লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ November 10, 2017, 12:00 AM, Hits: 3079
পরিচ্ছেদ - ১
স্বাধীনতা যুদ্ধের ফাঁক ও ফাঁকি এবং রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়ন
১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর বিগত ৩২ বৎসর সময়ে বিপুল বৈপরীত্য নিয়ে এ রাষ্ট্র এগিয়েছে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মাথা পিছু গড় আয়, সাক্ষরতা এবং সাধারণ শিক্ষার হার, গড় আয়ু ইত্যাদি যেমন বেড়েছে তেমন অবকাঠামোগত উন্নয়নও পূর্বের তুলনায় প্রচুর হয়েছে। বস্তুগত উন্নয়ন হয়েছে প্রধানত বিদেশী অনুদান এবং ঋণের উপর নির্ভর করে। কিন্তু এই ৩২ বৎসরে মুষ্টিমেয় ধনীর হাতে সম্পদের কেন্দ্রীভবন এবং সংখ্যাগুরুর নিদারুণ দারিদ্র্যের পাশাপাশি দেশের আত্মিক বা মানবিক দিক যাত্রা করেছে উল্টো দিকে। বরং বস্তুগত উন্নয়নের তুলনায় এই অবনতি তুলনাহীন পরিমাণে বেশী ঘটেছে। সমাজ ও রাষ্ট্রের এমন একটি ক্ষেত্র বাকী নেই যা এই অধঃপাতের শিকার হয় নি। দুর্নীতি সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে পরিব্যাপ্ত। সূচক দিয়ে কিছু বস্তুগত উন্নয়নকে মাপা যেতে পারে। কিন্তু সমাজের মানবিক বা আত্মিক দিকের অবনতি কোনও সূচক দিয়েই সঠিকভাবে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সংবাদপত্রে প্রকাশিত হত্যা, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ, দস্যুতার সংখ্যা এবং অনুমান ভিত্তিক ঘুষের হিসাব ইত্যাদির সংখ্যা ও পরিমাণের সূচক দিয়ে একটি চিত্র দাঁড় করাবার চেষ্টা করা গেলেও সেসব দিয়ে বাস্তবকে পরিমাপ করা সম্ভব নয়। সমাজের সর্বাত্মক অধঃপাতের শিকার হওয়া ভুক্তভোগীরা কেবলমাত্র এই অধঃপাতের তীব্রতা অনুভব করতে পারে।
সমাজের এই সার্বিক অধঃপাতের জন্য দায়ী কে? নিঃসন্দেহে এর সহজ উত্তর হবে, সমাজের নেতৃত্বকারী শ্রেণী তথা শাসক শ্রেণী এর জন্য দায়ী। কারণ তা দুর্বৃত্তায়নের যে প্রক্রিয়ায় বিকাশ ও পরিণতি লাভ করেছে সেটাই সমাজকে আজকের অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে। বস্তুত আজকের সংকট নিয়ে বহু কথা বলা গেলেও আমি এই আলোচনায় মূল যে বিষয়টির দিকে দৃষ্টি নিতে চাই তা হচ্ছে এই শ্রেণীর উদ্ভব ও বিকাশ প্রক্রিয়া। কারণ এটা বুঝতে না পারলে আজকের রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-নৈতিক ইত্যাদি যে সমস্যা বা সংকটেরই কথা বলা যাক সেগুলির কোনটারই প্রতিকার খুঁজে পাওয়া যাবে না। তবে আমি শুধু মূল বিষয়টিকে এখানে সংক্ষেপে উত্থাপন করব ভবিষ্যতে বৃহত্তর আলোচনার ক্ষেত্র প্রস্তুত করার জন্য।
এখন যে কথা বলতে চাই তা হল গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি আজ থেকে ৩২ বৎসর আগে যে রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার ভিতর খুঁজতে হবে সংকটের মূল উৎস। বস্তুত আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মূল ধারা দুই প্রধান দলে বিভক্ত হলেও এই দুইটি দল মূলত একটি অভিন্ন শাসক শ্রেণীর প্রতিনিধিত্বকারী, যে শাসক শ্রেণীর ভিতর কিছু মতপার্থক্য এবং ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত স্বার্থের পার্থক্য থাকলেও চরিত্র ও বাস্তব ভূমিকা বিচারে তাদের নিজেদের ভিতর যে বেশী কোনও পার্থক্য নেই তা তাদের দুই রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি-এর কর্মকাণ্ডের দিকে দৃষ্টি দিলেই বোঝা যায়।
অনেকে ১৯৭১-এর জাতীয় স্বাধীনতা বা মুক্তি যুদ্ধে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বকারী ভূমিকা এবং ১৯৭২-এর সংবিধানে গৃহীত চার মূল নীতি, যথা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা বা লোকবাদের কারণে আওয়ামী লীগকে লোকবাদী বা সেকিউলার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ও সংগঠক হিসাবে বিবেচনা করেন। তারা ১৯৬৬-তে শেখ মুজিব প্রদত্ত ৬ দফা দাবী ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের পরিণতি স্বরূপ ১৯৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধকে বিবেচনা করেন।
আমি মনে করি ভূলটা এখানে। প্রকৃতপক্ষে ৬ দফা ছিল পাকিস্তানের কাঠামোভুক্ত তৎকালীন পূর্ব ও পশ্চিম উভয় পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী। এটা যে পাকিস্তান তথা মুসলমানের রাষ্ট্রতত্ত্বের বিপরীতে বাঙ্গালীর রাষ্ট্রতত্ত্বের পক্ষে ছিল না সেটা ৬ দফা থেকেই স্পষ্ট যেখানে ১নং কর্মসূচীতে বলা হয়েছে, ‘দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনই হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশন ভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব।’ লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিই হচ্ছে ধর্মীয় দ্বি-জাতি তত্ত্ব। অর্থাৎ৬ দফা পাকিস্তানের ধর্ম-সাম্প্রদায়িক কাঠামো ভাঙ্গা বা সীমা অতিক্রমের কর্মসূচী কোনও অর্থেই ছিল না। এটা ছিল নেহায়েতই একটা প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী, যদিও ছয় দফা প্রণীত হয়েছিল পাকিস্তানের পূর্ব ও পশ্চিম উভয় প্রদেশের জন্য অভিন্ন কর্মসূচী হিসাবে।
শুধু পূর্ব বাংলার জন্য স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী ছিল ১৯৫৪-তে যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচীতে। কিন্তু ১৯৫৬-’৫৭-তে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং তাঁর অনুসারী শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন বিরোধী কী ধরনের ভূমিকা নেন তা আমাদের জানা আছে। বস্তুত তাঁদের এই ভূমিকার ফলে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন করতে বাধ্য হন।
১৯৭১-এ শেখ মুজিব আদৌ স্বাধীন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন কিনা সে প্রশ্ন করা যায়। তিনি ১৯৭১-এর মার্চে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ প্রস্তুতির বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা তো নেনই নি উপরন্তু ২৫ মার্চ তারা আক্রমণ শুরু করলে তাদের নিকট ধরা দেন। তবে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। এখন সঙ্গত রূপেই যে প্রশ্ন ওঠে তা হল স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ হল কীভাবে?
স্বায়ত্তশাসনের জন্য নির্বাচনমুখী আন্দোলনের তো এভাবে হঠাৎ করে যুদ্ধে পরিণত হবার কথা নয়। তাও আবার বাঙ্গালীর সেকিউলার তথা ধর্মের নিয়ন্ত্রণ বা আধিপত্য মুক্ত বা লোকবাদী জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ! অর্থাৎ ’৭১-এর যুদ্ধ বাংলাভাষী মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ ছিল না। এটা এমন এক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ ছিল যে রাষ্ট্র হবে মুসলমান, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, লোকবাদী কিংবা নিরীশ্বরবাদী নির্বিশেষে সকল বাঙ্গালীর। অর্থাৎ এ রাষ্ট্রে যে যার ধর্ম বিশ্বাস অথবা অ-বিশ্বাস নিয়ে সম-অধিকারের ভিত্তিতে বাস করবে প্রধানত তার বাঙ্গালী পরিচয় নিয়ে। অন্তত বাঙ্গালী জাতির অন্তর্ভুক্ত সবার জন্য এই রাষ্ট্রতত্ত্বের অঙ্গীকার ছিল এটাই। এর ফলে এই রাষ্ট্র এবং তার রাজনীতি হবে ধর্মমুক্ত, ধর্ম হবে যার যার ব্যক্তিগত ব্যাপার। এখন প্রশ্ন, এই তত্ত্ব যদি ’৭১-এর পূর্বে না থেকে থাকে তবে ’৭১-এ তার ভিত্তিতে স্বাধীনতার যুদ্ধ হল কীভাবে? বস্তুত ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের একটি অঞ্চলের স্বায়ত্তশাসন এবং সেই অঞ্চলে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর ধর্ম বহিভূêূতভাবে জাতি পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠন এই উভয়ের মধ্যে যে ব্যবধান বা ফাঁক তা কিন্তু বিশাল। এই প্রায় অনতিক্রম্য ব্যবধান বা ফাঁক অতিক্রমের জন্য যে বিরাট উল্লম্ফন বা উত্তরণ দরকার তা কীভাবে ঘটেছিল তার উত্তর কিন্তু ৬ দফা থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধের সাদামাঠা বা স্থূল ব্যাখ্যায় নেই। বস্তুত এই ফাঁক পূরণের জন্য এতকাল যাবৎ ফাঁকির যে সৌধ নির্মাণ করা হয়েছে তা রাষ্ট্রের জন্য এমন এক নৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছে যা জাতির জন্য অপরিমেয় ক্ষতির কারণ হয়েছে।
এই ফাঁকির আড়ালে অনেক সত্যের মত এই সত্যও আড়াল হয়েছে যে, স্বাধীনতা যুদ্ধ ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ শুরু হওয়া হঠাৎ ঘটনা নয়, বরং তার পূর্ব থেকেই গড়ে উঠেছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি। প্রকৃতপক্ষে ষাটের দশকে আওয়ামী লীগের ৬ দফা এবং ন্যাপের ১৪ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের পাশাপাশি ন্যাপের বলয়ে থাকা বামপন্থী ছাত্র এবং যুব সম্প্রদায়ের ভিতর থেকে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা এবং আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে উঠেছিল। এর বহিঃপ্রকাশ হিসাবে আসে স্বাধীন পূর্ব বাংলা কিংবা স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ধ্বনি যা ষাটের দশকের শেষ দিকে, বিশেষত ’৬৮ থেকে ’৭১-এর মার্চ পর্যন্ত কালটাতে সে কালের শিক্ষিত তরুণ প্রজন্মকে উদ্বেল করে তোলে। বস্তুত ষাটের দশকে উদ্ভূত এই বামপন্থী বা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী বিপ্লবী প্রজন্মের বৈশিষ্ট্য ও সমস্যা বুঝতে না পারলে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব এবং তার সমস্যা ও সংকটের অনেক কিছুই বোঝা যাবে না বলে আমি মনে করি। দুঃখজনক সত্য হল এই বিষয় স্বাধীনতা যুদ্ধ সংক্রান্ত প্রায় সকল গবেষণা, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা এবং লেখালেখিতে আজ অবধি সবচেয়ে অবহেলিত বা উপেক্ষিত হয়ে আছে। ব্যাপারটাকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এমনভাবে উত্থাপন করা হয় যেন ’৭১-এর আগে স্বাধীনতা আন্দোলন ছিল না, ছিল শুধু স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন এবং ’৭১-এর ৭ মার্চ শেখ মুজিব ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ বললেন আর তার ফলে ২৫ মার্চ পাক বাহিনী আক্রমণ অভিযান শুরু করলে একটা ভাষাভিত্তিক এবং সেকিউলার জাতীয়তাবাদ ভিত্তিক জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হল। ব্যাপারটা কি এতই সহজ?
স্বাধীনতা যুদ্ধের পটভূমিকে বুঝতে হলে বাঙ্গালী জাতিসত্তার দীর্ঘ ঐতিহাসিক বিকাশ ধারা, আরও সাম্প্রতিক ১৯৪৮-’৫২-এর ভাষা আন্দোলন এবং ষাটের দশকে বিকাশমান ধর্মমুক্ত তথা সেকিউলার বা লোকবাদী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে বুঝতে হবে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাঙ্গালী জাতির প্রতি বৈষম্য এখানে স্বায়ত্তশাসন ভাবনাকে প্রবল করতে থাকে যার বহিঃপ্রকাশ ছিল ১৯৫৪-তে রচিত ২১ দফা কর্মসূচী। কিন্তু স্বায়ত্তশাসন এমনকি বাঙ্গালী মুসলমানের বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র কিংবা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার রাজনীতির সঙ্গে ষাটের দশকে বিকাশমান সমাজতান্ত্রিক এবং লোকবাদী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং এই জাতীয়তাবাদের প্রকাশ স্বরূপ স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার রাজনীতির পার্থক্য ছিল অতীব তাৎপর্যপূর্ণ। এবং এটাও বুঝতে হবে যে, পশ্চিমা মুসলমানদের বিপরীতে বাঙ্গালী মুসলমান সম্প্রদায় হিসাবে নয় বরং বাঙ্গালী জাতি হিসাবে নিজেদের বুঝতে চাওয়ার প্রধান উৎস ছিল সেকালে সমাজতন্ত্র এবং মার্কসবাদ বা কমিউনিস্ট রাজনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাব। ভাষা পরিচয় ছিল এ ক্ষেত্রে সহায়ক ঘটনা মাত্র। তৎকালে সারা পৃথিবীতে দ্রুত প্রসারমান মার্কসবাদ ও সমাজতন্ত্রের যে ঢেউ এ দেশেও আছড়ে পড়ে তার প্রভাব সবচেয়ে বেশী অনুভূত হয় ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের ভিতর। এর প্রভাবে ছাত্র এবং শিক্ষিত তরুণদের এক বৃহৎ অংশ ইসলামসহ যাবতীয় ধর্মে অবিশ্বাসী এবং বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী হয়ে উঠে। এছাড়া যারা বস্তুবাদী কিংবা ধর্মে অবিশ্বাসী হয় নি তাদেরও ব্যাপক অংশ রাজনীতিকে ধর্ম থেকে মুক্ত দেখতে চায়। এই বস্তুবাদী, যুক্তিবাদী এবং রাজনীতিতে লোকবাদী দৃষ্টিভঙ্গীর অধিকারী তরুণ প্রজন্ম স্বাভাবিকভাবে ধর্মের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। পাকিস্তান ধর্ম-রাষ্ট্র হওয়ায় তারা দর্শনগতভাবেই তার বিরোধী হয়ে ওঠে। এর সঙ্গে জাতিগত নিপীড়ন ও বৈষম্য ইত্যাদি ফ্যাক্টর ক্রিয়াশীল থাকলেও বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের ভিতর থেকে তৎকালীন পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মূল দর্শনগত প্রেরণা ছিল এই যুক্তিবাদী তথা বিজ্ঞান মনস্ক এবং লোকবাদী বিশ্বদৃষ্টি। অর্থাৎ এই প্রজন্মের সামনে ধর্ম-সাম্প্রদায়িকতার বিপরীতে একটি লোকবাদী ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্র হিসাবে দেখা দেয় তৎকালীন পূর্ব বাংলা এবং হাতিয়ার হিসাবে দেখা দেয় বাঙ্গালী জাতি পরিচয় তথা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। তবে এখানে এ কথা বলা দরকার যে তারা পরজাতি নিপীড়ক উগ্র বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ বিরোধী ছিল, যে কারণে তাদের স্বাধীন পূর্ব বাংলার ভাবনায় অন্য সকল সংখ্যালঘু জাতিসত্তারও স্বশাসনের মর্যাদাপূর্ণ অধিকার স্বীকৃত ছিল। অর্থাৎ এ বিষয় বুঝতে হবে যে, ষাটের দশকে বামপন্থী প্রজন্মের উত্থান পশ্চিম পাকিস্তানী মুসলমানদের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানী মুসলমানদের দ্বন্দ্বকে ভিন্ন একটি স্তরে উত্তীর্ণ করে তাকে পাকিস্তানী (মুসলিম) রাষ্ট্রসত্তার সঙ্গে বাঙ্গালী জাতির (লোকবাদী) রাষ্ট্রসত্তার দ্বন্দ্বে রূপান্তরিত করে। বস্তুত বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ষাটের দশকে সম্পূর্ণরূপে বামপন্থী ছাত্র ও তরুণ সম্প্রদায়ের ভিতর থেকে উত্থিত হয়ে তৎকালীন পূর্ব বাংলার সমগ্র জাতীয় আন্দোলনকে প্রভাবিত এবং শেষ পর্যন্ত অধিকার ক’রে মুজিব নেতৃত্বাধীন স্বায়ত্তশাসন আন্দোলকেও বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন এবং লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যুদ্ধের দিকে যেতে বাধ্য করে।
যাইহোক, বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন ও লোকবাদী তথা সেকিউলার এবং অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার তাৎপর্য বুঝতে হলে ষাটের দশকে প্রধানত বাঙ্গালী মুসলমান সম্প্রদায়ের ভিতর থেকে অসাম্প্রদায়িক এবং লোকবাদী এক নূতন প্রজন্মের উত্থানের তাৎপর্য বুঝতে হবে। আজকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সকল সংকটের এক প্রধান উৎস হচ্ছে ঐ বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী প্রজন্মের ব্যর্থতা। কারণ তাদের ভূমিকা ছাড়া অন্তত ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ হত না এবং যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বাংলাদেশ হত না; অথচ তারা এই যুদ্ধ এবং রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং নিয়ন্ত্রণ দূরের কথা স্বীকৃতিটুকুও পায় নি।
পরিচ্ছেদ - ২
স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি সংগঠনকারী শক্তির পরাজয় এবং দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার বিজয়
ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্মের সমস্যা এবং তার উত্থানের পটভূমি বুঝতে হলে আমাদেরকে বুঝতে হবে আওয়ামী লীগের বিকাশ প্রক্রিয়াকে। আর আওয়ামী লীগের বিকাশ প্রক্রিয়াকে বুঝতে হলে বুঝতে হবে মুসলমান বাঙ্গালীর বিকাশ প্রক্রিয়াকে। সে সূত্রে আমাদেরকে যেতে হবে পাকিস্তান পূর্ববর্তী কালে যখন ব্রিটিশ শাসকদের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং মূলত বহিরাগত অবাঙ্গালী আশরাফ বা অভিজাত শ্রেণীর নেতৃত্বে মুসলিম লীগের জন্ম হয়। এই নেতৃত্বকে সামনে রেখে আতরাফ বা অনভিজাত সাধারণ বাঙ্গালী মুসলমান মধ্য শ্রেণীর বিকাশ ঘটতে থাকে। বিশেষ করে আধুনিক শিক্ষা লাভ করে বাঙ্গালী মুসলমান জোতদার, কৃষক, তাঁতী, জেলে, কারিগর ইত্যাদি মধ্য ও নিম্ন বর্গ এবং বিত্তের মানুষদের মধ্য থেকে এই শ্রেণীর উত্থান ঘটে। মুসলিম লীগের নেতৃত্বে এই শ্রেণী ক্রমে হিন্দু বাঙ্গলী উচ্চ ও মধ্য শ্রেণীর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে এক সময় মুসলমানদের রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এই শ্রেণী অধিকতর উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয় এবং নিজেদেরকে রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী উর্দূভাষী ও পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক শ্রেণী দ্বারা উপেক্ষিত ও বঞ্চিত দেখতে পেয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এই শ্রেণীর বৃহত্তর অংশ রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নকে অবলম্বন করে দাঁড়াতে গিয়ে ভাষা ও সংস্কৃতি ভিত্তিক জাতির প্রশ্নকে বিবেচনায় নিতে বাধ্য হয়। ফলে ১৯৪৮-’৫২-এর ভাষা আন্দোলন সংগঠিত হয়। বাঙ্গালী মুসলমান জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র রাজনৈতিক নেতৃত্বের শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালনের জন্য এই মধ্য শ্রেণীর রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে ১৯৪৯-এ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৫-তে মুসলিম শব্দ বর্জনের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের ধর্মমুক্ত ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক পরিচয় গ্রহণ সম্পন্ন হয়। ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪-এর নির্বাচন উপলক্ষ্যে ২১ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং নির্বাচনে মুসলিম লীগের নির্মূলীকরণ ইত্যাদি ঘটনা ছিল এই মধ্য শ্রেণীর প্রবল গতিতে অগ্রগমনের পরিচায়ক।
কিন্তু ১৯৫৬-’৫৭-তে আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ক্ষমতায় যাবার পর স্বায়ত্তশাসন এবং পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে যুক্তফ্রন্ট এবং আওয়ামী লীগের ঘোষিত কর্মসূচী থেকে সরে গেলে তার সঙ্গে ভাসানীর মতবিরোধ চরমে পৌঁছায়। আওয়ামী লীগের সংখ্যালঘু কিন্তু নীতিনিষ্ঠ অংশ ১৯৫৭-তে ভাসানীর নেতৃত্বে পৃথক রাজনৈতিক সংগঠন হিসাবে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা সংক্ষেপে ন্যাপ গঠন করে। এভাবে নীতি ও আদর্শ নিষ্ঠার সঙ্গে ক্ষমতার লোভের দ্বন্দ্ব আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করলে এ দেশের সুবিধাবাদী, আদর্শহীন এবং যে কোন উপায়ে ক্ষমতাকে ব্যবহার করে অর্থ-বিত্ত সঞ্চয়ের পথ গ্রহণকারী মধ্য শ্রেণীর প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে দেখা দেয় আওয়ামী লীগ। মধ্য শ্রেণীর এই অংশই এ দেশের মুসলমান বাঙ্গালী মধ্য শ্রেণীর বা মধ্যবিত্তের বিপুল সংখ্যাগুরু অংশ। এ দেশের ধর্মাচ্ছন্ন, ভাগ্যবাদী, পরনির্ভর, পশ্চাৎপদ এবং সবকিছু সহজে পেতে চাওয়া কৃষক-শ্রমিকসহ আম জনতার বিপুল সংখ্যাগুরু অংশও এদের পিছনে থেকেছে। সুতরাং ন্যাপের পিছনে যেমন ছিল সংখ্যালঘু মধ্য শ্রেণীর সমর্থন তেমন ছিল কৃষক ও শ্রমিকসহ আম জনতার সংখ্যালঘু অংশের সমর্থন। ন্যাপের ভিতরে ক্রিয়াশীল ছিল গোপন কমিউনিস্ট পার্টি।
এই বাস্তবতায় ষাটের দশকে আদর্শনিষ্ঠ রাজনীতির ধারা হিসাবে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাপ প্রভাবাধীন ধারার ভিতর থেকে অধিকতর অগ্রগামী ও লোকবাদী চেতনার প্রতিভূ হিসাবে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের উত্থান ঘটে, যারা বাঙ্গালী জাতির লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি গড়ে তোলে। এটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ যে ন্যাপ এবং গোপন পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির যে প্রভাব বলয়ে তাদের উদ্ভব ঘটে সেখানেও নেতৃত্বের ভিতর তাদের রাজনীতির সপক্ষে প্রকৃত অর্থে সমর্থন ছিল না।
মার্কসবাদী রাজনীতির আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের তত্ত্বের প্রভাবে এ দেশের পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট নেতৃত্বের মধ্যে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির প্রতি অনীহা থাকায় বিপ্লবী জাতীয়তাবাদী তরুণ প্রজন্ম প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বহীন ছিল। ব্যাপারটা এমন দাঁড়িয়েছিল যে, যে মার্কসবাদী ও সমাজতন্ত্রী রাজনীতির লোকবাদী চেতনার প্রভাবে ছাত্র-যুব সমাজ সে কালে ধর্মমুক্ত রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ হবার ফলে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্রতত্ত্বের পরিবর্তে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী কিংবা বাঙ্গালীর স্বাধীন জাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতির দিকে ঝঁুকে পড়ত সেই একই মার্কসবাদের শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্ব ও আন্তর্জাতিকতাবাদের তত্ত্বের অন্ধ অনুশীলন তাদের অগ্রগমনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াত। বিশেষ করে এই তত্ত্বের অন্ধ অনুশীলনকারী প্রতিষ্ঠিত ও পুরাতন বাম নেতৃত্ব জাতীয়তাবাদী বিপ্লবী প্রজন্মের অগ্রগমনের পথে প্রবল বাধা অর্পণ করে।
এই অবস্থায় তরুণ প্রজন্মের সমস্যা ছিল পর্বত প্রমাণ। প্রথমত, নেতৃত্ব অধিকতর প্রাগ্রসর স্বায়ত্তশাসন কর্মসূচী দেয় নি। ন্যাপের ১৪ দফা কর্মসূচী ছিল এই প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষা পূরণে অক্ষম। বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের স্বাধীনতার গোপন রাজনীতিকে আড়াল দেবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রকাশ্য স্বায়ত্তশাসন কর্মসূচী তাদের বাম ধারায় ছিল না। দ্বিতীয়ত, তারা যে স্বাধীনতার রাজনীতি গোপনে ও প্রকাশ্যে প্রচার করছিল তাও ১৯৭১-এর পূর্ব পর্যন্ত জনগণের ব্যাপক অংশের নিকট গ্রহণযোগ্য ছিল না। ব্যাপক জনসাধারণ ছিল পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে। ফলে তরুণ প্রজন্ম ছিল অনেকাংশে গণ-বিচ্ছিন্ন। এই সমস্যার সমাধান করতে গিয়ে তাদের একাংশ সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে গণ-আন্দোলন বর্জিত গোপন সশস্ত্র সংগ্রামের পথ গ্রহণ করে যা তাদেরকে পরিণতিতে সন্ত্রাসবাদ ও আত্মধ্বংসে ঠেলে দেয়। বৃহত্তর অংশ ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপের সঙ্গে থেকে কৃষক-শ্রমিকদেরকে অবলম্বন করে স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি গড়লেও নিজেদের অনভিজ্ঞতা, জনসমর্থনের সীমাবদ্ধতা এবং অন্ধ পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্বের বিরোধিতা ও নানান ধরনের চক্রান্তের ফলে ’৭১-এ যুদ্ধ শুরু হলে তাতে যথাযথ ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হয়।
সুতরাং ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, স্বাধীনতার রাজনীতি এবং যুদ্ধ গড়ার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রত্যক্ষ কোন ভূমিকা ছিল না। স্বায়ত্তশাসনের দাবীর মধ্যেই তার রাজনীতি সীমাবদ্ধ ছিল। মনে রাখতে হবে এই স্বায়ত্তশাসনও ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামোবদ্ধ। এ দেশের জনগণেরও ব্যাপক অংশ ছিল আওয়ামী লীগের এই রাজনীতির সমর্থক। ১৯৭০-এর নির্বাচনকে কাজে লাগিয়ে তা পূর্ব বাংলার একচ্ছত্র রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়। কিন্তু ’৭০-এর নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছিল ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের জন্য; স্বাধীনতার জন্য নয়।
’৭১-এর ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দমন অভিযান শুরু করলে জনগণের মনে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া ঘটে এবং বাঙ্গালী সৈনিক, পুলিশ ইত্যাদির অংশগ্রহণের মাধ্যমে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হয় প্রকৃতপক্ষে কেন্দ্রীয় কোনও নেতৃত্ব ছাড়া।
২৫ মার্চের পর আওয়ামী লীগ এবং বাম নেতৃত্বের একাংশ ভারতে আশ্রয় নেবার পর ভারত সরকাররের পৃষ্ঠপোষকতায় আওয়ামী লীগ জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের উপর তার নিয়ন্ত্রণ নিরংকুশ করতে সমর্থ হয়। আর এভাবে কোণঠাসা হয় সকল ভুল ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও এ দেশের আদর্শনিষ্ঠ, উৎপাদনশীলতার প্রতিনিধিত্বকারী এবং জনগণের স্বার্থের প্রতি নিবেদিত বাম ধারার রাজনীতি এবং সেই সঙ্গে এই ধারা থেকে উদ্ভূত ও বিকশিত এ দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতিও, একটি প্রকৃত লোকবাদী ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার রাজনীতি।
পরিচ্ছেদ - ৩
দুর্বৃত্তায়ন মুক্ত গণতন্ত্রের নূতন কাঠামো জাতীয় সরকার
এই সংক্ষিপ্ত আলোচনায় আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আনা না গেলেও আমি কিছু বিষয়ের উপর আলোকপাত করতে চেয়েছি বিগত ৩২ বৎসর কাল ধরে এ দেশে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে যেসব অতিকথা বা কল্পকথা সৃষ্টি হয়েছে সেগুলির স্বরূপ উদ্ঘাটনের জন্য। কারণ এটা আজকের সংকটের মূল অনুসন্ধানের জন্য অতীব গুরুত্বপূর্ণ। বস্তুত ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর শুধু পাকিস্তানের পরাজয় হয় নি সেই সঙ্গে সবটা না হলেও অনেকাংশে পরাজয় হয়েছে বাম রাজনীতিরও। এভাবে অনেকাংশে পরাজয় ঘটেছে ভাসানী নেতৃত্বাধীন আদর্শনিষ্ঠ রাজনৈতিক ধারারও। এ যাবৎকাল নানান মিথ্যাচার এবং অতিকথা দিয়ে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস এবং সেই সঙ্গে তার নির্মাতাদেরকে আড়াল করা হয়েছে। সুতরাং স্বাধীনতার স্থপতি এবং স্বাধীনতার ঘোষক উপাধি অর্পণ করা হয়েছে এমন দুইজনের উপর যাদের অবদান থাকলেও অন্তত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতি গড়ায় তাদের প্রকৃতপক্ষে কোন ভূমিকা ছিল না। যুদ্ধে প্রথম জনের কোন ভূমিকাই ছিল না, দ্বিতীয় জনের ভূমিকা ছিল তাৎক্ষণিক, ঘটনার চাপে পড়ে বিদ্রোহী একজন সৈনিক হিসাবে।
রাজনীতিতে এই প্রতারণা ও ফাঁকি নিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর থেকে যে শ্রেণী যাত্রা শুরু করেছে তা স্বাভাবিকভাবে একটি দুর্বৃত্ত শ্রেণী রূপেই আত্মবিকাশ ঘটায়। এই শ্রেণীর প্রয়োজনেই ইতিহাস লেখা হয়। সুতরাং এ দেশে ষাটের দশকে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের রাজনীতি গড়ার ক্ষেত্রে বামপন্থীদের বিশেষত বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা যেমন অস্বীকার করা হয় তেমন ’৭১- এর নয় মাস যার নেতৃত্বে যুদ্ধ সংগঠিত রূপ লাভ করে সেই তাজউদ্দিনের নামও আড়াল করা হয়।
বস্তুত ১৯৭১-এর ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে যে উৎপাদনশীলতা বিরোধী, ন্যায়-নীতি বোধহীন, লুটেরা, দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ফাঁকিতে অভ্যস্ত শ্রেণী শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয় তা-ই কখনও নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যম, কখনও সামরিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বর্তমান দুর্বৃত্ত শ্রেণীর পূর্ণাবয়ব নিয়েছে এবং সমাজ ও রাষ্ট্রের দুর্বৃত্তায়নকেও পরিপূর্ণতা দিয়েছে। অনুৎপাদক এই দুর্বৃত্ত শ্রেণীর আর বিকাশ সম্ভব নয়। ন্যায়-নীতি, উৎপাদন এবং সামাজিক স্থিতিশীলতা বিরোধী হওয়ায় দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়া প্রকৃতপক্ষে আত্মঘাতী। সুতরাং দ্রুতবিকাশের পর এখন তার ধ্বংস সময়ের ব্যাপার মাত্র। এখন প্রশ্ন, বিকল্প রাজনৈতিক শক্তির উত্থান কীভাবে সম্ভব যা সমাজ ও রাষ্ট্রের বিদ্যমান দুর্বৃত্তায়ন প্রক্রিয়ার অবসান ঘটিয়ে দেশকে রক্ষা করবে এবং একটা উন্নত, আধুনিক, উৎপাদনশীল, লোকবাদী এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে এ দেশকে গড়ে তুলবে?
বস্তুত এর জন্য প্রয়োজন বিদ্যমান দুর্বৃত্তায়িত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহের পরিবর্তে এমন একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করা, যা এ দেশের সকল প্রগতিশীল, উৎপাদনশীল, লোকবাদী, গণতান্ত্রিক এবং সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ লোকদেরকে সংগঠিত করে একটি শক্তিতে পরিণত করবে।
এমন কর্তব্য সাধনের জন্য যে প্রাথমিক আদর্শের প্রয়োজন তার জন্য আমাদেরকে শূন্যে হাতড়াতে হবে না। ১৯৭১-এর জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে চেতনা মূর্ত হয়েছিল তার লিপিবদ্ধ একটি রূপ হিসাবে আমরা পেয়েছিলাম ১৯৭২-এর সংবিধানের ঘোষিত চার মূল নীতি, যথা, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং সেকিউলারিজম। জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের রাজনীতি যে বা যারাই গড়ে তুলুক ১৯৭২-এর সংবিধান তাকেই স্বীকৃতি দিয়েছিল। এভাবে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং সেকিউলারিজম বা লোকবাদ এ দেশের এক মহৎ অর্জন হয়ে দেখা দিয়েছে।
কিন্তু ১৯৭৫ পর্যন্ত এটা প্রকৃতপক্ষে সীমাবদ্ধ ছিল কাগুজে ঘোষণার ভিতর, যার বাস্তবায়ন ছিল না। কিন্তু ১৯৭৫ থেকে রাষ্ট্র সেই কাগুজে ঘোষণা থেকেও সরে যায়। সুতরাং চার নীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে স্বাধীনতা যুদ্ধের আদর্শের পথে নূতন করে যাত্রার শামিল।
এখন প্রশ্ন, এই যাত্রা কাদেরকে নিয়ে শুরু করা যাবে এবং কীভাবে শুরু করা যাবে? আমার বিবেচনায় এ দেশে বিদ্যমান সকল রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ব্যর্থ অথবা দুর্বৃত্তায়িত কিংবা দুর্বৃত্তায়ন রোধে অসমর্থ। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সেনাসহ সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য এ কথা প্রযোজ্য। নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক দলের শাসন এবং সামরিক অভুøত্থানের মাধ্যমে সেনাবাহিনীর শাসনের অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে। উভয় ধরনের শাসন ব্যবস্থা রাষ্ট্র ও সমাজের ক্রমবর্ধমান দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছে।
নির্বাচন প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এ দেশে ব্যাপক সংখ্যক পশ্চাৎপদ, পরনির্ভর, ধর্মাচ্ছন্ন ও সহজ পথের পথিক সহজিয়া জনসাধারণের মূঢ়তা ও অসচেতনতাকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে অর্থ-বিত্তের অধিকারী রাজনীতিকরা পালাক্রমে ক্ষমতায় এসেছে গেছে। এইভাবে একদল প্রতারক এবং অর্থ-বিত্ত ও পেশীশক্তির অধিকারী দুর্বৃত্ত এ দেশের রাজনীতিকে অধিকার করে তার দুর্বৃত্তায়ন ঘটিয়েছে। মাঝখানে প্রায় ১৫ বছর সামরিক ও আধা সামরিক শাসনের মাধ্যমে এই কাজ করেছে একদল সামরিক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে কিছু সংখ্যক অসামরিক রাজনৈতিক সহযোগী নিয়ে।
এই বাস্তবতায় এ দেশের রাজনীতিকে দুর্বৃত্তায়ন থেকে মুক্ত করতে হলে তাকে বিদ্যমান সকল আধিপত্যকারী সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ মুক্ত করা ছাড়া উপায় নেই। ফলে বিদ্যমান নির্বাচন প্রক্রিয়া থেকে তাকে যেমন মুক্ত করতে হবে তেমন সামরিক শাসনেও তাকে নিতে দেওয়া যাবে না। সুতরাং রাজনীতির পুনর্বিন্যাস সাধনের জন্য আমাদেরকে এমন এক বিকল্প রাজনৈতিক কাঠামো বা প্রতিষ্ঠান গড়তে হবে যা এ দেশের সকল আদর্শনিষ্ঠ ও দেশপ্রেমিক মানুষকে চার মূল নীতির ভিত্তিতে একটি সংগঠিত শক্তিতে পরিণত করবে।
মনে রাখতে হবে এই মানুষগুলো আজ যতই কোণঠাসা হোক তাঁরা সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বত্র ছড়িয়ে আছেন এবং নিজ নিজ জায়গায় থেকে অনেকেই অবর্ণনীয় সব প্রতিকূলতার বিরুদ্ধে লড়াই করে চলেছেন। রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, সেনা এবং এমনকি পুলিশসহ সর্বত্র তাঁরা আছেন। এই মানুষগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করার উপায় হচ্ছে চার মূল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের লক্ষ্যাভিমুখী আন্দোলনের প্রক্রিয়ায় আন্দোলনের প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত জাতীয় কনভেনশনের মাধ্যমে জাতীয় সরকার গঠন করা। বস্তুত এই জাতীয় সরকার হতে পারে এমন এক রক্ষাব্যূহ যার আবেষ্টনে থেকে দেশপ্রেমিক ও যোগ্য ব্যক্তিবৃন্দ সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রয়োজনীয় পুনর্বিন্যাস সাধন করে বাংলাদেশকে পরিণত করবে লোকবাদী, উন্নত, আধুনিক এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে।*
*নিবন্ধটি ২০০৩-এ লিখা এবং এটি ‘প্রজন্মের চেতনা’ নামক সংগঠনের মুখপত্র ‘প্রজন্মের বার্তা’র ২০০৪-এর ৬ জানুয়ারী তারিখে প্রকাশিত সংখ্যায় মুদ্রিত হয়। ওয়েবসাইট সংস্করণে ২/১টি জায়গায় সামান্য কিছু সংস্কার করা হয়েছে। - লেখক ০১.০৪.২০০৬