Banner
বিষয়ঃ “আসাঞ্জ প্রসংগঃ বাক-স্বাধীনতা, আমেরিকা ও সমাজতন্ত্র” -- শামসুল আলম চঞ্চল

লিখেছেনঃ শামসুল আলম চঞ্চল, আপডেটঃ November 4, 2012, 8:01 AM, Hits: 1665

আমার লেখা “জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জকে নিয়ে আলমগীর হুসেনের নিবন্ধের জবাবে”-এর উত্তরে আলমগীর হুসেনের লেখা “আসাঞ্জ প্রসংগঃ বাক-স্বাধীনতা, আমেরিকা ও সমাজতন্ত্র” নিবন্ধটি সম্পর্কে কিছু বলা প্রয়োজন বলে মনে করছি। পাঠকদের বুঝার সুবিধার জন্য লেখক আলমগীর হুসেনের লেখা থেকে উদ্ধৃত করে তার উপর আলোচনা করব।

লেখক লিখেছেন, “….. আসাঞ্জের কর্মকাণ্ডকে আসাঞ্জ ও তার ভক্তরা কিভাবে দেখে এবং আসাঞ্জের সুইডেনে ধর্ষণের অভিযোগের ব্যাপারে তাদের অবস্থান ও জল্পনা-কল্পনার বিশ্লেষণ ছিল আমার রচনার বিষয়বস্তু। চঞ্চল ভাই উনার উত্তরে আমার লেখার মূল বিষয়বস্তুকে অনেকটা অগ্রাহ্য করেছেন।”

আমি মনে করি আলমগীর হুসেনের লেখার মূল বিষয়বস্তু ধরতে আমি ভুল করি নাই। তিনি জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জের প্রসংগে আলোচনা করলেও তাঁর আলোচনার মূল আবেদন ছিল আমেরিকার গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতাকে আমাদের কাছে আদর্শায়িত করা। সেখানে অ্যাসাঞ্জের কর্মকাণ্ডকে অ্যাসাঞ্জ ও তাঁর ভক্তরা কীভাবে দেখে সে প্রসংগ ছিল উপলক্ষ্য। অ্যাসাঞ্জের ব্যক্তিগত কর্মকাণ্ড আমার আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল না, যদিও সেখানে অ্যাসাঞ্জ প্রসংগে আমেরিকার গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতা নিয়ে আলোচনা ছিল। স্বাভাবিকভাবেই আমার রচনায় আমেরিকার গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার সত্য রূপকে তুলে ধরতে হয়েছে, যা ভণ্ডামীপূর্ণ ও দ্বিমুখী নীতি (Double Standard) দ্বারা পরিচালিত।

এরপর তিনি রাষ্ট্রের গোপন তথ্য ফাঁসের জন্য কমিউনিস্ট দেশগুলোর শাস্তির প্রসংগে বলছেন “… (রাষ্ট্রের গোপন তথ্য) প্রকাশ্য জনসমক্ষে উন্মোচন দণ্ডনীয় অপরাধ বিবেচিত হয়ে এসেছে এ পর্যন্ত। সম্প্রতি অতীতের কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলো সে গোপনীয়তা ভঙ্গের দায়ে দোষীদেরকে কোন গ্রহণযোগ্য বিচার-আচার ছাড়াই যেভাবে নিষ্ঠুর, বর্বর শাস্তি দিয়েছে, তার তুলনা মেলা ভার। … ” লেখকের আরও মন্তব্য হল, “কাজেই আসাঞ্জের কর্মকাণ্ড বাক-স্বাধীনতা কিনা সে ব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। তবে এটা নিশ্চিত যে, আজ পর্যন্ত বিশ্বের কোন দেশই এমন কাজকে বাক-স্বাধীনতা হিসাবে স্বীকৃতি দেয় নি। … ।”

দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে এখন পর্যন্ত সমস্ত পৃথিবী জুড়ে প্রায় সব রাষ্ট্রের গোপন তথ্য চুরি করার জন্য আমেরিকা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে সিআইএ-কে কাজে লাগিয়ে। বিভিন্ন দেশকে অস্থিতিশীল করেছে তার প্রয়োজন অনুযায়ী ও নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগে এমন তথ্য খুবই সুকৌশলে জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে। আমেরিকার সেসব কর্মকাণ্ড কি দণ্ডনীয় অপরাধ নয়? নাকি আমেরিকা মহা ক্ষমতাধর দেশ বলে তার সকল কর্মকাণ্ড আমাদের আদর্শ হবে এবং বিনা প্রশ্নে গ্রহণযোগ্য হবে?

যে রাষ্ট্রীয় গুপ্ত তথ্য চুরি নিয়ে অ্যাসাঞ্জের এত সমালোচনা সেই গুপ্ত তথ্য অপর দেশ থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা নিয়োগ করে তাদের মাধ্যমে আমেরিকা যা করছে সেটা যদি রাষ্ট্রীয় গুপ্ত তথ্য চুরি না হয় তাহলে কোনটা হবে? এই দুই চুরির মধ্যে একটাই পার্থক্য, তা হল একটা রাষ্ট্র করছে এবং তার বেশীরভাগই গোপন রাখছে, আর বিপরীত পক্ষে অপরটি একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে ছোট একটি গোষ্ঠী করছে, পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হয়ে এবং প্রায় সবই জন সমক্ষে প্রকাশ করছে।

আমার আলোচনায় সাবেক কমিউনিস্ট রাশিয়া বা সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বাক স্বাধীনতার প্রসংগ আসে নাই, যেহেতু ঐসব দেশে পাশ্চাত্য মডেলের বাক স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র নাই। যদিও পার্টির অভ্যন্তরে গণতন্ত্র অনেক সমাজতান্ত্রিক বা সমাজতন্ত্র ছিল এমন দেশে আছে। এক সময়কার কমিউনিস্ট রাশিয়া বা অন্যান্য প্রাক্তন সমাজতান্ত্রিক দেশ বিশ্বব্যাপী গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার কথা বলে বেড়ায় না, কিংবা গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্র কোনটাই আমেরিকা বা পাশ্চাত্যের মতো রপ্তানী করতে সচেষ্ট নয়, তাই গণতন্ত্র ও বাক স্বাধীনতার প্রশ্নে আমেরিকা বা অন্যান্য দেশের সাথে তাদের তুলনা আমার কাছে অর্থহীন মনে হয়েছিল। একইভাবে মধ্যপ্রাচ্যের ইসলামী দেশগুলোর সাথে আমেরিকার তুলনাও অর্থহীন।

আর আমেরিকা তার বিরোধীদের বর্বর শাস্তি দেয় না এমন দাবী সত্যের অপলাপ আর কুযক্তি ছাড়া কিছু নয়। "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' নাম দিয়ে আমেরিকা গুয়ান্তানামো বে সহ বিভিন্ন স্থানে এমন কি নিরাপরাধ বন্দীদের উপর যে ভয়াবহ নির্যাতন চালিয়েছে সেটা কি লেখক ভুলে গেছেন? কিংবা চালক বিহীন বিমানের (ড্রোন) সাহায্যে পাকিস্তান, আফগানিস্তান আর আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে এখনও বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে চলেছে সেটাও কি বর্বরতা নয়? কিংবা পাকিস্তানের পূর্ব অনুমতি না নিয়ে ইসলামাবাদে আমেরিকার হেলিকপ্টার নিয়ে গিয়ে ওসামা বিন লাদেনকে বিনা বিচারে হত্যা করেছিল, সেটাও কি তার বিরোধীদের প্রতি নিষ্ঠুরতা আর বর্বরতার প্রমাণ নয়? এসব কীর্তির পরেও আমেরিকার কোন নৈতিক ভিত্তি থাকে না মানবাধিকার আর গণতন্ত্রের জন্য কথা বলার।

লেখক আরও লিখেছেন, “…. বাক-স্বাধীনতা ব্যক্তির মতামত প্রকাশের অধিকার মাত্র। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা আন্দোলন বাক-স্বাধীনতা হিসাবে গণ্য নাও হতে পারে।”

ব্যক্তির মতামতের সামষ্টিক রূপই রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বা আন্দোলন হিসাবে প্রকাশ পায়। কাজেই ব্যক্তির বাক স্বাধীনতা থেকে রাজনৈতিক আন্দোলন খুব দূরে নয়। আমেরিকা তাদের মাটিতে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড ও আন্দোলনকে দমন করেছে মেনে নিলে এবং একই সাথে তা ব্যক্তি মতামতের প্রতি সহনশীল ছিল বললে বক্তব্যটি স্ববিরোধিতাপূর্ণ হয়ে যায়।

লেখকের বক্তব্য হল, “…. কাজেই কমিউনিস্ট পার্টির যারা রাশিয়ার পক্ষে গুপ্তচর বৃত্তিতে নিযুক্ত ছিল, তাদের অনেকে সে দোষে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হয়, অন্যদেরকে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনা হয়। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমেরিকার প্রভু-দেশ রাশিয়া কমিউনিস্ট বিরোধীদের প্রতি কিরূপ আচরণ করেছে, তা উদ্ধৃত করলে চঞ্চল ভাই’র আলোচনাটা সুন্দর হতো। উল্লেখ্য তাদের হাজার-হাজার, লাখ-লাখ মৃতদেহ কমিউনিস্ট দেশগুলোতে লাশের গঙ্গা বহিয়েছে।”

“আমেরিকার প্রভু-দেশ রাশিয়া” বলতে লেখক কী বুঝিয়েছেন তা আমি বুঝলাম না। সম্ভবত এটা মুদ্রণের ভুল। যাইহোক, আমেরিকার অভ্যন্তরে রাশিয়ার গোয়েন্দাবৃত্তি যেমন ইতিহাসের অংশ, তেমন প্রকৃত ইতিহাস হল আমেরিকাও রাশিয়া বা তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়নের অভ্যন্তরে গোয়েন্দা কার্যক্রম চালিয়েছিল। তবে লেখকের এমন ঢালাও বক্তব্য আমেরিকার শাসক শ্রেণী এক সময় স্বদেশে ও বিশ্বব্যাপী তাদের প্রচারযন্ত্রে পক্ষপাতদুষ্ট যে ঢালাও প্রচার চালিয়েছিল, সে কথাই মনে করিয়ে দেয়। কারও প্রচারণা দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে আমরা সত্য ইতিহাসেরই সন্ধান করব। এবিষয়ে নির্ভরযোগ্য তথ্য পাবার জন্য আমরা আমেরিকান সাংবাদিক ও লেখক টিম ওয়েইনারের সাহায্য নিতে পারি। বিষয়টি ভালভাবে বোঝার জন্য কিছুটা দীর্ঘ হলেও তাঁর লিগেসি অব অ্যাশেজ : সিআিইএ’র ৬০ বছরের ইতিহাস ১ গ্রন্থের কিছু অংশ নীচে উদ্ধৃত করছি :

“১৯৬৭ সালের অক্টোবরে অল্প কয়েকজন সিআইএ বিশ্লেষক প্রথমবারের মত ওয়াশিংটনে যুদ্ধবিরোধী (ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী) মিছিলে অংশ নেয়। যারা সেই মিছিলে ছিল, প্রেসিডেন্ট (যুক্তরাষ্ট্রের) তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে দেখতে থাকেন। তিনি ভাবতেন সে আন্দোলনের পিছনে টাকা ঢালছে মস্কো আর বেইজিং। এর প্রমাণ চাইছিলেন প্রেসিডেন্ট, রিচার্ড হেলমসকে তা হাজির করার নির্দেশও দেন তিনি।
……….
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশ পেয়ে সিআইএ’র পরিচালক সরাসরি আইন ভাঙেন এবং পার্ট টাইম গুপ্ত পুলিশ বাহিনী প্রধানে পরিণত হন। সিআইএ একটা অভ্যন্তরীণ সার্ভেইল্যান্স অপারেশন হাতে নেয়, কোড নাম ছিল ‘ক্যাওয়াস’। প্রায় সাত বছর চলে সে অপারেশন। আমেরিকান নাগরিকদের ওপর গোয়েন্দাগিরি চালানোর জন্য হেলমস নতুন একটা স্পেশাল অপারেশনস গ্রুপের সৃষ্টি করেন এবং সেটাকে সুকৌশলে অ্যাংলিটনের কাউন্টার ইন্টেলিজেন্স বাহিনীর আস্তিনে গুঁজে রাখেন। এগারোজন সিআইএ অফিসার সাধারণ আমেরিকানদের মত লম্বা চুল রাখতে শুরু করেন, নিউ লেফটদের সাঙ্কেতিক ভাষা শেখেন এবং আমেরিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন শন্তিবাদী দলে ইনফিলট্রেট করতে থাকেন। এজেন্সি একটা কম্পিউটার ইনডেক্স তৈরি করে যাতে ৩ লক্ষ আমেরিকানের নাম ও সংস্থার নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়। একই সাথে তৈরী করা হয় ৭ হাজার ২শ নাগরিক সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্যসম্বলিত ফাইল। এই স্পেশাল অপারেশনস গ্রুপ সারা আমেরিকায় পুলিশের সহায়তায় গোপনে কাজ শুরু করে। কিন্তু চরম বাম ও যুদ্ধের মূলধারার বিরোধীদের মধ্যে স্পষ্ট বিভাজনরেখা টানতে ব্যর্থ হয়ে শান্তি আন্দোলনে জড়িত সব বড় বড় সংগঠনের ওপর গোয়েন্দাগিরি শুরু করে। হেলমস ও সেক্রেটারি অব ডিফেন্সের মাধ্যমে প্রচার হওয়া প্রেসিডেন্টের নির্দেশ অনুযায়ী ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি তার সুবিশাল আড়িপাতার ক্ষমতাকে আমেরিকান নাগরিকদের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দেয়।

……….
কিন্তু সিআইএ কখনও কণা পরিমাণ প্রমাণও জোগাড় করতে পারেনি যাতে স্পষ্ট হয় যে আমেরিকান বাম বা কালোদের আন্দোলনের পিছনে কোনো বিদেশী শক্তির ইন্ধন আছে। হতাশ হওয়ার মত এই ‘প্রমাণ জোগাড় করতে না পারার’ বিষয়টা হেলমস ১৫ নভেম্বর প্রেসিডেন্টকে জানান। তিনি রিপোর্ট করেন, দেশের বামপন্থী রাজনীতিকদের কারও কারও মস্কো বা হ্যানয়ের প্রতি আদর্শিক আসক্তি থাকতে পারে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে। কিন্তু কোনো প্রমাণ তিনি হাজির করতে পারেননি যাতে বোঝা যায় এইসব রাজনীতিকের কর্মকাণ্ডের পিছনে বাইরের কোনো দেশের হাত আছে। প্রেসিডেন্ট নির্দেশ দেন তল্লাশী আরও জোরদার করার। তারপরও সেসবের মধ্যে সিআইএ’র চার্টারবিরোধী কিছু পাওয়া যায়নি।” (পৃষ্ঠাঃ ৩৩৪-৩৩৬)

উপরের অংশটি পড়ার পর বুঝা যায়, বাম শক্তিকে ধ্বংস করার জন্যই আমেরিকা একতরফা ও ঢালাওভাবে তার সমস্ত প্রচারযন্ত্রকে ব্যবহার করেছিল যার প্রতিধ্বনি করেছেন লেখক তাঁর লেখায়। কমিউনিস্ট দেশগুলোতে কমিউনিস্ট বিরোধীদের প্রতি যে নির্মমতার কথা লেখক লিখেছেন, তা অনেকাংশে সত্য হলেও এখানেও যে আমেরিকা রাষ্ট্রের প্রচারে অতিরঞ্জন আছে এবিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। "হাজার-হাজার বা লাখ-লাখ’ "লাশের গঙ্গা’-র যে উল্লেখ লেখক করেছেন তাও আমেরিকাসহ পাশ্চাত্যের প্রচারণা কৌশলের একটি অংশ।

আমেরিকা ও তার স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত গোষ্ঠী যখন কমিউনিস্ট দেশগুলোতে লাশের গঙ্গার কথা বলে তখন ‘উদার গণতান্ত্রিক’ এবং ‘মানবাধিকারের প্রবক্তা ও রক্ষাকারী’ আমেরিকা আর ইংল্যান্ডের দ্বারা সংগঠিত গণহত্যা ও "লাশের গঙ্গা’ বইয়ে দেবার কথা উল্লেখ না করে পারা যায় না। তাদের দ্বারা পৃথিবী ব্যাপী সংগঠিত অসংখ্য গণহত্যার মধ্যে এখানে আমি মাত্র কয়েকটির কথা উল্লেখ করব। উপনিবেশিক আমলে ১৯১৯ সাল পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ান ওয়ালাবাগের নিরস্ত্র ও শান্তিপূর্ণ মানুষের এক জনসমাবেশে ব্রিটিশ সেনাবাহিনী মেশিনগান থেকে গুলি শেষ না হওয়া পর্যন্ত টানা ১০ থেকে ১৫ মিনিট গুলিবর্ষণ করেছিল, যাতে ব্রিটিশ সরকারের হিসাব মতেই ৩৭৯ জনের মৃত্য হয় ও প্রায় ১১০০ জন আহত হয়। ভারতীয় কংগ্রেস থেকে দাবী করা হয়েছিল যে, সেই ঘটনায় ১১০০ মানুষ মৃত্যু বরণ করে। এই সংখ্যাই বরং সত্য বা সত্যের কাছাকাছি, যেহেতু সত্য প্রকাশের ভয়ে ‘উদার গণতান্ত্রিক’ ব্রিটিশ সরকার স্বাভাবিকভাবেই মৃতদেহ সরিয়ে ফেলবে ও মৃত্যুর সংখ্যাকে কমিয়ে বলবে। এই ঘটনা জালিয়ান ওয়ালাবাগের কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড হিসাবেই ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। এই হত্যাযজ্ঞের কুখ্যাত নায়ক তৎকালীন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডায়ার চাকুরী থেকে অবসর পেয়ে তাঁর স্বদেশ ব্রিটেনে ফিরে গেলে ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘মানবাধিকারবাদী’ ব্রিটিশরা ‘গণতান্ত্রিক’ ও ‘মানবাধিকারবাদী’ হত্যাযজ্ঞের জন্য তাকে বিপুলভাবে বীরের সংবর্ধনা দেয় ও বিপুল পরিমাণে অর্থ দ্বারা পুরস্কৃত করে।

পাঠকদের অবগতির জন্য "উদার গণতান্ত্রিক’ ব্রিটেনের দ্বারা সংগঠিত আরো কয়েকটি পরিকল্পিত গণহত্যার কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে বাংলার নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করে ইংরেজদের নিয়ন্ত্রণে বাংলার শাসনভার নেবার পর তাদের তত্ত্বাবধানে পরিকল্পিতভাবে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর (বাংলা ১১৭৬) নামে পরিচিত ১৭৬৯-১৭৭০ সালে যে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ঘটানো হয়েছিল তাতে বাংলার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ মৃত্যু বরণ করে। সরকারী কোন পরিসংখ্যান না থাকলেও ইংরেজদের হিসাবেই এই সংখ্যা ছিল সেই সময়কার মোট জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশ। তাতে দুর্ভিক্ষে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়ায় এক কোটি। সেই সময় দুর্ভিক্ষকে উপেক্ষা করে স্বাভাবিক সময়ের মত ইংরেজ কোম্পানী জনগণের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করে।২ গণতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজের এই ববর্রোচিত নিষ্ঠুরতা মানব জাতির ইতিহাসে এক কলংক হয়ে আছে। এছাড়া বাংলায় পঞ্চাশের মন্বন্তর (বাংলা ১৩৫০ সালে) হিসাবে পরিচিত আরেক বড় ধরণের দুর্ভিক্ষ ঘটে ১৯৪৩ সালে, যা ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বজায় ছিল। হিসাব অনুযায়ী জানা যায় যে, ১৯৪৩ থেকে ১৯৪৬ সালব্যাপী দুর্ভিক্ষ এবং এর ফলে সৃষ্ট মহামারীতে ৩৫ থেকে ৩৮ লক্ষ লোক মারা যায়।৩

‘উদার গণতান্ত্রিক’ আমেরিকার ইতিহাস এর চেয়ে কম ভয়ংকর আর নির্মমতাপূর্ণ নয়। কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের পর থেকে আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের উপর আমেরিকানরা ভয়ংকর নির্যাতন, তাদের আদি বাসভূমি থেকে বলপূর্বক উচ্ছেদ ও লক্ষ লক্ষ স্থানীয় অধিবাসীকে হত্যা করেছিল। উপরে বর্ণিত এসব ঘটনাকে আমরা কি তাহলে ইউরোপ-আমেরিকার ‘উদার গণতান্ত্রিক’ অথবা ‘মানবাধিকারবাদী’ গণহত্যা বলব? ভিয়েতনামের গণহত্যার স্মৃতি কি এখনই ফিকে হয়ে গেছে? গত শতাব্দীর পঞ্চাশ, ষাট ও সত্তরের দশকে আমেরিকা ভিয়েতনামে যে প্রায় অর্ধ কোটি মানুষকে হত্যা করেছিল এবং এজেন্ট অরেঞ্জসহ অন্যান্য বিষাক্ত রাসায়নিক দ্বারা লক্ষ লক্ষ মানুষকে পংগু করেছিল যার বিষক্রিয়ায় যুদ্ধের পরেও লক্ষ লক্ষ পঙ্গু শিশু জন্ম নিয়ে চলেছে সেটা মানবাধিকার রক্ষা কিংবা গণতন্ত্র চর্চার কোন সংজ্ঞায় পড়ে? নাকি ‘গণতান্ত্রিক’ এবং ‘মানবাধিকারবাদী’ আমেরিকা গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করলে সেটা আর গণহত্যা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন হয় না? তবে কি আমেরিকা দ্বারা সংগঠিত গণহত্যাকে বলব ‘গণতান্ত্রিক গণহত্যা’ অথবা ‘মানবাধিকারবাদী গণহত্যা’? বস্তুত পৃথিবীর দেশে দেশে আমেরিকা বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য দ্বারা সংগঠিত হত্যা, ধ্বংস ও নির্যাতনের এত অজস্র ইতিহাস রচিত হয়ে আছে যে যতই চেষ্টা করা যাক না কেন সেগুলোর স্মৃতিকে মানুষের মন থেকে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। এই সব অন্যায়কে কোনও কৌশল আর চেষ্টাতেই গ্রহণযোগ্য করা যাবে না।

এটা ঠিক যে, কমিউনিস্ট দেশগুলোতে বিরোধী মতকে কঠোর হাতে এবং কখনো নির্মমতার সাথে দমন করা হয়েছিল। কিন্তু একথা ভুললে চলবে না যে, সামন্তবাদী ইউরোপ থেকে আধুনিক শিল্পোন্নত ইউরোপে উত্তরণের প্রক্রিয়ায় ইউরোপের বিভিন্ন দেশে যুগ যুগ ব্যাপী যেসব যুদ্ধ হয়েছিল সেই সময়ে বিরোধীদের হাজার হাজার এমন কি লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। ফরাসী বিপ্লবের ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের কথা কি লেখক আলমগীর হুসেন ভুলে গেছেন? সেসব কি ‘লাশের গঙ্গা’ ছিল না? আমার লেখায় কমিউনিস্টদের নির্মমতার কথা বলি নাই বলে লেখক অনুযোগ করেছেন। যেহেতু কমিউনিস্ট দেশগুলো নিজেদের বাক স্বাধীনতা অথবা গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী বলে দাবী করে না, তাই স্বাভাবিকভাবেই তাদের নির্মমতা ও হত্যাকাণ্ডের প্রসংগ এখানে অপ্রাসঙ্গিক ও অপ্রয়োজনীয় ছিল। অপরপক্ষে আমেরিকা নিজেদের বাক স্বাধীনতা আর গণতন্ত্রের পুণ্যভূমি হিসাবে দাবী করায় একই কারণে সত্য প্রকাশের স্বার্থে আমেরিকার প্রকৃত রূপটা উন্মোচন করার প্রয়োজন হয়েছিল বলেই আমার আলোচনায় সে বিষয়টিকেই প্রাধান্য দিয়েছিলাম।

লেখক এক জায়গায় লিখেছেন, “তবে এটা অনেকটা আত্ম-বিরোধী ধারণা যে, উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা দিয়েছিল মার্ক্সবাদ। কেননা বিশ্বব্যাপী উপনিবেশ-বিরোধী আন্দোলন ছিল জাতীয়তাপন্থী, অথচ মার্ক্সবাদ হচ্ছে আন্তর্জাতিকতাপন্থী। কাজেই মার্ক্সবাদ ও জাতি-রাষ্ট্রবাদী আন্দোলন পারস্পরিক বিরুদ্ধ ধারণা।”

এটি খুবই দুর্বল যুক্তি যে, আন্তর্জাতিক মতবাদ হওয়ার ফলে মার্ক্সবাদ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হিসাবে কাজ করে নাই। চীনে বা ভিয়েতনামের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন কি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ছিল না? সেখানে আন্তর্জাতিকতাবাদী মার্ক্সবাদ কি সোভিয়েত রাশিয়ার নেতৃত্বে বিশ্বরাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলায় কোন ভূমিকা রেখেছিল? অথবা রাশিয়া, চীন, উত্তর কোরিয়া, ভিয়েতনাম, কিউবা – এসব দেশ কি রাশিয়া বা অন্য কোন একটি দেশের নেতৃত্বে বিশ্ব রাষ্ট্রব্যবস্থার অংশ? এটা ঠিক যে, মার্ক্সবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ হওয়ায় তা জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব বুঝে না। কিন্তু আমি বলতে চেয়েছি যে, মার্ক্সবাদ যে মতবাদই প্রচার করুক না কেন বাস্তবে তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের হাতিয়ার হয়েছিল, যা বহু ক্ষেত্রেই ছিল উপনিবেশ বিরোধী মুক্তি আন্দোলন।

লেখক লিখেছেন, “উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতির অংশ হচ্ছে বিশ্ব-স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে রাষ্ট্রগুলোর মাঝে সুসম্পর্ক, পরস্পর-নির্ভরশীলতা ও পারস্পরিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের পাশাপাশি বিশ্বকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস। মুসলিম দেশগুলোর সাথে আমেরিকার সম্পর্কও সে ভিত্তিতেই পরিচালিত।”

১৯৭১ সালে যখন বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর গণহত্যা আর নির্যাতনের শিকার হচ্ছিল, তখন আমেরিকার পাকিস্তানকে সমর্থন কি ‘বিশ্বকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস’-এর অংশ ছিল? অথবা ২০০১ সালে ‘উদার গণতান্ত্রিক’ আমেরিকার নেতৃত্বে ন্যাটো বাহিনী আফগানিস্তানে এবং ২০০৩ সালে ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে হাজার হাজার সাধারণ মানুষকে হত্যা করেছিল, যার ধারাবাহিকতা আজও চলছে লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, ধংস ও ব্যাপক মানবিক বিপর্যয়ের মাধ্যমে, সেসবও কি ‘বিশ্ব-স্থিতিশীলতা রজায় রাখতে’ ও ‘বিশ্বকে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস’ হিসাবে? তথাকথিত উদার গণতান্ত্রিক বিশ্বের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির রূপ কতখানি বিশ্ব-স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে আর কতখানি নিজ বাজার ব্যবস্থা ঠিক রাখা ও সম্প্রসারিত করে বিশ্বকে নিজ নিয়ন্ত্রণাধীনে রাখার চেষ্টায় তা টিম ওয়েইনার তাঁর লিগেসি অব অ্যাশেজ বইতে এত বিস্তারিত ও তথ্যবহুল বর্ণনা দিয়েছেন যে, এর পর লেখক আলমগীর হুসেনের উপরের মন্তব্য ভিত্তিহীন আর পরিহাসের বিষয়ে পরিণত হয়। বইটি পড়লে আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি বিশ্বকে ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার দিকে এগিয়ে নেওয়ার প্রয়াস’ না বিশ্বকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার প্রয়াস তা পরিষ্কার হয়ে যায়। কাজেই এ বিষয়ে আর অধিক আলোচনা করতে চাই না।

লেখক আরো লিখেছেন, “…. মার্ক্সবাদ আন্তর্জাতিকতাপন্থী এবং তা এক-কেন্দ্রিক স্বৈরাচারী; ফলে না সে জাতীয়তাপন্থী, না স্বাধীনতাপন্থী।” উপরেই লিখেছি যে, আন্তর্জাতিকতাবাদী দর্শন হওয়ার পরেও মার্ক্সবাদের জন্য জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলনে ভূমিকা রাখতে বহু দেশেই কোন অসুবিধা হয় নাই। তার এক-কেন্দ্রিক দর্শন মার্ক্সবাদী দেশগুলোকে স্বৈরাচারীও করেছে, কিন্তু তা স্বাধীনতাপন্থী নয় - এটি একটি একপেশে মন্তব্য। মার্ক্সবাদ যদি স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেরণা দিতে পারে তাহলে তা কীভাবে তার জন্য ‘স্বাধীনতাপন্থী নয়’ এমন মন্তব্য প্রযোজ্য হতে পারে? তবে মার্ক্সবাদে বিশ্বাসী দেশগুলোতে পাশ্চাত্য পদ্ধতির বহুদলীয় গণতন্ত্র না থাকায় সেখানে পাশ্চাত্য মডেলের বাক স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নাই একথা বলা যেতে পারে।

লেখক আলমগীর হুসেন লিখেছেন, “তবে আজ চঞ্চল ভাইকে যদি বাংলাদেশ ছেড়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিতে হয় এবং সুযোগ দেওয়া হয় আমেরিকা অথবা কোন আল-কায়েদা শাসিত দেশে আশ্রয়ের – উনি মনে হচ্ছে আল-কায়েদা শাসিত দেশে আশ্রয় নেবেন। তবে বৃহত্তর বাংলাদেশী জনতা এবং সিংহভাগ বাংলাদেশী মার্ক্সিস্টরাও আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে। আমেরিকা’ই সর্বাধিক শ্রেয় গন্তব্য বাংলাদেশ-সহ অন্যান্য তৃতীয় বিশ্বের মানুষের। এবং একইভাবে বলতে হয়ঃ এশিয়ায় আমেরিকার শ্রেষ্ঠ মিত্র দেশ হচ্ছে জাপান, সিংগাপুর, তাইওয়ান, দঃ কোরিয়া ইত্যাদি। এবং সে দেশগুলো এশিয়ার মুক্ততম দেশ এবং আল-কায়েদা শাসিত দেশে থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর। বরং বিংশ শতাব্দীতে সোভিয়েত রাশিয়ার ইন্ধনে প্রতিষ্ঠিত মার্ক্সবাদী রাষ্ট্রগুলোই ছিল আল-কায়েদা বা সম-মনা উগ্র ইসলামপন্থী শাসিত ত্রাসপূর্ণ রাষ্ট্রগুলোর কাছাকাছি (যেমন তালেবানী আফগানিস্তান ও আল-কায়েদাপন্থী আল-শাবাব শাসিত সোমালিয়ার অংশবিশেষ)।”

আমার বাংলাদেশ ছেড়ে কোথায়ও যাওয়া প্রসঙ্গে লেখক আলমগীর হুসেন যেভাবে মন্তব্য করেছেন তাতে তার চিন্তার ধরণ সহজে বেরিয়ে আসে। তাঁর কাছে আমেরিকা আর আল কায়েদা শাসিত দেশ ছাড়া পৃথিবীতে আর কোনও ধরণের দেশ নাই। বেশ ভালই বিচার-বুদ্ধি! তাঁর এ মন্তব্য কি ক্রোধের কথা হয়ে গেল না? অবশ্য আল-কায়েদা সংগঠন দ্বারা শাসিত না হলেও আমেরিকার ঘনিষ্ঠ মিত্র সউদী আরব যে চরিত্র বিচারে আল কায়েদা শাসিত রাষ্ট্র থেকে বিশেষ ভিন্ন নয় সে কথা সবার জানা। লেখক আলমগীর হুসেন না হয় আমেরিকা ছেড়ে সউদী আরবে যাবার কথা ভাবতে পারেন। কিন্তু আমরা এভাবে যাবার কথা ভাবব কেন? নিজের মত করে সবাইকে ভাবাটা যে ঠিক নয় সেটা তাঁর বুঝা উচিত।

আর “বৃহত্তর বাংলাদেশী জনতা” “আমেরিকায় পাড়ি জমাবার চেষ্টা করে” বলে লেখক যে ঢালাও মন্তব্য করেছেন সে প্রসঙ্গে বিতর্কে না গিয়ে আমি বলব যে, মানুষ বিপদের মুখে পড়ে বা জীবিকার তাগিদে অর্থাৎ জীবনের প্রয়োজনে যতই তার আদর্শের সংগে সমঝোতা করুক না কেন, সে তার আদর্শিক ধারণাকে মনের ভিতরে রেখে দেয়। তাই মানুষ জীবন বা জীবিকার তাগিদে কোথায় যায় তা দিয়ে তার আদর্শকে সর্বদা বিচার করা যায় না। এ প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা যায়, এককালে আমেরিকায় অভিবাসী ইউরপীয়রা যে দলে দলে ভিড় জমিয়েছিল সে কি আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানদের সামাজিক আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের সঙ্গে যোগ দিতে, নাকি তাদের উৎসাদন করে তাদের ভূমি দখল করতে?

আমাদের দেশসহ বিশ্বজুড়ে অনেক মানুষ আমেরিকা যেতে চাইলেও তারা কি রাষ্ট্র হিসাবে আমেরিকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল, বা তাকে আদর্শ মনে করে? বিশ্বব্যাপী এত আগ্রাসী ভূমিকার কারণে আমেরিকার কি কোন নৈতিক ভিত্তি আছে বিশ্বে তার আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার? বাস্তবে দেখা যায় যে, বাংলাদেশের কিছু সুবিধাভোগী রাজনীতিক বা বুদ্ধিজীবী ছাড়া আমেরিকার পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলার মত কাউকে দেখা যায় না। তারা আমেরিকার বেতনভুক কর্মচারী হিসাবে এদেশে আমেরিকার স্বার্থ ও পরিকল্পনাকে বাস্তবায়ন করার জন্য নিয়োজিত।


আর বাংলাদেশের বিশেষত মার্ক্সবাদীদের সিংহ ভাগ আমরিকায় পাড়ি দিতে চায় এই তথ্য তিনি পেলেন কোথায়? তিনি কোনও কালে আদৌ মার্ক্সবাদী হয়ে থাকলেও যদি পরবর্তী কালে মত পরিবর্তন করে থাকেন তবে সেটা তাঁর ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু তিনি তাঁর দেশ বা মতাদর্শ পরিবর্তনের ঘটনা দিয়ে সবাইকে কিংবা অধিকাংশকে তাঁর সঙ্গে এক কাতারে ফেলতে চাইছেন কেন? এ দেশের মার্ক্সবাদীদের তত্ত্ব কিংবা কর্মকাণ্ডের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে অনেক সমালোচনা থাকতে পারে, কিন্তু তাদের সিংহভাগের দেশপ্রেম কিংবা অঙ্গীকার নিয়ে যে ধরনের মন্তব্য তিনি করেছেন সেটা আমার কাছে একেবারে অজ্ঞতা অথবা বিদ্বেষ প্রসূত এবং হাস্যকর মনে হয়েছে। এ দেশের সিংহভাগ মার্ক্সবাদীদের নিজ দেশের গণমানুষের মুক্তির জন্য সংগ্রাম এবং তাদের বিরাট অংশের আত্মদানের ইতিহাসের ছিটেফোঁটাও তাঁর জানা আছে বলে মনে হয় না, অথবা সেটা স্বীকার করার জন্য যে সৎ সাহস থাকা দরকার সেটা তাঁর নাই। সুতরাং তাঁর পক্ষে এমন মন্তব্য করা সম্ভব, “সিংহভাগ বাংলাদেশী মার্ক্সিস্টরাও আমেরিকায় পাড়ি জমানোর চেষ্টা করে।” আবার বলি নিজেকে দিয়ে সবাইকে বিচার করাটা ঠিক নয়।

লেখক আলমগীর হুসেন বলেছেন, “এশিয়ায় আমেরিকার শ্রেষ্ঠ মিত্র দেশ হচ্ছে জাপান, সিংগাপুর, তাইওয়ান, দঃ কোরিয়া ইত্যাদি। এবং সে দেশগুলো এশিয়ার মুক্ততম দেশ এবং আল-কায়েদা শাসিত দেশে থেকে সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুর।”

এ কথা বলার সময় লেখক সম্ভবত এই দেশগুলোর অতীত ইতিহাসটা জানার প্রয়োজন বোধ করেন নাই। আজকের লেখক-কথিত ‘মুক্ততম’ জাপান, সিংগাপুর, তাইওয়ান, দক্ষিণ কোরিয়া ইত্যাদি রাষ্ট্রের উন্নয়নের ভিত্তিটা যে নির্মিত হয়েছিল কারও কখনও সাম্রাজ্যবাদী জঙ্গিবাদ (যেমন জাপান), কারও একটা পর্যায়ে বাস্তবে একদলীয় ও একনায়কী স্বৈরাচারী শাসন (যেমন সিংগাপুর), কারও একটা পর্যায়ে আমেরিকার অঢেল সাহায্যপুষ্ট একদলীয় স্বৈরতন্ত্র (যেমন তাইওয়ান), কারও একটা পর্যায়ে আমেরিকার অঢেল সাহায্যপুষ্ট সামরিক স্বৈরতন্ত্র (যেমন দক্ষিণ কোরিয়া)-এর মধ্য দিয়ে এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে আর যাই হোক সত্যনিষ্ঠার পরিচয় দেওয়া যায় না।

লেখক আরও লিখেছেন, “তবে বহির্দেশীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, শিক্ষাগত ও বৈজ্ঞানিক ধারা যদি গ্রহণ করতেই হয়, তাহলে আমাদের উচিত সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা, যা অধিক সুফল এনেছে মানবজাতির কল্যানে। শিক্ষায় ও বিজ্ঞানে পাশ্চাত্য ধারার বাইরে আমরা বাংগালীরা কিছু দাঁড় করাতে পারব কিনা, সে ব্যাপারের আমি সন্দিহান। রাজনীতিতে ইসলামতন্ত্র নিঃসন্দেহে আমার জাতীয় কল্যানে সহায়ক হবে না। কাজেই পুজিবাদী উদার গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র – এ দু’টো সমাজতত্ত্বের মাঝ থেকে একটাকে চয়ন করতে হবে আমাদেরকে।”

এ প্রসঙ্গে আমার বক্তব্য হচ্ছে আমরা কেন মনে করব যে, পুঁজিবাদী উদার গণতন্ত্র আর সমাজতন্ত্র ছাড়া অন্য কোন পদ্ধতি সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনার দর্শন হতে পারে না? বর্তমান পৃথিবীতে লেখক বর্ণিত ‘পুঁজিবাদী উদার গণতন্ত্র’ আর ‘সমাজতন্ত্র’ ছাড়া কি আর কোন পদ্ধতি প্রচলিত নাই? পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, যেমন ফ্রান্স, জার্মানী, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, ইত্যাদি কি প্রচলিত অর্থে ‘পুঁজিবাদী’, সেখানে কি সমাজতন্ত্রের উপাদান নাই? আসলে জনকল্যাণবাদী রাষ্ট্রের ধারণাই তো পশ্চিম ইউরোপ গত শতাব্দীতে নিয়েছিল সমাজতন্ত্রকে মোকাবিলা করার জন্য, যেখানে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রের ভিতর বৃহত্তর জনগণের কল্যাণের জন্য বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ যেমন ছিল তেমনি সেখানে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণও ছিল। কাজেই এই সমাজগুলো উদার গণতন্ত্রী হলেও প্রচলিত অর্থে পুঁজিবাদী নয়। ১৯১৭ খ্রীষ্টাব্দে সোভিয়েত ইউনিয়নে সফল সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবার পর সমাজতন্ত্রকে ঠেকানোর প্রয়োজন থেকে পশ্চিম ইউরোপ নিজ নিজ দেশে রাষ্ট্রীয় পৃষ্টপোষকতায় জনকল্যাণমূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এতে ‌ঐসকল রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা করলেও প্রচলিত পুঁজিবাদী পদ্ধতি থেকে সরে যায়। কাজেই লেখকের ধারণা ঠিক না যে, ‘পুঁজিবাদী উদার গণতন্ত্র’ আর ‘সমাজতন্ত্র’ ছাড়া আর কোন পদ্ধতি নাই, যা আমরা গ্রহণ করতে পারি। তাছাড়া আমরা তো নিজস্ব পদ্ধতিও উদ্ভাবন করতে পারি যা আমাদের সমাজের প্রয়োজন পূরণ করবে। আমেরিকা বা ইউরোপ থেকে আমাদের সমস্যা ভিন্ন। কাজেই সে সমস্যাকে আমরা মোকাবিলাও করব ভিন্নভাবে আমাদের মত করে।

আমরা দেখেছি ২০০৮ সালে পুঁজিবাদী বিশ্বে যে অর্থনৈতিক মন্দার ঢেউ আছড়ে পড়ে, তাতে পুঁজিবাদী বিশ্বের অর্থনীতিতে প্রবল আঘাত লাগে। এর ফলে আমেরিকায় লেম্যান ব্রাদার্সের মত বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠান দেউলিয়া হয়ে পড়ে। আর অন্যান্য বড় আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে বড় ধরণের বিপর্যয় নেমে আসে। এই মন্দার কারণে বৃহৎ প্রতিষ্ঠান জেনারেল মটরর্সকে বাঁচাতে আমেরিকান প্রশাসন আর্থিক সহায়তা প্রদান করে, যা অনেকটাই সমাজতান্ত্রিক ধারণার সাথে খাপ খায়। বছর খানেক আগে সারা আমেরিকা জুড়ে ‘ওয়াল স্ট্রীট দখল করো’ আন্দোলন অর্থনৈতিক সংকট আর বেকারত্বের ফলেই ঘটেছিল। এই আন্দোলনের জোয়ার ইউরোপেও ছড়িয়ে যায়। এই ঘটনাগুলো প্রচলিত পুঁজিবাদী ব্যবস্থার দুর্বলতাই প্রকটভাবে প্রকাশ করছে। অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি তো আরো আগেই ধ্বসে গেছে। কাজেই ‘পুঁজিবাদী উদার গণতন্ত্র’, যা ইতিমধ্যেই আমেরিকা চর্চা করছে তা যেমন আমাদের আদর্শ হতে পারে না তেমনি সোভিয়েত সমাজতন্ত্রও আমাদের আদর্শ হতে পারে না। দুই ব্যবস্থাই ইতিমধ্যে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। তবে ব্যবস্থা হিসাবে গণতন্ত্র মানুষের ব্যক্তি স্বাধীনতা ও বিকাশের পথকে উন্মুক্ত করে দেয় বলে তা নিঃসন্দেহে গ্রহণযোগ্য। কিন্তু সেটা আমেরিকার ‘সাম্রাজ্যবাদী গণতন্ত্র’ হবে না যেটা আমেরিকা বিশ্বব্যাপী রপ্তানী করার জন্য দেশে দেশে সমাজের সৎ, দেশপ্রেমিক ও শুভ শক্তিগুলোকে ধ্বংস করে অপশক্তিগুলোকে প্রতিষ্ঠিত করছে। পাশ্চাত্যের এমন সাম্রাজ্যবাদী গণতন্ত্রের প্রয়োজন আমাদের নাই। ভবিষ্যতের উন্নততর সমাজ নির্মাণ করার লক্ষ্যে, মানুষের সর্বাধিক বিকাশ আর অমেয় শক্তির স্ফুরণ ঘটাবার জন্য নিশ্চয় গণতন্ত্রের উন্নততর কোন রূপ তৈরী করতে হবে, যা পাশ্চাত্যের প্রচলিত গণতন্ত্রের দুর্বলতা থেকে শিক্ষা নিয়ে গড়ে উঠবে। আমাদের জাতির স্বার্থ রক্ষাকারী এই গণতন্ত্র আমেরিকা এসে করে দিয়ে যাবে না, আমাদের নিজেদেরকেই লড়াইয়ের মাধ্যমে তা গড়ে তুলতে হবে।


টীকাঃ
১। গ্রন্থটির নাম লিগেসি অব অ্যাশেজ : সিআইএ'র ৬০ বছরের ইতিহাস, প্রকাশক : আলমগীর সিকদার লোটন। ঢাকা থেকে ২০১২ সালে প্রকাশিত। গ্রন্থটি Tim Weiner লিখিত Legacy of Ashes: The History of the CIA-এর অনুবাদ।
২। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় সিরাজুল ইসলাম রচিত বাংলার ইতিহাসঃ ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো, ১৭৫৭-১৮৫৭ গ্রন্থ থেকে কিছু অংশ উদ্ধৃত করা হলঃ

”…….. বাংলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতিতে দুর্ভিক্ষ বিরল নয়, কিন্তু ১৭৬৯-১৭৭০ সনের দুর্ভিক্ষ ছিল এত ব্যাপক, দীর্ঘস্থায়ী, ও ভয়ংকর যে, এর বীভৎসতা পূর্বে বা পরের অন্য কোন জানা দুর্ভিক্ষের সঙ্গে তুলনাহীন।

১৭৬৯ সনের সেপ্টেম্বর মাসে রেজা খান (কোম্পানীর পক্ষে দীউয়ানী শাসন পরিচানার জন্য নিযুক্ত ডেপুটি দীউয়ান বা নায়েব দীউয়ান)প্রথম কোম্পানীকে অবহিত করেন যে, খরার দরুন শস্যের ফলন অনেক কম। অক্টোবর-নভেম্বর মাসেও কোন বৃষ্টি হয়নি। আমন ফসল সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যায়, অথচ এ ফসলই হচ্ছে অর্থনীতির মেরুদণ্ড। ফসলহানি ও দ্রুত মূল্য বৃদ্ধিতে শঙ্কিত হয়ে সরকার সেনাবাহিনী, ইউরোপীয়ন ও কলকাতার অধিবাসীদের জন্য চাল মজুত করতে শুরু করে। সরকারী মজুত নীতি দেখে ধনীলোক, ব্যবসায়ী, ফটকাবাজ, মজুতদার সবাই যেখানে যা চাল পাওয়া যায় মজুত করতে শুরু করে। ফলে চালের মূল্য দ্রুত বাড়তে থাকে। ১৭৬৯ সনের গোড়ায় চালের বাজার-মূল্য অন্যান্য বৎসরের তুলনায় অনেক বেশী ছিল এবং সে অবস্থায়ই টাকায় চার থেকে পাঁচ মন চাল পাওয়া যেতো। এর মূল্য বৃদ্ধি পেতে পেতে বৎসরের শেষে এসে দাঁড়ায় টাকায় মাত্র আট থেকে বার সেরে। রেজা খান ও সিতাব রায় (বিহারের ডেপুটি নায়েব) এক যুক্ত স্মারকপত্রে কলকাতা কাউন্সিলকে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানান যে বাংলা ও বিহার দুর্ভিক্ষপীড়িত। দুর্ভিক্ষাবস্থায় রায়তের অবস্থা ও রাজস্ব সংগ্রহ পরিস্থিতি সম্পর্কে রেজা খান বলেনঃ “বাংলা ও বিহারের রায়তেরা দুর্ভিক্ষের ফলে এমনি দুর্বল হয়ে পড়েছে যে, রাজস্বের জন্য চাপ দিলে অর্থের জন্য পুত্রকন্যা বিক্রি করতে বাধ্য হয়। লাঙ্গল, গরু, পুত্র কন্যা বিক্রয় ক’রে রাজস্ব দিতে বাধ্য করালে এ বৎসরের রাজস্ব হয়ত সংগ্রহ করা যাবে, কিন্তু পর বৎসর রায়তদের কর্মক্ষম রাখার জন্য উচিত সুচিন্তিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা।”

উপরোক্ত হুশিয়ারী রেজা খান দেন ১৭৬৯ সনের ডিসেম্বর মাসে। ১৭৭০ সনের শুরু থেকে অনাহারে অর্ধাহারে মৃত্যু শুরু হয়। মৃত্যুর মুখেও কোম্পানী রেজা খানকে বাধ্য করে বন্দোবস্ত মাফিক রাজস্ব সংগ্রহ করার জন্য। ১৭৭০ সনের মে মাসে দুর্ভিক্ষের উপর এক মর্মান্তিক রিপোর্ট দেন রেজা খান। তিনি উল্লেখ করেন দেশে পানি নেই, চাল নেই, সব শস্য বাজার থেকে উধাও, ঘরে ঘরে হাহাকার, গ্রাম ছেড়ে ক্ষুধার্ত মানুষ খাদ্যের তালাশে গ্রহণ করছে ভবঘুরে জীবন, মৃত্যু আর মৃত্যু, খরায় চৌচির, ঘর বাড়ীতে আগুন ধরছে ঘন ঘন, পুড়ে যাচ্ছে যা খাবার সম্পদ বাকী আছে তাও। তিনি লিখেছেন আগে দৈনিক হাজার হাজার মরেছে, এখন মরছে দৈনিক লক্ষ লক্ষ। জুন মাসের (১৭৭০) ২ তারিখ রেসিডেন্ট বেচার লেখেনঃ “সারাদেশে মৃত্যুর হার হবে প্রতি ষোলজনের মধ্যে ছয় জন” এবং তিনি বলেন দেশের অনেক জায়গায় “সব কিছু খেয়ে শেষ করে এখন মানুষকে মানুষ আক্রমণ করছে ও খাচ্ছে।” ………

দুর্ভিক্ষ মোকাবেলায় সরকার, ইউরোপীয়ান ও দেশবাসীদের ভূমিকা লক্ষ্য করা দরকার। রেজা খানের সরকার ১৭৬৮ সনেই কোম্পানীকে অবশ্যম্ভাবী দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে হুশিয়ারী দেয় এবং একই সঙ্গে রায়তদের উদ্বুদ্ধ করতে চেষ্টা করে শুষ্ক মওসুমের যাবতীয় ফসল উৎপন্ন করার জন্য। দীর্ঘায়িত খরার পরিপ্রেক্ষিতে রেজা খান কোম্পানীকে অনুরোধ করেন রাজস্বদাবী কমানো ও তাকাভী ঋণ বৃদ্ধি করার জন্য। কিন্তু কোম্পানীর কর্তৃপক্ষ পূর্ববৎ রাজস্ব আদায়ে অটল থাকে। রেজা খানের উপর কোম্পানী চাপ দেয় কোম্পানীর রাজস্ব যেন না কমে তা নিশ্চিত করার জন্য। কোম্পানী এর বিনিয়োগ ও সরকারী ব্যয়ের জন্য সম্পূর্ণ নির্ভরশীল দীউয়ানীর আয়ের উপর; অতএব ক্ষুধায় মমতা দেখালে চলে না, টাকা চাই। দেখা যাচ্ছে যদিও দুর্ভিক্ষের ফলে প্রায় এক কোটি লোক মারা যায়, তথাপি কোম্পানীর রাজস্ব সংগৃহীত হয়েছে প্রায় আগের মতই। ……..” পৃষ্ঠাঃ ৬৬-৬৯।

এই দুর্ভিক্ষের ফলে বাংলার অর্থনীতি ভেংগে পড়ে এবং মোগল আমলের শেষের দিকে যে শিল্পের জন্য বাংলা বিখ্যাত ছিল তার চালিকাশক্তি দক্ষ কারিগররা মারা যাওয়ায় তা চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ বিষয়ে সিরাজুল ইসলাম লিখেছেনঃ

”রেশম ও তাঁত শিল্পে জড়িত শ্রমিকদের মধ্যে অনাহারে মৃত্যুর হার ছিল সর্বোচ্চ। উভয় শিল্পই শ্রমিকদের অভাবে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাজশাহী রেশম শিল্পে নিয়োজিত শ্রমিক ও কারিগরদের মধ্যে প্রায় অর্ধেক লোক মারা যায়। এবং জীবিতেরা এত জীর্ণশীর্ণ হয়ে পড়ে যে তাদের পক্ষে রেশম শিল্প টিকিয়ে রাখাই দায় হয়ে দাঁড়ায়। গুঁটিপোকা উৎপাদন ও রেশম বয়ন অর্ধেকেরও বেশী কমে যায়। পরিমাণই শুধু কমেনি, গুণগত ভাবেও রেশম শিল্প পূর্বের উৎকৃষ্টতা হারায়। অভিজ্ঞ ওস্তাদ কারিগরদের মৃত্যুই এর কারণ। তাঁতশিল্পের বেলায়ও একই কথা প্রযোজ্য। মৃত্যু ও পলায়নের ফলে তাঁতশিল্পে দক্ষ শ্রমের অভাব দেখা দেয়। জরিপে দেখা যায় রেশম শিল্পের ন্যায় তাঁত শিল্পেও উৎপাদক শক্তি পূর্বের তুলনায় প্রায় অর্ধেক কমে যায়।” পৃষ্ঠাঃ ৭২।

বাংলার ইতিহাসঃ ঔপনিবেশিক শাসনকাঠামো, ১৭৫৭-১৮৫৭, লেখকঃ সিরাজুল ইসলাম, প্রকাশকঃ বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৪।


৩। বাংলাপিডিয়াঃ বাংলাদেশ জাতীয় জ্ঞানকোষ, খণ্ড ৪, প্রধান সম্পাদকঃ সিরাজুল ইসলাম, প্রকাশকঃ বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০০৩, পৃষ্ঠাঃ ৩৮৪।

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ