে। বুঝা যায় শান্তিকামী খ্রীষ্টান হোক আর অহিংস বৌদ্ধ হোক হিংসা ও বর্বরতাকে শেষ পর্যন্ত হিংসা ও বর্বরতা দিয়েই মোকাবিলা করেছে।
কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে কি এমনটা ঘটতে দেখা গেছে? এখানে হিংসা ও বলপ্রয়োগ হয় নাই তা নয়, তবে মাত্রা ও আয়তনের বিচারে সেগুলি তুলনায় সাধারণত অনেক ক্ষুদ্র কিংবা সীমিত। বিশেষত যাদের নিকট থেকে প্রত্যাঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে তাদের প্রতি ভারতীয়দের সহনশীলতা লক্ষ্যণীয়। ভারতীয়দের এই মনোভাব তাদেরকে বৃহদায়তনে রক্তপাত ও সহিংসতা বিমুখ করেছে।
আমরা অনুমান করতে পারি যে, হিংসা বিমুখতার এই ঐতিহ্য ভারত সিন্ধু সভ্যতা থেকে গ্রহণ করেছে। সব কিছুরই ভালো ও মন্দ দুই দিক থাকে। তবে কোনও একটা পন্থাকে পরিপ্রেক্ষিত বিচার না করে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে থাকাটা যে যৌক্তিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ আচরণ হতে পারে না সেটা বলাই বাহুল্য।
ঐতিহাসিক কালব্যাপী প্রবল বহিরাক্রমণগুলিকে প্রতিহত করায় কিংবা বহিরাগত শাসন উচ্ছেদে ভারতীয়দের ব্যর্থতার দীর্ঘ ইতিহাসকে আমাদের গুরুতর বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু পর্যালোচনা নয়, এর কারণ বিশ্লেষণও করতে হবে। সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিক প্রভাব কীভাবে এতকালেও এভাবে টিকে ছিল? শুধু স্মৃতি এত দীর্ঘকাল এভাবে টিকে থাকতে কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তার বস্তুগত তথা সামাজিক ব্যবস্থাও টিকে থাকতে হয় যার মাধ্যমে একটা সভ্যতা এত দূরপ্রসারী প্রভাব বজায় রাখতে পারে। বিষয়টির স্বরূপ উপলব্ধির জন্য আমাদের প্রথমে সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ প্রক্রিয়াকে বুঝার চেষ্টা করা দরকার।
সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রায় (১ম ও ২য় খণ্ড) আমরা বলতে চেয়েছি যে, প্রাচীন অন্যান্য সভ্যতা থেকে ভিন্ন ধারায় সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। বস্তুত হাজার হাজার বছর ধরে প্রধানত শান্তিপূর্ণ ধারায় এক বা একাধিক ক্ষুদ্র সমাজের একটি বৃহৎ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজে পরিণতি এবং মূলত একই রকম শান্তিপূর্ণভাবে নাগরিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে সমাজ থেকে বৃহৎ রাষ্ট্র গঠনের গতিধারায় ফেলে সিন্ধু সভ্যতাকে বুঝতে হবে। ফলে এখানে অন্যান্য সমাজের মতো করে রাষ্ট্র সংখ্যালঘু বহিরাগত ও আক্রমণকারীদের দ্বারা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর উপর জবরদস্তিমূলকভাবে চাপানো কোনও সত্তা নয়। সিন্ধু সভ্যতায় বরং রাষ্ট্র অনেকাংশে সমাজের ক্রমবিবর্তনের ফল তথা মূলত একটি শান্তিপূর্ণ সমাজের বিবর্তিত রূপ। এখানে যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগ কখনই ভূমিকা রাখে নাই এটা মনে করাটা ভাববাদী চিন্তা হবে। অমন আদর্শ পরিস্থিতি অনুযায়ী ইতিহাসের অগ্রগমন ঘটে না। কিন্তু এও সত্য যে, যুদ্ধ, বলপ্রয়োগ এসকলই এ সভ্যতায় সাধারণভাবে খুব গৌণ ভূমিকা রেখেছিল, সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব যার সবচেয়ে বড় সাক্ষী।
প্রশ্ন উঠা একান্ত স্বাভাবিক ও যৌক্তিক যে, একটি ক্ষুদ্র এলাকার পরিবর্তে এত বৃহৎ ভূভাগে কীভাবে কিংবা কোন প্রয়োজনবোধ থেকে সিন্ধু সভ্যতার বিশাল জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ ধারায় ও সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি সভ্যতা বা রাষ্ট্র গড়ে তুলল। বস্তুত এর উত্তর নিহিত রয়েছে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্যে। প্রথমত শান্তিপূর্ণ ধারা ছাড়া এমন বৃহৎ আয়তনে জলকপাটযুক্ত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকাকে, কিছু যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ হলেও, প্রধানত শান্তিপূর্ণ পন্থায় নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হয়েছে। তবে একবার নদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে সেই অঞ্চলকে সহজে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্বাধীনে নেওয়া সম্ভব। এরপর মূলত শান্তিপূর্ণভাবেই সভ্যতা তথা রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ ঘটানো গেছে। অর্থাৎ আমাদের বিবেচনায় সিন্ধু সভ্যতার ভরকেন্দ্র ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সুতরাং যত গণতান্ত্রিক পন্থায়ই হোক এর উপর নিয়ন্ত্রণ যারা রাখতে পেরেছিল সমগ্র সভ্যতা তথা সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদেরই হাতে।
সিন্ধু সভ্যতার প্রাণশক্তির উৎস যে মূলত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সে বিষয়ে আমরা বিশেষত ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’য় বিশদভাবে আলোচনা করেছি। এখানেও তার কিছু উল্লেখ করেছি। সুতরাং বিভিন্ন কারণে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় যখন সঙ্কট দেখা দেয় তখন সিন্ধু সভ্যতা ভিতর থেকেই ভেঙ্গে পড়তে থাকে। অবশেষে সভ্যতার শেষ পর্যায়ে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনসমাজের অন্তত একাংশের বিদ্রোহ ঘটলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। যেহেতু ততদিনে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেহেতু সমাজের নদীনিয়ন্ত্রণ বিরোধী অংশকে ধর্মসংস্কার ঘটাতে হয়। এই সংস্কারের ফল হল ঋগ্বেদ রচনা, বৈদিক আন্দোলন ও যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পতনোন্মুখ সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস সম্পন্ন হয়। আমাদের এই ব্যাখ্যা আপনার কাছে নূতন নয়। সুতরাং এ নিয়ে আর বিশদ বলবার প্রয়োজন নাই।
সিন্ধু সভ্যতার পর্যালোচনা এবং পরবর্তী ভারতীয় সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার গতিপ্রকৃতির বিশদ ও গভীর অনুসন্ধান থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, এখানে (সিন্ধু সভ্যতায়) রাষ্ট্র ছিল সমাজ তথা জনসমাজের অভিব্যক্তি। ফলে বিশাল অঞ্চলব্যাপী একটি বৃহৎ ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটলেও সমাজতল থেকে উঠে আসা এই রাষ্ট্রের উপর বৃহত্তর সমাজ তথা জনগণের নিয়ন্ত্রণ ছিল সুগভীর। আসলে নীচ থেকে উপর এবং প্রান্ত বা ভিত্তি থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিন্যস্ত এই রাষ্ট্র ছিল জনগণের স্তরবিন্যস্ত স্বশাসনের রাজনৈতিক রূপ। এটা এমন এক রাষ্ট্র যা একই সাথে যেন একটি সমাজ আবার একই সাথে একটি রাষ্ট্র। আমরা অনুমান করি গ্রাম থেকে নগর এবং সমাজের প্রান্ত থেকে রাজধানী বা শাসনকেন্দ্র পর্যন্ত মূলত প্রথাভিত্তিক স্বশাসনমূলক ব্যবস্থা দ্বারা সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালিত হত। স্বশাসনের এই নির্দিষ্ট ব্যবস্থা হয়ত পঞ্চায়ত বা পঞ্চায়েত নামে কথিত হত। যখন সিন্ধু সভ্যতা ও তার প্রজাতন্ত্রের অবসান হয়েছে, সিন্ধু সভ্যতার স্মৃতিও মুছে গেছে তখন একটা ঐতিহাসিক গতিধারায় রাষ্ট্রের নীচ তলায় স্থানীয় জনগণের প্রথাভিত্তিক স্বশাসনের রূপ হিসাবে পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থা যেমন টিকে থেকেছে তেমন ঐতিহ্যগত নাম তথা পঞ্চায়েত শব্দও টিকে থেকেছে। পঞ্চায়েত শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে স্মরণাতীত কালধরে চলে আসা স্থানীয় জনগণের স্বশাসনের প্রথাগত এই রূপ আমাদের কল্পনায় জীবন্ত হয়ে উঠে।
এখন আমরা অনুমান করতে পারি সিন্ধু সভ্যতার পতন-পরবর্তী কালে যখন রাষ্ট্রশাসনে ক্রমে বংশগত রাজতন্ত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন সমাজ তথা জনসমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র যে শুধু সামরিক বা যুদ্ধ নির্ভর হল তা-ই নয়, অধিকন্তু রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি হয়ে উঠল স্বৈরাচারী। জনগণের কণ্ঠস্বর রাজতন্ত্রে প্রতিধ্বনিত হবার সুযোগ অনেক কমে গেল। কিন্তু তারপরেও ভারতীয় স্থানীয় রাজা বা সম্রাটদের পক্ষে অন্যান্য অনেক অ-ভারতীয় সমাজের রাজাদের মতো খুব বেশী স্বৈরতন্ত্রী হবার সুযোগ ছিল না। রাজপ্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি স্থাপনা থেকে তুলনামূলকভাবে কৃষিসমদ্ধ ভারতীয় সমাজের এই বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। এর ফলে এখানে রাজতন্ত্র গড়ে উঠলেও রাষ্ট্র ও সমাজ তথা শাসক শ্রেণী ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক অধিকাংশ সমাজের তুলনায় অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ।
এভাবেও হয়তো বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার ভরকেন্দ্র গ্রাম তথা গ্রামীণ সমাজে চলে গিয়েছিল, যে সমাজের ভরকেন্দ্র স্বরূপ আবার ছিল কৃষিজীবী মানুষ তথা কৃষক। এক অর্থে এই কৃষক তথা কৃষি-সমাজ পরবর্তী ভারতীয় সভ্যতার মূল নিয়ন্তা। এই কৃষকেরই সামাজিক স্থিতির শক্তি হিসাবে কাজ করেছে সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যে লালিত পঞ্চায়েত তথা জনগণের পঞ্চায়ত জাতীয় স্বশাসনের ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনাকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রও দাঁড়াতে পারে নাই।
এর ক্ষতিকর দিকও আছে বৈকি! প্রজাদের মুখ চেয়ে চলতে গিয়ে রাজা বা রাষ্ট্র ক্ষেত্র বা পরিস্থিতি বিশেষে সেনাবাহিনী গঠন ও রক্ষা তথা সামরিক প্রস্তুতির জন্য যে বিপুল ব্যয় করতে হয় সেটা করতে পারে নাই। খ্রীষ্টীয় শতকের শুরুর কিছু পূর্ব থেকেই মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি ও মরুভূমি থেকে শক, হুন, ইত্যাদি বিভিন্ন যাযাবর ও পশুচারী জনগোষ্ঠীর আক্রমণের ঢেউগুলি আফগানিস্তানসহ ভারতবর্ষের পশ্চিম ভূভাগের উপর আছড়ে পড়তে থাকে। এর ফলে আফগানিস্তানসহ পশ্চিম ভারতের জনসমাজের বিপুল বিপর্যয় ঘটে। নগর ও শহরসহ বিপুল সংখ্যক জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলাম ধর্মকে অবলম্বন ক’রে সপ্তম শতাব্দীতে আরবের মরুপ্রান্তর থেকে পশুচারী যাযাবর আরব বেদুইনদের উত্থান ঘটে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের প্রাচীন সভ্যতাগুলির এক বৃহদাংশই মুসলিম পরিচয়ে চিহ্নিত এই মরুচারী যাযাবরদের প্রবল আক্রমণের আঘাতে তছনছ হয়ে গেল। ভারতের সিন্ধুর রাজা দাহিরকে পরাজিত করে আরব মুসলিমরা ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে সিন্ধু দখল করে। কিন্তু তখনও ভারতের প্রতিরোধ শক্তি কিছু পরিমাণে হলেও টিকেছিল। সুতরাং তারপর কয়েক শত বৎসরের জন্য মুসলিম অগ্রাভিযান থেমেছিল। লাগাতার বহিরাগত মুসলিম আগ্রাসন শুরু হয় প্রকৃতপক্ষে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে তুর্কী হানাদার মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণ ও দখল অভিযান দিয়ে।
এটা লক্ষ্যণীয় যে, বহিরাগত মুসলিম বিজেতারা এখানে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পর সাধারণত নবতর বহিরাগত আক্রমণ অভিযানগুলিকে প্রতিহত ক’রে অবশিষ্ট ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতাকে নিম্ন মাত্রায় হলেও রক্ষা করেছে। এ প্রসঙ্গে আমরা মোঙ্গল হানাদার চেঙ্গিস খানের ভারত আক্রমণ প্রতিহত করায় দিল্লীর খলজী সুলতান আলাউদ্দীন খলজীর ভূমিকার কথা বলতে পারি। আলাউদ্দীনের বহুবিধ নিষ্ঠুরতার কথা বহু প্রচারিত। তার সময়ে দিল্লার নিকট দশ হাজার মোঙ্গল ইসলাম গ্রহণ করে বাসরত ছিল। তার মনে হল যে, এরা তাকে উৎখাতের জন্য চক্রান্ত করছে। পরিণতিতে তিনি তাদের সবাইকে হাতীর পদপিষ্ট করে হত্যা করেন।
এটা ঠিক যে, বহিরাগত মুসলিমদের চেষ্টা ছিল ভারতীয় অমুসলিম বিশেষত হিন্দুদের ইসলামে দীক্ষিত করার। কিন্তু বিশেষত হিন্দু ধর্মকে অবলম্বন করে ভারতীয় সমাজ সে চেষ্টাকে প্রাণপণে প্রতিহত করেছে। এটা নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, বহিরাগত মুসলিম শাসনকেন্দ্র উত্তর ভারত আজও বিপুলভাবে হিন্দু গরিষ্ঠ ও মুসলিম লঘিষ্ট হয়ে আছে। আসলে বহিরাগত মুসলিম শাসকরাও অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম মানার বুদ্ধিটুকু রাখত। হিন্দু প্রজারা সাধারণত ছিল অপ্রতিরোধী বা নির্বিরোধ। একেবারে দেওয়ালে পিঠ না ঠেকলে তারা বিদ্রোহ করতে চাইত না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তারা দলবেঁধে পালাত বনজঙ্গলে কিংবা অন্য রাজ্যে। সুতরাং মুসলিম শাসকরা যতই অত্যাচার করুক সেটা একটা সীমার মধ্যে সচরাচর থাকত। বরং এইসব পশুচারী, মরুচারী যাযাবর বা অর্ধযাযাবররা ভারতবর্ষে এসে যে ভোগ ও সম্ভোগের সুযোগ পেত সেগুলিকে রক্ষা করতে চাইত। যদি প্রজাই না থাকে তাহলে তারা এসব পাবে কীভাবে? এভাবে শত শত বৎসরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বহিরাগত মুসলিম শাসক শ্রেণী ও ভারতীয় হিন্দু প্রজাদের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য বা স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওরঙ্গযেবের মতো শাসকরা মাঝে মাঝে এটা নষ্ট করলেও পূর্বেকার স্থিতাবস্থা ফিরে আসতে বেশী সময় লাগত না। অবশ্য আওরঙ্গযেবের কর্মনীতির মাশুল তাকে সহ মোগল সাম্রাজ্যকে দিতে হয়েছিল ব্যাপক গণ-বিদ্রোহ ও সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে।
যাইহোক, মুসলিম শাসনের কিছু শিক্ষণীয় দিক আছে বলে আমাদের মনে হয়। সেটা হল সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রজাসাধারণের উপর কর বা রাজস্বের অতিরিক্ত বোঝা চাপানো। এমনিতে মুসলিম যুগে ভূমি রাজস্ব ছিল পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ। হিন্দু শাসনকালে ফসলের একষষ্ঠাংশ রাষ্ট্র গ্রহণ করত। অথচ মুসলিম শাসনকালে এর পরিমাণ ছিল একতৃতীয়াংশ। অনেক সময় রাষ্ট্র প্রজাদের নিকট থেকে প্রায় সবটুকু নিংড়ে নিত। এ প্রসঙ্গে আমরা আলাউদ্দীন খলজীর কর্মনীতির উল্লেখ করতে পারি।।
এ ধরনের কর্মনীতি একান্ত প্রয়োজন হলেও প্রাক-মুসলিম যুগে সম্ভব ছিল না। কেন সম্ভব ছিল না সেটা স্পষ্ট করার জন্য বলি, পঞ্চায়েতমূলক ভারতীয় জনগণের স্বশাসনের যে জাল সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তৃত ছিল তার প্রভাবকে কোনও ভারতীয় শাসকের পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। গ্রামকেন্দ্রিক ভারতীয় সমাজের চাহিদা বা দাবীকে অস্বীকার করে দাঁড়াবার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন ভারতবর্ষে ছিল না, যেটা ইউরোপ কিংবা চীনে ছিল। এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত বলে আমাদের মনে হয়। মূলত গ্রামকেন্দ্রিক পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার শক্তির সপক্ষে থাকা মাত্রাতিরিক্ত সামাজিক ভারসাম্য রাষ্ট্রশক্তিকে দুর্বল রেখে ভারতীয় সমাজের দীর্ঘ পরাধীনতার অন্যতম সহায়ক ফ্যাক্টর হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আমাদের এখন নূতন করে ভাবা দরকার।
তবে আমাদের অনুমান, যে ফ্যাক্টরটি ভারতবর্ষে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে সমাজকে প্রায় সর্বশক্তিমান সত্তায় পরিণত করেছে সেটা হল হিন্দুধর্মের বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থা। বর্ণজাতিভেদকে আমরা শ্রমকর্ম বিভাজনের একটা নির্দিষ্ট ভারতীয় রূপও বলতে পারি। ব্রাহ্মণ পুরোহিত শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজকে তত্ত্বগতভাবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণজাতিতে বিভক্ত করা হলেও বাস্তবে সমাজ অগণিত বর্ণজাতিতে বিভক্ত হল, যেখানে অসম সম্পর্কভিত্তিক এই বর্ণজাতিগুলির একটার পাশাপাশি অপর বর্ণজাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হলেও তাদের মধ্যে একত্র আহার, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও বিবাহ নিষিদ্ধ হল।
ভারতীয় সমাজে বর্ণজাতি প্রথার প্রভাব এমনই সুগভীর যে, এমনকি এক সময় মুসলিম সমাজও এর প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারত না। মোগল আমলে রাষ্ট্রও এই প্রথার সংরক্ষণে সতর্ক ভূমিকা রাখত। ফলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নীচতলার সাধারণ কর্মজীবীদের জন্য কুলগত পেশা ও মর্যাদা পরিবর্তন নিষিদ্ধ ছিল।*
--------------------------
* মোগল আমলে ভারতে আগত ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিযেরের বিবরণ থেকে আমরা এ সম্পর্কে জানতে পারি। বিনয় ঘোষের বঙ্গানুবাদ বাদশাহী আমল-এ এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ইংরেজ শাসনকালেও ভারতীয় মুসলিম সমাজে হিন্দু সমাজের অনুরূপ জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে ইসলামে বর্ণজাতি প্রথার অনুমোদন না থাকায় বিভিন্ন ধর্মীয়-রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ থেকে বর্ণজাতিভেদের অনুরূপ প্রথা দূরীভূত করা সহজতর হয়েছে। মুসলিম সমাজে বর্ণজাতিভেদ বা জাতিভেদের প্রভাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন Dr. Nazmul Karim তার The Changing Society in India and Pakistan নামক গ্রন্থে। এর সপক্ষে পাকিস্তান কালে পূর্ব বাংলার সমাজ সম্পর্কে শামসুজ্জোহা মানিকের তরুণ বয়সের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তখন পাবনাসহ অনেক জায়গায় মুসলিম কৃষকদের বাইরে ‘জোলা’ হিসাবে কথিত তাঁতীদের নিয়ে গঠিত একটা বৃহৎ পেশীজীবী গোষ্ঠী ছিল। কৃষকদের পাশাপাশি বসবাস করলেও সামাজিক প্রথা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সাধারণ কৃষক বা চাষীদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল। অর্থাৎ চাষীদের ‘জাত’ আর জোলাদের ‘জাত’ সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। একই ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও কৃষকরা সামাজিক মর্যাদায় অধঃস্তন হিসাবে জোলা বা তাঁতীদের অবজ্ঞা, এমনকি ঘৃণাও করত। নির্দিষ্ট কর্ম বা পেশা ও সামাজিক মর্যাদার প্রায় অপরিবর্তনীয় কাঠামোতে আবদ্ধ এ ধরনের আরও কিছু ‘জাত’কে মুসলিম সমাজে দেখা যেত।
--------------------------
☆ ☆ ☆ ☆ ☆
এতে কোনও সন্দেহ নাই যে, একদিকে কৃষিসমৃদ্ধি, অপর দিকে জনগণের স্বশাসনের রূপ হিসাবে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার অস্তিত্ব ভারতীয় সমাজকে ইসলামের ধর্ম ও সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে বিরাট শক্তি যুগিয়েছিল। কিন্তু এইটুকুই যথেষ্ট নয়, এই অস্তিত্বের লড়াইকে ভারতীয় সমাজের আর একটি বৈশিষ্ট্য বা কাঠামো বিরাটভাবে শক্তি যুগিয়েছিল বলে আমরা অনুমান করি, সেটি হল হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রমভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা। কুলগত বা বংশানুক্রমিক কর্ম তথা পেশা ও সামাজিক নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় মর্যাদাভিত্তিক এই প্রথা ভারতীয় সমাজকে একটা দীর্ঘ সামাজিক অবক্ষয় ও প্রতিক্রিয়ার যুগে আত্মরক্ষার যে শক্তি যুগিয়েছিল সেটিকেও আমাদের বুঝতে পারতে হবে। বর্ণজাতিভেদ ও পঞ্চায়েত এই উভয় ব্যবস্থা পরস্পর বিজড়নের মাধ্যমে প্রধানত নিষ্ক্রিয় পদ্ধতিতে বিশেষত গ্রামীণ ভারতীয় সমাজকে আত্মরক্ষার শক্তি দান করেছিল।
এটা ঠিক যে, বর্ণজাতিভেদ ভারতীয় ঐক্য ও সংহতির শক্তিকে এক অর্থে ধ্বংস করেছিল। তবে এই ধ্বংসটা ঘটেছিল তার সামরিক কিংবা রাষ্ট্রগঠনের সক্ষমতার ক্ষেত্রে। কিন্তু ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে শ্রম-কর্ম বিভাজনমূলক এই নির্দিষ্ট ভারতীয় সমাজব্যবস্থা ভারতকে সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষার অবিশ্বাস্য শক্তি দান করেছিল। বর্ণজাতিভেদমূলক কাঠামোর রক্ষাব্যূহের আশ্রয় নিয়ে অন্তত দুই হাজার বছর ভারতীয় সমাজ বৈরী সমাজশক্তির আঘাতকে মোকাবিলা করে টিকে থেকেছে।*
--------------------------
*প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে হিন্দু ধর্মের সময়কাল এমনটা বলে আমরা মনে করি। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, সিন্ধু ধেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা, দ্বিতীয় খণ্ড, ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ (https://www.bangarashtra.net/article/1546.html)
--------------------------
রাজনৈতিক ঐক্য না থাকতে পারে, প্রবল বৈদেশিক আক্রমণগুলিকে মোকাবিলায় ব্যর্থতা ঘটতে পারে, কিন্তু প্রায় অভিন্ন ছন্দের গতিধারায় সমাজ এগিয়ে চলেছে। এভাবে একটা ধর্মীয় ব্যবস্থায় সমাজ তার ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছে। এই বিচারে আমরা হিন্দু ধর্মকে সমাজবাদী ধর্ম বলতে পারি। এটা সমাজকে অজস্র অনড় ভাগে বিভক্ত করে রাজনৈতিকভাবে তার উত্থানশক্তি রহিত করলেও বৈদেশিক বা বিধর্মী হলেও যে কোনও রাষ্ট্রশক্তির অধীনতার মধ্যেও বেশ কিছু ধর্মীয় প্রথা ও আচরণের মাধ্যমে তার সামাজিক ঐক্যকে রক্ষা করে। তবে যে কথা বলেছি, হিন্দুধর্ম মূলগতভাবে রাষ্ট্র বিরোধী। সুতরাং হিন্দুধর্মের শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির ক্ষয় ও পতন ঘটেছে।
আমাদের ধারণা ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটাতে গিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা ভারত-রাষ্ট্রের জন্য এই বিপদকে ডেকে আনছে। বেদের কথা বলে লাভ নাই; অন্তত দুই হাজার বছর ধরে যে ধারায় হিন্দু ধর্ম ও সমাজ গড়ে উঠেছে তার আলোয় হিন্দুধর্মকে দেখতে হবে। আর তখন হিন্দুধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বর্ণজাতিভেদ প্রথা চলে আসবে, যেমন যত ব্যাখ্যাই দেওয়া যাক একই সাথে চলে আসবে প্রতীক পূজা হিসাবে প্রতিমা পূজার গুরুত্ব। প্রথমত, ধর্ম অন্ধবিশ্বাসের ব্যাপার। আর যে কোনও অন্ধত্বই ক্ষতিকর। আজকের যুগে সেটা আরও অনেক বেশী প্রযোজ্য। প্রতিযোগিতার এ পৃথিবীতে ধর্মের অন্ধত্ব নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রশ্ন উঠে না। বিশেষত হাজার হাজার বছরের অনেক ভালো ঐতিহ্যের মতো অনেক জঞ্জালও হিন্দুধর্মে জায়গা করে নিয়েছে। জঞ্জালগুলি থেকে ভারতীয় সমাজকে মুক্ত করতে হবে। এটা এক অর্থে হিন্দুধর্ম থেকে ভারতকে মুক্ত করার ব্যাপার। সেটা আপনারা কীভাবে করবেন সে বিষয়ে আপনাদেরকেই বিশেষভাবে ভাবতে হবে। মুসলিম সংখ্যাগুরু বাংলাদেশের জন্য যেমন ইসলাম প্রধান সমস্যা তেমন হিন্দু সংখ্যাগুরু ভারতের জন্য প্রধান সমস্যা হিন্দুধর্ম। অর্থাৎ এ বিষয়ে আপনাদের বিশেষভাবে ভাববার প্রয়োজন রয়েছে।
ইসলাম নিয়ে আমাদের কিছু সুবিধা আছে। সেটা হচ্ছে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে বহিরাগত ধর্ম হওয়ায় এটা এ সমাজে শিকড়হীন। হিন্দুধর্মের ব্যাপারটা অত সহজ নয়। ইসলামকে অস্বীকার করার সাথে সাথেই বাংলাদেশে আমাদের সামনে ঐতিহ্য হিসাবে শুধু যে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি উপস্থিত হয় তা-ই নয়, অধিকন্তু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিও উপস্থিত হয়, যার উৎসে পৌঁছাতে গিয়ে আমরা উপস্থিত হই সিন্ধু সভ্যতায়। এখানে আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ধর্মের বিজড়ন না ঘটায় একবার ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি ঘটলে এখানে প্রথমে বাঙ্গালী জাতীয় চেতনা এবং অতঃপর সেই চেতনার সড়ক ধরে বৃহত্তর ভারতীয় চেতনার দিকে যাত্রা হয় অবারিত। এই ঘটনাটা এ দেশে ষাটের দশকে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। এটা ঠিক যে, এক অর্থে একাত্তরের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই সমগ্র গতিধারার সমাপ্তি ঘটে। অবশ্য এটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এই আলোচনা করতে গেলে বহুকিছু উঠে আসবে। সেটার সুযোগ এখানে নাই।
এখানে শুধু এইটুকু বলি যে, ধর্মবিশ্বাসমুক্ত এই প্রজন্মের রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছিল মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ছত্রছায়ায় ও প্রেরণায়। আবার মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব তাদের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দেখা দিয়েছিল। আসলে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ছিল মতান্ধ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের প্রতি অন্ধ অনুগত। এক কথায় বলি, শুদ্ধতার পূজারী হয়ে মার্কসবাদও তার অনুসারীদেরকে সাধারণত মতান্ধ করে। সুতরাং অনেকাংশে স্বাধীন চিন্তা ও ভিন্নমত নিয়ে গড়ে উঠলেও কমিউনিস্ট রাজনীতির ছত্রছায়া ও প্রেরণায় গড়ে উঠা বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের বিপর্যয়ও ছিল অনিবার্য।
যাইহোক, এ প্রসঙ্গ আর নয়। ভারতের কমিউনিস্ট রাজনীতির অভিজ্ঞতাও আমাদের নিকট হতাশাজনক। লোকবাদী বা সেকিউলার চেতনার অনুসারী হিসাবে সেখানকার কমিউনিস্টদের নিকট থেকে একটা প্রত্যাশা থাকাটা আমাদের জন্য স্বাভাবিক। আমাদের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে ১৯৯৫ সালে আমাদের প্রকাশিত ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization এবং ২০০৩ সালে বাংলা গ্রন্থ আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা প্রকাশের পর। আপনি জানেন যে, আর্যরা যে মূলত সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী এবং আর্য শব্দ যে কোনও জাতিবাচক অর্থে নয়, বরং সভ্য্, ভদ্র, ধার্মিক ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত একটা গুণবাচক শব্দ এটা আমরা প্রকাশিত গ্রন্থের মাধ্যমে সেই সময় থেকে বলে আসছি। অবশ্য তার আগে ১৯৯৪ সালে ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে নাকচ করে খসড়া থিসিস হিসাবে আমরা যে বক্তব্য তৈরী করি তার একটা কপি পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ও সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ক বিশ্ববিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের নিকট পাঠালে তিনি তাতে জোরালো সমর্থন দিয়ে সেটি অনতিবিলম্বে প্রকাশের তাগাদা দেন। এটা বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এ ধরনের কোনও সমর্থন বা প্রেরণা ভারতের কোনও পণ্ডিতের নিকট থেকে আমরা পাই নাই। বরং সেখানকার মার্কসবাদী মহল থেকে আমরা যে মনোভাবের প্রকাশ ঘটতে দেখেছি সেটাকে নেতিবাচক বলা ছাড়া আর কোনও ভাষা খুঁজে পাই না। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম বঙ্গ আমাদেরকে বিশেষভাবে হতাশ করেছে।
এটা শুনতে হয়ত বিস্ময়কর হবে যে, বাংলাদেশের ধর্মমুক্ত বাম রাজনীতির প্রভাব বলয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী, লেখক ও পণ্ডিতদের মধ্য থেকে আমরা নানানভাবে আমাদের আর্যতত্ত্বের প্রতি যে সমর্থন পেয়েছিলাম তার কিছুই আমরা পশ্চিম বঙ্গ বা ভারত থেকে পাই নাই। বরং সেখানকার বামপন্থীরা আমাদের তত্ত্বের প্রতি নানানভাবে তাদের অনীহা বা অপছন্দ প্রকাশ করেছে। এটা আরও উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে আমরা যে শুধু বামপন্থী ধারা থেকে আগতদের কাছ থেকে সমর্থন পেযেছিলাম তাই নয়, অধিকন্তু তার বাইরের অ্যাকাডেমিক ধারার পণ্ডিত মহলেও সমর্থন কিংবা উৎসাহ পেয়েছিলাম। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান এবং বাংলাদেশে ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজ প্রজেক্টের প্রাক্তন ন্যাশনাল প্রজেক্ট অ্যাডভাইজার প্রয়াত ডঃ নাজিমুদ্দীন আহমদের কথা। তিনি এক সময় পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের উপ-পরিচালক হিসাবে রফিক মোগলের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার উপর খননকাজে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আর্য ও সিন্ধু সভ্যতার উপর লিখা ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization পড়ে তিনি আমাদের তত্ত্বকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করেন। তার প্রস্তাব ছিল এ বিষয়ের উপর একটা সেমিনারের আয়োজন করার। সেখানে তিনি আমাদের থিসিসের সমর্থনে বক্তব্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সেমিনার আর করা হয় নাই। তিনিও প্রয়াত হয়েছেন অনেক দিন আগে।
এ বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৯৪ সালে ডঃ রফিক মোগল আমাদের থিসিসকে সমর্থন জানানোর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক ডঃ আহমেদ কামাল ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর তৎকালীন গবেষক ডঃ হোসেন জিল্লুর রহমান (তিনি ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন।) একটি সভার আয়োজন ক’রে আমাদের দুইজনকে সম্বর্ধনা প্রদান করেন। এখানে এটাও বলে রাখা উচিত হবে যে, ১৯৯০ সালে শামসুজ্জোহা মানিক কর্তৃক লিখিত ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান-এর হাতে লিখা পাণ্ডুলিপির ফটোকপি প্রচারের পর এই থিসিস নিয়ে ঢাকার পণ্ডিত ও গবেষক মহলে ঔৎসুক্য ও আলোচনা শুরু হয়েছিল। এমনকি এখানকার একজন প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক পাণ্ডুলিপিটি পড়ে এটিকে বই আকারে প্রকাশের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। তবে এক অর্থে সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে ২০০৩ সালে আমাদের বাংলা গ্রন্থ আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা প্রকাশের পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের একজন মন্ত্রী গ্রন্থটির প্রকাশন উৎসব করার প্রস্তাব দেন যেখানে তিনিসহ বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব ও মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে বক্তৃতা দিবেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, মান্নান ভূঁইয়া অনেক দিন আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু বিএনপি-এর রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের নাম জড়াতে না চাওয়ায় সে প্রস্তাবের প্রতি আমরা আগ্রহ প্রকাশ করি নাই।
প্রাচীন ভারতীয় এবং বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে মুসলিম সমাজ থেকে আগত শুধু ধর্মবিশ্বাস বিরোধী ব্যক্তিবর্গ নয়, অধিকন্তু কিছু উদার চিন্তার মুসলিমদেরও এমন মনোভাবের কারণ বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। শুধু বাংলাদেশে আমরা যে সমর্থন ও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম তা নয়। বরং আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে আর্যতত্ত্ব ও সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত বক্তব্য নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন সর্বোচ্চ ব্যক্তি ও সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা ও মৌলিক অবদান রাখবার কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত প্রত্নতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ রফিক মোগলের সমর্থন লাভের পর।*
--------------------------
*ঋগ্বেদ, আর্য ও সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত আমাদের প্রাথমিক তত্ত্বের প্রতি পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল শামসুল আলম চঞ্চলের নিকট যে পত্র পাঠিয়েছিলেন সেটা হয়তো আপনি পড়েছেন। তা সত্ত্বেও গুরুত্ব বিবেচনা করে আপনার নিকট প্রেরিত আমাদের এই যৌথ পত্রের শেষে তার একটা কপি সংযুক্ত করব।
--------------------------
এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা সঙ্গত যে, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু সমাজ থেকে আসা কমিউনিস্ট বা বামপন্থীদের নিজেদের বাসভূমির ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি এমন নিরাসক্তি, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিরুদ্ধতার কারণ কী? বুঝলাম, বিশেষত হিন্দুধর্মের মতো একটা প্রাচীন ও প্রচণ্ড প্রভাবসম্পন্ন ধর্ম থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য তার সঙ্গে ছেদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাই বলে অতীতের সবকিছুকে অবজ্ঞা ও বর্জন করে কি দাঁড়ানো যায়? অতীতের মধ্যে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সেখানে শক্তি ও সম্ভাবনার অনেক উৎসও যে লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা কি বুঝতে হবে না? সেটাকে খোঁজা তো দূরের কথা; এমনকি সেই খোঁজার কাজটাকে পারলে প্রাণপণে বিরোধিতাই করতে চান এরা। আসলে ভারতের কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী তথা বাম ধারার মধ্যে যে প্রেরণাটা সংগুপ্ত রয়েছে সেটা হল অতীত ঐতিহ্যকে বিরোধিতা করতে গিয়ে স্বদেশদ্রোহে চলে যাওয়া। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে ভারতের হিন্দু সমাজের বামপন্থীরা হিন্দুধর্মকে বিরোধিতা করতে গিয়ে এক ধরনের দেশহীন ও ভাসমান শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির আড়ালে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার অনেক শক্তির দিক যে লুকিয়ে রয়েছে সেটাকেও তারা বুঝতে চান না। যেহেতু তারা সেটা বুঝতে চান না সেহেতু তাদের সেদিকে দৃষ্টিটা পড়ে না। তারা এটা বুঝতে চান না যে, হিন্দুধর্মে যত ত্রুটি থাকুক এটা ইসলামের মতো পশুচারী ও মরুচারী যাযাবর লুটেরা ও ধর্ষক যোদ্ধাদের ধর্ম নয়। বরং তার বিপরীতে এটা ভারতীয় কৃষকদের এমন একটা ধর্ম যার মর্মে সকল পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও নিহিত রয়েছে এক সুপ্রাচীন ও মহান সভ্যতার উত্তরাধিকার। তারা দেশ থেকে নিজেদেরকে চেতনায় এমনইভাবে বিচ্ছিন্ন করেন যে, তাদের নিকট প্রকৃত অর্থে দেশের কোনও অস্তিত্ব নাই। আন্তর্জাতিকতাবাদ কিংবা সর্বহারা শ্রেণীর নামে তারা অখণ্ড মানবসত্তার ধ্যানেই নিমগ্ন থাকেন। ফলে তাদের নিকট বাস্তবের দেশ নাই। ফলে নাই বাস্তবের দেশপ্রেমও। যাদের মধ্যে দেশ প্রেম নাই, তারা দেশ গঠন করবেন কী করে?
বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের পর ভারতবর্ষের এক বিস্ময়কর মহাসভ্যতা একটু একটু করে আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আবিষ্কারের শত বৎসরের কথা থাক। বিগত ৪০-৫০ বৎসর সময়ের মধ্যে আরও অনেক আবিষ্কার এমন এক সভ্যতার চিত্র আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছে যা হয়ে উঠতে পারে আমাদের আগামী সভ্যতা নির্মাণে বিপুল শিক্ষা ও প্রেরণার উৎস। কিন্তু অতীতের সবকিছুকে অন্ধ ও নিঃশর্ত ভাবে নাকচ করতে চাইলে সেখান থেকে আমরা শিক্ষা ও প্রেরণা নিব কীভাবে?
☆ ☆ ☆ ☆ ☆
স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্পর্কে আপনি যথাযথই বলেছেন যে, এটা বাস্তবে থাকা সম্ভব নয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে শুধু গ্রাম নয়, অধিকন্তু একটা জনপদও অন্যান্য জনপদের উপর নির্ভরশীল হতে পারে। একটা ছোট ও সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। শুধু জমি থাকলেই ফসল ফলানো যায় না। তার জন্য লাঙ্গল লাগে। আবার শুধু কাঠ দিয়ে লাঙ্গল তৈরী করলেই জমি চাষ করা যায় না। তার জন্য লোহার ফলা দিতে হয় কাঠের লাঙ্গলের আগায়, যার দ্বারা জমিকে বিদীর্ণ করা সম্ভব। সব জায়গায় যেমন লোহা পাওয়া যায় না তেমন এটা দূর দেশ থেকে আনতে হয়। একইভাবে তরকারী রাঁধবার জন্য যে মশলা বা লবণ লাগে সেগুলিও হয়তো আসে দূর দেশ থেকে। এভাবে কৃষি কিংবা সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার মানুষকে যেমন তেমন তাদের বসতিগুলিকেও পরস্পর নির্ভরশীল করে। এই নির্ভরশীলতার ফলে গড়ে উঠে বাণিজ্য এবং বণিক শ্রেণী কিংবা বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণী বা গোষ্ঠী। বাণিজ্য দূরদূরান্তের মানুষদেরকে যেমন পরস্পর সংযুক্ত করে তেমন পরস্পর নির্ভরশীলও করে। অন্তত সভ্যতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ বা গ্রাম ইত্যাদি ক্ষেত্রবিশেষে আপেক্ষিক অর্থে সত্য হতে পারে; কিন্তু এ ধরনের বিবৃতির সময় আমাদের খুব সতর্ক থাকা উচিত।
হতে পারে এ ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক যে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা তাদের উপনিবেশবাদী মতলব থেকে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম’ ইত্যাদি যাবতীয় উদ্ভট ধারণা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিল। ঋগ্বেদ পাঠ ক’রে যারা ‘ভারতে বহিরাগত আর্য আক্রমণ’ তত্ত্বের মতো হাস্যকর ও ফালতু একটা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লাগতে পারে তাদের পক্ষে কী না করা সম্ভব! শুধু তলোয়ার ও বন্দুকের জোরে উপনিবেশের মানুষদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এর জন্য প্রয়োজন হয় তাদেরকে চিন্তা-চেতনা তথা ধারণাগতভাবেও বিভ্রান্ত, বিপথগামী ও অধীনস্থ করার।
গ্রামের উদ্ভব, সীমানা নির্ধারণ ইত্যাদি সম্পর্কে আপনি কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের মনে হয় বিষয়গুলি খুব জটিল কিছু না। প্রথমত বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে যখন একটা গ্রাম ধারণ করতে পারে না তখন নূতন গ্রাম পত্তন দ্বারা তার সমাধান করা হয়। নগরগুলি যেমন তেমন গ্রামও একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ভৌগোলিক ও অন্যান্য বহুবিধ কারণে আবদ্ধ থাকতে চায় বা বাধ্য হয়। বিশেষ করে কৃষির বিকাশ ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও বিস্তার সংযুক্ত। এর ফলে নূতন নূতন গ্রাম, শহর-নগর ও জনপদের প্রতিষ্ঠা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দেখা দেয়। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে যেমন এমনটা ঘটে তেমন সভ্যতার ক্ষয় বা বিপর্যয়ের সঙ্গে বিপরীতটাও ঘটে। সভ্যতা কিন্তু এমন একটা ছন্দে এগিয়ে এসেছে। এই গতির ছন্দ যেমন অনেক সময়ই সরল ও সহজবোধ্য হতে পারে তেমন অনেক সময়ই অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য হতে পারে। মানুষের সভ্যতার গতিধারাকে বুঝার সময় আমাদের এ বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার যে, মানুষের এই যাত্রায় অবিরাম নূতন নূতন উপাদান এসে যুক্ত হয়। ফলে পূর্ববর্তী অনেক অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা পরবর্তী ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে অনেক সময় ভুল করি।
আজকের যুগের অনেক চিন্তা ও দর্শনের উৎস হাজার হাজার বছর পূর্বের চিন্তা ও দর্শনের মধ্যে থাকতে পারে। আমরা সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা-র দ্বিতীয় খণ্ডে প্রাচীন গ্রীসের দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তায় সিন্ধু সভ্যতার প্রভাবের কথা বলেছি। এমন হতে পারে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রচিন্তা ও লোকায়তিক আদর্শ আরো অনেক পরে ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা-র প্রেরণা হিসাবে অবচেতনে কাজ করেছে, যেমনটা আপনি বলেছেন।
কিছু সংখ্যক পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা যে মত বিনিময় করেছি তার মাধ্যমে আমরা আমাদের অনেক চিন্তা বা ধারণাকে যেমন অধিকতর স্বচ্ছ ও তীক্ষ্ণ করতে পেরেছি তেমন পরস্পরকে অনেক সমৃদ্ধ করতে পেরেছি বলেও অনুভব করি। বিশেষত ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে আপনার এমন গভীর আগ্রহ আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। সবশেষে, আমাদের লেখার পাঠ এবং সেগুলির উপর প্রশ্ন ও আলোচনা করতে চাওয়ার জন্য আপনাকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।
আপনার মঙ্গল কামনা করে এখানে বিদায় নিই।
ইতি –
শামসুজ্জোহা মানিক
শামসুল আলম চঞ্চল
৩০ জুন, ২০২৩
E-mail : bangarashtra@gmail.com
-----------------------
* নিম্নে প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল-এর স্ক্যানকৃত পত্রটি দেওয়া হল