লিখেছেনঃ শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ March 31, 2017, 12:00 AM, Hits: 1839
বিষয়সূচী
(১) সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রের চরিত্র
(২) শাসন ব্যবস্থার রূপ
(৩) পঞ্চায়েত ও রাষ্ট্র
(৪) সভ্যতার নম্র রূপ
(৫) সভ্যতার বিকল্প পথ
(৬) শ্রেণীর প্রশ্ন
(৭) রাষ্ট্র ও ধর্মের আন্তঃসম্পর্ক
(৮) ভাবাদর্শিক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য ভূমিকা
(৯) সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
(১) সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্রের চরিত্র
দেশ ও কাল নিরপেক্ষভাবে রাষ্ট্র শাসনের আদর্শ রূপ বলে কিছু আছে বলে আমি মনে করি না। এটা আপেক্ষিক বা তুলনামূলক অর্থে প্রযোজ্য। সেই আপেক্ষিক অর্থে আজ যখন আমরা রাষ্ট্র শাসনের একটা আদর্শ রূপ সন্ধান করি তখন আমি পাশ্চাত্যের অনুকরণের পরিবর্তে যে দিকে দৃষ্টি দিতে বেশী আগ্রহ বোধ করি সেটা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতা। যত দিন যাচ্ছে যত চিন্তা করছি তত আমার কাছে সিন্ধু সভ্যতার নম্রতা ও মানবিকতা এবং সেই সঙ্গে তার গণতান্ত্রিকতার দিক অধিকতর জোরালো হয়ে দেখা দিচ্ছে। কেন, একটু ব্যাখ্যা করলেই বোধ হয় আমার চিন্তা স্পষ্ট করতে পারব।
তবে সেই আলোচনায় যাবার আগে বলি, আমাদের উপমহাদেশ হিসাবে ভারতবর্ষের সমাজ বা সমাজসমূহের এমন কিছু অভিন্ন সমস্যা, বৈশিষ্ট্য বা ধরন ও গতিপ্রকৃতি আছে যেগুলির উৎস সন্ধানে সিন্ধু সভ্যতায় উপস্থিত হওয়া ছাড়া আমাদের উপায় নাই। পৃথিবীর প্রাচীনতম সভ্যতা মেসোপটেমিয়া ও মিসরের সমসাময়িক এই সভ্যতা। সিন্ধু সভ্যতার নগর হিসাবে প্রথমে হরপ্পা আবিষ্কৃত হবার কারণে সিন্ধু সভ্যতা বিশেষত প্রত্নতত্ত্বের ভাষায় হরপ্পান সভ্যতা হিসাবেও কথিত হয়। প্রায় পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বে সিন্ধুর নগর সভ্যতার যাত্রা শুরু। রেডিও কার্বন ডেটিং অনুযায়ী চার হাজার ছয় শত বছর পূর্বে। মিসর ও মেসোপটেমিয়ার প্রত্যেকটির তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ আয়তন নিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই সভ্যতা আজ অবধি নানানভাবে বাংলাসহ সমগ্র উপমহাদেশের সমাজ, সংস্কৃতি, ধর্ম ও ভাষাকে প্রভাবিত করে রেখেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে তার প্রভাব অনেক গভীর এবং প্রবল।
সিন্ধু সভ্যতা যখন অনাবিষ্কৃত ছিল তখন ভারতবর্ষের দূর অতীত ছিল নানান অতিকথা, কল্পনা আর রহস্যের জালে ঢাকা। কিন্তু বিগত শতাব্দীর ২০-এর দশকে সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনসমূহ আবিষ্কারের পর থেকে ক্রমে ভারতবর্ষের দূর অতীতের অনেক অজানা রহস্য কিছু করে হলেও উন্মোচিত হতে শুরু করে। জানবার এখনও অনেক বাকী আছে, বুঝবারও। তা সত্ত্বেও প্রায় শতাব্দী কালের উৎখননের মধ্য দিয়ে সিন্ধু সভ্যতা সম্পর্কে একটা প্রাথমিক ধারণা করা যায়। এটা ঠিক যে, যে পরিমাণে নগর ও বসতি আবিষ্কার হয়েছে সে তুলনায় খননকার্য হয়েছে খুব সামান্য। সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী প্রায় দুই হাজার বসতির সন্ধান পাওয়া গেলেও উৎখনন করা নগর ও বসতিসমূহের সংখ্যা একশতেরও নীচে। দশ থেকে বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটার (কোনও কোনও হিসাবে ১.২৫ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার বা সাড়ে বারো লক্ষ বর্গকিলোমিটার) ব্যাপী বিস্তৃত একটা সভ্যতা সম্পর্কে ব্যাপক উৎখনন ছাড়া ধারণা করাও কঠিন। সর্বোপরি সিন্ধু সভ্যতার লিপির পাঠোদ্ধার আজ অবধি না হওয়ায় সভ্যতার বহু কিছুই এখনও কল্পনা নির্ভর হয়ে আছে।
তা সত্ত্বেও সিন্ধু সভ্যতার যেটুকু প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার হয়েছে তা থেকে তার সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্র সম্পর্কে কিছু ধারণা করা সম্ভব বলে আমি মনে করি। এ ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজের আদি ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ আমার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক একটি দলিল হিসাবে দেখা দিয়েছে। কারণ ঋগ্বেদ পাঠ করে আমি তাকে সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয় এবং ধ্বংসের সময়ে সংগঠিত জনপ্রিয় একটি ধর্মসংস্কার আন্দোলনের দলিল হিসাবে চিনতে পেরেছি। সুতরাং ইউরোপীয় পণ্ডিতদের দ্বারা উদ্ভাবিত এবং বহুল প্রচারিত ভারতবর্ষে বহিরাগত, পশুপালক ও যাযাবর আক্রমণকারীদের সঙ্গে ঋগ্বেদ এবং ঋগ্বেদ রচয়িতা ঋষি বা আর্যদের কোনও সম্পর্ক আমি দেখতে পাই নাই। সিন্ধু সভ্যতার ক্রমবর্ধমান আবিষ্কারসমূহ অবশ্য ইতিমধ্যে ইতিহাসের নামে এসব গালগল্পের জায়গা রাখে নাই। এ বিষয়ে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমার যৌথভাবে লিখিত গ্রন্থ ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় বিস্তারিত আলোচনা আছে।* পাঠকের আগ্রহ হলে সেটি পাঠ করতে পারেন। উপরোক্ত গ্রন্থের অনেক বিষয়বস্তুর সঙ্গে যোগসূত্র থাকলেও এই প্রবন্ধে আমার আলোচনার বিষয় অনেকখানি ভিন্ন। এখানে আমি খুব সংক্ষেপে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রের স্বরূপ ও দর্শন সন্ধানের চেষ্টা করছি।
------------------------------------------------------------------------------
* প্রকাশক ঃ ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, প্রকাশ কাল - ২০০৩। এখানে এটি উল্লেখ করা যায় যে, এই প্রবন্ধের সব নয় তবে অনেকগুলি বিষয় কম-বেশী ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আলোচিত হয়েছে। এখানে প্রসঙ্গক্রমে আরও উল্লেখ করা যায় যে, পৃথিবীর পণ্ডিত সমাজের সঙ্গে যোগাযোগ ও মতবিনিময়ের জন্য ইতিপূর্বে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমি যৌথভাবে ইংরাজীতে The Aryans and the Indus Civilization নামে একটি বই লিখি, যা ১৯৯৫ সালে দিনরাত্রি প্রকাশনী, ঢাকা, কর্তৃক প্রকাশিত হয়।
------------------------------------------------------------------------------
আমার বিবেচনায় সিন্ধু সভ্যতার জনগোষ্ঠীসমূহের মধ্যে সাধারণভাবে প্রচলিত বা কথিত ভাষায় ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল। তা না হলে এটা জনবোধ্য এবং সেহেতু জনগ্রাহ্য হত না। আবার এটাই যুক্তিযুক্ত যে, যে ভাষায় ঋগ্বেদ রচিত হয়েছিল জনসমাজের ভিতর থেকে উঠে আসা সভ্যতা হিসাবে সেটাই ছিল সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রভাষা।
সিন্ধু সভ্যতায় বৈদিক আন্দোলনের সময় প্রতিদ্বন্দ্বী অপর একটি জনপ্রিয় ধর্মসংস্কার হয়, যার দলিল হচ্ছে আমাদের নিকট সাধারণভাবে পারসিক হিসাবে পরিচিত ধর্মসম্প্রদায়ের ধর্মগ্রন্থ আবেস্তা। পণ্ডিতদের মতে ঋগ্বেদ যে ভাষায় লিখিত হয় সূচনায় সেই একই ভাষায় এটিও লিখিত হয়।
যদিও সিন্ধু সভ্যতায় সংঘটিত পরস্পর বিরোধী দুইটি ধর্মীয় আন্দোলন নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ নাই তথাপি যে পাঠকরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’ পড়েন নাই তাদের সুবিধার জন্য এ প্রসঙ্গে চুম্বকাকারে কিছু বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। ঋগ্বেদ, আবেস্তা এবং সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ পর্যালোচনা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে, সিন্ধু সভ্যতা বাঁধ ও জলকপাট সংযুক্ত নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার সমস্ত বড় এবং ছোট নদী বাঁধ এবং নদীর মাঝখানে জলকপাট বা স্লুইস গেট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত ছিল। আধুনিক কালের পূর্ব পর্যন্ত এমন কোনও ধরনের নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে কল্পনা করা না গেলেও এমন একটি ব্যবস্থার উপরই যে সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত ছিল সেই রকম অনুমানটাই একান্ত যৌক্তিক মনে হয়। তবে সুদীর্ঘ কাল ধরে এই ব্যবস্থা বিদ্যমান থাকার পর একটা সময়ে পলি জমে নদীখাত ভরাট হওয়া, নদীর গতিপথ পরিবর্তন এবং সরস্বতী নদীর মত সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নদীর মৃত্যুর ফলে বিরাট অঞ্চলের মরুকরণ ইত্যাদির ফলে সিন্ধু সভ্যতায় নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়তে থাকে এবং এক বিরাট অঞ্চল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ফলে সভ্যতায় নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গড়ে উঠে এবং জনগোষ্ঠীর একাংশ এই ব্যবস্থার অবসান দাবী করে। অপর অংশ নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সপক্ষে থাকে। এই অবস্থায় সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে।
তবে সিন্ধু সভ্যতায় নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা যে ধর্মেরও অংশ হয়েছিল ঋগ্বেদ সেই বার্তাই দেয়। ফলে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ধ্বংসের জন্য এর বিরোধী পক্ষ বিদ্যমান ধর্মকে সংস্কার করতে বাধ্য হয়। স্বাভাবিকভাবে বিদ্যমান ধর্ম ছিল রাষ্ট্র কর্তৃক সমর্থিত বা পৃষ্ঠপোষকতা প্রাপ্ত। অপর দিকে প্রত্নতত্ত্ব থেকে এটা স্পষ্ট যে, সিন্ধু সভ্যতা ছিল মূলত শান্তিপূর্ণ বা অহিংস। ফলে এটাই যুক্তিযুক্ত যে, পুরাতন ধর্ম ছিল অহিংস চেতনার সহায়ক। এখন নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করতে গিয়ে যে গৃহযুদ্ধের সূচনা ঘটাতে হয় তার জন্যও প্রয়োজন হয় পুরাতন অহিংস চেতনার সহায়ক ধর্মের সংস্কার। অর্থাৎ নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস এবং যুদ্ধকে সামাজিক বা নৈতিক বৈধতা দিবার জন্য সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। যারা এই সংস্কার করে তাদের ধর্মগ্রন্থ হচ্ছে ঋগ্বেদ, যা পরবর্তী সকল বেদের মূল। বেদের অনুসারীরা হচ্ছে বৈদিক।
একইভাবে সভ্যতায় যারা নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার সমর্থক ও সংরক্ষক ছিল তাদের জন্যও ধর্ম সংস্কার অপরিহার্য হয়ে পড়ে। কারণ পুরাতন অহিংসা নির্ভর ধর্ম দিয়ে যুদ্ধ নির্ভর বৈদিক পক্ষকে মোকাবিলা করা তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না। ফলে তারা পাল্টা একটা ধর্ম সংস্কার করে। তাদের এই ধর্ম সংস্কারের দলিল হচ্ছে আবেস্তা। এভাবে শেষ পর্যন্ত সিন্ধু সভ্যতায় একটি দীর্ঘস্থায়ী গৃহযুদ্ধ সূচিত হয় যার পরিণামে সিন্ধু সভ্যতার পতনোন্মুখ নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ধ্বংস হয়। কিন্তু এটা সিন্ধু সভ্যতার খাদ্য উৎপাদনের ভিত্তি স্বরূপ সেচ ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করে। ফলে খাদ্যাভাবে উভয় পক্ষ দ্বারাই সভ্যতার মূলভূমি পরিত্যক্ত হয়। অর্থাৎ বৈদিক পক্ষের জয় হয়েও পরাজয়ও হল। তারা সভ্যতার নিকটবর্তী এবং পূর্বদিকে অবস্থিত উর্বর গাঙ্গেয় উপত্যকায় অভিগমন করে সেখানে বসতি স্থাপন করে। আন্যদিকে, নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রক্ষায় অসমর্থ আবেস্তানরা পশ্চিমে তুলনায় কম উর্বর ইরানে অভিগমন করে। পরবর্তী কালে তারা সেখানে উন্নত নগর সভ্যতা এবং বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে।
তবে ইরানে পারসিক ধর্মাবলম্বীরা বিভিন্ন সময়ে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বিপর্যয়ের শিকার হওয়ায় মূল আবেস্তার বৃহত্তর অংশ যেমন হারিয়ে গেছে তেমন সামাজিক উলটপালটের প্রক্রিয়ায় ধর্মগ্রন্থ আবেস্তার মূল ভাষাও অনেকটাই পরিবর্তিত হয়েছে। তবু পণ্ডিতদের আবেস্তার ভাষাকে বৈদিক ভাষার সমগোত্রীয় হিসাবে চিনতে কষ্ট হয় না। যাইহোক, এ বিষয়ে এখানে আলোচনার সুযোগ নাই। তবে মূল ভাষা এবং ধর্মগ্রন্থ মূলত অপরিবর্তিত থাকায় সিন্ধু সভ্যতার সমাজকে বুঝবার ক্ষেত্রে আবেস্তার তুলনায় ঋগ্বেদ অনেক বেশী সহায়ক।
অবশ্য সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ব্যবস্থার স্বরূপ সন্ধানে ঋগ্বেদ যতটা না সহায়ক তার চেয়ে অনেক বেশী সহায়ক সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক বা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি। ঋগ্বেদের মূল দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল ধর্মসংস্কার ও যুদ্ধের উপর। সুতরাং সামাজিক ও রাজনৈতিক বিষয়গুলির প্রতি দৃষ্টি কম পড়েছে কিংবা অনেক ক্ষেত্রে পড়ে নাই। সর্বোপরি এটি সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসনের সঙ্গে পুরোহিত শ্রেণীর দূরত্ব থাকারও দিকে ইঙ্গিত দেয়। অর্থাৎ সমাজে ধর্ম এবং পুরোহিত শ্রেণীর যে ভূমিকাই থাকে রাষ্ট্র বা রাষ্ট্র শাসনে যে তাদের প্রত্যক্ষ কোনও ভূমিকা ছিল না ঋগ্বেদ থেকে সেই রকমই মনে হয়। সুতরাং এ ক্ষেত্রে বরং সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতত্ত্ব আমাদের জন্য অনেক বেশী সহায়ক হয়। নগর পরিকল্পনা, বসতির বিন্যাস, বিরাট কোনও প্রাসাদের অনুপস্থিতি, বাড়ীঘর ও তৈজসপত্রের বণ্টনের ধরন, ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে নরকঙ্কালে পুষ্টিমানে তেমন ধরনের পার্থক্য না থাকা*, ইত্যাদি থেকে সিন্ধু সভ্যতার একই সঙ্গে সমৃদ্ধি এবং গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে সহজেই ধারণা করা যায়। শুধু তাই নয়, এই সভ্যতা যে প্রাচীন অন্য সমস্ত সভ্যতার মত প্রধানত বলপ্রয়োগ ও দাস প্রথা নির্ভর ছিল না সে সম্পর্কেও সিদ্ধান্ত টানা যায়। বলপ্রয়োগ কিংবা দাসত্ব একেবারে ছিল না সেটা ভাবা ভুল হতে পারে। কিছু গৌণ রূপে দাসপ্রথাও হয়ত ছিল। তবে বিশালায়তনে প্রতিষ্ঠিত সভ্যতায় যে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠনে বলপ্রয়োগ ও যুদ্ধের ভূমিকা ছিল যথেষ্ট গৌণ সে কথা প্রত্নতাত্ত্বিক সকল নিদর্শন থেকে নির্দ্বিধায় বলা যায়। এ ব্যাপারে প্রায় সকল পণ্ডিতই একমত।
------------------------------------------------------------------------------
* কেনেডি পাঁচটি প্রধান বসতি থেকে প্রাপ্ত প্রায় ৩৫০টি নরকঙ্কালের উপর গবেষণালব্ধ ফলের কথা উল্লেখ করে বলছেন ঃ ‘... ... .. High ranking individuals enjoy a greater potential to attain their full ontogenetic development, hence are taller in stature, and tend to suffer less from abnormalities of nutritional stress than do individuals of subordinate social status within the same society. However, observations of Harappan skeletal series from five major sites, which comprise about 350 individuals, have not revealed significant differences in patterns of growth and development as would be recognized by lines of arrested growth in long bones and hyper-palsia or dental enamel. Osseons malformations suggestive of nutritional stress are absent as well. Nor are there any striking differences in incidences of dental attrition and common dental pathologies such as caries, abscess, malocclusion and ante-mortem tooth loss in Harappan skeletons. In short, the Harappan skeletal series is aberrant when compared with series from other archaeological sites for which archaeological data suggest a significant development of social stratification. This negative evidence from the Harappan sample should not be interpreted to mean that a social hierarchy was absent in Harappan culture. Rather, biological observations suggest that social control may have been exercised by the Harappan elite in a way that did not evoke the usual dietary stresses so often imposed elswhere upon an urban proletariat. The absence of royal tombs in Harappan centers may be significant in this connection.’ Kenneth A.R. Kennedy, ‘Skulls, Aryans and Flowing Drains : The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of the Harappan Civilization,’ in, Harappan Civilization:A Contemporary Perspective, (1982), P. 290.
------------------------------------------------------------------------------
অস্ত্র-শস্ত্রের নিম্নমান এবং স্বল্পতা থেকে কোন কোন পণ্ডিত এমনও মনে করেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ছিল না। কারণ তাদের ধারণা যে সেখানে স্থায়ী সেনাবাহিনী ছিল না। সঙ্গত কারণে সেনাবাহিনী না থাকলে কীভাবে রাষ্ট্র থাকতে পারে সেই প্রশ্ন তাদের আছে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রহীন সভ্যতা গঠন ও পরিচালনার সম্ভাব্য ধরন সম্পর্কে তাদের আলোচনাও আছে।*
------------------------------------------------------------------------------
* দেখুন ঃ Jim G. Shaffer and Diane A. Lichtenstein, ‘The concepts of “cultural tradition” and “paleoethnicity” in South Asian archaeology,’ in, The Indo-Aryans in Ancient South Asia: Language, Material Culture and Ethnicity (1997), pp. 134-137.
------------------------------------------------------------------------------
আমার মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র গঠন বা উদ্ভব ও পরিচালনা পদ্ধতি সম্পর্কে একটা যৌক্তিক অনুমান করতে পারলে ভারতবর্ষের সমাজ ও ইতিহাসের বহু রহস্যই উন্মোচিত হবে। শুধু তাই নয়, সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে একটি শান্তিপূর্ণ, স্থিতিশীল, ক্ষমতা ও সম্পদের মোটামুটি ভারসাম্যপূর্ণ ও সুষম বণ্টন ভিত্তিক সমাজ ও রাষ্ট্রের অবয়ব সম্পর্কে আমরা যে কল্পচিত্র নির্মাণ করতে পারি তা থেকে আজকের পৃথিবীর এই চরম বৈষম্য, বলপ্রয়োগ, হিংস্রতা, প্রতারণা, বঞ্চনা ও যুদ্ধ নির্ভর সভ্যতার বিপরীতে তুলনায় একটি অধিকতর মানব কল্যাণমুখী সভ্যতা নির্মাণের পথ খুঁজে পেতে পারি। এটা বুঝি যে, কোনও ব্যবস্থাই মানুষকে সব ধরনের কিংবা চিরস্থায়ী সমাধান দিতে পারে না। বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যেমন থেকে যায় কিংবা নূতন বিভিন্ন সমস্যা জন্ম নেয় তেমন কাল পরিক্রমায় মানুষের দেহের মত সভ্যতাকেও বার্ধক্য এবং মৃত্যু গ্রাস করে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সুস্থ, সবল, প্রবল ও দীর্ঘ জীবনের কল্পনার মত সভ্যতার দীর্ঘস্থায়িত্ব, মানবিকতা, ন্যায়নীতি, প্রাণশক্তি ও প্রাবল্যের সম্ভাব্যতার কল্পনা আমাদেরকে নব নির্মাণের প্রেরণায় উজ্জীবিত করে।
সুতরাং আজ নূতন করে সিন্ধু সভ্যতার দিকে দৃষ্টি ফিরাতে হয়। এই রকমটা মনে হয় যে আজকের মত করে না হলেও সিন্ধু সভ্যতা পরিচালিত হত এক ধরনের গণতান্ত্রিক রীতিতে। আজকের পাশ্চাত্য গণতন্ত্র তার অনেক অবদান সত্ত্বেও শুধু যে যুদ্ধ, পররাজ্য গ্রাস এবং অধীনস্থ, দুর্বল ও পশ্চাৎপদ পরজাতিগুলির উৎসাদন, লুণ্ঠন ও শোষণের প্রক্রিয়ায় অনেকাংশে বিকশিত হয়েছে তাই নয়, অধিকন্তু আজও তার গণতন্ত্র অনেক ক্ষেত্রেই যে ধরনের ব্যক্তি-মালিকানা ভিত্তিক পুঁজিবাদী ব্যবস্থার উপর নির্ভর করে দাঁড়িয়ে আছে সেই পুঁজিবাদের অস্তিত্বের একটি প্রধান শর্ত হয়ে আছে যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ এবং এই যুদ্ধাস্ত্র নির্মাণ নির্ভর অর্থনীতিকে রক্ষার জন্য দেশে দেশে বিভিন্ন কায়দায় যুদ্ধ রফতানী করা। এই যুদ্ধ রফতানী কখনও করা হয় গণতন্ত্রের নামে, কখনও করা হয় মানবাধিকার রক্ষার নামে, কখনও করা হয় গণবিধ্বংসী অস্ত্র ধ্বংসের নামে। আবার নানান কৌশলে পৃথিবীর দেশে দেশে যুদ্ধের উত্তেজনা জিইয়ে রেখে অস্ত্র ব্যবসাকে চাঙ্গা রাখা হয়। এ ক্ষেত্রে মূল বিবেচ্য হল যুদ্ধ ব্যবসার মাধ্যমে পাশ্চাত্য প্রাধান্য ভিত্তিক ও যুদ্ধনির্ভর ব্যক্তি-পুঁজিবাদকে রক্ষা ও প্রসার করা। বিশেষত পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক এই গণতন্ত্র অনেকাংশে দাঁড়িয়ে আছে পৃথিবীর যে প্রান্তের হোক দুর্বল ও অসহায় মানুষের দাসত্ব অথবা লাশের উপর। গত কয়েক শত বৎসর যাবত ইউরোপ-আমেরিকার ভূমিকার দিকে দৃষ্টি দিলে বিষয়টা স্পষ্ট হয়।
সভ্যতা, রাষ্ট্র, সমাজ ও গণতন্ত্র নির্মাণে সিন্ধু সভ্যতা এ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা চিত্র উপস্থিত করে। সেনাবাহিনী ও যুদ্ধ সম্পর্কে ভারতবর্ষ বহির্ভূত সমাজগুলির অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে না বলে সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ছিল না এমন ধারণাকে আমি সঠিক মনে করি না। কারণ রাষ্ট্র ছাড়া সভ্যতা নির্মাণ হতে পারে না। আর রাষ্ট্র এমন এক সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে সমাজের বলপ্রয়োগের ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়। শুধু যে রাষ্ট্রের ভিতরে বিদ্রোহ বা ভাঙ্গন ঠেকাবার জন্য বলপ্রয়োগ বা যুদ্ধের প্রয়োজন হতে পারে তাই নয়, উপরন্তু বহিঃশক্তির আক্রমণ ও আগ্রাসন থেকে আত্মরক্ষার জন্যও তার প্রয়োজন হতে পারে। আত্মরক্ষার শক্তি বা ব্যবস্থা না থাকলে সেই রাষ্ট্র কয়দিন টিকতে পারে? যুদ্ধের শক্তি বা প্রস্তুতি ছাড়া অধীনস্থ রূপ নিয়ে সমাজ টিকতে পারে, কিন্তু রাষ্ট্র পারে না।
সুতরাং প্রত্নতত্ত্ব দ্বারা সিন্ধু সভ্যতায় উন্নত ও শক্তিশালী সেনাবাহিনীর উপস্থিতি কিংবা যুদ্ধ নির্ভরতার প্রমাণ পাওয়া না গেলেও সেখানে আত্মরক্ষার ব্যবস্থা হিসাবে রাষ্ট্র যে সামরিক শক্তিকে রক্ষা করত তেমনটা ধরে নেওয়াই যুক্তিযুক্ত। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য দুর্বল হলেও সাহিত্য থেকে আমরা তার সাক্ষ্য পাই। আমরা অনুমান করতে পারি, সিন্ধুর নগর সভ্যতার দিকে যাত্রাকালে বৃহৎ ও কেন্দ্রীভূত রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নে সমাজে যে দ্বন্দ্ব দেখা দেয় তার মীমাংসার জন্য বৃহদায়তনে একটি যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে কেন্দ্রীভূত ও ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের শক্তি জয়ী হয়। এই যুদ্ধের ঘটনাকে অবলম্বন করে পরবর্তী কালে পৌরাণিক মহাকাব্য হিসাবে মহাভারত রচিত হয় বলে ধারণা করি।*
------------------------------------------------------------------------
* এ বিষয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় ‘মহাভারত ও সিন্ধু সভ্যতা’ নামে একটি অধ্যায়ে স্বতন্ত্রভাবে আলোচনা আছে।
-----------------------------------------------------------------------
সিন্ধু সভ্যতায় সামরিকতা বা যুদ্ধশক্তির অস্তিত্ব এবং যুদ্ধের অপর একটি সাক্ষ্য আমরা পাই ঋগ্বেদ থেকে। এ নিয়ে এখানে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ নাই। শুধু এইটুকু উল্লেখ করি যে আমার অনুমান সিন্ধু সভ্যতার পতন কালে সেখানে বিভিন্ন প্রশ্নে সমাজে যে দ্বন্দ্ব ও বিবাদ ঘটে সেটি প্রথমে একটি ধর্ম সংস্কার এবং অতঃপর একটি গৃহযুদ্ধের সূত্রপাত ঘটায়। এই সংস্কার ও গৃহযুদ্ধের প্রয়োজনে সিন্ধু সভ্যতার একদল ঋষি যে সকল মন্ত্র রচনা করেন সেগুলিই ধর্মগ্রন্থ হিসাবে ঋগ্বেদে সংকলিত হয়।
সুতরাং ঋগ্বেদকে মনে হতে পারে যুদ্ধনির্ভর একটি সমাজের দলিল। যুদ্ধনির্ভরতার দিকটি ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি সাময়িক ঘটনা, একটি বিশেষ প্রয়োজন সম্ভূত। বৈদিক আন্দোলন যে লক্ষ্য নিয়ে সংগঠিত হয়েছিল সেই লক্ষ্য অর্জিত হবার পর বৈদিক ধর্মের প্রতি আনুগত্য সত্ত্বেও বৈদিক সমাজ ক্রমে তার নিজস্ব শান্তির ধারায় অনেকাংশে ফিরে গেছে। এরই বহিঃপ্রকাশ আমরা ঘটতে দেখি পরবর্তী হিন্দু ধর্ম ও সমাজে। ঋগ্বেদের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারের প্রতি সাড়ম্বর আনুগত্য ঘোষণা করলেও পরবর্তী কালে বিকশিত হিন্দু ধর্ম ও সমাজ বৈদিক ধর্মের আদর্শ কতটুকু পালন করে সেটা মনে হয় যারা বেদ ও হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে কিছু ধারণা রাখেন তাদেরকে বলে দিতে হবে না। বস্তুত বেদের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা সত্ত্বেও হিন্দু ধর্ম ও সমাজ বৈদিক ধর্ম ও সমাজ থেকে বহু বিষয়েই ভিন্ন।
অবশ্য বৈদিক ধর্মের সহিংসতা এবং আরও কিছু উপাদান পরবর্তী হিন্দু সমাজে আমরা লক্ষ্য করি। যুদ্ধ এবং সহিংসতার চর্চা থেকেছে। তবে ক্ষত্রিয় বর্ণজাতির উদ্ভব ঘটিয়ে সেটাকে সমাজের ক্ষুদ্র একটা গোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা হয়েছে। তারা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে যুদ্ধ ও যুদ্ধ-নির্ভর রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। কিন্তু সমাজ মূলত অহিংসার আশ্রয় নিতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেছে। সুতরাং বর্ণজাতি হিসাবে ক্ষত্রিয়রা উদ্ভূত হল যুদ্ধের ও যুদ্ধ-নির্ভর রাষ্ট্রের শাসকের দায়িত্ব পালনের জন্য এবং সমাজের বাকী অংশ রইল নিরস্ত্র।
যাইহোক, এতে কোনই সন্দেহ নাই যে দীর্ঘ সময় ব্যাপী সিন্ধু সভ্যতায় অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ বা বিশৃঙ্খলার ভয় বা বিপদ যদি স্বল্পমাত্রায়ও থেকে থাকে তবু রাষ্ট্র বিশেষ করে বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য যেমন ধরনের হোক প্রতিরক্ষার শক্তি মজুত রাখত। কারণ যুদ্ধকে যুদ্ধ ব্যতীত আর কোন কিছু দিয়েই মোকাবিলা করা যায় না। হয়ত বহিঃশক্তির আক্রমণ থেকে বিশাল সভ্যতার প্রান্তে প্রতিরক্ষার এমন ব্যবস্থা ছিল যার রূপ এখন পর্যন্ত আমাদের অজানা রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে আমরা অনেক পরবর্তী কালে প্রজাতান্ত্রিক রোমের একটি প্রথার দিকে দৃষ্টি দিতে পারি। জুলিয়াস সিজার কর্তৃক প্রজাতান্ত্রিক রোমের ক্ষমতা দখল করার পূর্ব পর্যন্ত রোমান সমাজের প্রথা এবং রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী কোনও সশস্ত্র সেনাদল প্রজাতান্ত্রিক রোমের সীমান্ত হিসাবে বিবেচিত রুবিকন নদী অতিক্রম করে রোমের মূলভূমিতে এবং রোম নগরে প্রবেশ করতে পারত না। এটা ছিল যে কোনও সেনাদল ও তার সেনানায়কদের জন্য মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ। কেননা মনে করা হত যে, এতে রাজধানীতে প্রজাতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান, বিদ্রোহ অথবা গৃহযুদ্ধ হতে পারে। জুলিয়াস সিজার এই বিধানকে অমান্য করে তার সশস্ত্র সেনাদল নিয়ে খ্রীষ্টপূর্ব ৪৯ অব্দে রুবিকন নদী পার হয়ে রোম নগরে প্রবেশ করেন এবং ক্ষমতা দখল করেন। পরিণতিতে রোমের প্রজাতান্ত্রিক ব্যবস্থার অবসান ঘটে।
প্রজাতন্ত্রের যুগে রুবিকন নদীকে সীমান্ত হিসাবে বিবেচনা করে নিজের তৈরী সেনাবাহিনী সম্পর্কে রোমের এই সতর্ক দৃষ্টি খুব লক্ষ্যণীয়। অর্থাৎ নিজ সাম্রাজ্য বিস্তার এবং যুদ্ধের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরতার সময়েও রোমের অসামরিক শাসকদের তাদের সেনাবাহিনী এবং সমরযন্ত্রের উপর সতর্ক দৃষ্টি এবং কঠোর নিয়ন্ত্রণ রাখবার বিষয়টি সিন্ধু সভ্যতার বৈশিষ্ট্য বুঝবার ক্ষেত্রে আমাদের জন্য সহায়ক হতে পারে।
এটা বুঝা যায় রোম সাম্রাজ্যের মত সিন্ধু সভ্যতা যুদ্ধ নির্ভর ছিল না। এটা শুধু যে কিছু ব্যক্তির ইচ্ছা বা সদিচ্ছার ফলশ্রুতি তা নয়। সে কালে সিন্ধু সভ্যতা যে অঞ্চলকে ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল সেই অঞ্চলের সামাজিক বাস্তবতা এবং তৎকালীন সভ্যতা ও প্রযুক্তির মানও এমন একটি অবস্থার অনুকূল ছিল। বিশেষত তখনও অশ্বের ব্যবহার প্রবর্তিত হয় নাই। ফলে বহু দূর অঞ্চল থেকে ঝড়ের গতিতে এসে আক্রমণ চালানোর যুগ সেটা নয়। এই অবস্থায় দক্ষিণে সমুদ্র এবং উত্তর ও পশ্চিমে পর্বত, পাহাড় এবং মরু অথবা মরুপ্রায় ভূমি এবং পূর্বদিকে গঙ্গা প্লাবিত জলাভূমি ও অরণ্য আচ্ছাদিত বিস্তীর্ণ ভূভাগ ইত্যাদি দ্বারা উপমহাদেশের ঐ অঞ্চল অনেকখানি সুরক্ষিত ছিল। অন্যদিকে, তখনও মানুষ লৌহাস্ত্র নির্মাণ ও ব্যবহার করতে শিখে নাই। তখনও লৌহাস্ত্রের তুলনায় নমনীয় তাম্র ও ব্রোঞ্জের অস্ত্র নিয়ে পায়ে হেঁটে যুদ্ধাভিযানের যুগ। এর ফলে অশ্ব এবং লৌহাস্ত্র যুদ্ধে যে গতি এবং শক্তি পরবর্তী কালে এনেছিল সিন্ধু সভ্যতার নির্মাণ এবং বিকাশের কালে সেটা ছিল অনুপস্থিত। এই বাস্তবতার সঙ্গে যুক্ত করতে হবে এখানকার সমাজ বাস্তবতায় প্রধানত অহিংস বা শান্তিপূর্ণ উপায়ে সভ্যতা বিকাশের গতিধারাকে। ফলে এখানে প্রধানত অহিংস উপায়ে একটি সভ্যতা এবং রাষ্ট্রকে গড়ে তুলা এবং এত দীর্ঘকাল ব্যাপী রক্ষা করা গেছে।
তবে এটাও বুঝতে হবে যে, সভ্যতা যতই অহিংস হোক সভ্যতা বহির্ভূত অঞ্চল সর্বত্র তেমন ছিল না। বিশেষত সিন্ধু সভ্যতার কিংবা তার অধিবাসীদের সম্পদের প্রতি বাইরের বিভিন্ন উপজাতি বা জনগোষ্ঠীর লোভ হওয়া স্বাভাবিক ছিল। প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা না রাখা মানে তাদের লোভকে উস্কে দেওয়া। সুতরাং সে ক্ষেত্রে সভ্যতাকে বহিরাক্রমণ থেকে আত্মরক্ষার জন্য হলেও শক্তিশালী প্রতিরক্ষা তথা সামরিক ব্যবস্থাকে রক্ষা করতে হয়েছিল, যা সম্ভবত অবস্থান করত সভ্যতার প্রান্তবর্তী বা সীমান্তবর্তী স্থানে। তবে এটা বুঝা যায় সভ্যতা রক্ষায় যে ভূমিকা থাক সভ্যতা এবং রাষ্ট্র নির্মাণ ও পরিচালনায় গৌণ ভূমিকা রাখায় সেনাবাহিনী বা সৈনিকদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা তুলনায় অনেক কম ছিল। এটা অনুমেয় যে, রাষ্ট্রের জন্য অপরিহার্য হলেও মর্যাদায় তারা ছিল প্রান্তবর্তী এবং ক্ষমতা কেন্দ্র থেকে দূরে।
অবশ্য সভ্যতায় যুদ্ধ যে একেবারে অজ্ঞাত ছিল না তার প্রমাণ বৈদিক সংস্কারের মাধ্যমে সমাজে যুদ্ধের শক্তিকে মুক্ত করা বা প্রাধান্যে নিয়ে আসা। একইভাবে পাশাপাশি আবেস্তান সংস্কার দ্বারাও এই কাজ করা হয়। অর্থাৎ যত গৌণ আকারে হোক সমাজ ও রাষ্ট্রে পূর্ব থেকে যুদ্ধের উপাদান ছিল বলে ধর্ম বা সমাজ সংস্কারের মাধ্যমে গৌণ অবস্থান থেকে তাকে প্রাধান্যে আনা গিয়েছিল। তবে এটি ভিন্ন আলোচনার বিষয়।*
------------------------------------------------------------------------------
* ঋগ্বেদ এবং আবেস্তা উভয় ধর্মগ্রন্থ থেকেই গৃহযুদ্ধের পর্যায়ে যে দূর অঞ্চল থেকে যোদ্ধা বা সেনাদলসমূহকে যুদ্ধে অংশ নিবার জন্য আনা হয়েছিল সে সম্পর্কে অনুমান করা যায়। এ সম্পর্কে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমাদের আলোচনা আছে।
------------------------------------------------------------------------------
সিন্ধু সভ্যতায় যুদ্ধ ও সহিংসতার উপস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা শেষ করার পূর্বে এইটুকু বলি যে, কোনও সভ্যতাই যেমন যুদ্ধ নির্ভর ও সহিংস হলে সর্বক্ষণ যুদ্ধ করে বেড়াবে ব্যাপারটা তেমন নয় তেমন কোনও সভ্যতা অহিংস হলেও একান্ত প্রয়োজনে বা অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হলেও যুদ্ধ ও সহিংসতার চর্চা করবে না ব্যাপারটা তেমনও হতে পারে না। আসলে সভ্যতার মূল প্রবণতা ও বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে আমরা সেই সভ্যতাকে সহিংস নাকি অহিংস বলব সেটা। সেদিক থেকেই নির্দ্বিধায় সিন্ধু সভ্যতাকে আমরা মূলত অহিংস ও শান্তিপূর্ণ সভ্যতা হিসাবে চিহ্নিত করতে পারি।
(২) শাসন ব্যবস্থার রূপ
পুনরায় আমরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থার দিকটিতে দৃষ্টি দিই। একটু আগে বলেছি যে, প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য থেকে গোটা সভ্যতাকে মূলত শান্তিপূর্ণ বা অহিংস মনে হয়। তা থেকে মনে হয় সমাজ, সভ্যতা ও রাষ্ট্র নির্মাণে যুদ্ধ ও জবরদস্তি বা বলপ্রয়োগের তুলনায় শান্তি ও স্বেচ্ছাসম্মতির ভূমিকা ছিল অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। এটা কীভাবে সম্ভব যদি রাষ্ট্র ও সমাজ শাসনে সাধারণ মানুষেরও কোনও না কোনও ধরনের অংশগ্রহণ বা মত প্রতিফলনের সুযোগ না থাকে? প্রত্নতাত্ত্বিকদের অধিকাংশের মতে সিন্ধু নগর সভ্যতার সূচনার সময় খ্রীষ্টপূর্ব ২,৬০০ অব্দ। অনেকের মতে এটা খ্রীষ্টপূর্ব ৩,০০০ অব্দ। অবসান বা ধ্বংস শুরু হয় মোটামুটি খ্রীষ্টপূর্ব ১৯ শতকের দিকে এবং অবসান বা ধ্বংস হয় খ্রীষ্টপূর্ব ১৭ শতকে। অবশ্য সভ্যতার অবশেষ আরও কিছুকাল নানানভাবে টিকে থাকে। বিলুপ্তির সময়সীমা নিয়ে নানান মত আছে। কোনও মত অনুযায়ী সেটা খ্রীষ্টপূর্ব ১৫ শতাব্দী কোনও মত অনুযায়ী খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ১০ শতাব্দী। আমরা যদি পূর্ণাঙ্গ নগর সভ্যতা রূপে বিরাজমান কালটাকেও হিসাবে নিই তাহলে আজ থেকে প্রায় চার হাজার বছর আগে পর্যন্ত অর্থাৎ প্রায় এক বা পৌনে এক হাজার বছর ব্যাপী এমন এক রাষ্ট্র পরিচালনা ব্যবস্থাকে বিদ্যমান দেখতে পাই যার ভিত্তি ছিল প্রায় সকল অথবা সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের স্বেচ্ছাসম্মতি।
হয়ত বলা হবে এ ক্ষেত্রে স্বেচ্ছাসম্মতির মধ্যে গণতন্ত্রের কিছু নাই। কারণ ধর্মের প্রভাবে মানুষ শাসকদের সব সিদ্ধান্তকে নীরবে মাথা মেনে নিত। কিন্তু ধর্মের প্রভাবেও যে মানুষ সবকিছুকে মেনে নেয় না তার প্রমাণ মিসর এবং মেসোপটেমিয়ার প্রাচীন সভ্যতা। যারা এই দুই সভ্যতা সম্পর্কে কিছু জানেন তারা জানেন যে, ধর্ম ভিত্তিক হওয়া সত্ত্বেও জবরদস্তি, যুদ্ধ এবং নিষ্ঠুরতা এই দুই সভ্যতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। সেই সঙ্গে ছিল মুষ্টিমেয়ের হাতে ক্ষমতা ও সম্পদের অতি কেন্দ্রীভবন, যা সিন্ধু সভ্যতায় ছিল অকল্পনীয়।
এমন একটি সিদ্ধান্ত আমার কাছে যুক্তি সঙ্গত মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার অহিংসা নীতি বা শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ শাসনের একটি উৎস হচ্ছে সমাজের সাধারণ মানুষদের রাষ্ট্রের পরিচালনা ব্যবস্থায় কোন না কোন প্রকারে ভূমিকা রাখার কিংবা মত প্রতিফলনের সুযোগ। ফলে রাষ্ট্র জনগণের প্রয়োজন, ইচ্ছা ও চেতনার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চলতে বাধ্য হয়েছে। আবার একই সঙ্গে আমাদেরকে এই সিদ্ধান্ত টানতে হয় যে জনগণকেও কোনও বিশেষ প্রক্রিয়ায় এই রকম অহিংস রাষ্ট্র ব্যবস্থার উপযোগী করে নেওয়া হয়েছিল। সহিংসতায় অভ্যস্ত জনগণকে যদি রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে কোন প্রকার সুযোগ দেওয়া যায় তাহলে সেই রাষ্ট্রের কী দশা হতে পারে তা বোধ হয় ব্যাখ্যা করে বলতে হবে না। সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি থেকে আমরা যে ধরনের শান্তিপূর্ণ রাষ্ট্র ব্যবস্থার রূপ কল্পনা করতে পারি সেটা একমাত্র সেখানেই সম্ভব যেখানে শাসক ও শাসিত উভয়েই পারস্পরিক সম্মতি ও সহযোগিতার মাধ্যমে এই ধরনের একটি ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারে। অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে মূলত পারস্পরিক সহযোগিতা ও স্বেচ্ছাসম্মতির ভিত্তিতে গড়ে উঠা সমাজের অভিব্যক্তি হিসাবে দেখতে হবে যেখানে বলপ্রয়োগ বা সহিংসতা এবং ত্রাসের ভূমিকা ছিল তুলনায় অনেক কম।
যাইহোক, আমরা কি সিন্ধুর রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে কোনও অনুমান করতে পারি? আমার মনে হয় প্রত্যক্ষভাবে সিন্ধু সভ্যতার উত্তরাধিকার ধারণকারী ভারতবর্ষের সমাজের দিকে দৃষ্টি দিলে সিন্ধু সভ্যতার সেই শাসন ব্যবস্থার একটা অস্পষ্ট ও আংশিক ছায়া আমরা খুঁজে পাব ব্রিটিশ শাসন প্রতিষ্ঠার পূর্বকাল পর্যন্ত বিদ্যমান পঞ্চায়েতমূলক শাসন ব্যবস্থার মধ্যে, যা ছিল জনসমাজের স্বশাসনের নিজস্ব ভারতীয় রূপ। সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তী কালে কয়েক হাজার বছর যাবত বিশেষত গ্রাম সমাজের নিজস্ব শক্তি রক্ষায় পঞ্চায়েতের ভূমিকা ছিল অপরিমেয়।
এটা বুঝা যায় সিন্ধু সভ্যতায় কল্পস্বর্গীয় সাম্যবাদ ছিল না। তাহলে সভ্যতা নির্মাণ করা যেত না। কিন্তু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদি দ্বারা এটাও স্পষ্ট যে, সভ্যতায় শ্রেণী বিভাজন ও বৈষম্য থাকলেও ক্ষমতা এবং সম্পদের বৈষম্য খুব বেশী প্রকট বা ভারসাম্যহীন ছিল না। অন্তত নগরগুলির চিত্র থেকে সেটা স্পষ্ট। বাসগৃহের আকার-আয়তনে কিছু পার্থক্য থাকলেও হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োসহ সব নগরে প্রতিটা মানুষ থাকত ছোট বা বড় যেমন হোক ইটের তৈরী বাড়ীতে। সভ্যতার নিদর্শন থেকে সম্পদের আড়ম্বর কিংবা ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ করে এমন কোনও বিরাটায়তন এবং আকাশচুম্বী নির্মাণ বা মহানির্মাণের চিহ্ন আমরা কোথায়ও দেখি না।
অথচ মিসরীয় সভ্যতায় ছিল রাজাদের সমাধি হিসাবে বিশাল বিশাল পিরামিড, বিরাটায়তন রাজপ্রাসাদ ও মন্দির, দেবদেবীদের বিরাট প্রতিমা এবং সেই সঙ্গে সম্রাট বা ফারাওদের বিরাট সব মূর্তি বা প্রতিকৃতি। একইভাবে মেসোপটেমিয়ার নগর-রাষ্ট্রগুলি যে মন্দির বা জিগ্গুরাটগুলিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠত সেগুলিও হত বিরাটায়তন। এবং সেই সঙ্গে পুরোহিত-রাজাদের জন্য নির্মিত হত বিরাট সব প্রাসাদ ।
কিন্তু সিন্ধু সভ্যতায় সেই ধরনের বৃহৎ নির্মাণের দিকে দৃষ্টি না দিয়ে দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে কীভাবে নাগরিক বা জনসাধারণের জন্য সর্বাধিক ব্যবহারিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও সুবিধার বন্দোবস্ত করা যায় সেই দিকে। যেন এক সভ্যতা তার মানুষদের নিত্যদিনের প্রয়োজন কীভাবে পূরণ করবে সেদিকে দৃষ্টি রেখেই সতর্ক ও কৃপণ বণিকের মত প্রতি পাই-পয়সার নিপুণ হিসাব করে ব্যয় করেছে। এত বিশালায়তন ব্যাপী বিস্তৃত সুউন্নত রাষ্ট্র ও সভ্যতা! অথচ তা না করেছে তার শৌর্য এবং সামর্থ্য প্রকাশের আড়ম্বরপূর্ণ আয়োজন, না করেছে তার শাসক বা নেতাদের জন্য চোখে পড়ার মত অতিকায় কোনও নির্মাণ। এমনকি ধর্মমন্দির হিসাবে চিহ্নিত করা যায় এমন অতিকায় কোন গৃহও নাই। প্রতিটি নগরে আছে হয় ঢাকনা যুক্ত ড্রেন যা দিয়ে মানুষের দেহের বর্জ্য নগর থেকে দূরে নদীতে নিষ্কাশন করা হত, নয় নল দিয়ে মাটির নীচে বর্জ্য নিষ্কাশনের জন্য অন্য কোনও ধরনের নিপুণ ব্যবস্থা। সকল নাগরিকের জন্য আছে পানীয় অথবা ব্যবহার্য জল লাভের জন্য ব্যবস্থা। রাস্তা, বাসগৃহ ইত্যাদি নির্মাণের মধ্য দিয়েও বেরিয়ে আসে বিস্ময় জাগানিয়া নগর পরিকল্পনা। আসলে বেরিয়ে আসে সভ্যতার নায়ক বা শাসকদের দৃষ্টিভঙ্গী।
আমার কাছে সিন্ধু সভ্যতা কতটা অহিংস বা সহিংস তার চেয়ে অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ হল সকল নাগরিক বা সাধারণ মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণের প্রতি সভ্যতার মনোযোগ কতটা সেইটা। সেই দিক থেকে বিচার করলে সিন্ধু সভ্যতাকে আধুনিক কালের পূর্ব পর্যন্ত মানুষের ইতিহাসে এক অতুলনীয় সভ্যতার মর্যাদা দিতে হয়।
এটা ঠিক যে, নগর ও গ্রামের মধ্যে ছিল ব্যবধান তথা বৈষম্য। সেটা যে বড় রকম ছিল সেটা মনে করার কারণও আছে। কিন্তু প্রত্নতত্ত্ব থেকে সেটাকেও চরম পর্যায়ের বলে এখন পর্যন্ত আমরা মনে করতে পারি না। যতদূর মনে হয় সমাজের সর্বস্তরে কম অথবা বেশী একটা ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রাখবার উপর রাষ্ট্র সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিত। যার একটা প্রমাণ ধনী-দরিদ্র সব ধরনের পাওয়া বহুসংখ্যক মানুষের কঙ্কালে পুষ্টিমানের তুলনামূলকভাবে সমতার উপস্থিতি, যা এ সংক্রান্ত গবেষকদের বিস্মিত করেছে। অথচ অন্য সব সভ্যতায় ধনী এবং দরিদ্রদের কঙ্কাল থেকে পুষ্টিমানে বিরাট ধরনের পার্থক্যের উপস্থিতির প্রমাণ পাওয়া গেছে।
ফলে সভ্যতার আবিষ্কৃত সব নিদর্শন শাসকসহ সকলের জীবনাচরণে নম্রতা ও সংযমের দিকে যেমন ইঙ্গিত করে তেমন সম্পদের প্রদর্শনে সংযমের দিকেও ইঙ্গিত করে। এটা কিন্তু আর একটা দিকে ইঙ্গিত করে সেটা হচ্ছে এক হাতে সব ক্ষমতার কেন্দ্রীভবন না হওয়া। মনে হয় তুলনায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী একজন কোনও শাসকও ছিল না এবং ক্ষমতা ছিল ভারসাম্যপূর্ণভাবে বণ্টিত। এটাও মনে হয় শাসক বা রাষ্ট্র সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কাছ থেকে শ্রম পাবার জন্য কিছুটা নম্র বা নমনীয় পদ্ধতি যেমন উদ্ভাবন করেছিল তেমন বিনিময়ে তাদেরকে যতটা সম্ভব সুবিধা দিতেও চেষ্টা করেছিল। ফলে এক ধরনের সমতা ও মর্যাদা সাধারণ নাগরিক বা মানুষরা ভোগ করত এমনটা অনুমান করবার কারণ আছে।
সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসন ব্যবস্থার স্বরূপ সন্ধান করতে গিয়ে এখন একটা গুরুতর প্রশ্নের উত্তর আমাদেরকে পেতে হচ্ছে, তা হল এই যে সভ্যতার সর্বত্র সমরূপতা বা অভিন্ন বৈশিষ্ট্য কীভাবে সম্ভব হয়েছিল। বিশাল অঞ্চল ব্যাপী বিস্তৃত একটা সভ্যতা, কাল প্রেক্ষিতে যাকে মহাসভ্যতা হিসাবে উল্লেখ করা যায়, সেখানে সর্বত্র নগর পরিকল্পনায় এত সমরূপতা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? তাছাড়া একই মাপের ইট, একই মাপ, একই ওজন, এক ধরনের লিপি ও সিলের ব্যবহার ছিল সভ্যতার সর্বত্র। সভ্যতার বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক বিষয়ে ভিন্নতা বা স্থানীয় বৈশিষ্ট্য থাকাটা স্বাভাবিক এবং সেটা ছিলও। কিন্তু বহু বিষয় বা জিনিসের অভিন্ন ধরন কিংবা সমরূপতা বিস্ময় জাগায়। বিভিন্ন দ্রব্য ও বৈশিষ্ট্যের এই সমরূপতা দিয়ে সহজেই সভ্যতার সীমা নির্ধারণ করা যায়।
এখানে একটা বিরাট প্রশ্ন হয়ে আছে কীভাবে এই সমরূপতা অর্জন সম্ভব যদি একটা কেন্দ্রীভূত একক নেতৃত্ব সমগ্র সভ্যতাকে নিয়ন্ত্রণ না করে থাকে? কাজেই সেটা ছিল। কিন্তু সমগ্র সভ্যতার বৃহৎ অঞ্চল ব্যাপী এমন দৃঢ় ঐক্য বা সমরূপতা আনবার ক্ষেত্রে তাদের প্রধান হাতিয়ার কী ছিল? পুরাতত্ত্ব বলে এটা বলপ্রয়োগ ছিল না। আর যদি সেটা বাস্তবে থেকেও থাকে তবে সেটা যে সভ্যতার অন্তত প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল না তা নিশ্চিত করে বলা যায়। সুতরাং অনেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পান ধর্মে। একটু আগে এ সম্পর্কে বলেছি। আসলে ধর্ম সামাজিক নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে একটা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হতে পারে। কিন্তু সেটাও অহিংস উপায়ে সভ্যতাকে এভাবে নিয়ন্ত্রণের প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর হতে পারে না।
এই প্রশ্নের উত্তর আমরা খুঁজে পেয়েছি নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে। জলকপাট ও বাঁধ সংযুক্ত নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে নিহিত ছিল সিন্ধু সভ্যতার প্রাণশক্তির বস্তুগত উৎস। এ সম্পর্কে এখানে আলাদাভাবে আলোচনা করার অবকাশ নাই। এ নিয়ে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা আছে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য়। সেখানে যে কথা আমরা বলেছি সেটাই এক কথায় বললে বলতে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতা যারা গড়ে তুলেছিল তারা সুদীর্ঘ কাল ধরে বাঁধ, জলকপাট বা স্লুইসগেট যুক্ত ব্যারেজের সাহায্যে নদী শাসনের ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিল। এই নদী শাসন ছিল কৃষি ভিত্তিক সভ্যতা প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে তাদের মূল বস্তুগত হাতিয়ার। সুতরাং নদী ও সেচ ব্যবস্থাকে নিয়ন্ত্রণ করে তারা গোটা সভ্যতাকে অনেকখানি শান্তিপূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছিল।
কিন্তু এটা একটা উপকরণ মাত্র। শুধু একটা উপকরণ দিয়েই এভাবে একটা সভ্যতার দীর্ঘস্থায়িত্ব, স্থিতিশীলতা, অভিন্নতা ও ঐক্য আনা সম্ভব হয় না। সেখানে আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে যে প্রক্রিয়ায় এই রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল সেটিকে এবং এই রাষ্ট্রের উপর যে শ্রেণী নিয়ন্ত্রণ রেখেছিল সেটিকে। এই প্রক্রিয়াকে বুঝলে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা গড়ে তুলায় তার সাফল্যের কারণকেও বুঝা যাবে। তখন শান্তিপূর্ণভাবে রাষ্ট্র ও সভ্যতা গঠনের রহস্যও হয়ত উন্মোচিত হবে।
কারণ সভ্যতা যতই অহিংস হোক, রাষ্ট্র রাষ্ট্রই। অর্থাৎ রাষ্ট্র তার মর্মে ধারণ করবেই যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের শক্তি। এ ছাড়া কোনও রাষ্ট্র যেমন গড়ে উঠতে পারে না তেমন তা বাঁচতেও পারে না। আর রাষ্ট্র না থাকলে সেটা কার সভ্যতা হবে? কাজেই আমাদেরকে বুঝতে হবে যে, একটা অত্যন্ত শক্তিশালী রাষ্ট্র সিন্ধু সভ্যতার ভূমিতে ছিল যার হাতে ছিল যুদ্ধেরও ক্ষমতা অথচ যার ব্যবহারে তা ছিল অত্যন্ত সংযত। এখন আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে সেই সামাজিক শক্তিকে যা নিজে নিরস্ত্র হলেও সিন্ধু সভতায় বিপুল ক্ষমতা সম্পন্ন রাষ্ট্রটিকে নম্র শক্তি হিসাবে ব্যবহার করতে পেরেছিল। এর ফলে রাষ্ট্রের সামরিক বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অসামরিক বৈশিষ্ট্য অনেক বেশী শক্তিশালী হয়ে উঠতে পেরেছিল।
এ থেকে আমরা আর একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি সেটা হচ্ছে রাষ্ট্রের মর্মে ছিল এমন একটি বেসামরিক আমলাতন্ত্র, যা সামাজিক শক্তির নিয়ন্ত্রণে থেকে পরিচালিত হত। রাষ্ট্রের এমন কিছু কাজ থাকে যা পেশদারিত্ব ছাড়া করা সম্ভব হয় না। যখন তখন যাকে তাকে দিয়ে এসব কাজ করাতে গেলে রাষ্ট্র ভেঙ্গে পড়বে। সুতরাং রাষ্ট্র চালাতে আমলাতন্ত্র লাগবেই। বুঝা যায় সিন্ধু সভ্যতায় এমন একটা শক্তিশালী আমলাতন্ত্র ছিল যার সামরিক বৈশিষ্ট্যের তুলনায় অসামরিক বৈশিষ্ট্য ছিল অনেক বেশী শক্তিশালী। এই সঙ্গে এটাও বুঝা যায় এই আমলাতন্ত্রের মাথার উপর ছিল সামাজিক শক্তি। এরা হয়ত আজকের রাজনৈতিক প্রতিনিধি বা শাসকদের আদিরূপ।
পরবর্তী কালে ভারতীয় সমাজে গড়ে উঠা বর্ণজাতিভেদমূলক বিভাজন যে সমাজে ছিল না সেটাও আমরা নগরগুলির বিন্যাস ও সভ্যতার মান থেকে বুঝতে পারি। বর্ণজাতিভেদের মত নিদারুণ বৈষম্য ও বিভাজনের উপর প্রতিষ্ঠিত কোনও সমাজে যে, কাল প্রেক্ষিতে সিন্ধু সভ্যতার মত উন্নত নগর সভ্যতা গড়ে তোলা সম্ভব ছিল না তার প্রমাণ পরবর্তী কালে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক হিন্দু হিসাবে কথিত ভারতীয় সমাজ। সিন্ধু সভ্যতায় যে বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক কোন সামাজিক ব্যবস্থা ছিল না তার সাক্ষ্য আমরা পাই ঋগ্বেদ থেকেও। ঋগ্বেদের এক ঋষি স্পষ্টভাবে জানাচ্ছেন, ‘দেখো, আমি স্তোত্রকার, পুত্র চিকিৎসক ও কন্যা প্রস্তরের উপর যব-ভর্জনকারিণী। আমরা সকলে ভিন্ন ভিন্ন কর্ম করছি।’ (৯/১১২/৩)
যাইহোক, পরবর্তী কালে বর্ণাশ্রম ভিত্তিক জাতিভেদ প্রথা গড়ে উঠল। বিভিন্ন উপজাতি ও জনগোষ্ঠী এই ব্যবস্থাকে অবলম্বন করে নিজেদের অনেক ধর্মীয় বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে রক্ষা করে বৃহত্তর সমাজের অঙ্গীভূত হল। বেদের অভ্রান্ততা, শ্রেষ্ঠত্ব ও উত্তরাধিকারকে স্বীকৃতি দিয়ে এবং বেদ চর্চার বিশেষভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্রাহ্মণের বংশগত বা কুলগত পবিত্রতা ও শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিয়ে এই নূতন সমাজ গঠন হল। এভাবে ব্রাহ্মণকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠল এক ধরনের নূতন ধর্ম, যাতে বেদের প্রতি নৈতিক আনুগত্য দেওয়া হলেও বাস্তবে বেদেরও অনেক কিছুই রইল না। এটাই এখন আমাদের নিকট পরিচিত হিন্দু ধর্ম হিসাবে। বেদ ও ব্রাহ্মণের নৈতিক বা আদর্শিক শ্রেষ্ঠত্বকে মেনে নিয়ে এই ধর্ম গঠিত হলেও বিভিন্ন ধর্ম ও সমাজের ধারা-উপধারা এবং বিশ্বাস ও প্রথার সমষ্টি হওয়ায় এটা হল বিস্ময়করভাবে স্ববিরোধে পূর্ণ। এ হল একদিক।
অপর দিকে, সিন্ধু সভ্যতা পরবর্তী কালে যুদ্ধ ও সহিংসতা ভিত্তিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা গড়ে উঠলেও সেটা থাকল নগরকে কেন্দ্র করে সমাজের উপর তলায়। সমাজের নীচ তলা বিশেষত গ্রাম সমাজ শান্তি বা অহিংসাকে প্রাধান্য দিয়ে পরিচালিত হল পঞ্চায়েতমূলক ব্যবস্থা দ্বারা, যার মাধ্যমে নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী মানুষরা তাদের জীবন-জীবিকা ও আত্মরক্ষা বা প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা সংক্রান্ত বিষয়গুলি সম্পর্কে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নিত। বিশেষত হাজার হাজার বৎসর ধরে গ্রাম পঞ্চায়েত যে ভারতীয় সমাজের স্বশাসনের একটা বিশেষ রূপ হিসাবে বর্তমান ছিল বিভিন্ন তথ্যসূত্র থেকে আমরা তেমনটা ধারণা করতে পারি।
(৩) পঞ্চায়েত ও রাষ্ট্র
পঞ্চায়েতমূলক শাসন ব্যবস্থাকে বুঝলে সম্ভবত সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ও সমাজের শাসন বা পরিচালনা ব্যবস্থার চিত্র সম্পর্কে সামান্য কিছুটা হলেও অনুমান করা যাবে। পঞ্চায়েত সম্পর্কে আমরা যতটুকু ধারণা করতে পারি সেটা হচ্ছে এই যে এতে নির্দিষ্ট গ্রাম ও এলাকার মানুষরা সরাসরি হোক আর প্রতিনিধিদের মাধ্যমে হোক যে সিদ্ধান্ত নিত তাতে সংখ্যাধিক্যের পরিবর্তে মতৈক্য বা ঐক্যমতের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হত। সুতরাং একটা ভিন্ন ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে হয়ত অনেক সময় লাগত। তবু এটা যে ছিল গ্রাম সমাজে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রধান পদ্ধতি সেটা আমরা আজও গ্রাম সমাজে সামান্য কিছু ক্ষেত্রে অনুষ্ঠিত সালিশগুলি থেকে অনুমান করতে পারি।
অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু কিংবা ভোটাভুটির পরিবর্তে প্রয়োজনে দীর্ঘ আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে মতৈক্যে পৌঁছাবার উপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়া হত - এমন একটা অনুমান করা যেতে পারে। অবশ্য আজকের মত গোপন ব্যালটের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারকেও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। গৌতম বুদ্ধের সময় কিছু প্রজাতন্ত্রে গণতন্ত্র চর্চায় এমন পদ্ধতির বিদ্যমানতার কথা আমরা জানতে পারি। স্বাভাবিকভাবে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনার নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ঐতিহ্য ও প্রথার বিশেষ ভূমিকা থাকত।
এখন যে প্রশ্ন আসে তা হল, এত বিশাল ভূভাগে বিস্তৃত একটা রাষ্ট্র কী ধরনের প্রতিনিধিশীল গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা দ্বারা পরিচালিত হওয়া সম্ভব ছিল। সেটা ছিল খুব ধীর যোগাযোগের কাল। ঘোড়ার অস্তিত্বের প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ পাওয়া গেলেও বাহন হিসাবে তার ব্যবহারের সপক্ষে কোনও প্রত্নতাত্ত্বিক সাক্ষ্য আমরা পাই না। অনুমেয় যে ঘোড়ার ব্যবহার সিন্ধু সভ্যতার শেষ পর্যায়ে বা ধ্বংসের সময় সীমিতভাবে প্রবর্তিত হয়েছিল। ঋগ্বেদ থেকে আমরা তেমন একটা অনুমান করতে পারি। সুতরাং পায়ে হেঁটে বা গরুর গাড়ীতে করে এবং কিছু ক্ষেত্রে নৌকায় যাতায়াতের যুগ সেটা। অর্থাৎ যোগাযোগের ক্ষেত্রে ধীর গতিকে বিবেচনায় নিতে হবে।
এমন একটা কালে নির্দিষ্ট গ্রাম বা নগর শাসনে সবাই অংশ নিলেও নিশ্চয় সুবিশাল সাম্রাজ্য বা রাষ্ট্র শাসনে সবাই অংশ নিতে পারত না। এ ক্ষেত্রে কোনও না কোনও ধরনের জন-প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা নিশ্চয় গড়ে উঠেছিল। সেখানে জন-প্রতিনিধিরা কীভাবে নির্বাচিত হত? এটাই আজ অনুমেয় যে পঞ্চায়েতমূলক কোনও প্রতিনিধিত্বশীল ব্যবস্থা যদি থেকে থাকে তবে তা উপরে উঠে গিয়েছিল পিরামিডের মত ধাপে ধাপে একেবারে বিশাল রাষ্ট্রের কেন্দ্র পর্যন্ত। যারা এই কেন্দ্রে অবস্থান করত তাদের মেয়াদ যেমনই হোক তারা যে এক অর্থে বিপুল ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী হত তাতে কোনও সন্দেহ নাই। তারা যে নগরের ভিতর বিশেষভাবে গড়ে তুলা নগর-দুর্গ হিসাবে কথিত স্বতন্ত্র এলাকায় বাস করত তেমন অনুমানটাই যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বিস্ময়ের ঘটনা হচ্ছে এই যে তাদের এই বিপুল ক্ষমতা ও মর্যাদার প্রকাশও আমরা তাদের বাসগৃহ বা সমাধি সৌধ বা এই ধরনের কোনও কিছুর মহানির্মাণের মাধ্যমে পাচ্ছি না।
প্রত্নতত্ত্ব থেকে এটা অনুমান করা যায় যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-শাসকদের জীবনাচরণ ছিল কঠোরভাবে সংযত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ। বলপ্রয়োগ ও স্বেচ্ছাচারিতা নির্ভর সভ্যতা না হওয়ায় সেখানে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠানের একটা বড় শর্ত ছিল সম্ভবত সমাজ বা জনগণের নৈতিক আনুগত্য লাভ। এর জন্য শুদ্ধাচার, সংযম, মিতব্যয়ী জীবন যাত্রা ইত্যাদির চর্চা হয়ত শাসকদের জন্য বাধ্যতামূলক ছিল। সে ক্ষেত্রে ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে, সমাজ থেকে উঠে এলেও সমাজ বা সাধারণ মানুষদের থেকে শাসক শ্রেণীর কিংবা শাসনের প্রতিষ্ঠানের একটা দূরত্বও থেকে গিয়েছিল। এ সম্পর্কে ধারণা করা দূরে থাক তথ্যের অভাবে এখন পর্যন্ত অনুমান করাও কঠিন। তবু সত্যটাকে ধরবার জন্য আমরা চেষ্টা করে যেতে পারি।
এ কথা আমাদের বুঝতে হবে যে সিন্ধু সভ্যতা বহিরাক্রমণে বা কোনও দুর্ঘটনায় হঠাৎ করে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় নাই। বরং প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধান থেকে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে এই সভ্যতা অভ্যন্তরীণ সঙ্কটের কারণে কয়েক শতাব্দী ধরে ধীর গতিতে ধ্বংস এবং পরিত্যক্ত হয়েছে। প্রত্নতত্ত্বের সাক্ষ্য এবং ঋগ্বেদের বর্ণনা থেকে আমাদের অনুমান যে, যে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর সিন্ধু সভ্যতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এক সময় তা ভেঙ্গে পড়লে সভ্যতায় যে সঙ্কট দেখা দেয় তা তার পতন ঘটায়। তবে নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতা বা ভাঙ্গন এক দিনে হঠাৎ করে ঘটে নাই। কয়েক শতাব্দী যাবত ঘটেছে। সুতরাং ধীর গতিতে সভ্যতার ক্ষয় ও ধ্বংসকে আমাদের হিসাবে নিতে হবে। এ বিষয়ে আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় বিস্তারিত আলোচনা করেছি।
যাইহোক, সভ্যতার এমন এক ধীর গতির পতনের পরিস্থিতিতে এটা সহজবোধ্য যে, এই মহাসভ্যতা চূড়ান্ত বিলুপ্তির বহু পূর্ব থেকেই তার বহু বৈশিষ্ট্য ও উপাদানকে তার অধিবাসীদের স্থানান্তরের প্রক্রিয়ায় ভারতীয় সমাজের গভীরে উত্তরাধিকার হিসাবে রেখে দিয়ে গেছে নানান রূপে। সুতরাং নানান রূপে আমরা আমাদের জীবনে এই উত্তরাধিকারকে ধারণ করি। আমাদের ভাষায়, সংস্কৃতিতে, আচার-আচরণ-প্রথায়, মূল্যবোধে সিন্ধু সভ্যতা আজও তার গভীর প্রভাব রেখে চলেছে। যেমন ধরা যাক, বাংলা ভাষাসহ অধিকাংশ প্রধান ভাষাই বৈদিক বা সংস্কৃত জাত কিংবা তার দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত। বাকী বিষয়গুলির ক্ষেত্রে মুসলমানরা অনেক ক্ষেত্রে ভিন্ন হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ ইত্যাদি উপমহাদেশীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষরা বহু বিষয়েই সিন্ধু সভ্যতাকে তাদের জীবনে বিভিন্নভাবে বহন করে নিয়ে চলেছে আজও।
আর এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে এই চিন্তা মনে উঁকি দেয় যে, এক অর্থে সভ্যতা তো মানুষের বস্তুগত শক্তির প্রকাশ। যখন মানুষের সভ্যতা তথা তার বস্তুগত শক্তি ধ্বংস অথবা বিলুপ্ত হতে থাকে তখন কি মানুষ তার সভ্যতার উত্তরাধিকারকে ভাবগত রূপে রেখে দিতে চাইবে না? এটা হচ্ছে বস্তুর ভাবে রূপান্তর। সিন্ধু সভ্যতার মত মহাসভ্যতার ক্ষেত্রে কি এই ঘটনা ঘটা আরও বেশী সম্ভব এবং স্বাভাবিক নয়? আর এই চিন্তার সঙ্গে যে চিন্তা বিদ্যুৎ ঝলকের মত দেখা দেয় তা হল সিন্ধু সভ্যতার পতনের অনেক পরবর্তী কালে বৌদ্ধ, জৈন, সাংখ্য, চার্বাক, লোকায়ত ইত্যাদি ধর্মীয় এবং দার্শনিক আন্দোলনগুলিতে কি সিন্ধু সভ্যতার সমাজনীতি ও রাষ্ট্রনীতি স্থানান্তরিত বা রূপান্তরিত হয়ে ধর্মীয় ও দার্শনিক রূপ নিয়েছে আর এইভাবে রাষ্ট্র-শাসনের পরিবর্তে সমাজ-শাসনের ভার হাতে নিতে চেয়েছে?
বৈদিক ধর্ম তার ধর্মসংস্কার দ্বারা যুদ্ধ ও সহিংসতাকে প্রাধান্যে এনে এবং নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক প্রথা বা ঐতিহ্যের সঙ্গে বড় ধরনের ছেদ ঘটিয়েছে। ফলে সিন্ধু সভ্যতার মূল কিছু বৈশিষ্ট্য বা উপাদান তার কিংবা তার উত্তরাধিকারী ব্রাহ্মণ্য বা হিন্দু হিসাবে পরিচিত ধর্ম ও সমাজে অনুপস্থিত হতে অথবা কম থাকতে পারে। কিন্তু বৌদ্ধ এবং জৈন ধর্মের মত অহিংসা নির্ভর এবং সংঘের মত প্রতিষ্ঠান দ্বারা সংগঠিত ধর্মগুলিকে সিন্ধু সভ্যতার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতা হিসাবে ধারণা করবার কারণ আছে। হয়ত বৌদ্ধ ও জৈন ধর্ম ও সংঘ বা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র-শাসন ব্যবস্থারও অনেক উপাদান লুকিয়ে আছে। সে ক্ষেত্রে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসকদের মধ্যে আমরা হয়ত অনেক পরবর্তী কালের শুদ্ধাচারী ও সংসারত্যাগী শ্রমণ ও ধর্মগুরুদের সবটা না হলেও একটা অস্পষ্ট আদিরূপ খুঁজে পাব। সম্পদ বা বলপ্রয়োগের ক্ষমতার পরিবর্তে হয়ত জ্ঞানচর্চা কিংবা অন্য আর কোনও গুণাবলীর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনে ভূমিকা রাখা যেত।
এই রকম একটা কাছাকাছি ব্যবস্থায় ঐ রকম এক মহাসভ্যতার রাষ্ট্রশাসকদের পক্ষে অর্থের জোরে কিংবা অস্ত্রের জোরে রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন হবার কোনও পথ না থাকায় সঙ্গত কারণেই ক্ষমতাসীনরা অর্থ-বিত্তের আড়ম্বর কিংবা ক্ষমতার দম্ভ প্রকাশ পায় নিজেদের জন্য এমন কোনও গগনচুম্বি অট্টালিকা কিংবা সমাধি সৌধ কিংবা নিজেদের ভোগ-সম্ভোগের জমকালো আয়োজন নির্মাণে অক্ষম ছিল। বরং গোটা সভ্যতা যে মানুষের সর্বজনীন ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণের উদ্দেশ্যে পরিচালিত হত প্রত্নতত্ত্ব সেই সাক্ষ্যই দেয়। শাসকদের দায়িত্ব ছিল সেই উদ্দেশ্য পূরণে নিজেদেরকে নিবেদিত রাখা। বিনিময়ে তাদের বস্তুগত অর্জন কী ছিল বা কতটুকু ছিল তা আজ বলা না গেলেও তারা যে সমাজ ও জনগণের বিপুল শ্রদ্ধা, ভক্তি ও আনুগত্য একটা নির্দিষ্ট সময়ের জন্য হলেও ভোগ করত সেই অনুমানটুকু করা যায়।
(৪) সভ্যতার নম্র রূপ
আজকের যুদ্ধ নির্ভর পাশ্চাত্য পুঁজিবাদী সভ্যতার কেন্দ্র স্বরূপ পরাক্রান্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পাশে রেখে যখন আমি সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকাকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠা প্রধানত শান্তি ও অহিংসা নির্ভর প্রাচীনতম মহাসভ্যতাকে দেখি তখন বিস্মিত না হয়ে পারি না। কীভাবে অত প্রাচীন কালে আমাদের পূর্বপ্রজন্মের মানুষরা মানব জাতিকে নম্র ও সৌম্য এমন এক মহাসভ্যতা উপহার দিতে পেরেছিল, যা আর কোথায়ও আজ পর্যন্ত মানব জাতি পারে নাই? সিন্ধু সভ্যতা পৃথিবীতে একটাই। যতই বিশালায়তনে ও যত দীর্ঘ কাল স্থায়ী তা হোক তা এককই থেকে গেছে। প্রাচীন যুগে তার সমকালে অথবা তার পরবর্তী কালেও তাকে অনুসরণ করতে আর কেউই পারে নাই।
এই আলোচনায় সিন্ধু সভ্যতার সাম্প্রতিক আবিষ্কার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ না থাকলেও কিছুটা উল্লেখ প্রাসঙ্গিক হতে পারে। ২০০১ সালে ভারত-রাষ্ট্রের গুজরাট উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্বে উপসাগরের ৩০ থেকে ৪০ মিটার গভীরে সিন্ধু সভ্যতার বৃহত্তম নগরের সন্ধান পাওয়া গেছে। এই নগরে ভারতের সমুদ্র প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ থেকে শেষ অনুসন্ধান হয় ২০০৩-২০০৪ সালে। সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত নগরটি একটি প্রাচীন নদী খাতের দুই পাশে ৫ মাইল দীর্ঘ ও ২ মাইল প্রশস্ত এলাকা নিয়ে গঠিত। সুতরাং এটির আয়তন প্রায় ১০ বর্গমাইল। সেই তুলনায় মহেঞ্জোদাড়ো, হরপ্পা, এবং পরবর্তী কালে প্রাপ্ত রাখিগাড়ি ও গানেরিওয়ালা এই চার নগরের আয়তন অনেক কম। এগুলির আয়তন নিম্নলিখিত রূপ, যথা, মহেঞ্জোদাড়ো ২০০ হেক্টর (৪৯০ একর), এর বেড় প্রায় ৩ মাইল বা ৫ কিলোমিটার, হরপ্পা ১৫০ হেক্টর (৩৭০ একর), রাখিগাড়ি অন্ততপক্ষে ৩ বর্গকিলোমিটার এবং গানেরিওয়ালা ৮০ হেক্টর।
ক্যাম্বে উপসাগরের তলদেশে প্রাপ্ত এই নগরের উপর সেখানে জলস্রোতের প্রচণ্ডতার জন্য তেমন একটা কাজ করা যায় নাই। আবার ঘোলাজলের কারণে নগরের চিত্র চোখে দেখা যায় না। ফলে উপর থেকে শব্দ তরঙ্গের সাহায্যে নগরের চিত্র (sonar image) নিতে হয়েছে। তা থেকে এবং সাগর গর্ভে নিমজ্জিত নগরের বেশ কিছু প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে এটিকে সিন্ধু সভ্যতার নগর হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। রেডিও কার্বন ডেটিং পদ্ধতিতে নগর থেকে পাওয়া একটি কাঠের টুকরা থেকে সেটার যে সর্বপ্রাচীন বয়স পাওয়া গেছে তাতে তার বয়স সাড়ে নয় হাজার বছর হয়, অর্থাৎ খ্রীষ্টপূর্ব ৭ হাজার ৫ শত বছর আগের কাষ্ঠখণ্ড সেটি।
এখন এটাও বুঝা যায় যে নগরটি যখন স্থলভূমিতে ছিল তখন ছিল হিম বা বরফ যুগ। পৃথিবীর সর্বশেষ হিম যুগ আজ থেকে ২৫ হাজার বছর আগে শুরু হয়ে প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার বছর আগে শেষ হয়। তবে হিম যুগ সর্বত্র পুরাপুরি শেষ হতে আরও কিছু সময় নেয়। হয়ত নয় হাজার বছর আগে এটা শেষ হয়। হিম যুগে বিপুল পরিমাণ জল বরফে পরিণত হওয়ায় সমুদ্র পৃষ্ঠ তখন এখন থেকে প্রায় ৩৩০ ফুট বা ১০০ মিটার পর্যন্ত নীচে নেমে গিয়েছিল। কিন্তু হিম যুগ শেষ হলে বরফ গলে বিপুল স্থলভূমি সমুদ্রতলে চলে যায়। ফলে হিম যুগে এমন সব অঞ্চলে অনেক বসতি এবং সভ্যতা গড়ে উঠা সম্ভব যেগুলি হিম যুগের অবসানে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে জলের নীচে তলিয়ে গেছে।
এমনই একটি নগর ভারতের গুজরাটের উপকূল থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে ক্যাম্বে উপসাগরের জলের ৩০ থেকে ৪০ মিটার তলদেশে সন্ধান পাওয়া নগরটি। কাঠের রেডিও কার্বন পরীক্ষা এবং হিম যুগের সমাপ্তির হিসাব দুই দিক থেকেই তার বয়স অন্তত সাড়ে নয় হাজার বছর বা তারও বেশী নির্দেশ করে। এখন তার প্রতিষ্ঠার সময়কে যদি আরও এক হাজার বছর পিছিয়ে দেওয়া যায় তাহলে বলতে হবে কমপক্ষে সাড়ে দশ হাজার কিংবা হয়ত এগারো হাজার বছর আগে সিন্ধু সভ্যতা হিসাবে কথিত নগর সভ্যতার যাত্রা শুরু হয়। অথচ মেসোপটেমিয়া এবং মিসরের নগর সভ্যতার যাত্রা আজ থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে। হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োর যাত্রা প্রায় ঐ সময় হলেও রেডিও কার্বন ডেটিং অনুযায়ী চার হাজার ছয় শত বছর আগে। চীন আরও কিছু পরে নগর সভ্যতা নির্মাণ করে।
ক্যাম্বে উপসাগরের নিমজ্জিত নগর ইতিহাস ব্যাখ্যায় বহু সমস্যা সৃষ্টি করে। প্রথমত, সিন্ধু সভ্যতার জন্ম মিসর বা মেসোপটেমিয়ার সভ্যতার তুলনায় আরও পাঁচ বা ছয় হাজার বছর আগে হয়েছে এটা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না। দ্বিতীয়ত, হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়োসহ বর্তমান সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গেও নিমজ্জিত নগরের সম্পর্ক স্থাপনে জটিলতা সৃষ্টি হয়। বর্তমানে সিন্ধু সভ্যতা হিসাবে পরিচিত সভ্যতা এবং তার নগরগুলির বয়স চার হাজার ছয়শত থেকে পাঁচ হাজার বছর পূর্বে পর্যন্ত নেওয়া হয়। তাহলে প্রশ্ন আসবে, যদি ধরে নেওয়া হয় যে, প্রায় নয় হাজার বছর আগে এটি সমুদ্র গর্ভে নিমজ্জিত হয় তাহলে নিমজ্জনের পরেও প্রায় চার হাজার বছর এই সভ্যতা কোথায় ছিল? হঠাৎ করে ঐ নগর সভ্যতা প্রায় চার হাজার বছর পর কী করে প্রায় অভিন্ন রূপ নিয়ে সিন্ধু সভ্যতার বর্তমান এলাকায় গড়ে উঠল? মাঝখানের এই চার হাজার বছরের ধাঁধার উত্তর বেশ কয়েক বৎসর যাবত অজানা ছিল। তবে সম্প্রতি প্রকাশিত সিন্ধু সভ্যতার সর্বশেষ আবিষ্কার সংক্রান্ত তথ্য সঠিক হয়ে থাকলে এই ধাঁধার উত্তর পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
এই আবিষ্কারের ভিত্তিতে ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ বা Archaeological Survey of India (ASI) এবং IIT-Kharagpur-এর সিদ্ধান্ত সম্পর্কে যে প্রতিবেদন ভারতীয় সংবাদপত্রে ২০১৬ সালের মে মাসে প্রকাশ করা হয় সেখানে বলা হচ্ছে, ভারতের হরিয়ানা রাজ্যের ভিররানায় উৎখননের মাধ্যমে সিন্ধু সভ্যতার একটি বৃহৎ নগর পাওয়া গেছে যার বয়স আজ থেকে অন্তত ৮ হাজার বৎসর প্রাচীন।* বেশ কয়েক বৎসর যাবৎ আরও কিছু নূতন খননের মাধ্যমে এখন এই সভ্যতা সম্পর্কে আরও নূতন তথ্য উঠে আসছে। এই আবিষ্কারগুলি হয়ত বহু প্রশ্নের উত্তর যেমন দিবে তেমন হয়ত আরও অনেক নূতন প্রশ্নের জন্মও দিবে।
------------------------------------------------------------------------------
* সূত্র ঃ http://timesofindia.indiatimes.com/india/Indus-era-8000-years-old-not-5500-ended-because-of-weaker-monsoon/articleshow/52485332.cms
------------------------------------------------------------------------------
যাইহোক, ভিররানা ইত্যাদি সংক্রান্ত সব তথ্য আমাদের হাতে পৌঁছানোর পূর্বে এখনই এ নিয়ে বেশী আলোচনা করা কিংবা কোনও সিদ্ধান্ত টানা ঠিক হবে বলে মনে হয় না। তাছাড়া সব প্রশ্নের উত্তর এখনই পেতে হবে তার কী মানে আছে? বরং প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারসমূহ দিয়ে যেটুকু জানা হয়েছে তার ভিত্তিতেই আমরা আমাদের আলোচনাকে এগিয়ে নিতে পারি। সেখানে আমরা দেখতে পাই এক বিস্ময়কর মহাসভ্যতাকে। ক্যাম্বের নিমজ্জিত নগর থেকে শুরু করে হরপ্পা-মহেঞ্জোদাড়ো-রাখিগাড়ি-গানেরিওয়ালা এই পাঁচ সর্ববৃহৎ নগরসহ গড়ে উঠা সভ্যতার সময়সীমাকে হিসাবে নিলে অন্তত এগারো হাজার বছর পূর্ব থেকে প্রায় চার হাজার বছর পূর্ব পর্যন্ত আনুমানিক সাত থেকে আট হাজার বছর ধরে বিরাজমান একটা সভ্যতাকে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে। তবে ক্যাম্বে উপসাগরের নগরের কথা বাদ দিয়েও যদি ধরা যায়, এবং তথ্যের স্বল্পতার কারণে ভিররানার কথাও যদি বাদ দেওয়া যায়, এবং সেটাই এখন যুক্তিযুক্ত হবে, তবু আমরা প্রায় এক হাজার বছর ব্যাপী বিদ্যমান একটা নগর সভ্যতাকে দেখতে পাই যা বিকশিত হয়েছিল এবং টিকেছিল যুদ্ধ ও সহিংসতাকে যতটা সম্ভব পরিহার করে।
আর কোন্ সভ্যতা প্রধানত নির্দয়তা, জবরদস্তি, যুদ্ধ ছাড়া প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং টিকে থেকেছে? মিসর, মেসোপটেমিয়া, চীন? আরও পরবর্তী কালের গ্রীস অথবা রোম? কিংবা আমেরিকা মহাদেশের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। সেখানে নিয়মিত যুদ্ধের উপর প্রতিষ্ঠিত আজটেক, মায়া, ইন্কা সভ্যতার দেবতাদের রক্ত পিপাসা মিটাবার জন্য ছিল মানুষ হত্যার নিয়মিত আয়োজন। প্রতি বছর শত শত মানুষকে বন্দী করে এনে দেবতাদের বেদীতে হত্যা করা হত নিষ্ঠুর কায়দায়। কখনও কোনও উপলক্ষ্যে নরহত্যার সংখ্যা হাজার হাজার হত। বুঝাই যায় অগণিত মানুষের রক্ত, অশ্রু আর ঘামে সিঞ্চিত হয়ে এই সব সভ্যতার যাত্রাপথ নির্মিত হয়েছে। এগুলি থেকে সিন্ধু সভ্যতা কত ভিন্ন!
এ বিষয়ে কোনই সন্দেহ নাই যে সিন্ধু সভ্যতায় যতই প্রাচুর্য ও সুষম বণ্টন থাক সবাই যে দেহশ্রম নির্ভর কষ্টসাধ্য এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করত তা হতে পারে না। অথচ সভ্যতা নির্মাণের জন্য সংখ্যাগুরুকে সংখ্যালঘুর তুলনায় অনেক কষ্টসাধ্য কাজ করতে হয়েছে। এবং সবখানেই থেকেছে বিভিন্ন ধরনের কাজ। কারণ শ্রমবিভাজন ছাড়া সভ্যতা অচল। আজকের দিনের মত কঠিন কাজগুলি করবার জন্য সেদিন যন্ত্র ছিল না। তাহলে যে ধরনের হোক অধিক শ্রম, ঝুঁকি ও কষ্টের কাজগুলি যারা করত তাদেরকে নিশ্চয় নানান কৌশলে হোক, চাপ দিয়ে হোক অথবা প্রণোদনা দিয়ে হোক সেগুলি করাতে হত। হয়ত একাধিক পদ্ধতির সংমিশ্রণ ছিল। যেমনই হোক সিন্ধু সভ্যতার সেই পদ্ধতি আজ আমাদের অনেকটাই অজানা, কিছু হয়ত অনুমান সাপেক্ষ। তবে সেটা যে মেসোপটেমিয়া, মিসর, চীন বা পরবর্তী কালের গ্রীস-রোমের মত চাবুক আর তলোয়ার নির্ভরতা থেকে বেশ খানিকটা দূরবর্তী কিছু সেটা আমরা পুরাতত্ত্ব থেকে বুঝতে পারি।
এ প্রসঙ্গে বার বার যে প্রশ্ন মনে জাগে তা হল অর্থ নয়, ক্ষমতার বিরাট প্রদর্শন নয়, ধর্ম বিশ্বাসেরও বিরাট প্রদর্শন হিসাবে মহাকায় ও জাঁকালো মন্দির নির্মাণ নয়, তা হলে সেই আনুগত্যের প্রধান উৎসটি কী ছিল যার কারণে জনসাধারণ রাষ্ট্র ও শাসকের প্রতি অনুগত থেকেছে এবং সভ্যতার প্রয়োজনে সব ধরনের শ্রম দিয়েছে, ঝুঁকি নিয়েছে? একটু আগে এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছি শাসকদের শুদ্ধাচার, সংযম ও মিতব্যয়ী জীবন অনুশীলনের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার সম্ভাব্যতার মধ্যে। একদিকে, জ্ঞানচর্চা এবং নম্র ও সংযত জীবনাচরণ, অপর দিকে, সমাজ বা সাধারণ মানুষদের কল্যাণে ভূমিকা পালন দ্বারা শাসকরা হয়ত সাধারণ মানুষের আস্থা ও আনুগত্য অর্জন করত। হয়ত সেটা তাদেরকে শক্তি যোগাত রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে। হয়ত গ্রীক দার্শনিক প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের অভিভাবক শ্রেণী এবং দার্শনিক শাসকের কল্পনা এসেছিল সিন্ধু সভ্যতার এমন কোনও ব্যবস্থার স্মৃতি থেকে।
(৫) সভ্যতার বিকল্প পথ
আজকের আধুনিক সভ্যতা মানুষকে গৌরব করবার মত অনেক কিছু দিয়েছে। কিন্তু তার অনিয়ন্ত্রিত ব্যক্তি-পুঁজিবাদ যেভাবে মানুষের মানবিকতার দিকগুলিকে পর্যুদন্ত করে চলেছে সেটাকে আমরা কীভাবে খাটো করে দেখব? বিশেষত আমাদের মত পশ্চাৎপদ এবং পাশ্চাত্য নির্ভর সমাজগুলির জন্য তার এই পুঁজিবাদ যে সকল সমস্যা সৃষ্টি করেছে সেগুলিকে আমরা উপেক্ষা করতে পারি না। পাশ্চাত্য কেন্দ্রিক এই পুঁজিবাদের যুদ্ধ, প্রতারণা, নিদারুণ বৈষম্য, মানুষকে বিশেষ করে নারীকে ভোগ্যপণ্যে পরিণত করে তার মনুষ্যত্বকে অবমানিত করা এবং সর্বোপরি তার ব্যক্তিস্বার্থ সর্বস্ব অসংযত ভোগবাদ যা আমাদের এই গ্রহকে দ্রুতগতিতে দূষিত করে মানুষ ও জীবের বাসের অনুপযোগী করছে সেগুলির প্রতি আমাদের চোখ বন্ধ করে রাখতে পারি না।
মানব জাতির অস্তিত্বের প্রয়োজনেই সভ্যতার বিকল্প পথ সন্ধান করার সময় আজ আমাদের সামনে এসেছে। বিশেষত পরমাণু প্রযুক্তির বিপুল ও ব্যাপক বিস্তারের এই কালে এই গ্রহ এবং মানব জাতির অস্তিত্ব ভয়ানকভাবে বিপন্ন। যুদ্ধ ও সহিংসতা নির্ভর অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতি পরমাণু যুদ্ধের মাধ্যমে যে কোনও সময় মানব জাতিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারে। সুতরাং আমাদেরকে আধুনিক সভ্যতার উন্নততর ও বিকল্প রূপ সন্ধান করতে হবে। সহিংসতা ও যুদ্ধকে নিঃশর্ত ও অন্ধ ভাবে পরিত্যাগের কথা আমি বলি না। কিন্তু তার চর্চা হবে শুধু আত্মরক্ষার জন্য, মানবিক কল্যাণকে নিশ্চিত ও নিরাপদ করার জন্য। তার জন্য সন্ধান করতে হবে নূতন ধরনের সমাজ নীতি ও রাষ্ট্র নীতির। সেটা শুধু আমাদের দেশের জন্য নয়, বিশ্বের জন্যও। আর সেদিক থেকে আমি সিন্ধু সভ্যতার যেটুকু আবিষ্কার হয়েছে তার পুনর্মূল্যায়নের অপরিহার্যতা অনুভব করি। অবশ্যই সেটা সেখানে প্রত্যাবর্তনের জন্য নয়, বরং সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদের আগামী সভ্যতার নূতন যাত্রাপথ নির্মাণের জন্য।
আমি অনুমান করি সিন্ধু সভ্যতার বিস্ময়কর শক্তির মূল উৎস নিহিত ছিল তার সমাজ ও রাষ্ট্রের উদ্ভব ও বিকাশ প্রক্রিয়ার মধ্যে এবং সেই সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্র এই উভয়ের মধ্যে সম্পর্ক বিন্যাসের মধ্যে। নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উদ্ভব ও বিকাশ ছিল তার সঙ্গে সম্পর্কিত। সমাজ গড়ে উঠে মূলত মানুষের আচরিত নিয়ম, নীতি-নৈতিকতা বোধ, বিশ্বাস এবং প্রথার ভিত্তিতে। এভাবে মানুষ বৃহত্তর পরিসরে ঐক্যবদ্ধ বা সমাজবদ্ধ হয়। এখানে বলপ্রয়োগ বা জবরদস্তির ভূমিকা থাকতে পারে, তবে সেটার ভূমিকা হয় সাধারণত গৌণ। রাষ্ট্র যতই শান্তিপূর্ণ বা নম্র হোক তার অস্তিত্বের প্রধান ভিত্তি হচ্ছে বলপ্রয়োগ বা জবরদস্তির ক্ষমতা প্রয়োগের সক্ষমতা। দুইটাই মানুষকে এক অর্থে কিছু নিয়মের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে। কিন্তু সমাজ জোর দেয় স্বেচ্ছাসম্মতির উপর। বাধ্যতা কম বলে এ ক্ষেত্রে সমাজের কাছ থেকে মানুষের প্রত্যাশা যেমন বেশী থাকে তেমন সমাজ মানুষের প্রত্যাশা পূরণে বাধ্যও হয় তুলনায় অনেক বেশী। রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে সেটা প্রযোজ্য নাও হতে পারে। শুধুমাত্র বলপ্রয়োগেও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকতে পারে। বিশেষত অতীতে অনেক ক্ষেত্রেই সেটা ছিল সাধারণ নিয়ম।
সমাজে যেটা নিয়ম, রাষ্টে সেটা আইন। সমাজে কেউ নিয়ম ভঙ্গ করলে সাধারণভাবে তাকে সমাজচ্যুত বা বর্জন করা কিংবা তুলনায় কিছু লঘু দণ্ড দেওয়া হতে পারে, যেটা হতে পারে জরিমানা, প্রহার কিংবা তিরস্কার ও ধিক্কার। যখন এই নিয়ম ভঙ্গের জন্য কঠোর শাস্তি বা গুরুদণ্ড দানের বিষয় চলে আসে তখন সমাজ রাষ্ট্রের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। রাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে সাধারণত বাধা দেয়। রাষ্ট্র তার এখতিয়ারের জায়গায় সমাজকে সরাসরি হস্তক্ষেপ করতে দেয় না। কারণ তাতে সমাজ সরাসরি রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে অবতীর্ণ হয়, রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করে বসে। রাষ্ট্র তাই এই জায়গায় সাধারণত খুব স্পর্শকাতর থাকে। এই জন্য কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের মত শাস্তি বিধানের ক্ষমতা রাষ্ট্রই নিজের হাতে একচেটিয়া করে রাখে। যদি কখনও সমাজ গুরুদণ্ড দিবার জায়গায় যায় তবে বুঝতে হবে সেটা তা রাষ্ট্রের সম্মতি সাপেক্ষে এবং রাষ্ট্রের অঙ্গ ও সহায়ক হিসাবে করছে।
যে সমাজ বা রাষ্ট্রে সকল ক্ষমতা একীভূত সেখানে আমরা স্বৈরতন্ত্রের এমন নিরঙ্কুশ রূপ দেখতে পাই যেখানে সমাজের নিজস্ব কোনও সত্তাই প্রায় থাকে না। সমাজ থাকে মূলত রাষ্ট্রের ছায়া রূপে। যেমন রূপটা আমরা ইসলামে দেখতে পাই। ইসলাম ধর্ম একনায়কী এমন ব্যবস্থার জন্ম দেয় যেখানে রাষ্ট্র-শাসক ও সমাজ-নেতা মূলত একজন। কারণ এখানে প্রধানত বলপ্রয়োগের উপর নির্ভর ক’রে ধর্ম বৃহত্তর ও ঐক্যবদ্ধ সমাজ গঠনের প্রধান হাতিয়ার হিসাবে আবির্ভূত হয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রেরও সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী একজনকেই করে। এই সমাজ গঠনের প্রধান পদ্ধতি হচ্ছে যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ অর্থাৎ সামরিক-রাজনৈতিক। সুতরাং এই একনায়কী যুদ্ধবাদী রাজনীতির সহায়ক এবং অংশ হিসাবে আমাদেরকে দেখতে হবে ধর্ম ও সমাজের বিকাশ ও সম্প্রসারণকে।
এখন আমার মনে হয় মূলত সহিংস ও যুদ্ধবাদী ইসলামের বিপরীতে অহিংস ও শান্তিবাদী সিন্ধু সভ্যতাকে স্থাপন করলে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রকে বুঝতে অনেক সুবিধা হবে। আজকের আলোচনার জন্য এইটুকু বলা বোধ হয় সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনের রূপকে বুঝবার জন্য সহায়ক হতে পারে যে, সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ছিল অনেকাংশে সমাজের ছায়া স্বরূপ। শত শত কিংবা হাজার হাজার বৎসর ধরে ধীর গতিতে ও প্রধানত শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন উপজাতি ও জনগোষ্ঠী বা সমাজের ঐক্যের প্রক্রিয়ায় তাদের ভিতর থেকে অভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্বের যে রূপ বা কাঠামো গড়ে উঠছিল তা-ই সম্ভবত একটা পর্যায়ে পৌঁছে সিন্ধু সভ্যতায় বৃহত্তর সমাজের নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রের কর্তৃত্বে পরিণত হয়। এখানে সমাজ ও রাষ্ট্রের সীমারেখা হয়ত ছিল অনেকখানি অস্পষ্ট। ফলে উভয়ের কর্তৃত্ব বা এখতিয়ারের সীমানাও।
(৬) শ্রেণীর প্রশ্ন
এখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসনের মূল কিংবা প্রধান চালিকা শক্তিকে বুঝবার প্রয়োজনে এই সভ্যতা নির্মাণ ও পরিচালনায় যে শ্রেণী বা শ্রেণীসমূহ প্রধান নির্ধারক শক্তি হিসাবে ভূমিকা রেখেছিল বলে আজ আমরা অনুমান করতে পারি সেটিকে বা সেগুলিকে বুঝতে চেষ্টা করতে পারি। রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারাই অধিষ্ঠিত হোক, যে প্রক্রিয়ায় অধিষ্ঠিত হোক সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও অর্থনীতির মূল নিয়ন্ত্রণ যে শ্রেণী কিংবা শ্রেণীসমূহের হাতে ছিল তারাই যে মূলত সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণ করত এটা বুঝা যায়। অর্থাৎ শাসন ক্ষমতায় কারা সামনে ছিল তার চেয়েও বেশী গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে তারা মূলত কোন সামাজিক ও অর্থনৈতিক শ্রেণী বা গোষ্ঠী সমূহের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করত এবং এই শ্রেণী বা গোষ্ঠী সমূহ কোন প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠেছিল সেই বিষয়টি।
বিষয়টার গুরুত্ব বুঝবার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক। সেখানে রাষ্ট্র ক্ষমতায় যারা আসে তারা ভোটারদের ভোটে ক্ষমতায় এলেও মূলত যে স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করে সেটা হচ্ছে কর্পোরেট পুঁজি। সেখানে আরও স্বার্থ আছে যাদের ভূমিকাকে উপেক্ষা করার উপায় নাই, যেমন সেনাবাহিনী এবং গোয়েন্দা বিভাগ। কিন্তু বৃহৎ কিংবা কর্পোরেট পুঁজির ভূমিকাই সেখানে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। এই পুঁজি সেখানে নানানভাবে যে শুধু রাজনীতিকদের নিয়ন্ত্রণ করে তাই নয়, সংবাদপত্র ও টিভিসহ প্রচার মাধ্যমের উপর নিয়ন্ত্রণ দ্বারা জনমতকেও নিয়ন্ত্রণ করে। এই পুঁজির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সেখানে রাজনীতিতে কার্যকর কোন ভূমিকাই কারও পক্ষে নেওয়া সম্ভব নয়। সুতরাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রশাসনের প্রকৃত চরিত্র বুঝবার জন্য সেখানে সমাজ ও সেই সঙ্গে অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণের মূল বা প্রধান শক্তিটাকে খুঁজে বের করার গুরুত্ব অনেক বেশী। আর সেখানে আমরা দেখতে পাই কর্পোরেট পুঁজিকে। এই পুঁজি তথা পুঁজির মালিকদের মধ্যে স্বার্থের কিছু বিভাজন ও দ্বন্দ্ব থাকলেও মূল স্বার্থগত প্রশ্নে তাদের ভিতরে সাধারণত তেমন কোনও দ্বন্দ্ব ঘটে না।
সব সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণের প্রধান শক্তি যে অর্থনৈতিক শক্তি হয় তা নয়। যে সমাজ খুব বেশী যুদ্ধ-নির্ভর হয় সেখানে এটা যে যোদ্ধা শ্রেণী হবে সেটাই স্বাভাবিক। যুদ্ধ বা সামরিক প্রক্রিয়ার সাহায্যে এই শ্রেণী সমাজ এবং অর্থনীতির উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য রক্ষা করবে। তার জন্য যে তাদেরকে প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদন সংশ্লিষ্ট দায়িত্ব নিতে হবে তা নয়। আমরা ভারতবর্ষে মুসলিম যুগে কিংবা তার পূর্বেও সামরিক শ্রেণীকে সমাজ ও রাষ্ট্রের উপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে দেখেছি। বিশেষত মুসলিম যুগে যোদ্ধা শ্রেণীর গুরুত্ব অনেক বেশী ছিল। ধনিক বা ব্যবসায়ী, কুটীরশিল্প মালিক কিংবা জমির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পর্কিত শ্রেণীগুলির পরিবর্তে সামরিক শাসক তথা যোদ্ধা শ্রেণী শুধু যে রাষ্ট্রকে নিয়ন্ত্রণে রাখত তাই নয়, সমাজ ও অর্থনীতিকেও নানানভাবে প্রভাবিত ও নিয়ন্ত্রণ করত।
হিন্দু ধর্মের একটা বিশেষ ভূমিকা ভারতবর্ষের সমাজ জীবনে ছিল। মুসলিম শাসনামলে বিপুল সংখ্যাগুরু জনগণ হিন্দু ধর্মাবলম্বী বা অমুসলিম হওয়ায় হিন্দু অধ্যুষিত সমাজের উপর মুসলিম রাষ্ট্র এবং তার শাসকদের নিয়ন্ত্রণ দুর্বল থেকেছিল। রাষ্ট্র শাসনে হিন্দুদের তেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবার উপায় বা কারণ ছিল না। যারা ভূমিকা রাখত তারা সেটা রাখত মুসলিম সামরিক শাসক শ্রেণীর অধস্তন ও সহযোগী হিসাবে। বহিরাগত মুসলিম শাসকরা একটা পর্যায় পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে যত হত্যা ও ধ্বংস যজ্ঞ চালাক পরবর্তী সময়ে কিছু সহনশীলও হয়েছিল। তারা হিন্দুদের সমাজ জীবন নিয়ন্ত্রণের জন্য সর্বদা বেশী মাথাও ঘামাত না। সব সময় তার প্রয়োজনও হত না। হিন্দুরা ছিল সাধারণভাবে অপ্রতিরোধী ও নির্বিবাদী। তবে তাদের ছিল ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার তুলনাহীন সক্ষমতা।
এই অবস্থায় মুসলমান শাসকরা ধর্মান্তরকরণে মনোনিবেশ না করে নিজেদের শাসন ও শোষণ রক্ষার উপর জোর দিত। তারা নিজেদের শাসন ও শোষণ নিরাপদ ও নিরুপদ্রব ভাবে চালাতে পারলে খুশী হত। তবে এটা ঠিক যে মুসলিম শাসনামলে ধর্মের কারণে সমাজ ও রাষ্ট্রের মধ্যে একটা বড় ধরনের ব্যবধান থেকে গিয়েছিল, ফলত সাধারণ নিয়মে কিছু দ্বন্দ্বও। তবে সেই দ্বন্দ্ব সত্ত্বেও এক ধরনের সহাবস্থান টিকে থেকেছিল, যার একটি প্রধান কারণ ছিল হিন্দুদের সহনশীলতা। তবে যে কথা একটু আগেই বলেছি, হিন্দুদের এই সহনশীলতার সঙ্গে ছিল ধর্মীয় স্বাতন্ত্র্য রক্ষার সক্ষমতাও। ফলে মুসলিম শাসকরা বলপ্রয়োগেও ধর্মান্তরকরণে তেমন একটা সুবিধা করতে পারে নাই। যাইহোক, রাষ্ট্র ছিল মুসলিম সামরিক শাসকদের স্বৈরশাসনাধীন। সমাজ ছিল হিন্দু ধর্ম ভিত্তিক। অনুমান করা চলে ধর্মকে অবলম্বন করে টিকে থাকবার প্রয়োজনে হিন্দু সমাজ যেমন আরও বেশী করে ধর্মকে আঁকড়ে ধরেছিল তেমন ধর্ম রক্ষা ও চর্চার দায়িত্বপ্রাপ্ত শ্রেণী হিসাবে ব্রাহ্মণের ভূমিকা ও প্রভাবও পূর্বের তুলনায় অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছিল।
ধর্ম যে শুধু সমাজ নয়, অধিকন্তু রাষ্ট্র গঠনেরও প্রধান পদ্ধতি হতে পারে এবং যুদ্ধের মাধ্যমে সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন ও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তার দৃষ্টান্ত হচ্ছে ইসলাম। এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার জায়গা এটা নয়। তবে এখানে এইটুকু বলি যে আরবে মুহাম্মদ ধর্মবিশ্বাস এবং সেই সঙ্গে যুদ্ধের মাধ্যমে একই সঙ্গে একটি সামরিক একনায়কী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন করেন। কাজেই এই সমাজের মূল নিয়ন্ত্রণ কোনও অর্থনৈতিক শক্তির ভিতর না খুঁজে ধর্মীয় সামরিক শক্তি বা শ্রেণীর ভিতর খুঁজতে হবে। এটা ঠিক যে পাশ্চাত্যের আঘাতে এবং আধুনিক সভ্যতার চাপে ইসলামী সমাজের আদি রূপ রাখা সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু ইসলামের প্রকৃত রূপকে বুঝতে হলে তাকে তার আদিরূপেই দেখতে ও বিচার করতে হবে। এই সঙ্গে এটাও বুঝতে হবে যে ইসলামের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী ইসলামী সমাজ অব্যাহতভাবে তার আদিরূপে প্রত্যাবর্তনের লড়াই চালায় এবং যতদিন টিকে থাকবে ততদিন তা চালাবে।
পৃথিবীর বিস্তীর্ণ ভূভাগে সুদীর্ঘ কাল ধরে বিভিন্ন কারণে সমাজ ও সভ্যতায় যে সঙ্কট ও মানবিক বিপর্যয় ঘটে চলেছিল আরবের বর্বর ও যাযাবর বেদুইনদের উপর ভর করে ইসলাম এসেছিল তেমন একটা সামাজিক পরিস্থিতির উপযোগী ধর্ম এবং ব্যবস্থা হয়ে। সুতরাং এমন একটি ধর্মের সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় উৎপাদনশীল এবং মানবিক বোধ বা চেতনা সম্পন্ন কোনও শ্রেণী বা গোষ্ঠীর গুরুত্ব থাকবার কথা নয়। যুদ্ধ করে ভিন্ন সমাজ ও দেশ দখল করা হবে, লুঠ করা হবে, বিধর্মী নারীদেরকে ধর্ষণ ও সম্ভোগ করা হবে, নারীদেরকে অমানুষের মত রাখা হবে, স্বাধীন মানুষদেরকে দাস করা হবে এবং তলোয়ার ও চাবুকের ভয় দেখিয়ে শ্রমদানে বাধ্য করা হবে। যেহেতু মানুষকে শুধু ভয় দেখিয়ে চিরকাল দমন করে রাখা যায় না, আর সবাইকে মেরে ফেলে তো লাভও নাই, সুতরাং ভয় দেখিয়ে হোক, চাপ দিয়ে হোক, সুবিধা দিয়ে হোক, লোভ দেখিয়ে হোক, দ্রুত হোক, ধীর গতিতে হোক ইসলামে দীক্ষিত করা হবে। একবার ইসলামে দীক্ষিত হলে ধর্মবিশ্বাসের প্রভাবে বিজিতরা হবে ইসলামী শাসকদের অন্ধ অনুসারী ও অনুগত দাস এবং সেই সঙ্গে এই দাসত্বের ব্যবস্থার দৃঢ় সমর্থক ও রক্ষক।
সিন্ধু সভ্যতা এমন কোনও সামাজিক বাস্তবতাকে তুলে ধরে না। বুঝাই যায় যে সেটা ছিল ভারতবর্ষে মানুষের সভ্যতা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও উৎপাদনশীলতার ক্ষেত্রে মহা নির্মাণের কাল। সুতরাং যুদ্ধের পরিবর্তে এই মহা নির্মাণে যারা ভূমিকা রেখেছিল সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ যে মূলত তাদের হাতেই ছিল সেটা সহজবোধ্য। সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র-শাসক নির্বাচন কিংবা বাছাই কোন্ প্রক্রিয়ায় হত সেটা খুঁজবার চেয়ে সম্ভবত এই নিয়ন্ত্রণ যাদের হাতে ছিল সেই শ্রেণীগুলি কারা এবং কোন প্রক্রিয়ায় তারা সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও অর্থনীতির উপর নিয়ন্ত্রণ রাখত সেটা খুঁজে পাওয়াটা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অনুমান করা চলে এদের উদ্ভব ও বিকাশ মূলত অহিংস, শান্তিপূর্ণ ও নম্র প্রক্রিয়ায় ঘটায় সমাজ ও সভ্যতার বিকাশ যেমন নম্র ধারায় হয়েছে তেমন রাষ্ট্রেও তার প্রতিফলন ঘটেছে। ফলে সভ্যতা তার শক্তি ও সম্পদকে চোখ ধাঁধানো মহানির্মাণের পিছনে ব্যয় না করে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণ এবং কল্যাণের পিছনে ব্যয় করেছে, যার প্রতিচ্ছবি আমরা দেখতে পাই সিন্ধু সভ্যতার প্রতিটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শনে।
এটা আমরা অনুমান করতে পারি যে, সিন্ধু সভ্যতার সমাজ ও রাষ্ট্রের মূল নিয়ন্ত্রণ ছিল উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে উদ্ভূত শ্রেণী বা গোষ্ঠীগুলির হাতে। যেমন বণিক, কারখানা মালিক, ভূমিমালিক, প্রকৌশলী ইত্যাদি পেশা বা বৃত্তির অধিকারী ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীসমূহ। এছাড়া সিন্ধু সভ্যতায় বুদ্ধিজীবী বা জ্ঞান ও বিদ্যা চর্চায় নিযুক্ত ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান সমূহের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান ও মর্যাদা ছিল বলে ধারণা করবার কারণ আছে। কারণ আমাদের অনুমান অনুযায়ী সিন্ধু সভ্যতা যদি নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার উপর প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে তবে সভ্যতার প্রযুক্তি নির্ভরতার কারণে জ্ঞান চর্চার উপর সভ্যতা তার অস্তিত্বের প্রয়োজনেই সর্বাধিক গুরুত্ব দিতে বাধ্য ছিল। এবং সেই জ্ঞান চর্চা যে মূলত ধর্মীয় নয় বরং লোকবাদী বা জাগতিক তেমন অনুমান করাই যুক্তিসঙ্গত।*
------------------------------------------------------------------------------
* সিন্ধু সভ্যতায় শাসক শ্রেণী গঠনে বস্তুবাদ ও লোকবাদী বিশ্বদৃষ্টির প্রভাব প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় যে কথা বলা হয়েছে এখানে সেটা উদ্ধৃত করা যায়, ‘বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার গণতান্ত্রিকতা, প্রযুক্তির উন্নত মান, নগর পরিকল্পনা এবং নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা ইত্যাদি থেকে আমাদের ধারণা যে, হরপ্পান রাষ্ট্র বা সভ্যতা যা-ই বলা যাক তার মূল নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনাভার ছিল কম বা বেশী সেকিউলার বা লোকবাদী দৃষ্টিভঙ্গী এবং পেশার অধিকারী বিভিন্ন সামাজিক শক্তির হাতে। রাষ্ট্র পরিচালনায় প্রধান ভূমিকায় ছিল সম্ভবত বিভিন্ন ব্যবসায়ী-কারখানা মালিকগোষ্ঠী, প্রকৌশলী, ভূমিমালিক এবং বুদ্ধিজীবী শ্রেণী। পুরোহিত বা ধর্মীয় শ্রেণী ছিল রাষ্ট্রের পরিচালক শক্তির সহায়ক বা সহযোগী মাত্র। তবে সভ্যতার সংকটকালে পুরোহিত শ্রেণীর শক্তি বৃদ্ধি ঘটেছিল বলে মনে হয়। কারণ শ্রমজীবী ও সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রণের জন্য ধর্মের ভূমিকা সভ্যতার বস্তুগত সংকটকালে যে বৃদ্ধি পাবে সেটা একান্ত স্বাভাবিক।’ অষ্টম অধ্যায়, নদী নিয়ন্ত্রণ ও সিন্ধু সভ্যতা, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, পৃষ্ঠা ঃ ১৭৪। ঐ একই পৃষ্ঠার টীকায় আমরা যা বলেছি সেটাও এখানে উদ্ধৃত করা যায়, ‘সিন্ধু সভ্যতার পরিণত পর্যায়ে রাষ্ট্র পরিচালনার প্রধান ভূমিকা যে ধর্মীয় শক্তির পরিবর্তে লোকবাদী শ্রেণী অর্থাৎ সমাজের উৎপাদনী শক্তির হাতে ছিল তার একটি বড় প্রমাণ হল হরপ্পান সমাজ ও সংস্কৃতি যথেষ্ট উপযোগবাদী (Utilitarian) ছিল। জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োজনে লাগে এমন জিনিসের প্রতিই তারা মনোযোগী ছিল।’
------------------------------------------------------------------------------
বিশেষ করে সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্র শাসকরা তথা শাসক শ্রেণী যে মূলত ধর্মীয় শ্রেণী ছিল না তার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসাবে আমাদের সামনে আবির্ভূত হয় ঋগ্বেদ। ঋগ্বেদ মনোযোগ দিয়ে পড়লে একটা উন্নত সভ্য সমাজের বিস্তারিত চিত্র আমাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে। জলসেচ ও লাঙ্গল ভিত্তিক কৃষি, বণিক ও বাণিজ্য, সমুদ্র বাণিজ্য, সাগরগামী জাহাজ, বস্ত্র বয়ন, ধাতব দ্রব্য, ভবন, চিকিৎসা, প্রাচীর ঘেরা নগর ইত্যাদি সম্পর্কে ঋগ্বেদের বহুসংখ্যক মন্ত্রে বর্ণনা আছে। বৃহৎ ভবন বুঝাতে সহস্র স্তম্ভ কিংবা সহস্র দ্বার বিশিষ্ট ভবনের উল্লেখও আমরা ঋগ্বেদ থেকে পাই (৫/৬২/৬; ২/৪১/৫; ৭/৮৮/৫)। এছাড়া ঋষিদের তথা আর্যদের আবাস ভূমি হিসাবে বারবার সপ্তসিন্ধু তথা সিন্ধু সভ্যতার মূলভূমির উল্লেখ আছে। সুতরাং মুক্তমন নিয়ে পাঠ করলে খুব সহজেই ঋগ্বেদকে সিন্ধু সভ্যতার সঙ্গে সংযুক্ত করা যায়।
আর এখানেই আমরা একটি গুরুতর ধাঁধার সম্মুখীন হই। সেটা হচ্ছে ঋগ্বেদ থেকে সিন্ধু সভ্যতার সমাজ চিত্র সম্পর্কে স্পষ্ট চিত্র পেলেও রাষ্ট্র বা রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে স্পষ্ট চিত্রের অনুপস্থিতি। এই ধাঁধার সহজ উত্তর হিসাবে আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় এই সিদ্ধান্ত টেনেছি যে, সিন্ধু সভ্যতার রাষ্ট্রশাসনে পুরোহিত শ্রেণীর প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। ফলে তারা যখন ধর্ম সংস্কার করেছে তখন সেখানে রাষ্ট্র ও রাজনীতির বিষয়গুলি অনেকাংশে উপেক্ষিত থেকে গেছে। আসলে এগুলি তাদের অভিজ্ঞতা বহির্ভূত এবং এখতিয়ার বহির্ভূত বিষয় ছিল। কিন্তু সভ্যতার পতন বা ক্ষয়ের সময়ে একটা অহিংস সভ্যতার অহিংসায় অভ্যস্ত জনসমাজকে যুদ্ধের পক্ষে নেওয়ার প্রয়োজনে তারা ধর্ম সংস্কারে হাত দিয়েছিল। ফলে সমাজ ও ধর্মের বিষয়গুলি মন্ত্র রচনায় প্রাধান্য পেয়েছিল। রাষ্ট্র ক্ষমতায় পুরোহিতরা না থাকায় কিংবা তার সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক না থাকায় এবং এর ফলে এ সম্পর্কে ধারণাও না থাকায় ঋগ্বেদে রাষ্ট্র ও রাজনীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলির এমন অস্পষ্টতা ও গুরুত্বহীনতা। সুতরাং আমরা আর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর এখানে খুব সংক্ষেপে হলেও পাবার চেষ্টা করব, তা হল সিন্ধু সভ্যতায় রাষ্ট্র ও ধর্মের মধ্যে সম্পর্ক কী ধরনের হতে পারে।
(৭) রাষ্ট্র ও ধর্মের আন্তঃসম্পর্ক
‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় এ সম্পর্কে আমরা যে কথা বলেছিলাম এখানেও আমি সেই কথা বলব, ধর্ম এবং পুরোহিত শ্রেণীর ভূমিকা ছিল অধস্তনের বা সহায়কের। এটা স্বাভাবিক যে সভ্যতায় যেমন ধরনের হোক ধর্মের একটা অবস্থান বা ভূমিকা ছিল। তবে সিন্ধু সভ্যতার উত্থান পর্বে বা বিকাশমান পর্যায়ে তার ভূমিকা যে গৌণ ছিল সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়। আমাদের কাছে এটাও স্পষ্ট যে, বেদ সিন্ধু সভ্যতার প্রথাগত ধর্মীয় ঐতিহ্য থেকে আগত। তবে পুরাতন বা প্রথাগত ধর্মকে সংস্কার করা হয়েছে। যে কথা কিছু আগে বলেছি, একটি যুদ্ধ বিমুখ বা অহিংস সমাজকে যুদ্ধে নিবার জন্য এই ধর্মসংস্কার।* বৈদিক ধর্মে প্রতিমা পূজা নাই। কারণ সিন্ধু সভ্যতার বিদ্যমান যে ধর্ম থেকে তার আগমন সেই ধর্মে প্রতিমা পূজার স্থান ছিল না।
------------------------------------------------------------------
* এ নিয়ে ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় বিস্তারিত আলোচনা আছে।
-----------------------------------------------------------------
‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় ঋগ্বেদ ও আবেস্তার সূত্র ধরে আমরা বরুণ দেবতা কেন্দ্রিক একটি ধর্মকে সিন্ধু সভ্যতায় প্রধান ধর্ম হিসাবে দেখতে পেয়েছি। এই ধর্মে আরও দেবতা থাকলেও তারা ছিল বরুণের অধীনস্থ। অন্যদিকে এই ধর্মে দেবতাদের কোনও মূর্তি বা প্রতিমা না থাকায় সিন্ধু সভ্যতায় প্রতিমা পূজার নিদর্শন দেখা যায় নাই। এর ধারাবাহিকতা আমরা বৈদিক ও আবেস্তান উভয় ধর্মে দেখতে পাই।
যাইহোক, বৈশিষ্ট্যের বিচারে সিন্ধু সভ্যতার ধর্মকে নিরাকারবাদী এবং এক ধরনের একেশ্বরবাদী বলতে পারি। এটাই অনুমান করা যায় যে, নিরাকারবাদী ধর্ম হওয়ায় সিন্ধু সভ্যতায় বৃহৎ দেবতা মূর্তি পাওয়া যায় না। অযত্নে নির্মিত পোড়ামাটির যে সব ক্ষুদ্র পুতুল পাওয়া গেছে, যেগুলিকে মাতৃদেবী মূর্তি বলা হয়, সেগুলি যে রাষ্ট্র বা সভ্যতার দেবতা হতে পারে না তা অনুমান করা যায়। যদি এই কথিত মাতৃমূর্তিগুলি শিশুদের খেলনা বা গৃহসজ্জার সামগ্রী না হয়ে ধর্মবিশ্বাসের সঙ্গে সম্পর্কিত হয়ে থাকে তবে সেগুলি যে সমাজের প্রান্তস্থ, দুর্বল ও পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীসমূহের সংস্কৃতির স্মারক সেই রকমটাই মনে হয়। কারণ অমন শক্তিশালী ও বৃহৎ সভ্যতার দেব-দেবীদের মূর্তিও যে হবে আর সব সভ্যতার দেব-দেবীদের মূর্তির মত বৃহদায়তন ও জমকালো সেটাই স্বাভাবিক। সমাজ ও সভ্যতা তার শক্তিরও বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে চায় দেব-দেবীদের প্রতিমা পূজা থাকলে প্রতীক হিসাবে তাদের প্রতিমা নির্মাণ ক’রে। এই ধরনের প্রতিমা বা মূর্তি না থাকায় সিন্ধু সভ্যতায় ধর্ম মন্দির হিসাবে কোন গৃহকে সেভাবে চিহ্নিত করা যায় না।
সুতরাং আমরা যে সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি তা হচ্ছে সিন্ধু সভ্যতায় ধর্মের অবস্থান যেমন গৌণ তেমন সেটা ছিল প্রতিমা পূজাহীন। এখন আমরা যে প্রশ্নের সম্মুখীন হই তা হল রাষ্ট্র বা শাসক শ্রেণীর সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক কী ধরনের হওয়া সম্ভব ছিল।
এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া দুরূহ মনে হলেও এর কিছুটা উত্তর আমরা ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় পেতে চেষ্টা করেছি। সেখানে যে কথা বলেছি সেটা কিছু পূর্বে বলেছি যে, সভ্যতায় ধর্ম এবং পুরোহিত শ্রেণীর অবস্থান ছিল অধস্তনের এবং রাষ্ট্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্কহীন। এটাই আজ মনে হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার শাসক শ্রেণী ধর্ম ও ধর্মীয় তথা পুরোহিত শ্রেণীকে সুকৌশলে হলেও দৃঢ় নিয়ন্ত্রণে রেখেছিল। সভ্যতায় অবস্থিত বিভিন্ন পশ্চাৎপদ জনগোষ্ঠীর মধ্যে ধর্মের প্রভাব থাকাটা স্বাভাবিক হতে পারে। তাদের চিন্তা-চেতনার প্রভাব যেমন বৃহত্তর সমাজে পড়বার কথা তেমন রাষ্ট্রকেও কম বা বেশী তাদেরকে শান্তিপূর্ণভাবে নিজের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হয়েছে। ফলে শাসকরা নিজেরা বিশ্বাসের ক্ষেত্রে যেমন হোক ধর্মকে রাষ্ট্র ক্ষমতার প্রান্তে জায়গা যেমন দিয়েছে তেমন প্রয়োজনে ব্যবহারও করেছে। অর্থাৎ সেনাবাহিনী এবং ধর্ম এই দুইটি যেন ক্ষমতা কাঠামোর বিচারে এই সভ্যতার দুইটি প্রান্তস্থ উপাদান, যাদের উভয়কেই সম্ভবত রাখা হয়েছিল দৃঢ় নিয়ন্ত্রণে। ধর্মের ভূমিকা এবং অবস্থান সম্পর্কে এখন পর্যন্ত আরও বিশদ ও নির্দিষ্ট করে বলবার মত প্রত্নতাত্ত্বিক এবং সাহিত্যিক সাক্ষ্য-প্রমাণ আমাদের হাতে না থাকলেও আজ এটুকু অনুমান করা যায় যে, রাষ্ট্রশাসন বা রাষ্ট্র ছিল মূলত ধর্মমুক্ত। এ প্রসঙ্গে একটু পূর্বে যে কথা বলেছিলাম তার পুনরুক্তি করে বলি, রাষ্ট্র শাসনে ধর্ম বা ধর্মীয় শ্রেণী তথা পুরোহিত শ্রেণীর হস্তক্ষেপের সুযোগ যে ছিল না তার সাক্ষ্য আমরা ঋগ্বেদ থেকে পাই। অন্যদিকে এই সভ্যতার উপযোগবাদী বৈশিষ্ট্যও আমাদের এই অনুমানকে জোরালো করে।
এই রকম সিদ্ধান্ত কিংবা অনুমান আজকের ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে অবিশ্বাস্য মনে হওয়া সঙ্গত। কিন্তু পাঁচ হাজার বছর কিংবা ততোধিক কাল আগে যারা সিন্ধু-সরস্বতী নদীর মত কাল প্রেক্ষিতে বিশাল সব নদীকে বাঁধ ও জলকপাট বা স্লুইসগেটের সাহায্যে নিয়ন্ত্রণ ক’রে সিন্ধু সভ্যতার মত সম্পদ ও ক্ষমতার সুষম বণ্টনভিত্তিক এক মহাকায় সভ্যতা গড়ে তুলছিল তারা যে ধর্মাশ্রিত মানুষ ছিল না সে বিষয়ে সন্দেহ থাকার কারণ দেখি না। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় আমরা যে কথা বলেছিলাম সে কথাই এখানে আর একভাবে বলব যে, প্রাচীন কালে কোনও ধর্ম বিশ্বাসী কিংবা অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাসী মানুষের পক্ষে নদীকে বাঁধ ও জলকপাট দ্বারা নিয়ন্ত্রণের কল্পনা করা সম্ভব ছিল না। কারণ প্রাচীন কালের ধর্মবিশ্বাসী মানুষের বিশ্বাস অনুযায়ী যে কোনও শক্তির মত নদীও দেবতা। সেই দেবতাকে বন্দী করার দুঃসাহস সে কালের ধর্মবিশ্বাসী মানুষের পক্ষে কীভাবে করা সম্ভব?
শুধু প্রাকৃতিক অজ্ঞাত শক্তিকে তুষ্ট এবং নিয়ন্ত্রণ করবার আকাঙ্ক্ষা থেকে যে ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ তা-ই নয়, অধিকন্তু মানুষকে তুষ্ট এবং নিয়ন্ত্রণ করবার প্রয়োজন থেকেও ধর্মের উৎপত্তি ও বিকাশ। বস্তুত এই মানুষকে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজনটাই ধর্মের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। আর তাই আমরা দেখতে পাই, যে সব সভ্যতায় জবরদস্তি, পীড়ন এবং বৈষম্য অত্যন্ত বেশী সেই সব সভ্যতাতেই ধর্মের এত প্রভাব এবং প্রকটতা। জবরদস্তি, পীড়ন এবং বৈষম্য আর সব সভ্যতাতেই উৎকট রূপে দৃশ্যমান হলেও সিন্ধু সভ্যতায় সেগুলি সেভাবে দৃশ্যমান নয়। সুতরাং আমরা ধর্মের সেই উৎকট প্রকাশ কিংবা প্রাধান্য কোনওটাই সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনাদিতে দেখতে পাই না।
বস্তুত সিন্ধু সভ্যতার সমাজে অন্তত তার গৌরব কালে কিংবা বিকাশের পর্যায়ে ধর্মের প্রভাব যে জনসমাজেও বেশী ছিল না তা মনে করবার আরও যুক্তিসঙ্গত কারণ আছে। সিন্ধু সভ্যতার পতনের অনেক পরবর্তী কালে আজ থেকে আড়াই হাজার বৎসর পূর্বে নিরীশ্বরবাদী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ধর্মের যে বিস্তার ভারতবর্ষে ঘটা সম্ভব হয়েছিল তা থেকে মনে করবার কারণ আছে যে ব্যাপক জনসমাজে বহু পূর্বকাল থেকেই নিরীশ্বরবাদী চিন্তা যথেষ্ট শক্তিশালী ভিত্তি তৈরী করে রেখেছিল। নিরীশ্বরবাদী জৈন ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা মহাবীরকে বলা হলেও জৈন শাস্ত্রের দাবী অনুযায়ী তিনি এই ধর্মের ২৪তম এবং সর্বশেষ তীর্থঙ্কর। সুতরাং বুদ্ধের সমসাময়িক অর্থাৎ আড়াই হাজার বছর আগের মানুষ হলেও মহাবীর আরও অনেক প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী এক ধর্ম বা মতবাদের শেষ সংস্কারক বা শাস্ত্রকার। অর্থাৎ নিরীশ্বরবাদের ধারা ভারতবর্ষে স্মরণাতীত কাল থেকে বহমান। এর সঙ্গে আমাদেরকে যুক্ত করতে হবে চার্বাক হিসাবে পরিচিত বস্তুবাদী, যুক্তিবাদী ও ধর্মবিশ্বাস বিরোধী এবং কপিল মুনির সাংখ্যদর্শনের মত নিরীশ্বরবাদী দার্শনিক স্কুল বা প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রভাবকে।
বুঝা যায় এক সময় উপমহাদেশের জনসমাজে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে থাকা এ ধরনের নিরীশ্বরবাদী এবং বস্তুবাদী কিংবা ধর্মবিশ্বাস মুক্ত চিন্তাগুলি সিন্ধু সভ্যতার উৎসজাত। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী এ ধরনের দার্শনিক ও ধর্মীয় চিন্তাগুলির উদ্ভব আজ থেকে আড়াই-তিন হাজার বছর আগে। কিন্তু সভ্যতা ধ্বংসের পর সমাজের পশ্চাদগতি এবং অবক্ষয়ের পরিস্থিতিতে যখন সমাজ ফিরে গেছে নগর জীবন ছেড়ে গ্রামীণ জীবনে তখন যে এ ধরনের উন্নত, বুদ্ধিদীপ্ত এবং যুক্তিবাদী দর্শন চিন্তা আর নূতন করে বিকাশ লাভ করতে পারে না সেটা সহজেই ধারণা করা যায়। এটা ঠিক যে বুদ্ধ বা মহাবীরের সময়ে দীর্ঘ বিরতির পর নগর সভ্যতা নূতন করে কেবল গড়ে উঠতে শুরু করেছে। এই সময় সভ্যতা নির্মাণের পথে বাধা হয়ে থাকা বৈদিক ধর্ম এবং সেই সঙ্গে বৈদিক ধর্মের উত্তরাধিকার নিয়ে গড়ে উঠতে থাকা বর্ণজাতিভেদ ভিত্তিক ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধে যেসব ধর্মীয় ও দার্শনিক চিন্তার উত্থান ঘটতে দেখি সেগুলি কিন্তু দৃঢ় ও প্রাচীন ঐতিহ্যের ভিত্তি না পেলে প্রতিক্রিয়ার সেই কালে দাঁড়াবার কোনও সুযোগই পেত না। বুঝা যায় এগুলি নূতন কালের পটভূমিতে অনেক প্রাচীন বিভিন্ন নিরীশ্বরবাদী এবং বস্তুবাদী বা লোকবাদী দার্শনিক ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা।
এ থেকে আমরা অনুমান করতে পারি, সিন্ধু সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে ধর্মবিশ্বাস মুক্ত বা বস্তুবাদী ও লোকবাদী চিন্তার একটি প্রবল শক্তিশালী ধারা বহমান ছিল, যা সভ্যতা নির্মাণে নির্ধারক ভূমিকা রেখেছিল। সে ক্ষেত্রে লোকবাদ বা বস্তুবাদী চিন্তাধারার সমান্তরালে আত্মা কিংবা পরমাত্মা তথা ঈশ্বরের ধারণাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠা অলোকবাদী ধর্ম সমাজে থাকলেও তার অবস্থান এবং গুরুত্ব যে গৌণ ছিল তেমনটা অনুমান করা যায়। অর্থাৎ সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশ প্রক্রিয়ায় বস্তুবাদ ও অলৌকিকতা নির্ভর ভাববাদ দুইটি ধারাই সম্ভবত পাশাপাশি জন্ম ও বিকাশ লাভ করলেও সভ্যতার উদ্ভব ও বিকাশের একটা পর্যায় পর্যন্ত সমাজ ও রাষ্ট্রে বস্তুবাদী বা লোকবাদী ধারার প্রাধান্য ছিল। পরবর্তী কালে একটা পর্যায়ে যখন প্রধানত নদীনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার ব্যর্থতার ফলে সভ্যতায় সঙ্কট ও ক্ষয় দেখা দিয়েছে, সভ্যতার বস্তুগত শক্তি হ্রাস পেয়েছে, উৎপাদনে বিপর্যয়ের দরুণ সুষম বণ্টন সম্ভব হয় নাই, অর্থনৈতিক ও ক্ষমতা কাঠামোগত শ্রেণী বৈষম্য তীব্র হয়েছে এবং সভ্যতায় হিংসা, যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগ ক্রমেই অধিক থেকে অধিকতর গুরুত্ব অর্জন করেছে তখন জনসমাজ বা শাসিত শ্রেণীকে নিয়ন্ত্রণের জন্য শাসক শ্রেণীর নিকট ধর্ম ক্রমবর্ধমানভাবে লাভজনক ও গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে। সভ্যতার ক্ষয় বা পতনের সঙ্গে পুরাতন শাসকদের পতন হয়েছে। নূতন শাসকরা নম্রতা এবং গণতান্ত্রিকতার পথ অনুসরণের পরিবর্তে বঞ্চনা, দমন, যুদ্ধ, হিংসা এবং বলপ্রয়োগের পথ অনুসরণ করতে গিয়ে এ কাজে ধর্মকে সহায়ক হিসাবে দেখেছে। সুতরাং ধর্মকে ক্রমবর্ধমানভাবে পৃষ্ঠপোষকতা দিয়েছে। যুদ্ধ ও বলপ্রয়োগের হাত ধরে এসেছে ধর্ম। যুদ্ধকে বৈধতা দিতে গিয়ে ঘটাতে হয়েছে নম্র ও অহিংস সভ্যতার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ পুরাতন ধর্মের সংস্কার। এক পক্ষে ঘটেছে বৈদিক সংস্কার, অপর পক্ষে তাকে মোকাবিলা করতে গিয়ে ঘটেছে আবেস্তান সংস্কার। এই আলোচনার শুরুতে বিষয়টা আলোচনা করায় এখানে আর তার পুনরুক্তির প্রয়োজন নাই।
সিন্ধু সভ্যতার ক্ষয় এবং পতনের সঙ্গে বিজ্ঞান ও যুক্তির শক্তির তুলনায় অবিজ্ঞান ও ধর্মের শক্তি বৃদ্ধি পেয়েছে। সভ্যতার সূচনা থেকেই বিজ্ঞান ও অবিজ্ঞানের যে লড়াই সিন্ধু-সরস্বতী উপত্যকায় চলে আসছিল এবং যে লড়াইয়ে এতকাল বিজ্ঞানের জয় হয়ে চলেছিল বলে আমরা আজ অনুমান করতে পারি সেই লড়াইয়ে আজ থেকে প্রায় চার বা পৌনে চার হাজার বছর আগে অবিজ্ঞানের জয় সূচিত হয়। এবং আজকের ধর্ম শাসিত ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে বলা যায় এখানকার রাষ্ট্রগুলিতে আজ অবধি অবিজ্ঞানের সেই জয়জয়কার চলছে। অবিজ্ঞান ও ধর্মের জয়ের হাত ধরাধরি করে চলেছে সমাজ ও রাষ্ট্র জীবনের যত রকম বিকার ও বিকৃতি, নারী নিগ্রহ, সামাজিক বঞ্চনা এবং অবিশ্বাস্য শ্রেণী বৈষম্য এবং সেই সঙ্গে সমাজ ও রাষ্ট্রের প্রবল শক্তি কর্তৃক দুর্বলের উপর জবরদস্তির সর্বব্যাপী চর্চা। নিপীড়ক রাষ্ট্র এবং অলোকবাদী ধর্ম এখানে একে অপরের পরিপূরক। বস্তুত মানুষের উপর মানুষের পীড়ন, বঞ্চনা এবং বৈষম্যের দায় দায়ী মানুষের পরিবর্তে অন্য কোনও অদৃশ্য ও কাল্পনিক শক্তির উপর চাপানোর জন্য ধর্মের চেয়ে ভাল আর কোন্ হাতিয়ার হতে পারে? অন্যদিকে, যত দুঃখ, বঞ্চনা, বৈষম্য এবং অন্যায়কে নীরবে মাথা পেতে মেনে নিবার সুখ বা স্বস্তিও মানুষকে ধর্ম ছাড়া আর কী দিতে পারে? সুতরাং এই উপমহাদেশের উৎপীড়ক ও তঞ্চক রাষ্ট্রশাসক এবং অপ্রতিরোধী ও ভাগ্যবাদী শাসিত জনগণ উভয় শ্রেণীর নিকট যতই অবিজ্ঞান হোক ধর্মের কদর এত বেশী।
(৮) ভাবাদর্শিক প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য ভূমিকা
এখন আমরা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজি, সিন্ধু সভ্যতায় হিংসার শক্তি এবং বৈষয়িক ক্ষমতার কেন্দ্র স্বরূপ রাষ্ট্রের লাগাম টেনে ধরার জন্য প্রত্যক্ষভাবে শাসন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত শ্রেণী ছাড়াও পরোক্ষভাবে হলেও আর কোনও শ্রেণী বা গোষ্ঠীর ভূমিকা থাকা সম্ভব কিনা। মানুষের বাস্তব জীবন তো অনেকাংশেই ভোগের প্রেরণা এবং বৈষয়িক কর্ম নির্ভর। স্বাভাবিকভাবে ব্যবহারিক ও বৈষয়িক মানুষ দীর্ঘকাল ক্ষমতার চর্চা করলে ভোগ-বিলাসে অভ্যস্ত কিংবা তার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়তে পারে। ব্যতিক্রম থাকতে পারে। কিন্তু সেটা তো সাধারণ নিয়ম না। সে ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের নানানভাবে বিচ্যুতি ঘটতে পারে। তাহলে আর একটি অনুমানের দিকে আমাদেরকে এগিয়ে যেতে হতে পারে সেটা হচ্ছে এই যে, সিন্ধু সভ্যতায় প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্রকে যারাই নিয়ন্ত্রণ করুক, যে প্রক্রিয়ায় তারা ক্ষমতায় আসীন হোক, সেটা নির্বাচন হোক অথবা মনোনয়নের কোনও পদ্ধতি হোক, রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে অধিষ্ঠান করত আর একটি গোষ্ঠী, যারা সরাসরি রাষ্ট্র পরিচালনা না করলেও দূর থেকে হলেও তার নীতি নির্ধারণে চূড়ান্ত ভূমিকা রাখত। তাদের ভূমিকা হয়ত ছিল অনেকটা সমাজের বিবেকের মত।
এমনটা সম্ভব হতে পারে যে সিন্ধু সভ্যতা পরোক্ষভাবে হলেও নিয়ন্ত্রিত ছিল মূলত একটি নৈতিক বা আদর্শিক গোষ্ঠী বা শ্রেণী দ্বারা, যেটা হতে পারে বিভিন্ন লোকবাদী বা বস্তুবাদী আদর্শ বা ধ্যানধারণার মানুষদের দ্বারা গঠিত। বিশেষত সিন্ধু সভ্যতায় প্রযুক্তি বিদ্যা ও জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার উপর যে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হত সেই রকমই মনে হয়। এর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা ছিল বলে অনুমান করা চলে। উপমহাদেশের পৌরাণিক কাহিনীগুলি লোকালয় থেকে দূরে অরণ্যে অবস্থিত ধ্যানমগ্ন ঋষি, শিক্ষাব্রতী শিষ্য বা ছাত্র, আশ্রম ইত্যাদির বর্ণনায় পূর্ণ। এগুলি সিন্ধু সভ্যতার জ্ঞান বা বিদ্যা চর্চার শিক্ষক, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠীর স্মৃতি ভিন্ন রূপে বহন করছে এমনটা মনে করা যেতে পারে। অর্থাৎ ব্যাপারটা এমন হতে পারে যে, সভ্যতার জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার স্মৃতি সভ্যতা ধ্বংসের পরবর্তী কালে ধর্মভিত্তিক সমাজের মানুষদের নিকট অতিপ্রাকৃতিক ক্ষমতা সম্পন্ন ঋষিদের রহস্যমণ্ডিত ধ্যান ও জ্ঞানচর্চার স্মৃতিতে পরিণত হয়েছে।
যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতায় শিক্ষক-অধ্যাপক, পণ্ডিত এবং দার্শনিকদের কোনও ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মাধ্যমে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে ভূমিকা রাখা অসম্ভব নয়। হয়ত তাদের প্রতিনিধিরা আলাদাভাবে এই বিশেষ মর্যাদা সম্পন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত হত। অথবা হয়ত বিশেষ মর্যাদার অধিকারী জ্ঞানী-গুণীরা বিশেষ ঘটনা উপলক্ষ্যে নিজেদের পঞ্চায়েত বসিয়ে অভিমত ব্যক্ত করে জনমত ও রাষ্ট্রকে প্রভাবিত কিংবা নিয়ন্ত্রণ করত। এভাবে হয়ত এই প্রতিষ্ঠান আনুষ্ঠানিক না হয়ে অনানুষ্ঠানিক ছিল। তবু প্রথার মাধ্যমে এটাও হয়ে উঠতে পারে এক ধরনের প্রতিষ্ঠান। অবশ্য, সিন্ধু সভ্যতার নগর পরিকল্পনা, বসতির বিন্যাস ইত্যাদি যেভাবে সুচিন্তিত পরিকল্পনা ও দৃঢ় শৃঙ্খলায় আবদ্ধ এক সভ্যতার চিত্র উপস্থিত করে তাতে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব থাকলে সেটা যে সমাজ ও রাষ্ট্রের নিয়মবদ্ধ বা আনুষ্ঠানিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে ক্রিয়াশীল ছিল তেমন ভাবাটাই যৌক্তিক হবে। যাইহোক, এই সঙ্গে এটাও অনুমান করা অযৌক্তিক হবে না যে, এই ধরনের কোনও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার অস্তিত্ব থাকায় সভ্যতা এবং সেই সঙ্গে সভ্যতার নম্র, সংযত, ভারসাম্যপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য এতটা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছিল, যেটা হতে পারে হাজার, এমনকি কয়েক হাজার বছর।
অবশ্য সেটা হয়ত এই সভ্যতার রক্ষণশীলতা কিংবা এক ধরনের স্থবিরতারও প্রধান কারণ হয়ে থেকেছে। তবে এ প্রসঙ্গে আলোচনায় যাবার আগে সিন্ধু সভ্যতার কাল পর্যায় সম্পর্কে আর একটু স্পষ্টভাবে বলে নিলে ভালো হয়। সিন্ধু সভ্যতার পূর্ণাঙ্গ নগর সভ্যতার পর্যায়কে প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভাষায় হরপ্পান অথবা পরিণত হরপ্পান পর্যায় হিসাবে অভিহিত করা হয়। তার পূর্ববর্তী সময় যখন নগর সভ্যতার প্রস্তুতি চলছিল সেই পর্যায়কে বলা হয় আদি হরপ্পান পর্যায়। আদি হরপ্পান পর্যায়কে আমরা গ্রাম পর্যায় বলতে পারি, যে সময়ে নগর সভ্যতা গঠনের পূর্বপ্রস্তুতি চলছিল। এই সময় হরপ্পান পর্যায়ের উন্নত নগর পরিকল্পনা, সিল ইত্যাদি বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অভাব লক্ষ্যণীয়। তবে বাসগৃহসহ বিভিন্ন নিদর্শনাদি থেকে বুঝা যায় যে পরবর্তী হরপ্পান পর্যায় এই পর্যায়েরই বিকশিত ও বিবর্তিত রূপ। একইভাবে সিন্ধু সভ্যতার নগর পর্যায়ের ক্ষয় বা পতনের পর যে দীর্ঘ সময় নিয়ে হরপ্পান পর্যায়ের কিছু বৈশিষ্ট্য টিকেছিল সেটাকে পণ্ডিতদের ভাষায় বিদায়ী হরপ্পান পর্যায় হিসাবে অভিহিত করা যায়। এই সময়ে নগর সভ্যতার প্রকৃতপক্ষে গ্রাম পর্যায়ে প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল। শুধু তাই নয়, এই সময়ে সিন্ধু সভ্যতার অধিবাসীদের মূলভূমি পরিত্যাগ পূর্বক ব্যাপকায়তনে বিভিন্ন দূরবর্তী অঞ্চলে অভিগমন ঘটে। এই সময়টায় সিন্ধু সভ্যতার প্রধান বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্নগুলি ছিল না, যেমন নাগরিকদের জন্য কূপ অথবা ব্যবহার্য জল সরবরাহের মনোযোগী ব্যবস্থা, সোজা রাস্তা ও আন্ডারগ্রাউন্ড ড্রেন কিংবা পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থাসহ উন্নত নগর পরিকল্পনা, সিল, সভ্যতার সর্বত্র ওজন ও মাপের অভিন্নতা ইত্যাদি। সাম্প্রতিক কাল পর্যন্ত প্রত্নতাত্ত্বিকরা তিনটি হরপ্পান পর্যায়কে সাধারণত যে কাল পর্যায়ে ভাগ করেছেন সেটি মোটাদাগে এই রকম, খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ৩,৪০০ থেকে ২,৬০০ পর্যন্ত আদি হরপ্পান পর্যায়, খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ২,৬০০ থেকে ১,৯০০ পর্যন্ত হরপ্পান বা পরিণত হরপ্পান পর্যায়, এবং খ্রীষ্টপূর্ব প্রায় ১,৯০০ থেকে ১,০০০ পর্যন্ত বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়। অবশ্য কাল পর্যায় ভাগে যে কিছু ভিন্নতা এবং নমনীয়তা থাকে সেটা আমার ইতিপূর্বেকার আলোচনায় এসেছে বলে আশা করি।
কাল পর্যায়ের হিসাব এখন আরও সাম্প্রতিক কিছু আবিষ্কারের ফলে বদলে যেতে শুরু করেছে। তবে কাল পর্যায় নিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক মহলে মোটামুটি মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হবার কিংবা এ সম্পর্কে আরও ধারণা পাবার পূর্ব পর্যন্ত আমি পণ্ডিত মহলে কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত মোটামুটিভাবে স্বীকৃত হিসাবটাই এখানে উল্লেখ করেছি। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য়ও আমরা সিন্ধু সভ্যতার এই কাল পর্যায়ের কথা উল্লেখ করেছি।
যাইহোক, আমাদের মূল আলোচনায় ফিরে গিয়ে উল্লেখ করি যে, সিন্ধু সভ্যতার পূর্ণাঙ্গ নগর পর্যায় যেটা প্রত্নতাত্ত্বিকদের ভাষায় সাধারণত হরপ্পান বা পরিণত হরপ্পান পর্যায় হিসাবে কথিত হয় সেটা সভ্যতার প্রকৃতপক্ষে একটি পরিবর্তনহীন পর্যায়। যা কিছু পরিবর্তন ঘটেছে তা প্রধানত আদি হরপ্পান পর্যায়ে যখন সভ্যতা বিকাশ লাভ করছে কিংবা বিদায়ী হরপ্পান পর্যায়ে যখন সভ্যতা ক্ষয়িষ্ণু ও ধ্বংস হয়ে মূলত গ্রাম পর্যায়ে ফিরে গেছে। কিন্তু মধ্যবর্তী পর্যায়টাতে পরিণত হরপ্পান সভ্যতা বা নাগরিক সিন্ধু সভ্যতা একটা প্রায় অপরিবর্তনীয় ছকে দীর্ঘকাল আবদ্ধ হয়ে থেকেছে। সুতরাং এটাকে এক অর্থে আমরা সভ্যতার রক্ষণশীলতারও কাল বলতে পারি। এটা বুঝা যায় যে সভ্যতা এই সময়ে বিস্তীর্ণ অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু সেটা প্রায় একই ছকে আবদ্ধ থেকে। তাই অঞ্চল ভেদে কিছু ভিন্নতা থাকলেও প্রায় সর্বত্র যেমন মূলত একই কিংবা কাছাকাছি ধরনের নগর পরিকল্পনা দেখা যায় তেমন বিশাল অঞ্চলব্যাপী বিস্তৃত সভ্যতার সর্বত্র দেখা যায় অভিন্ন সিল, মাপ, ওজন এবং ব্যবহার্য সামগ্রী ইত্যাদি।
কাল প্রেক্ষিতে বিশাল ভূভাগ ব্যাপী সভ্যতার এই অভিন্নতা ও সুদীর্ঘ কাল ব্যাপী অপরিবর্তনীয়তা সভ্যতার কেন্দ্রীভূত নিয়ন্ত্রণের অসাধারণ দৃঢ়তার পাশাপাশি তার অনমনীয় রক্ষণশীলতার দিককেও নির্দেশ করে। যদি ধর্ম এই দৃঢ়তা ও অনমনীয়তার উৎস না হয়ে থাকে তবে সেটা কী হওয়া সম্ভব ছিল আমাদেরকে সেই প্রশ্নের উত্তর পাবার চেষ্টা করতে হয়। বস্তুগতভাবে তার উৎস হিসাবে আমরা সিন্ধু সভ্যতায় বাঁধ ও জলকপাট সংযুক্ত নদী নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে দেখেছি। এটা এমনই জটিল এবং স্পর্শকাতর একটা ব্যবস্থা যে একবার এর অন্তর্ভুক্ত হবার পর সভ্যতার পক্ষে নির্দিষ্ট শৃঙ্খলা বা নিয়মের বাইরে যাওয়া সম্ভব হয় না। কারণ তাতে করে গোটা জল নিয়ন্ত্রণ ও সেই সঙ্গে সামাজিক ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়বার ভয় থাকে। ‘আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা’য় এ বিষয়ে শামসুল আলম চঞ্চল এবং আমি দীর্ঘ আলোচনা করেছি। তবে এখানে এ বিষয়ে তেমন কোনও আলোচনার অবকাশ নাই।
এখন আমরা অনুমান করতে পারি যে, নদী নিয়ন্ত্রণ ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থা সভ্যতাকে যে স্থিতিশীলতা এবং সেই সঙ্গে এক ধরনের অনড়তাও দিয়েছিল তার ফলে দীর্ঘ সময় ধরে সমাজে প্রথার শক্তি প্রবল ও গভীর হয়েছিল। এমনটা অনুমান করা চলে যে, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালিত হত সুদীর্ঘ কাল ধরে সমাজের বিভিন্ন ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর পারস্পরিক মিথষ্ক্রিয়া, মতবিনিময়, দ্বন্দ্ব এবং মিলনের এক জটিল প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে গড়ে উঠা প্রথার মাধ্যমে। হয়ত এই প্রথা ধর্মের বিধান ও রাষ্ট্রের আইনের মত শক্ত কোনও নিয়মের শৃঙ্খলে সমাজ ও রাষ্ট্রকে বেঁধে রেখেছিল। এটাও অনুমেয় যে সভ্যতার বস্তুগত ভিত্তি যতদিন সুরক্ষিত ছিল ততদিন এই প্রথার মাধ্যমে রক্ষিত হত সিন্ধু সভ্যতার অভিভাবক সুলভ কোনও প্রতিষ্ঠানের সম্ভাব্য ভূমিকা। অর্থাৎ হয়ত প্রথার মাধ্যমে এমন কোনও প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল যার কাজ ছিল রাষ্ট্র ও সভ্যতার নৈতিক বা আদর্শিক মানদণ্ড রক্ষার দিকে দৃষ্টি রাখা।
চরিত্রগতভাবে সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির হলেও এটা যেন ইদানীং কালের ইরানের শিয়া ধর্মীয় গুরু আয়াতোল্লাদের মত কিংবা মধ্যযুগের পশ্চিম ইউরোপে ক্যাথলিক চার্চের পোপের মত প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র ক্ষমতার অধিকারী না হয়েও রাষ্ট্রের উপর অভিভাবক সুলভ ভূমিকা পালন।
অবশ্য উপরের দুইটি উদাহরণ ধর্ম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের প্রাধান্যের উদাহরণ। ধর্মীয় না হলেও সামাজিক প্রথার যে নিজস্ব শক্তি থাকতে পারে তার দৃষ্টান্ত হিসাবে এ কালের যুক্তরাজ্যের কথা বলা যায়। যুক্তরাজ্য বা গ্রেট ব্রিটেনের লিখিত কোনও সংবিধান নাই। আজকের যুগেও সেখানে রাষ্ট্র পরিচালনা হয় শত শত বৎসর ধরে গড়ে উঠা প্রথার ভিত্তিতে।
যাইহোক, সিন্ধু সভ্যতায় প্রথার শক্তি কত প্রবল ছিল আমরা তা অনুমান করতে পারি যখন বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ সত্ত্বেও তার এক ধরনের আত্মবদ্ধতা দেখি। আমরা জানি যে, মেসোপটেমিয়া, মধ্য এশিয়া কিংবা উপমহাদেশের বিভিন্ন দূর অঞ্চলের সঙ্গে তার যোগাযোগ কিংবা বাণিজ্য ছিল। এমনকি ইরাকের দক্ষিণে সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে কিংবা আরবের দক্ষিণে পারস্য উপসাগরীয় অঞ্চলে সিন্ধু সভ্যতার অনেকগুলি বসতি পাওয়া গেছে। এগুলিকে কোনও কোনও পণ্ডিত সাগরপারের উপনিবেশ আবার কেউ কেউ বাণিজ্য কেন্দ্র বলছেন। যেটাই হোক এগুলি সিন্ধু সভ্যতার বিস্তার, বিস্তৃত যোগাযোগ ও প্রভাবের প্রমাণ। আমরা এও জানি যে প্রাচীন মেসোপটেমিয়ায় সিন্ধু সভ্যতার সিল পাওয়া গেছে। কিন্তু এটা বিস্ময়কর যে, সিন্ধু সভ্যতায় মেসোপটেমিয়ার সিল পাওয়া যায় নাই। অন্য সভ্যতার প্রতিমার মত কোনও বস্তুও এখানে পাওয়া যায় না। অথচ বিভিন্ন দূরবর্তী স্থান বা দেশ থেকে তাকে তাম্রসহ বিভিন্ন ধাতু এবং মূল্যবান পাথর ইত্যাদি যে আনতে হত সেটা প্রমাণিত। তার মানে এই ধরনের যোগাযোগ ও বাণিজ্য বা লেনদেনের ক্ষেত্রে সমাজ ও রাষ্ট্রের কঠোর বিধিনিষেধ ছিল যা বাইরের প্রভাবকে যতটা সম্ভব দূরে রাখত। একান্ত প্রয়োজনীয় সামগ্রীর বাইরে হয়ত কিছু আমদানী করা বা আনা যেত না।*
------------------------------------------------------------------------------
* এ প্রসঙ্গে কেনোয়ারের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য হতে পারে ঃ ‘In contrast to the Mesopotamian evidence for Indus trade, no items produced in Mesopotamia proper have been found in the Indus region. Mesopotamian texts list such exports as wool, incense and gold, which are perishable or would have been transformed into new objects in the Indus cities. The absence of Mesopotamian cylinder seals and sealings would indicate Mesopotamian traders were not directly involved with the Indus trade and that no bundles of goods sealed by Mesopotamian merchants were being sent to the Indus cities. There is not enough evidence at this time to argue for the exclusion of Mesopotamian traders from the Indus market, but the Indus cities were clearly involved in the import of raw materials and the export of finished goods. This extremely profitable trade strategy may have been another factor in the rapid growth and spread of Indus settlements throughout the northwestern subcontinent.’ (Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, Oxford University Press and American Institute of Pakistan Studies, Karachi, 1998, p. 98). সিন্ধু সভ্যতার অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য বুঝবার জন্য কেনোয়ারের নিম্নোক্ত পর্যবেক্ষণটিও আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে ঃ ‘Detailed studies of the drilling techniques and manufacturing processes confirm that many long biconical carnelian beads as well as the decorated carnelian and green amazonite beads were actually made in distant Indus workshops. However, the long faceted carnelian beads may have been made by Indus artisans in Mesopotamia. These beads are drilled with the unique technique of the Indus Valley, yet the faceted shape is a style that was never produced in the Indus workshops. The pear-shaped decorated carnelian bead is also a shape that was never produced in the Indus, but it is made using a technology that has only been documented in the Indus cities. These clues suggest that merchants or entrepreneurs from the Indus Valley may have set up shops in cities such as Ur to market their goods and also produce objects in local designs. If this can be confirmed through further studies, it would be the earliest evidence for a pattern that came to be the norm in later historical times, when craftsmen and merchants from the subcontinent extended their trade networks throughout West Asia as well as Southeast Asia. ’ (Jonathan Mark Kenoyer, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, p. 97)
------------------------------------------------------------------------------
হয়ত একইভাবে বিভিন্ন বিধিনিষেধ দ্বারা বিদ্যমান ব্যবস্থার প্রতি হুমকি সৃষ্টি করতে পারে সমাজের ভিতর থেকেও নূতন এমন কিছুর উদ্ভাবনের পথ আটকে রাখা হয়েছিল। অর্থাৎ জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা ব্যাপক বিস্তৃত হলেও হয়ত সীমাবদ্ধ ছিল কঠোর বা অনমনীয় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে। কাজেই সভ্যতার অগ্রগতিতে সিন্ধু সভ্যতার ভূমিকা বিচারের সময় তার এই রক্ষণশীলতার দিকটিকেও আমাদের বিবেচনায় নেওয়া উচিত হবে। তবে যত রক্ষণশীল হোক সিন্ধু সভ্যতার প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর দৃঢ়বদ্ধতার ফলে জনকল্যাণমুখী একটা ব্যবস্থা মূলত অপরিবর্তনীয় থেকে হয়ত শত শত কিংবা এক হাজার বা এমনকি কয়েক হাজার বৎসর টিকে থাকতে পেরেছিল।
এটা অনুমেয় যে, ধর্মের পরিবর্তে প্রথা সিন্ধু সভ্যতাকে অবিশ্বাস্য অনমনীয়তা দিয়েছিল। ধর্ম মানুষকে এ জীবনে দুঃখের বিনিময়ে পরজন্মে বা পরকালে সুখের প্রত্যাশা দেয়। কিন্তু সভ্যতা যদি কাল্পনিক পরজন্ম বা পরকালে সুখসাধনের প্রত্যাশা লালনের পরিবর্তে এই বাস্তব জীবনে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কল্যাণ সাধনে সর্বোচ্চ পরিমাণে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে থাকে তবে তার পক্ষে ধর্মের আশ্রয় নেওয়া কীভাবে সম্ভব? ফলে এটা অনুমেয় যে, তাকে তার বিদ্যমান স্থিতাবস্থাকে রক্ষার জন্য প্রথার আশ্রয় নিতে হয়েছে। যদি তা হয়ে থাকে তবে এই প্রথাকে রক্ষার জন্য তাকে সম্ভবত গড়তে ও রক্ষা করতে হয়েছে এমন প্রতিষ্ঠানকে যা সমাজকে দৃঢ়ভাবে অপরিবর্তনীয় কিংবা খুবই ধীরভাবে পরিবর্তনশীল কাঠামোতে ধরে রাখবে।
এই ধরনের প্রতিষ্ঠানের সদস্যরা হয়ত শুদ্ধাচারী ও সংযত কিংবা সংসারত্যাগী জীবন যাপন করে সমাজের আনুগত্য অর্জন করত। ব্যাপক জনসমাজের আনুগত্য ও সমর্থন লাভের জন্য যে ঈশ্বর বিশ্বাসের প্রয়োজন হয় না তার প্রমাণ হিসাবে নিরীশ্বরবাদী জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের উদাহরণ দেওয়া যায়। সুতরাং জনসমাজের আনুগত্য কিংবা সমর্থনের জন্য ধর্মগুরু হবার কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সদস্য হবার প্রয়োজন ছিল এমন ভাবাটা ভুল হতে পারে। বস্তুত প্রাচীন কালের সাংখ্য দর্শন প্রণেতা কপিল মুনির মত নিরীশ্বরবাদী কিংবা চার্বাক দর্শন প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে কথিত ধীষণের মত বস্তুবাদী বা লোকবাদী বিভিন্ন দার্শনিকের যেসব প্রতিষ্ঠান বা স্কুল ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান না হয়েও কালপরম্পরায় টিকেছিল কোনও না কোনও ভাবে সামাজিক লালন ছাড়া সেটা কীভাবে সম্ভব হয়েছিল? বুঝা যায় সমাজের উপর তাদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল, যে কারণে সমাজ তাদেরকে লালন করত। এ কালেও জ্ঞান সাধনা, ত্যাগ ও সংযত জীবনাচরণের প্রতি হিন্দু, বৌদ্ধ ইত্যাদি ভারতীয় নিজস্ব ধারার জন-মানসে গভীর আস্থা ও ভক্তি বা আনুগত্য দেখা যায়। উপমহাদেশের এই বাস্তবতায় সেই সুপ্রাচীন কালে সিন্ধু সভ্যতার মত কাল প্রেক্ষিতে একটি সুউন্নত এবং সম্পদ ও ক্ষমতার ভারসাম্যপূর্ণ সভ্যতায় প্রথা ভিত্তিক এমন কোনও দার্শনিক বা জ্ঞানতাত্ত্বিক প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের সমাজের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রের অভিভাবক হিসাবে ভূমিকা পালনের সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
এই ধরনের প্রথা ভিত্তিক কোনও প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা যদি সিন্ধু সভ্যতায় থেকে থাকে তবে তার ইতিবাচক দিকের পাশে তার নেতিবাচক দিক হিসাবে রক্ষণশীলতার দিকটিকেও আমাদের সমালোচনামূলক দৃষ্টি দিয়ে দেখা উচিত হবে বলে আমি মনে করি। আরও আবিষ্কার এবং অনুসন্ধানের মধ্য দিয়ে হয়ত সভ্যতার অনেক ত্রুটি ও সীমাবদ্ধতা বেরিয়ে আসবে। অবশ্য তা দিয়ে তার ইতিবাচক দিক ম্লান হবে সেটা আমি মনে করি না। ঐ কালে সিন্ধু সভ্যতার নায়কেরা যা করেছিল, যেভাবে একটি অতুলনীয় সভ্যতাকে সুদীর্ঘ কাল ধরে রক্ষা করেছিল সেই দিকও যেন তার সমালোচনামূলক বিচারের সময় আমাদের মনে থাকে। সর্বোপরি, আজ যখন আমরা সিন্ধু সভ্যতার পুনর্মূল্যায়ন করব তখন আমাদের এ কথা মনে রাখা উচিত হবে যে, আমরা সেখান থেকে যে শিক্ষা কিংবা প্রেরণাই নিই আমাদের যাত্রাপথ অতীতমুখী হওয়া উচিত হবে না, বরং সেটাকে হতে হবে ভবিষ্যৎমুখী। এই বিষয়কে মাথায় রেখে পুনর্মূল্যায়ন বা পুনর্বিচারের সময় সিন্ধু সভ্যতার ইতিবাচক ও নেতিবাচক সকল দিকের প্রতি আমাদের নির্মোহ দৃষ্টিপাত করা উচিত হবে।
সিন্ধু সভ্যতার সেই প্রাচীন কালে ঘটনাটা কী ছিল এখন আমাদের পক্ষে বুঝা দুঃসাধ্য হলেও সিন্ধু সভ্যতার প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার, ঋগ্বেদসহ ভারতবর্ষের প্রাচীন সাহিত্য এবং বেশ কিছু সামাজিক বৈশিষ্ট্যের দিকে কিছু মনোযোগী দৃষ্টিপাত আমাদেরকে ইতিহাসের অনাবিষ্কৃত অনেক সত্যকেই উদ্ঘাটনে সাহায্য করতে পারে বলে আমি মনে করি।
তবে সিন্ধু সভ্যতার স্বরূপ যথাযথভাবে অনুধাবনের জন্য আমি অহিংসা ও নম্রতা নির্ভর জৈন ও বৌদ্ধ ধর্মের প্রতি বেশী গুরুত্ব দিবার প্রয়োজন দেখি। আমার অনুমান সিন্ধু সভ্যতার নম্রতা, অহিংসা ও ন্যায়-নীতি বোধ এই দুইটি ধর্মের ভিতর দিয়ে আর এক রূপে আত্মপ্রকাশ করেছে। এক সময় বুদ্ধের বাণী ভারতবর্ষকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছিল। সংসার ত্যাগী বুদ্ধের আকুল কামনা উচ্চারিত হয়েছিল এই বাণীতে, ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক।’ এই কামনা মানুষকে যতই তাড়িত করুক জীবন তো ভিন্ন। তাই সব প্রাণীর সুখ সাধনে সমাজ বা রাষ্ট্র যে নিজেকে নিয়োজিত করতে পারে তা নয়। তবে সর্বাধিক সংখ্যক মানুষের কল্যাণ ও ব্যবহারিক প্রয়োজন পূরণের প্রতি একটা রাষ্ট্র যে কাল প্রেক্ষিতে সর্বোচ্চ পরিমাণে মনোযোগী হতে পারে এবং সুবিশাল ও পরাক্রান্ত হয়েও নম্রতার পথচারী হতে পারে তার এক অনবদ্য দৃষ্টান্ত হয়ে আছে সিন্ধু সভ্যতা। সুতরাং আজ আমাদের সেই দিকটাতে দৃষ্টিপাতের এত প্রয়োজন।
(৯) সহায়ক গ্রন্থপঞ্জি
১। ঋগ্বেদ সংহিতা (প্রথম খণ্ড), রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে, হরফ প্রকাশনী, ১৯৮৭।
২। ঋগ্বেদ সংহিতা (দ্বিতীয় খণ্ড), রমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ অবলম্বনে, হরফ প্রকাশনী, ১৯৭৬।
৩। মনুসংহিতা, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলিকাতা, ১৩৯৭।
৪। পুরাতত্ত্ব পরিভাষা, এনামুল হক, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫।
৫। পৌরাণিক অভিধান, সংকলক: সুধীরচন্দ্র সরকার, এম,সি, সরকার অ্যাণ্ড সন্স প্রা: লি:, কলিকাতা, ষষ্ঠ সংস্করণ; ১৪০৪ (বাং)।
৬। প্রত্নতত্ত্ব পরিভাষা, সুলতান আহমদ, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৫,
৭। বাংলা একাডেমী ঐতিহাসিক অভিধান, সংকলক: মোহাম্মদ মতিওর রহমান, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৯৬ (পুনর্মুদ্রণ)
৮। এঙ্গেলস, ফ্রেডারিক, পরিবার, ব্যক্তিগত মালিকানা ও রাষ্ট্রের উৎপত্তি, কার্ল মার্কস- ফ্রেডারিক এঙ্গেলস, রচনা সংকলন, দ্বিতীয় খণ্ড, প্রথম অংশ, প্রগতি প্রকাশন, মস্কো, (তারিখ নাই) ।
৯। থাপার, রোমিলা, ভারতবর্ষের ইতিহাস, অনূদিত, ওরিয়েন্ট লংম্যান লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৮৮।
১০। বসু, যোগীরাজ, বেদের পরিচয় (বৈদিক সাহিত্যের ইতিহাস) ফার্মা কেএলএম প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৮০।
১১। মানিক, শামসুজ্জোহা এবং চঞ্চল, শামসুল আলম, আর্যজন ও সিন্ধু সভ্যতা, ব-দ্বীপ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০৩।
১২। ঘোষ, রমেন্দ্রনাথ, ভারতীয় দর্শন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮৩।
১৩। রায়, মনোরঞ্জন, আদিম সমাজের ইতিহাস, প্রকাশক: শ্রী নিরঞ্জন রায়, কলকাতা, ১৯৬২।
১৪। সাহা, অখীল বন্ধু, সাংখ্যদর্শন ও ন্যায়দর্শন, বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ১৯৮২।
১৫। হিট্টি, ফিলিপ কে, আরব জাতির ইতিহাস, অনূদিত, মল্লিক ব্রাদার্স, কলকাতা, ১৯৯৯।
১৬। Jaina Sutras, Translated from Prakrit by Hermann Jacobi, Sacred Books of the East series Vol. XLV, Oxford at the Clarendon Press, 1895.
১৭। Rig-Veda Sanhita, in 7 volumes, Translated by: H.H. Wilson, Cosmo Publications, New Delhi, Reprinted 1977.
১৮। The Buddha-Karita of Asvaghosha, Translated by E.B. Cowell, Oxford University Press, London, Reprint 1927 (1st edn. 1894), Sacred Books of the East series.
১৯। The Zend-Avesta, Part I The Vendidad. Translated by James Darmesteter, Second Edition, Oxford 1895, Sacred Books of the East series vol. IV & XIII.
২০। Agrawal, D. P., The Copper Bronze Age in India, Munshiram Manoharlal, New Delhi, 1971.
২১। Agrawal, D. P. and Sood, R.K., ‘Ecological Factors and the Harappan Civilization.’ In, G. L. Possehl, ed., Harappan Civilization : A Contemporary Perspective, New Delhi, 1982.
২২। Allchin, B. and Allchin, Raymond, The Birth of Indian Civilization, Penguin Books, New Delhi, 1968 (Reprinted 1993).
২৩। Allchin, B. and Allchin, Raymond, The Rise of Civilization in India and Pakistan, Selectbook Service Syndicate, New Delhi, 1983.
২৪। Bhattacharji, Sukumari, The Indian Theogony, Firma KLM Private Limited, Calcutta. Bhattacharya, D.K., 1978.
২৫। Bisht, R.S., ‘Excavation at Banawali : 1974 – 77.’ In, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, ed. G.L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co., New Delhi, 1982.
২৬। Bisht, R.S., ‘Structural remains and Town- planning of Banawali.’ In, Frontiers of the Indus Civilization, eds., B.B. Lal and S. P. Gupta, Books and Books, New Delhi, 1984.
২৭। Bisht, R.S., ‘Further Excavation at Banawali: 1983-84.’ In, Archaeology and History, eds. B.M. Pande and B.D. Chattopadhyaya, Vol. I, Agam Kala Prakashan, Delhi, 1987.
২৮। Bisht, R.S., ‘Dholavira and Banawali: Two Different Paradigms of the Harappan Urbis Forma.’ In, Puratattva, No. 29, 1999.
২৯। Dumont, Luis, Homo Hierarchicus, Granada publishing Ltd, London, 1972.
৩০। Dutt, Nripendra Kumar, (First edition) Origin and Growth of Caste in India, Firma KLM Private Limited, Calcutta, 1986.
৩১। Kennedy, Kenneth A.R., ‘Skulls, Aryans and the Flowing Drains : The Interface of Archaeology and Skeletal Biology in the Study of Harappan Civilization.’ In, G.L. Possehl, ed., Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, New Delhi, 1982.
৩২। Kennedy, Kenneth A.R., ‘Trauma and Disease in the ancient Harappans.’ In, Frontiers of the Indus Civilization, ed. B.B. Lal and S.P. Gupta, Books and Books, New Delhi, 1984.
৩৩। Kennedy, Kenneth A.R., ‘Have Aryans been identified in the prehistoric skeletal record from South Asia? Biological anthropology and concept of ancient races.’ In, The Indo-Aryans of Ancient South Asia: Language, Material Culture and Ethnicity, ed., George Erdosy, Munshiram Manoharlal Publishers Pvt. Ltd., New Delhi, First published in 1995, 1997.
৩৪। Kenoyer, Jonathan Mark, Ancient Cities of the Indus Valley Civilization, Oxford University Press and American Institute of Pakistan Studies, Karachi. Kenyon, M. Kathleen, 1998.
৩৫। Kenoyer, Jonathan Mark, Amorites and Canaanites, The Schweich Lectures of the British Academy 1963, The Oxford University Press, London, 1966.
৩৬। Kosambi, Damodar Dharmanand, An Introduction to the Study of Indian History, Popular Prakashan, Bombay. 1975.
৩৭। Kosambi, Damodar Dharmanand, The Culture and Civilization of Ancient India in Historical Outline, Vikas Publishing House Pvt. Ltd., New Delhi, 7th edn, 1982.
৩৮। Manik, Shamsuzzoha and Chanchal, Shamsul Alam, 1995 The Aryans and the Indus Civilization, Dinratri Prakashani, Dhaka.
৩৯। Mughal, M. Rafique, ‘Recent Archaeological Research in the Cholistan Desert.’ In, Harappan Civilization: A Contemporary Perspective, ed., Gregory L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co., New Delhi, 1982.
৪০। Mughal, M. Rafique, ‘Current Research Trends on the Rise of Indus Civilization.’ In, G. Urban and M. Jansen, ed., Forschungsprojekt Dfg: Mohenjo-dero. Aachen Veröffentlichung der Seminarbeiträge, No. 34, 1983.
৪১। Mughal, M. Rafique, ‘Genesis of the Indus Valley Civilization.’ In, Off-print from: Lahore Museum Bulletin, Vol. 1 (1), 1988.
৪২। Mughal, M. Rafique, ‘The Development of Protohistoric Research in Pakistan: 1970- 5.’ In, Journal of Central Asia, Vol. XII, No. 1, July, 1989.
৪৩। Mughal, M. Rafique, ‘The Harappan “Twin Capitals” And Reality.’ In, Journal of Central Asia, Vol. XIII, No. 1, July, 1990.
৪৪। Mughal, M. Rafique, ‘The Protohistoric Settlement Patterns in the Cholistan Desert.’ In, South Asian Archaeology 1987, eds., Maurizio Taddei, Istituto Italiano Per Il Medio Ed Estremo Oriente, Rome, 1990.
৪৫। Mughal, M. Rafique, ‘Further Evidence of the Early Harappan Culture in the Greater Indus Valley : 1971-90.’ In, South Asian Studies 6, 1990.
৪৬। Mughal, M. Rafique, ‘Archaeological Field Research in Pakistan Since Independence: An Overview.’ In, Bulletin of the Deccan College Post-Graduate & Research Institute, Vol. 49, Pune, 1990.
৪৭। Mughal, M. Rafique, ‘The Decline of the Indus Civilization and the Late Harappan Period in the Indus Valley.’ In, Lahore Museum Bulletin, Off-Print vol. III, No. 2, July-Dec.1990.
৪৮। Mughal, M. Rafique, ‘The Cultural Patterns of Ancient Pakistan and Neighbouring Regions circa 7000-1500 B.C.’ In, Pakistan Archaeology, No. 26, 1991.
৪৯। Mughal, M. Rafique, ‘The Consequences of River Changes for the Harappan Settlements in Cholistan.’ In, The Eastern Anthropologist, Vol. 45 ( 1 & 2), 1992.
৫০। Mughal, M. Rafique, ‘The Geographical Extent of the Indus Civilization During the Early, Mature and Late Harappan Times.’ In, South Asian Archaeology Studies, ed. G.L. Possehl, Oxford & IBH Publishing Co. Pvt. Ltd., New Delhi, 1992.
৫১। Mughal, M. Rafique, ‘Jhukar and the Late Harappan Cultural Mosaic of the Greater Indus Valley.’ In, South Asian Archaeology 1989, ed. Catherine Jarrige, Prehistory Press, Madison Wisconsin, 1992.
৫২। Pollock, Susan, Ancient Mesopotamia, Cambridge University Press, Cambridge, 1999.
৫৩। Shaffer, Jim G. and Lichtenstein, Diane A., ‘The concepts of “cultural tradition” and “paleoethnicity” in South Asian archaeology,’ in, The Indo-Aryans in Ancient South Asia: Language, Material Culture and Ethnicity (1997).
৫৪। Shaw, Ian, ed., The Oxford History of Ancient Egypt, Oxford University Press, Oxford, 2000.
৫৫। Singh, Bhagwan, The Vedic Harappans, Aditya Prakashan, New Delhi, 1995.
৫৬। Toynbee, Arnold J., A Study of History, Vol IV, Oxford University Press, London, 1956.
৫৭। Toynbee, Arnold J., A Study of History, Vol. I, Oxford University Press, London, 1956 (First edition 1934).
৫৮। Tautmann, Thomas R., ed., The Aryan Debate, Oxford University Press, New Delhi, 2005.