Banner
সিন্ধু থেকে গঙ্গা : এক সভ্যতার পথযাত্রা (তৃতীয় খণ্ড - আংশিক) — শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল

লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক ও শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ April 10, 2024, 12:00 AM, Hits: 1009

 

(প্রাককথাঃ ‘সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা’ গ্রন্থের প্রথম ও দ্বিতীয় খণ্ড ইতিপূ্র্বে ওয়েবসাইট ‘বঙ্গরাষ্ট্র’-এ প্রকাশিত হয়েছে। এখন একই গ্রন্থের তৃতীয় খণ্ডের শুধুমাত্র প্রথম অধ্যায় যার শিরোনাম হল ‘ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণ, বিজয় ও শাসনঃ একটি পর্যবেক্ষণ’ এখানে প্রকাশিত হল। কাজেই গ্রন্থটির তৃতীয় ও শেষ খণ্ডের যে অংশটুকু এখানে দেওয়া হয়েছে তা একটি অধ্যায় মাত্র এবং পরবর্তী পর্যায়ে আমরা গ্রন্থটির বাকী অংশ প্রকাশ করব।

শামসুজ্জোহা মানিক

শামসুল আলম চঞ্চল

তাঃ ৯ এপ্রিল, ২০২৪)  

প্রথম অধ্যায়

ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণ, বিজয় ও শাসনঃ একটি পর্যবেক্ষণ

আমরা আগের খণ্ডে আলোচনা করেছি যে, সিন্ধু সভ্যতার প্রধানত শান্তিপূর্ণ যুগ শেষ হবার পর সেখানকার অভিবাসীরা গাঙ্গেয় উপত্যকায় বসতি স্থাপন করার পর সমাজ ক্রমশ যুদ্ধের দিকে ঝুঁকে যায়। বিশেষভাবে এখানে লৌহ যুগ শুরু হলে লৌহ নির্মিত কৃষির হাতিয়ারের তুলনায় লৌহ নির্মিত যুদ্ধাস্ত্রের বেশী প্রাপ্যতা থেকে এই ধারণার পক্ষে জোরালো প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর দিক থেকে ক্ষত্রিয় হিসাবে পরিচিত বহু সংখ্যক যোদ্ধা জনগোষ্ঠীর স্বাধীন রাজ্য বা একাধিক কনফেডারেসীর উত্থান থেকে সেই সময়ের সমাজে যুদ্ধের প্রাধান্যের দিকটি বুঝতে পারা যায়। সম্ভবত সমাজকে অব্যাহত যুদ্ধ থেকে ফিরানো ও কৃষিসমাজ রক্ষা করতে চেয়ে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে ভারতীয় সমাজে জৈন, বৌদ্ধ ও কিছু পরে হিন্দু ধর্মের উদ্ভব হয়েছিল

----------------------------------------

আমরা সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা-র দ্বিতীয় খণ্ডে এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেছি যে, প্রাচীনকাল থেকে সমাজে ব্রাহ্মণের উপস্থিতি থাকলেও আজকে হিন্দু ধর্ম হিসাবে যাকে আমরা জানি তার উদ্ভব হয়েছিল, জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উদ্ভবের কিছু পরে।

----------------------------------------   

খ্রীষ্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পারসিকরা ও আরো পরে খ্রীষ্টপূর্ব চতুর্থ শতাব্দীতে গ্রীকরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে উত্তর-পশ্চিম ভারতের কিছু অংশ শাসন করে। এরপরে খ্রীষ্টপূর্ব প্রথম শতাব্দী থেকে আসতে শুরু করে শক ও কুষাণ নামে পরিচিত মধ্য এশিয়ার বিস্তীর্ণ তৃণভূমি থেকে আসা পশুপালক ও যাযাবর জনগোষ্ঠী। আরো পরে খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শতক জুড়ে স্রোতের মত ঢেউয়ের পর ঢেউয়ে ভারতবর্ষে প্রবেশ করে হুন নামে পরিচিত আরো একটি যাযাবর ও পশুচারী জনগোষ্ঠী। শক, কুষাণ ও হুনরা ভারতের মাটিতে আত্মীকৃত হয়ে যায়। আমরা সিন্ধু থেকে গঙ্গাঃ এক সভ্যতার পথযাত্রা-র ২য় খণ্ডে আলোচনা করেছি যে, ব্রাহ্মণরা বহিরাগত এই যোদ্ধা জনগোষ্ঠীকে ক্ষত্রিয়ত্বের মর্যাদা দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় একটি নূতন ধর্মের উদ্ভব ঘটায়, যা হিন্দু ধর্ম নামে পরিচিত। ফলে এই বহিরাগত আক্রমণকারীরা হিন্দু ধর্মের কাঠামোর মধ্যে অবস্থান নিয়ে ভারতীয় সমাজে মিশে যায়।

অষ্টম খ্রীষ্টাব্দের দিক থেকে আরো একটি বিদেশী আক্রমণকারী গোষ্ঠী মুসলিমরা ভারতবর্ষে প্রবেশ করে আংশিকভাবে সিন্ধু ও পাঞ্জাব অধিকার করে। তারা আগের আক্রমণকারীদের মত ভারতীয় সমাজে মিশে যায় নাই, বরং তারা তাদের আনা ধর্মকে জবরদস্তিমূলকভাবে এখানে চাপিয়ে দিতে বদ্ধপরিকর ছিল। তারা শুধু ভারতবর্ষে নয়, সকল স্থানে যেখানেই গেছে ভিন্ন সমাজ ও জনগোষ্ঠীর উপর আক্রমণাভিযান চালিয়েছে সেখানেই তাকে জিহাদ বা ধর্মযুদ্ধ হিসাবে যৌক্তিকতা দিয়েছে। ইসলামের প্রাণশক্তির উৎস হল জিহাদ বা যুদ্ধ। মুহাম্মদকে এই ধর্ম প্রতিষ্ঠার জন্য জিহাদ বা যুদ্ধকে আদর্শায়িত করতে হয়েছে। যেমন, কুরআনে বলা হচ্ছে, “যাহাদিগের প্রতি কিতাব অবতীর্ণ হইয়াছে তাহাদিগের মধ্যে যাহারা আল্লাহে ঈমান আনে না ও পরকালেও নহে এবং আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূল যাহা নিষিদ্ধ করিয়াছেন তাহা নিষিদ্ধ করে না এবং সত্য দীন অনুসরণ করে না, তাহাদিগের সহিত যুদ্ধ করিবে, যে পর্যন্ত না তাহারা নত হইয়া স্বহস্তে জিযযা দেয়।” (সূরা তাওবা: ৯:২৯)। আরবদের প্রতি যুদ্ধের সপক্ষে আল্লাহর নির্দেশ প্রদান করতে কুরআনে দেখা যায়। যেমন, “তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদের নিকট ইহা অপ্রিয়; কিন্তু তোমরা যাহা পসন্দ কর না সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা পসন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ্ জানেন; আর তোমরা জান না।” (সূরা বাকারা: ২:২১৬)। “… যাহারা কুফরী করে আমি তাহাদিগের হৃদয়ে ভীতির সঞ্চার করিব; সুতরাং তাহাদিগের স্কন্ধে ও সর্বাংগে আঘাত কর; …” (সূরা আনফাল: ৮:১২)। “তোমরা তাহাদিগের মুকাবিলার জন্য যথাসাধ্য শক্তি ও অশ্ব-বাহিনী প্রস্তুত রাখিবে এতদদ্বারা তোমরা সন্ত্রস্ত করিবে আল্লাহর শত্রুকে, তোমাদিগের শত্রুকে এবং এতদ্ব্যতীত অন্যদিগকে যাহাদিগকে তোমরা জান না, আল্লাহ জানেন; আল্লাহর পথে তোমরা যাহা কিছু ব্যয় করিবে উহার পূর্ণ প্রতিদান দেওয়া হইবে এবং তোমাদিগের প্রতি জুলুম করা হইবে না।” (সূরা আনফাল: ৮:৬০)। “অতঃপর নিষিদ্ধ মাস অতিবাহিত হইলে মুশরিকদিগকে যেখানে পাইবে হত্যা করিবে, তাহাদিগকে বন্দী করিবে, অবরোধ করিবে এবং প্রত্যেক ঘাঁটিতে তাহাদিগের জন্য ওঁৎ পাতিয়া থাকিবে; কিন্তু যদি তাহারা তওবা করে, সালাত কায়েম করে ও যাকাত দেয় তবে তাহাদিগের পথ ছাড়িয়া দিবে, আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা তাওবা: ৯:৫)

----------------------------------------

এই গ্রন্থে কুরআনের সকল উদ্ধৃতির উৎস: আল-কুরআনুল করীম, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ মাঘ ১৩৭৪, একাদশ মুদ্রণ ডিসেম্বর ১৯৮৭।

  ইসলামী রাষ্ট্রে অমুসলিমদের নিরাপত্তা ও যুদ্ধের দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি লাভের বিনিময়ে যে কর দিতে হয়, তাকে জিয্য়া বা জিজিয়া বলে।

কুফরী অর্থ সত্য গোপন করা বা প্রত্যাখান করা।

যিলকা’দাঃ, যিলহাজ্জ মুহাররাম ও রাজাব এই চার মাস আরববাসীদের কাছে অত্যন্ত পবিত্র ছিল। সেই জন্য তারা এই চার মাসে যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত হত না।

মুশরিক অর্থ পৌত্তলিক, বহুদেবতায় বিশ্বাসী।

সালাত অর্থ নামায।

----------------------------------------

পাতা : ১

যুদ্ধের সপক্ষে, শত্রু পক্ষকে হত্যা ও বন্দী করার সপক্ষে কুরআনে এই রকম আরো বহু আয়াত দেখতে পাওয়া যায়। যেমন, সূরা বাকারা: ২:১৯৩, সূরা আনফাল: ৮:৩৯, সূরা তাহরীম: ৬৬:৯, ইত্যাদি।

যুদ্ধে প্রাপ্ত লুটের মাল যেন মুহাম্মদের অনুসারীরা নিঃশঙ্ক চিত্তে ভোগ করতে পারে এইজন্য তাদের প্রতি কুরআনের আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমন, “যুদ্ধে যাহা তোমরা লাভ করিয়াছ তাহা বৈধ ও উত্তম বলিয়া ভোগ কর ও আল্লাহকে ভয় কর, আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।” (সূরা আনফাল: ৮:৬৯)। এবং “মু’মিনরা যখন বৃক্ষতলে তোমার নিকট বায়‘আত গ্রহণ করিল তখন আল্লাহ্ তাহাদিগের প্রতি সন্তুষ্ট হইলেন, তাহাদিগের অন্তরে যাহা ছিল তাহা তিনি অবগত ছিলেন; তাহাদিগকে তিনি দান করিলেন প্রশান্তি এবং তাহাদিগকে পুরস্কার দিলেন আসন্ন বিজয় ও বিপুল পরিমাণ যুদ্ধে লভ্য সম্পদ যাহা উহারা হস্তগত করিবে; আল্লাহ্ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। আল্লাহ্ তোমাদিগকে প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন যুদ্ধে লভ্য বিপুল-সম্পদের যাহার অধিকারী হইবে তোমরা। .... আরও বহু সম্পদ রহিয়াছে যাহা এখনও তোমাদিগের অধিকারে আসে নাই, উহা তো আল্লাহর নিকট রক্ষিত আছে। আল্লাহ্ সর্ব বিষয়ে সর্বশক্তিমান।” (সূরা ফাত্হ: ৪৮:১৮-২১), ইত্যাদি।

----------------------------------------

বায়’আত অর্থ শিষ্যত্ব গ্রহণ করা, কারো আধিপত্য স্বীকার করে নেওয়া।

----------------------------------------

উপরে উদ্ধৃত কুরআনের আযাত থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি যে, সত্য প্রত্যাখানকারী, পৌত্ত্লিক, ইত্যাদি পরিচিতি আরোপ করে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী জাতি ও জনগোষ্ঠীর উপর পরিচালিত আক্রমণাভিযান, যুদ্ধ, লুণ্ঠনের মাধ্যমে পরাজিত জনগোষ্ঠীর সম্পদ অর্জন - এই সকল কাজই ছিল ধর্ম দ্বারা অনুমোদনপ্রাপ্ত। আর এই যুদ্ধের বা জিহাদের অনুষঙ্গ হিসাবে থাকত ব্যাপক গণহত্যা, লুণ্ঠন, দাসকরণ ও নারী ধর্ষণ। যুদ্ধ-বন্দিনী নারী ও ক্রয়লব্ধ নারী ধর্ষণের সপক্ষে ধর্মের অনুমোদন সম্পর্কে নীচে কুরআনের কিছু আয়াত উল্লেখ করা হল।

“যাহারা নিজদিগের যৌন অংগকে সংযত রাখে, নিজদিগের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসিগণ ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না, …”(সূরা মু’মিনুল: ২৩:৫-৬), “ইহার পর, তোমার জন্য কোন নারী বৈধ নহে এবং তোমার স্ত্রীদিগের পরিবর্তে অন্য স্ত্রী গ্রহণও বৈধ নহে যদিও উহাদিগের সৌন্দর্য তোমাকে বিস্মিত করে, তবে তোমার অধিকারভুক্ত দাসীদিগের ব্যাপারে এই বিধান প্রযোজ্য নহে।” (সূরা আয্হাব: ৩৩:৫২); “এবং যাহারা নিজদিগের যৌন অংগকে সংযত রাখে, তাহাদিগের পত্নী অথবা অধিকারভুক্ত দাসীদিগের ক্ষেত্র ব্যতীত, ইহাতে তাহারা নিন্দনীয় হইবে না-”(সূরা মা‘আরিজ: ৭০:২৯-৩০)। এছাড়া, “এবং নারীর মধ্যে তোমাদের অধিকারভুক্ত দাসী ব্যতীত সকল সধবা তোমাদের জন্যে নিষিদ্ধ, তোমাদের জন্য ইহা আল্লাহ্‌র বিধান।…” (সূরা নিসা: ৪:২৪)।

এখানে বর্ণিত অধিকারভুক্ত দাসীরা হল যুদ্ধে লব্ধ অথবা ক্রয়কৃত। উপরে বর্ণিত কুরআনের আয়াত অনুসারে একজন মুসলমান পুরুষ, ক্রীতদাসী কিংবা যুদ্ধে বন্দীকৃত নারীদের সাথে যৌনসঙ্গম করতে পারে, যা ধর্ষণ ছাড়া কিছু নয়।

মুহম্মদের কথা, কাজ ও সম্মতিকে হাদীস বলা হয়। এই হাদীসগুলিও ইসলামের বিধান হিসাবে স্থান পেয়েছে। অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর চাপিয়ে দেওয়া যুদ্ধের ফলে গণহত্যা, লুণ্ঠন ও দাসকরণ যে বৈধ তার সপক্ষে একটি হাদীস নীচে দেওয়া হল।

‘আবু তাওবা ... সহল ইবন হানযালিয়্যা (রা) বর্ণনা করেন যে, তাঁরা হুনায়নের যুদ্ধের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর সঙ্গে সফরে ছিলেন। তখন দ্রুতগতিতে উট চালিয়ে সন্ধ্যাকালে মাগরিবের নামাযের সময় রাসূলুল্লাহ্ (সা)-এর নিকট গিয়ে পৌঁছলেন। এমন সময় একজন অশ্বারোহী সৈনিক এসে তাঁকে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আমি আপনাদের নিকট হতে আলাদা হয়ে ঐ সকল পাহাড়ের উপর আরোহণ করে দেখতে পেলাম যে, হাওয়াযিন গোত্রের স্ত্রী-পুরুষ সকলেই তাদের উট, বকরী সবকিছু নিয়ে হুনায়নে একত্রিত হয়েছে। তা শুনে রাসূলুল্লাহ্ (সা) মুচকি হাসি দিয়ে বললেন, ঐ সকল বস্তু আল্লাহ্ চাহেত আগামীকাল মুসলিমদের গণীমতের সামগ্রীতে পরিণত হবে।’ (আবু দাউদ শরীফ, তুতীয় খণ্ড, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯২, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, হাদীস নং-২৪৯৩)

গণীমতের সামগ্রী বা মাল অর্থ যুদ্ধে লুণ্ঠনের ফলে অর্জিত শত্রপক্ষের নারী, পুরুষ, শিশু ও অন্যন্য সকল সামগ্রী। ভিন্ন সম্প্রদায়ের উপর গণহত্যা চালানো, তাদের নারীদের বন্দী, দাসকরণ ও ধর্ষণ ইসলামে বৈধ। এই রকম অনেক হাদীস আছে যেগুলির মধ্যে দুইটি নীচে দেওয়া হল।

‘মুহাম্মদ ইবন আর’আরা (র) ... ... আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত, কতিপয় লোক (বনী কুরায়যার ইয়াহূদীগণ) সা’দ ইবন মু’আয (রা)-কে সালিশ মেনে (দুর্গ থেকে) নেমে আসে (তিনি আগত ছিলেন) তাঁকে নিয়ে আসার জন্য লোক পাঠানো হল। তিনি গাধায় সাওয়ার হয়ে আসলেন। যখন (যুদ্ধকালীন অস্থায়ী) মসজিদের নিকট আসলেন, তখন নবী করীম (সা) বললেন, তোমাদের শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তি অথবা (বললেন) তোমাদের সরদার আসছেন তাঁর দিকে দাঁড়াও। তারপর তিনি বললেন, হে সা’দ! তারা (বনী কুরায়যার ইয়াহূদীগণ) তোমাকে সালিশ মেনে (দুর্গ থেকে) বেরিয়ে এসেছে। সা’দ বললেন, আমি তাদের সম্পর্কে এ ফায়সালা দিচ্ছি যে, তাদের যোদ্ধাদেরকে হত্যা করা হোক এবং শিশু ও মহিলাদেরকে বন্দী করে রাখা হোক। (তাঁর ফায়সালা শুনে) নবী করীম (সা) বললেন, তুমি আল্লাহ্ তা’আলার ফায়সালা অনুযায়ী ফায়সালা দিয়েছ অথবা (বলেছিলেন) তুমি বাদশাহ (আল্লাহর) ফায়সালা অনুযায়ী ফায়সালা করেছ।’ (বুখারী শরীফ, ষষ্ঠ খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, হাদীস নং-৩৫২৯)

‘ইসহাক (র) ... ... আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বনী মুসতালিক যুদ্ধ সম্পর্কে বর্ণনা করেন যে, মুসলিম মুজাহিদগণ যুদ্ধে কতিপয় বন্দিনী লাভ করলেন। এরপর তাঁরা এদেরকে ভোগ করতে চাইলেন। আবার তারা যেন গর্ভবতী হয়ে না পড়ে, সে ইচ্ছাও পোষণ করছিলেন। তাই তারা নবী (সা)-কে আযল সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। নবী (সা) বললেনঃ এতে তোমাদের কোন লাভ নেই। কারণ আল্লাহ্ তা’আলা কিয়ামত পর্যন্ত যত জীবন সৃষ্টি করবেন, তা সবই লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন। মুজাহিদ (র) কাযআ (র)-এর মধ্যস্থতায় আবূ সাঈদ খুদরী (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, নবী (সা) বলেছেনঃ যত জীবন সৃষ্টি করার সিদ্ধান্ত করা হয়েছে আল্লাহ্ তা’আলা অবশ্যই তা সৃষ্টি করবেন।’ (বুখারী শরীফ, দশম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, হাদীস নং-৬৭৯২)

----------------------------------------

মুসলমানরা যুদ্ধ-বন্দী নারীদের ভোগ করে পরে সাধারণত দাসী হিসা্বে বাজারে বিক্রী করে দিত। নারীরা গর্ভবতী হলে তাদের দাসী হিসাবে বিক্রয়মূল্য কমে যাবার কারণে তারা এই বিষয়ে সচেতন ছিল।

আযল অর্থ হল নারীর যৌনাঙ্গের বাইরে পুরুষের শুক্রপাত ঘটানো।

----------------------------------------

মুসলমানদের জন্য অন্য ধর্মের ধর্ম-মন্দির ধ্বংসও ছিল ইসলাম ধর্ম দ্বারা অনুমোদনপ্রাপ্ত। এরকম একটি হাদীস নীচে বর্ণনা করা হল যেখানে মুহাম্মদ যুল-খালাসাহ নামে মূর্তি পূজারীদের একটি মন্দির ধ্বংস করতে তার অনুসারীদের উদ্বুদ্ধ করেন। হাদীসটি এই রকমঃ

‘আলী ইব্ন আব্দুল্লাহ্ (র) ... জারীর (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ (সা) বললেনঃ তুমি কি যুল-খালাসাহকে নিশ্চিহ্ন করে আমাকে চিন্তামুক্ত করবে? সেটা ছিল এক মূর্তি। লোকেরা এর পূজা করত। সেটাকে বলা হত ইয়ামানী কাবা। আমি বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আমি ঘোড়ার পিঠে স্থির থাকতে পারি না। তখন তিনি আমার বুকে জোরে একটা থাবা মারলেন এবং বললেনঃ ইয়া আল্লাহ্! আপনি তাকে স্থির রাখুন এবং তাকে হিদায়েতকারী ও হিদায়েতপ্রাপ্ত বানিয়ে দিন। তখন আমি আমারই গোত্র আহমাসের পঞ্চাশজন যোদ্ধাসহ বের হলাম। সুফিয়ান (র) বলেনঃ তিনি কোন কোন সময় বলেছেনঃ আমি আমার গোত্রের একদল যোদ্ধার মধ্যে গেলাম। তারপর আমি সেই মূর্তিটির নিকট গিয়ে তাকে জ্বালিয়ে ফেললাম। এরপর আমি নবী (সা)-এর কাছে এসে বললামঃ ইয়া রাসূলুল্লাহ্! আল্লাহর কসম! আমি যুল-খালাসাকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে পাঁচড়াযুক্ত উটের ন্যায় করে ছেড়েই আপনার কাছে এসেছি। তখন তিনি আহমাস গোত্র ও তার যোদ্ধাদের জন্য দু’আ করলেন।’ (বুখারী শরীফ, নবম খণ্ড, দ্বিতীয় সংস্করণ, ২০০০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন, ঢাকা, হাদীস নং-৫৭৮১)।

পাতা : ২

মুসলিম আক্রমণকারীদের ভারতে আক্রমণ, লুণ্ঠন, গণহত্যা, ধ্বংস, যুদ্ধে নারী-পুরুষ বন্দী ও দাসকরণ এবং নারী-ধর্ষণ

ধর্মীয়ভাবে এটাই প্রচার করা হয় যে, ইসলামের সেনাবাহিনী ভারতসহ পৃথিবীর অমুসলিম জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণাভিযান পরিচালনা করেছিল অমুসলিম জনগোষ্ঠীর উপর জিহাদ পরিচালনা করে তাদেরকে ইসলামের পতাকা তলে আনবার জন্য। প্রকৃতপক্ষে এই জিহাদের অন্তর্গত উদ্দেশ্য ছিল অপর জনগোষ্ঠীর সম্পদ লুণ্ঠন, তাদের নারী-পুরুষদের বন্দী করে দাসকরণ, বন্দী নারীদের ধর্ষণ ও তাদের ধর্মীয় মন্দির বা প্রতিষ্ঠানসমূহের ধ্বংসসাধন ও এইগুলির অবমাননা। নীচে ভারত অভিযানে মুসলিম বাহিনীর ভূমিকা সম্পর্কে আলোচনা করার সময় আমরা দেখতে পাব যে, মুসলিম আক্রমণকারী বাহিনী ভারতবর্ষে হত্যা, ধ্বংস, লুণ্ঠন, অপহরণ ও ধর্ষণমূলক যে সকল কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছিল সবগুলিই ধর্মীয় বিধান দ্বারা অনুমোদনপ্রাপ্ত ছিল। এই বিবরণগুলির প্রায় সকল দলিল সমকালীন বিশেষত মুসলমান ঐতিহাসিকদের নির্ভরযোগ্য রচনা থেকে পাওয়া।

যুদ্ধ ও বৈদেশিক আক্রমণাভিযানের সাথে মুসলিম যুগের আগেও ভারতবাসী পরিচিত ছিল পারসিক, গ্রীক ও শক, কুষাণ ও হুনদের দ্বারা ভারতভূমির উপর অভিযানের কারণে। কিন্তু মুসলিম আক্রমণকারীরা ভারতে আক্রমণাভিযান শুরু করলে ভারতবাসী এমন এক ধরনের যুদ্ধের মুখোমুখি হয় যার সম্পর্কে তাদের পূর্ব পরিচয় প্রায় ছিল না বা থাকলেও অল্প ছিল। এই সকল যুদ্ধের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল মুসলিম আক্রমণকারীদের সাধারণ মানুষের উপর ভয়ংকর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পরিচালনা, সাধারণ মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ। এছাড়া ছিল যুদ্ধ-বন্দীদের ধরে নিয়ে গিয়ে দাস ও দাসীতে রূপান্তরিত করে নিজ এলাকার বাজারে বিক্রী করা কিংবা তাদের ব্যবহার করা ছিল একটি নূতন অভিজ্ঞতা।

ভারতবর্ষে ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদ কাসিমের নেতৃত্বে আরব বাহিনীর আক্রমণাভিযান থেকে শুরু করে ১৭৬৮ খ্রীষ্টাব্দে আহমদ শাহ আবদালীর বাহিনীর আক্রমণাভিযান পর্যন্ত ভারতবর্ষ ছিল বিভিন্ন সময়ে কিছু বিরতি ছাড়া মুসলমানদের বহিরাক্রমণ ও ভয়ংকর যুদ্ধের লীলাভূমি। এই বিষয়গুলিকে স্পষ্ট করার জন্য নীচে মুসলিম আক্রমণকারীদের অভিযানসমূহের উপর ধারাবাহিকভাবে সংক্ষেপে আলোচনা করা হল।

মুহাম্মদ কাসিমের আগেও কিছু সংখ্যক আরবীয় যোদ্ধা ভারত আক্রমণের উদ্দেশ্যে বালুচিস্তানের কাছাকাছি অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সিন্ধুর প্রাচীন ইতিহাস গ্রন্থ চাচ্নামাহ্-য় বলা হয়েছে যে, খলীফা আলীর শাসন কালে হিজরী ৪০ সালে (৬৬০ খ্রীষ্টাব্দে) সাগীর বিন দাউদের নেতৃত্বাধীন বাহিনীকে হিন্দ ও সিন্ধে অভিযানেরর জন্য পাঠানো হয়। তারা বালুচিস্তানের মাকরান পর্যন্ত পৌঁছেছিল। সেখানকার বিজিত অঞ্চল থেকে তারা প্রচুর পরিমাণ লুণ্ঠিত মাল ও দাস-দাসী নিয়ে যায়। পরবর্তী খলীফা মুয়াবিয়া বিন আবু সুফিয়ানও সিন্ধু জয়ের জন্য তার সেনাবাহিনী পাঠান, যারা প্রতিবারই প্রচুর লুটপাটের মালামাল ও যুদ্ধ-লব্ধ দাস-দাসী নিয়ে যায়। তবে এই সময় পর্যন্ত কেউই মূল সিন্ধু রাজ্য দখল করতে পারে নাই। পরে খলীফা আবদুল মালিক বিন মারওয়ান হিন্দ ও সিন্ধের প্রশাসনিক ক্ষমতা হাজ্জাজ বিন ইউসুফকে অর্পণ করেন। হাজ্জাজ তার ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহম্মদ বিন কাসিমকে হিন্দ অঞ্চলে প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ করেন। সিন্ধু অঞ্চলে আক্রমণের জন্য মুহম্মদ কাসিম বিপুল সংখ্যক যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্যবাহিনী সহ পাল তুলা নৌকা যোগে বর্তমান বালুচিস্তানের মকরান অঞ্চলে এসে উপস্থিত হলেন। দেবল নামে হিন্দু অধ্যুষিত একটি বন্দর মুহম্মদ কাসিম আক্রমণ করেন। চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন যে, আক্রমণের নবম দিনে কাসিমের সৈন্যরা দুর্গের গম্বুজ ও পতাকাদণ্ডটি ধ্বংস করার পর যখন দুর্গের দেয়াল বেয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছিল তখন দেবলবাসীরা দুর্গের দ্বার খুলে দিল ও প্রাণ ভিক্ষা চাইল। জবাবে মুহম্মদ কাসিম বললেন যে, দেবল নগরবাসীদের কাউকে ক্ষমা করার কোনো আদেশ তিনি পান নাই। এরপর সশস্ত্র সৈন্যরা তিন দিন যাবত অজস্র নরহত্যা করল। এই তিন দিনে দেবলের কত জন সাধারণ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল তার কোনো ঐতিহাসিক দলিল নাই। মুহম্মদ কাসিম এরপর সেখানকার মন্দিরটিতে গেলেন। সম্ভবত সেটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল। যারা মন্দিরটির ভিতরে আশ্রয় নিয়েছিল তারা দরজা বন্ধ করে দিতে চাইল এবং আগুনে আত্মাহুতি দিতে চাইল। সেখানকার দুইজন দ্বাররক্ষীকে টেনেহিঁচড়ে বের করে এনে হত্যা করা হল। এখন আর প্রবেশে কোনো বাধাই রইল না। চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন যে, বুদ্ধের সুরক্ষাপ্রাপ্ত সাতশত সুন্দরী রমণীকে আটক করা হল। তাদের গায়ে মহামূল্যবান গহনা ও মণিমুক্তা খচিত পরিধেয় বস্ত্র ছিল। একসঙ্গে চারজন যোদ্ধাকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হল। কেউবা বলেন, চার শত যোদ্ধা অতর্কিত  হানা দিয়ে তাদের গহনাগুলি কেড়ে নিয়েছিল।

----------------------------------------

চাচ্নামাহ্ গ্রন্থটির মূল ফারসী অনুবাদক ও সংকলক মুহম্মদ আলী বিন আবু বকর কুফির বর্ণনায় জানা যায় যে, চাচ্নামাহ্-র মূল গ্রন্থটি বিশুদ্ধ হিজাজী ভাষায় লিখিত হয়েছিল। গ্রন্থটিতে আরব ও সিরিয়াবাসী বীরদের বীরত্বগাঁথা বর্ণিত ছিল। আলী বিন কুফি মূলত ইরাক অঞ্চলের কুফার অধিবাসী ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি দক্ষিণ পাঞ্জাবের উচ্ অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। আদি ইতিহাস অন্বেষণের ধারাবাহিকতায় তিনি শুক্কুর ও রোহরি অঞ্চলের মাঝামাঝি ভাকর দুর্গে সেখানকার সম্মানিত কাজী সাকিফি বংশের উত্তরপুরুষ ইসমাইল বিন আলী বিন মুহম্মদ বিন মুসা বিন তাঈ বিন ইয়াকুব বিন তাঈ বিন মুসা বিন মুহম্মদ বিন শাঈবান বিন ওসমান সাকিফিকে তিনি বিজ্ঞ পরামর্শদাতা হিসাবে কাছে পেলেন। কাজী জানালেন যে, আরব আক্রমণের সময়ের সিন্ধু অঞ্চলের বিশদ বিবরণ সংবলিত একটি গ্রন্থ তাঁর পূর্বপুরুষদের একজন লিখে রেখে গেছেন। পাণ্ডুলিপিটি তিনি সযত্নে সংরক্ষণ করে রেখেছেন। বিজয়ী বীর মুহম্মদ কাসিম ছিলেন সাকিফি বংশোদ্ভূত। আর তাই কাজী ইসমাইল হলেন বিজয়ীর বংশের একজন উত্তরসূরী। গ্রন্থটির মূল আরবী রচয়িতার নাম জানা যায় না। মুহম্মদ আলী কুফি ৬১৩ হিজরী সালে অর্থাৎ ১২১৬ খ্রীষ্টাব্দে চাচ্নামাহ্-র অনুবাদ ও সংকলন করেন।

দেখুনঃ মধুসূদন মিহির চক্রবর্তী (অনূদিত), চাচ্নামাহঃ সিন্ধের প্রাচীন ইতিহাস, মূলঃ মুহম্মদ আলী বিন আবুবকর কুফি (১২১৬ খ্রীষ্টাব্দ), অন্বেষা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪, পৃঃ ৯১,৯২।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২২-১২৩।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৩-১২৪।

----------------------------------------

চাচ্নামাহ্-র লেখক  আরো লিখেছেন যে, দেবল বিজয়ের পর যুদ্ধলব্ধ দাস-দাসীদের ও মালামাল সমূহ আনা হলে লুটের মালামালের একপঞ্চমাংশ ধর্মীয় বিধি অনুযায়ী আলাদা করে রাখতে ও খলীফার রাজকোষে পাঠিয়ে দিতে মুহম্মদ কাসিম নির্দেশ দিলেন। সেই অনুযায়ী দেবলে লুণ্ঠিত মালামালের পাঁচ ভাগের এক ভাগ হাজ্জাজের কোষাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হল। হাজ্জাজের কাছে পাঠানো এই লুটের মালামালের মধ্যে ছিল নগদ অর্থ ছাড়াও দেবলের প্রশাসকের দুই কন্যা।

দুর্গবেষ্টিত দেবল নগরীটি দখল করার পর মুহম্মদ কাসিম পচাত্তর মাইল দূরবর্তী নিরুন দুর্গ অভিমুখে যাত্রা করলেন। নিরুনের জনগণ তখন দুর্গের দ্বারগুলি বন্ধ করে দিল। চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন, স্থানটির শাসনকর্তা ও জনগণের নেতা ছিলেন একজন সামানি (বৌদ্ধ শ্রমণকে চাচ্নামাহ্-য় সামানি বলা হয়েছে)। মুহম্মদ কাসিম সৈন্যবাহিনীর রসদের আকালের জন্য ক্রুদ্ধ হলেন, বিশেষ করে সামরিক অশ্বের খাদ্য সংকট তাকে ভাবিয়ে তুলল। পরে মুহম্মদ কাসিমের সেনাদলের প্রতি সহযোগিতার উদ্দেশ্যে সেখানকার শাসনকর্তা দুর্গের দ্বার খুলে দিলেন ও স্থানীয় অধিবাসীরা সৈনিকদের সাথে ক্রয়বিক্রয় এবং ব্যবসা-বাণিজ্য শুরু করল। পর দিন সকালে শ্রমণটি প্রচুর উপহার ও অজস্র শ্রদ্ধার্ঘ নিয়ে কাসিমের কাছে হাজির হলেন। মুহম্মদ কাসিমকে বিশেষ অতিথির মর্যাদা দানে আপ্যায়ন করার উদ্দেশ্যে তিনি এত প্রচুর পরিমাণে রসদ সরবরাহ করলেন যে সৈন্যরা তাদের প্রয়োজনের পর্যাপ্ত পরিমাণ শস্য পেল। তারপর মুহম্মদ কাসিম দুর্গের অভ্যন্তরে একজন প্রতিনিধি নিয়োগ করলেন। বুদ্ধের মন্দিরের এলাকাটিতে একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন ও জনগণকে নামাজের জন্য আহবান জানাতে আযান দিবার জন্য একজন মুয়াজ্জিন নিয়োগ করলেন। নামাজ ও ধর্ম বিষয়ক দিকনির্দেশনা দিবার জন্য একজন ইমামকে নিযুক্ত করলেন।

----------------------------------------

চাচ্নামাহ্-র আরেকটি স্থানে বলা হয়েছে যে, ’তিনি সেখানকার দেবমন্দিরটির এলাকায় একটি মসজিদ নির্মাণ করলেন।’ প্রকৃতপক্ষে এটি একটি বৌদ্ধ মন্দির ছিল, হিন্দুদের দেব মন্দির নয়। তার মানে বৌদ্ধ মন্দিরের এলাকায় মসজিদ নির্মাণ করা হয়েছিল। দেখুনঃ পৃঃ ১৪৯।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩০-১৩৪।

----------------------------------------

এরপর মুহম্মদ কাসিম দিন রাত অনবরত আক্রমণ চালিয়ে শিবিস্তান দুর্গে প্রবেশ করলেন। তিনি সেখান থেকে বিপুল সোনা ও রূপা লুণ্ঠন করলেন। সেখানকার জনগণের কাছ থেকে তিনি প্রচুর পরিমাণ অলংকার ও নগর অর্থ নিশ্চিত করলেন। তারপর ইসলামের সেনাবাহিনীর মধ্যে ন্যায্য হিস্যা মোতাবেক লুটের মালামাল ভাগ বাটোয়ারা করা হল। সকল লুটের মালামালের পাঁচ ভাগের এক ভাগ সহ বন্দী নারী-পুরুষদের দাস হিসাবে হাজ্জাজের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হল। মুহম্মদ কাসিম সেখানে অবস্থান করে লুটের মালামাল ও যুদ্ধ বন্দীদের বণ্টনের দায়িত্ব পালন করলেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৫-১৩৮।

----------------------------------------

পাতা : ৩

আগে যেমন বলা হয়েছে যে, ইসলামী বাহিনীর সকল কর্মের যুক্তিগ্রাহ্যতা দিবার জন্য আল্লাহ্ ও কুরআনের কথা উল্লেখ করা হত। ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে রাজা দাহিরের বাহিনীকে মোকাবিলা করার সময় মুহম্মদ কাসিম তার আরব সৈন্যদের উদ্দেশ্যে অনুপ্রাণিত করার জন্য বলছেন, “ওহে আরববাসীগণ,  শত্রুরা দল বেঁধে প্রস্তুত হয়ে এসেছে আমাদের সাথে যুদ্ধ করার জন্য। আপনাদেরও সর্বোচ্চ পরিমাণ সচেষ্ট হতে হবে, কারণ তারা তাদের সম্পদ, পরিবার, বাড়ি-ঘর গৃহস্থালী ও সম্পত্তির খাতিরে ভয়ংকরভাবে লড়াই করবে। মহান আল্লাহর সহযোগিতায় তাদের বিরুদ্ধে অবতীর্ণ হোন। দৈব সুরক্ষা ও দৈবের কৃপায় আমরা আশা করি তাদেরকে আমাদের ধারালো ও শক্তিশালী তরবারির আহার্যে পরিণত করব এবং পরাজিত ও বশ্যতা স্বীকার করাতে সক্ষম হব। তখন পরিবার ও সম্পত্তি থেকে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করে দিব এবং প্রচুর যুদ্ধলব্ধ মালামাল নিশ্চিত করব। সংকল্পে অটল থাকুন, বিচলিত হবেন না। ... ... মনে রাখবেন, মহান ও মহিমাময় আল্লাহ্ ধার্মিকদের জীবনের সুখী পরিসমাপ্তি ঘটান। সবসময় আল্লাহর পবিত্র কুরআন থেকে আবৃত্তি করবেন এবং বলবেন, ”লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু।”

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৩।

----------------------------------------

৭১১ খ্রীষ্টাব্দে সিন্ধুর রাওয়ার দুর্গ মুহম্মদ কাসিমের বাহিনীর দখলে চলে যাবার পর সেখানে যে সমস্ত ধনসম্পদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল সবই বিজয়ীদের হস্তগত হয়। শুধুমাত্র রাজা দাহিরের পুত্র জয়সিয়া চলে যাবার সময় কিছু ধনসম্পদ সাথে করে নিয়ে গিয়েছিলেন। সেগুলি ছাড়া অবশিষ্ট সম্পদ ও লুটের মালামাল মুহম্মদ কাসিমের সামনে উপস্থিত করা হল। গণনা করে দেখা গেল যে, বন্দী নারী ও পুরুষের সংখ্যা ষাট হাজারের কাছাকাছি। এদের মধ্যে রাজ পরিবারের ত্রিশ জন যুবতী ছিলেন। যুবতীদের মধ্যে হাস্নাহ নামে রাজা দাহিরের এক ভাইয়ের মেয়েও ছিলেন। মুহম্মদ কাসিম এদের সবাইকে হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। বন্দিনী নারীদের সহ রাজা দাহিরের কর্তিত মস্তক, লুটের মালামালের এক পঞ্চমাংশ রাজকীয় কোষাগারে জমা দিবার জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল। দাহিরের মস্তক, নারীগণ ও লুটের মালামাল হাজ্জাজের কাছে পৌঁছাল। তিনি তখনই ভূমিতে নতজানু হয়ে আল্লাহর উদ্দেশ্যে সেজদায় পড়লেন এবং আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন, ”পৃথিবীর এই রাজ্যটির ক্ষমতা ও অন্যান্য ধনরাশির সাথে উন্মুক্ত ও গুপ্ত বহু সম্পদরাশি আমার মুঠোর মধ্যে চলে এসেছে।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৩-২১৪।

----------------------------------------

চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন যে, হাজ্জাজ তখন দাহিরের মস্তক, রাজকীয় ছত্রীসমূহ এবং ধনসম্পদসমূহ এবং রাজকীয় যুদ্ধবন্দীদেরকে তৎকালীন খলীফা ওয়ালিদের কাছে পাঠালেন। উপহার সামগ্রীর সাথে পাঠানো চিঠিটি হাতে পেয়ে খলীফা সেটি পড়লেন এবং মহান ও সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি প্রশংসা জ্ঞাপন করলেন। তিনি রাজপরিবারের সেইসব নারীদের মধ্য থেকে কয়েক জনকে বিক্রী করে দিলেন এবং অন্যদেরকে উপহার হিসাবে বিলিয়ে দিলেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৪।

----------------------------------------

এই যুদ্ধ জয়ের পরের বিবরণ দিয়েছেন চাচ্নামাহ্-র লেখক। তিনি লিখেছেন, ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গটির পতনের পর রাজা দাহিরের স্ত্রী রাণী লাডি ও রাজপুত্র মিলে শত্রু সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চাইলেন। তখন তারা আলর দুর্গে অবস্থান করছিলেন। মুহম্মদ কাসিমের সৈন্যবাহিনী দুর্গ আক্রমণ করলে রাণী লাডি সংকল্প করেছিলেন যে, যদি কোনো কারণে দুর্গের পতন হয়, তাহলে তিনি অনুসারী ও সন্তানদের সহ জ্বলন্ত অগ্নিতে আত্মাহুতি দিবেন। মুসলমান আগ্রাসনের সময়ে ভারতবর্ষে এই বৈশিষ্ট্য দেখা গিয়েছিল যে, মুসলমান সৈন্যবাহিনীর হাতে নারীরা নিজেদের ধর্ষিত হওয়া ও অবমাননাকর দাসত্বের পরিবর্তে অগ্নিতে আত্মাহুতি দিতে চাইত। যাইহোক, আকস্মিকভাবে দুর্গটি আরব সৈন্যদের হাতে চলে গেলে তারা সকলে আরব সৈন্যদের হাতে বন্দী হলেন। পরবর্তীতে মুহম্মদ কাসিমের সামনে সকল লুণ্ঠিত মালামাল ও বন্দীদের হাজির করা হল। তিনি সকল সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন যে, দুর্গের ভিতর থেকে বন্দী করা দাহির পত্নী লাডি ও দাহিরের অন্য একজন পত্নীর গর্ভজাত দুই জন কুমারী কন্যাকে তার সামনে হাজির করা হোক। তার আদেশ অনুসারে সেই নারীদের তার সামনে উপস্থিত করা হল ও একজন পরিচারকের দায়িত্বে তাদেরকে অন্য বন্দীদের থেকে আলাদা করে বসতে দেওয়া হল। রাজকোষের জন্য এক পঞ্চমাংশ লুটের মালামাল ও যুদ্ধবন্দীদের নির্বাচন করা হল। নির্বাচিত এই যুদ্ধবন্দীদের সংখ্যা দাঁড়াল কুড়ি হাজারের মত। অবশিষ্টদের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেওয়া হল। চাচ্নামাহ্-র লেখক আরো লিখেছেন, মুহম্মদ কাসিম তখন কারিগর, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের প্রতি তার ক্ষমা সুন্দর দরাজহস্ত প্রসারিত করেছিলেন। তাই বন্দীদের ভিতরে যারা কারিগর, ব্যবসায়ী ও সাধারণ জনগণের শ্রেণী ভুক্ত ছিল তাদেরকে ছেড়ে দেওয়া হল। তারপর তিনি জল্লাদখানায় এলেন এবং তার উপস্থিতিতেই সামরিক শ্রেণীর সকল যোদ্ধাকে শিরশ্ছেদ করতে নির্দেশ দিলেন। বলা হয় যে, এই উপলক্ষে ছয় হাজার লড়াকু যোদ্ধাকে শিরশ্ছেদ করে হত্যা করা হয়। কেউ কেউ এই সংখ্যাটি প্রায় ষোল হাজার বলেন। অবশিষ্ট লোকদের ক্ষমা করা হয়েছিল।

----------------------------------------

  প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৫-২২৬।

প্রগুক্ত, পৃঃ ২২৬।

----------------------------------------

চাচ্নামাহ্-র লেখক আরো লিখেছেন, মুহম্মদ কাসিম এরপর সকল প্রজার উপর আল্লাহর পবিত্র রাসূলের প্রণীত আইন অনুযায়ী কর ধার্য করলেন। যারা ইসলাম ধর্মকে গ্রহণ করল তারা দাসত্ব ও জিজিয়া কর থেকে মুক্ত হল এবং ক্ষতি সাধন থেকে বেঁচে গেল। যারা ইসলাম গ্রহণ করল না তাদের উপর জিজিয়া কর ধার্য করা হল। এরপরেও কিছু সংখ্যক লোক তাদের মাতৃভূমিতে থেকে যাওয়ার সংকল্প করল কিন্তু অন্যরা তাদের পূর্ব পুরুষের ধর্ম আঁকড়ে ধরে রাখতে দলে দলে দেশ ছেড়ে পালাতে শুরু করল। তাদের ঘোড়াগুলিসহ গবাদিপশু ও অন্যান্য সম্পত্তি তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হল। মুহম্মদ কাসিম এরপর কারিগর ও বণিকদের গণনা করার আদেশ দিলেন। সাধারণ জনগণের মধ্য থেকে প্রায় এক হাজার লোককে গণনা করে আলাদা করা হল। লুটের ফলে যেহেতু তারা তাদের সম্পত্তি হারিয়েছে তাই মুহম্মদ কাসিম মাথাপিছু কর হিসাবে ১২ দিরহাম ওজনের রৌপ্য নির্ধারণ করলেন। তার পর তিনি দলপতি ও গ্রাম প্রধানদের রাজস্ব আদায়ের জন্য নিযুক্ত করলেন। তিনি গ্রামবাসী ও নগরবাসী জনগণের রাজস্ব আদায় করার দায়িত্ব তাদের উপর ন্যস্ত করলেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৬-২২৮।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২৮।

----------------------------------------

মুহম্মদ কাসিমের সেনাবাহিনী যখন রাওয়ার দুর্গ ঘেরাও করে অনবরত আক্রমণ চালাতে লাগল তখন রাণী বাঈ দুর্গের ভিতরে থাকা অন্য রাণীদের এক জায়গায় জড়ো করে তাদের উদ্দেশ্যে মুহম্মদ কাসিমের সেনাবাহিনীর কাছ থেকে বিপদের কথা জানিয়ে আগুনে আত্মাহুতি দিবার আহবান জানালে সকল উপস্থিত নারী এক মত পোষণ করেন এবং তারা একটি বিশাল ঘরের মধ্যে দাহ্য বস্তু নিয়ে আগুন জ্বালালেন। এরপর দ্রুত সময়ের মধ্যে নিজেরা পুড়ে ছাই হয়ে গেলেন। মুহম্মদ কাসিম এরপর দুর্গ দখলে নিলেন। তিনি সেখানে থাকা ছয় হাজার লড়াকু সৈন্যকে হত্যা করলেন। তাদের অনুসারী ও পোষ্যদের পাশাপাশি নারী ও শিশুদের বন্দী করা হল।

----------------------------------------

  প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১২-২১৩।

----------------------------------------

মুহম্মদ কাসিম এরপর সিন্ধু অঞ্চলের আশেপাশের অন্যান্য স্থানীয় শাসকদেরকে আত্মসমর্পণ করে ইসলাম গ্রহণের জন্য চিঠি লিখলেন। ব্রাহ্মণাবাদের কাছে পৌঁছে তিনি বার্তাবাহকদের সেখানে পাঠিয়ে প্রস্তাব রাখলেন যে, হয় ইসলাম গ্রহণ করতে হবে, নয় জিজিয়া কর দিতে হবে। এই দুই প্রস্তাবের কোনোটাই যদি তারা গ্রহণ না করে তাহলে তাদেরকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৮, ২১৯।

----------------------------------------

পাতা : ৪

দীর্ঘ ছয় মাস অবরোধের পর ব্রাহ্মণাবাদ দুর্গে বসবাসকারী নাগরিকরা পরিবার-পরিজন ও সন্তান-সন্ততি সহ অনুকম্পা লাভের জন্য মুহম্মদ কাসিমের কাছে উপস্থিত হল ও ক্ষমা ভিক্ষা চাইল। চাচ্নামাহ্-র লেখক লিখেছেন, উভয়পক্ষের সম্মতি অনুযায়ী দৃঢ় একটি চুক্তি সম্পাদিত হল ও মুহম্মদ কাসিম তাদের ক্ষমা মঞ্জুর করলেন। লড়াইয়ে সমর্থ পুরুষদের সবাইকে শিরশ্ছেদ করা হল। তাদের অনুসারী ও আশ্রিতজনদের কারাগারে নিক্ষেপ করা হল। যাদের বয়স ৩০ বৎসর বা তার চেয়ে কম ছিল তাদেরকে শিকলবন্দী করা হল। অসংখ্য লোককে হত্যা করা হল এবং অবশিষ্ট জনগণের উপর রাজস্ব নির্ধারণ করা হল। ইসলামের সৈনিক মুহম্মদ কাসিমের ক্ষমার নমুনা বটে!

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২২২-২২৩।

----------------------------------------

ভারতবর্ষে ইসলামী বাহিনী ইসলাম প্রচারের সূচনালগ্নে যে নির্মমতা ও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটিয়েছিল তার বিবরণ এখানেই শেষ নয়। চাচ্নামাহ্-য় আরেকটি এই ধরনের বিবরণ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, মুহম্মদ কাসিম বিয়াস নদীর তীরে গোলকন্দহ্ নামে এক দুর্গে এসে পৌঁছালেন। আরব সৈন্যদের আগমনের সংবাদ পেয়ে দুর্গবেষ্টিত নগরীটির জনগণ যুদ্ধ করার জন্য অগ্রসর হল। তখন অনেকগুলি যুদ্ধ সংঘটিত হল এবং উভয় পক্ষেই প্রচুর রক্ত স্রোত বয়ে গেল। কিন্তু যখনই বিকালের নামাজের সময় উপস্থিত হত তখন আরব সৈন্যরা ‘আল্লাহু আকবর’ রণধ্বনিতে গর্জে উঠত এবং ডান ও বাম দিকে বিশাল আক্রমণ করে বসত। শত্রুরা তখন পালিয়ে যেত ও দুর্গের ভিতরে আশ্রয় নিত। তারপর তারা কেল্লা প্রাচীরের শীর্ষদেশ থেকে তীর বর্ষণ করত ও ফিঙ্গা থেকে পাথর ছুড়ে মারত। এভাবে প্রায় সপ্তাহ খানেক ধরে অবরোধ চলল। এক সময়ে রসদ সরবরাহের অভাবে তাদের সৈন্য শিবিরে দুর্ভিক্ষ শুরু হল। কারণ তাদের রসদ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।  অবশেষে গোলকন্দহ্-র শাসক রাতের অন্ধকারে পালিয়ে গেলেন। দুর্গের শাসকের প্রস্থানের পর নগরটির নিরীহ জনগণ ও সেই অঞ্চলের কারিগর ও বণিক শ্রেণীর লোকেরা আরবীয় সেনাপতিকে চিঠি লিখে জানালেন, ”আমরা সকলেই শাসকের অধীন প্রজা মাত্র। আমাদের শাসক এই মুহূর্তে পালিয়ে আছেন। আমাদের ক্ষমা করুন।” তখন মুহম্মদ কাসিম ব্যবসায়ী, কৃষিজীবী ও কারিগরদের সকলের জন্য ক্ষমা ঘোষণা করলেন এবং দুর্গে প্রবেশ করলেন। সামরিক শ্রেণীর চার হাজার লোককে তিনি তরবারির সাহায্যে হত্যা করলেন ও তাদের অনুসারী ও পরিবার-পরিজনদের বন্দী করলেন। এরপর তিনি রাভি নদীর দক্ষিণ তীরে সিক্কাহ্ ও মুলতানর অভিমুখে অগ্রসর হলেন। সেখানকার দুর্গের সৈন্যদের সাথে আরব সৈন্যদের যুদ্ধ শুরু হল ও একটানা সতের দিন যুদ্ধ চলল। এই যুদ্ধে মুহম্মদ কাসিমের কুড়ি জন প্রসিদ্ধ সহযোদ্ধা মারা যায় এবং সিরিয়া থেকে আগত বাহিনীর দুই শত পনের জন যোদ্ধা প্রাণ হারায়। পরবর্তীতে তিনি নির্দেশ দিলেন যে, সমগ্র নগরীটিকে যেন লুণ্ঠিত ও ধ্বংস করা হয়।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৭-২৫৯।

----------------------------------------

মুহম্মদ কাসিম এরপর যখন মুলতানে এসে পৌঁছালেন তখন সেখানকার শাসকরা তার সাথে যুদ্ধ করবার জন্য বেরিয়ে এলেন। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চলল। এই ভাবে অবিরাম দুই মাস যুদ্ধ চলল। সিন্ধুবাসীরা গুলতি, তীর ও পাথরের সাহায্যে প্রতিআক্রমণ করতে লাগল। এক সময়ে নগরে খাদ্য শস্যের অভাব দেখা দিল। সেখানকার শাসক বাছরা যখন দেখতে পেলেন তারা কারো কাছ থেকেই কোনো রকম সাহায্য পাবেন না, তখন তিনি কাশ্মীরের রাজার কাছে গিয়ে সাহায্য চাইলেন। পরবর্তী দিন আরব সৈন্যরা আগের মতই অগ্রসর হল ও যুদ্ধ শুরু করল। আরব সৈন্যরা কোনো মতেই দুর্গের দেওয়ালের কোথায়ও সুড়ঙ্গপথ বা ভূগর্ভস্থ রাস্তা তৈরী করতে পারছিল না। তখন দুর্গের ভিতর থেকে এক জন লোক বেরিয়ে এসে অনুকম্পা চাইলে মুহম্মদ কাসিম তাকে নিরাপত্তা দানের অঙ্গীকার করলেন। তখন লোকটি দুর্গের উত্তর দিকে অর্থাৎ নদীর তীরবর্তী একটি স্থান দেখিয়ে দিল। সেই স্থানটি থেকে সৈন্যরা গর্ত খোঁড়া শুরু করলে দুই-তিন দিনের মধ্যে দুর্গ প্রাচীরটি ধ্বসে পড়ল। এভাবে দুর্গটি দখল করা হল। সেখানে ছয় হাজার সামরিক যোদ্ধাকে হত্যা করা হয়েছিল ও তাদের পরিবার-পরিজন ও অনুসারীদেরকে যুদ্ধবন্দী করা হয়েছিল। সেখানে বণিক, কৃষিজীবী ও কারিগর শ্রেণীর লোকদের ক্ষমা করে দেওয়া হল। কিন্তু খলীফার কোষাগারে রাজস্ব পাঠাবার জন্য তাদের কাছ থেকে অর্থ আদায়ের হুকুম জারী হল। এছাড়াও যুদ্ধের সময়ে মুখোমুখী হয়ে অনবরত লড়ে যাবার জন্য ও সুড়ঙ্গ পথ তৈরীর সময় বিশাল ঝুঁকি নিবার জন্য সৈন্যমধ্যে অকাতরে অর্থ বিলি করা হল। সেই সময়ে বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ বিতরণ করা হয়। চাচ্নামাহ্-র লেখক আরো বলেন যে, শহরের অভিজাত ও মধ্যবিত্ত উভয় সম্প্রদায় থেকে মোট ওজনে ষাট হাজার দিরহাম রৌপ্য চাঁদা হিসাবে জোগাড় করা হল। সমস্তটিই আরব সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করা হল। প্রতিজন অশ্বারোহী যোদ্ধা অন্য কিছু বাদেও বিশেষ অংশ হিসাবে চার শত দিরহাম রৌপ্য পেয়েছিল। এরপর মুহম্মদ কাসিম তাদেরকে বললেন, ”এবারে খলীফার রাজধানীর কোষাগারে পাঠানোর জন্য তোমরা রাজস্ব সংগ্রহ কর।” এই সমস্ত বিষয়ে কথাবার্তা চালানোর সময়ে সেখানে একজন ব্রাহ্মণ উপস্থিত হয়ে বললেন যে, যেহেতু দাহিরের রাজত্বের অবসান হয়েছে তাই এই মুহূর্তে মুলতানের প্রবীণতম লোকদের কাছ থেকে শুনা মূল্যবান কথা বলতে দ্বিধা করব না। সেটি হল সুপ্রাচীনকালে এই নগরীটিতে যশ্বীন নামে এক রাজা বাস করতেন। বংশানুক্রমিকভাবে তিনি কাশ্মীরের রাজার উত্তরাধিকারী ছিলেন। তিনি জাতিগতভাবে একজন ব্রাহ্মণ ও উপাসক ছিলেন। তিনি একটি দেব মন্দির স্থাপন করে তার তলদেশে চল্লিশটি বড় বড় তামার ঘড়াভর্তি গুপ্তধন ভূগর্ভে মাটির নীচে ঢেকে দেন। সেই স্থানটির উপরিভাগে একটি দেবপ্রতিমা স্থাপন করেন, যা সম্পূর্ণরূপে স্বর্ণ নির্মিত ছিল। এই কথা শুনার পর মুহম্মদ কাসিম তার প্রধান সহচরবৃন্দ ও ব্যক্তিগত পরিচারকবৃন্দ সাথে নিয়ে মন্দিরটিতে ঢুকলেন। তিনি সেখানে একটি স্বর্ণ নির্মিত প্রতিমা দেখতে পেলেন। মূর্তিটির মুখমণ্ডলে লাল চুনি পাথরে নির্মিত দু’টি চোখ ছিল। মূর্তিটি অবিকল জীবন্ত মানুষের মত দেখতে ছিল। মুহম্মদ কাসিম মূর্তিটিকে সেখান থেকে উঠিয়ে ফেলতে নির্দেশ দিলেন। এটি ওজনে ২৩০ মন সোনার ছিল। তারপর মাটির তলায় লুকানো গুপ্তধন ভর্তি চল্লিশটি তামার ঘড়া উঠিয়ে এনে ওজন করা হল। সব মিলিয়ে ঘড়াগুলিতে ১৩২০ মন ওজনের সোনা পাওয়া গিয়েছিল। সোনানির্মিত মূর্তির সাথে অন্যান্য সোনার ভাণ্ডার সরকারী কোষাগারে স্থানান্তরিত করা হল। এছাড়া নগরীটিতে লুট করে আহরণ করা সকল মণি-মুক্তা সহ মুলতানের উন্মুক্ত ও সমাহিত সমস্ত ধনরত্ন নিয়ে যাওয়া হল। যে দিন মন্দিরটি আবিষ্কৃত হয় ও ধনরত্নসমূহ জব্দ করা হয়  সেই দিনই হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কাছ থেকে একটি চিঠি এসে পৌঁছায়। চিঠিতে হাজ্জাজ লিখেছেন, ”হে আমার প্রাণপ্রিয় ভ্রাতুষ্পুত্র, তোমার নেতৃত্বে পরিচালিত এই অভিযানের শুরুতে আমি খলীফা ওয়ালিদ বিন আবদুল মালিক বিন মারওয়ানের কাছে শপথ করে বলেছিলাম এবং নিশ্চয়তা দিয়েছিলাম যে, অভিযানের প্রস্তুতি হিসাবে এবং আগামীতে খলীফার রাজকোষ থেকে যে পরিমাণ অর্থের ব্যয় হবে আমি তার দ্বিগুণ পরিমাণ অর্থ ফেরত দিব বা পরিশোধ করব। খলীফার রাষ্ট্রীয় কোষাগারের কর্মকর্তাদের কাছে অনুসন্ধান করে আমি জানতে পেরেছি যে, এই অভিযান উপলক্ষে এ যাবত তোমাকে খরচ হিসাবে ষাট হাজার দিরহাম রৌপ্য পাঠানো হয়েছে। অপর দিকে তুমি আজকের দিন পর্যন্ত যে পরিমাণ নগদ ও মালামাল পাঠিয়েছ, বহু মূল্যবান দ্রব্যাদি সহ যোগ করে দেখা গেছে যে তার পরিমাণ দাঁড়ায় এক লক্ষ কুড়ি হাজার দিরহাম ও অতিরিক্ত কুড়ি হাজার দিরহাম। এই সমস্ত কিছুই রাজকীয় কোষাগারে জমা হয়েছে। এই মুহূর্তে যেখানেই তুমি স্থায়ী কোনো গ্রাম বা শহর বা বিখ্যাত কোনো নগর দেখতে পাবে অবশ্যই সেখানে মসজিদ ও ধর্ম প্রচারের মঞ্চ নির্মাণ করে দিবে। প্রতি সপ্তাহের জুম্মাবারে সেখানে অবশ্যই খুৎবা পাঠ করা হোক এবং মূদ্রাসমূহে খলীফার নাম খোদাই করা বাধ্যতামূলক করা হোক। ...”

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৯-২৬০।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬০-২৬২।

----------------------------------------

মুহম্মদ কাসিমের সিন্ধু জয়ের এই সমস্ত বিবরণ থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার যে, ইসলামী বাহিনী ভারতবর্ষে এখানকার সমৃদ্ধ শহর ও নগরসমূহ যেমন ব্যাপকভাবে ধ্বংস করেছিল তেমন এখান থেকে বিপুল সম্পদ লুণ্ঠন করে নিয়ে গিয়েছিল। এছাড়া তারা ভারতীয় নারী ও পুরুষদের উপর গণহত্যা পরিচালনা করেছিল ও তাদের যুদ্ধ-বন্দী করে দাস হিসাবে নিয়ে গিয়েছিল। এই সমস্ত কার্যকলাপ ছিল ইসলাম দ্বারা অনুমোদনপ্রাপ্ত। মুহম্মদ কাসিমের আক্রমণাভিযানের পরে কিছুকাল ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণকারীদের আক্রমণে তুলনামূলক বিরতি ঘটল।

পাতা : ৫

তবে সম্পুর্ণ বিরতি একেবারেই হয় নাই। কারণ পশ্চিম থেকে কখনো মুসলিম আফগানরা, কখনো মধ্যূ এশিয়ার অন্য মুসলিমরা ভারতের উপর আক্রমণ করতে থাকে। সবুক্তগীন ৯৭৭ খ্রীষ্টাব্দে গজনীর সুলতান হবার পর এক বিরাট বাহিনী নিয়ে ভারত আক্রমণ করেন। এই সময়ে ব্রাহ্মণ বংশীয় হরপালের পুত্র জয়পাল এক দিকে সারহিন্দ থেকে লামঘান ও অপর দিকে কাশ্মীর থেকে মুলতান পর্যন্ত বিস্তৃত এক বিশাল রাজ্যের অধিপতি ছিলেন। লামঘান সীমান্তে দুই বাহিনীর প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয় ও গজনীর বাহিনীর কাছে জয়পালের বাহিনী পরাজয় বরণ করে। ঐতিহাসিক কাসিম ফিরিশতা লিখেছেন যে, এই যুদ্ধ জয়ে সবুক্তগীন অপরিমিত সম্পদ ও অভূতপূর্ব যশের অধিকারী হয়েছিলেন। এছাড়াও শত্রু শিবির থেকে পরিত্যক্ত বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য তার হাতে পড়েছিল। এছাড়াও নিলাব নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত অঞ্চল তার অধিকারে আসে এবং লামঘান ও পেশোয়ার থেকে তিনি প্রচুর কর পান।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, Bengali Translation of Ferista’s History of Muslim Conquest of India, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৭৭, পৃঃ ১৩-১৬।

----------------------------------------

                        আধুনিক আফগানিস্তান ও তার আশেপাশের এলাকা

       (সৌজন্যে: Jonathan J. Lee, Afghanistan: A History from 1260 to the Present, 2018)

যুদ্ধ ও লুঠতরাজের মাধ্যমে ক্রমশ শক্তিশালী হতে থাকা গজনীর শাসকদের মনে ভারতের বিপুল ধন সম্পদের প্রতি লোভ ছিল। এছাড়া ঐতিহাসিক কাল থেকেই ভারতের বিপুল সমৃদ্ধি ও সম্পদের খবর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। তাই ভারতের ধন-সম্পদ ও যুদ্ধ-বন্দী দাস-দাসী পাওয়ার লোভে ৩৯১ হিজরী সালে (১০০১ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতান মাহমুদ গজনী থেকে পেশোয়ারের দিকে রওনা হন। ঐতিহাসিক কাসিম ফিরিশতা বলেন যে, সেখানে লাহোরের রাজা জয়পালকে যুদ্ধে পরাজিত করে সুলতান মাহমুদ প্রচুর ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেন। তিনি যে সমস্ত লুণ্ঠিত দ্রব্য পান তার মধ্যে ১৬ টি রত্ন খচিত কণ্ঠহার ছিল। সেকালের জহুরীরা এর মূল্য ১,৮০,০০০ দিনার ধার্য করেছিলেন।  সমসাময়িক ঐতিহাসিক উতবি লিখেছেন, ‘‘এবং এত বিপুল পরিমাণ কণ্ঠহার শিশুদের গলা থেকে নেওয়া হয়েছিল, যেগুলিতে মূল্যবান পাথর, উজ্জ্বল মুক্তা, ও মূল্যবান পদ্মরাগমণি বসানো ছিল, মূল্যনির্ধারণকারীরা যেগুলির মূল্য লাল সোনার দুই লক্ষ দিনার নির্ধারণ করেছিল। একইভাবে, মূল্যবান পাথর পাওয়া গিয়েছিল আহত ও নিহতদের গলা থেকে, এভাবে ইসলামের সৈন্যরা বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও অপরিমিত ধন যুদ্ধে লুঠের মাল ও বলপূর্বক কেড়ে নেওয়া থেকে পেয়েছিল, একইভাবে তারা এই অঞ্চল ও ভারতের আশেপাশের প্রদেশসমূহ থেকে প্রায় এক লক্ষ শিশু এবং তরুণ ও তরুণী বন্দী হিসাবে পেয়েছিল।”

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১।

উতবি লিখেছেন, “And so many necklaces were taken from the necks of the children, set with precious stones, glittering pearls, and valuable rubies, that the appraisers valued them at two hundred thousand of dinars of red gold. In like manner, similar precious stones were found on the necks of the wounded and the slain, so that the army of Islám obtained abundant wealth and unlimited riches from their booty, and from their spoil, and near a hundred thousand children and young people and girls were obtained from that country, and all those provinces of India submitted to the Sultán which are on the side of Khurasán, inclining towards the kingdoms of the west.” দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, translated from the Persian version of the contemporary Arabic chronicle of Al Ụtbi by James Reynolds, printed for the Oriental Translation Fund of Great Britain and Ireland, London, Date: MDCCC.L.VIII (1858), p. 282.

----------------------------------------

এইখানে যুদ্ধে ভারতীয়দের একটি বৈশিষ্ট্য বলা প্রয়োজন। সমসাময়িক মুসলিম ঐতিহাসিকরা এই বিষয়টি লক্ষ্য করেছেন যে, ভারতীয় রাজারা বিদেশীদের কাছে বার বার পরাজিত হলে অগ্নিতে আত্মাহুতি দিত। অথবা পরাজিত হয়ে শত্রুর হাতে বন্দী হবার উপক্রম হলে নিজের তরবারির সাহায্যে আত্মাহুতি দিত। এমন দেখা গেছে রাজা জয়পালের ক্ষেত্রে যিনি সুলতান মাহমুদের কাছে বার বার পরাজিত হওয়ায়, তার পুত্রকে রাজমুকুট পরিয়ে চিতা সজ্জিত করার আদেশ দেন ও নিজের হাতে সেই চিতায় আগুন দিয়ে পুড়ে মারা যান। ভাটিয়ার রাজা বিজয় রায় যখন সুলতান মাহমুদের সৈন্যদের দ্বারা ঘেরাও হন ও তার বন্দী হবার মত অবস্থা হয় তখন তিনি নিজের তরবারির ফলা নিজের বুকে বিদ্ধ করে আত্মাহুতি দেন। এই যুদ্ধে সুলতান মাহমুদ ২৮০ টি হাতী, বহু সংখ্যক যুদ্ধ-বন্দী ও অন্যান্য লুণ্ঠিত দ্রব্য পেয়েছিলেন। এরপর তিনি এই অঞ্চলটি নিজের সাম্রাজ্যভুক্ত করে গজনী ফিরে যান। সুলতান মাহমুদ ৩৯৬ হিজরীতে (১০০৬ খ্রীষ্টাব্দে) মুলতান থেকে অনতিদূরে এই ভাটিয়া আক্রমণ করেন। তিন দিনের এক যুদ্ধের পর চতুর্থ দিনে মাহমুদের বাহিনী নগরটি দখল করে। কামিলু’ত তাওয়ারিখের গ্রন্থকার ইবনে আসির লেখেন, এরপর সেখানে এক ভয়ানক হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হল, নারীদের ধর্ষণ করা হল এবং সেখানকার সম্পদ লুণ্ঠন করা হল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস,  পৃঃ ৩১।

ইবনে আসির লিখেছেন, “The chief marched out to meet his enemy, and fought for three days with the Musulmáns. On the fourth he fled, and sought to get back into the city; but the Musulmáns reached the gate before the fugitives, overpowered them, and disarmed them. A dreadful slaughter ensued, the women were dishonoured, and the property seized.” দেখুনঃ H.M. Elliot and John Dowson (eds.), The History of India, as Told by its Own Historians, The Muhammadan Period, Vol. II, Trübner and Co., London, 1869, p. 248.

----------------------------------------

মুসলমান সৈন্যদের আক্রমণাভিযানে ভয়াবহ ধ্বংস, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ ও দাস-দাসীকরণের সংবাদ ভারতবর্ষের অনেক দূর অঞ্চলে গিয়ে থাকবে। কারণ ভারতবাসী এই ধরনের আক্রমণকারীদের সাথে আগে সেভাবে পরিচিত ছিল না। তাই দেখা গেল যখন সুলতান মাহমুদ ১০০৮ খ্রীষ্টাব্দে লাহোর আক্রমণের উদ্দেশ্যে আগ্রসর হলেন, তখন ভারতীয় নারীরা যুদ্ধের ব্যয় মিটাবার জন্য তাদের রত্নাদি বিক্রী করে সেই অর্থ এবং সোনার অলংকার গলিয়ে সেই সোনা অকাতরে দান করে দিলেন। ফিরিশতা লিখেছেন যে, বহু দূরবর্তী অঞ্চল থেকে এই সাহায্য এসেছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৩৮।

----------------------------------------

পাতা : ৬

ফিরিশতা আরো লিখেছেন, ধর্ম প্রসারের উৎসাহে উদ্বুদ্ধ হয়ে সুলতান মাহমুদ নগর কোটের হিন্দুদের বিরুদ্ধে অগ্রসর হলেন। সেখানে তিনি মন্দিরের প্রতিমাগুলি ভেংগে ফেললেন ও মন্দিরকে ধুলিসাৎ করলেন। তারা তলোয়ার ও অগ্নি দ্বারা এর চারপাশে ছারখার করে ফেলেছিল। এর পর তারা ভীম নামে একটি দুর্গে আক্রমণ করে। দুর্গটি অত্যন্ত মজবুত ছিল বলে পার্শ্ববর্তী রাজ্যের হিন্দুরা দেবতাকে উৎসর্গীকৃত সমস্ত সম্পদ ঐ দুর্গে মজুদ রাখত। ফিরিশতা বলেন, এর ফলে ঐ দুর্গে এত সোনা, রূপা, মূল্যবান পাথর ও মণিমুক্তা সঞ্চিত ছিল যে, পৃথিবীর কোনো রাজার ভাণ্ডারেই এত ছিল বলে মনে হয় না। কাসিম ফিরিশতা বর্ণনা করেছেন যে, ভীম দুর্গে পাওয়া গিয়েছিল সাত লক্ষ স্বর্ণ মূদ্রা (দিনার), সাত শত মণ ওজনের সোনা ও রূপার থালা, দুই শত মন খাঁটি সোনার পিণ্ড, দুই হাজার মণ রূপার বাঁট এবং কুড়ি মণ ওজনের মুক্তা ও প্রবাল, হিরক, চুনী প্রভৃতি রত্নরাজি। এই বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য নিয়ে মাহমুদ গজনী ফিরে যান। ১০০৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি এক জমকালো ভোজের আয়োজন করেন এবং এই সময় শহরের বাইরে এক বিরাট প্রান্তরে তার এই সমস্ত সম্পদ স্বর্ণ সিংহাসন, মূল্যবান অলংকারাদি ও অন্যান্য জিনিসপত্র জনসাধারণকে প্রদশর্নের ব্যবস্থা করেন। এছাড়াও প্রত্যেক পদস্থ ব্যক্তিকে একটি রাজকীয় উপহার প্রদান করেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৯, ৪০।

উতবির বর্ণনাটিও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন, “And from the benefits of this possession prodigious fruits and abundant flowers accrued to the Sultán, and he found such an amount of exquisite gems, brilliant jewels, and precious stones, and rare treasures that the fingers of the scribe, and the account books of the calculators would be unequal to the task of catalogueing and numbering them, and with the Prince of Jurján and his private attendants, he went within the castle. … … And as to the robes, and cups (or basins), silk and cloth, &c., they were so many, that the seniors of the empire and the clerks of State were quite unable to arrange them, and acknowledged that they had never beheld such robes, both as regarded the beauty of the workmanship, and its delicate excellence.” দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, p. 342.

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৩৮, ৪০।

----------------------------------------

কিতাব-ই-ইয়ামিনি গ্রন্থের লেখক আল উতবি ৪০০ হিজরী সনে (১০০৯ খ্রীষ্টাব্দে) নযিন (Nazin) অভিযানের বিবরণে লিখেছেন যে, সেনাবাহিনী গজনীতে ফিরে আসার সময় অগুণতি সম্পদ ও দাস-দাসী নিয়ে আসে এবং দরিদ্র ও সাধারণরা প্রভূত সম্পদ ও দাস-দাসীর মালিক বনে যায়।

----------------------------------------

আল উতবি লিখেছেন, “And the army of Islám came to Ghazna with that boundless wealth, and those numberless sums of money, so that the forces of the foot soldiers of Islám were retarded in proceeding through India, and slaves fell in value to that extent, that the poor and humble became lords, and possessors of many slaves and goods beyond computation.” দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, p.  393

----------------------------------------

মুসলিম আক্রমণকারীরা যখন ভারতবর্ষে আসে তাদের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল এখানকার অমুসলিমদের বিশেষত হিন্দুদের মন্দির ও মূর্তি ধ্বংস করা ও এইগুলির অবমাননা করা। মুসলমানদের ভারত আক্রমণের বিভিন্ন সময়ে এর প্রমাণ দেখতে পাওয়া গিয়েছিল। এই কর্মনীতি তাদের ধর্ম বিশ্বাসের অংশও বটে। এখানে ফিরিশতা সুলতান মাহমুদের ভারত অভিযানের সময় এই রকম একটি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, সুলতান মাহমুদ ৪০২ হিজরীতে (১০১১ খ্রীষ্টাব্দে) থানেশ্বর জয় করবেন বলে স্থির করেন। তিনি শুনেছিলেন যে, মুসলমানদের কাছে মক্কা যেমন পবিত্র হিন্দুদের কাছে থানেশ্বর তেমন পবিত্র। পাঞ্জাবে পৌঁছে লাহোরের রাজা আনন্দ পালের সাথে পূর্বে সম্পাদিত শর্তানুযায়ী সুলতান মাহমুদ তার কাছে আশ্বাস চাইলেন যে, তার রাজ্যের মধ্য দিয়ে চলার সময় মাহমুদের সৈন্যদের কোনো প্রকার বিরক্ত করা হবে না। সুলতান রাজাকে তার উদ্দেশ্য জানাবার জন্য দূত পাঠালেন এবং রাজা যে সমস্ত গ্রাম ও শহর সুলতানের হাত থেকে রক্ষা করতে উৎকণ্ঠিত সেই সমস্ত জায়গায় তাকে রক্ষী সৈন্য পাঠাতে অনুরোধ করলেন। সুলতানের প্রস্তাবে সম্মত হয়ে রাজা আনন্দ পাল সুলতানের অভ্যর্থনার জন্য এক ভোজের আয়োজন করেন ও সুলতানের শিবিরে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সরবরাহ করতে প্রজাদের আদেশ করেন। রাজা তার ভাইকে দুই হাজার ঘোড়া সহ সুলতানের শিবিরে পাঠালেন ও তার ভাই রাজার পক্ষ থেকে সুলতানের কাছে অনুরোধ করলেন, ”আমার ভাই সুলতানের প্রজা ও করদাতা। তিনি সুলতানকে এইটুকু নিবেদন করবার অনুমতি প্রার্থনা করেন যে, থানেশ্বর এই দেশের অধিবাসীদের সর্বশ্রেষ্ঠ ভজনালয়। অন্য ধর্ম ধ্বংস করাই যদি মুহাম্মদের ধর্মের নীতি হয় তবে নগরকোট ধ্বংস করে সুলতান তার সেই কর্তব্য পালন করেছেন। তিনি যদি অনুগ্রহপূর্বক তার কল্পনা ত্যাগ করেন, তা হলে আনন্দ পাল থানেশ্বরে যে কর আদায় হয় তার সমপরিমাণ অর্থ সুলতানকে প্রতি বৎসর প্রেরণ করতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকবেন। উপরন্তু এই অভিযানে যত অর্থ ব্যয় হয়েছে, তিনি সব নিজে প্রদান করবেন এবং এছাড়াও নিজের পক্ষ থেকে তিনি পঞ্চাশটি হাতী ও বহু মূল্যের রত্নাদি উপহার স্বরূপ প্রদান করবেন।” এর উত্তরে মাহমুদ জানালেন, ইসলাম ধর্মের শিক্ষা এই ⁏ রাসূলের বাণী যে ব্যক্তি যতদূর বিস্তার করবে এবং রাসূলের অনুগামীদের মধ্যে যারা পৌত্তলিকতার উচ্ছেদ সাধনে যতটা তৎপরতা দেখাবে, বেহেশ্তে তাদের জন্য তত বেশী ইনাম মজুদ থাকবে এবং সেই জন্যই খোদার ইচ্ছায় সমস্ত ভারতবর্ষ থেকে মূর্তি পূজা দূর করবার জন্য আমি বদ্ধপরিকর হয়েছি। এই অবস্থায় থানেশ্বরকে কীভাবে রেহাই দিতে পারি?

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪১-৪২।

----------------------------------------

এর পরের ঘটনা মর্মান্তিক। ফিরিশতা লিখেছেন, হিন্দুদেরকে থানেশ্বর রক্ষার জন্য প্রস্তুত হবার সময় না দিয়েই মাহমুদ থানেশ্বরে এসে পৌঁছালেন। শহর লুণ্ঠন করা হল ও সমস্ত মূর্তি ভেংগে চুরমার করা হল। এছাড়া হিন্দুদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র জাগসোমা নামে মূর্তিটিকে পদদলিত করে অবমাননা করার জন্য গজনীতে পাঠানো হল। একটি মন্দিরে ৪৫০ মিসকাল ওজনের একটি পদ্মনাগমণি পাওয়া গিয়েছিল। এটি যারা দেখেছে, তারা স্বীকার করেছিল এটি এক আশ্চর্য বস্তু - এই রকম আর একটিও কোথায়ও আছে বলে কেউ শুনে নাই। কাসিম ফিরিশতা আরো লিখেছেন, এই সময় মুসলমান বাহিনী বহু ধন-সম্পদ ও দুই লক্ষ মানুষকে দাস হিসাবে বন্দী করে নিয়ে যায়। এতে রাজধানী গজনী একটা ভারতীয় নগরে পরিণত হয়েছিল। এমন কোনো সৈনিক থাকল না যে অনেক দাস-দাসী ও সম্পদের মালিক হল না। থানেশ্বরে যে ভয়াবহ রক্তপাত ঘটানো হয় সে সম্পর্কে উতবি লিখেছেন যে, সৈনিকরা এত রক্ত ঝরিয়েছিল যে সেখানকার প্রবাহমান নদীটির জল রক্ত দিয়ে রঞ্জিত হয়েছিল, ফলে পবিত্রকরণের কাজে এর জল আর ব্যবহারোপযোগী ছিল না এবং জলপানের জন্য সেটিকে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। তিনি আরো লিখেছেন, রাত্রি নামায় এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ হয়, নতুবা সেখানকার একজন হতভাগ্যও বাঁচতে পারত না।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৩।

  উতবি লিখেছেন, “The army spilt so much blood that the water of that river was so full, and that stream so abundantly stained with gore, that it could not be used for purification and was forbidden to drinkers, and if the darkness of the night had not prevented it, not one of these wretches would have escaped with life, …” দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, p. 395.

----------------------------------------

এর পর সুলতান মাহমুদ ১০১৩ খ্রীষ্টাব্দে আবার লাহোরের রাজার অধীন নিন্দুনা দুর্গে আক্রমণ করেন। দুর্গবাসী সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করলে তাদের প্রাণভিক্ষা দেন কিন্তু দুর্গে যা কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল তা লুট করলেন। তারপর মাহমুদ কাশ্মীর লুণ্ঠন করে অধিবাসীদেরকে রাসূলের প্রতি ঈমান আনতে বাধ্য করলেন ও প্রচুর লুণ্ঠিত জিনিসপত্র নিয়ে তার রাজধানীতে ফিরে গেলেন।

পাতা : ৭

মাহমুদের হাতে পড়ার সম্ভাবনায় এইখানে একজন হিন্দু রাজার আত্মাহুতি দিবার ঘটনা জানা যায়। সুলতান মাহমুদ যখন যমুনা নদীর তীরে মহাভন দুর্গে যান তখন মহাভনের রাজা কুলচাঁদ তার সৈন্যবাহিনী নিয়ে আত্মসমর্পণ করার জন্য বের হয়ে আসেন। সেই সময় আকস্মিকভাবে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে যুদ্ধ বেঁধে গেলে রাজা কুল চাঁদ নিরাশ হয়ে সেখানেই স্ত্রী ও পুত্র কন্যাকে হত্যা করে তলোয়ারের ফলা  নিজের দেহে প্রবেশ করিয়ে প্রাণ ত্যাগ করেন। এই সময় মাহমুদের সৈন্যদের হাতে প্রচুর ধন-সম্পদ ও অন্যান্য লুণ্ঠিত দ্রব্য এসে পড়ে।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৭।

----------------------------------------

সুলতান মাহমুদের মথুরা আক্রমণ, ধ্বংস ও লুণ্ঠন ছিল আরো একটি ভয়ানক ঘটনা। সেই সময় মথুরা দিল্লীর অধীন ছিল। এই নগরটির বর্ণনা করতে গিয়ে উতবি এর আশ্চর্য শিল্পকৌশল ও কল্পনাশক্তির প্রকাশ দেখতে পেয়েছিলেন, যাকে তিনি স্বর্গের নির্মাণ বলেছেন। মাহমুদ এখানে দিল্লীর সেনাবাহিনী দ্বারা কিছুটা বাধাপ্রপ্ত হন। এরপর তিনি নগরে প্রবেশ করে লুটপাট শুরু করেন ও মূর্তিগুলির কিছু ভেংগে ফেললেন ও কিছু জ্বালিয়ে দিলেন। এখান থেকে তিনি বিপুল পরিমাণ সোনা ও রূপা লুট করেন। কারণ মূর্তিগুলি সোনা ও রূপার তৈরী ছিল। ফিরিশতা বিবরণ দিয়েছেন যে, মথুরার মূর্তিগুলিতে চারটি সোনার তৈরী মূর্তি ছিল, যাদের চোখ পদ্মরাগমণি দিয়ে তৈরী ছিল। ঐ মূর্তিগুলির মূল্য ছিল ৫০,০০০ দিনার। অন্য আর একটি মূর্তিতে ৪০০ মিস্কাল ওজনের একটি নীরকান্ত মণি পাওয়া গিয়েছিল ও মূর্তিটি গলিয়ে বিপুল পরিমাণ বিশুদ্ধ সোনা পাওয়া গিয়েছিল। সোনার মূর্তিগুলি ছাড়াও সেখানে একশয়ের উপর রূপার মূর্তি ছিল, যে সমস্ত বহন করতে শতাধিক উট লেগেছিল।

----------------------------------------

উতবি বলেন, “In that place, in that city, there was a place of worship of the Indian people; and when he came to that place he saw a city, of wonderful fabric and conception, so that one might say, this is a building of Paradise, … They had brought immense stones, and had laid a level foundation upon high stairs (or steps). Around it and its sides they had placed one thousand castles, built of stones, which they had made idol temples, and has (cemented) fastened them all. And in the midst of the city they had built a temple higher than all, to delineate the beauty and decoration of which the pens of all writers and the pencils of painters would be powerless, and would not be able to attain to the power of fixing their minds upon it and considering it. In the memoir which the Sultán wrote of this journey he thus declares, that if any one should undertake to build a fabric like that he would expend thereon one hundred thousand packets of a thousand dinárs, and would not complete it in two hundred years, with the assistance of the most ingenious masters (architects). …” দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, pp. 454, 455.

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৭, ৪৮।

----------------------------------------

এরপর মাহমুদের সৈন্যবাহিনী মুনয্ নামে এক দুর্গে রাজপুত সৈন্যদের মুখোমুখি হল। এই রাজপুত সৈন্যরা পঁচিশ দিন ধরে মাহমুদের আক্রমণ প্রতিহত করেছিল। কিন্তু শেষে যখন তারা দেখল যে দুর্গ রক্ষা করার আর উপায় নাই তখন তারা শত্র বাহিনীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে মৃত্যু বরণ করতে লাগল। অনেকেই নিজ স্ত্রী-সন্তানসহ আগুনে আত্মাহুতি দিল। এই দুর্গে মাহমুদের সৈন্যরা একটি প্রাণীও জীবিত পায় নাই।

ভারতে আরো কিছু নগর জয় ও লুণ্ঠন করে লুটের মালে ভারাক্রান্ত ও অসংখ্য বন্দী পরিবৃত হয়ে মাহমুদ গজনী ফিরে গেলেন। গজনীতে তিনি তার লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি প্রদর্শনের ব্যবস্থা করেন। এর মধ্যে ছিল ২০,০০০,০০০ দারম্ সোনা ও রূপার পিণ্ড, ৫৩,০০০ বন্দী ও ৩৫০টি হাতী। এছাড়াও এত বেশী পরিমাণ মণি-মুক্তা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র ছিল যে তার সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব ছিল না। সরকারী কোষাগারে যা জমা হয়েছিল সৈন্যদের ব্যক্তিগত লুটের মালগুলি একত্রে তার চেয়ে কম ছিল না। এই প্রসঙ্গে উতবি লিখেছেন, সুলতান ভারত থেকে ফিরে আসার পর এত বিপুল পরিমাণ সম্পদ ও মণি-রত্ন এবং এত বিপুল সংখ্যক যুদ্ধ-বন্দী দাস-দাসী নিয়ে আসেন যে, গজনীর সুরাপানের স্থান ও রাস্তা তাদের কারণে খুবই সংকীর্ণ বলে প্রতীয়মান হল। এছাড়া এই অঞ্চলের খাদ্য ও পানীয় তাদের জন্য যথেষ্ট ছিল না। এই সময় খুরাসান, মাওয়ারন্নাহার ও ইরাকের মত দূর অঞ্চল থেকে বণিকদের বিভিন্ন গোত্র এত বেশী দাস-দাসী গজনীতে নিয়ে আসল যে, তাদের সংখ্যা মুক্ত মানুষদের চেয়ে বেশী হল ও শ্বেত মুক্ত মানুষেরা তাদের সংখ্যাধিক্যে হারিয়ে গেল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯, ৫০।

আমু দরিয়া নদীর অপরপারে অবস্থিত অঞ্চলকে মাওয়ারন্নাহার বলা হত।

উতবির ভাষায়, “When the Sultán returned from Hind in victory and light, with abundant wealth and no scanty amount of gems, and so many slaves that the drinking-places and streets of Ghazna were too narrow for them, and the eatables and victuals of the country sufficed not for them, and from the most distant parts tribes of merchants betook themselves to Ghazna, bringing so many slaves from Khurásán, and Mawarannahar, and Irák, that their number exceeded the free, and a white freeman was lost among them, …”, দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini, p.  462-463.

----------------------------------------

মূলত ভারতবর্ষ থেকে বিপুল সম্পদ লুণ্ঠনের ফলে সাধারণ একটি শহর গজনী একটি সমৃদ্ধ নগরে পরিণত হয়েছিল। ফিরিশতা লিখেছেন, ভারত থেকে ফিরবার পর মাহমুদ মার্বেল ও গ্রানাইট পাথর দিয়ে তৈরী এমন এক সুরম্য মসজিদ নির্মাণ করালেন যার সৌন্দর্য দর্শকদের মুগ্ধ করত। এই মসজিদটি তিনি মহামূল্যবান কার্পেট, ঝাড় লণ্ঠন এবং সোনা ও রূপা দিয়ে সুসজ্জিত করেন। এই মসজিদের পাশে সুলতান একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। আল উতবি এই মসজিদটি নির্মাণ প্রসংগে বলেন, গজনী এক সময় চারিপাশে সভ্য দেশ ও বিখ্যাত নগর সমূহের মধ্যে একটি হীনতর ও সংকীর্ণ অঞ্চল ছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৫০।

উতবি লিখেছেন, “… … he ordered that they should make a choice of a site for the Jama Masjid of Ghazna, since they had constructed the old mosque in bygone times and for a smaller number of people, at a time when Ghazna was but a small territory, and was inferior amongst civilized lands and renowned cities.” দেখুনঃ Al Ụtbi, The Kitab- i – Yamini,), p.  463.

----------------------------------------

১০২১ খ্রীষ্টাব্দের দিকে সুলতান মাহমুদ ভারতের আশেপাশের কিছু অঞ্চলে অভিযান ও লুণ্ঠন চালিয়ে আবার লাহোরে পৌঁছান। সেখানে বিনা বাধায় শহরে প্রবেশ করে সৈন্যদেরকে বেপরোয়াভাবে লুটপাটের জন্য ছেড়ে দেন। ফিরিশতা লিখেছেন, এখানে এত সম্পদ ও মূল্যবান জিনিসপত্র পাওয়া গিয়েছিল যে, তা পরিমাপ করা সাধ্যাতীত ছিল।

----------------------------------------

  দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস,  পৃঃ ৫৪।

----------------------------------------

গুজরাট প্রদেশে অবস্থিত সোমনাথ আক্রমণের উদ্দেশ্যে সুলতান মাহমুদ ৪১৫ হিজরী (১০২৪ খ্রীষ্টাব্দে) গজনী থেকে যাত্রা করেন। সোমনাথ হিন্দুদের পবিত্র মন্দিরের জন্য বিখ্যাত ছিল। ভারতের নানা জায়গা থেকে পুণ্যার্থীরা সেখানে যেত। তুর্কীস্তান ও আশেপাশের অঞ্চল থেকে ৩০,০০০ যুবক বিনা বেতনে মাহমুদের সহযাত্রী হয়েছিল। ধারণা করা যায় যে, লুটপাটের মাধ্যমে ভারতের বিপুল সম্পদ ও যুদ্ধ-বন্দী নারী-পুরুষ প্রাপ্তির খবর চারিদিকে এমনভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল যে, এত যুবক প্রলুব্ধ হয়ে সুলতান মাহমুদের অনুগামী হয়েছিল। মাহমুদ পথে আজমির শহর পড়লে শহরটি লুণ্ঠন ও আশেপাশের অঞ্চল ধ্বংস করে ছারখার করার জন্য সৈন্যদের প্রতি নির্দেশ দিলেন। সোমনাথ পৌঁছার পর কয়েক দিন ব্যাপী এক ভয়ানক যুদ্ধ সংঘটিত হল। ভারতীয়দের সাথে যুদ্ধে এক সময় জয়-পরাজয় অনিশ্চিত হয়ে গেল। শেষ পর্যন্ত মামুদের সৈন্যদের জয় হয় এবং ভারতীয়দের পরাজয় ঘটে। ফিরিশতা লিখেছেন যে, মাহমুদ তাঁর পুত্ররা, কয়েক জন সেনাপতি ও প্রধান দেহরক্ষী সঙ্গে নিয়ে সোমনাথে প্রবেশ করলেন। কাছে গিয়ে দেখলেন, মন্দিরটি প্রস্তর নির্মিত এক চমৎকার সৌধ। এর সুউচ্চ ছাদ পঞ্চাশটি স্তম্ভের উপর স্থাপিত। স্তম্ভগুলি অদ্ভুত কারুকার্য খচিত ও এর বিভিন্ন জায়গায় মূল্যবান জিনিস বসানো ছিল। মন্দিরের কেন্দ্র স্থলে পাঁচ গজ দীর্ঘ পাথরের মূর্তি সোমনাথ অবস্থিত। এর নিম্নাংশের দুই গজ পরিমিত অংশ মাটিতে প্রোথিত। মূর্তির কাছে গিয়ে সুলতান পদাঘাতে এর নাক ভেংগে ফেলেন। মূর্তিটির দুইটি খণ্ড ভেংগে গজনী পাঠানো হয়েছিল। এক খণ্ড সেখানকার জামে মসজিদের চৌকাঠে স্থাপন করা হয়েছিল ও অন্য অংশটি সুলতানের প্রাসাদের সদর দরজায় স্থাপন করা হয়েছিল। ফিরিশতা আরো লেখেন, মন্দিরে পাওয়া লুণ্ঠিত জিনিসপত্রের মধ্যে ২০০ মণ ওজনের একটা সোনার শিকল ছিল। এটি মন্দিরের চূড়ায় বাঁধা একটি সোনার বলয় থেকে ঝুলানো ছিল। এই শিকলের সাথে একটি প্রকাণ্ড ঘন্টা বাঁধা ছিল। এই ঘন্টা বাজিয়ে লোকদেরকে পূজার জন্য আহবান জানানো হত। দুই হাজার ব্রাহ্মণ পুরোহিত ছাড়াও মন্দিরে ৫০০ নর্তকী, ৩০০ গায়ক ও মন্দিরে প্রবেশের পূর্বে ভক্তদের মস্তক মুণ্ডনের জন্য ৩০০ নাপিত ছিল। গজনীর সুলতান এই মন্দিরে যে বিপুল পরিমাণ সোনা ও রত্ন পেয়েছিলেন জগতে কোনো রাজার ভাণ্ডারে তত ছিল না।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৫৬।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫৯, ৬০।

----------------------------------------

পাতা : ৮

সোমনাথ মন্দির অবরোধের সময় সেখানকার অধিবাসীদের সাহায্য করা ও সুলতানের বাহিনীর মুসলমান সৈন্যদের হত্যা করার অপরাধে সুলতান মামুদ নিহারওয়ালার রাজা ব্রহ্মদেবকে শাস্তি দিতে চাইলেন। ব্রহ্মদেব তখন কিছু দূরে গন্ধরা নামে একটি দুর্গে অবস্থান করছিলেন। ফিরিশতা লিখেছেন, সুলতানের বাহিনী দুর্গটি দখল করে পুরুষদের উপর এক ভয়াবহ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করল। নারী ও শিশুদের বন্দী করা হল।

----------------------------------------

 প্রাগুক্ত, পৃঃ ৬০, ৬১।

----------------------------------------

সুলতান মাহমুদের কীর্তি বর্ণনা করতে গিয়ে তবাকাত-ই-নাসিরীর লেখক মিনহাজ-উস সিরাজ লিখেছেন যে, ইসলামের উপর তার প্রভাব শিগগীরই ব্যাপকভাবে পরিচিতি পেল, কারণ তিনি এক হাজারের মত মূর্তি-যুক্ত মন্দিরকে মসজিদে পরিণত করেছিলেন, ভারতের নগরগুলিকে অধীনে এনেছিলেন, সেই দেশের রাজাদের পরাজিত করেছিলেন।

----------------------------------------

তবাকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থে মিনহাজ-উস সিরাজ লিখেছেন, “Mahmúd was a man of great abilities, and is renowned as one of the greatest champions of Islám. He ascended the throne in Balkh, in the year 387 H. (997 A.D.), and received investiture by the Khalífá Al Kádir bi-llah. His influence upon Islám soon became widely known, for he converted as many as a thousand idol-temples into mosques, subdued the cities of Hindustán, and vanquished the Ráís of that country.” দেখুনঃ H.M. Elliot and John Dowson (eds.), The History of India, as Told by its Own Historians, The Muhammadan Period, Vol. II, Trübner and Co., London, 1869, pp. 269, 270.

----------------------------------------

               সর্বোচ্চ বিস্তারের সময় গজনভী সাম্রাজ্য (১০৩০ খ্রীষ্টাব্দ)

                 সূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Ghaznavids)

সুলতান মাহমুদের সময়ে ৪২৪ হিজরীতে (১০৩৩ খ্রীষ্টাব্দে) ভারতে নিযুক্ত সেনাপতি (কমান্ডার) আহমদ নিয়ালতিগিন লাহোর থেকে তার যোদ্ধা ও সৈনিকদের সহ একটি অভিযান পরিচালনা করেন। এজন্য তিনি হিন্দুদের কাছ থেকে পর্যাপ্ত কর সংগ্রহ করেন। তিনি গঙ্গা নদী পার হয়ে এর বাম তীর ধরে চলতে লাগলেন ও এক সময় বেনা নামে একটি নগরে এসে উপস্তিত হলেন। এর আগে কোনো মুসলমান বাহিনী এই অঞ্চলে আসে নাই। তারিখ-উস সবুক্তগীনের লেখক আবুল ফযল আল বায়হাকী বলছেন, বস্ত্র-ব্যবসায়ী, সুগন্ধী-ব্যবসায়ী ও রত্নব্যবসায়ীদের বাজার লুণ্ঠন করা হল। কিন্তু এর বেশী করা সম্ভব ছিল না। সৈনিকরা ধনী হয়ে গেল; কারণ তারা সোনা, রূপা, সুগন্ধী ও মণি-রত্ন নিরাপদে নিয়ে যেতে পেরেছিল।

----------------------------------------

বায়হাকীর বর্ণনার জন্য দেখুন, Elliot and Dowson (eds.), The History of India, as Told by its Own Historians, Vol. II, pp. 123,124.

----------------------------------------

সুলতান মামুদের পর আফগানিস্তান থেকে মুসলিম আক্রমণকারীরা ব্যাপক ভিত্তিতে আক্রমণ অভিযান, হত্যা, লুণ্ঠন ও যুদ্ধ-বন্দী নারী-পুরুষদের দাসকরণ পরিচালনা করেছিল সুলতান মাসুদ গজনভীর সময়ে। তিনি ৪২৪ হিজরীতে (১০৩৩ খ্রীষ্টাব্দে) ভারত অভিযানের উদ্দেশ্যে কাশ্মীরের পর্বতশ্রেণীর মধ্যে অবস্থিত সুরসুতি দুর্গের দিকে যাত্রা করলেন। দুর্গবাসী সৈন্যরা কয়েকজন মুসলমান বণিককে আটক করে রেখেছে জেনে সুলতার দুর্গ আক্রমণ করেন এবং এক রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের পর দুর্গ অধিকার করেন। ফিরিশতা লিখেন, শিশু ও নারী ছাড়া দুর্গের সমস্ত মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করা হল। শিশু ও নারীদের যুদ্ধ-বন্দী করে দাস-দাসী করা হল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৮৩।

----------------------------------------

মূলত ভারতবর্ষের সম্পদ লুণ্ঠনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা আফগানিস্তানের গজনী নগরটির ক্রমশ শ্রীবৃদ্ধি ঘটতে থাকে। সুলতান মাসুদের সময়ে ৪২৭ হিজরীতে (১০৩৬ খ্রীষ্টাব্দে) গজনীতে একটা নূতন প্রাসাদ নির্মাণ কাজ সম্পন্ন করা হয়। এই প্রাসাদে অত্যন্ত চমৎকার ও বড় এক প্রকোষ্ঠে বহু রত্ন খচিত একটি সোনার সিংহাসন বসানো হয়। এই সিংহাসনের উপর শিকলে বাঁধা ৭০ মণ (১৩৫ পাউণ্ড) ওজনের একটি সুবৃহৎ মুকুট ঝুলানো ছিল। ঐ মুকুটে অসংখ্য রত্ন থেকে আলোকরশ্মি বিচ্ছুরিত হত। জনসাধারণকে সাক্ষাৎ দানের সময় সুলতান যখন সিংহাসনে বসতেন তখন মুকুটটি মাথার উপর চাঁদোয়ার মত শোভা পেত। ফিরিশতা লিখেছেন, এই বৎসরই সুলতান মাসুদ ভারতে হান্সী দুর্গ জয় করার জন্য যাত্রা করেন। দুর্গটিকে হিন্দুরা অজেয় মনে করত। ছয় দিনের যুদ্ধে সুলতানের বাহিনী দুর্গটি অধিকার করে। তারিখ-উস সবুক্তগীনের লেখক বায়হাকী বলছেন, সেখানকার ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য পুরুষদের হত্যা করা হল এবং তাদের নারী ও শিশুদের যুদ্ধ-বন্দী হিসাবে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে যা সম্পদ লুট করে পাওয়া গেল সমস্ত সৈনিকদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দেওয়া হল। এরপর সুলতানের বাহিনী সনপুত দুর্গের দিকে যাত্রা করে। সনপুতের রাজা দিপাল হরি দুর্গ ত্যাগ করে জঙ্গলে পালিয়ে যান। সময়াভাবে যে সমস্ত সম্পদ নিয়ে যেতে পারেন নাই তা বিজয়ীদের হাতে চলে গেল। ফিরিশতা লিখেছেন, মাসুদ সেখানকার সমস্ত মন্দিরকে ভুমিসাৎ করতে ও মূর্তিগুলি চূর্ণবিচূর্ণ করতে নির্দেশ দিলেন। সেখান থেকে সুলতান রাম রায়ের বিরুদ্ধে অগ্রসর হন। তার আগমন সংবাদ পেয়ে রাম রায় মাসুদের জন্য প্রচুর পরিমাণ সোনা ও হাতী উপহার হিসাবে পাঠিয়ে দেন ও বার্ধক্য জনিত দুর্বলতার জন্য নিজে উপস্থিত হতে না পারার জন্য ক্ষমা ভিক্ষা করেন। তার উপহার ও আবেদনে সন্তুষ্ট হয়ে সুলতান মাসুদ তার প্রতি আর কোনো অত্যাচার করেন নাই।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৬।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮৬। এছাড়া বায়হাকীর বর্ণনার জন্য দেখুনঃ Elliot and Dowson (eds.), The History of India, as Told by its Own Historians, Vol. II, p. 140.

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৮৬।

----------------------------------------

সুলতান ইব্রাহীম ভারতে এমন সমস্ত স্থানে সৈন্য পাঠিয়েছিলেন যেখানে আগে কোনো মুসলিম বাহিনী যায় নাই। ৪৭২ হিজরীতে (১০৭৯ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতান ডেরা নামে একটি শহর অবরোধকালে শহরবাসীদের আত্মসমর্পণ ও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বলেন। ফিরিশতা লিখেছেন, সুলতানের প্রস্তাব তারা প্রত্যাখ্যান করলে কয়েক সপ্তাহ অবরোধের পর শহরটি দখল করা হল এবং মুসলমানেরা প্রভূত ধন-সম্পদ পেল। এখান থেকে এক লক্ষ লোককে বন্দী করে গজনী আনা হল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১২।

----------------------------------------

পাতা : ৯

সুলতান মসউদ সম্পর্কে ফিরিশতা লিখেছেন, সুলতান মাহমুদের মতই তিনি বহু নগর ও মন্দির লুণ্ঠন করে প্রভূত ধন-রত্ন নিয়ে লাহোরে ফিরে আসেন। সেই সময় লাহোরই প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যের রাজধানীতে পরিণত হয়। কারণ সেলজুকরা গজনী পরিবারকে ইরান ও তুরানের অধিকাংশ স্থান থেকে বঞ্চিত করেছিল। পরে গজনীর শাহী পরিবার ভারতে বাস করতে আসে।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১১৪।

----------------------------------------

৫৭৪ হিজরীতে (১১৭৮ খ্রীষ্টাব্দে) মুহাম্মদ ঘুরী তার বাহিনী নিয়ে গুজরাট অভিযানে যান। যে ব্রহ্মদেব গুজরাটে মাহমুদকে বাধা দিয়েছিলেন, সেই ব্রহ্মদেবেরই বংশধর রাজা ভীমদেব এক বিরাট বাহিনী নিয়ে মুহাম্মদ ঘুরীর বাহিনীকে বাধা দিতে এগিয়ে এলেন ও তাদেরকে সম্পূর্ণ পরাস্ত করলেন। ফিরিশতা লিখেছেন, এই যুদ্ধে মুসলমানদের বহু লোকক্ষয় হয়েছিল। পলায়নকালে বহু কষ্টভোগ করে মুহাম্মদ কোনো প্রকারে গজনী ফিরে যান। ৫৭৭ হিজরীতে (১১৮১ খ্রীষ্টাব্দে) মুহাম্মদ ঘুরী সিন্ধু প্রদেশের দিবালের দিকে অগ্রসর হলেন ও সমুদ্রোপকুল পর্যন্ত সমস্ত দেশ পদদলিত করে বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত জিনিসপত্র নিয়ে নিজের দেশে ফিরে যান।

----------------------------------------

  প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৩, ১৩৪।

----------------------------------------

৫৮৭ হিজরীতে (১১৯১ খ্রীষ্টাব্দে) ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধে মুহাম্মদ ঘুরীর বড় ধরনের পরাজয় ঘটেছিল। এই সময় তিনি ডান বাহুতে তীর বিদ্ধ হওয়ায় আহত হন ও তার সমস্ত বাহিনী তাকে ফেলে পালিয়ে যায়। ভারতীয় বাহিনী তাদের প্রায় চল্লিশ মাইল পর্যন্ত পশ্চাদ্ধাবন করেছিল। এরপর মুহাম্মদ ঘুরী আবার ভারতে অভিযান যান। আজমীর-রাজকে সুলতানের পক্ষ থেকে জানানো হল যে, ভারতবাসীরা ইসলাম ধর্ম গ্রহণে অসম্মত হলে মুহাম্মদ ঘুরীর সাথে তাদের যুদ্ধ অনিবার্য। আজমীরের রাজা পৃথ্বীরাজ উত্তরে তার সংকল্প ত্যাগ করতে বললেন নতুবা যুদ্ধে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের কথা উল্লেখ করলেন। একই সাথে তিনি অন্যান্য ভারতীয় রাজাদের সাহায্য চাইলেন। এই যুদ্ধে ভারতীয় সম্মিলিত বাহিনীর বড় ধরনের পরাজয় ঘটে, ও অনেক ভারতীয় রাজা নিহত হন। এই পরাজয়ের পর সরস্বতী, সামানা, কোরাম ও হান্সীর দুর্গ আত্মসমর্পন করে। মুহাম্মদ ঘুরী আজমীর রাজ্য নিজ অধিকারভুক্ত করেন। ঐতিহাসিক হাসান নিজামী তার গ্রন্থ তাজ-উল মা’সিরে লিখেছেন, ইসলামের সেনাবাহিনী সম্পূর্ণ বিজয় লাভ করেছিল এবং এক লক্ষ অবলুণ্ঠিত হিন্দুকে দ্রুত নরকের আগুনে যাত্রা করানো হয়েছিল, অর্থাৎ হত্যা করা হয়েছিল। বাকীদের যুদ্ধ-বন্দী হিসাবে দাস করা হয়। হাসান নিজামী আরো লিখেছেন, তিনি প্রতিমা-মন্দিরের স্তম্ভ ও ভিত্তি ধ্বংস করেন, ও সেই জায়গায় মসজিদ ও মাদ্রাসা নির্মাণ করেন, এবং ইসলামের ধর্মানুশাসন ও আইনের নিয়ম প্রকাশ ও প্রতিষ্ঠা করেন। আজমীরে মুহাম্মদ ঘুরী এত সম্পদ লুণ্ঠন করে পান যেন সাগর ও পাহাড়ের গোপন ভাণ্ডার উন্মোচিত হয়ে পড়েছে। এরপর তিনি তার বিশ্বস্ত গোলাম ও সুহৃদ কুতুব-উদ্-দীন আইবককে কোরাম শহরে অবস্থান করার ব্যবস্থা করে নিজে গজনী ফিরে গেলেন। ফিরিশতা লিখেছেন, গজনী প্রত্যাবর্তনকালে তিনি যে সমস্ত দেশের মধ্য দিয়ে গিয়েছিলেন সেই সমস্ত দেশ লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে গিয়েছিলেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ Elliot and Dowson (eds.), The History of India, as Told by its Own Historians, Vol. II, p. 215.

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২১৫।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩৯, ১৪০। তবাকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থের লেখক মীনহাজ-ই-সিরাজও এই ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন। তার বর্ণনার জন্য দেখুনঃ Maulānā, Minhāj-ud-Dīn, Abū-‘Umar-i-‘Usmān,  Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: A General History of the of the Muḥammadan Dynasties of Asia, including Hisdūstān, Translated from Original Persian Manuscripts, Translated by Major H.G. Raverty, Vol. I, Printed by Gilbert & Rivington, London, 1881, pp. 458- 469.

----------------------------------------

মুহাম্মদ ঘুরী আবার গজনী থেকে ফিরে কনৌজের দিকে অগ্রসর হলেন এবং কনৌজ ও বেনারসের রাজ্য আক্রমণ করলেন। এরপর মুহাম্মদ ঘুরী অশ্বিনী দুর্গে আক্রমণ করলেন ও সেখানে থাকা বিপুল পরিমাণ সোনা, রূপা ও মূল্যবান পাথর লুণ্ঠন করে পেলেন। ফিরিশতা লিখেছেন, এই স্থান থেকে তিনি বেনারসের দিকে রওনা হলেন ও সেখানে সহস্রাধিক মন্দিরের মূর্তিগুলি ভেংগে ও অপসারণ করে সেই সমস্ত দেবালয়কে মসজিদে রূপান্তরিত করলেন। কামিলু’ত তাওয়ারিখের লেখক ঐতিহাসিক ইবনে আসির বলেন, সেখানে হিন্দুদের হত্যাকাণ্ড ছিল বিপুল সংখ্যক, নারী ও শিশুরা ছাড়া কেউই রক্ষা পায় নাই, এবং যতক্ষণ না পৃথিবী পরিশ্রান্ত হয় ততক্ষণ পুরুষদের উপর হত্যাকাণ্ড চলতে লাগল। সেখান থেকে কোলের দুর্গে ফিরে গিয়ে কুতুব-উদ-দীন আইবককে ভারতীয় রাজ্যের জন্য প্রতিনিধি নির্বাচন করে ও প্রচুর ধনরত্ন ভারাক্রান্ত হয়ে গজনীর পথে রওনা হলেন। মুহাম্মদ ঘুরী বাংলার সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা বিনা বাধায় নিজ অধিকারে এনেছিলেন। এই সময় তিনি মন্দিরের সমস্ত মূর্তি ধ্বংস করেন এবং বিপুল পরিমাণ ধন-সম্পদ লুণ্ঠন করেন। এত বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত জিনিসপত্র হয়েছিল যে সেগুলি বহন করতে চার হাজার উট লেগেছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১৪০।

দেখুনঃ Elliot and Dowson (eds.), The History of India, as Told by its Own Historians, Vol. II, p. 251.

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১৫১।

----------------------------------------

৫৯৩ হিজরীতে মুহাম্মদ ঘুরীর গজনীতে প্রস্থানের পরেই তার সেনাপতি কুতুব উদ্দিন মিরাট দুর্গ অধিকার করেন এবং চৌয়ান্দ রায়ের বংশধরদের কাছ থেকে দিল্লী কেড়ে নেন। তাজ-উল মা’সির গ্রন্থের লেখক হাসান নিজামী বলেন, দিল্লী নগরটি ও এর আশেপাশে থেকে মূর্তি ও মূর্তি-পূজা দূর করা হল এবং দেবতাদের মূর্তির উপাসনার স্থানে এক দেবতার উপাসকরা মসজিদ নির্মাণ করল।  কুতুব উদ্দিন কোলের দুর্গ অধিকার করেন ও দিল্লীতে স্থায়ীভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। ফিরিশতা লিখেছেন, তিনি চারপাশের সমস্ত অঞ্চলের অধিবাসীদেরকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণে বাধ্য করেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ Elliot and Dowson (eds.), The History of India, as Told by its Own Historians, Vol. II, p. 219.

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১৪০।

----------------------------------------

৫৯৩ হিজরীতে (১১৯৬ খ্রীষ্টাব্দে) গুজরাটের পথে সিরোহী প্রদেশের আবুগড় দুর্গের নিকট কুতুব-উদ-দীনের সাথে ভারতীয়দের প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে পঞ্চাশ হাজারের চেয়ে বেশী ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়েছিল এবং কুড়ি হাজার বন্দী হয়েছিল। এই সময়ে সুলতানের বাহিনীর হাতে বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য আসে। ফিরিশতা লিখেছেন, সৈন্যবাহিনীকে কিছুটা বিশ্রাম দানের পর কুতুব-উদ-দীন গুজরাটে প্রবেশ করলেন এবং বিনা বাধায় সমস্ত দেশ লুণ্ঠন করলেন। তিনি গজনীতে সুলতান মুহাম্মদ ঘুরীকে বিপুল পরিমাণ সোনা ও রত্ন এবং বহু সংখ্যক যুদ্ধ-বন্দী দাস-দাসী পাঠান। অবশিষ্ট লুণ্ঠিত দ্রব্য তিনি সৈন্যদের মধ্যে বন্টন করে দেন। ৫৯৯ হিজরীতে (১২০২ খ্রীষ্টাব্দে) কুতুব-উদ-দীন সমস্ত সৈন্যদল একত্রিত করে কালিঞ্জরের দিকে অগ্রসর হলেন। কালিঞ্জরের দুর্গের পতন হলে কালিঞ্জর লুণ্ঠন করে বিজয়ীরা বিপুল পরিমাণ সোনা ও রত্ন পেয়েছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৪, ১৫৫।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৫।

----------------------------------------

পাতা : ১০

৫৯১ হিজরীতে (১১৯৪ খ্রীষ্টাব্দে) কুতুব-উদ-দীন আইবক গুজরাটের রাজা ভীমদেবকে পরাজিত করেন। ফিরিশতা লিখেছেন, এই সমৃদ্ধ দেশে কিছুকাল অবস্থান করে কুতুব-উদ-দীন এই দেশে যথেচ্ছ লুট-তরাজ করেন।

----------------------------------------

  প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪১।

----------------------------------------

তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থের লেখক মীনহাজ-ই-সিরাজ বলেন, মুহাম্মদ-ই-বখতিয়ার মানের ও বিহার অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করে যেতেন যতদিন না তিনি পর্যাপ্ত ঘোড়া, যুদ্ধাস্ত্র ও সৈন্য তার অধিকারে আসে। তার সাহসিকতা ও লুণ্ঠিত দ্রব্যের সংবাদ চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এই সংবাদ সুলতান কুতুব-উদ-দীনের কাছে পৌঁছালে সুলতান তাকে সম্মানসূচক পরিচ্ছদ পাঠান ও সম্মান প্রদর্শন করেন। এই মনোযোগ ও সম্মান পাওয়ার পর তিনি বিহারের দিকে একটি বাহিনী পরিচালনা করলেন এবং সেই অঞ্চলে ব্যাপক লুণ্ঠন করেন। এভাবে তিনি এই অংশে লুণ্ঠনাভিযান পরিচালিত করতে থাকেন যত দিন না তিনি বিহারের দুর্গবেষ্টিত নগরে এক সংগঠিত আক্রমণ পরিচালনা করেন। মিনহাজ যাকে দুর্গবেষ্টিত নগর বলছেন সেটি আসলে ছিল বৌদ্ধদের মঠ বা বিহার। মিনহাজ আরো লিখেছেন, বিশ্বস্ত ব্যক্তিগণ থেকে এই বিষয়ে জানা গেছে যে, তিনি (বখতিয়ার) দুই শত সশস্ত্র অশ্বারোহী সৈন্য নিয়ে বিহারের দরজার দিকে অগ্রসর হন এবং অতর্কিতে স্থানটিতে আক্রমণ করেন। বখতিয়ারের সৈন্যরা বিহারটি অধিকার করে এবং অনেক দ্রব্য লুণ্ঠন করে। মিনহাজ লিখেছেন, এই জায়গার অধিবাসীদের বিপুল সংখ্যক ব্রাহ্মণ ছিল ও তাদের মাথা মুণ্ডিত ছিল। এই বিষয়ে কোনো সন্দেহ নাই যে, এটি একটি বৌদ্ধ বিহার ছিল যার অধিবাসীরা সবাই বৌদ্ধ ছিল। ধারণা করা যায় যে, সেই সময়ে ভারতবর্ষে বৌদ্ধ জনসংখ্যা ও সেই সাথে তাদের কেন্দ্র কমে গিয়েছিল। ফলে মিনহাজ বা তার বর্ণনাকারীর বৌদ্ধদের সম্পর্কে কোনো ধারণা ছিল না। ফলে তাদেরকে হিন্দু হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যাইহোক, সেই বৌদ্ধ বিহারে যুদ্ধে অপারগ সকল বৌদ্ধকে বখতিয়ারের বাহিনী হত্যা করল। সেখানে বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ ছিল। এই বইগুলি মুসলমানদের দৃষ্টি গোচর হলে তারা গ্রন্থে লিখিত বিষয়ের তথ্য জানবার জন্য ঘোষণা করল। কিন্তু সকলেই নিহত হয়েছিল। বইসমূহের বিষয়বস্তু জানার পর বুঝা গেল যে এই দুর্গটি ও নগরটি একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছিল। এই বিজয় অর্জিত হবার পর মুহাম্মদ বখতিয়ার বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত জিনিসপত্র নিয়ে ফিরে গেলেন এবং সুলতান কুতুব-উদ-দীনের কাছে উপস্থিত হলেন। সুলতান তাকে প্রভূত সম্মান ও পুরস্কার দিলেন।

----------------------------------------

বেনারস থেকে প্রায় ১০০ মাইল পূর্ব দিকে গঙ্গা ও সরযু নদীর সঙ্গমস্থলের নিকটবর্তী এবং গঙ্গা নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত ছিল মানের নামক স্থান।

রেভার্টি তার তবকাত-ই-নাসিরীর ইংরাজী অনুবাদে এটিকে কোনো সুনির্দিষ্ট বিহার হিসাবে চিহ্নিত করেন নাই। তবকাত-ই-নাসিরীর বাংলা অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার গ্রন্থের পাদটীকায় এটিকে উদন্তপুর বা ওদন্তপুর বৌদ্ধ বিহার হিসাবে উল্লেখ করেছেন। যাকারিয়ার পাদটীকার জন্য দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃঃ ১৯। ঐতিহাসিক A.S. Altekar তার Education in Ancient India গ্রন্থে তবকাত-ই-নাসির-র বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসের বর্ণনাটিকে বিক্রমশীলা বৌদ্ধ মঠ ধ্বংসের বর্ণনা হিসাবে উল্লেখ করেছেন। অল্টেকারের বর্ণনার জন্য দেখুনঃ A.S. Altekar, Education in Ancient India, Nand Kishore & Bros., Benares, 1944, pp.128, 129। তবে তবকাত-ই-নাসির-র বিহার ধ্বংসের বর্ণনাটি যে বৌদ্ধ বিহার ধ্বংসের বর্ণনাই হোক না কেন পণ্ডিতরা একমত যে, মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী বিখ্যাত নালন্দা বৌদ্ধ বিহারও ধ্বংস করেছিলেন।

এটি ছিল মিনহাজ কর্তৃক মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর বিহারে অবস্থিত একটি বৃহৎ বৌদ্ধ বিহারের ধ্বংস ও লুণ্ঠনের বিবরণ। তবকাত-ই-নাসিরীর পারস্য থেকে ইংরাজী অনূদিত গ্রন্থটির প্রাসঙ্গিক অংশটি এখানে দেওয়া হলঃ “He used to carry his depredations into those parts and that country until he organized an attack upon the fortified city of Bihār. Trustworthy persons have related on this wise, that he advanced to the gateway of the fortress of Bihār with two hundred horsemen in defensive armour, and suddenly attacked the place. There were two brothers of Farghānah, men of learning, one Niẓām-ud-Dīn, the other Ṣamṣām-ud-Dīn [by name], in the service of Muḥammad-i-Bakht-yār; and the author of this book met with Ṣamṣām-ud-Dīn at Lakhaṇawaṭī in the year 641 H., and this account is from him. These two wise brothers were soldiers among that band of holy warriors when they reached the gateway of the fortress and began the attack, at which time Muḥammad-i-Bakht-yār, by the force of his intrepidity, threw himself into the postern of the gateway of the place, and they captured the fortress, and acquired great booty. The greater number of the inhabitants of that place were Brahmans, and the whole of those Brahmans had their heads shaven; and they were all slain. There were a great number of books there; and when all these books came under the observation of the Musalmāns, they summoned a number of Hindūs that they might give them information respecting the import of those books; but the whole of the Hindūs had been killed. On becoming acquainted [with the contents of those books], it was found that the whole of that fortress and city was a college, and in the Hindūī tongue, they called a college Bihār.” দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 551, 552. এছাড়াও দেখুন তবকাত-ই-নাসিরীর বাংলা অনুবাদ। মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া অনূদিত ও সম্পাদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৩, পৃঃ ১৮-২০।

----------------------------------------

মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর নদীয়া জয়ের বিবরণ এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। মীনহাজ লিখেছেন, পরের বৎসর মুহাম্মদ-ই-বখতিয়ার একটি সৈন্যবাহিনী প্রস্তুত করলেন এবং বিহার থেকে রওনা হলেন। তিনি হঠাৎ নদীয়া নগরের দ্বারে উপস্থিত হলেন। সেই সময় আঠারো জনের বেশী অশ্বারোহী সৈনিক তার সাথে ছিল না এবং বাকীরা তাদের পিছনে আসছিল। নগরের দ্বারে উপস্থিত হয়ে বখতিয়ার কাউকে উৎপীড়ন করেন নাই এবং এমন অবিচলিত ও শান্তভাবে তিনি অগ্রসর হলেন যে, লোকজন মনে করল যে সম্ভবত তার দল বণিক এবং ঘোড়া বিক্রী করার জন্য নিয়ে এসেছে। তারা কল্পনা করে নাই যে তিনি মুহাম্মদ বখতিয়ার যতক্ষণ না তিনি রাজা লক্ষণ সেনের রাজপ্রাসাদের প্রবেশ দ্বারে উপস্থিত হলেন এবং তার তরবারী কোষমুক্ত করলেন ও অবিশ্বাসীদের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ করলেন। এই সময় রাজা লক্ষণ সেন তার টেবিলের প্রান্তে বসেছিলেন, এবং সোনা ও রূপার থালায় তার প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খাবারে পূর্ণ ছিল। এই সময় রাজার প্রবেশ দ্বার ও নগরের ভিতর থেকে চিৎকার শুরু হল। এই সময় তিনি নিশ্চিত হলেন যে কি ঘটছে এবং বুঝলেন মুহাম্মদ-ই-বখতিয়ার প্রবেশ দ্বার থেকে রাজপ্রাসাদে প্রচণ্ড আক্রমণ করেছে এবং বহু মানুষকে তরবারির সাহায্যে হত্যা করেছে। রাজা খালি পায়ে তার প্রাসাদের পিছনের অংশ দিয়ে পালিয়ে গেলেন। তার সমস্ত সম্পদ, তার অন্তঃপুরের নারীদের, তার গৃহের সেবক-সেবিকারা বখতিয়ারের দখলে আসল। এই সময় মুসলমানরা বহু সংখ্যক হাতী, ও এত বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত জিনিসপত্র পায় যা বর্ণনাতীত ছিল। যখন বখতিয়ারের সমস্ত সেনাবাহিনী এসে পৌঁছাল, এবং নগরটি ও তার আশেপাশের অঞ্চল দখল করল, তিনি সেখানে বাস করতে লাগলেন। রাজা লক্ষণ সেন সঙ্কোনাত ও বঙ্গের দিকে চলে গেলেন এবং সেখানে কিছুকাল রাজত্ব করে মৃত্যুবরণ করেন। তার বংশধররা এখন পর্যন্ত বঙ্গরাজ্যে শাসন করছেন। মুনতাখাবু’ত-তাওয়ারিখের লেখক আল-বাদাউনি লিখেছেন, বখতিয়ার মূর্তি-পূজকদের পূজার স্থান ও মন্দিরসমূহ ধ্বংস করে মসজিদ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা করেন।

----------------------------------------

  দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 557, 558, এবং মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ২৬-২৮।

দেখুনঃ Abdul Kadir Al-Badaoni, A History of India: Muntakhabu-t-Tawarikh, English translation by George S.A. Ranking, Volume I, Atlantic Publishers & Distributors, New Delhi, Reprinted 1990, p. 83.

----------------------------------------

রাজা লক্ষণ সেনের পলায়নের পর মুহাম্মদ বখতিয়ার নদীয়া নগরটি ধ্বংস করেন এবং সেখান থেকে লখ্নৌতি বা লক্ষণাবতী নামক স্থানে রাজধানী স্থাপন করেন। এই রাজ্যের বিভিন্ন অংশ তিনি নিজের অধিকারে আনেন এবং প্রতিটি অঞ্চলে খুৎবা ও মুদ্রা প্রচলন করেন। ঐ অঞ্চলসমূহে তার ও তার আমীরদের প্রচেষ্টায় মসজিদ, মাদ্রাসা ও দরবেশদের জন্য উপাসনালয় (খানকাহ্?) নির্মাণ করেছিলেন। লুণ্ঠিত দ্রব্য ও সম্পদ থেকে তিনি বিপুল পরিমাণ সুলতান কুতুব-উদ-দীন আইবককে পাঠান।

----------------------------------------

দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 559, 560; এবং মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ২৯।

----------------------------------------

মীনহাজ বখতিয়ার খলজীর আসামের কামরূপ অঞ্চলে অভিযানের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। এই অভিযানে অজেয় বীর হিসাবে পরিচিত বখতিয়ারের শোচনীয় পরাজয় ঘটে ও তার বাহিনীর বহু সৈন্য মারা যায়। এই পরাজয়ের পরে তিনি বাইরে অশ্বারোহণে বের হলে তার মৃত সৈনিকদের স্ত্রী-সন্তানরা তাকে অভিশাপ দিত ও গালাগালি করত। অপমানে তিনি বাইরে অশ্বারোহণে বের হওয়া বন্ধ করে দিলেন ও অসুস্থতায় কিছু দিন পর তার মৃত্যু ঘটল। বখতিয়ারের যুদ্ধ যাত্রাটি এখানে প্রাসঙ্গিক বলে মীনহাজ বর্ণিত সম্পূর্ণ ঘটনাটির উল্লেখ করা হল।

পাতা : ১১

মীনহাজ লিখেছেন, লক্ষণাবতী দখল করার কয়েক বৎসর পর লক্ষণাবতীর পূর্ব দিকে অবস্থিত অঞ্চল তুর্কিস্তান ও তিব্বত সম্পর্কে ধারণা অর্জন করলেন এবং তিনি এই দুটি অঞ্চল অধিকার করার জন্য অস্থির হলেন। তিনি সৈন্য প্রস্তুত করলেন ও প্রায় ১০,০০০ অশ্বারোহী বাহিনী প্রস্তুত করলেন। লক্ষণাবতী ও তিব্বতের মাঝামাঝি অবস্থিত পাহাড়ী অঞ্চলে তিন জাতির মানুষের বসবাস ছিল, তাদের একটিকে কোচ, দ্বিতীয়টিকে মেচ ও তৃতীয়টিকে তিহারু (বা থারো) বলা হত। তাদের চেহারা তুর্কীদের মত ছিল, কিন্তু তাদের ভাষা ভারতীয় ও তিব্বতী ভাষার মাঝামাঝি ছিল। এই কোচ ও মেচ জাতির প্রধানদের একজন বখতিয়ারের হাতে ধরা পড়েন ও মুসলমান হন, যিনি আলী মেচ নামে পরিচিত হন। তিনি ঐ পার্বত্য অঞ্চলে পথপ্রদর্শক হিসাবে বখতিয়ারকে নিয়ে যেতে সম্মত হন। তিনি বখতিয়ারকে এমন একটি স্থানে নিয়ে যান যেখানে একটি নগর ছিল, ও যার নাম ছিল বর্ধন কোট। তারা এই কাহিনীকে এভাবে সম্পর্কিত করে যে, প্রাচীনকালে চীন দেশ থেকে শাহ গুশতাসিব ফিরে কামরূপের দিকে আসেন, এবং এই পথে ভারতে এসে বর্ধন কোট নগরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই স্থানের সামনে দিয়ে একটি বড় নদী প্রবাহিত হচ্ছিল, যার নাম ছিল বেগ-মতি। যখন এই নদী ভারতে প্রবেশ করল তখন ভারতীয় ভাষায় এর নাম হল সমুদ্র। এর বিরাটত্ব, প্রশস্ততা ও গভীরতার দিক থেকে এটি গঙ্গা নদীর চেয়ে তিন গুণ ছিল।

----------------------------------------

বুঝা যাচ্ছে মীনহাজের তুর্কীস্তান ও তিব্বতের ভৌগোলিক অবস্থান সম্পর্কে ভুল ধারণা ছিল। 

তবকাত-ই-নাসিরী-র বাংলা অনুবাদক আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া তার গ্রন্থের পাদটীকায় লিখেছেন, কোচ-মেচ জাতির সন্ধান দিনাজপুর, রংপুর ও ভারতের দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি ও কোচবিহার ইত্যাদি অঞ্চলে পাওয়া যায়। কিন্তু এই সমস্ত অঞ্চলে থারো জাতির সন্ধান পাওয়া যায় না। ময়মনসিংহের গারো পাহাড় অঞ্চলের অধিবাসী ’গারো’ জাতিকে কেউ কেউ ’থারো’ জাতি বলে অনুমান করেন। দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ৩০।

তবকাত-ই-নাসিরী-র অনুবাদক মোহাম্মদ যাকারিয়া তার অনুবাদ গ্রন্থের পাদটীকায় বলছেন, কোচ, পলিয়া, রাজবংশী, বর্মন, ভঙ্গ ক্ষত্রীয়, ইত্যাদি বিভিন্ন নামে পরিচিত ও বিভিন্ন গোত্রে বিভক্ত হলেও তারা যে আদিতে মোঙ্গলীয় নরগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল তাতে সন্দেহ নাই। যদিও তারা বর্তমানে বাংলা ভাষায় কথা বলে, এককালে তাদের ভিন্ন ভাষা ছিল। দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০।

রেভার্টি গ্রন্থটির ইংরাজী অনুবাদে Burdhan-kot লিখেছেন। মোহাম্মদ যাকারিয়া গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদে মর্দান কোট লিখেছেন। রেভার্টির অনুবাদের জন্য দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, p. 561. মোহাম্মদ যাকারিয়ার অনুবাদের জন্য দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ৩১।

এই নদীটি ব্রহ্মপুত্র হওয়া সম্ভব।

----------------------------------------

মীনহাজ আরো লিখেছেন, মুহাম্মদ বখতিয়ার এই নদীর তীরে এলেন। তখন আলী মেচ ইসলামের সেনাবাহিনীর সাথে ছিলেন। দশ দিন ধরে নদীর ঊর্ধ্ব দিকে পার্বত্য শ্রেণীর মধ্য দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীকে নিয়ে গেলেন। তখন তারা এমন স্থানে এলেন যেখানে প্রাচীন কাল থেকে পাথর কেটে তৈরী একটি সেতু ছিল। সেখানে কুড়িটি খিলান ছিল। সৈন্যবাহিনী সেতু অতিক্রম করার পর তার ফিরে আসা পর্যন্ত বখতিয়ার তার নিজের দুইজন আমীর, একজন তুর্কী ক্রীতদাস ও অন্যজন খলজীকে সেনাবাহিনীসহ সেতুর মাথায় পাহারার জন্য নিয়োজিত করলেন। তখন মুহাম্মদ বখতিয়ার তার বাকী সৈন্যসহ সেতুটি অতিক্রম করলেন। যখন কামরূপের রাজা বখতিয়ারের সৈন্যবাহিনীর সেতুটি অতিক্রম করার বিষয়ে জানলেন, তিনি বিশ্বস্ত লোকজনদের পাঠালেন ও বললেন, ‘‘এই সময়ে তিব্বতের অভ্যন্তরে অভিযানে অগ্রসর হওয়া সমীচীন নয় এবং তাদের ফিরে যাওয়া দরকার। সামনের বৎসর আরো প্রস্তুতি নিয়ে অভিযান করা যাবে। আমি কামরূপের রাজা, সম্মত হচ্ছি যে আমি আমার নিজস্ব বাহিনী নিয়ে মুসলিম বাহিনীর পুরোভাগে থাকব, এবং ঐ অঞ্চল অধিকার করার জন্য উদ্যোগ নিব।” মুহাম্মদ বখতিয়ার কোনোভাবেই এই পরামর্শ গ্রহণ করলেন না এবং তিনি তার বাহিনী নিয়ে পাহাড়ী অঞ্চলের অভিমুখ যাত্রা করলেন।

মীনহাজ লিখছেন, ৬৪২ হিজরী সালের এক রাত্রিতে এই গ্রন্থের লেখক বখতিয়ারের এক বিশ্বস্ত অনুচর মু’তামাদ-উদ-দৌলার বাসায় অতিথি হিসাবে ছিলেন। স্থানটি ছিল লক্ষণাবতী অঞ্চলের দেও-কোট ও বেকানওয়াহ যেখানে তিনি বসতি স্থাপন করেছিলেন। লেখক তার কাছ থেকে এই সমস্ত বিবরণ শুনেছিলেন। বখতিয়ারের বাহিনী নদী পার হবার পর পনের দিন ধরে সংকীর্ণ গিরিপথের মধ্য দিয়ে এবং উঁচু পর্বতশ্রেণীতে উঠে ও নেমে চলল। ষোড়শ দিনে তিব্বতের উন্মুক্ত ভূমিতে এসে পৌঁছালেন। ঐ অঞ্চলটি কৃষিভূমি ছিল এবং উপজাতি লোকজন ও ঘনবসতিপূর্ণ গ্রামদ্বারা পূর্ণ ছিল। তারা এমন একটি স্থানে এসে পৌঁছাল যেখানে একটি শক্তিশালী দুর্গ ছিল। মুসলিম সেনাবাহিনী ঐ অঞ্চলের চারিদিকে লুটতরাজ শুরু করে দিল। ঐ দুর্গ ও শহরের ও সংলগ্ন এলাকার লোকজন প্রতিহত করার জন্য এগিয়ে এল এবং যুদ্ধ শুরু করল। দিনের শুরু থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত এক ভয়ংকর যুদ্ধ চলল এবং মুসলিম সৈন্যদের বহু সংখ্যক নিহত ও আহত হল। সমস্ত প্রতিরোধকারীর অস্ত্র ছিল টুকরা বাঁশের বল্লম। বিশেষভাবে তাদের বর্ম, ঢাল ও শিরস্ত্রাণ সবগুলিই বাঁশের অনেক ফালিকে একসাথে বেঁধে সেলাই করে তৈরী ছিল। এই সমস্ত মানুষ তুর্কী ও তীরন্দাজ ছিল ও তাদের কাছে দীর্ঘ ধনুক ছিল।

----------------------------------------

স্থানটি দেবকোট হবে। যাকারিয়া তার অনুবাদের পাদটীকায় লিখেছেন, ”দেওকোট – প্রাচীন দেবকোট বা দেবীকোট নামক স্থান গুপ্ত আমলে কোটিবর্ষ নামে পরিচিত ও ঐ নামীয় বিষয়ের প্রশাসনিক কেন্দ্র ছিল বলে গুপ্তদের বিভিন্ন তাম্রশাসন থেকে জানা যায়। এ স্থান বাণগড় নামেও পরিচিত ছিল্ ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর জেলায় গঙ্গারামপুর থানার সন্নিকটে ও পূণর্ভবা নদীর তীরে অবস্থিত এ স্থান দিনাজপুর শহর থেকে প্রায় ১৭ মাইল দক্ষিণে অবস্থিত। গুপ্ত আমল থেকে আরম্ভ করে মুসলিম আমল পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ের বিভিন্ন প্রত্নকীর্তির ধ্বংসাবশেষ আজও এখানে দেখা যায়। এখানে একটি ‘দমদমার’(দুর্গের) চিহ্ন আজও বিদ্যমান। এটি মোহাম্মদ বখতিয়ার কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল বলে জনশ্রুতি আছে। এখানে মোহাম্মদ বখতিয়ার তাঁর দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করেছিলেন এবং এখান থেকেই তিব্বত অভিযানে গিয়েছিলেন বলে অনুমান করা হয়।” দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ৩৩।

মোহাম্মদ যাকারিয়া তার অনুবাদে স্থানটির নাম বন-গাউন লিখেছেন।

এটি তিব্বত নয়, বরং আসামের কোনো অঞ্চল হতে পারে।

আগে বলা হয়েছে যে তারা মোঙ্গলীয় জনগোষ্ঠীর ছিল বলে ভুলবশত মীনহাজ তাদেরকে তুর্কী জনগোষ্ঠীর মানুষ ভেবেছিলেন।

----------------------------------------

যখন রাত্রি নেমে এল মুসলিম সৈন্যরা তাবু খাটিয়ে ফেলল, তখন বন্দী করা শত্রুদলকে তাদের সামনে আনা হল। মুসলমানরা তাদের কাছে অনুসন্ধান করতে লাগল। তারা এই কথা বলল যে, এখান থেকে পাঁচ লীগ দূরে কর-বত্তম (বা করমবত্তম) নামে একটি নগর আছে এবং সেখানে ৫০,০০০ সাহসী তুর্কী অশ্বারোহী তীরন্দাজ আছে। মুসলিম অশ্বারোহীরা এখানে আসার সাথে সাথে সংবাদ বাহক সেই নগরে সংবাদ নিয়ে গেছে। আগামীকাল সকালে ঐ সমস্ত অশ্বারোহী এখানে এসে যাবে। এই গ্রন্থের লেখক মীনহাজ যখন লক্ষণাবতীতে ছিলেন এই উল্লেখিত নগর সম্পর্কে খোঁজ নেন। এটি ছিল বিশাল আয়তনের এবং তার সমস্ত প্রাচীর পাথর কেটে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং তার অধিবাসীদের কিছু সংখ্যক ব্রাহ্মণ ও নুনি  ছিল। ঐ নগরটির কর্তৃত্ব তাদের প্রধান মিহিতারের অধীনে ছিল এবং তারা মূর্তি-পূজক ছিল। প্রতিদিন সকাল বেলা নগরের গবাদি পশুর বাজারে এক হাজার পাঁচ শত ঘোড়া বিক্রী হত। লক্ষণাবতী দেশে যে সমস্ত টাঙ্গহান ঘোড়াগুলি আসে সেইগুলি এই জায়গা থেকে আসে। মোহমহা-ই-দারাহ-এর যে গিরিপথ ধরে এই ঘোড়াগুলি আসে এই দেশে সেই পথটি বিখ্যাত। দৃষ্টান্ত হিসাবে বলা যেতে পারে যে, কামরূপের এলাকা থেকে তিরহুত পর্যন্ত পঁয়ত্রিশটি পার্বত্য গিরিপথ আছে, যে পথে তারা টাঙ্গহান ঘোড়াগুলি লক্ষণাবতীতে নিয়ে আসে।

----------------------------------------

রেভার্টি তার অনুবাদে লীগ লিখেছেন। যাকারিয়া তার অনুবাদে ফার্সাং উল্লেখ করেছেন। রেভার্টির অনুবাদের জন্য দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, p. 566.

তারা যে ব্রাহ্মণ ছিল না এতে কোনো সন্দেহ নাই। এটি মীনহাজের ভুল ধারণা প্রসূত উল্লেখ।

রেভার্টি তার অনুবাদের পাদটীকায় লিখেছেন, “In the oldest copies Nūnīān, and in the more modern ones Tūnīān. One copy of the text however has “but-parastān” idol-worshippers.” দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, p. 567.

----------------------------------------

পাতা : ১২

মীনহাজ লিখেছেন, মুহাম্মদ বখতিয়ার এই পথটির বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জানার পর এবং মুসলিম সৈনিকরা অভিযান থেকে ক্লান্ত ও অবসন্ন হয়ে পড়াতে এবং বহু সংখ্যক প্রথম দিনের যুদ্ধে নিহত ও আহত হয়ে যাওয়াতে তার আমীরদের সাথে পরামর্শ করলেন। তারা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন যে, পশ্চাদপসরণ করা আবশ্যক, এই লক্ষ্যে যে, আগামী বৎসর পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নিয়ে এই দেশে ফিরে আসা যেতে পারে। যখন তারা সমস্ত পথ ধরে পশ্চাদপসরণ করছিল, দেখল যে, একটি ঘাসের পাতা ও জ্বালানীকাঠের একটি ডালও অবশিষ্ট ছিল না। সেখানকার অধিবাসীরা সমস্ত কিছু আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল, এবং সেই সমস্ত যাত্রা পথের গিরিখাত ও পথের সকল মানুষকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল। যাত্রাপথের এই পনের দিন গবাদিপশু ও ঘোড়াদের জন্য এতটুকু খাদ্য বা ঘাসের একটি পাতাও ছিল না। লোকজন তাদের ঘোড়াদের হত্যা করে খেতে লাগল যত দিন না তারা পার্বত্য অঞ্চল থেকে কামরূপের ভূমিতে সেতুটির মাথায় এসে পৌঁছাল। তারা দেখল যে, সেতুটির দুইটি খিলান ভেংগে ফেলা হয়েছে। জানা যায় যে, যে দুইজন আমীরকে সেতুটির পাহারায় রাখা হয়েছিল তারা বিবাদে জড়িয়ে পড়ে এবং বিবাদ হেতু তারা সেতু ও রাস্তাটি রক্ষা করার বিষয়ে অবহেলা করে ও স্থান ত্যাগ করে। তখন কামরূপের হিন্দুরা এসে সেতুটি ভেংগে দেয়।

----------------------------------------

মীনহাজ এখানে একইভাবে ভুলক্রমে হিন্দু বলছেন।

----------------------------------------

মীনহাজ লিখেছেন, বখতিয়ারের বাহিনী সেখানে আসার পর দেখতে পেলো যে নদীটি পার হবার কোনো উপায় নাই এবং নৌকাও পাওয়া যায় নাই। তিনি হতবুদ্ধি ও বিভ্রান্তিতে পড়ে গেলেন। তারা একমত হল যে,  তাদের কোনো একটি স্থানে বিরতি দেওয়া উচিত এবং নৌকা ও ভেলা তৈরী করার বুদ্ধি বের করা প্রয়োজন যাতে তারা এই নদীটি পার হতে পারে। তারা সেখান থেকে কাছে একটি দেব-মন্দির দেখতে পেল যা অত্যন্ত উঁচু, সুদৃঢ়, ও মহিমান্বিত ও খুব সুন্দর ছিল। এটির ভিতর সোনা ও রূপার অসংখ্য মূর্তি সংরক্ষিত ছিল এবং একটি নিরেট সোনার তৈরী মূর্তি এত বড় ছিল যে মনে হয় তার ওজন দুই বা তিন হাজার মণ হতে পারে। বখতিয়ার ও তার অনুসারীরা মন্দিরের ভিতর আশ্রয় গ্রহণ করল এবং নদী পার হবার উদ্দেশ্যে ভেলা বানাবার জন্য কাঠ ও দড়ি সংগ্রহের চেষ্টা করতে লাগল। কামরূপের রাজা তার সমস্ত দেশের হিন্দুদের (প্রকৃতপক্ষে লোকদের হবে) আদেশ দিলেন এবং তারা দলে দলে আসতে লাগল এবং দেব-মন্দিরের চারপাশে সূচালো বাঁশের টুকরা মাটিতে পুঁততে লাগল এবং এগুলিকে একসাথে বাঁধতে লাগল যেন সেগুলি একটি প্রাচীরের মত মনে হল। যখন মুসলিম সৈন্যরা এই অবস্থা দেখল, তারা মুহাম্মদ বখতিয়ারকে বলল যে, ”আমরা যদি এই অবস্থায় থাকি, তাহলে আমরা সকলে বিধর্মীদের ফাঁদে আটকা পড়ব। এখান থেকে বের হবার উপায় বের করা উচিত।” তারা সকলে এক সাথে আক্রমণ করল ও দেব-মন্দির থেকে বের হয়ে আসল এবং একটি স্থানে আক্রমণ করে তাদের বের হবার পথ বের করে ফেলল ও খোলা সমভূমিতে এসে পৌঁছাল। হিন্দুরা তাদের পশ্চাদ্ধাবন করল। তারা নদীর তীরে এসে পৌঁছালে সেখানে তারা থামল এবং প্রত্যেকেই তাদের সামর্থ অনুযায়ী নদী পার হবার উপায় খুঁজল। হঠাৎ কিছু সংখ্যক সৈন্য তাদের ঘোড়া নিয়ে জলের দিকে গেল এবং দেখতে পেল যে প্রায় একটি তীর নিক্ষেপের সমপরিমাণ দূরত্ব পর্যন্ত নদী পার হবার মত ছিল। সৈন্যদের মধ্যে একটি চিৎকার শুনা গেল যে, নদী পার হবার মত অগভীর জায়গা পাওয়া গেছে। তখন সমস্ত বাহিনী জলের ঐ স্থানে গেল। হিন্দুরা ইতিমধ্যে তাদেরকে অনুসরণ করে নদীর তীর দখল করে ফেলেছিল। যখন মুসলমানরা নদীর মাঝ বরাবর স্থানে পৌঁছাল, দেখা গেল যে জল গভীর থাকায় তারা ডুবে মারা গেল। কেবল বখতিয়ার ও এক শতের বেশী বা কম সংখ্যক  অশ্বারোধী সৈনিক অনেক চেষ্টার পর নদী পার হল। বাকী সকলে ডুবে মারা গেল। বখতিয়ার যখন জল থেকে বের হয়ে আসলেন কোচ ও মেচদের মধ্যে খবর পৌঁছে গেল। আলী মেচ তার আত্মীয়-স্বজনদের পথে রেখে গিয়েছিলেন এবং তারা এসে বখতিয়ারকে বিপদ থেকে উদ্ধার করল এবং দেবকোটে না পৌঁছানো পর্যন্ত তাকে প্রভূত সাহায্য করল।

মীনহাজ আরো লিখেছেন, অতিরিক্ত মর্মযন্ত্রণায় বখতিয়ার অসুস্থ হয়ে পড়লেন। বিশেষভাবে যে সমস্ত খলজী মারা গিয়েছিল তাদের স্ত্রী ও শিশুদের নিকট থেকে লজ্জা এর কারণ ছিল। যখন তিনি অশ্বারোহণে বাইরে যেতেন বাড়ীর ছাদ ও রাস্তা থেকে মহিলারা ও শিশুরাসহ লোকজন বিলাপ করত ও তার বিরুদ্ধে অভিশাপ দিত ও গালাগালি করত। তখন থেকে তিনি আর বাইরে অশ্বারোহণে যেতেন না। এই বিরুদ্ধ পরিস্থিতিতে তিনি অনবরত বলতেন, ”সুলতান-ই-গাজীর উপর কি এমন কোনো বিপদ আপতিত হয়েছে যে আমার ভাল ভাগ্য আমাকে পরিত্যাগ করেছে?” এটা তখনই ঘটেছিল যখন সুলতান-ই-গাজী, মুইজ-উদ-দীন, মুহাম্মদ-ই-সাম মৃত্যু বরণ করেন। এই তীব্র মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে মুহাম্মদ বখতিয়ার অসুস্থ হয়ে পড়লেন, শয্যাশায়ী হলেন ও অবশেষে মারা গেলেন।

----------------------------------------

সম্পূর্ণ ঘটনাটির বিবরণ নেওয়া হয়েছে, মীনহাজ-ই-সিরাজের লিখিত গ্রন্থ তবকাত-ই-নাসিরীর রিভার্টির করা ইংরাজী অনুবাদ ও মোহাম্মদ যাকারিয়ার করা বাংলা অনুবাদ থেকে। দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 560-673; এবং মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ৩৩-৪৩।

----------------------------------------

হিজরী ৬০২ সালে (১২০৬ খ্রীষ্টাব্দে) আততায়ীর হাতে মুহাম্মদ ঘুরীর মৃত্যু হলে তার সম্পদ প্রসংগে ফিরিশতা বলেন, এই সুলতান যে ধন-দৌলত রেখে গিয়েছিলেন তা প্রায় অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়। তার সম্পদের নমুনা হিসাবে এইটুকু উল্লেখ করা যায় যে, বিভিন্ন আকারের হীরাই শুধু ছিল ৫০০ মণ (চার শত পাউণ্ড)। এগুলি ছিল ভারতে তার নয়টি অভিযানের ফল। দুইটি ব্যতীত প্রত্যেক অভিযানেই তিনি ভারত থেকে বিপুল ধন-রত্ন ভারাক্রান্ত হয়ে ফিরেছিলেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১৪৬, ১৪৭।

----------------------------------------

সুলতান শামস্-উদ-দীন ইলতুৎমীশ ৬২৯ হিজরীতে (১২৩১ খ্রীষ্টাব্দে) গোয়ালিয়র দুর্গ অধিকারের পর মালব অভিমুখে সৈন্য চালনা করেন ও ভিল্সান দুর্গ ও উজ্জয়িনী নগর অধিকার করেন। তবকাত-ই-নাসিরীর লেখক মীনহাজ-ই-সিরাজ লিখেছেন, ভিলসানে একটি দেব-মন্দির ছিল যা তৈরী করতে ৩০০ বৎসর লেগেছিল। এটি উচ্চতায় এক শত গজ ছিল। তিনি এটিকে ধ্বংস করেন। ফিরিশতা লিখেছেন, উজ্জয়িনীতে সোমনাথের ছাঁচে নির্মাণ করা মহাকালীর এক মন্দির ছিল। সুলতান মন্দিরটি ধ্বংস করেন। এই রাজ্যের প্রাচীন রাজা বিক্রমাদিত্য ও মহাকালীর পাথরের তৈরী মূর্তি ও আরো অনেক তামার তৈরী মূর্তি সেই মন্দিরে পাওয়া গিয়েছিল। সুলতান এই মূর্তিগুলি দিল্লীতে এনে বড় মসজিদের সামনে ভাংগার ব্যবস্থা করেন।

----------------------------------------

ইংরাজী অনুবাদক রিভার্টি এটিকে one hundred ells বলেছেন। দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, p. 622; এবং বাংলা অনুবাদক যাকারিয়া এই উচ্চতাকে ‘একশ’ (ও পাঁচ) গজ’ বলেছেন। দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ৭৮।

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১৬৭। তবকাত-ই-নাসিরী-র গ্রন্থকার মীনহাজ বলেছেন যে, মূর্তিটিকে দিল্লীতে জামে মসজিদের প্রবেশপথে রাখা হয় যেন সকল সত্যকার বিশ্বাসী সেটি পদদলিত করতে পারে। দেখুনঃ Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, p. 628.

----------------------------------------

৬৪৫ হিজরীতে সুলতান উলুঘ খান ভারতের দোয়াব অঞ্চলের  দিকে অগ্রসর হন। কনৌজ রাজ্যের মধ্যে একটি সুরক্ষিত স্থান ও দুর্গ ছিল যা তালসান্দাহ নামে পরিচিত ছিল। এই দুর্গের দেওয়াল অত্যন্ত শক্তিশালী ছিল। মীনহাজ লিখেছেন, একদল হিন্দু ঐ দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে এবং নিরাপত্তা লাভ করে। দশ দিন ধরে ঐ স্থানে আক্রমণের পর সমস্ত বিদ্র্রোহীকে হত্যা করা হয় এবং স্থানটি দখল করা হয়। উলুঘ খানের বীরত্বের প্রশংসা করতে গিয়ে মীনহাজ লিখেছেন, গুরুত্বপূর্ণ যুদ্ধ, সুরক্ষিত স্থান ও দুর্গ অধিকার, অরণ্য ও বিপদসংকুল স্থান দিয়ে অভিযান, বিধর্মী বিদ্রোহীদের হত্যা, লুণ্ঠিত দ্রব্য ও বন্দী অধিকার, এবং সেই সাথে বড় রাজাদের ও পোষ্যদের বন্দী করা, এই সমস্ত ঘটনার সম্পূর্ণ বিবরণ লিখা সম্ভব নয়। তিনি আরো লিখেছেন, ঐ পার্বত্য অঞ্চলে ও সেখানকার দলকী ও মলকী নামে স্থানে অসংখ্য অনুচর, অগণন যোদ্ধা, এবং অধিকৃত রাজ্য ও সীমাহীন সম্পদ, এবং সুদৃঢ় স্থান ও গিরিপথ তার অধীনে ছিল। উলুঘ খান এই সমস্তই ধ্বংস করেন, এবং সকল অনুচর, নারী ও তাদের সন্তানদের সহ বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য অধিকার করেন। শুধু পনের শত ঘোড়া মুসলমানদের হাতে আসে, যেখান থেকে অন্যান্য লুণ্ঠিত দ্রব্যের ধারণা করা যায়।

----------------------------------------

দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ১০৯; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 681, 682

দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ১০৯; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 682, 683.

----------------------------------------

পাতা : ১৩

৬৪৯ হিজরী সনে মুসলিম বাহিনী গোয়ালিয়র, চাঙ্গেরী, নারওয়াল ও মালবের দিকে অগ্রসর হয় ও মালবের নিকবর্তী এলাকায় পৌঁছে। চাহর আজর ঐ অঞ্চলের রাজাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন, যার অস্ত্রে সুপ্রশিক্ষিত ৫০০০ অশ্বারোহী বাহিনী এবং ২,০০,০০০ পদাতিক সৈন্য ছিল। যে দুর্গটি তিনি তৈরী করেছিলেন তা গিরিখাতের মধ্যে ছিল। সেটি অধিকৃত হবার পর লুণ্ঠিত হয় এবং মুসলমানদের হাতে লুণ্ঠিত দ্রব্য ও যুদ্ধ-বন্দী আসে।

----------------------------------------

দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ১১২, ১১৩; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 690, 691.

----------------------------------------

মীনহাজ আরো লিখেছেন, অয়োধার (অযোধ্যা) জায়গীর কুতলুঘ খান বিদ্রোহ করেন ও যুদ্ধে পরাজিত হয়ে সনটুরে স্বাধীন হিন্দু গোত্রসমূহের মধ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সুলতান উলুঘ খানের বাহিনী ৬৫৫ হিজরী সনে নববর্ষের সূচনায় সনতুরে এসে পৌঁছায়। কোহ-পায়াহ নামক জায়গায় পাহাড়ের প্রান্তে সুলতানের বাহিনী ও হিন্দুদের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। কুতলুঘ খান এই লোকদের মধ্যে ছিলেন এবং যুদ্ধে টিকতে না পেরে পালিয়ে যান। সুলতান উলুঘ খান তরবারির সাহায্যে এই পার্বত্য এলাকাকে পর্যুদস্ত করেন। তিনি এই সমস্ত পার্বত্য অঞ্চলের গিরিপথ ও সংকীর্ণ পথের মধ্য দিয়ে সিলমুর পর্যন্ত অগ্রসর হন। তারা সিলমুরের পার্বত্য অঞ্চলকে ধ্বংস করে ও সেখানে জিহাদে অবতীর্ণ হয়। এখানে কোনো মুসলিম বাহিনী আগে প্রবেশ করে নাই। মীনহাজ লিখেছেন, এই যুদ্ধে এত বেশী সংখ্যক বিদ্রোহী হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছিল যা সংজ্ঞায়িত করা অথবা গণনা করা সম্ভব না, এমন কি লিখিত বা মৌখিক বর্ণনায় প্রকাশ করা যায় না।

----------------------------------------

দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ১২০, ১২১; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 704-706. 

----------------------------------------

মীনহাজ বর্ণিত সুলতান উলুঘ খানের অনেক জিহাদের আর একটি ঘটনা এখানে উল্লেখ করা যায়। ৬৫৮ হিজরী সনের অবাধ্য মিউদের বিদ্রোহ দমনের জন্য সুলতান দিল্লীর পার্বত্য অঞ্চলের দিকে অগ্রসর হন। এই মিউদের কাছে দৈত্যরা পর্যন্ত ভীত হবে। আত্মরক্ষামূলক বর্ম পরিহিত, যোদ্ধা, প্রায় ১০,০০০ অশ্বারোধী সৈন্য, অদম্য যোদ্ধা তার অনুগমন করল। পরের দিন বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য ও গবাদিপশু দখলে এল। তিনি দুর্গম গিরিপথ ধ্বংস করলেন ও শক্তিশালী পার্বত্য অঞ্চলে আক্রমণ করেন। জিহাদীদের তরবারির আঘাতে অসংখ্য হিন্দু নিহত হয়েছিল।

----------------------------------------

  দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ১২৬, ১২৭; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. I, pp. 714, 715.

----------------------------------------

লক্ষণাবতীর শাসনকর্তা মালিক তুঘরীল ইউজবকের একটি ঘটনা মীনহাজ উল্লেখ করেছেন যা গুরুত্ব বিবেচনায় বর্ণনা করা যায়। ইউজবক কামরূপের দিকে অভিযান পরিচালনার সংকল্প থেকে বাঁকমতী নদীর অপর পাড়ে সৈন্য প্রেরণ করেন। কামরূপের রাজার প্রতিরোধ ক্ষমতা না থাকায় তিনি এক দিকে পালিয়ে যান। মালিক ইউজবক কামরূপ নগরটি অধিকার করেন ও অসংখ্য সম্পদ ও ধন তার অধিকারে আসে যার পরিমাণ ও ওজন তালিকাভুক্ত করার জায়গা ছিল না। কামরূপ অধিকৃত হবার পর বেশ কয়েকবার রাজা তার নির্ভরযোগ্য দূত মালিক ইউজবকের কাছে পাঠান এই কথা বলে যে, “আপনি এই রাজ্য অধিকার করেছেন, এবং এর আগে কোনো মুসলমান এই রকম সফলতা অর্জন করে নাই। এখন আপনি ফিরে যান এবং আমাকে আমার সিংহাসন ফিরিয়ে দিন। আমি আপনাকে প্রতি বৎসর অনেক বস্তা সোনা, এবং অনেক হাতী কর হিসাবে দিব। আমি খুৎবা এবং মুসলমানদের মুদ্রিত মুদ্রা বজায় রাখব।” মালিক ইউজবক কোনো ভাবেই এই প্রস্তাবে রাজী ছিলেন না। রাজা তার সমস্ত অনুসারী ও কৃষকদের হুকুম দিলেন যেন তারা মালিক ইউজবকের কাছে যায় এবং জামিন হিসাবে থাকে। সেই সাথে কামরূপের শহর ও গ্রাম থেকে ক্রয়যোগ্য সমস্ত খাদ্যশস্য যে কোনো মূল্যে কিনতে নির্দেশ দেন, যেন মুসলমান সেনাবাহিনীর কোনো উপায় না থাকে। তারা সেভাবে করল এবং সমস্ত খাদ্যদ্রব্য তারা উচ্চ মূল্যে কিনে নিল।

----------------------------------------

আনুষ্ঠানিকভাবে লক্ষণাবতীতে তার শাসনকাল ছিল ৬৪৮ হিজরী থেকে ৬৫৫ হিজরী পর্যন্ত। এই সম্পর্কিত মোহাম্মদ যাকারিয়ার অনুবাদকৃত তবকাত-ই-নাসিরী গ্রন্থের টীকা দ্রষ্টব্য। দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ১৬৫, ১৭০।

এই নদীকে বেগমতী লিখেছেন রেভার্টি। এই নদীর উল্লেখ দেখা যায় মুহাম্মদ বখতিয়ারের তিব্বত অভিযানের বর্ণনা প্রসংগে। মোহাম্মদ যাকারিয়া এই নদীকে করতোয়া বলে সন্দেহাতীতভাবে উল্লেখ করেছেন। তিনি তার গ্রন্থের পাদটীকায় লিখেছেন, প্রাচীনকাল থেকেই পুণ্ড্রবর্ধন (অর্থাৎ বর্তমান উত্তরবঙ্গ) ও কামরূপের সীমারেখা ছিল করতোয়া নদী। করতোয়ার পূর্ব তীরে অবস্থিত রংপুর জেলা, কোচবিহার, গোয়ালপাড়া, ধুবড়ী ইত্যাদি স্থান নিয়ে গঠিত ছিল পশ্চিম কামরূপ। কোচবিহার রাজ্যে (ভারত) ধরলা নদীর তীরে অসংখ্য প্রাচীন কীর্তির ধ্বংসাবশেষপূর্ণ একটি স্থানকে কামতা বলে চিহ্নিত করা হয়। এ কামতাপুরই ছিল খুব সম্ভব তদানীন্তন পশ্চিম কামরূপের রাজধানী। দেখুনঃ  মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ১৬৭।

----------------------------------------

সেই দেশের চাষাবাদের অবস্থা ও সমৃদ্ধি দেখে ইউজবক শস্যের মজুত করার ব্যবস্থা করেন নাই। বসন্তকালে ফসল কাটার সময় এলে রাজা তার প্রজাবৃন্দসহ বিদ্রোহী হয়ে চারিদিকের জলের বাঁধসমূহ খুলে দেন এবং ইউজবক ও তার ইসলামী বাহিনীকে অসহায় অবস্থায় ফেলে দেন। এই পরিস্থিতিতে তারা প্রায় ধ্বংসের অবস্থায় পড়ে যায়। তারা নিজেরা পরামর্শ করে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাল যে, এখন পশ্চাদপসরণ করা উচিত। নতুবা তারা অনাহারে মারা যাবে।

সেই অনুযায়ী তারা লক্ষণাবতীতে ফিরে যাবার উদ্দেশ্যে কামরূপ থেকে যাত্রা করে। সমতল ভূমির উপর দিয়ে এই পথটি বন্যার জলে ডুবে গিয়েছিল, এবং হিন্দুদের (মীনহাজ যে কোনো ভারতীয় জনগোষ্ঠীকে হিন্দু বলেছেন) দ্বারা অধিকৃত হয়েছিল। পাহাড়ের প্রান্তদেশের দিকে এই দেশ থেকে বের হবার জন্য মুসলমানরা একজন পথপ্রদর্শক পায়। তারা কিছু দূর অতিক্রম করার পর তারা পাহাড়ী পথ ও গিরিখাত ও সংকীর্ণ রাস্তার মধ্যে আটকে যায়। এই সময় তারা দেখল যে, তাদের সামনে ও পিছনের স্থান হিন্দুদের দখলে। একটি সংকীর্ণ স্থানে দুই পক্ষের সারিবদ্ধ সৈন্যের দুই হাতীর দল পরস্পর যুদ্ধে লিপ্ত হয়। মুসলিম বাহিনী হতচকিত হয়ে পড়ে এবং হিন্দুরা সব দিক থেকে তাদের উপর এসে পড়ে। মুসলিম ও হিন্দু সৈন্যরা পরস্পর মিশে যায়। হঠাৎ একটি তীর এসে মালিক ইউজবকের বুকে বিদ্ধ হয়, যিনি একটি হাতীর উপর ছিলেন। তিনি মাটিতে পড়ে যান ও বন্দী হন। এছাড়া সমস্ত শিশু, পরিবার, এবং অনুচরবর্গ সহ তার সমস্ত সৈন্যবাহিনী বন্দী হয়। যখন তারা মালিক ইউজবককে তাদের রাজার সামনে উপস্থিত করে তখন তিনি অনুরোধ করেন যেন তার পুত্রকে তার সামনে আনা হয়। যখন তারা তার পুত্রকে তার সামনে নিয়ে আসল তখন তিনি তার মুখ পুত্রের মুখের উপর রাখলেন এবং তার আত্মাকে আল্লাহ্-র কাছে সমর্পণ করেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ১৬৭-১৬৯; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. II, pp. 764-766.

----------------------------------------

এখানে উলুঘ খানের একটি যুদ্ধের বিবরণ প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ৬৪৫ হিজরী সনে উলুঘ খান সুলতানের কাছে নিবেদন করেন যে, ‘‘এই বৎসর ভারতের প্রত্যন্ত অঞ্চলে লুণ্ঠন ও জিহাদ পরিচালনা করা উচিত হবে। কারণ, যে স্বাধীন হিন্দু গোত্রসমূহ, রাজা ও রাণাগণ শাস্তি পায় নাই, তাদের শিক্ষা দেওয়া যাবে ও ইসলামের বাহিনীর হাতে পর্যাপ্ত লুণ্ঠিত দ্রব্য পড়বে এবং মোঙ্গলদের প্রতিহত করার জন্য সম্পদ পাওয়া যাবে।”

মীনহাজ লিখেছেন, এই অনুযায়ী ভারতের দিকে মহিমান্বিত বাহিনী যাত্রা শুরু করে এবং গঙ্গা ও যমুনা নদীর দোয়াবের মধ্যবর্তী স্থানে গমন করে। বিধর্মীদের সাথে প্রচণ্ড লড়াইয়ের পর ইসলামী বাহিনী তলসন্দাহ্ দুর্গ দখল করে। উলুঘ খান ও তার আমীররা ও সৈন্যবাহিনী মলকী রাজ্যের দলকীর উপর শক্তি প্রয়োগ করার জন্য অভিযান পরিচালনা করে। তিনি ছিলেন যমুনা নদীর নিকটবর্তী অঞ্চলের রাণা, যা কালিঞ্জর ও করাহ্-এর মধ্যবর্তী স্থানে ছিল। রাণা পাহাড়ের এমন এক স্থানে ছিলেন যে সেই সংকীর্ণ গিরিপথে অত্যন্ত চেষ্টার ফলে ও দড়ি ও মই ছাড়া সেখানে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না। উলুঘ খান মুসলিম বাহিনীকে জিহাদের জন্য উদ্দীপিত করেন। অবশেষে মুসলিম বাহিনী সেই স্থান অধিকার করে। তারা রাণার সমস্ত পরিবার, আত্মীয়স্বজন, ও শিশুদের, গবাদিপশু, ঘোড়া ও বহু সংখ্যক বন্দী দখল করে। ইসলামী বাহিনীর হাতে এত লুণ্ঠিত দ্রব্য আসে যে, এইগুলির হিসাব করতে গণিতজ্ঞ অসহায় হয়ে যাবে।

----------------------------------------

দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ২০৩, ২০৪; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. II, pp. 816, 817.

----------------------------------------

এর কিছু কাল পরে উলুঘ খান অন্যান্য মালিকদের নিয়ে ও বহু সংখ্যক সৈন্যসহ রন্তভুরের দিকে মেওয়াটের কোহ্-পায়াহ ও নাহার দেবের অঞ্চল লুণ্ঠনের জন্য অগ্রসর হলেন। নাহার দেব ছিলেন ভারতের রাজাদের মধ্যে সবচেয়ে বড়। সমগ্র রাজ্য ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে লুটতরাজ চালানো হয় ও বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য পাওয়া যায়। ৬৪৬ হিজরী সনে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই জিহাদে মুসলিম বাহিনী বহুসংখ্যক বিধর্মীকে হত্যা করে। বিপুল পরিমাণ লুণ্ঠিত দ্রব্য ও অমূল্য সম্পদ দখলে আসল এবং মুসলিম সৈন্যরা লুণ্ঠনের ফলে ধনী হয়ে গেল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ২০৫; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. II, pp. 818, 819.

----------------------------------------

পাতা : ১৪

৬৫৮ হিজরী সনে উলুঘ খান তার সেনাবাহিনী ও মালিকদের সৈন্যবাহিনী ও অন্যান্য সেনাবাহিনী নিয়ে দিল্লী থেকে অগ্রসর হন। তারা পার্বত্য অঞ্চলের বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে না থেমে যাত্রা করে ও অপ্রত্যাশিতভাবে সেই বিদ্রোহী দলের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের সকলকে বন্দী করে। তারা নারী, পুরুষ ও তাদের সন্তান সহ ১২,০০০ মানুষকে তরবারির সাহায্যে হত্যা করে।

----------------------------------------

দেখুনঃ মীনহাজ-ই-সিরাজ, তবকাত-ই-নাসিরী, পৃঃ ২৪১; এবং Minhāj-ud-Dīn, Ṯabaḳāt-i-Nāṣirī: Vol. II, p. 864.

----------------------------------------

ফিরিশতা লিখেছেন, দিল্লীর সুলতান গিয়াস-উদ-দীন বলবন আইন করেন যে, সরকারী কাজে যে কেউই যাতে ক্ষমতার অপব্যবহার করতে না পারে সেই জন্য কোন হিন্দুকে কোন দায়িত্বপূর্ণ কাজে বা উচ্চ সরকারী পদে নিয়োগ করা হবে না। তিনি মনে করতেন যে, হিন্দু কর্মচারী তাদের সেই ক্ষমতা মুসলমানদের অনিষ্ট সাধনে প্রয়োগ করবে। ৬৬৪ হিজরীতে (১২৬৫ খ্রীষ্টাব্দে) মেওয়াটি দস্যুদলকে নির্মূল করার জন্য সুলতান গিয়াস-উদ-দীন বলবন নির্দেশ দিলেন। তারা দিল্লী থেকে প্রায় ৮০ মাইল দক্ষিণ-পূর্বে পর্বতের দিকে বিস্তৃত এলাকা অধিকার করে নিয়েছিল ও পূর্বতন সুলতানের রাজত্বকালে ঐ স্থান থেকে তারা বার বার দিল্লী পর্যন্ত এসে হানা দিত। ফিরিশতা লিখেছেন, এই অভিযানকালে প্রায় এক লক্ষ মেওয়াটিকে হত্যা করা হয়েছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১৯৬, ১৯৭।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২০১।

----------------------------------------

সুলতান গিয়াস উদ-দীন বলবন কাথিয়াড়ে অভিযান চালিয়ে এলাকাটি লুণ্ঠন ও শিশু ও নারী ছাড়া সকল পুরুষকে হত্যা করতে নির্দেশ দিলেন। তারিখ-ই-ফিরুজশাহীর লেখক জিয়াউদ্দিন বারানী লিখেছেন, তার এই ধরনের নির্দেশের ফলে আট নয় বৎসরের বালকদেরও হত্যা করা হয়েছিল। সুলতান কয়েক দিন কাথয়াড়ে অবস্থান করে এই ধরনের হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করেন। এর ফলে মানুষের রক্তে নদী প্রবাহিত হয় এবং গ্রাম, জঙ্গল, শস্যক্ষেত্র সর্বত্র লাশের স্তূপ জমে উঠে। এই সমস্ত লাশের বিকট দুর্গন্ধ গঙ্গার ধার পর্যন্ত এসে পৌঁছেছিল। এইভাবে হত্যা করার ফলে বাকীরা আনুগত্য স্বীকার করতে বাধ্য হয়। কাথিয়াড়ের সমস্ত গ্রামাঞ্চল লুণ্ঠিত হয় ও সকল ধনসম্পদ গনিমতের মাল হিসাবে সৈন্যদের মধ্যে বিতরণ করে দেওয়া হয়। এই গনিমতের মাল এত প্রচুর ছিল যে, সুলতানী সৈন্যদলের অধিকাংশই ধনী হয়ে পড়ে।

----------------------------------------

দেখুনঃ জিয়াউদ্দিন বারানী, তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, গোলাম সামদানী কোরায়শী অনূদিত, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮২, পৃঃ ৪৬।

----------------------------------------

সুলতান জালাল-উদ-দীন ফিরোজ খিলজী ৬৮৯ হিজরীতে বিদ্রোহ দমনের জন্য রনথম্বর রওনা হলেন। দুর্গটি অজেয় মনে করে তিনি উজ্জয়িনীর পথে রওনা হলেন। ফিরিশতা লিখেছেন, উজ্জয়িনী লুণ্ঠন করা হল এবং মালবের বহু মন্দিরও ধ্বংস করা হল।  সেই সমস্ত মন্দিরে পাওয়া প্রচুর ধন-রত্ন নিয়ে সুলতান আবার রনথম্বর ফিরে এলেন।।  বারানী লিখেছেন, সুলতানের হাতে ঝাবনের পতন ঘটল। সুলতান এখানে বহু মন্দির ধ্বংস করলেন ও বহু মূর্তি জ্বালিয়ে দিলেন। ঝাবন ও মালোয়ার বহু গ্রাম ও শহর লুণ্ঠন করে প্রচুর ধনসম্পদ হাতে এল। সৈন্যরা সন্তুষ্ট হল।।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ২৩৬।

দেখুনঃ জিয়াউদ্দিন বারানী, তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, পৃঃ ১৭৫।

----------------------------------------

৬৯২ হিজরীতে (১২৯৩ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতান জালাল-উদ-দীন মন্দুর নিকটবর্তী এলাকায় হিন্দুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাভিযান পরিচালনা করেন এব্ং সেই অঞ্চল ছারখার করেন। জিয়াউদ্দিন বারানী লিখেছেন, সুলতান মন্দুর ও তার পার্শ্ববর্তী স্থানগুলি লুণ্ঠন করে প্রচুর সম্পদ সহ দিল্লী ফিরে আসেন। অন্য একবার ঝাবনের দিকে অভিযান পরিচালনা করেন ও সেখানেও প্রচুর লুণ্ঠিত দ্রব্য হস্তগত হয়।। এই সময় সুলতানের ভ্রাতুষ্পুত্র মাইলক আলা-উদ-দীনকে ভিলশার হিন্দুদের উপর হামলা করার অনুমতি দিলেন। আলাউদ-দীন সেই বৎসরই উক্ত অঞ্চলে প্রবেশ করে এটি অধিকার করেন ও লুটতরাজ করে বহু লুণ্ঠিত দ্রব্যসহ ফিরে আসেন। লুণ্ঠিত জিনিসের মধ্যে দুইটি পিতলের মূর্তিও ছিল, যেগুলি পদদলিত করবার জন্য দিল্লীর বাদায়ুন তোরণে ফেলে রাখা হয়।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৮০ 

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ২৩৮।

----------------------------------------

আলা-উদ-দীন রাজা রামদেবের রাজধানী দেবগিরি অভিমুখে রওনা হলেন। শহরটি অবরোধ করার পর সেখানকার বণিকদের নিকট থেকে প্রচুর অর্থ আদায় করলেন। রামদেবের তিন শত হাতী ও কয়েক সহস্র ঘোড়াও আলা-উদ-দীনের হাতে এল। এছাড়া আলা-উদ-দীন দাক্ষিণাত্যের অন্যান্য নগর লুণ্ঠন করলেন ও বণিক ও অন্যান্য বিত্তশালী নাগরিকদের কাছ থেকে ধনরত্ন বের করার জন্য তাদের উপর নির্যাতন শুরু করে দিলেন। এছাড়া রামদেবের কাছ থেকে চুক্তি অনুযায়ী ৫০ মণ সোনা, প্রচুর মুক্তা ও ধন-রত্ন পেলেন। আলা-উদ-দীন রাম দেবকে দ্বিতীয় দফা সন্ধি চুক্তিতে বাধ্য করলেন এবং এই চুক্তি অনুযায়ী রামদেব আরো বিপুল পরিমাণ মুক্তা, হীরা, চুনি, পান্না ও নীলকান্ত মণি, রূপা এবং রেশমী কাপড় ক্ষতিপূরণ দিলেন। ৬৯৫ হিজরীতে (১২৯৫ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতানের কাছে খবর এল যে, দেবগিরি জয় করে আলা-উদ-দীন এত ঐশ্বর্য লাভ করেছেন যে, দিল্লীর কোনো সুলতানই তত ধনরত্ন চোখে দেখেন নাই।

----------------------------------------

দেখুনঃ জিয়াউদ্দিন বারানী, তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, পৃঃ ১৮২, ১৮৩।

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ২৪০।

ঐ সোনার ওজন ১২০০ পাউন্ড থেকে ১৫০০ পাউন্ড হবে।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৪।

----------------------------------------

৬৯৭ হিজরীতে (১২৯৭ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতান আলা-উদ-দীন খিলজীর ভাই আলফ খান ও উজির নসরত খানকে এক বিরাট সৈন্যবাহিনী সহ গুজরাটে পাঠানো হল। তারা দেশে ধ্বংসকাণ্ড চালিয়ে রাজধানী নিহারওয়ালায় এসে পৌঁছায় ও তা অধিকার করে। রাজা রায়করণ নগর ত্যাগ করে দাক্ষিণাত্যে পালিয়ে যান ও দেবগিরির রামদেবের শরণাপন্ন হন। তাঁর সহায়তায় রায়করণ পরে দেশে ফিরে এসে বাগলানায় বসবাস শুরু করেন। বাগলানা ছিল রামদেবের রাজ্যের সীমান্তবর্তী গুজরাটের একটি প্রদেশ। মুসলমানদের আক্রমণে তার স্ত্রীগণ, সন্তানাদি, হাতী, ঘোড়া, সমস্ত জিনিসপত্র ও ধনরত্ন মুসলমানদের হাতে পড়ে। বন্দীদের মধ্যে ছিল তার পরমাসুন্দরী স্ত্রী কমলাদেবী। এই অভিযান শেষ করে নসরত খান সেনাবাহিনীর একাংশ নিয়ে ক্যাম্বে যান। সেখানে অনেক বণিক বাস করত এবং এটি ছিল এক অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী দেশ। এখানে আক্রমণকারীদের হাতে প্রচুর লুণ্ঠিত দ্রব্য এসেছিল। জিয়াউদ্দিন বারানী লিখেছেন, সমগ্র গুজরাট রাজ্য লুণ্ঠনের সামগ্রীতে পরিণত হয়। সুলতান মাহমুদের সোমনাথ আক্রমণ ও লুণ্ঠনের পর যে মূর্তিটিকে নূতনভাবে সোমনাথ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল এবং ঐ অঞ্চলের হিন্দুরা যাকে দেবতা হিসাবে পূজা করত, তা দিল্লীতে এনে টুকরা টুকরা করে সাধারণ লোকের চলাচলের পথে ছড়িয়ে দেওয়া হয়। মুনতাখাবু’ত-তাওয়ারিখ-এর লেখক বাদাউনি লিখেছেন, দ্বিতীয়বার সোমনাথের মন্দিরটিকে বিধ্বস্ত করার পর সেখানে উলুঘ (আলফ) খান একটি মসজিদ নির্মাণ করেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫৭।

দেখুনঃ জিয়াউদ্দিন বারানী, তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, পৃঃ ২০৬।

দেখুনঃ Al-Badaoni, Muntakhabu-t-Tawarikh, Vol. I, p. 256.

----------------------------------------

হিজরী ৭০৯ নালে (১৩০৯ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতান খবর পেলেন যে, তেলেঙ্গানার অন্তর্গত ওয়ারাঙ্গলে যে সেনাবাহিনী পাঠিয়েছিলেন তারা পরাস্ত হয়ে পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হয়েছে। সুলতান তখন মালিক কাফুরের অধীনে এক সেনাবাহিনী পাঠালেন। মালিক কাফুরের উপর নির্দেশ ছিল যে, ওয়ারাঙ্গলের রাজা লুদ্দুরদেব যদি প্রচুর উপহার প্রদান করেন এবং বাৎসরিক করদানে প্রতিশ্রুত হন, তাহলে যেন তিনি তার রাজ্য আক্রমণে বিরত থাকেন। মালিক কাফুর ও খাজা হাজী দেবগিরি পৌঁছালে রামদেব উপহার সহ তাদের সাথে দেখা করেন এবং তাদের নিজের প্রাসাদে নিমন্ত্রণ করে আতিথিয়তার পরাকাষ্ঠা দেখান। মুসলমান শিবিরের বাজারে তার প্রজারা যাতে সুলতানের রাজ্যে প্রচলিত মূল্যের বেশী মূল্যে কিছু বিক্রী না করে, সেই সম্পর্কে তাদেরকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেন। দেবগিরি ত্যাগ করে মালিক কাফুর তেলেঙ্গানা সীমান্তে অবস্থিত ইন্দোরে এসে পৌঁছালেন এবং হত্যা ও অগ্নিকাণ্ড দ্বারা দেশে বিভীষিকা সৃষ্টি করার জন্য সৈন্যদেরকে লেলিয়ে দেন। ফিরিশতা লিখেছেন, নিরীহ নিরাপরাধ জনসাধারণের উপর এই রকম নৃশংস আচরণে সকলে স্তম্ভিত হল।  এই সময়ে রাজা লুদ্দরদেবকে সাহায্য করার জন্য পাশের রাজ্যের রাজারা সৈন্যসহ রওনা হলেন। এদিকে কয়েক মাস অবরোধের পর ওয়ারাঙ্গল দুর্গের পতন হল। দুর্গবাসী অধিকাংশ সৈন্যই তলোয়ারের মুখে নিহত হল। এই সময় লুদ্দুর দেব ৩০০ হাতী, ৭০০০ ঘোড়া, বিপুল পরিমাণ অর্থ ও রত্ন দিয়ে সন্ধি করতে বাধ্য হলেন। এই ঘটনাটি মুসলিম আক্রমণকারীদের ভারতে যুদ্ধে তাদের চরম নীতিহীনতার একটি নিকৃষ্ট দৃষ্টান্ত হয়েছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ২৯২।

----------------------------------------

পাতা : ১৫

ফিরিশতা লিখেছেন, ৭১০ হিজরীতে (১৩১০ খ্রীষ্টাব্দে) দ্বার সমুদ্র ও মা আবির (উভয়ই ভারতের পশ্চিম উপকুলে) অধিকার করার জন্য সুলতান আলাউ-উদ-দীন খিলজী মালিক কাফুর ও খাজা হাজীর অধীনে আবার এক বিশাল সেনাবাহিনী দাক্ষিণাত্যে পাঠান। সুলতান শুনেছিলেন এই সমস্ত জায়গায় সোনা ও রত্ন পূর্ণ অনেক মন্দির আছে। দেবগিরি রাজার রাজ্য সীমা পার হবার পর মুসলিম সেনাবাহিনী লুটতরাজ ও ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু করে দিল। শেষে দিল্লী ছাড়ার তিন মাস পর তারা সমুদ্রোপকূলে এসে পৌঁছাল। পথে প্রত্যেক হিন্দু রাজ্য পার হবার সময় তারা বাধা পেয়েছিল ও যুদ্ধ করতে বাধ্য হয়েছিল। এইগুলির মধ্যে কর্নাটকের রাজা বিশাল দেবের সাথে যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। এই যুদ্ধে রাজা পরাজিত ও বন্দী হন। মালিক কাফুরের সৈন্যদল তাঁর রাজ্য ছারখার করে। এই সময় মুসলমানরা মন্দির লুট করে বিপুল ধনরত্ন পেয়েছিল। এর মধ্যে ছিল মূল্যবান পাথরের অলংকার শোভিত বহু সংখ্যক সোনার মূর্তি ও দেবদেবীর নামে উৎসর্গীকৃত আরো অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র।  মুসলমানরা সমুদ্রোপকূলে একটি ক্ষুদ্র মসজিদ নির্মাণ করে সেখানে ইসলাম ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করবার ও আলা-উদ-দীনের নামে খোৎবা পাঠ করবার হুকুম দেয়।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯৩, ২৯৪।

----------------------------------------

এই যুদ্ধ সম্পর্কে জিয়াউদ্দিন বারানী লিখেছেন, দ্বার সমুদ্র থেকে মালিক নায়েব কাফুর যথা নিয়মে সৈন্যদলসহ মেবারে এসে উপস্থিত হলেন। মেবারও বিজিত হল এবং সেখানকার স্বর্ণ মন্দিরটি ধ্বংস করা হল। যে সকল স্বর্ণ মূর্তি বহু বৎসর ধরে সেই এলাকার হিন্দু জনসাধারণের পূজা পেয়ে আসছিল, তার সবগুলিকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হল। স্বর্ণ মন্দিরের সমস্ত ধনরত্ন এবং ভাংগা মূর্তিগুলিসহ অগণিত ধনসম্পদ সৈন্যদলের হাতে আসল। মেবারে যে দুইজন রাজা ছিলেন, তাদের কাছ থেকে সমস্ত সম্পদ ও হাতীঘোড়া ছিনিয়ে নিয়ে নেওয়া হল।

----------------------------------------

দেখুনঃ জিয়াউদ্দিন বারানী (মূল), তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, পৃঃ ২৭৬।

----------------------------------------

মালিক কাফুর সুলতান আলা-উদ-দীনকে ৩১২ টি হাতী, ২০,০০০ ঘোড়া, ৯৬,০০০ সোনার পিণ্ড ও কয়েক বাক্স মণি-মুক্তা নজরানা দেন। বিপুল এই সম্পদ দেখে আলা-উদ-দীন আনন্দে অভিভূত হলেন এবং তার প্রত্যেক সেনাধক্ষকে পুরষ্কার দিলেন। প্রত্যেক প্রধান সেনাপতিকে ১০টি এবং প্রত্যেক সহকারী সেনাপতিকে ৫টি করে সোনার পিণ্ড দিলেন। দরবারের প্রত্যেক বিদ্বান ব্যক্তি এক থালা করে সোনা পেলেন। অবশিষ্ট সোনা গলিয়ে মুদ্রা তৈরী করে বায়তুল মাল তহবিলে গচ্ছিত রাখা হল। ফিরিশতা লিখেছেন, এই অভিযানে পাওয়া ধনের মধ্যে রূপার কোনো উল্লেখ নাই। তাতে অনুমান করা যায় যে, সেই সময় ঐসব দেশে রূপার মুদ্রার প্রচলন ছিল না। সোনা ছাড়া অন্য কোনো ধাতু নির্মিত বাজুবন্ধ, হার বা আংটি কেউ পরত না। বিত্তশালী মানুষদের ঘরের এবং মন্দিরের সমস্ত থালা সোনার তৈরী ছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ২৯৪, ২৯৫।

----------------------------------------

সুলতান আলা-উদ-দীনের সময়কার একটি নিষ্ঠুরতার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। আলা-উদ-দীন খলজী দাক্ষিণাত্যে অভিযান পরিচালনার ভার মালিক কাফুরের উপর ছেড়ে দেন। কাফুর ৭১২ হিজরীতে (১৩১২ খ্রীষ্টাব্দে) চতুর্থবার দাক্ষিণাত্য অভিযানে যাত্রা করলেন। কাফুর দেবগিরির রাজাকে বন্দী করলেন এবং অমানুষিক নৃশংসতার সাথে তাকে হত্যা করলেন। এরপর কাফুর দাবুল ও চাউল থেকে আরম্ভ করে রাচোর ও মুড্কুল পর্যন্ত বিস্তৃত মহারাষ্ট্র ও কানারী রাজ্যে ব্যাপক ধ্বংসলীলা চালালেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯৮।

----------------------------------------

কারিগর প্রভৃতি নিয়ে সুলতান আলা-উদ-দীনের গৃহ-ভৃত্যের সংখ্যা ছিল ১৭,০০০। তার আগে যারা ভারতে রাজত্ব করেছিলেন তাদের কারও সম্পদ আলা-উদ-দীনের সমতুল্য ছিল না। সুলতান মাহমুদ গজনভী ১০টি অভিযানে যে ধন-রত্ন সংগ্রহ করেছিলেন, আলা-উদ-দীনের সম্পদ তার চেয়েও বেশী ছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০১।

----------------------------------------

রাজত্বের দ্বিতীয় বৎসরে (৭১৮ হিজরী, ১৩১৮ খ্রীষ্টাব্দ) সুলতান মোবারক খলজী বিশাল সৈন্য-বাহিনী গঠন করে রাম দেবের জামাতা হরপালকে শাস্তি দিবার জন্য দাক্ষিণাত্যে রওনা হন। দাক্ষিণাত্যের অন্য রাজাদের সাথে মিলিত হয়ে হরপাল মহারাষ্ট্র রাজ্য পুনরুদ্ধার করেছিলেন। সুলতান সৈন্যসহ দেবগিরি পৌঁছালেন। মুসলমানদের বাধা দিবার জন্য কয়েক জন হিন্দু রাজা তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে হরপালকে সাহায্য করার জন্য দেবগিরি এসেছিল। ফিরিশতা লিখেছেন, মুসলিম সেনাবাহিনীর আসার সংবাদ পেয়ে হরপাল ও তার মিত্ররা পালিয়ে গেলেন। তাদের পিছনে অনুসরণ করার জন্য সুলতান একদল সৈন্য পাঠালেন। তারা হরপালকে বন্দী করল। জীবিত অবস্থায় হরপালের শরীরের চামড়া উঠিয়ে ফেলা হল ও তার মাথা বিচ্ছিন্ন করে তারই রাজধানীর তোরণের উপর বিদ্ধ করে রাখা হল। সুলতান তারপর দেবগিরি থেকে দ্বার সমুদ্র পর্যন্ত এলাকার জায়গায় জায়গায় কতগুলি সামরিক ঘাঁটি বা থানা স্থাপন করবার আদেশ দিলেন। তিনি দেবগিরিতে একটি মসজিদ তৈরী করালেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৭, ৩০৮।

----------------------------------------

ফিরিশতা লিখেছেন, সুলতানের উজির ও সেনানায়ক মালিক খসরু ৭১৯ হিজরীতে (১৩১৯ খ্রীষ্টাব্দে) মালাবারে গিয়ে প্রায় এক বৎসর ছিলেন। সেখানে লুণ্ঠনের মাধ্যমে ১২০ টি হাতী, ১৬৮ রতি ওজনের একটি হীরার খণ্ড ও আরো অনেক রত্ন ও বিপুল পরিমাণ সোনা পেয়েছিলেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩০৯।

----------------------------------------

পাতা : ১৬

মালিক খসরু ৭২১ হিজরীতে (১৩২১ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতান হবার পর নাসির-উদ-দীন উপাধি ধারণ করলেন। বাদাউনি লিখেছেন, এই সময় ইসলামের ধর্মানুষ্ঠান ও পর্বাদি পালনে অবহেলা দেখা গেল ও হিন্দু আনুষ্ঠানিকতা ও ধর্মহীনতা প্রচলিত হল। মূর্তিপূজা ও মসজিদ ধ্বংস বিস্তার লাভ করল। তিনি আরো লিখেছেন, হিন্দুরা ভিত্তি পেল ও বেশীর ভাগ প্রদেশসমূহে তাদের প্রভাব বাড়লো এবং হঠাৎ ইসলামের অনুসারীদের উপর ধ্বংসের স্রোত বয়ে গেল এবং তাদের সম্পদ ও সম্পত্তি ধ্বংস হল ও তাদের পরিবারসমূহ ধ্বংসের ঝড়ে পড়ল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Al-Badaoni, Muntakhabu-t-Tawarikh, Vol. I, pp. 290, 291.

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৯১।

----------------------------------------

মুহাম্মদ তোগলকের রাজত্বের প্রথম দিকে দুর্ধর্ষ মোগল সেনাপতি তুমুশ্রি খান এক বিশাল বাহিনী নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন। তুমুশ্রি খান ছিলেন চুঘতাই সম্প্রদায়ের নেতা। মুহাম্মদ তোঘলক অনেক সোনা ও রত্ন উপহার হিসাবে পাঠিয়ে আক্রমণ প্রত্যাহার করে তাকে নিজ দেশে ফিরে যাবার জন্য সম্মত করেন। তুমুশ্রি খান গুজরাট ও সিন্ধুর মধ্য দিয়ে দেশে ফিরবার সময় যথেচ্ছ লুণ্ঠন করেন ও বহু অধিবাসীকে বন্দী করে নিয়ে যান।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ পৃঃ ৩২৮।

----------------------------------------

সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক ৭৫২ হিজরী সালে ১৩৫১ খ্রীষ্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। তিনি তার জীবনী গ্রন্থ ফুত‚হাত-ই-ফীরূজশাহী-তে লিখেন, অতঃপর আমার প্রতি মহান আল্লাহর দ্বিতীয় দয়া ও অনুগ্রহ এই। অতীতের সুলতানদের উপাধি যা জুমা ও ঈদের খুতবা সমূহ থেকে বাদ দেওয়া হয়েছিল (তা পুনরায় চালু করা)। ঐ সকল বাদশাহ্-র নাম যাঁদের সাহস ও দৃঢ়তার গুণে কাফেরদের রাজ্যসমূহ বিজিত হয়, যাঁদের বিজয় পতাকা বিভিন্ন দেশে উড্ডীন হয়, মন্দিরের মূর্তি ধ্বংস হয়, মসজিদ এবং মিম্বর তৈরী হয় এবং মর্যাদাপ্রাপ্ত হয়, কলেমা তৈয়েবা প্রচারিত হয়, ইসলামের ধারকরা (মুসলমানেরা) শক্তিশালী হয় এবং (মুসলমানদের বিরুদ্ধে) যুদ্ধকারীরা যিম্মিতে পরিণত হয়, তাদের নাম সম্পূর্ণরূপে ভুলে যাওয়া হয়। ...”

----------------------------------------

আব্দুল করিম (অনু), সুলতান ফীরূজশাহ তুঘলক বিরচিত, ফুত‚হাত-ই-ফীরূজশাহী, এশিয়াটিক সোসাইটে অব বাংলাদেশ, ঢাকা, ১৯৮৯, পৃঃ ৭১।

----------------------------------------

ফিরোজ শাহ তুঘলক আরো লিখেছেন,‘‘আরও কয়েকটি দল ছিল - দাহরিয়া (প্রকৃতিপূজক), তরক্  বৈরাগী) এবং তজরীদ  (কৌমার্যব্রত অবলম্বনকারী) এর পোষাকে জনগণকে বিপথগামী করত, শিষ্য বানাত ও কুফরী কথা বলত। আহমদ বিহারী নামে এই বিপথগামীদের একজন মুর্শিদ বা পথ-প্রদর্শনকারী ছিল। সে শহরে বাস করত এবং বিহারী দলের লোকেরা তাকে ‘খোদা বলত’। ঐ দলকে শৃঙ্খলিত করে আমার নিকট নিয়ে আসা হল। (আমাকে বলা হল যে) সে নবী (দঃ)কে গালি দিত এবং বলত যে লোকের নয় জন স্ত্রী ছিল তার নবুওতের কি মর্যাদা থাকতে পারে? তার একজন শিষ্যের দ্বারা এরূপ কথা তাদের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়। আমি তাদের উভয়কে শৃঙ্খলিত করার (জেলে দেওয়ার) আদেশ দিলাম; অন্যদের তওবা করে সঠিক পথে ফিরে আসার আদেশ দিলাম এবং তাদের প্রত্যেককে বিভিন্ন শহরে নির্বাসন দেওয়ার আদেশ দিলাম। ফলে এই দলের কুকীর্তি বন্ধ হয়ে যায়।”

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৩।

----------------------------------------

          সর্বোচ্চ বিস্তারের সময়ে দিল্লীর সুলতানী যুগের মানচিত্র (১৩৩০-১৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দ)

                  (সূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Delhi_Sultanate)

তিনি আরো লিখেছেন,‘‘তাছাড়া আল্লাহর দানের মধ্যে আরও একটি এই — মেযমাকের হিন্দুরা এবং মূর্তিপূজকরা যিম্মার পরিবর্তে অর্থ দিতে সম্মত হয়ে জিযিয়া কর দিতে স্বীকার করে এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তা পায়। তারা শহর ও শহরতলীতে নতুন মন্দির নির্মাণ করে, কিন্তু নবী (দঃ)-এর শরীয়ত এবং হাদীসে মন্দির নির্মাণ করা বৈধ নয়, মহান আল্লাহর অনুগ্রহে এই সব অনর্থের বুনিয়াদ (অর্থাৎ মন্দির) ভেঙ্গে দিলাম এবং কাফেরদের নেতাদের, যারা অন্যদের বিপথগামী করত, তাদের হত্যা করলাম। সাধারণ জনগণকে বেত্রাঘাত করলাম, ফলে এই কুকাজ সম্পূর্ণ দূর হল।”

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৫।

----------------------------------------

পাতা : ১৭

মন্দির ধ্বংস করার আরো বর্ণনা দিয়েছেন সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক। তিনি লিখেছেন, “মলওয়াহ্ গ্রামে একটি কুয়া আছে যাকে কুণ্ড বলা হয়। সেখানে তারা কয়েকটি মন্দির নির্মাণ করে। হিন্দুদের একদল তাদের অনুসারীদের নিয়ে কোন নির্দিষ্ট দিনে দলে দলে ঘোড়ায় চড়ে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে সমবেত হত; তাদের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা পাল্কী ও গরুর গাড়ী চড়ে হাজারে হাজারে একত্রিত হয়ে মূর্তিপূজা করত। এই অপকর্মে এত জনসমাগম হত যে ব্যবসায়ীরা সেখানে বিভিন্ন খাদ্য-দ্রব্য নিয়ে আসত এবং দোকান সাজিয়ে বেচাকেনা করত। কিছু সংখ্যক ধর্মে উদাসীন মুসলমান নিজেদের কু-প্রবৃত্তি  চরিতার্থ করার জন্য তাদের দলে যোগ দিত। যখন এই বিষয়টি আমার কানে আসে, প্রভুর (আল্লাহ্তালার) অনুগ্রহে এই গর্হিত কাজ, যার অশুভ প্রভাব ইসলাম ধর্মে অনুপ্রবেশ করেছিল, বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিই। যেদিন তারা সমবেত হত, (এইরূপ) একদিন আমি সেখানে গেলাম। তাদের মধ্যে কিছু প্রবীণ লোক তাদের প্রতারণা করছিল ও বিপথে পরিচালিত করছিল। আমি আদেশ দিলাম যাতে তাদের সকলকে হত্যা করা হল। সাধারণ হিন্দুদের কঠোর শাস্তি দিতে নিষেধ করলাম। তাদের মন্দির ধ্বংস করলাম এবং সেখানে মসজিদ প্রতিষ্ঠা করলাম। আবাদী কসবা গড়ে তুললাম, একটির নাম তুঘলকপুর এবং অপরটির নাম সাদলাপুর রাখলাম। যে স্থানে মেযমাক কাফেররা মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিল এখন সেখানে মহান আল্লাহর অনুগ্রহে মুসলমানগণ সঠিক উপাস্যের (আল্লাহ্তালার) উদ্দেশ্যে সেজদা করতে লাগল এবং তকবীর, আযান ও জামাত প্রতিষ্ঠা করল। যে স্থানে কাফেররা বাসস্থান গড়ে তুলেছিল, সেখানে মুসলমানেরা বসতি স্থাপন করেছে এবং কলেমা লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ (আল্লাহ্ ছাড়া কোন উপাস্য নাই) স্মরণকারীদের মধুর স্বর ধ্বনিত হচ্ছে। ইসলামে সকল প্রশংসা আল্লাহরই জন্য।”

----------------------------------------

কসবা অর্থ শহর।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৫, ৭৬।

----------------------------------------

তিনি আরো লিখেছেন, “অতঃপর। আরও সংবাদ পেলাম যে সালিহপুর গ্রামে কিছু সংখ্যক হিন্দু নূতন মন্দির স্থাপন করেছে এবং মূর্তিপূজা করছে। সেখানেও লোক পাঠালাম যেন তারা মন্দির ধ্বংস করে দেয়। ঐ সকল লোকদের দুষ্কর্ম দমন করলাম যারা ভুল পথে নিমগ্ন ছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৬।

----------------------------------------

“গোহানা কযবায় কিছু সংখ্যক হিন্দু নূতন মন্দির নির্মাণ করে এবং মুশরিকদের একদল সেখানে সমবেত হয়ে মূর্তিপূজা করতে থাকে। এদের বন্দী করে আমার নিকট আনা হয়। আমি আদেশ দিলাম যে, যে সকল লোক এই অপকর্মের ভিত্তি স্থাপন করে, তাদের বিপথে যাওয়ার কথা ঘোষণা করা হোক এবং তাদের রাজপ্রাসাদের প্রধান ফটকে হত্যা করা হোক। আমি বললাম যে তাদের কুফরী পুস্তকসমূহ, মূর্তিগুলি এবং মূর্তিপূজার সরঞ্জামাদি, যা তারা এনেছিল, তাদের শাস্তি দেওয়ার স্থানে জনসমক্ষে পুড়িয়ে ফেলা হোক। অন্যদের ধমক দিয়ে এবং বেত্রাঘাত করে নিষেধ করা হয় যেন তারা সচেতন হয়ে যায় এবং যাতে ’দার-উল-ইসলাম’-এ কোন যিম্মি এইরূপ কাজ করার সাহস না পায়।”

ঐতিহাসিক শামস-ই সিরাজ আফিফ তার রচিত তারিখ-ই ফিরোজ শাহী গ্রন্থে লিখেছেন, ফিরোজ শাহ তুঘলক  তার বাংলা অভিযানে হত্যা করা সকল বাংগালীদের কর্তিত মাথা সংগ্রহ করতে নির্দেশ দিলেন এবং সৈনিকদের প্রতিটি মাথার জন্য একটি রূপার টংকা দেওয়া হয়েছিল। নির্দেশ অনুযায়ী সমস্ত সেনাবাহিনী তাড়াতাড়ি কাজ শুরু করল ও হত্যা করা মানুষদের মাথা এনে সেগুলি স্তূপাকার করল ও রূপার টংকা গ্রহণ করল। মাথাগুলি গুনার পর দেখা গেল যে তার সংখ্যা ১,৮০,০০০ এর বেশী হল। এই ঘটনাটি ঘটেছিল এমন একটি যুদ্ধে যা সারাদিন ব্যাপী প্রবলভাবে ও সাত ক্রোশ দূরত্ব পর্যন্ত হয়েছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India as Told by its Own Historians, Vol. III, p. 297.

----------------------------------------

সুলতান ফিরোজ তোগলক নগরকোট দখল করলে সেখানকার মূর্তিগুলি ভেংগে ফেলে সেগুলির টুকরাগুলি গরুর মাংস খণ্ডের সাথে মিশিয়ে থলিতে রাখেন ও সেই থলিগুলি ব্রাহ্মণদের গলায় বেঁধে শিবিরের মধ্য দিয়ে হেঁটে যেতে বাধ্য করেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৩৬১, ৩৬২।

----------------------------------------

৮০০ হিজরী সালে (১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে) তৈমুর লং-এর বাহিনী ভারতের দিকে যাত্রা শুরু করে। ঐতিহাসিক শরাফুদ-দীন ইয়াযদী তার যাফর-নামা গ্রন্থে লিখেন, তৈমুর শুনেছিলেন যে, দিল্লী ও অন্যান্য জায়গায় ইসলাম পালন করা হলেও সাধারণভাবে দেশটি অবিশ্বাসী ও মূর্তি-পূজকদের দ্বারা দূষিত। সুতরাং তিনি ধর্মীয় যুদ্ধ বা জিহাদের উদ্দেশ্যে মুলতান ও দিল্লীর উদ্দেশ্যে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করেন। তাদের সেনাবাহিনীর সংখ্যা এত বেশী ছিল যে, মনে হচ্ছিল যেন গাছের অসংখ্য পাতা। ইন্দরাবে পৌঁছে তিনি জানতে পারেন যে, কাটোর পাহাড়ে অবিশ্বাসীরা বাস করে। তারা সাধারণত নগ্ন চলাফেরা করে ও তাদের ভাষা অদ্ভূত, যা পারসিক, তুর্ক ও ভারতীয় ভাষা থেকে ভিন্ন। তিন দিনের অবিরাম যুদ্ধে তৈমুরের বাহিনী জয়লাভ করে। তৈমুর তাদের খবর পাঠালেন যে, তারা যদি আত্মসমর্পণ করে ও মুসলমান হয় তাহলে তাদের জীবন ও সম্পদ রক্ষা পাবে ও তারা তাদের ভূমিতে থাকার অধিকার পাবে। কিন্তু রাতের বেলা তারা তৈমুরের একটি বাহিনীকে আক্রমণ করে বসে ও তাদের ১৫০ জনকে বন্দী করে হত্যা করে। ইয়াযদী লিখেছেন, “তখন ইসলামের সমস্ত বাহিনী  পর্বতের উপরে উঠে এবং সকল পুরুষদের তরবারির সাহায্যে হত্যা করে, নারী ও শিশুদের বন্দী করে নিয়ে যায়। যারা আল্লাহর আরাধনায় কখনো তাদের মস্তক অবনত করে নাই সেই সমস্ত অবিশ্বাসীর মাথা দিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় পিরামিড তৈরী করা হয়।”

----------------------------------------

দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. III, 1871, pp. 480-481.

----------------------------------------

এরপর তৈমুরের বাহিনী আরেকটি বড় ধরনের গণহত্যা ও লুণ্ঠন সংঘটিত করে ভাটনির নামে একটি নগরে। রাও দুল চাঁদ ছিলেন এর শাসক। এটি ছিল প্রধানত হিন্দুদের বসতি। ইয়াযদীর ভাষ্যমতে এখানে তৈমুরের বাহিনী “দশ হাজার অবিশ্বাসীকে হত্যা করেছিল, সেখানকার বাড়ী-ঘর জ্বালিয়ে দিয়েছিল, এবং সমস্ত জায়গা ধ্বংস করেছিল। কিছু ছাইয়ের ঢিবি ছাড়া সেখানে কিছুই অবশিষ্ট ছিল না। লুটেরাদের হাতে আসা সোনা ও রূপা, এবং ঘোড়া ও লুটের সমস্ত ধরনের মালামাল তৈমুরের নির্দেশে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হল।”

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৮৮-৪৯১।

----------------------------------------

ভাটনির ধ্বংসের পর পচন ধরা নিহতদের কারণে তৈমুর তার বাহিনীকে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে অভিযান পরিচালনা করার নির্দেশ দেন। এর পর তার বাহিনী নানা শহর ও নগরে লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে। তবে তৈমুরের বাহিনীর আসার সংবাদ পেয়ে সব নগর ও শহরের বাসিন্দারা দূর অঞ্চলে পালিয়ে যায়। এরপরেও তৈমুরের সৈন্যরা তাদের পশ্চাধাবন করে তাদের মালামাল লুণ্ঠন করে ও তাদের অনেককে হত্যা করে ও নারী ও শিশুদের বন্দী করে। ইয়াযদী লিখেছেন, এই সমস্ত নগর ও শহরের বাসিন্দারা অবিশ্বাসী ছিল। এভাবে তৈমুরের বাহিনী এই সমস্ত স্থানে ব্যাপক গণহত্যা ও লুণ্ঠন চালায়। এক সময় তৈমুর যমুনা নদী অতিক্রম করে লোনি দুর্গের দিকে অগ্রসর হন। ইয়াযদী বলেন, অবিশ্বাসীরা আগেই দুর্গের ভিতরে অবস্থিত তাদের বাড়ী-ঘরে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল ও তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের পুড়িয়ে ফেলেছিল। ইয়াযদী এরকম একটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন যেখানে হিন্দুরা স্ত্রী ও সন্তানদের আগুনে নিক্ষেপ করে নিজেরা শত্রুদের বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। বুঝা যায় যে, মুসলিম আক্রমণকারীদের হাতে তাদের স্ত্রী-কন্যাদের ধর্ষিত হওয়া ও অবমাননাকর দাসত্বের চেয়ে হিন্দুরা এইভাবেই জীবন উৎসর্গ করাকে শ্রেয়তর মনে করত। তৈমুর আদেশ দিলেন যেন, সেখানে অবস্থিত মুসলমানদের সরিয়ে ফেলা হয় এবং বাকীদের অর্থাৎ হিন্দুদের তরবারির নীচে চালিত করা হয়। এরপর সৈয়দরা ছাড়া (তাদের মুহাম্মদের বংশধর বলে মনে করা হয়) সেখানে থাকা সকল অধিবাসীর উপর লুণ্ঠন পরিচালনা করা হল ও দুর্গটিকে পুড়িয়ে এটিকে ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯১-৪৯৬।

----------------------------------------

পাতা : ১৮

এর কিছুদিন পরে লোনির কাছে হিন্দুদের উপর পরিচালিত গণহত্যার বর্ণনা ইয়াযদী দিয়েছেন। সেখানে শিবির ফেলার পর তৈমুরকে আমীর জাহান শাহ ও অন্যান্য আমীররা জানায় যে, সিন্ধু নদী অতিক্রম করার পর কম বা বেশী এক লক্ষ হিন্দুকে বন্দী করা হয়েছিল এবং এই হিন্দুদের তাবুতে রাখা আছে। মনে করা হচ্ছে যে, দিল্লীর সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধের দিন তারা শত্রুর সাথে যোগ দিতে পারে। এই মতটির সমর্থন পাওয়া যায় যখন দিল্লীর সম্রাটের বাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযানে অগ্রসর হল তারা তখন উল্লসিত হয়ে উঠেছিল। তৈমুর এই বিষয়টিকে গ্রহণ করলেন এবং সকল হিন্দু বন্দীকে হত্যা করতে নির্দেশ দিলেন। আরো বললেন যে, যারা এই হুকুম প্রতিপালন করতে অবহেলা করবে তাদেরকে হত্যা করতে হবে এবং তাদের স্ত্রী, সন্তান ও সম্পত্তি তথ্য প্রদানকারীর সম্পত্তি হবে। এই হুকুমের ফলে ১,০০,০০০ হিন্দুকে তরবারির নীচে হত্যা করা হল। এরপর তিনি বন্দীদের স্ত্রী ও সন্তানদের ও গবাদিপশুগুলিকে পাহারা দিবার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন।

----------------------------------------

এই ভয়ংকর ঘটনার বিবরণ ইয়াযদী দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “On the same day Amír Jahán Shah and other amirs represented to Tímúr that from the time he crossed the Indus a hundred thousand Hindu prisoners, more or less, had been taken, and that these gabrs and idol-worshippers were kept in the camp. It was to be feared that in the day of battle with the forces of Delhí they might join the enemy. This opinion was confirmed by the joy which the prisoners had exhibited when Mallú Khán marched against the imperial forces at Jahán-numáí. Tímúr considered the point, and deeming the advice of his officers to be wise, he gave orders for all the Hindu prisoners to be put to death. Every one who neglected to comply with this command was to be executed, and his wives, children, and goods were to become the property of the informer. In pursuance of this order 100,000 infidel Hindus were put to the sword. Mauláná Násiru-d dín, a most distinguished ecclesiastic, had fifteen Hindus in his train, and he who had never caused a sheep to be slaughtered was obliged to have these fifteen Hindus killed. Tímúr also issued an order that one man out of every ten should be left in camp to guard the wives and children of the prisoners, and the captured cattle.”  প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৯৭।

----------------------------------------

১৩৯৮ খ্রীষ্টাব্দে তৈমুর লং দিল্লী দখল করেন। দিল্লীর নিয়ন্ত্রণ নিবার পর খাজাঞ্চীখানার কর্মকর্তাদের শহরে মুক্তিপণ আদায়ের জন্য রবিউস সানি মাসের ১৬ তারিখে পাঠানো হল। বহু সহস্র সৈন্য খাদ্য শস্য ও চিনি আদায়ের আদেশ নিয়ে শহরের দিকে অগ্রসর হল। কর্মকর্তাদের প্রতি একটি আদেশ দেওয়া হয়েছিল যে, যে সমস্ত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি তৈমুরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিল ও শহরে পলাতক অবস্থায় আছে তাদের প্রত্যেককে বন্দী করতে হবে। এই নির্দেশ পালনের জন্য সৈন্যদল সমস্ত শহরে ছড়িয়ে পড়ল। সৈন্যরা মানুষের উপর পীড়ন শুরু করল। চোখের সম্মুখে ধন-সম্পদ লুণ্ঠিত ও নিজ স্ত্রী-কন্যার ধর্ষিত হওয়া সহ্য করতে না পেরে দিল্লী শহরের সিরি, জাহান পানাহ ও পুরাতন দিল্লীর হিন্দুরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয় ও সৈন্যদের উপর আক্রমণ করে। হিন্দুরা প্রথা অনুযায়ী তাদের নিজেদের জিনিসপত্রে আগুন ধরিয়ে দেয় এবং তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের আগুনের মধ্যে নিক্ষেপ করে। তারপর শত্রু সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এর ফলে সৈন্যরা তোরণ ভেংগে ভয়ানক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন শুরু করে দেয়। সমস্ত শহরে লুণ্ঠন শেষ না হওয়া পর্যন্ত কর্মকর্তারা অপেক্ষা করে। প্রায় ১৫,০০০ মানুষ শুক্রবার সারা রাত লুণ্ঠন ও বাড়ী ঘরে আগুন দিবার কাজে নিয়োজিত ছিল। অনেক স্থানে হিন্দুরা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল। সকাল বেলায় যে সমস্ত সৈনিকরা বাইরে ছিল তারা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে নগরের ভিতরে প্রবেশ করল ও ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করল। রবিবার দেখা গেল যে সমস্ত জায়গায় লুণ্ঠন করা হয়েছে এবং জাহান পানাহ্ ও সিরির বহু প্রাসাদ ধ্বংস করা হয়েছে। ১৮ তারিখেও লুটতরাজ চলতে লাগল। দেখা গেল যে, প্রতিটি সৈনিক কুড়ি জনেরও বেশী মানুষকে বন্দী করে দাস হিসাবে পেয়েছে এবং কেউ কেউ পঞ্চাশ বা এক শত পুরুষ, নারী ও শিশুকে বন্দী করে দাস হিসাবে শহরের বাইরে নিয়ে গেছে। অন্যান্য দ্রব্য লুণ্ঠন ও কেড়ে নিবার পরিমাণ এত বেশী ছিল যে, সেগুলি হিসাবের বাইরে ছিল। এগুলি হল মূল্যবান মণি-রত্ন, হীরা, সব ধরনের জিনিপত্র ও কাপড়, সোনা ও রূপার পাত্র ও আধার, আলাই টংকা ও অন্যান্য মুদ্রা। যে সমস্ত নারীকে বন্দী করা হয়েছিল তাদের বেশীরভাগই হাত ও পায়ে সোনা বা রূপার হার, ও আঙ্গুলে আংটি পরেছিল। ১৯ তারিখে অনেক হিন্দু যারা বড় মসজিদে আশ্রয় নিয়েছিল, মনে করা হল যে, তারা প্রতিরোধের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তৈমুরের বাহিনী সেখানে গিয়ে তাদের হত্যা করে। হিন্দুদের কর্তিত মস্তকে উঁচু স্তম্ভ তৈরী করা হল। তাদের দেহ ক্ষুধার্ত পাখী ও প্রাণীদের খাদ্যে পরিণত হল। একই দিন সমগ্র পুরাতন দিল্লী লুণ্ঠন করা হল। সেখানকার যে সমস্ত অধিবাসী জীবন্ত রক্ষা পেয়েছিল তাদের বন্দী করা হল। সেখান থেকে বহু হাজার কারিগর ও যন্ত্রশিল্পীকে নগর থেকে বের করা হল এবং তৈমুরের অধীনে নেওয়া হল। তাদেরকে বিভিন্ন রাজপুত্র, আমীর ও আগাদের মধ্যে বিতরণ করা হল। তৈমুর তার রাজধানী সমরখন্দে একটি মসজিদ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি আদেশ দিলেন যে, এই ধর্মীয় কাজের জন্য যেন সকল পাথর-মিস্ত্রীকে সংরক্ষিত রাখা হয়।

----------------------------------------

দিল্লীতে তৈমুরের এই ভয়ংকর লুটতরাজ, গণহত্যা ও দাসকরণের বিবরণ ইয়াযদী ও ফিরিশতা দুইজনই দিয়েছেন। এই বিবরণের জন্য দেখুনঃ প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫০১-৫০৪ এবং কাশিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৩৯০-৩৯২।

----------------------------------------

এরপর তৈমুর এক যুদ্ধে মীরাটের দুর্গ অধিকার করেন। সেখানকার হিন্দু সৈন্যদের হত্যা করা হয় ও তাদের স্ত্রী ও সন্তানদের বন্দী করা হয়। এরপর দুর্গের দেওয়াল মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়। পরে তৈমুর যমুনা নদীর উপরের অংশে তার বাম ভাগের সেনাবাহিনীকে হিন্দুদের অঞ্চলসমূহের উপর লুটতরাজ ও আক্রমণে ব্যতিব্যস্ত করার জন্য পাঠিয়ে দেন। এরপর তৈমুর গঙ্গা নদী পার হয়ে ও পরে জম্মু সহ বিভিন্ন ভারতীয় অঞ্চল অধিকার করে লুণ্ঠন ও গণহত্যা পরিচালনা করেন। পরে তিনি সমরখন্দে প্রত্যাবর্তন করেন।

তৈমুর চলে যাবার পর দুই মাস দিল্লীতে এমন এক দুর্ভিক্ষ ও মহামারী দেখা দেয় যে, নগরটি পুরাপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়, এবং যে সমস্ত অধিবাসী সেখানে ছিল তারা মারা যায়। বাদাউনি লিখেছেন যে, এই পুরা দুই মাস দিল্লীর আকাশে কোনো পাখী পাখা মেলে নাই।

----------------------------------------

দেখুনঃ Al-Badaoni, Muntakhabu-t-Tawarikh, Vol. I, p. 359.

----------------------------------------

দিল্লীর সুলতান খিজির খান ৮২১ হিজরী সালে (১৪১৮ খ্রীষ্টাব্দে) কাটিহারের রাজাকে দমন করবার জন্য তার উজিরকে পাঠান। তিনি কাটিহার অঞ্চল লুণ্ঠন ও ব্যাপক ধ্বংসকাণ্ড পরিচালনা করে বাদায়ুনে চলে যান। এরপর এটোয়া নামে একটি স্থানে কর ধার্য করে তিনি দিল্লী ফিরে যান। পরে খিজির খান নিজে কাটিহারের বিরুদ্ধে রওনা হন। তিনি গঙ্গা পার হয়ে সম্বুল ও কাটিহার অঞ্চলে প্রবেশ করেন ও লুটতরাজ ও অগ্নিকাণ্ডের সাহায্যে দেশ ধ্বংস করে রাজধানীতে ফিরে আসেন।

----------------------------------------

কাশিম ফিরিশতা, ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪০৪।

----------------------------------------

 ৮৩২ হিজরীতে (১৪২৮ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতান মুবারিক মেওয়াট যান ও তা সম্পূর্ণ পদানত করে সেখানকার অধিবাসীদের কর প্রদানে বাধ্য করেন। পরের বৎসর সুলতান গোয়ালিয়র যান। পথে তিনি রাজা হলকান্তের কাছে রাজস্ব দাবী করেন। হলকান্ত দাবী পূরণে অসমর্থ হওয়ায় পাহাড়ে পালিয়ে যান। তখন সুলতান তার এলাকায় ধ্বংসকাণ্ড চালিয়ে ও সেখানকার বহু অধিবাসীকে বন্দী ও দাস করে দিল্লীতে নিয়ে যান।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১৪।

----------------------------------------

পাতা : ১৯

সুলতান মুবারিকের সময় একটি বড় ধরনের গণহত্যার কথা এখানে উল্লেখ করা যায়। সৈয়দ সেলিমের দুই পুত্র সুলতানের বিরুদ্ধে বিদ্র্রোহ করার জন্য ফোলাদ নামে এক তুর্কী ক্রীতদাসকে গোপনে সারহিন্দে পাঠান। সুলতানের সেনাবাহিনীর আবরোধের কারণে সারহিন্দের দুর্গে ফোলাদের অবস্থা সংকটাপন্ন হয়। তখন তিনি শাহ্রুখ মির্জা কর্তৃক নিযুক্ত কাবুলের সুবেদার শেখ আলীর সাহায্য চান। আমীর শেখ সারহিন্দে এসে পৌঁছালে সুলতানের বাহিনী পালাতে বাধ্য হয়। ফোলাদ তার মিত্রকে দুই লক্ষ তঙ্কার সমমূল্যের ধন-রত্ন ও অনেক উপহার দিলেন। শেখ আলী ফিরবার পথে শতদ্রু নদী পার হয়ে পাঞ্জাবে ব্যাপক লুণ্ঠন চালান। ফোলাদের কাছ থেকে তিনি যা পেয়েছিলেন তার শতগুণ ধন তিনি লুট করে পান। লাহোরের পর তিনি দিপালপুর যান ও সেখানের ব্যাপক লুণ্ঠন ও হত্যাকাণ্ড চালালেন। ফিরিশতা লিখেছেন, প্রায় ৪০,০০০ হিন্দুকে এই সময় হত্যা করা হয়েছিল বলে অনুমান করা হয়। এছাড়াও তিনি বহু সংখ্যক মানুষকে দাস হিসাবে বন্দী করে নিয়ে যান।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১৪-৪১৭।

----------------------------------------

আমীর শেখ আলী আর একবার মুলতানে অনুপ্রবেশ ও তুলুম্বা দখল করেন। তিনি তার অঙ্গীকার ভেংগে ঐ জায়গা লুণ্ঠন করেন এবং অস্ত্র ধরতে সক্ষম সকল পুরুষকে হত্যা করেন এবং শহর ভস্মীভূত করেন। সেখানকার অধিবাসীদের স্ত্রী ও সন্তানদের যুদ্ধ-বন্দী হিসাবে নিয়ে যান।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত,  পৃঃ ৪১৮।

----------------------------------------

দিল্লীর সুলতান সৈয়দ আলা-উদ-দীনের সময়ে ভারতের বিস্তৃত অঞ্চল দিল্লীর অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে অনেক খণ্ড খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত হয়ে পড়েছিল। সেই সময় দাক্ষিণাত্য, গুজরাট, মালব, জৈনপুর ও বাংলা প্রত্যেক প্রদেশই এক এক জন স্বাধীন সুলতানের অধীন ছিল। পাঞ্জাব, দিপালপুর, সারহিন্দ ও পানিপথ পর্যন্ত সমস্ত দক্ষিণাঞ্চল ছিল বাহ্লুল লোদীর অধীনে। মেহ্রোলী এবং দিল্লীর সাত মাইল দূরে সরাইলাদো পর্যন্ত সমস্ত এলাকা আহমদ খান মেওয়াটির অধীনে ছিল। দিল্লীর শহরতলী পর্যন্ত প্রসারিত সম্বল রাজ্য ছিল দরিয়া খান লোদীর অধীনে। দোয়াবের কোলে জলেশর ঈসা খান এবং রাবেরী ও তার আওতাধীন এলাকা কুতুব খান আফগান দখল করে নিয়েছিল। কাম্পিলা ও পাতিয়ালী ছিল রাজা প্রতাপ সিংহের অধীনে এবং বিয়ানা অধিকার করেছিল দাউদ খান লোদী। ফলে দিল্লী শহর ও পার্শ্ববর্তী অতিক্ষুদ্র অংশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল দিল্লীর প্রভুত্ব।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪২৯, ৪৩০।

----------------------------------------

সুলতান সিকান্দার লোদী ৯১০ হিজরীতে (১৫০৪ খ্রীষ্টাব্দে) মুন্দ্রিল অভিমুখে যাত্রা করেন। মুন্দ্রিল অধিকার করার পর সুলতান সেখানকার মন্দিরগুলি ভেংগে সেই স্থানে মসজিদ নির্মাণ করান।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৬১। বাদাউনি লিখেছেন, “… in the year 910 H (1504 A.D.), marched to reduce the fortress of Mandrāyal, which he took without fighting from the Rāja of Mandrāyal, who sued for peace; he also destroyed all the idol-temples and churches of the place, …” দেখুনঃ Al-Badaoni, Muntakhabu-t-Tawarikh, Vol. I, p. 420.

----------------------------------------

৯১২ হিজরীতে (১৫০৬ খ্রীষ্টাব্দে) সুলতান সিকান্দার লোদী হনুমন্ত গড় দুর্গের উদ্দেশ্যে রওনা হন। অল্প সময়ের মধ্যেই দুর্গটির পতন ঘটে। দুর্গবাসী রাজপুত সৈন্যদেরকে তলোয়ারের মুখে হত্যা করা হয়। সেখানকার মন্দিরগুলি ধ্বংস করে সেখানে মসজিদ নির্মাণের হুকুম দেওয়া হয়। বাদাউনি লিখেছেন, যে সমস্ত পৌত্তলিক তালোয়ারের হাত থেকে বেঁচে গিয়েছিল তারা স্ত্রী ও সন্তানসহ অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে আত্মাহূতি দেয়।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৬২।

বাদাউনি বলেন, “… after that he took the fort and gave the infidels as food to the sword; those who escaped the sword fed the flames of the fire of jūhar with their wives and children. He then cast down the idol temples, and built there a lofty mosque.” দেখুনঃ Al-Badaoni, Muntakhabu-t-Tawarikh, Vol. I, p. 422.

----------------------------------------

পরের বৎসর (৯১৩ হিজরী, ১৫০৬ খ্রীষ্টাব্দ) সুলতান মালবের অন্তর্গত নারোর নামে এক সুদৃঢ় দুর্গ জয় করার জন্য রওনা দেন। এই দুর্গটি হিন্দুদের অধিকারে ছিল। আট মাস অবরোধের পর দুর্গবাসী সৈন্যরা বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করল। ফিরিশতা লিখেছেন, সুলতান কয়েক মাস ধরে নারোরে মন্দির ধ্বংস ও মসজিদ নির্মাণ কাজে ব্যাপৃত থাকেন তিনি সেখানে একটি মাদ্রাসা স্থাপন করে সেখানে বহু সংখ্যক পীর ও আলেমকে স্থান করে দেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৬২, ৪৬৩।

----------------------------------------

সুলতান ইব্রাহিম লোদীর সময়ে (হিজরী ৯২৪, খ্রীষ্টাব্দ ১৫১৮) গোয়ালিয়র দুর্গ অবরোধ করা হল। কয়েক মাস অবরোধের পর ইব্রাহিম লোদীর বাহিনী একটি বহিঃঘাটি অধিকার করতে সমর্থ হয়। এই জায়গায় বাদিলগড় দুর্গ অবস্থিত ছিল। এইখানে একটি পিতলের বৃষ-মূর্তি আক্রমণকারীদের হাতে আসে। বহু শতাব্দী আগে থেকে হিন্দুরা এই বৃষমূর্তির পূজা করে আসছিল। মূর্তিটি আগ্রায় পাঠানো হয় এবং সেখানে বাগদাদ তোরণে এটিকে চিৎ করে রাখা হয়।  ধারণা করা যায় যে, মূর্তিটিকে অবমাননা করার জন্যই তা করা হয়েছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৭৩।

----------------------------------------

সম্রাট আকবরের আমলে যেশুইট পাদ্রী ফাদার মোনসারেট রচিত Commentary on the Court of Akbar গ্রন্থে গ্রন্থকার লিখেছেন যে, তিনি যখন আকবরের ডাকে দক্ষিণ ভারত থেকে ফতেহপুরসিক্রিতে আকবরের সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন তখন মুসলমানদের দ্বারা হিন্দুদের অনেক সুন্দর মন্দির ধ্বংসপ্রাপ্ত অবস্থায় দেখেন। ইতস্ততঃ ছড়িয়ে থাকা পাথরের টুকরার উপর মনোরম ভাস্কর্য ও স্থাপত্যের নিদর্শন দেখে তিনি তা ধারণা করেছিলেন। তিনি লিখেছেন, মুসলমান শাসকদের অমনোযোগিতার জন্য এই সমস্ত ভাংগা মন্দিরে হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ভীড় কম হয় না। সেখানে প্রকাশ্যেই পশুবলি দেওয়া হচ্ছে। যেখানেই দেবদেবীর মূর্তির টুকরাও পড়ে রয়েছে সেখানেই ফুল, চন্দন ও ধূপশিখা দিতে দেখা গেছে। তারা হিন্দু মন্দিরের ভিত্তির উপর অনেক মন্দিরের চত্ত্বরেই অনেক ছোট ছোট মসজিদ, ঈদগাহ ও কবর নির্মিত হতে দেখেছিলেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ নির্মল কুমার ঘোষ (অনু), যেশুইট পাদ্রীর আকবরনামা, Father Monserrate লিখিত Commentary on the Court of Akbar গ্রন্থের অনুবাদ, দিব্যপ্রকাশ, ঢাকা, ২০১৬, পৃঃ ৪৬।

----------------------------------------

আগের আলোচনায় দেখতে পেয়েছি যে, মুসলিম আক্রমণকারীরা ভারতীয় নারীদের উপর ধর্ষণ ও যুদ্ধ-বন্দী করে দাস-করণের পথ বেছে নিয়েছিল। বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই মুসলিম ঐতিহাসিকরা ভারতীয় নারীদের উপর পরিচালিত ধর্ষণ ও নির্যাতনের বিবরণ দিবার প্রয়োজন মনে করেন নাই। কারণ সেই সমস্ত ঐতিহাসিকের কাছে সম্ভবত অমুসলিম নারীরা ধর্ষণ, ভয়াবহ নির্যাতন ও দাসকরণের উপযুক্ত ছিল। কিন্তু মোগল যুগে মুসলিম সৈন্যবাহিনীও যে মুসলিম নারীদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন পরিচালনা করেছিল তার বিবরণ ঐতিহাসিক বাদাউনি দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ৯৮০ হিজরীর দিকে বিদ্রোহী ইব্রাহীম হোসেন মির্যা তার বাহিনী নিয়ে গুজরাট থেকে মিরাটের দিকে যান। পরে তিনি ৩০০ বাহিনী নিয়ে দেশ লুটপাট ও ধ্বংস করে গঙ্গা ও যমুনা নদী পার হয়ে আজমপুর পরগনায় আসেন, এক সময়ে তিনি যার জায়গীর ছিলেন। এর মধ্যে খবর আসল যে, মির্যা আমরোহাহ লুণ্ঠন করেছেন ও দ্রুত লাহোরের দিকে আসছেন। দাবার চালে বাধাহীন নৌকার মত মির্যা দেশের কেন্দ্রে এসে পৌঁছালেন এবং শহর লুণ্ঠন ও ধ্বংস করতে থাকলেন। বাদাউনি আরো লিখেছেন, যখন তিনি পায়াল গ্রামে এসে পৌঁছালেন, তার লোকজন মুসলমান লোকজন ও তাদের পরিবারের উপর এত বর্বর নৃশংসতা করল যে, তা ভালভাবে বর্ণনা করা যায় না। উদাহরণ হিসাবে, বারো জন কুমারীর উপর এত পরিমাণে অসদাচরণ করল যে তারা মারা গেল। অন্য শহরগুলিতেও একই রকম আচরণ করল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Al-Badaoni, Muntakhabu-t-Tawarikh, Vol. II, pp. 154-159.

----------------------------------------

পাতা : ২০

সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক বাংলা আক্রমণ করলে সেখানকার একডালা দুর্গে অবস্থিত মুসলিম নারীদের প্রতি তার সহানুভূতির কথা ঐতিহাসিক শামস-ই সিরাজ আফিফ তার তারিখ-ই ফিরোজ শাহী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। সুলতান ফিরোজের আক্রমণে বাংলার সুলতান শামস উদ্দিন একডালা দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করেন। আফিফ লিখেছেন, যখন ফিরোজ শাহের আগমনের সংবাদ পৌঁছাল সকল নারী ও সম্মানিত মহিলারা দুর্গের উপরে উঠল ও যখন তারা সুলতান ফিরোজকে দেখল তখন তারা তাদের মাথার কাপড় খুলে ফেলল ও তাদের দুর্দশায় বিলাপ করতে লাগল। সুলতান তাদের অবস্থা দেখলেন ও তাদের আর্তনাদ শুনলেন। তখন তিনি চিন্তা করলেন যে, তিনি নগরটি দখল করেছেন, অনেক মুসলমানকে পরাস্ত করেছেন, দেশটির অধিকার গ্রহণ করেছেন, ও খুতবা তার নামে পড়া হবে। দুর্গটিকে আক্রমণ করলে, আরো মুসলমানদের তরবারির আঘাতে মৃত্যু হবে, ও সম্মানিত মহিলাদের সম্মানহানি ঘটবে। এটি একটি অপরাধ হবে যা শেষ বিচারের দিনে তিনি জবাব দিতে পারবেন না, এবং যার জন্য তার সাথে মোগলদের কোনো পার্থক্য থাকবে না।  কিন্তু ভারতীয় মুসলমান ভিন্ন অন্য ধর্মের নারীদের সম্মানহানি ঘটলেও মুসলিম আক্রমণকারী ও মুসলিম ঐতিহাসিকদের মনে কোনো অনুশোচনার চিহ্ন দেখা যায় না।

----------------------------------------

দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India as Told by its Own Historians, Vol. III, pp. 296, 297.

----------------------------------------

অথচ মারাঠা জনগোষ্ঠী যারা হিন্দু ছিল, তাদের নেতা শিবাজী ও তার বাহিনী ব্যাপক লুটতরাজ করলেও মুসলমানদের ধর্মীয় গ্রন্থ কুরআনকে সম্মান করতেন। তার হাতে কুরআন গ্রন্থ এলে তিনি এটিকে সম্মানের সাথে গ্রহণ করতেন ও তার কোনো একজন মুসলিম অনুসারীকে দিয়ে দিতেন। এছাড়া যুদ্ধ-বন্দী নারীদের তাদের আত্মীয়রা তাদেরকে মুক্তিপণ দিয়ে কিনে না নেওয়া পর্যন্ত তাদের প্রতি ব্যক্তিগতভাবে নজর রাখতেন। সমসাময়িক মুসলিম লেখক কাফি খান তার রচিত গ্রন্থ মুনতাখাবু’ল লুবাব-এ এর বিবরণ দিয়েছেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India as Told by its Own Historians, Vol. VII, 1877, p. 260.

----------------------------------------

মুসলিম আমলে বিজিত অঞ্চলের যুদ্ধ-বন্দী নারী-পুরুষদের দাসকরণের বহুল প্রচলিত প্রথা কেবল আকবর তার শাসনকালের সপ্তম বৎসরে রহিত করেন। মুসলমান বিজয়ী বাহিনী ভারতবর্ষের বিস্তৃত অঞ্চলে যদৃচ্ছ ‍নিষ্ঠুরতা করে ভারতবর্ষের মানুষদের স্ত্রী, শিশু ও তাদের আত্মীয়দের যুদ্ধ-বন্দী করত এবং তাদের ভোগ করত বা বিক্রী করত। নূতন এই নিয়ম অনুযায়ী সম্রাটের বাহিনীর বিরুদ্ধে শত্রু পক্ষ অস্ত্র ধারণ করলেও সম্রাটের বাহিনী শত্রু পক্ষের লোকজনদের ও শিশুদের উপর নিপীড়ন করতে এবং দাস করতে পারবে না।  সম্রাট আকবরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা ছিল হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর তুলে নেওয়া। এটি তিনি তার শাসনকালের নবম বৎসরে বাস্তবায়ন করেন। আকবরের শাসনের সময়ে ভারতবর্ষে যে চার্বাক মতাদর্শের মানুষজন ছিল তা আবুল ফজল উল্লেখ করেছেন। আকবরের তেইশ বৎসরের বিবরণে তিনি লিখেছেন, যে সুফী, দার্শনিক, বক্তা, আইনজ্ঞ, সুন্নি, শিয়া, ব্রাহ্মণ, জৈন, বৌদ্ধ, চার্বাক, খ্রীষ্টান, ইহুদী, জরথুস্ত্র  এবং প্রতিটি বিশ্বাসের শিক্ষিত লোকজন আনন্দের সাথে রাজকীয় সমাবেশে যোগদান করেছিল। সকলে নির্ভয়ে তাদের বক্তব্য দিতে পারত।

----------------------------------------

দেখুনঃ Abu-l-Fazl, The Akbarnāmā, Vol. II, Translated from the Persian by H. Beveridge, The Asiatic Society, Calcutta, 1907, pp. 246, 247.

আকবরের সময়ের অনেক আগে থেকেই দক্ষিণ ভারতে জরথুস্ত্র ধর্মের অনুসারী তথা পার্সীদের উপস্থিতির কথা জানা যায়। ফাদার মনসেরাট লিখিত গ্রন্থে দামন থেকে সুরাট অভিমুখে যাত্রার সময় পাদ্রী মিশন নওসারিনুম বা নওসারী নামে শহরে জরথুস্ত্র সম্প্রদায়ের বাস করার কথা লিখেছেন। দেখুনঃ যেশুইট পাদ্রীর আকবরনামা, ২০১৬, পৃঃ ৩৬।

দেখুনঃ Abu’l-Fazl, The Akbar Nāma, Volume III, Translated from the Persian by H. Beveridge, First published 1939, Reprinted 2000, The Asiatic Society, Calcutta, p. 365.

----------------------------------------

সম্রাট আকবরের সময় থেকে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের প্রতি তুলনামূলক সহনশীলতার চর্চ্চা অনুশীলন করা হত বলে তার প্রভাব পরবর্তী শাহ জাহানের সময়েও প্রচলিত থাকতে দেখা যায়। মুনতাখাবু’ল লুবাব গ্রন্থের লেখক মুহাম্মদ হাশিম, যিনি কাফি খান হিসাবেও পরিচিত, লিখেছেন, সম্রাট শাহ জাহানের পুত্র দারা শিকোহ সম্পর্কে এমন প্রচার ছিল যে, তিনি সুফী মতাদর্শের প্রতি অনুগত। তিনি কাফির বা বিধর্মী হিসাবে নিজেকে ঘোষণা করেছিলেন এবং এই বিষয়ের উপর প্রবন্ধ লিখেছিলেন। তিনি ব্রাহ্মণদের সাথে নিজেকে যুক্ত করেছিলেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India as Told by its Own Historians, Vol. VII, 1877, p. 214.

----------------------------------------

সুলতানদের মত মোগল শাসকরা ভারতবাসী হিন্দুদের উপর ভয়াবহ নির্যাতন না করলেও বিধর্মী হিসাবে তাদের উপর খুব কম অত্যাচার কারেছে এমন নয়। মোগল শাসক জাহাঙ্গীর একজন হিন্দু সাধুকে তার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই সাধুর অপরাধ ছিল তার পুত্র খসরুকে ভারতীয় ভঙ্গীতে সম্বর্ধনা জানিয়ে খসরুর কপালে তিলকচিহ্ন এঁকে দিয়েছিল।

----------------------------------------

শুধু অর্জুন নামে সেই সাধুটিকে মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ দেন নাই, সেই সাথে তার গৃহাবাস ও সন্তান-সন্ততিদেরও মুর্তজা খানের হেফাজতে রাখতে নির্দেশ দেন। জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনীতে এই ঘটনার উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ  সুধা বসু (অনুঃ), তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী, কল্পন, কলিকাতা, দ্বিতীয় প্রকাশ ২০০৫, পৃঃ ৬৩, ৬৪।

----------------------------------------

ভারতে শুধু যে সুলতানরা ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা করত তাই নয়, মোগল বাদশাহদের নিষ্ঠুরতা বহু ক্ষেত্রেই কম ছিল না। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের পুত্র খসরু পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ফলে তাকে যারা সহায়তা করেছিল তাদের মধ্যে হুসেন বেগ ও আবদুর রহিম নামে দুই জনকে জাহাঙ্গীর ষাঁড় ও গাধার চামড়া দিয়ে আবৃত করে রাখতে হুকুম দেন। এর ফলে একজন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। এছাড়া অন্যান্য সকল বিদ্রোহীকে ফাঁসী দিয়ে ও শূলে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড দেন।

----------------------------------------

সম্রাট জাহাঙ্গীর তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী-তে এই বিষয়ে লিখে গেছেন। দেখুনঃ সুধা বসু (অনূঃ), তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী, পৃঃ ৬১।

----------------------------------------

মুসলমান সুলতান ও সম্রাটরা ভারতবর্ষে অত্যন্ত বিলাসী জীবন যাপন করতেন। সম্রাট আকবরের মোটামুটি পাঁচ হাজার বেগম ও সেবিকা ছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ বিনয় ঘোষ, বাদশাহী আমল, ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়েরের ভ্রমণ-বৃত্তান্ত Travels in the Mogul Empire (1656 – 1668 A.D.), অবলম্বনে, ইণ্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাইভেট লিঃ, কলিকাতা, ১৮৭৯ শকাব্দ, পৃঃ ১০৪।

----------------------------------------

পাতা : ২১

সাকি মুস্তাইদ খান সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে তার রচিত গ্রন্থ মা-আসির-ই আলমগিরী-তে লিখেছেন, ১০৭৯ হিজরীতে (১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দে) আওরঙ্গজেবের কাছে খবর গেল যে, থট্টা, মুলতান ও বিশেষভাবে বেনারসে ব্রাহ্মণরা স্বভাববশত তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অসার গ্রন্থের ব্যাখ্যা করছে, এবং মুসলমান ও হিন্দু ছাত্ররা ও শিক্ষাগ্রহণকারীরা এমনকি অনেক দূর থেকে পাপপূর্ণ বিজ্ঞান শিখতে সেখানে যাচ্ছে। আওরঙ্গজেব সাথে সাথে অবিশ্বাসীদের সেই সমস্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও মন্দিরগুলি ধ্বংস করতে সকল প্রদেশের শাসকদের নির্দেশ দিলেন। এছাড়াও সেই শাসকদের এই শিক্ষা ও মূর্তিপূজার চর্চা সম্পূর্ণ বন্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। সরকারী কর্মকর্তারা বেনারসে অবস্থিত বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করে এই নির্দেশ পালন করেছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India as Told by its Own Historians, Vol. VII, 1877, pp. 183, 184.

----------------------------------------

আওরঙ্গজেব তার রাজত্বের ত্রয়োদশ বৎসরে ১০৮০ হিজরীতে (১৬৬৯ খ্রীষ্টাব্দে) মথুরার দেহরা কেসু রায় নামে একটি হিন্দু মন্দির ধ্বংস করতে নির্দেশ দেন। মা-আসির-ই ’আলমগীরী-তে সাকি মুস্তাইদ খান লিখেছেন, শিগগীরই সেই মন্দিরটি মাটির সাথে মিশিয়ে ফেলা হয়। একই স্থানে একটি বিশাল মসজিদের ভিত্তি স্থাপন করা হয়। এখানকার মূল্যবান অলংকারপূর্ণ মূর্তিগুলি আগ্রায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ও নবাব বেগম সাহেবের মসজিদের সিড়ির নীচে স্থাপন করা হয়েছিল যাতে মুসলমানরা সেগুলিকে পদদলিত করতে পারে। মথুরার নাম বদল করে ইসলামাবাদ রাখা হয়েছিল এবং সমস্ত সরকারী দলিলে ও লোকজনের মধ্যে এই নামের ব্যবহার চালু করা হয়েছিল। ১০৯০ হিজরীতে (১৬৭৯ খ্রীষ্টাব্দে) যোধপুর থেকে হিন্দু মন্দির ধুলিস্মাৎ করার পর বহু সংখ্যক গাড়ী বোঝাই মূর্তি নিয়ে খান জাহান বাহাদুর সম্রাট আওরঙ্গজেবের কাছে আসেন। আওরঙ্গজেব তার অনেক প্রশংসা করেন। বেশীর ভাগ মূর্তিগুলি মূল্যবান পাথর দিয়ে অলংকৃত ছিল, অথবা সোনা, রূপা, পিতল, তামা বা পাথরের তৈরী ছিল। হুকুম করা হল যে, এগুলির কিছুকে আবর্জনা হিসাবে বহির্বাটিতে ফেলে দিতে হবে, এবং বাকীগুলি পদদলিত করার জন্য সিড়ির নীচে স্থাপন করতে হবে।

----------------------------------------

  প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ১৮৪।

  প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ১৮৭।

----------------------------------------

১০৯০ হিজরীতে (১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে) যুবরাজ মুহাম্মদ আজম ও খান-জাহান বাহাদুর উদয়পুর যাবার জন্য আওরঙ্গজেবের কাছে অনুমতি পেলেন। রুহু-ল্লাহ্ খান ও ইয়াক্কাতাজ খান মূর্তিপূজারীদের মন্দির ধ্বংস করার জন্য অগ্রসর হলেন। রাণার রাজপ্রাসাদের কাছে অবস্থিত এই বৃহৎ অট্টালিকাগুলি এই যুগের আশ্চর্য নির্মাণ ছিল। কুড়ি জনের মত মাচাতোর রাজপুত তাদের বিশ্বাসের জন্য মৃত্যুকে বরণ করতে স্থির সংকল্প ছিল। একজন তার মৃত্যুর পূর্বে অনেক আক্রমণকারীকে হত্যা করতে সমর্থ হল। এরপর পরের জন, তার পরের জন, যতক্ষণ না সকলে মৃত্যুবরণ করল। মা-আসির-ই ’আলমগীরী-তে সাকি মুস্তাইদ খান লিখেছেন, শেষ ধর্মান্ধ ব্যক্তির মৃত্যুর পূর্বে অনেক বিশ্বাসীও (মুসলমান) মৃত্যুবরণ করেছিল। মন্দিরটি থেকে সকল মূর্তি ধ্বংস করা হয়।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ১৮৭, ১৮৮। 

----------------------------------------

মা-আসির-ই আলমগীরী-তে সাকি লিখেছেন, ১০৯১ হিজরীতে (১৬৮০ খ্রীষ্টাব্দে) আওরঙ্গজেব উদয়সাগরে রাণা কর্তৃক নির্মিত সরোবরটি পরিদর্শন করেন। আওরঙ্গজেব তিনটি হিন্দু মন্দিরের সবকটিকে ধ্বংস করে মাটির সাথে মিশিয়ে দিতে নির্দেশ দিলেন। একই বৎসর হাসান আলী খান রাণার কাছ থেকে কুড়িটি উট দখল করেছিলেন এবং বলেছিলেন যে, রাজপ্রাসাদের নিকটে অবস্থিত মন্দিরটি ও সন্নিহিত অঞ্চলে অবস্থিত আরো এক শত বাইশটি মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। এই সেনাপতিকে তার বিশিষ্ট কর্মের জন্য বাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করা হয়। আওরঙ্গজেব চিতোরের দিকে অগ্রসর হলেন ও তেষট্টিটি মন্দির ধ্বংস করলেন। আবু তুরাবকে আম্বরের দেব-মন্দিরসমূহ ধ্বংস করার জন্য ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছিল ও ছেষট্টিটি এই ধরনের অট্টালিকা মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ১৮৮।

প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ১৮৮।

প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ১৮৮।

----------------------------------------

আওরঙ্গজেবের রাজত্বের পঞ্চম বৎসরে ১০৭২ হিজরীতে (১৬৬২ খ্রীষ্টাব্দে) মোগল সেনাবাহিনী আসামে অভিযান পরিচালনা করেছিল। কাফি খান তার রচিত মুনতাখাবু’ল লুবাব নামক গ্রন্থে এর বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, সেই সময় কুচবিহারের জমিদারের নাম ছিল ভীম নারায়ণ। আসামের রাজা প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। তবে মোগলরা বিপুল পরিমাণ সোনা ও রূপা সেখান থেকে অধিকার করেছিল। এছাড়া তারা ঘর-গানও (ঘর-গাঁও)-এর দূর্গটি অধিকার করে। তিনি লিখেছেন, আসামীয়রা অন্ধকার রাত্রিতে বার বার আক্রমণ করতে থাকে এবং বহু মানুষ ও ঘোড়া হত্যা করে। আসামীয়দের আক্রমণে মোগলদের সেনাবাহিনীর সংখ্যা অত্যন্ত কমে যায়। মোগল বাহিনী পশ্চাদপসরণ করলে আসামীয়রা আক্রমণ করে। এই সময় মোগল বাহিনীর আক্রমণে সহস্রাধিক আসামীয়ের মৃত্যু হয় ও বন্দী হয়। পরে আসামীয় রাজা শান্তি প্রস্তাব দেন। তিনি নির্দিষ্ট পরিমাণ সোনা ও রূপা ছাড়াও মোগলদের অধিকৃত বাংলার সীমান্তবর্তী চাষাবাদের অধীন অঞ্চলে কিছু দুর্গ ও শহর সম্রাটের অধীন রাজ্যের সাথে যুক্ত করতে সম্মত হন। এই অভিযান থেকে রোগ-ব্যাধির দ্বারা ভেংগে পড়া মোগল বাহিনী তাদের মৃত্যুর মুখে পড়া বহু কর্মকর্তা ও উচ্চ পদস্থরা সহ পশ্চাদপসরণ করে। অভিযানের সেনাপতি মুয়াজ্জম খান নিজে ভয়ানক অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে আওরঙ্গজেবের রাজত্বের ষষ্ঠ বৎসরের শুরুতে মারা যান।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৬৪-২৬৯।

কাফি খান রচিত মুনতাখাবু’ল লুবাব-এর ইংরাজী অনুবাদে Ghar-gánw লিখা হয়েছে। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৬৬।

----------------------------------------

আওরঙ্গজেব প্রথম দিকে ততটা কঠোর ধর্মীয় নীতি গ্রহণ না করলেও ক্রমশ তিনি কঠোর ইসলামী নীতি অনুসরণ করতে থাকেন। তার শাসনের একাদশ বৎসর পরে ১৬৬৮ খ্রীষ্টাব্দ থেকে যাত্রা ও মেলার জন্য নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন। কিছু নির্দিষ্ট দিনে হওয়া এই সমস্ত যাত্রা বা মেলায় প্রতিটি গোত্রের নারী ও পুরুষসহ অসংখ্য হিন্দু তাদের দেব-মন্দিরে সমাবেত হত। এখানে লক্ষ লক্ষ রুপির বেচা-কেনা হত, যেখান থেকে প্রাদেশিক কোষাগারে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হত।  সেই সময় সংগীত ও নৃত্য নিষিদ্ধ করে সরকারী ঘোষণা জারী করা হয়েছিল।

----------------------------------------

সম্রাট আওরঙ্গজেবের সমসাময়িক ঐতিহাসিক কাফি খান তার রচিত মুনতাখাবু’ল লুবাব গ্রন্থে এর বিবরণ দিয়েছেন। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৮৩।

----------------------------------------

আওরঙ্গজেবের শাসনকালের দ্বাদশ বৎসরে প্রাক্তন আবিসিনিয়ান দাস ও পরে ৯০০ মনসব-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত সিদি ইয়াকুত মারাঠা নেতা শিবাজীর অধিকারভুক্ত রাজপুরী থেকে ছয় বা সাত কোস দূরে একটি দুর্গের অবরোধকালে সেখানকার সৈন্যদের অনুকম্পার ঘোষণা দেন। তখন সেখান থেকে সাত শত মানুষ বের হয়ে আসে। কিন্তু তার প্রতিশ্রুতি সত্ত্বেও তিনি শিশু ও সুন্দরী নারীদের দাস করেন, এবং বলপূর্বক তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করেন। বৃদ্ধা ও অসুন্দর নারীদের তিনি মুক্তি দেন, কিন্তু পুরুষদের হত্যা করেন। সিদি ইয়াকুত তার বিজয়ের বিবরণ রাজকুমার মুহাম্মদ মুয়াজ্জম-কে দিলে তার মনসব উন্নীত করা হয়, তাকে সম্মানসূচক খেলাত প্রদান করা হয় ও খান উপাধি প্রদান করা হয়।

----------------------------------------

ঐতিহাসিক কাফি খান তার তার রচিত মুনতাখাবু’ল লুবাব গ্রন্থে এর বিবরণ দিয়েছেন। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৯২।

----------------------------------------

পাতা : ২২

কাফি খান লিখেছেন, আওরঙ্গজেবের শাসনের ষষ্ঠদশ বৎসরে তিনি সমস্ত প্রদেশের হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর পুনঃআরোপ করেন। এই খবর প্রচার হবার পর দিল্লীর চারিপাশ থেকে হিন্দুরা সম্রাটের কাছে এই কর প্রদানের অপারগতা ও এই আদেশ প্রত্যাহার করার জন্য অনুরোধ করতে রাজপ্রসাদের কাছে সমাবেত হয়। কিন্ত সম্রাট তাদের অভিযোগ শুনলেন না। একদিন যেদিন সম্রাট মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য যাচ্ছিলেন বহু সংখ্যক হিন্দু এই আদেশ থেকে মুক্তি পেতে প্রাসাদ থেকে মসজিদ পর্যন্ত রাস্তায় ভীড় করেছিল। পোদ্দার, বস্ত্রব্যবসায়ী, উর্দুবাজার থেকে সকল ধরনের দোকানদার, সকল ধরনের যন্ত্র-শিল্পী ও কারিগর, তাদের সকল কাজ ও ব্যবসা ছেড়ে সেই পথে ভীড় করেছিল। রাস্তা খালি করার জন্য নির্দেশ দিবার পরেও সম্রাটের পক্ষে মসজিদে যাওয়া অসম্ভব হল। প্রতিটি মুহূর্তে ভীড় বাড়তে লাগল ও সম্রাটের অনুচরদের এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। এক পর্যায়ে হাতীদের এনে ভীড়ের উপর চালানোর হুকুম হয়। হাতী ও ঘোড়ার দ্বারা পদদলিত হয়ে বহু মারা যায়। আরো কিছু দিন হিন্দুরা বহু সংখ্যায় সমাবেত হল এবং অভিযোগ করল। কিন্তু এক সময় তারা জিজিয়া কর দিতে স্বীকার করল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৯৬।

----------------------------------------

সর্বোচ্চ বিস্তারের সময় মোগল আমলের (আওরঙ্গজেবের সময়ে) ভারতবর্ষ (১৭০০ খ্রীষ্টাব্দ)

(সূত্র: https://en.wikipedia.org/wiki/Mughal_Empire)

আওরঙ্গজেবের শাসনের দ্বাবিংশতিতম বৎসরে তিনি চিতোরের রাণার উপর জিজিয়া কর দিবার জন্য কঠোর ফরমান জারী করেন। এই সময়ে রাজপুতদের বিরুদ্ধে আওরঙ্গজেবের বাহিনীর অনবরত যুদ্ধ লেগে থাকত। মোগল রাজপুত্র মুহাম্মদ আজমকে নির্দেশ দেওয়া হল রাহতোরের রাজপুতদের অঞ্চলে হত্যা, ধ্বংস ও বন্দী করার জন্য। মোগলরা দেশকে বিধ্বস্ত করল, মন্দির ও বাড়ী-ঘর ধ্বংস করল, ফলের গাছগুলিকে কেটে ফেলল, এবং যে সমস্ত নারী ও শিশুরা গর্তে ও ধ্বংসপ্রাপ্ত স্থানে লুকিয়ে ছিল তাদের বন্দী করল।

----------------------------------------

এই সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন মুনতাখাবু’ল লুবাব গ্রন্থের লেখক কাফি খান। তার বিবরণের জন্য দেখুন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৯৯, ৩০০। 

----------------------------------------

মুসলমান ঐতিহাসিকরা শিবাজীর গুণের প্রসংসা করতে কুণ্ঠিত হন নাই। মনতাখাবুল লুবাব গ্রন্থের লেখক কাফি খান লিখেছেন, শিবাজী ভ্রমণকারীদের লুণ্ঠন করে ও মানুষকে কষ্ট দিয়ে বিদ্রোহের পথ বজায় রাখলেও, তিনি অন্যান্য অমর্যাদার কাজ থেকে বিরত থাকতেন। যখন মুসলমান নারী ও শিশুরা তার হাতে পড়ত তিনি তাদের মর্যাদা রক্ষায় সতর্ক থাকতেন।

----------------------------------------

কাফি খান লিখেছেন, “Sivají had always striven to maintain the honour of the people in his territories. He preserved in a course of rebellion, in plundering caravans, and troubling mankind; but he entirely abstained from other disgraceful acts, and was careful to maintain the honour of the women and children of Muhammadans when they fell into his hands. His injunctions upon this point were very strict, and any one who disobeyed them received punishment.” প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৩০৫।

----------------------------------------

এমন নয় যে, হিন্দুরা বা ভারতীয়রা বহিরাগত মুসলমান আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ করে নাই। আওরঙ্গজেবের সময়ে অনেক প্রতিরোধের মধ্যে একটি প্রতিরোধ উল্লেখ করার মত। কাফি খান লিখেছেন, আওরঙ্গজেবের শাসনের ষষ্ঠদশ বৎসরে শতনামী নামে হিন্দু ভক্তদের বিস্ফোরণ ঘটার মাধ্যমে একটি স্মরণীয় ঘটনা ঘটেছিল। তারা মুনদিহ হিসাবেও পরিচিত ছিল। তারা নরনৌল ও মেওয়াট পরগনার গৃহস্থ ছিল, যারা সংখ্যায় ছিল চার বা পাঁচ হাজার। তারা ভক্তদের মত পোষাক পরত, কিন্তু তাসত্ত্বেও তারা কৃষি ও ব্যবসা করত, যদিও তাদের ব্যবসা ছোট আকারের ছিল। বৈধ পেশা ছাড়া তাদের কোনো সম্পদ অর্জন করা নিষেধ ছিল। যদি তাদের উপর কেউ অন্যায় করার চেষ্টা করত বা বলপূর্বক তাদের উপর অত্যাচার করত, তারা সহ্য করত না। তাদের অনেকেরই অস্ত্রশস্ত্র থাকত। যখন আওরঙ্গজেব হাসান আবদালের কাছ থেকে ফিরছিলেন, এক দিন নারনৌলের কাছে এই গোষ্ঠীর একজন যে কৃষি কাজে নিযুক্ত ছিল, তার সাথে অপর একজন ব্যক্তির, যে ফসল তদারকী করছিল, প্রবল বাগবিতণ্ডা হয়। এই ব্যক্তি তার লাঠি দিয়ে শতনামীর মাথা ভেংগে ফেলে। তখন কিছু সংখ্যক শতনামী সেখানে জমায়েত হয়ে প্রহরীটিকে মারধোর করে ও তাকে মৃত হিসাবে ফেলে যায়। যখন শিক্কদারের কাছে খবর পৌঁছায় সে তার লোকদের জমায়েত করে ও সেই সমস্ত শতনামীকে গ্রেফতার করতে পাঠায়। শতনামীরা শিক্কদারের লোকদের উপর আক্রমণ করে তাদের পরাজিত করে ও বহু সংখ্যককে আহত করে এবং তাদের অস্ত্র কেড়ে নেয়। শতনামীদের সংখ্যা বাড়তে থাকে ও পরে নারনৌলের ফৌজদারের কাছে খবর চলে যায়। তিনি তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য ঘোড়া ও পদাতিক বাহিনীর এক বড় সৈন্য বাহিনী পাঠালেন। শতনামীরা এই সৈন্যবাহিনীর সাথেও যুদ্ধ করল এবং তাদের বহু সংখ্যককে আহত ও হত্যা করল এবং বাকীদের বিতাড়িত করল। বিষয়টি গুরুতর আকার ধারণ করে ও আশেপাশের জমিদারদের কাছ থেকে আরো ঘোড়া ও পদাতিক সৈন্য সংগ্রহের জন্য ফৌজদার জমিদারদের সহযোগিতা চাইলেন। এরপর তিনি তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা করলেন ও তাদের অনেককে হত্যা করলেন। কিন্তু তিনি বিতাড়িত হলেন ও পালিয়ে যেতে বাধ্য হলেন। অনেক যুদ্ধের পর ফৌজদার নিহত হন ও নারনৌল শহরটি শতনামীদের হাতে চলে যায়। সম্রাটের কাছে খবর চলে গেলে তিনি একের পর এক সৈন্যবাহিনী পাঠাতে লাগলেন যারা সকলে পরাজিত ও ছত্রভংগ হল। বড় বড় রাজাদের ও প্রবীণ আমীরদের শক্তিশালী সেনাবাহিনী তাদের বিরুদ্ধে পাঠানো হল। কিন্তু বিদ্রোহীরা লড়াই করতে আগ্রহী ছিল ও শেষে দিল্লী থেকে ষোল বা সতর ক্রোশ দূরে পৌঁছাল। অবশেষে রাজা বিশান সিংহ, হামিদ খান, ও অন্যদের নিয়ে প্রচেষ্টার ফলে তাদের বহু সহস্র নিহত হয়, বাকীরা পালিয়ে যায় ও শেষে বিদ্রোহ প্রশমিত হয়। 

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৯৪, ২৯৫, ২৯৬। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ২৯৪, ২৯৫, ২৯৬।

----------------------------------------

পাতা : ২৩

আওরঙ্গজেবের শাসনের পঁয়ত্রিশতম বৎসরে তিনি নির্দেশ জারী করেন যে, অনুমতি ছাড়া কোনো হিন্দু পালকীতে এবং আরবীয় ঘোড়ায় চড়তে পারবে না।

----------------------------------------

ঐতিহাসিক কাফি খান তার মুনতাখাবু’ল লুবাব গ্রন্থে এটি উল্লেখ করেছেন। প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠাঃ ৩৪৩।

----------------------------------------

১৭৩৯ খ্রীষ্টাব্দে পারস্য থেকে নাদির শাহের সেনাবাহিনী মোগল রাজধানী দিল্লী দখল করে। তার যুদ্ধ লব্ধ জিনিসের মধ্যে ছিল কোহিনুর নামে একটি বিখ্যাত হীরা ও মযূর সিংহাসন। দিল্লীতে তিনি সাধারণ গণহত্যার নির্দেশ দেন। ফলে সেখানে এক ভয়াবহ গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুণ্ঠন সংঘটিত হয়, এবং দোকান ও ঘর-বাড়ী পুড়ানো হয়। যখন নাদির শাহ হত্যা ও ধ্বংসকাণ্ড বন্ধ করার নির্দেশ দেন তখন দেখা গেল যে, ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ এর মত পুরুষ, নারী ও শিশু নিহত হয়েছিল।  এই উন্মত্ত হিংস্রতার পর নাদির শাহ বিপুল সম্পদ নিয়ে হাতী ও উটের পিঠে নিজের দেশে নিয়ে যান।  নাদির শাহ ভারতে বহু সংখ্যক ধ্বংসকাণ্ড পরিচালনা করেছিলেন। তার সময়কার ঘটনাবলীর অনেক কিছুর সাক্ষী ঐতিহাসিক আনন্দ রাম মুখলিস লিখেছেন যে, ওয়াযিরাবাদ, ইমনাবাদ ও গুজরাটের মত নগরগুলি মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া হল। কোনো কিছুর প্রতিই ছাড় দেওয়া হল না, সব ধরনের সম্পদ লুণ্ঠনকারীদের হাতে বিনষ্ট হল, এবং নারীরা ধর্ষকদের শিকারে পরিণত হল।

----------------------------------------

  দেখুনঃ Jonathan L. Lee, Afghanistan: A History from 1260 to the Present, Reaktion Books Ltd, London, 2018, pp. 94-95.

ঐতিহাসিক রুস্তম আলী ১৭৪১-৪২ খ্রীষ্টাব্দের দিকে রচিত তারিখ-ই হিন্দী গ্রন্থে এই বিষয়ের বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “Afterwards, Nádir Sháh himself, with the Emperor of Hindústán, entered the fort of Delhí. It is said that he appointed a place on one side in the fort for the residence of Mahammad Sháh and his dependents, and on the other side he chose the Díwan-i Khás, or, as some say, the Garden of Hayát Bakhsh, for his own accommodation. He sent to the Emperor of Hindústán, as to a prisoner, some food and wine from his own table. One Friday, his own name was read in the khutba, but on the next he ordered Muhammad Sháh’s name to be read. It is related that one day a rumour spread in the city that Nádir Sháh had been slain in the fort. This produced a general confusion, and the people of the city destroyed five thousand men of his camp. On hearing of this, Nádir Sháh came of the fort, sat in the golden masjid which was built by Roshanu-d daula, and gave orders for a general massacre. For nine hours an indiscriminate slaughter of all and of every degree was committed. It is said that the number of those who were slain amounted to one hundred thousand. The losses and calamities of the people of Delhí were exceedingly great.

After this violence and cruelty, Nádir Sháh collected immense riches, which he began to send to his country laden on elephants and camels.” দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. VIII, 1877, p. 64.

আনন্দ রাম মুখলিস তার তাযকিরা গ্রন্থে লিখেছেন, “On the 4th of Shawwál the Persian army crossed the Attock river on a bridge of boats. On the 8th the Emperor reached the left bank of the Chináb river, and on the 9th encamped close to the bridge of Sháh-daula.

But how to relate the ruin and desolation that overwhelmed this beautiful country! Wazírábád, Ímanábád, and Gujarát, towns which, for population, might almost be called cities, were levelled with the earth. Nothing was respected, no sort of violence remained unpracticed; property of all kinds became the spoil of the plunderer, and women the prey of the ravisher.” দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. VIII, p. 80.

----------------------------------------

নাদির শাহের ৪০০০ আফগান দেহরক্ষীর সেনাপতি ছিলেন আহমদ খান আবদালী, যিনি নাদির শাহের মৃত্যুর পর কান্দাহারে ফিরে আসেন ও গোত্রীয় পরিষদে শাহ নির্বাচিত হন। ১৭৪৮ খ্রীষ্টাব্দে আহমদ শাহ আবদালী মোগলদের পরাজিত করে লাহোর জয় করেন ও ব্যাপক লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করেন। এই সময় তিনি হাজার হাজার নারী ও শিশুদের বন্দী করে দাস করেন ও হাজার হাজার পাঞ্জাবী পুরুষদের তার সৈন্যবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেন। এরপর আবদালী গুরুত্বপূর্ণ শহর সিরহিন্দ অধিকার করেন ও সেখানে ব্যাপক লুণ্ঠন পরিচালনা করেন। সেখানকার অধিকাংশ পুরুষ অধিবাসীদের এবং নারী ও শিশুদের দাস করা হয়। এখানে মোগল সেনাবাহিনীর সমস্ত সম্পদ তাদের হাতে চলে যায়। এখানে বহু সংখ্যক মুসলিম অধিবাসী থাকার পরেও আবদালীর বাহিনী এখানে লুণ্ঠন পরিচালনা করে। তিন বৎসর পর আবদালীর বাহিনী দ্বিতীয়বার লাহোরে গণহত্যা চালায় ও লুণ্ঠন পরিচালনা করে।

----------------------------------------

দেখুনঃ Jonathan L. Lee, Afghanistan: A History from 1260 to the Present, p. 121.

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২১।

----------------------------------------

১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের জানুয়ারী মাসে আহমদ শাহ দিল্লীর গেটে এসে উপস্থিত হন। তিনি ইতিমধ্যে মোগল বাদশাহ আলমগীর ২-কে একটি তালিকা দেন যেখানে ২ কোটি রুপি প্রদান, সম্রাটের কন্যাকে বিবাহে সম্মতি এবং কাশ্মীর ও সিরহিন্দের উত্তরে সকল মোগল অঞ্চল হস্তান্তরের কথা উল্লেখ ছিল। যদি তার শর্ত পালন না করা হয় সেক্ষেত্রে তিনি দিল্লী লুণ্ঠনের হুমকি দেন। আলমগীর ২ আহমদ শাহের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করলে অনেকটা শান্তিপূর্ণভাবে আহমদ শাহ দিল্লী প্রবেশ করেন। তিনি আলমগীর ২-কে সিংহাসনে থাকার অনুমতি দিলেও মূল ক্ষমতা আহমদ শাহের হাতে থাকল। কিছুদিনের মধ্যেই আহমদ শাহ মোগলদের ধর্মীয় সহনশীলতার দীর্ঘ ঐতিহ্যকে ভেংগে ফেললেন ও অমুসলিমদের পাগড়ী ও অন্যান্য ইসলামিক পোষাক পরার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেন। তিনি আদেশ দিলেন যে, হিন্দুরা কপালে একটি পৃথক চিহ্ন ব্যবহার করবে। আহমদ শাহ তার সৈন্যদের বেতন দিবার জন্য মোগল রাজকোষ থেকে নিযুত পরিমাণ রুপি চাইলেন, কিন্তু মোগল রাজকোষ তখন শূন্য। তিনি পারিষদ, বণিক ও প্রতিটি গৃহ থেকে খাজনা আদায়ের উদ্যোগ নিলেন ও এর জন্য মানুষের উপর ভয়ানক অত্যাচার করলেন। দিল্লীর উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পর এবার তিনি জাঠদের অঞ্চলের প্রতি মনোযোগ দিলেন, যেগুলি দিল্লীর দক্ষিণ ও পূর্বে ছিল। তিনি ফরিদাবাদ দুর্গ আগুন ও তরবারির মুখে ধ্বংস করলেন।

আফগান সেনানায়ক সরদার জাহান খান বল্লভগড় ও এর আশেপাশের অঞ্চল লুণ্ঠন ও ধ্বংস করেন। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে জাহান খান হিন্দুদের পবিত্র নগর মথুরা আক্রমণ করেন। এই নগরের অধিবাসীরা প্রধানত ছিল ধর্মীয় সাধু, ব্রাহ্মণ, পুরোহিত ও তীর্থযাত্রী, যারা যুদ্ধ করতে অপারগ ছিল। এর পরেও জাহান খানের সৈন্যরা সেখানকার সাধু, ব্রাহ্মণ ও পুরাহিতদের উপর হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করল ও তাদের মৃতদেহের মুখের ভিতর গরুর মাংসের টুকরা প্রবেশ করিয়ে মৃতদেহকে কলুষিত করল। নগরের মন্দিরগুলি পুড়ানো হল ও মূর্তিগুলি চূর্ণ-বিচূর্ণ করা হল। হাজার-হাজার হিন্দু পুরুষ, নারী ও শিশুকে হত্যা করে শিরশ্ছেদ করা হল। এমনকি নগরের মুসলিম অধিবাসীরাও এই হত্যাযজ্ঞ থেকে রেহাই পায় নাই। পার্শ্ববর্তী যমুনা নদীর জল প্রবাহ এর পরের সাত দিন মানুষের রক্তে লাল বর্ণ ধারণ করেছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৪, ১২৫।

----------------------------------------

মথুরার গণহত্যার পর সরদার জাহান খানের হাতে হিন্দুদের নিকট আরেকটি পবিত্র স্থান বৃন্দাবনের একই পরিণতি হয়। এরপর জাহান খানের বাহিনী আগ্রার সৈন্য-সরবরাহের প্রধান একজন মুসলমান হবার পরেও আগ্রার উপর উন্মত্ত গণহত্যা ও লুটতরাজ চালায়। ইতিমধ্যে আহমদ শাহ আবদালী গোকুল নামে ভিন্ন ধরনের এক হিন্দু ধর্মীয় কেন্দ্রের দিকে অভিযান পরিচালনা করেন। গোকুল ছিল হিন্দুদের ভক্তি শাখার নাঙ্গা সাধুদের কেন্দ্র যারা সামরিক শৌর্যের জন্য বিখ্যাত ছিল। সেনাবাহিনী শহরের দিকে আসলে হাজার-হাজার নগ্ন, শরীরে ছাই মাখা সাধুরা নিজেদের জীবনের মায়া না করে আক্রমণকারীদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ফলস্বরূপ আহমদ শাহ পরাজয় স্বীকার করেন ও গোকুল গণহত্যা ও লুটতরাজ থেকে রক্ষা পায়।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৫।

----------------------------------------

পাতা : ২৪

আহমদ শাহের ভারত অভিযানে এত লুণ্ঠিত মালামাল হয় যে, লুণ্ঠিত জিনিসপত্র নিবার জন্য ২৮,০০০ ভারবাহী পশু যোগাড় করা হয়েছিল, যার মধ্যে শতাধিক হাতী ছিল। এমনকি অশ্বারোহী বাহিনী থেকে ঘোড়াও এই সমস্ত অভিযানে লুণ্ঠিত মালামাল নিবার কাজে ব্যবহার করা হয়। তার ফিরবার পথে শিখদের অশ্বারোহী বাহিনী তার সেনাবাহিনীর পার্শ্বদেশে আক্রমণ করে। আহমদ শাহ সরদার জাহান খানকে শিখদের পবিত্র নগর কার্তারপুর আক্রমণ ও লুণ্ঠনের জন্য পাঠান। আফগান বাহিনী সেখানে মন্দির ও গুরুদুয়ারসমূহ অপবিত্র করে ও সেখানকার নাগরিকদের উপর হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করে। এরপর তিনি আরেকটি বাহিনীকে শিখদের পবিত্র নগর অমৃতসর আক্রমণ করতে পাঠান যার পরিণতি একই রকম হয়।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৬।

----------------------------------------

১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে পানিপথের যুদ্ধে মারাঠারা আহমদ শাহের কাছে পরাজিত হলে আফগানরা হাজার-হাজার যুদ্ধ-বন্দীকে শিরশ্ছেদ করে, এমনকি যারা আত্মসমর্পণ করেছিল তাদেরও। মূল যুদ্ধের পরে পানিপথের দুর্গ লুণ্ঠনের সময় আহমদ শাহের বাহিনীর সৈন্যরা চৌদ্দ বৎসর বয়সের উপরে প্রতিটি পুরুষকে শিরশ্ছেদ করে এবং শহরের নারী ও শিশুদের দাস হিসাবে বন্দী করে। যখন আহমদ শাহ বিজয়ীর বেশে রক্ত-ভেজা রাস্তার উপর দিয়ে ঘোড়ায় চড়ে নগরে প্রবেশ করলেন তিনি কোহিনুর হীরা দ্বারা অলংকৃত পোশাক পরেছিলেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৭, ১২৮।

----------------------------------------

       অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে পারস্য ও ভারতীয় সীমানা জুড়ে সাম্রাজ্যসমূহ

  (সৌজন্যেঃ Jonathan L. Lee, Afghanistan: A History from 1260 to the Present, 2018)

কান্দাহারে বিদ্রোহের খবর পাওয়াতে আহমদ শাহ সেনাবাহিনীকে নিয়ে পেশোয়ারে ফিরে যান এবং বিদ্রোহ দমনের জন্য সেখান থেকে সেনাবাহিনীর একটি অংশকে কান্দাহারে পাঠান। পাঞ্জাবের মধ্য দিয়ে যখন তার সেনাবাহিনী অতিক্রম করছিল শিখ অশ্বারোহী বাহিনী পুনরায় তাদের আক্রমণ করতে থাকল। ১৭৬১ খ্রীষ্টাব্দে শিখ সেনাবাহিনী চাহার মহলে অবস্থিত আহমদ শাহের গভর্নরের একটি বাহিনীকে নির্মূল করে। কান্দাহার থেকে পাঠানো সাহায্যকারী বাহিনীকে তারা পরাজিত করে ও আত্মসমর্পন করতে বাধ্য করে। এরপর শিখরা পাঞ্জাব অধিকার করে। মারাঠাদের পরাজিত করার কয়েক মাসের মধ্যেই এভাবে আহমদ শাহ আবদালী নূতন ও ভয়ংকর একটি শক্তি শিখদের কাছে পাঞ্জাবের অধিকার হারান।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৮।

----------------------------------------

কান্দাহারের বিদ্রোহ দমনের পর আহমদ শাহ পাঞ্জাবে ফিরে আসেন। মালেরকোটলার গভর্নর আহমদ শাহকে জানান যে, শিখ সেনাবাহিনীর পরিবার ও সৈন্যদলের অসামরিক লোকজন নিকটে শিবির স্থাপন করেছে। আহমদ শাহের সেনাবাহিনী তাদের ঘিরে ফেলে ও আহমদ শাহ সৈন্যদের নির্দেশ দেন যেন সেখানে ভারতীয় পোষাক পরিধানকারী একজনও বাঁচতে না পারে। শিখ রক্ষীদের একটি ছোট দল অসামরিক অপ্রতিরোধী মানুষদের শিবিরকে ঘিরে রাখে ও লড়াই করে শেষ ব্যক্তি পর্যন্ত মৃত্যু বরণ করে। দশ ঘন্টা পর আহমদ শাহ গণহত্যা বন্ধের আদেশ দেন। শিখ ঐতিহাসিকরা বলেন যে, এই গণহত্যায় প্রধানত নারী, শিশু, বৃদ্ধ ও সৈন্যদলের অসামরিক লোকজন মিলিয়ে ১০,০০০ থেকে ৩০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছিল। এই গণহত্যাকে শিখরা ওয়াড্ডা গলুঘরা (Wadda Ghalughara) বা বৃহৎ গণহত্যা নামে আজও স্মরণ করে।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৮।

----------------------------------------

পাতা : ২৫

এরপর আহমদ শাহ শিখদের নববর্ষের অল্প কিছু দিন পূর্বে অমৃতসরে আরেকটি গণহত্যা চালান। সেই সময় শিখদের স্বর্ণমন্দির অপবিত্র করা হয় ও গরুর মৃতদেহ শিখদের পবিত্র হ্রদে নিক্ষেপ করা হয়। এরপর মন্দির ও গুরুদুয়ারের ধ্বংসাবশেষ দিয়ে সেটি পূর্ণ করা হয়। এই সমস্ত গণহত্যার পরেও শিখ সেনাবাহিনী পুনরুজ্জীবিত হয় এবং কয়েক মাস পর আহমদ শাহ তার সেনাবাহিনী পুনরুজ্জীবিত করার জন্য কাশ্মীরে সরিয়ে নিয়ে যান। এই সময় শিখরা সিরহিন্দ ও জলন্ধর দুয়াবা এবং লাহোরের দূরবর্তী অঞ্চল সমূহে আক্রমণ পরিচালনা করে। ১৭৬২-র অক্টোবর মাসে আহমদ শাহ দেওয়ালী উৎসবের আগের দিন আবার অমৃতসর আক্রমণ করেন। কিন্তু এই সময় শিখরা যুদ্ধে জিতে যায়। এই সময়ে কান্দাহারে আবার বিদ্রোহের খবর পেলে তিনি তার বাহিনীকে সেখানে ফিরে যেতে নির্দেশ দেন। পাঞ্জাব পুনরায় শিখদের অধীনস্থ হয়। পরের বৎসর সরদার জাহান খান তার ছেড়ে যাওয়া এলাকা পুনর্দখল করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ১৭৬৩ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে গুজরানওয়ালায় জাহান খান ব্যাপক পরাজয় বরণ করেন। এরপর শিখরা মালেরকোটলা ও মরিনযায় লুণ্ঠন চালায়। পরের বৎসর জানুয়ারী মাসে সিরহিন্দের গভর্নর যইন খান যাকে শিখরা ওয়াড্ডা গলুঘরা হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী করেছিল, তাকে পরাজিত করে ও হত্যা করে। এরপর শিখরা সিরহিন্দের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ও এর লোকজনকে হত্যা করে ও বাড়ীঘর পুড়িয়ে দেয়। লাহোরকে একই ভাগ্য থেকে রক্ষা করার জন্য এর গভর্নর কর দিতে রাজী হন ও শিখ অধীনতা স্বীকার করেন। এরপর শিখরা অজেয় বলে পরিচিত রোহতাস দুর্গ অবরোধ করলে তার পতন ঘটে। এরপর শিখদের দিক থেকে আরো ভয়ানক আঘাত আসে মুলতানের পতনের মধ্য দিয়ে। এমনকি শিখরা ডেরা ইসমাইল খান ও ডেরা গাজী খানের মত দূরাঞ্চলের শত্রু ঘাটিগুলি অধিকার করে।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৮, ১২৯।

----------------------------------------

এই বিপর্যয়ের খবর শুনার পর আহমদ শাহ আবদালী রাগে জ্বলে উঠলেন ও কালাতের নাসির খানকে চিঠি লিখে তাকে এই অবিশ্বাসী গোষ্ঠীকে ধ্বংস করতে ও তাদের নারী ও শিশুদের বন্দী করে দাসত্বের অধীনে নিতে এক জিহাদে যোগ দিতে বললেন। ১৭৬৪ খ্রীষ্টাব্দে আহমদ শাহ পাঞ্জাবে ফিরে এলেন। কিন্তু জিহাদ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হল। লাহোরের বাইরে ওৎ পেতে থাকা শিখদের আক্রমণে তাদের অগ্রবর্তী সেনাদল ছত্রভংগ হয়ে যায় ও নাসির খান অল্পের জন্য রক্ষা পান। এরপর শিখরা জঙ্গলে পশ্চাদপসরণ করে। আহমদ শাহের সেনাবাহিনী তখন অমৃতসরে তৃতীয়বার লুণ্ঠন অভিযান চালায় ও সেখানকার মন্দিরকে অপবিত্র করে। এরপর শিখরা আফগান সেনাবাহিনীর পার্শ্বদেশে আক্রমণাভিযান চালিয়ে যায়। আহমদ শাহ সিরহিন্দের দিকে বাহিনী চালনা করেন ও পথে যা কিছু ছিল তার বাহিনী সমস্ত লুণ্ঠন ও ধ্বংস করে। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী মাসে তার বাহিনী আরো অভিযান করতে অস্বীকার করে। তাদের বেতন বাকী পড়েছিল। এছাড়াও আহমদ শাহের বিরতিহীন অভিযান তার উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি সৃষ্টি করে। বিদ্রোহের ভয়ে আহমদ শাহ লাহোরে যাবার প্রস্তুতি নেন। লাহোরে পৌঁছে তার বাহিনী ক্লান্ত হয়ে পড়ে। কিন্তু তিনি তার বাহিনীকে বিশ্রামের সুযোগ না দিয়ে সিন্ধু নদীর দিকে যাত্রা করতে নির্দেশ দেন। ভুল জায়গায় চেনাব নদী পার হতে গিয়ে তার বাহিনীর হাজার হাজার সৈন্য জলে ডুবে বা নদীতে ভেসে গিয়ে মারা যায়। তার অবশিষ্ট বাহিনী সিন্ধু নদী অতিক্রম করলে শিখদের বাহিনী পুনরায় পাঞ্জাবের বিভিন্ন অঞ্চল অধিকার করে। ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দের এপ্রিলে শিখ বাহিনী লাহোর অধিকার করে। ১৭৬৬ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে আহমদ শাহ উত্তর ভারতে শেষ অভিযান পরিচালনা করেন। সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্য তিনি লাহোর অধিকার করেন ও অমৃতসর অবরোধ করেন। আফগানদের পাঞ্জাবের অভ্যন্তরে টেনে নিয়ে এসে শিখরা তাদের সরবরাহ পথ বন্ধ করে দেয়। এরপর শিখদের স্তম্ভাকারে সজ্জিত সৈন্যদল আহমদ শাহের বাহিনীর পশ্চাদপসরণের পথ কেটে দিয়ে তাদের বাধ্য করে মুখোমুখি লড়াই করার জন্য। সফলভাবে আফগান বাহিনীকে দুইভাগে বিভক্ত করার পর শিখ সৈন্যরা সরদার জাহান খানকে আক্রমণ করে পরাজিত করে। তার বাহিনীর এই সমস্ত বিপর্যয় সত্তেও আহমদ শাহ দিল্লীর দিকে অগ্রসর হবার জন্য গোঁ ধরেন। কিন্তু তার পরাজয়ের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে একের এক প্রদেশ খাজনা দিতে, কর অথবা সৈন্য সরবরাহ করতে অস্বীকার করে। আরেকটি বিদ্রোহের আশংকায় দিল্লী যাবার সংকল্প ত্যাগ করে তিনি মুলতানে ফিরে যান।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৯. ১৩০।

----------------------------------------

প্রাক-মুসলিম ভারতে যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য

এটি খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে, যুদ্ধ করে ভারতবর্ষের বাইরে পররাজ্য দখল ভারতবাসীদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য ছিল না। এই কারণে ভারতবর্ষের ভিতর তাদের নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ সীমাবদ্ধ থেকেছে প্রায় সব সময়। আফগানিস্তান সিন্ধু সভ্যতার সময় থেকেই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সীমার মধ্যে ছিল। এই জন্য আফগানিস্তানকে অশোকের সাম্রাজ্যের অধিকারভুক্ত করা এই নীতির বাইরে ছিল না। ভারতবর্ষের অধিবাসীরা যে জাভা, সুমাত্রা, ইন্দোচীনে রাজ্য স্থাপন করেছিল সেটা ছিল মূলত বসতি স্বরূপ উপনিবেশ স্থাপন। পরে অবশ্য তারা রাষ্ট্র ক্ষমতা অধিকার করে।

সুপ্রাচীনকাল থেকে ভারতবর্ষে যুদ্ধে রক্তপাত ও নিষ্ঠুরতাকে যথাসম্ভব এড়িয়ে চলা হত। মৌর্য সম্রাট অশোকের কলিঙ্গ যুদ্ধের সময় রক্তপাত ও নিষ্ঠুরতার ঘটনা ছিল অনেকটা ব্যতিক্রমী ঘটনা। এটাও নিশ্চয় লক্ষ্যণীয় যে, এই যুদ্ধের হত্যা ও নিষ্ঠুরতা সম্রাট অশোকের জীবনধারাকে সম্পূর্ণ বদলে ফেলে। আত্মগ্লানি ও অনুশোচনার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ ক’রে বাকী জীবন শান্তি ও অহিংসার বাণী প্রচারে আত্মনিয়োগ করেন। যাইহোক, ঐতিহাসিক দলিলাদি থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী  ভারতবর্ষে যুদ্ধে সচরাচর বাড়াবাড়ি রকম নিষ্ঠুরতা দেখা যেত না।

যুদ্ধাভিযান পরিচালনার সময়ে মুসলমানরা যে ভয়ংকর বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা করত তার বিপরীতে এখানে ভারতীয় রাজারা তাদের সেনাবাহিনীকে পরিচালনা করত প্রতিপক্ষের সেনাবাহিনী ও রাজাকে পরাজিত করার জন্য; তারা তাদের অসামরিক জনসাধারণের উপর হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করত না বা সাধারণ মানুষের ধন-সম্পদ লুটতরাজ করত না। প্রাচীন ভারতীয় সকল সাহিত্য ও অন্যান্য দলিলাদি এর সপক্ষে সাক্ষ্য উপস্থিত করে। ঐতিহাসিক কাব্য গৌড়বহ-এর লেখক বাকপতি রাজা যশোবর্মার বীরত্বগাথা বর্ণনা করতে গিয়ে তার অনেক যুদ্ধের বিবরণ দিয়েছেন। সেখানে শত্রুপক্ষের সৈন্যদের হত্যার কথা বলেছেন, কিন্তু শত্রুপক্ষের সাধারণ মানুষের সম্পদ লুন্ঠন, বাড়ী-ঘর ও সম্পদ ধ্বংস, নারী অপহরণ ও ধর্ষণ ইত্যাদির কথা কোথায়ও উল্লেখ করেন নাই। এমন কি ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে সামরিক অভিযানের বর্ণনার সাথে লেখক বিজিত রাজ্যে গ্রামীণ মানুষের জীবন ও উৎসবের বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, ‘গ্রামের উৎসবের দিনগুলি হল খুশীর, যখন শিশুদের সাজানো হয়, যখন নারীরা নূতন রং করা শাড়ী পরে গর্বে পূর্ণ হয়, এবং যখন অজ্ঞ গ্রামবাসীরা নিশ্চল দাঁড়িয়ে খেলাগুলি উপভোগ করে।’  ভারতবর্ষের যুদ্ধের সাধারণ বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যতই রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হোক না কেন সাধারণ মানুষজন এই সমস্ত যুদ্ধের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হত না।

----------------------------------------

দেখুনঃ Shankar Pandurang Pandit (ed.), The Gaüḍavaho, A Prakrit Historical Poem by Vâkpati, Re-edited for the Second Edition by Narayan Bapuji Utgikar, Bhandarkar Oriental Research Institute, Poona, 1927, p. xxx.

----------------------------------------

ভিন্ন রাজার কাছে পরাজিত হলে পরাজিত রাজারা আনুগত্য স্বীকার করত ও বিজয়ী রাজাকে সাধারণত বাৎসরিক খাজনা বা কর দিত। সিরুর লিপিমালা থেকে জানা যায় যে, অঙ্গ, বঙ্গ ও মগধ রাষ্ট্রকুট রাজা অমোঘবর্ষকে (৮১৪-৮৮০ খ্রীষ্টাব্দ) অনুগত্য প্রদান করেছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ R.C. Majumder (ed.), The History of Bengal, Vol, I, Hindu Period, Published by the University of Dacca, Dacca, First edition 1943, p. 127.

----------------------------------------

পাতা : ২৬

পাল রাজা ধর্মপাল তার সাম্রাজ্য পশ্চিমে পাঞ্জাব, পূর্বে রাজপুতানা, মালওয়া ও বেরার পর্যন্ত বিস্তার করেছিলেন। এই সবগুলিই সামরিক অভিযানের ফলে তার অধীনে এসেছিল। এছাড়া পশ্চিম হিমালয়ের কেদার পর্যন্ত তার সাম্রাজ্যের সীমা ছিল। এই বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ যে, ধর্মপালের সাম্রাজ্য মৌর্য বা গুপ্ত এমন কি পরবর্তী প্রতিহারদের মত ছিল না। তার অধীন সামন্ত রাজ্য সমূহ তার সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে যেত না। যতদিন পর্যন্ত পরাজিত শাসকরা তার সাম্রাজ্যের আনুগত্য স্বীকার করত এবং প্রথা বা চুক্তি অনুযায়ী স্বীকৃতি দিত ও সামরিক সহযোগিতা প্রদান করত ততদিন তাদের নিরুপদ্রব রাখা হত।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৯।

----------------------------------------

ভারতবর্ষের রাজাদের আরেকটি বৈশিষ্ট্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। রাজাদের যুদ্ধজয়ের পর পরাজিত রাজ্যের স্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ দেব-দেবীদের তারা পুজা করত বা সম্মান করত। এমন বিবরণ পাওয়া যায় অনেক যুদ্ধ জয়ের গৌরবের অধিকারী বীর রাজা যশোবর্মা সম্পর্কে। গৌড়বহ গ্রন্থে বাকপতি লিখেছেন যে, যশোবর্মা সোন উপত্যকা হয়ে বিন্ধ্য পর্বতমালার দিকে অগ্রসর হয়ে, প্রসিদ্ধ অনার্য (হিন্দু ধর্মের নয় এমন অর্থে, অর্থাৎ স্থানীয় ও আদিম অধিবাসী) বিন্ধ্যবাসিনী দেবী বা বিন্ধ্য অঞ্চলের অধিবাসী দেবীর মন্দিরে যান। এই দেবীর আসন বহু শতাব্দী আগে থেকে বিন্ধ্যর উত্তরের ঢালু অঞ্চলে প্রতিষ্ঠিত। রাজা এই দেবীর প্রতি বাহান্নটি শ্লোকের স্তোত্র অর্পণ করলেন। এছাড়াও যশোবর্মা ও তার যোদ্ধাবাহিনী বিন্ধ্য অঞ্চলের বিখ্যাত অনার্য দেবী কালী দেবীর মন্দির দর্শন করেছিলেন। এই মন্দিরে মানুষ বলি দেওয়ার কথা বাকপতি উল্লেখ করেছেন। রাজা যশোবর্মা এই দেবীর প্রতি নির্দিষ্ট আনুষ্ঠানিকতার সাথে তার শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিলেন। ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণকারীদের আগমনের পূর্ব পর্যন্ত অপর জনগোষ্ঠীর ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন এখানকার স্বাভাবিক ও প্রচলিত রীতি ছিল। এরপর মুসলিমরা এই রীতির লঙ্ঘন ঘটায়।

----------------------------------------

যশোবর্মন বা যশোবর্মা ছিলেন খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীতে রাজপুতদের একটি গোত্র চন্দেল্লাদের রাজা। জানা যায় যে, তিনি সমগ্র উত্তর ভারতে সামরিক অভিযান পরিচালনা করেন এবং হিমালয় থেকে মালওয়া ও কাশ্মীর থেকে বাংলা পর্যন্ত সমগ্র অঞ্চলের উপর কর্তৃত্ব স্থাপন করেন।

দেখুনঃ Shankar Pandurang Pandit (ed.), The Gaüḍavaho, 1927, p. xxi, xxii, xxiii.

----------------------------------------

ভারতবর্ষে আসা আরব ভ্রমণকারীরাও ভারতবর্ষের এই বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করেছিলেন যে, রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ হলেও সাধারণ মানুষদের কোনো ক্ষতি করা হয় না। নবম শতাব্দীর আরব বণিক ও পরিব্রাজক সুলায়মান লিখেছেন যে, ভারতীয় রাজারা বিজয়ের জন্য যুদ্ধে যায়, কিন্তু এই ধরনের ঘটনা খুব কম। তিনি আরো লিখেছেন, এমন তিনি কখনো দেখেন নাই যে একটি দেশের লোকজন অপর দেশের কর্তৃত্বের প্রতি আনুগত্য দেখিয়েছে। একজন রাজা যখন প্রতিবেশী কোনো রাজ্যকে অধীন করেন তখন তিনি পরাজিত রাজার পরিবার থেকে অন্য এমন কাউকে সিংহাসনে বসান যিনি বিজয়ী রাজার পক্ষ থেকে রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। সেখানকার অধিবাসীদের এর জন্য কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। প্রাচীন ও মধ্যযুগে ভারতবর্ষের রাজারা যে সাম্রাজ্য বিস্তার করেছিলেন, কম ক্ষেত্রেই বিজিত অঞ্চলকে নিজ  কেন্দ্রীভূত সাম্রাজ্যের  অন্তর্ভুক্ত করতেন। এটাই সাধারণ নিয়ম ছিল যে, পরাজিত রাজারা বা তাদের পরিবারের অন্য কেউ কেবলমাত্র নির্দিষ্ট করের বিনিময়ে শাসন করার অনুমতি পেতেন। ভারতবর্ষে প্রতিহার বা রাষ্ট্রকূট সাম্রাজ্যের মত অনেক সাম্রাজ্য এবং বাংলার বিখ্যাত পাল সাম্রাজ্যের ক্ষেত্রে এমনটা ঘটেছিল। ১১শ ও ১২শ শতাব্দীতে কনৌজের গাহরবাল রাজবংশের রাজারা হিন্দু ধর্মের প্রতি ভক্তিযুক্ত ছিলেন। কিন্তু তাদেরও ভিন্ন ধর্মের প্রতি সহনশীলতা দেখা গেছে। এই বংশের বিখ্যাত রাজা গোবিন্দচন্দ্রের রাণীদের মধ্যে দুই জন রাণী বৌদ্ধ ছিলেন বলে জানা যায়। রাণীরা যে শুধু তাদের নিজস্ব ধর্মীয় বিশ্বাস অনুসরণ করতে পারতেন, তাই নয় এর প্রতি পৃষ্টপোষকতাও দিতে পারতেন। গাহরবাল রাজবংশের রাজারা মুসলমানদের প্রতিও সহনশীল ছিলেন। কামিলু’ত তাওয়ারিখ-এর লেখক ইবনে আসির লিখেছেন যে, মাহমুদ বিন সবুক্তগীনের সময় থেকেই সেই দেশে অনেক মুসলমান বাস করত, যারা ইসলাম ধর্ম পালন করে আসছিল। এই তথ্য থেকে এই বিষয়টি পরিষ্কার যে, বহিরাগত মুসলমান আক্রমণকারীরা হিন্দুদের উপর এত ভয়ংকর হত্যাযজ্ঞ, লুণ্ঠন, দাসকরণ ও ধর্ষণ পরিচালনা করার পরেও হিন্দুদের রাজত্বে মুসলমানদের শাস্তি দেওয়া দূরে থাক বরং তাদেরকে নিজ ধর্ম বাধাহীনভাবে পালন করতে দেওয়া হত।  

----------------------------------------

সুলায়মান বর্ণিত বিবরণটি এই রকম, “The Wars they wage with the neighbouring Princes, are not usually undertaken with a view to possess themselves of the adjoining Dominions; and I never heard of any, but the People bordering upon the Pepper Country, that have seized on the Possessions of their Neighbours after a Victory. When a Price makes himself Master of some Kingdom, he confers the Government thereof upon some Person of the Royal Family of the conquered Country, and thus he keeps it in Subjection to himself, apprehending the Natives would never agree to be otherwise governed. “ দেখুনঃ Eusebius Renaudot, Ancient Accounts of India and China, by Two Mohammedan Travellers, Translated from the Arabic, London, M DCC XXXIII (1733), p. 33.

ইলিয়ট ও ডোসন শেষ বাক্যটির কিছুটা ভিন্ন অনুবাদ করেছেন। তারা লিখেছেন, “When a king subdues a neighbouring state, he places over it a man belonging to the family of the fallen prince, who carries on the government in the name of the conqueror. The inhabitants would not suffer it to be otherwise.”  দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. I, p. 7.

এই বিষয়ে History of Mediaeval Hindu India-গ্রন্থের লেখক C.V. Vaidya-এর মন্তব্যটি উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, “We have often laid emphasis on the fact that in Ancient or Mediaeval Hindu India empire never meant annexation. The conquered king was allowed to rule or some one belonging to his family as before, subject only to payment of some tribute. Thus within the Kanauj empire of the Pratihāras we find some inscriptions that there were many subordinate kingdoms like the Chāvotakas of Wadhwan or the Chālukyas of Bhārapa. And in the same way, under the Rāshṭrakūṭas there were many subordinate kings as even Arab writers state.”  দেখুনঃ C.V. Vaidya, History of Mediaeval Hindu India, Vol. II, First published 1924, reprinted 1979, Cosmo Publications, New Delhi, p. 221.    

দেখুনঃ Roma Niyogi, The History of the Gāhaḍavāla Dynasty, Calcutta Oriental Book Agency, Calcutta, 1959, pp. 198, 199.

দেখুনঃ Elliot and Dowson, The History of India, as Told by its Own Historians: The Muhammadan Period, Vol. II, p. 251.

----------------------------------------

পাতা : ২৭

অবশ্য ভারতবর্ষে যুদ্ধে লুণ্ঠন ছিল না, তা নয়। তবে সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী তা কেবলমাত্র প্রতিপক্ষ রাজার বা তার রাজধানীর সম্পদ লুণ্ঠনের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকত। সেক্ষেত্রেও তারা সাধারণ মানুষের সম্পদ লুণ্ঠন করত না। বলা হয়ে থাকে যে, দাহলের কালাচুরী রাজা কোক্কল ১ সামরিক অভিযানে বঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যের সম্পদ লুণ্ঠন করেছিলেন। এছাড়া ৯১৫ ও ৯১৭ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে মহেন্দ্রপালের পুত্র প্রতিহার রাজা মহিপাল রাষ্ট্রকুটদের দ্বারা বিপর্যয়করভাবে পরাজিত হলে তার রাজধানী লুণ্ঠন করা হয়।

----------------------------------------

দেখুনঃ R.C. Majumder (ed.), The History of Bengal , Vol, I, p. 128

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৩০।

----------------------------------------

মধ্য প্রদেশের জবলপুর জেলার বিলহরি প্রস্তর-লিপি থেকে খ্রীষ্টীয় দশম শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে কালাচুরী রাজাদের কিছু বিষয় জানা যায় যা ভারতবর্ষের সাধারণ বৈশিষ্ট্য হিসাবে অন্য কোথায়ও দেখা যায় না। পদ্যাকারে লিখিত প্রস্তর-লিপিটি দুই জন কবির রচনা। সেখানে বলা হয়েছে, সামরিক অভিযানে কালাচুরী-রাজ যুবরাজদেব পশ্চিম-সমুদ্রের তীরে পৌঁছেছিলেন ও সেখানে তিনি গুজরাটের বিখ্যাত সোমেশ্বর বা সোমনাথ মন্দিরে পূজা দেন। এছাড়া আরো বলা হয়েছে যে, তিনি কোশলের শাসককে পরাজিত করেন, ও তাকে কালিয়দের (Kâliya) একটি মূল্যবান প্রতিকৃতি থেকে বঞ্চিত করেন যা তারা প্রভু ওড্রের কাছ থেকে অর্জন করেছিল। তবে কবিদের একটি বর্ণনা থেকে মনে হয় এই রাজা যুদ্ধে পরাজিত অঞ্চলের নারীদের যুদ্ধ-বন্দী করেছিল। এছাড়া আরো একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়, চোল সম্রাট রাজেন্দ্র চোলের একাদশ খ্রীষ্টাব্দের প্রথমার্ধে দাক্ষিণাত্য ও বাংলা অঞ্চলে অভিযান প্রসঙ্গে। তামিল গ্রন্থ প্রসস্তি-তে বলা হয়েছে, তিনি মদুর-মণ্ডলম নামে একটি নগর (দক্ষিণ ভারতের কোনো একটি নগর) মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংস করেন ও বঙ্গাল-দেশের গোবিন্দচন্দ্রকে পরাজিত করে উত্তর রাঢ় দখল করেন ও পরে মহিপালকে পরাজিত করেন। সেখানে নারী ও ধন-সম্পদ অধিকার করেন বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কালাচুরী রাজা কর্ণ খ্রীষ্টীয় একাদশ শতাব্দীতে মগধ আক্রমণ করলে প্রথমে ন্যায়পালকে পরাজিত করেন। বলা হয় যে, কর্ণের সেনাবাহিনী নগরটি অধিকার করতে ব্যর্থ হয়ে বৌদ্ধ পবিত্র প্রতিষ্ঠানসমূহ লুণ্ঠন করে, এবং এমনকি মঠের আসবাবপত্রের অনেকগুলি তারা নিয়ে যায়। বাংলার রাজা শশাংকের বৌদ্ধদের প্রতি নির্যাতনের কথা সুবিদিত। কিন্তু তিনিও বৌদ্ধ সন্ন্যাসীদের বা বৌদ্ধ হবার জন্য জনসাধারণের উপর হত্যাকাণ্ড পরিচালনা ও নারীদের যুদ্ধ-বন্দী করেছিলেন এমন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না।

----------------------------------------

বিলহরি প্রস্তর-লিপির বর্ণনাটি এই রকম, “Even when his soldiers, made to march to subdue the regents of the quarters, enacted the destruction of the universe so as to rouse the apprehension of the three worlds, no sheets of dust could rise from the earth, flooded as it was with streams of tears that were shed by crowds of captive women of enemies who again and again were made prisoners.” (Bilhari Chedi Inscriptions, Verse 25), দেখুনঃ Epigraphia Indica, Volume I (1892), Published by the Archaeological Survey of India, Delhi, 1983, p. 265.

তামিল প্রসস্তি (praśasti) নামক গ্রন্থে বলা হয়েছে, , “(Rājēndra seized) Śakkarakkōṭṭam, whose warriors were brave, Madura-maṇḍalam destroyed in trice, …. Vangāḷa-dēśa, where the rain water never stopped, (and from which) Gōvindacandra fled, having descended (from his) male elephant; elephants of rare strength, women and treasure, (which he seized) after having been pleased to put to flight in a hot battle-field the strong Mahipāla together with Śangu who wore the anklet (of valour); … “ দেখুনঃ K.A. Nilakanta Sastri, The Cōḷas, Vol. I, University of Madras, Madras, 1935, pp. 248, 249.   

  দেখুনঃ R.C. Majumder (ed.), The History of Bengal, Vol, I, Hindu Period, p. 144.

----------------------------------------

আগেই বলা হয়েছে, যুদ্ধে শত্রু পক্ষের নগর ধ্বংস, দাসকরণ কিংবা নারী অপহরণ ও ধর্ষণ ভারতবর্ষের যুদ্ধের সাধারণ রীতি বহির্ভূত বিষয় ছিল। অপ্রয়োজনে মানুষ হত্যা বা এর চেয়ে বেশী নিষ্ঠুরতার চর্চা ভারতবর্ষে সাধারণভাবে ছিল না। কালাচুরী, প্রতিহার, চোল, প্রভৃতি ভারতীয় শাসকদের সম্পর্কে নগর ধ্বংস ও নারীদের যুদ্ধ-বন্দী করার যে বিবরণ পাওয়া যায় সেগুলি ব্যতিক্রম ছিল। শক-হুন প্রভৃতি যে সমস্ত বহিরাগত গোষ্ঠী ভারতবর্ষে এসে এখানকার হিন্দু ধর্মের অন্তভুর্ক্ত হবার পর ক্ষত্রিয়ত্বের মর্যাদা পেয়েছিল তারাই কালাচুরী, প্রতিহার, চোল প্রভৃতি রাজবংশ গড়ে তুলে। ধারণা করা যায়, এই ধরনের নিষ্ঠুরতা ও ধ্বংসকাণ্ড তারাই মূলত পরিচালিত করেছে। অর্থাৎ এগুলিকে আমরা ভারতীয় সমাজে বহিরাগত যাযাবর ও বর্বর সমাজের সংস্কৃতির অবশেষ কিংবা ধারাবাহিকতা হিসাবে দেখতে পারি।

 

সেনাবাহিনীর ব্যয়ভার বহনের জন্য মুসলমানদের অর্থের উৎস

ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণকারীদের শক্তির উৎস ছিল সেনাবাহিনী। এই সেনাবাহিনীর সাহায্যেই তারা যেমন আক্রমণ ও যুদ্ধ করত তেমন তাদের আধিপত্য ও শাসনকে টিকিয়ে রাখত। ফলে তাদের সব সময় সেনাবাহিনীর সরবরাহ ও তাদের বেতন ও সুযোগ-সুবিধার দিকে নজর দিতে হত। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকরা কাউকে কাউকে সেনাবাহিনীতে বরাদ্দ সৈন্যের সরবরাহের জন্য জায়গীর দিত। এমন দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় সুলতান নাসির-উদ-দীন মাহমুদের সময়ে। ফিরিশতা উল্লেখ করেছেন যে, সিন্ধু নদের নিকটবর্তী এলাকায় কয়েকজন বৃদ্ধ সেনানায়ক শামস-উদ-দীন ইলতুৎমীশ ও কুতুব-উদ-দীন আইবকের সময় থেকে জায়গীর ভোগ করে আসছিল এবং কিছুদিন যাবত তারা সেনাবাহিনীতে বরাদ্দকৃত সৈন্য পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছিল, যদিও সেই শর্তেই তাদের জমিদারী দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধ নির্ভর এই ধর্মের প্রভাবে মুসলিম আমলে প্রতিটি শহর অনেকটা সামরিক ব্যারাক বা ছাউনি (Garrison City) হিসাবে গড়ে উঠেছিল। সুলতান নাসির-উদ-দীন মাহমুদ ৬৪৫ হিজরীতে (১২৪৭ খ্রীষ্টাব্দে) গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী এলাকার উপর দিয়ে অগ্রসর হয়ে বিতুণ্ডা আক্রমণ করেন। এরপর তিনি কারার দিকে সৈন্য চালনা করেন। এখানে দুই জন হিন্দু রাজা যমুনার দক্ষিণের সমস্ত দেশ অধিকার করে নিয়েছিলেন এবং মালব থেকে কারা পর্যন্ত এলাকার সুলতানের সমস্ত এলাকার সেনানিবাস ধ্বংস করেছিলেন। সুলতানের সেনাপতি বুলবন এই দুই রাজাকে পরাস্ত করে তাদের সর্বস্ব লুণ্ঠন করেন ও তাদের পরিবারের অনেককে বন্দী করেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১৮৫, ১৮৬।

----------------------------------------

মুসলমানদের সামরিক বাহিনী পালন করবার জন্য লুটপাট ছাড়া সবচেয়ে বড় আয়ের উৎস ছিল কর। কোনো কোনো শাসক প্রজাদের উপর অতিরিক্ত কর আরোপের ফলে প্রজাদের মধ্যে অসন্তুষ্টি ও অনেক সময় প্রজা বিদ্রোহও হয়েছিল। দিল্লীর সুলতান মুহাম্মদ তুঘলকের সময়ে ব্যাপক কর আরোপ করা হয়। ফিরিশতা লিখেছেন. মানুষের জীবন ধারণের জন্য যে সমস্ত দ্রব্য নিত্য প্রয়োজনীয় সেগুলির সকলের উপর কর ধার্য করা হয়েছিল। এছাড়াও সেই সমস্ত কর এমন জুলুম করে আদায় করা হতে লাগল যে, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় অচল হয়ে পড়ল। ফলে মানুষের দুর্দশা চরমে পৌঁছাল। কৃষকরা বাড়ী-ঘর ছেড়ে জঙ্গলে পালিয়ে গেল এবং লুটপাট করে জীবন ধারণ করতে লাগল। কৃষিখেত অনাবাদী পড়ে থাকল। দেশে ভয়ানক দুর্ভিক্ষ দেখা দিল। প্রদেশগুলি জনশূন্য হয়ে পড়ল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২৯।

----------------------------------------

ফিরিশতা আরো লিখেছেন, এই সময় প্রজাদের উপর এত বেশী কর চাপানো হল এবং তহশিলদাররা এত বেশী জুলুম করে সেই কর আদায় করতে লাগল যে, গঙ্গা ও যমুনার মধ্যবর্তী উর্বর দোয়াব অঞ্চলের কৃষকরা জীবনের প্রতি বিতৃষ্ণ হয়ে বাড়ী ঘরে আগুন দিয়ে পরিবার ও গবাদি পশু নিয়ে জঙ্গলে চলে গেল। ফলে অনেক জনবহুল জায়গা জনশূন্য হয়ে গেল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৩৬।

----------------------------------------

অর্থাভাবে সৈন্যদল ভেংগে যাওয়া সম্পর্কে জিয়াউদ্দিন বারানী লিখেছেন, যে বৎসর সুলতান মুহাম্মদ তুঘলক সৈন্য সংগ্রহের আদেশ দিয়েছিলেন, তখন কোনো রকম পরীক্ষা ও বাছ-বিচার না করেই শুধু মাথা পিছু ঘোড়ার মূল্য, তীর, কামান, ইত্যাদি দেওয়ার ফলে রাজ্যের সর্বত্র বহু ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। ফলে ঐ সকল ক্ষতি পূরণের জন্য শাহী খাজানাখানা থেকে নগদ ধন-সম্পদ ব্যয় হয়ে যায়। ঐ বৎসর তিন লক্ষ সত্তর হাজার অশ্বারোহীর নাম দেওয়ানে আরজে লিপিবদ্ধ হয়েছিল। এক বৎসর শুধু এই সকল সৈন্য সংগ্রহ, তাদের প্রাপ্য প্রদান এবং তাদের সুসজ্জিত করতে কেটে গেল। এই সময়ে সৈন্যদেরকে কোনো ধরনের যুদ্ধ বা দেশ জয়ে পাঠানো সম্ভব হল না। যদি এই রকম কিছু করা যেত, তাহলে লুণ্ঠিত সম্পদ দিয়ে তাদের প্রাপ্য বেতনের কিছু অংশ পূরণ করা সম্ভব হয়ে উঠত। এইভাবে দ্বিতীয় বৎসর এসে উপস্থিত হল; তখন খাজানাখানা খালি এবং জায়গীর দানের ব্যবস্থাও অপ্রতুল। ফলে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে তুলা সৈন্যদল ভেংগে গেল। তারা নিজ নিজ পথ ধরল। অনেকেই নিজেদের পূর্ব পেশা অবলম্বন করল।

----------------------------------------

দেখুনঃ জিয়াউদ্দিন বারানী, তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, পৃঃ ৩৯৪।

----------------------------------------

ভারতবর্ষের হিন্দুদের উপর চাপিয়ে দেওয়া জিজিয়া করও ছিল মুসলমান শাসকদের আয়ের আরেকটি উৎস। মুহাম্মদ কাসিম যখন প্রথম ভারত আক্রমণ ও বিভিন্ন অঞ্চল দখল  করেন তখন থেকেই জিজিয়া কর আরোপ করা হয়। তারিখু’স সবুক্তগীনের লেখক আবুল ফজল আল বায়হাকী লিখেছেন, ৪২৪ হিজরীতে (১০৩৩ খ্রীষ্টাব্দে) আহমদ নিয়ালতিগিনকে ভারতের গভর্নর ও সেনানায়ক হিসাবে পাঠাবার পর তাকে বলা হল, সে অবশ্যই যা তার করা দরকার তা সে করবে, এবং ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে জিজিয়া কর নিবে, অভিযানে যাবে এবং বিপুল পরিমাণ সম্পদ কোষাগারে দিবে।  আবুল ফজল বায়হাকী আরো লিখেছেন যে, বেনারস জয় করার পর সমস্ত সেনাবাহিনী ধনী হয়ে গিয়েছিল, বিপুল সম্পদ পাওয়া গিয়েছিল ও ব্রাহ্মণদের কাছ থেকে কর আদায় করা হয়েছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Abul Fazl al Baihaki, Tarikh-us Subuktigin, Translated and edited by H.M. Elliot and John Dowson, Sang-e-Meel Publications, Lahore, 2006, p. 79.

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৮১।

----------------------------------------

পরবর্তীকালে সুলতান ফিরোজ শাহের পূর্ববর্তী মুসলিম শাসকরা তা থেকে হিন্দুদেরকে অব্যাহতি দিয়েছিল। কিন্তু সুলতান ফিরোজ ছিলেন ধর্মান্ধ মুসলমান। তিনি আবার হিন্দুদের উপর জিজিয়া কর আরোপ করেন।

মোগল আমলে লুটপাট থেকে অর্থ আয় কমে যাওয়ায় মোগল সম্রাট আকবরকে দেশের কৃষির উন্নতির জন্য উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। বাদাউনি লিখেছেন, ৯৮২ হিজরীতে কৃষির উন্নতি ও রায়তদের অবস্থা ভাল করার জন্য সম্রাটের মাথায় নূতন ধারণা আসে। দেশের সমস্ত পরগনাসমূহ, শুকনা বা জলসেচের অধীন যাই হোক না কেন, শহর বা পার্বত্য অঞ্চল, মরুভূমি বা জঙ্গলে, নদী, জলাভূমি বা কুয়ার ধারে, হোক না কেন সকলই পরিমাপের অধীন হতে হবে। এবং সকল ভূমির, যেখান থেকে কৃষির মাধ্যমে এক কোটি টংকার ফসল উৎপন্ন হয়, সেগুলিকে ভাগ করতে হবে এবং একজন কর্মকর্তার অধীনে নিতে হবে, যাকে ক্রোরি বলা হবে। সেই ব্যক্তি খাজনা কর্মচারী বা শস্যাগারের আধিকারিকের পরিচিত হোক বা না হোক, তাকে বিশ্বাসযোগ্যতার কারণে নির্বাচিত করতে হবে। এটা এমনভাবে করতে হবে যেন তিন বৎসর পরে সকল অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আনা যায় এবং সরকারী শস্যাগার পূর্ণ হয়। কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে নিরাপত্তা গ্রহণ করা হয়েছিল। ফতেহপুরের পার্শ্ববর্তী অঞ্চল থেকে পরিমাপ শুরু হয়েছিল। একটি ক্রোরকে আদমপুর, অন্যটিকে সেথপুর, অপরটিকে আইয়ুবপুর, এইভাবে নামকরণ করা হল। কর্মকর্তাদের নিয়োগ করা হল। কিন্তু তারা যেভাবে নিয়মকানুন পালন করা উচিত ছিল সেভাবে পালন করল না। ক্রোরিদের অত্যাচারের কারণে দেশের একটি বড় অংশ পরিত্যাক্ত হল। রায়তদের স্ত্রী ও সন্তানদের বিক্রী করা হল এবং তারা বাহিরের দিকে ছড়িয়ে পড়ল। সবকিছুই দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যে পড়ল। কিন্তু ক্রোরিদের রাজা টোডর মলের অধীনে নেওয়া হল, এবং অনেক ভাল লোককে আইনের ধারায় ভয়ানক মারধোর এবং অত্যাচারের ফলে তারা মারা গেল। খাজনা কর্তৃপক্ষের জেলখানায় দীর্ঘ বন্দীত্বের ফলে বহু সংখ্যক মারা গেল। এর ফলে জল্লাদের অথবা তরবারিধারীর প্রয়োজন হয় নাই এবং কেউই তাদের কবর বা কাফনের কাপড় দিবার বিষয়ে চিন্তা করে নাই।

----------------------------------------

দেখুনঃ Al-Badaoni, Muntakhabu-t-Tawarikh, Vol. II, p. 192.

----------------------------------------

পাতা : ২৮

আকবরের সময়ের একটি পর্যায়ে সৈন্যদের পিছনে খরচ কমে যেতে থাকে। দাগ উ মশালের একটি আইন মীর বখশি শাহবাজ খান চালু করেছিলেন, যা সুলতান আলাউদ্দিন খলজীর আইন ছিল। পরবর্তীকালে তা শের শাহের অধীন আইন হয়েছিল। এটি নির্ধারিত হয়েছিল যে, প্রতিজন আমীর কুড়ি জন সৈন্যের পরিচালক হবে (বিষ্টি)। এবং গার্ডদের পরিচালনা করতে প্রস্তুত থাকবে, তথ্য বহন করবে, ইত্যাদি, যেমন হুকুম করা হবে। এবং তার অধীনে কুড়ি জন অশ্বারোহী থাকলে তাকে ১০০ জনের পরিচালক করা হবে (শদি)। একইভাবে তাদের অধীনে হাতী, ঘোড়া ও উট থাকতে হবে (মনসব)। পরবর্তীকালে সামরিক প্রয়োজনে বেচাকেনা পরিত্যক্ত হয়েছিল। এই প্রসংগে বাদাউনি লিখেছেন, সম্রাটের ভাগ্য ভাল ছিল যে, তার সকল শত্রু নির্মূল হয়েছিল, ফলে তার আর বড় সৈন্যবাহিনীর প্রয়োজন ছিল না।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৩, ১৯৪।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৯৪।

----------------------------------------

অন্যদিকে প্রাক-মুসলিম যুগে ভারতবর্ষের রাজাদের সামরিক ব্যয় অনেক কম হত। অনেক রাজার স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। এর ফলে রাষ্ট্র পরিচালনায় রাজার ব্যয়ও অনেক কম হত। আবার কিছু রাজার স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল। যেমন, বলহার বা রাষ্ট্রকূট রাজাদের শক্তিশালী ও নিয়মিত বেতনভূক সেনাবাহিনী ছিল। কনৌজের প্রতিহার বা বাংলার পাল রাজারা একইভাবে সেনাবাহিনী পালন করতেন। তার পরেও সামরিক ব্যয় পরিচালনার জন্য রাজারা কখনোই প্রজাদের উপর তাদের ভূমি থেকে উৎপাদিত ফসলের ছয় ভাগের এক ভাগ ও বণিকদের কাছ থেকে বাণিজ্যের লভ্যাংশের পঞ্চাশ ভাগের এক ভাগের বেশী কর হিসাবে নিতেন না।

----------------------------------------

দেখুনঃ C.V. Vaidya, History of Mediaeval Hindu India, Vol. II, First published 1924, reprinted 1979, Cosmo Publications, New Delhi, p. 225.   

----------------------------------------

মুসলিম বহিরাগতদের ভারতে ধর্মান্তরকরণের উদ্যোগ

ভারতবর্ষে মুসলমানেদের এত বিজয় ও বলপ্রয়োগের পরেও হিন্দুদের ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরকরণ সহজ হয় নাই। এই বিষয়টি সমসাময়িক মুসলিম ঐতিহাসিকরাও স্বীকার করেছেন। বহু ক্ষেত্রেই দেখা গেছে যে, প্রাথমিক বিজয়ের কিছু পরে মুসলিম শাসকদের দুর্বলতার সুযোগে ভারতীয় হিন্দুরা শাসন ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নিয়েছিল। কিন্তু আফগানিস্তান ও মধ্য এশিয়া থেকে আসা আক্রমণকারীদের জন্য আফগানিস্তানের এবং ভারত সীমান্তবর্তী বিভিন্ন পার্বত্য জাতি বা মধ্য এশিয়ার বিভিন্ন জনগোষ্ঠীকে বল প্রয়োগে বা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা তুলনায় সহজ ছিল। যেমন গোক্ষর নামে পরিচিত একটি পার্বত্য জাতি যারা নিলাব নদীর উভয় পার্শ্বস্থ অঞ্চলে ও নদী বরাবর তাদের বাসভূমি সেবালিক পর্বত শ্রেণীর পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। মুহাম্মদ ঘুরী তাদের পরাজিত করে সর্দারকে বন্দী করার পর ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করেন। ইসলাম ধর্ম গ্রহণের পর তাকে মুক্তি দিয়ে তার অনুগামীদেরকে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করার জন্য উৎসাহিত করা হয়। ফলে তাদের অধিকাংশ লোকই ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ফিরিশতা লিখেছেন, এই সময়ে গজনী ও সিন্ধু মধ্যবর্তী পার্বত্যাঞ্চলে যে সমস্ত ভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করত তাদের কাউকে বলপূর্বক ও কাউকে বুঝিয়ে ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়।

----------------------------------------

  সুলতান মওদুদের সময় ৪৩৫ হিজরীতে (১০৫৩ খ্রীষ্টাব্দে) দিল্লীর রাজা অন্যান্য রাজাদের সহায়তা নিয়ে মওদুদ নিয়োজিত শাসনকর্তাদের কাছ থেকে হান্সী, থানেশ্বর ও এগুলির আধীন অঞ্চল পুনরাধিকার করে নেয়। সেখান থেকে হিন্দুরা নগরকোটের দিকে রওনা হল। চার মাস অবরোধের পর নগর কোটের সৈন্যরা আত্মসমর্পন করল। কাশিম ফিরিশতা লিখেছেন, এই সময়ে হিন্দুরা তাদের স্বভাব অনুযায়ী মন্দিরে নূতন মূর্তি স্থাপন করে মূর্তি পূজা আরম্ভ করল। দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৯৫।

  এই রকম দেখা গেছে গোয়ালিয়রের ক্ষেত্রে। সুলতান আরামের স্বল্পকাল স্থায়ী রাজত্বের সময়ে এই দুর্গ পুনরায় হিন্দুদের হাতে চলে গিয়েছিল। পরে ৬২৯ হিজরীতে (১২৩১ খ্রীষ্টাব্দে) শামস্-উদ-দীন ইলতুৎমীশ এই দুর্গ অধিকার করেন। দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ১৬৬। এছাড়াও কুতুব-উ-দীন আইবক কর্তৃক গুজরাট ও মালব মুসলমান সাম্রাজ্যভূক্ত হলেও পরে তারা মুসলিম কর্তৃত্ব অস্বীকার করে। দেখুনঃ প্রাগুক্ত, ২০০।

  প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৪, ১৪৫।

----------------------------------------

দিল্লীর সুলতান সিকান্দার লোদীর সময়কালে (শাসনকাল ১৪৮৯ - ১৫১৭ খ্রীষ্টাব্দ) একটি ঘটনার উল্লেখ করা যায়। সেই সময় লক্ষ্ণৌ-এর নিকটবর্তী কাতীন নিবাসী বোধন নামে এক ব্রাহ্মণ ধর্ম সম্পর্কে একটি বিশেষ মত প্রকাশ করে বিপদে পড়েন। কয়েকজন মুসলমান তাকে ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, ”আন্তরিকতার সাথে পালন করলে হিন্দু ও মুসলমান উভয় ধর্মই খোদার কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য হবে।” ব্রাহ্মণ তার বক্তব্যের পক্ষে জোরালো যুক্তির অবতারণা করেছিলেন। ফলে এই কথা নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে আলোচনা চলতে থাকে। ব্রাহ্মণ ও লক্ষ্ণৌ-এর কাজীর উপর দরবারে হাজির হবার হুকুম হয়। সেখানকার কাজী এই মতের বিরোধিতা করেন। ব্রাহ্মণের কথা নিয়ে শহরে বেশ আলোড়নের সৃষ্টি হয়। সুবাদার আজিম হুমায়ুন ব্রাহ্মণকে সুলতানের নিকট পাঠানো সমীচীন মনে করেন। সুলতান সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ আলেমদিগকে সম্বলে হাজির হয়ে ব্রাহ্মণের সাথে ধর্ম বিষয়ে তর্কে প্রবৃত্ত হতে হুকুম দেন। অনেক বিতর্কের পর আলেমরা এই মত প্রকাশ করলেন যে, ব্রাহ্মণের কথার অর্থ দাঁড়ায় এই যে - হিন্দুর পূজা ও মুসলমানের ইবাদত আল্লাহর কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য। এই আপত্তিকর মত প্রকাশের জন্য তাকে তওবা করে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। আর তাতে সম্মত না হলে তাকে কতল করতে হবে। ফিরিশতা লিখেছেন, সেই ব্রাহ্মণ হিন্দু ধর্মান্তর গ্রহণ অপেক্ষা মৃত্যুকেই শ্রেয় জ্ঞান করলেন। ফলে তাকে মৃত্যুদণ্ড ভোগ করতে হল।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৫৮, ৪৫৯।

----------------------------------------

ফিরিশতা লিখেন, ইসলাম ধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ বশত এই সুলতান হিন্দুদের সমস্ত মন্দির ধ্বংস করবার নীতি গ্রহণ করেছিলেন। মথুরা নগরীর স্নান-ঘাটের সিঁড়ির পাশেই তিনি মসজিদ ও বাজার নির্মাণ করিয়ে হিন্দুদের সেই ঘাটে তীর্থস্নান বন্ধ করে দিয়েছিলেন। তীর্থস্থানে এসে হিন্দুরা দাড়ি ও মাথা মুণ্ডন করত। সুলতান নাপিতদের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিলেন যে, তারা কারো দাড়ি ও মাথা মুণ্ডন করতে পারবে না।

----------------------------------------

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৪৬৭।

----------------------------------------

ভারতবর্ষে প্রতিটি মুসলিম শাসক বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা কম করে নাই। এজন্য তারা হিন্দুদের উপর সব সময়ই চাপ প্রয়োগের নীতি অবলম্বলন করত। সুলতান আলাউদ্দিন মুহাম্মদ শাহ খলজী নামাজ পড়তেন না ও শুক্রবারের জুম্মার নামাজেও অংশ গ্রহণ করতেন না। সেই আলাউদ্দিনও হিন্দুদের উপর চাপ প্রয়োগের নীতি গ্রহণ করেছিলেন। জিয়াউদ্দিন বারানী লিখেছেন, সুলতান আলাউদ্দিন খলজী জ্ঞানীদের নিকট এমন একটি পন্থা বা নিয়ম জানতে চাইলেন, যা দিয়ে হিন্দুদেরকে শায়েস্তা করা যায়। যে ধনসম্পদ বিদ্রোহের কারণ হয়ে থাকে, তার বিন্দু মাত্র যেন তাদের কাছে না থাকে এবং ক্ষত্রিয় ও শূদ্র উভয়ের কাছ থেকে সমানভাবে যেন খারাজ আদায় করা হয়। শুধু হিন্দুদের কাছে যেন এই পরিমাণ ধন-সম্পদ না থাকে, যাতে ভাল অস্ত্র কিনতে, ভাল পোশাক পরতে এবং মনমত ভোগ সম্ভোগ ক’রে দিন কাটাতে না পারে। রাজ্যশাসনের অন্তর্গত এই বিশেষ ব্যাপারটির জন্য দুইটি আইন তৈরী করতে হবে। প্রথমটি হল, যারা কৃষিকাজ করে, তাদের জমির শ্রেণী, পরিমাণ, দূরত্ব ও তারতম্যের হিসাবে তারা অর্ধেক খেরাজ দিতে বাধ্য থাকবে। এই ব্যাপারে ক্ষত্রিয় ও শূদ্র একই প্রকার নিয়মের অধীন হবে। দ্বিতীয়টি হল, যে সকল গরু, মোষ ও ছাগল দুধ দেয় ও মাঠে চরে বেড়ায়, তাদের জন্য নির্দিষ্ট চারণভূমি রাখতে হবে এবং যত্রতত্র তাদের রাত্রিবাসের স্থান না ক’রে প্রকাশ্য ও নির্দিষ্ট স্থানে তা করতে হবে। যাতে খেরাজ ধরার সময় তাদের এক স্থানে পাওয়া যায়। বারানী আরো লিখেছেন, শহরের আশেপাশের সমস্ত গ্রামাঞ্চল, দোয়াব অঞ্চল, বয়ানা থেকে ঝাবন, পালাম থেকে দেবপালপুর ও লাহোর, সামানা ও সানামের সমস্ত অঞ্চল, রেউড়ী থেকে নাগুড়, কোড়া থেকে কানুদী, আমরূহা, আফগানপুর ও কাবেরের গ্রামাঞ্চলগুলি ধরে বাদাউন, খরক ও কুয়েলা পর্যন্ত এবং কাথিয়াড়ের সমস্ত অঞ্চলকে খেরাজের হিসাব অনুসারে ভাগ করলেন। সমস্ত অঞ্চলকে দূরত্ব, পরিমাণ, কৃষি ও চারণ ভূমির মানানুযায়ী একটি নির্দিষ্ট হিসাবের অন্তর্ভুক্ত করে নিলেন। এই হিসাব মত খেরাজ আদায়ের বিষয়টি এত মজবুত হল যে, চৌধুরী, খওতা ও মুকদিমদের মধ্যে ঘোড়ায় চড়া, তলোয়ার হাতে নেওয়া, ভাল কাপড় পরা, পান খাওয়া প্রভৃতি আয়েশের কাজ একেবারে বন্ধ হয়ে গেল। খেরাজ আদায়ের ব্যাপারে তারা সকলে একই আদেশের অধীন ছিল। তাদের আনুগত্য এমন চরম আকার ধারণ করল যে, গ্রাম-গঞ্জের একজন খেরাজ আদায়কারী বিশ জন চৌধুরী, খওতা ও মুকদিমকে একত্র বেঁধে খেরাজের জন্য মারপিট করত; অন্য হিন্দুরা এটা দেখেও উচ্চবাচ্য করত না। বারানী লিখেছেন, বস্তুত হিন্দুদের ঘরে এমন কোনো সোনা চান্দি ও তঙ্কা চীতল অবশিষ্ট ছিল না, যার ফলে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারে। এই ধরনের অসহায় অবস্থার ফলে হিন্দুদের সন্তানরা মুসলমানদের ঘরে চাকুরী করে দিন যাপন করতে বাধ্য হয়েছিল।

----------------------------------------

জিয়াউদ্দিন বারানী, তারিখ-ই-ফিরুজশাহী, পৃঃ ২৩৬, ২৩৭।

----------------------------------------

পাতা : ২৯

সুলতান আলাউদ্দিন খলজী লেখাপড়া জানতেন না। বারানী লিখেছেন, একদিন সুলতান শরীয়ত বিশারদ আলেম কাজী মুগিস উদ্দিন বয়ানাকে জিজ্ঞাসা করলেন, হিন্দুদের কাছ থেকে খেরাজ নেওয়ার ব্যাপারে শরীয়তে কী রকম নির্দেশ আছে এবং তারা কীভাবে এই খেরাজ প্রদান করবে? কাজী বললেন, শরীয়তে আছে, যখন দেওয়ানের তহশীলদার তাদের মুখে থুথুও দেয়, তবে তা প্রাপ্য বলে গ্রহণ করবে এবং আরো বেশী করে তহশীলদারের সেবা করতে থাকবে। এইভাবে তোয়াজ ও থুথু গিলে ফেলার তাৎপর্য এই যে, জিম্মীরা সব সময়েই অসম্মানের মধ্যে থাকবে। কারণ এর মধ্য দিয়ে সত্য ধর্ম ইসলামের সম্মান ও মিথ্যা ধর্মের অসম্মান প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। আল্লাহ্তালা তাদেরকে হেয় করে রাখার জন্য বলেছেন, ‘তোমরা এমনভাবে তাদের হাত থেকে গ্রহণ কর, যাতে তারা হেয় হয়ে থাকে।’ বিশেষ করে হিন্দুদেরকে অসম্মানকর অবস্থার মধ্যে রাখা ধার্মিকতার অংশ বলে গণ্য। কারণ তারা হযরত মুহাম্মদ মোস্তফার ধর্মের সর্বাপেক্ষা মারাত্মক শত্রু। এই জন্য হযরত তাদেরকে হত্যা করা, তাদের সম্পদ লুট করা এবং তাদের দাসদাসী হিসাবে গ্রহণ করবার আদেশ দিয়েছেন। আমরা যে ইমামের মজহাব মেনে চলি, সেই ইমাম আজম আবু হানিফাই শুধু তাদেরকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করা অথবা তাদের মেরে কেটে ধন-সম্পদ লুট করে দাসদাসী হিসাবে গ্রহণ করবার কথা বলেছেন। অন্যান্য ইমাম ও জ্ঞানী ব্যক্তিরা তাদের জন্য দুইটি পন্থা নির্দেশ করেছেন – হয় তারা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে; নতুবা তাদেরকে হত্যা করতে হবে।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৩৮, ২৩৯।

----------------------------------------

মিসর থেকে মওলানা শামস উদ্দিন তুর্ক নামে এক জন শরীয়ত বিশেষজ্ঞ আলেম মুলতানে এসে সুলতানের কাছে একটি চিঠি পাঠান। সেই চিঠিতে তিনি লিখেন, “... ধার্মিকতার কথা যা শুনেছি, তা এই যে, সুলতান হিন্দুদেরকে অতিশয় দুরবস্থার মধ্যে রেখেছেন। এমনকি তাদের পুত্র-পরিজন মুসলমানদের দ্বারে দ্বারে ভিক্ষা করে বেড়ায়।  এটি যথার্থই ধার্মিকতার কাজ। ইসলামের এই সম্মান ও ধর্মকে এইভাবে উচ্চে তুলে ধরবার জন্য সুলতানের প্রশংসা না করে পারা যায় না। ...”

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৪, ২৪৫।

----------------------------------------

সুলতান গিয়াস উদ্দিন তুঘলকও (সিংহাসন আরোহণ ৭২০ হিজরী) সমস্ত কেতাদার ও ওয়ালীদেরকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, হিন্দু প্রজাদের কাছ থেকে খেরাজ আদায় করতে গিয়ে দেখতে হবে, যাতে তারা এমন সম্পদশালী হয়ে না উঠে, যার ফলে বিদ্রোহ করতে সাহস পায় এবং এমন নিঃস্বও না হয়ে পড়ে, যাতে তারা চাষাবাদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩৫৭।

----------------------------------------

সুলতান ফিরোজ তুঘলকের সময়ে নগরকোটে হিন্দু মন্দিরে একটি উৎকৃষ্ট পাঠাগারের কথা ফিরিশতা উল্লেখ করেছেন। সেখানে জালামুখী নামে একটি মূর্তি ছিল। সেখানে হিন্দুদের ১,৩০০ গ্রন্থ ছিল।  দর্শন, জ্যোতিষ ও ঈশ্বরতত্ত্ব সম্বলিত একটি গ্রন্থ আইজ-উদ-দীন খালিদ খানী পারসিক অনুবাদ করেছিলেন। গ্রন্থটির নাম দেওয়া হয়েছিল দুলাইল ফিরোজ শাহী।

----------------------------------------

বাদাউনিও এই মন্দিরে থাকা মূর্তি ও বইগুলি সম্পর্কে বিবরণ দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন, “Under these circumstances they informed the Sultān that from the time when Sultān Sikandar Zūl Qarnain arrived at this place the people of that city have preserved an image of Noshāba and kept it in a room, where they worship it. There are one thousand three hundred books of the Brahmans of olden time in that idol temple which is commonly known as Jawālamukhī; a flame of fire rises from it towards heaven and is not to be extinguished.” দেখুনঃ Al-Badaoni, Muntakhabu-t-Tawarikh, Vol. I, p. 331.

দেখুনঃ মুহাম্মদ কাসিম ফিরিশতা (মূল), ভারতে মুসলিম বিজয়ের ইতিহাস, পৃঃ ৩৬১।

----------------------------------------

তবে ইসলামের অনেক অনুশাসন পালন না করায় ও ইসলাম ধর্মের সমালোচনার প্রতি সহনশীল ছিলেন বলে মোগল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছিল। আকবর নিয়মিত শুক্রবারের জুম্মার নামাজ পড়তেন না, রোজা রাখতেন না ও ইসলামের সমালোচনায় নীরব থাকতেন। তার সভায় অনেক ভিন্ন ধর্মের লোকজন গুরুত্ব পেত। এজন্য বহু মুসলমানই অসন্তুষ্ট হত। এইজন্য আকবরের একজন ওমরাহ খাজা মনসুর আরো অনেককে নিয়ে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে আকবরকে হত্যা করে ক্ষমতার বদল  চেয়েছিল। এই কাজে তাদের প্রেরণার কারণ ছিল এই প্রচারণা যে, আকবর ধর্মচ্যুত, কাফের, নবী মুহাম্মদের অবমাননাকারী, ইত্যাদি।

----------------------------------------

দেখুনঃ যেশুইট পাদ্রীর আকবরনামা, পৃঃ ৬৪, ৬৫।

----------------------------------------

মুসলিম যুগে উপমহাদেশে যে ধারাবাহিক বৈদেশিক আক্রমণাভিযান চলে তার সুদূরপ্রসারী ফলাফল এই উপমহাদেশের অধিবাসী হিসাবে আজও আমরা বহন করে চলেছি। এই উপমহাদেশের মানুষ কেন বিদেশীদের আক্রমণ ও লুণ্ঠন অভিযানকে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হয়েছিল তার কারণ অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যে পৃথিবীর অন্যান্য জাতি ও জনগোষ্ঠী কীভাবে বিদেশী আক্রমণকারীদের মোকাবিলা করেছিল সে সম্পর্কে জানা ও তাদের অভিজ্ঞতাকে পর্যালোচনা করা দরকার। পৃথিবীর বিভিন্ন জাতি ও জনগোষ্ঠী বিদেশী হানাদার ও আক্রমণকারীদের প্রতিরোধ ও তাদের রেখে যাওয়া স্মারক ও উত্তরাধিকারের বিরুদ্ধে কীভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তা এখানে আলোচনা করা হল। পূর্ববর্তী খণ্ডে এ সম্পর্কে কিছু আলোচনা করলেও গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা এখানে কিছু বিস্তারিত আলোচনা করতে চাই।

পাতা : ৩০

মোঙ্গল দখলদারিত্ব উচ্ছেদে চীনের অভিজ্ঞতা

মোঙ্গল দখলদারিত্ব ও তার উচ্ছেদ চীনের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা হয়ে আছে। চীনের ইতিহাসে মোঙ্গল যুগ ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দে শুরু হলেও মোঙ্গলদের সম্পূর্ণ চীন অধিকার করতে আরো অনেক সময় লেগেছিল। ওরখোন উপত্যকা থেকে চীনের চিন সাম্রাজ্যে মোঙ্গলদের কাছ থেকে আক্রমণ আসতে শুরু করে ১২১১ খ্রীষ্টাব্দ থেকে। খুব তাড়াতাড়ি মাঞ্চুরিয়া মোঙ্গলদের অধিকার চলে যায় ও ১২১৫ খ্রীষ্টাব্দে পিকিং অঞ্চল তাদের দ্বারা অধিকৃত হয়। ১২২৫-২৭ এর মধ্যে সামরিক অভিযানে সিয়া (Hsia) সাম্রাজ্য ধ্বংস হয় ও শেষ পর্যন্ত প্রথম আক্রমণের তেইশ বৎসর পরে চীন সাম্রাজ্য সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে ও সমগ্র উত্তর চীন মোঙ্গলদের কর্তৃত্বে চলে যায়। আরো তের বৎসর পরে মোঙ্গলরা দক্ষিণ-মধ্য চীনের যেচুয়ান (Szechwan/ Szechuan) দখল করে ও তাদের প্রায় চল্লিশ বৎসর লাগে চীনের ইয়াংজি (Yangtze) অঞ্চল ও দক্ষিণের প্রদেশসমূহ দখল করতে। মিয়ানমার (বার্মা) ও ভিয়েতনামে অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে মোঙ্গলদের অনেক প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষের দিকে তাদের জাপান ও জাভায় সমুদ্র অভিযান সম্পূর্ণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, পূর্ব এশিয়ায় মোঙ্গলদের ধীর অগ্রাভিযানের বিপরীতে এশিয়ার পশ্চিম অংশ ও ইউরোপে তাদের অগ্রগতি ছিল বিদ্যুৎ গতির মত। 

চেঙ্গিস খানের সময়ে, ১২১০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১২২৭ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত, মোঙ্গোলদের কোনো প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান ছিল না। তারা গণহত্যা পরিচালনা করার পর সাধারণত যে সমস্ত কারিগর ও পুরোহিতকে বাঁচিয়ে রাখত তাদের মোঙ্গল অভিজাতদের মধ্যে দাস হিসাবে ভাগ করে দিত। এছাড়া চাষ করা জমিকে তারা পশুচারণ ভূমিতে পরিণত করত। বিভিন্ন অঞ্চলকে তারা স্বাধীন জেলায় ভাগ করে সামন্ত প্রধানদের অধীনে অসংখ্য ব্যক্তিগত অঞ্চলে বিভক্ত করত যাদের সম্পূর্ণ ক্ষমতা থাকত তাদের প্রজাসাধারণের উপর। এভাবে পূর্ব এশিয়ায় গোত্রীয় সামরিক প্রতিষ্ঠান সরকারের কাজ করত এবং মোঙ্গলদের সাম্রাজ্যের সাধারণ কাঠামো হিসাবে গড়ে উঠেছিল। স্থায়ী রাজনৈতিক একক ও তাদের সম্প্রসারণের ধারাবাহিকতা রাখার জন্য মোঙ্গলদের তাদের অধীনস্থ অঞ্চলের মানুষদের প্রথমে অন্তর্ভুক্ত করতে ও তাদের সাহায্য নিবার জন্য উদ্যোগ নিতে হয়েছিল। কারণ তারা ছিল নূতন ভূমিতে এবং বিপুল সংখ্যক ভিন্ন ধরনের মানুষের মধ্যে অত্যন্ত সংখ্যালঘু। দক্ষিণ চীনের বিজয়, এবং জাপান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম ও জাভায় মোঙ্গলদের সামরিক অভিযান পরিচালিত হয়েছিল চীনে গড়ে তুলা সেনাবাহিনী ও কোরিয়ান ও চীনা নৌবহর ব্যবহার করে। মোঙ্গলরা চীনাদের উপর অধিকার প্রতিষ্ঠা করে তাদের প্রভাব প্রতিষ্ঠা করার পর তাদের আচরণ কম কঠোর হত ও চীনে উদ্ভূত হওয়া কিছু প্রতিষ্ঠান তারা ক্রমশ গ্রহণ করে নেয়। ১২৭১ খ্রীষ্টাব্দের দিকে মোঙ্গলরা চীনা ধরনের বংশগত নাম গ্রহণ করে যার নাম হল ইউয়ান (Yüan)। কিন্তু চীনা অনেক কিছু গ্রহণ করলেও মোঙ্গলরা চীনাদের বিশেষভাবে চীনা কর্মকর্তাদের অবিশ্বাস করত। এই কারণে উঁচু পদগুলি তারা মোঙ্গলদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখত ও রাষ্ট্রের অর্থসংক্রান্ত বিষয় তারা মধ্য এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম অঞ্চল থেকে আনা লোকদের হাতে অর্পণ করত। মোঙ্গল সৈন্যদলের সহযোগিতায় মুসলিম বণিকদের বিভিন্ন গোষ্ঠী খাজনা সংগ্রহের লাভজনক ব্যবসায় জড়িত থাকত। মোঙ্গলরা মধ্য এশিয়া ও মধ্য প্রাচ্যের বণিকদের আনুকূল্য প্রদান করত। ফলে তারা সুবিধাভোগী অবস্থানে থাকত। তারা সাধারণত ইসলামে ধর্মান্তরিত ইরানীয় জনগোষ্ঠীর ছিল। তারা মুসলমানদের ব্যাংক ব্যবস্থা সম্পর্কে ধারণা রাখত। এই সমস্ত লোকজন বিভিন্ন সুবিধাপ্রাপ্তির কারণে যে বিপুল সম্পদ গড়ে তুলেছিল তা চীনের বাইরে তাদের নিজেদের দেশে পাঠাত। পূর্ব এশিয়ায় মোঙ্গলদের শাসনের মৌলিক ভিত্তিতে ছিল জাতিগত বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা। গুরুত্বপূর্ণ সরকারী পদগুলি কেবলমাত্র মোঙ্গলরা বংশানুক্রমিকভাবে দখল করে রাখত। প্রশাসনিক জিলাসমূহের বেসামরিক প্রশাসকরা হয় মোঙ্গল হত অথবা খুবই অল্প কিছু ক্ষেত্রে বিদেশী হত। আর উপ প্রশাসকের পদ সাধারণভাবে মুসলমানদের দেওয়া হত। ফৌজদারী আইনে সবচেয়ে কঠোর শাস্তি দেওয়া হত চীনাদের।

----------------------------------------

দেখুনঃ Jacques Gernet, A History of Chinese Civilization, translated by J.R. Foster and Charles Hartman, Cambridge University Press, Cambridge, 1982, pp. 364-365.

প্রাগুক্ত; পৃঃ ৩৬৮।

প্রাগুক্ত; পৃঃ ৩৭২।

----------------------------------------

চীনে ব্যাপক দারিদ্র্যের সূচনা হয়েছিল ধাতব মুদ্রা দেশের বাইরে চলে যাওয়ায়। এই ক্ষতি পূরণের জন্য সরকার কাগজের মুদ্রা ছাপাতে শুরু করে, কিন্তু এগুলি দ্রুত অবমূল্যায়িত হওয়ায় মানুষরা আরো দরিদ্র হয়ে পড়ে। এভাবে নানা কারণে মোঙ্গল যুগ চীনকে ধারাবাহিক ও দ্রুত দরিদ্র করতে থাকে। এর সাথে ছিল বৃহদাকার মন্দির ও প্রকাণ্ড ভবনের জাঁকজমকের প্রদর্শন।

----------------------------------------

দেখুনঃ Wolfram Eberhard, A History of China, translated by E.W. Dicks, First published in Switzerland 1948, Published by Routledge & Kegan Paul Ltd., London, 1950, p. 250.

----------------------------------------

চীনে মোঙ্গলদের শাসন শান্তিপূর্ণ ছিল না। তাদের প্রচুর বিচ্ছিন্ন বিদ্রোহকে দমন করতে হয়েছে। বিশেষভাবে ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দের পর থেকে মোঙ্গলদের বহু সংখ্যক বিদ্রোহের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। চীনের দক্ষিণ-পূর্ব অংশে চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে বেশ কিছু জনপ্রিয় বিদ্রোহ ঘটে। যে সমস্ত বিদ্রোহ ১৩৫৭ থেকে ১৩৬৮ পর্যন্ত মোঙ্গল রাজবংশকে উচ্ছেদ করেছিল সেগুলির মধ্যে হুয়াই (Huai) থেকে চেকিয়াং (Chekiang) পর্যন্ত লবণ শ্রমিকরা সবচেয়ে সাহসী যোদ্ধা হিসাবে ভূমিকা পালন করেছিল। দক্ষিণ চীনে অর্থনৈতিক চাপ খুবই বেশী ছিল, যেখান থেকে মোঙ্গলরা তাদের রাজস্বের প্রায় অর্ধেক সংগ্রহ করত। ইয়াংজি নদীর নিম্ন অঞ্চলে পরিস্থিতি অসহনীয় হওয়ায় এই অঞ্চলে ও সমুদ্র তীরবর্তী প্রদেশগুলিতে ১৩৫১ - ১৩৬৮ পর্যন্ত বিদ্রোহের সবচেয়ে বড় ঘাঁটি গড়ে উঠেছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Jacques Gernet, A History of Chinese Civilization, 1982, p. 370.

----------------------------------------

এই সময়ে চীনে দু’টি বড় অঞ্চলে বিদ্রোহ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। একটি হল শানটুং-এর সীমানা ঘেঁসে, যেখানে সহস্র সংখ্যক অত্যন্ত সক্রিয় আন্দোলন থেকে এই দাবী তুলা হচ্ছিল যে, মৈত্রেয়র  আগমন আসন্ন, যিনি হলেন মুক্তিদাতা বোধিসত্ত্ব। মানুষজন বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে, সুং রাজবংশ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে। এই সমস্ত বিদ্রোহের লোকজন ছিল কৃষক সমাজ থেকে আগত। মোঙ্গলদের সাথে সংশ্লিষ্ট চীনা অভিজাতদের বিরুদ্ধেও ছিল এই সমস্ত বিদ্রোহ। মোঙ্গলরা আগের জাতিগত বৈষম্যমূলক আইন পুনরায় প্রয়োগ ও আরো কঠোর করলে, অল্প বৎসর পরে তার ফল দাঁড়াল এই যে, সমস্ত বিদ্রোহের লক্ষ্য হল শুধুমাত্র ধনীদের বিতাড়ন নয়, সাথে যুক্ত হল মোঙ্গলদেরও বিতাড়ন। এইভাবে একটি সামাজিক আন্দোলন জাতীয় আন্দোলনে রূপান্তরিত হল। এই জনপ্রিয় উত্থানগুলির চরিত্র পরিবর্তনে আরো একটি উপাদান কাজ করেছিল। সেটি হল বিদ্রোহীরা অনেক শহর দখল করেছিল। এই সমস্ত শহর বিদ্রোহীদের সাথে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে ও আপোস-মীমাংসা ক’রে আত্মসমর্পণ করে। বিদ্রোহীরা এই সমস্ত ক্ষেত্রে সেখানকার সকল অভিজাতকে হত্যা না করে তার বদলে তাদের কিছু অংশকে নিজেদের কাজে লাগায়। অভিজাতরা তাদের জীবন রক্ষার্থে এইগুলি করতে বাধ্য হয়। অভিজাতদের একবার এই অবস্থান নিবার পর বিদ্রোহীদের সাথে তাদের থাকা ছাড়া আর বিকল্প ছিল না।

----------------------------------------

চীনা বৌদ্ধদের একটা অংশ বিশ্বাস করত যে, ভবিষ্যতে গৌতম বুদ্ধের পুনরাবির্ভাব ঘটবে। এই ভবিষ্যৎ বুদ্ধই মৈত্রেয়।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৫২।

----------------------------------------

চীনের মধ্য সমভূমির সমগ্র অঞ্চল ও আরো দক্ষিণের আনহুয়েই (Anhwei) অঞ্চল একটি গোপন গোষ্ঠীর প্রভাবাধীনে ছিল। এই গোষ্ঠীর প্রধান নেতা ছিলেন হান শান-টুং (Han Shan-t’ung) যাকে মৈত্রেয়র পুনর্জন্মপ্রাপ্ত বলে বিবেচনা করা হত। ১৩৫৫ খ্রীষ্টাব্দে তার ছেলে হান লিন-এর (Han Lin-er) নিজেকে নূতন সুং রাজবংশের প্রথম সম্রাট হিসাবে ঘোষণা করেন। বিদ্রোহের অন্য একটি বড় অঞ্চল ছিল লবণ-শ্রমিক, নৌকার মাঝি ও লবণ-চোরাকারবারীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ইয়াংজি নদীর নিম্নাঞ্চল। এখানকার বিদ্রোহীদের নেতাকে চ্যাং শিহ-চেং নামে ডাকা হত। এছাড়াও মধ্য ইয়াংজি অঞ্চলে বিদ্রোহের আরো কিছু কম গুরুত্বপূর্ণ এলাকা ছিল।

পাতা : ৩১

এরপর দ্বিতীয় বিদ্রোহের নেতা হিসাবে যিনি আত্মপ্রকাশ করেন তিনি হলেন চু ইউয়ান-চ্যাং (Chu Yüan-chang), যিনি মিং রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর পিতা আনহুইয়ে কৃষি শ্রমিক ছিলেন ও তিনি ১৩৪৪-এর দুর্ভিক্ষের সময়ে সন্ন্যাসী হন ও সেই সময় থেকে তিনি সেই প্রদেশে ভবিষ্যৎ ত্রাণকর্তা আগমনের প্রচলিত ঐতিহ্য দ্বারা প্রভাবিত হন। ১৩৬০ খ্রীষ্টাব্দের সময়কার বিদ্রোহী নেতৃত্বের মধ্যে কনফুসীয় নৈতিকতার সাথে রাজনৈতিক বিপ্লবের মিশ্রণ ঘটেছিল। এছাড়া ১৩৫৫ পরবর্তী গণবিদ্রোহে ইউয়ান কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের পতনের জন্য স্থানীয় কনফুসীয়দের প্রভাব ছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ John W. Dardess, Shun-ti and the end of Yüan rule in China, in, The Cambridge History of China, vol. 6, eds., Herbert Franke and Denis Twitchett, Cambridge University Press, Cambridge, 1994, p. 581.

----------------------------------------

১৩৫৫ থেকে ১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত সময় ছিল ছোট ছোট যুদ্ধের কাল। সমগ্র দক্ষিণ অঞ্চল জয় করার পর চু উত্তর দিকে যাত্রা করেন। ১৩৬৮ খ্রীষ্টাব্দে তার সামরিক অধিনায়করা প্রায় কোনো আঘাত ছাড়াই ইউয়ান বংশের মোঙ্গোলদের প্রধান রাজধানী পিকিং দখল করে নেয়। মোঙ্গল শাসক তার নিজস্ব পার্শ্বচরদের নিয়ে ঘোড়ার পিঠে চড়ে চীনের উত্তরে পলায়ন করে ও এর পরে দ্রুত মোঙ্গলিয়ায় চলে যায়। প্রায় কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই মোঙ্গল বংশের পতন ঘটে। মোঙ্গলদের বিচ্ছিন্ন সৈন্যবাহিনী যখন যেভাবে পারে উত্তরে যাত্রা করে।

চীনা বাহিনী ১৩৬৯-এ পূর্ব মোঙ্গলিয়ার শ্যাং-টু (কাই-পিং) দখল করে। ১৩৭০-এ মোঙ্গোলিয়ায় মোঙ্গোল সেনাবাহিনী চারিদিক দিয়ে চীনা বাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ হয়। ১৩৭১ খ্রীষ্টাব্দে জিচুয়ান ও ১৩৭২ ও ১৩৮২-তে যথাক্রমে কানসু ও ইউয়ান যেখানে তখনো মোঙ্গলদের কেন্দ্রীভূত অবস্থা ছিল পুনরায় চীনাদের অধিকৃত হয়। এরপর উত্তর-পূর্ব মোঙ্গলিয়ায় বিজয়ের মধ্য দিয়ে চীনের সম্প্রসারণ নিশ্চিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় ১৩৮৭ খ্রীষ্টাব্দে সমগ্র চীন একীভূত হয়। পরবর্তী শতাব্দী জুড়ে মোঙ্গলরা চীনের একটি শক্তিশালী শত্রু হিসাবে টিকে ছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Kenneth Pletcher (ed.), The History of China, Britannica Educational Publishing, New York, First edition, 2011, p. 189.

----------------------------------------

১৪০৩-৪ খ্রীষ্টাব্দে মোঙ্গলদের আবার পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয় ও কুবলাই খানের পরিবার থেকে আসা আরুকতাই-এর নেতৃত্বে মোঙ্গলরা পুনরায় চীন সীমান্তে সমবেশ ঘটায়। পিকিং-এর রাজসভা মোঙ্গলদের এই পুনরায় আগমনে উদ্বিগ্ন হল। চীন সম্রাট ইউং লু তার বাহিনী নিয়ে মোঙ্গলিয়ায় প্রবেশ করে উত্তর ওনোন ও চেঙ্গিস খানের জন্মস্থানের সমভূমি পর্যন্ত অগ্রসর হলেন এবং মোঙ্গলদের সম্পূর্ণ পরাজিত করলেন (১৪১০-১১ খ্রীষ্টাব্দ)। এই পরাজয় মোঙ্গলদের জন্য ধ্বংসাত্মক ছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ René Grousset, The Empire of the Steppes: A History of Central Asia, Translated from the French by Naomi Walford, Rutgers University Press, New Brunswick, New Jersey, 1970, p. 504.

----------------------------------------

চীনে মোঙ্গল শাসনের দ্বিতীয়ার্ধে অনেক জনপ্রিয় গণঅভ্যুত্থান ছিল শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও সামাজিক। প্রথমে সেগুলি বিদেশী হিসাবে মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় নাই। চু ইউয়ান-চ্যাং-এর অধীনে অভ্যুত্থান ক্রমে শক্তি পেয়েছিল, যা কেবল সামাজিক অভ্যুত্থান ছিল। যদিও তাকে বিপ্লবী হিসাবে বলা যায়। চু সাধারণ পরিবার থেকে আসা এমন ব্যক্তি যিনি একই সাথে বৌদ্ধ ভিক্ষু ও কৃষক নেতা হয়েছিলেন। মোঙ্গলরা জাতীয় আইনকানুন কঠোর করার পরেই কেবল এই বিপ্লবী অভ্যুত্থান জাতীয় অভ্যুত্থানে রূপান্তরিত হয় ও বিদেশীদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয়। কেবলমাত্র অভিজাতরা চু-এর সাথে যোগ দিবার পর ও তাদের প্রভাবে আসার পর বিত্তহীন মানুষদের অভ্যুত্থান সামাজিক কোনো পরিবর্তনের বদলে একটি রাজবংশের জায়গায় অন্য একটি রাজবংশ প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে পরিণত হয়।  অসম্মানজনক জাতিগত আইনের কারণে চীনাদের মধ্যে বিদেশীদের প্রতি যে ঘৃণা জন্ম নেয় তা মিং রাজত্বের সমগ্র সময় শাসক শ্রেণীর মধ্যে বজায় ছিল। বিদেশীদের নিম্ন সভ্যতার মানুষ ও শান্তির জন্য ক্ষতিকর বিবেচনা করে চীন তার সীমানা তাদের জন্য বন্ধ করে দেয়। এই সময় প্রায় সকল বিদেশীকে দেশ থেকে বিতাড়ন করা হয় অথবা হত্যা করা হয়। যদিও কিছু সংখ্যক বিদেশী ব্যবসায়ী চীনা নাম গ্রহণ করে চীনে থাকতে পেরেছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Wolfram Eberhard, A History of China, 1950, pp. 258, 259.

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৬২।

----------------------------------------

পাতা : ৩২

মোঙ্গল আক্রমণাভিযান প্রতিরোধে জাপানের অভিজ্ঞতা

মোঙ্গলরা চীন অধিকার করার পর কুবলাই খান ১২৬৩ খ্রীষ্টাব্দে চীনের সম্রাট হলেন। কোরিয়া মোঙ্গলদের অধীনস্থ হল। ১২৬৮ খ্রীষ্টাব্দে কুবলাই খান জাপানে চিঠিসহ দুত পাঠালেন। কামাকুরা তখন জাপানের শাসন-কেন্দ্র। চিঠিতে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, জাপানকে চীনের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক শুরু করা উচিত। চিঠিটিতে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে এই বলে শেষ করা হয় যে, যেখানে সম্পর্ক সমন্বয়পূর্ণ হয় না সেখানে যুদ্ধ অনুগমন করতে বাধ্য। এই চিঠির পরবর্তী পাঁচ বৎসর ধরে জাপানকে ভীতি প্রদর্শন করে বার্তা প্রেরণ করা হয়। কামাকুরা সরকার এর বিপদ সত্ত্বেও কুবলাই খানের দূতদের উত্তর দিতে অস্বীকার করে। এরপর চূড়ান্তভাবে ১২৭৪ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বরে, এক বৎসরেরও বেশী প্রস্তুতি নিয়ে কোরিয়া থেকে মোঙ্গল সৈন্যরা কোরিয়ান জাহাজে কোরীয়ান নাবিকদের নিয়ে সমুদ্রযাত্রা করে। জাহাজের সম্ভাব্য সংখ্যা ছিল ৪৫০ টি ও ১৫,০০০ মোঙ্গল সৈন্য। এছাড়া এর বাইরে ১৫,০০০ কোরিয়ান নাবিক ও সাহায্যকারী। তারা সহজেই সুশিমা ও ইকি দ্বীপ দখল করে নেয়। এখানে অল্প সংখ্যক জাপানী সামরিক বাহিনী বিপুল সাহসিকতার সাথে শেষ ব্যক্তিটি জীবিত থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করেছিল। মোঙ্গলরা এখানকার অধিবাসীদের সাথে প্রচণ্ড নিষ্ঠুরতার সাথে আচরণ করে।

মোঙ্গলরা ছিল দুর্ধর্ষ যোদ্ধা ও যুদ্ধে দক্ষ। তাদের নেতৃত্ব শুধু যে দীর্ঘকাল বড় সেনাবাহিনী পরিচালনায় অভিজ্ঞ ছিল তাই নয়, উপরন্তু তাদের হাতে শক্তিশালী ধনুক ছিল যা দিয়ে বহু দূর পর্যন্ত প্রাণঘাতী তীর নিক্ষেপ করা যেত। তাদের হাতে এমন যন্ত্র ছিল যা দিয়ে তারা ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করতে পারত। অন্য দিকে জাপানীদের অসুবিধা ছিল যে, তারা শিথিল সংগঠন অথবা কোনো সংগঠন ছাড়াই যুদ্ধ করতে অভ্যস্ত ছিল। এছাড়া তারা কিছু চীনা আগ্নেয়াস্ত্রের কারণে ঘাবড়ে যেত, যার মধ্যে এমন একটি যন্ত্র ছিল যেখান থেকে দাহ্য গুলি নিক্ষিপ্ত হত। তারপরেও শুধুমাত্র সাহসের জন্য তারা পৃথিবীর যে কোনো সৈনিকদের সমকক্ষ ছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ G.B. Sansom, Japan: A Short Cultural History, Revised Edition, Tuttle Publishing, Tokyo, first published 1931, p. 315.

----------------------------------------

মোঙ্গল বাহিনীর এই জাহাজগুলিকে এরপর কিউশুতে (Kyūshū) নিয়ে যাওয়া হয় ও সৈন্যরা হাকোযাকি উপসাগরের তীরে একটি স্থানে অবতরণ করে। এখানে যারা মোঙ্গলদের প্রতিরোধ করে তারা কিউশুতে স্থানীয় গোষ্ঠী প্রধান, জমিদারীর মালিক অথবা এর তত্ত্বাবধায়ক ছিল। তারা জানত যে কামাকুরা ও পশ্চিম জাপান থেকে বড় সেনাবাহিনী রওয়ানা দিয়েছে, যারা প্রত্যেকে যুদ্ধে বীর। এর পরেও তারা অপেক্ষা করে নাই। তারা তৎক্ষণাৎ শত্রুদের আক্রমণ করল। জাপানীদের প্রচুর ক্ষতি হল। কিন্তু তারা সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে গেল এবং পরে তাদের মাটির প্রাচীরের পিছনে ফিরে গেল ও তাদের সাহায্যে পাঠানো অতিরিক্ত সৈন্যবাহিনীর জন্য অপেক্ষা করল। কিন্তু অন্যদিকে অন্ধকার হবার পূর্বে আক্রমণকারীরা তাদের জাহাজে ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নিল। শত্রুরা পরের দিন আক্রমণ করতে চেয়েছিল। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড় ঘনীভূত হওয়ায় ও তারা বড় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল বলে জাহাজে থাকা নিরাপদ মনে করল। সেই রাত্রিতে একটি বড় ধরনের ঝড় আঘাত করল। ঝড়ের ফলে ভোরের মধ্যে আক্রমণকারীদের সকল রণতরী ভেসে গিয়েছিল অথবা মোঙ্গল বাহিনী নিরাপত্তার জন্য দূরে সমুদ্রের দিকে চলে গিয়েছিল। এই অভিযানে তারা তাদের বহু জাহাজ হারিয়েছিল। আক্রমণকারীরা যখন কোরিয়া ফিরে গেল তখন তারা দেখল যে, এই অভিযানে তারা ১৩,৫০০-এর বেশী লোক হারিয়েছিল। ইতিমধ্যে জাপানের কামাকুরা সরকার সকল পশ্চিমাঞ্চলীয় অঞ্চলের বংশানুক্রমিক সরকারী কর্মকর্তাদের আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রস্তুতির জন্য সৈন্য সংগ্রহের নির্দেশ দিল। জাপানের সামরিক প্রশাসন বাকুফু কুবলাই খানের ইচ্ছা জানত, যে তারা আবার একটি আক্রমণের উদ্যোগ নিবে। কয়েক মাস পরে কুবলাই খান জাপানী শাসককে তলব করে পিকিং-এ তার নূতন প্রাসাদে এসে আনুগত্য স্বীকার করার জন্য দূত পাঠালেন। এই উদ্ধত্যপূর্ণ ভাষার জন্য জাপানীরা অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হল। এই দৌত্যকাজে নিযুক্ত ছয় জন সদস্যের মাথা কেটে ফেলা হল ও প্রকাশ্যে জনসাধারণের মধ্যে প্রদর্শন করা হল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১৫।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১৬।

----------------------------------------

এটি মনে করা হয় যে, বাকুফু প্রশাসন বিদেশী জলদস্যুদের শাস্তি দিবার জন্য সমুদ্রের অপর তীরবর্তী দেশে, অর্থাৎ কোরিয়া বা চীনে, একটি অভিযান প্রেরণে মনস্থ করেছিল। তারা পশ্চিম জাপানের তীরবর্তী অঞ্চলসমূহে তাদের কর্মকর্তাদের পরের বৎসরের বসন্তকালে (১২৭৬ খ্রীষ্টাব্দে) কোরিয়া বা চীনে একটি আক্রমণের প্রস্তুতি নিবার জন্য নাবিক ও প্রধান মাঝি সংগ্রহ করার জন্য নির্দেশ দিয়েছিল। বলা হল যে, নির্দেশ দিলে তারা যেন হাকাতায় রণতরী প্রেরণের জন্য প্রস্তুত থাকে। সম্ভবত তাদের পরিকল্পনা ছিল যখনই তারা কোরিয়ার রাজার নৌবহর গঠন করার কথা জানবে তখনই কোরীয় পোতাশ্রয়ে একটি আকস্মিক আক্রমণ পরিচালনা করবে যাতে একটি বহিরাক্রমণের সম্ভাবনাকে আগেই পণ্ড করা যায়। কারণ কুবলাই খানকে তার সৈন্য পরিবহনের জন্য কোরিয়ার রাজার উপর নির্ভর করতে হবে। কোরীয় দলিল অনুযায়ী, জাপানী জাহাজসমূহ ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দে তাদের উপকূলে আক্রমণ করেছিল। ধারণা করা হয় যে, ১২৭৬ খ্রীষ্টাব্দে সম্ভবত জাপানীরা একটি আক্রমণ করেছিল। যদিও এ সম্পর্কে সঠিক দলিল নাই। ইতিমধ্যে জাপানের সামরিক প্রশাসক বাকুফু আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থার জন্য চাপ দিল। তারা কিউশু জমির মালিকদের হাকোযাকি উপসাগরের উপকূলে পাথরের ঢিবি নির্মাণের নির্দেশ দিল। এটি তৈরী করতে পাঁচ বৎসর লেগেছিল। এই সময় ধরে কুবলাই খান দক্ষিণ চীন থেকে সুং রাজবংশকে উৎখাত করার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এই কারণে ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দের আগে তার পক্ষে জাপানের দিকে মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় নাই। এরপর কুবলাই খান আরো একটি দূতের দল পাঠান, মোঙ্গল সাম্রাজ্যের সাথে সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে জাপানকে আমন্ত্রণ অথবা নির্দেশ দিয়ে। অন্য কথায় জাপানকে সামন্ত রাজ্য হিসাবে সমর্পণ করতে বললেন। বাকুফু প্রশাসন মোঙ্গল দূতদের মস্তক কেটে ফেলল এবং জোরের সাথে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করল। জাপান ও চীনের মধ্যে বাণিজ্য জাহাজ চলাচল করার কারণে ও উভয় দেশে পুরোহিতরা যাতায়াত করত বলে জাপানীরা চীন সম্পর্কে ভাল খবর রাখত। ফলে জাপানীরা কুবলাই খানের ইচ্ছা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা পেয়েছিল। এরপর কুবলাই খান শেষ বারের মত দূত প্রেরণ করলেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩১৬, ৩১৭।

----------------------------------------

বাকুফুর ডাকে সামন্তরা সক্রিয়তার সাথে প্রতিক্রিয়া জানাল। জমিদারীর অনেক তত্ত্বাবধানকারী ও গৃহের লোকজন তাদের ক্ষমতা অনুযায়ী সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসল। যখন বিপদ নিকটে এল সামরিক শ্রেণী অত্যন্ত সাহসের সাথে নিজেদের যুদ্ধাস্ত্রসহ যুদ্ধ উদ্যোগে শামিল হল। ১২৮০ খ্রীষ্টাব্দের শেষের দিকে বাকুফু জানল যে, মোঙ্গলরা পরের বৎসর বসন্তে আক্রমণ করবে। তখনকার শাসক তোকিমুনে তার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মাধ্যমে সামন্তদের আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করার প্রস্তুতি নিতে বললেন। তিনি প্রতিজ্ঞা করলেন যে, যারা ভালভাবে কর্তব্য পালন করবে তাদের পুরষ্কার দেওয়া হবে এবং যারা আচরণে আনুগত্য প্রদর্শন করবে না তাদের ভয়ানক ও দীর্ঘস্থায়ী শাস্তি দিবেন। সম্রাটও যারা বাকুফুর সামন্ত নয় সেই সমস্ত ভূমির মালিকদের ও প্রধান মন্দিরসমূহের অধীনস্থ জমিদারীর কর্মকর্তাদের শাসনকর্তার মত একই রকম নির্দেশ প্রদান করলেন। পশ্চিমাঞ্চলের প্রদেশসমূহের ভূসম্পত্তির প্রধানদের কাছ থেকে পাওয়া খাজনা সেনাবাহিনীর জন্য বরাদ্দ করা হল। সম্রাট মন্দিরসমূহে প্রার্থনা করার জন্য নির্দেশ দিলেন ও ধর্মীয় সকল উদ্যোগের তিনি নেতৃত্ব দিলেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২১।

----------------------------------------

১২৮১ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে মোঙ্গলদের কাছ থেকে আঘাত আসল। মোঙ্গলরা দু’টি ভাগে ভাগ হয়ে জাপানের উদ্দেশ্যে নৌবহর পাঠাল। একটি কোরিয়া থেকে প্রায় ৫০,০০০ মোঙ্গল ও কোরিয়ান এবং অপরটি দক্ষিণ চীন থেকে প্রায় ১০০,০০০ চীনা বাহিনী। কোরিয়ান নৌবহর ২৩ শে জুনে কিউশুতে সৈন্য অবতরণ করাল। পরবর্তীতে দক্ষিণের নৌবহর আলাদা ভাগে একের পর এক এসে পৌঁছাল। হাকাতা উপসাগরের কাছে জাপানের উপকূলে তাদের শক্তিশালী বাহিনী অবতরণ করাল। এখানে জাপানীদের আগেই তৈরী করা দেওয়াল কার্যকর প্রতিরোধ ব্যবস্থা হিসাবে প্রমাণ রাখল। উপকূলে জাপানীরা সাহসিকতার সাথে যুদ্ধ করেছিল আর জলে মোঙ্গল জাহাজগুলি জাপানীদের ছোট পোতের আক্রমণে ব্যাপক ধ্বংসের মুখে পড়েছিল। তারা শেষ পর্যন্ত যুদ্ধে জয়লাভ করতে পারত কীনা তা বলা কঠিন। এই যুদ্ধ আক্রমণকারীদের প্রথম জাপানে অবতরণ থেকে পঞ্চাশ দিনেরও বেশী চলেছিল বলে ধারণা করা হয়। তারপর এক প্রচণ্ড ঝড় আসল ও দুই দিন ধরে চলল। এটি এত শক্তিশালী ছিল যে এর ফলে বড় গাছগুলি উপড়ে গেল। শত্রুদের জাহাজগুলি বাতাসে বা জোয়ারের ফলে বিশৃঙ্খল অবস্থায় সংকীর্ণ প্রণালীসমূহে তাড়িত হল। এখানে অনেক জাহাজ আটকে গেল ও ধ্বংসপ্রাপ্ত হল। তাদের নাবিকেরা জাপানীদের সহজ শিকারে পরিণত হল। একটি দলিল থেকে জানা যায় যে, ৪,০০০ জাহাজের মধ্যে কেবলমাত্র ২০০ টি রক্ষা পেয়েছিল। এছাড়া আক্রমণকারী সৈন্যদের ১৫০,০০০-এর মধ্যে এক পঞ্চমাংশও বাঁচে নাই। এটি সম্ভবত অতিরঞ্জন, তবে এ বিষয়ে খুব কম সন্দেহ আছে যে কোরিয়া থেকে আসা সৈন্যদের মধ্যে যেখানে বেশীরভাগই মোঙ্গল ছিল, তারা প্রায় অর্ধেক মারা গিয়েছিল। আর দক্ষিণের নৌবহরের ক্ষতি আরো বেশী হয়েছিল।  মোঙ্গলদের কাছ থেকে আরো আক্রমণের ভয়াবহ বিপদ আরো কুড়ি বৎসর ধরে চলেছিল। ১৩০০ খ্রীষ্টাব্দে কুবলাই খান মারা যাবার পর মোঙ্গলরা জাপানকে পদানত করার আকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করে।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৩২২।

----------------------------------------

পাতা : ৩৩

মোঙ্গলদের দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির লড়াইয়ে রাশিয়ার অভিজ্ঞতা

১২২৭ খ্রীষ্টাব্দে চেঙ্গিস খান মারা যাবার সময় তার মোঙ্গল সাম্রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশের দায়িত্বভার তার বড় পুত্র জোচিকে দেন। কিন্তু জোচিকে দেওয়া রাশিয়া ও ইউক্রেনের বেশীরভাগ অংশ  তখনো মোঙ্গলরা জয় করে নাই। জোচি মারা গেলে তার দায়িত্বভার পড়ে তার পুত্র বাতুর উপর। ১২৪১ খ্রীষ্টাব্দে পশ্চাদপসারণের পূর্ব পর্যন্ত বাতুর সেনাবাহিনী অড্রিয়াট্রিক ও অস্ট্রিয়ার উপত্যকায় পৌঁছে। তিনি যে রাজ্য পরিচালনা করেন সেখানে তার অধীনস্থ মোঙ্গলরা ’গোল্ডেন হোর্ড’ নামে পরিচিতি পায়। গোল্ডেন হোর্ডের ক্ষমতা ও সমৃদ্ধি চতুর্দশ শতাব্দীর দ্বিতীয় চতুর্থাংশে সর্বোচ্চ শিখরে উঠেছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Daniel C. Weugh, The Golden Horde and Russia, in, Genghis Khan and the Mongol Empire, ed., William Fitzhugh, Morris Rossabi and William Honeychurch, Dino Don: Mongolian Preservation Foundation; Washington, D.C.: Arctic Studies Center, Smithsonian Institution; [Seattle]: University of Washington Press, 2009   p. 173.

----------------------------------------

১২৩০-এর দশকের শেষের দিকে, তারা বুলগারদের পরাজিত করে, যারা মধ্য ভোলগা অঞ্চল দখল করেছিল। এছাড়াও তারা পোলোভট্সি-দের পরাজিত করে যারা আযভ সাগরের উত্তরে তৃণভূমিসমূহ ও ককেসাস নিয়ন্ত্রণ করত। এরপর বাতু রাশিয়ান ক্ষুদ্র রাজ্যসমূহে অভিযান প্রেরণ করেন ও ১২৩৭ খ্রীষ্টাব্দের শেষে রিয়াযান ধ্বংস করেন। পরের বৎসর ভ্লাদিমির-সুযদালের গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ও তখন পর্যন্ত তাৎপর্যহীন মস্কো দখল করেন। এরপর মোঙ্গলরা দ্রুতবেগে রাশিয়ার এক সময়ের বড় অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কেন্দ্র কিয়েভ দখল করে। ১২৪১ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে তাদের বাহিনী দক্ষিণে বুদাপেস্ট ও উত্তরে পোল্যান্ডের লিজনিয-এ পৌঁছায়।  ১২৩৭ থেকে ১২৪০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মোঙ্গলদের আক্রমণাভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধে অনেক রাশিয়ান রাজপুত্র ও অভিজাত যুদ্ধ করেছিল, যারা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুবরণ করে।

----------------------------------------

পোলোভট্সি-রা হল তুর্ক (Turkic) ভাষাভাষী একটি যাযাবর গোষ্ঠী, যারা মধ্য এশিয়ায় বসবাস করত।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৭৪।

চেঙ্গিস খানের যে সমস্ত বংশধর দক্ষিণ ও পূর্ব রাশিয়া অধিকার করেছিল তারা সকলে মোঙ্গল ছিল। অনেকে তাদেরকে ভুলক্রমে তাতার হিসাবে চিহ্নিত করেন। দেখুনঃ René Grousset, The Empire of the Steppes: A History of Central Asia, 1970, p. 472.

দেখুনঃ Charles J. Halperin, Russia and the Golden Horde, Indiana University Press, Bloomington, 1985, p. 49.

----------------------------------------

মোঙ্গলদের হাতে রাশিয়ার নগরসমূহের পতন হলে তারা প্রায় ক্ষেত্রেই সমগ্র নগর ধ্বংস করে ফেলত ও অধিবাসীদের উপর গণহত্যা পরিচালনা করত। এভাবে তারা আতঙ্ক সৃষ্টিকারী যুদ্ধ পরিচালনা করত। নিষ্ঠুরতার সাথে ধ্বংসকাণ্ড পরিচালনা করে মোঙ্গল সেনাবাহিনীর সম্পর্কে ভীতি উৎপাদন করা তাদের কৌশল ছিল। ১২৩৭ থেকে ১২৪০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত মোঙ্গল অভিযানে অনেক সমৃদ্ধ নগর ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল ও তাদের নাগরিকদের হত্যা করা হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে শস্যক্ষেত্র তারা জ্বালিয়ে দিত। এর ফলে সমগ্র রাশিয়া জুড়ে জনসংখ্যা কমে গিয়েছিল, বিশেষভাবে ব্যাপক জনসংখ্যা কমেছিল লুণ্ঠিত নগরগুলিতে। মোঙ্গলরা রাশিয়ার অর্থনীতিকে বিধ্বস্ত করে ফেলে ও কিয়েভের গ্রন্থাগারসমূহ ধ্বংস করে। চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ইসলাম গোল্ডেন হোর্ড-দের সরকারী ধর্মে পরিণত হয়। এরপর তারা মসজিদ তৈরী করতে থাকে ও ইসলামী শিক্ষাকে পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করতে শুরু করে।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৭৫, ৭৬।

----------------------------------------

দুই শত বৎসরেরও বেশী সময় পরে ১৪৬৮ খ্রীষ্টাব্দে এই মোঙ্গলদের রাশিয়ান প্রতিআক্রমণকে প্রতিরোধ করতে হয়। ১৫২১ খ্রীষ্টাব্দে মোঙ্গলদের একটি অংশ আকস্মিক রাশিয়ানদের উপর আক্রমণাভিযান চালায় ও ওকা নামে একটি জায়গায় রাশিয়ান সেনাবাহিনীকে ধ্বংস করে, এবং মস্কোর উপকণ্ঠে পৌঁছায়। মস্কো তখন একটি গুরুত্বপূর্ণ শহর ও রাজধানী। তবে মোঙ্গলরা রাশিয়ানদের রাজধানীতে আক্রমণ করার সাহস পায় নাই, কিন্তু স্থানীয় শাসকদের কাছ থেকে বাৎসরিক কর আদায়ের সম্মতি নেয়। তারা কাফার বাজারে দাস হিসাবে বিক্রী করার জন্য অসংখ্য যুদ্ধ বন্দী নিয়ে যায়।  ১৫২৩ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদ গিরেই-এর নেতৃত্বে মোঙ্গলরা আবার রাশিয়ায় আক্রমণের চেষ্টা করে। কিন্তু রাশিয়ান সৈন্যরা গোলন্দাজ বাহিনীর সহায়তায় ওকায় তাদেরকে আটকে ফেলে।

----------------------------------------

কাফা (Caffa) হল ক্রিমিয়ার একটি শহর।

দেখুনঃ René Grousset, The Empire of the Steppes: A History of Central Asia, 1970, p. 473.

----------------------------------------

মস্কোর জার ৪র্থ ইভান দ্য টেরিবল বা ভয়ংকর ইভান (১৫৩৩-১৫৮৪) স্থির করলেন যে, মোঙ্গলদের একটি অংশের অধীন কাযান (রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি শহর) অধিকার করবেন। ১৫৫২ খ্রীষ্টাব্দের জুন মাসে তিনি শক্তিশালী গোলন্দাজ বাহিনীর সমর্থনে শহরটিকে অবরোধ করলেন। এরপর তিনি আক্রমণ করে তা দখল করেন ও পুরুষ জনসংখ্যার বড় একটি অংশের উপর গণহত্যা পরিচালনা করেন ও নারী ও শিশুদের দাস করেন। তিনি এখানকার মসজিদগুলি ধ্বংস করেন ও মোঙ্গলদের এই অঞ্চলকে নিজ রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করেন।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৭৫।

----------------------------------------

 কাযানে মোঙ্গলদের ধ্বংস ছিল রাশিয়ার সাথে মোঙ্গলদের সম্পর্কের মোড় পরিবর্তনকারী ঘটনা। প্রায় সাথে সাথেই আস্ত্রাখানের মোঙ্গলদের উপর বিজয় ঘটেছিল। ১৫৫৪ খ্রীষ্টাব্দে ভয়ংকর ইভান ৩০,০০০ সেনাবাহিনী আস্ত্রাখানে পাঠান ও সেখানে দরবিশ নামে একজন মোঙ্গলকে করদ শাসক হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। দরবিশ বিদ্রোহ করলে ও রাশিয়ান প্রতিনিধিকে বিতাড়ন করলে ১৫৫৬ খ্রীষ্টাব্দে রাশিয়ান সেনাবাহিনী পুনরায় আসলে দরবিশ পলায়ন করেন ও আস্ত্রাখান রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত হয়। ক্রিমিয়ার শেষ মোঙ্গলরা আরো দুই শত বৎসর টিকে ছিল। ওসমানীয় সাম্রাজ্যের সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেওয়ায় তারা নিরাপত্তা পায়। ১৭৭৪ খ্রীষ্টাব্দে একটি চুক্তির বলে রাশিয়ানরা ইস্তানবুলের ওসমানীয় সাম্রাজ্যকে ক্রিমিয়ার স্বাধীনতার প্রতি স্বীকৃতি দিতে বাধ্য করে। রাশিয়ার প্রতিনিধিরা মোঙ্গল বংশীয় শাহিন গিরেইকে শাসক হিসাবে নিয়োগ করে। কিছু পরেই ক্রিমিয়ার অভিজাতরা শাহিনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে তিনি রাশিয়ার সাহায্য চান। রাশিয়ানরা ৭০,০০০ সৈন্যসহ ক্রিমিয়া পৌঁছে ও ১৭৮৩ খ্রীষ্টাব্দে তাকে রাশিয়ার সাথে সংযুক্ত করে। এভাবে শাহিন গিরেই-এর পতনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে মোঙ্গলরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪৭৩-৪৭৭।

----------------------------------------

পাতা : ৩৪

আরব মুসলিমদের দখলদারিত্ব থেকে মুক্তির লড়াইয়ে স্পেনের অভিজ্ঞতা

স্পেনে যখন মুসলিম আক্রমণাভিযান পরিচালিত হয় তখন স্পেন ছিল ভিসিগথদের শাসনাধীনে। তারা ছিল খ্রীষ্টীয় পঞ্চম শতকের প্রথম দিকে উত্তর ইউরোপ থেকে আসা জার্মান জনগোষ্ঠী। তারা ধর্মে প্যাগান বা পৌত্তলিক ছিল। তাদের স্পেন শাসনকালে মুসলমানরা যেমন তলোয়ারের ডগায় মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে পরাজিতদের মুসলমান ধর্মে দীক্ষিত করত তারা তেমন কোনো জবরদস্তি করে নাই। প্রথম দিকে পৌত্তলিক ভিসিগথ শাসকরা ইহুদী, খ্রীষ্টান বা পৌত্তলিক নির্বিশেষে সকল প্রজার ধর্মের প্রতি সহনশীল ছিল। পরে তারা ক্যাথলিক খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলে ইহুদী ও পৌত্তলিক প্রজাদের প্রতি তাদের সহনশীলতা কমে যায়।

----------------------------------------

দেখুনঃ এম,এ, খান, জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, বদ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০, পৃঃ ১০৭, ১০৮।

----------------------------------------

স্পেনে ইসলামের ইতিহাস শুরু হয় ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে, যখন মুসলিম সেনা-কমাণ্ডার তারিক বিন যাইদ ভূমধ্যসাগর পার হয়ে জিবরালটারের মাটিতে পা দেন। এরপর তারা আইবেরিয়ান উপদ্বীপের বেশীর ভাগ অঞ্চল দখল করে নেয়। স্পেনে মুসলিম শাসন ৮০০ বৎসর স্থায়ী ছিল।

যে সমস্ত মুসলমান স্পেনে প্রবেশ করেছিল তাদের মধ্যে ছিল ইয়েমেনী জাতিগোষ্ঠীর সুন্নী ও উত্তর আরবের বংশোদ্ভূত শিয়া। তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। পশ্চিমাঞ্চলীয় স্পেনের নগর মেরিদা জয়ের মধ্য দিয়ে মুসলিমদের স্পেনে সামরিক বিজয় হয়। মুসলিমদের সামরিক বিজয়ে সাত বৎসর (৭১১ থেকে ৭১৮ খ্রীষ্টাব্দ) লেগেছিল। এখানে আক্রমণকারীদের প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। স্পেনের জনগণ বৈশিষ্ট্যপূর্ণ রীতিতে গেরিলা দলে যুদ্ধ করে প্রচণ্ড সাহসিকতার সাথে নিজেদের শহর রক্ষা করেছিল। কিন্তু তাদের নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা ছিল না। কিছু অভিজাত লোক বিজেতাদের সাথে এমন চুক্তি করেছিল যেখানে তাদের ভূসম্পত্তি অধিকারে রাখার অনুমতি ছিল। কিন্তু অধিকাংশ স্পেনীয়ই মুসলিম বিজেতাদের বিরোধিতা করেছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Charles E. Chapman, A History of Spain, founded on the Historia de España y de la Civilización Españaola, The Free Press, New York, First Free Press Publishing Edition 1965, p. 40.

----------------------------------------

মুসলিম আক্রমণকারীরা স্পেন অধিকার করেই লুণ্ঠন, হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক ধর্মান্তরকরণ ও নারী ও শিশুদের দাসকরণ শুরু করে। কেবলমাত্র মর্যাদাসম্পন্ন ভিসিগথ পরিবার থেকেই তিরিশ হাজার শ্বেতাঙ্গ কুমারী নারীকে তারা দাস করে। এক অভিযানে মুসলমানরা প্রতিটি চার্চ ধ্বংস করে ও সেইগুলির ঘন্টা ভেংগে ফেলে। স্পেনীয়রা আত্মসমর্পন করলে মুসলমানরা যুদ্ধে নিহতদের ধনসম্পদ, গ্যালিসিয়ায় পলাতকদের ধনসম্পদ এবং চার্চের ধনসম্পদ ও সোনা, হীরা-জহরত লুণ্ঠন করে।

----------------------------------------

দেখুনঃ এম,এ, খান, জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, ২০১০, পৃঃ ১০৮।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৮।

----------------------------------------

উত্তর স্পেনের পর্বতসংকুল সংকীর্ণ দীর্ঘ অংশ ছাড়া ৭১৮ খ্রীষ্টাব্দে সমগ্র উপদ্বীপ মুসলিম সৈন্যরা বিধ্বস্ত করেছিল। এই সময় তারা পাইরেনিজ পর্বতমালা অতিক্রম করে দক্ষিণ ফ্রান্সে পৌঁছেছিল। এই সময় স্পেনকে আফ্রিকার একটি জিলা হিসাবে সংগঠিত করে একজন আমির দিয়ে শাসন করা হচ্ছিল। একটা সময়ে দখলকারীরা সংখ্যাধিক্য হলে তারা স্পেনীয় জনসাধারণকে তাদের বিশ্বাস ধরে রাখাকে নূতন শাসকদের জন্য বেশী সুবিধাজনক মনে করল। তখন স্পেনে ধর্মান্তরকরণের চেয়ে বরং কম বা বেশী প্রণালীবদ্ধ লুণ্ঠন সুবিধাজনক ছিল।

----------------------------------------

দেখুনঃ Charles E. Chapman, A History of Spain, 1965, p.40, 41.

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৪১।

----------------------------------------

৭১১ খ্রীষ্টাব্দে স্পেনে ইসলামের বিজয়ের সময় থেকে ধরলে চার দশকেরও বেশী সময় ধরে সেখানে সাঙ্ঘাতিক বিশৃঙ্খলা ও নিষ্ঠুরতা চলেছিল। আবদ আল-রহমান সেখানে উমাইয়া রাজবংশ (৭৫৬-১০৭১ খ্রীষ্টাব্দ) প্রতিষ্ঠা করলে দৃশ্যত একটা স্থিতিশীলতা ফিরে আসে। উমাইয়া শাসকরা তুলনামূলক সহনশীলতার সাথে শাসন করত ও অমুসলিমদের ধর্মান্তরিত করতে চাপ প্রয়োগ করে নাই। জিজিয়া করের মাধ্যমে রাজকোষে অর্থ সমাগমকে তারা সুবিধাজনক মনে করত। মুসলিমরা অনেক সামরিক অভিযান চালায় যার প্রধান উদ্দেশ্য বিজয়ের চেয়ে শত্রুপক্ষের শস্যখেত ধ্বংস করা ও লুণ্ঠন চালানো। স্পেনের উমাইয়া শাসক আবদ আল-রহমান ৩-এর সময়ে শুধু দাস নয় আরবদের চরিত্র অনুযায়ী নারী বেচা-কেনাও গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ৫০।

----------------------------------------

 ১০১০ ও ১০১৩ খ্রীষ্টাব্দের মধ্যে কর্ডোভার নিকটবর্তী অঞ্চল ও স্পেনের অন্যান্য অঞ্চলে মুসলিমরা হাজার হাজার ইহুদীকে হত্যা করে। ১০৬৬ খ্রীষ্টাব্দের এক দাংগায় গ্রানাডার ৪,০০০ ইহুদীর একটা গোটা সম্প্রদায়কে গণহত্যার মাধ্যমে নির্মূল করা হয়। ১১৪৮ খ্রীষ্টাব্দে আলমোহাদরা কর্ডোভা বিজয়ের পর ইহুদীদের হয় ইসলাম গ্রহণ নতুবা মৃত্য কিংবা নির্বাসন– এই তিনটির একটি বেছে নিবার নির্দেশ দেওয়া হয়।

----------------------------------------

দেখুনঃ এম,এ, খান, জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, ২০১০, পৃঃ ১০৮, ১০৯।

----------------------------------------

শেষে মুসলিম স্পেনে ক্ষয় ও বিচ্ছিন্নতা শুরু হলে, ক্যাস্টিলের ইসাবেলা ১ (১৪৭৪-১৫০৪ খ্রীষ্টাব্দ) ও আরাগনের ফার্দিনান্ড ২ (১৪৭৯-১৫১৬ খ্রীষ্টাব্দ) ১৪৯২ খ্রীষ্টাব্দে শেষ মুসলিম ঘাঁটি গ্রনাডা পুনরায় জয় করেন। ক্যাথলিক রাজারা সুলতান বোয়াবদিলের সাথে এক চুক্তির বলে এই জয়কে চিহ্নিত করেন। এই চুক্তির বলে মুসলমানদের থাকার অনুমতি দেওয়া হল। তবে এই চুক্তিকে সম্মান জানানো হয় নাই। স্পেনকে জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে সুদৃঢ় করার অংশ হিসাবে মুসলমান ও ইহুদীদের খ্রীষ্টান হিসাবে ধর্মান্তরিত হওয়া অথবা দ্বীপান্তরিত হওয়া বেছে নিতে বলা হয়। যারা ধর্মান্তরিত হয়েছিল বা তা হবার ভান করেছিল তাদের সন্দেহের মধ্যে রাখা হয় ও তুর্কীদের গোপন সৈন্যদলের সদস্য বলে বিবেচনা করা হত। মুসলমানদের বাধ্যতামূলক খ্রীষ্টান হওয়া দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলল ও ১৫০২ খ্রীষ্টাব্দে রাজকীয় একটি আদেশ প্রদান করা হল যেখানে বলা হল যে, ক্যাস্টিলিনিয়া অঞ্চলে বসবাসরত সকল মুসলমানকে হয় খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে হবে নতুবা দেশ ছাড়তে হবে। অনেকে দেশ ছাড়লেও বেশীরভাগই খ্রীষ্টান হল। মনে করা হয় তারা বাইরের আচরণে খ্রীষ্টান ধর্ম গ্রহণ করলেও অন্তরে সম্ভবত তা ছিল না।  সরকারীভাবে ক্যাস্টিলে দাস ছাড়া কোনো মুসলমান ছিল না। এই নূতন ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টানরা তাদের পুরাতন বিশ্বাসের প্রতি অনুগত থাকত ও খ্রীষ্টীয় ধারণা তাদের প্রেরণা দিত না। ফলে পরবর্তীতে তাদের ভীতিকর ইনকুইজিশনের অধীন হতে হয়েছিল। শুধু তাই নয়, স্পেনে বসবাসরত ইহুদীদেরও ক্যাথলিক স্পেনের শাসকরা উচ্ছেদ করার পদ্ধতি গ্রহণ করে।

----------------------------------------

দেখুনঃ Charles E. Chapman, A History of Spain, 1965, p. 205.

----------------------------------------

স্পেনের রাজা ফিলিপ ২-এর সময়ে (১৫৫৬-১৫৯৮ খ্রীষ্টাব্দ) গৃহযুদ্ধ শুরু হলে গ্রানাডার যে সমস্ত মুসলমান খ্রীষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিল, তাদের খ্রীষ্ট ধর্মের প্রতি আনুগত্য সম্পর্কে শাসকদের মধ্যে সন্দেহের কারণ দেখা দেয়। সাধারণ জনগণ বিশেষভাবে যাজক সম্প্রদায় তাদের বিরুদ্ধে অত্যন্ত বিরক্ত ছিল। ফলে তারা আইনের এমন সব অংশ প্রয়োগে প্ররোচিত করেছিল যা এই ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টানদের প্রতি আরো বেশী কঠোর ছিল। ১৫২৬ খ্রীষ্টাব্দে একটি অনুশাসন বলে আরবী ভাষা বা পোষাক ব্যবহার, মুসলিম রীতিতে স্নান করা, অস্ত্র বহন করা, অ-খ্রীষ্টীয় নাম ব্যবহার করা এবং মুক্ত বা দাস মুসলমানদের তাদের বাসায় বসবাস করতে দেওয়া নিষিদ্ধ করা হয়। এই সমস্ত ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টান যেন মুসলিম ধর্মীয় রীতি পালন না করে সেই জন্য তাদের পীড়নমূলক পর্যবেক্ষণে রাখা হয়। তাদের শিশুদের খ্রীষ্টীয় বিদ্যালয়ে পাঠানো বাধ্যতামূলক করা হয়। খ্রীষ্টধর্ম ত্যাগের বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগ করার জন্য গ্রনাডায় ইনকুইজিশনের একটি শাখা স্থাপন করা হয়। বহু বৎসর কোনো পরিবর্তন ছাড়াই এই পরিস্থিতি চলেছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ২৪৮, ২৪৯।

----------------------------------------

শেষে ১৬০৯ খ্রীষ্টাব্দে ফিলিপ ৩ প্রায় ৩০০,০০০ মুসলমান থেকে ধর্মান্তরিত খ্রীষ্টানকে (যারা খ্রীষ্টান হবার ভান করেছিল) বহিষ্কারের জন্য একটি নির্দেশে সই করেন। পরবর্তী সাড়ে তিন শতাব্দী ধরে স্পেনে মুসলমানদের উপস্থিতি ধর্তব্যের মধ্যে ছিল না, শুধুমাত্র মেলিলা ও সিউটা ছাড়া। মরক্কোর উপকূলে এই দু’টি ছিটমহল যথাক্রমে ১৫শ ও ১৬শ শতাব্দী পর্যন্ত স্পেনের দখলে ছিল। ১৮৬০-এ একটি চুক্তির বলে এখানে মরক্কো স্পেনীয় সার্বভৌমত্ত্ব স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল । 

পাতা : ৩৫

দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিমদের আক্রমণ প্রতিরোধে ব্যর্থতার কারণ

আগের আলোচনায় দেখেছি ভারতবর্ষে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু ও আশেপাশের অঞ্চলে জয় একেবারে বাধাহীন ছিল না। ভারতীয়রা সাহসিকতার সাথে মুসলিমদের প্রতিরোধ করে। কিন্তু তারা বহিরাগত আক্রমণকারীদের কার্যকর প্রতিরোধে ব্যর্থ হয়। ভারতবর্ষ কেন বহিরাগত আক্রমণকারী মুসলিমদের প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছিল তার কারণ অনুসন্ধান প্রয়োজন।

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের শেষ পর্যায়ে মহারাষ্ট্রে মারাঠা ও পাঞ্জাবে শিখ উত্থান ঘটে। এটি তাৎপর্যপূর্ণ যে, শিখরা মোগলদের শক্তিশালী প্রতিরোধ করতে পারলেও মারাঠারা সেই রকম প্রতিরোধ করতে পারে নাই। শিবাজীর মৃত্যুর পর মারাঠারা প্রধানত লুণ্ঠনের দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই প্রসঙ্গে বাংলায় মারাঠাদের আক্রমণ, লুণ্ঠন, হত্যা ও নারী-নিগ্রহের কথা উল্লেখ করা যায়, যা বঙ্গে বর্গীর হাঙ্গামা হিসাবে পরিচিত। এই বর্গীর হাঙ্গামার চিত্র পাওয়া যায়, শিশুদের ঘুম পাড়াতে ব্যবহার করা বিখ্যাত এই ছড়াটি থেকে,

“ছেলে ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে।

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কীসে?”

বাংলার তৎকালীন নবাব আলীবর্দী খানের সময়ে ১৭৪২ খ্রীষ্টাব্দ থেকে শুরু করে প্রায় নয় বৎসর ধরে মহারাষ্ট্র থেকে মারাঠিরা বাংলায় লুটপাট চালাতে আসত। এই সময় তারা বাংলায় এক ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল। তারা দলে দলে ঘোড়ায় চড়ে এসে গ্রামের বাড়ী-ঘর থেকে লুটপাট চালাত, টাকা-পয়সা নিয়ে যেত, ঘরে আগুন লাগাত ও নারীদের ধর্ষণ করত। মারাঠারা কোনো রাজ্য বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে আসত না। কেবল চৌথ নামে রাজকরের এক চতুর্থাংশ তারা দাবী করত।  যদিও চৌথ দাক্ষিণাত্যের অনেক জায়গায় চালু হয়েছিল কিন্তু বাংলায় হয় নাই। এক সময়ে উড়িষ্যা, রাজমহল ও বাংলার মেদিনীপুর, বর্দ্ধমান ও রাজশাহীর কিছু অংশ মারাঠাদের দখলে চলে গিয়েছিল। মারাঠাদের ভয়ে বহু মানুষ পালিয়ে দূরে চলে গিয়েছিল। ফলে এই সময়ে ব্যবসা-বাণিজ্য ও ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। এই মারাঠারা ছিল ধর্মে হিন্দু। মারাঠাদের সাথে বাংলার তৎকালীন নবাব আলীবর্দীর ১০টি যুদ্ধের পর তাদের সাথে সন্ধি হলে বাংলায় মারাঠাদের উপদ্রব বন্ধ হয়।

----------------------------------------

দেখুনঃ বিহারীলাল সরকার, বঙ্গে বর্গী, কারিগর, ২০১৬, কলকাতা, প্রথম প্রকাশ ১৩১৪ সাল (বাংলা), পৃঃ ২২

দেখুনঃ সৈয়দ গোলাম হুসায়ন খান তাব্তাবায়ী (মূল), সিয়ারে মুতাখ্খিরীন, প্রথম খণ্ড, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ ১৯৭৮, পৃঃ ৪৭৭।

----------------------------------------

বহিরাগত আক্রমণকারী মুসলিমদের আক্রমণাভিযান প্রতিরোধে হিন্দু ভারতের ব্যর্থতার প্রধান কারণ হিন্দু সমাজের অনৈক্য। হিন্দু ধর্ম নিজেদের মধ্যে অসংখ্য কুলগত বা বংশগত বিভাজন সৃষ্টি করায় তা সামাজিক ঐক্যের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে দাঁড়ায়। বহিরাগত আক্রমণকারীদের আক্রমণ ঘটলে যখন প্রতিরোধের জন্য সামাজিক ঐক্যের প্রয়োজন সবচেয়ে বেশী তখন এই ঐক্যের বিরুদ্ধে সামাজিক ও ধর্মীয় বাধা হয়ে দাঁড়ায় হিন্দু ধর্মের ধর্মবিশ্বাস-ভিত্তিক বর্ণজাতিভেদ প্রথা দ্বারা সৃষ্ট সামাজিক বিভাজন। এর ফলে বিদেশী আক্রমণকারীদের প্রতিরোধে হিন্দু ভারত বার বার ব্যর্থ হয়েছে। শক-হুনদের আক্রমণের সময় ভারতবর্ষ অনেকাংশে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের প্রভাবাধীনে ছিল। ফলে বহিরাগত আক্রমণ উত্তর-পশ্চিম ভারত পার হয়ে মধ্য, পূর্ব ও দক্ষিণ ভারতে পৌঁছাতে ব্যর্থ হয়েছিল। গুপ্ত যুগের সময় থেকে ভারতবর্ষ ক্রমাগত হিন্দু ধর্মের প্রভাবাধীনে আসতে থাকলে হিন্দু ধর্মের বর্ণজাতিভেদের কাঠামো দৃঢ়ীভূত হতে থাকে। অনুমান করা যায়, ৭১১ খ্রীষ্টাব্দে যখন মুহাম্মদ কাসিম সিন্ধুতে আক্রমণাভিযান পরিচালনা করেন তখনও ভারতবর্ষ সম্পূর্ণ হিন্দু ভারতে পরিণত হয় নাই। সেই সময় বৌদ্ধ ধর্মের অনেকটা প্রভাব ছিল, যা চাচনামাহ্ থেকে ধারণা করা যায়। ফলে মুসলিম আক্রমণকারীদের ভারতবর্ষ অধিকার করতে আরো প্রায় তিন শত বৎসর লেগেছিল। ১০০১ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদ ভারতবর্ষে ধারাবাহিক আক্রমণের সূচনা করেন। এর প্রায় এক শত বৎসর পরে ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে মুহাম্মদ বখতিয়ার খলজী কর্তৃক রাজা লক্ষণ সেনকে পরাজিত করার মধ্য দিয়ে মুসলিমদের বাংলার উপর কার্যত বিজয় ঘটে। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে দাক্ষিণাত্যের কিছু অংশ বাদে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ মুসলিম শাসনাধীনে চলে যায়। খ্রীষ্টীয় দশম-একাদশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষ মূলত হিন্দু ধর্মের প্রভাবাধীনে চলে আসে। ধারণা করা যায় এই সময় হিন্দু ধর্মের প্রভাবে সমাজে ঐক্যের শক্তি দুর্বল হয়ে পড়েছিল বলে সমগ্র ভারত দ্রত বহিরাগত আক্রমণকারীদের অধীনে যেতে পেরেছিল।

 

দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম আক্রমণকারীদের ধর্মান্তরকরণে ব্যর্থতার কারণ

আগের আলোচনায় দেখেছি যে, ভারতবর্ষে প্রথম থেকেই, অর্থাৎ মুহাম্মদ কাসিমের সময় থেকেই মুসলিম আক্রমণকারীরা বৌদ্ধ ও হিন্দুদের মঠ ও মন্দির ধ্বংস ও বলপূর্বক  ধর্মান্তরকরণের চেষ্টা করেছিল। মধ্য এশিয়া, পারস্য, আফগানিস্তান বা উত্তর আফ্রিকায় যেভাবে তারা ধর্মান্তরকরণে সফল হয়েছিল ভারতবর্ষে বহু চেষ্টার পরেও তা হতে পারে নাই। ইসলাম ধর্মের উদ্ভব আরব মরুভূমির পটভূমিতে মক্কা ও মদিনার স্থিতিশীল সমাজে ঘটলেও তার বিকাশ ও বিস্তার ঘটেছিল আশেপাশের যাযাবর, অর্ধ-যাযাবর ও সভ্যতা বহির্ভূত বেদুইন সমাজের সাহায্যে। ইসলামের অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল মূলত যুদ্ধে লুণ্ঠনের মাধ্যম্যে প্রাপ্ত সম্পদ ও যুদ্ধ-লব্ধ দাস-দাসী বিক্রীর মধ্য দিয়ে। সুতরাং যুদ্ধ, লুণ্ঠন, দাসকরণ ও নারী-ধর্ষণ ছিল ইসলামী সমাজের প্রধান বৈশিষ্ট্য। কিন্তু যে সমস্ত সমাজ শক্তিশালী ও স্থিতিশীল কৃষি সভ্যতার ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল সেখানে ইসলাম প্রবেশ করতে পারে নাই। ইউরোপ, চীন, ইত্যাদি সমাজগুলি ছিল কৃষি নির্ভর। সেখানে শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ  কৃষি-ভিত্তির উপর নির্ভর করে সভ্যতার দীর্ঘ ঐতিহ্য গড়ে উঠেছিল। ফলে ইউরোপের কিছু অংশে ইসলামী বাহিনী প্রবেশ করলেও ইউরোপীয় জনগণের প্রবল প্রতিরোধের মধ্য দিয়ে তাদের উচ্ছেদ হতে হয়। একাধিকবার চেষ্টা করেও চীনে ইসলামী বাহিনী প্রবেশ করতে পারে নাই। মুসলিমদের সকল আগ্রাসী আক্রমণ চীনারা বীরত্বের সাথে প্রতিরোধ করতে ও ইসলামী বাহিনীকে হটিয়ে দিতে সক্ষম হয়। হিন্দু ধর্মের বর্ণজাতিভেদের কারণে সমাজ বহুভাগে বিভক্ত হওয়ায় তা সামাজিক ঐক্যের বিপক্ষে কাজ করে। সমাজের অনৈক্যের ফলে সমাজ দুর্বল হওয়ায় ভারতবর্ষ ইসলামী বাহিনীকে প্রতিরোধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু ভারতবর্ষের কৃষি সভ্যতার দীর্ঘ ঐতিহ্য ভারতীয় সমাজকে ইসলামীকরণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ শক্তিও দিয়েছিল। এই জন্য প্রায় সাড়ে সাত শত বৎসর মুসলমানদের শাসনে থাকলেও ভারতবর্ষে ইসলামীকরণ ঘটেছিল খুবই কম। মুসলিম শাসনামলে ভারতবর্ষে মোট জনসংখ্যা ও জনসাধারণের ধর্মান্তরকরণের উপর কে,এস, লাল বিভিন্ন উৎস থেকে বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনা করে যে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন গুরুত্ব বিবেচনা করে আমরা এখানে তা আলোচনা করছি।

----------------------------------------

১০০১ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান মাহমুদের প্রথম ভারত আক্রমণকে সূচনা হিসাবে ধরে ও ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধে ব্রিটিশদের হাতে বাংলার নিয়ন্ত্রণ চলে যাবার সময়কে বিবেচনায় নিয়ে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের সময়কাল ধরা হয়েছে। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর যুদ্ধের পরে আরো প্রায় এক শত বৎসর পর্যন্ত দিল্লীতে মোগল শাসকরা থাকলেও তাদের হাতে ভারতবর্ষের কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ছিল না।

----------------------------------------

কে,এস, লাল দেখিয়েছেন যে, ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত এই ৮০০ শত বৎসরে ভারতবর্ষে মোট জনসংখ্যার উত্থান ও পতন ঘটে। তার প্রাক্কলিত জনসংখ্যার হিসাব নিম্নরূপঃ

----------------------------------------

দেখুনঃ K.S. Lal, Growth of Muslim Population in Medieval India (A.D. 1000 – 1800), Research Publications, Delhi, 1973, p. 92.

----------------------------------------

বৎসর, খ্রীষ্টাব্দ

প্রাক্কলিত জনসংখ্যা, কোটিতে

পূর্ববর্তী শতাব্দী থেকে শতকরা পরিবর্তন

১০০০

২০

-

১১০০

১৮

-১০.০০

১২০০

১৯

+৫.৫০

১৩০০

১৭.৫

-৭.৮৯

১৪০০

১৭

-২.৮৬

১৫০০

১২.৫

-২৬.৪৭

১৬০০

১৪

+১২.০০

১৭০০

১৭.৫

+২৫.০০

১৮০০

১৭

-২.৮৬

পাতা : ৩৬

জনসংখ্যা কমে যাবার কারণ হিসাবে তিনি উল্লেখ করেছেন, ভারতবর্ষে বহিরাগত মুসলিম আগ্রাসন ও যুদ্ধাভিযানে ব্যাপক হত্যা, বিতাড়ন ও যুদ্ধ-লব্ধ বন্দীদের দাস-দাসী হিসাবে ভারতের বাইরে নিয়ে যাওয়া। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে ফসলহানি জনিত ব্যাপক দুর্ভিক্ষ ও মহামারীর ফলে ভারতবর্ষে লোকসংখ্যা কমে যায়। লাল আরো জানিয়েছেন যে, ১০০০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতে মুসলিম জনসংখ্যা ছিল নামমাত্র। গজনীর সুলতান মাহমুদের সময় থেকে তুর্কী সুলতানদের দিল্লীতে শাসনের ফলে মুসলিমদের অভিবাসন, ধর্মান্তরকরণ এবং জন্মদানের ফলে যে মুসলিম জনসংখ্যা হয় তা ৩ থেকে ৪ লক্ষের বেশী হবে না। সেক্ষেত্রে ১২০০ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিম জনসংখ্যার সাথে মোট জনসংখ্যার অনুপাত ১ : ৪১২ বা ০.২১%। ১৪০০ খ্রীষ্টাব্দে মুসলমান জনসংখ্যা দাঁড়ায় ৩২ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ১.৮%, ও ৫০ থেকে ৫৩ জন হিন্দুর বিপরীতে ১ জন মুসলমান।  ১৬০০ খ্রীষ্টাব্দে মুসলিম জনসংখ্যা ১ কোটি ৫০ লক্ষের বেশী ছিল না। সেই সময় ভারতের মোট জনসংখ্যা ১৪ কোটি ধরলে মুসলিম জনসংখ্যা ভারতের মোট জনসংখ্যার এক-নবমাংশ থেকে এক-দশমাংশ পর্যন্ত ছিল। তিনি লিখেছেন, ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দে ভারতের মোট জনসংখ্যা ছিল ১৭ কোটি, যার মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ২ কোটি ৫০ লক্ষ এবং যা মোট জনসংখ্যার ১৫% ছিল। তখন মুসলিম ও হিন্দু জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ১ : ৭। লাল আরো দেখিয়েছেন যে, ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৮০০ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষের মোট জনসংখ্যা পর্যায়ক্রমে উঠা-নামা করলেও মুসলিম জনসংখ্যা একই সময়ে ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

----------------------------------------

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১০৮।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১২৬।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৪৩।

প্রাগুক্ত, পৃঃ ১৫৪-১৫৬।

----------------------------------------

মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সময়ে বিখ্যাত ফরাসী পর্যটক ফ্রাঁসোয়া বার্নিয়ের ভারতবর্ষে ভ্রমণ করেন। তিনি তার লেখায় সেই সময়ে অর্থাৎ সপ্তদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি ভারতবর্ষে শতকরা একজন মুসলমান থাকার বিষয়েও সন্দেহ পোষণ করেছেন। ব্রিটিশ ভারতে ১৮৭১-৭২ খ্রীষ্টাব্দে যখন প্রথম জনসংখ্যা জরিপ করা হয় তখন শিখ সহ হিন্দু জনসংখ্যা ১৪ কোটি ৫ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ৭৩.৫% এবং মুসলিম জনসংখ্যা ৪ কোটি ৭৫ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার ২১.৫% ছিল, অন্যান্য জনসংখ্যা ছিল ৯.২৫ লক্ষ, যা মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫%।  ১৮২০ খ্রীষ্টাব্দে ওয়াল্টার হ্যামিল্টন নামে একজন ব্রিটিশ তৎকালীন ব্রিটেনের বোর্ড অব কাউন্সিলের সভাপতি জর্জ ক্যানিং-কে (যিনি পরে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হন) ভারত সম্পর্কে যে বর্ণনা প্রদান করেন, সেখানে হিন্দু ও মুসলমানের সংখ্যার অনুপাত ৭ ও ১ বলে উল্লেখ করেছেন।

----------------------------------------

দেখুনঃ বিনয় ঘোষ, বাদশাহী আমল, পৃঃ ৮৭।

দেখুনঃ Memorandum on the Census of British India of 1871-72, London, 1875, p. 16.

দেখুনঃ Walter Hamilton, Geographical, Statistical, and Historical Description of Hindostan, and the Adjacent Countries, Vol. I, London, 1820, p. xxv.

----------------------------------------

বহিরাগত মুসলিম আক্রমণকারীরা ভারতবর্ষের স্থানীয় মানুষদের উপর যে ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালায় তার আংশিক বিবরণ বিভিন্ন উৎস থেকে আগে আলোচনা করা হয়েছে। তাদের সাড়ে সাত শত বৎসর শাসনামলে মোট কত জন মানুষকে তারা হত্যা করেছিল এ সম্পর্কে সঠিক কোনো জরিপ পাওয়া যায় না এবং সেটি পাবার কোনো উপায়ও নাই। তারপরেও বিভিন্ন ঐতিহাসিকের দেওয়া তথ্যসমূহ বিশ্লেষণ করে লাল অন্য একটি হিসাবে দেখিয়েছেন যে, ১০০০ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ১৫২৫ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণকারী ও শাসকদের দ্বারা ৬ থেকে ৮ কোটি মানুষ নিহত হয়। এই তথ্য থেকে ভারতবর্ষে বহিরাগত মুসলিম আক্রমণকারীদের ভয়ংকর নিষ্ঠুরতা ও বর্বরতা সম্পর্কে একটা ধারণা পাওয়া যায়। ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণকারীরা কত কোটি স্বাধীন ভারতবাসীকে দাসত্বের অধীনে নিয়ে এখানে কিংবা নানা দেশের বাজারে নিয়ে বিক্রী করেছিল তার যেমন হিসাব নাই তেমন এখানে কত কোটি ভারতীয় নারীকে ধর্ষণ করেছিল তারও কোনো হিসাব নাই। সমসাময়িক মুসলিম ঐতিহাসিকদের বিবরণ থেকে আমরা সামান্য কিছু অনুমান করতে পারি মাত্র।

----------------------------------------

কে,এস, লালের এই হিসাবটির কথা এম, এ, খান তার জিহাদ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। দেখুনঃ এম, এ, খান, জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, ২০১০, পৃঃ ২৭০।

----------------------------------------

মুসলিম যুগে মুসলমান জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রধান কারণ ছিল হিন্দুদের মধ্য থেকে বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ। যুদ্ধে যে সমস্ত যুদ্ধ-বন্দী মুসলিমরা পেত তাদের নারী, পুরুষ ও শিশু নির্বিশেষে সবাইকে ইসলামে ধর্মান্তরিত করত। যুদ্ধে যে সমস্ত ভারতীয় শাসক পরাজিত হত তাদের উপর চাপ প্রয়োগ করা হত ইসলামে ধর্মান্তরিত হতে। এছাড়া জিজিয়া করের মত অসম্মানজনক ও নিপীড়নমূলক কর ব্যবস্থা হিন্দুদের উপর চাপিয়ে তাদের জীবনকে অসম্মানজনক ও অসহনীয় করার কৌশল তো ছিলই। যেহেতু মুসলিম শাসকদের হাতে তখন বিপুল সম্পদ ও ক্ষমতা সেহেতু তাদের পক্ষে একদিকে বল প্রয়োগ ও প্ররোচনা আর অন্যদিকে ইসলামে দীক্ষিতদের মধ্যে নানা ধরনের পুরষ্কার ও সম্পদ বিতরণ সহজ ছিল। 

যাইহোক, কাসিমের সিন্ধু আক্রমণ, বিজয় ও সংক্ষিপ্ত শাসনের সময়টা বাদ দিলেও সাড়ে সাত শত বৎসর মুসলিম শাসনে বলপ্রয়োগ এবং প্ররোচনার পরেও যে মুসলিম জনসংখ্যা তুলনায় বৃদ্ধি পায় নাই তার বড় কারণ ছিল ভারতবর্ষে কৃষি সমাজের উপর ভিত্তি করে যে অর্থনীতি গড়ে উঠেছিল তা মুসলিমদের যাযাবর ও অর্ধ-যাযাবর সমাজের যুদ্ধ ও লুণ্ঠন নির্ভর অর্থনীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। ফলে ভারতের কৃষি সমাজ যাযাবরবৃত্তি, যুদ্ধ ও লুণ্ঠন নির্ভর ইসলামী সমাজের ধর্মকে প্রবল চাপ ও বলপ্রয়োগ সত্ত্বেও গ্রহণ করে নাই। হিন্দু ভারতের ধর্মান্তরকরণের বিরুদ্ধে এই প্রতিরোধ ছিল অনেকটা নিষ্ক্রিয়। মুসলিম শাসকরা যখন বেশী বল প্রয়োগ করেছে তখন তারা পাহাড়ে, জঙ্গলে বা দূরবর্তী অঞ্চলে পালিয়ে গেছে, অথবা কখনো মৃত্যুকে বেছে নিয়েছে। দেখা গেছে যে, কিছু ক্ষেত্রে মুসলিম শাসকদের শাসন দুর্বল হয়ে গেলে অথবা তারা অন্য কোথায়ও চলে গেলে ধর্মান্তরিত হিন্দুরা আবার স্বধর্মে ফিরে গেছে। ধর্মান্তরিত বৌদ্ধ ও জৈনরা হয়ত আর তাদের পূর্ববর্তী ধর্মে ফিরে যায় নাই, সেক্ষেত্রে তারা স্বভূমির ধর্ম হিসাবে পরিচিত হিন্দু ধর্মকে নিজেদের ধর্ম হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছে।

হিন্দু ধর্মের কিছু বৈশিষ্ট্য ইসলামকে প্রতিহত করার জন্য সহায়ক। যেমন তার জন্য বৃহৎ কোনও প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না। বৌদ্ধ বিহারের মত বৃহৎ নির্মাণের যেমন তার প্রয়োজন হয় না তেমন দলবদ্ধ ভিক্ষু-ভিক্ষুণীদের সমাবেশেরও প্রয়োজন হয় না। মন্দির ধ্বংস করলেও হিন্দু ধর্ম বিলুপ্ত হয় না। ব্রাহ্মণ পূজারী যেখানে তার পূজার প্রতিমা স্থাপন করে বেদমন্ত্র পাঠ করবে সেখানে হিন্দু ধর্ম জীবিত থাকবে। হিন্দু ধর্ম রক্ষার জন্য সংসারত্যাগী হবারও প্রয়োজন হয় না। দেবতার পূজারী ব্রাহ্মণ ও যে কোনও বর্ণজাতি বা গোষ্ঠীর ভক্ত থাকলে যে কোনও স্থানে হিন্দু ধর্ম রক্ষা পেতে পারে।

অবশ্য শত অত্যাচারের পরেও যে, মুসলিম শাসকরা সকল ভারতীয় প্রজার ধর্মান্তরকরণে সেভাবে উৎসাহী ছিল   সেটা মনে হয় না। প্রাথমিক আক্রমণাভিযানের ব্যাপারটা ভিন্ন হতে পারে। যখন শাসন প্রতিষ্ঠার বিষয় আসে তখন আসে রাজস্ব সংগ্রহের প্রশ্ন। প্রজা না থাকলে রাজস্ব বা সরকারের আয় আসবে কোথা থেকে? সুতরাং বহিরাগত হলেও রাষ্ট্র তথা সরকারকে নিজ অর্থনৈতিক স্বার্থেই ধর্মান্তরকরণের প্রশ্নে অনেক ক্ষেত্রে নমনীয় হতে হয়েছে।

পাতা : ৩৭

অর্থাৎ ধর্মীয় দিক থেকে বিবেচনা করলে হিন্দুদেরকে সফল বলতে হবে। রাজনৈতিক বা সামরিকভাবে ইসলাম ভারতবর্ষে হিন্দুদের প্রতিরোধকে পরাজিত করতে পারলেও সামাজিকভাবে সেটা পেরেছে সে কথা বলা যাবে না। এটা নিঃসন্দেহে ভারতবর্ষের কৃষি সমাজের শক্তির বহিঃপ্রকাশ। তবে এ প্রসঙ্গে পুনরায় প্রশ্ন আসা সঙ্গত যে, ইউরোপ কিংবা চীনের কৃষি সমাজ যে কাজটা করতে পেরেছে শক্তিশালী ও সুদীর্ঘ কৃষি ব্যবস্থার ঐতিহ্য নিয়েও ভারত কেন সেটা করতে পারে নাই? উত্তরে হয়ত বলা হবে সামাজিক ঐক্যের উপর গুরুত্ব প্রদানকারী খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধ ধর্মের বলে বলীয়ান ছিল বলে ইউরোপ কিংবা চীন ইসলামের আগ্রাসনের শক্তিকে শেষ পর্যন্ত প্রতিহত করতে সক্ষম হয়েছিল। চীনে তো ইসলামী বাহিনী সেভাবে ঢুকতেই পারে নাই, আর ইউরোপে প্রথম দিকে কিছুটা ঢুকতে পারলেও শেষ পর্যন্ত বহিষ্কৃত হয়েছে।

এটা ঠিক যে, এক সময় জৈন এবং বিশেষ করে বৌদ্ধ ধর্ম ভারতবর্ষে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত হিন্দু ধর্ম অপর দুই ধর্মের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করে। আর এ প্রসঙ্গে আমরা এই প্রশ্নের সম্মুখীন হই ভারতবর্ষের এমন কি বৈশিষ্ট্য ছিল যা এখানে তাকে বিশেষ করে বৌদ্ধধর্মের মত সামাজিক সমতা ও ঐক্যমুখী ধর্মের উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সুযোগ করে দিয়েছে?

হতে পারে যে, হিন্দু ধর্মের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার পিছনে ভারতবর্ষে শক, হুন ইত্যাদি বৈদেশিক যাযাবরদের সভ্যতাধ্বংসী প্রায় লাগাতার আক্রমণগুলির একটা সম্পর্ক আছে। আমরা দ্বিতীয় খণ্ডের শেষ অধ্যায়ে এ বিষয়ে কিছু আলোকপাতের চেষ্টা করেছি। বৈদেশিক আক্রমণের আঘাতে নগরকেন্দ্রিক ভারতীয় সমাজ বিপর্যস্ত বা প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলে ব্রাহ্মণকেন্দ্রিক হিন্দু সমাজ সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসে। এটা ঠিক যে, হিন্দু ধর্মের পটভূমিতেও ছিল সভ্যতা। কিন্তু সেটা ছিল অনেক বেশী পশ্চাদমুখী। তার চেয়েও বড় কথা এই ধর্ম ছিল বর্ণজাতিভেদ প্রথা ও সেই সঙ্গে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর নিজস্ব বিভিন্ন বিশ্বাস ও প্রথার মাধ্যমে সমাজের বহুধা বিভক্তির উপর প্রতিষ্ঠিত। এই বিভক্তি প্রকৃতপক্ষে ভারতবর্ষের ভূ-প্রকৃতির বৈচিত্র্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। এখানে সম্ভব হিমালয়ের বরফাচ্ছাদিত পর্বতশৃঙ্গের সঙ্গে রাজপুতানার মরুভূমির সহাবস্থান, উত্তর ও পশ্চিম ভারতের খরা ও দাবদাহের সঙ্গে বঙ্গীয় ব-দ্বীপ ভূমির মুষলধারে মৌসুমী বৃষ্টি ও প্রলয়ঙ্করী বন্যার সহাবস্থান। এছাড়া হিমালয় পর্বত ছাড়াও আছে বিন্ধ্য পর্বতমালার মত বহুসংখক পর্বত ও পাহাড় দ্বারা পরিবেষ্টিত ভূমি। আছে অরণ্য বেষ্টিত অগণিত সমভূমি কিংবা গাঙ্গেয় অববাহিকার মত বিশাল সমভূমি। এখন অরণ্যভূমির পরিমাণ অনেক কমলেও এক সময় সেগুলি ছিল বহুগুণ বিস্তৃত।

মানুষ তো এক অর্থে প্রকৃতির সন্তান। সিন্ধু সভ্যতার পতন পরবর্তী কালে এবং সভ্যতার ব্যাপক ও গভীরতর সঙ্কটের কালে সেই ভূমি ও প্রকৃতির সঙ্গে এবং একই সঙ্গে তার সমৃদ্ধ কৃষি সমাজের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ভারতে যে হিন্দু ধর্মের উত্থান ঘটবে সেটাকেই কি স্বাভাবিক মনে হয় না? বহুবিভাজিত কৃষি সমাজের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ভারতবর্ষ শেষ পর্যন্ত হিন্দু ধর্মের সাহায্যে যাযাবর ও পশুপালক বেদুইনদের ধর্ম ইসলামকে প্রতিহত করল। সভ্যতামুখী যাত্রায় এটাকে হিন্দু ধর্মের একটা ইতিবাচক ভূমিকা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া ছাড়া উপায় কী?      

ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের বৈশিষ্ট্য ছিল বহিরাগত। এর প্রাণশক্তির উৎস ছিল ধারাবাহিকভাবে প্রধানত মধ্য এশিয়া, পারস্য ও আফগানিস্তান থেকে আগত মুসলিমদের প্রবাহ। বস্তুত এই অব্যাহত বহিরাগমনের প্রবাহ দিয়ে  উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখা হয়েছিল। সাধারণত এটাই দেখা গেছে যে, মুসলিম শাসকরা যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা করত তার প্রতিষ্ঠাতারা বহিরাগত হত। ভারতবর্ষে মুসলিমদের সাড়ে সাত শত বৎসরের শাসনকালে এটাই স্বাভাবিক নিয়ম ছিল যে, এখানকার ধর্মান্তরিত মুসলিমদের মধ্য থেকে শাসক হতে দেওয়া হত না। একদিকে শাসক শ্রেণী ও রাজবংশ গঠনে বহিরাগত মুসলিমদের প্রাধান্য, অপর দিকে, মুসলিম শাসনের মূল ভিত্তি স্বরূপ সেনাবাহিনী গঠনেও বহিরাগত মুসলিম প্রাধান্য কিংবা তাদের নির্ধারক ভূমিকার ফলে ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন তার সাড়ে সাত শত বৎসর সময়ে বহিরাগত চরিত্র রক্ষা করে চলেছিল।

 

ভারতে মুসলিম শাসনের ফলাফল

বস্তুত খ্রীষ্টপূর্ব ২য় শতাব্দী থেকে শক, খ্রীষ্টীয় প্রথম শতাব্দী থেকে কুশান ইত্যাদি আক্রমণ দ্বারা আফগানিস্তানসহ উত্তর-পশ্চিম ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল আক্রান্ত ও বিপর্যস্ত হতে শুরু করে। এইসব আক্রমণের সবচেয়ে বড় লক্ষ্যবস্তু ছিল নগরগুলি। কারণ নগরগুলি যেমন ছিল অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্র তেমন এগুলি ছিল শাসন কেন্দ্র। বিরাট বিরাট ভবন শোভিত এসব নগর বা শহর দর্শনীয়ও হত সহজে। বিশেষ করে গ্রন্থাগার ও বিদ্যালয়-বিশ্ববিদ্যালয়সহ বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের মহানির্মাণগুলি নগরগুলিকে করে তুলেছিল অধিকতর আকর্ষণীয় ও দৃষ্টিনন্দন। এভাবে সিন্ধু সভ্যতার অনেক পরবর্তী কালে সমৃদ্ধির মাধ্যমে যে নবতর নগরায়ন পর্ব শুরু হয়েছিল সেটা কয়েক শত বৎসর পর বিপন্ন হয়। বৈদেশিক আক্রমণকারীদের আক্রমণে এগুলি ধ্বংস হতে শুরু করে। যেহেতু এইসব আক্রমণের ঢেউ প্রধানত মধ্য এশিয়া থেকে আগত যাযাবর পশুপালকদের দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল সেহেতু এগুলির প্রধান শিকার হয় প্রথমে আফগানিস্তান ও সেই সাথে পশ্চিম ও উত্তর ভারতের বিস্তীর্ণ ভূভাগ। এর ফলে শুরু হয় এই ভূভাগের বিনগরায়ন, যা পরবর্তী পর্যায়ে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলকেও প্রভাবিত করে। যেখানে প্রথম দিকে আক্রমণ হয় নাই সেখানেও উত্তর-পশ্চিমের বিনগরায়নের প্রভাব পড়ে নানানভাবে। পূর্ব ও দক্ষিণের অঞ্চলসমূহ তাদের সমৃদ্ধ বাজার হারায়, অপর দিকে, বৈদেশিক আক্রমণে বাস্তুচ্যুত বিপুল জনসংখ্যার আগমণে ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ে। সুতরাং পশ্চিমের বিনগরায়নের প্রভাব সমগ্র ভারতীয় উপমহাদেশের উপরেই যে পড়তে শুরু করেছিল তাতে সন্দেহ নাই।

আমরা ইতিপূর্বেই (২য় খণ্ড) বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের পতন ও হিন্দু ধর্মের উত্থানের সঙ্গে বিনগরায়নের সম্পর্ক নিয়ে আলোচনা করেছি। সামগ্রিকভাবে সমাজের শক্তি যখন দুর্বল হয়েছে তখন যেন এই দুর্বল পরিস্থিতিতে প্রাচীন ঐতিহ্য ভিত্তিক সমাজকে রক্ষার দায়িত্ব নিতে হিন্দু ধর্ম এগিয়ে এসেছে। সিন্ধু সভ্যতাসহ হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যের অনেক কিছু হারিয়ে গেলেও সবটা হারায় নাই হিন্দু ধর্মের কারণে। এই ধর্মের মাধ্যমে এক সুপ্রাচীন সভ্যতা নানানভাবে তার অস্তিত্বকে আজ অবধি বাঙ্ময় করে রেখেছে। যেমন সিন্ধু সভ্যতার ভাষা আজ অবধি হিন্দুদের মূল ধর্মগ্রন্থ বেদ বিশেষত ঋগ্বেদের মাধ্যমে বাঙ্ময় হয়ে রয়েছে। এমনকি হিন্দুদের অনেক প্রথা ও রীতিনীতির মধ্য দিয়ে আমরা সিন্ধু সভ্যতারও পূর্ববর্তী কালের অনেক স্মৃতিকে খুজে পাই। হিন্দু ধর্মকে অবলম্বন করে হলেও ভারতীয় সমাজ তার মাটির গভীরে শিকড়কে রক্ষার জন্য প্রাণপণ লড়াই করে গেছে। হয়ত এ লড়াই ততটা আক্রমণাত্মক নয়, যতটা আত্মরক্ষামূলক ও নিষ্ক্রিয় ধরনের। তবু এটাও একটা লড়াই; এটা আর যা-ই হোক নিষ্ক্রিয় আত্মসমর্পণ নয়।

যাযাবর বেদুইনদের ধর্ম ধারণকারী মুসলিম বহিরাগতরা এই জায়গায় ব্যর্থ হয়েছে। তবে ভারতীয় সভ্যতার অপরিমেয় ক্ষতি তারা করেছে। ভারতের সভ্যতা শক-হুনদের আক্রমণের পরেও যেটুকু রক্ষা পেয়েছিল সেগুলিকেও তারা অনেকাংশে ধ্বংস করেছে। যেমন আমরা বঙ্গ সংলগ্ন তৎকালীন বিশ্ববিখ্যাত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের কথা বলতে পারি। কিংবা বলতে পারি দাক্ষিণাত্যের মহানগর বিজয়নগরের মর্মন্তুদ ধ্বংসকাণ্ডের (১৫৬৫ খ্রীঃ) কথা। বহু ধ্বংস ও বিপর্যয়ের পরেও বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের আশ্রয়ে ভারতবর্ষে জ্ঞানচর্চার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল মুসলিম আক্রমণ ও শাসন সেটুকুকেও নির্মূল করে ফেলে। এর সপক্ষে দ্বাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় ধ্বংসের উল্লেখই যথেষ্ট। আসলে শুধু নালন্দা নয়, মুসলিম আগ্রাসন ও শাসন ভারতবর্ষে জ্ঞানচর্চার কোনও বৃহৎ প্রতিষ্ঠানকেই টিকে থাকতে দেয় নাই। তার মানে এই নয় যে, এর পরেও ভারতবর্ষে জ্ঞানচর্চা একেবারে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। সেটা হয় নাই। তবে বৃহদায়তনের প্রতিষ্ঠান থেকে জ্ঞানচর্চা আশ্রয় নিয়েছে মূলত গ্রামে ও ক্ষুদ্র পরিসরে, ব্রাহ্মণদের গৃহে অথবা গ্রামের পঞ্চায়েতের পৃষ্ঠপোষকতায় পরিচালিত টোলে। আসলে নগরায়ন ও জ্ঞানচর্চার বিচারে ভারতবর্ষের জন্য মুসলিম যুগ ছিল সাধারণভাবে অন্ধকার যুগ। মানবিকতার বিচারে তো চরম অন্ধকারের যুগ ছিল সেটা।

তবে মুসলিম আগ্রাসন ও শাসনের ফল কি সবটাই নেতিবাচক? সে কথা বলা সঙ্গত হবে না। এক ধরনের উপনিবেশিক ও পরাধীনতামূলক হলেও মুসলিম শাসন বৃহত্তর ভারতকে একটা রাজনৈতিক ঐক্য দিয়েছিল, যেটা মৌর্য শাসনের পর ভারতে বহুকালের জন্য ছিল না। বিশেষত মোগল রাজবংশের শাসনে ক্রমশ প্রায় সমগ্র উপমহাদেশ একটি অখণ্ড রাষ্ট্রভুক্ত হয়। এই মোগলদের উত্তরাধিকারী হিসাবে ইংরেজরা ভারতে আবির্ভূত হয়। আজকের ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ ইংরেজদের এই উত্তরাধিকারকে ধারণ করছে। সুতরাং বৃহত্তর ভারত ব্যাপী রাষ্ট্র গঠনের কৃতিত্ব বহিরাগত হলেও মুসলিম আক্রমণকারী ও শাসকদেরকে দেওয়া ছাড়া উপায় কী?

এভাবেও বলা যেতে পারে যে, মুসলিম যুগে আমরা যেন দুইটি ভারতকে দেখতে পাই। একটা ভারত বহিরাগত আক্রমণকারী মুসলিমদের শাসনাধীনে রাজনৈতিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ভারত, অপর দিকে, ব্রাহ্মণ বর্ণজাতির নেতৃত্বে হিন্দু ধর্মের মাধ্যমে ভেদাভেদমূলক হলেও সামাজিকভাবে ঐক্যবদ্ধ ভারত। প্রথম ভারত যতই বহিরাগত বা পরশাসিত হোক, দ্বিতীয় ভারত ছিল মূলত পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বশাসিত, দেশজ ও স্বাধীন। বহিরাগতদের সমরশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে প্রথম ভারত দীর্ঘকাল এই দ্বিতীয় ভারতের উপর চেপে থাকলেও সেটা ছিল অনেকটাই ভাসমান ও শিকড়হীন। কারণ পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থাকে কেন্দ্র করে গড়ে তুলা স্বশাসনের এই ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার সাধ্য মুসলিম শাসকদের হয় নাই। স্বশাসিত ও স্বাধীন এই ভারতকে প্রথমে কার্যকরভাবে ধ্বংস করতে এবং নিজেদের অধীনতায় নিতে সক্ষম হয় ইংরেজ শাসন, যা নিয়ে আমাদের পরবর্তী অধ্যায়ে আলোচনার ইচ্ছা আছে।

পাতা : ৩৮

_______________________________

[ বিশেষ বিজ্ঞপ্তি সিন্ধু থেকে গঙ্গা: এক সভ্যতার পথযাত্রা, তৃতীয় খণ্ড (আংশিক) রচনাটির প্রথম অধ্যায় ‘ভারতবর্ষে মুসলিম আক্রমণ, বিজয় ও শাসন: একটি পর্যবেক্ষণ’-এর ‘প্রাক-মুসলিম ভারতে যুদ্ধের বৈশিষ্ট্য’ শিরোনামে লেখাটিতে গত ২৮ এপ্রিল, ২০২৪ তারিখে কিছু প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনা হয়েছে। কোনো পাঠক এই তারিখের আগে লেখাটি পড়লে এখনকার পরিবর্তন বুঝতে পারবেন।-বঙ্গরাষ্ট্র ২৯ এপ্রিল, ২০২৪ ]

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ