লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 6, 2024, 12:00 AM, Hits: 454
(সাংখ্য দর্শন নিয়ে ভাবতে গিয়ে বছর খানেক আগে যে সংক্ষিপ্ত লেখাটা লিখেছিলাম সেটাকে তখন তেমন গুরুত্ব না দেওয়ায় সেই সময় এটার প্রকাশের তাগিদ বোধ করি নাই। কিন্তু বছর খানেক বাদে লেখাটা পড়তে গিযে মনে হল সিন্ধু সভ্যতা ও সাংখ্য দর্শনের মধ্যকার আন্তঃসম্পর্ক অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে লেখাটা সহায়ক হতে পারে। এটা হয়ত সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও রাষ্ট্রের ব্যবস্থাপনার স্বরূপ সন্ধানের কাজে কিছু আলোকপাত করতে পারে। বিশেষ করে সাংখ্য দর্শনের মতো প্রাচীন ভারতের একটা গুরুত্বপূর্ণ দর্শনের আলোয় সিন্ধু সভ্যতাকে দেখতে চাওয়ার কাজটাকে আর উপেক্ষা করতে পারছি না। সুতরাং একটু দেরীতে হলেও লেখাটা প্রকাশ করা হচ্ছে। - লেখক, ৬ জুলাই ২০২৪)
প্রতিটি ধর্ম কিংবা দর্শন অথবা মতাদর্শ যে সমাজ থেকে উঠে আসে কোনও না কোনও ভাবে তা সেই সমাজের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে। অর্থাৎ মানুষ যা চিন্তায় অথবা কল্পনায় নির্মাণ করে তা তার সামাজিক বাস্তবতাকে অবলম্বন করে নির্মিত হয়। যা সে দেখে না বা অনুভব করে না বা বাস্তব থেকে যার সম্পর্কে কোনও ধারণা করতে পারে না তাকে তার পক্ষে কল্পনায় তৈরী করা সম্ভব হয় না। সুতরাং মানুষের কল্পনা তার বাস্তবের ভিত্তির উপর দাঁড়ায়। এভাবে আমরা নির্দিষ্ট ধর্মকে বুঝতে গিয়ে তার উদ্ভবকালীন সমাজ-বাস্তবতাকে বুঝতে বা দেখতে বাধ্য হই। যেমন যুদ্ধ ও একনায়কতন্ত্রের ধর্ম হিসাবে্ ইসলামকে বুঝতে গেলে আমরা আরবের যুদ্ধ, হিংস্র সংঘাত, লুণ্ঠন, নারীর প্রতি সহিংস আচরণ নির্ভর ও একনায়কতান্ত্রিক একটি সমাজ-বাস্তবতার প্রতি দৃষ্টি দিতে বাধ্য হই। একইভাবে মূলত শান্তি ও প্রেমের আবেদন নিয়ে আবির্ভূত খ্রীষ্টধর্মের উদ্ভবকালীন সমাজ-বাস্তবতার দিকে দৃষ্টি দিলে আমরা দেখতে পাই রোমান সাম্রাজ্যের অধীনস্থ প্যালেস্টাইনের মূলত ইহুদী দরিদ্র ও শান্তিপ্রিয় দাস, কৃষক ও শ্রমজীবী জনগোষ্ঠীকে। একইভাবে আমরা যখন অহিংসার চেতনাবাদী বৌদ্ধ ধর্মের পটভূমির দিকে দৃষ্টি দিই তখন আমরা দেখতে পাই সিন্ধু সভ্যতা হিসাবে পরিচিত এক বিস্ময়কর রকমভাবে শান্তিপূর্ণ ভারতীয় সভ্যতার প্রভাবকে, যা বু্দ্ধের সময় বিলুপ্ত হলেও তার গভীর প্রভাব তখনও রেখে চলেছিল ভারতবর্ষের সমাজ-জীবনে। বুদ্ধের অল্প কিছু পূর্বে আবির্ভূত জৈন ধর্মের প্রবক্তা মহাবীরও অহিংসার চেতনা নির্ভর ধর্মমত প্রচার করে গেছেন। এ থেকেও বুঝা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের এক-দেড় হাজার বছর পরেও ভারতের সমাজে কত গভীরভাবে ক্রিয়াশীল ছিল তার প্রভাব। আর সিন্ধু সভ্যতা যে মূলত অহিংস বা শান্তিপূর্ণ ছিল প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকে পণ্ডিতগণ সে বিষয়ে সকলে নিশ্চিত হয়েছেন।
আরও দর্শন বা মতবাদ থাকতে সাংখ্য দর্শন নিয়ে এই আলোচনার অবতারণা কেন করছি সেটার উত্তর প্রথমে দিই। প্রাচীন ভারতের এক উল্লেখ্য দর্শন হল সাংখ্য দর্শন। এ দর্শন নিয়ে অনেক আলোচনা আছে। এটি নিরীশ্বরবাদী দর্শন হলেও বস্তুবাদী বলতে যা বুঝায় তেমন দর্শনও নয়। কারণ এখানে বস্তু বহির্ভূত তথা স্বয়ম্ভু চেতনার স্বতন্ত্র গুরুত্ব আছে। সাংখ্য দর্শনের মূল কথা হল জগৎসংসার পুরুষ ও প্রকৃতি এই দুই সত্তায় বিভক্ত এবং এই দুই সত্তার ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়ার মিথষ্ক্রিয়ার মাধ্যমে জগৎসংসার চলমান বা ক্রিয়াশীল।
এই দর্শন মতে পুরুষ হচ্ছে চেতনা আর প্রকৃতি হচ্ছে বস্তু বা জগৎসংসারে অস্তিত্বশীল পদার্থ। পুরুষ তথা চেতনার প্রভাবে বস্তু বা প্রকৃতি কাজ করে বা গতিশীল হয়। পুরুষের চাওয়া না ঘটলে বস্তু অচল, অনড় ও লক্ষ্যহীন হয়ে থাকে। কিন্তু একইভাবে প্রকৃতি ছাড়া একা পুরুষও নিরুপায়, অক্ষম ও অচল সত্তা মাত্র। সুতরাং পুরুষ ও প্রকৃতি মিলে সম্পূর্ণ বস্তুজীবন বা বস্তুজগৎ।
সাংখ্য দর্শনের পুরুষ ও প্রকৃতির সম্পর্ককে বুঝাতে একটা উপমা দেওয়া হয় এমন যে, পুরুষ এমন এক চক্ষুষ্মান ব্যক্তি যে এমন বিকলাঙ্গ যে প্রকৃতির ক্রিয়া ছাড়া সে অচল। অন্যদিকে, প্রকৃতি সচল বা ক্রিয়াশীল, কিন্তু অন্ধ। ফলে সে পথ চলে কিংবা কাজ করে পুরুষের নির্দেশে। এভাবে পুরুষ ও প্রকৃতি উভয়ে পরস্পরের পরিপূরক হয়ে বিশ্বজগৎকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে।
সাংখ্য দর্শন বস্তুবাদী নয়, বরং ভাববাদী। কারণ পুরুষ তথা চেতনাকে এখানে বস্তু থেকে বিচ্ছিন্ন সত্তা হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে। অথচ বাস্তবে চেতনা বস্তুকে অবলম্বন করেই বিকশিত বা উদ্ভূত হয়। বস্তুত চেতনাও বস্তুরই এক ধরনের রূপান্তর মাত্র, যা দাঁড়ায় বস্তুকে ভর ক’রে। বস্তুরই ক্রিয়ার এক ধরনের ফল হচ্ছে চেতনা। এটাকে বস্তুতে নিহিত বস্তুর বিশেষ শক্তিও আমরা বলতে পারি। জড়বস্তু থেকে উদ্ভূত হলেও জীবদেহের প্রাণন ক্রিয়ার বিশেষ রূপকে আমরা চেতনা বলতে পারি। এর অস্তিত্ব মূলত মস্তিষ্কে তথা মস্তিষ্কের ক্রিয়ায়।
কিন্তু প্রাচীন মানুষ জীবদেহ ও চেতনা তথা মস্তিষ্কের ক্রিয়ার মধ্যকার আন্তঃসম্পর্কের রহস্যভেদ করতে না পারায় চেতনা আর বস্তুর মধ্যে এ ধরনের যান্ত্রিক বিভাজন টানতে গেছে। ধর্মেরও উদ্ভব হয়েছে এ ধরনের ভ্রান্ত ধারণাকে অবলম্বন ক’রে। সেটা যেমনই হোক, পুরুষ ও প্রকৃতির দ্বৈততার সম্পর্ক ভিত্তিক এমন দর্শন চিন্তার সামাজিক ভিত্তি না থাকলে সাংখ্য দর্শন কীভাবে প্রাচীন ভারতে এতটা প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল?
রাজতান্ত্রিক সমাজের ভিতরে যে সাংখ্য দর্শনের মতো দর্শন চিন্তার ভিত্তি ছিল না সেটা বুঝা যায় পুরুষ সত্তা তথা চেতনার পঙ্গু দশা থেকে। এটা শাসক সত্তার দুর্বলতা ও অক্ষমতার প্রকাশক। বুঝা যায় সমাজের শাসক সত্তা থাকলেও তা ছিল নির্বাহী ক্ষমতাহীন। অর্থাৎ শাসক বা শাসক শ্রেণী ছিল মূলত পরিকল্পনাকারী ও নীতিনির্ধাারণকারী। কিন্তু নির্বাহ বা কর্মসম্পাদনের ক্ষমতা তাদের হাতে ছিল না। সেটা ছিল মাঠ পর্যায়ে নির্বাহের ক্ষমতার অধিকারীদের নিকট। অর্থাৎ মূলত এক ধরনের আমলাদের হাতে।
তবে কি সাংখ্য দর্শন আমাদের দৃষ্টিকে সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার বাস্তবতার দিকে নেয়? এটা এমন এক সমাজ বাস্তবতার দিকে আমাদের কল্পনাকে নেয় যেখানে সমাজের পরিকল্পনা বা নীতি নির্ধারণের প্রক্রিয়ার সঙ্গে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার একটা দূরত্ব থাকে।
সাংখ্য দর্শনের পুরুষ ও প্রকৃতির বিভাজনের মধ্যে পুরুষ ও নারী সত্তারও কি একটা গন্ধ পাওয়া যায়? পুরুষ শব্দের সঙ্গে পুরুষ সত্তা বা পুংলিঙ্গের একটা নৈকট্য আছে। বিপরীতে, প্রকৃতির সঙ্গে কি নারী সত্তার কোনও সাযুজ্য বা নৈকট্য দেখা যায়?
সংস্কৃতে প্রকৃতি শব্দের সঙ্গে শুধু বস্তুজগৎ নয়, অধিকন্তু সম্পর্ক আছে জনসমাজ ও নারীরও। সুতরাং সাংখ্য দর্শন যারা প্রতিষ্ঠা করেছেন বা এর নামকরণ করেছেন তাদের ভাবনায় পুরুষ ও প্রকৃতি এই দুই শব্দ চয়নের মধ্যে পুরুষ ও নারী এই দুই জৈবসত্তায় বিভাজনের কল্পনা কাজ করেছে বলে মনে হয়।
এখন আমাদের মনে যে প্রশ্ন আসতে পারে সেটা হল সাংখ্য দর্শনের এই বিশেষ ভাবনার পিছনে কি সিন্ধু সভ্যতার সমাজ বাস্তবতা কাজ করেছিল? অর্থাৎ এই দর্শনের উৎস কি সিন্ধু সভ্যতা? তবে কি সাংখ্য দর্শনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে আমরা যাকে জানি সেই কপিল মুণি সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসী? অথবা তা না হলেও তিনি হয়ত তার কিছু পরবর্তী কালে জীবিত ছিলেন, যার চেতনায় তখনও ক্রিয়াশীল ছিল সিন্ধু সভ্যতার সমাজ-বাস্তবতার স্মৃতি।
প্রথমে ভাবা যাক সিন্ধু সভ্যতার সমাজ বা রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থা কেমন হওয়া সম্ভব। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতা ছিল মূলত একটি শান্তিনির্ভর সভ্যতা। অর্থাৎ পৃথিবীর আর সকল সভ্যতা থেকে এটা ভিন্নধর্মী একটা সভ্যতা। অন্যান্য সমকালীন কিংবা প্রাচীন সভ্যতাগুলি যেখানে প্রায় অব্যাহত যুদ্ধ ও প্রজাসাধারণের উপর বলপ্রয়োগের উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল সেখানে এই সভ্যতা যেমন পার্শ্ববর্তী জনগোষ্ঠীসমূহের সঙ্গে মূলত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বজায় রেখে চলত বলে ধারণা করা যায় তেমন অভ্যন্তরীণভাবেও যে এই সভ্যতা শান্তিপূর্ণ কর্মনীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হত সেটা প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য থেকেই অনুমান করা যায়।
যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের পরিবর্তে শান্তি ও স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত একটি সভ্যতায় যে অন্যান্য পুরুষতান্ত্রিক সভ্যতাগুলির পরিবর্তে নারীর ভূমিকা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ ছিল তেমন মনে করা একান্ত যৌক্তিক। যতদূর মনে হয় রাষ্ট্রশাসনে নারীর অংশগ্রহণ সিন্ধু সভ্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। কিন্তু সামষ্টিক তথা ম্যাক্রো পর্যায়ে দশ লক্ষ বর্গকিলোমিটার ব্যাপী বিস্তৃত একটি সভ্যতায় নারীর পক্ষে ভূমিকা রাখা কীভাবে সম্ভব? হয়ত পল্লী বা গ্রাম এমনকি নগর পর্যায়ের মধ্যেও নারীর পক্ষে নির্বাহী ভূমিকা পালন করা সম্ভব। কিন্তু যখন সেটা জেলা, অঞ্চল কিংবা রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে যাবে তখন সেখানে সেই পায়ে হাঁটা বা গরুর গাড়ীর যুগে নারীর পক্ষে কীভাবে নির্বাহী ভূমিকা পালন করা সম্ভব? জানি না ম্যাক্রো বা সামষ্টিক পর্যায়ে সিন্ধু সভ্যতায় নারী কীভাবে ভূমিকা রাখত।
সাংখ্য দর্শনে ক্ষমতার বিভাজনটা এভাবে করা হয়েছে — পুরুষ হচ্ছে ভাব বা ধারণা, আর প্রকৃতি হচ্ছে ক্রিয়া বা কর্ম। সিন্ধু সভ্যতায় তবে কি সমগ্র সভ্যতার কর্ম পরিকল্পনা বা নীতি নির্ধারণ যেখানে করা হত সেটা ছিল পুরুষ প্রাধান্য বিশিষ্ট আর নির্বাহ বা কর্মসম্পাদনের জায়গাগুলি কি ছিল নারী প্রাধান্য বিশিষ্ট? যথেষ্ট তথ্যের অভাবে কোনও সিদ্ধান্ত নিতে চাই না এখনও। তবে সাংখ্য দর্শনের মতো একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাচীন দর্শন থেকে সিন্ধু সভ্যতার অন্ধকারাচ্ছন্ন অভ্যন্তরে জিজ্ঞাসার কিছু আলো ফেলা উচিত বলে মনে হল। বিষয়টা নিয়ে অন্তত এখন নূতন করে ভাবা যেতে পারে।
৩০-৩১ জুলাই, ২০২৩