লিখেছেনঃ শেখ বাতেন, আপডেটঃ July 30, 2008, 2:06 PM, Hits: 8867
বিশ্বায়নবিরোধী কবিতা
শেখ বাতেন
জ্যোতিপ্রকাশ
বিশ্বায়নবিরোধী কবিতা : শেখ বাতেন
প্রকাশক
মোস্তফা জাহাঙ্গীর আলম
জ্যোতিপ্রকাশ
৪২/১-ক, সেগুনবাগিচা, ঢাকা-১০০০
ফোন : ৯৩৪৯৭২৫, মোবা : ০১৭১৫১৫০৩০৫
প্রকাশকাল : ১৭ শ্রাবণ ১৪১৩/১ আগস্ট ২০০৬
প্রচ্ছদ : গৌতম ঘোষ
স্বত্ব : দুর্জয় শেখ, প্রত্যয় শেখ
অক্ষর বিন্যাস : কালজয়ী কম্পিউটার্স
৫ আজিজ সুপার মার্কেট (২য় তলা) শাহবাগ, ঢাকা
মুদ্রণ : আল আমিন প্রিন্টার্স, ১৫৮/এ, আরামবাগ, ঢাকা
মূল্য : ৬০ (ষাট) টাকা
BISWAYON BIRODHEE KABITA (Poems on Antiglobalization)
A Collection of Poems by Shaikh Baten. Published by Mostafa Jahangir Alam
JYOTI PRAKASH, 42/1-Ka, Segunbagicha, Dhaka-1000. Bangladesh. Price: US $ 7
উৎসর্গ
ইউএনডিপির হিসেবে ছয়টি দেশে কুকুর ও বেড়ালের খাদ্যের জন্যে প্রতিদিনের ব্যয় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার। কুকুরের একটা কমফর্টার অর্থাৎ শীতের বিছানা কিনতে লাগে ১৫ ডলার। আর না খেয়ে প্রতিরাতে ঘুমুতে যায় এশিয়া ও আফ্রিকার ১৫ কোটি শিশু--দেহমনে যারা সুস্থ মানুষ হয়ে উঠবে না কখনও। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১ কোটি ৪ লাখ শিশু ক্ষুধায় কষ্ট পায়, প্রতিবছর। ছয়শ কোটি মানুষের এই বিশ্বে দারিদ্র্যের আঘাতের আওতায় বাস করছে সাড়ে চারশ কোটি মানুষ। এই অশ্লীল ব্যবস্থা বদলাবার জন্যে যারা কাজ করে যাচ্ছেন... ...
বিশ্বায়নবিরোধী কবিতা
সাম্প্রতিক কালের সাম্রাজ্যবাদকে আল্লাদ করে একখান নতুন নাম দেয়া হয়েছে--বিশ্বায়ন। বিশ্ব যেন একটি গ্রাম। আমরা গ্লোবাল ভিলেজের সমমানিত বাসিন্দা। এই যাদুকরী কৃতিত্ব মাইক্রোচিপস্-এর যা দিয়ে হয় কম্পিউটার। যা বিশ্ব মানবের অভ্যাসে চিন্তনে স্বপ্নে ভোগে বণ্টনে তথা সমগ্র-জীবনাচরণে এনেছে সমরূপতা। প্রযুক্তি এনেছে প্রাচুর্য। আর মুক্তবাজার তা সবার জন্যে উন্মুক্ত করে এনেছে সমতা। দারিদ্র্যের জন্যে এখন আর সংগ্রামে কাজ নেই। বরং মানব জাতির জন্যে এ মহান সুযোগ, আগেভাগে গ্রহণ কর। নয়তো পস্তাবে।
এই গোলাপি-গল্প যাপিত জীবনের সঙ্গে মেলে না। জাতিসংঘ হিসাব দেয়--বিশ্বের সবচে ধনী তিন ব্যক্তির সম্পদ সবগুলো অনুন্নত দেশের ছয়শ কোটি মানুষের সম্পদের যোগফলের চেয়েও কিঞ্চিৎ বেশি। পাঁচটি সবচে ধনী দেশের সঙ্গে পাঁচটি দরিদ্রতম দেশের মানুষের আয়-বৈষম্য ১৯৬০ সনে ছিল ৩০ গুণ, ১৯৯০ সনে তা হয়েছে ৬০ গুণ, ১৯৯৭ সনে তা দাঁড়িয়েছে ৭৪ গুণ। পরিসংখ্যান ও আক্কেলজ্ঞান নির্দেশ করে নির্মম একপেশে সম্পদস্ফীতি বা পোলারাইজেশন। সৌভাগ্যের ঈশ্বর থাকেন ধনী দেশে। তাই পিতৃভূমি ছেড়ে বেশি দামে জীবন বেচতে যে কোনো মূল্যের ঝুঁকি নিচ্ছে মানুষ। ভাঙনের নতুন মাত্রা এসেছে সম্পর্কে। নারী ও পুরুষের যৌনতার যে সম্পর্ক মানবিক হতে পারতো, হয়েছে তার পণ্যায়ন। বেইজ্জতির চূড়ান্ত। বিশ্বের তথাকথিত গ্লোবাল শহরগুলো সামান্য পরদা সরালে এক একখান ঝলমলে পতিতালয়। আপনি লক্ষ করবেন, নিউইয়র্কে গত দশ-পনের বছরের বিশ্বায়নের নতুন উপহার রাশিয়ান বিউটি ও এশিয়ান কুইন। অনবরত ভ্রাম্যমাণ ফোন কিংবা কম্পিউটার স্ক্রিন থেকে সরাসরি ডাক দিচ্ছে, কোন রাখঢাক নেই। সে ডাক তথ্যসড়কের অলিগলি ধরে আজকাল পৌঁছায় পৃথিবীর সর্বত্র। এবং তারই প্রতিধ্বনিতে বিশ্বের দুই প্রাচীন প্রতিষ্ঠান গণিকাবৃত্তি ও বিয়ে পরসপরের ভূমি দখলে অধিকতর প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। অভিন্ন নিয়মে, প্রত্যন্ত সাইবেরিয়ার নিঝুম বনভূমির ভার্জিন সবুজেও গ্লোবাল পুঁজির অশ্লীল পেনিট্রেশন। নাইজেরিয়ায় গত পঞ্চাশ বছর ধরে বহুজাতিক সংস্থা শেল তৈল উত্তোলন করেছে অঢেল। অথচ সে দেশেই জ্বালানির অভাবে নিজস্ব বিমান ঠিকমত ওড়ে না আকাশে। ওড়ে কার্বন মনক্সাইড।
সম্পদের লুণ্ঠনে, নারী-পুরুষ-পরিবেশের চরিত্র দূষণের এই সাম্প্রতিক ত্বরায়নে মানুষের অস্তিত্বের নিভৃত প্রাঙ্গণ ক্রমেই বেহাত হয়ে যাচ্ছে। মানুষ ক্ষুব্ধ। আর পেছানোর জায়গা নেই। দেখে-শুনে বাধ্য হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি মানুষের ভেতর যে প্রতিরোধ-প্রবণতা জন্মেছে তারই সমন্বিত বহিঃপ্রকাশ বিশ্বায়নবিরোধী বিক্ষোভ। সিয়াটল থেকে কানকুন। অচিরেই তা কেন্দ্র থেকে প্রান্তিকে আরো সম্প্রসারিত ও বৈশিষ্ট্যায়িত হতে চলেছে, উপলব্ধি করা যায়। আজ লাভের লোভের নেশায়, যুদ্ধের নির্মাণবিকতায় জীবন তছনছ-করা যে বিশ্বে নিয়ত বসতি আমাদের তা থেকে আলাদা করে জীবনবোধের শৈল্পিক উপস্থাপন ক্রমেই অসম্ভব ও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।
বিশ্বজনীন গণদুর্ভোগের একখান মিনি-মডেল বাঙলাদেশ। একে এখন চেনাই যায় না। আক্ষরিকার্থেই এ এক জল্লাদের রঙ্গমঞ্চ। হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ, নির্লজ্জ লুণ্ঠনের বিপরীতে ক্ষুধা ও মঙ্গা। অর্থাৎ যে সকল মারাত্মক উৎপীড়ন থেকে
আমজনতাকে রক্ষা করতে রাষ্ট্র ওয়াদাবদ্ধ তার সবটাই এখানে লঙ্ঘিত হয়েছে। কখনো রাষ্ট্র বরং তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছে। ক্ষমতার নিছক পালাবদলে এ অসুখ সারবার নয় কিছুতেই। এক ব্যাপক প্রবঞ্চনাবোধে পোড়ায়। একদা এ রাষ্ট্রের জন্ম-প্রক্রিয়ায় আমি জীবনের সর্বোচ্চ ঝুঁকি বিনিয়োগ করেছিলাম। তখন সামান্য কিশোর আমি। এক অসামান্য দায়িত্ব--ত্রিপুরার গভীর এক অরণ্যে পাহাড়ের মাথায় শ-দুয়েক কিশোর-যুবকের এক কোম্পানির অধিনায়ক। দৈনিক সশস্ত্র প্রশিক্ষণের শেষে, প্রায়শ সন্ধ্যায়, মানসিক সশস্ত্রায়ণের প্রয়োজনে তাদের মৃত্যুকে মহিমান্বিত করে বক্তব্য রাখতে বলা হত আমাকে। তাদের একটি অংশ এখন মিশে আছে স্মৃতিসৌধের স্থবির কাঠামোয়--রাজারা পূজো দেয় বাৎসরিক। কিন্তু যারা বেঁচে গেছে তাদেরকে কেউ রাষ্ট্র কাঠামোতে আত্মস্থ করেনি। বরং নিরস্ত্র করেছে, অসংগঠিত রেখেছে, তেজস্বী যারা নিজেদের মৃত্যু ঘটিয়েছে নানান নির্মম প্রক্রিয়ায়, অন্যদের মারা হয়েছে কিংবা মরার মতো রাখা হয়েছে। ফলাফল, রাষ্ট্র বিশ্বস্ত প্রহরীর অভাবে বেহাত হয়েছে জনতার। এর প্রগতিশীল অবয়ব থেকে এক এক করে ইষ্টক খুলে নিয়ে গেছে দুর্বৃত্তরা। এখন চূড়ান্ত কিছুর অপেক্ষায়।
আশা ছাড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক ইতিহাসের পণ্ডিতেরা বলেন, ঐতিহাসিকভাবে বাঙলাদেশ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদী শিকলের এক দুর্বল গ্রন্থি--উইক লিঙ্ক অব ইমপেরিয়েলিজম। এ অঞ্চলে প্রথম সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ হয় বাঙলায়। এবং তার প্রতিরোধের যে বিশ্বখ্যাত কিংবদন্তী তা-ও হয়েছে এই বাঙলায়। ক্ষুদিরাম-তিতুমীর থেকে কানসাট পর্যন্ত গড়ে প্রতি পঁচিশ বছরে এখানটায় যত প্রতিরোধ সংগঠিত হয়েছে কোনো কোনো জাতির ইতিহাসে দুইশ বছরেও তা ঘটেনি। এখানকার মানুষ বাউল-প্রবণ আবার ফুঁসে ওঠায় যথেষ্ট ইহজাগতিক। জগজ্জননীর বৈচিত্র্য সমৃদ্ধ এই বাঙলায় আমি অভূতপূর্ব জলোচ্ছ্বাসে পলি-উর্বরতার সম্ভাবনা দেখি। কিন্তু ক্ষোভে, হতাশায়, বাঁচার জান্তব হিংস্রতার মোকাবেলায়, রক্তাক্ত কষ্টের পরীক্ষায় ক্রমসঞ্চিত শক্তির উপলব্ধির ভিতরে না গিয়ে কোথাও জনগণের যথার্থ মুক্তির যুদ্ধ সম্পন্ন হয়েছে কি? একাত্তরে সে মেয়াদ সম্পন্ন হয়নি বলেই আবার তা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে, ঐতিহাসিক অনিবার্যতায়। মক্কেল রাষ্ট্রের নষ্ট রাজনেতা ও মেধা-ব্যবসায়ীদের অকস্মাৎ পেছনে ফেলে দিয়ে সংগঠিত জনতার এগিয়ে যাবার আর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত এখানে তৈরি হয়েছে। তাই, ইতিমধ্যেই সাময়িক ক্ষোভ-নাশকের সেই সনাতনী ব্যবস্থাপত্র দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় ব্যতিব্যস্ত হয়েছে দেশী বিদেশী কারিগরেরা। চোখ রাখলেই তাদের নড়াচড়া দেখা যায়।
একটা অদ্ভুত নিন্দনীয় ব্যাপার ঘটে চলেছে আমার মধ্যে। বিশ-পঁচিশ দিন শক্ত-সামর্থ্য থাকি। তারপর হঠাৎ একদিন নামে অঝোর অশ্রু। যেন ছিঁড়ে ফেলে আমাকে, যখন একাকী থাকি। চারদিকের দেয়ালে দুটি শিশুর ছবি। নিচে মেঝেতে বিছানার পাশে তাদেরই দুটি লালরঙা বল, দুটি প্লাস্টিক ক্রিকেট-ব্যাট। দুটি পাখাভাঙা হেলিকপ্টার। দুটি স্কুল-সাইজ ব্যাগে বর্ণমালার বই-খাতায় আঁকা-উঁকির গন্ধ। আমি মুছে মুছে রাখি। দুটো দুটো করে সব। শুধু শিশু দুটি নেই হয়ে গেছে। ওরা আমার দুই যমজ সন্তান--দুর্জয় ও প্রত্যয়। ১১ অক্টোবর ২০০১। সেদিন ওরা ঘুমাচ্ছিল প্রতিদিনের মতো। একদল বেআইনি লোক ঘুমন্ত শিশুদের ওপর বলপ্রয়োগ করে। আকস্মিক বর্বরতায় ট্রমায় কাঁপতে-থাকা শিশু দুটিকে টেনে হেঁচড়ে জিয়া বিমান বন্দরে নেয়া হয়। এবং এক পর্যায়ে আমি জানলাম, আমার সুস্থ শিশু দুটি ঠাঁই পেয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের হোপ-সেন্টার নামক একটি শিশু আশ্রমে। এই অপরাধ সম্পাদনের প্রতিটি পর্বে এরা বাঙলাদেশের আদালতসমূহের আদেশ ও নিষেধ লঙ্ঘনসহ শিশু-স্নায়ুর ওপর ক্ষতিকর এমন কিছু করেছে, ভাবলে নিরীহের মনেও চূড়ান্ত ইচ্ছে জাগে। এ যেন দেশী ফিল্মের ঘটনা। হেন কিসিমের ব্যক্তি/প্রতিষ্ঠান নেই আমি প্রতিকার প্রার্থনা করিনি। এদ্দিন ওরা বেঁচে আছে, নাকি নেই? তার কোনো সাড়া-শব্দ নেই! এ বিষয়ে সর্বোচ্চ আদালতের সপষ্ট আদেশ আছে। কিন্তু বিচারপ্রার্থীর কষ্টার্জিত বহু টাকায় কেনা হাইকোর্ট রুলিঙকে এদেশের রুলাররা এক তামাশায় পরিণত করেছে। আর নিম্ন আদালতগুলিকে করেছে কয়েকটি সরকারি মন্ত্রণালয়ের এক্সটেনশন। সেখানে শাসকেরা নিজস্ব আদলে অধীনস্থ বিচারক ও বিচার-কাঠামোকে ধিক্কারযোগ্যতার এমন পর্যায়ে নামিয়েছে যা ইতিমধ্যেই দেশের মানুষের রোষ, আর বিদেশীদের গবেষণার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। আমি হাজারখানেক দৃষ্টান্ত দিতে পারি, তাৎক্ষণিক। আমি নিজেও একজন বিচারক।
কিন্তু বিস্ময়কর হলো অপরাধীরা আদালতে জানিয়েছে তারা স্থানীয় মার্কিন এ্যামবেসির কথায় এ কাজ করেছে। শিশুর বেআইনি স্থানান্তরে এ্যামবেসির সংশ্লিষ্টতা কি ছিল? হাইকোর্ট জানতে চেয়েছিল, উত্তর দেয়নি এ্যামবেসি। বরং বলেছে, বাঙলাদেশের পুলিশ দায়ী। আমি মাননীয় পুলিশ মন্ত্রীকে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি বললেন, মার্কিন এ্যামবেসি দায়ী। একে অন্যের ওপর দোষ চাপায়। আর নভেম্বর ২০০১ থেকে আমার শিশুদের অবস্থানের মেয়াদ বাড়তে থাকে ওয়েগোর চাইল্ডহোমে।
এই ঘটনা ব্যক্তিগত বটে। কিন্তু এর প্রতিটি স্তরে রাষ্ট্রীয় অরাজকতার সূচকসমূহ লক্ষণীয় : বিচারাদালতের অক্ষমতা, পুলিশী সহায়তায় অপরাধ (অপহরণ)। শিশু (বা দুর্বল)-এর ওপর বর্বরতা। শক্তিশালী দূতাবাস কর্তৃক কদলী রাষ্ট্রে কূটনৈতিক ক্ষমতার সীমানা ডিঙানো, স্থানীয় আইন-আদালতকে তোয়াক্কা না করা, মানবাধিকার ও জাতিসংঘ সনদ (সি আর সি) লঙ্ঘন... ইত্যাদি।
প্রভাবশালীদের সংশ্লিষ্টতা ছাড়া এদেশে বড় মাপের কোনো অপরাধ হয় না। এবং শাস্তি হবার আইনি সম্ভাবনা দেখামাত্র দলীয়-কাম্ সরকারি পরিচয়ে বিচারকার্যে হস্তক্ষেপ, বিচারপ্রার্থীকে হত্যার হুমকি--এসব প্রতিষ্ঠানায়িত হয়েছে। যথানিয়মে আমাকে হত্যার হুমকি দেয়া হয়েছে। আমি এখন নিজেকে দিয়ে বুঝি, আইন কাঠামোর দুর্বৃত্তায়নের কোন পর্যায় সাধারণ মানুষকে চূড়ান্ত ক্ষিপ্ত করে তোলে। হয়তো এইসব ভুক্তভোগীর ক্ষিপ্ততার ঐতিহাসিক সমন্বয়ে সংগঠিত গণঅভ্যুত্থানে কলঙ্কমুক্ত হবার অপেক্ষা করছে বাঙলাদেশ। এইসব ভাবনায় নিজেকে বড় করে ভাবি--প্রতিদিন কত শিশু, অসহায় মানব সন্তান, বোমার আগুনে পুড়ছে, মরছে- দেশে বিদেশে। নিজেকে ছেড়ে-ছুড়ে উত্তীর্ণ আমি তবে হাজার শিশুর নিরাপত্তা হই না কেন? আজকাল মার্কিন মুলুকে এতো শিশু ধর্ষিত হচ্ছে কেন? শিশুর পর্ণোগ্রাফি? যৌক্তিক সম্ভাবনার দুঃস্বপ্নে আবার স্রেফ নিজ শিশুর জন্যে ব্যক্তি-আমি আঁত্কে উঠি। কিন্তু নিজের স্ত্রী-পুত্রের উপর ঘা না-পড়লে কেউ প্রতিক্রিয়া করে না এই দেশে। পুরাকাহিনীতে পাপের ভারে কত প্রাচীন নগর সভ্যতা অগ্নুৎপাতের লাভায় তলিয়ে গেছে। এই জনপদ তলায় না কেন? এই যুগের ঈশ্বর নিজে তা করেন না। তিনি মানুষের ভেতরকার ঐশ্বরিক শক্তির দিকে তাকিয়ে থাকেন। আমি, বাঙলাদেশ ও বিশ্ব যেন দুর্ভোগের একই সমতলে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছি।
কবিত্বের দাবি করি না আমি। অবদমিত ক্ষোভের ফলপ্রসূ সংক্রমণের উৎকৃষ্টতর সুযোগ আপাতত না থাকায় এই ‘হিরন্ময় প্রতিশোধ’-এর আশ্রয়। আমার বাকভঙ্গি সবার পছন্দ হবার নয়। উপলব্ধিতে তাৎক্ষণিকতা ও ব্যক্তিতার ছাপ আছে। তাতেই আমি তুষ্ট, যদি এর সামান্য কিছুও সাধারণ মানুষের চেতনা সপর্শ করে। জগৎ পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় যে মানুষ অসাধারণ সম্ভাবনার অন্তহীন ধারাবাহিকতা। আমার ভুবনদৃষ্টিতে যা ঐতিহাসিক তাই চিরায়ত, যা ব্যক্তিক তাই গ্লোবাল।
পরিশেষে এখানে উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক যে- আমি স্টেট ইউনিভাসির্টি অব নিউইয়র্ক (SUN)-এ সমাজবিজ্ঞানে পিএইচডি গবেষণার কাজের ফাঁকে এইসব আবেগিত শব্দমালার বেশ কিছু অংশ প্রসব করেছি। সে সময়ে ভিন্নতর কাজে নিবিষ্টতা আমার জন্যে জায়েজ ছিল না। এই বিচ্যুতিকে কিঞ্চিত উস্কে দিয়ে ভালোই করেছেন নিউইয়র্কের ‘সাপ্তাহিক বাঙালী’র সম্পাদক কৌশিক আহমেদ। আমার ভালো লেগেছে যখন আমার বন্ধু পিয়াস করিম, শিকাগোয় এক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, জানালো যে তার এনজিও বিষয়ক আলোচনার ক্লাসে আমার একটি কবিতা শিক্ষার্থীদের ফটোকপি করে দেয়া হয়েছিলো এবং তাদের কাজে লেগেছে। বানানের ত্রুটি শুধরিয়ে এবং কবিতা সম্পর্কে নিখরচায় উপদেশ বয়ান করে কাজের কাজ করেছেন আমার বন্ধু, নিউইর্য়কে আমার হাউসমেট, সলিমুল্লাহ খান। পিটার কার্লো, কাঈ উইলিয়াম, বন্দনা স্বামী, কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিষ্ণুপদ--এইসব সহপাঠী সমজদারদের খুশি করা ছাড়াও ছাত্র-প্রতিনিধি হিসাবে বিভিন্ন সমাবেশে যাবার দীর্ঘযাত্রাপথে ওদের চাঙা রাখার এনারজাইজার হিসাবে এইসব আবেগিত শব্দের উচ্চারণের উপযোগিতা ছিলো ধন্বন্তরী।
আসলে আমরা সবাই বিশ্বাসের মৌলিক জায়গায় ছিলাম অভিন্ন। আমাদের দৃঢ় অবিশ্বাস ছিলো বিশ্বায়ন পণ্ডিতদের সেই উচ্চকণ্ঠ ফতোয়ায় : দেয়ার ইজ নো অলটারনেটিভ--টিনা। অর্থাৎ বণিকতন্ত্রের বিকল্প নাই। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক দারিদ্র্য, যুদ্ধ, বণিকের মুনাফা, বিশ্বব্যাংকের মাতব্বরি, নারীর পণ্যায়ন, বিশ্বায়ন যুগের শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি থেকে অনগ্রসর দেশের অবুঝ শিশুর ওপর বিস্ফোরক নিক্ষেপ--এইসব দুর্বৃত্তপনার কাঠামোগত অভিন্নতা মানুষের অভিজ্ঞতায় এতই সপষ্ট ও নগ্ন হয়েছে যা আগে কখনো এ মাত্রায় হয়নি। তাই সামাজ্যবাদী বিশ্বায়ন প্রতিরোধ আন্দোলন সংগঠিত হচ্ছে খোদ বিশ্বব্যবস্থার নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় শহরগুলিতে--একেবারে বুকের ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলে চল্লিশ হাজার মানুষের সংগঠিত বিক্ষোভ এই সংকেত দিয়েছে যে, কোনো দূর্গই যথেষ্ট দুর্ভেদ্য নয়। ম্যাক্সিকোর কানকুনে বিশ্বায়নবিরোধী মহিলা কর্মীরা এক পর্যায়ে হাতুড়ির ঘায় দশ ফুট উঁচু স্টিলের ফেন্সিঙ ছিঁড়ে ডব্লিউটিও-এর কার্যত্রম বন্ধ করে দিয়ে ঘোষণা করেছিলো--দুনিয়াটা ব্যবসায়ীদের বেচাকেনার বস্তু নয়। ওয়ার্ল্ড সোসাল জাস্টিস, ওয়ার্ল্ড সোসাল ফোরাম সহ অগণিত সংগঠনের ব্যানারে বঞ্চিত কৃষাণ, অপমানিত অভিবাসী, শ্রমজীবী, বর্ণবাদ বিরোধী, পরিবেশবাদী, অধিকার বঞ্চিত নারী, অন্যায় যুদ্ধে নিহতদের স্বজন, এমনকি আগ্রাসী যুদ্ধের সৈনিক পরিবারের যুদ্ধবিরোধী প্রগতিশীল, ধর্মীয়, বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষ এটা উপলব্ধি ও সনাক্ত করেছে, সব নষ্টামির উৎসমূল এক জায়গায়। এবং এই সহস্রাব্দের শুরু থেকে, অনেকেই জানেন, কী রকম পৌনঃপৌনিকতায় মানুষের ক্রোধ বিভিন্ন বিক্ষোভ সমাবেশে প্রতিফলিত হয়েছে ওয়াশিঙটন, নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্র্যাগ, রোম, মনট্রিল, মেলবোর্ণ, জেনোয়া, মুম্বাই, এবং হংকং-এ। এর ভেতর দিয়ে মানুষের মানুষ হয়ে উঠার প্রক্রিয়ায় একটা অগ্রসরতার মাত্রা যোগ হয়েছে প্রতীয়মান হয়। বিশ্বের অধিকাংশ মানুষের স্বপ্ন গুটিকতকের সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে সামলে রাখার সময় শেষ হয়ে এসেছে। কায়েমি শক্তি পিছু হটছে এবং মানুুষ এগুচ্ছে--পসিবল অলটারনেটিভ বা উৎকৃষ্টতর বিশ্বব্যবস্থার দিকে। দেশে দেশে নিজস্ব নিয়মে তার প্রাথমিক লক্ষণগুলো ক্রমেই সপষ্ট হচ্ছে। সময়কে ডিঙিয়ে যাবার এই সময়টা অগ্রসর মানুষের জন্যে সীমাহীন কষ্টের এবং একই ঐতিহাসিক কারণে তা অপরিমেয় আনন্দেরও বটে। বোধের সাহসী প্রেক্ষিতে নতুন মিলেনিয়ামে কাঙ্ক্ষিত বিশ্বব্যবস্থাকে স্বাগত জানাবার সীমিত প্রয়াস এই বিশ্বায়নবিরোধী কবিতা।
শেখ বাতেন
ক্রিসেন্ট রোড, ঢাকা
ই-মেইলঃ
সূচি
লী কিয়াঙ-হেই ৬
কেন গেলিরে সোনা ৭
বৈরী ঘোষণা করি ৮
ইমিগ্র্যান্ট ৯
সম্ভাবনার সূত্র ১০
খোলাচিঠি ১১
সময় ১২
মুক্তিযুদ্ধ ২০০৬ ১৩
মোনাজাতউদ্দিন ১৩
একটি মৃত্যু ১৪
ওহী ১৫
বানের আওয়াজ ১৬
কবিতা লিখি না আমি ১৭
মানবায়ন ১৮
মুখ্যু নই ১৮
দুঃসময়ের ভাষণ ১৯
পশু ২০
টেন এলিভেন ২১
অনুভব ২২
ঘুমায় মাতামুহুরী ২৩
পারবে কি পাশ কেটে চলতে ২৫
অবস্থান ২৬
তৃতীয় দুনিয়ায় বসতি ২৭
সাতই নভেম্বর ২৮
কানসাট থেকে ২৯
লী কিয়াঙ-হেই
উৎসর্গ : শুভ কিবরিয়া
[লীর বয়স ছাপ্পান্ন। জন্ম দক্ষিণ কোরিয়ার চোলা প্রদেশের ছোট্ট শহর জাঙসুতে। ওই শহরে তার কৃষি খামার। বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রী, ব্যাংক লোন ও কঠোর শ্রমে গড়ে-ওঠা তার খামার বিলুপ্ত হয় খোলাবাজারের নিয়মে। কৃষি পণ্য কম দামে বেচে বেচে কৃষক ফতুর হয়, দেশে দেশে এটা নতুন কথা নয়। দুর্বল রাষ্ট্রকে অবাধ বাণিজ্যের নসিহত করে ধনিক রাষ্ট্রের বণিক চক্র নিজেরাই তা ভাঙে। পণ্যে ভর্তুকি দিয়ে নিয়ন্ত্রণ করে বিশ্ববাজার। যেখানে এক ডলারে আশি সেন্ট ওদের চাই-ই। বিশ্ব অর্থনীতির ত্রই ক্যাসিনোতে নিঃস্ব হয় তৃতীয় বিশ্বের কৃষক। লী ত্রিশ বার অনশন করে প্রতিবাদ করেছিলেন। কেউ শোনে নি। ডেটলাইন : ১০ই সেপ্টেম্বর। মেক্সিকোর কানকুন। বিশ্ব বণিক সংঘের (ডব্লিউটিও) পঞ্চম বৈঠক। ভেতরে প্রতিনিধি মন্ত্রীবর্গ। বাইরে বিশ্বায়নবিরোধী মানুষের বিক্ষোভ--বিভিন্ন দেশ থেকে আগত। অকস্মাৎ একজন ওয়াগন থেকে লাফিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনীর উপরে উঠলেন। চিৎকার করে ডব্লিউটিও-কে ধিক্কার দিলেন, এবং একটি ছুরি নিজের বুকে আমূল বসিয়ে দিলেন। লীর মৃত্যু পুঁজির বিপরীতে প্রতিরোধের বিশ্বায়ন--এক নতুন স্তরের প্রতিকী উদ্বোধন।]
সময় যখন নপুংশকতায় ক্লান্ত
তোমার বাঁধাকপি আপেল বিবর্ণ কৃষকের মতো
আঙিনায় পুষ্পেরা মৃত, আকাশে বোমারু, জলে মেরিনসেনা
বস্তুতঃ আমাদের সকল পথ রুদ্ধ, অস্তিত্ব ক্রুদ্ধ, সম্ভাবনা নিষিদ্ধ
এমন অন্ধকারে সহযোদ্ধারা জ্বালিয়ে দিল
তোমার মৃতদেহের পাশে জীবন্ত মোমের আলো
অগ্নিময় কানকুনে উচ্চারিত হল সহস্রাব্দীর সতর্কতাঃ
এ বিশ্ব বণিকের নয়--‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ নট ফর সেল’
ওরা ওলটপালট করে, ওরা লুটেপুটে খায়
ওরা যুদ্ধে কিম্বা বাণিজ্যে বরাবর তালগাছ চায়
তোমায় নিঃস্ব করে খোলাবিশ্ব তত্ত্বে, নিরস্ত্র করে যুদ্ধে নামায়
ইতিহাস স্মৃতিময় কপার তৈল ও তুলায়।
সাইবেরিয়া থেকে তেতুলিয়া আষ্টেপৃষ্টে বিশ্বায়ন
নিস্বায়নের বুজরুকি বণিকের ফের সীমানা লঙ্ঘন;
পুঁজির অভিন্ন বিস্তারে আমিও ডাঙর--সমানে সমান
ভুল নয় বৃথা নয় কোন সঞ্চয় মানবের ক্রমঅভিজ্ঞানঃ
উনিশশ’-সতের-ঊনপঞ্চাশ-পঁচাত্তর, সিয়াটল-কানকুন--
হয়তো তথ্যসড়কে কৃষাণের এ সামান্য আত্মহনন
অলক্ষে অসামান্য প্রেক্ষিত করেছে নির্ধারণ,
হয়তো নিছক শোক
কফিনের পাশে স্বজনের এই নগণ্য দ্বীপালোক--
নিমেষে পোড়াতে পারে এ বিশ্ব
নিরাপত্তাহীনতায় এখন ভীষণ প্রস্তুত।
লী কিয়াঙ হেই, গ্লোবাল-কৃষাণের প্রথম শহীদ
এখন, বিশ্বব্যাংক ঋণের দায়ে তোমার উচ্ছেদ হবে না
এখন, বিশ্বদারিদ্র্যের দায়ে তোমার অনশন করতে হবে না
পৃথিবী ও সিউল তোমায় মওকুফ করেছে--এক নির্মম শর্তেঃ
সবুজ পুষ্পময় জাঙসুর খামারে তোমার আর ফেরা হবে না।
ঢাকাঃ ২৩.১০.২০০৩
কেন গেলিরে সোনা
[ডেটলাইন : দ্বারিয়াপুর, সখিপুর, টাঙ্গাইল- ১৫ জিলকদ ১৪২৩। আট বছরের সেলিম। পিতা তাকে বারণ করেছিল। তবু কোন অলক্ষুণে আবেগের টানে পাগলার মাজারে গেল। অজপাড়াগাঁয় হঠাৎ নিক্ষিপ্ত বিস্ফোরকের কল্জে-ফাটা আওয়াজ। ধোঁয়া আগুন আর অন্ধকার। সবাই নিজেকে নিয়ে পালায়। পিতা সনাক্ত করে তার সোনার সন্তান রক্তের উপর তড়পায়। ঢাকা মেডিক্যালে আনার পথে অবাধ্য সেলিম ভিন্ন গন্তব্যে চলে যায়। বর্তমান বিশ্বের সবচে বিপন্ন প্রাণী, প্রতিনিয়ত হত্যা ও নির্যাতনের শিকার শিশুদের জন্যে...]
কেন গেলিরে সোনা?
এতটা ডাঙ্গর হলি বুঝ নিলি না,
এই রক্তখোর মাটিতে ঘাতকের গন্ধ পেলি না?
তুই পশুশাবকেরও অধম? কোন ভরসায় তবে ছুট্ দিলি না!
সেই তো ফিরে এলি, হয়ে এলি লাশ,
কোনো মৃত্যুর ফয়সালা নেই এই জনজঙ্গলে
তাও কেন যাস?
শীতার্ত রাতে--ঘরে, মাদুরে, না হয় ফুটপাতে কুকুরের পাশে,
সেই তো ভালো ছিলি, কেন গেলি? --কী সে ডেকে নেয় তোরে--
মানুষের প্রান্তরে, মনের আকাশে কোন্ রঙ চাস!
এ কী রঙ গায়ে মেখে হয়ে এলি লাশ!
উত্তরে দক্ষিণে তাবৎ ভুবনে আজ, বিশ্ব হায়েনার-
নির্বিরোধ দুর্বলের খুন-খাওয়া লালসার-
যজ্ঞ,--
তোর বলি দিয়ে উদ্বোধন চায়।
আফগানে, ফিলিস্তিনে, কিম্বা ঊনসত্তর-গণঅভ্যুত্থানে--
মিছিলের আগে আগে কেন তুই,
মনে কি পড়ে না ইতিহাস?
তুই শুধু ভুলে ভুলে যাস!
বোমার সিপ্লন্টার সহজেই তোর খোঁজ পায়--
আচমকা গুলি, আগুন-কুণ্ডলি, সলিল-সমাধি-বারবার,
ইদানিং ঝোপঝাড়, নির্জনে ধর্ষণে
তোরই কণ্ঠে নরকের প্রথম চীৎকার,--
শান্তি কি যুদ্ধে, গেরস্ত কিম্বা খাকি-পোষাকী হায়েনার-
সমান খপ্পড়ে।
গোলাপি জননীর জরায়ুর পাপ তুই--ছুঁড়ে মারে নীচে
কিম্বা শিশু আশ্রমে তোর কচি প্রাণ পিষে--
নষ্ট অজুহাত।
তোর সঙ্ঘ নেই, লিঙ্গ নেই, ওরিয়ানা ফ্যালাসিদের বাহাস-বর্ম নেই,
জগতে তোরই অশ্রুর শুধু বর্ণ নেই।
যত্তসব বর্ণচোর, রক্তখোর, পাচারকারী তোর মঙ্গল চায়,
এ কী দুর্জয় প্রত্যয়ে নেচে নেচে সেদিকেই যাস!
যত্তবার খুঁজি তোকে, খুঁজে পাই লাশ।
ঢাকা : ২৪.০১.২০০৩
বৈরী ঘোষণা করি
উৎসর্গ : বন্ধু পিটার কার্লো
“হোয়াট্ ক্যান্ বি ডান টু ডেভেলপ্ ইয়োর কান্ট্রি”--মাল্টিন্যাশনাল মনিটর
“আই ক্যান্ গিভ্ ইউ ওয়ান সিমপল অ্যানসারঃ লিভ্ মাই কান্ট্রি অ্যালোন।”--ফরহাদ মজহার
আমি আবারও বলি,--আমাদের একা থাকতে দাও
আমি তো ছিলাম এখানে, চার হাজার কিংবা চার লক্ষ বছর,
ছিল না সভ্যতার নামে এইসব জঞ্জাল।
আমার মাথার উপরে হিমালয়,
পদতলে মহাসাগরের নির্ভয়,
ডাঙায় জলে কঠিনে কোমলে নিরন্তর-
সবুজে ঘেরাও এই বদ্বীপ-বাঙলা,
করেনি তো সীমানা লঙ্ঘন, হাজার বছর!
আমাকে একা থাকতে দাও,
আরো সপষ্ট উচ্চারণ চাও? তো বলি--
বিশ্বব্যাংক প্রত্যাহার চাই--বর্ণচোর শাইলক;
আর বহুজাতিক পঙ্গপালের আলামত,
তিরিশ বছর বহুত হয়েছে ক্ষুধা-বিতাড়ন খেল্
ফিরে যাক এঞ্জিয়োরা সদর দফতরে।
যে ভাষা বুঝি না আমি, যে ভালোবাসা সন্দেহ করি,
যে মানে না নিয়ন্ত্রণ আমার, করিনি নিমন্ত্রণ যারে--
আমি তার প্রত্যাহার চাই।
কালো আফ্রিকা জানে, জানে লাতিন আমেরিকা--
চিলি, গুয়াতেমালা, এল সালভাদোর
ঘানা, নাইজেরিয়ার বিরান অগনি অঞ্চল--
আগুনে শিলায়িত শস্যক্ষেত আমার নিষফলা করে-
একশো বছর, কার পাপ তবে--
শেল? এ্যানাকোন্দা? ইউনাইটেড ফ্রুট?
পৃথিবী জানে না, এই শতাব্দী কার মুখোমুখি আজ?
কারা করে যায় সীমানা লঙ্ঘনের কারুকাজ?
প্রতিনিয়ত আর্সেনিকে ওজোন লেয়ারে--
কার লোল জিহ্বার প্রকৃতি উৎখাত।
ঈশ্বর প্রতিদ্বন্দ্বী নয়, বরং ঈশ্বরের নামে--
এই জনপদ ওদের বৈরী ঘোষণা করে;
উৎপীড়ক যত, আমার সীমানা ছেড়ে যাক সদর দপ্তরে।
সভ্যতা ব্যর্থ যখন আমার প্রাঙ্গণে--প্রতি নিঃশ্বাসে,--
তৃতীয় বিশ্ব ক্ষরায় প্লাবনে,
চরিত্রহীন টেকনোলজি পরিসংখ্যানদুষ্ট-অর্থনীতিক উৎখাত হোক,
নিয়ে যাক সঙ্গে করে--
জিয়ারত-রাজনীতি জিকিরের-পার্লামেন্ট লুম্পেন সচিবালয়।
আর একটি বারও দেখতে চাই না,
বিদেশী মিডিয়ায় অশ্লীল ছবিঃ
শ্বেত সভ্যতার দিকে তাকিয়ে থাকা--
আমার শিশুর নিষ্প্রাণ চোখ
প্লাবিত বসতির চিত্রপটে জননীর লাঞ্ছনা
দুর্মুখের কলামে চৌর্যবৃত্তির খতিয়ান।
এই তো স্বদেশ--
ইতিহাস পায়চারি করে ক্ষমাহীন স্মৃতির ভেতরে
বহুদূর থেকে ভেসে-আসা গ্রাম, একটি পুকুর পার,
সারারাত নুয়ে-থাকা হিজলের ঘ্রাণ,--এ কেমন দায়?
এই আমাকে প্রতিরোধে নিয়ে যায়?
আমি তো বিশ্বাস করি--নারীর অন্তঃপুর,
শৈশব-সূর্যোদয়-অফুরান, যা কিছু আবহমান
আমার নিরীহতায় বেড়ে-ওঠা পাপের তাকতে-
দিনদিন ভুল বিশ্ব, আমার মুখোমুখি দাঁড়ায়।
মিসাইল-মেরিন-প্লাবন-ক্ষুধা-মহান শাইলক--
আমার বিপরীতে এক হয়ে যায়।
মাটি থেকে উঠে-আসা মানুষের উত্থানে বিশ্বাস করি
আর সব জঞ্জাল, এই জনপদে বৈরী ঘোষণা করি।
নিউ ইয়র্ক ০৭.০২.১৯৯৯
ইমিগ্র্যান্ট
উৎসর্গঃ আমার তথা সমগ্র নিপীড়িত বিশ্বের শিক্ষক প্রফেসর জেম্স্ পেট্রাস
নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে গেলো যেদিন,
একই দিনে উপোস গেলো জননী আমার।
জগতের অ্যান্টেনায় ধরেনি খবর--
কার অপুষ্ট জঠরে অকারণে আমি বড় আন্দোলন করি,
হয়তো সে-ই আমার বিপ্লবে হাতেখড়ি;
সেই থেকে পক্ষপাতদুষ্ট চাঁদ-সূর্যের সাথে বোঝাপড়া।
কার স্বার্থে সূর্যালোক কুক্ষিগত?
নিরন্তর বিপ্রতীপ আমার,--সোমালিয়া থেকে সিয়েরা লিওন,
পেরু, নেপাল, বদ্বীপ-বাঙলা,--ব্যর্থ মানুষের ইতিহাস ভূগোল,
স্থির গোলার্ধ নড়েনি একচুল;
জীবন নেড়ে দিল বরং আমাকেই,--শিকড় ছিঁড়েছুড়ে একদিন
ইয়াছিন-জগিন্দর-সুফিয়া-দিয়ালো-লুইমা,
পেছনে আখক্ষেত-পুর্তোরিকো, পাহাড়ে-প্লাবনে-আফ্রিকা-এশিয়া--
তবু তো পিতৃভূমি--অক্ষম পিতৃভূমি,
আজন্ম স্মৃতিকষ্টের পরিচয়-পরিধি আমার।
আঙ্কেল টমের কেবিনে--
মহাসাগর, কাঁটাতার, তিনশো বার শুকরের প্রহরা ডিঙিয়ে,
ক্রীতদাস জনস্রোতে ধেয়ে এলাম, ভোগের বেহেশত্ এখানে;
বণিকতন্ত্রের কিম্ভূত নিয়মে পৃথিবী কেন্দ্রীভূত,
বেদম প্রাচুর্য, আদিরসে উপচায় রমণী--ক্ষুৎপিপাসাহীন।
আর, আমার থাকে স্রেফ জৈবিক নিয়ম,
আমার কক্ষপথ নিয়ন্ত্রিত নির্মম আবর্তনে,
আমার পৃথিবী বর্ণ ও শ্রেণীর--যার যার তার তার।
রাতভর নিংড়ানো শ্রমে সলতে জ্বলে--লাসভেগাস থেকে টাইম স্কোয়ার,
আমার পুড়ে পুড়ে যায় যৌবন ও দেহের শ্রেষ্ঠ সময়,
জীবনের নির্যাস জানা হয়ে গেছে--জন্মের আজন্ম পাপে।
অসংখ্য সংখ্যায় বিলুপ্ত প্লাস্টিক-পরিচয়-ছবি,--আমি নই, আমি নই।
ফিরে চাই-
মানবিক স্মৃতিময় পূর্ণাঙ্গ পরিচয়,
গেলমান গণিকা নয়--চাই স্বচ্ছ মানবী,
মুনাফার ভুল-মূল্যবোধে নিহত সন্তান ফিরে চাই।
কার প্রয়োজনে, এ জীবন ঘরদোর ভাঙচুর?
কার পাপে, জল স্থল আকাশ দূষিত?
কিসের বিনিময়ে, এ যুগের নমরুদ নগর বানায়
ফি বছর গোলাম-রঙ্গিণীর আমদানি চায়।
আহাজারি অভিসম্পাৎ নয়
আমি ইতিহাস--সমবণ্টনে-বঞ্চিত-অধিকার--
আমি আদিম ক্ষোভ ধারাবাহিকতার;
গ্লোবাল ভিলেজ নেটওয়ার্ক-তত্ত্ব নিপাত যাক,
যদি আমার না মেলে হিসাব, হিংস্রতার সংক্রমণ দেব বিশ্বায়নে।
আমারই মত রক্তপাতে, স্বার্থ সমান জখম হবে ব্যাপক ভূপ্রান্তে,
আমি কিছুতেই দেবনাকো ছাড়;
জঙ্গী বোমারুর ছোবলের ভয়? এ গ্রহ জঙ্গল নয় দখলী ক্ষমতার।
মানুষ ভেঙেছে অক্ষরেখা শত শতাব্দীর উত্তরণ তার,
ইমিগ্র্যান্ট নই, জীবনের নির্মম বিনিয়োগে--
এ গ্রহ আমার
সবখানে আমার
সবটুকু আমার।
বিঙহামটন ০৬.০৫.২০০১
সম্ভাবনার সূত্র
দুঃসময়ের আঁধার ছিঁড়ে আগুন জ্বলুক সম্ভাবনার
আগুন জ্বলুক জমাট ক্ষোভে বৃষ্টি নামুক অগ্নিকণার
ধর্ষণে কার রক্ত ক্ষরণ মরলো মরণ নিজের হাতে!
ঝাঁকড়া গুলির লাশ পড়েছে পড়লে পড়ুক কার কী তাতে
সকাল-বিকাল আগামীকাল নিয়ম মাফিক যখন তখন
খুন-প্রকল্প খুনের গল্প নিত্যখুনে খুনী শাসক
স্বর্গে আছে, আমরা সবাই-- মর্গে যাব, এইতো কথা?
ক্রসফায়ারের ধন্ধ-ধোঁয়ায় খাচ্ছে খাবি আমজনতা
উড়ছে উড়ুক তাবৎ মুলুক একের পর এক বিস্ফোরণে
চাই ক্ষমতার শুক্লপক্ষ আপন লক্ষে, বিস্মরণে
ভাবছে যাবে-- যাচ্ছে যেমন অনন্তকাল
হিসাব আছে অন্য কিসিম-- ছেচল্লিশ ও একাত্তরে
তৃতীয় দাগের মরণ কামড় শাণায় বাঙলা অতঃপরে
মানুষ আছে মানুষ বাঁচে সময় হলে টেনে নামায়
জলোচ্ছ্বাসে জীবন আসে অগ্নিরঙের সূর্যকণায়।
খোলাচিঠি
উৎসর্গঃ কাকু, তর বাবায় কই? ‘বাবায় গেছে মিঠাই আনতো।’ নির্বিরোধ নিঃস্ব কালু শাহ। সংসারের খবর তেমন রাখতো না। গানের খবর পাইলে উধাও। তবে ফেরার সময় তার শিশু-সন্তানের জন্যে মিঠাই আনতে ভুল করতো না। করলো একদিন। যেদিন মঞ্চের সামনে তার ছিন্নভিন্ন দেহ সনাক্ত করলো স্বজনেরা। উদীচীর বোমা হামলায় নিহত আবহমান বাঙালী বাউল কালু শাহ্-কে।
“চুল্লীতে আগুন জ্বালাও, আলো ঠিকরে পড়বেই”--হোসে মার্তি
প্রিয় বন্ধুরা--
আজ কোনো মেধার প্রসঙ্গ নয়,
তত্ত্বে কাব্যে কে কেমন ঝলসায়, তা নয়
সময়ের মুখোমুখি মামুলি মানুষ,
ইতিহাস ফেঁসেছে ওদের দোর গোড়ায়--
সামনের পথে অন্ধকার, আলো কিম্বা কারিশ্মার-
যদি কেউ হও
প্রজ্জ্বলন ছাড়া, তোমার অন্য কোনো মানে হতে পারে না।
দুঃসময়ের সংজ্ঞা হয় না এখন
কোনো কৌশলের প্রসঙ্গ নয় আজ
আমাকে জিজ্ঞেস কোরো না--
বিপ্লবীরা এঞ্জিয়ো, এঞ্জিয়োরা বিপ্লব করবে কী, না?
ধৈর্যের পথে শহীদ হওয়া জায়েজ কী না।
এ মাটি নিরন্তর--
আগলে আছে সহযোদ্ধার কবর,
অঙ্গীকার তুমি এড়াতে পার না;
যেখানে দাঁড়াও রণাঙ্গণ আজ,
কোথাও তুমি পালাতে পার না।
এ সময় ধুরন্ধর--
বিশ্বাস বেঁচে খায় মুনাফেক-মেধা
ব্যর্থ নেতার টিকে থাকা উত্তরণের বাধা
ভাঙনের দায়ভার--
দ্রোহের প্রাঙ্গণে সমবেত আম-জনতার।
সামনের পথে সমানে আগুন,
জলোচ্ছ্বাস ছাড়া--
বঙ্গোপসাগরের অন্য কোনো মানে হতে পারে না।
ঢাকা ১৭.০৭.২০০২
সময়
[আমার পিতা, পানি ও মৃত্তিকার মতো স্বচ্ছ ও সর্বংসহা। অবিকল তাঁরই পিতার মতো। কিন্তু অদ্ভুত বৈপরীত্য ছিল, শক্ত হয়ে যেতেন কখনও। যেমন, আইও-কে মাত্র একশো টাকা দিলেই হতো, দিলেন না। ফলে আগাগোড়া পরহেজগার এই সরকারী কর্মকর্তাকে সাতটা বছর অনর্থক দাবড়াল আমাদের এন্টিকরাপশন। শেষে সূফী মানুষটা খালাস পেলেন এক আদালতের আদেশে। তদ্দিনে, তারিখে তারিখে হাজিরা দিয়ে, পৈত্রিক জমি বেচে বেচে, তার নিজস্ব বোঝায় ভারাক্রান্ত করে গেছেন আমাদের সবাইকে। যার সংক্রমণধারা এখনো আমার সর্বত্র। আমার নিজ গ্রাম, সোনালি শৈশবের গন্ধভরা। বড় কষ্ট হয়, আমি যেতে পারি না। মানুষে শুধায়্তমিয়ার পুত, একটা ঘর না তুললে ক্যামনে, লজ্জার কতা না? ঘর আছে, বার হাত বাই বাইশ হাত, বাঙলাদেশে আমার একমাত্র স্থাবর সম্পত্তি। বেড়া ও কাঠ উঁইপোকায় খাওয়া। অথচ এ রাষ্ট্রের বেশ উঁচু মাপের একখান চাকরি করি। সেই আমার ক্ষুণ্নিবৃত্তি হয় না সবদিন, আক্ষরিকার্থেই। সাহস করে তা জানিয়ে দেয়া হল না। আমার ভেতরে নিশ্চুপ এক গোঁজামিলের নাম বাংলাদেশ-- বিস্ফোরিত হতে চায়।]
সময়, আহারে সময় কী রকম করে বয়
শুধুই আমায় ফেলে দিয়ে চলে যাওয়া
যা ছিল নিকট তাবৎ সুদূর সকাল গড়াল কঠিন দুপুর
গ্রামের পুকুর কোথায় আমার ঝাঁপ-মেরে ডুব খাওয়া
কলার ভেলায় অভিযাত্রীরা পারাই সুয়েজ খাল
“কার পুত তুই?” “তুমি কার তবে?” “দূর ব্যাটা পয়মাল”
“দে তো ফুঁক দিয়ে কেরনের কষ্” আকাশ লুটায় হেসে
জীবনের সব স্বপ্ন আমার বুদ্বুদ হয়ে ভাসে
সময়, আহারে সময় আমার কী রকম হয়ে যাওয়া
শব্দে আজ আবেগ শাণাই দর্শনে খুঁজি ধার
মানুষের যত ইতিহাস পড়ি অপমান লজ্জার
জীবন নিঃস্ব তৃতীয়-বিশ্ব আমার বরাতে পাওয়া
প্রাণপণ খুঁজি শেষ হল বুঝি আমার সহজ হওয়া
সময়, ঘাতক সময় এখন মুখোমুখি হয়ে যাওয়া।
মুক্তিযুদ্ধ ২০০৬
উৎসর্গঃ আমার গেরিলা যুদ্ধের শিক্ষক, অম্পির আলফা কোম্পানির ক্যাপটেন চৌহান ও স্মৃতিময় সকল সতীর্থ সহযোদ্ধাকে।
সেই যে সীমানা পারায়ে--
হাঁপানিয়া জিরানিয়া অম্পিনগরে,
অতঃপর টু-ইন্চ্ মর্টারে--
মুক্তভূমির রক্তিম উদ্বোধন।
সেই টেনে আনা ইতিহাস মানুষের দিকে
আধাঁর চার্জ করে আলোর মোড়কে,
ওরা কোথায় লুকালো অকারণ।
স্বজন অরক্ষিত, এ কি অভিমান?--পিছুটান?
দিলি ঘুম কোন্ বাংকারে,--ও কি এ্যামবুশ?
তিরিশ বছর শুধু বেড়ে উঠে কবরের ঘাস,
ব্যর্থ দিগন্ত ছোঁয় বিশাল আকাশ,
কিছুই হলো না, এখানে!
জীবন ফেঁসে গেছে হায়
হিমালয় থেকে জংগল চট্টলা,
স্বপ্নের বধ্যভূমি সবাই পালায়।
সশস্ত্র কমরেড দেবতারা এসো
অজস্র ক্ষুধায় পীড়িত জনপদে,
আকাশ ছিঁড়ে রংধনু আনো রক্তে আবার আল্পনা
এখানে মুক্তির শেষ যুদ্ধ ইতিহাস গাড়ুক আস্তানা।
মোনাজাতউদ্দিন
উৎসর্গঃ আমান-উদ্-দৌলা প্রিয়বরেষু
তারপর উত্তর বাঙলায় গিয়ে দেখি--আর নেই,
অন্ধ জনপদে সেই ফ্লাশ-জ্বালানিয়া--আর নেই;
চোখের তারায় সেই আন্ধার-তাড়ানিয়া--আর নেই,--
প্রয়োজন ছিল আরো;
ইলা মিত্রের অবুঝ নাচোলে অন্ধকার নামে গাঢ়।
মোনাজাত, কী রকম ব্যর্থ আমাদের সকল প্রার্থনা;
সকল আয়োজন আর সম্ভাবনা,
কী রহস্যে পা ফস্কে পড়ে যায় এই দেশ--
বারবার।
পথ থেকে পথে নিঃসঙ্গ অবিরাম,
কে আর বলপেনে আঁকে, শিশু-শ্রমিকের ঘাম?
কার দায়, সময়ের উজানে যায় নাচোল?
অথচ কথা ছিল--আমি, দুলাল দা, আমাদের আশরাফুল--
এই যৌবন কতটা নিহত ফলো-আপ নেই কারো
চিলমারী থেকে সবখানে আজ প্রয়োজন ছিল আরো।
দুর্ভাগা বাঙলার কমরেড রিপোর্টার--
কী অমন হেরে-যাওয়া গেড়ে বসে আমাদের, বারবার
কী অমন ডোবে মাঝপথে, অন্ধকার নামে গাঢ়
আজ জ্বলে উঠবার প্রয়োজন যখন আরো।
নিউ ইয়র্ক ০৬.১২.১৯৯৮
একটি মৃত্যু
[..... এমএ শেষবর্ষের ছাত্র শেখ রকিব (২৫)-এর মৃত্যু ছিল মর্মান্তিক। অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি করা হয়। জরুরী বিভাগ তাকে রেফার করে বার্ন বিভাগে। বার্ন বিভাগ রোগীকে গ্রহণ করে নি। বলে, তাদের পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। অনেক অনুরোধ উপরোধে চব্বিশ দিন পর বার্ন বিভাগ রোগীকে গ্রহণ করে। তদ্দিনে দ্গ্ধশরীর সংক্রমণের চূড়ান্ত পর্যায়ে। রকিব মারা যায়। - ইত্তেফাক রিপোর্ট ১৫.৮.৯২]
“কোনো কোনো রক্তের দাগ কিছুতেই শুকোবার নয়”--পাবলো নেরুদা
সেই-থেকে তাবৎ নিঃসঙ্গতার সাথে কথা বলি
দুঃস্বপ্নের সাথে শুই,
এই পরভূমে মাচাঙ বেঁধে পলাতক হয়েছি-
পারি কই
কুইন্সের আকাশ ছেয়ে তোমার লাশ--
তুরাগের পার থেকে আটলান্টিক পার হয়ে
প্রতিবারই মনে হয় এই মাত্র উঠে-আসা
আমায় ছেড়ে কবরে থাকবার নয়,
কোনো কোনো রক্তের দাগ কিছুতেই শুকোবার নয়।
কখনো মৃত্যু থাই পাহাড়ের অনড় সবুজ
কখনো আগুনের গম্বুজ- উত্তীর্ণ কবিতার উপমায়
কখনো ক্ষমতার উপায় সব সেক্টরে করে চাষ-
সাধারণ লাশ আমাদের।
এই মৃত্যু আমার চাবুকমারা জীবনবোধ
ব্যর্থ করে শব্দপ্রয়াস বাইপাস প্রতিশোধ।
ও শিল্পের স্থিতি নয়, লোবানের ধোঁয়া নয়,
আরো তাৎপর্যময় জীবিত ও আত্মার-
সামাজিক সর্ম্পকের ইহজাগতিক স্তর।
সেই থেকে আধ্যাত্মিক আমি- নাড়িচাড়ি প্রতিদিনঃ
পুরনো ট্রাউজারে গায়ের গন্ধ
তার পাণ্ডুলিপি ভরা বঞ্চনা অভিযোগ,
অবিরাম শব্দের আর্তনাদ- ডায়রি
কার এত ছবি? এই মৃত্যুর দেশে কোন্ মায়া?
কোন্ মেয়ে- জানি না তো?
কোথায় সাটুরিয়া, সারি সারি সোনালু-
দুপুরের শূন্যতায় কেঁপে কেঁপে কেঁদে ওঠে কার?
সেই থেকে এইসব সাধারণ আলামত তুলে রাখি
তুলে আনি অসাধারণ নির্যাস নির্লজ্জ প্রেক্ষিতের--
একটি অন্যায় মৃত্যুর মানে
একটি সোফা কেনার জন্যে ফরিয়াদীর ফাঁসি দিতে প্রত্যহ এজলাসে ওঠা;
একটি অন্যায় মৃত্যুর মানে
কারো প্রিয়মুখের জানাজা পড়বে বলে প্রত্যহ হাসপাতালে যাওয়া;
একটি অন্যায় মৃত্যুর মানে--
পতিত শাসকের কাছে সবটুকু হেরে যাওয়া ।
এই বদ্বীপে আমি অন্যায় লাশের স্বজন
শোকের দ্রোহে করি অপেক্ষার চাষ,
আসুক সর্বনাশ--
আসুক মহামারী কষ্টের সংক্রমণে ঠিকঠাক,
শেকড়শুদ্ধ পাপের বসতি তছনছ হয়ে যাক।
ওহী
উৎসর্গঃ বছর খানেক পর বিদেশ থিকা আসলাম। একদিন গিয়া আয়েশ কইরা ডাক দিলাম-- ফকির, বাইত আছ নি দোস্ত? --জ্বি না, হেয় ত মারা গেছে। --অসুখ না, খালি কইছিল বুকটা বেদনা করে। --জ্বি না, কই কবর দিছে জানি না। --জ্বি না... জানি না। আমার বন্ধু রফিকুল ইসলাম ওরফে ফকির চাঁন মিয়া-কে।
চেতনায় আর কিছুই ঠাহর হয় না যখন
শুধুই অভ্যাসে যাপিত জীবন
এই যে এমন সুদূর সীমানা দরদি দিগন্ত
ওড়াওড়ি নেই কাকপক্ষীর ডানার সাহস
শৈশবের এক মসজিদের ঘাটলায়
একটি লাল-ফড়িঙের পিছে একটি দুপুর-
কী রকম সুদূর!
মধ্যরাত মিয়াবাড়ি কালো কুকুর প্রলম্বিত চিৎকার
মায়ের অমঙ্গল-ব্যাখ্যায় সবকিছু মিলে যায় আজ।
আমি উজ্জ্বল এক ভোরের প্রত্যাশা করলাম,
আমাদের জন্যে সূর্য প্রত্যাখ্যান করলো আলোক,
আমি ঈশানে তাকালাম--
মেঘ প্রত্যাখ্যান করল বৃষ্টির সম্ভাবনা।
কাকে ডাকি, এই শতাব্দীতে কোন দিকে ঈশ্বর?
পিতৃ পুরুষের নিয়মে ঊর্ধ্বেই তাকালাম,
অনেক গভীরে নামলাম--
লোকায় ছেড়ে পর্বতগুহা পার হয়ে, আরও...
আত্মম্ভর মানব প্রজাতির কেউ সেদিকে যায় না
আমি তাও সমস্ত হোমোসেপিয়েন-এর পক্ষে
অবচেতনের সামিয়ানায় নিস্তব্ধতার জন্যে ওঁৎ পাতলাম।
আমার পায়ের নীচে কি জমিন?
না, ওটা লিথোস্ফিয়ারের উপরিতলে কোনো আধুনিক শহরের ছুটাছুটি।
আমার মাথার উপর কি আসমান?
না, ওটা এটমোস্ফিয়ারে একঝাঁক মার্কিন বোমারুর মহড়া।
তবে কি খোদকারি নালায়েক মানুষ
নিজ বসতির চতুষ্পার্শ্বে আত্মার প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে?
আমি এস্তেকারায় বসি।
আমার মাসুম দুই ছাওয়ালের নামে
বাপজানের পুণ্যের নামে
এই বাঙলার--
অতঃপর কালো আফ্রিকা, এশিয়া ও লাতিন আমেরিকার
সকল মানব সন্তানের মুসিবতের নাজাত চাইলাম।
দীর্ঘ স্তব্ধতার পর রূঢ় সতর্কবাণী--
‘ওয়াল্ আছ্রে ইন্নাল্ ইন্সানা লা ফি খুস্ রে’
আসরের কসম, নিশ্চয় মানবজাতি ক্ষতির গহ্বরে নিমজ্জিত!
‘আমি কি অতীতে পানির প্লাবনে
বিশাল পর্বত-ঘর্ষণে জনপদ বিধ্বস্ত করিনি!’
আশি হিজরির পর কী হবে মানুষের?
আল্লার রসুল নাকি ভাবনায় পড়ে যেতেন।
মা বলে তা-ই দেখ্: খান-এ-দজ্জাল আজ ঘরে ঘরে
উঠানে আসমানে, মানুষ কতল করে
নিশ্চিত গজবের আলামত;
বাবাঃ দজ্জালের মোকাবেলা আজ মানুষের দায়
তুমি--তোমরা, পুণ্যবান সব মানুষ জড় কর,
ভালো করে ডাক দেও, সময় বেশি পাবা না।
নিউ ইয়র্ক ০১.১১.১৯৯৮
বানের আওয়াজ
উৎসর্গ : ঝিটকা, দৌলতপুর, মানিকগঞ্জ, ধামরাই সাটুরিয়ায় ফি বছর বানভাসি মানুষ।
আয়, হায়াৎ মউতের মালিক
এ কোন জনপদ, এ কোন ভুলের কারুকাজ
আন্ধার-করা আসমানে বানঝিলকির আক্রোশ--
কার পাপ?
এখানে জন্মে নাই ফিরিসতার মতো স্বচ্ছ
আমার পিতা প্রপিতামহ?
দেয় নাই পাঁচ-অক্ত আযান মিম্বর কাঁপাইয়া;
আজো ওঠে না কালি-আন্ধারে গ্রামের ফতু মিয়া--
সাতপুরুষ ধরে?
সর্বনাশের শেষ কিনারায় এই দেখ
আমারই বুকের মতো আমারই ভিটি ভাঙে
মানে না দোহাই,
আজিমনগর-ঝিটকা-সুতানড়ি-আন্ধারমানিক
আন্ধারের কিনারা নাই।
কার পাপ?
কে না জানে রাজনীতি কার নাম
সংরক্ষিত মুর্দার লাগি জেদাজেদি খেল্
আর বানের তোড়ে হাজার জীবন অবহেলায়
ডাঙর ছাওয়াল তলায়ে গেল বাঁচামরায়
শেষরাতে কান্দে বাপ আরিচা সড়কে,
জিগাও, তার বুক ছেয়ে থাকে কোন মড়কে?
সব মরণ সমান আহাজারি দাবি করে আজ,
দাবি করে আরো কিছু, যদি শোনো বানের আওয়াজ
চারপাশে ঘিরে ঘিরে ফুসলায়--
তুরাগে
পদ্মায়
কালীগঙ্গায়।
নিউ ইয়র্ক ১৬.১৮.১৯৯৮
কবিতা লিখি না আমি
[উনিশ শ চুরানব্বই। দুর্ভিক্ষপীড়িত সুদান। লাগাতার অনাহারে হাড়-চামড়া এক হয়ে যাওয়া একটি শিশু হামাগুড়ি দিয়ে এগুচ্ছে। গন্তব্য, এক কিলোমিটার দূরে, জাতিসংঘের লঙ্গরখানা। অদ্দুর হয়তো যাওয়া হবে না তার। অদূরে একটি শকুন বসে আছে কখন শিশুটি মারা যাবে, এবং কখন এটিকে খেয়ে তৃপ্ত হবে। শিকার ও শিকারীর এই যুগল ছবি নিউইয়র্ক টাইমস্-এ প্রকাশিত হলে পুরো বিশ্বকে তা নাড়া দিয়েছিল। শ্রেষ্ঠ ফটোগ্রাফার হিসাবে পুলিৎজার পুরস্কার পায় এই ছবির সাংবাদিক কেভিন কার্টার। কিন্তু শত শত মানুষ পত্রিকার অফিসে জানতে চায় শিশুটির কী হল? কেউ তা বলতে পারে না। পুরস্কার পাবার তিন মাসের মাথায় কেভিন অনুশোচনায় আত্মহত্যা করে- কেন সেদিন ওই শিশুটিকে সে উদ্ধার করে নিয়ে আসল না?]
নিঃসঙ্গতায় যদি না পাই তোমাকে
মিছিলে সংগ্রামে স্মরণে না পাই পঙ্ক্তিমালা,
আমিও ক্ষোভিত বাঙালি কবির মতো
তোমাদের মুখে থুতু দিই।
মেধার পুরিন্দায় নেশা করে সারাবেলা
বোদলেয়ারের ঘোড়ায় চড়ে রমণীরঞ্জন খেলা
লাগামহীন লিবিডোয় আধুনিক শিল্প গড়ো
জীবনের দায় এলে ঝিম্ মারো--
এই লোকালয়ে ফিরবে না আর?
আমি যে উপোসের কথা চেপে রাখি
আমি যে সৌদি-কাতারে জেলের লকারে পড়ে থাকি,
আমি এই ন্যুয়র্কের উজ্জ্বলতম বাত্তির নীচেও আন্ধার--
কিছুই বোঝো না তার?
তুমি এই শতাব্দীর কেউ নও?
ছিল না স্বজন কেউ আমারি মতো--
ঘর আছে আশ্রয় নেই
রাষ্ট্র আছে ভরসা নেই
সভ্যতা আছে আমি নেই
আজো গুহামানব আমি, নিকুচি করি মহামানবের--
বহুজাতিক বজ্জাতির স্বদেশী পয়গম্বর যত
মানি না পূত মিনার কিংবা প্রেরিত বাণী
ক্ষুধার যখমে শাণিত যখন।
আমার ভূমণ্ডলে সার্বভৌম শুধু একথালা ভাত--
লুট হয় বারবার,
তুমি ছেনাল সৌজন্যে বারেক ঘাড় ফেরাও,
অতঃপর, নিজের ভুবনে চলে যাও ।
কোথাও পাবে না পার
যদি না বাঁচি এবার--মঙ্গায় খরায় অথৈ বন্যায়,
সোনালি সুখ হারাম করে দিয়ে যাব;
কবিতা লিখি না আমি---
বহু দুঃখে গলে গলে এইসব লানৎ বর্ষণ করি।
নিউ ইয়র্ক ০৫.০৮.১৯৯৮
মানবায়ন
উৎসর্গ : সেই মার্কিন বৈমানিক। ভিয়েতনামে বোমা ফেলতে অস্বীকার করেছিলেন যিনি। তাকে ‘রোগমুক্ত’ করতে মানসিক থেরাপি দিয়েছিল মুক্তবিশ্ব।
উত্তীর্ণ হবার প্রক্রিয়া যন্ত্রণায় ছট্ফট্
সামান্য আলো তীক্ষ্ণ বর্ষাফলকে গাঁথা
গুহাজুড়ে অন্ধকারে খুঁজো তারে একা।
মানুষ উত্তীর্ণ হয় নিজের ভেতরে যখন--
মানুষের ইতিহাসের অতিক্রমণ হয় তার ভেতরে
এই বেড়েওঠা ভাঙচুর ব্যাকরণে নেই।
তোমার ব্যর্থতায় জগতে জন্মায় সংহত শক্তি
তোমার সফলতা সম্ভব করে ভ্রূণ পদক্ষেপ
কষ্টের বয়লার যোগায় সৃষ্টির উত্তাপ
আপন স্নায়ুর পীড়নে না পুড়ে প্রজ্ঞা,
তোমার মেধায় জগতে ক্ষরণ হবে,
নাগাসাকিতে আবার বিস্ফোরণ হবে।
নিয়মেরই সভ্যতা তবু নিয়ম মানে পাভলভের কুত্তা
আর নিয়ম ভাঙে মানুষ।
মুখ্যু নই
উৎসর্গ : সলিমুল্লাহ খান বন্ধুবরেষু
“সংগ্রামই সুন্দর/সংগ্রামই সত্য/এ ছাড়া আর/সবই ভুল তত্ত্ব।”
অমর্ত্য কী আনন্দ তুমি মর্ত্যধামে
কী করে বুঝাই
তুমি বাঙলার ছাওয়াল, মনে টের পাই।
আমি উত্তর বঙ্গের হায়াত আলি
এই ধরো নাচোল, নাটোর কিবা চিলমারি,
মোক বাড়ি--হারভাড থেকে বেশি দূর নয়
যদি হাঁটা দিই কোনাকুনি।
তয়, এখানে হিসাব অন্য কিসিমের
হপ্তায় দুইখান দুর্ভিক্ষ--তেতাল্লিশ ও চুয়াত্তর।
মড়কের সিজন নাই,--মরে ফি বছর,
আমি মরি নাই, যদিও বিনাশ গেরস্থালি
নামের বরকতে, নয় অভাবের বেদিশায়
হামেশা অলৌকিক কিছু ভাবি খালি--
একদিন বাঙলার ভাতের অভাব বাপ্ বাপ্ করে
চিরতরে হবে দূর
পুণ্যাত্মার উছিলায় কী না হয়!
অত মুখ্যু নই, যত ভাবে লোকে
ফের নামে যদি আকাল অভাবী ছাওয়াল--
লয়ে উঠব তোমার হারভাড মুলুকে
অত মুখ্যু নই, যত কয় লোকে।
মাফ করো-- এই হায়াত আলি
আক্কেলের দোষে দিছি গালি--
পুঁজিবাদ নষ্টের মূল
অহন ভাঙে ভুল আপনার বরাতে;
চিন্তায় কী রোশনাই--গণতন্ত্রে ক্ষুধা নাই,
শুকরের খোঁয়াড়েও আমাদের লোক,
বুঝি নাই--
বিত্তের চিত্তেও বাজে আমাদের দুখ্
অমন তত্ত্ব অমর হোক
নিউ ইয়র্ক ২৫.১২.১৯৯৮
দুঃসময়ে ভাষণ
বন্ধু সভাপতি ও রণাঙ্গনের সাথীরা--
আমি, এইট-এইট নাইন-নাইন, সেলফ্-লোডেড্ রাইফেল,
সেলফ্-কমিটেড এফ্-এফ্।
সাকিনঃ সালদানদী, জনযুদ্ধের ফ্রন্ট লাইন --
ভিয়েতনাম থেকে একাত্তর, চিলি থেকে চিয়াপাস,
মুক্তির রণাঙ্গণে সর্ববিদ্যমান;
বয়সে হো চী মিন--
আমি চিরায়ত আটাশ কি পঁচিশ।
আপনারা জানেন, স্মৃতিচারণ অসম্ভব আজ
আমার অস্তিত্ব ঘেরাও দিয়েছে অস্ত্রবাজ,
আবার বিপন্ন এই দেশ, ক্ষোভে বিনিদ্র আমি
দুঃস্বপ্নে গ্রেনেডে শব্দে জেগে-ওঠা লাশের কণ্ঠ--
আমি আক্রান্ত, কে তুমি?
কে আমি!
আমি কি দিইনি আমার জীবনের ঝুঁকি?
পর্যাপ্ত দুঃসাহস সৃষ্টির অঙ্গীকার,
সশস্ত্র উপমায় উত্তীর্ণ কবিতায় দিইনি উত্তাপ
অতঃপর--
রাষ্ট্রক্ষমতা,--নীরবে ছেড়ে গেছি কথামতো
ছেড়েছি জীবনের দাবি আম-জনতার মতো
আমারই পাপ--এই অনিচ্ছা সমর্পণ,
এই তিন দশকের রাজনীতি লুণ্ঠন
অন্যায়-লাশ লাগাতার সন্ত্রাস,
কার স্বার্থে কাড়াকাড়ি?
এ রাষ্ট্রে--এ আমারই বুকে অন্ধকারে চাঁনমারি।
প্রতিদিন টার্গেট আমি--
একটি ভাস্কর্যে আঘাত হয়
আমার সর্বাঙ্গ যন্ত্রণায় ভাঙে,
সহিষ্ণু মৃত্তিকার প্রতিমা ধর্ষিতা হয়
আমি ঠেকাতে পারি না,
অভাবী যুবক নষ্টরাজনীতির লাশ হয়
আমি লজ্জায় লুকাতে পারি না,
প্রকাশ্য দিবালোকে খুন হয় মুক্তিযোদ্ধা
আমি স্থির থাকতে পারি না।
বন্ধুগণ--
দুর্যোগের প্রহরী চূড়ান্ত প্রতিনিধি ক্ষমতার--
আমাদের ছাড়া অবৈধ সকল হাতিয়ার,
নিঃশর্ত সমর্পণ চাই
অতিষ্ঠ সময়ের সংকেত দিয়ে যাই।
আমি আগুনের অগ্রজ সন্তান বাঙলার--
সাতান্নর বিদ্রোহী সিপাহী ফাঁসির রজ্জুয় উত্তীর্ণ,
চট্টলায় পটাশিয়াম সায়ানাইডে ধরেনি,
জেনারেল ডায়ারের গুলিতে মরিনি,
হায়েনার মুরুব্বিরা নোয়াতে পারেনি--
একাত্তরে।
রণাঙ্গনের বন্ধুরা,
মুক্তির সপক্ষের মানুষ ও
প্রিয় প্রজন্মের সন্তানেরা--
আজ এমন কিছু দেখি, যার সপষ্টোচ্চারণ দেখি না
আমি শংকিত, সংহত প্রতিরোধ দেখি না;
সমেমলন ডাকো, যেন গাঢ় না হয় অন্ধকার
সময় প্রস্তুতি চায়--
সবার,
আর একবার।
মাননীয় সভাপতি, এখনো আপনার সময় হয় নি?
পশু
উৎসর্গ : প্রত্যয় শেখ
এখানে ফল্ অর্থাৎ বসন্ত এখন--
সিমেট্রির গা ছুঁয়ে চলে যাওয়া সড়কের পাশে দূরে
লালে আগ্নেয়-হলুদে স্মৃতির তীব্রতায়--
তোমাদের ঘ্রাণ,
এই ছোট্ট বিঙহামটনে আমার অনুসন্ধান--
এইতো রবার্ট স্ট্রিট, সেনাঙো পেরিয়ে অস্টানেঙো--বারবার
অজস্র পরিপাটি ক্রস এতো কার--
এই শহরের উপরিতলে?
বোঝাই যায় না নেপথ্যে এতো লাশ,
ক্যালিওগ্রাফে উঠে আসে অভিবাসনের ইতিহাস--
কয়েক শতাব্দীর পোড়খাওয়া কণ্ঠ :
এখানে ফল্ অর্থাৎ--পতন এবং পতন অতএব পতন।
আফ্রিকান আইরিশ লাতিনো ইতালিয়ান
নৃতত্ত্ব হয় না পতিতের-- আত্মার পোস্টমর্টেমে একই ছাপ--
মৃত্যুর একই ভাষ্য, একই অপমানদাহ
একই পশুর সাথে বোঝাপড়া, ভেতর থেকে ছিঁড়ে-নেয়া
আমার সন্তান,--কত দূরে--
গোমতী অবিরত গোঙায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে পিতার কবর
সে-ই আমাদের শেকড়-- একান্ত পরিচয়।
তবু আটলান্টিকের এই পাড়ে আমি--
ইতিহাসের শেষ চালান--ন্যুয়র্কের নওল ক্রীতদাস
এ্যাই দ্যাখো--মেটাল ফ্যাকট্রিতে আমার হাত অবশ,
শেষরাতের ক্যাবে শহরের তাবৎ মাতাল ঘরে পৌঁছে যায়
বিনিময়ে রোজ পাঁচশবার উষ্টা খাওয়ার স্বাধীনতায়
সভ্যতার নিয়ম মেনে
যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় লীজ দিয়ে
অতিশ্রম-পঙ্গুতায় মেরুদণ্ড বন্ধক রেখে
তোমাদের জন্যে স্বপ্ন কিনতে এসেছিলাম;
হাডসন, প্রতারক হাডসন, পারে পারে তার--
স্বপ্নের পোড়া গন্ধ আমার।
পশুর বিস্তার ক্রমেই
জরায়ুর গভীরে নিভৃতে অন্দরে---
যেখানে যা কিছু নিংড়ায় প্রাণ;
এ আমার হেরে যাওয়া সভ্যতার ব্যর্থতার সমান।
লড়ে যাব--
তবু হারাই যদি, কিম্বা যা কিছু আমার
দিগন্তে না উঠে সূর্য সম্ভাবনার।
দেখে নিও, কুয়াশা সরায়ে পার যদি--
এম্পায়ার স্টেট-বিল্ডিঙের আকাশছোঁয়া সাম্রাজ্যে
কার নাম পতিতের অপমানে বিদ্ধ ছিল?
সাসকোহেনা হাডসনের জলপ্রবাহে
কতটা স্বপ্ন লুথারীয় বিভ্রান্তি ছিল?
এই অভিশপ্ত অভিবাস বন্ধন ছিঁড়ে-নেয়া সন্ত্রাস
কতটা গভীরে হানা দিয়েছিল?
নিউ ইয়র্ক ৭.১১.১৯৯৯
টেন এলিভেন
( “...শিশুদের আতংক, চিৎকার নিষ্ঠুরতা সম্পর্কে যে তথ্য উপস্থাপিত হইয়াছে তাতে প্রতীয়মান হয় যে এক্ষেত্রে সীমা লঙ্ঘন করা হইয়াছে।... এটা সুস্থতা ও সদুদ্দেশ্য প্রতীয়মান করে না ” --নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইবুনাল নং ৪, ঢাকা ৩০.৩.২০০৩ (৩৩/২০০৩)
( “...শিশু দুর্জয় ও প্রত্যয় শেখকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বিদেশে যাইতে না পারে কর্তৃপক্ষ ব্যবস্থা নিবেন।... আদেশানুলিপি ভিসা অফিসার মার্কিন এ্যামবেসিকে দেওয়া হউক।... শিশুদের নিরাপত্তা সম্পর্কে অত্র আদালত উদ্বিগ্ন আগামী ৭২ ঘণ্টার মধ্যে শিশুদের উদ্ধারপূর্বক অত্র আদালতে প্রেরণ করবেন।”--সিএমএম আদালত ঢাকা, (৪৬৯১/২০০১)
¨ “Children were taken to USA in total violation of the court order...directed to produe Prottoy and Dorjoy to this Court”—Supreme Court of Bangladesh. (Ruling dated 20.01.2002 Cr. Misc 9590/2001)
¨ “কোন উপযুক্ত আদালতের সপষ্ট নির্দেশ ছাড়া কোনো শিশুর স্থানান্তর, অন্য কোনো দেশে নিয়ে যাওয়া, এমন কী তা যদি মা-বাবাও করে থাকে, তা অপহরণ, অবৈধ ও শাস্তিযোগ্য...।” --জাতিসংঘ চাইল্ড রাইট কনভেনশন, অনুচ্ছেদ ১১।
¨ “The local people... had never seen such brutal treatment of children” —Ain Adhikar Trust. Investingation Report dated.02.02.02.
উপর্যুক্ত তথ্যসমূহ এই নির্মম চিত্র উপস্থাপন করে যে, দু’টি শিশুর উপর সন্ত্রাসী হামলা চালানো হয়। শিশুদের আতংক, চিৎকার ও কৃত নিষ্ঠুরতা যে কোনো সুস্থ মানুষকে অসুস্থ করার মতো। কতিপয় দুর্বৃত্ত এই সন্ত্রাস সম্পন্ন করেছে। এতে বিদেশী মদৎ ছিল, যেমন থাকে। এবং হামলা ও মানবাধিকার সম্পর্কে এদের নিজস্ব সংজ্ঞা আছে যা সুবিধামত তৈরি করা। যা দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইন এবং মানবতার লঙ্ঘন। নাইন-এলিভেন হামলায় আমি প্রলয়ের ভাঙচুর, মৃত্যুর ছুটাছুটি, স্বজন-হারানোর আর্তনাদ দেখেছি। আমার অস্তিত্বের ভুবনে টুইন টাওয়ারের মতোই উচ্চকায় দুটি শিশুর জন্যে একই রকম আর্তনাদ ভাঙচুর হচ্ছে। বর্বরতার মানে অন্যের বিনাশ বুঝতে পারার অক্ষমতা। সন্ত্রাসের ব্যাকরণ সর্বত্রই অভিন্ন। দেশে বিদেশে বিভিন্ন সংস্থায় আমার সন্তানদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপনে যারা বিভিন্নভাবে সহায়তা করছেন তাদের.....]
টেন এলিভেন-- মাত্র ত্রিশ দিন পর,
ওরা আবার হামলে পরে
গ্রাউন্ড জিরো : অনগ্রসর দেশ এক মফস্বল শহর
দুটি অবুঝ শিশুর বসত ঘর।
মানুষের জান কবজে ওরা দক্ষ অমানুষ
অতর্কিত আক্রমণ দিগ্বিদিক ছুটাছুটি
নরকের গুহায়
মৃত্যুর মুখোমুখি জীবনের অভিন্ন দায়
নিরন্তর সাইরেনে পৃথিবী আর্তনাদ করেছে সেদিন।
কিন্তু আমাদের ছোট্ট শহরে সিএনএন ছিল না।
আমাদের উপেক্ষিত স্নায়ুর জন্যে কভারেজ ছিল না,
শুধু নিজস্ব নিয়মে পৃথিবী দেখল বর্বরের অভিন্ন আলামত---
দোমড়ানো এরোপ্লেন, পরিত্যক্ত জুতো-পোষাক
ইমারত-ভেঙে-পড়া লেগোর স্তূপ নিয়ে
এই শহর হতবাক দাঁড়িয়ে আছে
শুধু আমার অস্তিত্বের সমান টাওয়ার দুটি নেই।
এবং সব্বাই নিশ্চুপ, জবাব নেই;
বস্তুত আক্রমণের সঙ্গত ব্যাখ্যা দিতে না পারাই সন্ত্রাস।
আমাদের স্বরাষ্ট্র বললেন
: মার্কিন এ্যামবেসির দোষ, ওদের ধরেন
হ্যালো--এ্যামবেসি ঢাকা,
: আস্ক্ ইউর গভর্নমেন্ট অর ওয়াশিঙটন
হ্যালো ওয়াশিঙটন?
: আস্ক ফর মিসিং চিল্ড্রেন হোম অর আওয়ার এ্যামবেসি ইন ঢাকা
হ্যালো লরা এলিস, হোপ চাইল্ড হোম--
ওরা বাবা বাবা বলে কাঁদছিল, খেলনা-জুতো সব ফেলে...
: উই কান্ট হেল্প ইউ, স্যার।
আহা ঘুমাচ্ছিল... হঠাৎ আক্রমণ... ট্রমায়... না, শুধু কথা বলব।
: উই কান্ট এলাউ ইউ, স্যার।
আহা! এরা কি সুস্থ? আদৌ জীবিত?
: ইনফরমেশন সিল্ড অফ, স্যার।
আমি বাবা... ইট্স মাই রাইট
: সরি, স্যার।
প্রিয় সন্তানেরা--
প্রতিদিন আমি দুটি মানব সন্তানের মুখ খুঁজি,
প্রতিদিন আমি অসংখ্য জন্তুর সাক্ষাৎ পাই-
দেশী পুলিশ, বিদেশী এ্যামবেসি, ওয়োগো অনাথ-আশ্রম,
রাজনেতা-আমলা-নরকের কীট, ন্যান্সি থেকে টম।
চোখ অবসন্ন পা অবশ তাও চলতে চলতে
ফ্ল্যাশব্যাকে লেক্সিঙটন এভিন্যুতে দাঁড়াই--
দেয়ালজুড়ে শত হারানো মুখের খুঁজাখুঁজি এতো কার?
এখন যে কোনো কষ্টের আমি চিৎকার
এখন যে-কোনো নিখোঁজ আমার সন্তান
যন্ত্রণার বিস্তারে আমি সভ্যতার সমান!
আমার সন্তানেরা--
তুমি আমি জঙ্গল-সভ্যতার সেতু পারাচ্ছি--
আমাদের বেদনার সংযোগ ব্যর্থ, অস্ত্রের ভাষা নিশ্চিত
আমাদের নিরাপত্তা বিতর্কিত, অপমৃত্য অবিসংবাদিত।
সন্ত্রাস ও মানবতার একই ঠিকাদার ওরা--
তোমাদের গ্রেফতার করেছে : মঙ্গলের জন্যে।
অপহরণ করেছে : মুক্তির জন্যে।
সুস্থ শিশুকে খোঁয়াড়ে রেখেছে : ওটা শিশু-অধিকার।
জনকের কণ্ঠস্বর নিষিদ্ধ করেছে : ওটা মানবাধিকার।
সভ্যতা এখন পশুর গুহায়
স্রেফ আপন জখমে অন্ধ ক্ষিপ্ত
অন্যের প্রাণ বিনাশে নির্বিচার নির্লিপ্ত;
বিপন্ন অন্ধকার, তবু হাত বাড়াবার
এখনই সময়।
অনুভব
কোথাও পর্যাপ্ত অক্সিজেন নেই,
নিঃশ্বাসে ট্রাফিক-জ্যামের অস্বস্তি।
নিষ্পাপ কিশোরী অকস্মাৎ ধর্ষিতা
শয্যা ছেড়ে পৃথিবী ধূমায়িত দেখে
আবার উবু হয়ে পড়ে থাকে নিঃসাড়--
আমিও যেমন।
দুর্দশা দেখে কার্ল মার্কস পালিয়েছে
ফ্রয়েড ইয়ার্কি মেরে হাসছে
ঈশ্বর এজলাসে বিব্রত বোধ করছেন।
বিবর্তনের স্নায়ুরা মগজে বিদ্রোহ করে
ভাঁজ করে দেয় সভ্যতার গোয়েন্দা বাস্তব,
লেজে গোবর-পাওয়া ডোরার মত আমি
ধ্বংসের ভেতরে সম্ভাব্য অস্তিত্ব।
অথচ এই সেদিন অবলীলায় শালিকের
বাচ্চাকে পানিতে চুবিয়ে মানবতা শেখালাম,
আজ রানুর কামিজের সেপ্টিন ছাড়াতেও
আমার খট্কা লাগে।
লুইস মর্গানের আদি সাম্যবাদের পাপহীন সংগম নেই
আগত সাম্যবাদের নিশ্চয়তা নেই
মাঝপথে নারী পুরুষের প্রতিষ্ঠান মাড়াতে মাড়াতে দেখি
ও মরেও না ছাড়েও না, পরে জানলাম--
ওখানে আসলে কেউ থাকেও না।
ইচ্ছে ছিল মহান মৃত্যুর, সম্ভাবনা নেই,--
বলিভিয়ায় ঝুঁকি নেবে না এখন চে গুয়েভারা,
ভিয়েতনাম কিশোরীর বুক বিস্ফোরকের সেফ্টি ফিউজে বাঁধা
এখন শুধুই স্তন--
মলাট ঘেটে মাও-এর বইয়ের মতো ফেরৎ দিয়ে যাই।
আমি চাই না, তবু
উজাড়-করা উলাউঠায় মরি যদি,
একশো কিম্বা এক হাজার বছর পর
খুঁজে পাও আমার কবর,
ইচ্ছে হলে জুতো ছুঁড়ে দিও--
কিম্বা মরণোত্তর কোন ফায়ারিঙ স্কোয়াডে।
আমার অস্তিত্ব আজ প্রেক্ষিত-ভারাক্রান্ত,
পৃথিবী বাঁক ফিরছে না গোল্লায় যাচ্ছে?
এই মুহূর্তে আমি তার কিছুই জানি না
আমি আর কী বলতে পারি?
ঘুমায় মাতামুহুরী
[সাংবাদিক শেখ বাছেত। এই পরিচয়ই তার নেশা। নিজ পিতৃভূমি ছেড়ে অনেক দূরে চকোরিয়ায়, বিশ বছর। স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক, ক্রাইম রিপোর্টার, প্রতিনিধি ইত্যাদি। বললাম, ক্ষান্ত দে। সহোদর ভাবল, আমি তার পেশা-পরিচয় ছোট করে দেখছি। যোগাযোগ রাখতো না। খবর পেতাম- প্রাণনাশের চেষ্টা, লোহার চেইনে পিটিয়ে জখম...। ডেটলাইন : ৮ নভেম্বর ২০০৪। বিকেল-সন্ধ্যায় কারা ওকে ডেকে নিয়ে যায়। পরদিন আসে লাশ। হার্ট ফেলিওর? তাহলে মুখে রক্ত কেন? এ দেশে এসব তলিয়ে দেখবে কে? এই বছরের পরিসংখ্যানে শারীরিক আঘাত ৯৬ জন, হুমকি ১৭৫ জন, গত ছয় বছরে খুন ১২ জন। খুনের চে নির্মানবিক হাত-পা থেঁতলে পঙ্গু করা। রিপোর্টারদের জন্যে পৃথিবীর সবচে বিপদজনক স্থান বাঙলাদেশ। এইমত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার। --সিপিজে, আইএফজে, আরএসএফ।]
কতবার বলেছি চলে আয়
পাপে উন্মাদ নদী আপন প্রবাহে ভাঙে পার
উজানে আন্ধার তাড়াবার এ নেশায়--
কাজ নেই--চলে আয়।
লামায় পাহাড় কেটে অরণ্য উজাড়,--তোর কী?
কোন আয়েশার খোঁজ নেই, লাশ কার? --তোর কী?
কার অস্ত্র চালান যাবে ভোর রাতে,--তাতে তোর কী?
হারবাঙে কিছু হলে জুম-পাহাড়ীর--তোর কী?
রাষ্ট্র ছাই আছে কিবা নাই? তার কোন্ স্তম্ভের অধিকার--
রাষ্ট্র করে শাসকের জারিজুরি--জীবন জীবিকার।
তোর চোখকানখোলা-তত্ত্ব আমূল তুলে ফেলা যায়
পেশা নয়, পিষে মারার অধিকার সার্বভৌম
প্রাক-সভ্যতার স্তর থেকে আসে ক্রোধ--
তোর লাগি প্যাকেটে কাফন;
বেধড়ক-- ব্যান্ডেজ--শুয়ে-থাকা আজীবন,
কিংবা স্রেফ লাশ-- তোরই কাগজের সাব হেডলাইন।
ও আমাদের কেউ নয়--
হয়তোবা কারো কিছু
মাতামুহুরীর পারে নির্জন অজ্ঞাত লোকেশনে--
ঘুমায়--
পাশ দিয়ে ছাপাবার কতকিছু যায়--
কতদিন রিপোর্ট হয় না তাঁর।
হয়ে গেছে সহকর্মীর কয়েক কলাম--
মানিক টিপু স্বপন--হতে পারে যে কোনো নাম,
মফস্বল সংবাদের যে কোনো নদী--স্মরণীয় কিছু নয়,--
ঘুমায়--
ছোট শিশুটার ভুল হয়ে যায়।
‘এই দেশ এই তার রূপ ইতিহাস
এই আমি এই তুমি মানবতা পরিহাস!’
০৯.০৫.২০০৬
ঘুমায় মাতামুহুরী
[সাংবাদিক শেখ বাছেত। এই পরিচয়ই তার নেশা। নিজ পিতৃভূমি ছেড়ে অনেক দূরে চকোরিয়ায়, বিশ বছর। স্থানীয় পত্রিকার সম্পাদক, ক্রাইম রিপোর্টার, প্রতিনিধি ইত্যাদি। বললাম, ক্ষান্ত দে। সহোদর ভাবল, আমি তার পেশা-পরিচয় ছোট করে দেখছি। যোগাযোগ রাখতো না। খবর পেতাম- প্রাণনাশের চেষ্টা, লোহার চেইনে পিটিয়ে জখম...। ডেটলাইন : ৮ নভেম্বর ২০০৪। বিকেল-সন্ধ্যায় কারা ওকে ডেকে নিয়ে যায়। পরদিন আসে লাশ। হার্ট ফেলিওর? তাহলে মুখে রক্ত কেন? এ দেশে এসব তলিয়ে দেখবে কে? এই বছরের পরিসংখ্যানে শারীরিক আঘাত ৯৬ জন, হুমকি ১৭৫ জন, গত ছয় বছরে খুন ১২ জন। খুনের চে নির্মানবিক হাত-পা থেঁতলে পঙ্গু করা। রিপোর্টারদের জন্যে পৃথিবীর সবচে বিপদজনক স্থান বাঙলাদেশ। এইমত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার। --সিপিজে, আইএফজে, আরএসএফ।]
কতবার বলেছি চলে আয়
পাপে উন্মাদ নদী আপন প্রবাহে ভাঙে পার
উজানে আন্ধার তাড়াবার এ নেশায়--
কাজ নেই--চলে আয়।
লামায় পাহাড় কেটে অরণ্য উজাড়,--তোর কী?
কোন আয়েশার খোঁজ নেই, লাশ কার? --তোর কী?
কার অস্ত্র চালান যাবে ভোর রাতে,--তাতে তোর কী?
হারবাঙে কিছু হলে জুম-পাহাড়ীর--তোর কী?
রাষ্ট্র ছাই আছে কিবা নাই? তার কোন্ স্তম্ভের অধিকার--
রাষ্ট্র করে শাসকের জারিজুরি--জীবন জীবিকার।
তোর চোখকানখোলা-তত্ত্ব আমূল তুলে ফেলা যায়
পেশা নয়, পিষে মারার অধিকার সার্বভৌম
প্রাক-সভ্যতার স্তর থেকে আসে ক্রোধ--
তোর লাগি প্যাকেটে কাফন;
বেধড়ক--ব্যান্ডেজ--শুয়ে-থাকা আজীবন,
কিংবা স্রেফ লাশ- তোরই কাগজের সাব হেডলাইন।
ও আমাদের কেউ নয়--
হয়তোবা কারো কিছু
মাতামুহুরীর পারে নির্জন অজ্ঞাত লোকেশনে--
ঘুমায়--
পাশ দিয়ে ছাপাবার কতকিছু যায়--
কতদিন রিপোর্ট হয় না তাঁর।
হয়ে গেছে সহকর্মীর কয়েক কলাম--
মানিক টিপু স্বপন--হতে পারে যে কোনো নাম,
মফস্বল সংবাদের যে কোনো নদী--স্মরণীয় কিছু নয়,--
ঘুমায়--
ছোট শিশুটার ভুল হয়ে যায়।
‘এই দেশ এই তার রূপ ইতিহাস
এই আমি এই তুমি মানবতা পরিহাস!’
০৯.০৫.২০০৬
পারবে কি পাশ কেটে চলতে?
[উনিশ শ একাত্তর। অপারেশন সার্চলাইট- পাকিস্তানি শাসক কর্তৃক নিজ রাষ্ট্রের পূর্বাঞ্চলের অপ্রস্তুত নাগরিকের ওপর পূর্ণাঙ্গ সামরিক আক্রমণ। একদিকে দেশের ভেতরে নির্বিচার গণহত্যা, নারীধর্ষণ, জনপদে অগ্নিসংযোগ--প্রতিক্রিয়ায় গণযুদ্ধ, প্রতিবেশী ভারতে শরণার্থী মানুষের খাদ্য-পানীয়-অস্তিত্ব সংকটের ভয়াবহতা। অন্যদিকে, বিশ্বব্যবস্থার বৈদেশিক নীতির দেউলিয়াত্বে আবদ্ধ অধিকাংশ রাষ্ট্রশাসকের নির্লিপ্ততা। এই দুর্যোগ সংক্রমিত হয়েছিল মার্কিন শিল্পী জর্জ হ্যারিসন (১৯৪৩-২০০১)-এর অনুভবে। বন্ধু রবি শংকরের উদ্যোগে সহশিল্পীদের নিয়ে আয়োজন করেছিলেন চ্যারিটি অনুষ্ঠান দ্য কনসার্ট ফর বাঙলাদেশ। স্থান : ন্যুইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেন। দর্শক চল্লিশ হাজার। তাৎক্ষণিক অর্থ-সাহায্য এসেছিলো ২ লক্ষ ৫০ হাজার ডলার। সে অ-নে-ক। কনসার্ট-এ্যালবামের সমাপ্তির গানটি সহজ ভাষায় হ্যারিসনের স্বরচিত। তার আবেগী কণ্ঠে উপস্থাপিত। রক সংগীত উত্তীর্ণ হয়েছিল শক্তিতে, অতঃপর ইতিহাসে। এখানে তা-ই বাঙলায়িত এবং প্রয়াত শিল্পীর সমমানে নিবেদিত। শিরোনামটি আমার দেয়া।]
এক বন্ধু আমায় এসে বলল--
কী বেদনায় চোখ তার জ্বলল
দেশ তার ধ্বংসের মুখোমুখি
কিছু করবার আমাদের নেই কি?
সেই কষ্টের পরিমাপ জানি না
জানি শুধু এড়াতে তা পারি না
আজ এসেছি তাদের কথা বলতে
পারবে কি পাশ কেটে চলতে?
মানবতা নিপীড়নে নিঃশেষ
বাঙলাদেশ, বাঙলাদেশ।
এই মৃত্যুর বিস্তার অগনন
নিমেশেই নিশ্চিত নিদারুণ
আমি কখনো দেখিনি এর পরিধি।
একবার তুমি যদি ভাবতে
হাত বাড়াবার কাজে লাগতে
মুক্তির লাগি কতো প্রাণ শেষ!
বাঙলাদেশ, বাঙলাদেশ।
গণহত্যার ইতিহাসে নেই উপমা
এর বিভীষিকা কিছুতেই আমি বুঝি না
তুমি যদি একবার বুঝতে
পারতে কি পাশ কেটে চলতে?
আমি চাই--তুমি চাও এর শেষ
বাঙলাদেশ, বাঙলাদেশ।
হতে পারি তুমি আমি বহুদূর
গণদুর্যোগে আমরা কি নিষ্ঠুর?
পারবে কি পাশ কেটে চলতে?
দেখে ক্ষুধার আগুনে শিশু জ্বলতে
ত্রাণ চায় এই দায় আমাদের--
লাঞ্ছিত মানবতা এই ক্লেশ
বাঙলাদেশ, বাঙলাদেশ।
ঢাকা ০৬.০৫.২০০৬
অবস্থান
[উৎসর্গঃ সন্ত্রাসীর আক্রমণে নিহত পুলিশ সার্জেন্ট আহাদ-কে]
মনে হবে জীবন তার অর্থহীন
কিন্তু একদিন--
প্রান্ত থেকে এই শহরে।
মেধার নৌকোয় আকাশ ডিঙিয়ে এসেছিল।
প্রতিষ্ঠানে গেল না, প্রেম তাকে নিল না
কাটা রাইফেল ও নাইন শুটারিরা
গণতন্ত্রের ক্ষত উজ্জ্বলতর করতে
মানিক মিয়ার দালানে গেল।
সে ঠায় দাঁড়িয়ে।
টিএসসি থেকে বিতাড়িত
ইদানীং চারুকলা প্রাঙ্গণে কিংবা শাহবাগে।
দেহ ও দেহবাসে উত্তরবঙ্গের খরা
ধারালো চোখে এখন দুরারোগ্য ব্যাধি
তবু শেষ দেখবার জেদ তার
দেখেছে একাত্তরঃ স্রেফ আত্মম্ভরিতা
পচাত্তরঃ মহান ভুলের লোকসংগীত
নব্বইঃ বিশ্বাসহত্যার প্রামাণ্য অনুষ্ঠান
তবু শেষ দেখবার জেদ তার নির্বিকার,
দেখতে দেখতে--
বন্ধুরা ব্রিটিশ এয়ারওয়েজে ওঠে, নামে ।
কেউ এঞ্জিয়োর মিশন ও ভিশন আনতে
ঈগলের দেশে আসে, যায়।
আকালের অজুহাতে কেউ কাল ফিরে পায়।
সে অবস্থানে অনড়,
গড়-জ্ঞানের সঙ্গে দুইশো ডিগ্রী ব্যবধান নিয়ে
বলবেইঃ কেন নয়?
একটি দুইটি কানসাট হয়ে আসতেই পারে বাঙলাদেশ
হাতের হাঁসিয়া থেকে দাবানল
লাঙল-ধরা হাতে ওঠেনি অস্ত্র--
একাত্তরের আগ্নেয় বদ্বীপে!
ছত্রিশ বছর আকাশ জুড়ে দুঃশাসনের শকুন
পনর কোটি লাশের আশায়
তবু আশা তার
ইতিহাসের অগ্রগতির নিবিষ্টতায়।
০২.০৫.২০০৬
তৃতীয় দুনিয়ায় বসতি
[উৎসর্গ : বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ যোসেফ স্টিগালিৎস- যিনি ক’ মাস আগে বাংলাদেশে এসে প্রকাশ্যে তার সংস্থার ভয়াবহ অপকর্মের কথা বলে আমাদের সাবধান করে দিয়ে গেছেন। দৈনিক জনকণ্ঠ ২৪.১০.২০০৪]
কতটা স্মৃতির ডালপালা নিয়ে বৃক্ষ সবুজ হয়
কতটা আবেগে বেগবতী নদী অভ্যন্তরে বয়
কতটা উৎফুল্লতায় উড়ন্ত পক্ষী কলরব করে
এইসব সহজিয়ায় বসতি হল না আমার--
এই মানবজন্ম লুট হয়ে গেছে।
আজ আকাশ নুয়ে যেখানে ছুঁয়েছে
দিগন্ত নয়, বাজার
ব্যক্তি-কষ্টের বর্ণমালায় কবিতা হবে না আর
হবে না উপমা ঘরে-প্রাঙ্গণে নারীর পণ্যায়ন
প্রাপ্তির মানে প্রতিযোগিতা শক্তির ব্যাকরণ।
আমায় খুঁজে নাও নতুন দ্রাঘিমায়--
কোথায় অবরুদ্ধ আমি কোন অভ্যন্তরে
কোথায় নর্দমায় খাবি খায় সভ্যতার সকল অর্জন।
কারা শিশু আব্বাসের দু’হাত কেটে মানবাধিকারের রাবার লাগাল?
কোন্ গণতন্ত্রে এক মার্কিন নারী অনেক পুরুষকে বেঁধে ধর্ষণ করল--
আবু গারীবে?
এর কিছুদিন পর আদমজী ও মেশিনটুলস ফ্যাক্টরি বন্ধ হল
পিতারতুল্য জননেতা জননীর ইজ্জৎ বিনাশে শরীক হল
সভ্যতার সমান বয়সী আমার সন্মানিত আদিবাসী জনকের শরীর যখম হল--
মধুপুরে
লুণ্ঠনের বিস্তীর্ণ উৎসবে অতঃপর
জলা থেকে জেলে, ভূমি থেকে কৃষক
মানুষের ভেতর থেকে মানুষ উচ্ছেদ হল।
আমি ভীষণ একা--
অথচ আজকেই গণঅভ্যুত্থান প্রয়োজন ছিল
সোভিয়েত? ভিয়েতনাম? জঙ্গি ইসলাম? বিশ্বায়ন?-- নাহ!
দৃষ্টান্ত খুঁজো না- সংকটের সংবিধান থাকে না।
নূরুল কবীর এখন ভুল পত্রিকায়,
গণমুক্তিরা রিয়েল-এস্টেট ব্যবসায়,
সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ফেরদৌস আয়তাল কুরসিতে
আমার হার্টে ব্যথা,
ঠিক তখনই বিশ্বব্যাংক বাঙলাদেশের হৃৎপিণ্ডে ঢুকে পড়ে।
বেশ কিছু বোমা ও শেষে গ্রেনেড ফাটিয়ে
ঝঞ্ঝাটের পূর্ণতর সুযোগ নিয়ে
নারীকে বেশ্যা, পুরুষকে দালাল ও ধনীকে ডাকাত বানানোর প্রকল্প তৈরি হল।
ম্যাগসাইসাই মহান কেউ হলে আমিও বলতে পারতাম
তমশার অবসানে আলো আসবেই।
আমি মহামানবীয় ভারসাম্যে ব্যর্থ
আমার পশ্চাতে পূর্ব পুরুষের অভিসম্পাৎ
আমার সমমুখে উত্তর পুরুষের বরাদ্দ করা অন্ধকার
মধ্যিখানে ঈগলের ঠোঁটে অরক্ষিত বাঙলাদেশ--
আমি ঘুরপাক খাই।
গণদুর্গতি তামাম দুনিয়ায় রেহাই হবে না কারো
ইতিহাস দোরগোড়ায় প্রাণান্ত প্রতিরোধ গড়ো।
ঢাকা ১১.১১.২০০৪
সাতই নভেম্বর
বারবার ফিরে আসা জাগ্রত তৎপর
ঝুঁকি বিনিয়োগ ধারাবাহিকতায় ক্ষুধিরাম, সূর্যসেন, অতঃপর--
আমি সাতই নভেম্বর
এই অচলায়তনে চিরচলমান উদ্যোগ
আমি মৃত্যু-স্বয়ংবর
আমাকে ডেকে যায় শস্যের সমারোহ সব্জীর ঘ্রাণ
নদীর ঢালে মায়াবী গ্রাম, বাঙলার সহজিয়া প্রাণ
আমার স্বপ্নের তুলিতে অগণন বসতির ঘর
রঙের ছোঁয়ায় অসমাপ্ত--আমি অঙ্গীকার পূরণে অপূর্ণতর।
তাই ফিরে আসা, তাই ফিরে আসি
আমি সাতই নভেম্বর।
আমি গারো পাহাড় থেকে নেমে আসা একাত্তর
আমি এই সমতলে সংগ্রামী চেতনার অবকাঠামো
আমি বিচ্ছিন্ন প্রত্যঙ্গে পূর্ণাঙ্গ পথ চলার দায়--
ফেলে আসা রণাঙ্গনে আমি আসতেই পারি।
ভাবো যদি অন্ধকারে ডোবাবে আলোর ঐতিহ্য
আঁধারচেরা ট্রেসারে অকস্মাৎ সংকেত আমি হতেই পারি
বিজিত শত্রুর ফের আনাগোনা বিজয়ী জনপদে
দুর্জয় বাঙলা ব্রহ্মপুত্র-ধরলা প্রতিরোধ চায় পুনঃপ্রবাহের
আবার চিলমারি-এ্যামবুশ পারে পারে প্রস্তুতি অবাধ্যতার
মঙায় প্রতারণায় আমাকে ঠেকাতে পার না ফিবছর।
আবার জয়ী হবার জনযুদ্ধ হব--
আমি সাতই নভেম্বর।
ক্রাচে ভর করে ঠিকই পৌঁছাব সময় হলেই মঞ্চ আমার
ফাঁসি ও বিজয়ে দেশ-কাল ছেয়ে আমি একাকার
আমি বিগত ও অনাগত--ইতিহাস ও বিদ্যমানতার
যতক্ষণ না ফয়সালা হবে--
আমি গরমিল--মুনাফা ও মজুরির--রাষ্ট্র ও জনতার।
আমি অসম্ভব সম্ভাবনায় সদা তৎপর
আমি সাতই নভেম্বর।
ঢাকা ০২.০৫.২০০৬
কানসাট থেকে
[কালচে সবুজের লাগাতার আমবাগান আর অসংখ্য বৃক্ষের সমারোহে চাঁপাই নবাবগঞ্জ জেলার কানসাট ইউনিয়ন। বাগের মতো মনোরম ছোট্ট জনপদ। মূলত কৃষক ও কৃষিমজুর--অসচ্ছল অবস্থা, ভাঙা শরীর। ওই বরেন্দ্রর মাটি ফসলের জন্যে সেচ চায়, সেচের জন্যে বিদ্যুৎ। অপরিহার্য হয় বিদ্যুতের আন্দোলন। সেটা দমন করার জন্যে পুলিশের গুলিতে ৪ জানুয়ারি ২ জন, ২৩ জানুয়ারি ৭ জন, ৬ এপ্রিল ৫ জন এবং ১২ এপ্রিল ৬ জন নিহত হয়। আহত/পঙ্গু ৫ শ’র বেশি। ওখানে, যখন বিদ্যুৎ চাহিদা গুলিতে মেটানো হচ্ছিল। এখানে, ঢাকায়- সুপার মার্কেটে, মন্ত্রীপাড়ায়, এমনকি উদ্যানেও অন্যায়ভাবে বাত্তি জ্বলেছে। অশোভন আলোকসজ্জার সুনির্দ্দিষ্ট ছবি এসেছে পত্রিকায়। গণস্বার্থবিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র ও রাজনীতির চরম দেউলিয়াত্ব। নিজের অভিজ্ঞতায় বিস্মিত, আন্দোলনকর্মী আব্বাস বাজারের শরীফুল ইসলাম বললেন--আমি ঘুমাইতে পারি না। এই দেশে কোনো নেতা নাই?... সূত্র : সমকাল/প্রথম আলো]
সারারাত নির্ঘুম আছি
জানতে চেয়েছি আমার কাছে,
এই দেশে
ছিল না সেদিন নেতা-টেতা,--কেউ?
পিতার ঔরসে জাতক--এমন কেউ?
পূর্বপুরুষে মানুষের রক্ত ধরে--এমন কেউ?
জানে না-কি উদারান্নের ইতিহাস খতিয়ান,
এই বরেন্দ্রর চৌচির মাটি কতটা ঘামের জল
সোনালী সবুজ করে প্রাণ?
আমি তো জানি--
এই বুভুক্ষুর দেশে লকলকে বেড়ে ওঠে কার?
দিনদিন ভিন্ দেশে বাড়ি ওঠে কার?
আমার মেরুদণ্ড বেয়ে-ওঠা
মন্ত্রী-সান্ত্রী, দুর্বৃত্ত, কালো টাকা, কার?
আমায় লেলিয়ে-দেয়া এই রাষ্ট্র--
এই নিক্ষেপিত সিসার ব্যয়ভার,--কার?
চৌডালা থেকে হঠাৎপুর
এক দুইবার নয়, তিন চারবার--
টার্গেট করে আমার কৃষাণী, কিশোর--
জীবনের শুরুতেই জুলুমের বোঝা নামাবার বলিদান,
ফজল নয়ন অতঃপর বিশটি তাজা প্রাণ--
নেই হয়ে গেছে; আছে অবিস্ফোরিত প্রশ্নের ক্ষোভ
যার যা তা-ই নিয়ে, এই বেড়িকেড দিয়ে--
নিজ ভিটায় বিতাড়িত--এই মাঠে, গাছতলে রাত।
এটা কোন দেশ? কোন দিন-মাস-ইতিহাস
কোন দুঃস্বপ্নের ধারাবাহিকতা?
শতাব্দীর নির্বাক আমের বাগানেরা জানে।
সময় এসেছে সরাসরি জানাবার--
আমি টংক তেভাগা নানকার থেকে
ঊনসত্তর একাত্তর হয়ে--
নিয়মের বিরতি দিয়ে দিয়ে
এদ্দুর এসেছি অনিবার্য--আরো যাবার।
দুই-একখণ্ড বিজলি নয়,
তিন দশকের অন্ধকারে জ্বলে-উঠা জনপদে
পূর্ণাঙ্গ আলোর এই প্রাথমিক বিদ্রোহ।
আমি তো প্রান্তে আছি, দিনদিন পিছিয়েছি
হেরে যাওয়া ছাড়া কিছু নেই হারাবার,
চূড়ান্ত প্রস্তুত আছি ঘরেঘরে গ্রামান্তরে
কৃতঘ্নের মুখোমুখি দাঁড়াবার।
১২.০৫.২০০৬