লিখেছেনঃ আলমগীর হুসেন, আপডেটঃ November 8, 2011, 5:31 AM, Hits: 5223
বিশ্বব্যাপী চলমান ইসলামী সন্ত্রাসী তৎপরতা কেবল যারা তার শিকার হচ্ছে তাদেরকেই ধ্বংসকাণ্ড ও বেদনা-যাতনার শিকার করছে না, তা বিশ্বের সকল দয়ালু ও করুণাশীল ব্যক্তিদেরকেও ব্যথিত করছে। যদিও এরূপ সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বহু মুসলিমদেরকে হৃদয়ে উল্লসিত করে এবং কখনো সে উল্লাস ও আনন্দ রাস্তায় উদ্দাম আনন্দ-নৃত্যে রূপ নেয়, যেমন ঘটেছিল আমেরিকায় ৯/১১ ইসলামী সন্ত্রাসী হামলার পর পাকিস্তান ও ফিলিস্তিন ইত্যাদি দেশগুলোর রাস্তায়, তথাপি তা অনেক করুণাশীল মুসলিমকেও একইভাবে কাতর ও ব্যথিত করে। এমন মানবিক মুসলিমরা আত্মঘাতী সন্ত্রাসী মুসলিমদেরকে গালাগাল এবং নানান দানবীয় লেবেল দিতেও কার্পণ্য করে না। সম্প্রতি (২৯ অক্টোবর ২০০৫) দিল্লির এক শপিং কম্পেক্স-এ ইসলামী সন্ত্রাসীদের দ্বারা বোমা হামলায় দিউয়ালী উৎসবের জন্য কেনাকাটা করতে আসা ৬০ জন প্রধানত মহিলা ও শিশুর প্রাণহানী ঘটে। এ অন্যায় ও হৃদয়-বিদারক ধ্বংসকাণ্ডে ব্যথিত এক মুসলিম বন্ধু তার মনের আক্রোশ প্রকাশ করতে এক রচনায় সন্ত্রাসীদেরকে “শয়তানের রূপান্তর” আখ্যা দিয়েছে।
যদিও সে রচনাটি বিধর্মী হিন্দুদের জীবন-নাশে মর্মাহত এক মুসলিমের সহমর্মিতা ও সন্ত্রাসীদেরকে ধিক্কার দিতে একটি ভাল লেখা, তবে সেসব সন্ত্রাসীকে কেন “শয়তান” হিসেবে চিহ্নিত করা হলো, সেটা ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন! কেন এসব মুসলিম সন্ত্রাসীর ঘৃণ্য কর্মের জন্য তাদেরকে দায়ী না করে শয়তানকে দোষী করা হবে, কিংবা শয়তানকে সে ঘৃণ্য কর্মের অংশীদার করা হবে? যুক্তিগতভাবে মানুষ কখনোই কোরান বা বাইবেলে বর্ণিত বা নির্ণীত শয়তানে রূপান্তরিত হতে পারে না, তার কোনই সুযোগ বা সম্ভাবনা নেই। কেননা কোরান ও বাইবেল বলছে যে, আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করেছেন তার নিজস্ব প্রতিকৃতিতে (image) বা আত্মায় (spirit):
বাইবেল ও কোরান অনুসারে মানুষ যেহেতু আল্লাহর প্রতিকৃতি বা আত্মায় সৃষ্ট, সাদাসিধা যুক্তিতে মানুষ কখনোই শয়তানে কিংবা শয়তান মানুষে রূপান্তরিত হতে পারে না, বরং পারে মানুষ ঈশ্বরে বা ঈশ্বর মানুষে রূপান্তরিত হতে। কেননা মানুষ ও ঈশ্বর একই প্রতিকৃতি, আত্মায় তথা অনুরূপ উপাদানে সৃষ্ট।
এবার বিশ্লষণ করে দেখা যাক, দিল্লিতে দিউয়ালী উৎসবের বাজার করতে আসা ওসব নিষ্পাপ মা-সন্তানরা যেসব বর্বর হত্যাকারী সন্ত্রাসীদের হাতে নিহত হলো, তারা গুণাগুণ ও মনোবৃত্তি তথা আত্মিকভাবে ঈশ্বরের না শয়তানের কাছাকাছি।
কোরানের কাহিনী অনুসারে শয়তান মূলত সদ্বিবেচনা, আত্মসম্মানবোধ, ন্যায় বিচার ও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক। আল্লাহ ফেরেস্তাদেরকে সৃষ্টি করেছেন এবং কর্ম সাধনে উৎকর্ষতার জন্য শয়তান হয়েছিল ফেরেস্তাদের নেতা। মানবের সৃষ্টির পূর্ববর্তী স্বর্গে ফেরেস্তাদের জগৎ ছিল এক সর্বিশেষ সুষ্ঠতা, সম্প্রীতি ও শান্তির যুগ। তারপর আল্লাহ সৃষ্টি করলেন তাঁর নিজ প্রতিকৃতি বা গুণাগুণে নতুন জীব, “আদম” নামের এক মানুষ। এবং আল্লাহ ফেরেস্তাদিগকে আদেশ করলেন আদমকে সম্মান ও আনুগত্য দেখাতে মাথা নত করে সেজদা দিতে। নির্বোধ সব ফেরেস্তা ত্বরিত আল্লাহর কথামত আদমকে সেজদা দিয়ে সম্মান ও আনুগত্য দেখালো, কিন্তু তাদের নেতা শয়তান (ইবলিস) আল্লাহর আদেশ অমান্য করে সেজদা থেকে বিরত থাকল। সেজদা দেওয়ার আগে শয়তান আল্লাহর কাছে জানতে চাইল কেন বা কোন যুক্তিতে সে আদমকে আনুগত্য দেখাবে? সেজদা দেওয়ার আগে সে নিশ্চিত হতে চেয়েছিল কেন সে তা করবে? ফেরেস্তারা কেন আদমকে সেজদা দিবে, অর্থাৎ আদম কেন ফেরেস্তাদের সেজদার যোগ্য – সেটা ব্যাখ্যা না করে আল্লাহ শয়তানের ন্যায্য প্রশ্নে রাগান্বিত হয়ে উঠলেন। আল্লাহ উদার মনের বিশ্ব-স্রষ্টার মত ব্যবহার না করে অনেকটা নীচু বা স্বৈরাচারী মনের মানুষ, যেমন সাদ্দাম হুসেইন, হিটলার, স্ট্যালিন বা পল পটের মত ব্যবহার করে শয়তানকে সর্বাধিক নির্মম ও বর্বর শাস্তি দিলেন – যা হবে দোজখের আগুনে অনন্তকাল ধরে তাকে পুড়িয়ে মারা।
কাজেই শয়তান হলো ন্যায়, যুক্তিবাদ ও প্রজ্ঞাশীলতার কণ্ঠস্বর।[1] সে বুঝতে চেয়েছিলঃ সে যে কাজটা করতে যাচ্ছে তা সে কেন করবে, এবং সেটা করা উচিত কিনা? যখন কোন পিতা তার সন্তানকে নতুন বা অদ্ভুত কোনকিছু করতে বলেন, এটা প্রত্যাশিত যে, কেন সে তা করবে পিতা আগাম তা ব্যাখ্যা করবেন। এবং পিতা যদি তা আগাম ব্যাখ্যা করতে ভুলে যান এবং সন্তান তা ব্যাখ্যা করতে বলে, তখন সে পিতা আগাম তা ব্যাখ্যা করতে ভুলে যাওয়ার জন্য ত্বরিত মাফি মেঙ্গে তা ব্যাখ্যা করবেন। সন্তান যদি পিতার ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট না হয়ে কাজটি করতে নারাজ হয়, তাহলে একজন সুস্থ মনের পিতা সন্তানের উপর জোরজবরদস্তি করবেন না। বড়জোর তিনি একটু না-খুশ হবেন এবং দু-এক দিন পর সবকিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবে। সভ্য সমাজে একজন সুশিক্ষিত ও ভাল পিতার কাছ থেকে এমনটিই আশা করা হয়। তবে অসভ্য ও পশ্চাৎপদ সমাজের পিতা সন্তানদের কাছে কৈফিয়ৎ দিতে রাজী না হতে পারেন; তিনি কেবল আদেশ করবেন এবং সন্তান কোন প্রশ্ন না তুলে তা সম্পন্ন করবে। সন্তান তার আদেশ না মানলে তিনি কোন কিছু না বলে সন্তানকে পিটানি দিবেন, যদিও আল্লাহর শয়তানকে শাস্তি দেওয়ার মত চরম বর্বর শাস্তি তিনি কখনোই তার সন্তানকে দিবেন না।
সুতরাং আমরা দেখছিঃ আল্লাহ যদিও ফেরেস্তাদের স্রষ্টা বা পিতা, তবু তিনি একজন সুসভ্য মানব পিতার মত নন। বরং তিনি একজন অশিক্ষিত, অসভ্য ও স্বৈরাচারী মানব পিতার মত এবং তার চেয়েও বহুগুণে বর্বর ও নির্মম। আল্লাহ একজন সুসভ্য, গণতান্ত্রিক ও ন্যায় শাসকের মত ব্যবহার না করে একজন স্বৈরাচারী বর্বর শাসকের মত ব্যবহার কোরে একটা খুবই ন্যায্য প্রশ্ন করার কারণে শয়তানকে তার ভাণ্ডারের কঠোরতম শাস্তিটি দিলেন। বাকী সব ফেরেস্তাদের মত ভীতু ও অন্ধ আনুগত্য না দেখিয়ে সুবিবেচিত ও মেধাবী প্রশ্ন করায় শয়তানের পাওয়া উচিত ছিল আল্লাহর কাছ থেকে প্রশংসা। শয়তান যে কেন ফেরেস্তাদের নেতা হওয়ার যোগ্য ছিলেন, তিনি তারই পরিচয় দিয়েছিলেন আল্লাহকে ন্যায্য প্রশ্নটি কোরে। অথচ আল্লাহ খুশী হয়ে তাকে আশাকৃত প্রশংসা ও পুরস্কার না দিয়ে দিলেন অকল্পনীয়ভাবে কঠোর শাস্তি। এমনই আল্লাহর কীর্তি!
সুতরাং আদমকে সৃষ্টির সে দুর্ভাগ্যের দিনটি চিরকালের জন্য যুক্তিবাদ, সদ্বিবেচনা ও ন্যায়-পরায়ণতার সমাপ্তি ঘোষণা করলো।[2] সেদিনটি আল্লাহর স্বৈরাচার, অবিচার ও প্রজ্ঞাহীনতার সূচনা করলো। এবং সেদিনটিতে মানুষ নামের এক নতুন জীবের আবির্ভাব হলো – যে আল্লাহর স্বৈরাচার, অবিচার, যুক্তিহীনতা, নির্মমতা ও অনুরূপ অন্যান্য গুণাবলীর ধারক। সামগ্রিকভাবে মানব ইতিহাস আমাদেরকে সেটাই বলে। সুতরাং আল্লাহর দাবী যে তিনি মানুষকে তাঁর নিজস্ব প্রতিকৃতি বা গুণাবলীতে সৃষ্টি করেছেন, সে দাবী যথার্থ। মানুষ সত্যিকার অর্থেই আল্লাহর প্রতিকৃতি বা গুণাবলীর প্রতিফলন এবং শয়তানের ঠিক উলটো।
সুতরাং আমেরিকায় ৯/১১, লন্ডনে ৭/৭, দিল্লিতে ২৯/১০ এবং এরূপ অন্যান্য নিষ্পাপ জীবন-বিধ্বংসী সন্ত্রাসী হামলাকারীদেরকে শয়তানের রূপান্তর বলা যায় না। কেননা আল্লাহ ও শয়তান হলো একে অপরের বিপরীত মেরুর, সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী উপাদানে সৃষ্ট। আর মানুষ যেহেতু আল্লাহ প্রতিকৃতিতে বা গুণাবলীতে সৃষ্ট, কাজেই মানুষ ও শয়তান বিপরীত মেরুর সত্তা। কাজেই হত্যান্মোত্ত সন্ত্রাসী বা বোমা হামলাকারীরা কেবল মাত্র আল্লাহর প্রতিকৃতি বা মনোবৃত্তিকে উপস্থাপন করতে পারে, শয়তানের প্রতিকৃতি বা মনোবৃত্তিকে নয়।
আসুন এবার তলিয়ে দেখিঃ আত্মঘাতী বোমা-হামলাকারী বা অন্য সন্ত্রাসী হামলাকারী মুসলিমরা আল্লাহর নির্দেশ কার্যকর করছে, না শয়তানের? আদমকে সৃষ্টির কাহিনী আমাদেরকে বলে যে, আল্লাহ তাদেরকে পছন্দ করেন যারা তার নির্দেশ পূর্ণ আনুগত্যের সাথে পালন করে, তথাকথিত আত্মবিধ্বংসী লেমিংদের মত (লেমিং হলো ইঁদুর জাতীয় এক প্রাণী, যারা ব্যাপক প্রজননের সময়ে খাদ্য ও আশ্রয়ের জন্য চোখ বুজে হন্যে কুকুরের মত যে কোন দিকে দৌড়াতে থাকে ও সে প্রক্রিয়ায় তাদের বেশিরভাগ মৃত্যুবরণ করে)।[3][1] দৃষ্টান্তস্বরূপ, শয়তান ব্যতীত বাকী সব ফেরেস্তা, যারা সুনিপুণ সততার সাথে তাদের দায়িত্ব পালনের কৃতিত্ব সত্ত্বেও অনেকটা লেমিংদের মত নিজেদের আত্মমর্যাদাকে বেমালুম পদদলিত করে এমন এক জীবের পায়ে পড়ে সেজদা করল, যার মত খারাপ জীব পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি আছে কিনা সন্দেহ। আমাদের এ আলোচ্য ঘটনাতে, ওসব আত্মঘাতী বোমা-হামলাকারী প্রকৃতপক্ষে লেমিংদের মতো আল্লাহর নির্দেশ পালন করতঃ নিজ জীবন বিসর্জন দিচ্ছে এবং সেই সাথে ধ্বংস করছে যত বেশি সম্ভব নিষ্পাপ জীবন। আল্লাহর সে নির্দেশ কোরানের বেশকিছু আয়াতে উল্লেখিত হয়েছে। এখানে এরূপ কয়েকটি আয়াত উদ্ধৃত করা হলোঃ
সুতরাং আল্লাহ যুদ্ধ (জিহাদ) করাকে মুসলমানদের জন্য বাধ্যতামূলক করেছেন, তারা তা পছন্দ করুক বা নাই করুক। এবং আল্লাহর পথে সে যুদ্ধে তারা অবিশ্বাসীদেরকে হত্যা করবে এবং নিজেরা নিহত হবে যতদিন না একমাত্র আল্লাহতে বিশ্বাস (অর্থাৎ ইসলাম) বিশ্বের সর্বত্র আধিপত্য পাবে।
তবে হতাশার বিষয় যে, আল্লাহ মুসলমানদেরকে এ নির্দেশ দেওয়ার ১,৪০০ বছর পরও আজ পৃথিবীর বহু অংশে, যেমন ভারত, ইউরোপ, আমেরিকা ও অন্যান্য অঞ্চলে, আল্লাহর তথা ইসলামের রাজত্ব স্থাপিত হয় নি। বরং আল্লাহর সর্বাধিক ঘৃণিত মূর্তিপূজাসহ অন্যান্য মিথ্যা ঈশ্বরে বিশ্বাস কিংবা পুরোপুরি অবিশ্বাস (নাস্তিকতা) বিশ্বের বিরাট জনসংখ্যার মধ্যে আজও বিরাজমান বা প্রাধান্যকারী। আল্লাহর চূড়ান্ত আকাঙ্ক্ষা পূর্ণকরণে মুসলমানদের এ ব্যর্থতা আল্লাহকে অত্যন্ত নিরাশ করে থাকবে এবং আজকের তথাকথিত ইসলামী সন্ত্রাসবাদীরা পৃথিবীর সর্বত্র আল্লাহর তথা ইসলামের আধিপত্য কায়েমের জন্য আল্লাহর সে আদেশ পালন করছে মাত্র। এসব সন্ত্রাসীরা আত্মঘাতী হামলায় ঝাঁপিয়ে পড়ছে ঠিক যেমন করে নবী মুহাম্মদের অপেক্ষাকৃত দুর্বল অনুসারীরা অধিক শক্তিশালী বিধর্মীদের বিরুদ্ধে লেমিংদের মত ঝাঁপিয়ে পড়তো এবং বেশীরভাগ সময় শত্রুপক্ষের উপর অধিক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাতো। আজকের আত্মঘাতী মুসলিম সন্ত্রাসীরা নবীর সাহাবীদের মত কর্মকাণ্ডে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের চেয়েও বেশি কৃতিত্ব অর্জন করছে; অনেক সময় একা একশ’ জন শত্রুকে সাথে নিয়ে মরছে তারা।
অন্যদিকে, শয়তান কখনো এমন নির্দয় বর্বর নির্দেশ কাউকে দিয়েছেন বলে জানা যায় নি। আগেই বলে হয়েছেঃ মানব-পূর্ববর্তী শয়তানের নেতৃত্বাধীন ফেরেস্তাদের জগৎ ও যুগ ছিল ন্যায়, সুষ্ঠতা ও শান্তির যুগ। তবে আল্লাহ দাবী করেনঃ শয়তান এক “মহা অন্যায় কর্ম” করেছিল আদম ও হাওয়াকে বিপথে চালিত করে। কিন্তু সেটা তেমন কোন বড় অন্যায় কাজ ছিল কী? আল্লাহ সৃষ্টি করেছিলেন আদম ও হাওয়াকে নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দিয়ে, অথচ আল্লাহ সস্নেহ ও মমতাশীল পিতার মত ব্যবহার না করে এক যুক্তিহীন নিষ্ঠুর ও খেলাড়ী নিপীড়কের মত তাদেরকে সে ফলটি খেতে নিষিদ্ধ করলেন। আল্লাহ আদম-হাওয়া’কে যে ফলটি খাওয়ার আকাঙ্ক্ষা দিয়েছিলেন এবং তাদের সুস্থ জীবনযাপনের জন্য যে ফলটি খাওয়ার অধিকার ছিল তাদের – সে ফলটি খেতে প্ররোচণা দেওয়া ছিল শয়তানের একমাত্র দোষ। শয়তানের সে তথাকথিত “মহা অপকর্মের” একমাত্র কারণ ছিল আদম ও হাওয়া’কে তাদের চলমান মানসিক পীড়ন বা যাতনা থেকে রেহাই দেওয়া। কাজেই শয়তান ছিল আদম-হাওয়ার সহমর্মী বন্ধু; আল্লাহর মত অযৌক্তিক, নিপীড়ক ও নির্মম পিতা নন। এবং সুবিচারে আদম-হাওয়ার নিষিদ্ধ ফল খাওয়ার এ তথাকথিত অপরাধে অপরাধী হবেন প্রধানত আল্লাহ নিজে এবং দ্বিতীয়ত শয়তান, কেননা হাওয়া কেবল শয়তানের মিথ্যা প্ররোচণার ফাঁদে পড়েছিলেন। কিন্তু আল্লাহ আরেকবার তার স্বভাবসিদ্ধ স্বৈরাচারী অবিচারের নজীর রাখলেন আবারো সে অপকর্মে মূলত নির্দোষ আদম ও হাওয়া’কে বেহেস্ত থেকে বহিষ্কারের মত চরম শাস্তি দিয়ে।
এক কথায় বলতে হয়ঃ মুসলিম সন্ত্রাসীদের অযৌক্তিক, বর্বর ও নির্দয় ধ্বংসকাণ্ড কোনক্রমেই শয়তানের নীতি ও নৈতিকতা প্রদর্শন করে না, বরং তা সুস্পষ্ট আল্লাহর নীতি ও নৈতিকতার প্রতিফলন। অন্যকথায়, এসব সন্ত্রাসীরা শয়তানের না হয়ে আল্লাহর পুনর্জন্ম বা রূপান্তর উপস্থাপিত করে মাত্র।
আধুনিক বৈশ্বিক (secular) ও মানবিক শিক্ষা ও নৈতিকতায় দীক্ষিত অনেক ধার্মিক ও নমনীয় (moderate) মুসলমান অত্যন্ত অন্যায়ভাবে ইসলামী সন্ত্রাসীদেরকে শয়তানের রূপান্তর আখ্যা দেন, যদিও তাদের সে অপকর্ম মূলত আল্লাহর নির্দেশনা, মনোবৃত্তি ও প্রকৃতিকে প্রতিফলিত করে। অন্যান্য ধর্মের নমনীয় অনুসারীরাও প্রায়শ একই মনোবৃত্তির পরিচয় দেয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, মধ্যযুগের ইউরোপে খৃষ্টানরা মিলিয়ন মিলিয়ন নারীকে “ডাইনি” আখ্যা দিয়ে পুড়িয়ে মেরেছিল[4] ও অসংখ্য নারী-পুরুষকে ধর্মত্যাগী ও নাস্তিক হিসেবে একইভাবে মেরেছিল। অথচ আজকের আধুনিক খৃষ্টানরা তৎকালীন খৃষ্ট-যাজক শ্রেণী গোঁড়া খৃষ্টান, যারা ওসব ডাইনি ও নাস্তিক হত্যার প্ররোচণা দিয়েছিলো বা তাতে অংশগ্রহণ করেছিল – তাদেরকে শয়তানের রূপান্তর আখ্যা দিবে। অথচ প্রকৃতপক্ষে বাইবেলের ঈশ্বর সেসব বর্বর ও নির্মম হত্যাকাণ্ডের নির্দেশ দিয়েছেন নিম্নোক্ত আয়াতেঃ
অনুরূপভাবে আজকের সকল ভাল বা ধার্মিক খৃষ্টানরা বিশ্বাস করে যে, সমকামী ক্লাব ও গর্ভপাতকারী চিকিৎসালয় ইত্যাদি পাপাচারী ও তাদের ঈশ্বরের অনুমোদনের পরিপন্থী। অথচ এরিক রুডলফ নামক এক খৃষ্টান সন্ত্রাসী যখন খৃষ্টধর্মীয় নৈতিকতায় উদ্দীপিত হয়ে আমেরিকাতে সমকামী ক্লাব ও গর্ভপাতকারী চিকিৎসালয়ে বোমা হামলা চালিয়ে বহু লোককে হত্যা, আহত ও পংগু করলো, তখন খৃষ্টানরা রুডলফকে শয়তানের পুনর্জন্ম আখ্যা দিল, যদিও তার সে নির্দয়-বর্বর কর্মের অনুপ্রেরণা পেয়েছিল খৃষ্টীয় ঈশ্বরের নৈতিকতার বিধান থেকে। শয়তান কখনোই কোথাও বলে নি যে সমকামিতা বা ইচ্ছাকৃত গর্ভপাত পাপাচারী ও অনৈতিক, যা রুডলফকে ওসব বর্বর সন্ত্রাসী কর্মে উদ্দীপিত করতে পারে।
শেষ কথায়, আসুন আমরা এসব বর্বর সন্ত্রাসী অপকর্মের দোষ উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে না চাপিয়ে, অর্থাৎ নিরীহ-নিষ্পাপ শয়তানের ঘাড়ে না চাপিয়ে, প্রকৃত দোষীর উপর চাপাই। নইলে, এসব অনাকাঙ্ক্ষিত ধ্বংসকাণ্ড নিরসনের জন্য সঠিক সমাধান বের করা মুস্কিল হবে।
[1] জন মিল্টন তার Paradise Lost-এ শয়তানকে এভাবেই উপস্থাপিত করেছেন।
[2] ঐ
[4] Dr. Jakob Prenger-এর Malleus Maleficarum গ্রন্থে ৯ লাখ ডাইনি হত্যার কথা বলে হয়েছে।