লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ November 9, 2015, 12:00 AM, Hits: 1363
বাংলা শব্দ, বানান ও উচ্চারণ নিয়ে কিছু কথা
সম্প্রতি কিছু কাল ধরে আমি আমার লেখায় বানান এবং উচ্চারণে বিদ্যমান বা ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন রীতি থেকে সরে গিয়ে কিছু পরিবর্তন ঘটিয়েছি। বাঙালি না লিখে উচ্চারণে বলিষ্ঠতা বা শক্তির প্রকাশ ঘটে এমন রীতিতে বাঙ্গালী লিখি। এক সময় এই বানানই লিখা হত। এই বাংলার সাধারণ মানুষের কথ্য রীতিতে নাই লিখি, পশ্চিম বঙ্গের কথ্যরীতি অনুযায়ী নেই লিখি না। নেতিবাচক অর্থ বুঝাতেও নি ব্যবহার না করে নাই ব্যবহার করি। যেমন যায়নি, করেনি-এর পরিবর্তে যায় নাই, করে নাই ইত্যাদি। এই রকম কিছু পরিবর্তন আমি আমার সাম্প্রতিক লেখাগুলিতে আনছি।
সামগ্রিকভাবে বললে বানানের বর্তমান কলকাতা বা পশ্চিম বঙ্গের রীতি যেটা বাংলা একাডেমী অনুসরণ করছে আমি সেটা এখন অনুসরণ করি না। এক সময় বাংলা ভাষার উচ্চারণ রীতির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে যে ধরনের বানান করা হত আমি এখন সাধারণভাবে সেটা অনুসরণ করতে চেষ্টা করি। ফলে দেশীকে আমি দেশীই লিখি দেশি লিখি না। এভাবে অতীতের বানান নিয়মে তৈরী বা তৈয়ারী, বাড়ী, গাড়ী, শাড়ী লিখি।
জানি উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গতি না রেখে এ ধরনের বানান শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। তিনি নিশ্চয় লেখ্য ভাষাকে সহজতর রূপ দিতে চেয়ে পুরাতন বানানের কিছু নিয়মকে পাল্টে দিয়ে নূতন বানান রীতি প্রবর্তন করেছেন। স্বাভাবিকভাবে তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল হওয়ায় তাকে অনুসরণ করে প্রচলিত অনেক বানান রীতি ভাঙ্গার ধারা শুরু হল। সেই সঙ্গে সাধু রীতির পরিবর্তে চলিত রীতিতে বাংলা সাহিত্য রচনাও প্রচলিত হল। বিশেষ করে সংস্কৃত বা তৎসম শব্দগুলির ক্ষেত্রে কিছু রক্ষণশীলতা বা অপরিবর্তনীয়তা রইলেও বাংলা দেশজ এবং সংস্কৃত ভাষার শব্দ বা সরাসরি সংস্কৃত থেকে আগত নয় তবে সংস্কৃতজাত বা তদ্ভব এবং অন্যান্য বিভিন্ন ভাষার শব্দের বানান এমনভাবে করা শুরু হল যার সঙ্গে উচ্চারণের কোনও সম্পর্কই রইল না। যেমন উচ্চারণের সঙ্গে সঙ্গতি না রেখেই সমস্ত জায়গায় হ্রস্ব-ইকার বা হ্রস্ব-উকার ব্যবহার শুরু করা হল। এখানে বলে রাখা ভাল ভাষার এ সব পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং নিয়ম ভাঙ্গা শুরু হল এবং এগিয়ে গেল কলকাতা তথা পশ্চিম বঙ্গে। আমি এমন লেখা বা পত্রিকাও পড়েছি যেখানে কোনখানেই ঈ বা ঊ কিংবা দীর্ঘ-ঈকার বা দীর্ঘ-ঊকার বানান রাখা হয় নাই। যেমন শুধু বাড়ী, গাড়ীর ক্ষেত্রে যে বাড়ি, গাড়ি লিখা হয়েছে তা-ই নয়, উপরন্তু শীত, ঈশ্বর, ঊর্ধ্ব, গ্রীষ্ম, জয়ী, নবীন ইত্যাদিও হয়েছে ইশ্বর, উর্ধ, শিত, গ্রিষ্ম, জয়ি, নবিন ইত্যাদি। যতদূর মনে পড়ে ‘ন’-এর উচ্চারণের জন্য ন এবং ণ-এর আলাদা ব্যবহার না রেখে শুধু ‘ন’ রাখা হল। তখন এর উচ্চারণ দন্ত্যন না হয়ে শুধু ‘ন’ হবে।
অর্থাৎ উচ্চারণের সঙ্গে বানানের কোনও সম্পর্ক থাকল না। এমনিতে কিন্তু দীর্ঘকাল হতে যে উৎস-ভাষা থেকেই আগত হোক বাংলায় সেই শব্দ লিখবার সময় মূল ভাষার উচ্চারণের সঙ্গে যতটা সম্ভব সঙ্গতি রেখে বানান করা হয়। ফলে বাংলায় নবি না লিখে নবী, ফার্সি না লিখে ফার্সী লিখা হয়। তবে এখনকার প্রমিত রীতিতে এটা পাল্টে গেছে। এখন নবি, ফার্সি হয়েছে। এমন আরও অনেক কিছু হয়েছে যার সঙ্গে উচ্চারণের কোনও সম্পর্ক নাই। বাংলায় শব্দের অন্তে বা শেষে ‘ই’কার বা ‘উ’কার থাকলে কথা বলার সময় তার উচ্চারণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে দীর্ঘ হয়। আগের দিনে ব্যাকরণেও সেটা শিখানো হত। ফলে বাড়ী, গাড়ী, শাড়ী লিখা হত। কারণ এগুলির ক্ষেত্রে শেষে উচ্চারণে বা স্বরে কিছু দীর্ঘতা বা ব্যাপ্তি আসে।
এক সময়ে পুরাতন রীতি অনুযায়ী বাংলা একাডেমীও তার নামের বানান ‘একাডেমী’ রেখেছিল। তারপর পশ্চিম বঙ্গের বর্তমান রীতির অনুসরণ করে সব জায়গায় শব্দের শেষেও উচ্চারণে বাছবিচারহীনভাবে ই-কার এবং উ-কার ব্যবহার করা শুরু করেছে। তবে একাডেমী বানানটা বাংলা একাডেমীর ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাওয়ায় সেটা আর বদলানো যায় নাই। সেখানে এখনও একাডেমি না লিখে একাডেমী লিখা হয়। অর্থাৎ বাংলা একাডেমীই রয়ে গেল তার কাগজপত্রে। এসব দেখে মনে হয় হ্রস্ব এবং দীর্ঘ উচ্চারণের জন্য ই, ঈ, উ, ঊ ইত্যাদি রাখার দরকার কী ছিল! বাংলা ভাষাকে আরও সহজ ও স্বচ্ছন্দ করার জন্য বাংলা বর্ণমালার ব্যাপক পরিবর্তন এবং সংস্কারে বাংলা একাডেমী হাত দেয় না কেন? তাহলে ভাষা শিক্ষা আরও অনেক সহজ হয় নাকি? শুধু একটা ই, উ, ন থাকত। এভাবে আরও অনেক পরিবর্তন আনা যেত। ভাষার প্রশ্নে পশ্চিম বঙ্গকে যখন আদর্শ ধরা হয়েছে তখন সেখানকার ‘বাংলা একাডেমি’র নেতৃত্বাধীনে বাংলা ভাষার ব্যাপক সংস্কারের কথা ভাবা কি উচিত নয়? পশ্চিম বঙ্গের ‘বাংলা একাডেমি’ তার নামে যে বানান লিখে এখানে আমি সেটাই লিখেছি।
যাইহোক, পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য একটা পর্যায় পর্যন্ত এসব হয়ত মন্দ নয়। তবে একটা পর্যায়ে এ ধরনের পরীক্ষায় লাগাম টানার দরকার হয়। কিছু দীর্ঘ সময়ের জন্য একটা নির্দিষ্ট নিয়মে ভাষাকে আবদ্ধ করার প্রয়োজন হয়। সব ভাষারই নিজস্ব কিছু শৃঙ্খলা থাকে। সেটা গড়ে উঠে দীর্ঘ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে। বাংলা ভাষাও তার ব্যতিক্রম নয়। বিশেষত বাংলা পৃথিবীর একটি প্রধান ভাষা। পৃথিবীর বহু সংখ্যক মানুষ যে এই ভাষায় কথা বলে শুধু তা-ই নয়, বরং বহু ভাষার তুলনায় এটি অনেক সমৃদ্ধও। সব ভাষার মত এর কিছু দুর্বলতা বা সমস্যাও আছে। সেগুলিকে দূর করে ভাষাটিকে আরও সমৃদ্ধ, উন্নত ও কালোপযোগী করার জন্য আমাদেরকে নিশ্চয় যত্নবান হতে হবে। এর জন্য ভাষার বেশ কিছু সংস্কারেরও প্রয়োজন হতে পারে। এটাকে যদি ভাষার কিছু পুনর্গঠন বলা যায় তবে সেটা বলতেও আমার আপত্তি নাই।
আর এইখানে আমার কিছু বক্তব্য আছে। সেটা হল সংস্কার বা পুনর্গঠনের এই কাজের দায়িত্বটা প্রধানত কাদের উপর বর্তায়। নির্দিষ্টভাবে বললে বঙ্গ বা বাংলার কোন অংশের উপর বর্তায় ─ পশ্চিম নাকি পূর্ব? আরও নির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় পশ্চিম বঙ্গ, নাকি পূর্ব বঙ্গ, এখন যেখানে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত? পশ্চিম বঙ্গ ভারতের একটি প্রদেশ, যেটাকে বলা হয় রাজ্য। ভারতের রাষ্ট্রভাষা ইংরাজী এবং হিন্দী। অবশ্য সরকারী কাজকর্মে ইংরাজী ভাষার প্রাধান্য রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের সরকারী ভাষা হিসাবে বাংলার স্বীকৃতি থাকলেও সেখানে সরকারী কাজকর্ম হয় প্রধানত ইংরাজী ভাষায়।
পশ্চিম বঙ্গে কেউ গেলে বা থাকলে যে কারও সেখানকার শিক্ষিত মানুষদের ভিতরে ইংরাজী ভাষা ব্যবহার এবং তাতে দক্ষতা প্রকাশের প্রতিযোগিতা চোখে পড়বে। সেখানকার একাডেমিক অনুষ্ঠানগুলিতে বাংলা ভাষা একেবারে অপাংক্তেয় বললে বোধ হয় বেশী বাড়িয়ে বলা হয় না। সেখানে সর্বত্র ইংরাজী দাপিয়ে বেড়াচ্ছে।
ইংরাজী শিখবার কিংবা তা ব্যবহারের প্রয়োজন আছে। কারণ সেটাই আজকের দিনে প্রধান আন্তর্জাতিক ভাষা। এই ভাষা না জানা মানে আধুনিক পৃথিবীর জ্ঞানভাণ্ডার থেকে শুধু নয়, এমনকি আধুনিক পৃথিবীর গতিধারা থেকেও নিজেকে অনেকাংশে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়া হয়ে দাঁড়ায়। সেটার সপক্ষে আমি বলি না, বলবও না। কিন্তু আমি যে কথাটা বলতে চাচ্ছি সেটা হচ্ছে, সমাজে যে জিনিসকে মানুষ গড়ে তুলতে বা বড় করতে চায় না সেটা গড়ে উঠতে বা বড় হতে পারে না। নিজের ভাষার প্রতি মমত্ববোধ না থাকলে এবং সেটা নিয়ে হীনমন্যতা থাকলে সেই ভাষাকে বড় করা যাবে কী করে? পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর নিকট বাংলা ভাষার গুরুত্ব এক কালে যতটুকুই থাকুক এখন সেটা নাই। সুতরাং বাংলা ভাষা নিয়ে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেখানে হোক সেটার ফল কতটা কাঙ্ক্ষিত হতে পারে তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। কিংবা সেখানে এখন ভাষা ব্যবহারের যে রীতি অনুসৃত হচ্ছে সেটা আমাদের জন্য কতখানি গ্রহণযোগ্য হতে পারে সে বিষয়েও আমার সংশয় আছে।
ভাষার প্রশ্নে আমাদের মনে রাখা দরকার যে, ভাষা মানুষের ভাব বিনিময়ের প্রধান মাধ্যমই শুধু নয়, এমনকি এটা মানুষের চিন্তা করারও প্রধান মাধ্যম। কারণ আমরা চিন্তা বা কল্পনা করতেও প্রধানত ভাষার আশ্রয় নিই। সেই ভাষা সাধারণত হয় মাতৃভাষা, যার সঙ্গে আমরা পরিচিত হই জন্মের পর আমাদের মায়ের বুকে এবং কোলে থাকতেই।
সেই মাতৃভাষাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মর্যাদা দিবার জন্য বঙ্গ বা বাংলার যে অংশটির বাঙ্গালীরা প্রাণ দিয়েছিল সেই অংশটি ছিল ব্রিটিশ শাসিত অখণ্ড বঙ্গ বা বাংলার পূর্ব অংশ তথা পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব বাংলা, যা ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পাকিস্তান-রাষ্ট্রের অন্তর্ভুক্ত হয়। ভাষাকে কেন্দ্র করে এই অংশের বাঙ্গালীর ভিতর জাতি চেতনার যে উন্মেষ ঘটে তার ফল হচ্ছে ১৯৭১-এ পাকিস্তানী শাসকদের বিরুদ্ধে বাঙ্গালীর স্বাধীনতা যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বঙ্গের বুকে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।
আর এভাবে বাঙ্গালী জাতি এবং তার ভাষা ও সংস্কৃতির ভরকেন্দ্র যেটা এক দীর্ঘ সময় কলকাতা ও পশ্চিম বঙ্গে ছিল সেটা সেখান থেকে পূর্ব বঙ্গ তথা আজকের বাংলাদেশ এবং তার রাজধানী ঢাকায় সরে এসেছে। ইতিহাসের এই সত্য অনেকের কাছে মানাটা কষ্টদায়ক কিংবা নির্মম হলেও এটাই বাস্তবতা।
জাতি ও রাষ্ট্র গঠনে ভাষার ভূমিকা
ভাষা জাতি এবং রাষ্ট্র গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষাকে কেন্দ্র করে যেমন জাতির সত্তা ও শক্তি একটা দৃঢ় রূপ নিতে থাকে তেমন জাতি যখন তার রাষ্ট্র পায় বা গঠন করে তখন থেকেই প্রকৃতপক্ষে তার ভাষার নবতর স্ফুরণ বা বিকাশ ঘটে। সব জাতির ক্ষেত্রে আমরা এই ঘটনা ঘটতে দেখি।
এ প্রসঙ্গে আরবী ভাষার কথা উল্লেখ করা যায়। যারা আরবী ভাষা নিয়ে কাজ করেছেন তাদের কাছ থেকে আমরা জানতে পারি ইসলাম আবির্ভাব কালীন আরবী ভাষার বিবর্তন সম্পর্কে। যখন কুরআন রচনা হচ্ছিল সেই সময় আরবদের রাষ্ট্র ছিল না। সেই সময় বিভিন্ন ধরনের আরবী উপভাষা বা কথ্যভাষা বা Dialect আরবে প্রচলিত ছিল। প্রথম দিকে এগুলির বিভিন্ন উপভাষায় কুরআনের আয়াতগুলি লিখা হয়েছিল, যেগুলির মধ্যে কুরাইশদের দ্বারা ব্যবহৃত উপভাষাও ছিল। যে কারণে মুহাম্মদের বক্তব্য হিসাবে আমরা হাদীসে এই কথা পাই, ‘কুরআন সাত হরফে অবতীর্ণ হয়েছে।’ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারি যে, তৎকালে আরবে যে সাতটি প্রধান উপভাষা ছিল সেগুলির সবগুলিতেই কুরআন অবতীর্ণ এবং লিখিত হয়েছিল। এই সাত ‘হরফ’ বা ‘বর্ণ’ থেকে এক হরফ’ বা ‘বর্ণ’-এ আনতে পরবর্তী কালে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। বিশেষ করে ওসমানকে এই কাজ করতে হয়েছিল।*
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
* মুহাম্মদের সময়ে এবং তার মৃত্যুর কিছু পরবর্তী কাল পর্যন্ত কুরআনের এই ভাষাগত পার্থক্যের একটা চিত্র আমরা পাই হাদীস থেকে। এখানে বুখারী শরীফ থেকে দুইটি হাদীস নিম্নে উদ্ধৃত করা যেতে পারে :
‘২২৫৮। আবদুল্লাহ্ (র) ... উমর ইব্ন খাত্তাব (রা) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি হিশাম ইব্ন হাকীম ইব্ন হিযামকে সূরা ফুরকান আমি যেভাবে পড়ি তা থেকে ভিন্ন পড়তে শুনলাম। আর যেভাবে রাসূলুল্লাহ্ আমাকে এ সূরা পড়িয়েছেনে। আমি তাড়াতাড়ি তাকে বাধা দিতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু তার সালাত শেষ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করলাম। এরপর তার গলায় চাদর পেঁচিয়ে তাকে রাসূলুল্লাহ্র কাছে নিয়ে এলাম এবং বললাম, আপনি আমাকে যা পড়তে শিখিয়েছেন, আমি তাকে তা থেকে ভিন্ন পড়তে শুনেছি। নবী তাকে ছেড়ে দিতে আমাকে বললেন। তারপর তাকে পড়তে বললেন, সে পড়ল। তিনি (নবী) বললেন, এরূপ নাযিল হয়েছে। এরপর আমাকে পড়তে বললেন, আমিও তখন পড়লাম। আর তিনি (নবী) বললেন, এ রূপই নাযিল হয়েছে। কুরআন সাত হরফে নাযিল হয়েছে। তাই যেরূপ সহজ হয় তোমরা সেরূপেই তা পড়।’
─ বুখারী শরীফ (চতুর্থ খণ্ড), ইসলামিক ফাউন্ডেশন, সপ্তম সংস্করণ, প্রকাশ - ২০১২, পৃষ্ঠা- ২২৬
‘২৯৮৯। ঈসমাইল (র) ... ইব্ন আব্বাস (রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্ বলেছেন, “জিবরাইল (আ) আমাকে এক আঞ্চলিক ভাষায় কুরআন পাঠ করে শুনিয়েছেন। কিন্তু আমি সর্বদা তাঁর নিকট অধিক ভাষায় পাঠ করে শুনাতে চাইতাম। অবশেষে তা সাতটি আঞ্চলিক ভাষায় সমাপ্ত হয়।”
─ বুখারী শরীফ (পঞ্চম খণ্ড), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, জুন ১৯৯৯, পৃষ্ঠা- ৩৭৪।
এ প্রসঙ্গে বুখারী শরীফের বঙ্গানুবাদের টীকায় বলা হয়েছে, ‘পবিত্র কুরআন সর্বপ্রথম শুধুমাত্র কুরায়শী ভাষায় অবতীর্ণ হয়। পরে নবীর বাসনা অনুযায়ী আরবের সাতটি আঞ্চলিক ভাষায় অবতীর্ণ হয়। পরে যখন এতে অসুবিধা সৃষ্টি হয়, তখন একমাত্র কুরায়শী ভাষা রেখে বাকী সব আঞ্চলিক ভাষা রহিত করে দেওয়া হয়।’
─ বুখারী শরীফ (পঞ্চম খণ্ড), ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় সংস্করণ, জুন ১৯৯৯, পৃষ্ঠা- ৩৭৪।
---------------------------------------------------------------------------------------------------------
কুরাইশদের দ্বারা কথিত একটা নির্দিষ্ট ভাষা রীতিতে কুরআনকে নিয়ে আসা এবং সেই সঙ্গে কুরআনের তথা আল্লাহর বাণী হিসাবে প্রচলিত বিভিন্ন সূরা এবং আয়াতকে একটি নির্দিষ্ট কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসবার কাজটি প্রধানত ওসমান করেছিলেন। এ কাজ করতে গিয়ে বিপুল সংখ্যক আয়াতকে তিনি পুড়িয়ে ফেলেন বা ধ্বংস করেন। মনে রাখতে হবে, এক ও অভিন্ন আরবী ভাষায় নয়, বরং বিভিন্ন আরবী ভাষা বা উপভাষায় কুরআনের এসব আয়াত লিখিত ছিল। সেগুলিকে একটি অভিন্ন রীতির আরবী ভাষায় আনবার কাজটি সহজ ছিল না। সেই সঙ্গে এমন সব আয়াতও ধ্বংস করা হয় যেগুলি নিয়ে সেই সময় থেকেই ইসলামের ইতিহাসে অনেক বিরোধ মাথা তুলে। এমন একটি বিরোধ হচ্ছে শিয়া-সুন্নীর বিরোধ। যাইহোক, ওসমানের নির্দেশ যেসব কুরআন মুখস্থকারী বা সংরক্ষণকারী হাফেজ অমান্য করেন কিংবা তার সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করেন তাদেরকে হত্যা করা হয় বলে জানা যায়। ইসলাম ধর্ম প্রতিষ্ঠার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে কুরআনের ভাষা হিসাবে আরবী ভাষার ব্যবহারে যে জটিলতা ও সমস্যা দেখা দেয় সেটুকু সম্পর্কে কিছু ধারণা দিবার জন্য এই বিষয়টি উল্লেখ করলাম।
ইসলামের সাহায্যে আরবে শুধু একটি রাষ্ট্র গঠন হয় নাই, উপরন্তু আরবের বাইরেও একটি বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা হয়। এই রাষ্ট্র ও সাম্রাজ্য শাসনের প্রয়োজনে আরবী ভাষা এবং তার বর্ণমালায় যে অনেক সংস্কার বা সংযোজন ও বিয়োজন ঘটাতে হয়েছিল সেটা বোধগম্য একটি বিষয়। এ সম্পর্কে আমরা ইতিহাস থেকেও জানতে পারি। যারা এই রকম একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র গঠন ও সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিল তাদের জাতির শক্তিও যে এই ভাষার মাধ্যমে শুধু অভিব্যক্ত হয়েছিল তা-ই নয়, উপরন্তু তাদের ভাষাও আরও বিকশিত ও বিবর্তিত হয়ে মরুভূমির সীমানা ছাড়িয়ে তৎকালীন সভ্য পৃথিবীর এক বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সাম্রাজ্য পরিচালনার ভাষা হয়ে উঠতে পেরেছিল।
আমরা যদি ইংরাজী ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ সম্পর্কে জানতে চাই তবে সেখানেও একইভাবে একটা দুর্বল ও অবিকশিত ভাষার জাতির বিকাশের সঙ্গে বিকশিত হয়ে ক্রমে একটি রাষ্ট্রের ভাষা হয়ে উঠবার ইতিহাস খুঁজে পাব। এক সময় যেখানে লাতিন এবং অ্যাংলো-নরম্যান বা ফরাসী ছিল জ্ঞানচর্চা ও রাজকার্য পরিচালনা করার প্রধান ভাষা সেখানে চতুর্দশ শতাব্দীতে এসে ইংরাজী সেই জায়গা নিতে থাকে। রাষ্ট্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও প্রয়োজনের সঙ্গে এই ভাষা ক্রমেই উন্নত ও শক্তিশালী হয়েছে। অবশেষে ইংরেজ জাতির সাম্রাজ্য বিস্তারের সঙ্গে এই ভাষা পৃথিবীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের ভাষা হয়ে উঠেছে।
এভাবে আমরা দেখি যে, জাতির বিকাশের সঙ্গে ভাষার বিকাশ ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে থাকে। বিশেষত জাতির রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হিসাবে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় ভাষা একটি নির্ধারক উপাদান।
বঙ্গের পাকিস্তানভুক্ত পূর্বাঞ্চলের বাঙ্গালীর ভিতর জাতি চেতনার যে বিকাশ ঘটে তার অভিব্যক্তি হিসাবে গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাকে বুঝতে হবে। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর পশ্চাদগতি ঘটেছে কিনা বা জাতি-রাষ্ট্র হিসাবে তা আদৌ বাঙ্গালী জাতি বা তার জাতীয়তাবাদের অভিব্যক্তি হতে পেরেছে কিনা, পারলে কতটা পেরেছে, না পারলে কেন পারে নাই কিংবা এ ক্ষেত্রে সমস্যাগুলি কোনখানে এবং কী ধরনের সেগুলি নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়। কিন্তু সেই সংক্রান্ত আলোচনার জায়গা এটা নয়। আমি আমার বহুসংখ্যক লেখায় বিষয়গুলিকে নিয়ে আলোচনার চেষ্টা করেছি।
তবে এখানে সংক্ষেপে এইটুকু বলি যে, জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য যে সুষ্ঠু ও সুস্থির প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাঙ্গালী জাতির আসবার প্রয়োজন ছিল সেটা বিভিন্ন কারণে হয় নাই। এগুলির মধ্যে বঙ্গের ভূ-প্রকৃতি, সুদীর্ঘ বৈদেশিক বা পরশাসন, ধর্ম এবং ধর্মীয় কারণে বিভাজন ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা যেমন এক দিক থেকে বাঙ্গালী জাতি গঠন প্রক্রিয়ার উপর বিরাট আঘাত ছিল তেমন এক অর্থে এটি আবার তার জন্য সহায়কও হয়েছিল। কারণ ধর্মীয় বিভাজনের ভিত্তিতে পাকিস্তান লাভ করায় এখানে বাঙ্গালী হিন্দুর সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলমানের বিরোধের সুযোগ হ্রাস পেল। এর ফলে ১৯৪৭-এ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পরই পাকিস্তানী অবাঙ্গালী শাসক শ্রেণীর সঙ্গে বাঙ্গালী মুসলমানদের জাতিগত দ্বন্দ্ব শুরু হলে বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে বাঙ্গালী হিসাবে জাতি চেতনার উন্মেষ ঘটাটা সহজতর হয়, যার ফলে ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন। তবে সুস্থির জাতি চেতনার তুলনায় তখনও আবেগ নির্ভরতার প্রাধান্য ছিল। তবু এর ধাক্কায় ১৯৭১ সালে ধর্ম-ভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙ্গে জাতি-ভিত্তিক রাষ্ট্র গণ-প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
সুস্থিরভাবে জাতির চেতনা ও সংস্কৃতির বিকাশের জন্য পাকিস্তানের চব্বিশ বৎসর সময় হয়ত কম ছিল, যার কারণে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখানকার বাঙ্গালী মুসলমানদের মধ্যে ধর্মীয় চেতনার প্রাবল্য দেখা দিতে শুরু করে। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা ছিল ভারত-রাষ্ট্রের আশ্রয় ও নিয়ন্ত্রণে। সেটা সমস্যার অপর কারণ। এর কিছু সুবিধা এবং সমস্যা দুই দিকই আছে। ভারতের ভূমিকার ফলে পাকিস্তানীদের পক্ষে শক্তির ভারসাম্য নিজেদের পক্ষে আনা সম্ভব হয় নাই এটা যেমন সুবিধার দিক তেমন যুদ্ধ স্বাধীনভাবে বেড়ে না উঠতে পারার সমস্যাও বিবেচনায় নিতে হবে। তবে সব মিলিয়ে যেটাকে গুরুত্বের সঙ্গে হিসাবে নিতে হবে সেটা হচ্ছে ধর্মের কাঠামো ভেঙ্গে বাঙ্গালী জাতির একটা স্বাধীন রাষ্ট্র লাভ। এটার গুরুত্ব অপরিমেয়। যে সমস্যাই থাক জাতির ভিতর উদ্যম, সঙ্কল্প এবং লক্ষ্য স্থির থাকলে সব সমস্যা কাটিয়েই এখানে বাঙ্গালীর একটা উন্নত ও শক্তিশালী লোকবাদী তথা ধর্মমুক্ত রাষ্ট্র গঠন করার সম্ভবনা আছে।
আর এ ক্ষেত্রে আসে ভাষার প্রশ্ন, যা উন্নত ও শক্তিশালী সমাজ, জাতি ও তার রাষ্ট্র গঠনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আর এ প্রসঙ্গে বাংলা বানান ও উচ্চারণ, এমন কি বাক্য গঠন সংক্রান্ত বিষয়গুলিকে নিয়েও আমাদের নূতন করে ভাবা উচিত বলে আমি মনে করি।
আধুনিক বাংলা ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ
প্রথমে বলা দরকার যে বাংলা ভাষার ইতিহাস প্রাচীন হলেও যে বাংলায় আমরা এখন সাধারণভাবে কথা বলি কিংবা যে বাংলায় এখন লিখা হয় সেটা খুব নূতন। আসলে আধুনিক এই বাংলা জন্ম নেয় ব্রিটিশ শাসনামলে রাজধানী কলকাতায়। এটা তখনকার মধ্যবিত্তের অবদান, ধর্ম পরিচয়ে সাধারণভাবে যারা হিন্দু ছিল। তখন শিক্ষিত বাঙ্গালী বলতে মূলত তাদেরকেই বুঝতে হবে। বুঝা যায় নওয়াবী আমলের শেষ দিক থেকেই বাঙ্গালী হিন্দুর মধ্যে একটা জাগরণ চলছিল। কিংবা আরও পূর্ব থেকে। কারণ শিক্ষায় হিন্দু উচ্চশ্রেণী বঙ্গে বরাবরই এগিয়ে ছিল। হিন্দু যুগের পতনের পর তারা বহিরাগত মুসলমানদের রাজভাষা ফার্সী শিখে নিয়েছিল এবং রাজদরবার থেকে শুরু করে সর্বত্র প্রধানত তারা দলিল-পত্র লিখবার কাজগুলি করত। বিশেষত রাজস্ব বিভাগে তাদের প্রায় একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। ইংরেজ শাসনামলে রাজভাষার পরিবর্তনের সঙ্গে তারা সহজে ইংরাজী ভাষা শিখে নেয়। কিন্তু এই ভাষার সঙ্গে ইউরোপের উন্নততর জ্ঞান তাদের ভিতর প্রবেশ করে। ফলে তাদের মধ্যে যে জাগরণ ঘটে তার প্রকাশ যে শুধু হিন্দু ধর্ম ও সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে ঘটে তা-ই নয়, অধিকন্তু যে মাতৃভাষায় তারা কথা বলত সেই বাংলা ভাষার মাধ্যমেও ঘটে।
ইতিহাস থেকে আমরা জানতে পারি যে, সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ দিকে ১৬৮৬ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর একজন প্রতিনিধি জব চার্নক হুগলি নদীর তীরে অবস্থিত সুতানুটি নামে এক গ্রামে প্রথম অবস্থান নেন। এরপর ১৬৯০-তে সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কালিকাটা এই তিন গ্রামকে নিয়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাণিজ্য কুঠি এবং বসতি প্রতিষ্ঠিত হলে কলকাতার শহর ও নগর হয়ে উঠবার পথে যাত্রা শুরু হয়। ইংরেজরা যখন সেখানে তাদের বাণিজ্য কুঠি, কারখানা এবং নিজেদেরও নিরাপত্তার জন্য কেল্লা গড়ছিল তখন বৃহত্তর বঙ্গের সামাজিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তার কারণে বিশেষত হিন্দু বাঙ্গালীরা কলকাতার প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছিল। সেই সময় বঙ্গের পশ্চিম দিক থেকে মারাঠাদের এবং পলাতক ও বিদ্রোহী আফগানদের আক্রমণ ও লুঠতরাজ নওয়াবী শাসনের জন্য এবং বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গের জনজীবনের জন্য বড় ধরনের সমস্যা এবং হুমকি সৃষ্টি করেছিল। এই অবস্থায় শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য ধনবান ব্যক্তিদের কেউ কেউ কলকাতায় বসতি স্থাপন করতে শুরু করে। এদের প্রায় সকলে ছিল হিন্দু।
আর এটাও এ প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য যে, বঙ্গের ব্যবসা-বাণিজ্যে হিন্দুদের প্রাধান্য যেমন অনেক আগে থেকেই ছিল তেমন বঙ্গের জমিদারদেরও বেশীর ভাগ ছিল হিন্দু। অবশ্য ব্রিটিশ আমলের জমিদারদের মত এই জমিদারদেরকে কেউ যেন জমির মালিক মনে না করেন। নাম জমিদার হলেও তারা জমির মালিক হত না। তারা ছিল রাজসরকারের পক্ষে নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের খাজনা আদায়কারী মাত্র। তবে নির্দিষ্ট এলাকা বা জমিদারীতে তারা সাধারণত বংশপরম্পরায় এই দায়িত্ব পালন করত। এ ছাড়া কিছু প্রশাসনিক দায়িত্ব তারা সরকারের পক্ষ থেকে পালন করতে পারত। তবে তাদের মূল কাজ ছিল খাজনা আদায় করা।
যাইহোক, এটা জানা যায় যে নওয়াবী আমলেই কলকাতা দ্রুত বর্ধিষ্ণু শহর হিসাবে গড়ে উঠছিল। অবস্থাপন্ন কিছু সংখ্যক মানুষ যেমন সেখানে নিরাপত্তার জন্য পাড়ি জমাচ্ছিল তেমন ইংরেজদের ব্যবসা-বাণিজ্যের মধ্যস্থতাকারী বা দালাল-ফড়িয়া এবং দোভাষীও কিছু করে কলকাতায় পাড়ি জমাচ্ছিল। এরা সাধারণভাবে ছিল হিন্দু। কলকাতার এই দ্রুত বিকাশের ফলে জনসংখ্যার স্ফীতি ঘটে। ১৭৫০ সালেই তার জনসংখ্যা হয় ১,২০,০০০ (এক লক্ষ কুড়ি হাজার) (Keay, John (2010). India: A History. New York, NY: Grove Press. p. 388. ISBN 978-0-8021-4558-1.)। সদ্য প্রতিষ্ঠিত শহরের জন্য কাল প্রেক্ষিতে এটা কিন্তু খুব বড় জনসংখ্যা। মনে রাখতে হবে তখনও বাংলায় ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। তারপর ১৭৫৭ খ্রীষ্টাব্দে নওয়াব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ইংরেজদের বিজয় কলকাতায় বসতি স্থাপন করতে থাকা এই হিন্দু বাঙ্গালীদের নিকট নূতন সুযোগ এনে দিল। নূতন শাসক-বণিকদের অনুগত ও সহযোগী হয়ে তাদের অনেকে যেমন বিপুল অর্থ-বিত্ত করল তেমন তাদের অনেকে আবার তাদের নূতন শাসক ইংরেজদের ভাষা শিখে নিল। কিন্তু ভাষা শিখে শুধু যে ভাল দোভাষী বা কেরানী তারা হল তা-ই নয়, বরং সবচেয়ে বিপ্লবাত্মক যে ঘটনা তারা ঘটালো সেটা হচ্ছে আধুনিক ইউরোপের জ্ঞানের জগতে প্রবেশ।
বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসে এই ঘটনার প্রভাব অপরিমেয়। প্রকৃতপক্ষে আধুনিক বাঙ্গালী জাতি গঠনের পথে তারাই আমাদের পথিকৃত। সমস্যা অনেক ছিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা পরাধীনতা। পরাধীনতায় মানুষ আর কত প্রবল এবং কত বড় হতে পারে! তবু তারা ছিলেন কালপ্রেক্ষিতে এবং আপেক্ষিক অর্থে প্রবল বাঙ্গালী। এই প্রবল বাঙ্গালীদের হাতে আধুনিক বাংলা ভাষা এবং গদ্য জন্ম নিল। সাধারণভাবে প্রচলিত বহু উপভাষার সমষ্টির জায়গায় বাংলা ভাষার একটা অভিন্ন সাধারণ রূপ সৃষ্টি হল। প্রথমে তার সাধু রূপ, পরবর্তী সময়ে কলকাতায় সাধারণের ব্যবহারের মাধ্যমে যে চলিত বা প্রচলিত রূপ গড়ে উঠছিল সেই চলিত রূপ নিয়ে একটা প্রমিত বা স্ট্যন্ডার্ড বাংলা ভাষা গড়ে উঠল। বাংলা ভাষার বিকাশ ও প্রতিষ্ঠার সঙ্গে চলিত রূপটাই এক সময় সর্বজনীন হয়ে উঠল। আঞ্চলিক বিভিন্ন উপভাষায় কথা বলা হলেও সেটা সাধারণ বা প্রমিত বাংলা হিসাবে স্বীকৃত নয়। এখন প্রায় সর্বত্র প্রমিত বা স্ট্যান্ডার্ড বাংলা ভাষায় কথা বলার রীতি প্রচলিত হচ্ছে। এক সময় সাধু বাংলায় বাংলা লিখা হলেও এখন উভয় বঙ্গ বা বাংলার প্রায় সবখানে সব কাজে সাধারণত চলিত কথ্য বাংলায় লিখা হয়, যার উৎস কলকাতা।
বিবর্তনে বাংলা ভাষা
ভাষা পরিবর্তনশীল। নদীর প্রবাহের সঙ্গে অনেকে তাকে তুলনা করেন। নদীর খাত পরিবর্তনের মত তারও খাত পরির্তন হয়। বিশেষত জাতি বা জনগোষ্ঠীর বিকাশ, মিশ্রণ ও অবক্ষয়ের এবং রূপান্তরের প্রকাশও ঘটে তার ভাষার মাধ্যমে। অষ্টাদশ-উনবিংশ শতাব্দীতে বাঙ্গালী জাতি যে জায়গায় ছিল সে জায়গায় যে আজ বাঙ্গালী জাতি দাঁড়িয়ে নাই সেই বাস্তবতাকে অস্বীকার করা যাবে না। তখন বাঙ্গালী ছিল অবিভক্ত, কিন্তু পরাধীন। এখন একবিংশ শতাব্দীর ২০১৫-তে বাঙ্গালী বিভক্ত, কিন্তু তার একাংশ স্বাধীন। একটা রাষ্ট্র তার আছে। এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার মাত্রা ও চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন থাকতে পারে। এই বিভক্ত বাঙ্গালীর জাতিসত্তার বিকাশের মান নিয়েও প্রশ্ন থাকতে পারে। কিন্তু বাস্তব হচ্ছে বঙ্গের পূর্বাংশে বসবাসকারী বাঙ্গালীর একটা রাষ্ট্র আছে। এই বঙ্গে বসবাসকারী বাঙ্গালীর সংখ্যাগুরু অংশ হিন্দু না হয়ে মুসলমান সম্প্রদায়ভুক্ত সেটা যেমন সত্য তেমন অপর একটি সত্য এই যে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে এই বঙ্গ তথা পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালী কিছু বিষয়ে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালী থেকে ভিন্ন।
পশ্চিম বঙ্গের তুলনায় অনেক বেশী প্রমত্ত নদী বিধৌত, ঝড়-ঝঞ্ঝা কবলিত, বন্যাপ্লাবিত এবং অনেক বেশী উর্বর এই বাংলার মানুষরাও তাই হুবহু পশ্চিম বাংলার মানুষদের মত নয়। এই বাংলার মানুষদের মধ্যেও যেমন অঞ্চল ভেদে আচার-আচরণে কিছু ভিন্নতা দেখা যায় দুই বাংলার ক্ষেত্রেও সেটা তেমন এবং ক্ষেত্র বিশেষে আরও বেশী দেখা যায়। এর প্রভাব এবং প্রকাশ আঞ্চলিক বাংলা ভাষা গঠনে এবং বিশেষত তার শব্দের উচ্চারণে বেশী দেখা যায়। যেমন ধরা যাক স্বরসঙ্গতির কথা।
পূর্ব বঙ্গ বা বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের ভাষায় সাধারণত স্বরসঙ্গতি দেখা যায় না। যেমন তারা হিসাবকে হিসেব না বলে হিসাব বলে, বিকালকে বিকেল না বলে বিকাল বলে। পশ্চিম বঙ্গে প্রায় সব শব্দ উচ্চারণ ও লেখায় স্বরসঙ্গতির প্রভাব বা প্রচলন দেখা যায়। ই থেকে আ বা উ থেকে আ-তে যেতে যে কষ্ট হয় সেটাকে এড়াতে চেয়ে এই স্বরসঙ্গতির ব্যবহার বলে আমার ধারণা। স্বরসঙ্গতি সম্পর্কে যাদের কিছু ধারণা আছে তারা হয়ত আমার কথার তাৎপর্য বুঝছেন। এ সম্পর্কে অজস্র উদাহরণ দেওয়া গেলেও আলোচনা সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে সে দিকে আমি যাচ্ছি না। আমি শুধু এটুকু বলতে চাই স্বরসঙ্গতির ব্যবহার অনেক সময় শব্দকে শ্রুতিমধুর করলেও এতে শব্দ বা ভাষার শক্তিও কমে বলে আমার মনে হয়। আমার মনে হয়েছে কবিতার জন্য অনেক সময় শুনতে ভাল লাগলেও গদ্যের ভাষাকে স্বরসঙ্গতির ব্যবহার প্রায়শই দুর্বল করে।
সম্ভবত পূর্ব বঙ্গের মানুষের যে শক্তি তা তার ভাষার মাধ্যমেও অনেকখানি প্রকাশিত। এই ভাষার এবং উচ্চারণ রীতির পার্থক্যের কারণে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালী এক কালে পূর্ব বঙ্গের বাঙ্গালীকে ‘বাঙ্গাল’ বলে উপহাস করত। কিন্তু যা-ই বলা যাক, অনেক উর্বর ভূমির ফসলে এবং নদী-খাল-বিল-জলার মাছে পুষ্ট এবং নদীভাঙ্গন প্রবণ ভূমি ও অনিশ্চিত প্রকৃতির সঙ্গে সতত কঠিন লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে টিকে থাকা এই বঙ্গের মানুষের সঙ্গে বলিষ্ঠতায়, ক্ষিপ্রতায় ও সাহসে পশ্চিম বঙ্গের মানুষ সর্বদা তুলনীয় নয়। এ ক্ষেত্রে হিন্দু বা মুসলমানের ব্যাপার নাই। তাই ভাষা দিয়ে এখানে আঞ্চলিক পার্থক্য বুঝা গেলেও হিন্দু-মুসলমানের পার্থক্য বুঝবার উপায় নাই। এই সঙ্গে আমি যুক্ত করতে চাই এই বঙ্গের বাঙ্গালীদের রাষ্ট্র অর্জনের সাফল্যকে, যা তাদের শক্তিমত্তার প্রকাশক এবং যার তাৎপর্য অপরিমেয়।
অবশ্য একই সঙ্গে এই বঙ্গের মানুষদের তুলনামূলক দুর্বলতাগুলিকেও আমাদেরকে হিসাবে নিতে হবে। ভূ-প্রকৃতির অস্থিরতা বা অস্থিতিশীলতা এবং ভূমি ভাঙ্গন এই বঙ্গের মানুষদেরকে যেমন অবিরাম ছত্রভঙ্গ করেছে তেমন তাদেরকে করেছে বারবার সমাজ বিচ্ছিন্ন, ক্ষুদ্র গোষ্ঠী কেন্দ্রিক ও অতি-ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী। এটা তাদের মনকে এবং আচরণকে নানানভাবে প্রভাবিত করেছে। ফলে তাদের ভাষার উপরেও তার প্রভাব পড়েছে নানানভাবে। পশ্চিম বঙ্গও তো এই ভূ-প্রকৃতির একেবারে বাইরে নয়। ফলে এই দিক থেকেও সমগ্র বঙ্গেই কম আর বেশী কিছু অভিন্নতা রয়েছে। একটি উন্নত ও শক্তিশালী জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের প্রয়োজনকে সামনে রেখে ভাষার সংস্কার বা নির্মাণের সময় এই বিষয়গুলিকে আমাদের চিন্তায় রাখতে হবে। এখানে এই প্রসঙ্গে এইটুকু উল্লেখ করা উচিত হবে যে, কোন কোন পণ্ডিত বাংলা ভাষা প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে বাঙ্গালী চরিত্র ও মননের দুর্বলতা ও সমস্যাগুলির প্রতি ইঙ্গিত করেন নাই তা নয়। সুতরাং আমি এখানে এ প্রসঙ্গে নূতন কিছু্ই বলছি না।
যাইহোক, আলোচনাকে সংক্ষিপ্ত করতে চেয়ে এখন আমি মূল কথায় আসি। সেটা হচ্ছে এই যে, বাংলাভাষাকে উন্নততর করার প্রয়োজনে তার সংস্কারের প্রয়োজন আছে। কিন্তু সেটা এখন আর পশ্চিম বঙ্গের অনুকরণ হওয়া উচিত নয়। মনে রাখতে হবে বাংলা ভাষা নির্মাণ ও বিকাশে এক সময় ব্রিটিশ উপনিবেশিক ভারতবর্ষের রাজধানী-নগর কলকাতার যে ভূমিকাই থাকুক সেটা এখন তার আর নাই। প্রকৃতপক্ষে ১৯৪৭ থেকেই তার এই হারানোর যাত্রা শুরু হয়। তবু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পূর্ব পর্যন্ত তার কিছু ভূমিকা থাকতে পারে। কিন্তু ১৯৭১-এ রাষ্ট্র হিসাবে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর থেকে বাংলা ভাষার ভরকেন্দ্র পশ্চিম বঙ্গ এবং কলকাতা থেকে বাংলাদেশ এবং তার রাজধানী ঢাকায় সরে এসেছে। এখন শুধু বাংলা ভাষা নয়, অধিকন্তু বাঙ্গালী জাতিরও মূলভূমি বাংলাদেশ এবং রাজধানী ঢাকা। একটা উন্নত স্বাধীন জাতির ভাষা হিসাবে বাংলা ভাষাকে গড়ে তুলাটা ১৯৭১ থেকে আমাদেরই মূল দায়িত্ব। এ ক্ষেত্রে উদ্যোগ আমাদেরকেই নিতে হবে। পশ্চিম বঙ্গের কাছ থেকে এটা আশা করলে ভুল করা হবে। কারণ বাঙ্গালী জাতি হিসাবে তারা এখন আমাদের থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। তাদেরকে যদি বাঙ্গালী হিসাবে এগিয়ে নিতে হয় তবে সেই দায়িত্বটাও প্রধানত আমাদেরকে পালন করতে হবে। এই কথাটা গুরুত্বের সঙ্গে উপলব্ধি করতে হবে যে, অনেক সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও বাঙ্গালী হিসাবে আমাদের একটা রাষ্ট্র আছে। এই রাষ্ট্র বাঙ্গালী জাতি হিসাবে পশ্চিম বঙ্গের বাঙ্গালীর নাই।
তার জন্য কলকাতাকে কেন্দ্র করে যে বাংলা গড়ে উঠেছে সেটাকে বর্জন করে পূর্ব বঙ্গ বা বাংলাদেশের কোনও আঞ্চলিক বাংলা ভাষাকে নিয়ে নূতনভাবে বাংলা ভাষা গড়ার উদ্ভট যুক্তি আমি দিব না, যেমন পাকিস্তান আমলে ইসলামী বাংলা প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে আরবী-ফার্সী ঘেঁষা পুথি সাহিত্য ভিত্তিক বাংলা প্রতিষ্ঠার ধুয়া তুলা হয়েছিল। তবে এটা ঠিক যে কলকাতায় বাংলা ভাষার যে আদিপুরুষেরা আধুনিক বাংলা ভাষা নির্মাণ করেছিলেন তাদের উত্তরসূরীরা সেখানে যেমন দুর্বল হয়েছেন তেমন তাদের ভাষাকেও যথেষ্ট দুর্বল করেছেন। হয়ত কবিতার মত জায়গায় তাদের ভাষা রীতির ব্যবহার চলতে পারে। কিন্তু সব ক্ষেত্রে নয়। তবে বানান এবং উচ্চারণের কিছু ক্ষেত্রে অভিন্নতার প্রয়োজন আছে। সে ক্ষেত্রে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে হলেও উদ্যোগটা আমাদেরকে এই বাংলা থেকেই নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কলকাতা এবং পশ্চিম বঙ্গের সঙ্গে সঙ্গতি রাখার কথা আমরা ভাবতে পারি। কিন্তু কলকাতা এবং পশ্চিম বঙ্গের অনুসারী আমরা হব না। বরং আমাদেরকেই এ ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে। বানান এবং ভাষা-কাঠামোসহ সবদিক থেকেই ভাষাকে সংস্কার করে উন্নততর এবং শক্তিশালী করতে হবে। তবে এই উদ্যোগ নিবার সময় মনে রাখতে হবে আমাদের একটি উন্নত, মানবিক, সম-অধিকার ভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও শক্তিশালী সমাজ, জাতি এবং রাষ্ট্র গঠন করতে হবে। ভাষা এবং বানান সংস্কার তার প্রয়োজনে।
সেই দিকে দৃষ্টি রেখেই আমি বাংলা লেখায় এমন কিছু রীতি অনুসরণের চেষ্টা করছি যেগুলি বর্তমানে প্রচলিত কিছু রীতির সঙ্গে মিলে না। এর মধ্যে অনেক কিছুকেই এক সময় কলকাতায় প্রবর্তিত পুরাতন রীতির পুনঃপ্রবর্তন বলা যায়। আবার কিছু ক্ষেত্রে এই বঙ্গের নিজস্ব বাচন বা উচ্চারণ ভঙ্গীতে লিখবার চেষ্টা বলা যায়। বলা যায় আমি একটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি। হয়ত আমি যেভাবে ভাবছি তার কিছু দুর্বলতা বা সীমাবদ্ধতা আছে। তবে আমি বাংলা ভাষার একটা সংস্কার এবং পুনর্গঠনের প্রয়োজন বোধ করি। আর সেই কাজটা গজদন্তমিনারে বসে থাকা কিছু সংখ্যক জন-বিচ্ছিন্ন পণ্ডিতের কাজ বলে আমি মনে করি না। তবে পণ্ডিতদেরকেই দায়িত্বটা নিতে হবে বৈকি। কিন্তু তারা হবেন জন-ঘনিষ্ঠ এবং জন-সম্পৃক্ত। কারণ যেমনই হোক ভাষা উঠে আসে মূলত জন-সমাজের ভিতর থেকে। তারপর এক সময় পণ্ডিতরা তার উপর কাজ করতে এবং সেটাকে একটা পরিশীলিত রূপ দিতে পারেন, যেটা আবার নূতন ও উন্নততর রূপ ও বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন-সমাজের ভিতরে ফিরে যেতে পারে।
তবে এ প্রসঙ্গে আমি বলা প্রয়োজন মনে করি যে আমাদের জাতি ও রাষ্ট্র গঠনের জন্য যেমন একটি নূতন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলবার প্রয়োজন আছে তেমন বাংলা ভাষাকে উন্নততর এবং বলিষ্ঠতর করার জন্যও একটি নূতন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন গড়ে তুলবার প্রয়োজন আছে। ভাষাকে নদীর সঙ্গে তুলনা করা হলেও ভাষা নদীর মত অচেতন প্রকৃতির সৃষ্টি নয়। ভাষা সচেতন মানুষের সৃষ্টি। সুতরাং এখানে মানুষের সচেতন প্রচেষ্টার বিশেষ গুরুত্ব আছে। সেটা গোষ্ঠী, শ্রেণী বা রাষ্ট্রের ভূমিকাও হতে পারে। বিশেষত আজকের দিনে অনেক সময় রাষ্ট্রের ভূমিকার গুরুত্ব অনেক বেশী হয়ে দেখা দেয়। রাষ্ট্রের হস্তক্ষেপ বা উদ্যোগ এমন কি নূতন ভাষা গঠন কিংবা মৃত ভাষার পুনরুজ্জীবনেও যে ভূমিকা রাখতে পারে তার দৃষ্টান্ত হিসাবে ইন্দোনেশিয়া এবং ইসরাইলের কথা বলা যায়।
সুকর্ণ এবং হাত্তার নেতৃত্বে ১৯৪৫ সালে বহুসংখ্যক দ্বীপসমষ্টি (প্রায় আঠারো হাজার দ্বীপ) সাবেক ডাচ উপনিবেশ ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ডাচরা স্বাধীনতার ঘোষণাকে অস্বীকার করে ইন্দোনেশিয়ার উপর তাদের দখল পুনর্বহাল করতে চাইলে ডাচদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৪৯ সালে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হয়। একটি স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য একটি অভিন্ন ভাষার প্রয়োজন দেখা দেয়। ইন্দোনেশিয়ার দ্বীপপুঞ্জে ডাচ শাসনপূর্ব কালে যেমন অভিন্ন জাতীয়তা বোধ ছিল না তেমন অভিন্ন বা সাধারণ ভাষাও ছিল না। আজও প্রায় ১৮,০০০ (আঠারো হাজার) দ্বীপে বসবাসকারী মানুষরা ৭০০-এর বেশী আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে। এই অবস্থায় সমস্ত রাষ্ট্রের অধিবাসীদের একটি অভিন্ন ভাষা ভিত্তিক জাতিতে পরিণত করার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার সুবিধার প্রয়োজনে একটি অভিন্ন ভাষা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। এই উদ্যোগের মাধ্যমে জনসংখ্যার মাত্র ৫% দ্বারা কথিত মালয় ভাষার বিকাশ ঘটিয়ে রাষ্ট্রভাষা প্রতিষ্ঠা করা হয়, যার নাম দেওয়া হয় ‘বাহাসা ইন্দোনেশিয়া’ (Bahasa Indonesia)। এই ভাষার লিপি হিসাবে লাতিন বা রোমান লিপিমালাকে গ্রহণ করা হয়। এটা এখন পৃথিবীর চতুর্থ বৃহত্তম জনসংখ্যা (প্রায় ২৫ কোটি) অধ্যুষিত ইন্দোনেশিয়ার শুধু রাষ্ট্রভাষা নয়, উপরন্তু সেখানকার ব্যাপক সংখ্যক মানুষের দ্বারা কথিত এবং সাধারণ মানুষদের মধ্যে যোগাযোগেরও ভাষায় (Lingua Franca) পরিণত হয়েছে।
মৃত ভাষা পুনরুজ্জীবনের দৃষ্টান্ত হিসাবে হিব্রু ভাষার কথা বলা যায়। খ্রীষ্টপূর্ব ৫৮৭ সালে ব্যাবিলনীয়দের হাতে জেরুসালেমের পতন এবং মন্দির ধ্বংসের পর থেকে ইহুদীদের উপর যে দুর্যোগ নেমে আসে তার ছায়া থেকে তারা মুক্ত কম সময়ের জন্যই হয়েছিল। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন রাষ্ট্র ও জাতিসমূহের আক্রমণ ও আগ্রাসন তাদেরকে কম-বেশী আড়াই হাজার বৎসর যাবৎ তাড়া করে বেড়িয়েছে। রাষ্ট্রহীন এবং দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়তে থাকা সাধারণ ইহুদীরা ক্রমে তাদের দৈনন্দিন জীবনের ভাষা হিসাবে হিব্রু ভুলে গিয়েছিল এবং বিভিন্ন দেশের ভাষাকে নিজেদের কথ্য ভাষা বা মাতৃভাষা হিসাবে গ্রহণ করে নিয়েছিল। তবে যেখানেই তারা বাস করুক তারা সাধারণভাবে তাদের ধর্মকে আঁকড়ে ধরে ছিল। আর এই ধর্মের ভাষা ছিল হিব্রু, যে ভাষায় তারা উপাসনা বা প্রার্থনা এবং ধর্মচর্চা করত।
কিন্তু ঊনবিংশ শতাব্দী থেকে তাদের মধ্যে ইহুদী জাতীয়তাবাদের প্রসার শুরু হলে পৃথিবীর দেশে দেশে বিশেষত পশ্চিম ইউরোপে ছড়িয়ে থাকা ইহুদীদের নিজেদের মধ্যে হিব্রু ভাষার ব্যবহার শুরু হয়। ১৯৪৮ সালে প্যালেস্টাইন ভূখণ্ডে ইসরাইল-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর হিব্রু ভাষাকে সরকারী ভাষার মর্যাদা দান করা হয়। হিব্রুর পাশাপাশি আরবী ইসরাইলের অন্যতম সরকারী ভাষা হলেও হিব্রুই সেখানে বাস্তবে বহুলভাবে ব্যবহৃত সরকারী ভাষা। এবং এখন সেখানে হিব্রুই সাধারণ মানুষদের মধ্যে ভাব বিনিময়ের জন্য প্রধান মাধ্যম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত। ইসরাইলের ৮০ লক্ষ জনসংখ্যার মধ্যে প্রায় ষাট লক্ষ ইহুদী, বাকী প্রায় ২০ লক্ষ আরব।
যাইহোক, ভাষা সংস্কারের প্রসঙ্গে আমি মনে করি এই দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের উপর এসে পড়ে; বিশেষত আজকের যুগে এবং আমাদের মত দেশে। সেই রাষ্ট্র কি আমরা আজ পর্যন্ত নির্মাণ করতে পেরেছি? জাতি নির্মাণের সমস্যার সমাধানই যে রাষ্ট্র আজ অবধি দিতে পারে নাই সেই রাষ্ট্র উন্নততর ও অধিকতর শক্তিশালী ভাষা নির্মাণ করবে কী করে? তবে উন্নত রাষ্ট্র ও উন্নত জাতি গঠনের সংগ্রামের অংশ হিসাবে আমি ভাষা সংস্কার বা নির্মাণের কাজটাকে দেখি। সেই সংগ্রামের প্রয়োজন বোধ থেকে আমার ইদানীংকার লেখাগুলিতে সতর্ক বিবেচনার ভিত্তিতে কিছু ক্ষেত্রে এই বঙ্গ তথা বাংলাদেশ-রাষ্ট্রভুক্ত অঞ্চলের ভাষা রীতিকে অগ্রাধিকার দিয়ে লিখছি। আমি ভাষা সংস্কার করে নূতনভাবে বাংলা ভাষাকে গঠন করছি তা মনে করি না। প্রকৃত অর্থে আমি যা করছি তা ভাষা সংস্কার বা নূতনভাবে বাংলা ভাষা নির্মাণের সূচনাও নয়, বরং এটা সেই প্রয়োজনকে দৃষ্টির সম্মুখে নিয়ে আসবার একটা প্রয়াস।