লিখেছেনঃ ইমাম গাজ্জালী, আপডেটঃ October 5, 2015, 12:00 AM, Hits: 2007
এক
মুক্তিযুদ্ধের ধারায় চলছে না বাংলাদেশ। না এর রাজনীতি, না এর দর্শন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরবর্তী কোনো কালে তা চলেও নি। যুদ্ধোত্তর সদ্য স্বাধীন দেশে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ অস্থির সময়ে এই ধারার রাজনীতির মূর্ত নির্দিষ্ট রূপটা কী হবে তা তুলে আনা সম্ভব হয়নি। অস্থির সময়ের এক ‘অজানা’ ঝড়ে সব তছনছ হয়ে যায়, সামরিক শাসনে উল্টো ধারায় পথ চলা শুরু করে দেশ, যার প্রভাব এখনো এড়াতে পারেনি বাংলাদেশ।
এই উল্টো পথে চলাটা মুক্তিযুদ্ধের ধারকে ভোঁতা ক’রে, তার বৈপ্লবিক উজ্জ্বলতাকে ম্লান করে দিয়ে, যুদ্ধ বিরোধী অংশের সঙ্গে একটা গোঁজামিল দিয়ে, তাদের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের একটা পথ বের করে দিয়েছে। একই সঙ্গে লুটেরাদের কাছে যে মুক্তিযুদ্ধ ছিল বিপজ্জনক তাকে সহনীয়ভাবে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় ভূমিকায় যে আগ্রাসনের চরিত্র ছিল, তাকে সাম্প্রদায়িক কালিমা দিয়ে কিংবা দরকারের চেয়ে বড় করে দেখিয়ে জাতীয় মুক্তির চেতনাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করতে মুখর হওয়ার সুযোগ পেয়েছে একটি মুখচেনা মহল। এসকল তৎপরতাই মুক্তিযুদ্ধের শোষণহীন আকাঙ্খার অভিযাত্রাকে নির্বাসনে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। সেই পথ চলার প্রভাবে পাকিস্তানী মতাদর্শের কাছে বাংলাদেশের দর্শনের অনেকাংশে পরাজয় ঘটেছে।
বাংলাদেশে এখন চলছে নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা কথিত গণতান্ত্রিক চেতনার রাজনীতি। এই চেতনার শক্তি দিয়ে আর এগুতে পারছে না বাংলাদেশের রাজনীতি। মুখ থুবড়ে পড়েছে, নানা সংকট দেখা দিয়েছে ইতোমধ্যেই। তাই দেশকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার শক্তি খুঁজে পেতে তাকে ফের ফিরে যেতে হচ্ছে সেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কাছে। সম্প্রতি গণজাগরণ সেই বার্তাটিই জানান দিয়ে গেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার স্বরূপটা কী তার সঠিক ব্যাখ্যা করতে জানাটাই এই মুহূর্তের গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
নব্বইয়ের চেতনার রাজনীতির সাংগঠনিক রূপ মুজিব পরবর্তী আওয়ামী লীগ ও জিয়া পরবর্তী বিএনপির দ্বিদলীয় ধারায় বৃত্তাবদ্ধ। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে এক ভিন্নতর আওয়ামী লীগের সন্ধান পাওয়া যায়, যে আওয়ামী লীগ সামরিক শাসনে সৃষ্ট মুক্তিযুদ্ধ প্রশ্নে ভিন্ন ধারায় চলা বাংলাদেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে, তার সঙ্গে মিলতাল করে চলার কৌশল বের করে নিয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই কৌশল তারা গ্রহণ করেছে শুধু ক্ষমতা দখলটাকে নিশ্চিত করার জন্যই, মোটেই মুক্তিযুদ্ধের ধারায় দেশকে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়।
নব্বইয়ের চেতনার মধ্যে বামপন্থীদেরও অংশ গ্রহণ ছিল। তাদের নানা অংশের সমর্থন শেষ বিচারে ওই দ্বিদলীয় ধারার রাজনীতিকেই পরিপুষ্ট করেছে। দ্বিদলীয় ধারার বিপরীতে স্বাধীন স্বকীয় ধারা গড়ে তোলার কার্যকর উদ্যোগ দেখা যায় নি তাদের মধ্য থেকে। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দুই নেত্রীকে এক করার দূতিয়ালী করেছে নিজেদের করণীয় বাদ দিয়ে। নব্বইয়ে স্বৈরাচার এরশাদের পতন পরবর্তী নির্বাচনে এদের ন্যক্কারজনক ভূমিকার মধ্যে তার প্রমাণ মেলে। একবার এ দল আরেকবার ও দলের কাছে নির্বাচনী আসন ভাগাভাগির জন্য দৃষ্টিকটুভাবে দরকষাকষি করতে দেখা গেছে তাদের। এমন অভিযোগও শোনা গেছে যে, এসব দলের কেন্দ্রীয় কমিটির কিংবা পলিটব্যুরোর সদস্যরা পর্যন্ত নিজ দল কিংবা নিজ জোটের প্রার্থীকে ভোট না দিয়ে বিএনপি ঠেকাতে আওয়ামী লীগের বাক্সে কিংবা আওয়ামী লীগ ঠেকাতে বিএনপির বাক্সে ভোট দিয়েছেন। এতে বিএনপিও ঠেকেনি কিংবা আওয়ামী লীগও ঠেকেনি বরং তারা নিজেরাই ঠেকে গেছেন।
অপরদিকে নব্বইয়ের পরবর্তী সময়ে এক ভিন্ন ধারার আওয়ামী লীগ ও ভিন্ন ধারার বিএনপির দেখা মেলে। জিয়ার আমলের বিএনপির সঙ্গে নব্বই পরবর্তী বিএনপির একটা বড় পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়। জিয়ার বিএনপি ছিল হতাশাগ্রস্ত দলচ্যুত বিভ্রান্ত চৈনিক ধারার কমিউনিস্ট ও একই সঙ্গে স্বাধীনতা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং টাউট বাটপাড়দের নিয়ে গঠিত জনবিচ্ছিন্ন বিএনপি। নব্বইয়ের আন্দোলনের মাধ্যমে সেই বিএনপি একটা গণভিত্তি পায়, আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে দলটি জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়। আওয়ামী লীগ বিরোধিতা ও অনেকটা সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে ভারত বিরোধিতাই ছিল দলটির মূল জিগির। এর পরেও মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নটি এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়নি দলটির। এই প্রশ্নে জনগণের আবেগ-অনুভূতিকে কাজে লাগাতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে তাদের কোনখানে কোথায় কতটুকু অবদান রয়েছে, তা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বের করতে পিছ পা হয় না তারা। মূলত বিএনপি হল আওয়ামী লীগের এবং প্রগতিশীল রাজনীতির ব্যর্থতার ফলাফল। আরো সুনির্দিষ্টভাবে, মুক্তিযুদ্ধের ধারায় সুনির্দিষ্ট রাজনীতির সুপ্রতিষ্ঠার অভাবেই বিএনপি ফুলে ফলে বিকশিত হয়েছে। দলটি গড়েই উঠেছে স্বাধীনতা বিরোধী ও আওয়ামী লীগ বিরোধী অংশের যৌথ সহায়তায়। সেখানে যেমন সাকা চৌধুরীদের দেখা মেলে তেমন একই সঙ্গে মান্নান ভুঁইয়াদেরও সাক্ষাৎ পাওয়া যায়।
দুই
নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান বিজয়ী হয়েছিল দেশীয় সামরিক স্বৈরাচারকে পরাস্ত করে। পূর্ব বাঙলার মানুষ জাতীয় চেতনায় উদ্বেলিত হয়ে পাকিস্তানী শাসক শ্রেণির জাতিগত শোষণের বিরুদ্ধে লড়েছিল। ওই সময়ে প্রধানত পাকিস্তানী সামরিক শাসক আইউব শাহীর বিরুদ্ধেই জাতীয় মুক্তির আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল। জাতীয় মুক্তির আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধেই লড়তে হয়েছিল। সঙ্গত কারণে মুক্তিযুদ্ধ বিজয়ী হয়েছিল সামরিক স্বৈরতন্ত্রকে পরাস্ত করার ধারায়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে আমরা শুধু স্বাধীনতাই লাভ করিনি, সামরিক শাসনের নিয়তি থেকেও মুক্তি পেয়েছি, যে মুক্তি এখন পাকিস্তানের জন্য সুদূর পরাহত।
নব্বইয়ের সামরিক স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদে সেই পুরোনো করণীয়টাই সম্পন্ন হয়েছিল দেশীয় বাস্তবতায়। রাজনীতির যে দুষ্ট ক্ষত সারানো হয়েছিল স্বাধিকার ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে, শাসকদের সীমাহীন শোষণ, লুটপাট ও সীমাবদ্ধতার কারণে সেই সামরিক স্বৈরাচার আবার নতুনভাবে জাতির ওপর চেপে বসে। মানুষ সেই দুর্ভাগ্যকে জয় করেছিল নয় বছরের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে। সাপ লুডু খেলার মত অনেক দূর এগিয়ে গিয়ে আবার পেছন থেকে শুরু করতে হয়েছে। ফের সামরিক স্বৈরতন্ত্র উচ্ছেদের করণীয় সম্পন্ন করার দায় নিতে হয়েছিল জাতিকে। তবু ভাল কাজটা সমাধা করা গেছে। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তার খেসারত এখনো দিতে হচ্ছে জাতিকে।
বুর্জোয়া রাজনীতির আপাত অমীমাংসেয় সংকট ও মেহনতীদের বিকল্প রাজনীতির অনুপস্থিতিই সামরিক শাসনের পথকে খোলাসা করে দেয়।
বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর ধারাবহিকতা। আরো সুনির্দিষ্টভাবে বলা যায় এটা বৃটিশ সামরিক বাহিনীর নিয়ম-কানুন ও ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা। তাই এই সশস্ত্র বাহিনী বহন করছে ঔপনিবেশিকতার ক্ষত, যা জনগণের পক্ষে তাদের দাঁড়াতে দেয় না। ল্যাটিন আমেরিকার হুগো শ্যাভেজের মত মেহনতীদের পক্ষে ক্ষমতা দখল করা এদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এই বাহিনীর মধ্যেও দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার কিছুটা জায়গা তৈরি হয়েছিল। কর্ণেল তাহেরের ক্ষমতা দখলের ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছিল সশস্ত্র বাহিনীর সেই দেশপ্রেম ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতার সেই আবেগ-অনুভুতি। কর্ণেল তাহেরের অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা অসফল হয়। অসম সাহসিকতায় পূর্ণ হলেও পথটা ছিল ভুল ও হটকারী। সেই অভ্যুত্থান প্রচেষ্টা ভণ্ডুল করে দেয় দেশী ও বিদেশী কায়েমী শাসকচক্র। সেই ‘ভণ্ডুল’ প্রচেষ্টায় সেনাবাহিনীর মধ্যে যারা জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ, যারা দেশপ্রেমিক এবং সাহসী তাদের হত্যা করে অংকুরেই বিনষ্ট করে দেওয়া হয় সেনাবাহিনীর মধ্যকার সেই সম্ভবনাটুকুকে। সশস্ত্র বাহিনীর মধ্যেও জয়ী হয় সেই পুরোনো ঔপনিবেশিক ধাঁচের ধারাটিই। এরাই পরবর্তী কালে জিয়া ও এরশাদের নেতৃত্বে দীর্ঘ ১৫ বছর সামরিক শাসন জারি রাখে দেশে। জিয়া ও এরশাদ এদের সার্থক প্রতিনিধি। এ ছিল বাংলাদেশের সামরিক শাসকগণের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের দারুণ মিতালী। এরাই বাংলাদেশ বিরোধী রাজনীতিকে ডেকে নিয়ে এসেছে। চরমোনাই পীরের সঙ্গে এরশাদের, গোলাম আজমের সঙ্গে জিয়ার সখ্যতা কে না জানে?
নব্বই পরবর্তী রাজনীতির ধারায় দেশীয় বুর্জোয়ারা তাদের শোষণ-লুণ্ঠনের জন্য একটা আপাত স্থিতিশীল পরিবেশ পায়, যা স্বাধীনতা পরবর্তী সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে অনুপস্থিত ছিল। নব্বই পরবর্তী প্রভাবশালী দল দু’টি (আওয়ামী লীগ ’৯০-’১৩ ও বিএনপি ’৯০-’১৩) নিজেদের সাবেক অবস্থান থেকে সরে আসে। জনগণের কাছে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের ধারায় এরা একটা গ্রহণযোগ্যতা পায়। ফলে বুর্জোয়ারাও নির্দ্বিধায় এদের ওপর নির্ভর করতে ভরসা পায়। যা বুর্জোয়ারা আগেকার আওয়ামী লীগ (মুজিব আমলের) ও আগেকার জনবিচ্ছিন্ন বিএনপির (জিয়ার আমলের) ওপর অতটা ভরসা করতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধের রাজনৈতিক চেতনার প্রশ্নে আপোষ
জাতীয় মুক্তির আকাঙ্খায় মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এদেশে একটি গণতান্ত্রিক সেক্যুলার আধুনিক চেতনার ধারা গড়ে উঠেছিল। একটা মুসলিম দেশে সেক্যুলার আধুনিক গণতান্ত্রিক ধারা গড়ে ওঠা মোটেই হালকা বিষয় নয়। পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশেই চেতনার এই ধারাটি গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল। একটা মুসলমানদের দেশ হিসাবে একে এগিয়ে নেয়া একটা বড় চ্যালেঞ্জ। কাজটি এগিয়ে নেয়া সম্ভব হলে, পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নি:সন্দেহে একটি উদাহরণ হয়ে উঠত। কিন্তু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র ও সেক্যুলার রাজনীতির ধারক-বাহক হিসাবে আবির্ভূত হয় শাসক দল আওয়ামী লীগ। সেক্যুলার ও আধুনিক গণতান্ত্রিক রাজনীতির প্রশ্নে দলটির নানা ভণ্ডামী ও সীমাবদ্ধতা বেরিয়ে আসতে সময় নেয়নি। এই ধারাটি এগিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তারা ক্লান্ত হয়ে পড়ে। এব্যাপারে আওয়ামী লীগ মোটেই নির্ভরযোগ্য দল নয়, তা নিজেরাই প্রমাণ করেছে। সেক্যুলার রাজনীতির নামে সংখ্যলঘুদের সম্পত্তি দখল ছাড়াও চালাতে থাকে সীমাহীন শোষণ, লুটপাট ও চুরিচামারি। সেই সঙ্গে দেশে শুরু হয় অস্ত্রের ঝনঝনানি, হত্যা, খুন, ধর্ষণ, নৈরাজ্য ও মাৎস্যন্যায়।
এর বিরুদ্ধে অসম সাহস নিয়ে দাঁড়ায় জাসদ। তারা মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে গড়ে ওঠা আধুনিক গণতান্ত্রিক সেক্যুলার ও সাম্যের রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার চ্যালেঞ্জ নিতে এগিয়ে আসে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রশ্নে হয়ত যথেষ্ট পরিপক্ব হয়ে উঠেনি তারা, কিংবা অনেক শর্তই সেখানে অপূরিত ছিল। আপাত সঠিকতা থাকলেও জাসদের নানা ভুলত্রুটি ও সীমাবদ্ধতার কারণে ওই করণীয় সমাধা করতে পারেনি তারা। তাদের আপোষহীন লড়াইয়ের তেজে সেই সময়ের শাসকদের উচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বিপ্লবী লড়াইয়ের ফলশ্রুতিতে শাসকদের উচ্ছেদ অনিবার্য হয়ে উঠলেও রাজনৈতিক লক্ষ্য দিশাহীন থাকলে সামরিক শাসনই আমন্ত্রিত হয়। তাই রাষ্ট্র রক্ষার জন্য সামরিক শাসনই ছিল বুর্জোয়াদের কাছে একমাত্র দাওয়াই।
ইতিহাসের প্রতি, জনগণের প্রতি সামরিক শাসকদের কোনো দায়বদ্ধতা থাকে না। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিও এদের কোনো দায় নাই। এদের হাতেই মুক্তিযুদ্ধ এবং আধুনিক গণতান্ত্রিক সেক্যুলার চেতনা কলঙ্কিত হয়।
পাকিস্তানকে শুধু সামরিক লড়াইয়ে পরাস্ত করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়নি, তার প্যান ইসলামিক দ্বি-জাতি তত্ত্বকে মতাদর্শিকভাবে পরাস্ত করেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের দার্শনিক ভিত্তি ছিল গণতান্ত্রিক, আধুনিক, সেক্যুলার ও সাম্যের রাজনীতির চেতনা। সামরিক শাসকেরা সেই চেতনাকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। সেই বাংলাদেশকে তারাই অনেকখানি পরাজিত করে ছেড়েছে। এদের কারণেই নব্বই পরবর্তী কালে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হয়নি, বরং তা অনুকূল পরিবেশ পেয়ে ষোলকলায় পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে। এসময়েই কুখ্যাত গোলাম আজম নাগরিকত্ব পায়। বাংলাদেশ বিরোধী অংশের কাছেও মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টি সহনীয় হয়ে ওঠে। এই মহল সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা নিতে সক্ষম হয়, সে কাজে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের দল বলে কথিতদের মধ্যেও দৃষ্টিকটু প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা গেছে।
সামরিক শাসকদের সৃষ্ট দলের পাশাপাশি এখন বাংলাদেশকে পরাজিত করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে আওয়ামী লীগ। এদের নেতারা এখন মাথায় টুপি পরে, হিজাব পরে এবং হাতে তসবি রাখে। মাদ্রাসা নির্মাণ করে নিজেদের সাচ্চা মুসলমান হিসাবে তুলে ধরতে প্রাণান্তকর কস্রত করে যায়। এসব ধর্মচর্চার অবস্থান থেকে নয়, ভণ্ডামী করেই এসব করে থাকেন তারা। পাশাপাশি অসাম্প্রদায়িকতার স্লোগানও বজায় রাখেন।
তিন
সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িকতা বাংলাদেশের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে কোনো ক্রমেই মেলে না, মেলানো যায় না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি এক সময় মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর হাত ধরে দাঁড়াতে চেয়েছে, বর্তমানে খালেদা জিয়ার কাঁধে ভর করে দাঁড়াচ্ছে। কখনো কখনো এরশাদের ওপর ভর করে দাঁড়িয়েছে। দায়ে পড়ে মহজোটে থাকলেও হেফাজতের ও জামায়াতের সঙ্গে এরশাদের সখ্যতা বড়ই মধুর। নিজেদের পায়ে ভর করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি বাংলাদেশে দাঁড়াতে পারেনি কখনো। উল্লেখ্য, মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ এবং খালেদা জিয়া দুজনেই ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মের ধার ধারেন না। সামরিক শাসন ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি হাত ধরাধরি করে বেড়ে উঠেছে বাংলাদেশে। এ কাজে সবচেয়ে বড় সহায়ক হয়েছে চৈনিক ধারার বামপন্থীরা। তোয়াহা, মান্নান ভূঁইয়া, কাজী জাফর আহমেদ, মশিউর রহমান যাদু মিয়া, খালেদুর রহমান টিটো, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, তরিকুল ইসলাম, সাদেক হোসেন খোকা প্রমুখ সামরিক শাসক জিয়া ও এরশাদের দল গড়ে তুলতে বড় ভূমিকা রেখেছেন। সরাসরি রাজনীতির বাইরে থেকেও ভূমিকা রেখে চলেছেন অনেকে, যেমন ফরহাদ মজহার, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, পিয়াস করিম প্রমুখ। আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে গিয়ে তারা বাংলাদেশের দর্শনের বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন।
বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা যুদ্ধকে বাদ দিয়ে এদেশের দর্শনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া সম্ভব নয়। গণতান্ত্রিক চেতনায় জাতীয় মুক্তির আকাঙ্খার ধারায় বাংলাদেশের দর্শনের ছিল দুইটি দিক, এক. সেক্যুলারিজম দুই. সমাজতন্ত্র। সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতি তত্ত্বকে পরাস্ত করতে তাকে সেক্যুলারিজমের উপর দাঁড়াতে হয়েছে। অপরদিকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধে ব্যপক কৃষক-শ্রমিক মেহনতীদের অংশ গ্রহণ এবং শক্তিশালী সোভিয়েত রাশিয়ার প্রভাবে সমতা ভিত্তিক সমাজ গড়তে সমাজতন্ত্রের আকাঙ্খা জাতির মর্মে শক্তিশালী জায়গা করে নেয়। এ কারণে বুর্জোয়া শেখ মুজিবও রাষ্ট্রের চার মূল নীতিতে ধর্মনিরপেক্ষতা (secularism) ও সমাজতন্ত্র রাখতে বাধ্য হয়েছিলেন।
বাংলাদেশে সাম্যের রাজনীতির দর্শন গড়ে তুলতে মুক্তিযুদ্ধের কালপর্বে এখানে ক্রিয়াশীল কমিউনিস্ট ও বামপন্থী দলগুলোর একটা বড় ভূমিকা ছিল। বিশেষত তাদের ছাত্র সংগঠনের ভূমিকা ছিল আরো জোরাল। লেনিনীয় ভূমিকা পালন করতে না পারায় মুক্তিযুদ্ধে কমিউনিস্টদের প্রভাবশালী অংশগুলো মূল ধারা থেকে ছিটকে পড়ে কিংবা প্রান্তিক ধারায় পরিণত হয়। ছাত্রলীগের সবচেয়ে আপোষহীন এবং অগ্রসর অংশ নিয়ে গঠিত ‘নিউক্লিয়াসের’ মধ্যেও সমাজতন্ত্রের শক্তিশালী প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। এদের নেতা শহীদ স্বপন চৌধুরীর ‘স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের’ প্রস্তাব তার সাক্ষ্য বহন করে। সত্তরের নির্বাচনের পর শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী বানানোর চেয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার দিকে ঠেলে দিতে এরাই মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন।
(সেক্যুলারিজম : সেক্যুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ হিসেবে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ কিংবা ‘অসাম্প্রদায়িকতা’ বলে অনেকে ব্যবহার করছেন। আমার মতে, সেক্যুলারিজমের বাংলা কখনো অসাম্প্রদায়িকতা নয়, এমনকি ধর্মনিরপেক্ষতাও নয়। আমার মতে সেক্যুলারিজমের বাংলা প্রতিশব্দ হল ‘ইহজাগতিকতা’। সেক্যুলারিজমের রাজনৈতিক প্রতিপাদ্য হল, রাষ্ট্র ও রাজনীতিকে সকল সময় ধর্ম থেকে পৃথক রাখতে হবে। ধর্মের ব্যাপারে রাষ্ট্র সকল সময় তার উদাসীন চরিত্রটা বজায় রাখবে। - লেখক)