লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ November 7, 2015, 12:00 AM, Hits: 2028
হামলা ও খুন
সম্প্রতি কিছু কাল ধরে বাংলাদেশে ইসলামবাদীদের দ্বারা এমন কিছু গুপ্ত হামলা ও হত্যা সংঘটিত হয়েছে যেগুলির ধরন এবং টার্গেট দেখে এগুলির ইসলামী উৎস ও বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা করা যায়। বুঝা যায় খুনীদের বা হামলাকারীদের প্রধান লক্ষ্যবস্তু মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার ও প্রকাশক এবং অতঃপর মূল ইসলামী ধারা বিচ্যুত মুসলমানরা এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরা।
মুক্তচিন্তার উপর আক্রমণ অবশ্য সাম্প্রতিক নয়। অনেক কাল আগে ১৯৯৯ সালের জানুয়ারীতে ইসলামী জঙ্গী সংগঠন হরকাত-উল-জিহাদ-আল-ইসলামী মুক্ত বা উদার চিন্তার জন্য কবি শামসুর রহমানকে হত্যার জন্য আক্রমণ করলেও তিনি বেঁচে যান। আরও পরবর্তী সময়ে ২৭ ফেব্রুয়ারী, ২০০৪-এ লেখক হুমায়ুন আজাদের উপর আক্রমণের পর একটা দীর্ঘ বিরতি গিয়েছিল। ঐ আক্রমণের ফলে অল্প কিছুদিন পর তার মৃত্যু হয়। এটা সহজে বুঝা গিয়েছিল মৌলবাদী মুসলমানরা ঐ আক্রমণ বা হামলার পিছনে ছিল। তবে তার উপর হামলা ও খুনের কোনও বিচার এ দেশে হয় নাই।
কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ইসলামবাদীদের আক্রমণগুলি অনেক প্রবল এবং সুসংগঠিত ভাবে পরিচালিত হচ্ছে বলে বুঝা যায়। ব্লগ লেখক আসিফ মহিউদ্দিন বা গ্রন্থ প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুলের মত ভাগ্যবানেরা গুরুতরভাবে জখম হয়ে বেঁচে গেলেও আহমেদ রাজীব হায়দার বা অভিজিৎ রায়ের মত লেখকরা বাঁচতে পারেন নাই। রাজীব হায়দার লিখতেন থাবা বাবা ছদ্মনামে। তাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয় ২০১৩ সালের ১৫ ফেব্রুয়ীতে। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচালিত ‘মুক্তমনা’ ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক এবং খ্যাতনামা মুক্তচিন্তার লেখক অভিজিৎকে হত্যা করা হয় ২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারীতে।
এটা খুব লক্ষ্যণীয় যে, এই ধারাবাহিকভাবে লেখক ও ব্লগার বা অনলাইন এক্টিভিস্টদের উপর আক্রমণের সূচনা হয়েছে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারীতে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি এবং ফাঁসীর দাবীতে শাহবাগ চত্বরে গণজাগরণ মঞ্চের উত্থানের পর। এই যুদ্ধাপরাধীরা ছিল প্রধানত জামাতের নেতা-কর্মী। একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে তাদের জাতিদ্রোহী ও দেশদ্রোহী ভূমিকা এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের কঠোর শাস্তির দাবীতে যখন লক্ষ লক্ষ মানুষ গণজাগরণ মঞ্চের পিছনে জমায়েত হল তখন দেখা গেল একেবারে সামনে না এলেও মুক্তচিন্তার লেখক ও ব্লগারদের খুব বড় অংশ গণজাগরণ মঞ্চের যুদ্ধাপরাধের বিচারের আন্দোলনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বস্তুত এই আন্দোলনের শুরুটা হয়েছিল ব্লগ ও ফেসবুকে অনলাইন লেখক ও ফেসবুক ব্যবহারকারীদের নিজেদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে। এটা এ দেশের আন্দোলনে এক সম্পূর্ণ নূতন ধারার সংযোজন ঘটায়। কারণ ব্লগ ও ফেসবুকের মত অনলাইনে লেখালেখি ও সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এই আন্দোলনের সূচনা ঘটে, যা এ দেশে অতীতে কখনও ঘটে নাই। এবং আন্দোলনের শুরুটা হয় তখন যখন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গুরুতর অপরাধী মীরপুরের কসাই খ্যাত কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়। শাহবাগ আন্দোলনের চাপে কাদের মোল্লার রায় পরিবর্তন করে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছিল ’৭১-এর উত্তরাধিকার ধারণকারী জনমতের এক বিরাট বিজয়।
এই আন্দোলনের সময় জামাতে ইসলামী এবং হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিএনপি এবং তার নেতা খালেদা জিয়াও গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলনকে নাস্তিকদের আন্দোলন হিসাবে আখ্যায়িত করে তার বিরোধিতা করেন। এভাবে বিএনপি এ দেশের স্বাধীনতা বিরোধী এবং ধর্মান্ধ শক্তির সঙ্গে একীভূত শক্তি হিসাবে নিজেকে দেশবাসীর সম্মুখে চিহ্নিত করে। স্বাভাবিকভাবে আওয়ামী লীগ সরকার তার সুযোগ নিয়েছে। এখন তা তার প্রধান শত্রু বিএনপি-এর উপরও আজ অবধি সংঘটিত এ ধরনের প্রায় সব হত্যা-হামলার দায়ভার চাপানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে।
বিজ্ঞানমনস্ক ও ধর্মীয় প্রশ্নে মুক্তচিন্তার অধিকারী হিসাবে পরিচিত বেশ কয়েক জন লেখক, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টকে সাম্প্রতিক কালে হত্যা অথবা হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা ও জখম করা হয়েছে। কয়েকজন মুক্তচিন্তার লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্টকে হত্যার পর সেই তালিকায় এখন যুক্ত হল মুক্তচিন্তার বই প্রকাশকও। হত্যার এই ধারায় গত ৩১ অক্টোবর, ২০১৫-তে দুপুর আড়াইটার দিকে ঢাকার শাহবাগের নিকটবর্তী জনাকীর্ণ আজিজ মার্কেটের নিজ অফিসে খুনীদের ছুরিকাঘাতে নিহত হন জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সাল আরেফিন দীপন। একই দিনে প্রায় একই সময়ে ঢাকার লালমাটিয়ার নিজ অফিসে প্রকাশনা সংস্থা শুদ্ধস্বরের প্রকাশক আহমেদুর রশীদ টুটুল ছুরি, চাপাতি ও পিস্তল ধারী হামলাকারীদের দ্বারা আক্রান্ত ও গুরুতর আহত হয়েও বেঁচে গেলেও তিনি এখন হাসপাতালে। তার সঙ্গে আহত হয়েছেন সঙ্গে বসে থাকা আরও দুইজন লেখক। আহতদের সংখ্যা বাদ দিলেও গত আড়াই বছরে সারা দেশে নিহত মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার ও প্রকাশকের সংখ্যা এখন সাত।
গত ২৪ অক্টোবর শনিবার গভীর রাতে মুহর্রম উপলক্ষ্যে শিয়া সম্প্রদায়ের তাজিয়া মিছিলের প্রস্তুতি চলাকালে বোমা হামলায় নিহতের সংখ্যা দুই আর শিশুসহ আহত হয়েছে দেড় শতাধিক যাদের কয়েকজন এখনও হাসপাতালে। একদিকে যখন চলছে লেখক ও প্রকাশকদের উপর হামলা এবং ঘটেছে শিয়াদের উপর বোমা হামলা তখন দেখা যাচ্ছে পুলিশও এই হামলার হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না। অল্পকিছু দিন আগে গাবতলীতে পুলিশের উপর হামলা ও হত্যার পর সাভারের আশুলিয়ায় ছুরি ও চাপাতির আঘাতে একজন পুলিশ কনস্টেবলকে হত্যা ও অপরজনকের কুপিয়ে জখম করা হয়। এর মধ্যে আবার দুই বিদেশী নাগরিককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। একজন ইতালীর, অপরজন জাপানের নাগরিক।
পুলিশের উপর হামলার প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুমান করা যেতে পারে যে এগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ভীত ও সন্ত্রস্ত করা বা তাদের মনোবল ভেঙ্গে ফেলা। কিন্তু শিয়াদের উপর হামলা? সেটা কারা করতে পারে? সহজ কারণে আঙ্গুলের ইশারা যায় কোনও অজ্ঞাত সুন্নী মুসলমান গোষ্ঠীর দিকে। সেটার উদ্দেশ্য কি রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করা? নাকি, এটার উদ্দেশ্য প্রধানত ধর্মীয়? যে কারণে ইতিপূর্বে কয়েক জন পীর ও পীরের অনুসারী এবং ইসলাম ধর্মীয় শাস্ত্রবিদকে তাদের ধর্মীয় অনুশীলন এবং ইসলাম সংক্রান্ত ব্যাখ্যার জন্য হত্যা করা হয়েছিল বলে সন্দেহ করা হয়। তাহলে ব্যাপারটা এই দাঁড়াচ্ছে যে, এক বা একাধিক শক্তিশালী গোষ্ঠী কিছু সংখ্যক হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, যাদের উদ্দেশ্য একই সঙ্গে দুইটি হতে পারে, যে দুইটির একটি হচ্ছে ধর্মীয় ̶ অর্থাৎ মুসলমান নয় অথবা ধর্মবিশ্বাসমুক্ত কিংবা ইসলাম সংক্রান্ত তাদের ব্যাখ্যার সঙ্গে যাদের ব্যাখ্যা মিলে না তাদেরকে হত্যা ও নির্মূল করা, অপরটি হচ্ছে রাজনৈতিক ̶ রাষ্ট্রকে তাদের লক্ষ্য সাধনের জন্য অস্থিতিশীল করা।
এবার আসা যাক লেখক ও প্রকাশকদের ব্যাপারে। এটা স্পষ্ট যে প্রকাশকরা স্বঘোষিতভাবে ধর্মে অবিশ্বাসী কিংবা নাস্তিক হিসাবে পরিচিত না হলেও যারা নিহত হয়েছেন অভিজিৎসহ সকল লেখক ও অনলাইন এক্টিভিস্ট তা-ই। তারা সবাই নিজেদেরকে যুক্তিবাদী ও নিরীশ্বরবাদী হিসাবে দাবী করেছেন এবং ধর্মীয় অন্ধ বিশ্বাসের বিরুদ্ধে তাদের তীক্ষ্ণধার লেখা অনেকের পরিচিত। এদের হত্যার সঙ্গে রাষ্ট্রকে অস্থিতিশীল করার উদ্দেশ্য কতটা সম্পৃক্ত সেই প্রশ্ন সঙ্গত কারণেই করা যায়। বরং সহজেই সন্দেহের তীর নিক্ষিপ্ত হয় জিহাদী তথা জঙ্গী ইসলামী গোষ্ঠীর প্রতি, যারা জিহাদের অংশ হিসাবে এবং ভিন্ন মতাবলম্বীদের নিশ্চিহ্ন ও নিস্তব্ধ করার জন্য কাপুরুষোচিতভাবে এইসব গুপ্তহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। হতে পারে যে তাদের লক্ষ্য এইসব হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এমন এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করা যাতে তারা বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে এখানে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
এইসব হত্যা ও হামলার কি কোনও নির্দিষ্ট প্যাটার্ন বা বিন্যাস বের করা যায়? এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন। কারণ তাহলে যেসব দেশী বা বিদেশী শক্তি এইসব হত্যা ও হামলার পিছনে ক্রিয়াশীল থাকতে পারে তাদের সম্পর্কে একটা ধারণা পাবার চেষ্টা করা যায়। তাতে পুরা সত্যকে ধরা না গেলেও কিছুটা কাছাকাছি একটা জায়গায় যাওয়া যেতে পারে।
হামলা-হত্যার প্যাটার্ন
বাংলাদেশে এখন হত্যা, সন্ত্রাস ও হানাহানি খুব স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। সেগুলিকে আমাদের আলোচনায় না নিয়ে সাম্প্রতিক যেসব হামলা ও খুনকে জিহাদী বা ইসলামী হামলা ও খুন হিসাবে মনে করার কারণ আছে সেগুলি নিয়ে কিছু আলোচনা করলে হয়ত হামলা-খুনের এক অথবা একাধিক প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যেতে পারে।
সে ক্ষেত্রে আমরা কী দেখতে পাই? মোটামুটি চারটি ধারায় হামলাগুলিকে ফেলা যায়। একটা হচ্ছে মুক্তচিন্তার লেখক, ব্লগার ও অনলাইন এক্টিভিস্টদের উপর হামলা। সর্বশেষে অভিজিতের প্রকাশক দীপন হত্যা ও টুটুলের উপর হত্যার উদ্দেশ্যে হামলার মাধ্যমে মুক্তচিন্তার গ্রন্থ প্রকাশকদেরকেও হত্যার লক্ষ্যবস্তু করা হল। এই ধারার মধ্যে আমরা ফেলতে পারি ধর্ম বিশ্বাসহীন বা মুক্তচিন্তার লেখক ও তাদের গ্রন্থ প্রকাশকদেরকে।
অপরটা হচ্ছে ইসলাম চিন্তার ভিতরকার দ্বন্দ্বের বহিঃপ্রকাশ হিসাবে বিভিন্ন পীর ও ধর্মীয় নেতা ও শিয়া সম্প্রদায়ের উপর হামলা। অনুমান করা যেতে পারে যে, ইসলামের সালাফী বা ওয়াহাবী সুন্নী ধারার কোন গোষ্ঠী এই হামলাগুলি পরিচালনা করেছে।
তৃতীয় ধারা হচ্ছে পুলিশ তথা রাষ্ট্রযন্ত্রকে লক্ষ্যবস্তু বা টার্গেট করে হামলা এবং হত্যা। গাবতলী ও সাভারের আশুলিয়া এই দুই জায়গায় কয়েক দিনের ব্যবধানে দুই জন পুলিশ সদস্য নিহত হয়েছেন।
চতুর্থ ধারা হচ্ছে বিদেশীদের উপর হামলা। তাভেল্লা সিজার নামে একজন ইতালীয় নাগরিক ও কুনিও হোশি নামে একজন জাপানী নাগরিক এর মধ্যে নিহত হয়েছেন। অথচ দাবী করা হয়েছে যে জাপানী নাগরিক কুনিও হোশি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। তারপরও তাকে হত্যা করা হয়।
ইতিমধ্যে পাবনার ঈশ্বরদীতে একজন খ্রীষ্টান পাদ্রীর উপর হামলা করে তার গলা কাটা হলেও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। এর জন্য কয়েকজন জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতারও করা হয়েছে। এটাকে কোন ধারায় ফেলব?
যেহেতু খ্রীষ্টানরাও ইসলামের বিচারে কাফের সেহেতু জেএমবি-এর মত জিহাদী গোষ্ঠীর পক্ষে এই হত্যাচেষ্টা চালানো স্বাভাবিক। এটা ইসলাম প্রসারের জন্য জিহাদের অংশ। মুক্তচিন্তার লেখক ও প্রকাশকদের মত খ্রীষ্টান পাদ্রী বা ধর্মগুরুও একজন কাফের। অবশ্য এই কাফেরের বৃহত্তর সংজ্ঞায় শিয়া কিংবা ইসলামের ভিন্ন ধারার অনুসারীরাও পড়ে। আর সেই কারণে পীররাও তাদের টার্গেট হয়। কারণ এই পীরদের অনেকে ইসলামের কিছুটা নমনীয় ব্যাখ্যা এবং কিছুটা ভিন্ন আচরণবিধি দেওয়ার চেষ্টা করে যেটা কুরআন ও সুন্নার খাঁটি অনুসারীরা সহ্য করতে পারে না। সুতরাং ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য তারা যখন জিহাদ শুরু করে তখন তাদের টার্গেট কাফেরদের মধ্যে শুধু বস্তুবাদী-যুক্তিবাদী কিংবা মুক্তচিন্তার মানুষরা পড়ে না শিয়াসহ এই ধরনের ভিন্ন ধারার মুসলমানরাও পড়ে। তখন ইসলামের শুদ্ধতার চর্চা করতে গিয়ে তারা তাদের বিবেচনায় ইসলামের অশুদ্ধ চর্চাকারীদেরকেও কতল করতে দ্বিধা করে না। প্রথমে দাওয়াত তথা বুঝিয়ে ইসলামের পথে আসবার আহ্বান জানানো, তাতে কাজ না হলে কতলের ইসলামী বিধান প্রয়োগের মধ্যে তারা কুরআন-হাদীসের শিক্ষা অনুযায়ীই অন্যায় কিছু দেখতে পায় না।
যাইহোক, সরকার বা রাষ্ট্র যে কী করছে সে তো সবাই দেখতে পাচ্ছে। সুতরাং আমাদেরকে প্যাটার্ন বা ছক খুঁজতে হচ্ছে। অবশ্য সরকার বা রাষ্ট্র একাও সব করতে পারে না। তবে তাদের আন্তরিকতা নিয়ে যে প্রশ্ন প্রথম দিক থেকেই ছিল সেটা এখন প্রায় সর্বমহলে উঠছে। রাষ্ট্রের ভিতরেও যে এই সব হামলার ঘটনায় প্রশ্রয় থাকতে পারে সে কথাও উঠছে এখন রাষ্ট্রেরই ভিতর থেকে। কারণ কথাটা বলেছেন মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান ডঃ মিজানুর রহমান। মানবাধিকার কমিশন রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান; সুতরাং রাষ্ট্রেরই একটা অংশ। ডঃ মিজান গত ২ নভেম্বর ২০১৫ তারিখে ফেনীতে বলেন, ‘প্রকৃত অপরাধীদের ধরতে ব্যর্থ হওয়ায় একের পর এক ব্লগার খুন হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোন মহল খুনীদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে কিনা তা প্রমাণের জন্য নিজেদের খতিয়ে দেখতে হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘জনগণের মনে এই সন্দেহটি জাগা অস্বাভাবিক নয় যে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যেও এমন কোনো দুষ্ট চক্র লুকিয়ে আছে, যারা এই অপরাধীদের আশ্রয়-প্রশ্রয় দিচ্ছে।’ (আমাদের সময়, মঙ্গলবার, ৩ নভেম্বর, ২০১৫; ১৯ কার্তিক, ১৪২২)।
যাইহোক, এই প্যাটার্ন বা বিন্যাস খুঁজবার সময় আমরা যেন এ কথা ভুলে না যাই যে একবার সন্ত্রাস ব্যাপকায়তন বা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নিলে সেটার একক বা অভিন্ন প্যাটার্ন নাও থাকতে পারে। এখানে আরও বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠী বা শক্তি এসে যোগ দিতে পারে। তারা নিজেরা পরস্পর বিরোধীও হতে পারে। এই বঙ্গের মানুষ হিসাবে আমরা ঘোলা জলে মাছ শিকার কথাটার তাৎপর্য বুঝি। অবশ্য এক সময় যখন প্রায় সর্বত্র গ্রাম বা গ্রামীণ পরিবেশ ছিল এবং যত্রতত্র ছিল অনেক নদী-নালা-খাল-বিল-জলা তখনকার কথা এটা। অনেক মানুষের পদচারণা বা ছুটাছুটিতে কাদা হয়ে উঠা বিল বা জলাভূমিতে যারা মাছ ধরেছেন বা মাছ ধরা দেখেছেন তারা এই উপমার তাৎপর্য আরও সহজে বুঝবেন। জল ঘোলা হলে পোলো বা বাঁশে বাঁধা ছোট জাল দিয়ে মাছ ধরতে খুব সুবিধা হয়। কাদাজলে মাছ না পারে ভালভাবে অক্সিজেন নিতে, না পারে দেখতে। ফলে খাবি খায়। সেই সময় এমনকি হাত দিয়েও মাছ ধরা যেতে পারে। আর এই সহজে হাত দিয়ে মাছ ধরার জন্য অনেক দর্শকও কাপড় বাঁচাবার চিন্তা না করে পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তো এখন দেশে যদি এমন হয় যে সন্ত্রাস সেটা ধর্মীয় হোক আর যা-ই হোক এমন সহজ ও অনিয়ন্ত্রিত পর্যায়ে চলে গেছে তবে অনেক নূতন খেলোয়াড়ও এই খেলায় যোগ দিতে পারে। এর ফলে সন্ত্রাসের আদি বা শুরুর রূপ ও উদ্দেশ্য সর্বত্র বজায় নাও থাকতে পারে। বিশেষত এই রকম পরিস্থিতিতে বিভিন্ন বিদেশী শক্তিও তাদের স্বার্থে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কৌশলী অংশীদার হতে পারে কিংবা দূর থেকে হলেও তাতে খুব সূক্ষ্মভাবে কলকাঠি নাড়তে পারে।
বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ জিহাদী বা ইসলামী জঙ্গী রাজনীতির সঙ্গে আন্তর্জাতিক রাজনীতির যোগসাজশ ঘটাটা খুব স্বাভাবিক। আর সে ক্ষেত্রে শুধু বিরোধী দল কেন সরকারী দল তথা খোদ সরকারের মধ্যেও কোনও অংশের সঙ্গে এই ধরনের হত্যা-হামলার যোগসূত্র থাকা স্বাভাবিক। বিশেষত বিনা শাস্তিতে, বিনা বিচারে যেভাবে অপ্রতিরোধ্যভাবে খুন ও হামলাগুলি হয়ে চলেছে তাতে রাষ্ট্র এবং সরকারের ভিতরেও এগুলির পৃষ্ঠপোষকতা বা কৌশলী সমর্থন আছে তেমন ভাবাটা অযৌক্তিক নয়।
যাইহোক, এই সব হত্যা ও হামলার মধ্যে সবচেয়ে যেটা লক্ষ্যণীয় সেটা হচ্ছে সমাজের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ, যারা লেখনীর মাধ্যমে জনমতকে প্রভাবিত করে, তাদেরকে হামলার প্রধান লক্ষ্যবস্তু করা। আওয়ামী লীগের এবং আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবীদের সেকিউলারিজমের নামে ভণ্ডামির পরিবর্তে যারা এ দেশে সেকিউলারিজমের প্রকৃত চর্চাকে নূতন একটি মাত্রা দিয়েছিল তাদেরকে হত্যার প্রধান টার্গেট করাটা অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ।
যাইহোক, আমি এখন খুন-হামলাগুলির ভিতর থেকে একটা বিন্যাস বা প্যাটার্ন বের করে নিতে চেষ্টা করব। মোটা দাগে যে চার ধারায় আমি এখানে হামলাগুলিকে ফেলার চেষ্টা করেছি সেগুলির মধ্যে নির্দিষ্ট কোনও প্যাটার্ন বের করা যায় না, একটা প্যাটার্ন ছাড়া, সেটা হচ্ছে মৌল ইসলামের চর্চা বা অনুশীলন। আরও নির্দিষ্ট করে বললে জিহাদ অর্থাৎ প্রকৃত ইসলাম কায়েমের উদ্দেশ্যে শেষ ও চূড়ান্ত পন্থা হিসাবে সহিংসতার আশ্রয় গ্রহণ, আইসিস বা আইএস যেটা ইরাক বা সিরিয়ায় করছে, কিংবা তালেবান করছে আফগানিস্তানে, বোকোহারাম করছে নাইজিরিয়া, কেনিয়ায়, ইত্যাদি। তবে ইসলামের আরও কিছু অনুষঙ্গের চর্চা জিহাদীরা বাংলাদেশে এখনও করতে পারছে না যেমন লুণ্ঠন ও নারী ধর্ষণ। কারণ এর জন্য যে দখলী এলাকা লাগে সেটা এখনও সেভাবে এ দেশে করতে পারছে না। করতে পারলে যে এখানকার জিহাদীরাও আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, নাইজিরিয়া ইত্যাদি দেশের মত বাংলাদেশেও সেগুলি ঘটাবে তাতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নাই। কারণ এগুলি সবই ইসলামের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এদেশে তখন ১৯৭১-এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে নূতন করে।
যাইহোক, প্রশ্ন রয়ে গেল। তাহল নিরীশ্বরবাদী এবং মুক্তচিন্তার মানুষরা কেন জিহাদীদের প্রধান টার্গেট হল। উত্তরটাও এর আগে এসেছে। প্রকৃতপক্ষে অন্ধ ধর্মবিশ্বাস থেকে মুক্ত, যুক্তিবাদী এবং মুক্তচিন্তার মানুষরা লোকবাদী বা প্রকৃত সেকিউলার বাংলাদেশের আদর্শিক ভিত্তি নির্মাণে একটি ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। ইসলামী পৃথিবীর কোথায়ও অলোকবাদী ধর্ম এবং ইসলামের বিরুদ্ধে এভাবে ভিতর থেকে বিদ্রোহ হয় নাই। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যতিক্রম। এর তাৎপর্য অপরিমেয়। ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার এটা নবতর ও আরও মূর্ত রূপে আত্মপ্রকাশ।
হাঁ, অনেক প্রগতিশীলতা সত্ত্বেও আমার বিবেচনায় এদের অনেকের চেতনা বা চিন্তার কিছু সমস্যা আছে। তাদের অনেকের চিন্তা রাজনীতি বর্জিত, আবার অনেকের চিন্তা সম্পূর্ণরূপে পাশ্চাত্য রাজনীতি ও জ্ঞানতত্ত্ব নির্ভর। আমাদের দেশের বাস্তবতায় সেটা পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য বজায় রাখতে সাহায্য করে বলে আমি মনে করি। এ দেশে ধর্মের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ ধরনের রাজনীতি বর্জিত কিংবা পাশ্চাত্য নির্ভর চিন্তা কতটা সহায়ক হতে পারে সে প্রশ্নও আমার আছে। তা সত্ত্বেও ধর্মের অন্ধত্ব ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তাদের লড়াইকে আমি প্রশংসার চোখে দেখি। এ দেশে পাশ্চাত্য এবং বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেন্দ্রিক এই ধরনের বুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে ‘মুক্তমনা’ ব্লগ একটা গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান তৈরী করেছে। এই ধারার অনেকে এখন বিশেষ করে ফেসবুককে অবলম্বন করে তরুণ প্রজন্মের ভিতর ব্যাপক যোগাযোগ ও প্রভাব বিস্তার করেছে। এদের কেন্দ্র ‘মুক্তমনা’ ব্লগ। আবার তার প্রাণপুরুষ ছিলেন অভিজিৎ রায়।
এটা বুঝা যায় যে খুনীদের প্রধান টার্গেট ছিল অভিজিৎ রায় এবং সেই সঙ্গে তাকে ও ‘মুক্তমনা’কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা একদল প্রতিশ্রুতিশীল ও সম্ভাবনাময় লেখক। এবং এখন দেখা যাচ্ছে যে শুধু লেখক নয় এমনকি অভিজিতের প্রকাশকরাও তাদের হত্যার টার্গেট। অর্থাৎ অভিজিৎ তাদের প্রধান টার্গেট। অভিজিতের কোনও ভিত্তি বা নাম-নিশানা তারা এ দেশে রাখতে চায় না। তার প্রভাব এবং যোগাযোগও সবই তারা ধ্বংস করতে চায়। সেটা কি পারা যায়? তবু তারা সেই কাজ যে করতে চায় তেমনটা মনে হয়।
কিন্তু কেন? মুক্তমনা গোষ্ঠী ও অভিজিৎকে কি এতই ভয়, নাকি ঘৃণা? এর সঙ্গে কি শুধু জিহাদের সম্পর্ক আছে, নাকি রাজনীতিরও সম্পর্ক আছে? অবশ্য ইসলাম নিজেই একটা রাজনীতি, যা ধর্মকে তার হাতিয়ার করেছে। সুতরাং জিহাদ একই সঙ্গে তার ধর্ম এবং রাজনীতির অংশ। যাইহোক, এটা বুঝা যায় যে, যারা ধর্ম এবং বিশেষত ইসলামের সমালোচক তারা এই খুনীদের প্রধান টার্গেট হয়েছে। এবং এই ধরনের খুনের পিছনে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ধরনের রাজনীতির সংমিশ্রণ থাকতে পারে।
এমন সম্ভাবনা আছে যে, স্থানীয় জিহাদী বা ইসলামী জঙ্গী গোষ্ঠীগুলি যার যার নিজস্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী যার যার মত করে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে। কিন্তু, প্রশ্ন তবু থাকবে? সরকার এবং রাষ্ট্র কেন প্রকৃত অর্থে নিষ্ক্রিয়? তবে কি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের সন্দেহই সত্য যে রাষ্ট্রের ভিতর কোনও অংশ এইসব হত্যার পিছনে আছে পৃষ্ঠপোষকের ভূমিকায়? নাকি, আরও নির্দিষ্ট করে বলতে হবে যে সরকারের ভিতরে একটা অংশ আছে যারা এইসব ঘাতককে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দিচ্ছে? এ কথা তো অনেকেই এখন প্রকাশ্যে বলছেন। সে ক্ষেত্রেও প্রশ্ন আসবে, কিন্তু কেন? সরকারের ভিতর থেকে কেন কেউ এইসব হত্যাকাণ্ডের প্রশ্রয়দাতা হবে? তাদের কী স্বার্থ? কোন রাজনৈতিক স্বার্থে তারা এই ধরনের ঘটনাগুলি ঘটতে দিচ্ছে? অথবা তারা কি ভিন্ন কোনও রাষ্ট্রের পক্ষে কাজ করছে? কিন্তু তারা কেন ভিন্ন কোনও রাষ্ট্রের স্বার্থ রক্ষার দায়িত্ব নিয়ে এ কাজ করবে? আর সেই রাষ্ট্রেরই বা কী লাভ এইসব হত্যায়? অনেক প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নাই। আমরা শুধু চিন্তা করতে পারি। চিন্তাকে তো আর থামিয়ে রাখা যায় না।
তবে ঘটনা যেটাই হোক সরকার কিন্তু এইসব হত্যার দায় এড়াতে পারবে না। আর সেই কথাই দীপনের পিতা অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক বলেছেন পুত্রহত্যার বিচার না চাওয়ার কথা বলে। এটা সরকার এবং রাষ্ট্রের প্রতি কতখানি ধিক্কারের কথা তা বুঝবার ক্ষমতা মাহবুবউল আলম হানিফের মত কাণ্ডজ্ঞানহীন শীর্ষস্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতার না থাকতে পারে, কিন্তু যারা নিজেদের বিবেক এবং কাণ্ডজ্ঞান বিসর্জন দেন নাই তারা প্রত্যেকেই বুঝবেন। একই ভাবে এই রাষ্ট্র এবং সরকারের প্রতি ধিক্কার প্রকাশ করেছেন অভিজিতের স্ত্রী বন্যা। তিনিও বলেছেন যে তিনি তার স্বামী অভিজিতের হত্যার বিচার চান না।
হামলা, খুন ও সরকারী ভূমিকার ফলাফল
বিদেশী নাগরিক, পুলিশ, শিয়া কিংবা ইসলামী বিভিন্ন ধারা-উপধারার মধ্যকার দ্বন্দ্বের কারণে হত্যাগুলির বিষয়ে আমি এখন কথা না বলে যে প্রশ্ন করব সেটা হচ্ছে কম্পিউটার-ইন্টারনেটের যুগে সনাতন ইসলামী কায়দায় লেখক বা প্রকাশকদেরকে এভাবে হত্যা করে কি ইসলাম কিংবা ধর্মের সমালোচনা এবং মুক্তচিন্তার চর্চা বন্ধ করা সম্ভব? ধর্ম এবং ইসলাম সমালোচনাকারী অসংখ্য ওয়েবসাইট এবং ব্লগ এখন পৃথিবীময় চালু আছে। ইসলাম ওয়াচ (www.islam-watch.org) বা ফেইথফ্রীডম (www.faithfreedom.org)-এর মত বিশ্বময় পরিচিত ও জনপ্রিয় ইংরাজী ওয়েবসাইটগুলির কথা বাদ দেওয়া যাক। মুক্তমনা (www.mukto-mona.com) এবং ধর্মকারী (www.dhormockery.net/com)-এর মত জনপ্রিয় বাংলা ওয়েবসাইটের লেখক-প্রকাশকদেরকে জিহাদীরা খুন করবে কী করে?
উপরে উল্লিখিত বাংলা ওয়েবসাইট দুইটির কোনটিই বাংলাদেশ থেকে প্রচারিত হয় না। বুঝা যায় স্বনামে যেসব লেখক লিখেন তারা কেউ বাংলাদেশে থাকেন না। জিহাদীরা তাদেরকে ধরবে এবং মারবে কী করে? আর বাংলাদেশে থেকে ছদ্মনামে লিখলে তাদের চিনা বা ধরা যাবে কী করে? যারা মুদ্রিত বইয়ের লেখক ও প্রকাশকদের হত্যার পথ বেছে নিয়েছে তাদের এইটু্কু কাণ্ডজ্ঞানও নাই যে আজকের যুগে আর এভাবে কোনও চিন্তার চর্চাকে বন্ধ করা যায় না। বরং এ ধরনের হত্যা ঘৃণা ও প্রতিরোধের শক্তিকেই বৃদ্ধি করে। এক সময় সেটা জাগিয়ে তুলতে পারে ভয়ঙ্কর প্রতিশোধ স্পৃহাকে।
বাংলাদেশের অনেক লেখক এবং ব্লগার ইতিমধ্যে পশ্চিম ইউরোপে বা কানাডা ইত্যাদি দেশে চলে গেছেন। সেখান থেকে তারা নূতন উদ্যমে লিখবেন, ইতিমধ্যে শিখতে শুরুও করেছেন অনেকে। বিশেষত আজকের দিনে একটি অনলাইন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বাংলাদেশে খুব জনপ্রিয় হয়েছে ̶ সেটি হচ্ছে ফেইসবুক। এখন জিহাদী খুনীরা ফেসবুককে আক্রমণ বা খুন করবে কীভাবে? বরং এদের সহিংস কর্মকাণ্ড বিদেশে অবস্থানকারী ধর্মে অবিশ্বাসী লেখক ও চিন্তকদেরকে আরও আক্রমণাত্মক করে তুলছে। বিভিন্ন ওয়েবসাইট এবং ফেসবুকের মাধ্যমে ইসলাম ও মুহাম্মদের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করে যে সব লেখক ছদ্মনামে এবং স্বনামেও লিখতে শুরু করেছে তাদেরকে তারা আক্রমণ ও হত্যা করবে কীভাবে? অন্যদিকে, ধরা যাক বাংলাদেশ সরকার এবং রাষ্ট্র ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে ৫৭ ধারায় তাদেরকে পাকড়াও করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল। তখন কী হবে? সরকার এবং রাষ্ট্র নিজেই কি নিজেকে তামাশার সামগ্রী করবে না? নাকি সরকার বাংলাদেশকে পৃথিবীর একমাত্র ইন্টারনেট বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র হিসাবে ঘোষণা করবে?
বস্তুত জিহাদীদের সাম্প্রতিক হত্যা ও হামলা এবং একই সঙ্গে এগুলির সমান্তরালে সরকার ও রাষ্ট্রের প্রায়শ নিষ্ক্রিয় এবং এমনকি অনেক সময় এগুলির প্রতি প্রশ্রয়মূলক এবং লেখকদের বিরুদ্ধে হুমকি ও হয়রানীমূলক ভূমিকা সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতি যে অবিশ্বাস, সন্দেহ ও অনাস্থার জন্ম দিয়েছে তার ফলে ইতিমধ্যে অনেক মুক্তচিন্তার লেখক বিদেশে চলে গিয়েছেন। আরও অনেকে যাবার চেষ্টা করছেন। এখন বিদেশে গিয়ে এদের লেখনী বন্ধ করার দায়িত্বটা কোন্ জিহাদী বা কোন্ সরকার নিবে? এটা এখন স্পষ্ট যে, বিদেশে গিয়ে এইসব লেখক নিজেদেরকে একটু গুছিয়ে অনেক বেশী সংগঠিত ও আক্রমণাত্মকভাবে ধর্ম বিশেষত ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযানে নামবে। একটু লক্ষ্য করলেই বুঝা যাবে যে, কিছুদিন যাবৎ এই আক্রমণের তীব্রতা পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্তত ইন্টারনেটের জগতে সকল অলোকবাদী ধর্ম এবং বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে একটা আসন্ন প্রলয়ঙ্কর সুনামির জন্য ইন্টারনেট ব্যবহারে অভ্যস্ত বাঙ্গালী পাঠকরা এখন থেকে নিজেদেরকে মানসিকভাবে প্রস্তুত করতে পারেন।
মনে রাখতে হবে এই লেখক এবং ব্লগাররা চাকুরী বা উন্নত জীবন ও জীবিকার সন্ধানে পাশ্চাত্যে যাচ্ছেন না। বরং এরা যাচ্ছেন নিজেদের বিশ্বাসকে রক্ষা করে বাঁচবার জন্য। এদের এই যাওয়াটা অন্যদের যাওয়া থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে এরা যেমন একই সঙ্গে ধর্মের বিরুদ্ধে সমালোচনায় আরও নির্ভয়, নিষ্করুণ এবং আক্রমণাত্মক হবেন তেমন যে সরকার ও রাষ্ট্র তাদের রক্ষা করা দূরে থাক বরং তাদের সঙ্গে রীতিমত তামাশা করেছে এবং তাদের উপর বিভিন্নভাবে চাপ দিয়েছে সেই সরকার ও রাষ্ট্রের প্রতিও তারা বিরূপ হবে। প্রথমত তারা আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধ হবে। এটা হবে আওয়ামী লীগের জন্য একটা ক্ষতি। কারণ এদের অধিকাংশ রাজনীতি নিয়ে মাথা না ঘামালেও তাদের অনেকের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন ছিল স্পষ্ট। বিশেষত বিএনপি-জামাতের বিপরীতে মন্দের ভাল হিসাবে তারা অনেকেই আওয়ামী লীগকে বিবেচনা করত। এই জায়গা আওয়ামী লীগ সরকার ধ্বংস করেছে।
আর রাষ্ট্র প্রসঙ্গে বলতে হয় তারা সবাই এখানে ছিল মুক্তিযুদ্ধের গৌরব প্রচারক। সুতরাং বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিরোধী তারা হবে না। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিবর্তনের চিন্তা তাদের মধ্যে দ্রুত বিস্তার লাভ করবে বলে অনুমান করা যায়। অর্থাৎ যারা এতকাল ছিল শুদ্ধ বুদ্ধিবাদী এবং অনেকাংশে রাজনীতি বিমুখ পরিস্থিতি এখন তাদেরকে রাজনীতিমনস্ক করবে। বিদেশে গেলেও সেখানে থেকেই তারা বাংলাদেশে লীগ-বিএনপি-জামাত মার্কা পুরাতন রাজনীতির পরিবর্তে নূতন রাজনীতির বিকাশ বা উত্থানে ভূমিকা রাখতে চাইলে সেটাকে আটকানো যাবে কীভাবে? একজন বা দুইজন নয়, বরং বহুসংখ্যক তরুণ বা যুবা যারা এ সমাজের বহু প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবী এবং পণ্ডিতের চেয়ে অনেক বেশী যুগমনস্ক, সাহসী, গতিশীল এবং মুক্তচিন্তার অধিকারী তারা যখন দলে দলে বিদেশে যাচ্ছে তখন তারা যে কী ভূমিকা পালন করবে তা বুঝতে খুব বেশী বুদ্ধি বা পাণ্ডিত্যের প্রয়োজন হয় না। তারা প্রায় প্রত্যেকেই এই সমাজের ভিতরে প্রচুর যোগাযোগ এবং প্রভাব রেখে যাচ্ছে। তাদের প্রায় প্রত্যেকের এখানে থাকছে আত্মীয়, বন্ধু, সমর্থক এবং পরিচিত জনদের এক বিরাট বলয়। আজকের এই ইন্টারনেট, কম্পিউটার আর মোবাইলের যুগে তারা দেশের বাইরে থেকেও দেশের মর্মে অধিষ্ঠান করবে। সেখান থেকে তাদেরকে উৎপাটন করবে এমন সাধ্য কার! তারা বিদেশে থেকেই এ দেশের চিন্তার জগতে নির্ভাবনায় ও নির্ভয়ে ভূমিকা পালন করবে। আর সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা মানুষের জীবনে পরিবর্তন ঘটাবার ক্ষেত্রে চিন্তা বা চেতনার ভূমিকা যে কতটা নির্ধারক সেটা কোন বুদ্ধিমান ব্যক্তি না জানে? সুতরাং, একদিকে জিহাদীরা বা ইসলামী জঙ্গীরা, অপর দিকে সরকার এই দুই শক্তি দুই দিক থেকে এ দেশে ভবিষ্যৎ পরিবর্তন কিংবা হয়ত বিপ্লবেরও নূতন শক্তির আগমনের পথটা প্রশস্ত করে দিল।
৫ নভেম্বর, ২০১৫