লিখেছেনঃ হাবিবুর রহমান , আপডেটঃ November 7, 2015, 12:00 AM, Hits: 1019
মত প্রকাশের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ব্লগার, লেখক ও প্রকাশকদের কুপিয়ে হত্যার মহোৎসব চলছে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ও ‘গণতান্ত্রিক’ বাংলাদেশে। এর সর্বশেষ বলি জাগৃতি প্রকাশনীর প্রতিষ্ঠাতা ফয়সাল আরেফিন দীপন। একইদিন ঘাতক দল শুদ্ধস্বর প্রকাশনীর মালিক আহমেদুর রশীদ টুটুলকে গুরুতর আহত করে। সাথে আরও দু’জন – লেখক রণদীপম বসু এবং কবি তারেক রহিম। এরা মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক। এ নিয়ে এই বছরে মাত্র ৮ মাসের মধ্যে ৫জন এ ধরনের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন।
লেখালেখির অপরাধে একের পর এক বীভৎস হত্যাকাণ্ড ঘটছে, অথচ এর কোনটারই সুষ্ঠু তদন্ত হচ্ছে না, গ্রহণযোগ্য ভাবে কোন হত্যাকাণ্ডের বিচার হচ্ছে না। ব্লগার, লেখক ও প্রকাশক হত্যায় এখনো পর্যন্ত একজন অভিযুক্তকেও শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব হয় নি। এ বছর ঘটে যাওয়া ৫টি খুনের কোন আসামীই ধরা পড়ে নি। ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান হত্যার ঘটনায় দুই আসামীকে জনতা ধরে দিলেও তাদের কাছ থেকে পুলিশ কোন তথ্যই বের করতে পারে নি। বিচার না হবার যে ইতিহাস গড়ে উঠেছে বাংলাদেশে, সেটা এবং সেই সঙ্গে সরকারের এসব হত্যাকাণ্ডকে গুরুত্ব না দেবার অদ্ভুত ও বিপজ্জনক প্রবণতা হত্যাকারীদের উৎসাহ-উদ্দীপনা দিয়ে চলেছে।
সরকারের ঊর্ধ্বতনরা ঘোষণা দিয়ে বলেন যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া যাবে না। পেনাল কোড ও আই সি টি আইনে শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু ধর্মীয় অনুভূতির কোন ব্যাখ্যা দেয়া হয় নি। স্পষ্ট করা হয় নি ধর্মের পর্যালোচনা করা যাবে কি না। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার নামে ব্যক্তির মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ সংবিধানের মৌলিক অধিকার ভাগের বিধানাবলীর সাথে মেলে না। সরকার যদি ধর্মীয় অনুভূতির ব্যাপারে আরও পরিষ্কার ও আন্তরিক হয় তবে আইন করতে পারে, যেমন ব্লাশফেমি আইন। এতে জনগণ পছন্দ করুক আর না করুক মানতে বাধ্য হবে। তাতে সুবিধা হবে এই যে, এখন পরোক্ষভাবে খুনিদের যে অধিকার দেয়া হয় তা থেকে জনগণ মুক্ত হবে। যদি কেউ আইন ভঙ্গ করে তবে জেনে শুনেই অপরাধটি করবে। অন্তত এধরনের গুপ্ত হত্যার শিকার হওয়ার আশংকা থেকে মুক্ত হতে পারবে। সরকারের পক্ষ থেকে যদি কোনভাবে স্বীকৃতি দেয়া হয় যারা ব্লগার অর্থাৎ নাস্তিক তারা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানে, অতএব তাদের খুন করা জায়েজ, স্বভাবতই তা খুনিদের অনুপ্রাণিত করবে। এক্ষেত্রে খুনিরা এবং সরকার তখন এক পক্ষ হয়ে যায়।
আর একটি বিপজ্জনক দিক হল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীসহ অনেকে এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দিতে চান। এ ধরনের আক্রমণ মত প্রকাশের ওপর আক্রমণ। এগুলো ধারাবাহিক ঘটনা এবং সুপরিকল্পিত ভাবে ঘটানো হচ্ছে। এগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলা চোখ বন্ধ করে রাখার শামিল যা খুনি ও খুনের পরিকল্পনাকারীদের অনুপ্রাণিত করে এবং সমস্যার মূল থেকে দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়। এ ক্ষেত্রে ড. জাফর ইকবালের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সমালোচনা করে বলেছেন, একসঙ্গে দুই জায়গায় দুইজন প্রকাশকের ওপর হামলা করা হয়েছে। এটাকে বিচ্ছিন্ন বলা হয় কি ভাবে? হয় আমি বিচ্ছিন্নের মানে জানি না অথবা উনি বিচ্ছিন্নের মানে বুঝেন না। তিনি আরও বলেছেন, সেই অভিজিৎ থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের কাউকে ধরতে পারে নাই। আমি এটাকে বিশ্লেষণ করি এভাবে – কোন একটা কারণে সরকার মনে করে যে এদের ধরার দরকার নেই। তা হলে এর পরের প্রশ্ন কেন?
দীপনের বাবা অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক ছেলের লাশের সামনে দাঁড়িয়ে বলেছেন, আমি পুত্র হত্যার বিচার চাই না। এ কথার সাথে ঐকমত্য পোষণ করে অভিজিতের স্ত্রী বন্যা বলেছেন, ‘আমিও আমার স্বামী হত্যার বিচার চাই না। আমি নিশ্চিত জানি, টুটুলের স্ত্রী, দীপনের স্ত্রী, অনন্তের বোন, রাজিব, বাবু, নিলয়ের বন্ধুরাও তার বিচার চান না। এই সরকারের কাছে আমাদের কিছু চাওয়ার নেই। তাদের কাছে একটাই অনুরোধ, দয়া করে দিন-রাত আর ‘আমরা সেক্যুলার পার্টি’ বলে গলা ফাটিয়ে নিজেদের এনার্জি নষ্ট করবেন না। আপনারা আপনাদের লক্ষ্যে চুপ করেই থাকুন; অভিজিৎ, বাবু, অনন্ত, নিলয়, দীপনরা আপনাদের জন্য একটি স্কোর কার্ড’। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক তাই জঙ্গি, আই এস ইত্যাদিকে অভিযোগ করেন নি। অভিযোগ করেছেন দেশের বুকে দোনলা বন্দুকের মতো তাক করে থাকা দুই শক্তিকে। তিনি যথার্থই বলেছেন, যারা ধর্মনিরপেক্ষবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, আর যারা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন – এই উভয়পক্ষই দেশের জন্য সর্বনাশ করছেন।
দেশে দোষারোপের রাজনীতি চালু হয়েছে। তদন্ত শুরুর আগেই সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে কারা দায়ী বলে দেয়া হয়। ফলে তদন্ত সুষ্ঠু, সঠিক ও স্বচ্ছ হবার পরিবেশ থাকে না। প্রতি ঘটনার পর সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল ও আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায় একই রকমের গৎবাঁধা বুলি শোনা যায়। বস্তুত, এদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থের নিকট বলি হচ্ছে মেধাবী মুক্ত মনের মানুষ। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মকে প্রতারণার উদ্দেশে ব্যবহার করলে সেটা দিয়ে সুখকর কিছু হবে না। তিনি যথার্থই অনুধাবন করেছেন যে বিষয়টি সম্পূর্ণ রাজনৈতিক, সম্পূর্ণ সাংস্কৃতিক। তিনি এই সত্যটাই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন, বিচার ও বিচারহীনতা নিছক আইন শৃঙ্খলার বিষয় নয়, এটি রাজনীতি দ্বারা নির্ধারিত হয়। এ কারণেই রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক শুভবুদ্ধির উদয় দেশের জন্য জরুরী।
যুগে যুগে সত্য প্রকাশে অকুতোভয়, সময়ের সাহসী সৈনিকেরা সমাজকে হাতে ধরে নিয়ে যেতে চেয়েছেন সামনের দিকে, অন্ধকার থেকে আলোর দিকে। পশ্চাৎপদ, হীন স্বার্থপর গোষ্ঠী তাদেরকে সহ্য করতে পারে নি। এরা হাইপেশিয়াকে আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় হায়েনার হিংস্রতায় ছিন্ন ভিন্ন করেছে। ব্রুনোকে জলন্ত আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। সক্রেটিসকে বিষ পানে মৃত্যু বরণ করতে হয়েছে। কিন্তু তাই বলে সত্য প্রকাশের অভিযাত্রা থেমে থাকে নি। তাই যখন গুরুতর আহত আহমেদুর রশীদ টুটুল বলেন, ‘আমি পিছু হটব না’, তখন তিনি চিরকালের সত্য কথাটাই উচ্চারণ করেন। অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক যখন বলেন, ‘আমি কোন বিচার চাই না’ তখন তা সময়ের সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিবাদ হয়ে উঠে। ইতিহাসকে পিছনে ঠেলে দেয়া যায় না। সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।