লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ July 18, 2020, 12:00 AM, Hits: 1166
বিষয়সূচী ঃ
প্রারম্ভিক কথা
ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা এবং সমস্যা
একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
প্রারম্ভিক কথা
এতদিন যারা আওয়ামী লীগকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পতাকাবাহী মনে করে এসেছিলেন লীগের সাম্প্রতিক কিছু কর্মকাণ্ডে তাদের অনেকের এখন ভির্মি খাবার দশা। আসলে তারা এই সত্য কোনও দিন বুঝবার প্রয়োজন মনে করেন নাই যে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান কালে কখনই মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির চর্চা বা প্রচার কিছুই করে নাই। মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতিটা এ দেশে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে অন্যরা গড়ে তুলেছিল। এই রাজনীতির পরিণতিতে ’৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে ঘটনাচক্রে লীগ তাতে জড়িয়ে পড়ে এবং তৎকালীন ভারত সরকারের সহায়তায় তার নেতৃত্ব দখল করে। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা লীগের মধ্যে খুঁজে বেড়ান তাদের আজ হতাশ হওয়া ছাড়া আর কীই বা করার আছে?
বস্তুত হেফাজতে ইসলামের মত ইসলামী দলগুলির সঙ্গে আওয়ামী লীগের সখ্য এবং তাদের দাবী অনুযায়ী শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রমবর্ধমান ইসলামীকরণ এবং কওমী মাদ্রাসার সর্বোচ্চ ডিগ্রীকে সাধারণ শিক্ষা ব্যবস্থার সর্বোচ্চ ডিগ্রী মাস্টার্সের সমমানের মর্যাদা প্রদান ইত্যাদি ঘটনার মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ তার স্বরূপ নূতনভাবে প্রকাশ করছে মাত্র। এটা বুঝা অত্যাবশ্যক যে, মুখে যা-ই বলুক বাস্তবে আওয়ামী লীগ ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বিকাশমান বাঙ্গালী মুসলমান মধ্যবিত্ত শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষক একটি ধর্মীয় সাম্প্রদায়িক দল, যা মুসলিম লীগ থেকে পাওয়া ইসলামী ঐতিহ্যের রসদে পুষ্ট। এই ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা আজ অবধি আওয়ামী লীগ তার সকল কর্মকাণ্ডে রক্ষা করে চলেছে।
এই ঘটনা অনেকের জানা আছে যে, ব্রিটিশ আমলে পাকিস্তান আন্দোলনের নেতৃত্ব মুসলিম লীগ নেতা মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ্ এবং লিয়াকত আলী খানের মত উর্দূভাষী কিংবা অবাঙ্গালীদের হাতে থাকলেও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানদের তুলনায়ও বাঙ্গালী মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং উদীয়মান বাঙ্গালী মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ভূমিকা ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করতে হয় লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপনকারী হিসাবে তৎকালীন বঙ্গের প্রধান মন্ত্রী আবুল কাসেম ফজলুল হকের কথা। সেই সময় অবিভক্ত বঙ্গের মুখ্য মন্ত্রীকে প্রধান মন্ত্রী বলা হত। তিনি ১৯৪০ সালে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের লাহোরে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে ‘লাহোর প্রস্তাব’ পাঠ করেন। এতে ভারতের উত্তর-পূর্ব ও উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশ বা অঞ্চল সমূহ নিয়ে ‘স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহ’ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এই প্রস্তাব পরবর্তী কালে পাকিস্তান প্রস্তাব হিসাবে কথিত হয়। কিন্তু তখনও পাকিস্তান কিংবা এক রাষ্ট্র গঠনের কথা ছিল না। অর্থাৎ ১৯৪০ সালে মুসলিম লীগ কর্তৃক গৃহীত লাহোর প্রস্তাবে ভারতের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চলসমূহ নিয়ে রাষ্ট্রসমূহ গঠনের কথা ছিল। মুসলিম লীগ ১৯৪৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রসমূহের পরিবর্তে পাকিস্তান নামে একটি একক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব পাস করে। ১৯৪০ সালে গৃহীত লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক আন্দোলন এভাবে ১৯৪৬ সালে মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান নামে একটি একক রাষ্ট্র গঠনের আন্দোলনে পরিণত হল।*
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* দ্রষ্টব্য : মহিউদ্দিন আহমদ, আওয়ামী লীগ : উত্থান পর্ব ১৯৪৮-১৯৭০, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, দ্বিতীয় মুদ্রণ, জানুয়ারী ২০১৭, পৃষ্ঠা- ১৬-১৮।
--------------------------------------------------------------------------------------------------------------
কিন্তু পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় যে ঘটনা সেই সময় একটি নির্ধারক ভূমিকা রাখে সেটি হচ্ছে ১৯৪৬ সালে ‘গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং’ নামে অভিহিত কলকাতায় অনুষ্ঠিত সাম্প্রদায়িক হত্যাযজ্ঞ। এই হত্যাযজ্ঞে তখনকার অবিভক্ত বঙ্গের প্রধান মন্ত্রী এবং বঙ্গের মুসলিম লীগ নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দীর ভূমিকা বহুল আলোচিত।* ভারত ভাগ ক’রে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবীতে মুসলিম লীগ ১৯৪৬-এর ১৬ আগস্ট তারিখে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস (Direct Action Day) ঘোষণা করে। ঐ দিন সকাল থেকেই কলকাতায় ভযাবহ দাঙ্গা শুরু হয় যা তিন দিন তীব্র গতি নিয়ে চলে। দাঙ্গা পরিস্থিতি শান্ত হতে প্রায় এক সপ্তাহ লাগে। এতে প্রাণহানি হয় হাজার হাজার মানুষের। হাজার হাজার বাড়ীঘর লুণ্ঠিত হয়। লক্ষাধিক মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়। হাজার হাজার নারী ধর্ষিত ও অপহৃত হয়। এই হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠানে সোহরাওয়ার্দীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা বা সরাসরি উদ্যোগ কতটা ছিল সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যে, বঙ্গের শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত প্রধান ব্যক্তি হিসাবে সোহরাওয়ার্দীকেই এই হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী করতে হবে। হিন্দুদের উপর সংগঠিত আক্রমণ অভিযান পরিচালনার সুবিধার জন্য কলকাতার পুলিশ এবং প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রাখা হয়েছিল, যা ছিল তখন সোহরাওয়ার্দীর নিয়ন্ত্রণাধীন। অবশ্য কিছু ক্ষেত্রে মুসলিম লুঠেরা ও ঘাতকদের প্রশ্রয় ও রক্ষায় সোহরাওয়ার্দীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা সম্পর্কে জানা যায়। এই ঘটনার ক্রিয়া এবং প্রতিক্রিয়ার ধারাবাহিকতায় বঙ্গের নোয়াখালী এবং বিহার, উত্তর প্রদেশ, পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশসহ সারা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ভয়াবহ দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এতে হিন্দু ও মুসলমান উভয় পক্ষে বিপুল সংখ্যক প্রাণহানি ঘটে। পরিণতিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* দ্রষ্টব্য : ল্যারি কলিন্স ও দোমিনিক ল্যাপিয়ের, ফ্রিডম অ্যাট মিডনাইট, অনুবাদঃ হরিশেখর সেনগুপ্ত, প্রকাশক- এম, সি, সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, প্রকাশ কাল ১৩৯৭, পৃষ্ঠা- ২৯, ৩০ এবং ২৫৯-২৬০।
H. V. Hodson, The Great Divide : Britain – India – Pakistan, Oxford University Press, Karachi, First published 1969, pp. 166-167.
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
এভাবে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় সোহরাওয়ার্দীর ভূমিকা ছিল বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ভূমিকার তাৎপর্য বুঝলে আমরা ১৯৫০-এর দশকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনকে সংহত ও দৃঢ়বদ্ধ করার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ এবং বিশেষ করে তৎকালীন আওয়ামী লীগের নেতা সোহরাওয়ার্দীর বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের তাৎপর্য বুঝতে পারব। এখন সেই দিকে একটু দৃষ্টি দেওয়া যাক।
পূর্ব বঙ্গের আইন পরিষদে ১৯৫৪ সালের নির্বাচনকে সামনে রেখে ১৯৫৩ সালে গঠিত যুক্তফ্রন্টের কর্মসূচী হিসাবে গৃহীত হয় ২১ দফা কর্মসূচী। এই কর্মসূচীতে পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের দাবীর উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগ ছিল যুক্তফ্রন্টের অন্যতম প্রধান শরীক দল। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট বিপুল ভোটাধিক্যে জয়ী হয় এবং মুসলিম লীগের কবর রচিত হয়। এই নির্বাচনের ফলাফল অনুযায়ী আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্টের প্রধান শরীক দল হিসাবে বেরিয়ে আসে।
একদিকে পূর্ব বঙ্গে যখন এই বাস্তবতা তখন অন্যদিকে পাকিস্তানের তৎকালীন রাজধানী করাচীতে ঘটছে ভিন্ন আর এক ঘটনা। ১৯৫৬ সালের মার্চে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান কার্যকর হয় যাতে পাকিস্তানকে ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করা হল। এই সংবিধানে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলিকে বাতিল করে এক ইউনিট গঠন করা হল। অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তান একটি মাত্র প্রদেশে পরিণত হল। এভাবে সেখানকার সিন্ধী, পাশতুন বা পাঠান এবং বালুচ জাতিকে পাঞ্জাবীদের পদতলে নিক্ষেপের ব্যবস্থা করা হল। অন্যদিকে পূর্ব বঙ্গকে পূর্ব পাকিস্তান নামে অপর ইউনিট হিসাবে গণ্য করা হল। শুধু তাই নয়, পূর্ব বঙ্গের জনসংখ্যা অনেক বেশী হলেও কেন্দ্রীয় সংসদের আসনে সংখ্যাসাম্য করা হল। ফলে পাকিস্তানের জাতীয় সংসদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ১৫০ আসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য ১৫০ আসন বরাদ্দ করা হল। অন্যদিকে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবীকে উপেক্ষা করা হল। এই সংবিধান রচনায় প্রধান ভূমিকা রাখেন ১৯৫৪ সালে পাকিস্তানের আইন মন্ত্রী হিসাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবী প্রাধান্য বিশিষ্ট শাসক শ্রেণীর স্বার্থ সংরক্ষণের পুরস্কার হিসাবে এর কিছু দিন পরেই সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হলেন। এই হল ‘গণতন্ত্রের মানসপুত্রের’ কিছু কর্মকাণ্ডের নমুনা। এই ব্যক্তির অনুসারী হয়েই শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্রের কেন্দ্রীয় সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিলেন।
১৯৫৬-তে পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হয়ে সোহরাওয়ার্দী ২১ দফার স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করলেন। শেখ মুজিবও তার অনুসারী হলেন। তাদের বক্তব্য তখন পরিষ্কার। তারা এখন পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায়; সুতরাং স্বায়ত্তশাসন হয়ে গেছে। ১৯৫৭-এর ১৪ জুন তারিখে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় তার বক্তৃতায় প্রধান মন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানকে শতকরা আটানব্বই ভাগ স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছে।’
অন্যদিকে, পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের গৃহীত সিদ্ধান্ত ছিল স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির পক্ষে। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী এ প্রশ্নেও ডিগবাজী দিলেন। তিনি এক তত্ত্ব হাজির করলেন যে, শূন্যের সঙ্গে যত শূন্য যোগ করা যাক যোগফল শূন্যই হয়। সুতরাং দুর্বল পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসাবে মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোটে থাকতে হবে। এ প্রশ্নেও তিনি শেখ মুজিবকে তার সঙ্গে পেলেন। এভাবে সোহরাওয়ার্দী এবং মুজিবের সঙ্গে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। কারণ ভাসানী ছিলেন ক্ষমতার লোভে এভাবে নীতি ও কর্মসূচীর প্রতি প্রতারণা ও অঙ্গীকারভঙ্গের বিরুদ্ধে।
এই ইতিহাসকে আজকের মুজিব ও লীগ প্রেমীরা যেমন জানতে চান না তেমন জানলেও এটাকে তারা চেপে রাখতেই পছন্দ করেন। এই রকম এক বাস্তবতায় ষাটের দশকে এ দেশে পূর্ব বাংলার বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তার ইতিহাস তারা জানতে চাইবেন কেন? প্রকৃতপক্ষে এই লোকগুলি কখনই কোনও ঘটনার গভীরে গিয়ে বুঝতে চান নাই। সুতরাং যুদ্ধের আগে যে যুদ্ধের রাজনীতি থাকে সেটা তারা মানতে চান নাই। এ দেশে ষাটের দশকে গড়ে উঠা বাঙ্গালীর স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস এবং তার তাৎপর্য বুঝবার আগ্রহ যাদের নাই তারা কী করে বুঝবেন যে পূর্ব প্রস্তুতি ছাড়া একটা স্বাধীনতা যুদ্ধ কীভাবে ’৭১-এ হঠাৎ করে শুরু হয়?
আসলে মুক্তিযুদ্ধের পূর্বেও যে তার আন্দোলনের একটা ইতিহাস আছে সেটুকু জানবার আগ্রহও তারা কখনই বোধ করেন নাই। তারা মনে করেন, স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনকে দমন করবার জন্য পাকিস্তানী সেনাবাহিনী হঠাৎ করে আক্রমণ করেছে আর তার মোকাবিলায় স্বাধীনতা যুদ্ধও হঠাৎ করে শুরু হয়েছে। সুতরাং তারা মুক্তিযুদ্ধের জটিলতা বুঝতে চাইবেনই বা কেন কিংবা তারও পূর্বে সুচিত মুক্তিযুদ্ধের রজনীতিতে যে জটিলতা ও সমস্যা ছিল সেগুলিকেই বা বুঝতে চাইবেন কেন? দৃশ্যমান ঘটনার অন্তরালে অনেক সময় যে ভিন্ন এমনকি বিপরীত সত্য লুকিয়ে থাকে তার উদ্ঘাটনে যে শ্রম বা ঝামেলা থাকে তা তারা করতে চান না। তারা উপরের সাজানো-গুছানো আবরণ দেখেই মোহিত হয়ে থাকতে পছন্দ করেন। সুতরাং তাদের প্রিয় দল লীগ যে অন্যদের দ্বারা তৈরী স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতির পরিণতিতে সূচিত স্বাধীনতা যুদ্ধ ভারতের সাহায্যে ১৯৭১-এ আত্মসাৎ ক’রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মালিকানার দাবীদার হয়েছে এই সত্য তারা কখনই বুঝতে পারেন নাই কিংবা বুঝতে বা মানতে চান নাই।
অথচ যুদ্ধের পূর্বে আওয়ামী লীগ এবং তার নেতা শেখ মুজিব চেয়েছিলেন পাকিস্তানকে রক্ষা করে তার রাষ্ট্র ক্ষমতায় যেতে। যখন সেটা সম্ভব হয় নাই তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে শেখ মুজিব ধরা দিয়ে পাকিস্তান সরকারের জেলে গিয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে বসে থাকলেন। কিন্তু পূর্ব বঙ্গের জনগণ বসে থাকে নাই। তারা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিদ্রোহ শুরু করল। ফলে শুরু হল প্রতিরোধ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে শুধু বাঙ্গালী যোগ দিল না যোগ দিল সাঁওতাল, ওরাওঁ, গারো এবং পার্বত্য চট্রগ্রামের পাহাড়ীসহ পূর্ব বঙ্গের সকল জাতিসত্তার মানুষ। এভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ পরিণত হল বাঙ্গালীর এবং পূর্ব বঙ্গের ভূমি সন্তান সকল জাতির মানুষদের জাতীয় মুক্তি যুদ্ধে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব দেশের ভিতরে থেকে মুক্তিযুদ্ধ শুরুর দায়িত্ব না নিয়ে দল বেঁধে পালিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়ে এবং ভারত সরকারের সাহায্য নিয়ে ইতিপূর্বেই দেশের ভিতর থেকে শুরু হয়ে যাওয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব দখল করল। তাড়া খেয়ে ভারতে পালানো এই আওয়ামী লীগ চেয়েছিল প্রকৃতপক্ষে মর্মবস্তুতে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান যার নাম তারা দিয়েছিল বাংলাদেশ। আর ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারও ঠিক তা-ই চেয়েছিল। কোন দুঃখে তারা এখানে একটি প্রকৃত লোকবাদী বা সেকিউলার রাষ্ট্র চাইতে যাবে, যার প্রভাব গিয়ে পড়বে ভারতের বাংলাভাষী অঞ্চলগুলিতে, বিশেষত পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরায় এবং শেষ পর্যন্ত সমগ্র ভারতে?
এ কথা বুঝতে হবে যে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মর্মে আছে ধর্মদ্রোহ। এই ধর্মদ্রোহী রাজনীতি আর যেই হোক আওয়ামী লীগ যে গড়ে নাই এটা বুঝবার জন্য বেশী ইতিহাস জ্ঞানের প্রয়োজন হয় না। সুতরাং ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ধ্বংস করে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের বুকে একটি লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতি এ দেশে তারাই গড়েছিল যারা ছিল ধর্মমুক্ত এবং বস্তুবাদী দর্শনে বিশ্বাসী। এরা এ দেশে ছিল গত শতাব্দীর মূলত ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম যারা অলোকবাদী ধর্ম হিসাবে ইসলামে অবিশ্বাসী ছিল এবং বস্তুবাদী দর্শন হিসাবে মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিল। এরা ছিল ধর্মীয় পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান বিরোধী। ফলে তারা ছিল জাতীয়তাবাদী, এমন জাতীয়তাবাদী যারা বাঙ্গালীর রাষ্ট্র চিন্তাকে যেমন প্রাধান্য দিয়েছিল তেমন একই সঙ্গে এই বঙ্গের সকল অবাঙ্গালী সংখ্যলঘু জাতিগুলির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারেও বিশ্বাসী ছিল। যেমন পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ী জাতিসত্তাসমূহের স্বায়ত্তশাসন দাবীর প্রতি তাদের ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। এরা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে উচ্ছেদ করে পূর্ব বঙ্গের বুকে বাঙ্গালীর একটি জন-গণতান্ত্রিক কিংবা সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখত।
এ কথা স্পষ্ট এবং জোরালোভাবে বলার প্রয়োজন আছে যে, ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ধ্বংস করে লোকবাদী তথা ধর্মমুক্ত জাতি হিসাবে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য যে স্বাধীনতার রাজনীতি এ দেশে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম গড়ে তুলেছিল সেই রাজনীতির পরিণতি হচ্ছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।* বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সেই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে। এই ঘটনার তাৎপর্য বুঝলে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রকৃত তাৎপর্য বুঝতে অসুবিধা হয় না। ভোটের রাজনীতির খেলায় ফেলে যারা বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের তাৎপর্যকে বুঝতে এবং বুঝাতে চান তাদের হাতে পড়েই বিগত প্রায় অর্ধ শতাব্দী কাল ধরে বাংলাদেশের এ করুণ পরিণতি। বস্তুত স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রকৃত সমস্যা ও তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদেরকে ষাটের দশকে এ দেশে যে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম গড়ে উঠেছিল তাদের ভূমিকা এবং সমস্যা বুঝতে চাইতে হবে। আর তখন শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, উপরন্তু ধর্মীয় রাজনীতিরও বিরুদ্ধে একটি প্রজন্মের উত্থান রূপে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের উত্থানকে চেনা যাবে।
----------------------------------------------------------------------------------------------------------------
* এ প্রসঙ্গে আমি আমার বিভিন্ন লেখায় ও গ্রন্থে আলোচনা করেছি। যথা, রাজনীতির পুনর্বিন্যাস, বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের ভূমিকা, বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র ঃ সমস্যা ও করণীয়, বাংলাদেশের সঙ্কট, বাংলাদেশের দুর্বৃত্তায়ন, বাংলাদেশের সঙ্কট ও উত্তরণের পথ, আওয়ামী লীগ-বিএনপি বিরোধের সমাজতত্ত্ব, বাংলাদেশের রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন ও জাতীয় সরকারের প্রয়োজনীয়তা, ইত্যাদি।
------------------------------------------------------------------------------------------------------------------
ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা এবং সমস্যা
বস্তুত ষাটের দশকের স্বাধীনতার রাজনীতির বিকাশের পিছনে ঊনিশশ’ বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনের এক বিরাট ভূমিকা ছিল। কারণ ভাষা আন্দোলন এ দেশের মুসলমান বাঙ্গালীকে তার ধর্ম পরিচয়ের ঊর্ধ্বে উঠে প্রথম কার্যকরভাবে নিজ জাতি পরিচয়কে চিনতে শিখিয়েছিল। এই বোধ পঞ্চাশের দশকেই ধর্মমুক্ত এমনকি ধর্মবিরোধী দর্শন হিসাবে মার্কসবাদের আশ্রয় নিয়ে পুষ্ট হতে শুরু করলেও ষাটের দশকে তা পূর্ণতা নেয়।
এর ফলে তৎকালীন পূর্ব বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতির একটি লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষার প্রকাশ ঘটে। এটি ছিল বাঙ্গালী জাতির এমন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা যেখানে এই ভূমির সংখ্যালঘু অবাঙ্গালী জাতিসত্তাগুলির স্বশাসন বা স্বায়ত্তশাসনেরও পূর্ণ স্বীকৃতি ছিল। অর্থাৎ এর মধ্যে সুপ্ত ছিল বাংলাদেশকে বাস্তবে একটি বহুজাতিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তুলবারও সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা। সেই সঙ্গে ছিল একটি সমাজতান্ত্রিক অথবা সমাজতান্ত্রিক ধাঁচের কাঠামো প্রতিষ্ঠারও আকাঙ্ক্ষা। বাস্তবে কী হয়েছে সে তো আমরা সকলেই দেখতে পাচ্ছি। অন্যসব আকাঙ্ক্ষার প্রসঙ্গ এখন থাক। এখন শুধু এইটুকু বলি যে, একদিকে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সূচনা পর্ব থেকেই নানান কৌশলে সমাজ, রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে ইসলামকে সংরক্ষণ ও লালন করা হয়েছে এবং অবশেষে ইসলামকে রাষ্ট্রের ধর্ম হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ হল একদিক। অন্যদিকে এই ইসলামীকরণের অংশ হিসাবে বিশেষত হিন্দু সম্প্রদায় ও জাতিগত সংখ্যালঘুদের উপর সম্ভাব্য সব রকম নির্যাতন চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়ন করা হচ্ছে এবং তাদের সম্পদ ও সম্পত্তি লুণ্ঠন করা হচ্ছে। তাদের নারীদের সম্ভ্রম এবং জীবনও যখন তখন লুণ্ঠিত হচ্ছে। এভাবে গত ৪৫ বৎসর ধরে আমরা যে বাংলাদেশকে দেখছি তা চরিত্রগতভাবে পাকিস্তানের উত্তরাধিকারী।
তবু একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ যেমন বাস্তব তেমন গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে সূচিত এবং ষাটের দশকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত স্বাধীনতার রাজনীতিও বাস্তব। এই রাজনীতির পূর্ণাঙ্গ না হলেও আংশিক পরিণতি ঘটেছে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়। এখন কাল প্রেক্ষিতে এই রাজনীতির মৌলিক বাস্তবায়নের প্রয়োজনে রাষ্ট্রের পুনর্গঠনের কাজে হাত দেওয়াই সময়ের দাবী। আর এই কাজের প্রথম শর্ত হচ্ছে বাংলাদেশ-রাষ্ট্রটিকে ইসলাম তথা ধর্ম থেকে মুক্ত করা। রাষ্ট্র হবে ধর্মীয় বিশ্বাস বা পরিচয় মুক্ত তথা লোকবাদী।
’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি রচনায় শুধু ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের ভূমিকাকে দেখলে চলবে না, অধিকন্তু ষাটের দশকে উত্থিত বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ভূমিকাকেও দেখতে এবং বুঝতে হবে। এবং একই সঙ্গে বুঝতে হবে ঐ প্রজন্মের সমস্যাও। বিশেষত এই প্রজন্মের ভূমিকা আলোচনার সময় তাদের সমস্যাটাও এখানে আমি কিছুটা নিয়ে আসার চেষ্টা করব। তা না হলে ঐ প্রজন্মের সমস্যা এবং পরিণতিতে ব্যর্থতার কারণগুলিকেও শনাক্ত করা যাবে না।
পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতাকামী ছাত্রদের এই প্রজন্ম তৎকালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নে সংগঠিত ছিল। সংখ্যার বিচারে তুলনায় ক্ষুদ্র হলেও অগ্রণী এবং নির্ধারক অংশের ভিতর অলোকবাদী ধর্মের প্রতি অবিশ্বাস তাদেরকে একটি ধর্মমুক্ত সমাজ নির্মাণের ভিত্তিভূমি হিসাবে বাঙ্গালী জাতির স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের চিন্তায় নিয়ে যায়। বাংলা ভাষা ও বাঙ্গালী জাতির প্রতি পাকিস্তান সরকারের উপেক্ষা তাদের মনে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আবেগ জাগিয়েছিল এ কথা সত্য। কিন্তু তাদের ভিতর ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র-চিন্তা ও সমাজ-চিন্তা জাগাবার ক্ষেত্রে সে কালে মার্কসবাদ বা কমিউনিস্ট রাজনীতির ধর্মবিশ্বাসহীনতা তথা বস্তুবাদী দর্শন চিন্তার প্রভাব যে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল সেটাকে অস্বীকার করা ভুল হবে।
সেটা ছিল বিশ্বব্যাপী কমিউনিস্ট আন্দোলনের জোয়ারের কাল। এ দেশেও তার ঢেউ আছড়ে পড়ে। ১৯৬০-এর দশকের ছাত্র ও তরুণ প্রজন্ম এর দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়। বিশেষত কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্তি ঐ প্রজন্মের মনে জাতিগত পরিচয়ের প্রশ্নে সঙ্কট সৃষ্টি করে। ইসলামকে মানলে পাকিস্তানের পরিচয় ঠিক থাকে। তখন সেটাকে মানা যায়। কিন্তু ইসলামকে না মানলে তারা কীভাবে পাকিস্তানী থাকে, যার ভাবাদর্শিক ভিত্তি ইসলাম? এইভাবে একটি দার্শনিক জিজ্ঞাসা তাদেরকে পাকিস্তানের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র-চিন্তার বিপরীতে ধর্ম এবং ধর্মীয় পরিচয় থেকে মুক্ত জাতি পরিচয়ের সন্ধান করতে বাধ্য করে।
ঐ প্রজন্মের একজন হিসাবে অন্তত নিজের কথাটা দিয়েই এ প্রসঙ্গের অবতারণা করতে পারি। ১৯৫৭ সালে আমি রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুলে যখন অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি তখনই আমি আমার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার পরিণতিতে অলোকবাদী ধর্ম বিশ্বাস পরিত্যাগ করি এবং লোকবাদে আস্থা অর্পণ করি। তর্ক-বিতর্ক এবং ব্যাখ্য-বিশ্লেষণের মাধ্যমে আমি একদিকে যেমন ধর্ম এবং ভাববাদ বর্জন করে বস্তুবাদকে গ্রহণ করি এবং এর পরিণতিতে বস্তুবাদী দর্শনের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠা রাজনৈতিক মতবাদ হিসাবে মার্কসবাদকে গ্রহণ করি, অপর দিকে তেমন ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান বিরোধীও হয়ে পড়ি। অলোকবাদী ধর্মে বিশ্বাস বা আস্থা থাকলে জাতিগত পরিচয় নিয়ে আমার মনে সমস্যা দেখা দিত না। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি অলোকবাদী ধর্মকে ভ্রান্ত বলে মনে করি সেই মুহূর্ত থেকে আমি বাঙ্গালী হিসাবে নিজ জাতিগত পরিচয় নিয়ে দাঁড়াতে চেয়ে বাঙ্গালীর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তাকে গ্রহণ করি।
আমার নিজের এই প্রসঙ্গ এখানে উল্লেখ করলাম ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের গতিধারাকে মূর্ত করে তুলে ধরার জন্য। এ কথা মনে করলে ভুল হবে যে আমাদের প্রজন্মের সবাই কিংবা অধিকাংশই আমার মত করে বুদ্ধিবৃত্তিক বা জ্ঞানতাত্ত্বিক চর্চার মধ্য দিয়ে বিপ্লবী কিংবা বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার রাজনীতির দিকে এগিয়েছিল। তা সত্ত্বেও এ কথা বলা যায় যে, সে কালে পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালীদের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর জাতিগত বঞ্চনা, উপেক্ষা এবং বৈষম্যের বাস্তবতায় বিশেষত ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে দাঁড়ানো তরুণ প্রজন্মের উপর মার্কসবাদ বা কমিউনিস্ট রাজনীতির প্রভাব তাদেরকে সহজেই পাকিস্তানের পরিবর্তে বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তার দিকে নিয়েছিল।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে নবজাগ্রত বাঙ্গালী চেতনার সঙ্গে ধর্মবিশ্বাস মুক্ত কমিউনিস্ট রাজনীতির সম্মিলনের ফলে যে বাঙ্গালী জাতির নূতন সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটবে সেটা ছিল স্বাভাবিক। এই চিন্তার ভিতর ছিল ধর্মীয় বিভক্তির ঊর্ধ্বে উঠে বাঙ্গালী জাতির ঐক্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাও। কারণ ধর্মকে অস্বীকার করলে নৈতিক ও যৌক্তিকভাবে তাদেরকে সেই জায়গাতেই যেতে হয়। যেমন আমার দৃষ্টিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ধর্মের ভিত্তিতে বাঙ্গালী জাতির বিভাজন ঘটানো ছিল আমাদের পূর্ব প্রজন্মের একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্তি। এই ভ্রান্তি সংশোধনের উপায় হিসাবে আমি দুইটি পর্যায়কে দেখতে পাই। প্রথম পর্যায় পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বঙ্গকে স্বাধীন করে এখানে বাঙ্গালী জাতির একটি লোকবাদী বা ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। দ্বিতীয় পর্যায়টি আমার মত যারা চিন্তা করত তাদের দৃষ্টিতে প্রথম পর্যায়ের সম্প্রসারণ। সেটা হচ্ছে উভয় বঙ্গের স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে বঙ্গ ও বাঙ্গালী জাতির পুনরেকত্রীকরণ। সে কালে তরুণ প্রজন্মের সবাই দার্শনিক দৃষ্টি থেকে এভাবে যে চিন্তা করত তা নয়, কিন্তু এই প্রজন্মের যারা চিন্তার ক্ষেত্রে অগ্রণী ছিল এবং সেই সঙ্গে কর্ম ও আন্দোলনেও গুরুত্বপূর্ণ এমনকি অনেক ক্ষেত্রে নির্ধারক ভূমিকা পালন করত তাদের ভিতর এমন একটি দৃষ্টিভঙ্গী কাজ করত। অবশ্য আমার মত কারও কারও ভিতর সমাজতান্ত্রিক বাংলা প্রতিষ্ঠা ছিল ঐক্যবদ্ধ ও সমাজতান্ত্রিক ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার পূর্ববর্তী পদক্ষেপ। অর্থাৎ সে ক্ষেত্রে এই ধরনের চিন্তার ভিতর ছিল এই উপমহাদেশের প্রেক্ষিতে বিপ্লবের তিনটি পর্যায়ের ধারণা।
তবে এ কথা বুঝতে হবে যারা এই চিন্তা করছিল তাদের সামনে ছিল পাকিস্তানের বাস্তবতা। সুতরাং তারা তৎকালে তাদের বিবেচনা এবং কর্মের মূল ভূমি হিসাবে ভারত কিংবা ভারতের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম বঙ্গের পরিবর্তে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত পূর্ব বঙ্গকে অগ্রাধিকার দিয়েছিল। এই চিন্তা ছাত্র ও তরুণ প্রজন্মের ভিতর পঞ্চাশের দশকে জন্ম নিলেও প্রধানত তার বিকাশ ও বিস্তৃতি ঘটে ষাটের দশকে। তরুণ প্রজন্মের এই রাষ্ট্র চিন্তা থেকে ষাটের দশকে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি। এই রাজনীতি ষাটের দশকের শেষার্ধে ক্রমবর্ধমানভাবে প্রকাশ্য আন্দোলনে রূপ নেয়। এই রাজনীতির বিকাশ শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান বা পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী জনগোষ্ঠীকে রেখে পাকিস্তানের রাজনীতিকে এগিয়ে নেওয়ার পথ বন্ধ করে দেয়। পরিণতিতে যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান ভেঙ্গে যায় এবং পূর্ব বাংলা বাংলাদেশ নাম নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হয়।
বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতির সঙ্গে আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনমূলক ৬ দফার রাজনীতিকে মিলাবার চিন্তা ভ্রান্ত। দুইটি দুই ভিন্ন ধারার রাজনীতি। প্রথমটি ছিল বাঙ্গালী জাতির একটি ধর্মমুক্ত তথা অসাম্প্রদায়িক ও লোকবাদী রাষ্ট্র-চিন্তার অভিব্যক্তি। দ্বিতীয়টি ছিল ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাঙ্গালী মুসলমানদের জন্য স্বায়ত্তশাসনের আকাঙ্ক্ষার এবং এমনকি সম্ভব হলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে পশ্চিম পাকিস্তানীদেরও উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার সুপ্ত আকাঙ্ক্ষার অভিব্যক্তি। এ কথা আমাদের জানা দরকার যে তৎকালীন পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানের বাংলাভাষীরা ছিল সংখ্যাগুরু (১৯৬১-এর লোকগণনার হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৩০ লক্ষ, যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৫ কোটি আর পশ্চিম পাকিস্তানের জনসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ২৮ লক্ষ। - সূত্রঃ ইন্টারনেট : https://en.wikipedia.org/wiki/Census_in_Pakistan) এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমানরা কয়েকটি জাতিতে বিভক্ত, ফলে তাদের মধ্যে ছিল জাতিগত দ্বন্দ্বও, যার সুযোগ নেওয়া বাঙ্গালী মুসলমানদের পক্ষে ছিল সহজতর। যাইহোক, যেভাবেই দেখা যাক, পাকিস্তানভুক্ত পূর্ব বাংলার যে কোনও ধরনের স্বায়ত্তশাসনমূলক রাজনীতি ছিল পাকিস্তানের ইসলামী রাষ্ট্র-চিন্তার অভিব্যক্তি।
প্রথমটি এসেছিল ধর্মীয় চেতনা ও পরিচয় ভিত্তিক রাষ্ট্র ভাঙ্গার তাড়না থেকে। একই সঙ্গে এই রাজনীতির মর্মে ছিল বাঙ্গালীর অখণ্ড রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষাও। কারণ পাকিস্তানের ধর্ম ভিত্তিক রাষ্ট্র-চিন্তাকে প্রত্যাখ্যানের যৌক্তিক, নৈতিক ও দার্শনিক পরিণতি হয়ে দাঁড়ায় অখণ্ড বঙ্গ প্রতিষ্ঠা যে কথাটা একটু আগেই বলেছি। তবে সে কালে অখণ্ড বঙ্গ প্রতিষ্ঠার চিন্তা সামনে আসবার কারণ ছিল না। যেমন কারও কারও মনে থাকা সমাজতান্ত্রিক এবং যুক্তরাষ্ট্রীয় ভারতবর্ষ প্রতিষ্ঠার চিন্তাও তখন সামনে আসবার কারণ ছিল না। তখন পাকিস্তান ভেঙ্গে পূর্ব বঙ্গের বুকে ধর্মীয় পরিচয় মুক্ত বাঙ্গালীর একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই ছিল মূল করণীয়, যার সমস্যাগুলি নিয়ে সে কালের বিশেষত বামপন্থী তরুণ প্রজন্ম যে বিশেষভাবে ভাবিত হবে সেটাই স্বাভাবিক।
দ্বিতীয় ধারা তথা স্বায়ত্তশাসন বা ৬ দফার রাজনীতি পাকিস্তানের কাঠামোবদ্ধ রাজনীতি, যে কথা একটু আগেই বলেছি। এটা পাকিস্তানের ইসলামী রাজনীতিরই প্রকারভেদ মাত্র। এর ভিতর পাকিস্তান থেকে ভিন্ন রাষ্ট্র-চিন্তার প্রকাশ আশা করা ভ্রান্ত। এখানে বাঙ্গালীর স্বাতন্ত্র্যের ভাবনা থাকলেও সেটা ইসলামী সত্তা কিংবা পরিচয়ের অন্তর্ভুক্ত হয়ে থেকেছে। সুতরাং তার ভিতর থেকে ধর্মীয় পরিচয় ও বিশ্বাস মুক্ত বাঙ্গালী জাতির নয়, বরং বাংলা ভাষাভাষী মুসলমানের কণ্ঠস্বর উচ্চারিত হয়। মনে রাখতে হবে সেটা বাঙ্গালী হোক আর যা-ই হোক সেটা মুসলমান। মুসলমানেরই একটা রূপ সেটা, যেটা অমুসলমান কিংবা ধর্মবিশ্বাস মুক্ত বাঙ্গালীর সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে স্পষ্ট হয়ে ধরা দেয়। সুতরাং এই বাঙ্গালী মর্মমূলে ইসলামে বিশ্বাসী এবং ধর্মপ্রাণ মুসলমান। হ্যাঁ, এটা স্পষ্টভাবে বলতে হবে যে, ৬ দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ইসলাম বিশ্বাসী তথা ঈমানদার মুসলমান বাঙ্গালীর কর্মসূচী। এই ঈমানদার মুসলমান বাঙ্গালীদের শ্রেষ্ঠ নেতা শেখ মুজিব সেটা তার ৬ দফা কর্মসূচীর প্রস্তাব - ১-এ স্পষ্ট করে দিয়েছেন এ কথা বলে, ‘দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো এমনি হতে হবে যেখানে পাকিস্তান হবে একটি ফেডারেশনভিত্তিক রাষ্ট্রসংঘ এবং তার ভিত্তি হবে লাহোর প্রস্তাব।’
লাহোর প্রস্তাব কী তা যারা জানেন তাদের কাছে এই কর্মসূচীর তাৎপর্য বুঝা কষ্টকর হবে না। সুতরাং ৬ দফা যে রাষ্ট্র-চিন্তাকে তুলে ধরে সেটা বাঙ্গালী মুসলমানের রাষ্ট্র-চিন্তা। সেটাও ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামোবদ্ধ বাঙ্গালী মুসলমানের রাষ্ট্র অর্থাৎ ফেডারেল পাকিস্তান। এর ভিতর স্বাধীনতা, বাঙ্গালীর সেকিউলার কিংবা লোকবাদী রাষ্ট্র-চিন্তা এসব খুঁজে বেড়ানোটা হাস্যকর চেষ্টা, যেটা অনেকেই করেন। এমনকি এই ধরনের রাষ্ট্রচিন্তা যদি কখনও পশ্চিম পাকিস্তানী তথা পশ্চিমা মুসলমানদের সঙ্গে দ্বন্দ্বের পরিণতিতে বাঙ্গালী মুসলমানদেরকে পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্নতা তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার দিকে নিয়ে যেত তবে সেটাও বাস্তবে আর একটি পাকিস্তান তথা বাঙ্গালী মুসলমানের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর কী হতে পারত? এবং বাস্তবে মূলত কী হয়েছে, কেন হয়েছে সেটা কি নূতন করে ভেবে দেখা উচিত নয়?
তবে একই সঙ্গে এ কথা বলতে হবে যে, পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতার আন্দোলনের বিকাশ ও বিস্তারের জন্য ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচীর ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই কর্মসূচী ভিত্তিক আন্দোলনের প্রভাবে স্বাধীনতার রাজনীতির বিকাশ ঘটানো সহজতর হয়েছিল। এটা স্বাধীনতার রাজনীতিকে একটা প্রয়োজনীয় আড়াল এবং প্রেরণা দিয়েছিল। অন্যদিকে, একই সঙ্গে এটাও ঠিক যে, বামপন্থী তরুণ প্রজন্মের ক্রমবিকাশমান স্বাধীনতার রাজনীতি জাতীয় রাজনীতির উপর এমন চাপ সৃষ্টি করে যে তার প্রভাবে ৬ দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের রাজনীতিও প্রবল শক্তি লাভ করে। আসলে ছয় দফার মত যে কোনও স্বায়ত্তশাসনের রাজনীতি পাকিস্তানের পশ্চিমা মুসলমান শাসক শ্রেণীর সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলমানদের এমন এক দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত সৃষ্টি করে যার ফলে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গে ধর্মমুক্ত বাঙ্গালী চেতনা এবং রাজনীতির উত্থান ও বিকাশ ঘটানো সহজতর হয়। এরই সুযোগ নেয় ধর্মবিশ্বাস মুক্ত এবং বিপ্লবী রাজনৈতিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ ষাটের দশকের তরুণ প্রজন্ম। এভাবে জাতীয় রাজনীতিতে সমান্তরালে থেকে দুইটি ধারা কখনও পরস্পরের পরিপূরক হয়ে আবার কখনও পরস্পরের বিরুদ্ধ হয়ে এগিয়ে যায় একাত্তর পর্যন্ত। এর একটি ইসলাম ও ধর্মীয় পরিচয় থেকে মুক্ত বাঙ্গালী জাতির সমাজতান্ত্রিক বা জন-গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাকামী ধারা, এবং অপরটি ইসলামী এবং বৈশ্বিক পুঁজিবাদী রাজনীতি ও অর্থনীতির অন্তর্ভুক্ত রাষ্ট্র পাকিস্তানের কাঠামোবদ্ধ থেকে মুসলমান বাঙ্গালীর স্বায়ত্তশাসনকামী ধারা।
শেষ পর্যন্ত পূর্ব বঙ্গের রাজনীতিকে আর পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতর আবদ্ধ রাখা গেল না। বিশেষত ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের আসনগুলিতে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভকে পাকিস্তানের পশ্চিমা শাসক শ্রেণী মেনে নিতে পারছিল না। কারণ এই নির্বাচনের ফল মেনে নিলে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আওয়ামী লীগের মাধ্যমে বাঙ্গালী মুসলমানদের প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পাঞ্জাবী প্রাধান্য বিশিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানীরা ভুট্টোর নেতৃত্বে নির্বাচনের ফল মেনে না নিয়ে মুজিবের নেতৃত্বে সরকার গঠনের বিরোধিতা করল। হয়ত একটা আপোস হত। কারণ মুজিব সেটা চেয়েছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতায় থাকার স্বার্থে যে লোক ইতিপূর্বে ২১ দফার প্রতি অঙ্গীকারভঙ্গ করতে পারেন তার পক্ষে তো পাকিস্তানের ক্ষমতায় যাবার জন্য ছয় দফার ক্ষেত্রেও ছাড় দেওয়া কোনও ব্যাপার ছিল না।
সবচেয়ে বড় কথা শেখ মুজিব যে যুদ্ধ করা দূরের কথা, এমনকি পাকিস্তান ভাঙ্গতেও রাজী ছিলেন না তার প্রমাণ হচ্ছে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী জাতির বিরুদ্ধে আক্রমণ অভিযানের মুখে বাসায় বসে থেকে শত্রুর নিকট আত্মসমর্পণ করা। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে জেনারেল ইয়াহিয়ার সঙ্গে তিনি আপোস-রফায় যেতে প্রস্তুত ছিলেন। কিন্তু সেটা সম্ভব হয় নাই প্রধানত বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের নেতৃত্বে গড়ে উঠা স্বাধীনতা আন্দোলনের বিকাশ ও বিস্তারের ফলে। বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব ক্রমে গিয়ে পড়ে আওয়ামী লীগ নিয়ন্ত্রণাধীন ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগেরও উপর। এভাবে সমগ্র তরুণ প্রজন্ম ক্রমবর্ধমানভাবে পশ্চিমা বিরোধী এবং পাকিস্তান বিরোধী হয়ে উঠতে থাকে।
বিপ্লবী ছাত্র-তরুণদের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রভাব প্রবলভাবে গিয়ে পড়ে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বাঙ্গালী অফিসার ও সৈনিকদের নিয়ে গঠিত ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের উপরেও। বাঙ্গালী হবার কারণে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের দ্বারা এরা ছিল নানানভাবে অপমানিত, লাঞ্ছিত এবং বঞ্চিত। ফলে পাকিস্তানের প্রতি বিশেষত পশ্চিমাদের প্রতি তাদের মনে ক্ষোভ ও ঘৃণা জন্ম নিয়েছিল। এই অবস্থায় বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের স্বাধীনতার রাজনীতি তাদের উপর প্রভাব ফেলে। এভাবে তৎকালীন পূর্ব বঙ্গের দুই প্রবল সামাজিক শক্তি ছাত্র-তরুণ প্রজন্ম এবং বাঙ্গালী সেনাসদস্যরা আওয়ামী লীগের নেতা শেখ মুজিবের জন্য পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে সমাধান খুঁজবার পথ বাস্তবে বন্ধ করে দিয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে বামপন্থীদের নেতৃত্বাধীনে থাকা তৎকালীন শ্রমিক আন্দোলনের ব্যাপক অংশের উপর স্বাধীনতার রাজনীতির ক্রমবর্ধমান প্রভাবকে। শ্রমিক আন্দোলন সে কালে ছিল বামপন্থীদের প্রায় একচেটিয়া নিয়ন্ত্রণাধীনে। সে কালে কৃষক সংগঠন এবং আন্দোলনও এ দেশে যা ছিল তা ছিল প্রায় একচেটিয়াভাবে বামপন্থীদের নিয়ন্ত্রণাধীন। বামপন্থী নেতৃত্ব যা-ই চেয়ে থাকুক বিপ্লবী ছাত্র-তরুণদের স্বাধীনতার রাজনীতির প্রভাব এই সংগঠিত শ্রমিক এবং কৃষক আন্দোলনের উপর বিরাট জলোচ্ছ্বাসের মত আছড়ে পড়ছিল ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সময় থেকে। ১৯৬৮-এর ৬ ডিসেম্বর ভাসানীর নেতৃত্বে সূচিত আইয়ুব সরকারের পতনের দাবীতে গণ-আন্দোলন ছাত্র ও জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণে ১৯৬৯-এর জানুয়ারীতে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়। গণ-অভ্যুত্থান চলে ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চ তারিখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের পদত্যাগ এবং জেনারেল ইয়াহিয়ার নেতৃত্বে সামরিক শাসন প্রবর্তন পর্যন্ত। ১৯৬৯-এর জানুয়ারী থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ব্যাপক গ্রামাঞ্চলে গরুচোর, ডাকাত এবং অত্যাচারী ও দুর্নীতিপরায়ণ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান-মেম্বার ইত্যাদি এবং সেই সঙ্গে থানা-পুলিশসহ রাষ্ট্রযন্ত্রের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক গণ-অভ্যুত্থান প্রলয়ঙ্কর রূপ নিয়ে দেখা দিল। এই রকম পরিস্থিতিতে ঘটনা প্রবাহের উপর প্রকৃতপক্ষে কারও নিয়ন্ত্রণ রইল না। একটি জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে পূর্ব বঙ্গের অভ্যুদয় সময়ের ব্যাপার মাত্র হয়ে দাঁড়ালো।
এ কথা অনেকেই জানেন না কিংবা ধর্তব্যের মধ্যে নেন না যে, তৎকালীন পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভায় ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের পক্ষ থেকে পূর্ব বাংলায় স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ‘স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচী’ ঘোষণা করা হয়। অর্থাৎ স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আনুষ্ঠানিক ও প্রকাশ্য কর্মসূচীও ঐ বিপ্লবী প্রজন্মের প্রতিনিধিত্বকারী ছাত্র সংগঠন থেকে দেওয়া হল স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরুর বৎসরাধিক কাল পূর্বে। সে কালে প্রথমে কাজী জাফর আহমদ এবং কিছু পরে রাশেদ খান মেননকে সামনে রেখে গড়ে উঠা পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের শক্তি সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা বুঝবেন ১৯৭০-এর ২২ ফেব্রুয়ারীতে স্বাধীনতার প্রকাশ্য কর্মসূচী ঘোষণা কতখানি গুরুত্বপূর্ণ। একই সঙ্গে এ কথাও বুঝতে হবে যে তৎকালীন চীন সমর্থক ধারায় অবস্থিত কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ছিল প্রকৃতপক্ষে এ ধরনের স্বাধীনতার আন্দোলন গড়ে তুলবার আকাঙ্ক্ষা বিরোধী। অর্থাৎ এই কর্মসূচী এক অর্থে ছিল সে কালের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের তাদের নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থারও ঘোষণা। আজ যদি নির্মোহভাবে বিচার করা যায় তবে দেখা যাবে, এই কর্মসূচীতে অনেক ক্ষেত্রে ছিল প্রজ্ঞার তুলনায় আবেগের প্রাধান্য। এতদ্সত্ত্বেও প্রকৃতপক্ষে নেতৃত্বহীন বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচীর ঘোষণার তাৎপর্য ছিল অপরিমেয়। আজ আমাদেরকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে এই ঘোষণার পটভূমিতে ফেলেই বিচার করতে হবে। ’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পটভূমিতে তরুণ প্রজন্মের এই ঘোষণা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার সমতুল্য ছিল এবং এটা ছিল আসন্ন ’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য দিক নির্দেশক ঘটনা।
সুতরাং বিভিন্ন ঘটনার মধ্য দিয়ে একটা যুদ্ধ অনিবার্য হল এবং ছয় দফা ভিত্তিক নেতৃত্ব লাহোর প্রস্তাব ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন দাবীতে আর সীমাবদ্ধ থাকতে পারল না। আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব নিতে না চেয়ে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা দিলেও যুদ্ধকে ঠেকানো গেল না। এ দেশের ভিতরে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দমন অভিযান শুরু হলে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করল, যা পরিণত হল স্বাধীনতা যুদ্ধে। স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হলে ভারতের সাহায্য নিয়ে আওয়ামী লীগ যুদ্ধের নেতৃত্ব দখল করল। এভাবে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম দ্বারা সূচিত ও লালিত স্বাধীনতার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাতে চলে গেল। সেই সঙ্গে গেল যুদ্ধের রাজনীতি এবং যুদ্ধেরও নিয়ন্ত্রণ।
এক অর্থে সময়ের চেয়ে অনেক বেশী এগিয়ে ছিল এই প্রজন্ম। সুতরাং তা সমাজ ও রাজনীতির উপর যতই প্রভাব বিস্তার করুক এবং গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে নিজেদের যতই জন-সম্পৃক্ততা ঘটাক সামগ্রিক বিচারে তা যেমন ছিল জন-সমাজ থেকে অনেকটা বিচ্ছিন্ন তেমন ছিল নেতৃত্বহীনও। সনাতন কমিউনিস্ট রাজনীতির ধারায় গড়ে উঠা কমিউনিস্ট নেতৃত্ব সাধারণভাবে বাঙ্গালীর জাতি-রাষ্ট্র গঠনের রাজনীতির পক্ষপাতী তো ছিলই না এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই এই রাজনীতির বিরোধী ছিল। অন্ধ আন্তর্জাতিকতাবাদ এবং কখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং কখনও চীনের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের কারণে এই নেতৃত্বের পক্ষে এ দেশের বাস্তবতায় বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের গুরুত্ব ও তাৎপর্য বুঝা এবং তার পরিপ্রেক্ষিতে সঠিক কর্মসূচী দেওয়া কখনই সম্ভব হয় নাই। এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হলে সোভিয়েত পন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের অনুসারী হল। আর সে কালে চীন পাকিস্তান সরকার এবং রাষ্ট্রের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিলে চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্ব স্বাধীনতার লক্ষ্যকে সামনে রেখে স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন গড়া দূরের কথা এমনকি সরকার বিরোধী কোনও শক্তিশালী জাতীয় আন্দোলন গড়ে তুলবারও বিরোধী হল। জাতীয় পর্যায়ের কোনও আন্দোলন গড়বার পরিবর্তে তাদের আগ্রহ এবং মনোযোগ নিবদ্ধ ছিল বিভিন্ন স্থানীয় অথবা পেশাভিত্তিক দাবী-দাওয়ার ভিত্তিতে শ্রমিক-কৃষকের ‘শ্রেণী সংগ্রাম’ গড়ে তুলবার উপর। এমন পরিস্থিতিতে সনাতন কমিউনিস্ট নেতাদের সঙ্গে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ছিল অব্যাহত দ্বন্দ্ব ও মতবিরোধ। অথচ সেই সময় ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ন্যাপ) এবং সমগ্র বাম রাজনীতি ছিল সনাতন ধারায় গড়ে উঠা কমিউনিস্ট নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণাধীন।
এ প্রসঙ্গে এ কথা বলে রাখা উচিত হবে যে পাকিস্তান কালে নিষিদ্ধ থাকায় কমিউনিস্ট পার্টি গোপনে থেকে কাজ করত। কমিউনিস্ট পার্টি গোপন থাকলেও ন্যাপ এবং বিভিন্ন প্রকাশ্য গণ-সংগঠনের মাধ্যমে কমিউনিস্ট পার্টি তার কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। সোভিয়েতপন্থী ও চীনপন্থী ধারায় যখন বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন বিভক্ত হল তখন তার প্রভাব এ দেশেও পড়ল। কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবাধীন গণ-সংগঠনগুলিও কখনও আগে কখনও পরে বিভক্ত হল। সেই সময় বিশেষ করে ষাটের দশকে মওলানা ভাসানী নেতত্বাধীন ন্যাপ এবং তার সঙ্গে সংযুক্ত গণ-সংগঠনগুলি ছিল মূলত চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টি বা নেতৃত্ব দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। সেই সময় এ দেশে চীনের প্রভাবের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বামপন্থী আন্দোলনের উপর চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ছিল প্রবল প্রভাব।
এমন এক পরিস্থিতিতে সনাতন বামপন্থী নেতৃত্বের ছত্রছায়ায় থাকা বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের জন্য সময়টা ছিল খুবই জটিল এবং কঠিন। বিশেষ করে যে মার্কসবাদকে তারাও সে যুগে ব্যবহার করতে চেয়েছিল এ দেশে সেই মার্কসবাদী রাজনীতির যারা কর্তৃত্ব বা অথরিটি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত ছিল তাদের দিক থেকে তারা সব সময়ই ছিল নানান বাধা, চক্রান্ত এবং আক্রমণের সম্মুখীন। বিকল্প তত্ত্ব নির্মাণের জন্য যে অভিজ্ঞতার প্রয়োজন সেটা যেমন তাদের ছিল না তেমন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও তাদের পক্ষে ছিল না। এর উপর বিভিন্ন তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক প্রশ্নে তাদের মধ্যেও ছিল নানান বিভক্তি। তবু তারা তাদের সর্বশক্তি নিয়ে সেই কালটাতে তাদের ভাবনা অনুযায়ী বাঙ্গালীর একটা যুক্তিভিত্তিক, মানবিক, লোকবাদী এবং সমাজতান্ত্রিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ার লক্ষ্য নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তাদের লক্ষ্যকে তারা ১৯৭০ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী তারিখে ‘স্বাধীন জন-গণতান্ত্রিক পূর্ব বাংলার ১১ দফা কর্মসূচী’র ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্যে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে জনসমক্ষে তথা জাতির সামনে উপস্থিত করল।
এই রাষ্ট্র যে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কিংবা ভোটের রাজনীতি দিয়ে অর্জন করা সম্ভব নয় সেই বোধটুকুও তাদের ভিতরে ছিল। সুতরাং পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তারা বেছে নিয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রামের পথ এবং সশস্ত্র সংগ্রাম ও যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য তারা বেছে নিয়েছিল কৃষক এবং শ্রমিকদেরকে ঐক্যবদ্ধ বা সংগঠিত করার পথ। সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলবার জন্য তারা নির্বাচনের পথ পরিহার করেছিল। বামপন্থী আন্দোলনের সামগ্রিক নেতৃত্ব হাতে না থাকলেও তাদের প্রবল চাপ ছিল নেতৃত্বের উপরেও। সুতরাং এই প্রজন্মের অংশগ্রহণে সমৃদ্ধ এবং প্রভাবে প্রভাবান্বিত মওলানা ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি যে ১৯৭০-এর নির্বাচন বর্জন করেছিল সেটা স্বাভাবিক ছিল।
কিন্তু এভাবে নির্বাচন বর্জন ছিল ভ্রান্ত। কর্মনীতি হিসাবে এটা ঠিক হলেও পদ্ধতি হিসাবে ভুল ছিল। এটা জাতীয় রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিতে সাহায্য করল। বস্তুত ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিব ৬ দফা কর্মসূচী ঘোষণার পর গোপন কমিউনিস্ট পার্টি নিয়ন্ত্রণাধীন বামপন্থীদের প্রকাশ্য রাজনৈতিক দল ভাসানী নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি থেকে ১৪ দফা কর্মসূচী দেওয়া হলেও এটা ছিল পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে দায়সারা গোছের এবং দুর্বল কর্মসূচী। এটা নিয়েও তৎকালীন চীনপন্থী কমিউনিস্ট নেতারা জনগণের মধ্যে যেতে প্রস্তুত ছিল না। কারণ চীন তখন পাকিস্তানের মিত্র এবং তার একনায়কী শাসক আইয়ুবের দৃঢ় সমর্থক। অন্ধ চীনপন্থী হবার কারণে এই নেতারা প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনকে দুর্বল করে এমন কোনও আন্দোলনে যেতেও রাজী ছিল না।
মওলানা ভাসানী ছিলেন তাদের দ্বারাই তখন পরিবেষ্টিত। এদের বাধা ডিঙ্গিয়ে বিকল্প কর্মসূচী নিয়ে মাঠে নামবার ক্ষমতা তার ছিল না। তিনি বামপন্থী নেতৃত্বকে অস্বীকার করে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের ডাক দিয়ে একাই মাঠে নেমেছিলেন অনেক পরে ১৯৬৮-এর ৬ ডিসেম্বরে এবং সেটাও বিকল্প কর্মসূচী ছাড়াই এবং শুধু আইয়ুব সরকারের পতন দাবী করে। তিনি এই আন্দোলনের অগ্রবাহিনী হিসাবে পেলেন বিপ্লবী ছাত্র-যুব সমাজকে। এই আন্দোলন দ্রুত গণ-অভুত্থানে পরিণত হল। শ্রমিক এবং কৃষকদের অংশগ্রহণে গণ-অভ্যুত্থান ছড়িয়ে পড়ল সারা দেশে। বিশেষত লক্ষ লক্ষ কৃষকের গণ-অভ্যুত্থানের ফলে সারা দেশের ব্যাপক গ্রামাঞ্চল রাষ্ট্রযন্ত্রের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল। এই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে কারারুদ্ধ শেখ মুজিব মুক্ত হলেন এবং জাতীয় রাজনীতিতে প্রধান নির্ধারক শক্তিতে পরিণত হলেন। বামপন্থীদের তখন প্রকৃত অর্থে জাতীয় কোনও কর্মসূচী নাই। বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম ইতিপূর্বেই ন্যাপ ও পুরাতন নেতৃত্বের প্রতি আস্থা হারিয়ে নিজেদের মত করে স্বাধীনতার রাজনীতি নিয়ে চলতে শুরু করেছে। এই গণ-অভ্যুত্থানে তারা যতই নির্ধারক ভূমিকা গ্রহণ করুক পূর্ব থেকেই প্রস্তুতি না থাকায় ৬৯-এর ২৫ মার্চে সামরিক শাসন কায়েম হলে তারা এই অভ্যুত্থানকে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধে পরিণত করতে পারল না।
আসলে পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নকে কেন্দ্রে রেখে ১৯৬৬-তে ন্যাপ যদি ১৪ দফার পরিবর্তে একটি উন্নত ও জোরালো কর্মসূচী দিত তাহলে পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম স্বায়ত্তশাসনমূলক এই কর্মসূচীকে সামনে রেখে গোপনে তাদের স্বাধীনতার রাজনীতিকে নিয়ে এগিয়ে যেতে পারত। সে ক্ষেত্রে গণ-অভ্যুত্থানের মোকাবিলায় ১৯৬৯-এর ২৫ মার্চে যখন পাকিস্তানে সামরিক শাসন প্রবর্তন করা হল তখন সাথে সাথে তারা স্বাধীনতার কর্মসূচী নিয়ে গণ-অভ্যুত্থানকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার যুদ্ধে রূপান্তরিত করতে পারত। ততদিনে গ্রামাঞ্চলের উল্লেখযোগ্য এলাকায় তাদের প্রভাব বা শক্তি গড়ে উঠায় সেগুলিকে আশ্রয় করে তারা গেরিলা যুদ্ধ গড়ে তুলতে পারত। এবং আমি অনুমান করি এই রকম একটি যুদ্ধে ভাসানীকেও তারা তাদের সঙ্গে পেত। আমার অনুমান পাকিস্তানকে ভাঙ্গবার প্রয়োজনে অন্তত একটা পর্যায় পর্যন্ত তৎকালীন ভারত সরকার ভাসানী এবং বামপন্থীদের নেতৃত্বাধীন এই যুদ্ধকে সমর্থন বা সাহায্য দিত।
তবে সেটা যে ইতিহাসের গতিকে খুব একটা বদলাত তা নয়। কারণ বামপন্থীরা খুব বেশী সময় পেত না। আওয়ামী লীগ এবং তার পৃষ্ঠপোষক পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ যে বসে থাকত না তা সহজবোধ্য। লীগ যেভাবে ’৭০-এর নির্বাচন প্রক্রিয়ায় গিয়ে ’৭১-এ সূচিত যুদ্ধের উপর ভারতের সাহায্য নিয়ে নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল সেভাবেই হয়ত মুক্তির যুদ্ধের উপর নিয়ন্ত্রণ নিত। কিংবা নির্বাচন না হলে কিংবা তাতে অংশগ্রহণের বাস্তবতা না থাকলে ভারতের সর্বাত্মক সাহায্য নিয়ে বামপন্থীদের যুদ্ধের পাশাপাশি যুদ্ধ শুরু করে তা স্বাধীনতা যুদ্ধের মূলধারার উপর নিয়ন্ত্রণ নিত বলে অনুমান করি। এ কথা মনে রাখতে হবে শক্তি হিসাবে বামপন্থীরা যত সংগঠিত হোক জনসমর্থন আওয়ামী লীগের অনেক বেশী ছিল। বিশেষত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর ব্যাপক অংশ ছিল লীগ রাজনীতির সমর্থক। অন্যদিকে লীগ যুদ্ধে গেলে এটা সহজবোধ্য যে ভারত বামপন্থীদের পরিবর্তে সম্পূর্ণ সমর্থন ও সাহায্য তাকেই দিত। ফলে তার পিছনে তখন থাকত পূর্ব বঙ্গকে তিন দিক থেকে পরিবেষ্টন করে রাখা এক বৃহৎ শক্তি ভারতের সমর্থন। ফলে থাকত সোভিয়েত ইউনিয়নেরও সমর্থন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও হয়ত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তার কর্মনীতিতে পরিবর্তন ঘটিয়ে বামপন্থীদের উত্থান রোধের প্রয়োজনে আওয়ামী লীগের প্রতি নমনীয় হওয়াকেই লাভজনক মনে করত। চীন পাকিস্তানকে ছেড়ে পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করত? ঐ কল্পনা না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
কাজেই ঘটনা যেভাবে ঘটেছে পরিণতিতে হয়ত অনেকটা সেই রকমই ঘটত। যুদ্ধের রাজনীতির পরিণতি স্বরূপ মুক্তিযুদ্ধ এবং তার ফল যে শেষ পর্যন্ত লীগের হাতেই যেত সেই রকমই অনুমেয়। এবং শেষ পর্যন্ত আজকের মতই বামপন্থীদের সকল কীর্তির দাবীদার হত লীগ। বামপন্থীদের দ্বারা সূচিত জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের রাজনীতি না গড়েও তার কারিগর হবার দাবীদার হত লীগ, ঠিক যেমনটা আজ হয়েছে। তৎকালীন পৃথিবীর বৃহৎ প্রায় সকল শক্তির বিরোধিতা অথবা সমর্থনহীনতার বাস্তবতায় এবং দেশের ভিতরেরও সামাজিক বাস্তবতায় যতই ভূমিকা রাখুক বামপন্থীদের সাফল্যলাভের সম্ভাবনা কি আদৌ ছিল? বিশেষত যে তরুণ প্রজন্ম একটি রাষ্ট্রিক ও সামাজিক বিপ্লবের জন্য স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি গড়ে তুলেছিল তাদের জন্য সময়টা ছিল বেশী রকম প্রতিকূল।
তা সত্ত্বেও ঘটনা এটাই যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ এবং ইসলামী পরিচয়মুক্ত বাংলাদেশ-রাষ্ট্রের মূল রূপকার হচ্ছে ষাটের দশকের এই বিপ্লবী প্রজন্ম। সুতরাং ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের ফসল হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশ। এবং প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগ হচ্ছে এই ফসল আত্মসাৎকারী। তাদের নেতা কী চেয়েছিলেন সেটা বুঝা যায় তখন যখন তিনি বাঙ্গালী জাতিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হামলার মুখে ফেলে দিয়ে তাদের কাছে আত্মসমর্পণ করলেন। আসলে তরুণ প্রজন্মের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাজনীতি ততদিনে বাঙ্গালী জাতিকে এমন একটা পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল যে তখন পাকিস্তান যেমন বাঙ্গালী জাতির কাছে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল তেমন একই সঙ্গে এখানে বিপ্লবী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের বিকাশ পাকিস্তানী শাসক শ্রেণীর কাছেও পূর্ব বঙ্গকে দায়ে পরিণত করেছিল। তখন বিশেষত পূর্ব বঙ্গে ক্রমবর্ধমান বিপ্লবী এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাকে দমন করে পাকিস্তানের কাঠামোর উপযোগী করবার জন্য পাকিস্তানী শাসকদের নিকট সামরিক হস্তক্ষেপ প্রয়োজনীয় হয়ে দেখা দিয়েছিল। পাকিস্তান কাঠামোর মধ্যে থেকে আপোসের শেষ চেষ্টা হিসাবে শেখ মুজিব পাকিস্তানী সেনার নিকট আত্মসমর্পণ করেন। কিন্তু পাকিস্তানী সেনার দমন অভিযানের সঙ্গে বাঙ্গালীর নিকট ছয় দফা এবং নির্বাচনের মূল্য ফুরিয়ে গিয়েছিল। ছয় দফা দাবী আদায় এবং নির্বাচনের ফললাভের অপেক্ষা না করে পাল্টা যুদ্ধ দিয়ে নেতৃত্বহীন বাঙ্গালী জাতি এবং পূর্ব বঙ্গের সকল জাতির জনগণ পাকিস্তানকে মোকাবিলা করল।
শেখ মুজিব ধরা দিলেও আওয়ামী লীগ আত্মসমর্পণ না করে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ যুদ্ধের ধারাবাহিকতায় ভারতে আশ্রয় নিল। এ দেশে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটা বিপ্লবী শক্তির উত্থান রোধে তৎকালীন ভারতীয় কংগ্রেস সরকারের আশ্রয় এবং সমর্থন যেমন তাদের জন্য প্রয়োজনীয় ছিল তেমন একটি স্বাধীন এবং বিপ্লবী পূর্ব বাংলা তথা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে রোধ করার জন্য তাদেরকে সর্বপ্রকার সহায়তা দান ভারতের কংগ্রেস সরকারের জন্যও প্রয়োজনীয় ছিল। তারপরের ভূমিকাটা মূলত কংগ্রেস সরকারের তথা ভারতের।
প্রকৃতপক্ষে আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে ভারত-সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ন্ত্রণ করল। ভারত-সরকার বাংলাদেশে একটি প্রকৃত সেকিউলার কিংবা লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মোটেই আগ্রহী ছিল না। কারণ সেটা পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরার সামনে বঙ্গের পুনরেকত্রীকরণের বাস্তবতা হাজির করতে পারত, যেটা ভারত-রাষ্ট্রের অখণ্ডতার জন্য হুমকির কারণ হতে পারত কিংবা ভারতের বিদ্যমান কেন্দ্রীয় শাসন ব্যবস্থাকে দুর্বল করতে পারত। অন্যদিকে বঙ্গের পুনরেকত্রীকরণ না ঘটলেও ভারত তৎকালীন পূর্ব বঙ্গে এমন কোনও মুক্তিযুদ্ধও চায় নাই যা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের নিকট থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থাকে এ বঙ্গে ভেঙ্গে ফেলতে পারত। সেটাও ব্রিটিশ শাসকদের দ্বারা গড়ে তোলা এবং রেখে যাওয়া উত্তর-উপনিবেশিক ভারতের রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার জন্য হুমকি সৃষ্টি করতে পারত। কারণ এর প্রভাব সেখানেও গিয়ে পড়তে পারত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের আশ্রয়ে ও নিয়ন্ত্রণে যে সুবিধাভোগী শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ গড়ে উঠেছিল উপনিবেশিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতা রক্ষার মধ্যেই তাদের স্বার্থ নিহিত। কাজেই তাদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী তৎকালীন কংগ্রেস সরকার পূর্ব বঙ্গের রাষ্ট্র ও সমাজে উপনিবেশিক ব্যবস্থার ধারাবাহিকতায় যাতে ছেদ না ঘটে সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রেখেছিল।
সুতরাং বাংলাদেশ, বঙ্গ বা বাংলা যে নামই দেওয়া যাক বিপ্লবী রূপান্তরের মধ্য দিয়ে স্বাধীন পূর্ব বঙ্গের উত্থান তাদের নিকট অগ্রহণযোগ্য ছিল। এই অবস্থায় বিশেষত বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের বিপ্লবী রাজনীতির অভিঘাতে সূচিত হয়েছিল বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের প্রথম যে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ তাকে সর্বপ্রকারে নিয়ন্ত্রণ এবং পথভ্রষ্ট করার উপর ভারত-রাষ্ট্র এবং ভারতের তৎকালীন কংগ্রেস সরকারের আশ্রয়পুষ্ট আওয়ামী লীগের প্রবাসী সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করল। এভাবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হলেও আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে জন্মের মুহূর্ত থেকেই মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার ও স্বপ্নগুলিকে ধূলায় লুণ্ঠিত করার পথে তার যাত্রা শুরু হল।
প্রকৃতপক্ষে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠতে পারত জাতীয় বিপ্লবের মধ্য দিয়ে একটি সামাজিক বিপ্লবের সূচনা। কিন্তু বাস্তবে ভারত এবং আওয়ামী লীগের বিজয় এবং ’৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে জয় হল বিপ্লবের পরিবর্তে প্রতিবিপ্লবের। সুতরাং ১৯৭২-এ গৃহীত সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, সেকিউলারিজম, সমাজতন্ত্র ও গণতন্ত্র - এই চার মূলনীতির কথা বলা হলেও সেগুলির প্রতিটির সঙ্গে অঙ্গীকার ভঙ্গের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছে। এসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এটা নয়। তবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বিগত ৪৫ বৎসরের বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে এই বক্তব্যের সত্যতা ব্যাখ্যার বিশেষ প্রয়োজন হয় না। বস্তুত বাংলাদেশের ইতিহাস হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা ও অঙ্গীকার থেকে বিচ্যুতি এবং সেগুলির প্রতি প্রতারণার ইতিহাস, যার সূচনা আওয়ামী লীগের হাত দিয়ে।
আওয়ামী লীগের ইতিহাসের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রতারণা ও বিশ্বাসঘাতকতা। আলোচনার গোড়ার দিকে যে কথা বলেছিলাম তার কিছুটা পুনরুক্তি করে বলি, ১৯৪৯ সালে মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে যে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছিল তার অঙ্গীকার ছিল পূর্ব বঙ্গের স্বায়ত্তশাসন এবং পাকিস্তানের জন্য স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি প্রতিষ্ঠা করা। এই অঙ্গীকারের প্রতি জনসমর্থনকে ব্যবহার করে আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী এবং শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রী হলেন। পাকিস্তানের রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পেয়ে সোহরাওয়ার্দী ডিগবাজী দিলেন এবং স্বায়ত্তশাসন ও জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতির বিরোধিতা করলেন।
অবশ্য সোহরাওয়ার্দী এর পূর্বেও আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর প্রতি অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছিলেন। তিনি আইন মন্ত্রী হিসাবে ১৯৫৬-তে পাকিস্তানের যে সংবিধান প্রণয়ন করলেন তাতে স্বায়ত্তশাসনের দাবী জলাঞ্জলি দেওয়া হল। এর ফলে ভাসানীর সঙ্গে তার মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৬ সালে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী হলে স্বায়ত্তশাসন এবং পররাষ্ট্র নীতির প্রশ্নে তার সঙ্গে ভাসানীর মতবিরোধ তীব্রতর হয়ে দেখা দিল। ভাসানীর বিরোধিতায় দাঁড়িয়ে মুজিব সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন করলেন। আদর্শ ও নীতি নিয়ে দাঁড়াতে গিয়ে মওলানা ভাসানী তার গড়া দলেই সংখ্যালঘু হলেন। ক্ষমতার লোভে বাঙ্গালী মুসলমান নেতৃত্বের প্রধান অংশই সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন করল। পরিণতিতে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হল। ভাসানী তার নিজের গড়া দল আওয়ামী লীগকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হলেন এবং তার নীতিনিষ্ঠ সহকর্মীদেরকে নিয়ে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি বা ন্যাপ গঠন করতে বাধ্য হলেন। এভাবে সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব এ দেশের রাজনীতির ইতিহাসে অঙ্গীকার ভঙ্গকারী হিসাবে নিজেদেরকে চিহ্নিত করলেন। সুতরাং শেখ মুজিবের কাছ থেকে পরবর্তী কালেও সৎ বা নীতিনিষ্ঠ চরিত্র বা আচরণ কোনটাই আমরা আশা করতে পারি না।
মুক্তিযুদ্ধের সূচনা লগ্ন এবং বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান থেকে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর থেকে তার সমগ্র কর্মকাণ্ড সেই সাক্ষ্যই দেয়। যে বাংলাদেশের রাজনীতি তিনি গড়েন নাই, যে মুক্তিযুদ্ধের চিন্তাও তিনি করেন নাই, তাতে নেতৃত্ব দেওয়া তো দূরের কথা, সেই বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা এবং সেই মুক্তিযুদ্ধের নেতা হবার দাবী তার দলকে করতে হচ্ছে। শুধু এইটুকু নয় এই দাবী করতে গিয়ে যারা আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের বিরোধিতার মুখে দাঁড়িয়ে ষাটের দশকে এ দেশে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি গড়ে তুলেছিল তাদের সমস্ত ভূমিকা ও অবদানকে অস্বীকার করা হযেছে। যেমন তারা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা ভাসানীর নীতিনিষ্ঠ ভূমিকাকে সর্বদাই অস্বীকার করে চলতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। স্বাভাবিকভাবে এই ধরনের লোভী, শঠ ও প্রতারকরা যে দেশে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে পারে সে দেশে রাষ্ট্রের যাত্রা দুর্বৃত্তায়নের পথ ধরেই হয়। সেটাই বাংলাদেশে হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে এ দেশে আজ অবধি যারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় এসেছে তারা সকলেই এই দুর্বৃত্তায়নের সুফলভোগী এবং অংশীদার। আর এই দুর্বৃত্তায়নের প্রয়োজনে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রমবর্ধমান ইসলামীকরণ।
রাষ্ট্র ক্ষমতা হাতে পাবার পর প্রথমেই শেখ মুজিব জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের সেকিউলার এবং জাতীয়তাবাদী অঙ্গীকারকে সরাসরি নাকচ করতে পারেন নাই। তখনও জন-মানসে মুক্তিযুদ্ধের ভাবপ্রেরণা তীব্রভাবে ক্রিয়াশীল। সুতরাং শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ কৌশলের আশ্রয় নিল। সেকিউলারিজমের কথা বললেও এবং সংবিধানে সেকিউলারিজমকে নীতি হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হলেও বাস্তবে শেখ মুজিব করলেন বিপরীত অথবা ভিন্নটা। মাদ্রাসা শিক্ষাকে শুধু রাখলেন না, তাকে পৃষ্ঠপোষকতা দিলেন, ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করলেন, পাকিস্তান কালের হিন্দু বিরোধী শত্রু সম্পত্তি আইনকে অর্পিত সম্পত্তি আইন নাম দিয়ে রক্ষা করলেন। শুধু এইটুকু নয়, তিনি ইসলামী রাষ্ট্রগুলির সংগঠন ওআইসি-তেও বাংলাদেশকে নিলেন। তিনি যুদ্ধাপরাধের বিচারে অবহেলা এবং কালক্ষেপণ করলেন। এভাবে পাকিস্তানের ইসলামী ভাবাদর্শের সামাজিক-রাজনৈতিক ভিত্তিকে বিপর্যয়ের সম্ভাবনা থেকে রক্ষা করলেন।
মুক্তিযুদ্ধের ভাবপ্রেরণার কী চমৎকার এক নেতা শেখ মুজিব এবং তার দল আওয়ামী লীগ! এই পথ ধরেই জিয়া, এরশাদ থেকে খালেদা, হাসিনা পর্যন্ত সবার অগ্রযাত্রা। আজকের শেখ হাসিনা নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার কর্তৃক মুষ্টিমেয় কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও শাস্তির আয়োজন দেখে কেউ যদি ভাবেন যে আওয়ামী লীগের চরিত্রের পরিবর্তন হয়েছে তাহলে তিনি ভুল করবেন। আওয়ামী লীগ যা ছিল তা-ই আছে। তার সুবিধার প্রয়োজনে, বিদ্যমান ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে তার ক্ষমতায় যাবার কিংবা থাকবার রাজনীতির প্রয়োজনে তা যখন যা করা সুবিধাজনক মনে করে তখন সেটাই করে। এর সঙ্গে নীতি-আদর্শের সম্পর্ক খুঁজে লাভ নাই। বিপুলভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের মূল নীতি একটাই সেটা হচ্ছে আত্মসাৎ ও লুণ্ঠনসহ যে কোনও উপায়ে অর্থ-বিত্ত সঞ্চয় ও রক্ষার জন্য ক্ষমতায় যাওয়া এবং থাকা। সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য হিসাবে প্রতারণার পথ ধরে যাদের উত্থান তাদের কাছে ন্যায়-নীতি নিষ্ঠা আশা করা মূর্খতা ছাড়া আর কী হতে পারে? যেহেতু এরা প্রতারক সেহেতু প্রতারণার ব্যবহারে এরা দক্ষ। প্রতারক তো মানুষের মন জয়ের জন্য মানুষ যে সব কথা শুনতে ভালবাসে সেগুলিই সাজিয়ে-গুছিয়ে বলে। কথা বলতে অসুবিধা কী? তার সঙ্গে জীবনাচরণের সঙ্গতি থাকবে তার কী মানে আছে? তাদের ঝুলিতে ইসলাম, কুরআন-সুন্না, সেকিউলারিজম কিংবা অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি সবই থাকে। যখন যেটা দেখাবার দরকার হয় তখন তারা সেটাই তাদের ঝুলি থেকে বের করে দেখায়। মূল উদ্দেশ্য তো একটাই ন্যায়-নীতির বালাই না রেখে স্বার্থ উদ্ধার।
একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা
স্বাধীনতা যুদ্ধের পর প্রায় অর্ধশতাব্দী পার হয়েছে। এখন গত শতাব্দীর ষাটের দশকের প্রজন্মের সমস্যা ও কমিউনিস্ট আন্দোলনের ভুলগুলি নিয়ে অনেক নির্মোহ আলোচনার প্রয়োজন আছে। কিন্তু দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে এত কাল পরেও সে ধরনের তাৎপর্যপূর্ণ আলোচনা প্রায় চোখে পড়ে না। তবে আমি নিজে দীর্ঘকাল ধরে আমার মত করে এ ধরনের আলোচনা করে আসছি। এখন নূতন প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে গিয়ে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে লীগের ভূমিকা এবং সেই সঙ্গে বামপন্থী আন্দোলন এবং বিশেষত ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের ভূমিকা এবং তাদের সমস্যাগুলি সম্পর্কে পুনরায় সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা করতে হচ্ছে।
বিশেষত ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের ভূমিকা এবং সমস্যা নিয়ে পর্যালোচনার সময় আমাদের এ কথা বুঝতে হবে যে, বিপ্লব শুধু কয়েকজন ব্যক্তির ইচ্ছা এবং চেষ্টা নির্ভর বিষয় নয়। সে কালের সামগ্রিক জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির কারণে ঐ প্রজন্মের পক্ষে সফল হওয়া সম্ভব ছিল না। এর জন্য শুধু তৎকালীন ভারত সরকারের ভূমিকাকে দায়ী করে লাভ নাই। এটা ঠিক যে ভারত সরকার এখানে সমাজতান্ত্রিক কিংবা জন-গণতান্ত্রিক বিপ্লবী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল। পূর্ব বাংলাকে তিন দিক দিয়ে পরিবেষ্টন করে থাকা আমাদের তুলনায় বিশাল এবং মহাশক্তিধর রাষ্ট্র ভারতের বাধাকে অতিক্রম করে এখানে বিপ্লবকে সফল করা সে কালের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে কীভাবে সম্ভব ছিল? সেই সময় চীনও এখানে ছিল বিপ্লবী জাতীয় আন্দোলন কিংবা স্বাধীনতা আন্দোলন দূরের কথা এমনকি পাকিস্তান সরকারকে দুর্বল করে এমন যে কোনও সরকার বিরোধী আন্দোলনেরও বিরুদ্ধে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গ এখানে নাই বা আনলাম।
এখন বাইরের বাধাগুলির কথা বাদ দেওয়া যাক। ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম যে ধরনের সামাজিক বিপ্লব এবং রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় বিশ্বাসী ছিল তাতে বাস্তবে ধর্মের প্রশ্নকে এড়াবার উপায় থাকে না। ভাবাদর্শগতভাবে ধর্মান্ধতা এবং শ্রেণীগতভাবে মোল্লা বা ধর্মীয় শ্রেণী ছিল এই বিপ্লবের প্রধান শত্রু। ইন্দোনেশিয়া, ইরান, আফগানিস্তান ইত্যাদি ইসলাম অধিকৃত প্রায় প্রতিটি দেশের কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে বিপ্লব প্রয়াসের অভিজ্ঞতা মর্মন্তুদ। বিপ্লব সংগঠনের প্রয়াসের জন্য অপরিমেয় মূল্য তাদেরকে দিতে হয়েছে। বস্তুত কমিউনিস্টদের বস্তুবাদী ভাবাদর্শের কারণে তারা ইসলাম অধিকৃত সমাজে সহজেই চিহ্নিত এবং আক্রান্ত হতে পারত। মার্কিন নেতৃত্বাধীন পাশ্চাত্যের সাম্রাজ্যবাদী-পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলি সহজেই এই বাস্তবতাকে ব্যবহার করেছে। একবার মার্কসবাদ বা কমিউনিজম কিংবা শ্রেণী সংগ্রাম এবং শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের কথা বললে যে পরিচিতি দাঁড়িয়ে যেত তারপর কোনও কৌশলই আর কাজ করত না।
অবশ্য কমিউনিস্টদের তত্ত্বগত কিছু সীমাবদ্ধতাকেও আমাদের হিসাবে নিতে হবে। এটা ঠিক যে, ধর্মবিশ্বাস বিশেষত ইসলামের মত ভয়ঙ্কর একটি ধর্মীয় মতাদর্শের প্রভাব থেকে মুসলিম সমাজের মানুষদের একটা অংশকে মুক্ত করার ক্ষেত্রে মার্কসবাদ ও কমিউনিজমের ভূমিকা বিরাট। কিন্তু মার্কসবাদের একটা সীমাবদ্ধতা হল যে, তা আলাদাভাবে ধর্মীয় ভাবাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াইকে গুরুত্ব দেয় না। এই তত্ত্বের বিবেচনায় শ্রমিক-কৃষকের শ্রেণী সংগ্রামের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত সমাজতান্ত্রিক এবং ব্যক্তি মালিকানা মুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠিত হলেই আর সব সমস্যার মত ধর্মের সমস্যাও দূর হয়। অর্থাৎ ব্যক্তি মালিকানাকেই এই তত্ত্ব অনুযায়ী সকল সমস্যার মূল বিবেচনা করা হত। সুতরাং ধর্মের বিরুদ্ধে বুদ্ধিবৃত্তিক বা আর কোনও ধরনের প্রত্যক্ষ লড়াইকে গুরুত্ব দেওয়া হত না।
অন্যদিকে কমিউনিস্ট তত্ত্বে ছাত্র এবং মধ্যবিত্তকে সুবিধাবাদী ও দোদুলমান পেটিবুর্জোয়া হিসাবে তুচ্ছ বিবেচনা করে শ্রমিক-কৃষকদেরকে বিপ্লবের মূল ভিত্তি এবং এমনকি মূল শক্তি হিসাবে বিবেচনা করা হয়। অথচ ইসলামী সমাজে বাস্তবটা হচ্ছে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে সমাজতল তথা জনসমাজ ধর্মের প্রভাবে ভয়ঙ্করভাবে পশ্চাৎপদ এবং প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা দ্বারা আচ্ছন্ন থাকে। এখানে ইউরোপ থেকে আসা আধুনিক যুগ চেতনাকে যেটুকু ধারণ করে সেটুকু করে আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছাত্র-যুব সমাজ এবং মধ্যবিত্ত শ্রেণী। সুতরাং সমাজে বিপ্লবের শক্তি ও সম্ভাবনা যেটুকু থাকে সেটুকু এদের মধ্যেই থাকে সবচেয়ে বেশী। সাধারণ নিয়ম অনুযায়ী এদের ভিতরে জন্ম নিয়ে তারপরই মাত্র বিপ্লবী চিন্তা-চেতনা সমাজের নীচ তলায় অবস্থিত আমজনতার মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে পারে। অন্যদিকে ইসলামের ভাবাদর্শের প্রচারক মোল্লা শ্রেণী যেমন প্রতিবিপ্লবী চেতনার মূল চালিকা শক্তি হিসাবে কাজ করে তেমন তাদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত বা প্রভাবিত মুসলিম শ্রমিক-কৃষক তথা আমজনতা প্রতিবিপ্লবের মূল বাহিনী হিসাবে কাজ করে। মোল্লা শ্রেণীর তথা ধর্মীয় আবেগের প্রভাব মুক্ত না হলে যে কোনও মুহূর্তে এই আমজনতা প্রতিবিপ্লবের বেদুইন বাহিনী হিসাবে বিপ্লব প্রয়াসের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। এই অবস্থায় এখানে ধর্মীয় ভাবাদর্শ থেকে মুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্র চিন্তার দাঁড়াবার মত জায়গা কতটা থাকে?
এই রকম এক বাস্তবতায় কমিউনিস্টদের মধ্যে প্রবল আত্মদ্বন্দ্ব বা স্ববিরোধ কাজ করত। তাদের দর্শন হচ্ছে ধর্ম বিরোধী বা ধর্মবিশ্বাস মুক্ত। ফলে তাদেরকে কাজ করতে হত এই দর্শনের ভিত্তিতে। অথচ জনসাধারণের মধ্যে ঢুকবার বা কাজ করবার প্রয়োজনে তারা ধর্মের প্রশ্নকে প্রকাশ্যে যতটা সম্ভব এড়াতে চেষ্টা করত। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলিকে নিয়ে জনসাধারণের মধ্যে যেত। কিছু ভিত্তি নির্মাণেও সক্ষম হত। কিন্তু ধর্মের প্রশ্নে তাদের একটা দুর্বল অবস্থান থেকে যেত। ধর্মের পক্ষে যেমন তারা বলতে পারত না তেমন ধর্মের বিরুদ্ধেও তারা প্রকাশ্যে কিছু বলতে পারত না। বরং কোনও কোনও সময় ধর্মের মানানসই ব্যাখ্যা দিয়ে জনতাকে নিজেদের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির পক্ষে নিবার চেষ্টা করত। কিংবা ধর্মীয় প্রশ্নগুলিকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলতে চাইত। জনমানসে ধর্মীয় ভাবাদর্শের প্রবল প্রভাবের কারণে তাদের মনের ভিতরে সর্বদাই কম-বেশী ভয় বা ভীতি কাজ করত।
সুতরাং ধর্মের বিষয়ে আলোচনা বা সমালোচনা সীমাবদ্ধ থাকত তুলনায় খুব ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠীতে। ষাটের দশকে ছাত্র এবং শিক্ষিত তরুণদের মধ্যে বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার ব্যাপকতার কারণে তাদের ভিতর ধর্মের ত্রুটি, ভ্রান্তি এবং ক্ষতিকর দিকগুলি নিয়ে কম-বেশী আলোচনা ও অধ্যয়ন থাকলেও সাধারণ মানুষদের সঙ্গে এগুলি নিয়ে আলোচনাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে চলা হত। তা সত্ত্বেও জনসাধারণের মধ্যে তাদের কমিউনিস্ট কিংবা বামপন্থী পরিচিতি বিশেষত জাতীয় রাজনীতিতে অনেক ক্ষেত্রে তাদের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে থাকত। এমনিতে বামপন্থীদেরকে সাধারণভাবে নাস্তিক বা ধর্মবিশ্বাসহীন বলা হত। তার উপর বেশীর ভাগ বামপন্থী নেতা-কর্মী বিশেষত তরুণ বামপন্থীরা সাধারণভাবে নামায-রোযার ধার ধারত না। জাতীয় রাজনীতিতে বামপন্থীদের নেতা হিসাবে একজন মুসলিম ধর্মীয় নেতা বা পীর হিসাবে সুপরিচিত মওলানা ভাসানীর বিরাট অবস্থান তাদের জন্য সহায়ক হলেও ব্যাপক মুসলিম জনসাধারণ বামপন্থীদেরকে ধর্মীয় কারণে সহজে গ্রহণ করতে চাইত না। বিভিন্ন আন্দোলন এবং ভূমিকার কারণে সে কালে বামপন্থী বা কমিউনিস্টরা মুসলিম সমাজে একটা শ্রদ্ধার আসন পেলেও ধর্মীয় কারণে তাদের প্রতি সমাজে একটা দ্বিধার জায়গাও থেকেই গিয়েছিল।
সুতরাং মার্কসবাদ এবং এ দেশের কমিউনিস্ট রাজনীতির ব্যর্থতা ও ভ্রান্তি বিবেচনার সময় ইসলামী সমাজে বিপ্লবের সমস্যাকেও আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। বস্তুত ইসলামের মত হিংস্র ধর্মের বিরুদ্ধে সরাসরি ও ব্যাপক আয়তনে ভাবাদর্শিক লড়াইয়ের যুগ সেটা নয়। অথচ সমাজে প্রথমে ভাবাদর্শিক আন্দোলন গড়ে তুলতে না পারলে কি রাষ্ট্রীয় কিংবা সামাজিক বিপ্লব গড়ে তুলা সম্ভব? বস্তুত ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে জাগরণ এবং যুক্তিবাদের প্রতিষ্ঠা ছাড়া ইসলামী সমাজে সামাজিক বিপ্লব ও লোকবাদী রাষ্ট্র সংগঠন একটি অলীক কল্পনা মাত্র।
ইসলামের মত ভয়ঙ্কর হিংস্র এবং আক্রমণাত্মক ধর্মের বিরুদ্ধে জনসমাজের উত্থান ঘটানো দূরের কথা একটা প্রকাশ্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলাও ইন্টারনেট উদ্ভাবন ও ব্যবহারের পূর্ব কালে ছিল অকল্পনীয় বিষয়। এমনকি ইন্টারনেট ব্যবহারের এমন দ্রুত বর্ধমান বিস্তারের কালেও ইসলামী সমাজের ভিতর থেকে ইসলামের সমালোচনা কিংবা স্বরূপ উদ্ঘাটন কতখানি বিপজ্জনক তার সাক্ষ্য বাংলাদেশে সাম্প্রতিক কালের ঘটনাবলী যেখানে একদিকে ইসলামী জঙ্গীরা এবং অপর দিকে আওয়ামী লীগ সরকার সমন্বিতভাবে হত্যা, গ্রেফতার, হামলা ও মামলা চালিয়ে মানুষের চিন্তার জগৎকে দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করে রাখতে চাইছে। এই রকম বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিয়ে পাকিস্তান কালে এই সমাজের প্রধানত তরুণ প্রজন্ম যেটুকু করেছিল সেটার ঐতিহাসিক গুরুত্বকে আজ আমাদের মূল্যায়ন করতে হবে।
ঐ প্রজন্মের ভূমিকা চুলচেরা বিচারের সময় অনেক বিষয় আসবে। তাদের সমাজ ও কালগত সীমাবদ্ধতা এবং যে মার্কসবাদী তত্ত্ব নিয়ে তারা কাজ করতে চেয়েছিল তারও বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা বিশেষত ইসলাম ও মুসলিম সমাজের প্রেক্ষিতে ─ এগুলিকে আমাদের বিবেচনায় আনতে হবে।
পুরাতন কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে তাদের একটি মৌলিক পার্থক্যের জায়গা হল পুরাতন নেতৃত্বের মনে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাড়না ছিল না, বরং তারা সমাজতন্ত্রের লক্ষ্যে একটি সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলবার জন্য কাজ করাকেই অগ্রাধিকার দিত, আর ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের নিকট সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজনে একটি বিপ্লবী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চিন্তাই ছিল সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করার প্রয়োজনে নিজস্ব রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা থেকে সে কালের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার হিসাবে দেখতে পায়।
তরুণ প্রজন্ম এবং ছাত্ররা বাঙ্গালীর উপর পরিচালিত জাতিগত বঞ্চনার ঐ কালটাতে মার্কসীয় দর্শনের প্রভাবে ধর্মবিশ্বাস-মুক্ত বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের আদর্শিক ভিত্তি নির্মাণ করতে থাকে। কিন্তু এ দেশে প্রগতিশীলতা ও সমাজের বিপ্লবী রূপান্তরের ক্ষেত্রে জাতীয়তাবাদের ভূমিকা ও গুরুত্ব বুঝবার ক্ষেত্রে মার্কসবাদের শ্রেণী সংগ্রাম এবং মার্কসবাদী রাজনীতি ছিল বাধা হয়ে। এর সঙ্গে যুক্ত করতে হবে সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের ভূমিকা এবং এ দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উপরেও তাদের প্রভাবকে। বহুবিধ বাধা অতিক্রম করে চীন, ভিয়েৎনাম ইত্যাদি অন্য অনেক দেশের মত বিপ্লব সংগঠনের জন্য এই প্রজন্মের যে পরিপক্বতা এবং সময় দরকার সেটা যেমন ছিল না তেমন ইসলামী সমাজে বাস করে ইসলামের বিরুদ্ধে ভাবাদর্শিক লড়াইয়ের যুগ যে সেটা ছিল না সেটা আশা করি বুঝা খুব কঠিন নয়। অর্থাৎ যে ধরনের সামাজিক এবং রাজনৈতিক বিপ্লব ইসলামী সমাজের জন্য প্রয়োজনীয় সেটা সম্পন্ন করার জন্য যে ধরনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং বিশ্বপরিস্থিতির দরকার সেসব তখন ছিল না যেমন ছিল না তার উপযোগী তত্ত্বও। এ কথা আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, ইসলামী সমাজে সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লবের সমস্যা নিয়ে মার্কস-এঙ্গেল্সকে ভাবতে হয় নাই।
মার্কসবাদের ভূমিকার তাৎপর্য বুঝবার ক্ষেত্রে তার সামাজিক পটভূমিকেও আমাদের হিসাবে নিতে হবে। মনে রাখতে হবে পশ্চিম ইউরোপের খ্রীষ্টান সমাজের পটভূমি থেকে তার উত্থান। সামাজিক বিপ্লব সংগঠনের জন্য তার সফল প্রয়োগ হয়েছে সাধারণভাবে খ্রীষ্টান অথবা বৌদ্ধ অধ্যুষিত সমাজগুলিতে। যেমন রাশিয়া, চীন, ভিয়েৎনাম বা ইন্দোচীন, কিউবা ইত্যাদি। খ্রীষ্টান এবং বৌদ্ধ এই দুই ধর্মের কোনটিই রাজনৈতিক নয়, বরং মূলগতভাবে অহিংস এবং অরাজনৈতিক। এই দুই ধর্ম দ্বারা প্রভাবিত সমাজগুলি থেকে ইসলামী সমাজের বাস্তবতা অনেক ভিন্ন। ইসলাম সহিংস চরিত্র বিশিষ্ট একটি রাজনৈতিক ধর্ম। এখানে ধর্ম এবং ধর্মীয় শ্রেণীর দ্বারা জনগণ বা জন-সমাজ এমনইভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় যে আধুনিকতার পথে এখানে ভিতর থেকে জাগরণ ঘটানো এক প্রায় অসম্ভব ব্যাপার হয়ে আছে। স্বাভাবিকভাবে এক সময় মুসলিম সমাজগুলি তাদের পশ্চাৎপদতার কারণে পাশ্চাত্য আধিপত্যের অধীনে চলে যায়। এক দীর্ঘ সময় মুসলিম দেশগুলির অধিকাংশই পাশ্চাত্য বিভিন্ন রাষ্ট্রের উপনিবেশ হয়ে ছিল। আধুনিকতার পথে তাদের যেটুকু যাওয়া সেটুকুর মূলে রয়েছে পাশ্চাত্যের আধিপত্য। স্বাভাবিকভাবে পাশ্চাত্য শক্তিবর্গ মুসলিম সমাজে বিপ্লব সংগঠনের উদ্দেশ্য নিয়ে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নাই। সুতরাং তাদের উপনিবেশবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী লুণ্ঠন ও শোষণের প্রয়োজনে যেটুকু পরিবর্তন ঘটানো দরকার মনে করেছে তারা সেটুকুই করেছে। একটা সময়ে তাদেরকে প্রত্যক্ষ শাসন বা আধিপত্যের অবসান ঘটাতে হয়েছে। যাবার সময় সাধারণভাবে তারা তাদের অধস্তন এবং সহযোগী শ্রেণীসমূহের কাছে এখানে রাষ্ট্র ক্ষমতা হস্তান্তর করে গেছে। এভাবে প্রত্যক্ষ উপনিবেশবাদী শাসনের অবসান হলেও তাদের পরোক্ষ আধিপত্য রয়ে গেল।
তৎকালীন পূর্ব বাংলা কিংবা আজকের বাংলাদেশের জন্যও এই বাস্তবতা বিদ্যমান। আধুনিক যুগের চাহিদা পূরণের জন্য যে ধরনের রাষ্ট্রিক ও সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন তা অন্যান্য মুসলিম দেশের মত এ দেশেও সম্পন্ন হয় নাই। এবং এ প্রসঙ্গে মনে রাখতে হবে পৃথিবীর অন্য সকল সমাজ থেকে মুসলিম সমাজের সমস্যা ও বৈশিষ্ট্য অনেক ভিন্ন। পাশ্চাত্য প্রবর্তিত অর্থনীতি কিংবা প্রযুক্তির বহিরঙ্গ দেখে তাকে অন্য সমাজের মত মনে করা নিদারুণ ভুল, যেটা অনেকে করেন। একই ধরনের প্রযুক্তিগত উপকরণ নিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন ধরনের সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা ছিল এবং আছে। যেমন মধ্যযুগে একই লাঙ্গল ভিত্তিক কৃষি সত্ত্বেও পশ্চিম ইউরোপে যে ধরনের সামন্তবাদী ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল ভারতবর্ষে তা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থা ছিল। আবার এখানে ধর্মবিশ্বাসকে আশ্রয় করে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক কাঠামোতে লাঙ্গল-চাষ নির্ভর কৃষি সমাজ গড়ে তোলা হয়েছিল, যা পৃথিবীর অন্য কোথায়ও এভাবে দেখা যায় না। বর্ণজাতিভেদ প্রথা ভারতবর্ষের নিজস্ব বৈশিষ্ট্য। এভাবে আরও বিভিন্ন দেশের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে সমাজ গঠনে প্রযুক্তি বা অর্থনীতির সীমাবদ্ধতার দৃষ্টান্ত হিসাবে। অর্থাৎ শুধু প্রযুক্তির মান বা অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য দিয়ে সমাজের সবকিছুকে ব্যাখ্যা করা যায় না।
যাইহোক, এখানে রাষ্ট্রিক ও সামাজিক বিপ্লবের প্রয়োজন সেদিন যেমন ছিল আজও তেমন আছে। ’৭১ যেন বিপ্লবের ছায়াপাত করেছিল মাত্র। কিন্তু বিপ্লব জয়যুক্ত হয় নাই। বিভিন্ন কারণেই সেটা হয় নাই। এখানে সেই কারণগুলির কিছু সম্পর্কে খুব সংক্ষিপ্তভাবে কিছুটা আলোকপাত করতে চেয়েছি। কিন্তু এ নিয়ে আরও বিস্তারিত এবং প্রচুর আলোচনার প্রয়োজন আছে। এটা কারও একারও আলোচনার বিষয় নয়। বহুজনের অংশগ্রহণেই এই আলোচনা একটা তাৎপর্যপূর্ণ ফল বয়ে আনতে পারে। এখানে আমি নূতন করে সেই আলোচনার সূত্রপাত করতে চাইলাম।
যাইহোক, এই আলোচনাকে সমাপ্তির দিকে নিবার আগে যে কথা স্পষ্টভাবে বলতে চাই সেটা হচ্ছে এই যে, যদি লীগকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের কারণে মুক্তিযুদ্ধের ধারার শক্তি বলতে হয় তবে বিএনপি-কেও তা বলতে হবে, কারণ তার প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান নিজে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এ দিক থেকে বরং জিয়া মুজিবের তুলনায় অনেক বেশী উজ্জ্বল। মুজিব মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী নন, নেতৃত্বদানকারী তো ননই। তার দল যাই করুক তিনি যুদ্ধে যে যান নাই সেটাই ইতিহাস। অপর দিকে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী জিয়াউর রহমান যে বামপন্থীদের নিয়ে তার দল বিএনপি গঠন করেন তাদের এক বড় অংশ ছিল প্রত্যক্ষভাবে মুক্তিযুদ্ধের যোদ্ধা। ভারত এবং লীগের বহু বাধা ও বিপত্তিকে অতিক্রম করেই তাদেরকে নিজেদের মত করে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়েছিল। এর পরেও কি বলা যাবে যে বিএনপি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা আদর্শ ধারণকারী দল?
আসলে লীগ-বিএনপি এরা সবাই নিজেদের সুবিধার প্রয়োজনে মুক্তিযুদ্ধের নাম ব্যবহারকারী। এর সঙ্গে নীতি-আদর্শের সম্পর্ক নাই। দলগতভাবে এরা প্রকৃতপক্ষে হঠাৎ ঘটনাচক্রে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়া শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী, যারা ষাটের দশকে যেমন মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি গড়ে নাই তেমন তাকে ধারণও করে নাই যুদ্ধ পরবর্তীকালে তাদের কর্মকাণ্ডে। আর যারা ষাটের দশকে মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি গড়লেও এসব দলের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে তাদেরকে পথভ্রষ্ট বলা ছাড়া বলার আর কিছু নাই। তারা হতাশার কারণে হোক, পরিস্থিতির চাপে হোক, আর সুবিধাবাদ ও লোভের কারণে হোক, পথভ্রষ্ট।
আজ যদি নির্মোহভাবে দেখা যায় তবে আমরা দেখতে পাব যে, ষাটের দশকে যে প্রজন্ম জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের রাজনীতি নির্মাণ করেছিল বিভিন্ন ঘটনা প্রবাহে ’৭১-এ যুদ্ধ ঘটিয়ে দিয়ে তারা তাদের ভূমিকা শেষ করেছিল। ফলে মুক্তিযুদ্ধও আর প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ হয়ে উঠে নাই। যেটা হয়েছে সেটা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নামে একই সঙ্গে এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজিডি এবং তামাশাও। যারা যুদ্ধ চেয়েছিল এবং এই যুদ্ধ গড়বার জন্য নেতৃত্বহীন হয়েও যথাসাধ্য করেছিল ’৭১-এর ঘটনাধারা তাদেরকে ছিটকে ফেলেছিল যুদ্ধের মূল ধারা থেকে এবং যারা মুক্তিযুদ্ধ চায় নাই এবং যুদ্ধকে সর্বপ্রযত্নে বাধা দিতে এবং এড়াতে চেয়েছিল তারা হয়ে গেল যুদ্ধের নেতা-পিতা এবং আরও কত কী! বস্তুত লীগ নেতৃত্বের হাতে মুক্তিযুদ্ধের নিয়ন্ত্রণ চলে যাবার সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের মূল ভাবপ্রেরণার মৃত্যুমুখী যাত্রাও শুরু হল। লীগের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে ধারণ করা সম্ভব নয়। কারণ তা এটার নির্মাতা নয়। এটার প্রতি তার কোনও আত্মিক অঙ্গীকারও নাই। তা এটার আত্মসাৎকারী মাত্র। বিএনপি-এর মতই আওয়ামী লীগকেও চিনতে হবে নবরূপে মুসলিম লীগের ধারাবাহিকতা হিসাবে। তবে তা বিএনপি-এর তুলনায় আরও সূক্ষ্ম, আরও চতুর। মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতি না গড়েও মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তা ভারতের আশ্রয়, সাহায্য ও নিয়ন্ত্রণে থেকে তার উপর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার সুবাদে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাহারাদার হবার দাবীদার। সুতরাং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তাকে অভিনয় করে যেতে হবে মঞ্চের নিপুণ অভিনেতা-অভিনেত্রীর মত। আর মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির প্রকৃত নির্মাতাদেরকে থাকতে হবে অনির্দিষ্ট কাল অস্বীকৃতির অন্ধকারে।
সব মিলিয়ে বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের জন্য সাফল্যের কাল সেটা ছিল না। বিশেষত ’৭১ পরবর্তী কালে একদিকে যেমন নানান ধরনের বিপত্তি ও ভ্রান্তির মধ্যে তাদেরকে পড়তে হয়েছে তেমন শত্রুদের আক্রমণে তাদেরকে ধ্বংসও হতে হয়েছে। একটা অংশ মৃত্যু বরণ করেছে, অপর একটা অংশ ছত্রভঙ্গ হয়ে নানান ভাগে বিভক্ত ও বিক্ষিপ্ত হয়েছে, কিছু বিএনপি, জাতীয় পার্টির মত দলগুলির নিকট আত্মবিক্রয় ক’রে এবং কিছু আওয়ামী লীগের ছায়াতলে আশ্রয় নিয়ে বিদ্যমান ক্ষমতা কাঠামো এবং সমাজের ভিতর জায়গা করে নিয়েছে। এভাবে ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্মের রাষ্ট্র গঠন এবং সামাজিক বিপ্লবের স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল।
যাইহোক, আলোচনাকে আর দীর্ঘায়িত না করতে চেয়ে পরিশেষে এ কথা বলি, আমার বিবেচনায় গত শতাব্দীর ষাটের দশকের বিপ্লবী তরুণ প্রজন্ম তাদের ঘাম ও রক্ত দিয়ে যে ভিত্তি রচনা করেছিল সেটার উপর দাঁড়িয়ে রচিত হবে আগামী সফল বিপ্লবের যাত্রাপথ। ঐ প্রজন্মের এবং সেই সঙ্গে বামপন্থী আন্দোলনের ঐতিহ্যের অনেক কিছুই হবে আগামী বিপ্লবের পাথেয়। ব্রিটিশ শাসন কালের অভিজ্ঞতাকে বাদ দিয়ে যদি শুধু পঞ্চাশের দশকের সময় থেকে হিসাব করা যায় তাহলেও দেখা যাবে, অর্ধ শতাব্দীরও অনেক বেশী কাল পার হয়ে গেছে। এর মধ্যে পৃথিবীর পরিস্থিতিতে যেমন অনেক পরিবর্তন ঘটেছে তেমন দেশের পরিস্থিতিতেও অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। মার্কসবাদী সমাজতান্ত্রিক শিবির এখন অতীতের বিষয় মাত্র। কমিউনিস্ট রাজনীতির অনেক সীমাবদ্ধতা এবং ভ্রান্তি এখন প্রমাণিত। সুতরাং অতীতের মত ভিন্ন সমাজের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নির্মিত তত্ত্বের প্রতি অন্ধত্ব এবং কখনও সোভিয়েত ইউনিয়ন কিংবা কখনও চীনের প্রতি অন্ধ আনুগত্য নিয়ে যারা এক সময় বিপ্লবী রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করত তাদের দিন শেষ হয়েছে। অন্যদিকে, এখন এসেছে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ। এর ফলে বিদ্যমান ব্যবস্থা থেকে মুক্তির জন্য একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক বিপ্লব সংগঠন এখন আর অসম্ভব কোনও বিষয় নয়।
এই রকম বাস্তবতায় আমাদের চিন্তা এবং কর্মপদ্ধতিতে এবং কর্মসূচীতেও অনেক পরিবর্তন আনতে হবে। তবে পশ্চিম ইউরোপ থেকে উদ্ভূত একটা তত্ত্ব হিসাবে মার্কসবাদ এবং কমিউনিজমের ভূমিকা কিংবা কার্যকরতা ফুরালেও তার বিপ্লবী উত্তরাধিকারকে আমরা বর্জন করতে পারি না। পৃথিবীর আগ্রগমনে তার ভূমিকা যেমন অতুলনীয় তেমন আমাদের দেশেরও অগ্রগমনে তার বিরাট ভূমিকা রয়েছে। ফলে তার সবকিছু যেমন পরিত্যাজ্য নয় তেমন বিভিন্ন দেশের সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতাও আমাদের আগামী বিপ্লবের পথকে আলোকিত করবে। সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের নূতন যাত্রাপথ নির্মাণ করতে হবে। বলা যায় এটা হবে অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাদের নূতন বিপ্লবী তত্ত্ব নির্মাণ এবং আমাদের কর্মকাণ্ডের পুনর্বিন্যাস। এভাবে দেখা যাবে ষাটের দশকের বিপ্লবী প্রজন্মের ভূমিকা আগামী বিপ্লবের সফলতার ভিত্তি তৈরী করে দিয়েছে।