লিখেছেনঃ শামসুল আলম চঞ্চল , আপডেটঃ August 13, 2015, 12:00 AM, Hits: 2334
পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে একাত্তর সালের নয় মাস ব্যাপী মুক্তি যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জন্ম যেমন আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়েছে তেমনি এমন কতগুলো অমীমাংসিত প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে যা এ অঞ্চলে বসবাসরত বাংগালী জাতির জন্য আজ এক জটিল সংকটের সৃষ্টি করেছে। পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল ধর্মের উপর ভিত্তি করে। বলা হয়েছিল ভারতবর্ষে বসবাসরত মুসলমানরা এক জাতি। কিন্তু সমাজবিজ্ঞানের দৃষ্টিতে ভ্রান্ত এই তত্ত্ব দ্রুত মিথ্যা বলে প্রতীয়মান হল এবং মানব সমাজে আবেগ, অনুভূতি ও যোগাযোগের মাধ্যম যে মাতৃভাষা এবং একই ভাষাভাষী মানুষ নিয়ে যে জাতি গঠিত হয় সেটাই প্রমাণিত হল। পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির পূর্ব অংশ পূর্ব পাকিস্তান তার পশ্চিম পাকিস্তানী একই ধর্মের শাসকদের বিরুদ্ধে লড়াই করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করল। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি ছিল ইসলাম ধর্ম। সুতরাং পাকিস্তানের ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তিকে আঘাত না করে তার পূর্ব অংশকে স্বাধীন করা যেত না। কাজেই পূর্ব অংশে বসবাসকারী বাংগালী মুসলমানকে পশ্চিমের মুসলমানের বিরুদ্ধে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের লড়াইকে পাল্টা নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি দিতে হয়েছে। এই নৈতিক ও দার্শনিক ভিত্তি হল সেক্যুলারিজম বা লোকবাদ এবং বাংগালী জাতীয়তাবাদ। কিন্তু বৃটিশ উপনিবেশিক আমলে হিন্দু ও মুসলমান এই দুই ধর্মের পরিচয়কে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বাংলাকে ভাগ করে এর পশ্চিম অংশ ইতিমধ্যেই ভারত রাষ্ট্রে যোগ দেওয়াতে এই বাংগালী জাতিয়তাবাদ পূর্ণাংগ ছিল না। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ কালীন পাকিস্তানের ধর্মীয় চেতনাকে আঘাত করতে গিয়ে লোকবাদ ও বাংগালী জাতীয়তাবাদ সঠিক হাতিয়ার ছিল। কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর আমাদের নৈতিক ও আদর্শিক দাবী বা লক্ষ্য হওয়া উচিত ছিল ধর্ম নির্বিশেষে সকল বাংগালী জাতির ঐক্যের আহ্বান জানানো। ১৯৪৭ সালে ধর্মের ভিত্তিতে বাংগালী জাতির যে বিচ্ছিন্নতা ঘটানো হয়েছিল তাকে প্রত্যাখান করা উচিত ছিল উন্নত ও আধুনিক রাষ্ট্র হিসাবে সমগ্র বাংগালী জাতির প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনে। মৌলিক এই আদর্শ ও নৈতিকতাকে আমরা ধারণ করতে না পারার ফলে আজকে সমাজে ও রাষ্ট্রের যেমন নীতিহীনতা প্রাধান্য পাচ্ছে তেমনি ধর্মীয় রাজনীতির ক্রমিক পুন:প্রতিষ্ঠা ঘটছে। এরই ফল হিসাবে সমাজে ও রাষ্ট্রে ক্রমবর্ধমান ধর্মীয় রাজনীতির শক্তিবৃদ্ধি ও বিস্তার। একই সূত্রে গাঁথা সাম্প্রতিক বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম নামে মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠনটির প্রবল শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ।
এটা ঠিক যে, আওয়ামী লীগ-বিএনপি-র একচ্ছত্র রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে হেফাজতে ইসলামের প্রবল শক্তি নিয়ে সাম্প্রতিক উত্থান ছিল খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। এদেশের রাজনীতিতে যাঁরা ক্রমশ বিকাশমান ইসলামী শক্তিকে অবমূল্যায়ন করতেন ও হিসাবে আনতেন না তাঁরা এখন নড়ে চড়ে বসছেন। কারণ হেফাজতে ইসলাম নিজেদের রাজনৈতিক দল হিসাবে পরিচয় না দিলেও এ বিষয়টি স্পষ্ট করেছে যে, আগামীতে বাংলাদেশে ইসলামী আইন প্রতিষ্ঠা করার জন্য তারা দৃঢ় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এই আইনের একটি প্রথমিক রূপরেখা তারা তাদের তের দফার মধ্যে আংশিক প্রকাশ করেছে। তারা একটি বৃহৎ শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে এ বছর (২০১৩ সাল) দুইবার গত ৬ এপ্রিল ও ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে ৪/৫ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে ।
গত ৫ মে তারিখে ঢাকা অবরোধ শেষে ৫ ও ৬ তারিখের মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশে সরকারী বিভিন্ন বাহিনীর আক্রমণে হেফাজতের অনেকে নিহত, আহত ও ছত্রভংগ হয়ে গেলেও খুব দ্রুতই যে তারা নিজেদের সংহত ও পুনরসংগঠিত করে ফেলছে তা তাদের নেতাদের বক্তৃতা-বিবৃতি শুনে ও সাম্প্রতিক সময়ের কর্মকান্ড দেখেই বোঝা যায়। কিছু দিন আগে ঘটে যাওয়া পাঁচটি সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে তারা সরাসরি অংশ গ্রহণ না করলেও তাদের সমর্থন ও সক্রিয় উপস্থিতি নির্বাচনের ফলাফলে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। বিএনপি তার প্রধান শত্রু আওয়ামী লীগকে মোকfবিলা করার জন্য প্রথম থেকেই হেফাজতকে ব্যবহার করতে চেয়েছে। প্রথম দিকে জামায়াতে ইসলামীর সাথে হেফাজতের কিছুটা বিরোধ থাকলেও সরকার বিরোধী আন্দোলনে উভয় দলই এখন ঐক্যবদ্ধ। সবকিছু মিলিয়ে এটি স্পষ্ট যে, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বড় দল বিএনপি, উদীয়মান বৃহৎ শক্তি হেফাজত ও জামায়াতে ইসলামী অদূর ভবিষ্যতে এক যোগে আন্দোলনে যাবে ও রাষ্ট্রব্যবস্থাকে সম্ভবত বড় ধরনের আঘাত করবে।
এক : হেফাজতে ইসলামের উত্থানের পটভূমি
২০১১ সালে আওয়ামী লীগ সরকার নারীনীতি ঘোষণা করলে অন্যান্য ইসলামী সংগঠনের সাথে হেফাজতে ইসলাম নামে মাদ্রাসা ভিত্তিক নূতন একটি সংগঠন এর প্রতিবাদে রাস্তায় নামে। পরে তারা প্রকাশ্যে বড় ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করে নাই বলে তাদের কথা লোকজন ভুলে যায়। এর পর গত ৫ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ তারিখে যুদ্ধাপরাধী ও জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনালের বিচারে যাবজ্জীবন কারাদন্ড রায় প্রদান করলে সেদিনই এর প্রতিবাদে শাহবাগের চত্বরে ব্লগাররা আন্দোলন শুরু করে। এর কিছুদিন পরে ১২ ফেব্রুয়ারী শাহবাগ আন্দোলনের কর্মী ও ব্লগার রাজিব হায়দার শোভনকে কিছু ইসলামী জঙ্গী হত্যা করলে ইসলাম পন্থীরা ব্যাপক প্রচারণা চালায় যে রাজিব ও শাহবাগ আন্দোলনের ব্লগাররা নাস্তিক ও ইসলামের নবী মোহাম্মদের সমালোচনাকারী। তারই প্রেক্ষিতে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবী পেশ করে ও ৬ এপ্রিল তারিখে ঢাকার শাপলা চত্বরে ৪ থেকে ৫ লক্ষ মানুষের সমাবেশ ঘটিয়ে তাদের শক্তি প্রদর্শন করে।
হেফাজতের মূল শক্তি হল মাদ্রাসার ছাত্ররা। বিশেষভাবে কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা। স্বাধীনতার পর শেখ মুজিব থেকে শুরু করে বিভিন্ন সরকার ক্রমবর্ধমানভাবে মাদ্রাসা শিক্ষার অনুদান বাড়িয়েছে। তার উপর আছে দরিদ্র লোকজনের তাদের শিক্ষা খরচ কমাবার জন্য তাদের সন্তানকে মাদ্রাসায় দেওয়ার প্রবণতা। বলা যায় অনেকটা অন্তরালেই মাদ্রাসার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের সংখ্যাও আজ আর কম নয়। মাদ্রাসা শিক্ষা প্রায় পুরোপুরিই ইসলাম ধর্ম ভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা। এখানে ইসলামী জ্ঞানের চর্চা করা হয় ও কোরআন-হাদীস পড়ানো হয়। সুতরাং ইসলামকে তার সঠিক রূপে বোঝার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান হিসাবে মাদ্রাসার চেয়ে উপযুক্ত অন্য কোন প্রতিষ্ঠান নাই। তাদের ইসলামী জ্ঞান সম্পর্কে সন্দেহ অথবা এবিষয়ে তাদেরকে অবমূল্যায়নের কোন সুযোগ নাই।
এটা ঠিক যে, শাহবাগের আন্দোলন থেকে যখন জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধের সাথে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী উঠল তখন স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ক্রমবিকাশমান ইসলামী শক্তি তাদের আশু বিলুপ্তির সম্ভাবনায় শংকিত ছিল। আর একবার তাদের বিলুপ্তির সম্ভাবনা হয়েছিল একাত্তরে স্বাধীনতা লাভের পরপরই। সে সময় প্রায় সকল ইসলামী শক্তিই বাংগালী জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধকে বিরোধিতা করেছিল। ফলে রাজাকার, আল-বদর, আল শামস্ সহ সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও শাস্তি হলে এদেশে ইসলামী শক্তির মেরুদণ্ড ভেংগে যেত। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংগালীর বিজয় ও পাকিস্তানের পরাজয়ের ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগী শক্তি স্বাভাববিকভাবেই ছত্রভংগ ও দুর্বল হয়ে পড়েছিল। পরাজিত এই অপশক্তিকে সহজেই নির্মূল করা যেত যদি যুদ্ধের পর রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ এ বিষয়ে আন্তরিক হত ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিত। কিন্তু শেখ মুজিব ইসলামী শক্তিকে রক্ষা করতে চেয়ে ৭১’-এর দালালদের বিচারে সময়ক্ষেপণ করলেন ও নমনীয়তা প্রদর্শন করলেন। তিনি সময়ক্ষেপণ করার নীতি নিয়েছিলেন যুদ্ধাপরাধীদের প্রতি মানুষের ঘৃণা যাতে কমে যায়। এক পর্যায়ে অনেককে বিচার থেকে অব্যাহতি দিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের ভাবপ্রেরণা থেকে বাহাত্তরের সংবিধানে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র রাখা হলেও রাষ্ট্রনেতা হিসাবে শেখ মুজিব এই মূল নীতিসমূহের প্রতি অংগীকার রক্ষার নৈতিকতা থেকে এগুলোকে ধারণ ও বাস্তবায়ন করার পরিবর্তে ধর্মীয় চেতনা ও সাম্প্রদায়িকতার বৃদ্ধি ঘটাতে সচেষ্ট হলেন। এই প্রক্রিয়ার অংশ হিসাবে তিনি ইসলাম ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসা শিক্ষাকে বিলুপ্ত করে দেশব্যাপী একমুখী বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা বাস্তবায়ন করার বদলে পাকিস্তান আমলের প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থাকে রক্ষা তো করলেনই বরং ধর্মভিত্তিক মাদ্রাসার অনুদান বৃদ্ধি করলেন। সাম্প্রদায়িকতা দোষে দুষ্ট পাকিস্তান আমলের শত্রু সম্পত্তি আইনকে শুধুমাত্র নাম পরিবর্তন করে অর্পিত সম্পত্তি আইন নামে বলবৎ রাখলেন। বাংলাদেশ ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র হবার পরও ওআইসি সম্মেলনে যোগ দিলেন। এভাবে শেখ মুজিবের সরকার তাঁর আমলে ভয়াবহ অরাজকতা, দুর্নীতি ও লুটপাটের পাশাপাশি যতটা সম্ভব দেশকে ইসলামীকরণের পথে এগিয়ে নিয়ে গেলেন।
জিয়া ক্ষমতায় আসার পর শেখ মুজিব তাঁর দল আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধে বিজড়ণের ফলে ইসলামীকরণের পথে যে কাজগুলো করতে পারেন নাই সেই কাজগুলোতে হাত দিলেন। জিয়ার পর এরশাদের নয় বছরের শাসনামলে জামায়াত ও অন্যান্য ইসলামী শক্তি সমাজে ও রাষ্ট্রে একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলে। এরপর বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমে খালেদা জিয়ার বিএনপি ও শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে এবং প্রত্যেকেই নানাভাবে সমাজ ও রাষ্ট্রের ক্রমিক ইসলামীকরণ করে গেছে। সর্বশেষ শেখ হাসিনার সরকারকেও মাদ্রাসার জন্য অনুদান বৃদ্ধি করে তাদের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করতে দেখা গেছে।
অনেকেই মনে করেন শাহবাগ আন্দোলন না হলে হেফাজতের উত্থান হত না। প্রকৃতপক্ষে হেফাজত নাম না নিয়ে হলেও হেফাজতের মত আদর্শিক ইসলামী শক্তির উত্থান বাংলাদেশে হতই। শাহবাগের আন্দোলন ছিল এই শক্তির উত্থানের উপলক্ষ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকেই যে নীতিহীনতা আর অসততা সমাজের ও রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যান্সার কোষের মত ক্রমবর্ধমান বিস্তার হয়ে সর্বাত্মক ধংসের পথে দেশকে নিয়ে চলেছে তা থেকে সমাজ ও রাষ্ট্র নিজেই যে এক সময় বাঁচতে চাইবে সেটাই স্বাভাবিক ও অবশ্যম্ভাবী বলে মনে হয়। সংকট থেকে উত্তরণের জন্য সমাজের মধ্যে আধুনিক ও প্রগতিশীল আদর্শিক শক্তি সেভাবে দাঁড়াতে না পারার কারণে এবং ইতিমধ্যেই সমাজে ইসলামের সহজ গ্রহণযোগ্যতা থাকাতে হেফাজতে ইসলাম এই আদর্শিক শূন্যতা পূরণে এগিয়ে এসেছে।
অবশ্য হেফাজতে ইসলামের আকস্মিক উত্থানের পিছনে দেশের ভিতরের ও বহি:শক্তির যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ হাত আছে তা স্পষ্ট বোঝা যায়। কওমী মাদ্রাসাগুলোতে বেশীর ভাগ ছাত্রই দরিদ্র শ্রেণী থেকে আসা। তাদের শিক্ষকরাও যথেষ্ট দরিদ্র। সাধারণত বিভিন্ন সামাজিক অনুদানে এই মাদ্রাসাগুলো চলে। অন্যদিকে আমরা জানি সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষাধিক লোকের যে কোন সমাবেশ করতে গেলে কোটির উপরে টাকা লাগে। পত্রিকান্তরে জানা যায় হেফাজতে ইসলামের ৬ এপ্রিলের সমাবেশের জন্য ৮৩ কেটি টাকা খরচ হয়েছিল। এছাড়া যেখানে শেখ হাসিনা বা খালেদা জিয়ার মত বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দও জনসভা করতে হেলিকাপ্টার ব্যবহার করেন না সেখানে দুস্থ ও দরিদ্র মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রদের সংগঠনের নেতা আহমদ শফী জনসভায় বক্তব্য রাখতে হেলিকাপ্টারে করে চট্টগ্রাম থেকে বগুড়ায় যান ও সেখান থেকে একই ভাবে ঢাকায় আসেন ৬ এপ্রিলের জনসভায় যোগ দিতে। সেই ৬ এপ্রিল ও পরবর্তী ৫ মে-এর জনসভা সফল করার জন্য হেফাজত হাজার হাজার বাস ও অন্যান্য বাহন সংগ্রহ করে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসতে পারে এত টাকা তারা কোথায় পেল।
আরেকটি বিষয় স্মরণ রাখা দরকার যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীনকে মোকাবিলা করার জন্য দীর্ঘ দিন ধরে এই অঞ্চলে তার সামরিক উপস্থিতি বাড়াতে চেয়ে বঙ্গোপসাগরে নৌঘাঁটি করার জন্য বদ্ধপরিকর। কাজেই অতীতে খালেদা বা হাসিনার কোন সরকারের কাছ থেকেই তাদের নৌঘাঁটি করার বিষয়ে সহযোগিতা না পেয়ে তারা বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে এদেশের সার্বভৌমত্ব ও ভূ-সীমার উপর যে কোন আঘাত হানতে মরিয়া হয়ে উঠেছে তা খুবই যুক্তি সংগত মনে হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে হেফাজতের মত শক্তিকে গড়ে তোলার প্রবল সম্ভাবনাকে নাকচ করা যায় না।
দুই : হেফাজত কি ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী?
কোন প্রেক্ষিতে হেফাজতে ইসলাম তের দফার আন্দোলন শুরু করে তা আগেই উল্লেখ করেছি। তের দফাতে অনেক বিষয় উল্লেখ থাকলেও তিন ও চার নম্বর দফাগুলোতেই সবচেয়ে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে হেফাজতের উত্থানই হয়েছে মূলত শাহবাগের আন্দোলনের প্রতিক্রিয়ায়। বিশেষভাবে ঐ আন্দোলনকে প্রতিহত করার জন্য।
এছাড়া তাদের নারীনীতি বিরোধী অবস্থান তো সকলের কাছে পরিচিত। তাদের তের দফার১ চতুর্থ দফায় বলছে, ‘মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ’ বন্ধ করতে হবে। বিষয়টি খুবই কৌতুহলোদ্দীপক যে, তারা মোমবাতি প্রজ্জ্বলনকে বিজাতীয় বলছে। প্রাসংগিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে ধর্ম ও জাতি কী এক? ধর্মীয় পরিচয় পরিবর্তন করা যায়, কিন্তু জাতি পরিচয় সহজে পরিবর্তন করা যায় না। বাংলাদেশের মুসলমানদের ধর্ম ইসলাম হলেও নৃতাত্ত্বিক জাতিসত্তায় তারা বাংগালী। উষর মরুভূমির আরব জাতি থেকে শস্য-শ্যামলা আর নদ-নদীপূর্ণ ভূমি বাংলায় বসবাসকারী বাংগালী জাতি সম্পূর্ণ পৃথক। পৃথক তার সভ্যতা, সংস্কৃতি, রুচি, মূল্যবোধ সবকিছুই। বাংগালীর মহাস্থানগড় আর উয়ারী-বটেশ্বরের মত আড়াই হাজার বছরেরও বেশী প্রাচীন নগর সভ্যতা আছে। আছে সাহিত্য, দর্শন, আর সংগীতের ঐতিহ্যও। বাংগালী জাতি হিসাবে যেখানে আমরা হাজার হাজার বছরের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উত্তরাধীকারী সেখানে আমাদেরই আবহমান কালের সংস্কৃতি মঙ্গল প্রদীপ জ্বালানোকে হেফাজত কী না বলছে বিজাতীয় সংস্কৃতি!
আমরা যদি ১২০৪ খ্রীষ্টাব্দে ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজির বাহিনীর বাংলার উপর আগ্রাসন ও বলপূর্বক অনুপ্রবেশকে বিজাতীয় তুর্কীদের আাগ্রাসন হিসাবে না দেখে বরং তাকে নিয়ে গৌরব করি তাহলে আমাদের আর সকল বিজাতীয় ও বিদেশীদের আগ্রাসনকে নিয়েও গৌরব করতে হবে। বখতিয়ার খলজির আগ্রাসনের ফল হিসাবে আরও যে সব বহিরাগত আগ্রাসন এ জাতির উপর হয়েছে ও তার ফলে যে ধর্ম আমাদের উপর চাপানো হয়েছে সেটাও কী আগ্রাসী বহিরাগতের ধর্ম নয়? বাংগালী জাতির জাতীয় আত্মগৌরববোধ জাগ্রত করার পথে এই বহিরাগত ও বলপূর্বক চাপিয়ে দেওয়া ধর্ম যে একটি বড় বাধা এটি না বুঝলে আমরা পৃথিবীর বুকে উন্নত জাতি হিসাবে দাঁড়াতে পারব না।
হেফাজত ও অন্যান্য ইসলামপন্থীদের শাহবাগের আন্দোলনের তরুণ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে বলেছিল যে ব্লগাররা নাস্তিক ও মোহাম্মদ সম্পর্কে কুৎসা রটনাকারী। এই সময় বুদ্ধিজীবীরা বলতে থাকেন যে, হেফাজত ইসলামের অপব্যাখ্যা করছে। শুধু বুদ্ধিজীবীরা নয় এদেশের প্রায় সকল শিক্ষিত নাগরিক সমাজেরই এধরনের একটি দৃষ্টিভংগী দেখতে পাওয়া যায়। আসলেই কী হেফাজত ইসলামের অপব্যাখ্যা করেছিল?
হেফাজত তার তের দফার চতুর্থ দফায় বলেছে, “ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ,” বন্ধ করতে হবে। প্রকৃতপক্ষে নারীদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা, অফিস-আদালত ও শিল্প প্রতিষ্ঠান সহ সকল সামাজিক ও রাষ্ট্রিক কর্মযজ্ঞে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে গৃহের অবরোধের বাইরে অবস্থানই হেফাজতের দৃষ্টিতে ‘প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ’ ও ‘বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার।’ অর্থাৎ তারা নারীদের সমাজ ও রাষ্ট্রের সকল ক্ষেত্র থেকে বিযুক্ত করে অন্তপুরে বন্দী করে রাখতে চায়। চায় ইসলামের কঠোর অনুশাসন প্রয়োগের। অর্থাৎ আজকে বাংলাদেশের নারীরা অবাধে অফিস, আদালত, কারখানা প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানে কাজ করছে সেসব বন্ধ করতে হবে। ৬ এপ্রিল তাদের সমাবেশের নারী বিদ্বেষী আচরণও ঢাকার নাগরিক সমাজের সকলকে হতচকিত করে ফেলে। শাপলা চত্বরে মিছিল করে যাবার পথে বিভিন্ন স্থানে নারীদের প্রতি অপমানজনক আচরণ ও সমাবেশে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় কিছু সংবাদ মাধ্যমের নারী কর্মীদের উপর হেফাজতের কর্মীদের হামলা, মারধর ও মারমুখী আচরণ শহরের শিক্ষিত মানুষের মধ্যে হেফাজতের প্রতি নেতিবাচক ধারণা তৈরী করে। গত ৬ এপ্রিল মতিঝিলের শাপলা চত্বরে সমাবেশের দিন তারা মহড়া দিয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কি রকম সমাজ নির্মাণ করতে চায়।
নারীরা বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে বিপুলভাবে সহযোগিতা করছে ফলে দেশের অর্থনীতির চাকাকে সচল রাখতে তাদের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়াও এদেশে নারীরা এখন অনেক সামাজিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে এমনভাবে যুক্ত হয়ে গেছে যে, সামাজিক অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন করে ফেললে দেশের অর্থনীতির অপুরণীয় ক্ষতি হবে।
আমরা যদি ইসলাম ধর্মের মূল আদর্শ যে সকল ধর্মগ্রন্থে বর্ণিত আছে তার উপর নির্ভর করি তাহলে দেখতে পাব যে, শুধু নারীর প্রশ্নে নয় হেফাজতের তের দফার কোন দাবীই ইসলামের মূল ভাবপ্রেরণার সাথে অসংগতিপূর্ণ নয়।
কিছুদিন আগে হেফাজতে ইসলামের আমীর আহমদ শফীর কোন এক ইসলামী অনুষ্ঠান বা ওয়াজে প্রদত্ত বক্তৃতার একটি অংশের ভিডিও ফেসবুক সহ অন্যান্য আন্তর্জালের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক আলোচনা চলেছে। এবিষয়ে টেলিভিশনের টকশো ও জাতীয় সংসদেও আলোচনা হয়েছে এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী পর্যন্ত বক্তব্য রাখতে বাধ্য হয়েছেন। কী ছিল আহমদ শফীর কথায় যার ফলে দেশের সচেতন ও আধুনিক মানুষ মাত্রই প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাধ্য হয়েছে।
ঐ ওয়াজে আঞ্চলিক ভাষার মিশ্রণে নারীদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে আহমদ শফী বলেন২, “তেঁতুল দেখলে মানুষের যেমন জিভে জল আসে তেমনি নারীদের দেখলে দিলের মইধ্যে লালা বাহির হয়।’ নারীদের শিক্ষা প্রসংগে শফী বলেছেন, ‘মহিলাদের ক্লাসের সামনে বসানো হয় কলেজ-ভার্সিটিতে। পুরুষরা কি লেখাপড়া কইরতেছে? মহিলা তেঁতুলের মত – তেঁতুলের মত – তেঁতুলের মত। ছোট্ট একটা ছেলে তেঁতুল খাইতেছে, আপনে দেখতেছেন, আপনার মুখ দিয়া লালা বাইর হবে। সত্য না মিথ্যা বলেন তো? তেঁতুল বৃক্ষের নীচ দিকে আপনে হাইটা যান, আপনার মুখ থেকে লালা বাইর হয়। মার্কেটে যেখানে তেঁতুল বিক্রি করে ওদিকে যদি আপনে যান, আপনার মুখ থেকে লালা বাইর হয়। মহিলা তার থেকে বেশী খারাপ। মহিলাদের দেখলে দিলের মইধ্যে লালা বাইর হয়, বিবাহ করতে ইচ্ছা হয়। লাভ ম্যারেজ/ কোর্ট ম্যারেজ করতে ইচ্ছা হয়। হয় কি-না বলেন? এই মহিলারা তেঁতুলের মত।’
গার্মেন্টস শিল্পে কর্মরত নারীদের প্রসংগে অত্যন্ত অশালীন মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘গার্মেন্টে কেন দিছেন আপনার মেয়েকে? ফজরে ৭-৮ টা বাজে চলে যায়, রাত ৮ টা, ১০ টা, ১২ টায়ও আসে না। কোন পুরুষের সংগে ঘোরাফেরা করতেছে তুমি তো জান না। কতজনের মধ্যে মত্তলা হচ্ছে আপনার মেয়ে, আপনে তো জানেন না। জেনা কইরা কইরা টাকা রোজগার করতেছে, কী বরকত হবে।’
মেয়েদের লেখাপড়া সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আপনারই মেয়ে স্কুলে, কলেজে, ভার্সিটিতে লেখাপড়া করছে। আরে ক্লাস ফোর-ফাইভ পর্যন্ত লেখাপড়া করান। বিবাহ-শাদি দিলে স্বামীর টাকা-পয়সার হিসাব কইরতে পারে মত, অতটুকু দরকার। বেশী বেশী আপনার মেয়েকে আইজকে স্কুলে-কলেজে-ভার্সিটিতে লেখাপড়া করাইতেছেন, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ করতেছেন। কিছুদিন পরে আপনার মেয়ে স্বামী একটা নিজে ধরি নিবে, লাভ ম্যারেজ-কোর্ট ম্যারেজ করি চলে যাবে।’
ইসলাম ধর্মে মূল গ্রন্থ সমূহ সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তারা বুঝবেন যে হেফাজতের তের দফা যেমন ইসলামের মূল আদর্শের সংগে সংগতিপূর্ণ তেমনি তার আমির আহমদ শফীর বক্তব্যও ইসলামের মূল চেতনার সাথে অসংগতিপূর্ণ নয়। মূল ইসলামী গ্রন্থসমূহ আলোচনার পূর্বে আমাদের একটি কথা মনে রাখা দরকার যে, অন্যান্য ধর্মে যেমন ধর্মীয় নির্দেশ প্রতিপালনের কঠোর বাধ্যবাধকতা নাই, ইসলাম তেমন নয়। জীবনের প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে কী করা যাবে অথবা কী করা যাবে না তার বিশদ নির্দেশ কোরআন ও হাদীস সমূহে৩ বলা আছে। শুধু তাই নয়, আল্লাহ ও তাঁর রসূল যা বলছেন ও নির্দেশ দিয়েছেন সেখান থেকেও কোন মুসলমান ভিন্ন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। এ বিষয়ে কোরআন৪ কি বলছে, তা দেখা যাকঃ
‘আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূল কোন বিষয়ে নির্দেশ দিলে কোন মু’মিন পুরুষ কিংবা মু’মিন নারীর সে বিষয়ে ভিন্ন সিদ্ধান্তের অধিকার থাকিবে না। কেহ আল্লাহ্ এবং তাঁহার রাসূলকে অমান্য করিলে সে তো স্পষ্টই পথভ্রষ্ট হইবে।’ (আল-কুরআনুল করীম, ৩৩ সূরাঃ আহযাব, ৩৬)
যদিও চৌদ্দশত বৎসর পূর্বে সেই সময়কার আরবীয় প্রেক্ষিত ও পরিবেশ অনুযায়ী ইসলামের নবী মোহাম্মদ যা বলেছিলেন অথবা কোরআনে যা বলা হয়েছে তা অক্ষরে অক্ষরে পালন অত্যন্ত কঠিন তবু সৌদী আরবের মত ইসলামী দেশগুলো ও বিভিন্ন দেশে প্রকৃত ইসলামী আদর্শ অনুসরণ করতে চেয়ে সেখানকার রাজনীতিকরা আজকের যুগে যতটা সম্ভব মূল ইসলামী মতাদর্শ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। আমরা নীচে এ বিষয়টি আলোচনা করব যে, হেফাজতে ইসলাম যা বলছে তা মূল ইসলামের অনেক কাছাকাছি এবং বাংলাদেশে ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করা অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর চেয়ে অনেক কম ভন্ডামীপূর্ণ।
হেফাজতের সাথে আমরা প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম তাদের নারীনীতি বিরোধী আন্দোলন থেকে। আমরা জানি যে, আধুনিক সভ্যতা নারীকে সম্পত্তির অধিকারী যেমন করেছে তেমনি নারীদের পুরুষের সমান মর্যাদা দিয়েছে। এভাবে বিভিন্ন সমাজে, বিভিন্ন ধর্মে হাজার হাজার বছর ব্যাপী চলে আসা নারীর উপর পুরুষের কর্তৃত্বমূলক ও নারীর অধস্তন অবস্থার অবসান ঘটছে। যদিও মানব সভ্যতায় পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভিন্ন একটি ভূমিকা সব সময়ই ছিল। কিন্তু চৌদ্দশত বছর আগের ধর্ম তা মানতে নারাজ। এবিষয়ে কোরআনে আমরা দেখিঃ
’পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ্ তাহাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন এবং পুরুষ তাহাদের ধন-সম্পদ ব্যয় করে। সুতরাং সাধ্বী স্ত্রীরা অনুগতা, এবং লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হিফাজতে উহারা হিফাজত করে। স্ত্রীদের মধ্যে যাহাদের অবাধ্যতার আশংকা কর তাহাদিগকে সদপুদেশ দাও, তারপর তাহাদের শয্যা বর্জন কর এবং তাহাদিগকে প্রহার কর। যদি তাহারা তোমাদের অনুগত হয় তবে তাহাদের বিরুদ্ধে কোন পথ অন্বেষণ করিও না। আল্লাহ্ মহান, শ্রেষ্ঠ।’ (৪ সূরাঃ নিসা, ৩৪)
উপরে কোরআন-এর আয়াতটিতে বলা হয়েছে ‘… লোকচক্ষুর অন্তরালে আল্লাহর হিফাজতে উহারা হিফাজত করে।’ অর্থাৎ নারীরা গৃহে থাকবে পুরুষের অধীনে। এছাড়াও অসংখ্য হাদীসে নারীদেরকে স্বামীদের উপর নির্ভরশীল হয়ে গৃহে থকেতে বলা হয়েছে।
মহিলাদের ঘরের বাইরে বের হওয়াকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে নীচের হাদীস তিরমিযী শরীফে৫:
’মুহাম্মদ ইবনে বাশশার …. হযরত আবদুল্লাহ (রাঃ) হইতে বর্ণিত। নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করিয়াছেন, মহিলা হইল পর্দার জিনিস। যখন সে বাহিরে আসে তখন শয়তান তাহার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে।’ (তিরমিযী শরীফ, হাদীস-১১৫১)
পাঠক লক্ষ্য করুন জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদ নারী ও পুরুষের সমানাধিকারের ঘোষণা ও বাংলাদেশের নারী নীতির সাথে কোরআনের ’পুরুষ নারীর কর্তা, কারণ আল্লাহ্ তাহাদের এককে অপরের উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করিয়াছেন’ এই কথা কী পরষ্পর বিরোধী নয়? কোরআন-এর এত স্পষ্ট ঘোষার পরও কী হেফাজতে ইসলামের ২০১১ সালে নারী নীতি বিরোধী আন্দোলন ও পরে তাদের নারীর বিষয়ে দাবী সমূহ ও কর্মকাণ্ডকে ইসলামের অপব্যাখ্যা বলে মনে হয়? এ বিষয়ে আরো ধারণা পাবার জন্য কোরআনের নীচের আয়াতে কী বলা হয়েছে দেখিঃ
‘হে মু’মিনগণ! তোমরা যখন একে-অন্যের সহিত নির্ধারিত সময়ের জন্য ঋণের কারবার কর তখন উহা লিখিয়া রাখিও; তোমাদের মধ্যে কোন লেখক লিখিতে অস্বীকার করিবে না। যেহেতু আল্লাহ্ তাহাকে শিক্ষা দিয়াছেন, সুতরাং সে যেন লিখে; এবং ঋণগ্রহীতা যেন লিখার বিষয়বস্তু বলিয়া দেয় এবং তাহার প্রতিপালক আল্লাহকে ভয় করে, আর উহার কিছু যেন না কমায়; কিন্তু ঋণ-গ্রহীতা যদি নির্বোধ অথবা দুর্বল হয় অথবা লিখার বিষয়বস্তু বলিয়া দিতে না পারে তবে যেন তাহার অভিভাবক ন্যায্যভাবে লিখার বিষয়বস্তু বলিয়া দেয়। সাক্ষীদের মধ্যে যাহাদের উপর তোমরা রাযী তাহাদের মধ্যে দুইজন পুরুষ সাক্ষী রাখিবে, যদি দুইজন পুরুষ না থাকে তবে একজন পুরুষ ও দুইজন স্ত্রীলোক; স্ত্রীলোকদের মধ্যে একজন ভুল করিলে তাহাদের অপরজন স্মরণ করাইয়া দিবে। সাক্ষীগণকে যখন ডাকা হইবে তখন তাহারা যেন অস্বীকার না করে। ……… ‘ (২ সূরাঃ বাকারা, ২৮২)
আয়াতটিতে দেখি ঋণের কারবারের একটি চুক্তিতে একজন পুরুষে সমান দুইজন সাক্ষীর কথা বলা হয়েছে। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, বলা হয়েছে দুই জন পুরুষ সাক্ষী হতে পারবে, অথবা একজন পুরুষ ও অপর পুরুষের পরিবর্তে দুইজন নারী, কিন্তু দুই জন পুরুষের পরিবর্তে চার জন নারীর কথা বলা নাই। তার মানে সাক্ষ্যে কী কমপক্ষে এক জন পুরুষ লাগবে? কিন্তু নারী নীতি তো এমন ধারণার বিরোধিতা করে যেখানে নারীর অধিকার ও মর্যাদা পুরুষের চেয়ে কম। সুতরাং হেফাজত এই নারী নীতির বিরোধিতা করলে তা কোরআন অনুযায়ী দাবী করছে, এতে কোন সন্দেহ নাই।
ইসলাম ধর্মে নারীর উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের বর্ণনা দেওয়া হয়েছে একটি হাদীসে এভাবেঃ
’মাহমুদ ইবনে গায়লান …. হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হইতে বর্ণিত। নবী কারীম (সাঃ) ইরশাদ করিয়াছেন, যদি আমি কাহাকেও কাহারো জন্য সিজদা করার নির্দেশ দিতাম, তবে অবশ্যই স্ত্রীকে নির্দেশ দিতাম তাহার স্বামীকে সিজদা করার জন্য।’ (তিরমিযী শরীফ, হাদীস-১১৩৮)
যেখানে আধুনিক বিজ্ঞান বলছে নারী ও পুরুষের মধ্যে বুদ্ধি বা মেধাগত কোন পার্থক্য নাই সেখানে হাদীস মুসলিম শরীফ৬ নারীদের সম্পর্কে কী বলছে তা দেখা যাকঃ
‘সূত্রঃ- মুহাম্মদ ইবনে রুমহ, লাইছ, ইবনে হা’দ, আবদুল্লাহ ইবনে দিসার।
আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ (সঃ) নারীদিগকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন, হে মহিলাগণ তোমরা দান খয়রাত কর, এবং আল্লাহর নিকট বেশী বেশী ক্ষমা প্রার্থনা কর। কারণ আমি তোমাদের বেশীরভাগকে দোজখে দেখিয়াছি। অতঃপর একটি বুদ্ধিমতি ও সাহসীনি মহিলা বলিয়া উঠিল হুজুর! কারণ কি? আমাদের সংখ্যা বেশী কেন? হজরত উত্তর করেন, তোমরা (লা’নত) খুব বেশী করে থাক, এবং স্বামীর প্রতি অকৃতজ্ঞ হইয়া থাক, তোমাদের বুদ্ধি অপূর্ণ, ধর্ম অপূর্ণ হওয়ায় বুদ্ধিমান পুরুষের বুদ্ধি হরণের ব্যাপারে তোমাদের চাইতে বেশী কাহাকেও দেখি নাই। মহিলাটি বলিল, হে আল্লাহর রসুল! আমাদের বুদ্ধিও অপূর্ণ, ধর্মও অপূর্ণ সেইটা কেমন? হুজুর (সঃ) বলিলেন, তোমাদের বুদ্ধি অপূর্ণ, (তাহার প্রমাণ এই যে) কেননা দুইজন মহিলার সাক্ষ্য একজন পুরুষের সাক্ষ্যের সমান। বস্তুত ইহাই তোমাদের বুদ্ধির অপূর্ণতা। তোমরা প্রত্যেক মাসে কয়েকদিন নামাজ পড় না এবং রমজানেও এফতার করিতে হয়। ইহাই তোমাদের ধর্মের অপূর্ণতা।’ (মুসলিম শরীফ, হাদীস-১৪৯)
আহমদ শফী যেমন তাঁর বক্তৃতায় নারীদের তেঁতুলের সাথে তুলনা করে ঘরে থাকতে বলেছেন, তেমনি তাঁর সংগঠন হেফাজতে ইসলামের তের দফার চতুর্থ দফায় বলা হয়েছে, “ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ” বন্ধ করার জন্য। এই বক্তব্যে আছে পড়াশোনা, পেশাগত ও বিভিন্ন কাজে নারীর ঘরের বাইরে বের হওয়ার বিষয়ে স্পষ্ট বিরোধিতা। নারীর বিষয়ে হেফাজতের তের দফার চতুর্থ দফা, আহমদ শফীর বক্তব্য ও তাদের নারীনীতি বিরোধী আন্দোলন যে আল্লাহ ও তাঁর রসুলের নির্দেশের সাথে সম্পর্কিত তা আমরা আল্লাহর বাণী কোরআন ও তাঁর রসুল মোহাম্মদের বাণী হাদীসের সাহায্যে আরো বিস্তারিত নীচে দেখব।
ইসলামে নারীকে দেখা হয়েছে শয়তানের প্রতিরূপ হিসাবে। নীচের হাদীসসমূহে এবিষয়ে বলছেঃ
’মুহাম্মদ ইবনে বাশশার …. হযরত জাবির ইবনে আবদুল্লাহ (রাঃ) হইতে বর্ণিত। নবী কারীম (সাঃ) একবার এক মহিলাকে দেখিলেন। ফলে তিনি হযরত যায়নাব (রাঃ)-এর নিকট প্রবেশ করিয়া তাঁহার হাজত পূর্ণ করিলেন (সহবাস করিলেন) এবং বাহির হইয়া আসিলেন। আর বলিলেন, যখন কোন মহিলা সামনে আসে তখন সে শয়তানরূপে সামনে আসে। অতএব, যখন তোমাদের কেহ কোন মহিলা দেখিয়া, তাহার কাছে তাহাকে ভাল লাগে তবে যেন তাহার স্ত্রীর কাছে গমন করে। কারণ, তাহার সাথে তাই (সম্ভোগ উপকরণ) রহিয়াছে যাহা সেই মহিলার সাথে রহিয়াছে।’ (তিরমিযী শরীফ, হাদীস-১১৩৭)
’সূত্র- ইবনে আবি শায়বা – ইবনে ‘ওলাইয়া – (সূত্র পরিবর্তন) জুহাইর ইবনে হারব – ইবনে ইব্রাহিম- ইউনুস – হুমাইদ – ইবনে সামেত – আবু জর।
আবু জর (রাঃ) বলেন, রসুলুল্লাহ (সঃ) বলিয়াছেন, যখন তোমাদের কেহ নামাজের উদ্দেশ্যে দাঁড়াইবে, সে তাহার সম্মুখে হাওদার পেছনের কাঠটি পরিমাণ একটি কাঠ রাখিয়া দিবে, যদি ঐ রূপ কোন কাঠ বা অন্য কিছু রাখা না হয় এমতাবস্থায় তাহার সম্মুখ দিয়া গাধা, স্ত্রীলোক অথবা কাল কুকুর গমন করিলে তাহার নামাজ ভংগ হইয়া যাইবে। বর্ণনাকারী ইবনে সামেত বলেন, আমি বলিলাম, হে আবু জর, লাল কুকুর এবং হলুদ রংয়ের কুকুর হইতে কাল কুকুরকে পৃথক করিবার কারণটা কি? তিনি বলেন, হে আমার ভাতিজা, আমি তোমাদের মত এই বিষয়ে রসুলুল্লাহ (সঃ) এর নিকট জিঞ্জাসা করিয়াছিলাম, রসুলুল্লাহ (সঃ) বলিলেন, কাল কুকুর একটি শয়তান।’ (মুসলিম শরীফ৭, হাদীস-১০৩৩)
শফী তেঁতুলের সাথে তুলনা করে নারীদের অপমান করেছেন ঠিকই, কিন্তু অন্তত শয়তানের সাথে তুলনা করেন নাই। মোহাম্মদের বাণী হিসাবে পরিচিত হাদীস থেকে এই কথা উদ্ধৃত করলে হয়ত আজকের যুগের মানুষ তৎক্ষণাৎ তার প্রতিবাদ করে উঠবে। কাজেই শফীকে আজকের যুগ ও সাধারণ মানুষের চেতনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে ইসলামী সভাটিতে বক্তব্য রাখতে হয়েছে। অথচ কোরআন ও হাদীস থেকে আমরা জানি যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল যা বলেছেন তা প্রত্যেক মুসলমান নারী ও পুরুষের বিশ্বাস করা যেমন কর্তব্য তেমনি পালন করাও অবশ্য কর্তব্য। সেখান থেকে ব্যতিক্রম করার কোন সুযোগ নাই।
আজকের যুগে যখন নারীরা রাষ্ট্রপ্রধান হচ্ছে ও সফলভাবে দেশ পরিচালনা করছে, তখন একটি হাদীস বলছেঃ
’আবু বকরাহ্ (রাঃ) বলিয়াছেন, জামাল-যুদ্ধের সময়ে আমি অত্যন্ত উপকৃত হইয়াছি (হযরত রসুলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহে অসাল্লামের) একটি উক্তি দ্বারা। হযরত নবী (দঃ) যখন জানিতে পারিলেন, পারস্যবাসী তাহাদের পরলোকগত শাসনকর্তা কেছরার কন্যাকে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করিয়াছে তখন হযরত (দঃ) বলিয়াছিলেন –
……….. ঐ জাতির উন্নতি হইবে না যে জাতি তাহাদের শাসন-কার্য পরিচালনার ভার কোন নারীর উপর ন্যস্ত করিয়াছে।’ (বোখারী শরীফ৮, হাদীস-২৩৫৪)
যখন ইসলামের নবী নীচের কথাগুলো বলেন এবং যা প্রত্যেক মুসলমান পুরুষ ও নারীকে অবশ্যই বিশ্বাস ও পালন করতে বলা হয় তখন বুঝতে কী সমস্যা হয় যে, গত ৬ এপ্রিল হেফাজতের কর্মীরা যে মিছিল নিয়ে যাবার পথে নারীদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণ করেছিল তার উৎস কোথায়? নীচের হাদীস থেকে দেখিঃ
’হযরত ইমার ইবনুল খাত্তাব (রাঃ) নবী করীম (সঃ) হইতে বর্ণনা করিয়াছেন যে, কোন ব্যক্তিকে (দুনিয়াতে) তাহার স্ত্রীকে মারধর করিবার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হইবে না।’ (আবু দাউদ শরীফ৯, হাদীস-২১৪৪)
’মুহাম্মাদ ইবনে আবদুল আ’লা সানআনী (রহঃ)…. উসামা ইবনে যায়েদ ও সাঈদ ইবনে যায়েদ ইবনে আমর ইবনে নুফায়ল (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। নবী করীম (সাঃ) ইরশাদ করিয়াছেনঃ আমি আমার পর লোকদের মাঝে পুরুষদের জন্য মেয়েদের তুলনায় ক্ষতিকর আর কোন ফিতনা ছাড়িয়া যাইতেছি না।’ (তিরমিযী শরীফ, হাদীস-২৭৩১)
ইসলাম পূর্ব আরবে নারীরা ঘরের বাইরে স্বাধীন পেশা গ্রহণ করত। হাদীস ও অন্যান্য সূত্র থেকে সাহিত্য রচনা, ব্যবসা, কারুশিল্প, ইত্যাদি পেশার কথা জানা যায়। ইসলামের নবী মোহাম্মদের প্রথম স্ত্রী খাদিজাই এর এক বড় উদাহরণ। খাদিজা ব্যবসা পরিচালনা করতেন ও মোহাম্মদ তাঁর কর্মচারী ছিলেন। কিন্তু মোহাম্মদ ইসলাম প্রতিষ্ঠা করলে ও এর বিকাশ শুরু হলে ক্রমশ তিনি নারীদের গৃহের অবরোধের মধ্যে রাখতে উদ্যোগী হন।
শুধু হেফাজতে ইসলামের লক্ষ্য ও আদর্শের মধ্যেই নয়, ব্যতিক্রমহীনভাবে পৃথিবীর মুসলমান দেশগুলোতে নারীদের অবনত অবস্থা ও নারী নিগ্রহ এক স্বাভাবিক বিষয়।১০ উন্নত গণতান্ত্রিক বিশ্বে যেভাবে নারী নিগ্রহের খবর প্রকাশিত হয় ও তার বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত হয়, সমাজের ও রাষ্ট্রের কঠোর নিয়ন্ত্রণের ফলে এবং সমাজের ভিতরেই নারীদের হীন অবস্থার পক্ষে জনমানস থাকে বলে মুসলমান দেশগুলোতে নারী নিগ্রহের খবর সেভাবে প্রকাশ পায় না বা খবরগুলোকে চাপা দেওয়া হয়।
উপরের আলোচনায় আমরা দেখলাম হেফাজতে ইসলাম নারীদের প্রশ্নে যে অবস্থান নিয়েছে তা যেমন তার বক্তব্য ও দাবীর ক্ষেত্রে তেমনি বাস্তবে তার প্রয়োগের ক্ষেত্রেও মূল ইসলাম ধর্মের আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ। কোরআন ও হাদীস থেকে উপরের আলোচনা স্পষ্ট করেছে যে, হেফাজত কোনভাবেই ইসলামের অপব্যাখ্যা তো করছেই না বরং জামাত, বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মত ইসলাম নিয়ে তার ভন্ডামীপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যবসা নাই।
হেফাজত তার সপ্তম দফায় ‘মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা’-র দাবী জানিয়েছে । ছবি সম্পর্কে নীচের হাদীস কী বলছে দেখা যাক :
’আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করিয়াছেন যে, তিনি একটি গদি বা আসন ক্রয় করিয়া আনিয়া গৃহে রাখিলেন, উহাতে ছবি ছিল। হযরত রসুলুল্লাহ (সাঃ) গৃহের দরওয়াজায় পৌঁছিলেই তাঁহার দৃষ্টি উহার উপর পতিত হইল; তিনি গৃহে প্রবেশ করিলেন না, দরওয়াজায় দাঁড়াইয়া রহিলেন এবং ক্রোধে তাঁহার চেহার রং পরিবর্তিত হইতে লাগিল। আয়েশা (রাঃ) বলেন – আমি আরজ করিলাম, স্বীয় গোনাহ হইতে আল্লাহ তায়ালার দরবারে তওবা করিতেছি, আমার কসূর কি হইয়াছে? হযরত (সঃ) বলিলেন, এই গদিটি কেন? আমি আরজ করিলাম, আপনি উহার উপর বসিবেন এবং বিছানা রূপে ব্যবহার করিবেন এই উদ্দেশ্যে ক্রয় করিয়াছি। হযরত রসুলুল্লাহ (সঃ) বলিলেন,
তুমি কি জান না যে, (রহমতের) ফেরেশতাগণ ঐ ঘরে প্রবেশ করে না যেই ঘরে ছবি আছে এবং যে ব্যক্তি ছবি বানাইবে (আঁকিয়া বা যে কোন উপায়ে) তাহাকে কেয়ামতের দিন শাস্তি প্রদান করা হইবে এবং (তিরস্কার ও ধমক স্বরূপ) বলা হইবে, যেই আকৃতি তুমি বানাইয়াছ উহার মধ্যে জীবন দান করত দেখি!’ (বোখারী শরীফ১১, হাদীস-১৪১৫)
এ সম্পর্কে আরো হাদীসগুলো দেখা যাকঃ
’সালামা ইবনে শাবীব, হাসান ইবনে আলী খাল্লাল, আবদ ইবনে হুমাইদ (রহঃ) ও আরো অনেক… আবু তালহা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ)কে বলিতে শুনিয়াছি, যে ঘরে কুকুর এবং মূর্তির ছবি আছে সে ঘরে ফিরিশতা প্রবেশ করেন না।’ (তিরমিযী শরীফ, হাদীস-২৭৫৪)
’হযরত জাবির (রা) থেকে বর্ণিত যে, নবী (সাঃ) মক্কা বিজয়ের দিন, যখন তিনি ‘বাত্হা’ নামক স্থানে অবস্থান করছিলেন, তখন উমার ইবন খাত্তাব (রাঃ)-কে এ মর্মে নির্দেশ দেন যে, তুমি কা’বা ঘরে যাও এবং সেখানে যত ছবি আছে, তা সব মুছে ফেল। আর নবী (সাঃ) সেখানে ততক্ষণ প্রবেশ করেননি, যতক্ষণ না সেখানকার সব ছবি নিশ্চিহ্ণ করে ফেলা হয়।’ (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস-৪১১১)
আঁকা বা অন্য কোন উপায়ে যদি ছবি বানানো নিষিদ্ধ হয় তাহলে ফটো তোলা, টেলিভিশন চালানো নিষিদ্ধ করতে হয়। আজকের আধুনিক জীবন যাপন করাই অসম্ভব হয়ে পড়বে যদি সকল ছবি নিষিদ্ধ করা হয়। ফটো না তুললে পাসপোর্ট করে হজ করা সম্ভব হবে না এবং টেলিভিশন দেখে বিনোদন বন্ধ হয়ে যাবে।
অমুসলমানদের আবিষ্কৃত ভোগের উপকরণগুলো তাই মুসলমানরা ভোগ করে মোহাম্মদের নির্দেশ পালন না করেই, অথবা কখনো ঘৃণার সাথে। এই জায়গায় তারা নিরব থাকে পাছে সব বাদ দিতে গিয়ে সমগ্র ধর্মীয় ব্যবস্থাটাই না প্রশ্নের মুখোমুখি হয়ে পড়ে ও শেষে ভেংগে পড়ার আশংকা দেখা দেয়।
তবে মূর্তির ক্ষেত্রে ইসলামে কোন ছাড় নাই। মোহাম্মদের আল্লাহর একত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত ইসলামের প্রচার ও প্রসারে প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল বহুদেবতাবাদী পৌত্তলিকরা। মূর্তির ব্যবহার ছাড়া আধুনিক জীবন যাপন অনেকটা সম্ভব বলে এ বিষয়ে আজকের যুগের ইসলামী দেশগুলো কোন ছাড় দেয় নাই। কাজেই এ ক্ষেত্রে তারা ইসলামী নির্দেশ অনুযায়ী মূর্তি নির্মাণ ও স্থাপনের ঘোর বিরোধী। তবে প্রকাশ্য ও উন্মুক্ত স্থানের জন্য ছবি ও মূর্তি উভয়ই আজকের ইসলামী সমাজে নিষিদ্ধ করে রেখেছে।
হেফাজতের ভাস্কর্য বিরোধী দাবীর জবাবে আওয়ামী লীগ সরকারের নেতারা এবং বুদ্ধিজীবীরা বলেছিলেন অনেক মুসলমান দেশেই রাস্তায় এমন ভাস্কর্য আছে। হয় তাঁরা জানেন না অথবা জেনেও না জানার ভান করছেন যে, ইসলামে কঠোরভাবে মূর্তি নির্মাণ, প্রদর্শণ অথবা সংরক্ষণ নিষিদ্ধ। যে সব মুসলমান দেশে রাস্তার ধারে বা প্রকাশ্য স্থানে যেসব ভাস্কর্য আছে তা ইসলামের নির্দেশ অমান্য করেই যে রাখা হয়েছে তা আমরা উপরের আলোচনায় দেখেছি। সুতরাং মূর্তি বা ভাস্কর্য সম্পর্কে হেফাজত যা বলছে তাও ইসলাম ধর্মের অপব্যাখ্যা নয়।
আমরা নিশ্চয়ই ভুলে যাই নাই অল্প কয়েক বছর আগে তালেবানরা আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখল করলে হাজার হাজার বছরের প্রাচীন বৌদ্ধ ভাস্কর্যগুলো কীভাবে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন এসে যায় তালেবানরাও কী ইসলামের অপব্যাখ্যা করে এমন কাজ করছিল?
হেফাজতে ইসলাম ইসলামের অপব্যাখ্যা দিচ্ছে এমন দাবী যারা করছে তারা ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতা থেকেই করছে। এছাড়া সাধারণ যুক্তি দিয়েও বোঝা যায় যে, মাদ্রাসা ভিত্তিক সংগঠন হেফাজতের মত করে কেউই ইসলাম ধর্ম নিয়ে অধ্যয়ন করে না। মাদ্রাসা যেহেতু ইসলামী জ্ঞান অনুশীলনের স্থান সুতরাং এই জ্ঞানের সাথে যারাই সংশ্লিষ্ট, শিক্ষক হিসাবে জ্ঞান বিতরণ করে হোক অথবা ছাত্র হিসাবে এই জ্ঞান আহরণ করে হোক, তারা সবাই আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাথে কম পরিচিত থাকতে পারে কিন্তু তাদের ইসলাম ধর্ম বিষয়ে জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন তোলা যে নির্বুদ্ধিতার শামিল তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। বরং আমাদের দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষজন, বুদ্ধিজীবী ও কমিউনিস্টদের মাদ্রাসা শিক্ষা ও তার সাথে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অবজ্ঞা থাকার কারণে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে অধ্যয়ন না করেই হেফাজত বা অন্যান্য ইসলামপন্থী রাজনীতি সম্পর্কে মন্তব্য করে থাকে।
তিন : ইসলাম নিয়ে এদেশের বুদ্ধিজীবী ও কমিউনিস্টদের বিভ্রান্তি
ইসলাম নিয়ে এ দেশের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের সবচেয়ে বড় যে বিভ্রান্তি রয়েছে তা হল ইসলাম শান্তির ধর্ম। বিশেষভাবে হেফাজতে ইসলামের সাম্প্রতিক উত্থানের পর বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়েছে। ইসলাম আদৌ শান্তির ধর্ম কীনা এ বিষয়টি বোঝা এখানে প্রাসঙ্গিক এ কারণে যে, বাংলাদেশে হেফাজতে ইসলাম কিংবা তাদের মত আর কোন আদর্শিক ইসলামী সংগঠনের আগামী দিনের রাজনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া এতে সহজে বুঝা যাবে।
বলা হয়ে থাকে ইসলাম শব্দের অর্থ শান্তি। বাস্তবে এই ধর্মের প্রসার হয়েছে যুদ্ধের মাধ্যম্যে। ইসলামের নবী মোহাম্মদের জীবনকালে তাঁর পরিচালনায় অথবা নির্দেশে আরবের বহুদেবতাবাদী পৌত্তলিক ও ইহুদী গোত্র গুলোর উপর সামরিক হামলা চালিয়ে তাদের ’শান্তির ধর্ম’ ইসলাম গ্রহণে বাধ্য করতেন।১২ ইসলাম যে যুদ্ধ ও বল প্রয়োগের উপর কতখানি গুরুত্ব দিয়েছে তা কোরআনের অনেক আয়াত ও হাদীসের বহু বিবরণের মাধ্যমে তার সমর্থন পাওয়া যায়। নীচের অল্প কয়েকটি আয়াত থেকে আমরা দেখি :
’তোমাদের জন্য যুদ্ধের বিধান দেওয়া হইল যদিও তোমাদের জন্য ইহা অপ্রিয়; কিন্তু তোমরা যাহা পছন্দ কর না সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য কল্যাণকর এবং যাহা পছন্দ কর সম্ভবত তাহা তোমাদের জন্য অকল্যাণকর। আল্লাহ্ জানেন তোমরা জান না।’ (২ সূরাঃ বাকারা, ২১৬)
’অভিযানে বাহির হইয়া পড়, হালকা অবস্থায় হউক অথবা ভারি অবস্থায়, এবং সংগ্রাম কর আল্লাহর পথে তোমাদিগের সম্পদ ও জীবন দ্বারা। উহাই তোমদিগের জন্য শ্রেয়, যদি তোমরা জানিতে!’ (৯ সূরাঃ তাওবা, ৪১)
কোরআনের মত হাদীসেও আছে যুদ্ধাভিযানের সপক্ষে পরিষ্কার বক্তব্য :
’সাঈদ ইবনে ইয়াকুব…. হযরত আনাস ইবনে মালিক (রাঃ) সূত্রে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাঃ) ইরশাদ করিয়াছেনঃ আমি লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য আদিষ্ট হইয়াছি যতক্ষণ না তাহারা সাক্ষ্য দিবে যে, আল্লাহ ছাড়া কোন উপাস্য নাই, মুহাম্মাদ আল্লাহর বান্দা ও রাসুল এবং আমাদের কেবলামুখী হইয়া নামায পড়িবে, আমাদের জবাই করা পশুর গোশত খাইবে এবং আমাদের মত নামায আদায় করিবে। তাহারা এইগুলি করিলে তাহাদের জান ও মালে হস্তক্ষেপ করা আমাদের জন্য হারাম হইয়া যাইবে। কিন্তু ইসলামের অধিকারের বিষয়টি স্বতন্ত্র। মুসলমানদের যেইসব সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য তাহারাও সেইগুলি পাইবে এবং মুসলমানদের উপর যেইসব দায়দায়িত্ব তাহাদের উপরও অনুরূপ দায়দায়িত্ব বর্তাইবে।’ (তিরমিযী শরীফ, হাদীস-২৫৫৯)
কোরআন ও হাদীস থেকে আরও এরকম অসংখ্য উদ্ধৃতি দেওয়া যায় যেখানে যুদ্ধ করতে নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে অথবা যুদ্ধকে আদর্শায়িত করা হচ্ছে। মোহাম্মদের সময় থেকে আধুনিক যুগে ইসলামী সাম্রাজ্যের প্রসারে যুদ্ধ একটি প্রধান ভূমিকা পালন করেছে। এর ফলে আজকের যুগেও যারাই ইসলামী শিক্ষা ও জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে ইসলামের মূল আদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে তারাই জিহাদ বা যুদ্ধকে ইসলাম প্রতিষ্ঠার হাতিয়ার হিসাবে নৈতিকভাবে গ্রহণ করছে। আর ইসলাম এমন একটি ধর্ম যার কিছুমাত্র পরিবর্তন বা আংশিক অনুশীলন গ্রহণযোগ্য নয়। সুতরাং ‘মডারেট’ বা মধ্যপন্থী ইসলাম বলে ইসলামের একটি সহনশীল রূপ দেবার ও আধুনিক সভ্য সমাজের সাথে খাপ খাওয়ানোর যে চেষ্টা চলছে প্রকৃতপক্ষে ইসলামের মৌল আদর্শের সাথে তা খাপ খায় না। কারণ আমরা আগেই দেখেছি আল্লাহ্ ও তাঁর রসূল মোহাম্মদের নির্দেশের বাইরে কোন কিছু করলে সেটা আর ইসলাম সম্মত হয় না।
উপরের আলোচনা থেকে আমরা দেখতে পেয়েছি, ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসার যেমন যুদ্ধ ও আক্রমণাভিযানের মধ্য দিয়ে হয়েছে তেমনি তার মৌল আদর্শও যুদ্ধ ও সহিংসতাকে অনুমোদন দেয়। এর ফলে ইসলাম ধর্মকে শান্তির ধর্ম বলে যারা প্রচার করেন বা বিশ্বাস করেন তারা হয় ইসলাম সম্পর্কে জানেন না অথবা সত্যকে বুঝতে পারেন না। আজকে পৃথিবীর দেশে দেশে আদর্শিক ইসলামী দলগুলো জিহাদ বা ধর্ম যুদ্ধকে অবলম্বন করতে চাওয়ার পিছনেও যে ধর্মের পরিষ্কার নির্দেশ রয়েছে সেটাও তারা বুঝতে চান না। আমাদের দেশের শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণী, বুদ্ধিজীবী ও কমিউনিস্টরা প্রায় সকলেই এই বিভ্রান্তিতে ভোগেন। এর ক্ষতিকর দিক হল যে না বুঝার ফলে ইসলামী সমাজে সমাজ পরিবর্তন বা বিপ্লব সম্পাদন করার বাধাকে সঠিকভাবে বুঝা ও তাকে মোকাবিলা করার পদ্ধতি তারা নির্ধারণ করতে এ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছেন। মুসলমান দেশগুলোর মধ্যপন্থী শাসকরাও সমস্যাটিকে ধরতে না পারার ফলে আদর্শিক ইসলামী শক্তিকে, যাকে তারা জঙ্গীবাদী ইসলামী দল বলছেন, তাদের মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হচ্ছেন।
আমাদের মত ইসলামী সমাজে যে ইসলামের অনেক নির্দেশ পালন করা হয় না তার প্রধান কারণ এ দেশে কখনই আদর্শিক ইসলাম সেভাবে দৃঢ় ভিত্তি পায় নাই। সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ইসলাম চর্চা ও প্রভাব বৃদ্ধির কারণে ইসলামের মৌল বিষয়গুলো সমাজে ও রাষ্ট্রে পালনের জন্য জনমত বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে আজকে আমাদের দেশে যতটা সম্ভব মৌল ও আদর্শিক ইসলাম প্রতিষ্ঠা করার জন্য হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরির, আনসারউল্লাহ্ বাংলা টিম ও হেফাজতে ইসলামের মত সংগঠনগুলো দাঁড়িয়ে গেছে ও ক্রমশ তাদের শক্তিবৃদ্ধি হচ্ছে।
ইসলামকে মূল্যায়ন করতে গিয়ে একথা আমাদের মনে রাখা দরকার যে ইসলামে ধর্মীয়, সামরিক ও রাজনৈতিক কেন্দ্র এক জায়গায়।১৩ মোহাম্মদ নিজে ধর্ম প্রচার করতেন, সেনাবাহিনী পরিচালনা করতেন এবং একই সাথে তাঁর নবগঠিত রাষ্ট্রেরও প্রধান ছিলেন। অর্থাৎ ইসলাম রাষ্ট্রধর্ম হিসাবেই প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। পরবর্তীকালে ইসলাম পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগে প্রসার লাভ করলেও তার প্রধান চরিত্র অর্থাৎ তার রাষ্ট্রধর্মের রূপ অপরিবর্তিত থেকেছে। সুতরাং জন সমাজে ইসলামী চেতনা দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত হলে এক সময়ে তা রাষ্ট্রকে অধিকার করে তার স্বাভাবিক রূপ রাষ্ট্রধর্ম প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সুতরাং যারা মনে করছেন যে ব্যক্তিগত পর্যায়ে ইসলামকে রক্ষা করবেন বাস্তবে তা কখনই সম্ভব নয়। ইসলাম তার চিরন্তন নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রকে অধিকার করতে চাইবে। আমাদের দেশে এই জন্যই ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার দাবী নিয়ে আদর্শিক ইসলামী দলগুলো ক্রমশ বৃদ্ধিশীল জনমত নিয়েই দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে আসছে। দীর্ঘকাল থেকে বিভিন্ন সরকার দমন করতে চেষ্টা করছে হরকাতুল জিহাদ, হিজবুত তাহরির এবং সাম্প্রতিক আনসারউল্লাহ্ বাংলা টিম-এর মত এই আদর্শিক ইসলামী দলগুলোকে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে ব্যাপক ধরপাকড় ও শাস্তির পর এসব সংগঠন এক সময় দমন হলেও পরবর্তীকালে নূতন নাম নিয়ে ও নূতন শক্তি নিয়ে আত্মপ্রকাশ করছে।
শুধু আমাদের দেশেই নয় পৃথিবীর সব মুসলমান দেশে যেখানে শাসকশ্রেণী মৌল ইসলামী আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়ে তুলনামূলকভাবে আধুনিক, সভ্য ও গণতান্ত্রিক সমাজ নির্মাণ করতে চেয়েছে সেখানে প্রতিটি দেশেই ক্রমবর্ধমান ইসলামী শক্তির চাপ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এর মধ্যে এক সময়ের ধর্ম নিরপেক্ষ বা ‘সেক্যুলার’ আদর্শের দেশ কামাল আতাতুর্কের তুরস্ক, নাসেরের মিসর এবং সিরিয়া, ইরাক, আলজেরিয়া সহ সকল দেশেই আজ মৌল ইসলামী আদর্শিক শক্তি অত্যন্ত ক্ষমতাধর, কোথায়ও তারা ইতিমধ্যেই ক্ষমতা দখল করেছে, যেমন তুরস্কে। মিসরে কিছুদিন আগেও ইসলামী আদর্শিক দল ইসলামী ব্রাদারহুডের নেতা মুরসি শাসন ক্ষমতায় ছিলেন, যিনি ঘোষণা করেছিলেন যে ইসলামী শরীয়া আইন প্রতিষ্ঠা করবেন। সিরিয়ায় যে গৃহযুদ্ধ চলছে তাতে বিরোধীদের গুরুত্বপূর্ণ অংশই ইসলামপন্থী।
আজকে বুদ্ধিজীবীদের অনেকেই এদেশে ইসলামকে তিরিশ, চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছর আগের তুলনামূক সহনশীল ও মধ্যপন্থার রূপে দেখতে চান। তারা ইসলামকে এভাবেই দেখতে চান যেভাবে তারা তাদের শৈশবের স্মৃতিতে গেঁথে থাকা ‘মডারেট’ বা মধ্যপন্থী ইসলামকে দেখেছেন। তাঁদের স্মৃতিতে ধরে রাখা এদেশে এক সময়ের ইসলাম ধর্মের চর্চা তাঁদের চেতনায় দোলা দেয়। ভোর বেলা মায়ের সূর করে কোরআন পড়া, ছোটবেলার মত করে ঈদ উৎসব পালন করা, বড় জোর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়া, ইত্যাদির মধ্যে ইসলামকে সীমাবদ্ধ দেখতে চান। এর বাইরে তারা জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ইসলামের আদর্শের প্রয়োগকে এড়িয়ে যান বা ভয় পান। কিন্তু তাদের এই ইসলাম ইসলামের মূল আদর্শের সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। যেহেতু তা খন্ডিত ইসলাম, কাজেই তা প্রকৃত বা আদর্শিক ইসলাম থেকে অনেক দূরে। ইসলাম সম্পর্কে প্রকৃত ধারণা না থাকায় তাঁরা মনে করছেন তাঁদেরটাই সঠিক ইসলাম, ও প্রকৃত ইসলামপন্থীদের মনে করেন ইসলামের অপব্যাখ্যাকারী। এই ভ্রান্ত ধারণা থেকে তাঁরা প্রকৃত ও আদর্শিক ইসলামপন্থীদের বিরোধিতা করেন।
ইসলামী সমাজে ধর্মকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা সম্ভব নয়। সমাজের জনগণ মুসলমান হলে যেহেতু তাদের মধ্যে ইসলাম চর্চা থাকবে, এই ইসলাম চর্চাই ক্রমশ তাদেরকে জীবনের সর্বক্ষেত্রে ইসলামের অনুশাসন সমূহের প্রয়োগ ও রাষ্ট্রের ইসলামীকরণের দিকে নিয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে আমাদের দেশে যে সব বুদ্ধিজীবী ও কমিউনিস্ট মধ্যপন্থী ও সুবিধাবাদী মুসলমান সেজে ইসলামের মূল আদর্শের প্রয়োগের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করছেন তারা কোনভাবেই ক্ষমা পাবেন না হেফাজত, জামায়াত বা অন্যান্য ইসলাম পন্থী দলগুলোর আক্রোশ ও আক্রমণ থেকে। ইতিমধ্যেই এর কিছু পরিমাণ লক্ষণও দেখা গেছে ঢাকার শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে আন্দোলন শুরু হবার পর।
তবে বাংলাদেশে ভবিষ্যতে ইসলামপন্থীদের আক্রমণ ও আক্রোশের শিকার হবার প্রবল সম্ভাবনা আওয়ামী লীগ ও ছাত্র লীগের নেতা কর্মীদেরও। ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতা পালনের বিচারে আওয়ামী লীগ তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি-র চেয়েও বেশী ইসলাম পন্থী। কিন্তু ১৯৭১ সালে হিন্দু ভারতের সাহায্য নিয়ে মুসলমান পাকিস্তান ভাংগার জন্য এদেশের ইসলামী শক্তি কোন দিনই শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগকে মেনে নেয় নাই। এদেশে ইসলামী শক্তিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন শেখ মুজিব ’৭১ সালে স্বাধীনতার পর। কিন্তু সেই ইসলামী শক্তিই আওয়ামী লীগের বড় শত্রু। সুতরাং এমন সম্ভাবনা প্রবল যে হেফাজতের মত মৌলিক ইসলামী দল তার শক্তিকে একবার অবমুক্ত করতে পারলে যে বৃহৎ আকারের প্রতিহিংসা ও আক্রোশের প্রকাশ ঘটাবে তা এদেশে বড় ধরণের রক্তপাতের দিকে নিয়ে যেতে পারে। ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাব মুসলমান দেশগুলোতে এমন ঘটনা অতীতে ঘটেছে - ইরানে, আফগানিস্তানে এবং সবচেয়ে নির্মমভাবে ইন্দোনেশিয়ায়।
১৯৪১ সালে প্রতিষ্ঠিত হবার পর ইরানের কমিউনিস্ট দল তুদেহ পার্টি মোটামুটি শক্তিশালী হয়ে উঠে। বিশেষভাবে মোহাম্মদ মোসাদ্দেকের সময়ে ব্রিটিশ-ইরানীয় মালিকানায় থাকা তেল কোম্পানী সমূহের জাতীয়করণের প্রশ্নে তাঁর প্রচারণায় এবং তাঁর প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন। ১৯৫৩ সালে মোসাদ্দেকের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান হলে তুদেহ পার্টির বিপর্যয় ঘটে, যদিও পার্টি তার পরেও টিকে ছিল। ১৯৭৯ সালে খোমেনীর নেতৃত্বে ইসলামপন্থীরা ক্ষমতায় আসে। ১৯৮১ সালে ইসলামী রিপাবলিকান পার্টি প্রভাবিত মজলিস উদারপন্থী প্রেসিডেন্ট বনি সদরকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। এর ফলে দেশব্যাপী প্রবল গণআন্দোলন শুরু হয়। পাসদারান নামে পরিচিত খোমেনির প্রতি অনুগত সশস্ত্র বিপ্লবী কমিটিসমূহ জাতীয়তাবাদী ও বামপন্থী উভয় গোষ্ঠীর বহু হাজার তরুণ ও সক্রিয় কর্মীদের গ্রেফতার করে যাদের অনেককেই পরে বিচারের পর মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। যদিও বিভিন্ন বামপন্থী দল ইসলামপন্থীদের বিরোধিতা করেছিল, তুদেহ্ পার্টি নেতৃত্ব ইসলামপন্থী সরকারকে সমর্থন করার কৌশল গ্রহণ করে। ১৯৮২ সালে তুদেহ্ পার্টির এই কৌশল ব্যর্থ প্রমাণিত হয়, ইসলামী সরকার তাদের পত্রিকা বন্ধ করে দেয় ও সরকারী মন্ত্রণালয়সমূহ থেকে তাদের সদস্যদের অপসারণের মাধ্যমে শুদ্ধি অভিযান পরিচালনা করে। এই কমিউনিস্ট পার্টিকে ১৯৮২ সালে নিষিদ্ধ করা হয় ও ব্যাপক গ্রেফতার অভিযান পরিচালনা করা হয়। সরকার তাদের পাঁচ হাজারেরও বেশী সদস্য ও সমর্থককে গ্রেফতার করে ও কারাগারে অন্তরীণ রাখে। ১৯৮৩ থেকে ১৯৮৪ পর্যন্ত তুদেহ্ পার্টির নেতৃত্বকে নির্যাতনের মাধ্যমে স্বীকার করতে বাধ্য করা হয় যে, তারা “ষড়যন্ত্র”, “অন্তর্ঘাত” ও “রাষ্ট্রদ্রোহিতা”–র মত অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিল। এছাড়াও ইসলামের প্রশংসা ও মার্ক্সবাদ-লেনিনবাদের উপর ইসলামের শ্রেষ্ঠত্বকে ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়। এই সবকিছুই সরকার বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে প্রচার করতে থাকে। তবে ইরানে ইসলামপন্থীদের দ্বারা প্রগতিশীল ও বামপন্থীদের উপর সবচেয়ে ভয়ানক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞ পরিচালনা করা হয় ১৯৮৮ সালে। সমগ্র ইরানব্যাপী রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত কারাগারে আটক রাজবন্দীদের এই হত্যাযজ্ঞ পাঁচ মাসব্যাপী স্থায়ী ছিল। যারা ছিল ইরানের পিপলস্ মুজাহেদীন (ইরানের বামপন্থী বিপ্লবী দল), ফেদাইন ও তুদেহ পার্টি সহ অন্যান্য বামপন্থী দলের সমর্থক। অ্যামেনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল কর্তৃক সংগৃহীত নামের তালিকা থেকে জানা যায় সে সময় ৪,৪৮২ জন জেলখানাগুলো থেকে নিখোঁজ হয়েছিল। ইরানী বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর তথ্য মতে ৩০,০০০ মানুষ জেলহত্যার শিকার হয়েছিল। ইরানে এরপরেও বামপন্থী ও প্রগতিশীলদের উপর হত্যাকান্ড থেমে থাকে নাই। ইরানীয় বুদ্ধিজীবীরা যাঁরা ইরানের ইসলামপন্থী শাসনের সমালোচক ছিলেন তাঁদের ধারাবাহিকভাবে হত্যা ও গুম করা হতে থাকে ১৯৮৮ সাল থেকে ১৯৯৮ সাল পর্যন্ত। লেখক, অনুবাদক, কবি, রাজনৈতিক কর্মী, ও সাধারণ নাগরিকদের বিভিন্ন কৌশলে হত্যা করা হতে থাকে। এভাবে দীর্ঘকালব্যাপী লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যার মধ্য দিয়ে ইরানে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা আজ দৃঢ় ভিত্তির উপর টিকে আছে।
প্রগতিশীল ও বামদের জন্য আফগানিস্তানের ইতিহাসেও কাছাকাছি ধরনের গণহত্যার অভিজ্ঞতা দেখতে পাওয়া যায়। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সোভিয়েত সেনাবাহিনী আফগানিস্তানে প্রবেশ করে এর নিয়ন্ত্রণে নিলে ইসলামপন্থী আফগান মুজাহিদীন আমেরিকার সাহায্য নিয়ে সোভিয়েত সেনাবাহিনী ও আফগান সরকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত রেড আর্মি প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্ট নাজিবুল্লাহর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এর অল্পদিন পর মুজাহিদীন গোষ্ঠী কাবুল দখল করে নেয় ও বুরহানউদ্দিন রাব্বানিকে এই ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করে। মুজাহিদীনরা ক্ষমতা দখল করেই ব্যাপক গণহত্যা চালায়, বিশেষভাবে কাবুলে ও অন্যান্য শহরগুলোতে যেখানে প্রগতিশীল ও বামদের সংখ্যাধিক্য ছিল। তারা শুধু কাবুলেই দশ হাজার লোক হত্যা করে। ধারণা করা হয় যে, হেকমতিয়ারের হেযব্-ই ইসলামী ও আবদুর রশিদ দোস্তামের জুনবিশ-ই মিলির মিলিত ব্যাপক বোমা বর্ষণের সময়ে ২৫,০০০ মানুষ মারা গিয়েছিল। পাঁচ লক্ষ মানুষকে আফগানিস্তান ছেড়ে উদ্বাস্তু হতে হয়েছিল। এই অরাজকতাপূর্ণ সময়ে ১৯৯৪ সালের শেষের দিকে আফগানিস্তানের দক্ষিণাংশে কান্দাহারে আরও উগ্র ইসলামপন্থী দল তালেবানের উত্থান ঘটে। তারা আদর্শিক ইসলামের ঘোষণা দিয়ে মুজাহিদীনদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে। পাকিস্তানের সামরিক ও অন্যান্য সহযোগিতা ও সৌদী আরবের আর্থিক সাহায্যে শক্তি সঞ্চয় করে ক্রমশ তারা আফগানিস্তানের বিরাট অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিতে থাকে। ১৯৯৫ সালের প্রথম দিকে তারা কাবুলের আবাসিক এলাকায় ব্যাপক বোমা বর্ষণ করে। এবং শেষে ১৯৯৬ সালে কাবুল দখল করে। তারা ক্ষমতায় এসেই ইসলামের মৌলিক আদর্শ সমূহ প্রতিষ্ঠা করার কাজে হাত দেয়। এর অংশ হিসাবে তারা প্রথমেই নারীদের গৃহে অবরুদ্ধ করে, বোরখা বাধ্যতামূলক করে, গৃহের জানালা বন্ধ রাখতে বাধ্য করা হয় যাতে তাদের দেখতে পাওয়া না যায়। এছাড়াও নারীদের জোরে হাসা নিষিদ্ধ করা হয় যাতে তা অন্যরা শুনতে না পারে। তারা অন্যান্য ইসলামী শরিয়তের আইনসমূহ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হয়, যেমন চুরির জন্য হাত কর্তন করা। তালেবানদের দল রাস্তায় ঘুরে বেড়াত এবং কোথায়ও কোন ইসলাম বিরোধী কিছু দেখলে সাথে সাথে সংশ্লিষ্টদের নির্মমভাবে প্রহার করত। তারা ইসলামের নির্দেশ অনুযায়ী মূর্তির বিরুদ্ধে অভিযানে নামে ও আফগানিস্তানের প্রাচীন বৌদ্ধ যুগের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ ধ্বংস করতে থাকে। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার নিউইয়র্ক ও পেন্টাগনে আত্মঘাতী হামলার কিছুদিন পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্রদের বিমান হামলায় তালেবানদের পতন ঘটে।
ইরান বা আফগানিস্তানের বাম ও প্রগতিশীলদের গণহত্যার চেয়েও আরো ভয়াবহ ছিল ইন্দোনেশিয়ার গণহত্যা। জনসংখ্যার দিক দিয়ে পৃথিবীর বৃহত্তম মুসলমান দেশ ইন্দোনেশিয়ায় ষাটের দশকের প্রথম দিকে কমিউনিস্ট পার্টি পিকেআই ছিল তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের পর পৃথিবীর মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। কৃষকদের মধ্যে তাদের ছিল মজবুত সাংগঠনিক কাঠামো। পঁয়ত্রিশ লক্ষ ছিল তাদের সদস্য সংখ্যা। সেনাবাহিনী ও প্রশাসনেও তাদের অনুগামী ছিল। তবে সেনাবাহিনীর জেনারেলরা ছিল কমিউনিস্ট বিরোধী। সেসময় মূলত জাতীয়তাবাদী কিন্তু কমুনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল সুকর্ণ ছিলেন দেশের শাসক। শুধু তাই নয় তিনি ছিলেন ব্রিটেন ও আমেরিকা বিরোধী। পর-রাষ্ট্রনীতিতে চীন ও সোভিয়েতের সাথে সম্পর্ক প্রাধান্যে ছিল। ১৯৬৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর রাতে কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি অনুগত সেনাবাহিনীর কিছু উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তা ছয় জন জেনারেলকে হত্যা করে একটি অভ্যুত্থান ঘটায়।১৪ কিন্তু পর্যাপ্ত পূর্বপ্রস্তুতি ও অন্যান্য কারণে এই অভ্যুত্থান ব্যর্থ হয়। পরের দিন ১ অক্টোবর সন্ধ্যা থেকে পরিস্থিতি জেনারেলরা নিজেদের পক্ষে আনতে শুরু করে ও ২ অক্টোবর থেকে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। এর অল্প কিছু দিন পরে সেনাবাহিনীর মদদে শুরু হয় এক ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ। শুরুর দিকে সেনাবাহিনী কমিউনিস্ট বিরোধী তরুণদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে কমিউনিস্টদের হত্যা করতে পাঠায়। জেনারেলদের হত্যার পূর্বে নির্যাতন ও পরে অঙ্গহানী করা হয়েছে এমন ঘটনা সেনাবাহিনী পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক প্রচার করলে কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে পুরো সামরিক বাহিনী ও জনগণের মনোভাব প্রবল আকার ধারণ করে। এই মনোভাবকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্ট বিরোধী ইন্দোনেশীয় সেনাবাহিনী জাতীয়তাবাদী, ইসলামী সংগঠন ও অন্যান্যদের প্ররোচিত করে কমিউনিস্টদের হত্যা করার জন্য। এছাড়া কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে আল্লাহয় অবিশ্বাস বা নাস্তিকতার প্রচারণাও তারা কাজে লাগিয়েছিল। সমস্ত ইন্দোনেশিয়ায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে এই ভয়ংকর ও নির্মম গণহত্যা। শুধু কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য নয়, যারা তাদের সমর্থন করত বা যারা তাদের সমর্থন করত বলে সন্দেহ করা হত তাদের সকলকে হত্যা করা হয়েছিল। এই সব হত্যাকাণ্ডে যেমন সমস্ত গ্রামের মানুষ অংশগ্রহণ করেছিল তেমনি তারা অসংখ্য গ্রামকেও হত্যা করে নিশ্চিহ্ণ করেছিল। ১৯৬৫ সালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাস ব্যাপী এই কমিউনিস্ট নিধন যজ্ঞে প্রায় পাঁচ লক্ষ মানুষকে নিশ্চিহ্ণ করে ফেলা হয়১৫। ইন্দোনেশিয়ার সংখ্যাগরিষ্ট জনগোষ্ঠী মুসলমান হওয়ায় ধারণা করা যায় যে, তাদের ইসলামপন্থী চেতনাকে সেনাবাহিনীর পক্ষে কাজে লাগানো সহজ হয়েছিল।
এটি একটি কৌতুহলোদ্দীপক বিষয় যে, পৃথিবীর সব দেশেই যেখানে সমাজের প্রগতিশীল ও কমিউনিস্টদের নির্যাতন ও হত্যা অভিযান পরিচালনা করা হয়েছে সব জায়গাতেই তাদের প্রতি একটি সাধারণ অভিযোগ ইসলামপন্থীরা করেছে, তা হল আল্লাহর বা ইসলামের প্রতি অবিশ্বাস অর্থাৎ তথাকথিত নাস্তিকতার অভিযোগ। বাংলাদেশে যেমন হেফাজতসহ ইসলামপন্থীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনরতদের ও প্রগতিশীলদের বিরুদ্ধে একইভাবে নাস্তিকতার অভিযোগ করেছে। হেফাজতের তের দফায়ও একই সূর দেখতে পাওয়া যায়। তারা তের দফার দ্বিতীয় দফায় বলছে, “আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস”-এর দাবী। এর তৃতীয় দফায়ও একই সূর, যেখানে বলছে “কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয়নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা”-র দাবী।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসতে পারে যে, ইসলামী সমাজের ভিতরেই যারা ধর্মীয় পরিচয়ে মুসলমান থেকেই ইসলামকে সমাজে ও রাষ্ট্রে সীমিত ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ রাখতে চায় সেই সব আধুনিকতাপন্থী, প্রগতিশীল ও কমিউনিস্টদের প্রতি ইসলামের মৌলিক বিধান ও রীতি-নীতি সমূহের প্রতি দৃঢ় অংগীকারাবদ্ধ ও আদর্শিক ইসলামপন্থীরা সকল ইসলামী সমাজেই অসহিষ্ণু, ভয়ংকর আক্রমনাত্মক ও হিংস্র কেন। প্রকৃতপক্ষে ইসলাম তার সমাজ কাঠামোর মধ্যে কোন ভিন্ন মত অনুমোদন করে না, এমন কী সেটা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাস ও রীতি-নীতি গ্রহণ করে হলেও। তাই ভিন্ন মত পোষণকারী ইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মত্যাগকারী। আর ইসলামী বিধান মতে ধর্মত্যাগকারীর একমাত্র শাস্তি মৃত্যুদন্ড। কোরআনের নীচের আয়াত সমূহে ধর্মত্যাগকারীদের সম্পর্কে বলছেঃ
’৮৬। ঈমান আনয়নের পর ও রাসূলকে সত্য বলিয়া সাক্ষ্যদান করিবার পর এবং তাহাদের নিকট স্পষ্ট নিদর্শন আসিবার পর যে সম্প্রদায় সত্য প্রত্যাখ্যান করে উহাকে আল্লাহ্ কিরূপে সৎপথে পরিচালিত করিবেন? আল্লাহ্ জালিম সম্প্রদায়কে সৎপথে পরিচালিত করেন না।
৮৭। ইহারাই তাহারা যাহাদের কর্মফল যে, তাহাদের উপর আল্লাহ্, ফিরিশতাগণ এবং মানুষ সকলেরই লানত।
৮৮। তাহারা ইহাতে স্থায়ী হইবে, তাহাদের শাস্তি লঘু করা হইবে না এবং তাহাদিগকে বিরামও দেওয়া হইবে না।
৮৯। তবে ইহার পর যাহারা তওবা করে ও নিজদিগকে সংশোধন করিয়া লয় তাহারা ব্যতিরেকে। আল্লাহ্ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
৯০। ঈমান আনার পর যাহারা সত্য প্রত্যাখ্যান করে এবং যাহাদের সত্য প্রত্যাখ্যান-প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পাইতে থাকে তাহাদের তওবা কখনও কবুল হইবে না। ইহারাই পথভ্রষ্ট।
৯১। যাহারা কুফরী করে এবং কাফিররূপে যাহাদের মৃত্যু ঘটে তাহাদের কাহারও নিকট হইতে পৃথিবী-পূর্ণ স্বর্ণ বিনিময়-স্বরূপ প্রদান করিলেও তাহা কখনও কবূল হইবে না। ইহারাই তাহারা যাহাদের জন্য মর্মন্তুদ শাস্তি রহিয়াছে; ইহাদের কোন সাহায্যকারী নাই।’ (৩ সূরাঃ আল’ইমরান)
‘১৩৭। যাহারা ঈমান আনে ও কুফরী করে এবং আবার ঈমান আনে, আবার কুফরী করে, অতঃপর তাহাদের কুফরী প্রবৃত্তি বৃদ্ধি পায়, আল্লাহ্ তাহাদিগকে কিছুতেই ক্ষমা করিবেন না এবং তাহাদিগকে কোন পথে পরিচালিত করিবেন না।’ (৪ সূরাঃ নিসা)
আল্লাহ্ ও তার রসূলের বিরুদ্ধাচরণকারী শাস্তি সম্পর্কে কোরআনে বলা হচ্ছেঃ
’৩৩। যাহারা আল্লাহ্ ও তাঁহার রাসূলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কার্য করিয়া বেড়ায় তাহাদের শাস্তি এই যে, তাহাদিগকে হত্যা করা হইবে অথবা ক্রুশবিদ্ধ করা হইবে অথবা বিপরীত দিক হইতে তাহাদের হাত ও পা কাটিয়া ফেলা হইবে অথবা তাহাদিগকে দেশ হইতে নির্বাসিত করা হইবে। দুনিয়ায় ইহাই তাহাদের লাঞ্ছনা ও পরকালে তাহাদের জন্য মহাশাস্তি রহিয়াছে।’ (৫ সূরাঃ মায়িদা)
নীচের হাদীস বোখারী শরীফে১৬ ধর্মত্যাগীদের শাস্তি সম্পর্কে বলা হচ্ছেঃ
’আবূ নু’মান মুহাম্মদ ইবন ফায্ল (র)……. ইকরামা (র) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আলী (রা)-এর নিকট একদল যিন্দীককে (নাস্তিক ও ধর্মদ্রোহী) আনা হল। তিনি তাদেরকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিলেন। এ ঘটনা ইবন আব্বাস (রা)-এর কাছে পৌঁছলে তিনি বললেন, আমি হলে কিন্তু তাদেরকে পুড়িয়ে ফেলতাম না। কেননা, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নিষেধাজ্ঞা রয়েছে যে, তোমরা আল্লাহর শাস্তি দ্বারা শাস্তি দিও না। বরং আমি তাদেরকে হত্যা করতাম। কেননা, রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর নির্দেশ রয়েছে, যে কেউ তার দীন বদলে ফেলে তাকে তোমরা হত্যা কর।’ (বুখারী শরীফ, হাদীস-৬৩৪১)
’মুসাদ্দাদ (র) ….. আবূ মূসা (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর কাছে এলাম। আমার সাথে আশআরী গোত্রের দু’ব্যক্তি ছিল। একজন আমার ডানদিকে, অপরজন আমার বামদিকে। আর রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তখন মিসওয়াক করছিলেন। উভয়েই তাঁর কাছে আবদার জানাল। তখন তিনি বললেনঃ হে আবূ মূসা! অথবা বললেন, হে আবদুল্লাহ্ ইবন কায়স! রাবী বলেন, আমি বললামঃ ঐ সত্তার কসম! যিনি আপনাকে সত্য দীনসহ পাঠিয়েছেন, তারা তাদের অন্তরে কি আছে তা আমাকে জানায়নি এবং তারা যে চাকরি প্রর্থনা করবে তা আমি বুঝতে পারিনি। আমি যেন তখন তাঁর ঠোঁটের নিচে মিসওয়াকের প্রতি লক্ষ্য করছিলাম যে তা এক কোণে সরে গেছে। তখন তিনি বললেন, আমরা আমাদের কাজে এমন কাউকে নিয়োগ দিব না বা দেই না যে নিজেই তা চায়। বরং হে আবূ মূসা! অথবা বললেন, হে আবদুল্লাহ্ ইবন কায়স! তুমি ইয়ামনে যাও। এরপর তিনি তার পেছনে মু’আয ইবন জাবাল (রা)-কে পাঠালেন। যখন তিনি তথায় পৌঁছলেন, তখন আবূ মূসা (রা) তার জন্য একটি গদি বিছালেন। আর বললেন, নেমে আসুন। ঘটনাক্রমে তার কাছে একজন লোক শৃঙ্খলাবদ্ধ ছিল। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, ঐ লোকটি কে? আবূ মূসা (রা) বললেন, সে প্রথমে ইহুদী ছিল এবং মুসলমান হয়েছিল। কিন্তু পুনরায় সে ইহুদী হয়ে গিয়েছে। আবূ মূসা (রা) বললেন, বসুন। মু’আয (রা) বললেন, না, বসব না, যতক্ষণ না তাকে হত্যা করা হবে। এটাই আল্লাহ্ ও তাঁর রাসূলের ফায়সালা। কথাটি তিনি তিনবার বললেন। এরপর তার সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হল এবং তাকে হত্যা করা হল।…… ‘(বুখারী শরীফ, হাদীস-৬৩৪২)
এছাড়া অন্যান্য হাদীসেও ইসলাম ধর্মত্যাগকারীর শাস্তি সম্পর্কে বলা হয়েছেঃ
’হযরত আবদুল্লাহ্ (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলিয়াছেনঃ ঐ মুসলমানের রক্ত বৈধ নয়, যে এইরূপ সাক্ষ্য দেয় যে, “আল্লাহ্ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল।” তবে তিনটি কারণে কোন মুসলমানের রক্ত প্রবাহিত করা বৈধঃ ১. যদি কোন বিবাহিত ব্যক্তি ব্যভিচার করে; ২. যদি কেহ কাউকে খুন করে, তবে এর বিনিময়ে খুন করা এবং ৩. যে ব্যক্তি ধর্ম ত্যাগ করে মুরতাদ হইয়া মুসলমানের জামাআত থেকে বাহির হইয়া যায়।’ (আবু দাউদ শরীফ, হাদীস- ৪৩০৩)
’হযরত ইবন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আবদুল্লাহ ইবন সা’আদ ইবন আবূ সারাহ্ (রা) রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ)-এর লেখক ছিলেন। তিনি শয়তানের খপ্পরে পড়ে গুমরাহ্ হইয়া পুনরায় কাফিরদের সাথে মিলিত হন। পরে মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাহাকে হত্যার নির্দেশ দেন। এ সময় উছমান ইব্ন আফফান (রা) তার নিরাপত্তার জন্য আবেদন পেশ করলে – রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) তাহাকে নিরাপত্তা দেন।’ (আবূ দাউদ শরীফ, হাদীস-৪৩০৯)
এভাবে কোরআন ও বিশেষভাবে হাদীসের অসংখ্য বর্ণনা আাছে যেখানে ইসলাম ধর্মত্যাগীদের জন্য মৃত্যুদন্ডকে আইন বা বিধান হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে। সুতরাং এ বিষয়টিতে আর বিতর্ক থাকা উচিত না যে, ইসলামী দেশগুলোতে ইসলামপন্থীরা রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলে বা তারা রাষ্ট্রীয় অনুমোদন পেলে ধর্মত্যাগী বা মুরতাদ তথা প্রগতিশীল, আধুনিকতাপন্থী ও কমিউনিস্টদের উপর দেশে দেশে যে নির্যাতন ও হত্যার বিভিষীকা নেমে আসে, তা শুধু যে ইসলাম অনুমোদন দেয় তাই নয় ধর্মত্যাগী বা মুরতাদদের মৃত্যুদন্ডের শাস্তি ইসলামের নির্দেশ। একইভাবে হেফাজতের তের দফার সংশ্লিষ্ট দফাগুলোও ইসলামের এই বিধানকে ধারণ করে।
উপরের আলোচনা এ বিষয়টি স্পষ্ট করে যে, বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান শক্তি নিয়ে ও ইসলামের মৌলিক আদর্শকে ধারণ করে হেফাজত ও জঙ্গীবাদী ইসলামপন্থী দলগুলো যেভাবে অগ্রসর হচ্ছে তাতে বর্তমান আদর্শিক রাজনৈতিক শূন্যতার মধ্য দিয়ে তাদের রাষ্ট্র ক্ষমতার কাছাকাছি যাবার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এবং একবার তারা রাষ্ট্রক্ষমতার কেন্দ্রে বা তার কাছাকাছি যেতে পারলে প্রগতিশীল, অসাম্প্রদায়িক ও আধুনিকতার শক্তির কী পরিণতি হতে পারে তার উদাহরণ কিছু পূর্বে দেওয়া হয়েছে।
চার : বাংলাদেশের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে হেফাজত
হেফাজতের উত্থানের সাথে বাংলাদেশের আগামী দিনের রাজনীতি মেলাতে পারব যদি আমরা এই অঞ্চলকে ঘিরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা কৌশল সম্পর্কে ধারণা রাখি। গত ২০১১-এর নভেম্বরে বারাক ওবামা ঘোষণা করেছিলেন যে, চীনকে মোকাবিলা করার জন্য মার্কিন নিরাপত্তা নীতিতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলকে সবচেয়ে বেশী গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এর পর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য, বিশেষত ইরানকে। এই লক্ষ্যে তাকে জাপান থেকে শুরু করে ভারত মহাসাগরীয় দ্বীপ দিয়াগো গার্সিয়া ঘাঁটি পর্যন্ত সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো প্রয়োজন। আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহার শুরু হলে দক্ষিণ এশিয়ায় নজরদারী ও কর্তৃত্ব ধরে রাখার বিকল্প বন্দোবস্ত প্রয়োজন। সেসব বিচারে প্রয়োজনীয় শক্তি মজুদের জন্য বঙ্গোপসাগরই সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান বলে মনে করে যুক্তরাষ্ট্র।১৭ যার মাধ্যমে একদিকে চীনের উপর নজর রাখা যাবে আবার অন্যদিকে ভারতের সব নিরাপত্তা স্থাপনা আমেরিকার নজরদারীর আওতায় থাকবে। পত্র-পত্রিকার সূত্র থেকে আমরা জানি যে কয়েক দশক থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চট্টগ্রামে নৌঘাঁটি পেতে আগ্রহ প্রকাশ করছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ওবামার নিরাপত্তা নীতিতে পরিবর্তনের ফলে চীনকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে চাওয়ায় বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অতীতের যে কোন সময়ের চেয়েও যে অনেক বেশী হয়েছে তাতে কোন সন্দেহ নাই। এই পরিপ্রেক্ষিতে পূর্বের নির্বাচিত সরকারগুলো নৌঘাঁটি প্রদানে অনীহা প্রদর্শন করায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যে এই সুবিধা পাবার জন্য যত দ্রুত সম্ভব ভিন্ন উপায় অবলম্বন করবে না সে বিষয়ে আমরা নিশ্চিত হতে পারি না।
ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি, আফগানিস্তানে সোভিয়েত শাসনামলে আমেরিকার প্রত্যক্ষ অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য দেওয়া হচ্ছিল আফগান মুজাহিদীন বাহিনীকে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য। এক সময় আফগানিস্তানের তালেবানদেরও তারা পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছে। সম্প্রতি সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিদ্রোহী পক্ষকে যে অস্ত্র সাহায্য দিচ্ছে তা আর গোপন নাই। ইতিহাস থেকে আমরা দেখেছি আমেরিকা তাদের সম্প্রসারণবাদী ও আগ্রাসী নীতির কারণে পৃথিবীর দেশে দেশে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে জঙ্গীবাদী ও সন্ত্রাসী বিভিন্ন গোষ্ঠীকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য করে থাকে। খনিজ সম্পদ ও বিশেষভাবে নৌঘাঁটি পাবার জন্য এমনিতেই জটিল রাজনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত বাংলাদেশে তাদের হেফাজতে ইসলামের মত শক্তিকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্যের সম্ভাবনা নাকচ করা যায় না।
এই রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হয়েছে আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নিজ অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠান করার বিষয়ে যেমন অনমনীয় তেমনি প্রধান বিরোধী দল বিএনপিও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবীতে অনড়। এমন পরিস্থিতি দেশকে ব্যাপক সংঘাতের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে বাংলাদেশের জন্ম থেকেই যে নীতিহীনতা আর আদর্শের সংকট চলছে তার চূড়ান্ত পরিণতিতে এদেশে আদর্শের শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা প্রবল হয়ে উঠেছে। এর স্থান পূরণ করতে গণভিত্তি নিয়ে এগিয়ে আসছে হেফাজতে ইসলামের মত আদর্শিক ইসলামী সংগঠন। কিন্তু বাংলাদেশ আজ যে জটিল ও বহুমুখী সংকটে নিপতিত হয়েছে তা থেকে চৌদ্দশত বছর আগের ইসলাম ধর্মের সাহায্যে রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়। বরং এই ধর্ম দেশকে আরও পশ্চাuপদতা, পরনির্ভরতা আর পরদাসত্বের পথে নিয়ে যাবে। বাংলাদেশকে আজ উন্নত পৃথিবীর সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে আধুনিক ও সেক্যুলার বা লোকবাদী শক্তিকে রাষ্ট্র ক্ষমতার নিয়ন্ত্রণে যেতে হবে।
শুরুতে যেমন বলেছিলাম, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আমাদের যে অমীমাংসিত পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে তার অনিবার্য পরিণতি হল আরেকটি যুদ্ধের মাধ্যমে এর মীমাংসা হওয়া। এতে কোন সন্দেহ নাই যে এই লড়াই হবে আদর্শের, চৌদ্দ শত বছর আগের বর্বর আরবীয় ধর্মের আদর্শের শক্তির সাথে আধুনিক, শিল্পোন্নত ও মানবিক সমাজ নির্মাণের উদ্দেশ্যে পাল্টা আদর্শের শক্তির লড়াই। আরেকটি বিকল্প আদর্শ ছাড়া ক্রমবর্ধমান জঙ্গীবাদী ও আদর্শিক ইসলামী শক্তির উত্থানও রোধ করা সম্ভব নয়।
সূত্র ও টীকাঃ
১। আলোচনার সুবিধার জন্য হেফাজতের তের দফার দাবীগুলো নীচে সম্পূর্ণ উল্লেখ করা হলঃ
১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।
২. আল্লাহ, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুত্সা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩. কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয়নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুত্সা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
৬. সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতত্পরতা বন্ধ করা।
৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
৯. রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিষ্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতত্পরতা বন্ধ করা।
১১. রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।
১২. সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাঁদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
১৩. অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
২। কোন একটি ইসলামী সভায় হেফাজতে ইসলামের আমির শাহ আহমদ শফীর এই বক্তব্য আর্ন্তজালের বিভিন্ন ব্লগে ও ফেসবুকে ভিডিও ক্লিপ আকারে পাওয়া যাচ্ছে। এই লেখায় বর্তমান উদ্ধৃতি সমূহ নেওয়া হয়েছে দৈনিক পত্রিকা সমকাল–এর ১৩ জুলাই, ২০১৩ তারিখ সংখ্যার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি লেখা ‘আল্লামা শফীর বক্তব্যে তোলপাড়ঃ স্পষ্ট ব্যাখ্যা নেই হেফাজতের’ থেকে।
৩। সাম্প্রতিক কালে ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার প্রেক্ষিতে বিশেষভাবে হাদীস গ্রন্থ সমূহ থেকে ইসলাম ও মোহাম্মদ সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা তৈরী হয় বলে ইসলামের বিতর্কিত ও অন্ধকার রূপ ঢাকার প্রয়োজন থেকে অনেকেই কেবলমাত্র কোরআনকে নির্ভরযোগ্য বলছেন এবং হাদীস গ্রন্থগুলোকে অনির্ভরযোগ্য বলছেন। কিন্তু যুগে যুগে ইসলামী পন্ডিতরা হাদীসকে নির্ভুল হিসাবেই বলেছেন বিশেষভাবে সহিহ হাদীসগুলোকে। এবং সন্দেহাতীতভাবে এগুলো মোহাম্মদের কথা, কাজ অথবা সম্মতিকে নির্ভুলভাবে প্রকাশ করে।
এটা ঠিক যে মোহাম্মদ মারা যাবার পরও এমন কী যাকে খোলাফায়ে রাশেদীনের যুগ বলা হয় তখনও হাদীস লিখে রাখা হয় নাই। সেই সময়ে মোহাম্মদের অনুসারীরা পরস্পর পরস্পরের নিকট মৌখিকভাবে হাদীস শুনতেন এবং সেগুলো মুখস্ত রাখতেন। বিশুদ্ধ হাদীস সংগ্রহ করার কাজে যে সকল ব্যক্তি শুরুর দিকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাবী বিন সাবিহ্ এবং সাইদ বিন আবি আরুযার নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিশুদ্ধ হাদীস সংগ্রহ করার কাজ প্রথম শুরু হয় হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর প্রথম দিকে। সেসময় ইমাম মালেক ইবনে আনাস প্রচলিত হাদীসগুলো থেকে বাছাই করে মুয়াত্তা নাম দিয়ে একটি হাদীস গ্রন্থ রচনা করেন। এই সময়েই মক্কায় আবু মুহাম্মদ আবদুল মালেক, সিরিয়ায় আবু উমার ও আবদুর রহমান, কুফায় আবদুল্লাহ সুফিয়ান ইবনে সাইদ এবং বসরায় আবু সালমা ইবনে সালমা ইবনে দীনার প্রভৃতি একটি হাদীস গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এরপর হিজরী দ্বিতীয় শতাব্দীর মধ্যভাগে হাদীস সংকলনে এগিয়ে আসলেন আবদুল্লাহ ইবনে মুসা কুফী, মুসাদ্দাদ ইবনে মুনীর বসরী, আসাদ ইবনে মুসা, আমুয়ী নইম ইবনে হাম্মাদ খাজায়ী মিসরী প্রভৃতি প্রত্যেকেই একটি করে ‘মসনদ’ বা হাদীস সংকলন রচনা করলেন। এভাবে এই কাজে আরও এগিয়ে আসলেন ইমাম আবু হানিফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম আহামাদ ইবনে হাম্বল, ইসহাক ইবনে রাওয়াইয়া এবং উসমান ইবনে আবু শাইবা। এভাবে হিজরী তৃতীয় শতাব্দীর প্রারম্ভে বিভিন্ন লেখকের দ্বারা লিখিত ছোট বড় হাদীস গ্রন্থের সংখ্যা প্রায় চৌদ্দশতে যেয়ে পৌঁছালো। এই অসংখ্য হাদীস গ্রন্থের মধ্যে মুসলমান বিশ্বে যেগুলো প্রামাণ্য ও বিশুদ্ধ বলে গৃহীত ও সমাদৃত হয়েছে সেগুলোর সংখ্যা খুবই কম। এগুলোর মধ্যে ছয়টি হাদীস সবচেয়ে বিশুদ্ধ বা সহিহ্ হাদীস হিসাবে পরিচিত। এগুলো হল – সহিহ বোখারী, সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামেয়ে তিরমিজি এবং সুনানে ইবনে মাজা। এ বিষয়টি সর্বজন স্বীকৃত যে সহিহ বোখারী ও সহিহ মুসলিমে কোন ‘জয়ীফ’ বা দুর্বল হাদীস নাই। এই ছয়টি হাদীস গ্রন্থ ছাড়াও আরও কিছু প্রসিদ্ধ সহিহ হাদীস গ্রন্থ আছে, যেগুলো হল – মসনদে ইমাম ইবনে হাম্বল, ইমাম শাফেয়ী, দারমী, মোয়াজামে সালাসা তেবরানী, মুস্তাদারাকে হাকেম, সুনানে দারকুৎনী, মুসান্নাফে ইবনে আবি শাইবা এবং আবদুর রাজ্জাক।
হাদীস সংগ্রাহকদের মধ্যে সবচেয়ে সম্মানিত ইমাম বোখারী সুদীর্ঘ ষোল বৎসর ধরে ছয় লক্ষ হাদীস থেকে বাছাই করে ৭২৭৫টি হাদীস গ্রহণ করেন। মুসলিম শরীফ রচনাকারী ইমাম মুসলিম তিন লক্ষ হাদীস বাছাই করে সেখান থেকে বারো হাজার হাদীস গ্রহণ করে তাঁর গ্রন্থ মুসলিম শরীফ প্রণয়ন করেন। আবু দাউদ সোলায়মান ইবনে আশআস সাজতানী পাঁচ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে সেখান থেকে বাছাই করে চার হাজার আট শত হাদীস গ্রহণ করে তাঁর সুবিখ্যাত গ্রন্থ সুনানে আবু দাউদ রচনা করেন। এভাবে বিভিন্ন হাদীস সংগ্রাহক হাজার হাজার বা লক্ষ লক্ষ হাদীস সংগ্রহ করে সেখান থেকে বাছাই করে তাঁদের হাদীস গ্রন্থসমূহ রচনা করেছিলেন।
৪। এই নিবন্ধে কোরআন থেকে সকল উদ্ধৃতির নেওয়া হয়েছে, আল-কুরআনুল করীম, ইসলমিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা কর্তৃক অনুদিত ও প্রকাশিত, প্রথম প্রকাশ ১৩৭৪।
৫। এই নিবন্ধে তিরমযী শরীফের সকল উদ্ধৃতির উৎসঃ
সহীহ্ তিরমিযী শরীফ- মূলঃ আবু ঈসা মুহাম্মদ ইবনে ঈসা তিরমিযী (রহঃ), অনুবাদঃ হযরত মাওলানা মোহাম্মদ কামরুজ্জামান, প্রকাশকঃ বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী লিমিটেড, ঢাকা, ২০১০।
৬। বঙ্গানুবাদ মুসলিম শরীফ, ১ম খন্ড, অনুবাদকঃ মৌলানা নেছারুল হক, ইসলামিয়া লাইব্রেরী, চট্টগ্রাম, প্রথম সংস্করণ ১৯৭৩।
৭। বঙ্গানুবাদ মুসলিম শরীফ, ২য় খন্ড, অনুবাদকঃ মৌলানা নেছারুল হক, ইসলামিয়া লাইব্রেরী, চট্টগ্রাম, প্রথম সংস্করণ ১৯৭৩।
৮। বোখারী শরীফ, সপ্তম খন্ড, অনুবাদঃ মাওলানা শামসুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, হামিদিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা, ১৯৭১।
৯। এই নিবন্ধে দাউদ শরীফের সকল উদ্ধৃতির উৎসঃ
সহীহ্ আবু দাঊদ শরীফ, মূলঃ ইমাম আবু দাউদ মসালায়মান ইবনুল আশ’আস আস-সিজিস্তানী (র.), অনুবাদঃ মাওলানা এম. এন. ইমদাদুল্লাহ, বাংলাদেশ তাজ কোম্পানী লিমিটেড, ঢাকা, ২০০৯।
১০। শামসুজ্জোহা মানিক তাঁর গ্রন্থ ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা-য় ইসলামের বিজয়ে নারীর পরাজয় নামে পরিচ্ছেদে ইসলাম ধর্মে ও ইসলামী সমাজে নারীর শোচনীয় অবস্থার বিষয়টি তুলে ধরেছেন। ইসলাম ধর্মের আদর্শিক ও দার্শনিক ভিত্তিকে বিশ্লেষণ করে তিনি দেখিয়েছেন এই ধর্ম নিজেই সমাজে নারীর অধস্তন অবস্থা ও সমাজে নারী নিগ্রহের জন্য দায়ী। এ বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য দেখুন ইসলামের ভূমিকা ও সমাজ উন্নয়নের সমস্যা, শামসুজ্জোহা মানিক, বদ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০।
১১। বোখারী শরীফ, তৃতীয় খন্ড, অনুবাদঃ মাওলানা শামসুল হক ও মাওলানা আজিজুল হক, হামিদিয়া লাইব্রেরী, ঢাকা, ১৯৬৭।
১২। ইসলাম ধর্ম যে যুদ্ধের মাধ্যমে বিস্তার লাভ করেছে সে বিষয়ে কোরআন ও হাদীস সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ আকর গ্রন্থের সাহয্যে এম, এ, খান তাঁর বই জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার বইয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। বাংলা বইটি লেখকের মূল ইংরেজী বই Islamic Jihad: A Legacy of Forced Conversion, Imperialism and Slavery, iUniverse, Inc., New York, Bloomington থেকে প্রকাশিত হয়েছে।
ইসলাম প্রসারে যুদ্ধের ভূমিকা বলতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ইসলামী ইতিহাসবিদদের দ্বারা লিখিত নবী মোহাম্মদের জীবনীতে মদীনায় বসবাসকালীন তাঁর জীবনের শেষ ১০ বছরে নবী কর্তৃক পরিচালিত বা নির্দেশিত ৭০ থেকে ১০০টি ব্যর্থ বা সফল আক্রমণ, লুণ্ঠন-অভিযান ও যুদ্ধের উল্লেখ পাওয়া যায়। এর মধ্যে ১৭ থেকে ২৯টিতে তিনি ব্যক্তিগতভাবে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন - জিহাদঃ জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তরকরণ, সাম্রাজ্যবাদ ও দাসত্বের উত্তরাধিকার, মূলঃ এম, এ, খান, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশকালঃ ২০১০।
১৩। শামসুজ্জোহা মানিক তাঁর নিবন্ধে ’বাংলাদেশে রাষ্ট্রের চরিত্র ও ভূমিকা’-য় বিষযটি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেনঃ
’প্রথাগতভাবে ইসলামী সমাজে ধর্ম, যুদ্ধ ও রাজনীতি স্বতন্ত্র বা ভিন্ন সত্তা নয়। এখানে ধর্ম, রাজনীতি, সেনাবাহিনী, প্রশাসন, রাষ্ট্র ও সমাজ সব মূলত একাকার। যেহেতু ধর্মীয়, রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ মূলত একীভূত, এক ব্যক্তিরই হাতে কেন্দ্রীভূত সেহেতু ইসলামী সমাজে বিচ্ছিন্নভাবে কোন একটির বিরুদ্ধে সংগ্রামের সাফল্যের কোন আশাই নেই। বিশেষত ইসলাম ধর্মের একাধিপত্যবাদী ও আক্রমণাত্বক বৈশিষ্ট্য ও প্রবণতা সমাজে অব্যহতভাবে যে উগ্র সমরবাদ এবং অসহিষ্ণু ও আক্রমণাত্বক স্বৈরতন্ত্র জন্ম দেয় তার ফলে ইসলামী সমাজে আধিপত্যবাদী সামরিক আমলাতন্ত্র ও একনায়কী স্বৈরতন্ত্রের অস্তিত্ব অনিবার্য ঘটনা। এই রকম সমাজে একটি বিশেষ সেনাবাহিনীর ধ্বংস ও বিলুপ্তিও তাই শেষ পর্যন্ত আর একটি নূতন আমলাতান্ত্রিক সেনাবাহিনী কিংবা স্বৈরতান্ত্রিক সমরশক্তির উদ্ভব ও বিকাশের পথ করে দেয় মাত্র। বাস্তবে এই সমাজে স্বেচ্ছাতন্ত্র ও সমরবাদ সর্বত্র পরিব্যাপ্ত। ধর্মের মাধ্যমে একনায়কতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র ও যুদ্ধবাদ গোটা সমাজ ও প্রতিটি ব্যক্তির সমগ্র চিন্তা পদ্ধতিকে নিয়ন্ত্রণ করে। ধর্মচর্চা দ্বারা সমাজ মানস থেকে একনায়কতন্ত্র, সমরবাদ ও স্বৈরতন্ত্রের যে অবিরাম উদ্ভব ঘটে তা নিরবচ্ছিন্নভাবে অধিকার করে রাখে রাষ্ট্র ও সমাজকে। একনায়কী ধর্মের প্রভাবে সমাজ মানসে নারীর স্বাধীনতা, ব্যক্তিসত্তার স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্র দাঁড়াবার মত কোন দৃঢ় ভিত্তি পায় না বলে সামরিক আমলাতন্ত্রের একনায়কতন্ত্র এবং বর্বর স্বৈরতন্ত্র এই সমাজের নিয়তি।’ (পৃষ্ঠাঃ ৩৮-৩৯)।
উপরের লেখাটি শামসুজ্জোহা মানিকের আওয়ামী লীগ বিএনপি বিরোধের সমাজতত্ত্ব (প্রবন্ধ সংকলন), বদ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০১০ থেকে উদ্ধৃত।
১৪। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টি পিকেআই-এর অনুগত সেনাবাহিনীর কিছু কর্মকর্তা দ্বারা সংঘটিত যে ব্যর্থ অভ্যুত্থান হয় ও তার ফলে সুহার্তো সহ সেনাবাহিনীর কমিউনিস্ট বিরোধী জেনারেলদের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে কমিউনিস্টদের নিশ্চিণ্হ করতে গিয়ে যে ব্যাপক গণহত্যা চালানো হয় তার বিস্তারিত বিবরণ আছে আমেরিকান সাংবাদিক জন হিউজের লেখা বই Indonesian Upheaval-এ (Indonesian Upheaval, by John Hughes, David McKay Company, Inc., New York, 1967)।
১৫। ইন্দোনেশিয়ায় সেই কমিউনিস্ট নিধনের রক্তস্নানের সময়ে অর্থাৎ ১৯৬৫ সালের অক্টোবর, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে প্রকৃতপক্ষে কত লোক হত্যা করা হয়েছিল তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান নাই। জন হিউজ তাঁর Indonesian Upheaval-বইয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে সংখ্যাটি সর্বনিন্ম ২,৫০,০০০ ও সর্বোচ্চ ৫,০০,০০০ বলে উল্লেখ করেছেন। তবে টিম ওয়েইনারের লিগেসি অব অ্যাশেজঃ দি হিস্ট্রি অব দ্যা সিআইএ থেকে জানা যায় খোদ সিআইএ সংখ্যাটা ৫ লাখের কাছাকাছি বলে উল্লেখ করেছে যে সমস্ত গ্রাম জনশূন্য হয়েছে সেগুলোর জনসংখ্যার আন্দাজে। গ্রন্থটির বাংলা অনুবাদ লিগেসি অব অ্যাশেজঃ সিআইএ’র ৬০ বছরের ইতিহাস, মূলঃ টিম ওয়েইনার, অনুবাদঃ ইফতেখার আমিন, প্রকাশকঃ আকাশ, ঢাকা, ২০১২। বইটির ৩০৪ থেকে ৩০৮ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ইন্দোনেশিয়ায় সেই সময় সিআইএ-র ভূমিকা সম্পর্কেও বর্ণনা আছে।
১৬। বুখারী শরীফ, দশম খণ্ড, মূলঃ আবূ ‘আবদুল্লাহ মুহাম্মদ ইবন ইসমা’ঈল আল-বুখারী আল-জু’ফী (র), প্রকাশকঃ ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ মে ১৯৯৪।
১৭। তথ্যসূত্র – দৈনিক ইত্তেফাক, ৩ জুন, ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত খবর, “এশিয়ায় ৬০ ভাগ নৌ-শক্তি মোতায়েন করবে যুক্তরাষ্ট্র।”