লিখেছেনঃ ইকবাল মাহমুদ, আপডেটঃ April 26, 2009, 12:00 AM, Hits: 15206
বিশ শতকের প্রথমে ফরাসী দেশে ইমপ্রেশনিজমের আদর্শ ও রীতির বিরুদ্ধে এক প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। প্রধানত চারটি ধারায় তা প্রবাহিত হয়¬১. ফবিজম (১৯০৫), ২. ফিউচারইজম (১৯০৯), ৩. কিউবিজম (১৯০৭-১৪), ৪. এক্সপ্রেশনিজম (১৯১২-১৯১৩)। ফবিস্টরা রং কে প্রাধান্য দিতেন ¬ ফিউচারিস্টরা গতি ¬ কিউবিস্টরা গঠন এবং এক্সপ্রেশনিস্টরা বিকারকে।
মাতিস এবং কান্ডিনস্কি এক্সপ্রেশনিজম ধারার বাহক। এক্সপ্রেশনিস্ট বা প্রকাশবাদী শিল্পীরা আকার, আকৃতি ও বর্ণকে অনুভূতি প্রকাশের বাহন বলে মনে করতেন। যার ফলে প্রাকৃতিক আকার বা বর্ণকে বিকৃত করতেও তাঁরা পশ্চাৎপদ হননি। ভ্যান গগ্যাঁ-এর ‘সাইপ্রাস গাছ’ বা ‘তারকালোকিত রাত্রি’ দেখলে মনে হবে সবকিছু যেন বিশ্বজগতের ছন্দে স্পন্দমান হয়ে উঠছে। ভ্যান গঁগার ধারণা ছিল সংগীত এবং চিত্রের ধর্ম এক এবং চিত্র বর্ণের সুসংগতি (harmony); অতএব চিত্রের কোন কোনো দৃশ্য বর্ণনা বা কাহিনী বর্ণনার দরকার নেই। সুতরাং বলা যায় যে অনুভূতির আবেগময় অভিঘাত-ই এক্সপ্রেশনিজম।
আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতাবাদ (law of relativity) থেকে কিউবিজম এর জন্ম। পিকাসো, গ্রিস, ব্রাক্ প্রভৃতি চিত্রকর বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়বস্তুকে দেখে তার খণ্ড খণ্ড রূপ নতুন করে জোড়া দিতেন। তবে বিভিন্ন তলের (plane) সেই কোণ¬সমাকুল (Angular) নকশায় একটি চাবিকাঠি থাকতো যা দিয়ে সমস্ত ছবিটির অর্থ বোধগম্য হতো। যেমন¬ গ্রিসের Chess Board) | আবার সেজান চেয়েছিলেন চিত্রের মধ্যে একটা স্থাপত্যসুলভ ঘনত্ব প্রকাশ করতে। এভাবে ক্রমে ক্রমে কিউবিজম এর জন্ম হলো।
ফিউচারইজম বা বাস্তুবাদীরা সবসময় যথার্থ বর্ণনার উপর নির্ভর করতেন এবং করে থাকেন। তাঁরা যা দেখতেন ঠিক সেইভাবে বর্ণনায় টেনে আনতেন। কোন মিথ্যে বা চিত্রকল্পের আশ্রয় নিতেন না।
ফবিজম বা ইমপ্রেশনস্টি যারা তাঁরা সবসময় আলোছায়া নিয়ে খেলা খেলতেন। আলোছায়া নিয়ে খেলতে খেলতে তাঁরা এমন বলয়ের মধ্যে প্রবেশ করতেন যে বলয়ের সঠিক অর্থ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে পড়তো। ইমপ্রেশনিস্টরা সবসময় রংকে প্রধান্য দিতেন। অর্থাৎ ছাঁয়াবাজির খেলা খেলতে ইমপ্রেশনিস্টদের মতো আর কারো জুড়ি নেই।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় বিভিন্ন জাতির দেশান্তরী একদল তরুণ জুরিখে ‘ডাডাবাদ’ আন্দোলন শুরু করেন। ‘ডাডা’ হলো ফরাসি শব্দ। এর অর্থ হলো ‘কাঠের খেলনা ঘোড়া’। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে শিল্প ও সাহিত্যের প্রচলিত সব রীতি, বিষয় ও ভাবনাকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের কষাঘাতে জর্জরিত করছেন ডাডাবাদীরা। বুর্জোয়া সমাজ ও সংস্কৃতির নির্লজ্জ নগ্নতার বিরুদ্ধে ডাডাবাদীরা যা কিছু সনাতন ও নিয়মানুগ সে সবকে তছনছ করে স্বাভাবিক প্রবৃত্তির আত্নপ্রকাশ ও অবচেতন মনের যথার্থ উন্মোচনে বিশ্বাসী হন। শুধু তাই নয়, ডাডাবাদ ছিল ধ্বংসাত্নক; সবকিছুর বিরুদ্ধে। সুররিয়ালিজম, রিয়ালিজম ও ইমপ্রেশনিজম তথা সমস্ত পুরনো ধ্যান-ধারণা-রীতির বিরুদ্ধ। শুরুতে ডাডাবাদ ছিল এরকম-Dada was against everything (including Dada) and had been composed in unequal proportions of an understandable disgust with world conditions, boredom and the desire of individuals for self advertisement.
তবে তাঁরা দাঁড়াতে চেয়েছে ফন্সয়েডীয় অবচেতন মনের তত্ত্বের ভিত্তিতে। ফন্সয়েড কথিত মানুষের মনের (Super-Ego) বিচার বুদ্ধি দিয়ে জীবনের সমস্যার সমাধান করে। আবার ফন্সয়েড বর্ণিত মানব মন (ID) হলো অবচেতন মানস, যা স্বত:স্ফূর্ত হলেও নানা অসঙ্গতিতে পূর্ণ। একে রূপায়িত করতে হলে কবিকে যুক্তি ও শৃংখলাযুক্ত একটা স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয়। যেহেতু মনের তিন চর্তুথাংশই অবচেতন, সুতরাং সুর রিয়ালিস্টরা চেতন এক চতুর্থাংশের বদলে অবচেতন তিন চতুর্থাংশ থেকে কবিতার উপাদান সন্ধানী হন। অর্থাৎ চেতন মনের খোলস ছেড়ে অবচেতন জগতের এলোমেলো ছবি ও কল্পনা করতে হয়। এ প্রক্রিয়াকে টমাস ডিলানের ভাষায় বলা যায় : One method the surrealists used in their poetry was to juxtapose words and images that had no rational relationship; and out of this they hoped to achieve a kind of subconscious or dream, poetry that would be timer to the real imaginative world of the mind, mostly submerged, than is the poetry of the conscious mind, which relies upon the rational and logical relationship of ideas, objects and images.
১৯২২ সালে ডাডাবাদী আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটলে আন্দ্রে ব্রেঁত ও আরাগঁ-এর নেতৃত্বে কয়েকজন ফরাসি লেখক ডাডাবাদ থেকে বেরিয়ে এসে প্রতিষ্ঠা করেন সুররিয়ালিজম বা পরাবাস্তববাদ। ডাডাবাদকে প্যারিসে আনেন ত্রিস্তান জারা। জারাকে বাদ দেবার পর বিশের দশকে ফরাসী সুররিয়ালিজমের সুনির্দিষ্ট রূপ দাঁড়ায় এরকম-Pure psychic automatism by means of which it is proposed to express, either verbally, in writing, or in any other ways, the real process of thought - in the absence of all control exercised by reason and outside all aesthetic or moral considerations.[1]
মূলত ফন্সয়েডীয় মনোবিজ্ঞান থেকেই সুর রিয়ালিজম এর জন্ম। সুররিয়ালিজম শুধু চিত্রকলাতে নয়, শিল্পকলায় শিল্পীদের সামনে অবচেতন জগতের সমস্ত দ্বার খুলে দেয়। পরবাস্তববাদীদের মতে মানুষের চৈতন্য যখন শিথিল হয়, তখন মগ্ন চৈতন্য থেকে মানব মনের শিশু সুলভ মানসিকতা ও পশুসুলভ নগ্নতা মনের রাজ্যে প্রাধান্য পায়। যুক্তি থাকলেও আবেগ-ই পরাবস্তববাদী কবির প্রতীক ও চিত্রকল্পসমূহের যোগসূত্র। অনুষঙ্গ ও ইঙ্গিতের সাহায্যে তৈরী হয় সুররিয়ালিস্ট কবির আবহ। সালভাদর দালি, চিত্রশিল্পী পল ক্লে, পল এলুয়ার, বে্রঁত, আরাগঁ এরা প্রত্যেকই সুররিয়ালিস্ট ছিলেন।
ম্যাক্স্র আর্নেস্টের মতে, “সুর রিয়ালিস্টের লক্ষ্য অবচেতনার বাস্তব চিত্র আঁকা নয় কিংবা অবচেতনার বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে কল্পনার একটি পৃথক জগৎ সৃষ্টিও নয়। তাঁর লক্ষ্য হলো চেতন ও অবচেতন, অন্তর ও বহির্জগতের মধ্যে সমস্ত দৈহিক ও মানসিক বেড়া ভেঙে দেয়া:”
'…and to create a super-reality in which real and unreal meditation and action, meet and mingle and dominate the whole life. (Marks Arnest - Op. Cit. PP-237-38)
১৯১৭ খ্রি: কবি গীয়ম আপলোনীয়র 'Surrrealist’ শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন বাস্তবের সীমা অতিক্রম করার প্রয়াস বোঝাতে। “যুক্তির অনুশাসনের বাইরে মানুষের মনে যে এক মগ্নচৈতন্যের অতিবাস্তব জগৎ আছে; সেখানে ডুব দিয়ে তার অতলস্পর্শী রহস্যকে উন্মোচন করাই সুররিয়ালিজমের কাজ।” সাহিত্যিক অভিধানে সুররিয়ালিজম এর যে সংজ্ঞা মেলে তা এ রকম :
A movement in the 20th century literature and art which attempts to express and exhibit the workings of the sub-concious mind especially as manifested in dreams and uncontrolled by reason or any conscious prices, characterized by the incongruous and startling arrangement and presentation of subject matter. (Standard Literary Dictionary)
উপরোক্ত সংজ্ঞাটি ভালোভাবে বিশ্লেষণ করলে, ডাডাবাদের ভিতরেই যে সুররিয়ালিজমের বীজ লুকিয়ে ছিল তা পরিষ্কার হয়ে ওঠে। সুররিয়ালিস্ট কবিরা জেগে জেগে দিবাস্বপ্ন দেখেন। অবচেতন মনে বিশেষ করে স্বপ্নে তাঁরা এমন এক জগতে চলে যান, যখন বাস্তব জীবনের যুক্তি পরম্পরা শিথিল হয়ে পড়ে। যখন তাঁরা ঘুমোন তখন প্রতীক এবং অদ্ভূত কল্পনার রাজ্যে চলে যান। চলে যান অতি বাস্তবে। মগ্নচৈতন্যের গভীরে। এ মগ্নচৈতন্য স্বভাবতই ফন্সয়েডের মনস্ততত্ত্বের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। হাবার্ট রীডের ভাষায়:
`The artist, whether poet or mystic or painter, does not seek a symbol for what is clear to the understanding and capable of discursive exposition: he realize that life, especially the mental life, exists on two planes, one definite and visible in outline and detail, the other-perhaps the greater part of life - submerged, vague, indeterminate. A human being drifts through time like iceberg, only partly floating above the level of the consciousness. It is the aim of the Surrealist, whether as painter or as poet, to try and realize some of the dimensions and characteristics of his submerged being, and to do this he resorts to various kinds of symbolism. (Herbert Read, The Meanings of Art, P-233)
হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর বৌদ্ধগান ও দোহা, দীনেশচন্দ্র সেনের মৈমনসিংহ গীতিকা, বৈষäব পদাবলী, পুঁথি-পাঁচালী-সংস্কৃত পণ্ডিতদের দণ্ডী-কুন্তক রীতিনীতি থেকে পার হয়ে মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা ভাষা ঋদ্ধ হবার পর হঠাৎ করেই যেন ইউরোপ থেকে আসা নতুন চিন্তা বাংলাভাষাকে পেয়ে বসে। রবীন্দ্রত্তোরকালে আচমকাই যেন ঘুরে গেল ভাবনার চাকা। বিশেষ করে কবিতায়। একদল কবি ইউরোপীয় মুগ্ধতায় ভুলতে বসলেন নিজেদের শিকড়-বাকর অন্যদল আঁকড়ে ধরে পড়ে রইলেন দণ্ডী-কুন্তক প্রাচীনতাকে। আর জীবনানন্দ দু’টোর মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রাচীন পুঁথি পালা, পাঁচালির বিস্ময়কর প্রকাশ ঘটালেন ইউরোপ থেকে মাল-মশলা সংগ্রহ করে একেবারে খাঁটি বাংলার রূপ-রস-গন্ধ মিশিয়ে। নগর বিমুখ কবি যেন হারানো বাংলার প্রত্নসম্পদকেই চিত্রকল্পের বর্ণনায় ফিরিয়ে আনতে চাইলেন কবিতায়। স্বত:স্ফূর্ত আধুনিক থেকে উত্তর আধুনিকতায়। ভারতচন্দ্রের পরে বাংলা কাব্যে মধুসূদন এবং রবীন্দ্রনাথই একমাত্র আধুনিক কবি। মধুসূদন দত্ত ও রবীন্দ্রনাথের পরে বাংলা কাব্য নিয়ে যিনি রীতিমতো গবেষণা করেছেন তিনি জীবনানন্দ দাশ। তিনি শুধু আধুনিক নন, আজকের যে উত্তরআধুনিক কবিতার কথা আমরা বলছি তার বীজ বাংলা কবিতায় তিনিই প্রথম পুঁতে গেছেন। এমনকি আধুনিক এবং উত্তর কবিদের মধ্যে তিনিই অন্যতম। বিশ্ব কবিতায়ও তাঁর কবিতা এক উজ্জ্বল আসন দখল করে আছে। গটফন্সীড বেন-এর মতে, বিশ্ব কবিতার যদি তালিকা করা যায় তবে বড় বড় কবিদের কাছ থেকে সব শুদ্ধ পাঁচটি শ্রেষ্ঠ কবিতার আশা করা যায়। জীবনানন্দ সেখানে একাধারে উৎকীর্ণ করে গেছেন পঞ্চাশটি কবিতা; এমনকি তার চেয়েও বেশি। যা শেলী, কীটস তো দূরে থাক, রবীন্দ্রনাথকেও ছাড়িয়ে গেছে। যাইহোক, রবীন্দ্রনাথ এর যুগ থেকে বের হয়ে নতুন এক পথে পা বাড়াবার তাগিদ জীবনানন্দের ছিল এবং তা ‘ঝরা পালক’-এর পর থেকে। ‘ঝরা পালক’-এ যেমন দেখি রবীন্দ্র, নজরুল, সত্যেন্দ্রনাথ, মোহিতলাল মজুমদারের ছাপ তেমনি তাঁর পরবর্তী কালের কাব্যগ্রন্থে একান্ত নিজস্বতা, স্বকীয়তা ছাড়া আর কিছু দেখি না। তবে সেটা রাবীন্দ্রিক ঐতিহ্য, ভাবাবেগকে অস্বীকার করে নয়, রীতিমতো গ্রহণ করেই। রবীন্দ্রনাথ থেকে বের হয়ে সমাজ বাস্তবতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে মিশে কাব্যকে শেষ পর্যন্ত এক নতুন পথ দেখাতে তিনি পেরেছিলেন। রবীন্দ্রনাথকে যদি আধুনিক কবি বলি তবে জীবনানন্দ হলেন আধুনিকদের অন্যতম এবং উত্তর আধুনিক কবিদের প্রথম উত্তসূরি।
আধুনিক কবিতার বৈশিষ্ট্য ছিলো প্রতীকধর্মিতা। আধুনিকতা থেকেই উত্তরআধুনিকতার জন্ম। আধুনিক কবিতার ভাষা, শব্দ, বিন্যাস প্রকরণ এমন এক জায়গায় অগ্রসর হচ্ছিল যে তা সাধারণ পাঠকের কাছে ক্রমেই দুর্বোধ্য মনে হচ্ছিল। জীবনানন্দ আধুনিকতাকে উপেক্ষা করে নয় বরং গ্রহণ করে ক্রমেই উন্নীত হচ্ছিলেন উত্তরআধুনিকতার দিকে। তিনি বাংলা কাব্যকে আধুনিক কবি পাউন্ড, এলিয়ট, ইয়েটসীয় পশ্চিমা আদলের বায়বীয় কাঠামোর শৃংখলমুক্ত করে বোদলেয়ারীয় নীতি ও বিবমিষা বিমুক্ত করে প্রতীকী রূপ বর্ণনায় ইতিহাস চেতনাকে ধারণ করে নিয়ে গেছেন বাংলার সূদর মাঠ, ঘাট, জনপদ, মানুষের হৃদয়ের গহীন গোপন কুঠুরিতে। আর এজন্যই তাঁর কবিতা কখনো মেকী হয়ে ওঠেনি ¬ পাশাপাশি আধুনিকতা থেকে ক্রমেই অগ্রসর হয়েছে উত্তরআধুনিকতায় - সুররিয়ালিজমে। প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক উত্তরআধুনিকতা কি? বা উত্তর আধুনিকতা অর্থে কি বোঝায়? উত্তরআধুনিকতার নির্দিষ্ট সংজ্ঞা দাঁড় করানো কঠিন, এবং নেইও। তবে সাহিত্য বিচারে উত্তরআধুনিকতাকে যদি একটি প্রসূতিধারা হিসেবে গ্রহণ করি যার এক প্রান্তে থাকবে একটিমাত্র চারিত্রলক্ষণ আর যতোই সে অগ্রসর হবে সামনের দিকে বা অন্যপ্রান্তমুখী ততই বাড়তে থাকবে লক্ষণ সংখ্যা ও নিবিড়তা। শিহাব হাসান উত্তরআধুনিকতার তুলনামূলক লক্ষণসমূহ সূত্রাবদ্ধ করেছেন নিন্মোক্তভাবে-
আধুনিকতা উত্তর আধুনিকতা
রোমান্টিসিজম/প্রতীকধর্মিতা প্যাটাফিজিক্স/ডাডাইজম
ফর্ম (কাঠামোর চক্রাবদ্ধতা) এ্যান্টিফর্ম (চক্রহীনতা, উন্মুক্ত)
উদ্দেশ্য নির্ভরতা ক্রীড়াময়তা
শ্রেণীলগ্নতা নৈরাজ্য
যুক্তির শাসন নিস্পন্দন, নীরবতা
ফলাফলপ্রধান, শিল্প সৃষ্টি প্রক্রিয়াপ্রধান
দূরত্ব অংশগ্রহণ
সৃজন/সমগ্রায়ন অবিনর্মাণ/বিনির্মাণ
সমন্বয় বিরোধাভাস
উপস্খিতি অনুপস্খিতি
প্রকরণ/সীমা বয়ান/অন্তর্বয়ান
নির্বাচন একত্রায়ন
ব্যাখা/পাঠ অ-ব্যাখা/ভুলপাঠ
দ্যোতিত দ্যোতক
লক্ষণ বাসনা
প্যারানইয়া সিজোফেন্সনিয়া
পিতা, ইশ্বর পবিত্র ভূত
অধিবিদ্যা আয়রনি
সিদ্ধান্ত, মীমাংসা অমীমাংসা
(জীবনানন্দ দাশ - মূল্যায়ন ও পাঠোদ্ধার - পৃথম প্রকাশ - আবু হাসান শাহরিয়ার - পৃষ্ঠা- ১৩২-১৩৩)
উপরোক্ত তুলনামূলক সূত্র থেকে উত্তরআধুনিকতার যে ধারণা পাওয়া যায় তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় জীবনানন্দ দাশের প্রথমদিককার কবিতায় রোম্যান্টিক আবহ তথা আধুনিকতার ছাপ স্পষ্ট। সময় যতই গড়াচ্ছিল ততই তিনি রোম্যান্টিকতা থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন। আধুনিকতার একরৈখিক বদ্ধকাঠামোর ঘেরাটোপ ভেঙ্গে ক্রমেই অগ্রসর হচ্ছিলেন বহুরৈখিকতায় তথা উত্তরআধুনিকতায় এবং হয়েছেনও।
আধুনিক জীবনে মানুষ এক জটিল ধাঁধাঁয় বিপর্যস্ত। শাণিত শাপের মতো অন্ধকার মানুষের জীবনকে দিন দিন গ্রাস করছে। ফলে পৃথিবীর লোকসানী বাজারে মানুষ দিন দিন হয়ে উঠছে হাঙর। তার ভিতরের মানবীয় সত্তা তথা বিস্ময় বোধ আর থাকছে না। বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষ শুধু অর্থনৈতিকভাবে রোগাক্রান্ত হয়নি তার ভিতরের সাবলীল প্রবাহিত ঝর্ণার মতো হৃদয় বসন্ত হলুদ পাতার মতো হয়েছে বিবর্ণ। নি:সঙ্গ নির্জন বনে সে এক প্রেমহীন মানব, সুষমাহীন মানুষ। জীবনের প্রবহমান অস্তিত্বের দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখা যায় মানুষের জীবনের গভীরে সুন্দর চেতনা, ঐক্যবদ্ধ জীবনচেতন নেই আর। তার বদলে হিংস্রতা, লোভ ভয়ঙকর দানব থেকেও সে হয়ে উঠছে আরো বেশি ছন্দ,স্পন্দহীন হাঙর শরীর। প্রস্তর যুগ থেকে আধুনিক যুগ সেই সাথে বিশ্বযুদ্ধ এবং রেনেসাঁসের ফলে নিয়তই পরিবর্তিত হয়ে গেছে মানুষ। গ্রাম থেকে শহরে কাজের সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছে মানুষ। আধুনিকতার ফলে শহর সভ্যতার দাঁত যতো উজ্জ্বল হয়েছে, ঝকমকে হয়েছে মানুষের জীবন ততোই হারিয়ে গেছে দিকনির্দেশনাহীন পথে। স্বভাব সৌন্দর্য থেকে চ্যুত মানুষ হারিয়ে ফেলেছে তাদের পূর্বপুরুষদের পরিতৃপ্ত বিবেক। জীবনের লিপ্ত অভিধান থেকে তারা সরে এসে এখন প্রত্যেকেই প্রত্যেকের বিপরীত, সক্রিয় প্রতিনিধি। জীবনানন্দ সেই সব মানুষের, সময়ের সমগ্রতা ফিউচারইজম দৃষ্টিভঙ্গিতে নিপুণ রেখার টানে তুলে এনে নিবিড় নরমভাবে প্রকাশ ঘটিয়েছেন তাঁর কবিতায়। অনেকটা প্রতীকী ঢঙে। নিষ্টুর জীবনের সমগ্রতা, সময়কে যে এভাবে কবিতায় তুলে আনা যায় বা আধুনিক ও উত্তরআধুনিক বাংলা কবিতায় উত্তরণ ঘটানো সম্ভব তা ছিল প্রশ্নাতীত। অথচ তিনি সেই কাজটিই করেছেন ব্রাতীয় ভঙ্গিতে। তাঁর ‘বিড়াল’ কবিতায় আমরা যেমন জীবন-মরণের গল্প বিড়ালের ঘুরে ফেরার মধ্যে দিয়ে প্রতীকী বর্ণনায় দেখতে পাই ঠিক তেমনি ‘পথের কিনারে’ কবিতায় মানব জীবনের শেষ আকুতি তথা ইচ্ছা ভেসে ওঠে অত্যন্ত প্রখরভাবে। যেমন:
পথের কিনারে দেখলাম একটা বিড়াল পড়ে আছে,
আস্তে-আস্তে ছটফট ক’রে ম’ের যাচ্ছে;
কেন এই মৃত্যু?¬ বরং অল্প বয়সের এই প্রাণীটির?
একে ঘিরে কোনো জনতা নেই
খানিকটা কলরব নেই এর মৃত্যুকে আস্তে-আস্তে
ভালোবেসে তারিয়ে দেবার জন্য
বিড়ালটা তার শরীরের সমস্ত শাদা কালো রঙ দিয়ে
মুহূর্তের জন্য আমার মনের ভেতর চিন্তা হ’য়ে এলো
তার নির্জন অদ্ভূত শরীরের সমস্ত শাদা কালো রঙ নিয়ে
আমার কবিতার ভেতর এলো;
বললে, এর চেয়ে অসাধারণ দাবি কোনোদিন করবো না আমি আর।
(পথের কিনারে - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
সুররিয়ালিস্ট কবিরা যেমন রঙ, আলো ও ছায়া নিয়ে ছায়াবাজির খেলা খেলে থাকেন জীবনানন্দও ঠিক তেমনি এ কবিতায় শাদা, কালো রঙকে তুলে এনেছেন কবিতায়। একবার বেড়াল, একবার মানুষ তথা নিজে আবার বেড়াল। বাস্তব থেকে পরাবস্তব, পরাবাস্তব থেকে বাস্তবে ফিরে এসে বিড়াল হয়ে প্রতিবাদ করে গেছেন পৃথিবীকে। অথবা তাঁর অনুপম ত্রিবেদী কবিতার দিকে তাকালে আমার দেখতে পাই ইতিহাসের মধ্য দিয়ে তিনি সময়ের কথা বলে গেছেন কত অবলীলায়। যেমন:
এখন শীতের রাতে অনুপম ত্রিবেদীর মুখ জেগে ওঠে।
যদিও সেই নেই আজ পৃথিবীর বড়ো গোল পেটের ভিতরে
সশরীরে; টেবিলের অন্ধকারে তবু এই শীতের স্তব্ধতা
এক পৃথিবীর মৃত জীবিতের ভিড়ে সেই স্মরণীয় মানুষের কথা
হৃদয়ে জাগায়ে যায়; টেবিলে বইয়ের স্তূপ দেখে মনে হয়
যদিও প্লেটোর থেকে রবি ফন্সয়েড নিজ নিজ চিন্তার বিষয়
পরিশেষ ক’রে দিয়ে শিশিরের বালাপোশে অপরূপ শীতে
এখন ঘুমায়ে আছে ¬ তাহাদের ঘুম ভেঙে দিতে
নিজের কুলুপ এঁটে পৃথিবীতে ¬ ওই পারে মৃত্যুর তালা
ত্রিবেদী কি খোলে নাই? তান্ত্রিক উপাসনা মিস্টিক ইহুদী কাবালা
ঈশার শবোথান ¬ বোধিদ্রুমের জন্ম মরণের থেকে শুরু ক’রে
হেগেল ও মার্কস: তার ডান আর বাম কান ধ’রে
দুই দিকে টেনে নিয়ে যেতেছিলো; এমন সময়
দু’ পকেটে হাত রেখে ভ্রূকুটিল চোখে নিরাময়
জ্ঞানের চেয়েও তার ভালো লেগে গেল মাটি মানুষের প্রেম
(অনুপম ত্রিবেদী - শ্রেষ্ঠ কবিতা - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র -আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
অথবা,
এইখানে সরোজিনী শুয়ে আছে,¬ জানি না সে এইখানে শুয়ে আছে কিনা।
অনেক হয়েছে শোয়া;¬ তারপর একদিন চ’লে গেছে কোন্ রূঢ় মেঘে।
অন্ধকার শেষ হ’লে যেই স্তর জেগে ওঠে আলোর আবেগে:
সরোজিনী চ’লে গেল অতদূর? সিঁড়ি ছাড়া ¬ পাখিদের মতো পাখা বিনা?
হয়তো বা মৃত্তিকার জ্যামিতিক ঢেউ আজ? জ্যামিতির
ভূত বলে : আমি তো জানি না।
জাফরান আলোকের বিশুষ্কতা সন্ধ্যার আকাশে আছে লেগে:
লুপ্ত বেড়ালের মতো; শূন্য চাতুরীর মূঢ় হাসি নিয়ে জেগে।
(সপ্তক - সাতটি তারার তিমির - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
অথবা,
হাইড্র্যান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল:
অথবা সে হাইড্র্যান্ট হয়তো বা গিয়েছিলো ফেঁসে।
এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে।
একটি মোটর কার গাড়লের মতো গেল কেশে
(রাত্রি - সাতটি তারার তিমির - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
বাঙালীর আত্নিক অবক্ষয়কে তুলে ধরেছেন অপ্রচলিত শব্দের সঙ্গে কাব্যিক শব্দকে মিশিয়ে ¬ তিনি ভঙ্গুর সমাজের গভীর থেকে নতুন মূল্যবোধ রচনার উপাদান খুঁজেছেন ‘রাত্রি’ কবিতায়। তাঁর অন্ধকার ভুবনের দ্বারা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সাতটি তারার তিমির কাব্যগ্রন্থের অধিকাংশ কবিতা উত্তর আধুনিকতা তথা সুররিয়ালিজম এর চিহ্ন¬লক্ষণ¬বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট। যেমন- ‘হাঁস’ কবিতা :
নয়টি হাঁস রোজ চোখ মেলে ভোরে
দেখা যায় জলপাই পল্লবের মতো স্নিগ্ধ জলে;
তিনবার তিনগুণে নয় হয় পৃথিবীর পথে;
এরা তবু নয়জন মায়াবীর মতো জাদুবলে।
সে নদীর জল খুব গভীর¬গভীর;
সেইখানে শাদা মেঘ¬লঘু মেঘ এসে
তিনমানে আরো নিচে ডুবে গিয়ে তবু
যেতে পারে নাকো কোনো সময়ের শেষে
(হাঁস-সাতটি তারার তিমির - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
নয়টি অমল হাঁস শিশু প্রাণের প্রতীক, যারা নারীর কোলে আশ্রিত। খই রঙা এ নয়টি অমল হাঁস যখন জীবন নদীর মধ্যে মায়াবীর মতো জাদুবলে পৃথিবীর পথে এসে ধরা দেয় তখন তারা পৃথিবীকেই চিনে নিতে চায়। সুকান্ত যেমন পৃথিবীকে শিশুর বাসযোগ্য করে যেতে চেয়েছেন তেমনি জীবনানন্দও একান্ত একাগ্রতায় বাসযোগ্য করে যেতে চেয়েছেন শিশুর পৃথিবীকে। যে পৃথিবী নষ্ট হয়ে গেছে, নষ্ট হয়ে যাচ্ছে সে পৃথিবীকে শিশুর জন্যে বাসযোগ্য করে যাওয়া যে আমাদেরও দায়িত্ব তা তিনি সহজ-সরল শব্দের রেখায় তুলে ধরেছেন। আরাগঁ যেমন অ ই ঈ উ বর্ণ আকৃতিতে কবিতা রচনা করেছেন তেমনি জীবনানন্দও সংখ্যাতত্ত্ব দিকটি বেছে নিয়েছেন। ফন্সয়েডের দ্বিতীয় সংখ্যা হলো পবিত্র ¬ তা হলো নয়। তিন বার তিন গুণে যেমন নয়; তাই শিশুর প্রতীকী শুভ সংখ্যা। বনলতা সেন কাব্যগ্রন্থের ‘বিড়াল’ কবিতায়ও তিনি এমনি জীবনকে নিয়ে ইমপ্রেশনিস্টদের মতো আলোছায়ার খেলা খেলেছেন। যেমন :
সারাদিন একটা বিড়ালের সঙ্গে ঘুরে ফিরে কেবলি আমার দেখা হয় :
গাছের ছায়ায়, রোদের ভিতরে, বাদামী পাতার ভিড়ে;
কোথাও কয়েক টুকরো মাছের কাঁটার সফলতার পর
তারপর শাদা মাটি কঙ্কালের ভিতর
নিজের হৃদয় নিয়ে মৌমাছির মতো নিমগ্ন হয়ে আছে দেখি;
কিন্তু তবুও তারপর কৃষäচূড়ার গায়ে নখ আঁচড়াচ্ছে,
একবার তাকে দেখা যায়,
একবার হারিয়ে যায় কোথায়।
হেমন্তের সন্ধ্যায় জাফরান রঙের সূর্যের নরম শরীরে
শাদা থাবা বুলিয়ে বুলিয়ে খেলা করতে দেখলাম তাকে;
তারপর অন্ধকারকে ছোটো ছোটো বলের মতো থাবা দিয়ে লুফে আনল সে
সমস্ত পৃথিবীর ভিতর ছড়িয়ে দিল।
(বিড়াল - বনলতা সেন - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
এই বিড়াল কে? কবি নিজে নয় কি? বিড়ালকে এখানে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে মাত্র। সারাদিন গাছের ছায়ায় রোদের মধ্যে যে বিড়াল খেলা করে সে কবির অন্তরাত্না। গাছের ছায়ায় রোদের ভিতর যে বিড়াল মাছের কাঁটা খোঁজে সে কবি নিজে। কবি পৃথিবীর পথে এসে পৃথিবীর হারানো সব বিষয়-আশয় নিত্য খুঁজে ফিরেন। রৌদ্্রগন্ধ গাছের নীচে বিড়ালের যে জীবনযুদ্ধ তা মানুষের চিরন্তন জীবনসংগ্রাম। আবার পৃথিবীর পথে এসে মানুষ যে সভ্যতা খুঁজে ফিরে সেই সভ্যতা সে নিজেই বিড়ালের মতো গাছের গায়ে নখ আঁচড়ে ভাঙে¬ধ্বংস করে। পাশাপাশি ‘নাবিক’ কবিতায় তিনি মানুষের ভুলের বুননে পৃথিবীর ইতিহাস যে ধ্বংস হয়ে গেছে, মানুষ দখলদারিত্বের ক্রোধে যে শুধু ভুল করেই চলেছে তারই বর্ণনা উঠে এসেছে অকপটভাবে।
জীবনানন্দের এ যে বিস্ময়কর কাব্যভাষা "ভাষার গঠনতন্ত্র ¬ ইন্দ্রজাল যা কাব্যভাষার সর্বাত্নক সার্থকতার একটি সূত্র। বোদলোয়ার এমন এক গদ্যাশ্রিত কাব্যভাষার কথা বলেছিলেন যাতে সঠিকভাবে ফুটিয়ে তোলা যাবে "...the lyrical stirring of the soul, the wave motions of dreaming, the shocks of conciousnes."
জীবনানন্দের কাব্যভাষায় বোদলেয়ারীয় ভাষাসূত্রের এই তিনটি সূত্রই আশ্চর্যজনকভাবে সফল হয়েছিল। তাঁর কবিতায় শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বহুরৈখিকতার মধ্য দিয়ে lyrical stirring of the soul অভ্রান্তভাবে শুনতে পাই। বহু বিতর্কিত মগ্ন¬মন্থর গতির অন্তরালে ক্রিয়াশীল wave motions of dreaming-কেই আমরা সহজে অনুধাবন করতে পারি। যে আধুনিকতার কথা আমরা বলি, আধুনিকতার বোধের উৎসমূলে যে নগর সভ্যতার shocks of conciousnes, জীবনানন্দের শেষের দিকের কাব্যে বিশেষ করে সাতটি তারার তিমির-এ ছত্রে ছত্রে বিন্যস্ত হয়েছে।
জীবনানন্দ সারাজীবন সত্যকে অনুসন্ধান করেছেন ইতিহাস চেতনার মধ্যে, ইতিহাস খুঁড়লেই রাশি রাশি জলরাশির মধ্য দিয়ে। সমাজ চেতনা এমনকি মগ্নচৈতন্যের গভীরতা দিয়ে। জীবনানন্দ বুঝতে পেরেছিলেন রোম্যান্টিসিজমের যুগ শেষ হচ্ছে ¬ আসছে রিয়ালিজম। রিয়ালিজম-এর মধ্য দিয়েই অনুসন্ধান করতে হবে চারপাশ, মানুষ, সভ্যতা, জীবন, জগৎ এমনকি পৃথিবীর যাবতীয় বিষয়-আশয়। তাই তিনি রবীন্দ্রনাথ থেকে দূরে সরে এসেছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন রবীন্দ্রনাথের যুগ শেষ। এখন যা কিছু করতে হবে তা রিয়ালিজমের ধ্বংসস্তূপের মধ্য দিয়ে তীক্ষîবোধের উপলব্ধি দ্বারা সুররিয়ালিজম তথা অতিবাস্তবচেতনায়। তাঁর ‘হরিণেরা’, ‘অবশেষে’ কবিতা এর উজ্জ্বল উদাহরণ। যেমন :
স্বপ্নের ভিতরে বুঝি ¬ ফাল্গুনের জ্যোৎস্নার ভিতরে
দেখিলাম পলাশের বনে খেলা করে
হরিণেরা; রূপালি চাঁদের হাত শিশিরে পাতায়;
বাতাস ঝড়িতেছে ডানা ¬ মুক্তা ঝরে যায়
পল্লবের ফাঁকে ফাঁকে ¬ বনে বনে ¬ হরিণের চোখে;
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর মুক্তোর আলোকে।
হিরের প্রদীপ জ্বেলে শেফালিকা বোস যেন হাসে
হিজল ডালের পিছে অগণন বনের আকাশে,¬
বিলুপ্ত ধূসর কোন পৃথিবীর শেফালিকা, আহা,
ফাল্গুনের জ্যোৎস্নায় হরিণেরা জানে শুধু তাহা।
বাতাস ঝড়িতেছে ডানা, হীরা ঝরে হরিণের চোখে¬
হরিণেরা খেলা করে হাওয়া আর হীরার আলোকে।
(হরিণেরা - বনলতা সেন - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
এ কবিতায় গাছেরা একবার হরিণী হয় আবার বাঘিনী। হরিণেরা কবিতায় প্রতীকী হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে। বাস্তব পৃথিবীর নয়। সুররিয়ালিজম অনুযায়ী এ হলো Fantasy । কিংবা ‘যেইসব শেয়ালেরা’ কবিতা । যেমন:
যেইসব শেয়ালেরা ¬ জন্ম জন্ম শিকারের তরে
দিনের বিশ্রুত আলো নিভে গেলে পাহাড়ের বনের ভিতরে
নীরবে প্রবেশ করে, বার হয়, ¬ চেয়ে দেখে বরফের রাশি
জ্যোৎস্নায় প’ড়ে আছে; ¬উঠিতে পারিত যদি সহসা প্রকাশি
সেইসব হৃদযন্ত্র মানবের মতো আত্নায়:
তাহ’লে তাদের মনে যেই এক বিদীর্ণ বিস্ময়
জন্ম নিতো;¬ সহসা তোমাকে দেখে জীবনের পারে
আমারো নিরভিসন্ধি কেঁপে ওঠে স্নায়ুর আঁধারে।
(যেইসব শেয়ালেরা - সাতটি তারার তিমির - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
এ কবিতার অবোধ্য হেঁয়ালি আবৃত করে আছে। রাত্রি পাহাড়, বন, জ্যোৎস্না এসব আমাদের মনকে এক কুয়াশার শরীরের মধ্যে নিয়ে যায় ¬ নিয়ে যায় স্বপ্নালোকে। শেয়ালেরা এখানে হতমান পঙ্গু মানুষের প্রতীক। যাঁরা শিকারের খোঁজে নিশ্ছিদ্র তারার পথে মৃত জ্যোৎস্নার বীভৎসতায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। এইসব শেয়ালেরা যদি কোনদিন মানুষের জীবন পেত ¬ মানুষের আত্নায় ফুটে উঠতে পারতো তাহলে তারাও মানুষের মতো প্রেমের আনন্দ উপভোগ করতে পারতো ¬ সৌন্দর্য দেখতে পেতো ¬ উপলব্ধি করতে পারতো।
আমাদের পৃথিবীতে যেমন মানুষ আছে; মানুষের সাথে আরো অনেক জীবজন্তু আছে। মানুষের সাথে মানব অস্তিত্বের অবিরাম গতি ও ধাবমানতার পাশে রয়েছে এমন কিছু জীবজন্তু যাদের অস্তিত্বকে আমরা প্রতিনিয়ত লক্ষ্য করতে বাধ্য হচ্ছি এবং করছি। আত্ম অতিক্রমণের জন্যে এইসব জীবজন্তুর একটা বড় ভূমিকা রয়েছে। কারণ জীবজন্তু দেখতে দেখতে মানুষের সুপ্ত সত্তার জাগরণ ঘটে। নানাধরনের জীবজন্তু ও ইতর শ্রেণীর প্রাণী দেখতে দেখতে যেমন মানুষের মধ্যে সুপ্ত সত্তায় বহুবিধ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় তেমনি মানুষ কখনো আতঙ্কে কখনো প্রশ্নসঙ্কুল বোধে কখনোবা অজানা ভবিষ্যতের নানা সম্ভাবনাকে স্পষ্ট করতে নিজস্ব স্বরূপ উদ্ঘাটনে ব্রতী হয়। জীবনানন্দ দাশও ঠিক তেমনি জীবজন্তুদের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন আমি সত্তার বিভিন্ন মুদ্রা, বিভিন্ন সংকট, বিভিন্ন কারুকার্য। জীবজন্তুদের সাহায্য নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে স্বপ্ন ও পরিভাষায় তিনি বাস্তব থেকে পরাবাস্তবে ও পরাবাস্তব থেকে বাস্তবে ফিরে এসেছেন। জীবজন্তুরা তাদের স্ব স্ব দেহ দিয়ে পৃথিবীর যে ঘ্রাণের পসরা সাজিয়ে রেখেছে এবং সেই ঘ্রাণ অনুভব করে জীবনানন্দ তা তুলে এনেছেন কবিতায়। যেমন ‘আজকের এক মুহূর্ত’।
বাংলার পাড়াগাঁয়ে শীতের জ্যোৎস্না আমি কতবার দেখলাম
কত বালিকাকে নিয়ে বাঘ ¬ জঙ্গলের অন্ধকারে;
কত বার হটেনটট - জুল দম্পতির প্রেমের কথাবার্তার ভিতর
আফিন্সকার সিংহকে লাফিয়ে পড়তে দেখলাম;
* * * * * * * * * * * *
যে ঘোড়ায় চ’ড়ে আমরা অতীত ঋষিদের সঙ্গে আকাশে নক্ষত্রে উড়ে যাব
সেইসব শাদা শাদা ঘোড়ার ভিড়
যেন কোন্ জ্যোৎস্নার নদীকে ঘিরে
নিস্তব্ধ হ’য়ে অপেক্ষা করছে কোথাও;
আমার হৃদয়ের ভিতর
সেই সুপক্ক রাত্রির গন্ধ পাই আমি।
(আজকের এক মুহুর্ত - মহাপৃথিবী - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
হামিদের এ ঘোড়া পরিণত হয়ে মহিনের ঘোড়ায়। সে ঘোড়া নিয়ে এসেছে যুগ যুগান্ত পূর্বের প্রস্তর-যুগের স্মৃতি। স্বপ্নে যেন বাস্তব-ই কিম্ভূত হ’য়ে দেখা দেয়; কবিতাটি তদ্রুপ। পৃথিবীর কিমাকার ডায়নামোর উপর নিওলিথ ঘোড়া যেন কবির যৌবন কামনার প্রতীক। যে যৌবন কামনা ঘোড়ার মতো, আফিন্সকার সিংহের মতো তেজোদ্দীপ্ত ছিলো, আজ তা প্রস্তরীভূত ফসিলে মতো নিষ্প্রাণ হলেও এখনও ঘাসের লোভে চরে পৃথিবীর পথে। কামনা নেই কিন্তু স্মৃতি এখনো অম্লান ¬ এখনো আকাঙক্ষা জাগায়। আবার ‘জয়জয়ন্তী সূর্য’ কবিতায় তিনি পল এলুয়ার ও লুই আরাগঁ-এর মতো সত্যের পূজারী হয়েছেন। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তাঁর উচ্চারণ সতত। সংগ্রাম দানবের বিরুদ্ধে যাবার ন্যায়শক্তি যেমন তেমিন আশায় প্রস্ফুট জীবনের আহ্বান। সাম্যবাদী কবিদের মতো তিনিও এ কবিতায় বিদ্রোহের বীজ পুঁতে দিয়ে আহ্বান করেছেন নতুন দিনের, নতুন সূর্যের। যেমন :
মহীয়ান কিছু এই শতাব্দীতে আছে, ¬আরো এসে যেতে পারে:
মহান সাগর গ্রাম নগর নিরুপম নদী ;¬
যদিও কাহারো প্রাণে আজ রাতে স্বাভাবিক মানুষের মতো ঘুম নেই,
তবু এই দ্বীপ, দেশ, ভয়, অভিসন্ধানের অন্ধকারে ঘুরে
সসাগরা পৃথিবীর আজ এই মরণের কালিমাকে ক্ষমা করা যাবে;
অনুভব করা যাবে স্মরণের পথ ধ’রে চ’লে:
কাজ ক’রে ভুল হ’লে, রক্ত হ’লে মানুষের অপরাধ মামথের নয়
কত শত রূপান্তর ভেঙে জয়জয়ন্তীর সূর্য পেতে হলে।
(জয়জয়ন্তীর সূর্য - বেলা অবেলা কালবেলা - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
কিংবা
জানো নাকো আজো কাঞ্চী বিদিশার মুখশ্রী মাছির মতো ঝরে;
সৌন্দর্য রাখিছে হাত অন্ধকার ক্ষুধার বিবরে;
গভীর নীলাভতম ইচ্ছা চেষ্টা মানুষের ¬ ইন্দ্রধনু ধরিবার ক্লান্ত আয়োজন
হেমন্তের কুয়াশায় ফুরাতেছে অল্পপ্রাণ দিনের মতন।
*******************************
ধানের রসের গল্প পৃথিবীর ¬ পৃথিবীর নরম অঘ্রাণ
পৃথিবীর শঙ্খমালা নারী সেই ¬ আর তার প্রেমিকের ম্লান
নি:সঙ্গ মুখের রূপ, বিশুষ্ক তৃণের মতো প্রাণ,
জানিবে না, কোনোদিন জানিবে না; কলরব ক’রে উড়ে যায়
শত স্নিগ্ধ সূর্য ওরা শাশ্বত সূর্যের তীব্রতায়।
(সিন্ধুসারস - মহাপৃথিবী - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ্র - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
এক কবিতায় কবি মানুষের যন্ত্রণাবিদ্ধ দু:খের কথা বলেছেন। আধুনিক জনযুদ্ধের উন্মাগ্নী উচ্চাকাঙখার বিশ্লেষণ রয়েছে এ কবিতায়। ‘সিন্ধুসারস’ সম্ভ্রান্ত পুরনো কালের মানুষ। নীলাভতম, মছির মত ঝরে হেমন্তের কুয়াশায় ¬ এসব শব্দ ¬ রং বা আবহই অধিবাস্তবাবাদী ধারণার সাথে সাযুজ্য। সিন্ধু সারস কবিতাটিতে পল গগ্যাঁর আঁকা ছবির কথা মনে পড়ে যায়। যে ছবিতে নীলাভ সমুদ্রতটে শুয়ে আছে জ্যামিতি আকৃতি পৃথিবীর আদিম নারী। সমুদ্র সেই আদিম প্রাণের প্রতীক।
অন্যদিকে মানুষই যে যুগযুগান্তরের নিয়ন্তা তা তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন ‘নাবিক’ কবিতায়। নজরুলের ‘কাণ্ডারী’ কবিতার মতো স্বপ্ন ও জাগরণের মগ্নচৈতন্যের লীলা জেগেছে এ কবিতায়। যেমন-
আশ্চর্য সোনার দিকে চেয়ে থাকে ; নিরন্তর দ্রুত উন্মীলনে
জীবাণুরা উড়ে যায় ¬ চেয়ে দ্যাখে ¬ কোনো এক বিস্ময়ের দেশে।
হে নাবিক, হে নাবিক, কোথায় তোমার যাত্রা সূর্যকে লক্ষ্য ক’রে শুধু?
বেবিলন, নিনেভে, মিশর, চীন, উরের আরশি থেকে ফেঁসে
*** *** *** *** ***
প্রয়োজন র’য়ে গেছে ¬ যত দিন স্ফটিক পাখনা মেলে বোলতার ভিড়
উড়ে যায় রাঙা রৌদ্রে; এরোপ্লেনের চেয়ে প্রমিতিতে নিটোল সারস
নীলিমাকে খুলে ফেলে যত দিন; ভুলের বুনুনি থেকে আপনাকে মানবহৃদয়:
উজ্জ্বল সময়-ঘড়ি¬নাবিক¬অনন্ত নীর অগ্রসর হয়।
(নাবিক - সাতটি তারার তিমির - অগ্রন্থিত কবিতা - প্রকাশিত অপ্রকাশিত কবিতা সমগ - আব্দুল মান্নান সৈয়দ সংকলন ও সম্পাদিত)
শেষে একথা বলা যায় যে, জীবনানন্দের কবিতা বহু বর্ণাঢ্য প্রকৃতি ও পৃথিবীর রং, ঘ্রাণ, শব্দ ও স্পর্শের। তাঁর কবিতা কীটসের ইন্দ্রিয়ময়তায় পরিপূর্ণ। চিত্রকর পল গগ্যাঁর ছবির মতো। জীবনানন্দ দাশের কবিতার ছত্রে ছত্রে সাজানো নীল ও কমলা রঙ। যা সালভাদর দালির ছবির মধ্যেই একমাত্র বর্তমান।
মূলত জীবনানন্দ দাশের কবিতায় সুররিয়ালিস্টিক শিল্পরীতির চূড়ান্ত প্রকাশ থাকলেও সেই শিল্পরীতির মূলে আছে কবির গভীর ও প্রখর বিস্ময়বোধ। এ বিস্ময়বোধের জন্যে কবি বার বার শান্তি খুঁজতে প্রবেশ করেছেন বোধের মগ্ন চৈতন্যের গভীরে, বাস্তব থেকে অতিবাস্তব বাস্তবে।
অনলাইন : ২৬ এপ্রিল, ২০০৯
[১] Op. Cit. PP.-237-38