Banner
ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা বিষয়ে একগুচ্ছ পত্র বিনিময় : শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল বনাম অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল বনাম অভিরূপ মুখোপাধ্যায়, আপডেটঃ August 6, 2023, 12:00 AM, Hits: 1357

 

(প্রাচীন ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতা প্রসঙ্গে পশ্চিম বঙ্গ থেকে অভিরূপ মুখোপাধ্যায় (E-mail-   avirup2000.official@gmail.com) শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চলের (E-mail- bangarashtra@gmail.com)  নিকট পত্র পাঠালে উভয় পক্ষের মধ্যে যে মতবিনিময় হয় পত্রলেখকদের সম্মতিক্রমে সেগুলির মধ্য থেকে বাছাইকৃত পত্রগুচ্ছ কাল-ক্রমানুসারে নিম্নে প্রকাশ করা হল। — বঙ্গরাষ্ট্র, ৬ আগস্ট, ২০২৩)

 

Jan 18, 2023, 4:48 PM

প্রথমেই আপনাদের দু-জন তথা শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল মহাশয়কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি সিন্ধু সভ্যতা ও ঋগ্বেদকে যুক্ত করে একটি অখণ্ড আলোচনা উপস্থাপন করার জন্য।

আমি পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা নগরীর সংলগ্ন একটি মফস্বল, বেলঘরিয়ায় থাকি।

'ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান', 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা' আর বর্তমানে 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা: এক সভ্যতার পথযাত্রা'-র দুটি খণ্ড পড়া হয়েছে আমার। এ ছাড়াও বঙ্গরাষ্ট্র-এর ওয়েবসাইটে আপনাদের লেখা সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ক কিছু নিবন্ধও পড়েছি আমি। অন্য সূত্র থেকেও সিন্ধু সভ্যতা আর বৈদিক ঐতিহ্য সম্পর্কে কিঞ্চিৎ ধারণাও হয়েছে আমার। প্রচলিত মতানুযায়ী, পশ্চিম-ঘেঁষা ঐতিহাসিকদের ভিত্তিহীন 'আর্য আগমন (বহিরাক্রমণ) তত্ত্ব' আর সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের সময়ে আর্যদের ভিন্ন নৃগোষ্ঠী হিসেবে উপস্থাপন করার ছলচাতুরিকে আপনারা সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য দিয়েই খণ্ডন করেছেন 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা' আর তার পূর্ববর্তী খসড়া-গ্রন্থটিতে। আর্যদের বহিরাগত বলার পরিবর্তে সিন্ধু সভ্যতার পরবর্তী যুগে সিন্ধুবাসীদের বড়ো অংশকেই অভিবাসী হিসেবে দেখাতে চেয়েছিলেন পূর্বোক্ত গ্রন্থে। অবশ্যই তারা কৃষিভিত্তিক সমাজের মানুষ ছিল। এই জায়গা থেকেই 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা' গ্রন্থটির ব্যাখ্যা শুরু হয়েছে: অভিবাসী সিন্ধুবাসীরা এবং সিন্ধু সভ্যতার সায়াহ্নে বৈদিক ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পূর্ববর্তী লোকায়ত মতাদর্শ পূর্ব ভারতের জনপদগুলিতে প্রতিষ্ঠিত হয়। বৌদ্ধ, জৈন ও অন্যান্য ধর্মমত, যেগুলি অধ্যাত্মিকতার অহেতুক প্রচারের জায়গায় বরং জনকল্যাণমূলক সমাজ গঠন করার কথা বলেছে, সেই ধর্মগুলির মধ্যে অতীতের সিন্ধু সভ্যতার লোকায়তিক আদর্শের ধারাবাহিকতা লক্ষ করেছেন আপনারা উক্ত গ্রন্থের দুটি খণ্ডে। তৃতীয় খণ্ডটি প্রকাশের অপেক্ষায় রইলাম। হার্ড কপি পাওয়া যাবে না, তাই সফট কপিতেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে।

এভাবে বিচার-বিশ্লেষণ আগে হয়নি; ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসের এমন সামগ্রিক ব্যাখ্যা প্রত্নতত্ত্ব আর তৎকালীন ধর্মগ্রন্থের ঐতিহাসিক ব্যাখ্যার সমন্বয়ের লেখা হয়নি এইভাবে। দুর্ভাগ্য, এরকম ব্যাখ্যাকে অ্যাকাডেমিক বিদ্যায়তনে প্রতিষ্ঠিত করার কোনো উদ্যোগ নেই। আপনারাও এই কাজের প্রথম দিকে অনেকের দ্বারাই নিরুৎসাহিত হয়েছিলেন বলে উল্লেখ করেছেন। হয়তো অনেকের রুটিরুজি আর ধান্দার কারবারিতে টান পড়বে এরকম ব্যাখ্যা প্রতিষ্ঠা পেলে। তবুও আপনাদের এই নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দঃ-পূঃ এশিয়ার ইতিহাসচর্চায় গুরুত্ব পাক, আলোচনার কেন্দ্রে আসুক, এই আমার প্রার্থনা।

প্রসঙ্গত, কয়েকটি প্রশ্ন আমার মনেও জেগেছে আপনাদের বিশ্লেষণ পড়তে গিয়ে। সেগুলি নীচে বলা হল:

১) ঋগ্বেদের মধ্যে অতীতের দুটি আলাদা সময়ের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের বর্ণনা রয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। আপনারা বলেছেন, মূলত যুদ্ধ তথা সিন্ধুধর্মের সংস্কারের লক্ষ্যে বৈদিক আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিল। অথচ আমার মনে হয়েছে আন্দোলন একবার নয়, দু-বার সংঘটিত হয়েছিল। প্রথমে বৃত্র তথা বাঁধ-নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা ভেঙে ফেলার জন্য (এই ব্যাখ্যার জন্য ধন্যবাদ আপনাদের) বরুণপন্থীদের আন্দোলন ঘটেছিল বলে মনে হয়েছে। নয়তো যে জলকে বৃত্র রোধ করে রেখেছিল, সেই যুগে জলের দেবতা বরুণই কেন প্রতিষ্ঠা পাবে? আবেস্তাতেও বৃত্রঘ্নকে শ্রদ্ধা জানানো হয়, কিন্তু ইন্দ্রকে নিন্দা করা হয়। তাহলে এমনটা হওয়া কি অসম্ভব যে, সিন্ধু বা সরস্বতীর (বাঁধ দেওয়ার কারণেই কি সরস্বতী নদী শুকিয়ে গিয়েছিল?) জলরোধক বৃত্রকে জলের দেবতা ধ্বংস করার ডাক দিয়েছিল, অর্থাৎ বরুণই আদি বৃত্রঘ্ন ছিল এবং পরে ইন্দ্রের ওপর বরুণের কৃতিত্ব আরোপ করা হয়েছে? এমনকি ইন্দ্রকে বরুণের সমান হয়ে ওঠার অনুরোধও জানিয়েছে ঋষিরা কেউ কেউ। ভক্ষক বাঁধের পরিবর্তে রক্ষক-প্রতিপালক বরুণই ছিল হয়তো সেই যুগের নদীমাতৃক সিন্ধুবাসীদের মসীহা। তাহলে দ্বিতীয় প্রশ্ন উঠে আসে: ইন্দ্রের ভূমিকা তাহলে কী? এখানেই দ্বিতীয় আন্দোলন লক্ষ করেছি আমি (হতে পারে ইন্দ্র বরুণের সমকালীন হিংস্র কোনো দেবতা অথবা আলেকজান্ডার-চেঙ্গিসের মতো কোনো পরবর্তী সামরিক যোদ্ধা)। ইন্দ্রপন্থীরাই ঋগ্বেদের অনেকটা অংশ রচনা করেছে। কিন্তু তাদের মন্ত্র পড়ে মনে হয় অঙ্গিরা, অথর্বা, আদিত্য, বরুণ-- এরা সকলেই অনেক আগেকার ঋষি ও দেবতা। অঙ্গিরা প্রমুখের মতো প্রাচীন ঋষিদের পরবর্তী যুগেই কি বশিষ্ঠ-বিশ্বামিত্রদের দলাদলি উদ্ভূত হয়? ঋগ্বেদ লেখার আগেও অঙ্গিরা, অথর্বা, ভৃগু প্রমুখ সিন্ধু এলাকায় উপস্থিত ছিলেন বলেই মনে হয়। প্রসঙ্গত, অঙ্গিরা বা অথর্বা ঋষির সরাসরি লিখিত কোনো ঋক্ বা সূক্ত পাওয়া যায় না ঋগ্বেদে। এরাই কি সিন্ধুযুগের শেষের দিকে লোকায়ত আদর্শ তৈরি করেছিলেন? অঙ্গিরা, অথর্বা, ভৃগু ঋষির সঙ্গে জড়িত অথর্ববেদে লোকায়ত চিন্তার ছাপ অনেক পরিষ্কার ঋগ্বেদের তুলনায়। কেউ কেউ অথর্ববেদের ভাবনার জগৎকে (লোকায়ত মতবাদ আর একেশ্বরবাদ) ঋগ্বেদের পূর্ববর্তী বলেও মনে করেছেন। তাই আমার মনে হয়, ঋগ্বেদের যে অংশে ইন্দ্রের স্তুতি করা হয়েছে, সেই অংশের ঋষিরা অনেকটা পরবর্তীকালের মানুষ। ২৬০০ খ্রিঃপূঃ-এর দিকে সিন্ধু সভ্যতার নগর-বসতি তৈরি হওয়াটা যেমন কিছুটা আকস্মিক, তেমনই প্রচলিত মত অনুযায়ী, ১৭৫০ খ্রিঃপূঃ-এর দিকে সিন্ধু সমাজে স্থানীয়করণ আর ধর্মের প্রভাব (ইন্দ্রপন্থা নয়) বেড়ে যাওয়াটাও আকস্মিক ঘটনাই মনে করে ঐতিহাসিকরা। ঋগ্বেদ রচনার পটভূমিকে যদি একটা আন্দোলনের সময় মনে করেন আপনারা, তাহলে সিন্ধু নগরায়ণের পতনের যুগে লোকাচার আর ধর্মের প্রভাব বেড়ে যাওয়াটাকেই বা কেন কোনো আন্দোলন বলে ধরে নেব না? সর্বজনীনতা তথা সম্প্রসারণই (বাণিজ্যে, শিল্পকীর্তিতে) যে সিন্ধু নগরায়ণের প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, সেই নগরসভ্যতা কেন হঠাৎ করে সংকোচন তথা আঞ্চলিকতার দিকে ঝুঁকে পড়ল? কেন কৃষিভিত্তিক সিন্ধুনগরের জায়গায় 'গ্রাম' নামের একটি বিশেষ কৃষিভিত্তিক সমাজকাঠামো তৈরি হল? সর্বজনীনতা থেকে আঞ্চলিকতায় এই মোড় পরিবর্তন, আমার মতে, বৈদিক আন্দোলনের পূর্বেই ঘটেছিল। আর যদি তা হয়েই থাকে, তাহলে সেই পরিবর্তনের মধ্যেই লোকায়ত আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ঋগ্বৈদিক ঋষিরা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের প্রবর্তক নয়, কারণ ঋগ্বেদে আঞ্চলিকতার সুর বিশেষ নেই। পূর্ববর্তী সময়ে তাহলে কীভাবে লোকায়ত ধর্মাদর্শ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল? বৈদিক আন্দোলনের কি পূর্বসূরী ছিল উক্ত লোকায়তিকরা ('অঙ্গিরা পিতৃগণ' অতীতে অনেক বীরত্ব দেখিয়েছিল বলা হয়েছে ঋগ্বেদে)?

২) এই প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন করব আমি সিন্ধু সভ্যতার পূর্ববর্তী সরকারি কাঠামো নিয়ে। প্রচলিত মত অনুসারে, নগর আর গ্রাম, গণতন্ত্র আর রাজতন্ত্র বিপরীত জিনিস। সিন্ধুযুগের নগরের সঙ্গে আর আজকের নগরের সংজ্ঞাও মিলবে না এটা ঠিক। কারণ সিন্ধু সভ্যতার তথাকথিত নগরের মধ্যেই কৃষিকাজ আর কারুশিল্প একসঙ্গে সহাবস্থিত ছিল। কিন্তু বর্তমান যুগের নগরগুলি শিল্পকেন্দ্র (ছোটো ও বড়ো শিল্প) এবং গ্রামগুলি কৃষিকেন্দ্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশা তথা বৃত্তির ওপর জনবসতির এই আড়াআড়ি বিভাজন প্রাচীন মেলুহায় ছিল না বলেই মনে হয়। সিন্ধু সভ্যতাকে তাই পৃথকভাবে নগর বা গ্রামসভ্যতা বলা যাবে না; এটি উভয়েরই মিশ্রিত রূপ, উভয় বসতির পেশার মিশ্রিত সমাজ প্রতিষ্ঠিত ছিল সিন্ধুপারে। তবুও একটা প্রশ্ন করাই যায়। সিন্ধু সভ্যতা মূলত সামাজিক সাম্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। তাহলে বৈদিক আন্দোলনের পরবর্তীকালে কীভাবে রাজতন্ত্র গজিয়ে উঠল ভারতীয় উপমহাদেশে? সিন্ধুবাসীরা গাঙ্গেয় অববাহিকায় স্থানান্তরিত হয়েছিল বলেই ধরে নিচ্ছি আমি। তাহলে সিন্ধু গণতন্ত্র কীভাবে গাঙ্গেয় রাজতন্ত্রে রূপান্তরিত হল? ঋগ্বেদ তো খুব একটা রাজতন্ত্রের পক্ষে ওকালতি করে না। আবার এই সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসসাধন আর গাঙ্গেয় জনপদ তৈরি হওয়ার মধ্যবর্তী সময়ে রচিত মহাভারতে ধৃতরাষ্ট্র-পাণ্ডুর পূর্ববর্তী যুগের রাজতন্ত্র বড্ড দুর্বল ছিল। আমার সন্দেহ, এই তথাকথিত লোকায়ত ধর্মাদর্শ, যেটি সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে তৈরি হয়েছিল, তার একেশ্বরবাদী কাঠামোর মধ্যেই রাজতন্ত্রের বীজ নিহিত ছিল। ইন্দ্র সেভাবে রাজা নন (এক-আধবার রাজা বলা হয়েছে ঋগ্বেদে যদিও), তবে পূর্ববর্তী দেবতা বরুণকে বেশ কয়েকবার রাজা বলা হয়েছে ঋগ্বেদে। মোট কথা, জনমতের ওপর যে সরকারি কাঠামো পরিচালিত হয়, সেই সমাজে রাজার শাসন প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। সিন্ধু এলাকায় কি কোনোভাবে রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেও সংঘর্ষ হয়েছিল? তার প্রতিক্রিয়াতেই কি সিন্ধু-সরস্বতী এলাকা থেকে রাজতন্ত্রীরা সরে এসে গাঙ্গেয় অববাহিকায় রাজতন্ত্র তৈরি করল? বৌদ্ধধর্মের উত্থান (নাস্তিক মতাদর্শ আর সংঘ নির্মাণ) কি গাঙ্গেয় রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে সিন্ধু গণতন্ত্রীদের বিদ্রোহ ছিল?

এগুলিই আমার প্রশ্ন মোটামুটিভাবে। মেইলের রেপ্লাই পেলে ভালো লাগবে। আপনারা সুস্থ থাকবেন। পরিবারকে ভালো রাখবেন। ধন্যবাদ।

ইতি, অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Jan 20, 2023, 2:42 PM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

প্রথমেই আপনার সুচিন্তিত এবং পাণ্ডিত্যপূর্ণ মতামত সম্বলিত পত্রের জন্য আমাদের গভীর আনন্দ এবং কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আপনি যে সিন্ধু সভ্যতা ও আর্যপ্রশ্ন বিষয়ক ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রকাশিত আমাদের লেখাগুলি পড়েছেন সে কথা জেনে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত বোধ করছি। তার চেয়েও বড় কথা আপনি আমাদের বক্তব্য প্রসঙ্গে আপনার প্রশ্ন এবং সেই সঙ্গে আপনার নিজস্ব কিছু অভিমতও তুলে ধরেছেন। আপনার এই শ্রমসাধ্য আন্তরিকতায় আমরা কৃতজ্ঞ এবং অভিভূত বোধ করছি।

আপনার গুরুত্বপূর্ণ এই পত্রের উত্তর দিতে আমাদের একটু সময় নিতে হচ্ছে। বিষয়গুলি নিয়ে আমরা উভয়ে আলোচনা করে লিখছি। যেহেতু খুব জটিল কিছু বিষয়ের উপর আলোচনা করতে হচ্ছে সেহেতু কিছুটা সময় লাগতে পারে। হয়ত আরও দুই বা তিন দিন যাবে। এইটুকু জানাবার জন্য আমি ব্যক্তিগতভাবে আপনাকে পত্রটি দিচ্ছি। পরের পত্রটি হবে আমাদের উভয়ের পক্ষ থেকে লিখা।

ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

শামসুজ্জোহা মানিক

   

Jan 21, 2023, 10:49 PM

ধন্যবাদ আমার মেইলের রেপ্লাই দেওয়ার জন্য।

হাতে সময় রেখেই আমার প্রশ্নের উত্তর দিন; আমার তাড়া নেই।

আপনাদের তরফ থেকে উত্তর পাওয়ার অপেক্ষা রইল।

 

Jan 22, 2023, 6:14 PM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

আমাদের ধারণা পরিষ্কার করার জন্য প্রথমে সিন্ধুর সমাজ ও সভ্যতার ধারাবাহিক বিকাশ নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করব। সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায়ের সূচনাকাল ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ (আগে মনে করা হত ১৭৫০ খ্রীঃপূঃ-এ সিন্ধু সভ্যতার পতন হয়। গত শতাব্দীর নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা একমত হন যে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটে ১৯০০ খ্রীঃপূঃ-এ)। কিন্তু এই সময়ের অনেক আগে থেকেই, আরো কয়েক হাজার বৎসর আগে থেকে, এই অঞ্চলে সভ্যতার পথে ক্রমিক যাত্রা চলছিল, যা সম্পর্কে আদি হরপ্পান যুগের শেষের দিকে (আদি হরপ্পান যুগকে ধরা হয় ৫৫০০ খ্রীঃপূ থেকে ২৬০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত) পরিকল্পিত নগর ও বসতি নির্মাণ, নর্দমা ব্যবস্থা, ইটের মাপের স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন বা প্রমিতকরণ, নগর-প্রাচীর নির্মাণ, ইত্যাদি থেকে ধারণা করা যায়। তবে এই সময়ে কোনো কেন্দ্রীয় রাষ্ট্র গড়ে উঠে নাই, ফলে নগরায়নের বৈশিষ্ট্য দেখা গেলেও বিচ্ছিন্নভাবে ও আঞ্চলিক উদ্যোগে এগুলি গড়ে উঠেছিল। এর পরে ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে একটি কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় সিন্ধুর নগর সভ্যতা গড়ে উঠে, যেখানে ভাবাদর্শিক দিক থেকে য়েমন ঐক্য সাধিত হয় তেমনি বস্তুগত নানা দিকে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা পায় ও ঐক্য দেখা যায়। তবে সিন্ধু সভ্যতার সমাজের ঐক্য রক্ষার জন্য কয়েকটি বিষয়ে রাষ্ট্র কঠোর ছিল বলে আমরা মনে করি। তার মধ্যে ছিল ভাষা, লিপি ও বাটখারার মাপ। লিপি ও বাটখারার মাপে কঠোর নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে জানা যায়। অভিন্ন লিপির উপর রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ রক্ষার উপর গুরুত্ব প্রদান থেকে একটি অভিন্ন ভাষা প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার উপর রাষ্ট্রের গুরুত্বারোপের বিষয়টিকে অনুধাবন করতেও কষ্ট হয় না। বুঝা যায় কয়েক লক্ষ বর্গকিলোমিটার (রক্ষণশীল হিসাব অনুযায়ী ১০ লক্ষ বর্গকিলোমিটার) ব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতার জন-মানসে ঐক্য ও অখণ্ডতা রক্ষার তাগিদ থেকে লিপির এবং সেই সঙ্গে ভাষার অভিন্নতা অর্জনের উপর এতটা গুরুত্ব প্রদান।

সিন্ধু সভ্যতার আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণের কালে বিভিন্ন অঞ্চলে ছোট পর্যায়ে কিছু যুদ্ধ হয়ে থাকতে পারে। এই সম্ভাবনার কথা আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ ও ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা’-য় বলেছি।

সিন্ধু সভ্যতা যে একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ সভ্যতা ছিল, তা তার বিপুল সংখ্যক বসতি, নরকংকালসমূহের পুষ্টিমানে সমতা, নগর বিন্যাস, ইত্যাদি থেকে বুঝা যায়। এটি যে তার কৃষির বিপুল উৎপাদনের ফলে সম্ভব হয়েছিল তাতে কোনো সন্দেহ নাই। প্রত্নতাত্ত্বিকরাও এই সমৃদ্ধির বিষয়টি বলেছেন। আমরা মনে করি এই বিপুল সমৃদ্ধির উৎস ছিল বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় নদীগুলির উপর নির্মিত বাঁধ-ভিত্তিক সেচব্যবস্থা।

প্রবাহমান নদীর উপর বাঁধ নির্মাণের মত বড় আয়োজন করা সেযুগে সহজ হবার কথা নয়। এটা শুধু প্রযুক্তিগত বা কারিগরি কারণে দুঃসাধ্য ছিল তা নয়, অধিকন্তু প্রাচীন মানুষের ধর্মবোধও এ ধরনের উদ্যোগের অনুকূল ছিল না। এমনিতেই প্রবাহমান নদী সেযুগে সাধারণ মানুষের কাছে দেবতার মত পূজনীয় ছিল। সুতরাং প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যে সকল মানুষ এই আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিল, নিশ্চয়ই বাঁধ নির্মাণের সপক্ষে কোনো মতাদর্শিক আন্দোলন তাদের করতে হয়েছিল। জলকপাটযুক্ত বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে নদীনিয়ন্ত্রণের মত দুঃসাহসিক কাজে যারা  নেতৃত্ব দিয়েছিল তাদের এক ধরনের ভাবাদর্শিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হয়েছিল। স্বাভাবিকভাবে অলৌকিক শক্তির অধিকারী দেবতাদের অস্তিত্ব সংক্রান্ত যুক্তি-প্রমাণহীন বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাদেরকে সংগ্রাম পরিচালনা করতে হয়েছিল। এই রকম কালব্যতিক্রমী এবং অবিশ্বাস্য রকম শক্তিধর মানুষেরাই লোকায়ত বা বস্তুবাদের মত মতাদর্শকে ধারণ করেছিল বলে আমরা মনে করি। আমরা অনুমান করি ছোট পর্যায়ে হলেও একটি যুদ্ধের মাধ্যমে তারা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে ও এই মতাদর্শকে তারা রাষ্ট্র ও সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার যারা নির্মাতা তারাই লোকায়ত মতাদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করেছিল বলে আমরা মনে করি। কিন্তু সেযুগে লোকায়ত মতবাদ প্রাধান্যে এলেও সমগ্র সমাজ একেবারে বস্তুবাদী বা নিরীশ্বরবাদী হয়ে গিয়েছিল এটি মনে করা ভুল হবে। প্রাচীন দেবতারা লোকসমাজে সমান্তরাল ধারায়, কিন্তু গৌণভাবে টিকে থাকল। এটি বরুণ, ইন্দ্র, প্রভৃতি দেবতাদের জন্যও প্রযোজ্য। যেহেতু লোকায়ত মতবাদ বলপূর্বক প্রতিষ্ঠিত হয় নাই, তাই আরো অন্যান্য মতবাদ ও ধর্মীয় বিশ্বাস ও দেবতার সমাজ ও রাষ্ট্রে গৌণভাবে টিকে থাকা স্বাভাবিক ছিল।

সিন্ধুর সমাজ ও সভ্যতা ৭০০ বৎসর টিকে ছিল ও ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এর পতন হয়। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব বলে এই সাত শত বৎসর সিন্ধুর সমাজ ও রাষ্ট্র একই রকম ছিল না। এই সময়ে মৃৎশিল্প, সীল ও লিপি এবং স্থাপত্যে কিছু পরিবর্তন দেখা গিয়েছিল। আমরা অনুমান করি, যে বাঁধ-ভিত্তিক সেচব্যবস্থার উপর সিন্ধু সভ্যতা দাঁড়িয়ে ছিল সেই বাঁধ-ব্যবস্থা নদীতে পলি জমে অকার্যকর হওয়ায় সেখানে সংকট দেখা দিয়েছিল। বাঁধ ও জল নিয়ন্ত্রণের স্লুইস গেট মেরামত করে সভ্যতা হয়ত আরো তিন/চার শত বৎসর টিকে থাকলেও কৃষি ব্যবস্থায় সংকট দেখা দেওয়ায় ক্রমশ রাষ্ট্রে ও সমাজে ধর্মের প্রভাব বেড়ে যেতে থাকে। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য এ কথাই বলে।

নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থা একটা সময়ে সিন্ধু সভ্যতার মানুষদের অপরিমেয় দুঃখ-দুর্দশার কারণ ঘটায়। এই সময়ে রাষ্ট্রও লোকবাদের পাশাপাশি কিছুটা ধর্মেরও আশ্রয় গ্রহণ করে বা জনমতের চাপে করতে বাধ্য হয়। ২৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে নির্মিত মহেঞ্জো-দাড়োর ‘গ্রেট-বাথ’-কে প্রাচীন কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার শুরুর পর্যায়ে অবদমিত দেবতা বরুণের উদ্দেশ্যে নির্মিত বলে ধারণা করা যায়। এভাবে প্রায় তিন শত বৎসর পরে বরুণ সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের আনুকূল্যপ্রাপ্ত দেবতায় পরিণত হয়। স্বাভাবিকভাবে সেই সময়ে রাষ্ট্রের আনুকূল্যপ্রাপ্ত কিছু ঋষিরও সৃষ্টি হয়েছিল, যারা বরুণের পূজা করত।

বাঁধের কারণে যেহেতু সিন্ধু সভ্যতার নানা অঞ্চলের জনসাধারণের দুর্দশা ঘটে তাই সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে বাঁধ ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে জনমত তৈরী করার জন্য রাষ্ট্রের অধীনস্থ ঋষিদের একটি অংশ বিদ্রোহ করে। প্রথম এই বিদ্রোহ ঘটে অঙ্গিরা ঋষির নেতৃত্বে, সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতা পতনের কয়েক শত বৎসর আগে। বাঁধ ধ্বংসের এই প্রচেষ্টা একটি এলাকায় সীমাবদ্ধভাবে সফল হলেও তারা এটিকে আর এগিয়ে নিতে যে ব্যর্থ হয়েছিলেন সেটা ঋগ্বেদ থেকে বুঝা যায়। তবু এটা ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ বিরোধী আন্দোলনের সূচনা। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সপক্ষে গড়ে তোলা ধর্মেরও সংস্কারের মাধ্যমে নূতন ধর্ম গড়ে তোলার প্রচেষ্টা। পরবর্তীকালে বৈদিক ধর্ম সংস্কার আন্দোলন জোরালোভাবে শুরু হলে ঋগ্বেদের ঋষিদের নেতৃত্বে অনেক বাঁধ ধ্বংস করা হয়েছিল বলে ঋগ্বেদ সাক্ষ্য দেয়। বাঁধ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে জনসাধারণের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করার জন্য বৈদিকরা প্রাচীন কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার সময়ের অবদমিত দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনেন।

এই সময়ে বিদ্রোহী বৈদিক আন্দোলনের পাশাপাশি সিন্ধুর রাষ্ট্রে আরেকটি ধর্মসংস্কার আন্দোলন হয়েছিল বলে আমরা ধারণা করি। এই ধর্ম সংস্কারের নেতৃত্ব দেন জরথুস্ত্র নামে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতাপ্রাপ্ত ধর্মের একজন ঋষি। 

ইন্দ্র দেবতার নামে বাঁধ ধ্বংস হল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতা যে বাঁধ-ভিত্তিক নদীনিয়ন্ত্রণব্যবস্থার উপর টিকে ছিল তার পতন ঘটল। ফলে সেখানকার মানুষেরা নানা দিকে ছড়িয়ে পড়ল। কিছু অংশ সেখানকার বসতিগুলিতে বা আশেপাশে নূতন বসতি গড়ে গ্রামীণ সমাজে ফিরে গেল।

সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের একটি বড় অংশ বিশেষভাবে যারা বৈদিক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তারা গাঙ্গেয় সমভূমিতে ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে ও সেখানে কৃষি সমাজ প্রতিষ্ঠিত করে। তাদের উত্তরসূরীরা বেদকে ধারণ করল ও নিজেদের ব্রাহ্মণ পরিচয়ে পরিচিত করল। অন্যদিকে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের আনুকূল্য নিয়ে যারা বরুণের প্রাধান্যযুক্ত প্রচলিত ধর্মের সংস্কারের মাধ্যমে নূতন আর একটি ধর্ম গড়ে তুলল সেই আবেস্তান বা জরথুস্ত্র ধর্মের অনুসারীরা ইরানে বসতি স্থাপন করল।

সুতরাং আমরা মনে করি সিন্ধু সভ্যতার পতনের কালে প্রধানত দুইটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল। একটি বৈদিক ও অপরটি জরথুস্ত্রের ধর্ম সংস্কার আন্দোলন। প্রথমটির সংকলিত গ্রন্থ বেদ ও অপরটির গ্রন্থ আবেস্তা।

উপরে আলোচিত বিষয় আমাদের উভয়ের লিখা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’, ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা (দ্বিতীয় খণ্ড)’, ‘সিন্ধু সভ্যতাঃ আগামী সভ্যতার বাতিঘর’ এবং শামসুজ্জোহা মানিকের লিখা ‘সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত চেতনায় জেগে উঠুক উপমহাদেশ’, ‘সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-দর্শন’, প্রভৃতি গ্রন্থ ও নিবন্ধে নানাভাবে আলোচনায় নিয়ে এসেছি। তবে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ ২০০৩ সালে যখন প্রকাশিত হয়, সেই সময় থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত আমাদের চিন্তায় কিছু পরিবর্তন হয়েছে। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’-য় সিন্ধু সভ্যতার নির্মাতাদের সভ্যতার সূচনাকাল থেকে লোকায়ত চেতনাকে ধারণ করার কথা বলা হয়েছে (মুদ্রিত গ্রন্থের ১৭১ পৃষ্ঠা থেকে ১৭৫ পৃষ্ঠায় এ সম্পর্কে বলা আছে)। সিন্ধু সভ্যতায় যে ধর্মীয় শক্তির হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা ছিল না তা সেখানকার ১৭৫ পৃষ্ঠায় বলা হয়েছে। আমরা এই বিষয়টি আরো জোরালোভাবে বলেছি পরবর্তীকালের রচনাগুলিতে।

এবার আসা যাক আপনার প্রশ্নে। আপনার আলোচনা ও প্রশ্ন থেকে সংক্ষেপে নীচে উত্তর দিবার চেষ্টা করছি :

১। প্রথমত আমরা বলেছি, বৈদিক ধর্মীয় আন্দোলন হয়েছিল সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে, ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে। অঙ্গিরা ঋষিগণের নেতৃত্বে যে বাঁধ ধ্বংসের প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তা ব্যর্থ হয়েছিল বলে ঋগ্বেদ থেকে মনে হয়। এই ঘটনাটি ঘটেছিল বৈদিক আন্দোলন শুরু হবার পঞ্চাশ বা এক শত বৎসর আগে। কোনও একটি অঞ্চলে বাঁধ ধ্বংসে সফল হলেও এটি তখনও সফল কোনো ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলন হিসাবে দাঁড়াতে পারে নাই। তবু এটাই ছিল পরবর্তী সফল বৈদিক আন্দোলনের বাতিঘর, যা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংসের লক্ষ্যে পরিচালিত বৈদিক আন্দোলনকে পথনির্দেশ ও অনুপ্রেরণা দান করেছিল। ঋগ্বেদে এই ঘটনার উল্লেখ থাকলেও অঙ্গিরা ঋষিদের কোনো মন্ত্রের উল্লেখ নাই। তারা, সাময়িকভাবে হলেও, ব্যর্থ বা দমিত হওয়ায় তাদের দ্বারা রচিত মন্ত্র রক্ষা করবার মত কোনও সামাজিক শক্তি তখনও গড়ে উঠে নাই। পরবর্তী বৈদিক ঋষিগণ যাঁরা পরবর্তীকালে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর্যায়ে (অর্থাৎ ১৯০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে) বৈদিক সংস্কার আন্দোলন গড়ে তুলেন তারা বরুণের পরিবর্তে অপর একটি প্রাচীন দেবতা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনেন। পরবর্তী এই ধর্ম সংস্কার আন্দোলন সফল হওয়ায় তার (এই আন্দোলনের) মন্ত্রসমূহের সংকলন হিসাবে আমরা ঋগ্বেদ পাচ্ছি। অঙ্গিরা ঋষিদের বিষয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’-র ১৩১ থেকে ১৩৪ পৃষ্ঠায় এর বিবরণ আছে।

বরুণ ছিল রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা প্রাপ্ত ধর্মের দেবতা, যে ধর্মের পৃষ্টপোষকতা দেওয়া হয়েছিল সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পান পর্যায়ের মাঝামাঝি সময়ে। সিন্ধু সভ্যতার সূচনালগ্নে যখন এর নির্মাতারা বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা ব্যাপী ক্রমান্বয়ে সকল নদীতে বাঁধ দিতে শুরু করেছিলেন সেই সময়ে রাষ্ট্রে বরুণ দেবতার জায়গা ছিল না। তবে বরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি, অশ্বিদ্বয়, আদিত্য, প্রভৃতি দেবতারা আগে থেকেই ছিল সমাজের বিভিন্ন গোত্র বা গোষ্ঠীর দেবতা হিসাবে। তাদের অবস্থান ছিল গৌণ ও অবদমিত এবং একটি পার্শ্বস্রোত হিসাবে। রাষ্ট্র ও সমাজে প্রাধান্যশীল ছিল লোকায়ত মতাদর্শ। বাঁধ দিয়ে নদীকে দীর্ঘকাল বেঁধে রাখার ফলে সিন্ধু সভ্যতার সূচনার দুই/তিন শত বৎসর পরে উজানে পলি জমে কৃষি ব্যবস্থায় কিছু করে সংকট তৈরী করেছিল। সেই সময় বাঁধ ও স্লুইস গেট মেরামত করে বাঁধভিত্তিক সেচ ব্যবস্থাকে চালু রাখা গিয়েছিল সম্ভবত আরো চার বা পাঁচ শত বৎসর। তবে সব অঞ্চলে এক সময়ে সংকট দেখা দেয় নাই বলে মনে হয়। বাঁধের কারণে নদীর উজানে পলি জমার ফলে কৃষি ব্যবস্থায় বিপর্যয় ঘটলে সমাজে ব্যাপক ক্ষোভ তৈরী হয়। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্রেও তার প্রভাব পড়ে। সভ্যতার সূচনা লগ্ন থেকে লোকায়ত মতাদর্শ ধারণকারী রাষ্ট্র এই সংকটে বরুণের ধর্মকে পৃষ্টপোষকতা দিতে বাধ্য হয়। সেই সাথে গড়ে উঠে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতাপ্রাপ্ত পুরোহিত শ্রেণী বা ঋষিগণ। তবে একথা বলা যায় যে, রাষ্ট্র বরুণের ধর্মকে প্রাধান্যে আনলেও সেই সমস্ত পুরোহিত বা ঋষিরা রাষ্ট্র শাসনের অংশ কখনোই ছিলেন না। ঋগ্বেদ থেকে রাষ্ট্র শাসন বিষয়ে তেমন কোনো ইঙ্গিত না থাকায় এই বিষয়টি ধারণা করা যায়। সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতা প্রাপ্ত পুরোহিত শ্রেণী থেকে বেরিয়ে বিদ্রোহী বৈদিক ঋষিরা ইন্দ্রকে প্রাধান্যে এনে একটি ধর্ম সংস্কার আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন।

সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যাদের অংশ ছিল, যেমন কারখানার মালিক ও পরিচালক, দার্শনিক ও শিক্ষক – তারা ছিল লোকায়ত মতাদর্শের ধারক ও পৃষ্টপোষক। সেই সাথে লোকায়ত মতাদর্শের অনুসারী ছিল সমাজের বিপুল সংখ্যক মানুষ যারা নগর, শহর ও গ্রামের জনগোষ্ঠী ছিল। তবে এটাই যুক্তিসংগত বলে মনে হয় যে, তাদের বড় অংশ পাশাপাশি বিভিন্ন গোত্রীয় ও আঞ্চলিক দেবতারও পূজারী ছিল। সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র কর্তৃক অনুমোদনপ্রাপ্ত সীলে বা বিভিন্ন ফলকে বণিক বা কারিগরদের দ্বারা উৎকীর্ণ বিভিন্ন ছবির উপস্থিতি এটাই প্রমাণ করে।

জৈন ও বৌদ্ধ যুগে ভারতবর্ষে যে বিভিন্ন বস্তুবাদী মতাদর্শের প্রবল প্রভাব দেখতে পাই তা ছিল গাঙ্গেয় সমভূমিতে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। তারা অভিবাসনের পূর্বে যেমন বরুণের ধর্মের অনুসারী ছিল না, তেমন বৈদিক আন্দোলনেরও অনুসারী ছিল না। ছিল লোকায়ত বা বস্তুবাদী ভাবাদর্শের অনুসারী।

আবার বলছি, সিন্ধুর সমাজে ও রাষ্ট্রে লোকায়ত মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে, যখন সিন্ধুর এক শক্তিশালী নেতৃত্ব বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকাব্যাপী ছড়িয়ে থাকা বিভিন্ন গোষ্ঠীকে একই রাষ্ট্রের অধীনে এনেছিল কৃষিতে বাঁধভিত্তিক সেচব্যবস্থা প্রবর্তন করার উদ্দেশ্যে।

২। বৈদিক আন্দোলন সফল হবার পর অর্থাৎ বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার নদীগুলির উপর নির্মিত বাঁধগুলি ধ্বংসের পর ও একই সাথে সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর বৈদিক ঋষিরা ও তাদের অনুসারীদের একটি বড় অংশ পূর্ব দিকে গাঙ্গেয় উপত্যকায় ধীরে ধীরে বসতি স্থাপন করে ও ছোট ছোট গ্রাম সমাজ গঠন করে, সিন্ধু সভ্যতারই অন্য অভিবাসীদের সাথে। তখনো বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায় নাই। বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্য এমন প্রমাণ দেয়। তখনো রাষ্ট্র শাসনে পরিষদের গুরুত্ব ছিল। পরবর্তীকালে যুদ্ধের প্রাধান্য এলে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিবার প্রয়োজনে পরিষদের কার্যকারিতা ক্রমশ দুর্বল হয়ে যায় ও এক সময় বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পায়। সিন্ধু সভ্যতার ব্রোঞ্জের অস্ত্র ও পায়ে হাঁটা, নৌকা ও পশুটানা গাড়ীর ‍যুগে বিদেশী হানাদারদের যেভাবে মোকাবিলা করা গেছে পরবর্তীকালে লৌহাস্ত্র ও ঘোড়ার যুগে বিদেশী হানাদার বা্ প্রতিবেশী শত্রুকে মোকাবিলার পদ্ধতি ভিন্ন হবে। তখন চাইলেও আর সিন্ধু সভ্যতার গণতন্ত্র ও পরিষদে সিদ্ধান্ত নিয়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে মোকাবিলা করা সম্ভব ছিল না। কাজেই শুরুতে অনেক জনপদে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা থাকলেও এগুলিকে আর টিকিয়ে রাখা যায় নাই।

আরেকটি বিষয় আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ঋগ্বেদে যাদেরকে রাজা বলা হয়েছে, তারা সবাই আঞ্চলিক শাসক, যাদের কর্তৃত্বে আঞ্চলিক নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা থাকত। তাদের শাসনকেন্দ্র সম্ভবত বাঁধের কাছাকাছি কোনো নগরে বা শহরে হত। ঋগ্বেদে যে রাজাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলা হয়েছে তারা বৃত্র বা বাঁধ ও এর স্লুইস গেটের নিয়ন্ত্রক। কাজেই ঋগ্বেদে যে রাজাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের কথা বলা হয়েছে তারা বাঁধ ব্যবস্থা রক্ষার পক্ষে ছিল। বৌদ্ধ ও জৈন সাহিত্যে যাদেরকে রাজা বলা হয়েছে, তারা প্রায় সবাই গোত্র প্রধান ও আঞ্চলিক শাসক। কম ক্ষেত্রেই তারা বংশানুক্রমিক রাজা।

মহাভারতের রচনাকাল সম্পর্কে আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’-র দশম অধ্যায়ে (২১৫ থেকে ২৩০ পৃষ্ঠা পর্যন্ত) আলোচনা করেছি। সেখানে আমরা বলেছি যে, আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণের সময়ে, অর্থাৎ ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের দিকে, বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকাব্যাপী বসবাসকারী বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর ঐক্য সাধনের জন্য একটি যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সংঘটিত এই যুদ্ধে আঞ্চলিকতার পক্ষে যারা ছিল তারা ‍ঐক্যের পক্ষের পাঁচটি অঞ্চলের কনফেডারেসির সংগে যুদ্ধে পরাজিত হয়। এই যুদ্ধে বাস্তবে খুব বড় ধ্বংসকাণ্ড না ঘটলেও জনমনে এই যুদ্ধের প্রবল প্রভাব পড়েছিল। এই যুদ্ধের ফল ছিল সুদূর প্রসারী। প্রত্নতাত্ত্বিকরা আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণের সময়ে একটি বা দু’টি বসতিতে অগ্নিকাণ্ডের ফলে ধ্বংসের প্রমাণ পেয়েছেন। এছাড়া কয়েকটি বসতি এই সময়ে পরিত্যক্ত হবার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

আমরা আশা করি উপরের আলোচনা থেকে আপনি হয়ত আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর পেয়েছেন।

বিদায় নিবার পূর্বে বলি ভারতবর্ষের ইতিহাসের প্রতি আপনার গভীর আগ্রহ আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। আপনাকে অনেক ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা।

শামসুজ্জোহা মানিক

শামসুল আলম চঞ্চল

   

Feb 2, 2023, 11:48 AM

প্রিয় মানিক ও চঞ্চলবাবু,

পত্রের উত্তর দিতে দেরি হওয়ায় আমি দুঃখিত। আপনাদের সাথে দক্ষিণ এশিয়ার ইতিহাস বিষয়ে আলোচনা চালাতে পারলে আমারও ভালোই লাগবে।

আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দেখে আমি সন্তুষ্ট। দ্বিতীয় প্রশ্নের উত্তর প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বললাম নীচে:

● লোকায়ত আদর্শ প্রসঙ্গে জৈন আর বৌদ্ধধর্মের কথা এসেছে আলোচনায়। আমি নিজে হিসেব করে দেখেছি জৈন আর বৌদ্ধধর্মের উদ্ভবকালকে সিন্ধু সভ্যতার অবক্ষয়ের যুগ অবধি বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব। জৈন মতে, ২৪ তীর্থঙ্করের কথা বলা আছে। বৌদ্ধ মতে, ২৪ বুদ্ধের কথা বলা আছে; যদিও জৈন মতধারা থেকে বৌদ্ধরা ২৪ জন পূর্বসূরীর কাহিনি গ্রহণ করে থাকতেই পারে। মহাবীরের আগে পার্শ্বনাথ প্রায় ২৫০ বছর আগে আবির্ভূত হয়েছিলেন বলে মনে আছে আমার। তাহলে প্রতি তীর্থঙ্করের সময়সীমা যদি অন্তত ৫০ বছর করেও পিছিয়ে দিই, তাহলে প্রথম তীর্থঙ্কর ঋষভনাথের সময় হচ্ছে আনুমানিক ১৯০০ খ্রিঃপূঃ তথা সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের যুগ। হিসেবটা বড্ড আঁটোসাঁটো হল। আরেকটু উদারভাবে তীর্থঙ্করদের সময় পিছিয়ে দেওয়া সম্ভব হলে ২৬০০ খ্রিঃপূঃ অবধিও জৈনধর্মের প্রথম তীর্থঙ্করের সময়কে বাড়িয়ে দেওয়া সম্ভব। এখন আপনাদের মতামতকে অনুসরণ করলে বলতে পারি কি-- লোকায়ত মতাদর্শের অনুগামীরা প্রাচীন জৈন ছিল? প্রাচীন সিন্ধু যুগের লোকায়ত আদর্শই কি পরবর্তীতে জৈন আর বৌদ্ধমতের রূপ নিয়েছিল সরাসরি? আর নতুন বিদ্রোহী এই ধর্মমতগুলি যথেষ্ট পরিমাণে ইহলোকের কথা বলত তথা বৈদিক ঐতিহ্যের বিরোধীও ছিল।

● সমাজ যদি আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের মাধ্যমে পরিচালিত হয়, তাহলে সমাজকে পরিচালনা করার প্রয়োজন পড়ে না। সমাজকেই যখন পরিচালনা করার প্রয়োজন পড়ে, তখন সমাজের ঊর্ধ্বস্থিত একটা সরকারি যন্ত্রের প্রয়োজন পড়ে। এরকম আঞ্চলিক শাসনতন্ত্র না-ভাঙলে রাষ্ট্র তৈরি করা সম্ভব? স্বতন্ত্র কৃষি অঞ্চলগুলিকে একটি অখণ্ড প্রশাসনিক এলাকায় বাঁধতে চাওয়াটা কাদের স্বার্থ ছিল? পৃথক অঞ্চলগুলির, না রাষ্ট্রের প্রবর্তকদের? একীকরণের এই উদ্দেশ্যের কারণ কী ছিল?

● ২৬০০ খ্রিঃপূঃ-এ যুদ্ধের মধ্য দিয়ে আপনারা যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, সেটা কি রাজশাসিত ছিল, না পরবর্তীকালে জৈন-বৌদ্ধধর্মের মতো 'সংসদ'শাসিত ছিল (ঋগ্বেদে 'সংসদ' শব্দটির ব্যবহার আছে)? তাছাড়া ১০০০ খ্রিঃপূঃ-র আশপাশেও বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়নি সেভাবে। বংশভিত্তিক রাজতন্ত্র এল কীভাবে তাহলে? সমাজ নিজেই বংশভিত্তিক পেশায় বাঁধা না-পড়লে প্রশাসনিক উত্তরাধিকারও কি বংশানুক্রমিক হওয়া সম্ভব? সামাজিক পেশার বংশানুক্রমিক হয়ে ওঠার পেছনে কি সিন্ধুরাষ্ট্রের কোনো ভূমিকা ছিল? ফলে প্রশ্ন করাই যায়: যুদ্ধের ফল কি রাজতন্ত্র, না রাজতন্ত্রের ফল হল যুদ্ধ?

● মহাভারত সম্পর্কে 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা'র দশম অধ্যায়টি আমি পড়েছি। বিষয়ের নতুনত্ব চোখে পড়ার মতো। সিন্ধু উপত্যকায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে কিছু প্রশ্ন করব মহাভারত সম্পর্কিত আপনাদের ধারণাকে:

১) মহাভারতে যারা বিজয়ী হয়েছিল, তাদের বৈদিক ভাবাদর্শের লোক বলে মনে হয়। অথচ আপনারা বলেছেন যে, ২৬০০ খ্রিঃপূঃ-র দিকে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে লোকায়ত আদর্শ তথা কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং এই কাহিনিই মহাভারতের উৎস। প্রশ্ন তাহলে: মহাভারতের যুদ্ধের বিজয়ীরা লোকায়ত আদর্শের অনুসারী ছিল, না বৈদিক পক্ষ ছিল?

২) মহাভারতের বিজয়ী পক্ষ নিশ্চয়ই বাঁধভিত্তিক সেচব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য লড়াই করেছিল। যদি তা-ই হয়, তাহলে মহাভারতের কেন্দ্রীয় কাহিনিতে সেভাবে কৃষিকাজের বর্ণনা বা কৃষিমুখীনতা পাই না কেন? রামায়ণের নায়িকা স্বয়ং কৃষিক্ষেত্র থেকে উদ্ভূত-- মাটিতে লাঙ্গলের ফলার দাগকে বৈদিক পরিভাষায় সীতা বলে। কিন্তু মহাভারতের নায়িকা বৈদিক যজ্ঞ থেকে উদ্ভূত। অন্য ক্ষেত্রেও কৃষিভিত্তিক সমাজের জায়গায় মূলত আরণ্যক আদিবাসী জগৎকে দেখি মহাভারতে। কৃষিভিত্তিক বসতির সাথে এই চিত্র বিজাতীয় ধরনের নয় কি?

৩) প্রসঙ্গত, যুধিষ্ঠির সম্পর্কে আরেকটি কথা বলব। 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা'য় আপনারা বলেছেন যে, ঋগ্বেদে ধর্ম নামক দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায় না সেভাবে। আমি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের একদম শেষের দিকে সূর্যপুত্র হিসেবে ধর্মের উল্লেখ পেয়েছি। আর ধর্মের পুত্র হল যুধিষ্ঠির। অন্য পাণ্ডবরা সরাসরি বৈদিক দেবতার সন্তান হলেও যুধিষ্ঠির অনেকটা ঘুরপথে বৈদিক দেবতার উত্তরাধিকার বহন করছে। মহাভারতের আদি কাহিনি কি আগে সূর্য-উপাসকদের কাহিনি ছিল? পরবর্তীকালে কি তাতে বৈদিক পালিশ মারা হয়েছে? প্রসঙ্গত, 'সরস্বতী' শব্দের ব্যুৎপত্তি দেখলে 'সরস্ + বতী' পাই আমরা। 'সরস্' একটি লুপ্ত বৈদিক শব্দ; এর অর্থ 'জল'। সূর্যদেবতাকেও 'সরস্বান' (দশম মণ্ডল) বলা হয়েছে, অর্থাৎ 'সরস্ + বান'। সরস্বতী নদীকে স্ত্রীলিঙ্গ আর সূর্যদেবতাকে পুংলিঙ্গবাচক হিসেবে দেখানো হয়েছে। ঋক্-সংহিতায় 'সরস্বৎ' শব্দের ব্যবহারেও এই শব্দের অর্থ পাওয়া যায় 'জলাধিপতি'। কৃষিক্ষেত্রে সূর্যালোকের ভূমিকা ততটাই, পলিজমিতে নদীর জলের যতটা ভূমিকা রয়েছে। বাঁধভিত্তিক সেচব্যবস্থায় কোনোভাবে কি সরস্বতী নদীর ওপর নির্মিত বাঁধের ব্যবস্থাপকরা সূর্য-উপাসকও ছিল? যদিও বরুণের (জলাধিপতি?) ভূমিকাকে অস্বীকার করছি না আমি, মিসিং লিঙ্ক খোঁজার মতো সম্ভাবনার উল্লেখ করছি।

● এ ছাড়া ২৬০০ খ্রিঃপূঃ-র দিকে কয়েকটি বসতিতে অগ্নিকাণ্ডের নমুনা পাওয়া যায়। এককালে কিছু গবেষক, অতুল সুর প্রমুখ বলতে চেয়েছিলেন যে, বাণিজ্যিক স্বার্থে কোটদিজির শিল্পরীতিকে ধ্বংস করার জন্য হরপ্পান রীতির লোকেরা সেখানে অগ্নিকাণ্ড ঘটায়। তারপর থেকে কোটদিজি এলাকায় হরপ্পান রীতির শিল্পই দেখা যায় মূলত। দুটো শিল্পরীতির মধ্যে পার্থক্যের কথাও বলেছিলেন তাঁরা। পরবর্তীকালের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন আরও অন্যরকম তথ্য এনেছে বলে মনে হয়।

এরকম প্রশ্নের উত্তরে আটকে না-থেকে আনুষঙ্গিক বিষয়েও আলোচনা হতে পারে। এতে বিষয়ের আলোচনায় বিস্তৃতি আসবে। আর সব বিষয়ে সমান পড়াশোনাও নেই আমার। তাই আপনাদের থেকে কিছু বিষয়ে তথ্যের জ্ঞানও হতে পারে আমার। 'সিন্ধু থেকে গঙ্গা'র তৃতীয় খণ্ড লেখার মাঝে আমার সাথে আলোচনা চালানোটা হয়তো অসুবিধাজনক আপনাদের পক্ষে। তাই আলোচনায় কিছুটা বিরতি নেওয়া যেতেই পারে। আপনাদের অনেক শুভেচ্ছা রইল।

ইতি, অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Feb 9, 2023, 9:42 AM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

আপনি এমন কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন যে, অল্প কথায় উত্তর দিতে গেলে কিছু বিভ্রান্তি বা অস্পষ্টতার অবকাশ থাকতে পারে এই ভয় করছি। সুতরাং কয়েকটি বিষয়কে এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে হলেও কিছু বিশদভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করব। আমাদের মনে হয় তার ভিতর থেকে আপনি আপনার অনেক প্রশ্নের উত্তর পাবেন। এখন আমরা আলোচনায় যাই :

অন্যান্য সকল ধর্মের মত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মও সমাজে প্রচলিত আরো প্রাচীন চিন্তাধারাকে ধারণ করে গড়ে উঠেছিল। লোকায়ত বা বস্তুবাদী চিন্তা নিশ্চিতভাবে তার সূচনায় সকল ধর্মবিরোধী ছিল। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় যখন ক্ষয় দেখা যায় তখন সমাজেও তার প্রভাব দেখা যায়। এক সময় সিন্ধু সভ্যতার পতন হলে ও পরবর্তীকালে ধর্মের প্রভাব বেড়ে গেলেও বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে এই চিন্তা নানা রূপে নানা ভাবে সক্রিয় থাকে। জৈন ও বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে বুদ্ধের সময়ে সমাজে নানা ধরনের নিরীশ্বরবাদী গোষ্ঠীর উপস্থিতির কথা জানা যায়। শুধু ভারতীয় সমাজের মানুষ নয়, সমগ্র পৃথিবীর মানুষ সহজে নূতন কোনো ধর্মীয় মতাদর্শ গ্রহণ করতে চায় না। এই জন্য সকল ধর্ম নেতাকে বা ধর্মীয় গোষ্ঠীকে নূতন ধর্ম প্রতিষ্ঠা করার সময় নিজেকে বা নিজেদেরকে পুরাতন ধর্মের উত্তরাধিকারী হিসাবে প্রচার ও প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। এই কারণেই মহাবীরকে বা বুদ্ধকে প্রচার করতে হয়েছিল যে, তাদের পূর্বে আরো তীর্থংকর বা বুদ্ধ এসেছিলেন ও তাঁরা সেই সকল ব্যক্তির উত্তরাধিকারী। সমকালীন সমাজে ঐ সকল প্রাচীন তীর্থংকর বা বুদ্ধ সম্পর্কে পরিচয় ও শ্রদ্ধাবোধ ছিল। নূতন ধর্ম প্রচারকদের আরো প্রাচীন ধর্মের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে নূতন মতাদর্শ প্রচার করার ফলে তাঁদের জন্য সমাজে গ্রহণযোগ্যতা পাওয়া সহজতর হয়। অনুমান করা যায়, এই প্রাচীন তীর্থংকর বা বুদ্ধরা কাছাকাছি মতাদর্শ অর্থাৎ নিরীশ্বরবাদী চিন্তা ধারণ করতেন। তাতে করে তাঁরা মহাবীরের বা বুদ্ধের মতাদর্শ ধারণ করতেন বা সিন্ধু সভ্যতার শুরু থেকে জৈন বা বৌদ্ধ ধর্ম সমাজে প্রচলিত ছিল একথা বলা যায় না। শুধু তাই নয়, জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মের সংঘের ধারণা সিন্ধু সভ্যতার পরিষদ বা কাউন্সিল ভিত্তিক রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থা থেকে আসলেও সিন্ধু সভ্যতায় জৈন বা বৌদ্ধ ধর্ম ছিল না। সিন্ধু সভ্যতার সমাজে শান্তিপূর্ণ ধারা প্রবল হলেও সেখানকার অধিবাসীরা যে যথেষ্ট পরিমাণে পশুর মাংস খেত তার প্রমাণ প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে পাওয়া যায়। অথচ জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ, যদিও বৌদ্ধ ধর্মে প্রাণী হত্যা নিষিদ্ধ হলেও মৃত প্রাণীর মাংস খাওয়া যায়।

নূতন ধর্মের উত্থান সম্পর্কে বুঝার জন্য আমরা তুলনামূলক নবীন ধর্ম ইসলাম সম্পর্কে আলোচনা করতে পারি। খ্রীষ্টীয় সপ্তম শতকে আরবে একেশ্বরবাদী ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চেয়ে নিজে বহুদেবতাবাদী ধর্মের ঐতিহ্য থেকে এলেও মুহাম্মদকে তৎকালীন আরবে পরিচিত ইহুদী ও খ্রীষ্টান এই দুই একেশ্বরবাদী ধর্মের ঐতিহ্য গ্রহণ করতে হয়েছিল। অথচ ইহুদী ও খ্রীষ্টান কারো উপাস্য দেবতা আল্লাহ্ ছিল না। মুহাম্মদকে ইহুদী ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা নবী মোশি বা মুসাকে যেমন নিজ ধর্মের নবী হিসাবে প্রচার করতে হয়েছিল তেমনি খ্রীষ্টান ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা যীশুকেও নিজ ধর্মের একজন নবী হিসাবে প্রচার করতে হয়েছিল। শুধু তাই নয় তিনি ইহুদী ধর্মের প্রাচীন সকল নবীকেও তার নিজ ধর্মের নবী হিসাবে দাবী করেছিলেন। সকল ধর্মের প্রতিষ্ঠা এভাবে আরো প্রাচীন ঐতিহ্য থেকে গড়ে উঠে। জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মও এর ব্যতিক্রম নয়। একইভাবে বৈদিক ধর্মের সকল দেবতাই জনসমাজে পরিচিত আরো প্রাচীন কোনো দেবতা থেকে রূপান্তরিত হয়েছে নূতন পরিস্থিতিতে নূতন পরিচয় নিয়ে।

আরো একটা বিষয় হল যে, দেবতাদেরও চরিত্রের, ভূমিকার ও গুণগত বৈশিষ্ট্যের পরিবর্তন হতে পারে নূতন পরিস্থিতিতে সমাজে তার ভূমিকার প্রয়োজনে। আরবের একটি আঞ্চলিক দেবতা আল্লাহ্ প্রধানত কুরাইশ গোত্রের প্রধান দেবতা হলেও আরবের অন্যান্য গোত্র তাদের নিজস্ব দেবতার সাথে তারও (অর্থাৎ আ্ল্লাহরও) পুজা করত। এই আঞ্চলিক দেবতা আল্লাহ কীভাবে একটি একেশ্বরবাদী ধর্মের দেবতায় রূপান্তরিত হতে পারে তা ইসলামের বিকাশ প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণ করলে বুঝতে পারা যায়। শুধু তাই নয় তা একটি যুদ্ধ প্রবণ ধর্মের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী ভীতি সৃষ্টিকারী এক হিংস্র দেবতায়ও রূপান্তরিত হয়েছিল, কুরআন বা হাদীস যার সাক্ষ্য দেয়।

যুদ্ধের মধ্য দিয়ে প্রজাতন্ত্র বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় না তা বলা যায় না। তাহলে ব্রিটিশ বিপ্লব কিংবা ফরাসী বিপ্লবের ফলাফলকে ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্রিটেনে পার্লামেন্ট এবং রাজার মধ্যে যুদ্ধে রাজা ১ম চার্লস পরাজিত এবং মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হন। তারপর বিভিন্ন পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেও ব্রিটেনকে নিশ্চয় রাজা শাসিত বলা যাবে না। রাজার ভূমিকা একটা খুব সীমাবদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত সামাজিক-নৈতিক অভিভাবকের বেশী কিছু না। সেই কারণে ব্রিটেন বা ইংল্যান্ড গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে বিবেচিত। ফ্রান্সের বিপ্লবের ইতিহাস অবশ্য বেশ খানিকটা ভিন্ন রকম। বিভিন্ন পটপরিবর্তনের মধ্য দিয়ে সেখানে গণতন্ত্র ও প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা পেয়েছে।

আমরা এ কথা বলি নাই যে, যুদ্ধ হলেই সেখানে রাজতন্ত্র হবে। তবে খুব বেশী যুদ্ধ নির্ভর সমাজ বংশগত রাজতন্ত্রে পরিণত হয়। ইসলাম ধর্মের গতিধারার দিকে দৃষ্টিপাত করলে এটা সহজে বুঝা যায়। মুহাম্মদ রাষ্ট্রহীন আরবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। এর জন্য তিনি যে শুধু যুদ্ধের আশ্রয় নেন তা-ই নয়, অধিকন্তু বাস্তবে চিরন্তন যুদ্ধ বা জিহাদের ভাবাদর্শ হিসাবে ইসলাম ধর্মকে গড়ে তুলেন। এর ফলে সূচনায় বংশগত রাজতন্ত্র না থাকলেও সেখানে চার খলীফার শাসন-পরবর্তীকালে বংশীয় রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ইসলাম-পূর্ব কুরাইশ বংশ উপজাতীয় গণতান্ত্রিক রীতিনীতি দ্বারা পরিচালিত হলেও মুহাম্মদের ভূমিকার কারণে এই কুরাইশ বংশের নেতৃত্বেই হিংস্র একনায়কী ও স্বৈরতান্ত্রিক খলীফা হিসাবে কথিত রাজা বা সম্রাটদের বংশীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। অর্থাৎ রাজতন্ত্র বা স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্র বা প্রজাতন্ত্রকে খুব বেশী পরস্পর বিরোধী ধরে নেওয়া ভুল হতে পারে। একটা সমাজে যেমন বলপ্রয়োগের উপাদান এবং শান্তি বা অহিংসার উপাদান উভয়ই থাকে তেমন স্বৈরতন্ত্র এবং গণতন্ত্রের উপাদানও সহাবস্থান করে। পরিস্থিতি অনুযায়ী একটা বিশেষ উপাদান প্রধান বা আধিপত্যকারী হয়। সুতরাং একটা সমাজ পরিস্থিতির চাপে অহিংস থেকে সহিংস কিংবা গণতন্ত্র থেকে স্বৈরতন্ত্র বা একনায়কতন্ত্রে রূপান্তরিত হতে পারে; আবার উল্টাটাও।

কয়েকজন বা কিছু সংখ্যক মানুষ একত্র হলেই সেখানে সামাজিক শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রয়োজনে একটা কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব গড়ে উঠে। এই কর্তৃত্ব বা নেতৃত্ব গঠনে হিংসা বা বলপ্রয়োগ নাকি অহিংসা ও স্বেচ্ছাসম্মতি কোনটা প্রধান ভূমিকা নিবে সেটা বহুবিধ ফ্যাক্টরের উপর নির্ভর করে। সুতরাং একটা সমাজের বিশেষ বৈশিষ্ট্য ও গতিপ্রকৃতি বুঝবার ক্ষেত্রে যথেষ্ট সতর্ক বিচার প্রয়োজনীয়।

গ্রাম ও শহর বা নগরকে আমরা পরস্পর বিরোধী বা বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে দেখবার পক্ষপাতী নই। আসলে গ্রাম থেকেই নগরের উদ্ভব ঘটে। বলা উচিত যখন অনেকগুলি গ্রামের উদ্ভব ঘটে তখন সেগুলির মধ্যে সমন্বয় সাধনের প্রয়োজনে গ্রামেরই জটিলতর, উন্নততর রূপ হিসাবে নগর বা শহর গড়ে উঠে। এক গ্রাম থেকে আর এক গ্রামের উৎপন্নের বিনিময়, বিভিন্ন গ্রামের জীবনযাত্রা ও কর্মকাণ্ডের মধ্যে সমন্বয় সাধন এবং প্রতিরক্ষা বা নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রয়োজনে একটি বৃহৎ গ্রাম তথা নগর গড়ে উঠে। এই নগর তখন আর গ্রাম থাকে না। এটা হয়ে উঠে প্রশাসনিক এবং বাণিজ্য কেন্দ্রও। এভাবে রাষ্ট্রও গড়ে উঠে। এটা শান্তিপূর্ণ উপায়ে হোক আর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে হোক এটা রাষ্ট্র, যেটা সাধারণ সমাজেরই বিবর্তিত রূপ হলেও সমাজ থেকে ভিন্নও বটে।

গ্রাম থেকে নগর হোক আর সমাজ থেকে রাষ্ট্র হোক উত্তরণের কালে একটা মূলত অহিংস বা শান্তিপূর্ণ সমাজও যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে পারে। যেখানে উত্তরণ যুগান্তকারী ফলাফল বয়ে আনে এবং এর ফলে যুগান্তকারী পদক্ষেপ দাবী করে সেখানে সমাজ যত শান্তিপূর্ণ হোক তাকে একটা যুদ্ধ বা রক্তপাতপূর্ণ সংঘাতের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। তারপর সমাজ পুনরায় তার শান্তিপূর্ণ ব্যবস্থার দিকে ফিরতে পারে। আমরা অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতার আদি হরপ্পান পর্যায় থেকে হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণ কালে তেমন একটা রক্তাক্ত যুদ্ধ ঘটেছিল, যার অভিঘাত থেকে পরবর্তী কালে মহাকায় মহাকাব্য ‘মহাভারত’-এর বীজ কাহিনী রচিত হয়েছিল। এটাই কালে কালে হাজার হাজার বছর ধরে আজকের মহাভারতের রূপ নিয়েছে। তবে মহাভারতের মধ্যে ইতিহাস খুঁজে লাভ নাই। ঐতিহাসিক ঘটনার অভিঘাত থাকা আর ইতিহাস থাকা এক জিনিস নয়। সবচেয়ে বড় কথা মহভারত বেদ বা কুরআনের মত অপরিবর্তনীয়তার বিধান দ্বারা চিহ্নিত কোনও ধর্মগ্রন্থও নয়। এটা একটা পুরাণ মাত্র, যেখানে কালে কালে অসংখ্য পরিবর্তন ও প্রক্ষেপণ ঘটেছে। সুতরাং এটা রচনার পিছনের অভিঘাতের স্বরূপ সন্ধানের বাইরে আর তেমন কিছু খুঁজবার চেষ্টা না করাই উচিত হবে।

রচনার পর ধর্মগ্রন্থগুলিতে কোনও পরিবর্তন হয় না এ কথা বলা যায় না। তা সত্ত্বেও একবার অলৌকিক বা পরম সত্তার বাণী হিসাবে স্বীকৃতি লাভের পর তাতে আর সচরাচর পরিবর্তন ঘটানো যায় না। এই কারণে ধর্মগ্রন্থগুলি সমকালীন সমাজ-বাস্তবতা বুঝবার ক্ষেত্রে অপরিমেয় মূল্য বহন করে। বস্তুত প্রতিটি ধর্ম তার উদ্ভবকালীন সমাজ ও তার বাস্তবতার এক ধরনের আয়না হিসাবে কাজ করে। তাতে তার কালের সমাজ-বাস্তবতাই কম অথবা বেশী প্রতিফলিত হয়। রামায়ণ বা মহাভারতের মত পৌরাণিক কাহিনীগুলি এই সুবিধা ভোগ করে না। বহু দেশ ও কালের পথ পেরিয়ে এগুলিকে আসতে হয় অসংখ্য পরিবর্তন এবং পরিবর্ধনেরও মধ্য দিয়ে। বহু সমাজ ও কালের ছাপ পড়ে এগুলির রচনা ও সংকলনে। এই কারণে আমরা রামায়ণ বা মহাভারতের মত পৌরাণিক কাহিনীগুলিতে ইতিহাস না খুঁজে যে ঐতিহাসিক ঘটনার অভিঘাতের ফলে এমন সব কালজয়ী মহাকাব্যের বীজ-কাহিনী রচিত হতে পারে তার স্বরূপকে অনুধাবনের চেষ্টার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছি।

ইতিহাসের সত্য আবিষ্কারে আমরা সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দিয়েছি প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য, ঋগ্বেদের মত ধর্মগ্রন্থ এবং পর্যটকদের বিবরণসহ সমকালীন বিভিন্ন দলিলপত্রের উপর। সুতরাং ইতিহাস অনুসন্ধানে রামায়ণ-মহাভারতের গুরুত্ব অনেক সীমিত। বলা যায় একটা সমাজ ও সভ্যতার মনোজগৎকে বুঝতে চাওয়া থেকে এই দুই মহাকাব্যকে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমাদের আলোচনায় এনেছিলাম। অবশ্য এই অনুসন্ধান থেকে ভারত-ইতিহাসের কিছু হারানো সূত্র বা ‘মিসিং লিংক’ও আমরা খুঁজে পেয়েছি বলে ধারণা করি। এ হচ্ছে মানুষের মনোজগৎ বা কল্পনার জগৎকে দেখে তার পিছনের বস্তুজগৎকে ধারণা করতে চাওয়া। কাজটা খুব কঠিন, প্রায় অসম্ভব। তবু সত্যকে পুরাপুরি ধরতে না পারলেও তার কাছাকাছি যাওয়া যেতে পারে।

তবে এই কাজের ক্ষেত্রে আমরা প্রত্নতত্ত্বের কাঠামোর মধ্যে নিজেদের ব্যাখ্যাকে সীমাবদ্ধ রাখবার চেষ্টা করেছি। এই কারণে আমরা মহাভারতের বীজ কাহিনী যে ঘটনার অভিঘাতে জন্ম নিয়েছে বলেছি সেটাকে সিন্ধু সভ্যতায় আদি হরপ্পান থেকে হরপ্পান পর্যায়ে উত্তরণ কালীন ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত বলেছি। এ সম্পর্কে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র দশম অধ্যায় ‘মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমরা বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছি। মহাভারতের বিবরণ থেকে আমাদের কাছে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে একটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ যু্দ্ধের মধ্য দিয়ে সমাজের বিরাট ধরনের উত্তরণ ঘটেছিল বলে সমাজ-চেতনায় তার অভিঘাতের এমন প্রভাব। এটা প্রায় আদিম পর্যায়ে থাকা উপজাতীয় সমাজ থেকে বৃহৎ অঞ্চল ব্যাপী একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘটনাকে তুলে ধরে। তবে কাল পরিক্রমায় মহাভারতের মূল কাহিনী আর অবিকৃত বা অপরিবর্তিত থাকে নাই। সুতরাং সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠায় ধর্মের ভূমিকা না থাকলেও সমগ্র মহাকাব্য ধর্মের কাঠামোভুক্ত হয়েছে। এটা হল স্থান ও কালের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে পরিবর্তনকে মেনে নেওয়া। যে কোনও জনপ্রিয় প্রথা বা কাহিনী এ কারণে কালে কালে তার আদিরূপে থাকে না। ধর্মগুলির ক্ষেত্রেও আমরা এমন ঘটনা ঘটতে দেখি। নিরীশ্বরবাদী বুদ্ধকে তার অনুসারীদের একটা অংশ পরবর্তী কালে প্রায় ‘পরম’ সত্তা বা ঈশ্বরের কাছাকাছি জায়গায় নিয়ে গেছে।

পুরাতন বিশ্বাস বা ধর্মের পরিবর্তন অনেক সময় নূতন ধর্মের জন্ম দেয়। এ আলোচনার শুরুর দিকে বলেছি যে, প্রাক-মুহাম্মদ আরবে ‘আল্লাহ্’ ছিল এক দেবতা। আল্লাহ্ মক্কার কুরাইশ এবং আশপাশের উপজাতিসমূহের প্রধান দেবতা, যার মূর্তির পূজাও ছিল। আরবদের বিশ্বাস অনুযায়ী আল্লাহর লাত, মানাত এবং উজ্জা নামে তিন কন্যা ছিল। মুহাম্মদ আল্লাহকে নিরাকার এবং একক সর্বশক্তিমান দেবতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করলেন। এভাবে আল্লাহ সম্পর্কিত পুরাতন বিশ্বাসকে অবলম্বন এবং ব্যবহার ক’রে তিনি একটা নূতন ধর্ম জন্ম দিলেন। আসলে শূন্য থেকে কিছু আসে না। প্রতিটি সৃষ্টির পিছনের বাস্তবতাকে বুঝার উপরে এই কারণে গুরুত্ব দিতে হয়।

আমাদের আলোচনায় আমরা সমাজের রাষ্ট্রে উত্তরণকালীন সংঘাতের ফলে সৃষ্টি হিসাবে ‘মহাভারত’কে দেখেছি। এর পিছনের বাস্তবতাকে বুঝতে গিয়ে আমরা প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার থেকে ২৬০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দের কাছাকাছি একটা সময়কে ধরেছি যখন আদি হরপ্পান পর্যায়ের আঞ্চলিকতার যুগ থেকে সমাজের হরপ্পান পর্যায়ের কেন্দ্রীকরণের যুগে বৃহত্তর সিন্ধু অঞ্চলের প্রবেশ ঘটতে যাচ্ছে।

এটাও কিন্তু অপরিবর্তনীয় কোনও সময়-সীমা নয়। সিন্ধু সভ্যতার বহুকিছু এখনও অনাবিষ্কৃত রয়েছে। গুজরাট উপকূলের নিকটবর্তী ক্যাম্বে উপসাগরের গর্ভে নিমজ্জিত যে বিরাট নগরের সন্ধান পাওয়া গেছে তার উপরে এখন পর্যন্ত তেমন কোনও কাজ হয় নাই। কেন হয় নাই, সেটা ভারত সরকার কিংবা ভারতের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ বলতে পারবে। এই নগরের উপর ভালভাবে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান হলে এবং তার প্রতিবেদন প্রকাশিত হলে শুধু সিন্ধু সভ্যতা নয়, উপরন্তু মানবেতিহাসও বহুল পরিমাণে বদলে যেতে পারে। তখন কিন্তু আমাদেরকে মহাভারত সৃষ্টির অভিঘাতকে ঐ নগর এবং তার সভ্যতা ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্থান ও কালের সঙ্গে সম্পর্কিত করতে হতে পারে। সেক্ষেত্রে ভারতবর্ষে সভ্যতা প্রতিষ্ঠার ইতিহাস অনেক হাজার বছর পিছিয়ে যাবে। হয়ত সেটা হবে আজ থেকে এগারো থেকে বারো হাজার বছর আগের সময়। যদি তা হয় তবে সেটা হবে মানব সভ্যতার সূতিকাগার বা উৎস-ভূমি হিসাবে ভারতবর্ষের প্রতিষ্ঠা।

ক্যাম্বে উপসাগরের নিমজ্জিত নগর প্রসঙ্গে কিছু আলোচনা আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় করেছি। ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’র ১ম খণ্ডের ভূমিকাতেও এ সম্পর্কে উল্লেখ করেছি। যাইহোক, নিমজ্জিত নগর সম্পর্কে পুরাতাত্ত্বিক তথ্য আমাদের কাছে না থাকায় আমরা এতদসংক্রান্ত কোনও সিদ্ধান্তে যেতে পারছি না।

আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’সহ আমাদের বিভিন্ন গ্রন্থ বা রচনায় বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী অববাহিকায় নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে একীকরণ বা কেন্দ্রীকরণ তথা বৃহত্তর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়ে আলোচনা করেছি। একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া সিন্ধু সভ্যতার অন্তর্ভুক্ত বৃহৎ অঞ্চলে নদনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। যৌক্তিকভাবে আঞ্চলিকতার শক্তির সঙ্গে বৃহত্তর রাষ্ট্র গঠনের শক্তির একটা যুদ্ধ ঘটেছিল। আমাদের ধারণা ‘মহাভারত’ সেই যুদ্ধের স্মৃতিকে তার গর্ভে ধারণ করে কালপরিক্রমায় আজকের রূপ নিয়েছে। মনে হয় ‘মহাভারত’ সংক্রান্ত আলোচনা আজকের মত এখানেই শেষ করা যায়।

আমাদের ধারণা নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার পটভূমিতে স্থাপন করতে না পারলে আমরা যেমন সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য, শক্তি এবং সমস্যা বুঝব না তেমন সেখানে অলৌকিক বিশ্বাস তথা ধর্ম-বিরোধী লোকায়ত দর্শনের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার তাৎপর্যও বুঝব না। প্রাচীন মানুষের আত্মা সম্পর্কে, জীবন ও জগতের নিয়ম ও গতিধারা সম্পর্কে অজ্ঞতা প্রসূত ধারণা না বুঝলে আমরা ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে ধারণা করতে পারব না। সেই প্রাচীন বা আদিম মানুষের কাছে প্রমত্ত নদীর আত্মা স্বরূপ দেবতার ধারণার গুরুত্ব কতটা হতে পারে সেটা সহজেই ধারণা করা যায়। যে মানুষ বৃহৎ বটগাছে অধিষ্ঠিত ব্রহ্মদৈত্য নামক অলৌকিক সচেতন শক্তির ভয়ে সন্ত্রস্ত থাকে তাকে দিয়ে কীভাবে নদীর উপর আড়াআড়ি বাঁধ দিয়ে নদীর দেবতা তথা নদীর আত্মার বিরুদ্ধাচরণের সাহস আশা করা যায়? এটা কিন্তু নদীর দুই পাড়ে বাঁধ দেওয়া নয়, যাতে নদীর স্রোতধারার বিরুদ্ধাচরণ করা হয় না, এটা বরং নদীকে বন্দী করতে চাওয়ার শামিল। অর্থাৎ আত্মা, পরমাত্মা, অলৌকিক সত্তা ইত্যাদিতে বিশ্বাসপ্রবণ প্রাচীন মানুষের নিকট থেকে বৃহদায়তনে এমন কর্মকাণ্ড কল্পনাই করা যায় না। এই জন্য এমন কর্মকাণ্ডে একটা জনগোষ্ঠীকে নেওয়ার পূর্বশর্ত হচ্ছে জীবন, জগৎ ও প্রকৃতি সম্পর্কে তাদেরকে বস্তুবাদী ও যুক্তিনির্ভর চেতনার অধিকারী করে তুলা। যারা নিজেরা এই চেতনার অধিকারী হবে না তারা কী করে অন্যদেরকে এমন চেতনার অধিকারী করবে? সুতরাং আমরা মনে করি সিন্ধুর নগর সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতারা যেমন ছিলেন লোকায়ত দর্শনে বিশ্বাসী তেমন তাদের অনুসারী জনগোষ্ঠীও ছিল তা কিংবা তাদেরকে তেমনভাবে গড়ে তোলা হয়েছিল।

কিন্তু তার মানে এই নয় যে, সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত অধিবাসী লোকায়ত দর্শনে বিশ্বাসী ছিল। যত প্রাচীন বা আদিম ধরনের হোক বিভিন্ন ধরনের ধর্মবিশ্বাসী মানুষও সেখানে ছিল। রাষ্ট্র ও সমাজের মূলধারা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত লোকায়ত বিশ্বাসের বিপরীতে বা সমান্তরালে এ ধরনের বিশ্বাসও সমাজে অপ্রধান ধারা হিসাবে টিকে ছিল। রাষ্ট্র যতই লোকবাদী বা লোকায়ত হোক এ ধরনের বিশ্বাস এবং এইসব বিশ্বাসের সঙ্গে যুক্ত আচার-অনুষ্ঠানের প্রতি নির্লিপ্ত থাকতে পারে নাই। বিশেষত সিন্ধু সভ্যতা যেখানে মূলত অহিংস ও নম্র ধারার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল সেখানে এই ধরনের বিশ্বাসগুলিকে রাষ্ট্র তার নিয়ন্ত্রণে রাখবার জন্য বিভিন্ন কলা-কৌশল অবলম্বন করেছিল বলে আমরা ধারণা করি। কিছু ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তর রাষ্ট্র চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ হিসাবে একটা বিশেষ ধর্মমতকে সরাসরি না হলেও পরোক্ষ পৃষ্ঠপোষকতা কিংবা অনুমোদন দেওয়াও হতে পারে। সম্ভবত বরুণ কেন্দ্রিক ধর্মমত ছিল তেমন একটা।

বরুণ ছিল জল এবং ফলত নদীসমূহেরও সর্বোচ্চ দেবতা। অবশ্য তাকেই সর্বোচ্চ বা শ্রেষ্ঠ দেবতা হিসাবে মান্য করা হত বলে ‍ঋগ্বেদ থেকে বুঝা যায়। মহেঞ্জোদাড়োর ‘গ্রেট বাথ’-কে বরুণ পূজার সঙ্গে সংযুক্ত মনে হয়। আমরা অনুমান করি নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় সংকট দেখা দিলে ধর্মনির্ভর জনমতকে পক্ষে নেওয়ার জন্য পরবর্তী কালে (২৩০০ খ্রীষ্টপূর্বাব্দ) এটির নির্মাণ হয়। এভাবে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সংকট রাষ্ট্রকে ক্রমবর্ধমানভাবে ধর্মের সঙ্গে আপোসকে মেনে নিতে বাধ্য করে।

আরও পরবর্তী কালে যখন বৈদিকদের নদীনিয়ন্ত্রণমূলক ব্যবস্থা ধ্বংসের আন্দোলন শুরু হয় তখন তারা নদীনিয়ন্ত্রণের সঙ্গে সম্পর্কিত প্রধান দেবতা বরুণের পরিবর্তে সমাজে গৌণভাবে বিদ্যমান যুদ্ধদেব ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনে। তখন সভ্যতার ধ্বংসের সময় হয়েছে। সুতরাং ধর্মের শক্তিও ক্রমবর্ধমান। এমন পরিস্থিতিতে বরুণ-কেন্দ্রিক অহিংস বা শান্তিবাদী বিদ্যমান ধর্মকে রেখে বৈদিক শক্তিকে রাষ্ট্রশক্তির পক্ষে মোকাবিলা করা সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে নদীনিয়ন্তণ ব্যবস্থার পক্ষে থাকা ধর্মবিশ্বাসীদেরকে নিজেদের পক্ষে রেখে বৈদিক শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বরুণ-কেন্দ্রিক ধর্মেরও একটা সংস্কারের প্রয়োজন হয়েছিল। এই সংস্কারের ফল হচ্ছে আবেস্তান ধর্মের উত্থান। প্রতিটি নূতন ও সফল ধর্ম পুরাতন ধর্মের সংস্কারের মধ্য দিয়ে আসে। এভাবে বরুণের প্রাধান্যযুক্ত ধর্মের সংস্কারের মধ্য দিয়ে পতনোন্মুখ সিন্ধু সভ্যতায় পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী দুইটি নূতন ধর্মের উত্থান ঘটে — একটি বৈদিক, অপরটি আবেস্তান।

ধর্মের উত্থান বা বিকাশ সম্পর্কিত আলোচনা আমাদেরকে অনেকটা ভিন্ন দিকে নিতে পারে। সেটাও একটা চমৎকার ও তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনার বিষয় হতে পারে। তবে এই মুহূর্তে আমরা আমাদের আলোচনাকে বেশী ছড়িয়ে না দিই। ধর্ম প্রসঙ্গে এখানে শুধু এইটুকু বলি যে, ধর্ম মিথ্যা বা অবাস্তব বিশ্বাসের উপর প্রতিষ্ঠিত হলেও তার পিছনে থাকে মানুষের সমাজ ও সভ্যতার বাস্তবতা। সভ্যতার শক্তি যখন ফুরিয়ে আসে তখন মানুষকে সভ্যতার সঙ্কটকালে একটা পর্যায় পর্যন্ত পথচলার প্রেরণা দিতে এগিয়ে আসে ধর্ম। তাই ধর্মকে আমরা সভ্যতার এক ধরনের ভাবগত রূপ বলতে পারি। সভ্যতার অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও সেগুলিরও অনেক কিছু ভাব বা কল্পনার জগতে রয়ে যায় ধর্মের মাধ্যমে।

ধর্ম সম্পর্কে আলোচনা করতে গেলে আমাদেরকে বারবার ফিরতে হবে সিন্ধু সভ্যতায়। আমাদের ধারণা আধুনিক সকল একেশ্বরবাদী ধারণার উৎস সিন্ধু সভ্যতা। যখন সিন্ধু সভ্যতার পতন হচ্ছে তখন পৃথিবীর চতুর্দিকে লক্ষ লক্ষ বা মিলিয়ন মিলিয়ন মানুষ ছড়িয়ে গেছে। এদেরই কিছু অংশ মিসর, প্যালেস্টাইন এবং আরব অঞ্চলে একেশ্বরবাদী ধর্মগুলির বীজ নিয়ে গিয়েছিল বলে আমরা মনে করি। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমরা এ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। আপনার আমাদের এ সংক্রান্ত আলোচনা পড়বার কথা।

আসলে ভারতবর্ষের ইতিহাসের বহু গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় আজ অবধি অনাবিষ্কৃত রয়েছে। যেমন তামিলনাড়ুর সমুদ্রগর্ভে পাথরের কাঠামোর অস্তিত্ব সম্পর্কে জানলেও তার সম্পর্কে আর বিশেষ কিছু আমরা জানি না। বিশেষত ক্যাম্বে উপসাগরের নিমজ্জিত নগর আবিষ্কৃত হলেও সেখানে তেমন কোনও অনুসন্ধানই হয় নাই। যদি অনুসন্ধানের মাধ্যমে বাস্তবেই তেমন একটা উন্নত নগর সভ্যতার চিত্র আমাদের সামনে উঠে আসে তবে তখন এক মহাসভ্যতার বহু রহস্যই যে উন্মোচিত হবে শুধু তা-ই নয়, অধিকন্তু ভারতবর্ষে ধর্মের উদ্ভব ও বিকাশ সংক্রান্ত অনুসন্ধানও নূতন মাত্রা লাভ করতে পারে। তবু সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব এখন পর্যন্ত আমাদেরকে যা দিচ্ছে তার মূল্যও কম নয়। বিশেষত পৃথিবীর আধুনিক বৃহৎ ধর্মগুলির উদ্ভব ও বিকাশের পটভূমি বুঝার ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতা আমাদের জন্য বিরাটভাবে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে।

এখানেই আপাতত আমাদের কথা শেষ করি। আপনার মতামতের অপেক্ষায় রইলাম।

আপনার এবং আপনার পরিবারের সবার সুস্বাস্থ্য এবং কল্যাণ কামনা করছি।

 ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক

 শামসুল আলম চঞ্চল  

 

Feb 12, 2023, 5:57 AM

প্রিয় মানিক ও চঞ্চলবাবু,

সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও প্রশাসনের গঠন পুরোপুরি জানা যায়নি আজও। বিপুল ক্ষেত্রের মধ্যেও যেটুকু প্রত্নতাত্ত্বিক খনন হয়েছে, তা থেকেও গুরুত্বপূর্ণ বহু অবশেষ পাওয়া গেছে। সেখান থেকে সেই মহাসভ্যতার মহিমা বুঝে নিতে পারি কিছুটা।

সভ্যতার ইতিহাসের আলোচনায় অনেক সমাজতাত্ত্বিকই নগর আর গ্রামের মধ্যে তুলনামূলক আলোচনা টেনে এনেছেন; এর মধ্যে কোন সমাজ বেশি উন্নত ছিল-- এই বিষয়ে প্রচুর বচসাও হয়েছে কালে কালে। আজও গ্রামকে শহরের আর শহরকে গ্রামের বিপরীত সত্তা হিসেবে দেখানোর প্রবণতা রয়ে গেছে। না, আমি সেরকম কিছু বলতে চাইনি যে, গ্রাম ও শহর পরস্পরের বিরোধী বা বিচ্ছিন্ন কোনো জনবসতি। সিন্ধু সভ্যতা সম্বন্ধে আমার আগ্রহ অনেক পরে এসেছে। তার আগে অবধিও আমার ধারণা ছিল; গ্রাম মানে প্রকৃতির কাছাকাছি একটা সমাজ, যেখানে মানুষ মূলত চাষবাস করে, প্রকৃতিনির্ভর অর্থনীতি আর মাটি বা কাঠের ঘরবাড়ি তৈরি হয় সেখানে। আর শহর বলতে যে ধারণা ছিল আমার: শহর হল মূলত কৃষি - বহির্ভূত একটা সমাজ, যেখানে মানুষ কৃষিদ্রব্যের বাইরে অন্য জিনিসপত্র উৎপাদন করে, বাড়িঘর গ্রামের তুলনায় পোড়ামাটির ইঁট দিয়ে তৈরি হয়। এই যে গ্রাম আর শহরের দুটো ছবি বললাম, এই ধারণাটা আমার মতো অনেকের মনেই রয়েছে। গ্রাম আর শহরের এই গঠন গত তিন হাজার বছরের ইতিহাসকে পর্যবেক্ষণ করলেই দেখা যাবে। আবার মধ্যযুগে একেকটা নগর একাধিক গ্রামকে রাজধানী হিসেবে পরিচালিত করত। আধুনিক সময়ে নগর বলতে শুধু রাজধানীই বুঝি না, শহরবাসী এক জনবসতিকেও বুঝি। পক্ষান্তরে, শহরবাসীর এলাকা বাড়তে থাকায় প্রাচীন গ্রাম সেই অর্থে লোপ পাচ্ছে। এই অর্থে, নগর আর গ্রামের অস্তিত্বকে পরস্পরের পরিপূরক মনে না হয়ে পরস্পরের বিপরীত বলেও মনে হতে পারে। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতার বসতির পরিমাপ, উপাদান যখন দেখতে গেছি, তখন প্রাক্-নগরায়ণ পর্যায়েও পোড়ামাটির ইঁটের তৈরি বাড়ি দেখেছি, যা আধুনিক শহরের বৈশিষ্ট্য এবং বড়ো নগরগুলির আশপাশেও যথেষ্ট কৃষিক্ষেত্র রয়েছে, যা আমাদের ধারণায় নগরের মধ্যবর্তী গ্রামীণ বিশ্বের ছবিকেই অনেকটা সামনে নিয়ে আসে। তাহলে সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণের ধারাবাহিকতায় গ্রাম আর শহরের আলাদা কোনো বিভাজন থাকার কথা নয়। সমাজের প্রত্যেকেই কাজ করত এবং সেই জন্যেই উদ্বৃত্তজীবী কোনো অংশ আঞ্চলিক সিন্ধু ঐতিহ্যে আমরা পাই না। ফলে বৈষম্য নামের যে জিনিসটা নগর-শাসিত সমকালীন (ও আধুনিক) অন্য সভ্যতায় আমরা পাই, সিন্ধু সভ্যতার আঞ্চলিক সমাজে সেই বৈষম্য বিশেষ পাওয়া যায় না। সিন্ধু সভ্যতার কৃষিক্ষেত্রের মানুষরা কৃষিকাজ এবং শহর এলাকার কারিগররা শিল্পদ্রব্য তৈরি করত।

উৎপাদকদের মধ্যে বিনিময় প্রথায় প্রয়োজনীয় জিনিস বিনিময় হওয়ার কথা। তাহলে মুদ্রা বা কারেন্সির ওপর নির্ভরশীল মধ্যস্বত্বভোগী সম্প্রদায় সিন্ধু ঐতিহ্যে আসার কথা নয় (পরবর্তী বৃহৎ নগরায়ণের পর্যায়ে সিন্ধু সিল পাওয়া যায়। সেগুলো কারেন্সি কিনা নিশ্চিত নয়)।

সমাজের প্রায় প্রত্যেক মানুষই কমবেশি বৈষয়িক উৎপাদনে যুক্ত থাকলে বাণিজ্যের লভ্যাংশের ওপর বেঁচে থাকা অনুৎপাদক সমাজ আদৌ গড়ে ওঠা সম্ভব? আবার ঋগ্বেদেও ব্যবসার কথা পাই, মূলত ছোটো আকারের ব্যবসা। ধনী পণিদের কথাও পাই আর তারা অনেকটাই ঘৃণিত ছিল অনেক বৈদিক ঋষিদের কাছে। সিন্ধু নগরায়ণের ফলশ্রুতিতে উদ্ভূত বড়ো বণিকদের বিরুদ্ধেও কি কোনো প্রতিরোধ হয়েছিল বৈদিক আন্দোলনের আড়ালে? মক্কার কুরাইশ বংশীয় বড়ো ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে ইসলামকে মদিনার ছোটো ব্যবসায়ীদের সমর্থন পেতেও দেখি ইতিহাসে। সংক্ষেপে, সিন্ধু সভ্যতার জনবসতির গঠনে আলাদা করে শহর বা গ্রাম পর্যায় দেখি না প্রথমত, উভয়ের মিলিত রূপ দেখি। ২৬০০ খ্রিঃপূঃ-এর সময় থেকে সর্বজনীন পরিমাপ, বাণিজ্যের নগর গড়ে উঠতে দেখি। নগরগুলি রাজধানীর মতো আচরণ করত (সেচব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ থেকে বহির্বাণিজ্য অবধি)। কাজেই, সিন্ধু কারিগরদের মধ্য থেকে বণিক সম্প্রদায় গড়ে উঠতে পারে না। তাহলে বৈষয়িক উৎপাদনের বাইরের কোনো জনগোষ্ঠীর শাসন কেনই-বা কৃষিজীবী-কারিগর সিন্ধুবাসী মেনে নিয়েছিল? সিন্ধুনগরী আর তার কৃষিনির্ভর পশ্চাদভূমির মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক ছিল, না শাসক- শাসিতের সম্পর্ক ছিল? অন্ততপক্ষে কৃষি আর অ-কৃষিজাত পেশার মধ্যে সামাজিক বিভাজন (গ্রাম আর শহর) বৃহৎ প্রাক্-নগরায়ণের সিন্ধু উপত্যকায় পাই না, গ্রাম-শহরের উভয় লক্ষণের সহাবস্থান ও মিশ্রণ দেখি একই জনবসতির এলাকায়।

আরও একটি প্রশ্ন তোলা যায়: সিন্ধু সভ্যতায় পেশা (কৃষিজাত ও অ-কৃষিজাত, অত্যাবশ্যকীয় ও শৌখিন দ্রব্যের উৎপাদন) কি বংশানুক্রমিক ছিল? যদি বংশানুক্রমিক পেশা প্রচলিত থাকে সিন্ধু সভ্যতার অন্তত প্রাথমিক পর্যায়েও, তাহলে উপরিতলের প্রশাসনও (বৃহৎ নগরায়ণের পর্যায়ে) বংশানুক্রমিক হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। কিন্তু আপনাদের আলোচনা অনুযায়ী, লোকায়ত প্রশাসন বংশানুক্রমিক ছিল না। তাহলে সামাজিক উৎপাদনও বংশানুক্রমিক হওয়ার কথা নয়। এ ক্ষেত্রে আরও বড়ো প্রশ্ন আসে: পরবর্তীকালে গ্রামসমাজে বংশানুক্রমিক পেশা, বর্ণব্যবস্থা চালু হতে দেখি। বংশভিত্তিক পেশার এই সামাজিক প্রথা ব্রিটিশ আগমন পর্যন্ত চালু ছিল ভারতবর্ষীয় সমাজে। তাহলে সিন্ধু সভ্যতার প্রাক্-নগরায়ণ পর্বের মতোই সিন্ধু সভ্যতার পরেও লক্ষ লক্ষ মানুষ যদি গ্রামীণ সভ্যতায় ফিরে যায়, তাহলে প্রাক্-নগরায়ণ পর্বের গ্রামীণ ক্ষেত্রে কি বংশানুক্রমিক পেশা চালু ছিল? প্রাক্-নগরায়ণের সিন্ধু সভ্যতায় পেশা হয় বংশানুক্রমিক ছিল, নয় তা ছিল না। অনুসন্ধানের বিষয় এটা। ২৬০০ খ্রিঃপূঃ-এ সমাজের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠিত নগর প্রশাসনকে যদি কৃষিজীবী-কারিগররা মেনে নিয়ে থাকে, তাহলে সমাজের ইচ্ছাকে গুরুত্ব না দিয়ে লোকায়ত প্রশাসন তৈরি হতে পারে না ৷ তেমনটাই হলে প্রশাসনের ধরন থেকে সমাজের ছবির প্রতিফলন পাওয়া যাবে। আপনাদের মতানুসারে, লোকায়ত প্রশাসন জনমতকে কমবেশি গুরুত্ব দিলে সাধারণ জনসমাজও বংশানুক্রমিক পেশায় বাঁধা ছিল না বলেই মনে হয়। বংশভিত্তিক পেশা তাহলে এল কোথা থেকে? অবদমিত ধর্মীয় ধারা, যেগুলোর কথা আপনারা বলেছেন, সেগুলোর সাথে বংশভিত্তিক পেশা চালু হওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কি? কারণ বৈদিক ঋষিরাও একেকটা বংশ হিসেবেই নিজেদের পরিচয় দিয়েছে। সিন্ধু-সরস্বতীর বাঁধ ভাঙার মূল কারিগররাই কি ভারতের সমাজে বংশভিত্তিক পেশা প্রবর্তন করেছিল? অন্তত এই বিশেষ পরিবর্তনের দিক থেকে প্রাক্-নগরায়ণের গ্রামীণ দশা আর পরিকল্পিত আকারের পরবর্তী গ্রামসমাজ-- দুটো সম্পূর্ণ পৃথক সমাজকাঠামো তুলে ধরে বলে আমার মনে হয়েছে।

নগর ও গ্রামের দ্বৈত আলোচনা প্রসঙ্গে বলব, প্রাচীন ভারতের তথা পৃথিবীর মানবসভ্যতার ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে ক্যাম্বে উপসাগরে নিমজ্জিত নগরীর ধ্বংসাবশেষ অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নিতে পারে। এ ব্যাপারে আমি আপনাদের সাথে একমত। সে-ক্ষেত্রে মহাভারতে চিত্রিত আদিম সমাজের ছবিকে সেই প্রাচীনতর সভ্যতার সাথে যুক্ত করে দেখা যেতে পারে। এরকম গবেষণা হলে আক্ষরিক অর্থেই আফ্রিকা থেকে অভিগমনের তত্ত্ব বাতিলের খাতায় চলে যেতে পারে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে প্রচুর উপাদান খোঁড়াখুঁড়ি প্রয়োজন; বৈদিক অভিঘাত সিন্ধু এলাকা থেকে মধ্যপ্রাচ্য অবধি বিস্তৃত ছিল। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের অশান্ত পরিবেশ আর বিশ্বশান্তির রক্ষকদের উন্নাসিকতার দরুন প্রত্নতাত্ত্বিক খনন স্বপ্নেই থাক আপাতত।

☆ ☆ ☆

সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে আপনাদের আলোচনা থেকে সেমেটিক একেশ্বরবাদকে সিন্ধু সভ্যতার সর্বজনীন প্রবণতার সাথে যুক্ত করা অসম্ভব কিছু নয়। আবেস্তা, ইহুদি ধর্ম, ঔপনিষদিক একেশ্বরবাদ-- সিন্ধু-উত্তর সমস্ত প্রাচীন ধর্মের মধ্যেই ব্রহ্ম শব্দ আর তার সর্বোচ্চ কর্তৃত্বের কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে স্বীকৃত হয়েছে। প্রসঙ্গত, ইহুদি ধর্মের আদিপুরুষ 'আব্রাহাম' (Abraham) শব্দটির মধ্যেই 'ব্রহ্ম' (উচ্চারণে braham) শব্দটিকে লক্ষ্য করা যায়।

☆ ☆ ☆

সমাজে ঈশ্বর স্বয়ং ধর্মপ্রতিষ্ঠা করে না, মানুষই ধর্মমতের প্রতিষ্ঠা করে। ঋক্-সংহিতায় তাহলে দেবতা ইন্দ্ৰকে কেন যোদ্ধা হিসেবে ফিরে আসার অনুরোধ করা হচ্ছে? আল্লাহ্ বা অন্যান্য ধর্মের প্রচারক হিসেবে নবী বা পয়গম্বর ধরনের মানব-প্রতিনিধি ছিল, যারা নিজেরা যুদ্ধ বা সংঘাতের মধ্য দিয়ে সমাজে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করত। ঋগ্বেদে ঋষিরা (কেউ কেউ বাদে) দেবতার প্রতিনিধি হিসেবে যুদ্ধ না-করে বরং উপাস্য দেবতাকে ইন্দ্রকেই ধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে আহ্বান করছে। ঋষিরা নিজেরা সেভাবে ধর্মপ্রতিষ্ঠার কাজ না-করে ঈশ্বরকেই সমাজে ন্যায়বিচার আনতে বলছে। অলৌকিক দেবতা না-হয়ে ইন্দ্ৰ কি নিজেই তাহলে কোনো লৌকিক বীর ছিল, কালক্রমে যার বীরত্বের গাথা ঈশ্বরত্বে রূপলাভ করেছে? কোরানে আল্লাহ্-কে বারংবার পরাক্রমশালী বলা হলেও স্বয়ং আল্লাহ্ অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করেছে-- এমন দৃষ্টান্ত কোথাও নেই। অথচ ঋগ্বেদে ইন্দ্র পরাক্রমশালী, কারণ সিন্ধুপারের শত্রুদের হন্তারক যোদ্ধা তিনি। এমন অজেয় বীর সম্পূর্ণ কাল্পনিক যোদ্ধা/ দেবতা হতে পারে? তা-ই যদি হয়, তাহলে বড়ো অংশের ঋষি যুদ্ধ না-করে কেন নিষ্ক্রিয় হয়ে রয়েছে ঋগ্বেদে? অঙ্গিরা ইন্দ্ৰকে আহ্বান করেছিল-- এমন কথা বলা আছে ঋগ্বেদে। সোমরসে মত্ত ইন্দ্র দেবতার লক্ষণ বহন করে, না মানুষের লক্ষণ বয়ে বেড়ায়?

এ ছাড়াও যেমনটা বলেছেন আপনারা, ধর্মের উৎপত্তির ইতিহাস চমৎকার আলোচনার বিষয় হতে পারে। আমি নিজে ধর্মের উৎপত্তির ইতিহাসকে দু-রকমভাবে গড়ে উঠতে দেখেছি-- আরণ্যক সমাজের ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়াকলাপ এবং কৃষিনির্ভর ও নগরসমাজে পরিশীলিত ঈশ্বরের (গ্রামদেবতা বা নগরদেবতা) ধারণা। সে-ক্ষেত্রে বৈদিক ইন্দ্রের পক্ষে কোনো আদিম দেবতা হওয়ার কোনো তথ্য রয়েছে? সেটা থাকলে ইন্দ্ৰকে লৌকিক সামরিক যোদ্ধা ভাবার প্রয়োজন থাকবে না আর। আর বিদ্রোহী বেদপন্থাকে আদৌ কোনো পুরোনো ধর্মের সংস্কৃত রূপ বলা যায়? সেটাই হলে নাগরিক সিন্ধু সভ্যতায় অবদমিত ধর্মসম্প্রদায়ের ইতিহাসটা আরও পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা প্রয়োজন।

আলোচনার জন্য আমাকে সময় দেওয়ায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারা সুস্থ থাকবেন, পরিবারকে ভালো রাখবেন।

ইতি, অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Feb 23, 2023, 12:56 AM

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

নিম্নে ১২ ফেব্রুয়ারী ২০২৩ তারিখে আপনার পাঠানো পত্রের উত্তর দেওয়া হল :

সিন্ধু সভ্যতার হরপ্পান পর্যায়ে গ্রাম ও শহরের পরস্পর নির্ভরশীল সম্পর্ক দেখা গেছে। এমন কি সেটা এর আগেও অর্থাৎ আদি হরপ্পান পর্যায়েও ছিল। সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত বসতিতেই চার্ট পাথরের বাটখারা পাওয়া গেছে। যার উৎস হল সিন্ধু প্রদেশের উত্তরাংশে রোহরি পর্বতমালায়। প্রত্নতাত্ত্বিকরা ধারণা করেন যে, রোহরি পর্বতমালার কাছাকাছি জায়গায় কিছু গ্রামীণ বসতি ছিল যেখানকার অধিবাসীরা পাহাড় থেকে প্রয়োজনীয় আকারের এই চার্ট পাথর সংগ্রহ করত ও সিন্ধুর বিভিন্ন বসতি থেকে আসা বণিকদের কাছে তা সরবরাহ করত। বণিকরা এইগুলি কারিগরদের কাছে বিনিময় করত। আবার সেখানকার কিছু গ্রামে চার্ট পাথরের উপর কাজ করার কারখানা থাকার সম্ভাবনার কথাও তারা বলেছেন। একইভাবে রাজস্থানের তামার খনি থেকে সেখানকার স্থানীয় বসতির অধিবাসীরা সরাসরি তামা পাঠানো ছাড়াও তামা প্রক্রিয়াজাত ক’রে সিন্ধু সভ্যতার বণিকদের মাধ্যমে বিভিন্ন বসতিতে পাঠাত। প্রত্নতাত্ত্বিক রফিক মোগল বর্তমান পাকিস্তানের অর্ধ-যাযাবর ও গরু, মহিষ, ইত্যাদি পালনকারী কিছু জনগোষ্ঠীর সাথে স্থানীয় শহরের দুধ, মাখন, ইত্যাদি পশুজাত খাদ্যের বিনিময়ের বিষয়টির সাথে সিন্ধু সভ্যতার যুগে শহর ও গ্রামের পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে তুলনা করেছেন। হরপ্পার বসতিটির কোনো কোনো জায়গায় কিছু কক্ষে বা কিছু এলাকায় প্রচুর প্রাণীর হাড় পাওয়াতে কিছু লেখক ধারণা করেছেন যে, হরপ্পাতে শিকারীরাও বসবাস করত। কিন্তু এমনটাই মনে করা যুক্তি সংগত যে, শিকারীদের অস্ত্র হরপ্পায় তৈরী হত যা সেখানকার কারিগররা বা বণিকরা অন্য কোনো গ্রামীণ বসতিতে থাকা শিকরাীদের সাথে বিনিময় করত।

অন্যদিকে আবার গ্রামকে শহর ও শহরকে গ্রামেও রূপান্তরিত হতে দেখা গেছে আদি হরপ্পান ও হরপ্পান ও বিদায়ী হরপ্পান যুগে। আদি হরপ্পান থেকে অনেক গ্রামীণ বসতিকে বিকশিত হয়ে শহরে রূপান্তরিত হতে দেখা গেছে। আবার সিন্ধু সভ্যতা ক্ষয়ের পর বিদায়ী হরপ্পান যুগে অনেক নগর ও শহর যেমন পরিত্যক্ত হয়েছিল তেমন অনেক শহরের বাসিন্দারা সেখানে থেকেই গ্রামীণ জীবনে ফিরে গিয়েছিল বলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা বলছেন। কাজেই গ্রাম বা শহর কোনোটাই বিচ্ছিন্ন কেন্দ্র যেমন নয় তেমন তাদের উভয় দিকে বিকাশ ও ‍রূপান্তর ঘটতে পারে।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

বিনিময়ের জন্য মুদ্রা বা কারেন্সী ব্যবহার হত এমন প্রমাণ প্রত্নতাত্ত্বিকরা এখনো পান নাই। সীলগুলির ব্যবহার প্রধানত রাষ্ট্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত গুদামঘর বা রফতানীর জন্য ব্যবহৃত পাত্রে সীলমোহর দেওয়ার কাজে ব্যবহৃত হত বলে তারা মনে করেন।

অবশ্য বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে যে প্রস্তুতকৃত মুদ্রার প্রচলন হতে হবে তার মানে নাই। এটা নির্দিষ্ট ওজনের স্বর্ণ বা তাম্র হতে পারে। কিংবা সেটা হতে পারে আর কোনও প্রাকৃতিক বস্তু। যেমন আমাদের দেশে এক সময় মুদ্রা হিসাবে কড়ির চল ছিল।

সিন্ধু সভ্যতায় ব্যবসায়ীরা ছিল, ঋগ্বেদে যাদেরকে পণি বলা হচ্ছে। তারা সমুদ্রপথে বৈদেশিক বাণিজ্যের সাথেও যুক্ত ছিল। সিন্ধু সভ্যতার সংকট শুরু হলে সমাজে দ্বন্দ্বের রূপটা বুঝার জন্য এক দিকে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত জনবসতি ও তার লোকজন এবং অন্য দিকে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রক্ষার পক্ষের বসতি ও তার লোকজনের দ্বন্দ্বকে বুঝতে পারা দরকার। আমরা যদি বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী নদী উপত্যকাব্যাপী অঞ্চল জুড়ে প্রবাহমান অসংখ্য নদী ও তার উপর আড়াআড়িভাবে স্থাপিত বাঁধের বিষয়টিকে বিবেচনায় নিই, তাহলে অঞ্চল ভিত্তিক সংকটের বিষয়টিকেও বুঝতে পারব। বাঁধ নির্মাণের ফলে এই নদীসমূহের মধ্যে কোনো কোনোটি গতিপথ পরিবর্তন করার ফলে ভাটিতে জলাভাব ও খরা দেখা দিয়েছে, কোনোটির উজানে জল জমে বন্যা দেখা দিয়েছে। এর সাথে আছে বাঁধের কারণে উজানে তৈরী হওয়া জলাধার থেকে যে সমস্ত খাল দিয়ে স্লুইস গেটের মাধ্যমে দূরে কৃষিজমিতে সেচের উদ্দেশ্যে জল সরবরাহ করা হত সেই সমস্ত স্লুইস গেট ও খাল অকার্যকর হয়ে যাওয়ায় অনেক এলাকার জল ধেকে বঞ্চিত হওয়া। কাজেই সব এলাকায় এক সাথে কিংবা একই প্রকৃতির সমস্যা দেখা দেয় নাই। আবার অনেক এলাকায় তেমন সমস্যা ছিল না। এই রকম অবস্থায় অনেকে বা অনেক এলাকা বাঁধ ব্যবস্থার পক্ষে ছিল। তবে সাধারণভাবে শাসক শ্রেণী বাঁধ ব্যবস্থার পক্ষে ছিল। এই জটিল পরিস্থিতিতে প্রধান দ্বন্দ্ব দেখা দেয় যারা বাঁধ ধ্বংস করতে চায় তাদের সাথে যারা বাঁধ ব্যবস্থা রক্ষা করতে চায় তাদের। এখানে আঞ্চলিক প্রেক্ষিত থেকে পক্ষ ঠিক হয়েছে। সবক্ষেত্রে তাই ধনী ব্যবসায়ী বা পণিরা শত্রু নয়। বৈদিক পক্ষের ব্যবসায়ী বা পণির কথাও জানা যায়। কোনো কোনো অঞ্চলের প্রধান বা রাজা যারা স্থানীয় পর্যায়ে স্লুইস গেট নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে কৃষি ভূমিতে খালের জল প্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করত তাদের অনেকেই নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ার ফলে উদ্ভূত সংকটের কারণে বৈদিক পক্ষে যোগ দেয়। আমাদের অনুমান বৈদিক পক্ষের রাজারা এই পক্ষ ত্যাগকারী আঞ্চলিক শাসক। এই জন্য আমরা মনে করি বৈদিক আন্দোলনে সম্পদের অধিকারী ও সম্পদ বঞ্চিত এমন বিভাজন প্রধান ছিল না।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

ইসলাম প্রচারে মক্কার প্রধান ও অভিজাত গোত্র কুরাইশদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব আসে। মুহাম্মদ নিজেই ছিলেন তাদের একজন। তিনি যে সময়টায় মক্কায় ছিলেন সেই সময়ে তার অনুসারী হয়েছিলেন বেশীরভাগই দরিদ্র শেণীর মানুষেরা, যাদের সংখ্যা এক বা দেড় শতর বেশী নয়। এছাড়া কুরাইশ গোত্রেরই আরো কয়েকজন অভিজাত ব্যক্তি তার অনুসারী হয়েছিলেন, যারা হলেন আবু বকর, ওমর , ওসমান ও আলী। ইসলামের ইতিহাস থেকে ধারণা করা যায় যে, মুহাম্মদের উত্থানের সময়ে মক্কাকে কেন্দ্র করে বাণিজ্য বিকাশ লাভ করছিল। এই বিকাশমান বাণিজ্যের নেতৃত্বে ছিল কুরাইশরা। সিরিয়া ও পারস্যের সাথে বাণিজ্যের ফলে তারা বুঝতে পারছিল যে, চারপাশে সভ্যতার ক্ষয় শুরু হয়েছে। বাইজেন্টাইন রোমান সাম্রাজ্য ও পারস্য দীর্ঘ যুদ্ধে ক্লান্ত ও ক্ষয়িষ্ণু। চারদিকে শূন্যতা চলছে। এই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসার এটাই সুবর্ণ সুযোগ ও সময়।

আরব সংলগ্ন পারস্য ও বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যসহ এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলে যখন ক্ষয়িষ্ণুতা চলছিল তখন সমান্তরালে চলছিল আরবের হেজাজ অঞ্চলে মক্কা নগরকে কেন্দ্র করে কুরাইশ বংশের নেতৃত্বে আরব সমাজের এক নূতন উত্থান প্রক্রিয়া। আরবের দিগন্তবিস্তারী মরুভূমির পটভূমিতে যাযাবর বেদুইনরা বিভিন্ন উপজাতিতে বিভক্ত হয়ে তাদের পশুপালের জন্য তৃণভূমির সন্ধানে ঘুরে বেড়াত। যেখানে তৃণ এবং কিছু জল পেত সেখানে কিছু সময় থেকে তৃণ ও জল ফুরালে নূতন জায়গার সন্ধানে তারা যাত্রা করত। মরুভূমির রুক্ষ, অনিশ্চিত ও কঠোর পরিবেশ তাদের জীবনযাত্রার উপরেও প্রভাব ফেলত। ফলে পারস্পরিক যুদ্ধ, হত্যা, লুণ্ঠন এগুলি বেদুইন জীবনের এক সহজাত বৈশিষ্ট্য হয়েছিল। এই রকম এক বিশৃঙ্খল ও উপজাতিতে বিভক্ত আরব সমাজকে ঐক্যের পথে এগিয়ে নিবার কাজ সূচিত করেছিল কুরাইশ বংশ। স্বাভাবিকভাবে এ কাজের পরিণতি হতে পারত বৃহত্তর ঐক্যবদ্ধ সমাজ ও তার পরিণতিতে আবার ঐক্যবদ্ধ আরব জাতি এবং রাষ্ট্র গঠন।

কিন্তু ঐক্যবদ্ধ সমাজ, জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের যে লক্ষ্যের দিকে কুরাইশরা এগিয়ে যাচ্ছিল তার পথ ছিল সম্পূর্ণরূপে শান্তিপূর্ণ। এ কাজে তাদের হাতে ছিল দুইটি হাতিয়ার — একটি বাণিজ্য তথা অর্থনীতি, অপরটি ধর্ম। এটা বোধগম্য যে, সেই সময় মরুপ্রকৃতির সকল সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও আরবের মরূদ্যানগুলিকে কেন্দ্র করে কৃষির কিছু বিকাশ হয়েছিল। ফলে কৃষি উৎপাদনের ভিত্তিতে ব্যবসা তথা বাণিজ্য অর্থনীতিরও একটা বিকাশ হয়েছিল। এর ফলে বাণিজ্যের মাধ্যমে কুরাইশদের আর্থ-সামাজিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। কুরাইশদের এই বাণিজ্যিক বিকাশের জন্য বেদুইন প্রাধান্যবিশিষ্ট আরব উপদ্বীপে শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতির অপরিহার্যতা ছিল। সুতরাং কুরাইশরা উপজাতিসমূহের দেবতাদের সহাবস্থান ও সমন্বয় সাধন পূর্বক একটি ধর্মব্যবস্থা গড়ে তুলে। এই ধর্মব্যবস্থার কেন্দ্র হিসাবে তারা তাদের বসতি-নগর মক্কায় পবিত্র মন্দির হিসাবে কাবাগৃহ প্রতিষ্ঠা করে। কথিত আছে যে, এই কাবা মন্দিরে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার জন্য ৩৬০টি মূর্তি ছিল। আরবের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের বিভিন্ন উপজাতির সদস্যরা তাদের দেবতাদের পূজা এবং খেলা, কবিতা আবৃত্তিসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনের জন্য বছরের একটা নির্দিষ্ট সময়ে কাবাগৃহ এবং সংলগ্ন এলাকায় সমবেত হত। পরবর্তী সময়ে কাবাকে কেন্দ্র ক’রে মুহাম্মদ কর্তৃক প্রবর্তিত বাৎসরিক হজ অনুষ্ঠানের রীতিটি মুহাম্মদ সেখান থেকেই গ্রহণ করেন।

যাইহোক, এটা স্পষ্ট যে, কুরাইশদের পথ ছিল শান্তিপূর্ণভাবে আরবে একটি বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠন করা। শান্তির উপর তাদের গুরুত্ব কতটা ছিল তা বুঝা যায় বছরের চারমাসকে শান্তির মাস হিসাবে আরবব্যাপী প্রতিষ্ঠা করা। এই চারমাসে আরবে যুদ্ধ, লুণ্ঠন, আক্রমণ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ছিল। এই কারণে এই চার মাসকে নিষিদ্ধ মাস বলা হত, যা আরবরা কঠোরভাবে মেনে চলত। এটা স্পষ্ট যে, কুরাইশরা যোদ্ধা ও লুঠেরা হিসাবে নয়, বরং শান্তিপূর্ণ ব্যবসায়ী হিসাবে নিজেদের আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছিল। সেটাকে রক্ষাও করতে চেয়েছিল সেই ভাবে।

কিন্তু মুহাম্মদের পথ ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার পথ ছিল ধর্মের নামে যুদ্ধ ও লুণ্ঠনের। এর সঙ্গে সমাজের উৎপাদনশীলতা এবং তার সঙ্গে সম্পর্কিত ধনী-দরিদ্র, ‍সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিতের শ্রেণী সংগ্রামের কোনও সম্পর্কই ছিল না। বরং মুহাম্মদের ধর্মীয় আন্দোলনের মূল বা প্রধান ভিত্তি গঠন করেছিল সমাজের উৎপাদনশীলতা বহির্ভূত যুদ্ধপ্রবণ ও লুঠেরা পশুচারী, যাযাবর বেদুইনরা। এরা সংখ্যায় যা-ই হোক, এরা ছিল স্থিতিশীল ও কৃষিনির্ভর জন-সমাজ বহির্ভূত বিচরণশীল জনগোষ্ঠী, যারা সভ্যতাকে আক্রমণ কিংবা ধ্বংসের শক্তি হতে পারে, কিন্তু সভ্যতা নির্মাণের শক্তি হতে পারে না। ইসলামকে বুঝতে হলে তাই পশুচারী ও মরুচারী আরব বেদুইনকে বুঝতে হবে।

স্বাভাবিকভাবে কুরাইশদের সংখ্যাগুরু অংশ নিজেদের গড়ে তুলা পথ ও জীবনধারাকে রক্ষা করতে চেয়ে মুহাম্মদের বিরোধিতা করেছিল। হয়ত তারাও রাষ্ট্রই গড়তে চেয়েছিল। তবে সেটা মুহাম্মদের পথ অনুসরণ করে নয়। সুতরাং তাদের সঙ্গে মুহাম্মদের বিরোধ বাধে।

কুরআন-হাদীসের মনোযোগী পাঠ থেকে এটা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, ঐ সময় বিস্তীর্ণ ভূভাগে সভ্যতায় যে ক্ষয় এবং বিপর্যয় ঘটছিল তা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাণিজ্য পরিচালনাকারী হিসাবে মুহাম্মদের মতো অন্য কুরাইশ সদস্যদেরও চোখে পড়েছিল। তবে সভ্যতার সঙ্কট জনিত শূন্যতা পূরণ করতে গিয়ে তারা তাদের পথ পরিবর্তন করতে চায় নাই। ফলে সময়ের সাথে তাল মিলাতে না পেরে তারা হেরে যায় এবং শেষাবধি পরাজিত কুরাইশরাও বণিকবৃত্তি বাদ দিয়ে মুহাম্মদের অনুসারী হয়ে যোদ্ধা এবং রাষ্ট্র-শাসকে পরিণত হয়। দামেস্কের উমাইয়া খলীফা কিংবা আরও পরবর্তী কালের বাগদাদের আব্বাসীয় খলীফারা এই কুরাইশদেরই উত্তরপুরুষ। এই সমগ্র গতিধারায় মুহাম্মদের সংস্কারের কারণে ধর্মের রূপ ও চরিত্রে যত পরিবর্তন ঘটুক সমাজ বা রাষ্ট্র শাসনে ধর্মের ভূমিকা অপরিবর্তিত রইল।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆ 

সিন্ধুর নগর এবং তার গ্রামীণ কৃষিনির্ভর পশ্চাদভূমির মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক যেমন ছিল তেমন শাসক-শাসিতের সম্পর্কও ছিল বলে আমরা মনে করি। আঞ্চলিক ক্ষেত্রে প্রত্যকটি নগর বা শহরের তার আশেপাশের গ্রামগুলির উপর নিয়ন্ত্রণ ছিল। আবার অন্যদিকে স্থানীয় পর্যায়ে নীতিনির্ধারণে সেই সমস্ত গ্রামীণ সমাজেরও প্রতিনিধিত্ব ও গুরুত্ব ছিল বলে মনে হয়। সিন্ধু সভ্যতার লিপিযুক্ত সীল ও বাটখারা গ্রামীণ বসতিগুলিতেও পাওয়ার কথা প্রত্নতাত্ত্বিকরা জানিয়েছেন। এছাড়াও পাকিস্তানের বিয়াস বা বিপাশা নদীর প্রবাহ পথ জুড়ে জরিপ পরিচালনা করার সময় প্রত্নতাত্ত্বিকরা সিন্ধু সভ্যতার ছোট গ্রাম ও শহরে হরপ্পা ও মহেঞ্জো-দাড়োর মত পদ্ধতিতে তৈরী কুয়া দেখতে পেয়েছেন। এছাড়াও হরিয়ানার সিন্ধু বসতিগুলির উপর সাম্প্রতিক গবেষণা থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেখানকার শহর ও গ্রামগুলির পরস্পর নির্ভরশীলতার কথা বলেছেন এবং শহরকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে গ্রামগুলির বিনিময় ভিত্তিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল বলে উল্লেখ করেছেন। এই সমস্ত সাক্ষ্য থেকে মনে হয় সিন্ধু সভ্যতায় যেমন একটি কেন্দ্রীয় ও দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল (যার প্রমাণ সমগ্র বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকা জুড়ে প্রমিত লিপি, সীল, বাটখারা, ইত্যাদির ব্যবহার), তেমনি আঞ্চলিক প্রতিনিধিত্ব ও সম্মতি ভিত্তিক শাসন ব্যবস্থাও ছিল। এই ব্যবস্থা ছিল কেন্দ্র থেকে একেবারে প্রান্ত পর্যন্ত ধাপে ধাপে।

সিন্ধু সভ্যতায় অপরিবর্তনীয়ভাবে বংশানুক্রমিক পেশা ছিল না বলে আমরা বিভিন্ন জায়গায় বলেছি। সিন্ধু সভ্যতার প্রাক-নগরায়নের যুগেও সেটা ছিল না বলে মনে হয়। একইভাবে শাসন ব্যবস্থাও বংশানুক্রমিক ছিল না। ঋগ্বেদে উল্লেখিত রাজারা বংশানুক্রমিক ছিল না বলে বুঝা যায়। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্বও একই সাক্ষ্য দেয়। সিন্ধুর অধিবাসীরা অনেক পরে গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসতি স্থাপন করলে ভিন্ন পরিস্থিতির কারণে বংশানুক্রমিক পেশা যেমন শুরু হয় তেমন পরবর্তীকালে বংশানুক্রমিক রাজতন্ত্রও শুরু হতে দেখা যায়। যে কোনো সমাজেই বংশানুক্রমিক পেশার বীজ বা উপাদান সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। সামাজিক প্রয়োজন থেকে সেটা বিকশিত রূপ নিতে পারে। পরিবর্তিত সামাজিক প্রয়োজনে উভয় দিকে পরিবর্তন সম্ভব। যেমন সব প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থারই সব সময় অনিবার্য পরিণতি রাজতন্ত্র নয়। উল্টাটাও হতে পারে। এমন দেখা গেছে মেগাস্থিনিসের সময়ে, একটি রাজতান্ত্র্রিক রাজ্যকে প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রূপান্তরিত হতে। তবে রূপান্তরের ক্ষেত্রেও সবকিছুর হুবহু পুনরাবৃত্তি সচরাচর ঘটে না। এই জন্য সিন্ধু সভ্যতার আদি-হরপ্পান বা প্রাক-নগরায়নের কিছু বৈশিষ্ট্য সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর ফিরে এলেও সব কিছুরই পুনরাবৃত্তি দেখা যায় নাই।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

মানুষের কল্পনায় তার ইচ্ছাপূরণের হাতিয়ার হয়ে দেখা দেয় দেবতা বা ঈশ্বর। এ যেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গল্পের ‘ইচ্ছাপূরণ ঠাকুর’। দেবতা ইন্দ্রের নামে যোদ্ধারা বা কোনো ক্ষেত্রে ঋষিরা যুদ্ধ করে। দেবতাকে নৈবেদ্য দেয় মানুষ আর ভাবে দেবতা তা খেয়ে পরিপুষ্ট হয়ে আরো শক্তিশালী হয়ে আরো সহজে মানুষের ইচ্ছা পূরণ করতে পারবে। ধর্মীয় বিশ্বাসপ্রবণ ও ঐশ্বরিক শক্তির উপর আস্থাশীল মানুষ কল্পনা করে শক্তিমান অলৌকিক কেউ এসে তার সমস্যার সমাধান করে দিবে। অথবা সে নিজে যে কাজ করতে ইচ্ছুক তার নৈতিক সমর্থন খুঁজে কাল্পনিক ঈশ্বরের মধ্যে। এজন্য বাঁধ ভাঙ্গার জন্য নিজেরা যুদ্ধ করলেও দেবতা ইন্দ্রের সাহায্য লাগে। এখানে দেবতা যুদ্ধ না করলেও, বৈদিকরা যে যুদ্ধ করছে তার কৃতিত্ব আরোপ করছে দেবতার উপর। এভাবে তারা যুদ্ধ করতে প্রেরণা লাভ করেছে।

যুদ্ধের প্রয়োজনে তাদের প্রচলিত ধর্মকে সংস্কার করে ইন্দ্রকে প্রাধান্যে আনতে হয়েছিল। এজন্য ইন্দ্রের উপর বীরত্ব আরোপ করতে হয়েছে। তাই বলা হয়েছে ইন্দ্র অজেয় বীর। আর ঋষিদের প্রধান কাজ ছিল বাঁধ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যুদ্ধের জন্য জনমনস্তত্ত্ব তৈরী করা ও যোদ্ধাদের উদ্দীপ্ত করা। যুদ্ধকে প্রধানত তারা যোদ্ধা ও রাজাদের জন্য রেখে দিয়েছিল। তাই যুদ্ধে তাদের বেশীরভাগ ক্ষেত্রে নিষ্ক্রিয় দেখা যায়। ইসলামের এক দেবতা বা ঈশ্বর আল্লাহ যুদ্ধে তার প্রতিনিধিকে অর্থাৎ মুহাম্মদকে সাহায্য করেছে এমন কথাও বলা হয়েছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরা কাউকে হত্যা করে আল্লাহর নামে চালিয়েছে। অর্থাৎ প্রচার করেছে যে, আল্লাহ হত্যা করেছে। ইসলামের সাথে বৈদিক আন্দোলনের একটা পার্থক্য হল ইসলামে যে ধর্ম প্রচারক সে-ই যোদ্ধা, অন্যদিকে বৈদিক আন্দোলনের যারা ধর্ম প্রচারক তারা বেশীরভাগ ক্ষেত্রে যোদ্ধা নয়। ইসলামের মুহাম্মদ এক সর্বশক্তিমান ও নিরঙ্কুশ দেবতা আল্লার একমাত্র প্রতিনিধি, যিনি একই সাথে তথাকথিত ঐশ্বরিক বাণী বা মন্ত্র প্রচারকারী এবং যোদ্ধা ও শাসক।

এখন পর্যন্ত বৈদিক দেবতা ইন্দ্রকে আদিম কোনো দেবতা হবার তথ্য পাওয়া যায় না। তবে, সমাজের মানুষের প্রয়োজনে দেবতাদেরও রূপান্তর ঘটে, যা আমরা আগে আলোচনা করেছি। ভারতীয় পুরাণ সাহিত্য থেকে বরুণ জলের দেবতা ছিল বলে জানা যায়। কিন্তু এই বরুণ দেবতাই ভিন্ন পরিস্থিতিতে ভিন্ন স্থানে গিয়ে নূতন নাম গ্রহণ করেছে। ইরানে বরুণ দেবতা অহুর ময্দা (এই নামটি ‘অসুর মস্তক’ থেকে উদ্ভূত হতে পারে বলে আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় উল্লেখ করেছি) নাম গ্রহণ করেছে এবং সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী এক দেবতা তথা ঈশ্বরে রূপান্তরিত হয়েছে। এই জন্য জোর দিয়ে বলা যায় না যে, ইন্দ্র যুদ্ধের দেবতা ছিল বা কোনো প্রাচীন বীর ছিল। এটা কেবল ধারণা করা যায় মাত্র। তবে এটা জোর দিয়ে বলা যায় যে, ইন্দ্র কোনো প্রাচীন দেবতা ছিল, এবং সম্ভবত বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকার একটি পরিচিত দেবতা ছিল। নতুবা তাকে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে গ্রহণযোগ্য করা যেত না।

আমাদের মনে হয় আমরা এখানে আমাদের আলোচনা আপাতত শেষ করতে পারি। আপনার উত্তরের অপেক্ষায় থাকব। আপনার সর্বাঙ্গীন কুশল কামনা করি।

ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক,

 শামসুল আলম চঞ্চল

 

Mar 4, 2023, 11:23 AM

প্রিয় মানিকবাবু ও চঞ্চলবাবু,

উত্তরের প্রথম অংশে গ্রাম-শহরের দ্বৈতরূপ নিয়ে আলোচনা করেছেন আপনারা। এখানে আমার আপত্তিকর কিছু লাগছে না। আমি একমত আপনাদের সাথে। তবে গ্রাম প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য আরেকটু বিস্তারে বলব।

গ্রামের প্রকৃতিজগৎ নিয়ে আমি শহুরেদের মতো অতিরিক্ত আদিখ্যেতা করছি না। আমার বলার বা আগ্রহের জায়গা হল মূলত গ্রাম বলতে যা বুঝি আমরা আজকের দিনেও, সেই গ্রামবাংলার সামাজিক সংগঠন নিয়ে। আগের পত্রে সঠিকভাবেই বলেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার বিকাশের পর্যায়ে গ্রাম থেকে শহর বা শহর থেকে গ্রামের রূপান্তর দেখা যায়। তার সাথে এ কথাও মনে রাখতে হবে- শহর বা গ্রাম নামের এই দুই পৃথক ধারণা তুলনায় আধুনিক। সিন্ধু উপত্যকায় কৃষিজাত গ্রাম্য বসতি নগরে রূপান্তরিত হচ্ছে মানে সেই যুগে গ্রাম বা শহর বলে আলাদা সমাজ-সংগঠনের অস্তিত্ব ছিল না। পরবর্তীকালে আধুনিক নগরের বেশ কিছু ব্যবস্থা পরিণত নগর-পর্যায়ে দেখা যায় সিন্ধুপারে। লক্ষ করার বিষয় যে, সিন্ধু সভ্যতার তথাকথিত গ্রাম-পর্যায় সাবলীলভাবে নগর-পর্যায়ে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। অর্থাৎ অখণ্ড সত্তা হিসেবে সিন্ধু সভ্যতার প্রাথমিক পর্যায়ে গ্রামীণ কাঠামো থাকলেও পরিণত পর্যায়ে সেটা নগরে রূপান্তরিত হতে পারত; উল্টোটাও সম্ভব ছিল।

এখানে এবার দ্বিতীয় বিষয় আসবে। সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংস হওয়ার বহু পরে যখন গাঙ্গেয় উপত্যকায় গ্রামসমাজ তৈরি হচ্ছে, সেই গ্রাম সেভাবে নগরের রূপ নিচ্ছে না। ফলে সিন্ধু সভ্যতায় যে হারে নগরের বিকাশ দেখি, গঙ্গাতটে নগরের বিকাশকে রোধ করে রেখেছে স্বনির্ভর গ্রামগুলি। সিন্ধু সভ্যতায় কারিগররা সম্ভবত নগরকে ভিত্তি করে কার্যক্রম চালাত, যেমনটা বহু পরে খ্রিস্টীয় তেরো শতকে ইউরোপে গিল্ড আকারে দেখা যায়। আশপাশে কৃষি এলাকার বিস্তার থাকত। কিন্তু গাঙ্গেয় রাজতন্ত্র, মহাজনপদের যুগে গ্রামের মধ্যেই অনেক ক্ষেত্রে কারিগর শ্রেণিকে আবদ্ধ অবস্থায় দেখি। যেন কোনো একটা অদৃশ্য শক্তি কারিগরদের শহরাঞ্চল তৈরি করতে বাধা দিচ্ছে। এমনকি নগর বলতে সে-যুগে মোটের ওপর একটা রাজধানী এলাকা বোঝাত। কিছু নগরবাসীও থাকত সেখানে। অথচ সিন্ধু যুগ থেকে আজকের দিনে নগর বা শহর বলতে স্রেফ রাজধানীই বোঝায় না, একটা বিশাল জনগোষ্ঠীর আবাসস্থলও বোঝায়। আবার গাঙ্গেয় গ্রামগুলিতে সামাজিক পেশাগুলির এমন বিন্যাস ছিল, যাতে সমস্ত পেশা মিলে একেকটা গ্রাম যেন স্বতন্ত্র ইউনিট হয়ে ওঠে, মানবদেহে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মিলে যেমন একটা অখণ্ড সিস্টেম তৈরি হয়।

এরকম স্বনির্ভর ধরনের সমাজবিন্যাস থেকে সিন্ধু যুগের মতো নগরসভ্যতার জন্ম সম্ভব নয়। নগর তৈরি হওয়ার অবস্থাই রাখেনি গঙ্গা উপকূলবর্তী জনপদের সভ্যতা; গ্রাম নামের এমন একটা সমাজকাঠামো সেখানে জন্ম নিল, যা নগরসমাজের বিকাশকে (রাজধানী হিসেবে নগরের ব্যবহার চলতে পারে) রোধ করেছে বারবার। ফলে পূর্ব ভারতের গ্রামসভ্যতাকে ব্যাপক ধ্বংসের মুখে না-ফেললে শহুরে সমাজ জন্ম নিতে পারত না। কোনো রাজশাসনের আমলেই এমন মহাধ্বংসের যজ্ঞ করা হয়নি। ব্রিটিশরা এসে প্রথমেই আক্রমণ শানাল এখানকার কুটির শিল্প আর বিপুল কৃষিভিত্তিক গ্রামের ওপর। ফলে যা ঘটল, তা আমরা সবাইই জানি। হেস্টিংস সেই মহাদুর্ভিক্ষের ফলশ্রুতি হিসেবে হাস্যকরভাবে 'নীতিসম্মত আইন' প্রণয়ন করেন। এই হেস্টিংস থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকেরাই আবার কলকাতার নগরায়ণে পয়সা ঢেলেছিল, থিয়েটার বানিয়ে উৎসবে মেতেছিল। প্রথমদিকের কলকাতার নবজাগরণের পাণ্ডারা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে বিশেষ যায়ইনি, সে রামমোহন সাহেব হন, ইয়ং বেঙ্গলের তরুণরা হোক বা সিপাহী বিদ্রোহ অবধি বিদ্যাসাগরই হন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিরুদ্ধে কলকাতার এইসব গুণধরেরা যায়নি, তবে ব্যাপক আদিবাসী বিদ্রোহ হয় এই সময়টায়। সে-কথা কলকাতার মুষ্টিমেয়ের নবজাগরণের সমান্তরালে পড়ানো হয় না ভারতে বিশেষ। তিতুমীরকে নিছক কাঠমোল্লা বানিয়ে ছাড়া হয়েছে।

বাংলার গ্রামসমাজকে ধ্বংস না করলে কলকাতাকে ঘিরে পরজীবী শহুরে সমাজ জন্ম নিত? ঠিক এই অর্থেই, সিন্ধু যুগের গ্রামীণ কাঠামো বা নাগরিক কাঠামোর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ধারণা দিয়ে পূর্ব ভারতে গড়ে ওঠা আত্মনির্ভর গ্রামের ব্যাখ্যা আসবে না। তাই সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের পরবর্তীতে সমাজ 'পশ্চাৎপদ’ অবস্থায় ফিরে গেল- এরকম সরল মন্তব্য আমি এক কথায় করছি না। সিন্ধু সভ্যতার প্রাক্-নগরায়ণের পর্যায়ের বিকাশ স্বতস্ফূর্তভাবে ঘটেছিল। সেখানে গাঙ্গেয় গ্রামগুলি যেন অনেক সচেতনভাবে নগরায়ণের অনেক লক্ষণ নিজের মধ্যে ধারণ করে নিজেই একটি স্বশাসিত সামাজিক একক হিসেবে বিরাজ করত। অনেকেই মনে করে, আগেকার যুগে যাতায়াতের বন্দোবস্ত ছিল না বলে গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন ছিল। কিন্তু যে গ্রাম নিজেই একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ পৃথিবী, সে কি আলাদা করে মঙ্গল গ্রহের জীবকে দেখতে যেতে চাইবে? গ্রামবাংলার এই বিশেষ সামাজিক গঠনে নজর না-দিয়ে বড়ো বড়ো সমাজতাত্ত্বিকরাও বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলিকে প্রাকৃতিক কারণে সৃষ্ট বলে ধরে নেন। প্রসঙ্গত, রুশদেশে 'গ্রাম'-এর সমার্থক শব্দ হল 'মির'। এই শব্দের আরেকটি অর্থও আছে। তা হল 'পৃথিবী'। অর্থাৎ রাশিয়াতেও গ্রাম আঞ্চলিক পৃথিবী হিসেবেই বিরাজ করত, যা সরাসরি নগরায়ণকে রোধ করে। জার্মানদের 'মার্ক' এরকমই বিশেষ গ্রামসমাজ। এই বৈশিষ্ট্য সিন্ধু সভ্যতার গ্রামীণ ক্ষেত্র থেকে নগর-পর্যায়ে বিকাশের হিসেবের সাথে পুরোপুরি আঁটবে না। রাজতন্ত্রও যেন অনেকটা ওপর থেকে চাপানো ব্যবস্থা লাগে গাঙ্গেয় এলাকায়। এই দিকটায় আপনাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি আমি।

এই প্রসঙ্গে আপনারা নিজেদের বক্তব্য জানালে তারপর এরকম স্বনির্ভর গ্রাম-একক নির্মাণে 'ধর্ম (ধারণ করা অর্থে) জিনিসটার কোনো আর্থসামাজিক ভূমিকা ছিল কিনা, সে-বিষয়ে কিছু মন্তব্য করব।

☆ ☆ ☆

সিন্ধু নগরসভ্যতায় কৃষিক্ষেত্রে বাঁধনির্মিত সেচব্যবস্থার সংকট প্রসঙ্গে কয়েকটি কথা বলব। কিছু রচনায় পড়েছি যে, সুমেরের পুরোহিত সম্প্রদায় কৃষিক্ষেত্রের জল সরবরাহের নিয়ন্ত্রণ নিজেদের হাতে রাখত। এক ঝলকে আপনাদের কথাই মনে পড়ে গেছিল তখন। কারণ আপনারাও সিন্ধু- সরস্বতী অববাহিকায় বাঁধ নির্মাণ এবং কৃষির বিপুল বিস্তারের কথা বলেছেন। কোনোভাবে সুমের জলনিয়ন্ত্রক পুরোহিত সম্প্রদায় আর সিন্ধু সভ্যতার বাঁধনির্মাতাদের সম্পর্ক থাকতে পারে কি? অবশ্য প্রচলিত ধারণা যে, সিন্ধু সভ্যতায় জলবণ্টনকে ভিত্তি করে পুরোহিত সম্প্রদায় গড়ে ওঠেনি। কিন্তু আপনাদের রচনা পড়ার পর এ বিষয়ে অযথা কথা না-বাড়ানোই ভালো। কৃষিক্ষেত্রে জলবণ্টন আর বাঁধনির্মাণ যে সিন্ধু-সরস্বতী অববাহিকার একটা গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু ছিল, আপনাদের দৌলতে এ বিষয়ে আমার আর কোনো সন্দেহই নেই। অন্য একটা বিষয় আমি ভেবেছি সিন্ধু সভ্যতার শেষের দিকের বাঁধভাঙা আন্দোলনকে ঘিরে। কোনোভাবে বৈদিক আন্দোলনকে কি সিন্ধু উপত্যকার পরিবেশবাদী আন্দোলন বলা যেতে পারে? পশুর হাড় বা অধিবাসীদের খাদ্যপ্রণালীর নমুনা দেখে মনে হয় সিন্ধুজনতা মানুষের ক্ষেত্রে অহিংস নীতি নিলেও অন্য প্রাণীজগতের ক্ষেত্রে সবসময় অহিংস আচরণ করেনি, বিশেষত খাদ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে। এ ছাড়াও সিন্ধু এলাকায় বড়ো আকারের বাঁধ আর যান্ত্রিক ব্যবস্থার কারণে জলের সাপ্লাই লাইনে অসুবিধা এবং পাশ্ববর্তী কৃষিক্ষেত্রে জলের সরবরাহে সমস্যার কথা বহুবার আপনারা বলেছেন। বৈদিক আন্দোলন এর বিরুদ্ধে সংঘটিত হয়েছিল বলেও মত দিয়েছেন আপনারা। মানুষের নির্মিত বাঁধব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাওয়ার পরিণাম কী হল? এরকম বড়ো আয়তনের জল-সরবরাহের কাঠামো ভেঙে পড়ল আর কৃষি উৎপাদন, সেই সাথে সিন্ধু কৃষিজীবীরাও এলোমেলো হয়ে বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল। বৈদিক আন্দোলনের পরিণামে কৃষিসভ্যতার অনেকটাই বিনাশ ঘটেছে বৈকি। পাশাপাশি এটাও লক্ষ্য করার মতো বিষয় যে, প্রকৃতির চক্রকে ব্লুইস গেটের চাকা দিয়ে বাঁধার বিরোধী ছিল ঋষিরা। তুলনায় তাঁরা নদীর জলকে কামাতুর হয়ে স্বতস্ফূর্ত অবস্থায় সাগরে মিলিত হতে দেখতে চেয়েছেন। কৃষিসংকটের কালে গড়ে ওঠা বৈদিক আন্দোলনকে এভাবে এক ধরনের পরিবেশবাদী আন্দোলন বলা চলে কি, যার পরিণামটা অবশ্য সিন্ধুবাসীদের কৃষি উৎপাদক সমাজের খুব একটা হিতে যায়নি?

☆ ☆ ☆

এবার আসি ইসলাম সম্পর্কিত বিষয়ে। কথা প্রসঙ্গে ইসলামের আলোচনা এসেছে। 'ইসলাম ও আধুনিক সভ্যতা'র তৃতীয় অধ্যায়টি পাঠিয়েছিলেন। সেটি পড়েছি। এই ধরনের রচনা, এত তথ্য আর প্রমাণ দিয়ে ইসলামের ব্যবহারিক স্বরূপ ফুটিয়ে তোলা আমাদের এদিকেও এসব বই বিতর্ক তৈরি করতে পারবে যথেষ্ট পরিমাণে। সেখানে বাংলাদেশের মতো জায়গায় এই বই লিখে প্রকাশ করা রীতিমতো সাহসিকতার পরিচয়। যাই হোক, একটা ধারণা আমার আবছা ছিল, সেটা আরও পরিষ্কার হল রচনাটি পড়ে। উৎপাদনশীল ধর্ম আর অনুৎপাদক ধর্মের তফাতটা বুঝলাম ভালো মতো। দ্বিতীয় ভাগে ইসলামের অনুসারীরা পড়ে। সভ্যতার ধারণা মূলত কৃষির ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। সেখানে কৃষি-বহির্ভূত কোনো যাযাবর সম্প্রদায় যদি ধর্ম তৈরি করে, তা মোজেইক বা খ্রিস্টধর্মের মতো উৎপাদকদের ধর্ম হবে না। এ ক্ষেত্রে যাযাবর সম্প্রদায় নিয়ে কিছু বলার আছে আমার। ইসলামের অনুসারী যারা হয়েছিল বহু পরিমাণে, সেই বেদুইন সম্প্রদায়ের হানাহানির স্বভাব জানি আমরা। এককালে বৈদিক ঋষিদেরও এরকম পশুপালক, যাযাবর সম্প্রদায় হিসেবে প্রমাণ করার (অপ)চেষ্টা ছিল বহুল পরিমাণে। আপনাদের গবেষণা সেই ধারণার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আছে। আমি যাযাবরদের সম্বন্ধে পড়তে গিয়ে দেখেছি এই সম্প্রদায়, বিশেষ করে ইউরোপের জিপসি বা অন্য কিছু সম্প্রদায় ভারতের প্রাচীন ইতিহাসের সাথে যুক্ত। আমাদের বাংলা শব্দের গঠনকে বৈদিক যুগের ইতিহাস অনুসরণে ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করে দুজন ভদ্রলোক অভিধান রচনা করেছিলেন বাংলায়। কলিম খান আর রবি চক্রবর্তী তাঁদের নাম। 'বঙ্গীয় শব্দার্থকোষ (দু- খণ্ডে) [প্রথম খণ্ড: https://banglaelibrary.blogspot.com/2022/11/blog- post_309.html?m=1; দ্বিতীয় খণ্ড: https://banglaelibrary.blogspot.com/2022/11/blog- post_339.html?m=1] আর সহজভাবে কাজের জন্য এক খণ্ডে 'সরল শব্দার্থকোষ' [https://banglaelibrary.blogspot.com/2022/11/blog- post_765.html?m=1] লেখেন তাঁরা। বেদে জাতির প্রসঙ্গে অভিধানে লেখা আছে যে, তারা আদি বৈদিক জাতি ইত্যাদি। আমি সে প্রসঙ্গে যাব না। তবে বলব, বেদে জাতি সাপের খেলা দেখায়। ময়মনসিংহের গীতিকা'য় 'মহুয়ার পালা'য় এই বেদে জাতির কাহিনি পাবেন। এই জাতির নামে 'বেদ' শব্দটি চোখে পড়ার মতো এবং এরা যাযাবর। জিপসিরাও রাজস্থানের আদি নিবাসী বলে গবেষকরা কেউ কেউ মনে করেন। বেদুইনদের কথা ছেড়ে দিই, ইউরোপ আর এশিয়ার যাযাবর জাতিগুলি অনেকাংশেই বৈদিক আন্দোলনের যুগের সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে বলে অনুমান করা যায়। আরও গবেষণা প্রয়োজন। এ প্রসঙ্গে বলব ইয়েজিদি ধর্মসম্প্রদায়ের কথা। এরা প্রায় আমাদের দেশি মানুষদের মতো। মন্দিরের গঠন আমাদের মতো, মেয়েরা সন্ধ্যাবেলায় উলুধ্বনি দেয়, শাড়ি পরে। এদের মিথেও ভারতীয়ত্ব প্রকট; বিশেষ করে ময়ূর আর সাপের ব্যবহার দেখা যায় এদের মিথে। কোনো ময়ূরদেবতার থেকে ইয়েজিদি সম্প্রদায় উদ্ভূত বলে এদের দাবি। তবে এদের মন্দিরে সাপ আঁকা থাকে বড়ো আকারে। ইরাকের উত্তরাঞ্চলে এদের নিবাস। বছর দশেক আগে আইসিস বাহিনী এদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন চালায়। তখন প্রচারের আলোয় আসে এই সম্প্রদায়। আমার বক্তব্য এই যে, মধ্যপ্রাচ্য অবধি যাযাবর ও সাপকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ের দেখা পাই আমরা। আপনারা 'অহি' শব্দের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন 'আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা'য়, সেই বিতাড়িত অহি বা বৃত্র বা বাঁধপন্থীদের সাথে সম্ভবত বিদায়ী সিন্ধু যুগে উদ্ভূত এইসব যাযাবর, সর্পকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ের যোগ আছে কি?

☆ ☆ ☆

সিন্ধু উপত্যকা ছেড়ে এবার একটু গাঙ্গেয় উপত্যকায় আসব। আমি আর আপনারা উভয়েই এই বাংলার সন্তান। তবে পূর্ববাংলায় আপনারা থাকেন। ফলে কৃষিজীবী আর পাহাড়ি জাতিগুলির সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা আছে আপনাদের। বিশেষ করে গারো জাতির সম্বন্ধে 'বঙ্গরাষ্ট্র'-এ কয়েকটি নিবন্ধ দেখেছি আমি। সেখানে গারো জাতির মধ্যেকার লৌকিক যাপনকে সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত ধারার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হিসেবে দেখাতে চেয়েছেন। ইঙ্গিতটা তাৎপর্যবহ। আমি আরেকটা দিক উল্লেখ করব। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের 'লোকায়ত দর্শন'-এর কথায় আসব। লোকায়ত দর্শনের অনুসারী সমাজের পারিবারিক গঠনে মায়ের ভূমিকা বেশি থাকে বলে তিনি বলেছেন তাঁর গ্রন্থে। সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত ধারার আলোচনায় মাতৃতন্ত্র বা নারীর ক্ষমতায়ন প্রসঙ্গে একটি নিবন্ধ দেখেছি আমি 'বঙ্গরাষ্ট্র'-এ। তবুও বলব, লোকায়ত দর্শন আর মাতৃতন্ত্রকে কতখানি সম্পর্কিত বলে মনে করেন আপনারা?

যদি সিন্ধু সভ্যতার সমকালীন পারিবারিক গঠন থেকে মাতৃতন্ত্র উদ্ভূত হয়ে থাকে, তাহলে গারো জাতির ধর্ম নিয়ে আমার কিছু বলার আছে। ওদের ধর্মের নাম 'সাংসারেক' (জনৈক গারো নেতার মতে, ধর্মটির আসল নাম নাকি 'সংসারেক')। শব্দটায় 'সংসার' শব্দটি প্রকট। এ ছাড়াও আমাদের সংস্কৃত শাস্ত্রে বা ঔপনিষদিক, পৌরাণিক রচনাতেও 'সংসার' শব্দটির দু-রকম অর্থ পাই। একটা গার্হস্থ্য সংসার, অন্যটি জগৎ-সংসার। ভারতের ধর্মচিন্তায় 'সংসার' শব্দ এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, গারো জাতি আস্ত একটা 'সাংসারেক ধর্মের অনুসারী-- এই কথাটি একটা বিরাট সম্ভাবনা হাজির করে আমাদের সামনে। পরিকল্পিত শয়তানির চক্রান্তে বাংলাদেশের 'মান্দি' সমাজে আজ এই ধর্মমতের অবসান হচ্ছে বলে শুনেছি। 'মান্দি' শব্দের অর্থ যদ্দূর জানি 'মানুষ'। গারোদের ধর্ম কি কোনোভাবে অধ্যাত্মিক ধর্মবর্জিত মানবতাবাদের অতীতকে তুলে আনে ঝাপসাভাবে?

উপনিষদের আদিরূপগুলিই হোক বা কপিলের সাংখ্যই হোক, বঙ্গভূমি লোকায়ত দর্শনকে সুসংহত রূপদান করেছে বরাবরই। বুদ্ধের জন্মও কপিলাবাস্তুতে, যার নামের সাথে কপিল শব্দটি যুক্ত। দেবীপ্রসাদের গ্রন্থে সাংখ্য যে লোকায়ত দর্শনের একটি রকমফের, এ বিষয়ে আলোচনা আছে। পারিবারিক মাতৃতন্ত্র, সংসার জীবন থেকে কোনোভাবে বিশ্বজনীন ধারণার একেশ্বরবাদী উপনিষদ এই বঙ্গভূমিতে উদ্ভূত হয়ে থাকতে পারে বলে আমি অনুমান করি। যদি তাই হয়ে, তাহলে সংসার-অবলম্বী গারো জাতির সমাজ, তাদের সংস্কার নিয়ে আরও গভীর গবেষণা হওয়া প্রয়োজন। গারো-চাকমা প্রভৃতি পাহাড়ি জাতির সাথে মেলামেশা করেছেন আপনারা। সে-ক্ষেত্রে ওদের সমাজে পারিবারিক সংসার জীবনের সাথে লোকায়ত দর্শনের কোনো যোগ খুঁজে পান কি ?

আপাতত এখানেই কথা শেষ করি। আপনাদের কল্যাণ কামনা করে আজকের মতো বিদায় নেব। ভালো থাকবেন ।

ইতি, অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Mar 15, 2023, 1:28 PM

পত্রের যৌথ উত্তর

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

গ্রাম ও শহর বা নগর প্রসঙ্গে আপনি যে আলোচনা করেছেন সেটা যথেষ্ট আগ্রহ উদ্দীপক। বিশেষ করে সিন্ধু অববাহিকার নগর সভ্যতা থেকে গাঙ্গেয় অববাহিকার নগর সভ্যতার মধ্যকার পার্থক্য সম্পর্কে আপনার পর্যবেক্ষণ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে। আপনার এই পর্যবেক্ষণে আমরাও আমাদের কিছু পর্যবেক্ষণ কিংবা ধারণা যোগ করতে চাই। তবে তা করতে গিয়ে ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’র ‘বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকায় সভ্যতার গতিধারা’ শিরোনামে প্রথম অধ্যায়ের কিছু অংশ পুরাটাই তুলে ধরতে চাই :

‘দক্ষিণ এশিয়া, যাকে আমরা ভারতীয় উপমহাদেশ কিংবা ভারতবর্ষ বলে জানি, তা এক সুপ্রাচীন মানব সভ্যতার পীঠভূমি। সভ্যতা শুরু হবার অনেক আগেই এই অঞ্চলে প্রাচীন মানুষ বাস করত। পাকিস্তানের পোটওয়ার মালভূমিতে আজ থেকে কুড়ি লক্ষ বৎসরেরও আগে মানুষের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া যায়।*  বিখ্যাত প্রত্নতাত্ত্বিক জোনাথান মার্ক কেনোয়ার মনে করেন যে, এই আবিষ্কারের ফলে ‘আফ্রিকা থেকে বহির্গমন’ মতবাদ বা Out of Africa Models** দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় প্রস্তর নির্মিত যন্ত্রপাতি ব্যবহারকারী জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিকে ভালভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না।***  বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকা, বালুচিস্তান ও থর মরুভূমির বিভিন্ন অঞ্চলে পুরাতন প্রস্তর-যুগের পাথরের যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা জনগোষ্ঠীকে প্রায় ৫,০০,০০০ বৎসর আগে থেকে শুরু করে ১২,০০০ বৎসর আগে পর্যন্ত বাস করতে দেখা গেছে।****  যদি বাইরে থেকে নূতন জনগোষ্ঠী স্থানীয় জনগোষ্ঠীকে প্রতিস্থাপিত করে তাহলে পাথরের প্রযুক্তি ও বসতি বিন্যাসে পরিবর্তন দেখা যায়। এই সময়ে এই রকম পরিবর্তন না ঘটাতে ধারণা করা হচ্ছে যে, এখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ধারাবাহিকতা ছিল।*****  এরপরে আজ থেকে প্রায় নয় হাজার বৎসর আগে আফগানিস্তান, বালুচিস্তান ও সিন্ধু উপত্যকার কিছু অংশ জুড়ে কৃষি ও পশুপালন ভিত্তিক কিছু জনগোষ্ঠীকে স্থিতিশীল জীবন শুরু করতে দেখা যায়। আরো পরে ৫৫০০ খ্রীঃপূঃ থেকে ২৮০০ খ্রীঃপূঃ পর্যন্ত কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য নির্ভর বিভিন্ন জনগোষ্ঠী বৃহত্তর সিন্ধু উপত্যকার পশ্চিম, উত্তর পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় ২৬০০ খ্রীঃপূঃ-এর দিকে সিন্ধু ও ঘাগর-হাকরা (যা প্রাচীন সরস্বতী নদী) উপত্যকায় নগর সভ্যতা শুরু হয়, যাকে আমরা সিন্ধু সভ্যতা নামে চিনি। এই অধ্যায়ে প্রধানত সিন্ধু সভ্যতার বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার ও গবেষণার আরো নানা শাখায় যে সমস্ত কাজ হয়েছে বা হচ্ছে সে সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হবে।

---------------------------

* দেখুনঃ Bridget and Raymond Allchin, Origins of a Civilization: The Prehistory and Early Archaeology of South Asia, First published by Viking by Penguin Books India (P) Ltd., 1997, pp. 36-39.

** আফ্রিকা থেকে বহির্গমন মতবাদ বা Out of Africa Model অনুযায়ী এখন থেকে প্রায় ৫০,০০০ থেকে ১,০০,০০০ বৎসর আগে আধুনিক মানুষেরা আফ্রিকা থেকে কয়েকটি ধারায় এশিয়া ও ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুনঃEwen Callaway, Ancient DNA reveals secrets of human history, in, Nature, Vol. 476, August 2011, pp. 136-137; Alan R. Templeton, Out of Africa again and again, in, Nature, Vol. 416, March 2022, pp. 45-51.

*** কেনোয়ার বলেন,, ‘Most of the literature is focused on the issues of DNA studies and fossil hominid studies that suggest one or more waves of early hominin and later modern humans emerged in Africa and spread throughout the Old World. While this is not the place to present all of the competing arguments, there is increasing evidence to suggest that South Asia has an important role to play in this discussion. None of the “Out of Africa Models” adequately explains the presence of stone tool using hominin in South Asia at more than two million years ago as revealed at the well-dated site of Riwat, Pakistan, or other early sites such as Uttar Bani which still require further confirmation.’ দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, Published by Nalanda International, Los Angeles and D.K. Printworld (P) Ltd., New Delhi, 2014, p. 505.

**** দেখুনঃ Jonathan M. Kenoyer, The Archaeological Heritage of Pakistan, in, A History of Pakistan, ed., Roger D. Long, Oxford University Press, 2015, p. 4.

***** তবে এই বিষয়ে আরো তথ্য ও অনুসন্ধান প্রয়োজন বলে কোনোয়ার মনে করেন। দেখুনঃ Jonathan Mark Kenoyer, New Perspectives on the Indus Tradition: Contributions from Recent Research at Harappā and Other Sites in Pakistan and India, in, Sindhu-Sarasvatī Civilization: New Perspectives, ed., Nalini Rao, 2014, p. 506.’

---------------------------

আমাদের উদ্ধৃতির গুরুত্বটা স্পষ্টতর করার জন্য টীকা সহকারে ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা’র শুরুর অংশটুকু উদ্ধৃত করলাম। আমরা যে কথাটা বলতে চাচ্ছি তা হল আজকের আমাদেরকে ভালোভাবে বুঝতে হলে আমাদের অতীত ইতিহাসও বুঝতে হবে। আমরা কোথা থেকে এসেছি, আমাদের পূর্বপ্রজন্ম কোথা থেকে এসেছে, তারা এবং তাদের জীবন প্রণালী কেমন ছিল সেগুলি না জানলে আমাদেরকে সঠকভাবে চিনা বা বুঝা যাবে না। অর্থাৎ আমরা শুধু আজকের সৃষ্টি নই, আমাদের একটা অতীত আছে, যা অনেক প্রজন্ম নিয়ে গঠিত। সেই দিক থেকে বলতে হবে আমরা শুধু বর্তমানের মানুষ নই, আমরা অতীতেরও সন্তান। সামাজিক মানুষকে বুঝতে তাই সমাজ ও ইতিহাসের যে গতিধারায় মানুষ গড়ে উঠে তাকে বুঝাটা সবচেয়ে বড় করণীয়।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

কথাটা বলতে চাইছি গ্রাম ও শহর প্রসঙ্গে আলোচনা উত্থাপন করতে গিয়ে। প্রথমে আসা যাক গ্রাম প্রসঙ্গে। গ্রাম তো মূলত কৃষিজীবী বা কৃষকদের বসতি। কিন্তু এই গ্রাম যে মানুষরা গড়ে তুলছে তারা কোন ঐতিহাসিক ও সামাজিক অভিজ্ঞতা কিংবা গতিধারায় বেড়ে বা গড়ে উঠেছে তার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠবে তাদের দ্বারা গঠিত গ্রাম এবং অবশ্যই সেই সঙ্গে গ্রাম-সমাজের চরিত্র-বৈশিষ্ট্যও।

প্রত্নতত্ত্ব এখন আমাদেরকে জানাচ্ছে যে, ভারতবর্ষে প্রস্তর হাতিয়ারধারী মানুষ ২০ লক্ষ বৎসর আগে থেকে উপস্থিত ছিল। এছাড়া বালুচিস্তান, বৃহত্তর সিন্ধু অঞ্চল এবং থর মরুভমির বিভিন্ন স্থানে আজ থেকে ৫ লক্ষ বৎসর আগে থেকে ১২ সহস্র বৎসর পূর্ব পর্যন্ত সময়ব্যাপী পুরাতন প্রস্তর যুগের নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীর মানুষকে নিরবচ্ছিন্ন ধারায় বাস করতে দেখা গেছে। হাতিয়ার এবং বসতি বিন্যাসের ধারাবাহিকতা থেকে প্রত্নতাত্ত্বিকরা জনগোষ্ঠীর অভিন্নতা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

অর্থাৎ এটা বুঝা যাচ্ছে যে, দক্ষিণ এশিয়ার উত্তর-পশ্চিমের অঞ্চলগুলিতে লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে মানুষ বাস করেছিল। শুধু তা-ই নয়, এখন আমরা অনুমান করি এই মানুষগুলির উপজাতি ও গোত্রসমূহ লক্ষ লক্ষ বৎসর ধরে মোটামুটি শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়েছিল। অর্থাৎ শুধু যে শেষ হিমযুগের চাপে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে মানুষরা ভারতের বিষুব অঞ্চলে এসে ঘনবদ্ধভাবে বাস করতে বাধ্য হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে অভ্যস্ত হয়েছিল ব্যাপারটা তা নয়। বরং শেষ হিমযুগের পূর্ব থেকেই বহু লক্ষ বৎসর ধরে এমন একটা ঐতিহ্য ভারতে গড়ে উঠেছিল। সেই ঐতিহ্যের ভিত্তিভূমির উপর দাঁড়িয়ে সর্বশেষ হিমযুগে দাক্ষিণাত্যের কোনও এক জায়গায় এক বা একাধিক উপজাতি লাঙ্গলভিত্তিক কৃষির প্রবর্তন করে বলে আমরা অনুমান করি। এ সম্পর্কে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’র ‘রামায়ণ ও কৃষি বিপ্লব’ নামক অধ্যায়ে আমাদের আলোচনা আছে।

এর মধ্যে যুদ্ধ আছে বৈকি! তবে সেটা সমাজের মূল সুর নয়, মূল বৈশিষ্ট্য নয়। বহিরাক্রমণে যুদ্ধ হতে পারে। এছাড়া কিছু যুদ্ধ হয়ত সমাজের ক্রান্তিকালীন কোনও উৎক্ষেপ মাত্র। এ ধরনের ব্যতিক্রমী যুদ্ধ শেষ হলে সমাজ ফিরে গেছে তার চিরাচরিত শান্তির ধারায়। অর্থাৎ ভারতবর্ষে মানব প্রজাতির বিকাশকে লক্ষ লক্ষ বৎসরের প্রধানত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারায় দেখা উচিত হবে। লক্ষ লক্ষ বৎসর কালব্যাপী পরস্পর সংলগ্ন হয়ে জীবন যাপন করতে গিয়ে এতসব উপজাতি ও গোত্র পরস্পরকে শুধু সহ্য করতে নয়, উপরন্তু চিনতে ও জানতেও বাধ্য হয়েছিল। স্বাভাবিক নিয়মে তাদের মধ্যে সহাবস্থানের তাগিদে কিছু রীতি-নীতিও গড়ে উঠেছিল এবং ঘটেছিল কিছু বিনিময়ও। ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতার বিকাশে শান্তিপূর্ণ ধারার প্রাধান্যকে তার এই সুদীর্ঘ প্রাচীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখা উচিত হবে। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতাসহ ভারতবর্ষের সকল সভ্যতা গড়ে উঠেছে তার বহু লক্ষ বৎসরকালের এই ঐতিহ্যকে কম-বেশী ধারণ করে।

লাঙ্গল ভিত্তিক কৃষির সঙ্গে মানুষের স্থায়ী আবাস হিসাবে গ্রামের উদ্ভব ও বিকাশ অনিবার্য। কারণ পশুপালের মত কৃষিভূমিকে সাথে করে নিয়ে বেড়ানো যায় না। অস্থিতিশীল এবং কিছুটা ভ্রাম্যমাণ উদ্যান কৃষি থেকে লাঙ্গল-চাষে মানুষের উত্তরণ ছিল প্রকৃত অর্থে যুগান্তকারী বিপ্লব। এরপর স্বাভাবিকভাবে আসতে পারে নগর এবং নগর সভ্যতা এবং সেই সঙ্গে রাষ্ট্র। প্রায় প্রতিটি যুগান্তকারী পরিবর্তনের সঙ্গে হয়ত সংযু্ক্ত হয়েছে যুদ্ধ, কিন্তু ভারতের সমাজ পুনরায় ফিরে গেছে তার দীর্ঘস্থায়ী শান্তিপূর্ণ গতিধারায়। এরই এক জীবন্ত দৃষ্টান্ত সম্রাট অশোক। পৃথিবীর আর কোথায়ও তাই যুদ্ধ জয়ের পর অনুতপ্ত সম্রাটের পথ পরিবর্তনের মত দৃষ্টান্ত খুঁজে পাওয়া যায় না। মানুষ এভাবে পথ ও মত পরিবর্তন করে বিরাট ব্যর্থতা বা পরাজয় হলে। যেমনই হোক ভারতীয় সমাজের মূলধারাকে চিনতে হবে বহু হাজার নয়, বরং বহু লক্ষ বছরের মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা ধারা হিসাবে। যুদ্ধ হবে, তা যুদ্ধ করবে, কিন্তু তারপরেও তা ফিরতে চাইবে তার চিরচেনা শান্তিপূর্ণ ও সহিষ্ণু জীবনধারায়।

সুতরাং গ্রাম থেকে নগর গড়ে উঠবার পথে এখানে যুদ্ধ হলেও যুদ্ধনির্ভর রাষ্ট্র এখানে সেভাবে গড়ে উঠে না। সিন্ধু সভ্যতা তার সাক্ষ্য দেয়। সুতরাং এখানে গ্রাম-সমাজ আর পৃথিবীর অন্য সমাজগুলির গ্রাম-সমাজের রূপ ও বৈশিষ্ট্য এক রকম হবার কথা নয়। এখানে তাই সমাজ আর রাষ্ট্রের সীমানা নিরূপণ করা অনেক সময় সম্ভব হয় না। এমনকি গাঙ্গেয় অববাহিকার প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতাতেও।

আমরা অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতার আদি হরপ্পান পর্যায়ে যখন গ্রাম এবং গ্রাম-সমাজ গড়ে উঠছিল তখন সেখানে গ্রাম শাসনের জন্য যেমন পঞ্চায়েত জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছিল তেমন বহু গ্রাম ও গ্রাম-সমাজকে সমন্বিত করার জন্যও পঞ্চায়েত জাতীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছিল। নগর ছিল এই সমন্বয় কেন্দ্র। আমরা এই সমন্বয় এবং পরিচালনার সমগ্র কাজকে ব্যবস্থাপনাও বলতে পারি। এর মধ্যে ছিল নদী নিয়ন্ত্রণ ও জল বণ্টনের সামগ্রিক কর্মকাণ্ড। সেই সঙ্গে ছিল প্রয়োজনীয় প্রতিরক্ষার এবং বিদ্যাশিক্ষার ব্যবস্থাপনা। বৃহৎ এলাকায় এই সামগ্রিক ব্যবস্থাপনাকে আমরা রাষ্ট্র বলতে পারি। সম্ভবত বিদ্যাশিক্ষার প্রতি এই সভ্যতা ছিল অসাধারণভাবে মনোযোগী। মুসলিম আক্রমণে ধ্বংস হবার পূর্ব পর্যন্ত টিকে থাকা নালন্দার মত বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ সেদিকেই কিন্তু ইঙ্গিত দেয়।

যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের এই ব্যবস্থাপনার রূপ ও চরিত্রের সঙ্গে সমকালীন মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন কিংবা পরবর্তী কালের গ্রীস এবং রোমের রূপ ও চরিত্রকে মিলাতে চাওয়া ভুল হবে। ঐসব রাষ্ট্র এবং সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ও সমাজের বহু কিছুই মিলবে না। অন্য সকল সভ্যতায় রাষ্ট্র উপর থেকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে চাপানো তথা বহিরারোপিত ব্যবস্থা। কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র হচ্ছে সামাজিক ব্যবস্থাপনার বিকশিত বা ক্রমবিবর্তিত রূপ। এটা প্রধানত সমাজের ভিতর থেকে উঠে আসা একটা পরিচালনা-যন্ত্র। সেই দিক থেকে দেখলে রাষ্ট্রকে সমাজ থেকে বেশী একটা পৃথক করে দেখা যাবে না।

পরবর্তী ভারতবর্ষে গাঙ্গেয় অববাহিকায় যখন নগর সভ্যতা গড়ে উঠছে তখন সিন্ধু সভ্যতার নাগরিকতার বহুকিছু আর না থাকলেও গ্রাম-সমাজের নিয়ন্ত্রণের প্রবল রূপ কিন্তু থেকে গেছে। আমাদের মনে হয়, সিন্ধু সভ্যতা-পরবর্তী কালের সমাজ ও সভ্যতার গতিধারার উপর সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের স্মৃতির প্রচণ্ড প্রভাবকেও আমাদের হিসাবে নিতে হবে।

আসলে সিন্ধু সভ্যতা ছিল বিপুল সংখ্যক মানুষের সভ্যতা। প্রত্নতাত্ত্বিকরা সেখানে পঞ্চাশ লক্ষের মত মানুষ বাস করত বলে অনুমান করেন। আমাদের অনুমান নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে হিসাবে নিলে এই জনসংখ্যা এক কোটি থেকে তিন কোটিও হতে পারে। যাইহোক, আমরা যদি পঞ্চাশ লক্ষও মেনে নিই তবু প্রাচীন পৃথিবীতে সেটাই একটা বিশাল সংখ্যা। এত বিশাল এবং কাল প্রেক্ষিতে অত্যুন্নত একটা সভ্যতার ধ্বংসের আঘাত জনমনে কত প্রচণ্ড ও ভয়ঙ্কর হতে পারে তা অনুমেয়। পরবর্তী সামাজিক বিকাশধারার উপর এর প্রভাব বা ফলাফলকে আমাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত হবে, বিশেষত তার মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়াকে।

আমাদের ধারণা এই আঘাতকে উপমহাদেশের সমাজ ও সভ্যতা কখনই আর পুরাপুরি কাটিয়ে উঠতে পারে নাই। যে ধারায় সিন্ধু সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার বিরুদ্ধে এক প্রবল ও গভীর প্রতিক্রিয়াও ঘটেছিল। শুধু বৈদিক কিংবা তার পরবর্তী রূপ হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নয়, জৈন এবং বৌদ্ধ ধর্মও এই প্রতিক্রিয়াকে অনেকাংশে ধারণ করেছিল। ফলে এই ধর্মগুলির ভিতরে এক ধরনের জীবনবিমুখতা ও বৈরাগ্য এত গভীর। জৈন বা বৌদ্ধ ধর্মের মত বৈরাগ্য হিন্দু ধর্মে অতটা দৃশ্যমান না হলেও এটাকে অতিক্রম করে তা উঠতে পারে নাই। সভ্যতার বিরুদ্ধে ইসলামের মত হিংস্র আক্রমণাত্মক না হলেও সভ্যতা নির্মাণের প্রতি ভারতীয় এই ধর্মগুলির এক ধরনের অনীহা লক্ষ্যণীয়।

প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষে সিন্ধু সভ্যতার মত আর নাগরিক সভ্যতা কখনই গড়ে উঠে নাই। অবশ্য পরিবর্তিত ঐতিহাসিক পরিস্থিতিতে এর জন্য যে ধরনের নৃশংসতার চর্চা করতে হত তাকে ভারতীয় সমাজ কখনই মেনে নিতে পারে নাই। ফলে তা সর্বদা এমন নিম্নমাত্রার নগর সভ্যতায় সন্তুষ্ট থেকেছে যেখানে সামাজিক বৈষম্য তুলনায় যথেষ্ট সংযত থেকেছে এবং সমাজের সাধারণ মানুষদের অধিকার যতটা সম্ভব রক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে কিংবা রক্ষা পেয়েছে।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

ভারতবর্ষের সমাজের শক্তির এক বিশাল উৎস তার পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থা। এটা শুধু গ্রামের ব্যবস্থা নয়। এটা সমগ্র সমাজে প্রায় সর্বস্তরে বিস্তৃত ছিল। পঞ্চায়েত কোনও স্থায়ী পরিষদ বা কমিটি নয়। এটা সমাজের যে কোনও স্তরের বা শ্রেণীর স্বশাসনের একটা ব্যবস্থা। একটা পল্লীর সকল বৃত্তির মানুষ কোনও সিদ্ধান্ত নিবার জন্য একত্র হলেই সেটা গণ্য হবে পঞ্চায়েত হিসাবে। সেখানে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে সেটা হবে পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মূল পদ্ধতি ছিল মতৈক্য বা consensus. আমাদের অনুমান এই পদ্ধতি সিন্ধু সভ্যতার কাল থেকে চলে এসেছিল। সিদ্ধান্ত গ্রহণে সংখ্যাগুরু বা সংখ্যালঘুর ব্যাপার ছিল না তা নয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণে মতভেদকে যতটা সম্ভব এড়ানো হত। সবার স্বেচ্ছাসম্মতিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ায় কোনও ব্যক্তির পক্ষে এর বিরুদ্ধে যাওয়া সাধারণত সম্ভব ছিল না।

এই পঞ্চায়েত শুধু পল্লী নয়, সমগ্র বৃহত্তর গ্রাম ভিত্তিকও হতে পারত। শুধু তাই নয়, একটা নির্দিষ্ট বর্ণজাতি বা জাতের লোকরা তাদের নিজ জাত সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত নিতে পারত। মজার ব্যাপার পঞ্চায়েত শুধু গ্রামে নয়, শহর বা নগরের বিভিন্ন মহল্লায়ও ক্রিয়াশীল হতে পারত। এমনকি ব্রিটিশ আমলে এই ঢাকা শহরের মহল্লাগুলিতেও পঞ্চায়েত ক্রিয়াশীল ছিল। আসলে পঞ্চায়েত সমাজের স্বশাসন বা ব্যবস্থাপনার এমন একটা রূপ যা খুব জীবন্ত অথচ পরিবর্তনশীল। সমু্দ্রের অক্টোপাশের সঙ্গে একে তুলনা করা যায়। দশটা বা পঞ্চাশটা গ্রামের প্রতিনিধিরা একত্র হয়ে সিদ্ধান্ত নিলেও সেটা হবে ঐ দশ বা পঞ্চাশ গ্রামের পঞ্চায়েতের সিদ্ধান্ত।

গ্রাম কিংবা পল্লীর জনগণ নিজেদের জীবনের বহুকিছুর জন্য এই পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার উপর নির্ভর করত। অর্থাৎ এটা হচ্ছে সমাজের নীচ তলার জনগণের সামষ্টিক সিদ্ধান্ত বা ইচ্ছা প্রকাশ করারও মাধ্যম। ফলে বহু সমস্যার সমাধান হত এই ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। রাষ্ট্র থাকত সবার উপর। এমনকি বহিরাগত মুসলিম শাসকরাও পঞ্চায়েতকে অর্থাৎ জনসমাজের সামষ্টিক সিদ্ধান্ত কিংবা ইচ্ছাকে মূল্য দিত। এমন একটা ঘটনার কথা উল্লেখ করা যায়। ঘটনাটা নওয়াবী শাসন কালের।

যদিও এই মুহূর্তে সূত্র মনে হচ্ছে না, তবে এটা সেই সময়কার একজন মুসলিম লেখকের বৃত্তান্ত। সেই সময় কয়েকজন বিদেশী মুসলিম বণিক জাহাজে করে বাংলায় প্রবেশ করে। তারা জাহাজ থেকে নেমে পদযাত্রায় রাজধানী মুর্শীদাবাদের দিকে যাচ্ছিল। যাত্রাপথ ছিল চব্বিশ পরগণার ভিতর দিয়ে। যাত্রাপথে ময়ূর দেখে তাদের খাবার লোভ হল। স্থানীয় হিন্দু জনগণের নিষেধ অমান্য করে তারা ময়ূর মেরে রান্না করে খায়। এখন যারা বাধা দিয়েছিল তাদের নিকট গরুর মত পবিত্র ছিল ময়ূর। যাইহোক, হিন্দুদের নিষেধ অমান্য করে ময়ূর হত্যা করায় উক্ত অঞ্চলের পঞ্চায়েত প্রতিনিধিদের দল মুর্শীদাবাদে নওয়াবের দরবারে দ্রুত উপস্থিত হয়ে অভিযোগ জানালে নওয়াবী সরকার ত্বরিত ব্যবস্থা নেয়। বণিকরা মুর্শীদাবাদে পৌঁছানো মাত্র তাদের বন্দী করে কারাগারে নেওয়া হয়। অভিযোগ হিন্দু প্রজাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের প্রতি অমর্যাদা প্রদর্শন পূর্বক পবিত্র ও পূজনীয় প্রাণী হত্যা। এই অপরাধের শাস্তি হিসাবে তাদের প্রাপ্য ছিল মৃত্যুদণ্ড। মৃত্যুদণ্ড থেকে তাদের শেষ পর্যন্ত পরিত্রাণ ঘটেছিল। তবে তার আগে তাদেরকে অনেক কষ্ট ভোগ করতে এবং যতদূর মনে পড়ে অর্থদণ্ড দিতে এবং পঞ্চায়েত কর্তৃক ক্ষমা পেতে হয়েছিল। এই ঘটনা থেকে মনে হয় অন্তত নওয়াবী আমলে মুসলিম রাষ্ট্রও হিন্দু প্রজাদেরকে নিরর্থক চটাতে চাইত না।

যতদূর মনে হয় পঞ্চায়েতমূলক স্বশাসনের ব্যবস্থা এবং সেই সঙ্গে বর্ণজাতির কাঠামো আত্মরক্ষার ক্ষেত্রে ভারতীয় সমাজকে প্রচণ্ড শক্তি দিয়েছিল, যার ফলে শত বৈরিতার মধ্যেও হিন্দু ধর্মকে অবলম্বন করে ভারতীয় সমাজ তথা সংস্কৃতি শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার কালে পেশাভিত্তিক বিন্যাস থাকলেও সেটার সঙ্গে অপরিবর্তনীয়তা এবং পবিত্রতা-অপবিত্রতার সম্পর্ক যে ছিল না সেটা বুঝা যায়। ধর্মের কালও সেটা নয়। তবে পরবর্তী কালে ক্রমে ক্রমে পেশার সঙ্গে অপরিবর্তনীয়তা এবং মর্যাদার সম্পর্ক স্থাপিত হয়। ক্রমে এটার সঙ্গে ধর্মও আসে, যার ফলে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মকে অপসারণ করে হিন্দু ধর্মের উত্থান ঘটে। হিন্দু ধর্মের উত্থানটা সমাজের ভিতর থেকে একটু একটু করে ঘটেছে বলে আমরা ধারণা করি। এই উত্থানের সঙ্গে শক-হুন ইত্যাদি বৈদেশিক আক্রমণ অভিযানের সম্পর্ক যে আছে সে সম্পর্কে আমরা ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’য় আলোচনা করেছি।

বিষয়টাকে অনেকটা এভাবে বলা যায় যে, ভারতের লোকায়ত বা নিরীশ্বরবাদী এবং সেই সঙ্গে বৌদ্ধ কিংবা জৈন ধর্মাবলম্বী সমাজগুলি শত শত কিংবা সহস্রাধিক বৎসর ধরে একটু একটু করে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক বিভাজনকে গ্রহণ করেই বৃহত্তর পরিসরে হিন্দু সমাজ গঠন করেছে যেখানে ঐক্যের মূলসূত্র হয়েছে বাহ্মণের শ্রেষ্ঠত্ব ও পবিত্রতার প্রতি আনুগত্য প্রদান। পেশা এবং বংশ বা গোত্রের ঘনিষ্ঠ ও অপরিবর্তনীয় কাঠামোর বিকাশ একটা পর্যায়ে কথিত হিন্দু ধর্মের বিকাশ ঘটিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এই ধর্মীয় ব্যবস্থায় আদর্শিক ও ব্যবহারিক নেতা হয়েছে ব্রাহ্মণ বর্ণজাতি। বলা যায় এই সমাজের আত্মা এবং মস্তিষ্ক হচ্ছে ব্রাহ্মণ।

শহর নয়, গ্রাম হচ্ছে এই সমাজের মূল শক্তিভিত্তি। অর্থাৎ কুটীর শিল্প কিংবা বাণিজ্যের পরিবর্তে কৃষি হচ্ছে এই সমাজের মূল শক্তির জায়গা। এমনকি যোদ্ধা তথা ক্ষত্রিয় বর্ণজাতি এবং তাদের দ্বারা পরিচালিত রাষ্ট্রও এখানে সমাজ দ্বারা সংকুচিত হয়ে থাকে। মুসলিম শাসনকালেও এখানে ব্রাহ্মণ নেতৃত্বাধীন সমাজ দ্বারা রাষ্ট্রের সঙ্কুচিত দশা রয়ে গিয়েছিল। তাই রাজধানী যতটা না নগর তার চেয়ে বেশী ‘গ্যারিসন সিটি’ (Garrison City) হয়ে থেকেছিল।

আসলে ভারতের গ্রাম-সমাজের শক্তি তার তুলনামূলক কৃষি সমৃদ্ধির মধ্যে নিহিত ছিল। মুসলিম শাসকরা প্রজাসাধারণের ধর্ম ও সমাজ-শাসনের ব্যবস্থায় সব সময় হস্তক্ষেপ করে নাই তাদের কর এবং রাজস্ব আদায়কে নিরাপদ রাখবার জন্য। এই কারণে কৃষিসমৃদ্ধ জনপদগুলি সাধারণভাবে হিন্দু রয়ে গেছে। যেসব স্থানে ভূমির অনুর্বরতার কারণে কৃষি দুর্বল ছিল সাধারণত সেই সব অঞ্চলে ইসলাম প্রসার লাভ করেছিল। যেমন আফগানিস্তান এবং ভারতের উত্তর-পশ্চিমের পাহাড়ী বা রুক্ষ অঞ্চলগুলি। পার্বত্য অঞ্চল কাশ্মীর সম্পর্কেও এই কথা প্রযোজ্য। পূর্ব বঙ্গ কৃষি সমৃদ্ধ হলেও নদীর ভাঙ্গন ও ভূমির অস্থিরতার কারণে এখানে সমাজ-বিন্যাস বা সামাজিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় যে দুর্বলতা ছিল তার সুযোগ নিয়ে এখানে ইসলাম তার শাসনকালে প্রবেশ করতে পেরেছিল।

যাইহোক, বিশেষ করে মুসলিম ধর্মীয়-সাংস্কৃতিক আক্রমণকে ভারত তার যে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দ্বারা সবচেয়ে কার্যকরভাবে প্রতিহত করতে পেরেছে সেটা হল বর্ণজাতিভেদমূলক সমাজ-বিন্যাস এবং তার পাশে থাকা পঞ্চায়েতমূলক সমাজ-শাসনের ব্যবস্থা। এই দুই মিলে এমন এক দুর্ভেদ্য সামাজিক-সাংস্কৃতিক আত্মরক্ষার ব্যবস্থা তা গড়ে তুলেছিল যাকে কোনও বিদেশী আক্রমণকারী ভাঙ্গতে পারে নাই। তবে সামাজিক স্বশাসনের ব্যবস্থাকে ব্রিটিশরা মূলত ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। কিন্তু মূলত অক্ষত রেখে গেছে বর্ণজাতিভেদমূলক সমাজ ব্যবস্থাকে। তাতে ব্রিটিশ শাসকদের লাভ ছাড়া ক্ষতি নাই। কারণ এটা ভারতীয় সমাজকে গ্রাম্য ব্যবস্থার এমন এক অচলায়তনে ধরে রাখে যেখানে স্বাধীন ও স্বচ্ছন্দভাবে শিল্প-সমাজ গড়ে তোলা অসম্ভব। বিশ্ব-পরিস্থিতির চাপে এবং সেই সঙ্গে বিশ্ব-পুঁজির চাপে সমাজ আগাবে না কেন আগাবে, তবে সেটা হবে হোঁচট খেতে খেতে আগানো। তাতে লাভ বিদ্যমান বিশ্ব-বাজার ব্যবস্থায় যারা ‍উপমহাদেশকে রেখে দিয়ে গেছে তাদেরই সবচেয়ে বেশী।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

অতীত ভারতের সামাজিক জাড্যের মূল ভিত্তি হিসাবে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম’কে ধরা বা বলা হয়। মার্কসও ‘স্বনির্ভর’ বা ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ’ গ্রামকে ভারতীয় সামাজিক প্রগতির সবচেয়ে বড় বাধা হিসাবে দেখেছেন। কিন্তু আসলে কি এমন গ্রাম ভারতে ছিল? আর থাকলেও কয়টা ছিল? আসলে সে ধরনের স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম কোনও কালেই ভারতে ছিল না। ওটা থাকবার কারণও ছিল না। বিভিন্ন প্রয়োজন পূরণের জন্য গ্রামগুলির পারস্পরিক নির্ভরতা এবং নগর-শহর ও গ্রামের পারস্পরিক নির্ভরতা – এগুলি বাদ দিয়ে গ্রামের কল্পনা এক বিমূর্ত কল্পনা বলে আমরা মনে করি। পৃথিবীর অধিকাংশ কৃষি-সমাজের মতই ভারতের গ্রামও ছিল পরস্পর নির্ভরশীল এবং কম-বেশী পরস্পর সংযুক্ত। একই কথা প্রযোজ্য শহরের সঙ্গে গ্রামের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও। বিচ্ছিন্ন, স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম দিয়ে অতীত বাংলা কিংবা ভারতের কুটীর শিল্পের রূপকথার গল্পের মত সমৃদ্ধিকে ব্যাখ্যা করা যাবে না।

আমাদের বুঝতে হবে একটা মাত্র বৈশিষ্ট্য ভারতকে পৃথিবীর আর সকল সমাজ থেকে ভিন্নতা দিয়েছে সেটা হচ্ছে ধর্মের কাঠামোবদ্ধ বর্ণজাতিভেদ প্রথা। পৃথিবীর আর কোনও সমাজে স্বশাসনের কোনও ধরনের ব্যবস্থা ছিল না এটা যেন আমরা মনে না করি। তবে সেই স্বশাসনকে আর কোথায়ও বর্ণজাতিভেদ প্রথার সম্মিলন এমন বিশিষ্টতা দেয় নাই যেমনটা ভারতবর্ষে দিয়েছে।

বিশেষ করে ভারতীয় সমাজে বর্ণজাতিভেদের গভীর ও প্রচণ্ড প্রভাবকে আমাদের হিসাবে নিতে হবে। কথিত স্বয়ংসম্পূর্ণ বা স্বনির্ভর গ্রাম নয়, বরং বর্ণজাতিভেদ প্রথা ভারতীয় সমাজকে আত্মবদ্ধতার এমন এক ব্যবস্থায় আবদ্ধ করেছে যেটা সমগ্র সমাজদেহকে স্থবির করে রেখেছে যুগ যুগান্ত ধরে। বর্ণজাতির বাইরে কোনও ব্যক্তির অস্তিত্ব ছিল না। (বর্ণজাতি পরিচয়কে অস্বীকার করবার উপায় কি আজও কোনও ব্যক্তির আছে?) বর্ণজাতিভেদকে অস্বীকার করার একটাই উপায় ছিল তা হল সমাজ ও সংসার ত্যাগ ক’রে সন্ন্যাসী হয়ে যাওয়া। বর্ণজাতিভেদ প্রথায় প্রতিটি বর্ণজাতির কর্ম বা পেশা এবং সামাজিক মর্যাদা অপরিবর্তনীয়ভাবে নির্ধারিত। সমাজের প্রতি প্রতিটি বর্ণজাতির দায়-দায়িত্ব যেমন বংশপরম্পরায় নির্ধারিত তেমন প্রতিটি বর্ণজাতির প্রতিও আরও বহু বর্ণজাতি নিয়ে গঠিত বৃহত্তর সমাজের দায়-দায়িত্ব সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারিত। প্রায় সবকিছু পূর্বনির্ধারিত এবং অলঙ্ঘনীয়। এটা শুধু সামাজিক প্রথা নয়, অধিকন্তু ধর্মীয় বিধান দ্বারা বিধিবদ্ধ। সুতরাং একই সঙ্গে প্রথা এবং ধর্মীয় বিধানের বিরুদ্ধে দাঁড়াবে এমন সাধ্য কার? দাঁড়ালে সমাজ থেকেই নেমে আসত সমাজ-চ্যুতি বা জাতি-চ্যুতির শাস্তি, যার সাধারণ অর্থ ছিল মৃত্যু বা ধ্বংস।

বস্তুত বর্ণজাতিভেদের ব্যবস্থায় সমগ্র সমাজ হয়েছে আত্মবদ্ধ। এটা শুধু গ্রামের ব্যাপার নয়। শহর বা নগরও এই ব্যবস্থার ঊর্ধ্বে নয়। এমনকি রাষ্ট্রও নয়। যুদ্ধ ও রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষমতা ও দায়িত্ব যাদের হাতে তারাও ক্ষত্রিয় হিসাবে চিহ্নিত বর্ণজাতিতে আবদ্ধ। প্রতিটি ব্যক্তি এবং গোষ্ঠী যার যার গণ্ডী বা সীমা রক্ষায় যেমন সদা তৎপর থেকেছে তেমন অন্য কেউ যাতে তার গণ্ডী বা সীমায় অযাচিতভাবে প্রবেশ না করে সেই বিষয়েও সদা সতর্ক থেকেছে। ফলে সমগ্র সমাজ এবং প্রতিটি ব্যক্তি হয়েছে আত্মবদ্ধ। এমন অবস্থায় এখানে নূতন কিছু যেমন উদ্ভূত হতে পারে না তেমন গতিশীলতা হারিয়ে সমাজ হয়ে পড়ে স্থবির। সুতরাং নওয়াবী আমলে বাংলায় কুটীর শিল্পের এমন বিস্ময়কর বিকাশ বা বিস্তার ঘটলেও তা সমাজকে শিল্প-বিপ্লবে নিয়ে যেতে পারে নাই।

ইউরোপীয় বিচার পদ্ধতিতে অর্থনীতি সাধারণত খুব বেশী গুরুত্ব রাখায় অনেক সময় বিচারে ভ্রান্তি ঘটে। কিন্তু কৃষি এবং গ্রামের অর্থনীতির মধ্যে ভারতের সামাজিক অচলায়তনের উৎস নিহিত বলে আমাদের মনে হয় না। এখানে অর্থনীতি থাকতে পারে। কিন্তু অর্থনীতির ভূমিকা এখানে খুব গৌণ। এটা মূলত একটা সামাজিক বিষয় যেটাকে ঠিকভাবে বুঝতে চাইলে একটা সমাজকে তার ঐতিহাসিক বিকাশ ধারায় ফেলে বুঝতে হবে। আর তখন আসবে তার সংস্কৃতি। এটা অর্থনীতির বিষয় ততটা নয়, যতটা একটা সমাজের উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া আত্মপরিচয় নিয়ে বেঁচে থাকতে চাওয়ারও বিষয়। ভারতবর্ষের বিশেষ ঐতিহাসিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে ব্রাহ্মণরা মানুষের এই চাওয়ার ব্যাপারটাকে ঠিকমত ধরতে বা ব্যবহার করতে পারায় তারা শেষ অবধি সফল। তবে এটাই আবার ভারতবর্ষকে অচলায়তনে তলিয়ে দিয়েছে। তবে ভারতের প্রেক্ষিতে যান্ত্রিক না হয়ে চোখ-কান খুলে বর্ণজাতিভেদ প্রথার ইতিবাচক দিকটাকেও বিচারে নিয়ে আজ তা থেকে মুক্তির পথ সন্ধান করতে হবে। এখন বর্ণজাতিভেদ যতই ক্ষতিকর এবং বর্জনীয় হোক এক সময় এটাই যে সেই প্রতিক্রিয়ার অন্ধকার কালটাতে ভারতবর্ষকে নিম্নমাত্রায় হলেও তার সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে রক্ষার ক্ষমতা দিতে পেরেছিল এটা বুঝলে আজ অভিশাপে পরিণত এই ব্যবস্থা থেকে হিন্দু সমাজের মুক্তির পথে সঠিক পদক্ষেপও দিতে পারা যাবে।  

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

উপরে আমরা যা লিখলাম তার অনেকটা আপনার বক্তব্যের প্রেক্ষিতে আমাদের মনে যে চিন্তাগুলি এসেছে সেগুলিকে বলবার চেষ্টা করা। এগুলি থেকে আপনার কিছু প্রশ্নের উত্তর হয়ত পাবেন। তবে আপনার আরও কয়েকটা প্রশ্ন আছে যেগুলির কিছু উত্তর এখন যতটা সম্ভব সংক্ষিপ্ত আকারে দিতে চেষ্টা করব। যেমন আপনি প্রশ্ন তুলেছেন সিন্ধু সভ্যতায় বাঁধ ধ্বংসের আন্দোলনকে পরিবেশবাদী আন্দোলন বলা যাবে কিনা। অবশ্যই তা যাবে। ঋষিরা তো নদী-প্রবাহের মুক্তির দাবী ঘোষণা করেই এই আন্দোলন সংগঠিত করেছিলেন।

এখন সমস্যা হচ্ছে সভ্যতা যেহেতু কৃত্রিম জীবনে মানুষকে নেয় সেহেতু পরিবেশবাদের প্রকৃত মর্মার্থ কিন্তু সভ্যতাকে পরিত্যাগ করে আদিম প্রাকৃতিক জীবনে ফিরে যাওয়াও হতে পারে। সেটা কি সম্ভব? বাস্তব হচ্ছে সম্ভব নয়। সুতরাং বাস্তব হচ্ছে এ দিক থেকে দেখলে ঋষিদের চাওয়াটা প্রতিক্রিয়াশীল এবং ক্ষতিকর। কিন্তু তারপরেও এই দাবী বহুসংখ্যক মানুষের প্রাণের দাবী হয়েছিল। আসলে সবকিছুরই শেষ থাকে। জীবনের পর মৃত্যুর মত। সিন্ধু সভ্যতারও মৃত্যু বা ধ্বংসের সময় হয়েছিল। যা দিয়ে তার এমন বিস্ময়কর উত্থান স্বাভাবিকভাবে তার অনিবার্য সঙ্কট ও ব্যর্থতা দিয়েই তার পতন হয়েছে। মৃত্যু যেমন জীবনকে অর্থহীন করে না তেমন সভ্যতার অবসান বা ধ্বংসও তাকে মূল্যহীন করে না। তার মূল্যায়ন হবে তার ভূমিকা দিয়ে।

যাইহোক, সেই অর্থে আমরা পরিবেশবাদী না হলেও প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় ভারসাম্যপূর্ণ কর্মনীতি অনুসরণের প্রয়োজন আমরা অনুভব করি। এ কথা ভুললে ভুল হবে যে, আমরা প্রকৃতির অংশ। সুতরাং প্রকৃতিকে ধ্বংস করা আমাদের অস্তিত্বের ভিত্তিকেই ধ্বংস করা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু কিছুটা হলেও প্রকৃতির বিরুদ্ধে না গিয়ে সভ্যতাকে এগিয়ে নিবার উপায় কোথায়? কিন্তু এরও একটা সীমা থাকা উচিত। অবশ্য সেখানেও প্রশ্ন আসবে সীমাটা কোথায় বা কোন পর্যন্ত যাবে? শেষ পর্যন্ত এটা আমাদের খুব জটিল একটা প্রশ্নের সম্মুখীন করে, যার সহজ কোনও উত্তর নাই।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

কলিম খান ও রবি চক্রবর্তী সম্পর্কে আমরাও কিছু জেনেছিলাম এক সময়। তাদের কিছু বক্তব্যও পড়েছিলাম। তারা মৌলিক কিছু কাজ করছেন বলে মনে হয়েছিল। তবে খুব বেশী দিকে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না বলে পরে আর তাদের বক্তব্য নূতন করে জানবার চেষ্টা করি নাই।

এখন বেদেদের সম্পর্কে সামান্য বলব। পূর্ব বঙ্গে কিন্তু বেদে বলা হয় না। এখানকার ভাষায় তারা হচ্ছে বাদিয়া বা সাধারণ মানুষদের ভাষায় বাইদ্যা। বাদিয়া থেকে বাইদ্যা। এর সঙ্গে শাস্ত্রীয় বেদ বা বিদ্যার সম্পর্ক কতটা আছে তা আমাদের পক্ষে বলা সম্ভব না। বেদে সম্প্রদায়ের জীবন সম্পর্কে আমাদের প্রত্যক্ষ জ্ঞানও নাই। তবে ভারতবর্ষের বিভিন্ন জনজাতি বা সমাজ সম্পর্কে এখন কিছু মূল্যায়ন করতে গেলে আমরা খুব সতর্ক হই। কারণ এখন আমাদের নিকট এখানকার মানুষ শুধু বহু হাজার নয়, অধিকন্তু বহু লক্ষ বছরের প্রায় অবিচ্ছিন্ন ধারাকে প্রতিনিধিত্ব করে। শুধু গারো নয় বা চাকমা নয়, সাঁওতাল ইত্যাদি জনজাতি নিয়ে ভাবতে গেলে এখন অনেক প্রশ্নের উত্তর নূতন করে খুঁজতে হয়।

মধ্যপ্রাচ্য বলে কথা নয় পৃথিবীর দূর বিস্তারী বিভিন্ন জনপদে বিভিন্ন সময়ে যাওয়া ভারতীয়দেরকে পাওয়া যাবে। আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় তার কিছৃ ইঙ্গিত দিয়েছি। শুধু ইহুদী নয় আমাদের অনুমানে মক্কার কুরাইশরাও ভারত থেকে যাওয়া জনগোষ্ঠী। বিপর্যয় শুধু সিন্ধু সভ্যতার পতন কালে ঘটে নাই। তার বহুকাল আগে শেষ হিমযুগের অবসানকালে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির ফলে এক বিরাট মানবিক বিপর্যয় ঘটেছিল। সেই সময় বহু মানুষ আরব, মধ্যপ্রাচ্য বা আরও দূর দেশে গিয়ে থাকতে পারে। মনুর প্লাবণ তো তারই স্মৃতিবাহী উপাখ্যান। কয়েক লাখ বছরের মানব ইতিহাসের কতটুকু আমাদের জানা আছে?

গারো বা চাকমাদের নিয়ে ভাবলেও অনেক প্রশ্নের উত্তর এখনও আমাদের কাছে নাই। চাকমারা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তবে ধর্ম যা-ই হোক, চাকমারা গোঁড়া নয়, বরং যথেষ্ট উদার। এক সময় মার্কসবাদী রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব ছিল তাদের যুবকদের মধ্যে। বিশেষত ষাটের দশকে পাহাড়ী শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের প্রায় সবটাই ছিল মার্কসবাদী কিংবা ঐ রাজনীতি প্রভাবিত। এটা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, চাকমারা ধর্মীয় প্রশ্নে উগ্র না হলেও পার্বত্য চট্টগ্রামে খ্রষ্টান মিশনারীদের তৎপরতার ঘোর বিরোধী।

চাকমা এবং বিশেষত গারোদের সম্পর্কে বঙ্গরাষ্ট্রে যা বলা আছে তার বেশী এখন আর বলার মত তেমন কিছু আমাদের নাই। খ্রীষ্টান মিশনারীরা অবশ্য গারো সমাজের প্রভূত ক্ষতি করেছে এবং করছে। এ সম্পর্কে বঙ্গরাষ্ট্রের নিবন্ধে কিছু ইঙ্গিতও আছে। নূতন করে কাজ করার অবস্থায় আমরা কেউ এখন নাই। তবে গারো জনজাতি সম্পর্কে আমরা গুরুত্ব সহকারে অধিকতর অনুসন্ধান করার পক্ষপাতী। সেটা যদি কোনও দিন কোনও বাঙ্গালী সত্যান্বেষী করে তবে তখন হয়ত আমরা আরও নূতন কিছু জানব এবং ভাববও।

তবে শেষ করার আগে গারো জাতি সম্পর্কে বলব গারোরা তাদের জাতিকে সাধারণত মান্দি বা মান্দে বলে। মান্দি অর্থ মানুষ। এই মান্দি শব্দের উৎপত্তি কি আদি মানুষ ‘মনু’ থেকে? গারো ভাষায় ধর্মকে ‘থরম’ বলা হয়। থরম স্পষ্টতই ধর্মের রূপান্তর। গারোদের নামকরণ সাধারণত সংস্কৃত ভাষা থেকে শব্দ নিয়ে করা হয়। কেন? প্রশ্নটুকু থাকুক।

আজ এ পর্যন্ত। শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ।

ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক

 শামসুল আলম চঞ্চল

 

Apr 25, 2023,1:49 PM

প্রিয় মানিক ও চঞ্চলবাবু,

গত ১৭ মার্চ, ২০২৩ তারিখের যৌথপত্রে আপনারা ভারতের গ্রাম-সমাজ সম্পর্কে নিজস্ব অভিমত দিয়েছেন। বলতে গেলে আমি একমত আপনাদের বক্তব্যের সাথে। সেই সাথে আমার নিজের কিছু মতের সংশোধন ও পরিমার্জন করে নেব।

আমি একমত আপনাদের সাথে যে, 'স্বয়ংসম্পূর্ণ' গ্রাম বলে বাস্তবে কিছু দেখা যায়নি। এ ক্ষেত্রে পশ্চিমের শিক্ষিত সমাজ একপ্রকারে আমাদেরকে বিপথে চালানোর চেষ্টা করেছে। মার্কসের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে, তিনি ভারত সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ব্রিটিশ রিপোর্টের ওপরই নির্ভর করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ফলে মধ্যবয়স্ক মার্কস ভারতের গ্রাম অথবা সার্বিক বিচারে এশিয়ার গ্রাম-সমাজ সম্পর্কে যা মন্তব্য করবেন, তার নেতিবাচক সমালোচনায় ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থের হিসেব দেখতে পাওয়া যাবে। সে-ক্ষেত্রে প্রশ্ন জাগবে, ভারতের গ্রামীণ অর্থনীতি ভেঙে ফেলার এত তাগিদ ছিল কেন ব্রিটিশদের? কৃষির পতন ঘটানো তাদের লক্ষ্য ছিল না, কারণ উপনিবেশের কৃষির রক্ত চুষেই ব্রিটিশ নাগরিকদের বিলাস-ব্যসন চলত। ফলে ভারতের ব্রিটিশ প্রভুরা অন্য উদ্দেশ্যেই পূর্ব ভারতের গ্রামীণ কাঠামোর পতন ঘটাতে চেয়েছিল। এই প্রসঙ্গেই আলোচনায় আসবে পঞ্চায়েতের কথা। মানিকবাবুর একটি রচনা আছে 'বঙ্গরাষ্ট্র'-এ; সেটি হল 'ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে পঞ্চায়েত'। কয়েকটি গ্রাম সংঘবদ্ধ স্থানীয় প্রশাসনের মতো কাজ করত এই পঞ্চায়েত। এখন সর্বক্ষেত্রে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে গেলে ব্রিটিশ সরকার আর কৃষিভিত্তিক জনসমাজের মাঝে প্রশাসনিক বাধা হয়ে দাঁড়াবে এই পঞ্চায়েত। একটা স্থানীয় প্রশাসনের যতো কাজ করায় এলাকার মানুষকেই ঠকিয়ে অন্যায় কিছু হাসিল করে নেওয়া পঞ্চায়েতের অধিকর্তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তার ওপর ছিল জনমতের বিপুল চাপ। ব্রিটিশরা প্রথমত স্থানীয় পরিসরে স্বায়ত্তশাসন রাখতে চায়নি, দ্বিতীয়ত, দেশীয় জনমতের ভিত্তিতে ব্রিটিশরা সরকার বসায়ওনি। আমার অনুমান, প্রধান শত্রু এই আপাত স্বনির্ভর সমাজের শিরদাঁড়া ভেঙে ফেলার মনোভাবকে কার্যকরী করতে গিয়ে পঞ্চায়েতের অস্তিত্বের কথা সরকারিভাবে চেপে গিয়েছিল ব্রিটিশরা। আর নিরিবিলি গ্রামবাংলার পঞ্চায়েতি কাঠামোর ক্ষতিপূরণ হিসেবে 'স্বয়ংসম্পূর্ণ, একক' গ্রামের ধুয়ো তুলল সাদা চামড়ার বানিয়ারা। ফলে তাত্ত্বিকভাবে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন, কারণ স্বনির্ভর গ্রামের অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে তা থাকার কথা নয়। বড়োজোর 'অধিক পরিমাণে যোগাযোগ' তৈরি করা, তথা সরকারি স্বার্থে রেলপথ বসানোর ছুতোটাকে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য ব্রিটিশরা 'বিচ্ছিন্ন' গ্রামের গল্প ফাঁদে বলে আমার বিশ্বাস ।

এবার আমি আসব একটু অতীতের আলোচনায়। সব ব্যাপারে নিশ্চিত না-হলেও কিছু সংশয় নিয়েই শুরু করব ভারতবর্ষের সাবেকি গ্রামব্যবস্থা নিয়ে আমার বক্তব্য।

প্রথমে বলব গ্রামের স্বয়ংসম্পূর্ণতার বিষয়ে। বিচ্ছিন্ন গ্রাম আদৌ সম্ভব কিনা, সেটা পরীক্ষা করে মেপে দেখার বিষয়। কিন্তু স্বয়ংসম্পূর্ণতার অর্থ হল নিজের এলাকার মধ্যেই চাহিদা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জিনিসের ব্যবস্থা করে নেওয়া। আর ভারতের গ্রাম-সমাজ, অর্থাৎ একটা বড়ো এলাকার গ্রামসমষ্টির মধ্যে প্রয়োজন অনুযায়ী যোগান পাওয়া যেত কমবেশি। এই হিসেবে একটি মাত্র গ্রাম না-হোক, একটা গ্রামসমষ্টির এলাকাকে স্বয়ংসম্পূর্ণ, একক সমাজ বলা যেতে পারে না? জীবনধারণ আর ভোগের জিনিস উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে এই স্থানীয়করণের প্রবণতা অন্ত্যকালীন সিন্ধু সভ্যতার বিনগরায়নের সাথে সম্পর্কিত হয়ে থাকতে পারে। তাহলেও সাধারণ কিছু বিষয় (ধর্মীয় উৎসব বা বড়ো আকারের বাণিজ্য) বাদ দিলে একেকটি পঞ্চায়েত ও আরও সংকীর্ণ অর্থে একেকটি গ্রামীণ এলাকাকে দৈনন্দিন জীবনযাপনের নিরিখে কি 'আঞ্চলিক পৃথিবী' বলা যায় না? স্বয়ংসম্পূর্ণতার যুক্তিটাকে আমি গ্রাম থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে পঞ্চায়েতের আধারে প্রতিস্থাপন করলাম মাত্র।

দ্বিতীয় বক্তব্য বলব গ্রামের উদ্ভবের বিষয়ে। এটা খুবই সঠিক বক্তব্য যে, গ্রাম বলতে মূলত চাষবাস এবং কিছু আনুষঙ্গিক বৃত্তির ওপর নির্ভরশীল সমাজ বোঝায়। পরবর্তীতে আমরা একাধিক গ্রামের মধ্যেকার প্রশাসনিক ঐক্য হিসেবে পঞ্চায়েতকেও দেখছি। সবশেষে সমাজের থেকে আরও ওপরে রাজাদের সরকারি কাঠামোও খুঁজে পাচ্ছি। পঞ্চায়েত সেই হিসেবে সমাজের প্রথার সাথে এমনভাবে সম্পৃক্ত হয়ে থাকত যে, পঞ্চায়েতকে আলাদা করে গভর্নমেন্ট বলে মনে হবার কথা নয়; তার চেয়ে একে সমাজের স্বশাসন বলাই সঙ্গত। এ ছাড়াও বলব, লিখিত সংবিধান সমাজ আর প্রশাসনের তফাতকে পরিষ্কার করে তোলে। কিন্তু সমাজের প্রথা থেকেই যদি প্রশাসনের ভিত্তি তৈরি হয়, যা মুখের কথায়, কাজের ভাষায় পরিচালিত হবে, তবে সেই স্বশাসনে লিখে রাখার মতো, লিখিত নির্দেশ না মানলে বলপ্রয়োগের যতো ব্যবস্থার প্রয়োজন পড়বে না। আমাদের পঞ্চায়েত কি সে-রকমই সামাজিক সংঘ ছিল না? তাহলেও প্রশ্ন আসে একাধিক গ্রামের মধ্যে প্রশাসনিক ঐক্য আনার কোনো প্রয়োজন ছিল? একেকটা গ্রামের মধ্যেই কি সমস্তরকম বৃত্তির সমাবেশ ঘটানো যেত না; অন্য গ্রাম থেকে দ্ৰব্য সরবারহের প্রয়োজন ছিল? পঞ্চায়েতের মধ্য দিয়ে গ্রামগুলির সামাজিক ভারসাম্য রক্ষা পেল, অথচ গ্রামগুলি পরস্পরের সাথে মিশে গিয়ে পঞ্চায়েতটাই একটা বিরাট গ্রাম-তল্লাট হয়ে উঠতে পারল না কেন? একেকটি পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় প্রত্যেকটা গ্রামেরই কমবেশি একটা নিজস্ব নাম, মন্দির বা সাধারণের চাষের জমি নিয়ে এত পৃথক অস্তিত্ব ধরে রাখা কী করে সম্ভব হল, ঐক্য-ভারসাম্য-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠাই যদি পঞ্চায়েতের লক্ষ্য হয়ে থাকে? রাজার রাষ্ট্রকে আলোচনায় আনছি না; বলপ্রয়োগের জন্য সৈন্যবাহিনীর আস্ত বৃত্তিই সেখানে উপস্থিত। পঞ্চায়েতের শাস্তিমূলক ভিত্তি বড়োজোর একঘরে করে দেওয়া। ব্রাহ্মণদের সমাজের সাথে খাপ খাইয়ে' নেবার চালাকি ই শুধু পঞ্চায়েতের অস্তিত্বের পেছনে দায়ী? পঞ্চায়েত নাম হয়তো ছিল না সেই যুগে, অন্য নাম থাকতে পারে গ্রামগুলির সমবায়ের। আমার উত্তরের এই পিডিএফ ফাইলটির সাথে বিশ শতকের বাংলার এক বিস্মৃত পণ্ডিত, অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের দুটি রচনা একটি পিডিএফ ফাইলে পাঠালাম। পরবর্তী বৈদিক যুগে সমিতি বা সভা কীভাবে গ্রাম ও নগরের মাঝে ভারসাম্য বজায় রাখত, বেদের সংহিতা ও অন্যান্য শাস্ত্রগ্রন্থ উদ্ধৃত করে তিনি সেগুলি নিয়ে সংক্ষেপে আলোচনা করেছেন। তার সমিতির ধারণা আরও প্রাচীন। উপজাতীয় ধরনের কাঠামো সেটা। তখনও ব্রাহ্মণদের 'সমাজপতি' (সমাজে থেকেই সমাজ বশে থাকলে 'রাষ্ট্রপতি' হবার কি প্রয়োজন?) হবার যুগ আসেনি। অর্থাৎ আমি বলতে চাইছি গ্রাম ও পঞ্চায়েতের উদ্ভব ও পারস্পরিক সম্পর্ক আরও প্রাচীন প্রথার উত্তরাধিকার বহন করে। কিন্তু এতে করে পৃথক পৃথক গ্রামের অস্তিত্বের সমস্যাটা ব্যাখ্যা করা যায় না। কৃষিই আমাদের পরিচিত গ্রামগুলির ভিত্তি। কিন্তু বিভিন্ন আঞ্চলিক সমাজ দেখা যায়, যেখানে গ্রামের অস্তিত্ব বর্তমান, কিন্তু কৃষির চল নেই সেভাবে। চাষবাসের চল থাকলেও সেটা গৌণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। তাহলে গ্রাম বলতে যা বুঝি, ছোটো আকারের এই সামাজিক সংগঠন কি অ-কৃষিজাত সমাজ থেকে এসেছে, যারা সিন্ধু সভ্যতার বাইরের অস্ট্রাল বা আরণ্যক আদিবাসী ধরনের সমাজ? কিন্তু আপনাদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, পঞ্চায়েতের গঠন সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত স্বায়ত্তশাসনের উত্তরসূরী। তাহলে একটা সাহসী প্রশ্ন করা যায়: সিন্ধু সভ্যতার বাইরের জনগোষ্ঠী যদি গ্রাম-সমাজের আদি উদ্ভাবক হয়ে থাকে আর পঞ্চায়েত কাঠামো যদি সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত স্বশাসনকে নির্দেশ করে, তাহলে গ্রামসমষ্টির ওপর পঞ্চায়েতের শাসনকে কি কৃষি-বহির্ভূত জাতিকে কৃষি অনুসারী করে তোলার শাসনপ্রণালী বলা যেতে পারে? এই যুক্তি ধরে নিলে অঞ্চলের বিচারে সম্প্রসারণমুখী সিন্ধু কৃষিজনতা আর গঙ্গাপারের সংকোচনমুখী স্থানীয় চাষিদের তফাতটা ভালোভাবে ব্যাখ্যা করা যাবে। শুধু তা- ই নয়, পঞ্চায়েতের মোড়কে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্রাহ্মণদের কৃষি বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে যাবার তাৎপর্যকেও ধরা যাবে।

পঞ্চায়েতের অস্তিত্ব আর পরবর্তীকালে তাতে ব্রাহ্মণদের অংশগ্রহণের সম্ভাবনাটা বললাম। তাহলে আরেকটি বিষয় উঠে আসে। তা হল: গ্রামের একেকটি পাড়ায় একেকটি সামাজিক বৃত্তি অনেক আগেই তৈরি হয়েছিল। বর্ণভেদের মধ্যে যে বৈশ্য বর্ণ আছে, তারাই মূলত অর্থনৈতিক বর্ণ; কৃষি, পশুপালন ও বাণিজ্য তাদের কাজ। অন্য দুটি এলিট বর্ণের কথা বাদ দিলেও শূদ্রের অস্তিত্ব মনুস্মৃতির আগে অনেক রচনাতেই পাওয়া যায় না। আম্বেদকর বা রামশরণ শর্মা বলেন শূদ্ররা নাকি ক্ষত্রিয়দের সাথে আদি রাজা ছিল। পরে ব্রাহ্মণরা নাকি তাদের বংশগুলোকে সমাজচ্যুত করে। কিন্তু সমাজের মধ্যে যে হীন জাতিভেদ ছিল এককালে, সেটা পেশাগত ভেদাভেদ ছাড়া আর কী? চামার ঘৃণিত নয়, চামারের কাজ ঘৃণিত। আবার বংশপরম্পরায় একেকটা পেশা চলে আসছে, তাই ব্যক্তিবিশেষ তো বটেই, গোটা চামার সম্প্রদায়টাই ঘৃণিত হবে। এভাবেই কি পেশার আধারে বর্ণজাতিভেদ প্রথা আরও প্রবল রূপ নেয়নি? আমি এখানে আরেকটা দিক তুলে ধরব। ব্রাহ্মণরা যদি এতটা ভেদাভেদের জন্ম দিয়ে থাকায় সফল হয়, তাহলে গ্রামনির্ভর ভারতের সমাজে এতটা ঐক্যবদ্ধতা কী করে সম্ভব? রাজা থাকলে তবেই 'বিভাজন আর শাসন'-এর নীতি খাটা সম্ভব। কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে ব্রাহ্মণরা রাজা হত না, হতে চাইতও না বিশেষ। তাহলে একটা সম্ভাবনা বেরিয়ে আসে যে, পঞ্চায়েত বা গ্রাম-সমাজে মহল্লাভিত্তিক বংশগত পেশা অনেক আগে থেকেই ছিল; ব্রাহ্মণরা কোনোভাবে কোনো একটা যুগসন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে ওই সমাজের মধ্যে ভেদাভেদের বীজ বপন করায় সফল হয়েছিল। বাংলার বৌদ্ধ আমলে সে-রকম গ্রাম সমাজ দেখি আমরা; সেন আমলের বামুনদের লাফঝাঁপে বর্ণজাতির ভেদ আরও মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। এই দিক থেকে পাল আমল থেকে সেন আমলে গ্রাম-সমাজের বৈষয়িক গঠনের পরিবর্তনটাকে আলোচনা করা যেতে পারে। তার সাথে মুসলিম আগ্রাসনে ব্রাহ্মণরা সাময়িকভাবে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ায় গ্রাম-সমাজে বর্ণভেদ শিথিল হয়ে পড়ে ঐক্যবদ্ধতার শক্তি আরও বেড়ে উঠেছিল কিনা, এ বিষয়ে গভীর গবেষণা প্রয়োজন।

☆ ☆ ☆

এবার অন্য প্রসঙ্গে যাব একটু। সিন্ধু সভ্যতার আলোচনায় আসার আগে কমিউনিস্ট সমাজ নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছি আমি। কমিউনিস্ট ধারায় যে-সমস্ত ধারণা অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করে, সিন্ধু সভ্যতার আলোকে তার অন্তত দুটো বিষয়ের পুনর্মূল্যায়ন করব।

১) ১৮৭১ সালের ১৮ মার্চ প্যারিস শহরের পৌর এলাকায় ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনলাভ করার পর প্যারিসের শ্রমিকদের ঘর থেকে উঠে আসা প্রতিনিধি সরাসরি পৌরসভাকে নিজেদের অধীনে নিয়ে আসে। ফাটকাবাজদের কেন্দ্রীভূত ফরাসি রাজতন্ত্রকে উপেক্ষা করে গোটা ফরাসি সাম্রাজ্যকে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের নিরিখে ভেঙে উৎপাদনশীল সমাজ হিসেবে পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করে প্যারিসের শ্রমিকরা। ফলস্বরূপ ব্যাপক সংঘর্ষ হয় এবং ৫০,০০০ শিশু-নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ নির্বিশেষে পাইকারি হারে কমিউনার্ডদের কচুকাটা করার পর ভার্সাইয়ের অস্থায়ী সরকার প্যারিস পুনর্দখল করে। ৭২ দিনের মাথায় প্যারিসের শ্রমিক সরকারের পতন ঘটে। এরপর পৃথিবীতে আর কখনও শ্রমিকরা সরকারে আসেনি সরকারি; যাও বা এসেছে, সে-সব শহুরে বাবু সমাজের কৃপার অনুদান হাত পেতে নিয়ে। তাই মার্কসের বলা শ্রমিক পার্টি দেখি না ইতিহাসে একটাও, যা দেখি, তা হল কমিউনিস্ট পার্টি। শ্রমিক আর কমিউনিস্ট এক বস্তু নয় ।

এবার আসি প্যারি কমিউনের সরকারি নীতির জায়গায়। গ্রাম থেকে মহাজনদের শেষ করে দেওয়া থেকে শহরের বড়ো আকারের কারখানায় নির্বাচনভিত্তিক অধিকর্তা নিয়োগ, রাষ্ট্র-শিক্ষা-গির্জাকে পৃথক করা এবং সর্বোপরি ফরাসি সাম্রাজ্যকে সাধারণ উৎপাদক জনতার ভোটাভুটির ওপর দাঁড় করানোর চেষ্টা, যার ফলশ্রুতিতে লোকায়ত ধরনের স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠিত হত বলে আমার মনে হয়েছে। প্যারিসের কমিউন প্রতিষ্ঠার নেপথ্যে হাজার হাজার বছর আগের লুপ্ত সিন্ধু সভ্যতার লোকায়ত স্বশাসনের শক্তি কাজ করছিল কি? এটা কমিউনিজমের তত্ত্বকে সিন্ধু সভ্যতার লোকবাদী আদর্শের নিরিখে পুনর্বিচারের চেষ্টা আমার।

২) কমিউনের পেছনে সিন্ধু লোকায়তিক রাষ্ট্রের ঐতিহ্য অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করেছিল বলে আমার ইদানিং মনে হয়। ফরাসি ইতিহাস প্রসঙ্গে আমার দ্বিতীয় বক্তব্যে সেই কথার আরেকটু বেশি প্রতিধ্বনি পাবেন আপনারা।

ফরাসি বিপ্লবের সময় সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতার দাবিকে কেন্দ্র করে সাম্য আর ন্যায়পূর্ণ সমাজ গঠনের দাবি রাজনীতির প্রকাশ্য ময়দানে জায়গা করে নেয়। রুশোর কথা বলব। তাঁর 'সামাজিক চুক্তি'র ধারণা অনুসারে, মানুষ সভ্যতা তৈরি করেছিল এক সহযোগিতাপূর্ণ বোঝাপড়ার মধ্য দিয়ে, কিন্তু ক্রমেই সেটা অন্যায়ের সমাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এরপরে ইউটোপীয় সমাজতন্ত্রের ধারণাও বিকাশলাভ করে, যাকে মার্কসীয় সমাজতন্ত্রের তাত্ত্বিকরা সমালোচনা করেছেন যথেষ্ট পরিমাণে। সিন্ধু সভ্যতা প্রসঙ্গে আপনারা যা আলোচনা করেছেন, তাতে সহযোগিতা বা 'সামাজিক চুক্তি'র মধ্য দিয়ে সভ্যতার নির্মাণ একমাত্র এই ভারতীয় উপমহাদেশ বা দক্ষিণ এশিয়াতেই হওয়া সম্ভব। কিন্তু মার্কসীয় তত্ত্ব ফরাসি বিপ্লবের সমকালীন ধারণার বিপরীতে বলে যে, সভ্যতার ভিত্তিই হল অল্পসংখ্যকের হাতে গরিষ্ঠের দাসত্ব। তখনকার যুগে আজকের মতো প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ছিল না আমাদের কাছে। কিন্তু আজ তো আছে! অর্থনৈতিক বৈষম্য আর সামরিক বলপ্রয়োগের ওপর সভ্যতা আর রাষ্ট্র দাঁড়িয়ে রয়েছে বরাবর-- এঙ্গেলসের বহুপ্রচারিত এই মার্কসীয় ধারণাকে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন দিয়েই খণ্ডন করার সময় এসে যায়নি কি?

আমি বলছি না ইউটোপীয় সমাজতন্ত্র বা রুশো প্রমুখের বক্তব্যকে নিয়ে মাতামাতি করতে। তবে এটাও কি অস্বীকার করা যাবে যে, সিন্ধু সভ্যতার লোকায়তিক রাষ্ট্রের আদর্শ বহু সহস্র বছর ধরে টিকে থেকেছে পৃথিবীতে আর প্রথম ফরাসি বিপ্লব ও প্যারি কমিউনের মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে যার সমাজতান্ত্রিক বহিঃপ্রকাশ?

আজকের মতো এটুকুই বলব। আপনাদের উত্তরের আশায় থাকব। আপনারা দুজনে সুস্থ থাকবেন। আপনাদের কুশল কামনা করে আজকের মতো বিদায় নেব।

ইতি, অভিরূপ মুখোপাধ্যায়

 

Jun 30, 2023, 6:52 PM

২৫ এপ্রিল, ২০২৩ তারিখে অভিরূপ মুখোপাধ্যায় কর্তৃক প্রেরিত পত্রের উত্তর

প্রেরণ তারিখ : ৩০ জুন, ২০২৩

প্রিয় অভিরূপ বাবু,

আপনার সর্বশেষ পত্রসহ ইতিপূর্বেকার আপনার বিভিন্ন পত্রে আপনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের অবতারণা করেছেন। আশা করি সেগুলির মধ্যে সবগুলির না হলেও অনেকগুলি প্রশ্নের উত্তর আমরা দিয়েছি। আপনার বিভিন্ন সময়কার প্রশ্নগুলির উত্তর দিতে গিয়ে আমাদেরকে সমাজ, রাষ্ট্র ও সামাজিক কর্তৃত্ব গঠন ইত্যাদি বহুবিধ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হয়েছে। অন্যান্য প্রাচীন সভ্যতার সমান্তরালে গঠিত হলেও বহু বিষয়ে প্রায় সম্পূর্ণভাবে ভিন্ন চরিত্র ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ সংক্রান্ত প্রশ্নগুলির উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাদেরকে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে শ্রেণী, কর্তৃত্ব, সামাজিক নেতৃত্ব গঠন ইত্যাদি বিষয় নিয়ে ভাবতে হয়েছে। বিষয়গুলি নিয়ে সুদীর্ঘ কাল আমরা ভেবেছি এবং প্রচলিত গণ্ডী ভেঙ্গে বেরিয়ে আমাদের মতো করে উত্তর বের করার চেষ্টা করেছি। শামসুজ্জোহা মানিকের লিখা মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যৎ (http://bangarashtra.net/article/395.html) যদি পড়ে থাকেন তবে সেখানে মার্কসবাদের কেন্দ্রে অবস্থিত এই বিষয়গুলি সম্পর্কে তার যে বক্তব্য পড়েছেন সে সম্পর্কে আমরা উভয়ে মূলত একমত পোষণ করি।

আমাদের কাছে সবই আপেক্ষিক বা relative. ন্যায়, সাম্য, সুবিচার ইত্যাদি সব ধারণা কিংবা বাস্তবতাই আপেক্ষিক। অতএব শ্রেণীহীন নিরঙ্কুশ সাম্যের ধারণাও ভ্রান্ত। দুইটি প্রাণ যখন পরস্পর যুক্ত বা সম্পর্কিত হয় তখন তাদের সম্পর্কের মধ্যে কম অথবা বেশী অসমতা দেখা দেয়। কারণ সবার ক্ষমতা হুবহু সমান হয় না সব ব্যাপারে। নারী, পুরুষের সম্পর্কই দেখুন না! এক ক্ষেত্রে নারী শ্রেষ্ঠ হতে পারে, অপর ক্ষেত্রে পুরুষ। সভ্যতায় এসে সম্পর্কের জটিলতা এবং অসমতা অবিশ্বাস্য রকমভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। পারস্পরিক প্রয়োজন যেমন বহু মানুষকে একত্র করে তেমন তাদের মধ্যকার পরস্পর বিরোধী প্রবণতা বা প্রয়োজন তাদেরকে বিভক্ত বা পরস্পর বিরুদ্ধও করতে পারে। এভাবে সমাজ, জাতি, রাষ্ট্র গঠিত হয়, আবার বিভক্তও হয়। সমাজ, জাতি কিংবা রাষ্ট্র গঠনের প্রক্রিয়াকে আমরা গোষ্ঠী গঠনের প্রক্রিয়াও বলতে পারি। আসলে গোষ্ঠীবদ্ধতা বা গোষ্ঠী গঠন এবং তার ভাঙ্গনের মাধ্যমে নবতর গোষ্ঠী গঠনের গতিধারায় নিহ্তি রযেছে মানুষের এগিয়ে যাওয়ার শক্তি। মজার ব্যাপার হচ্ছে পুরাতন বা বিদ্যমান গোষ্ঠী ভাঙ্গতে গিয়ে মানুষকে প্রথমে এক অর্থে একা বা ব্যক্তি হতে হয়, আবার নবতর গোষ্ঠী গঠন করতে গিয়ে আপেক্ষিক বা তুলনামূলক অর্থে হলেও একটা পর্যায়ের জন্য তার ব্যক্তিসত্তাকে গৌণ করতে এমনকি বিসর্জন দিতে হতে পারে।

এই অবস্থায় আমরা নিরঙ্কুশ বা বিশুদ্ধ সত্য কোথায় খুঁজে পাব বলুন? তবু আমরা আপেক্ষিক বা তুলনামূলক অর্থে কিংবা একটা সময়ের জন্য তাকে খুঁজি। আসলে মানুষ বলে কথা নয়, বরং কোনও প্রাণই বিশুদ্ধ সত্তা নয়। সুতরাং মানুষের শুদ্ধ সত্তার সন্ধান করেও লাভ নাই। তবু সেটা আপেক্ষিক বা তুলনামূলক বিচারে আছে বা থাকে বৈকি! তবে ঐ যে বললাম তাকে দেখতে হবে আপেক্ষিক অর্থে।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

যাইহোক, আমাদের অভিজ্ঞতা এবং ইতিহাস পাঠ থেকে আমরা আপেক্ষিক অর্থে একটা আদর্শ বা শুদ্ধ সভ্য সমাজ হিসাবে সিন্ধু সভ্যতাকে দেখতে পেয়েছি। আপেক্ষিক অর্থে হলেও এ ধরনের একটা বিস্ময়করভাবে সাম্য, ন্যায়, শান্তি ও গণতান্ত্রিক চর্চা ভিত্তিক সভ্যতার ভিত্তিটা যেমন একদিনে নির্মিত হয় নাই তেমন তার অস্তিত্বও সম্ভব হয়েছিল বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক ও ঐতিহাসিক পটভূমিতে। এ বিষয়ে আমরা আমাদের যৌথ গ্রন্থ সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রার দ্বিতীয় খণ্ডে আলোচনা করেছি। আশা করি সেটা পড়েছেন।

সুতরাং সিন্ধু সভ্যতাকেও দেখতে হবে বিশেষ কাল ও স্থানের পরিপ্রেক্ষিতে। প্রাচীন পৃথিবীতে এমন সভ্যতা নজিরবিহীন। কারণ আর কোথায়ও এমন একটি প্রাচুর্যপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র শান্তিপূর্ণভাবে গড়বার মতো বাস্তবতা ছিল না। এ বিষয়ে সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রায় আলোচনা করায় এ প্রসঙ্গে আর বেশী কথা বলব না। অন্যদিকে, নদীর দুই তীরবর্তী বাঁধ ছাড়াও নদীর মাঝ বরাবর জলকপাটযুক্ত বাঁধ দিয়ে নদীগুলিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বিশাল ভূভাগকে শস্যভাণ্ডার রূপে গড়ে তুলবার সুযোগও আর কোথায়ও ছিল না। এমনকি সেটা সিন্ধু সভ্যতার ভূমিসংলগ্ন বিশাল গঙ্গা অববাহিকতাতেও ছিল না। এ বিষয়ে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ পর্যন্ত দুই খণ্ডে প্রকাশিত সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রায় ( http://bangarashtra.net/article/1538.html এবং http://bangarashtra.net/article/1546.html) আলোচনা করায় এখানে তার পুনরুক্তি ঘটাতে চাইছি না।

স্বাভাবিকভাবে যুদ্ধে লৌহাস্ত্র ও বিশেষত অশ্বের ব্যবহার প্রবর্তনের পর শান্তিপূর্ণ ধারায় গড়ে উঠা সিন্ধু সভ্যতার অবসান এমনিতেই অনিবার্য হয়েছিল। অপর দিকে, নদীখাতে পলি সঞ্চয়জনিত কারণে নদীর মাঝবরাবর স্লুইসগেট বা জলকপাটসমূহ অকার্যকর হওয়া, একই কারণে বারবার নদীখাত পরিবর্তন, কোথায়ও জলাবদ্ধতা ও বন্যা, কোথায়ও জলশূন্যতা ও মরুকরণ এবং ভূমির লবণাক্ততা ‍বৃদ্ধির ফলে ক্রমবর্ধমানভাবে ফসল উৎপাদন হ্রাস ইত্যাদি কারণে এক সময় বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রবর্তিত কৃষিব্যবস্থায় সঙ্কট ও বিপর্যয় দেখা দিলে সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্বের ভিত্তি ভেঙ্গে পড়ে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি পৃথিবীর বৃহত্তম ও মহত্তম ব্রোঞ্জ সভ্যতার পতনকে অনিবার্য করে তুলেছিল।

খ্রীষ্টপূর্ব ১,৯০০ অব্দে অর্থাৎ আজ হতে ৩ হাজার ৯ শ’ বছর আগে সিন্ধু সভ্যতার অবসান হয়েছে। কিন্তু তার সুগভীর প্রভাব তাকে আবেষ্টন করে থাকা বৃহত্তর ভারতীয় উপমহাদেশ কখনই পুরাপুরি অতিক্রম করতে পারে নাই। সিন্ধু সভ্যতার অহিংসা, সাম্য ও গণতন্ত্রের ভাবপ্রেরণা নিয়ে অনেক পরবর্তী কালে গড়ে উঠেছে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মতো ধর্মগুলি। বিশেষত বৌদ্ধ ধর্ম এক সময় উপমহাদেশের সীমানা পার হয়ে আন্তর্জাতিক ধর্মে পরিণত হয়েছে। সিন্ধু সভ্যতার অহিংস চেতনা কিংবা গণতন্ত্র ও রাষ্ট্র বা সমাজ পরিচালনার বিষয়গুলি নিয়ে আমরা সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রার ১ম (http://bangarashtra.net/article/1538.html ) ও ২য় (http://bangarashtra.net/article/1546.html) খণ্ডে মোটামুটি বিশদ আলোচনার চেষ্টা করেছি।

এটা নিশ্চয় তাৎপর্যপূর্ণ যে, মুসলিম আগ্রাসন ও শাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত সময়ে রাজতন্ত্র গড়ে উঠলেও সেভাবে দর্শনীয় রাজপ্রাসাদের চিহ্ন পাওয়া যায় না। এটা কি বিস্ময়কর নয় যে, রাজধানী পাটলিপুত্রে অবস্থিত আসমুদ্রহিমাচল বিস্তৃত সুবিশাল সাম্রাজ্যের অধিকারী সম্রাট অশোকের রাজপ্রাসাদও ছিল কাষ্ঠনির্মিত। এই ঘটনা এই বাস্তবতাকে তুলে ধরে যে, রাজতন্ত্রের যুগেও ভারতীয়দের শাসনকালে রাজা ও প্রজায় খুব বেশী ব্যবধান ছিল না, যে ব্যবধানটি পরবর্তী সমগ্র মুসলিম শাসনকালের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল। সুতরাং মুসলিম শাসনকালে রাজপ্রাসাদ ছিল আড়ম্বরপূর্ণ ও জাঁকালো এবং দুর্গ দ্বারা সুরক্ষিত। অর্থাৎ প্রাক-মুসলিম যুগে রাজা ও প্রজা তথা রাষ্ট্র ও সমাজের সম্পর্কের মধ্যে বৈষম্য যে অনেকটাই সংযত ছিল সেটা এই স্থাপত্য নির্মাণের বৈশিষ্ট্য থেকেই অনুমান করা যায়। এ কালে বরং বিশালায়তনের বৌদ্ধ বিহার বা মঠ এবং বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা হিন্দু মন্দিরগুলির স্থাপত্য নিদর্শন অনেক ধ্বংসের পরেও আজ অবধি নানানভাবে তাদের অস্তিত্বের জানান দিয়ে আমাদেরকে বিস্ময়াভিভূত করে। এ প্রসঙ্গে মুসলিম হানাদার ইখতিয়ার উদ্দীন মুহাম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী কর্তৃক ধ্বংপ্রাপ্ত বঙ্গসংলগ্ন নালন্দা বৌদ্ধ বিহার ও বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উল্লেখ করা যায়, যার গ্রন্থাগার ছিল নয়তলা ভবনবিশিষ্ট এবং তাতে ছিল নব্বই লক্ষ গ্রন্থ বা পাণ্ডুলিপি। ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে বখতিয়ার খলজী যখন নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংস এবং নিরস্ত্র ছাত্র-শিক্ষক ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের গণহারে হত্যা করে তখন সেটা ছিল দেশ-বিদেশ থেকে আগত দশ হাজার ছাত্র, দেড় থেকে দুই হাজার শিক্ষক এবং আজ আমাদের নিকট অজ্ঞাত সংখ্যক বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণী পদচারণা মুখর শিক্ষা ও সেই সাথে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান।* বঙ্গের বরেন্দ্রভূমির পাহাড়পুর কিংবা কুমিল্লার ময়নামতীর বৌদ্ধ বিহার এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলির ধ্বংসস্তূপ আজ আমাদের একই সাথে ব্যথিত ও বিস্মিত করে। বহিরাগত হানাদার মুসলিম শাসকদের অগণিত ধ্বংসকাণ্ডের পরেও ভারতবর্ষব্যাপী বিস্তৃত বহুসংখ্যক প্রাচীন হিন্দু মন্দির কিংবা সেগুলির পুনরুদ্ধারকৃত স্থাপত্য ভারতবর্ষের সমাজশক্তির অন্তর্নিহিত দিকটিকে আমাদের সামনে উন্মোচিত করে।

---------------------------

* নালন্দা ধ্বংসের সময় ১২০৫ খ্রীষ্টাব্দ, যা প্রত্নতাত্ত্বিক এইচডি সংকালিয়ার উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ Lokesh Chandra, Nalanda University, in, Purātattva, No. 46, Indian Archaeological Society, New Delhi, 2016, p. 189.) 

---------------------------

এটা আমাদের নিকট স্পষ্ট যে, মুসলিম আগ্রাসনের পূর্বকাল পর্যন্ত ঐতিহাসিক কালে ভারতীয় সমাজের প্রাণশক্তির প্রকাশ ঘটেছিল প্রধানত তার ধর্ম তথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান এবং বিস্ময়কর হলেও তার সমান্তরালে কিংবা আশ্রয়ে গড়ে উঠা লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে। সুতরাং সমাজ ও রাষ্ট্র রাজকীয় সুখ-সম্ভোগ ও আড়ম্বর আয়োজনের পিছনে অর্থ-সম্পদ ও সময় ব্যয়ের পরিবর্তে সেই অর্থ-সম্পদ ও সময় ব্যয় করেছে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে বৌদ্ধ-জৈন বিহার ও তৎসংলগ্ন বিশ্ববিদ্যালয় বা বিদ্যালয় এবং একইভাবে হিন্দু মন্দির প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণের পিছনে। অবশ্য হিন্দু মন্দিরের পাশে অতিকায় বিশ্ববিদ্যালয় না থাকার বিষয়টি তাৎপর্যপূর্ণ। এ থেকে এটি বুঝা যায় যে, ধর্ম চর্চা ও শিক্ষার বাইরে শিক্ষার অন্যান্য শাখার প্রতি হিন্দু সমাজের আকর্ষণ ও মনোযোগের ঘাটতি ছিল। সুতরাং প্রাথমিক শিক্ষার বাইরে তাদের মনোযোগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আমাদের সামনে সেভাবে নাই বলাই উচিত হবে।

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

ভারতবর্ষের ঐতিহাসিক যুগের এই বৈশিষ্ট্য তার সামাজিক দুর্বলতাকেও উন্মোচিত করে বলে আমরা মনে করি। সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রশক্তির প্রতি তুলনামূলক অবহেলা। আমরা অনুমান করি রাষ্ট্রশক্তি তথা যুদ্ধনির্ভর রাষ্ট্র নির্মাণের প্রতি উপেক্ষার উত্তরাধিকারও ভারতবর্ষ লাভ করেছে সিন্ধু সভ্যতার নিকট থেকে।

সমাজতলের প্রয়োজনকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে রাষ্ট্র তথা সমরশক্তির গুরুত্বকে খাটো করে দেখার মাশুল উপমহাদেশকে দিতে হয়েছে প্রথম দিকে বিশেষত শক-হুন ইত্যাদি বহিরাগত হানাদার এবং পরবর্তী কালে মুসলিম হানাদারদের অধীনতা বরণ ক’রে। এটা ঠিক যে, হিন্দু ধর্মকে অবলম্বন করে ভারতীয় উপমহাদেশ তার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনেক কিছুকে রক্ষায় সমর্থ হয়েছে। কিন্তু বিনিময়ে দিতে হয়েছে বিপুল মূল্য। ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে আরব হানাদার মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয় ও লুণ্ঠনকে* হিসাবে ধরলে ইংরেজদের হাতে ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয় পর্যন্ত সহস্রাধিক বৎসর কাল ভারতের এক বৃহদাংশ বহিরাগত মুসলিম শাসন, শোষণ ও লুণ্ঠনের নিগড়ে আবদ্ধ থেকেছিল।

---------------------------

* সিন্ধুর প্রাচীন ইতিহাস চাচনামাহ্-র মূল গ্রন্থে এই সময়কে ৭৩ হিজরী সন হিসাবে বলা হয়েছে।  মূল অনুবাদক ৭১১ খ্রীষ্টাব্দ বলে উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী (অনূদিত), চাচনামাহ্ঃ সিন্ধের প্রাচীন ইতিহাস, অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪, পৃঃ ১৩০, ১৩১, ১৯৯।) 

---------------------------

অবশ্য মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু জয়ের পর মুসলিম আগ্রাসনের ঢেউগুলি কিছু কালের জন্য স্তিমিত হয়ে আসে। কিন্তু দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে মুহাম্মদ ঘুরীর নেতৃত্বে মুসলিম আগ্রাসনের যে নবতরঙ্গ ভারতের উপর আছড়ে পড়ে* সেটা ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে ইংরেজদের বাংলা জয় পর্যন্ত সময়কে ধরলে প্রায় পাঁচশত পঁচাশি বৎসর কাল স্থায়ী হয় এবং এরপর ইংরেজদের নিকট ভারতের নবরূপের পরাধীনতা প্রায় দুইশত বৎসর কাল স্থায়ী হয়।

---------------------------

* ঐতিহাসিক কাশিম ফিরিশতা উল্লেখ করেছেন যে, মুহাম্মদ ঘুরী ৫৬৭ হিজরী বা ১১৭২ খ্রীষ্টাব্দে মুলতান অধিকার কারেন। এই হিসাবে পাঁচ শত পঁচাশি বৎসর হয়। দেখুনঃ মুহাম্মদ কাশিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, Translation of Ferista’s History of Muslim Conquest of India, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৭, পৃঃ ১৩২।

---------------------------

মুসলিম ও ইংরেজদের বহিরাগত শাসন ও আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ ছিল না, তা নয়। কিন্তু তারপরেও এটা বাস্তবতা যে, সাফল্যের তুলনায় ব্যর্থতার পরিমাণই অনেক বেশী। ইংরেজ শাসনের অবসানের পিছনে ভারতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের বীর নায়ক সুভাষ চন্দ্র বসুর যে ভূমিকাই থাকুক এ ক্ষেত্রে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইংরেজদের সামগ্রিক বিপর্যয় সর্বাধিক ভূমিকা রেখেছিল। অবশ্য নেতাজী সুভাষ বসুর বীরোচিত ভূমিকা ইংরেজ শাসনের অবসানকে ত্বরান্বিত যে করেছিল সে কথা নিশ্চিত করে বলা যায়। তা না হলে ইংরেজ শাসকরা কখন ভারতবর্ষ থেকে বিদায় নিত তা বলা সম্ভব নয়।

সুদীর্ঘ কালব্যাপী বহিরাক্রমণ ও শাসন প্রতিরোধে উপমহাদেশের সামগ্রিক ব্যর্থতার কারণ অনুসন্ধান ইতিহাস অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ করণীয় বলে আমরা মনে করি। এটা সমাজতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিষয়ও বটে। আর এ ক্ষেত্রে এ ধরনের বহিরাক্রমণ প্রতিরোধে অন্যান্য সমাজের সফল দৃষ্টান্তগুলি আমাদের সামনে বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে দেখা দেয়।

আমাদের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে প্রথমে আমরা ইউরোপের পশ্চিম ও পূর্ব এই দুই প্রান্তের দুইটি অভিজ্ঞতা তুলে ধরব। একটি স্পেন, অপরটি রাশিয়ার অভিজ্ঞতা। তারিক ইবনে যিয়াদ ও মুসা ইবনে নোসিরের নেতৃত্বে ৭১০-৭১১ খ্রীষ্টাব্দে আরব মুসলিম হানাদার বাহিনী সমুদ্র পার হয়ে স্পেন দখলের অভিযান শুরু করে।*

---------------------------

* Muhammad Abdullah Enan, Decisive Moments in the History of Islam, Published by Shaikh Muhammad Ashraf, Kashmiri Bazar, Lahore, 1940, p. 44.

---------------------------

একটা সময় মুসলিম বাহিনী প্রায় সমগ্র আইবেরীয় উপদ্বীপ জয় ক’রে ফ্রান্সের সীমানায় প্রবেশ করে। তবে ফ্রান্সের সেনাবাহিনীর নিকট আরব মুসলিম বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর তাদের অগ্রাভিযান থেমে যায়। কিন্তু স্পেন আরব পদানত থাকে সাত শতাব্দীর অধিক কাল। আরব মুসলিমদের অধিকারে ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রয়ে যায় স্পেনের সর্বদক্ষিণে অবস্থিত গ্রানাডা।  ঐ বৎসর স্পেনের খ্রীষ্টান শক্তির হাতে গ্রানাডা দুর্গের পতন হলে স্পেন তথা ইউরোপের পশ্চিম প্রান্তে মুসলিম আধিপত্যের চির অবসান ঘটে। এর পরের অভিজ্ঞতা ইসলামের জন্য ছিল ভয়াবহ। চার্চের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী স্পেনে অবস্থিত প্রতিটি মুসলিমের সামনে তিনটি বিকল্প দেওয়া হল। ইসলাম ত্যাগ করে খ্রীষ্টধর্ম গ্রহণ, স্পেন ত্যাগ করে মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর আফ্রিকায় গমন, অথবা মৃত্যুবরণ। যারা প্রথম দুই বিকল্পের একটিও গ্রহণ করল না তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা হল। এখন আমরা যেমনই মনে করি, স্পেন তথা পশ্চিম ইউরোপ ইসলামের সমস্যা সমাধানের জন্য অত্যন্ত নিষ্ঠুর পন্থা বেছে নিয়েছিল।

১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দ পশ্চিম ইউরোপ ও বিশেষত স্পেনের জন্য জয়যাত্রা সূচনার বৎসর। এই বৎসরে গ্রানাডা দখলের মাধ্যমে স্পেন থেকে মুসলিম শাসনের শেষ চিহ্নকেই শুধু উচ্ছেদ করা হল না, অধিকন্তু এই বৎসর অর্থাৎ ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনের প্রতিনিধি হিসাবে ক্রীস্টোফার কলম্বাস ভারত পৌঁছাবার সমুদ্র-পথ আবিষ্কার করতে গিয়ে আমেরিকা মহাদেশে পৌঁছাবার পথ আবিষ্কার করেন। বিশেষত এই পরবর্তী ঘটনার ফল হল শুধু স্পেন নয়, অধিকন্তু সমগ্র পশ্চিম ইউরোপের জন্য যুগান্তকারী। এরপর বিকাশমান ইউরোপীয় শক্তি সমস্ত পৃথিবী ব্যাপী তাদের সাম্রাজ্য ও উপনিবেশ স্থাপনের অভিযান শুরু করল।

এ হল পশ্চিম ইউরোপের ঘটনা। এবার আমাদের আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করার জন্য বল্কান অঞ্চলের উপর আলোচনা না করে আমরা রাশিয়ার অভিজ্ঞতার দিকে একটু দৃষ্টি দিব। মোঙ্গলিয়ায় চেঙ্গিসের উত্থানের পর বিভিন্ন রাজ্যে বিভক্ত রাশিয়া মোঙ্গল অধিকারভুক্ত হয়। মোঙ্গলরা তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য সর্বত্র রক্তপিপাসু এবং ধ্বংসাত্মক নীতি অনুসরণ করতে পছন্দ করত। রাশিয়ায়ও তার ব্যতিক্রম হয় নাই। রাশিয়ায় মোঙ্গল আধিপত্য প্রায় আড়াইশ’ বছর স্থায়ী হয়। শেষ দিকের মোঙ্গল শাসকদের মধ্যে যারা রাশিয়াসহ পূর্ব ইউরোপের উপর আধিপত্য বজায় রেখেছিল গোল্ডেনহোর্ড হিসাবে পরিচিত মোঙ্গলদের সেই অংশটি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। এদেরকে তাতারও বলা হয়। ১৪৮০ খ্রীষ্টাব্দে রুশ বাহিনী গোল্ডেন হোর্ড বাহিনীকে পরাজিত করে রুশ অঞ্চল থেকে বিতাড়ন করে। মুসলিমদের ব্যাপকভাবে খ্রীষ্টান ধর্মের অন্তর্ভুক্তকরণ, মসজিদসমূহকে গীর্জায় রূপান্তরিতকরণ ইত্যাদি নানান ভাবে রাশিয়ার মুসলিমদের বিরাট অংশকে রুশ খ্রীষ্টান সমাজের অংশ করে নেওয়া হয়। মুসলিমদের উপর উল্লেখযোগ্য মাত্রায় অত্যাচার হয় ইভান দি টেরিবল্ বা ভয়ঙ্কর ইভান হিসাবে খ্যাত রুশ জারের সময়।* বলা হয় যে, অর্ধোন্মাদ এই সম্রাটের শাসনকালে রুশ জনসংখ্যার একতৃতীয়াংশ তার বিভিন্ন সময়কার নির্দেশে নিহত হয়। সুতরাং মুসলিম মোঙ্গল বংশধরদের পরিণতি সম্পর্কে ধারণা করতে কষ্ট হয় না। এভাবে রুশ জাতি ও সমাজ তাদের মতো করে বহিরাক্রমণকারী জাতি ও সমাজের আধিপত্য ও অস্তিত্বের সমস্যার সমাধান করে। অথচ স্পেনের মতো রাশিয়ার মানুষরাও মূলত ছিল খ্রীষ্টান, যা কিনা ধর্মীয় তত্ত্ব অনুযায়ী মূলত শান্তিবাদী। স্পেনে যেমন রাশিয়াতেও তেমন খ্রীষ্টানরা বৈদেশিক হনাদার ও তাদের উত্তরাধিকারীদের হাত থেকে নিজ ভূমিকে মুক্ত করতে যীশু খ্রীষ্টের শান্তি ও প্রেমের বাণীর কোনও ধার ধারে নাই।

---------------------------

* শাসনকাল ১৫৩৩-১৫৮৪। এই সম্রাটকে ইভান ৪-ও বলা হয়। দেখুনঃ Daniel C. Waugh, The Golden Horde and Russia, in, Genghis Khan and the Mongol Empire, ed., William Fitzhugh, Morris Rossabi and William Honeychurch, University of Washington Press, 2009, p. 179.

---------------------------

এবার আমরা বহিরাক্রমণকারী কিংবা বহিরাগত শাসনকারীদের সমস্যা সমাধানে চীনের ‍ভূমিকার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। চেঙ্গিস খানের দখল অভিযানের পর চীন কম-বেশী দেড় শত বৎসর মোঙ্গল অধিকারে ছিল।*

---------------------------

*  উত্তর চীনে চিন রাজবংশের শাসনের সময় ১২১৫ খ্রীষ্টাব্দে মাঞ্চুরিয়া ও পিকিং অঞ্চল মোঙ্গলরা দখল করে নেয়। এই সময়কে চীনে মোঙ্গল শাসনের শুরু ধরা যায়। ১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে চু ইউয়ান-চ্যাং-এর নেতৃত্বে চীনা বাহিনী মোঙ্গলদের কাছ থেকে ইউয়ান নামে পরিচিত মোঙ্গল রাজবংশের রাজধানী পিকিং (বর্তমান বেইজিং) দখল করে। এই মধ্যবর্তী সময়টি ১৫৩ বৎসর। দেখুনঃ Jacques Gernet, A History of Chinese Civilization, Second Edition, Originally published in French in 1972, First published in English by Cambridge University Press, Cambridge, 1982, p.360, 361, 390.)

---------------------------

চেঙ্গিস চীন আক্রমণ ও দখল অভিযানে যে ধ্বংসযজ্ঞ চালান তাতে চীনের দশ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে দুই কোটি মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু চীনাদের প্রতিরোধ যুদ্ধে এক সময় (১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে) মোঙ্গল শাসকরা পরাজিত ও উৎখাত হয়। এরপর ছিল চীনাদের প্রতিশোধ নেওয়ার পালা। চীনে থাকা প্রতিটি মোঙ্গলকে চীনারা হত্যা করে। শুধু তাই নয়, বর্বর হানাদার শাসনের প্রতি চীনাদের ঘৃণা এমনই ভয়ঙ্কর ছিল যে, সমগ্র চীনে মোঙ্গলদের দ্বরা নির্মিত যত স্থাপনা বা ভবন ছিল সবগুলিকেই ধ্বংস করা হয়। শুধু তা-ই নয়, মাটির তলদেশ থেকে ভিত্তিমূলে থাকা ইট বা প্রস্তরখণ্ডগুলিকেও উপড়ে ফেলা হয়। অর্থাৎ সমগ্র চীনে মোঙ্গল শাসনের কোনও স্মৃতিচিহ্ন পর্যন্ত চীনারা রাখে নাই।

কিন্তু এখানেই চীনারা ক্ষান্ত হয় নাই। এরপর হাজার হাজার বছর ধরে মোঙ্গলিয়ার মরুভূমি থেকে উঠে আসা যাযাবর ও হানাদার মোঙ্গল সমস্যার চিরস্থায়ী সমাধানের জন্য চীনারা যে সিদ্ধান্ত নেয় সেটা হল অভূতপূর্ব ও অত্যন্ত নির্দয়। চীনের মহাপ্রাচীর নির্মাণ করেও মোঙ্গল আক্রমণ সমস্যার কোনও স্থায়ী সমাধান বের করা যায় নাই। সুতরাং এবার মোঙ্গল সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য মোঙ্গলিয়ার সমগ্র মোঙ্গল জনগোষ্ঠীকে হত্যার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রায় তিন লক্ষ সৈন্য দিয়ে মোঙ্গলিয়ার বিশাল ভূমিকে পরিবেষ্টন করা হল। একজনের হাত ধরে অপরজন দাড়িয়ে এই পরিবেষ্টন বা বেড় তৈরী করা হল। এই বেড় তখন সম্পূর্ণ হল যখন প্রথম চীনা সৈনিকের হাতের সঙ্গে সর্বশেষ চীনা সৈনিকের হাত মিলিত হল। এভাবে সমগ্র মোঙ্গলিয়াকে ঘেরাও করার পর ক্রমে এই বেড়কে সংকীর্ণ করে আনা হল। এবং এই বেড়ের ভিতরে যত মানুষ পাওয়া গেল তাদের প্রত্যেককে হত্যা করা হল। নারী, পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ, অসুস্থ কাউকে বাঁচিয়ে রাখা হল না। এভাবে দশ লক্ষ মোঙ্গলীয়কে হত্যা করা হল। অর্থাৎ মোঙ্গলীয় জাতির বংশধারা বা উত্তরাধিকার পর্যন্ত নিশ্চিহ্ন করা হল।

এভাবে মোঙ্গলিয়াকে জনশূন্য করা হল। কিন্তু সেটা আবার ভবিষ্যতে নূতন যাযাবর এবং বর্বর জনগোষ্ঠীর আবাস হয়ে উঠতে পারে। সেটা যাতে না হয় সে জন্য ঐতিহাসিক কাল ধরে চীনের অধিকারে থাকা এবং চীনের প্রতি অনুগত অন্তর্মোঙ্গলিয়া থেকে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মোঙ্গলদেরকে বহির্মোঙ্গলিয়া হিসাবে কথিত মূল মোঙ্গলিয়ায় পুনর্বাসন করা হল। শুধু এইটুকু নয়, বসতিস্থাপনকারী বৌদ্ধ মোঙ্গলদের উপর একজন বৌদ্ধ ধর্মগুরু হিসাবে লামাকে প্রতিষ্ঠা করা হল, যে থাকবে চীনের প্রতি দায়বদ্ধ। মোঙ্গলিয়ার ইতিপূর্বেকার অধিবাসীরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী ছিল না। তারা ছিল প্রকৃতির বিভিন্ন অলৌকিক শক্তির পূজারী। এদেরকে পেগানও বলা যায়। যাইহোক, এভাবে চীনারা মোঙ্গলিয়া থেকে চীনের উপর আক্রমণকারী কোনও শক্তির উত্থান সম্ভাবনা চিরতরে রোধ করতে চেয়েছিল।

এটা বিস্ময়কর যে, খ্রীষ্টান ইউরোপ এবং বৌদ্ধ চীন উভয় ক্ষেত্রেই মরুচারী, যাযাবর বা অর্ধযাযাবর আরব কিংবা মোঙ্গল মুসলিম এবং মরুচারী, যাযাবর পেগান মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে প্রায় একই ধরনের নির্মূলীকরণের কর্মকৌশল গ্রহণ করতে দেখা গেছে, যা বৃহদায়তনে প্রযোজ্য হয়েছে। বুঝা যায় শান্তিকামী খ্রীষ্টান হোক আর অহিংস বৌদ্ধ হোক হিংসা ও বর্বরতাকে শেষ পর্যন্ত হিংসা ও বর্বরতা দিয়েই মোকাবিলা করেছে। 

কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে কি এমনটা ঘটতে দেখা গেছে? এখানে হিংসা ও বলপ্রয়োগ হয় নাই তা নয়, তবে মাত্রা ও আয়তনের বিচারে সেগুলি তুলনায় সাধারণত অনেক ক্ষুদ্র কিংবা সীমিত। বিশেষত যাদের নিকট থেকে প্রত্যাঘাতের সম্ভাবনা রয়েছে তাদের প্রতি ভারতীয়দের সহনশীলতা লক্ষ্যণীয়। ভারতীয়দের এই মনোভাব তাদেরকে বৃহদায়তনে রক্তপাত ও সহিংসতা বিমুখ করেছে।

আমরা অনুমান করতে পারি যে, হিংসা বিমুখতার এই ঐতিহ্য ভারত সিন্ধু সভ্যতা থেকে গ্রহণ করেছে। সব কিছুরই ভালো ও মন্দ দুই দিক থাকে। তবে কোনও একটা পন্থাকে পরিপ্রেক্ষিত বিচার না করে অন্ধভাবে আঁকড়ে ধরে থাকাটা যে যৌক্তিক ও প্রজ্ঞাপূর্ণ আচরণ হতে পারে না সেটা বলাই বাহুল্য।

ঐতিহাসিক কালব্যাপী প্রবল বহিরাক্রমণগুলিকে প্রতিহত করায় কিংবা বহিরাগত শাসন উচ্ছেদে ভারতীয়দের ব্যর্থতার দীর্ঘ ইতিহাসকে আমাদের গুরুতর বিবেচনায় নিতে হবে। শুধু পর্যালোচনা নয়, এর কারণ বিশ্লেষণও করতে হবে। সিন্ধু সভ্যতার ধারাবাহিক প্রভাব কীভাবে এতকালেও এভাবে টিকে ছিল? শুধু স্মৃতি এত দীর্ঘকাল এভাবে টিকে থাকতে কিংবা প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। তার বস্তুগত তথা সামাজিক ব্যবস্থাও টিকে থাকতে হয় যার মাধ্যমে একটা সভ্যতা এত দূরপ্রসারী প্রভাব বজায় রাখতে পারে। বিষয়টির স্বরূপ উপলব্ধির জন্য আমাদের প্রথমে সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ প্রক্রিয়াকে বুঝার চেষ্টা করা দরকার।

সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রায় (১ম ও ২য় খণ্ড) আমরা বলতে চেয়েছি যে, প্রাচীন অন্যান্য সভ্যতা থেকে ভিন্ন ধারায় সিন্ধু সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটেছে। বস্তুত হাজার হাজার বছর ধরে প্রধানত শান্তিপূর্ণ ধারায় এক বা একাধিক ক্ষুদ্র সমাজের একটি বৃহৎ ও ঐক্যবদ্ধ সমাজে পরিণতি এবং মূলত একই রকম শান্তিপূর্ণভাবে নাগরিক সমাজ গঠনের মাধ্যমে সমাজ থেকে বৃহৎ রাষ্ট্র গঠনের গতিধারায় ফেলে সিন্ধু সভ্যতাকে বুঝতে হবে। ফলে এখানে অন্যান্য সমাজের মতো করে রাষ্ট্র সংখ্যালঘু বহিরাগত ও আক্রমণকারীদের দ্বারা সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর উপর জবরদস্তিমূলকভাবে চাপানো কোনও সত্তা নয়। সিন্ধু সভ্যতায় বরং রাষ্ট্র অনেকাংশে সমাজের ক্রমবিবর্তনের ফল তথা মূলত একটি শান্তিপূর্ণ সমাজের বিবর্তিত রূপ। এখানে যুদ্ধ বা বলপ্রয়োগ কখনই ভূমিকা রাখে নাই এটা মনে করাটা ভাববাদী চিন্তা হবে। অমন আদর্শ পরিস্থিতি অনুযায়ী ইতিহাসের অগ্রগমন ঘটে না। কিন্তু এও সত্য যে, যুদ্ধ, বলপ্রয়োগ এসকলই এ সভ্যতায় সাধারণভাবে খুব গৌণ ভূমিকা রেখেছিল, সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব যার সবচেয়ে বড় সাক্ষী।

প্রশ্ন উঠা একান্ত স্বাভাবিক ও যৌক্তিক যে, একটি ক্ষুদ্র এলাকার পরিবর্তে এত বৃহৎ ভূভাগে কীভাবে কিংবা কোন প্রয়োজনবোধ থেকে সিন্ধু সভ্যতার বিশাল জনগোষ্ঠী শান্তিপূর্ণ ধারায় ও সুপরিকল্পিতভাবে এমন একটি সভ্যতা বা রাষ্ট্র গড়ে তুলল। বস্তুত এর উত্তর নিহিত রয়েছে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের মধ্যে। প্রথমত শান্তিপূর্ণ ধারা ছাড়া এমন ‍বৃহৎ আয়তনে জলকপাটযুক্ত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করাই সম্ভব ছিল না। দ্বিতীয়ত, বৃহত্তর সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকাকে, কিছু যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ হলেও, প্রধানত শান্তিপূর্ণ পন্থায় নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার আওতায় আনতে হয়েছে। তবে একবার নদী নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা হলে সেই অঞ্চলকে সহজে একটি কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ বা কর্তৃত্বাধীনে নেওয়া সম্ভব। এরপর মূলত শান্তিপূর্ণভাবেই সভ্যতা তথা রাষ্ট্রের সম্প্রসারণ ঘটানো গেছে। অর্থাৎ আমাদের বিবেচনায় সিন্ধু সভ্যতার ভরকেন্দ্র ছিল নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। সুতরাং যত গণতান্ত্রিক পন্থায়ই হোক এর উপর নিয়ন্ত্রণ যারা রাখতে পেরেছিল সমগ্র সভ্যতা তথা সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল তাদেরই হাতে।

সিন্ধু সভ্যতার প্রাণশক্তির উৎস যে মূলত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সে বিষয়ে আমরা বিশেষত ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা’য় বিশদভাবে আলোচনা করেছি। এখানেও তার কিছু উল্লেখ করেছি। সুতরাং বিভিন্ন কারণে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় যখন সঙ্কট দেখা দেয় তখন সিন্ধু সভ্যতা ভিতর থেকেই ভেঙ্গে পড়তে থাকে। অবশেষে সভ্যতার শেষ পর্যায়ে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে জনসমাজের অন্তত একাংশের বিদ্রোহ ঘটলে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। যেহেতু ততদিনে নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধর্মের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল সেহেতু সমাজের নদীনিয়ন্ত্রণ বিরোধী অংশকে ধর্মসংস্কার ঘটাতে হয়। এই সংস্কারের ফল হল ঋগ্বেদ রচনা, বৈদিক আন্দোলন ও যুদ্ধ। এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পতনোন্মুখ সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংস সম্পন্ন হয়। আমাদের এই ব্যাখ্যা আপনার কাছে নূতন নয়। সুতরাং এ নিয়ে আর বিশদ বলবার প্রয়োজন নাই।

সিন্ধু সভ্যতার পর্যালোচনা এবং পরবর্তী ভারতীয় সমাজ, রাষ্ট্র ও সভ্যতার গতিপ্রকৃতির বিশদ ও গভীর অনুসন্ধান থেকে আমরা এই সিদ্ধান্ত নিতে পারি যে, এখানে রাষ্ট্র ছিল সমাজ তথা জনসমাজের অভিব্যক্তি। ফলে বিশাল অঞ্চলব্যাপী একটি বৃহৎ ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটলেও সমাজতল থেকে উঠে আসা এই রাষ্ট্রের উপর বৃহত্তর সমাজ তথা জনগণের নিয়ন্ত্রণ ছিল সুগভীর। আসলে নীচ থেকে উপর এবং প্রান্ত বা ভিত্তি থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিন্যস্ত এই রাষ্ট্র ছিল জনগণের স্তরবিন্যস্ত স্বশাসনের রাজনৈতিক রূপ। এটা এমন এক রাষ্ট্র যা একই সাথে যেন একটি সমাজ আবার একই সাথে একটি রাষ্ট্র। আমরা অনুমান করি গ্রাম থেকে নগর এবং সমাজের প্রান্ত থেকে রাজধানী বা শাসনকেন্দ্র পর্যন্ত মূলত প্রথাভিত্তিক স্বশাসনমূলক ব্যবস্থা দ্বারা সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালিত হত। স্বশাসনের এই নির্দিষ্ট ব্যবস্থা হয়ত পঞ্চায়ত বা পঞ্চায়েত নামে কথিত হত। যখন সিন্ধু সভ্যতা ও তার প্রজাতন্ত্রের অবসান হয়েছে, সিন্ধু সভ্যতার স্মৃতিও মুছে গেছে তখন একটা ঐতিহাসিক গতিধারায় রাষ্ট্রের নীচ তলায় স্থানীয় জনগণের প্রথাভিত্তিক স্বশাসনের রূপ হিসাবে পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থা যেমন টিকে থেকেছে তেমন ঐতিহ্যগত নাম তথা পঞ্চায়েত শব্দও টিকে থেকেছে। পঞ্চায়েত শব্দটি উচ্চারণের সাথে সাথে স্মরণাতীত কালধরে চলে আসা স্থানীয় জনগণের স্বশাসনের প্রথাগত এই রূপ আমাদের কল্পনায় জীবন্ত হয়ে ‍উঠে।

এখন আমরা অনুমান করতে পারি সিন্ধু সভ্যতার পতন-পরবর্তী কালে যখন রাষ্ট্রশাসনে ক্রমে বংশগত রাজতন্ত্র প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা লাভ করে তখন সমাজ তথা জনসমাজের সঙ্গে রাষ্ট্রের দূরত্ব সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্র যে শুধু সামরিক বা যুদ্ধ নির্ভর হল তা-ই নয়, অধিকন্তু রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলি হয়ে উঠল স্বৈরাচারী। জনগণের কণ্ঠস্বর রাজতন্ত্রে প্রতি্ধ্বনিত হবার সুযোগ অনেক কমে গেল। কিন্তু তারপরেও ভারতীয় স্থানীয় রাজা বা সম্রাটদের পক্ষে অন্যান্য অনেক অ-ভারতীয় সমাজের রাজাদের মতো খুব বেশী স্বৈরতন্ত্রী হবার সুযোগ ছিল না। রাজপ্রাসাদ, দুর্গ ইত্যাদি স্থাপনা থেকে তুলনামূলকভাবে কৃষিসমদ্ধ ভারতীয় সমাজের এই বৈশিষ্ট্য স্পষ্ট। এর ফলে এখানে রাজতন্ত্র গড়ে উঠলেও রাষ্ট্র ও সমাজ তথা শাসক শ্রেণী ও জনগণের মধ্যকার সম্পর্ক অধিকাংশ সমাজের তুলনায় অনেকটা ভারসাম্যপূর্ণ।

এভাবেও হয়তো বলা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার পতনের পর ভারতবর্ষের সমাজ ও সভ্যতার ভরকেন্দ্র গ্রাম তথা গ্রামীণ সমাজে চলে গিয়েছিল, যে সমাজের ভরকেন্দ্র স্বরূপ আবার ছিল কৃষিজীবী মানুষ তথা কৃষক। এক অর্থে এই কৃষক তথা কৃষি-সমাজ পরবর্তী ভারতীয় সভ্যতার মূল নিয়ন্তা। এই কৃষকেরই সামাজিক স্থিতির শক্তি হিসাবে কাজ করেছে সিন্ধু সভ্যতার ঐতিহ্যে লালিত পঞ্চায়েত তথা জনগণের পঞ্চায়ত জাতীয় স্বশাসনের ব্যবস্থাপনা। এই ব্যবস্থাপনাকে অস্বীকার করে রাষ্ট্রও দাঁড়াতে পারে নাই।

এর ক্ষতিকর দিকও আছে বৈকি! প্রজাদের মুখ চেয়ে চলতে গিয়ে রাজা বা রাষ্ট্র ক্ষেত্র বা পরিস্থিতি বিশেষে সেনাবাহিনী গঠন ও রক্ষা তথা সামরিক প্রস্তুতির জন্য যে বিপুল ব্যয় করতে হয় সেটা করতে পারে নাই। খ্রীষ্টীয় শতকের শুরুর কিছু পূর্ব থেকেই মধ্য এশিয়ার তৃণভূমি ও মরুভূমি থেকে শক, হুন, ইত্যাদি বিভিন্ন যাযাবর ও পশুচারী জনগোষ্ঠীর আক্রমণের ঢেউগুলি আফগানিস্তানসহ ভারতবর্ষের পশ্চিম ভূভাগের উপর আছড়ে পড়তে থাকে। এর ফলে আফগানিস্তানসহ পশ্চিম ভারতের জনসমাজের বিপুল বিপর্যয় ঘটে। নগর ও শহরসহ বিপুল সংখ্যক জনপদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ইসলাম ধর্মকে অবলম্বন ক’রে সপ্তম শতাব্দীতে আরবের মরুপ্রান্তর থেকে পশুচারী যাযাবর আরব বেদুইনদের উত্থান ঘটে। এশিয়া, আফ্রিকা ও ইউরোপের প্রাচীন সভ্যতাগুলির এক বৃহদাংশই মুসলিম পরিচয়ে চিহ্নিত এই মরুচারী যাযাবরদের প্রবল আক্রমণের আঘাতে তছনছ হয়ে গেল। ভারতের সিন্ধুর রাজা দাহিরকে পরাজিত করে আরব মুসলিমরা ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে সিন্ধু দখল করে। কিন্তু তখনও ভারতের প্রতিরোধ শক্তি কিছু পরিমাণে হলেও টিকেছিল। সুতরাং তারপর কয়েক শত বৎসরের জন্য মুসলিম অগ্রাভিযান থেমেছিল। লাগাতার বহিরাগত মুসলিম আগ্রাসন শুরু হয় প্রকৃতপক্ষে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে তুর্কী হানাদার মুহাম্মদ ঘুরীর ভারত আক্রমণ ও দখল অভিযান দিয়ে।

এটা লক্ষ্যণীয় যে, বহিরাগত মুসলিম বিজেতারা এখানে শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার পর সাধারণত নবতর বহিরাগত আক্রমণ অভিযানগুলিকে প্রতিহত ক’রে অবশিষ্ট ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতাকে নিম্ন মাত্রায় হলেও রক্ষা করেছে। এ প্রসঙ্গে আমরা মোঙ্গল হানাদার চেঙ্গিস খানের ভারত আক্রমণ প্রতিহত করায় দিল্লীর খলজী সুলতান আলাউদ্দীন খলজীর ভূমিকার কথা বলতে পারি। আলাউদ্দীনের বহুবিধ নিষ্ঠুরতার কথা বহু প্রচারিত। তার সময়ে দিল্লার নিকট দশ হাজার মোঙ্গল ইসলাম গ্রহণ করে বাসরত ছিল। তার মনে হল যে, এরা তাকে উৎখাতের জন্য চক্রান্ত করছে। পরিণতিতে তিনি তাদের সবাইকে হাতীর পদপিষ্ট করে হত্যা করেন।

এটা ঠিক যে, বহিরাগত মুসলিমদের চেষ্টা ছিল ভারতীয় অমুসলিম বিশেষত হিন্দুদের ইসলামে দীক্ষিত করার। কিন্তু বিশেষত হিন্দু ধর্মকে অবলম্বন করে ভারতীয় সমাজ সে চেষ্টাকে প্রাণপণে প্রতিহত করেছে। এটা নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, বহিরাগত মুসলিম শাসনকেন্দ্র উত্তর ভারত আজও বিপুলভাবে হিন্দু গরিষ্ঠ ও মুসলিম লঘিষ্ট হয়ে আছে। আসলে বহিরাগত মুসলিম শাসকরাও অর্থনীতির সাধারণ নিয়ম মানার বুদ্ধিটুকু রাখত। হিন্দু প্রজারা সাধারণত ছিল অপ্রতিরোধী বা নির্বিরোধ। একেবারে দেওয়ালে পিঠ না ঠেকলে তারা বিদ্রোহ করতে চাইত না। বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে তারা দলবেঁধে পালাত বনজঙ্গলে কিংবা অন্য রাজ্যে। সুতরাং মুসলিম শাসকরা যতই অত্যাচার করুক সেটা একটা সীমার মধ্যে সচরাচর থাকত। বরং এইসব পশুচারী, মরুচারী যাযাবর বা অর্ধযাযাবররা ভারতবর্ষে এসে যে ভোগ ও সম্ভোগের সুযোগ পেত সেগুলিকে রক্ষা করতে চাইত। যদি প্রজাই না থাকে তাহলে তারা এসব পাবে কীভাবে? এভাবে শত শত বৎসরের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে বহিরাগত মুসলিম শাসক শ্রেণী ও ভারতীয় হিন্দু প্রজাদের সম্পর্কের মধ্যে এক ধরনের ভারসাম্য বা স্থিতাবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আওরঙ্গযেবের মতো শাসকরা মাঝে মাঝে এটা নষ্ট করলেও পূর্বেকার স্থিতাবস্থা ফিরে আসতে বেশী সময় লাগত না। অবশ্য আওরঙ্গযেবের কর্মনীতির মাশুল তাকে সহ মোগল সাম্রাজ্যকে দিতে হয়েছিল ব্যাপক গণ-বিদ্রোহ ও সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে।

যাইহোক, মুসলিম শাসনের কিছু শিক্ষণীয় দিক আছে বলে আমাদের মনে হয়। সেটা হল সামরিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে গিয়ে প্রজাসাধারণের উপর কর বা রাজস্বের অতিরিক্ত বোঝা চাপানো। এমনিতে মুসলিম যুগে ভূমি রাজস্ব ছিল পূর্বের তুলনায় দ্বিগুণ। হিন্দু শাসনকালে ফসলের একষষ্ঠাংশ রাষ্ট্র গ্রহণ করত। অথচ মুসলিম শাসনকালে এর পরিমাণ ছিল একতৃতীয়াংশ। অনেক সময় রাষ্ট্র প্রজাদের নিকট থেকে প্রায় সবটুকু নিংড়ে নিত। এ প্রসঙ্গে আমরা আলাউদ্দীন খলজীর কর্মনীতির উল্লেখ করতে পারি।।

এ ধরনের কর্মনীতি একান্ত প্রয়োজন হলেও প্রাক-মুসলিম যুগে সম্ভব ছিল না। কেন সম্ভব ছিল না সেটা স্পষ্ট করার জন্য বলি, পঞ্চায়েতমূলক ভারতীয় জনগণের স্বশাসনের যে জাল সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশে বিস্তৃত ছিল তার প্রভাবকে কোনও ভারতীয় শাসকের পক্ষে অস্বীকার করা সম্ভব ছিল না। গ্রামকেন্দ্রিক ভারতীয় সমাজের চাহিদা বা দাবীকে অস্বীকার করে দাঁড়াবার মতো প্রাতিষ্ঠানিক ও সাংস্কৃতিক আয়োজন ভারতবর্ষে ছিল না, যেটা ইউরোপ কিংবা চীনে ছিল। এ বিষয়ে যথাযথ গুরুত্ব সহকারে ভাবা উচিত বলে আমাদের মনে হয়। মূলত গ্রামকেন্দ্রিক পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার শক্তির সপক্ষে থাকা মাত্রাতিরিক্ত সামাজিক ভারসাম্য রাষ্ট্রশক্তিকে দুর্বল রেখে ভারতীয় সমাজের দীর্ঘ পরাধীনতার অন্যতম সহায়ক ফ্যাক্টর হয়েছে কিনা এ বিষয়ে আমাদের এখন নূতন করে ভাবা দরকার।

তবে আমাদের অনুমান, যে ফ্যাক্টরটি ভারতবর্ষে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে সমাজকে প্রায় সর্বশক্তিমান সত্তায় পরিণত করেছে সেটা হল হিন্দুধর্মের বর্ণজাতিভেদ ব্যবস্থা। বর্ণজাতিভেদকে আমরা শ্রমকর্ম বিভাজনের একটা নির্দিষ্ট ভারতীয় রূপও বলতে পারি। ব্রাহ্মণ পুরোহিত শ্রেণীর নেতৃত্বে সমাজকে তত্ত্বগতভাবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র এই চার বর্ণজাতিতে বিভক্ত করা হলেও বাস্তবে সমাজ অগণিত বর্ণজাতিতে বিভক্ত হল, যেখানে অসম সম্পর্কভিত্তিক এই বর্ণজাতিগুলির একটার পাশাপাশি অপর বর্ণজাতির শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান হলেও তাদের মধ্যে একত্র আহার, ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ও বিবাহ নিষিদ্ধ হল।

ভারতীয় সমাজে বর্ণজাতি প্রথার প্রভাব এমনই সুগভীর যে, এমনকি এক সময় মুসলিম সমাজও এর প্রভাবের ঊর্ধ্বে উঠতে পারত না। মোগল আমলে রাষ্ট্রও এই প্রথার সংরক্ষণে সতর্ক ভূমিকা রাখত। ফলে হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে নীচতলার সাধারণ কর্মজীবীদের জন্য কুলগত পেশা ও মর্যাদা পরিবর্তন নিষিদ্ধ ছিল।*

---------------------------

* মোগল আমলে ভারতে আগত ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিযেরের বিবরণ থেকে আমরা এ সম্পর্কে জানতে পারি। বিনয় ঘোষের বঙ্গানুবাদ বাদশাহী আমল-এ এ সম্পর্কে উল্লেখ আছে। ইংরেজ শাসনকালেও ভারতীয় মুসলিম সমাজে হিন্দু সমাজের অনুরূপ জাতিভেদ প্রথা প্রচলিত ছিল। তবে ইসলামে বর্ণজাতি প্রথার অনুমোদন না থাকায় বিভিন্ন ধর্মীয়-রাজনৈতিক আন্দোলনের মাধ্যমে মুসলিম সমাজ থেকে বর্ণজাতিভেদের অনুরূপ প্রথা দূরীভূত করা সহজতর হয়েছে। মুসলিম সমাজে বর্ণজাতিভেদ বা জাতিভেদের প্রভাব নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করেছেন Dr. Nazmul Karim তার The Changing Society in India and Pakistan নামক গ্রন্থে। এর সপক্ষে পাকিস্তান কালে পূর্ব বাংলার সমাজ সম্পর্কে শামসুজ্জোহা মানিকের তরুণ বয়সের কিছু অভিজ্ঞতা আছে। তখন পাবনাসহ অনেক জায়গায় মুসলিম কৃষকদের বাইরে ‘জোলা’ হিসাবে কথিত তাঁতীদের নিয়ে গঠিত একটা বৃহৎ পেশীজীবী গোষ্ঠী ছিল। কৃষকদের পাশাপাশি বসবাস করলেও সামাজিক প্রথা অনুযায়ী তাদের সঙ্গে সাধারণ কৃষক বা চাষীদের বৈবাহিক সম্পর্ক নিষিদ্ধ ছিল। অর্থাৎ চাষীদের ‘জাত’ আর জোলাদের ‘জাত’ সম্পূর্ণরূপে ভিন্ন। একই ইসলাম ধর্মাবলম্বী হলেও কৃষকরা সামাজিক মর্যাদায় অধঃস্তন হিসাবে জোলা বা তাঁতীদের অবজ্ঞা, এমনকি ঘৃণাও করত। নির্দিষ্ট কর্ম বা পেশা ও সামাজিক মর্যাদার প্রায় অপরিবর্তনীয় কাঠামোতে আবদ্ধ এ ধরনের আরও কিছু ‘জাত’কে মুসলিম সমাজে দেখা যেত।

---------------------------

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

এতে কোনও সন্দেহ নাই যে, একদিকে কৃষিসমৃদ্ধি, অপর দিকে জনগণের স্বশাসনের রূপ হিসাবে পঞ্চায়েতী ব্যবস্থার অস্তিত্ব ভারতীয় সমাজকে ইসলামের ধর্ম ও সংস্কৃতির আগ্রাসনের বিরুদ্ধে অস্তিত্বরক্ষার লড়াইয়ে বিরাট শক্তি যুগিয়েছিল। কিন্তু এইটুকুই যথেষ্ট নয়, এই অস্তিত্বের লড়াইকে ভারতীয় সমাজের আর একটি বৈশিষ্ট্য বা কাঠামো বিরাটভাবে শক্তি যুগিয়েছিল বলে আমরা অনুমান করি, সেটি হল হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রমভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা। কুলগত বা বংশানুক্রমিক কর্ম তথা পেশা ও সামাজিক নির্দিষ্ট ও অপরিবর্তনীয় মর্যাদাভিত্তিক এই প্রথা ভারতীয় সমাজকে একটা দীর্ঘ সামাজিক অবক্ষয় ও প্রতিক্রিয়ার যুগে আত্মরক্ষার যে শক্তি যুগিয়েছিল সেটিকেও আমাদের বুঝতে পারতে হবে। বর্ণজাতিভেদ ও পঞ্চায়েত এই উভয় ব্যবস্থা পরস্পর বিজড়নের মাধ্যমে প্রধানত নিষ্ক্রিয় পদ্ধতিতে বিশেষত গ্রামীণ ভারতীয় সমাজকে আত্মরক্ষার শক্তি দান করেছিল।

এটা ঠিক যে, বর্ণজাতিভেদ ভারতীয় ঐক্য ও সংহতির শক্তিকে এক অর্থে ধ্বংস করেছিল। তবে এই ধ্বংসটা ঘটেছিল তার সামরিক কিংবা রাষ্ট্রগঠনের সক্ষমতার ক্ষেত্রে। কিন্তু ব্রাহ্মণের নেতৃত্বে শ্রম-কর্ম বিভাজনমূলক এই নির্দিষ্ট ভারতীয় সমাজব্যবস্থা ভারতকে সামাজিক স্থিতাবস্থা রক্ষার অবিশ্বাস্য শক্তি দান করেছিল। বর্ণজাতিভেদমূলক কাঠামোর রক্ষাব্যূহের আশ্রয় নিয়ে অন্তত দুই হাজার বছর ভারতীয় সমাজ বৈরী সমাজশক্তির আঘাতকে মোকাবিলা করে টিকে থেকেছে।*

---------------------------

* প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য থেকে হিন্দু ধর্মের সময়কাল এমনটা বলে আমরা মনে করি। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা, দ্বিতীয় খণ্ড, ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’ (https://www.bangarashtra.net/article/1546.html)

---------------------------

রাজনৈতিক ঐক্য না থাকতে পারে, প্রবল বৈদেশিক আক্রমণগুলিকে মোকাবিলায় ব্যর্থতা ঘটতে পারে, কিন্তু প্রায় অভিন্ন ছন্দের গতিধারায় সমাজ এগিয়ে চলেছে। এভাবে একটা ধর্মীয় ব্যবস্থায় সমাজ তার ঐক্য ও শৃঙ্খলা রক্ষা করে চলেছে। এই বিচারে আমরা হিন্দু ধর্মকে সমাজবাদী ধর্ম বলতে পারি। এটা সমাজকে অজস্র অনড় ভাগে বিভক্ত করে রাজনৈতিকভাবে তার উত্থানশক্তি রহিত করলেও বৈদেশিক বা বিধর্মী হলেও যে কোনও রাষ্ট্রশক্তির অধীনতার মধ্যেও বেশ কিছু ধর্মীয় প্রথা ও আচরণের মাধ্যমে তার সামাজিক ঐক্যকে রক্ষা করে। তবে যে কথা বলেছি, হিন্দুধর্ম মূলগতভাবে রাষ্ট্র বিরোধী। সুতরাং হিন্দুধর্মের শক্তিবৃদ্ধির সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির ক্ষয় ও পতন ঘটেছে।

আমাদের ধারণা ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থান ঘটাতে গিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা ভারত-রাষ্ট্রের জন্য এই বিপদকে ডেকে আনছে। বেদের কথা বলে লাভ নাই; অন্তত দুই হাজার বছর ধরে যে ধারায় হিন্দু ধর্ম ও সমাজ গড়ে উঠেছে তার আলোয় হিন্দুধর্মকে দেখতে হবে। আর তখন হিন্দুধর্মের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে বর্ণজাতিভেদ প্রথা চলে আসবে, যেমন যত ব্যাখ্যাই দেওয়া যাক একই সাথে চলে আসবে প্রতীক পূজা হিসাবে প্রতিমা পূজার গুরুত্ব। প্রথমত, ধর্ম অন্ধবিশ্বাসের ব্যাপার। আর যে কোনও অন্ধত্বই ক্ষতিকর। আজকের যুগে সেটা আরও অনেক বেশী প্রযোজ্য। প্রতিযোগিতার এ পৃথিবীতে ধর্মের অন্ধত্ব নিয়ে এগিয়ে যাবার প্রশ্ন উঠে না। বিশেষত হাজার হাজার বছরের অনেক ভালো ঐতিহ্যের মতো অনেক জঞ্জালও হিন্দুধর্মে জায়গা করে নিয়েছে। জঞ্জালগুলি থেকে ভারতীয় সমাজকে মুক্ত করতে হবে। এটা এক অর্থে হিন্দুধর্ম থেকে ভারতকে মুক্ত করার ব্যাপার। সেটা আপনারা কীভাবে করবেন সে বিষয়ে আপনাদেরকেই বিশেষভাবে ভাবতে হবে। মুসলিম সংখ্যাগুরু বাংলাদেশের জন্য যেমন ইসলাম প্রধান সমস্যা তেমন হিন্দু সংখ্যাগুরু ভারতের জন্য প্রধান সমস্যা হিন্দুধর্ম। অর্থাৎ এ বিষয়ে আপনাদের বিশেষভাবে ভাববার প্রয়োজন রয়েছে।

ইসলাম নিয়ে আমাদের কিছু সুবিধা আছে। সেটা হচ্ছে ইসলাম সম্পূর্ণরূপে বহিরাগত ধর্ম হওয়ায় এটা এ সমাজে শিকড়হীন। হিন্দুধর্মের ব্যাপারটা অত সহজ নয়। ইসলামকে অস্বীকার করার সাথে সাথেই বাংলাদেশে আমাদের সামনে ঐতিহ্য হিসাবে শুধু যে বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী সংস্কৃতি উপস্থিত হয় তা-ই নয়, অধিকন্তু বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে অবিচ্ছেদ্য বন্ধনে আবদ্ধ বৃহত্তর ভারতীয় সংস্কৃতিও উপস্থিত হয়, যার উৎসে পৌঁছাতে গিয়ে আমরা উপস্থিত হই সিন্ধু সভ্যতায়। এখানে আমাদের বাঙ্গালী সংস্কৃতির সঙ্গে ইসলাম ধর্মের বিজড়ন না ঘটায় একবার ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি ঘটলে এখানে প্রথমে বাঙ্গালী জাতীয় চেতনা এবং অতঃপর সেই চেতনার সড়ক ধরে বৃহত্তর ভারতীয় চেতনার দিকে যাত্রা হয় অবারিত। এই ঘটনাটা এ দেশে ষাটের দশকে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ক্ষেত্রে ঘটেছিল। এটা ঠিক যে, এক অর্থে একাত্তরের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই সমগ্র গতিধারার সমাপ্তি ঘটে। অবশ্য এটা ভিন্ন আলোচনার বিষয়। এই আলোচনা করতে গেলে বহুকিছু উঠে আসবে। সেটার সুযোগ এখানে নাই।

এখানে শুধু এইটুকু বলি যে, ধর্মবিশ্বাসমুক্ত এই প্রজন্মের রাজনৈতিক উত্থান ঘটেছিল মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ছত্রছায়ায় ও প্রেরণায়। আবার মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের নেতৃত্ব তাদের সাফল্যের পথে বাধা হয়ে দেখা দিয়েছিল। আসলে কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ছিল মতান্ধ এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা চীনের প্রতি অন্ধ অনুগত। এক কথায় বলি, শুদ্ধতার পূজারী হয়ে মার্কসবাদও তার অনুসারীদেরকে সাধারণত মতান্ধ করে। সুতরাং অনেকাংশে স্বাধীন চিন্তা ও ভিন্নমত নিয়ে গড়ে উঠলেও কমিউনিস্ট রাজনীতির ছত্রছায়া ও প্রেরণায় গড়ে উঠা বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের বিপর্যয়ও ছিল অনিবার্য।

যাইহোক, এ প্রসঙ্গ আর নয়। ভারতের কমিউনিস্ট রাজনীতির অভিজ্ঞতাও আমাদের নিকট হতাশাজনক। লোকবাদী বা সেকিউলার চেতনার অনুসারী হিসাবে সেখানকার কমিউনিস্টদের নিকট থেকে একটা প্রত্যাশা থাকাটা আমাদের জন্য স্বাভাবিক। আমাদের সবচেয়ে খারাপ অভিজ্ঞতা হয়েছে ১৯৯৫ সালে আমাদের প্রকাশিত ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization এবং ২০০৩ সালে বাংলা গ্রন্থ আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা প্রকাশের পর। আপনি জানেন যে, আর্যরা যে মূলত সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী এবং আর্য শব্দ যে কোনও জাতিবাচক অর্থে নয়, বরং সভ্য্, ভদ্র, ধার্মিক ইত্যাদি অর্থে ব্যবহৃত একটা গুণবাচক শব্দ এটা আমরা প্রকাশিত গ্রন্থের মাধ্যমে সেই সময় থেকে বলে আসছি। অবশ্য তার আগে ১৯৯৪ সালে ভারতবর্ষে বহিরাগত আর্য আক্রমণ তত্ত্বকে নাকচ করে খসড়া থিসিস হিসাবে আমরা যে বক্তব্য তৈরী করি তার একটা কপি পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের তৎকালীন মহাপরিচালক ও সিন্ধু সভ্যতা বিষয়ক বিশ্ববিখ্যাত প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগলের নিকট পাঠালে তিনি তাতে জোরালো সমর্থন দিয়ে সেটি অনতিবিলম্বে প্রকাশের তাগাদা দেন। এটা বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এ ধরনের কোনও সমর্থন বা প্রেরণা ভারতের কোনও পণ্ডিতের নিকট থেকে আমরা পাই নাই। বরং সেখানকার মার্কসবাদী মহল থেকে আমরা যে মনোভাবের প্রকাশ ঘটতে দেখেছি সেটাকে নেতিবাচক বলা ছাড়া আর কোনও ভাষা খুঁজে পাই না। এ ক্ষেত্রে পশ্চিম বঙ্গ আমাদেরকে বিশেষভাবে হতাশ করেছে।

এটা শুনতে হয়ত বিস্ময়কর হবে যে, বাংলাদেশের ধর্মমুক্ত বাম রাজনীতির প্রভাব বলয়ে থাকা বুদ্ধিজীবী, লেখক ও পণ্ডিতদের মধ্য থেকে আমরা নানানভাবে আমাদের আর্যতত্ত্বের প্রতি যে সমর্থন পেয়েছিলাম তার কিছুই আমরা পশ্চিম বঙ্গ বা ভারত থেকে পাই নাই। বরং সেখানকার বামপন্থীরা আমাদের তত্ত্বের প্রতি নানানভাবে তাদের অনীহা বা অপছন্দ প্রকাশ করেছে। এটা আরও উল্লেখযোগ্য যে, বাংলাদেশে আমরা যে শুধু বামপন্থী ধারা থেকে আগতদের কাছ থেকে সমর্থন পেযেছিলাম তাই নয়, অধিকন্তু তার বাইরের অ্যাকাডেমিক ধারার পণ্ডিত মহলেও সমর্থন কিংবা উৎসাহ পেয়েছিলাম। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের প্রাক্তন প্রধান এবং বাংলাদেশে ইউনেস্কোর কালচারাল হেরিটেজ প্রজেক্টের প্রাক্তন ন্যাশনাল প্রজেক্ট অ্যাডভাইজার প্রয়াত ড. নাজিমুদ্দীন আহমদের কথা। তিনি এক সময় পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব ও যাদুঘর বিভাগের উপ-পরিচালক হিসাবে রফিক মোগলের সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার উপর খননকাজে অংশ নিয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত আর্য ও সিন্ধু সভ্যতার উপর লিখা ইংরাজী গ্রন্থ The Aryans and the Indus Civilization পড়ে তিনি আমাদের তত্ত্বকে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন করেন। তার প্রস্তাব ছিল এ বিষয়ের উপর একটা সেমিনারের আয়োজন করার। সেখানে তিনি আমাদের থিসিসের সমর্থনে বক্তব্য দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সে সেমিনার আর করা হয় নাই। তিনিও প্রয়াত হয়েছেন অনেক দিন আগে। এ বিষয়ও এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৯৪ সালে ডঃ রফিক মোগল আমাদের থিসিসকে সমর্থন জানানোর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক আহমেদ কামাল ও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর তৎকালীন গবেষক ডঃ হোসেন জিল্লুর রহমান (তিনি ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন।) একটি সভার আয়োজন ক’রে আমাদের দুইজনকে সম্বর্ধনা প্রদান করেন। এখানে এটাও বলে রাখা উচিত হবে যে, ১৯৯০ সালে শামসুজ্জোহা মানিক কর্তৃক লিখিত ভারত-ইতিহাসের সূত্র সন্ধান-এর হাতে লিখা পাণ্ডুলিপির ফটোকপি প্রচারের পর এই থিসিস নিয়ে ঢাকার পণ্ডিত ও গবেষক মহলে ঔৎসুক্য ও আলোচনা শুরু হয়েছিল। এমনকি এখানকার একজন প্রতিষ্ঠিত প্রকাশক পাণ্ডুলিপিটি পড়ে এটিকে বই আকারে প্রকাশের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন্। তবে এক অর্থে সবচেয়ে বিস্ময়কর হচ্ছে ২০০৩ সালে আমাদের বাংলা গ্রন্থ আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা প্রকাশের পর তৎকালীন ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকারের একজন মন্ত্রী গ্রন্থটির প্রকাশন উৎসব করার প্রস্তাব দেন যেখানে তিনিসহ বিএনপির তৎকালীন মহাসচিব ও মন্ত্রী আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া আমাদের বক্তব্যের সমর্থনে বক্তৃতা দিবেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, মান্নান ভূঁইয়া অনেক দিন আগে মৃত্যুবরণ করেছেন। কিন্তু বিএনপি-এর রাজনীতির সঙ্গে নিজেদের নাম জড়াতে না চাওয়ায় সে প্রস্তাবের প্রতি আমরা আগ্রহ প্রকাশ করি নাই।

প্রাচীন ভারতীয় এবং বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতা নিয়ে মুসলিম সমাজ থেকে আগত শুধু ধর্মবিশ্বাস বিরোধী ব্যক্তিবর্গ নয়, অধিকন্তু কিছু উদার চিন্তার মুসলিমদেরও এমন মনোভাবের কারণ বুঝতে পারা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে আমরা মনে করি। শুধু বাংলাদেশে আমরা যে সমর্থন ও অনুপ্রেরণা পেয়েছিলাম তা নয়। বরং আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রন্থ প্রকাশের মাধ্যমে আর্যতত্ত্ব ও সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত বক্তব্য নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু হয়েছিল পাকিস্তান প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন সর্বোচ্চ ব্যক্তি ও সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা ও মৌলিক অবদান রাখবার কারণে বিশ্বব্যাপী প্রতিষ্ঠিত প্রত্নতত্ত্ববিদ মোহাম্মদ রফিক মোগলের সমর্থন লাভের পর।*

---------------------------

* ঋগ্বেদ, আর্য ও সিন্ধু সভ্যতা সংক্রান্ত আমাদের প্রাথমিক তত্ত্বের প্রতি পাকিস্তানের প্রসিদ্ধ প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল শামসুল আলম চঞ্চলের নিকট যে পত্র পাঠিয়েছিলেন সেটা হয়তো আপনি পড়েছেন। তা সত্ত্বেও গুরুত্ব বিবেচনা করে আপনার নিকট প্রেরিত আমাদের এই যৌথ পত্রের শেষে তার একটা কপি সংযুক্ত করব।

---------------------------

এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা সঙ্গত যে, বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু সমাজ থেকে আসা কমিউনিস্ট বা বামপন্থীদের নিজেদের বাসভূমির ইতিহাস-ঐতিহ্যের প্রতি এমন নিরাসক্তি, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিরুদ্ধতার কারণ কী? বুঝলাম, বিশেষত হিন্দুধর্মের মতো একটা প্রাচীন ও প্রচণ্ড প্রভাবসম্পন্ন ধর্ম থেকে সমাজকে মুক্ত করার জন্য তার সঙ্গে ছেদের প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাই বলে অতীতের সবকিছুকে অবজ্ঞা ও বর্জন করে কি দাঁড়ানো যায়? অতীতের মধ্যে অনেক সমস্যা আছে। কিন্তু সেখানে শক্তি ও সম্ভাবনার অনেক উৎসও যে লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা কি বুঝতে হবে না? সেটাকে খুঁজা তো দূরের কথা; এমনকি সেই খুঁজার কাজটাকে পারলে প্রাণপণে বিরোধিতাই করতে চান এরা। আসলে ভারতের কমিউনিস্ট বা মার্কসবাদী তথা বাম ধারার মধ্যে যে প্রেরণাটা সংগুপ্ত রয়েছে সেটা হল অতীত ঐতিহ্যকে বিরোধিতা করতে গিয়ে স্বদেশদ্রোহে চলে যাওয়া। আমাদের অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয়েছে ভারতের হিন্দু সমাজের বামপন্থীরা হিন্দুধর্মকে বিরোধিতা করতে গিয়ে এক ধরনের দেশহীন ও ভাসমান শক্তিতে পরিণত হয়েছেন। হিন্দু ধর্ম ও সংস্কৃতির আড়ালে ভারতীয় সমাজ ও সভ্যতার অনেক শক্তির দিক যে লুকিয়ে রয়েছে সেটাকেও তারা বুঝতে চান না। যেহেতু তারা সেটা বুঝতে চান না সেহেতু তাদের সেদিকে দৃষ্টিটা পড়ে না। তারা এটা বুঝতে চান না যে, হিন্দুধর্মে যত ত্রুটি থাকুক এটা ইসলামের মতো পশুচারী ও মরুচারী যাযাবর লুটেরা ও ধর্ষক যোদ্ধাদের ধর্ম নয়। বরং তার বিপরীতে এটা ভারতীয় কৃষকদের এমন একটা ধর্ম যার মর্মে সকল পশ্চাৎপদতা ও প্রতিক্রিয়া সত্ত্বেও নিহিত রয়েছে এক সুপ্রাচীন ও মহান সভ্যতার উত্তরাধিকার। তারা দেশ থেকে নিজেদেরকে চেতনায় এমনইভাবে বিচ্ছিন্ন করেন যে, তাদের নিকট প্রকৃত অর্থে দেশের কোনও অস্তিত্ব নাই। আন্তর্জাতিকতাবাদ কিংবা সর্বহারা শ্রেণীর নামে তারা অখণ্ড মানবসত্তার ধ্যানেই নিমগ্ন থাকেন। ফলে তাদের নিকট বাস্তবের দেশ নাই। ফলে নাই বাস্তবের দেশপ্রেমও। যাদের মধ্যে দেশ প্রেম নাই, তারা দেশ গঠন করবেন কী করে?

বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের পর ভারতবর্ষের এক বিস্ময়কর মহাসভ্যতা একটু একটু করে আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছে। আবিষ্কারের শত বৎসরের কথা থাক। বিগত ৪০-৫০ বৎসর সময়ের মধ্যে আরও অনেক আবিষ্কার এমন এক সভ্যতার চিত্র আমাদের সামনে উন্মোচিত করেছে যা হয়ে উঠতে পারে আমাদের আগামী সভ্যতা নির্মাণে বিপুল শিক্ষা ও প্রেরণার উৎস। কিন্তু অতীতের সবকিছুকে অন্ধ ও নিঃশর্ত ভাবে নাকচ করতে চাইলে সেখান থেকে আমরা শিক্ষা ও প্রেরণা নিব কীভাবে?

☆ ☆ ☆ ☆ ☆

স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম সম্পর্কে আপনি যথাযথই বলেছেন যে, এটা বাস্তবে থাকা সম্ভব নয়। বিভিন্ন প্রয়োজনে শুধু গ্রাম নয়, অধিকন্তু একটা জনপদও অন্যান্য জনপদের উপর নি্র্ভরশীল হতে পারে। একটা ছোট ও সহজ উদাহরণ দেওয়া যাক। শুধু জমি থাকলেই ফসল ফলানো যায় না। তার জন্য লাঙ্গল লাগে। আবার শুধু কাঠ দিয়ে লাঙ্গল তৈরী করলেই জমি চাষ করা যায় না। তার জন্য লোহার ফলা দিতে হয় কাঠের লাঙ্গলের আগায়, যার দ্বারা জমিকে বিদীর্ণ করা সম্ভব। সব জায়গায় যেমন লোহা পাওয়া যায় না তেমন এটা দূর দেশ থেকে আনতে হয়। একইভাবে তরকারী রাঁধবার জন্য যে মশলা বা লবণ লাগে সেগুলিও হয়তো আসে দূর দেশ থেকে। এভাবে কৃষি কিংবা সভ্যতার বিকাশ ও বিস্তার মানুষকে যেমন তেমন তাদের বসতিগুলিকেও পরস্পর নির্ভরশীল করে। এই নির্ভরশীলতার ফলে গড়ে উঠে বাণিজ্য এবং বণিক শ্রেণী কিংবা বিভিন্ন পেশাজীবী শ্রেণী বা গোষ্ঠী। বাণিজ্য দূরদূরান্তের মানুষদেরকে যেমন পরস্পর সংযুক্ত করে তেমন পরস্পর নির্ভরশীলও করে। অন্তত সভ্যতায় স্বয়ংসম্পূর্ণ সমাজ বা গ্রাম ইত্যাদি ক্ষেত্রবিশেষে আপেক্ষিক অর্থে সত্য হতে পারে; কিন্তু এ ধরনের বিবৃতির সময় আমাদের খুব সতর্ক থাকা উচিত।

হতে পারে এ ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক যে, ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীরা তাদের উপনিবেশবাদী মতলব থেকে ‘স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম’ ইত্যাদি যাবতীয় উদ্ভট ধারণা প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করেছিল। ঋগ্বেদ পাঠ ক’রে যারা ‘ভারতে বহিরাগত আর্য আক্রমণ’ তত্ত্বের মতো হাস্যকর ও ফালতু একটা তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য উঠেপড়ে লাগতে পারে তাদের পক্ষে কী না করা সম্ভব! শুধু তলোয়ার ও বন্দুকের জোরে উপনিবেশের মানুষদেরকে নিয়ন্ত্রণ করা যায় না, এর জন্য প্রয়োজন হয় তাদেরকে চিন্তা-চেতনা তথা ধারণাগতভাবেও বিভ্রান্ত, বিপথগামী ও অধীনস্থ করার।

গ্রামের উদ্ভব, সীমানা নির্ধারণ ইত্যাদি সম্পর্কে আপনি কিছু প্রশ্ন তুলেছেন। আমাদের মনে হয় বিষয়গুলি খুব জটিল কিছু না। প্রথমত বিভিন্ন কারণে অতিরিক্ত জনসংখ্যাকে যখন একটা গ্রাম ধারণ করতে পারে না তখন নূতন গ্রাম পত্তন দ্বারা তার সমাধান করা হয়। নগরগুলি যেমন তেমন গ্রামও একটা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে ভৌগোলিক ও অন্যান্য বহুবিধ কারণে আবদ্ধ থাকতে চায় বা বাধ্য হয়। বিশেষ করে কৃষির বিকাশ ও খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে জনসংখ্যার বৃদ্ধি ও বিস্তার সংযুক্ত। এর ফলে নূতন নূতন গ্রাম, শহর-নগর ও জনপদের প্রতিষ্ঠা স্বাভাবিক ব্যাপার হয়ে দেখা দেয়। সভ্যতার বিকাশের সঙ্গে যেমন এমনটা ঘটে তেমন সভ্যতার ক্ষয় বা বিপর্যয়ের সঙ্গে বিপরীতটাও ঘটে। সভ্যতা কিন্তু এমন একটা ছন্দে এগিয়ে এসেছে। এই গতির ছন্দ যেমন অনেক সময়ই সরল ও সহজবোধ্য হতে পারে তেমন অনেক সময়ই অত্যন্ত জটিল ও দুর্বোধ্য হতে পারে। মানুষের সভ্যতার গতিধারাকে বুঝার সময় আমাদের এ বিষয় সম্পর্কে সচেতন থাকা দরকার যে, মানুষের এই যাত্রায় অবিরাম নূতন নূতন উপাদান এসে যুক্ত হয়। ফলে পূর্ববর্তী অনেক অভিজ্ঞতা দিয়ে আমরা পরবর্তী ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে অনেক সময় ভুল করি।

আজকের যুগের অনেক চিন্তা ও দর্শনের উৎস হাজার হাজার বছর পূর্বের চিন্তা ও দর্শনের মধ্যে থাকতে পারে। আমরা সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা-র দ্বিতীয় খণ্ডে প্রাচীন গ্রীসের দর্শন ও রাষ্ট্রচিন্তায় সিন্ধু সভ্যতার প্রভাবের কথা বলেছি। এমন হতে পারে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রচিন্তা ও লোকায়তিক আদর্শ আরো অনেক পরে ফরাসী বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা-র প্রেরণা হিসাবে অবচেতনে কাজ করেছে, যেমনটা আপনি বলেছেন।

কিছু সংখ্যক পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে আমরা যে মত বিনিময় করেছি তার মাধ্যমে আমরা আমাদের অনেক চিন্তা বা ধারণাকে যেমন অধিকতর স্বচ্ছ ও তীক্ষ্ণ করতে পেরেছি তেমন পরস্পরকে অনেক সমৃদ্ধ করতে পেরেছি বলেও অনুভব করি। বিশেষত ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাস সম্পর্কে আপনার এমন গভীর আগ্রহ আমাদেরকে মুগ্ধ করেছে। সবশেষে, আমাদের লেখার পাঠ এবং সেগুলির উপর প্রশ্ন ও আলোচনা করতে চাওয়ার জন্য আপনাকে আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি।

আপনার মঙ্গল কামনা করে এখানে বিদায় নিই।

ইতি – শামসুজ্জোহা মানিক

শামসুল আলম চঞ্চল

* নিম্নে প্রত্নতত্ত্ববিদ ডঃ মোহাম্মদ রফিক মোগল-এর স্ক্যানকৃত পত্রটি দেওয়া হল

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ