জীবনানন্দ দাশের কবিতায় হতাশা, নৈরাজ্য ও সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র – ইকবাল মাহমুদ
লিখেছেনঃ ইকবাল মাহমুদ, আপডেটঃ March 10, 2009, 12:00 AM, Hits: 5302
সৃষ্টি কর্মের কোন বাঁককেই একটি মানদণ্ড দিয়ে চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। তবু তিরিশের দশকের কবিদের কণ্ঠে শোনা গেল এক নতুনতর স্বর। যে স্বর জুড়ে ছিলো সংগ্রাম, সাম্যবাদ ও গণচেতনার স্বর। এ সময়েই তিরিশের দশকের কবিদের মধ্যে বিষ্ণুদে এলেন সাম্যবাদের পথ ধরে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এলেন রাজনীতি ও নৈরাজ্যবাদের পথে; আর জীবনানন্দ দাশ? তিনি কি শুধু রূপসী বাংলার কবি হয়েই থাকলেন ? না তাঁর কবিতায় ছিলো অন্য কোন স্বর-সুর?
১৯৪০ থেকে ১৯৫০-এর মধ্যবর্তী সময়টা ছিলো দলিত ও বিপন্ন, জটিল ও নিষ্ঠুর দশক। এর মধ্যে থেকে একজন কবি সহজ ও সরল কোন পথ ধরে আসতে পারে না পারা সম্ভবও নয়। জীবনানন্দ দাশও পারেননি। বিক্ষুব্ধ মনে তিনি হেঁটে চলেছিলেন কাটা বাংলার মাঠ-ঘাট-প্রান্তরের পথ ধরে। আর তাই এ সময়েই কবির বিভিন্ন কবিতায় বারবার অনুষঙ্গ হয়ে ব্যবহৃত হতে দেখি নদী, মাঠ, ঘাস, শিশিরের জল-এর বদলে ভিন্ন উপকরণ ভিন্ন অনুষঙ্গ, চিত্রকল্প পাল্টে যেতে থাকে বারবার। গ্রামের সহজ-সরল-নিস্তরঙ্গ রূপ বদলে কবিতায় তিনি কথা বলতে থাকেন সমাজের ছোটো ছোটো বিষয়-আশয়-যুগ যন্ত্রণা-বিবর্তনের। যুগ যন্ত্রণা নিয়ে নানা মতভেদ থাকা স্বাভাবিক। যুগ-যন্ত্রণা একেজনের কাছে একেক রকম। কারো কাছে যুগ যন্ত্রণার একমাত্র স্বরূপই হচ্ছে ফ্রফন্সয়েডীয় তত্ত্বের বিকার ও বিকৃতি, বিচ্ছিন্নতা ও হতাশা। কেবল এই মানসিক সঙ্কটকেই কেউ কেউ আধুনিক যুগ-যন্ত্রণার একমাত্র লক্ষণ বলে চিহ্নিত করতে চাইলেন। কিন্তু এগুলোই যুগ যন্ত্রণার সঙ্কট নয়। আধুনিক মানুষের জীবনে অর্থনৈতিক সমস্যা, শ্রেণীশোষণ, ঔপনিবেশিক শক্তির প্রতাপ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মরণাস্ত্রের প্রসার, এক শ্রেণীর মানুষের হাহাকার-গৃহহারা উদ্বাস্তু জীবনের ডাক, দু:খ-দারিদ্র্য, শোষকের করাল ভয়াল থাবা, মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কাজের সঙ্কট এগুলো কি যুগ যন্ত্রণা নয়?
প্রথম মহাযুদ্ধের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে স্বাভাবিকভাবে মানুষের মনে বিত্রশ্নার বিতৃষ্ণার জন্ম হয়েছিল। মানুষের স্বপ্ন ও আশা গুড়িয়ে গিয়েছিল, যে নিরাপদ ও নি:শঙ্ক পৃথিবীর প্রতিশ্রুতি প্রচারিত হয়েছিলো, রুপার্ট ব্রুকের মতো কবিদের উৎসাহী কণ্ঠেও যার আভাস পরিস্ফুট, কিন্তু যুদ্ধের নিষ্ঠুর ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে মানুষের সেই মোহভঙ্গের কোন বিলম্ব হয়নি। যুদ্ধোত্তর ইউরোপীয় সাহিত্যে তার প্রকাশই অধিকতর স্পষ্ট। এরপর দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের ভয়াবহতা নাগরিক জীবনবোধের জটিলতা তাঁর সমাজ ও স্বকালবোধ এসবের প্রভাবে কবি মন হতাশায় জর্জরিত। তাঁর শীতরাত কবিতায় সেই হতাশা, নাগরিক জীবনের দলিত মথিত নৈরাজ্যেও নির্ঘন্ট উঠে এসেছে কর্কশভাবে। যেমন :
শহর ও গ্রামের দূর মোহনায় সিংহের হুংকার শোনা যাচ্ছে,
সার্কাসের ব্যথিত সিংহের।
সিংহ অরণ্যকে পাবে না আর
পাবে না আর
পাবে না আর।
কোকিলের গান
বিবর্ণ এঞ্জিনের মতো খ’সে খ’সে
চুম্বক পাহাড়ের নিস্তব্ধ।
(শীতরাত - মহাপৃথিবী)
জীবনকে পাল্টে নেয়ার তাগিদে একটু ভালোভাবে বেঁচে থাকার তাগিদে, হতাশা, দৈন্য আর অভাব মুছে ফেলার তাগিদে মানুষ আশ্রয় খোঁজে শহরে। কিন্তু সেই শহর হতাশায় দীর্ণ, ক্লান্ত, প্রকৃতি বিচ্ছিন্ন মানুষকে নগরের যান্ত্রিক সভ্যতার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হতে দেয়ার বদলে আরো বেশি হতাশ, আরো বেশি দৈন্যের মধ্যে ফেলে দেয়। শুধু দেয় না, তাকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলে শহর ও গ্রাম উভয় থেকেই। এ কবিতায় কবি মানুষকে সার্কাসের ব্যথিত সিংহের সাথে তুলনা করেছেন। ‘বন্যেরা বনে সুন্দর শিশুরা মাতৃক্রোড়ে’। প্রকৃতির সংস্পর্শে রূপ-রস নিয়ে বেড়ে উঠা মানুষ কিছুতেই নগরীর পাশবিকতায় একাত্ন হতে পারে না। গ্রাম থেকে শহরে আশ্রয় নেয়া পোড় খাওয়া মানুষগুলো সার্কাসের ব্যথিত সিংহের মতো। আর চারপাশের নগরায়নের ফলে প্রকৃতি আজ বাক্প্রতিবন্ধী। তাই তার কোকিলের কণ্ঠও ইঞ্জিনের মতো খস খসে। জীবনানন্দ ঠিক চারপাশের এই দৈন্য ও হতাশা দেখতে দেখতে অনুবীক্ষণ চোখ দিয়ে জগৎ ও মানুষের সেই মানুষী প্রতিচ্ছবি এঁকে গেছেন অবিকলভাবে।
তিরিশের কবিদের কৈশোর ও যৌবনের স্বপ্নময় দিনগুলো কেটেছে এইসব নপুংসক ঘটনার মুখোমুখি; তাঁদের বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাঁরা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, মানুষের জীবন কতগুলো মৌল প্রশ্নের সন্মুখীন। মানুষের প্রতি মানুষের বিশ্বাস হারানো, নিটোল শুভ ও সুন্দরের প্রতি উৎসাহহীন, ভীতি-বিভ্রান্ত, পীড়িত ও যন্ত্রণাকাতর। তিরিশের অর্থনৈতিক মন্দা বিশ্বজুড়ে সৃষ্টি করেছিল এক চরম সঙ্কট। এই সঙ্কটের হাত থেকে উপমহাদেশের অর্থনীতি তো রক্ষা পায়নি, বরং অভাবনীয় মূল্যবিপর্যয় ও বেকার সমস্যার ভয়াবহ বিস্তৃতি মানুষের জীবনে নিয়ে আসে শোচনীয় দুর্দশা। সমাজজীবন বহুলাংশেই বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এই হতাশাজনক দৃশ্যের রূপ প্রত্যক্ষ করতে হয় তিরিশের কবিদের। তিরিশের কবিতার উদ্ভব ও বিকাশের সাথে এই হতাশাদীর্ণ সমাজের চিত্র, ইতিহাস গভীরভাবে সংযুক্ত। মানবসভ্যতার সঙ্কট রবীন্দ্রনাথকে যে কতখানি উদ্বেগাকুল করে তুলেছিলো তার প্রমাণ মেলে ‘কালান্তর’ পর্যায়ের রচনায়। সমাজের দুর্দিন, সভ্যতার সঙ্কট, হতাশা, মনুষ্যত্বের অপমান, নৈরাজ্য ও স্বদেশের দুর্যোগে তিনি নীরব থাকেননি।
স্ফীতকায় অপমান
অক্ষমের বক্ষ হতে রক্ত শুষি করিতেছে পান
রুক্ষ মুখ দিয়া! বেদনারে করিতেছে পরিহাস
স্বার্থোদ্ধত অবিচার
সংকুচিত ভীত ক্রীতদাস
লুকাইছে ছদ্মবেশে! ওই যে-দাঁড়ায়ে নতশির,
মূক সবে, ম্লান মুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর
বেদনার করুণ কাহিনী।
জীবনানন্দের কবিতা সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে তিরিশের কবিতার উদ্ভব ও বিকাশের ধারাবাহিক ইতিহাস জানতে হবে। তিরিশের কবিরা প্রায় সবাই ঐ শতাব্দীর সমান। বিশশতক ইতিহাসের একেকটি বিশাল ঘটনায় জর্জরিত এবং নানাভাবে আন্দোলিত। একেকটি ঐতিহাসিক ঘটনা এই শতাব্দীকে আমূল কাঁপিয়ে দিয়েছে। বিশ্বব্যাপী একেকটি পরিবর্তন, রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তিজীবনের উথান-পতন, সামন্ততন্ত্রের দ্রুত অবসান, গণতন্ত্রের বিকাশ, ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর সাম্রাজ্য হারানো, দেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম, দু-দু’টি বিশ্বযুদ্ধ, আণবিক বোমার ধ্বংসলীলা, ফ্যাসিবাদ, স্পেনের গৃহযুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, দারিদ্র্য, বিকলাঙ্গ, মন্বন্তর, দাঙ্গা এবং পুঁজিবাদী সভ্যতার ক্ষত ও বিভীষিকা যেমন এই শতকের মানুষকে প্রত্যক্ষ করতে হয়েছে তেমন পাশাপশি মানুষ আবার দেখেছে ঐতিহাসিক সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব, মানবিকতার বিজয়, বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব সাফল্য, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অবদান, বুদ্ধি ও চিন্তার মুক্তি। বিশ শতকে মানুষের মনে প্রশ্ন, অন্বেষণ ও অনুসন্ধিৎসা বৃদ্ধি পায়; জীবন ও জগৎ সম্পর্কে মানুষের সামগ্রিক কৌতূহল। নব নব আবিষ্কারের ফলে মানুষের মনে দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকা ভুল ধারণা বা বিশ্বাসে ফাটল। সত্যকে মানুষ সরাসরি প্রত্যক্ষ করতে শেখে বাস্তব বিশ্লেষণের মাধ্যমে। প্রাকৃত জগতের বিস্তার মানুষের ইন্দ্রিয়কে যে কুসংস্কার অন্ধকারে রেখেছিলো সেই অন্ধকার ও অনুমান নির্ভর অন্ধবিশ্বাসকে মানুষ বুদ্ধি ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে বিচার করতে শিখল। মানুষের শাশ্বত বোধে চিড় ধরার পাশাপাশি প্রেম ও দয়ার মতো অনুভূতিগুলো অনেক ক্ষেত্রেই মূল্য হারাতে থাকল।
তিরিশের কবিরা প্রায় সকলেই অধীত বিদ্যায় পারদর্শী, দর্শনে পারঙ্গম, ইউরোপীয় সাহিত্যে ব্যুৎপন্ন এবং সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাস ও মনস্তত্ত্বে সমান কৌতূহলী, বিজ্ঞানেও কারো কারো গভীর উৎসাহ। পাশাপাশি তিরিশের কবিদের প্রধান লক্ষ্য ছিলো :
১) রবীন্দ্রপ্রভাব কাটিয়ে উঠা অর্থাৎ রবীন্দ্রনাথের কাব্যধারা থেকে বের হয়ে নতুন এক কাব্যের স্বরূপ উন্মোচন করা।
২) যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর বিশৃঙ্খল, অস্থির, হতাশাদীর্ণ ও রুগ্ন জীবনচিত্র কাব্যে ফুঠিয়ে তোলা।
এছাড়াও সামগ্রিক নৈরাজ্য ও বিস্বাদ, উন্মূল মনোবৃত্তি ও স্ববিরোধ, নগরসভ্যতার এই সমৃদ্ধির শূন্যতা, ফন্সয়েড ও য়ূংয়ের মনস্তাত্ত্বিক সমীক্ষার প্রভাব, মার্কসীয় দর্শনের সাম্যবাদী চেতনা, দুরূহ জ্ঞান থেকে আহৃত মননধর্মিতা, প্রেম ও সুন্দর প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত সত্যে অবিশ্বাস এসব লক্ষণই তিরিশের কবিতার শরীরে স্পষ্ট ও প্রকাশিত। তাঁর ‘জহু’ কবিতাটিতে সমাজতত্ত্ব, সমাজ পরিবর্তনের ছাপ স্পষ্টভাবে পরিলক্ষিত হয়। যেমন :
মানুষেরা বার-বার পৃথিবীর আয়ুতে জন্মেছে;
নব-নব ইতিহাস সৈকতে ভিড়েছে;
তবুও কোথায় সেই অনির্বচনীয়
স্বপনের সফলতা-নবীনতা-শুভ্র মানবিকতার ভোর?
নচিকেতা জরাথুষ্ট্র লাওৎ-সে এঞ্জেলো রুশো লেলিনের মনের পৃথিবী
হানা দিয়ে আমাদের স্মরণীয় শতক এনেছে?
(জহু - সাতটি তারার তিমির)
কিংবা,
নতুন তরঙ্গে রৌদ্রে বিপ্লবে মিলনসূর্যে মানবিক জাতীয় মিলন?
নব-নব মৃত্যুশব্দ রক্তশব্দ ভীতিশব্দ জয় ক’রে মানুষের চেতনার দিন
কিংবা,
সে অনেক রাজনীতি রুগ্ননীতি মারী
মন্বন্তর যুদ্ধ ঋণ সময়ের থেকে
উঠে এসে এই পৃথিবীর পথে আড়াই হাজার
বছর বয়সী আমি;
মানুষের মূল্যবোধের বিরুদ্ধে অবক্ষয়ের ষড়যন্ত্র-সভ্যতা বিনাশের যে চক্রান্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে কবি সেকথা নির্নিমেষে বুঝতে পেরেছিলেন। বুঝতে পেরেছিলেন মানুষের উচ্চাকাঙ্খী স্বভাবের মধ্যেই নিহিত রয়েছে রক্তপাত তথা বিনাশ; মানুষকে স্থির থেকে স্থিরতর হতে দেবে না সময়। তাই তিনি বলে উঠেছিলেন-
চারিদিকে নবীন যদুর বংশ ধ্বসে
কেবলই পড়িতে আছে; সঙ্গীতের নতুনত্ব সংক্রামক ধূয়া
নষ্ট করে দিয়ে যায়;
স্মৃতির ভিতর থেক জন্ম লয়, এইসব গভীর অসূয়া।
(আমিষাশী তরবারী - অগ্রন্থিত কবিতা)
মানুষের মনে প্রেম থাকে, থাকে বিস্ময় তেমনি থাকে সম্ভাবনা। সব প্রেম,সব বিস্ময়, সব সম্ভাবনা মানুষের হয়তো পূরণ হয় না; আর যখন হয় না মানুষ তখন হতাশার পঙ্কিলতায় ডুবতে থাকে, তাঁর মাঝে প্রেমের বদলে অ্যাবসার্ড এসে দখল নেয়। সে তখন মাথার ভিতর এক বোধ নিয়ে ঘুরপাক খায় বস্তুজগতে। তাঁর জন্যে অপেক্ষা করে এমন এক পরিণতি যা মৃত্যুতেই স্থিত। মানুষের সুন্দর চিন্তা, চেতনা, বোধ, বিস্ময়, বিষয়-আশয় কিভাবে চেনা জগৎ থেকে অচেনা হয়ে যাচ্ছে জগৎ সংসারের সঙ্গে পরিচয় সূত্রগুলো খসে খসে যাচ্ছে জীবনানন্দ তা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। ‘এই নিদ্রা’ কবিতায় কবি হতাশার সেই চিত্র এঁকেছেন পরাবস্তব দৃষ্টিতে। স্খূলজগৎ থেকে পরাবস্তব-এর জগৎ সম্পূর্ণ আলাদা।
শুনেছে সে ইহাদের মুখে কোনো অন্ধকার কথা?
সকল সংকল্প চিন্তা রক্ত আনে ব্যাথা আনে মানুষের জীবনের এই
বীভৎসতা
ইহাদের ছোঁয় নাকো;
ব্যুবনিক প্লেগের মতন
সকল আচ্ছন্ন শান্ত স্নিগ্ধভাবে নষ্ট করে ফেলিতেছে মানুষের মন
(এই নিদ্রা - অগ্রন্থিত কবিতা)
“হাইড্রান্ট খুলে দিয়ে কুষ্ঠরোগী চেটে নেয় জল
অথবা সে হাইড্রান্ট হয়তোবা গিয়েছিলো ফেঁসে।
এখন দুপুর রাত নগরীতে দল বেঁধে নামে।
একটি মোটরকার গাড়লের মতো গেল কেশে
কিংবা,
ভিখিরীকে একটি পয়সা দিতে ভাসুর, ভাদ্র বৌ সকলেই নারাজ
... ... ... ... ...
আমাদের সোনা রুপো নেই তবু আমরা কে কার ক্রীতদাস?
বিংশ শতকীয় মানবীয় সভ্যতার যে ছাপ তার উপরে পড়েছিলো তার প্রতিবিম্বনে কোনো অস্পষ্টতা নেই। কেননা সেই অভূত সময় ও জাঁহাবাজ সভ্যতার মধ্যে অবস্থান করলে যে কোন শিল্পীর লেখায় ভিন্ন সুর পরিলক্ষিত হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয় আর তা দেখে আঁৎকে উঠারও কোন কারণ নেই। সভ্যতার বর্বর পিঠে অবস্থান করে সেই সময়ে নিজের কলমকে আর তিনি স্থির রাখতে পারেননি। লিখেছেন দলিত ও বিপন্ন এবং জটিল ও নিষ্ঠুর সময়ের সব পুরাণ।
উত্তেজিত কঠিন দেবতারা
অপরূপ মদ খেয়ে মুখ মুছে নিয়ে
পুনরায় তুলে নেয় অপূর্ব গেলাস
উত্তেজিত না হয়েই অনায়াসে বলে যায় তারা :
হেমন্তের ক্ষেতে কবে হলুদ ফসল ফলেছিল
অথবা কোথায় কালো হ্রদ ঘিরে ফুঠে আছে সবুজ সিঙাড়া।
রক্তাতিপাতের দেশে বসেও তাদের সেই প্রাঞ্জলতায়
দেখে যাই সোনালী ফসল, হন্সদ, সিঙাড়ার ছবি।
শুধু কী তাই
বিশ শতকের মরণোত্তর সভ্যতা মানুষকে একথা খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দিয়েছে যে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিগত অস্তিত্ব প্রকৃতপক্ষে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে লিপ্ত বৃহৎ রাষ্ট্র সমূহের হিসেবী কূটনৈতিকতার অংশমাত্র। নিজেকে মানুষ এতো অসহায় বলে মনে হয় আর কখনো ভাবেনি। নিজের চারিদিকে এক ভয়াবহ অন্ধকারকে প্রতিমুহূর্তে স্বীকার করে নিয়ে আত্নস্খ করে নিয়ে বাঁচতে হচ্ছে তাকে। যেমন উদাহরণ হিসেবে বলা যায় :
“পৃথিবীর সৈনিকেরা ঘুমায়েছে বিম্বিসার রাজার ইঙ্গিতে
ঢের দূর ভূমিকার পর;
সত্য সারাৎসার মূর্তি সোনার বৃষের ’পরে ছুটে সারাদিন
হয়ে গেছে এখন পাথর;
যেসব যুবারা সিংহীগর্ভ জন্মে পেয়েছিলো কৈটিল্যের সংযম
তারাও মরেছে আপামর।
(একটি কবিতা - সাতটি তারার তিমির)
অথবা,
স্বভাবিক মধ্যশ্রেণী নিম্নশ্রেণী মধ্যবিত্ত শ্রেণীর পরিধি থকে ঝ’রে
এরা তবু মৃত নয়; অন্তবিহীন কাল মৃতবৎ ঘোরে।
নামগুলো কুশ্রী নয়, পৃথিবীর চেনা-জানা নাম এইসব।
আমরা অনেকদিন এসব নামের সাথে পরিচিত; তবু
গৃহ নীড় নির্দেশ সকলি হারায়ে ফেলে ওরা।
জানে না কোথায় গেলে মানুষের সমাজের পারিশ্রমিকের
মতন নির্দিষ্ট কোনো শ্রমের বিধার পাওয়া যাবে;
জানে না কোথায় গেলে জল তেল খাদ্য পাওয়া যাবে;
অথবা কোথায় মুক্ত পরিচ্ছন্ন বাতাসের সিন্ধুতীর আছে।
(এই সব দিনরাত্রি - শ্রেষ্ঠ কবিতা)
অবক্ষয়ী সমাজের অস্তিরত মানুষকে তাড়া করে, ঘুমোতে দেয় না। যার জন্যে মানিক বন্দোপধ্যায়ের ভিখু সারারত শিক চোখা করে আর ভাবে দুনিয়ার সমস্ত নারী আর খাদ্য যদি আমার হোত। প্রবোধ স্যানালের ‘আঁকাবাঁকা’র সচ্ছল মানুষেরা ভিখুর মতো ঘর ছাড়ে। পথে পথে ঘোরে আর ভাবে, ভাবায়। সেই অস্থিরতার আর এক নাম জীবনানন্দ দাশের ‘লাশকাটা ঘর’ নামক আশ্চর্য কবিতা। যন্ত্রণা সভ্যতায় পিষ্ট এক সচ্ছল মানুষ অশ্বথের প্রধান আঁধারে কি করে গলায় ফাঁসি দিয়ে মরল তারই ইতিবৃত্ত।
কালের নিসর্গ অসঙ্গতিকে প্রাণপণে শোষণ করে নিয়ে নির্মোহ দৃষ্টি রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত ঘৃণাকে অনুচ্চার রেখেই ব্যক্ত করতে পেরেছিলেন মানুষের প্রতি অগাধ ভালবাসা। কিন্তু জীবনানন্দ এই সর্বাঙ্গ-সূচীমূখ, বিপুল ব্যাখ্যাময় ঘৃণার অভিব্যক্তির মধ্য দিয়ে রেখে গেছেন মানব সমাজের সঙ্গে তাঁর নাড়ীর বন্ধনের শোণিত চিহ্ন। জীবনানন্দ রূপসী বাংলার কবি। তবু তাঁর কলমে ঘৃণার যে তীব্রতা প্রকাশ পেতে দেখি তা আর কারো লেখায় এতো প্রাঞ্জলভাবে ভাবে দেখিনি। যেমন
“দেখেছি রক্তিম আকাশে সূর্য জেগে ওঠে
মানুষিক সৈনিক সেজে পৃথিবীর মুখোমুখী দাঁড়াবার জন্য
আমাকে নির্দেশ দিয়েছে;
আমার সমস্ত হৃদয় ঘৃণায়-বেদনায়-আক্রোশে ভরে গিয়েছে
সূর্যের রোদে আক্রান্ত এই পৃথিবী যেন কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদে
উৎসব শুরু করেছে।”
(অন্ধকার - বনলতা সেন)
বোদলেয়ার যেমন চারিদিকে শুধু অন্ধকার দেখেন, জীবনানন্দও তেমনি অন্ধকারের মধ্যে থেকে মানুষের স্বভাবে পান চিল, শকুন, শুয়োর ইত্যাদি জানোয়ারের স্বভাব। ‘অন্যের মুখ ম্লান করে দেয়া ছাড়া প্রিয় সুখ আর নেই’ যাদের ‘অন্ধকার’ কবিতায় কবি সেইসব মানুষকে শুয়োরের সাথে তুলনা করেছেন। এই যে ‘কোটি কোটি শুয়োরের আর্তনাদ’ উদগ্র বীভৎসতা এই কোটি কোটি শুয়োর কে ? মানুষ নয় কি ? ঘৃণার এমন বীভৎস প্রকাশ এ পর্যন্ত কোন কবির কবিতায় হয়েছে কিনা সন্দেহ। সমাজের আসল রূপ, সামাজিক অবক্ষয়ের খণ্ড চিত্র তিনি তুলে এনেছেন শিল্পীর তুলি টানে। আসলে এত ঘৃণা এমনভাবে লেখায় বা কবিতায় প্রকাশ কেউ কখনো করেনি। সামাজিক অবক্ষয়ের আর এক চিত্র যা তাঁর ‘অভুত আঁধার এক’ কবিতা।
অভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোন প্রেম নেই প্রীতি নেই করুণার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সু-পরামর্শ ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের প্রতি
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।
(অদ্ভূত আঁধার এক - জীবনানন্দ দাশের অন্যান্য কবিতা)
অথবা,
কবিকে দেখে এলাম,
দেখে এলাম কবিকে
আনন্দের কবিতা একাদিক্রমে লিখে চলেছে
তবুও পয়সা রোজগার করার দরকার আছে তার
... ... ... ...
কবিকে দেখে আমরা কি করবো?
পড়বো তার আনন্দের কবিতা কবিতার বই
আর্ট পেপারে আর্ট প্রেসে ছাপা হয়
অনির্বচনীয় কভার
কখনোবা অন্ধকারিক, নাক্ষত্রিক, কখনোবা প্রান্তরের বটের গুড়ির ফাঁকে
জ্যোৎস্নার মতো জ্যোৎস্নার প্রেতাত্নার মতো;
ডিমাই সাইজ; একটার পর একটা বেরোয়
ফী পূজোর মরশুমে
কিংবা বড়দিনের গুলজারের সময়
হাতে ক’রে গভীর সান্তবনা পাই
অবাক হয়ে ভাবি : কবি কিছু পয়সা পেলো?
পেলো না হয়তো
কিন্তু উপন্যাস লিখে পায়
যাক, এসো আমার তার কবিতা পড়ি
অজস্র আশাপ্রদ কবিতা
টইটুম্বর জীবনের স্লট-মেশিনের তৈরী
এক-একটা গোল্ড ফ্লেক সিগারেটের মতো।
(কবি - অগ্রন্থিত কবিতা)
১৯৪০-’৫০-এর দশক যেমন ছিলো দলিত ও মথিত তেমনি ছিলো বিপন্ন। চারিদিকের হতাশা, নৈরাজ্য, বেকার সমস্যা, বিশ্বব্যাপী যে অর্থনৈতিক মন্দা চলছিল জীবনানন্দ দাশ সে সময়েরই একজন। সাংসারিক টানাপোড়েনের মাঝে কবিতা লেখার দায়ে যখন তাঁর চাকরি যায় তখন অর্থের জন্য পত্রিকা অফিসের অনুরোধে তাঁকে লিখতে হয়েছিল উপন্যাস বা লেখানো হয়েছিল। কবিকে দিয়ে এই সস্তা উপন্যাস লেখার তাগিদ, অপ্রাতিষ্ঠানিক পণ্য লেখক বানানোর কৌশল; একটা সমাজ কতটুকু নীচে নামলে, তার শিল্প-সংস্কৃতিতে পচন ধরলে এমন কাজ করতে পারে এবং তার বিরুদ্ধে নীরবে প্রতিবাদ করা ও সেই সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র অঙ্কন সেটা এ কবিতা।
জাগতিক যুদ্ধ, জাতিতে জাতিতে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে হানাহানি, দুর্ভিক্ষ, মহামারী, দারিদ্র্য, মানবতার বিকার সব মিলিয়ে যে ছাপ তাঁর কবিতায় পড়েছিল পৃথিবীময় সেই ধ্বংস ও নৈরাশ্য তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন গভীর উপলব্ধি দিয়ে। সংশয়, দ্বিধা, নির্বেদ নৈ:সঙ্গ-চেতনা ও বিস্বাদের পাশাপাশি তাঁর কবিতায় তিমির হননের উচ্চারণও আমরা শুনতে পাই এবং সেখানেও তিনি বিশেষভাবে স্বতন্ত্র তিরিশের আর সব কবিদের থেকে এমনকি রবীন্দ্রনাথ থেকেও। সামাজিক বৈষম্যের সেই ক্লেদাক্ত সময় এবং হতাশা বৈষম্য ও অবক্ষয়ের ছবি তিনি তুলে এনেছেন তাঁর ‘নিলেমের ঘরবাড়ি’ কবিতায়। যেমন-
নিলেমের ঘরবাড়ি আসবাব অথবা যা নিলেমের নয়
সে-সব জিনিস
বহুকে বঞ্চিত করে দুজন কি একজন কিনে নিতে পারে।
পৃথিবীতে সুদ খাটে; সকলের জন্য নয়।
অনির্বচনীয় হুন্ডি একজন দু’জনের হাতে
পৃথিবীর এই সব উঁচু লোকেদের দাবি এসে সবই নেয়, নারীকেও নিয়ে যায়।
(নিলেমের ঘরবাড়ি - অগ্রন্থিত কবিতা)
নব নব মৃত্যশব্দ, রক্তশব্দ ভীতিশব্দ জয় করে মানুষের চেতনার দিন একদিন আসবেই এর মাঝে একথাও তিনি উচ্চারণ করেছিলেন সগর্বে। তার প্রমাণ মেলে ‘সময়ের কাছে ’ কবিতায়।
চলেছে নক্ষত্র, রাত্রি, সিন্ধু, রীতি, মানুষের বিষণí হৃদয়;
জয়, অস্ত সূর্য, জয়, অলখ অরুণোদয়, জয়।
(সময়ের কাছে - সাতটি তারার তিমির)
আসলে প্রতেকেই দিনকালের সঙ্গে একটা বোঝা পড়া করে নিয়েছিলেন-ঠিকঠাক গুছিয়ে নিয়েছিলেন জীবনটাকে শুধু পারেননি জীবনানন্দ। তাই চিরকালই থেকে গিয়েছিলেন অন্যমনস্ক; সঙ্গহীন, নিরানন্দ, বস্তুগত সাফল্যের জগতের বাইরে আর সকলের চেয়ে ব্যর্থ এবং বহুজনের কাছেই শেষ পর্যন্ত নির্মমভাবে উপহাসিত একজন মানুষ। চল্লিশের দশক সময়টি এমন এক গতিতে চলছিল যে তার সামনে কষ্ট বোধ করা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল না। আর তা ভালবাসার কবিতায় তিনি প্রকাশ করতে পারছিলেন না। ফলে ঘৃণা ও ব্যঙ্গের কবিতা দিয়ে যাত্রা শুরু করেছিলেন। জীবনানন্দের অস্থিরতা, ক্লান্তি, বিষাদ, বিপন্নতা, হতাশা ও অতৃপ্তির মূলেও জীবনের কোনো গভীরতম সত্যের জন্যেই ছিলো ব্যাকুলতা। গাঢ় ইন্দ্রিয়ানুভূতির মধ্যে সমাজসচেতনতার বা মগ্নচৈতন্যের গভীরে তাঁর যে বিরামহীন যাত্রা সেও ছিলো উন্মোচনেরই প্রয়াস। জীবনান্দের কবিতায় মগ্নচৈতন্যের গভীরে সমাজ জীবনেরই সত্যানুসন্ধান। অবচেতনার বাস্তব চিত্রাঙ্কন এভাবে গাঢ় হয়ে উঠেছে। অর্থাৎ বলা যায় সমকালীন জীবন, সমাজ ও পৃথিবী তার চোখে এত উদ্ভট ও বিচ্ছিন্ন লেগেছিল যে মুখোশ খুলে তার সত্যরূপের প্রাকশ ঘটাতে, ঠিক তাকে আনতে হয় এক উদ্ভট চিত্রকল্পের, প্রকাশ ঘটাতে হয় ভিন্ন এক পথে।
সমাজজীবনের অবক্ষয়ের চিত্র দেখতে দেখতে বিদ্রোহ ও প্রতিবাদের অন্তিম সংগতি বা শেষ রক্ষা তিনি এভাবেই হয়তো সম্পূর্ণ করে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হলো না। মাত্র ৫৫ বৎসর বয়সে এক ট্রাম দুর্ঘটনায় তাঁকে জীবন থেকে ছিনিয়ে না নিয়ে গেলে হয়তো সে অন্তিম সংগতির পথের খোঁজ শেষ পর্যন্ত তিনি আমাদের দিয়ে যেতে পারতেন। পথের অভাসটুকু তিনি রেখে গেছেন সন্ধানের দায়িত্বটুকু দিয়ে গেছেন উত্তর পুরুষের হাতে।
বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর মতো জীবনানন্দ দাশ হয়তো চল্লিশের দশকে ভেবেছিলেন
ছত্রিশ হাজার কবিতা না লিখে
যদি আমি সমস্ত জীবন ধরে
একটি বীজ মাটিতে পুঁততাম
একটি গাছ জন্মাতে পারতাম
শেষাংশে একথাই বলা যায় রূপসী বাংলার কবিতা লিখতে গিয়ে যখন তিনি দেখেন তাঁর চারপাশে, নি:সঙ্গতা, নৈরাশ্যবাদ, সমাজজীবনের রন্ধেন্স রন্ধেন্স অবক্ষয় তখন তিনি কবিতায় আনলেন অন্য স্বর, সুর।
রূপসী বাংলার কবি হিসেবে যেমন তাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে তেমনি সমকালীন সমাজজীবনের চিত্রকরও বলা যায় তাঁকে। কেননা তাঁর অনেক কবিতা জুড়ে একে একে এসেছে ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ এবং বিদ্রোহের স্রোতধারা। তিনি রূপসী বাংলার কবি। সামাজিক চিত্র অবলোকনের কবি কেন নয়?
অনলাইন : ১০ মার্চ, ২০০৯