Banner
মার্কসবাদ ও বিপ্লব বিতর্ক : ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ প্রসঙ্গে ডঃ লেনিন আজাদ ও শামসুজ্জোহা মানিকের পত্রালাপ

লিখেছেনঃ ডঃ লেনিন আজাদ ও শামসুজ্জোহা মানিক, আপডেটঃ April 24, 2017, 12:00 AM, Hits: 2335


রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ প্রসঙ্গে ডঃ লেনিন আজাদ ও শামসুজ্জোহা মানিকের পত্রালাপ

 

১৯৯৬-তে লিখার সময় গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির নাম ‘আমার দৃষ্টিতে বাম-লীগ বিতর্ক ও রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ রাখা হলেও পরবর্তী কালে এর নামকরণ করা হয় ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ এবং এই নামে এটি বদ্বীপ প্রকাশন কর্তৃক প্রকাশ করা হয়। যাইহোক, গ্রন্থটি লিখার পর পাণ্ডুলিপির একটা ফটোকপি তিনি বিশিষ্ট গবেষক ও লেখক ডঃ লেনিন আজাদকে পড়তে পাঠান। তিনি সেটি পড়ে তার উপর কিছু মতামত ও পরামর্শ জানিয়ে গ্রন্থের লেখককে একটি সংক্ষিপ্ত পত্র পাঠান। লেখক সেটির উত্তরে যা লিখে পাঠান তা ছিল প্রকৃতপক্ষে একটি প্রবন্ধ বা নিবন্ধ। পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন জনকে পড়তে দেবার জন্য ডঃ আজাদের সম্মতিক্রমে লেখক ও ডঃ আজাদের পত্র দুইটি কম্পিউটারে মুদ্রণ করা হয়। যদিও ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ প্রসঙ্গে ডঃ আজাদের মন্তব্য ও প্রশ্নের উত্তরে লেখকের পত্র লিখা হয়েছে তথাপি এটি এমনভাবে লিখা হয়েছে যে, ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ যাঁরা পড়েন নি তাঁদেরও এটা বুঝতে বিশেষ একটা সমস্যা হবে না বলে মনে হয়। তবে যে সব পাঠক ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ পাঠ করেছেন বা করবেন তাঁদের আরও কিছু প্রশ্নের উত্তর লাভের জন্য এই পত্রালাপ বিশেষভাবে সহায়ক হতে পারে এই বিবেচনা থেকে পত্র দুইটি ওয়েব সাইটে দেওয়া হয়েছে।

সাদ্দাম হোসেন,
ঢাকা, ০২/১২/২০০৬ইং

 

শামসুজ্জোহা মানিকের ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’-এর * পাণ্ডুলিপির উপর ডঃ লেনিন আজাদের মন্তব্য

ঢাকা

২৮/১১/৯৬

শ্রদ্ধেয় মানিক ভাই,


আমার পড়া বাংলা ভাষায় রচিত রাজনৈতিক সাহিত্যে একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হচ্ছে আপনার ‘আমার দৃষ্টিতে বাম-লীগ বিতর্ক ও রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’।* কিছু কিছু জায়গা ভাষা ও বিশ্লেষণে এমন শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, বিশ্বের নামকরা যে কোন গ্রন্থকে অতিক্রম করে যেতে পারে। কমিউনিস্ট ইস্তেহার ঊনিশ শতকের তরুণ প্রজন্মকে যেমন উদ্দীপিত করেছিল, আপনার এ গ্রন্থেরও বেশ কিছু জায়গা আছে যে রকম। সহজ অথচ কি উদ্দীপিত হওয়ার মত ভাষা আপনি ব্যবহার করেছেন, কি শক্তিশালী উপমা আপনি ব্যবহার করেছেন, কত কঠিন বিষয়কে আশ্চর্য রকম সহজে আপনি বিবরণ দিয়েছেন তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গেছি। আপনার গ্রন্থের অন্তত শতাধিক বাক্য আছে যেগুলি উদ্ধৃতি দেওয়ার মত এবং অন্তত ১০টি বাক্য আছে যেগুলির সন্ধান বিদ্বৎ সমাজ পেলে যুগ যুগ ধরে সযত্নে রক্ষা করবে।

 

আমরা বিবেচনায় এ গ্রন্থের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ হচ্ছে ১১০ পৃষ্ঠা থেকে ২৬৭ পৃষ্ঠা অর্থাৎ ৬ষ্ঠ অধ্যায় থেকে ১০ম অধ্যায় পর্যন্ত। ৪নং অধ্যায়টিও এমনই মাপের হতে পারতো যদি কাজী জাফরের শক্তিমান দিকটির বিবরণ দেওয়া যেত। কেননা, কাজী জাফর, যিনি একটি যুগের সৃষ্টি, আন্দোলনের ফসল, সেই কাজী জাফরের নিজের মধ্যে কি মৌলিকত্ব ছিল যার জন্য তিনি অতোটা শক্তি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন এ ব্যাখ্যাটা দিতে পারলে এবং কিছু অসতর্ক বাক্য ও মন্তব্যকে এড়ানো গেলে এটাই সম্ভবত সবচেয়ে শক্তিশালী অধ্যায় হয়ে উঠতো।

 

নারী অধ্যায়টিও খুবই শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারতো যদি আপনি সিদ্ধান্তমূলক জায়গায় নারীকে তথা তার চেতনাকে আঘাত করার পদ্ধতিটা গ্রহণ করতেন। অবশ্য আপনি গ্রন্থের শেষ দিকে কথাটা বলেছেন। কিন্তু আপনার এ গ্রন্থ এ জন্য শক্তিশালী নয় যে, আপনি এখানে গভীর পাণ্ডিত্য প্রকাশ করেছেন, সকল ব্যাপারে যৌক্তিক সমাধান দিয়েছেন। আমরা বিবেচনায় আপনার এ গ্রন্থ এ কারণেই মহামূল্যবান হয়ে উঠবে যে, কবি নজরুল বিদ্রোহী কবিতা লিখে যে ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই ভূমিকাটি আপনিও এ গ্রন্থ্যের মধ্য দিয়ে পালন করতে চলেছেন। সে কারণে নারীর প্রতি সমবেদনা বা নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে হবে না, তাকে আঘাত করা, ঘেন্যা দিয়ে বলা এবং শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে যাদের কিছু যোগ্যতা আছে তারাও কি করে অতি সহজে বাধ্য গৃহপালিত রমণী হয়ে ওঠে, সম্পদ, গহনা ইত্যাদির কাছে আত্মসমর্পণ করে তার বিরুদ্ধে ঘৃণা দিয়ে লেখা প্রয়োজন বলে আমরা ধারণা। নারীর সংগ্রাম পুরুষরা করতে পারে না, করলে নারীর ওপর পুরুষের নতুন বেড়ি বা বন্ধন তৈরী হয়। নারীর সঙ্গে পুরুষের যে বিরোধ তা যতোদিন সত্তাদ্বয়ের অস্তিত্ব থাকবে ততোদিন এর শেষ ও মীমাংসা হবে না, শুধুমাত্র নারীর উত্থানই পুরুষের সাথে তার বিরোধ মীমাংসার ক্ষেত্রে তাকে সমান অংশীদার করতে পারে, কিংবা তারও বেশী কিছু পারে যদি পুরুষের বিকাশ সমান হারে না ঘটে। ফলে নারীর ব্যাপারে যারা মায়াকান্না করে আমার মনে হয় তারাও নারীকে নতুন বন্ধনে আটকাবার ফন্দিফিকিরে লিপ্ত।

 

______________________________________________________________________
* গ্রন্থের পাণ্ডুলিপির নাম ছিল ‘আমার দৃষ্টিতে বাম-লীগ বিতর্ক ও রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’। কিন্তু প্রকাশের সময় এটির নাম করা হয় শুধু ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’।
______________________________________________________________________

 

আমার ধারণা ষাট দশকের যুব উত্থান কিংবা বাষট্টির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাম যুবশক্তির উত্থান পঞ্চাশ দশকে সোহ্‌রাওয়ার্দীর বিশ্বাসঘাতকতার জবাব। এর প্রধান অংশটি কমিউনিস্টদের দ্বারা লালিত। তারাই এ যুবশক্তির মাতা। কিন্তু এ সন্তানটি এমনই বৃহৎ কলেবর নিয়ে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করলো যে, মায়ের সীমাবদ্ধ আঁচল তাকে ছায়া দিতে অক্ষম। অনেকটা মাকড়সা বা কাঁকড়ার সন্তান লাভের মত ─ মায়ের আত্মবিনাশের মধ্য দিয়েই যারা পৃথিবীর আলোক দর্শন করে। কাজী জাফর বা আপনার মত সন্তানেরা তা বোঝেন নি বলেই মায়ের প্রাণহীন দেহবল্লরির মাঝে আপনারা বারবার আশ্রয়  খুঁজেছেন। আর বাংলার চিরায়ত মায়ের মতই মায়ের প্রেতাত্মারা আপনাদের পিছন থেকে টেনে ধরেছে, যুদ্ধ সাজে সাজিয়ে দিতে পারে নি। তথাপি, তাদের সে ভূমিকাকে স্বীকার না করলে যথার্থ বলা হয় না।

 

মার্কসবাদ কিংবা কমিউনিজম সম্পর্কে যা বলেছেন তা না লিখলেই কি না? মার্কসবাদের যাথার্থ্য বিচার করতে গিয়ে আপনি যা কিছু মন্তব্য করেছেন তাতে যুক্তির তুলনায় আরোপিত সিদ্ধান্ত বেশী বলেই মনে হয়েছে। পৃথিবীর যে কোন দর্শনের পিছনেই দেখা যায় এক ধরনের আইডিয়াল টাইপ কাজ করে। কখনও তা বাস্তব হয়ে ওঠে না, তবুও তার কত কাছাকাছি যাওয়া যায় তারই প্রাণান্তকর চেষ্টা করে গেছে অনুসারীরা। কিন্তু যারা বিজ্ঞান মনস্ক তারা তো তার ভাল দিকটা নেবে, যা কিছু বিজ্ঞানের বিবেচনায় ভ্রান্ত প্রমাণিত কিংবা বিকাশের কোন সুযোগ নেই তাকে প্রত্যাখ্যান করবে। তাছাড়া, মার্কসের মৃত্যুর পর এঙ্গেলস যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন তার পূরণ এখনও হয় নি। লেনিনের রাষ্ট্র চিন্তাসহ কয়েকটি ক্ষেত্রে ইতিহাস ব্যাখ্যায় অবদান, মাও সে-তুং-এর নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব, সাংস্কৃতিক বিপ্লব ও দ্বন্দ্ব বিচারের মত কয়েকটি ক্ষেত্রে অবদানের পর গত ৪০ বছরে এ শাস্ত্রের কোন বিকাশ হয় নি। আমার বিচারে মার্ক্সের দ্বন্দ্ব তত্ত্ব, লেনিনের রাষ্ট্র চিন্তা এবং মাও সে-তুং-এর সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ধারণার বাইরে বর্তমান সময়কে ব্যাখ্যা করার জন্য মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন-স্তালিন-মাও সে-তুং-এর গাদাগাদা বই পুস্তক কোন কাজে আসে না। তবে এঙ্গেলস-এর কিছু মারাত্মক বিভ্রান্তিমূলক লেখা ছাড়া বাকীদের সকল মৌলিক তত্ত্বকেই বিকশিত করা সম্ভব। সময় যেমন মার্কসবাদের অনেক তত্ত্বকে বাতিল করে দিয়েছে, তেমনই নতুন সময়কে ব্যাখ্যা করে শূন্যের উপর স্থাপন করলে সে দাঁড়াতে পারে না। তার জন্য অতীত লাগে, শেকড় লাগে। মার্কসবাদের প্রতি ধর্মীয় বিশ্বাসীদের তাড়াতে না পারলে এদেশে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়িত কোনদিনই হবে না, এমনকি, পৃথিবীকেও মুক্ত বিশ্বে পরিণত করা যাবে না। প্রায় দেড়শো বছরের বুড়ো মার্কসকে এখনও কেউ বাতিল করতে পারে নি। এই সেদিন পর্যন্তও পৃথিবীর সেরা মেধাবীরা মার্কসের প্রতি দুর্বল হয়ে পড়তো। তাইতো, এখনও গোটা সমাজ বিজ্ঞানে মার্কস একা একদিকে আর একদিকে গোটা বিশ্বের সকল যুগের শ্রেষ্ঠ পণ্ডিতেরা। গত ২০/২৫ বছর ধরে মার্কসের আবেদন কমে যাওয়ার সাথে সাথে পৃথিবী ক্রমশ আদর্শহীন হয়ে পড়ছে। গোটা বিশ্বের মানবিক মূল্যবোধকে রক্ষা করতে হলেও একটি আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।

 

আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মার্কসের দ্বন্দ্বতত্ত্বের উপর দাঁড়ালেও মার্কস তাঁর জীবনকালে বিভিন্ন বিষয়ে যে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন অনেক বিষয়ে সম্পূর্ণ তার বিপরীত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তার মধ্যে জাতীয়তাবাদ একটি। মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বও বাতিল হয়ে গেছে, কিন্তু নতুন কিছু সেভাবে এখনও দাঁড়ায় নি। আপনি নিজেই বলেন আপনি মার্কসবাদী নন, কিন্তু মার্কসবাদের সন্তান। মার্কস কিন্তু তাঁর পূর্বসূরিদের অস্বীকার করেন নি, তাদের ভুলগুলোকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। দুনিয়া জোড়া এ প্রভাবশালী তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করে আমরা দাঁড়ানোর মাটি পাবো না। দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা যে শূন্যের উপর দাঁড়িয়ে আছি সে শূন্যস্থানটা পূরণ করতে হবে মার্কসবাদের ভ্রান্তিগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নতুন তত্ত্ব নির্মাণ করে সে সীমাবদ্ধতাকে দূর করার মাধ্যমে।

 

আমার বিবেচনায় আপনি বান্দা সংস্কৃতি ও শূদ্র-ব্রাহ্মণ সংস্কৃতির মূল উৎসকে নিপুণভাবে উদ্‌ঘাটন করে জাতীয়তাবাদের যে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন তাও কোন মাটি পাবে না যদি না আপনি একে মার্কসবাদের বিকশতি রূপ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেন। কেননা, আপনি যুবসমাজের মধ্যে যে সম্ভাবনার স্ফুরণ দেখতে পেয়েছেন তার মূল্য বিদ্যমান কোন দর্শন বুঝবে না। একমাত্র মার্কসবাদ কিছুটা হলেও মূল্য দেবে। তবে যুবসমাজকে ব্যবহার করার দৃষ্টিভঙ্গী থেকে, তাকে নেতা বানানোর অক্ষমতা রয়েছে মার্কসবাদের তত্ত্বের মধ্যে। মার্ক্সীয় তত্ত্বের এটুকুকে প্রত্যাখান আজ সহজেই করা যায়। মার্ক্সের দ্বন্দ্ব তত্ত্বের যে অংশে সামাজিক শক্তিসমূহের আলোচনা করা হয়েছে, লেনিনের এমপিরিয় ক্রিটিসিজমে যেখানে এ বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে সেখানে যে সকল ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে নেতৃত্বকারী সামাজিক শক্তি হিসাবে শ্রমিক শ্রেণীর কথা বলা হয়েছে, সেই একই ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আজ খুব সহজেই প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব যে বাংলাদেশের মত দেশগুলিতে সে সামাজিক শক্তি হল শিক্ষিত তরুণ সমাজ। লেনিন নিজেই দিশা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দর্শন আসবে শ্রমিক-শ্রেণীর বাইরে থেকে ─ একথা বলে এক রকম তত্ত্বটাকে মানানসই করেছেন।

 

আজকের যুগে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে উৎপাদন সম্পর্কের বিমূর্ততাই তার শ্রেষ্ঠত্বকে অবদমিত করেছে, ফলে আদর্শই হয়ে উঠেছে যে কোন আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি। আর বিশ্বব্যাপী সীমাহীন আদর্শের সংকট প্রতিদিন সন্ত্রাস আর নৈরাজ্যে পৃথিবীকে গ্রাস করতে চলেছে। এরকম আদর্শের সংকট দেখা দিয়েছিল চতুর্দশ শতাব্দী থেকে, যার অবসান ঘটে মার্কসীয় দর্শন উত্থানের পর। ফলে বিদ্যমান বিশ্বের আদর্শের সংকটকে পূরণ করতে পারে একটি নব্য দর্শন, আমার বিবেচনায় মার্কসবাদের ধারাবাহিকতা হিসাবে সে দর্শন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেই তা সহজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।

 

পরিশেষে, নিজের অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিতে গিয়ে যে নির্মোহভাবে নিজের বিভিন্ন সময়ের ভুল, সীমাবদ্ধতা ও অক্ষমতা সম্পর্কে স্পষ্ট চিত্র এঁকেছেন তা সত্যিই শিক্ষণীয়। নিজের অবদান সম্পর্কে যা বলেছেন তাও বিনয়ের সীমাকে একটুও অতিক্রম করে নি। তবুও বলবো আমার দাগ দেওয়া বাক্যগুলো একবার দেখবেন এবং প্রয়োজন বোধ করলে সংশোধন করে নেবেন। অবশ্য, খুব বেশী রকম ভাল লাগাতেও কিছু বাক্যে দাগ দিয়েছি।

ইতি - আপনার

লেনিন আজাদ


পুনশ্চঃ ১. ’৬৮-’৬৯ কাল পর্বের ঘটনাগুলি এবং ভাসানীর ঐ দুই বছরের ভূমিকা সম্পর্কে কিছু অস্পষ্টতা, তথ্য প্রমাদ এবং ভুল ব্যাখ্যা আছে বলে আমার ধারণা। বিশেষ করে ’৬৯-এর জানুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ থেকে ফেব্রুয়ারীর প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত কেন ভাসানী অজ্ঞাতবাস করছিলেন এবং এ জন্য কমিউনিস্টদের দায়-দায়িত্ব কি এ প্রসঙ্গটি আলোচনা করা আপনার বক্তব্য প্রতিষ্ঠার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

 

২. কমিউনিস্টদের ব্যাপক ব্যর্থতার পিছনে কমিউনিস্ট নেতারা কতটুকু দায়ী আর কমিউনিস্ট দর্শন ও তার বিভিন্ন তত্ত্ব কতটুকু দায়ী সে বিষয়টিও বিচার করা হয় নি, যা বিচারের মধ্য দিয়ে আপনার জাতীয়তাবাদী তত্ত্বের একটি নজির গড়ে উঠতে পারে।

 

 

 

রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ -এর * উপর ডঃ লেনিন আজাদের মন্তব্যের প্রেক্ষিতে শামসুজ্জোহা মানিকের উত্তর


ঢাকা

১৩ জানুয়ারী  -  ২১ জানুয়ারী

১৯৯৭

 

 

ডঃ লেনিন আজাদ

স্নেহবরেষুু ,


‘আমার দৃষ্টিতে বাম-লীগ বিতর্ক ও রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’-এর উপর আপনার মন্তব্য মনোযোগ দিয়ে পড়েছি। আপনি আমার বৃহৎ লেখাটা যে, এত মনোযোগ ও গুরুত্ব দিয়ে পড়েছেন তার জন্য প্রথমেই আমার কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। আমি আরও বেশী কৃতজ্ঞ বোধ করছি এই কারণে যে, আপনি শ্রম ও সময় ব্যয় করে আমার বইয়ের পাণ্ডুলিপির উপর আপনার লিখিত সমালোচনা করেছেন। আপনার দৃষ্টিতে এর শক্তিশালী ও দুর্বল দিকগুলোর উপর যে আলোচনা করেছেন তার আন্তরিকতা আমাকে মুগ্ধ করেছে। আমি আপনার লিখিত মন্তব্যের উত্তর নাও দিতে পারতাম। কারণ আপনি যে দিকগুলোর প্রশংসা করেছেন সেগুলো আমার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়েছে। আর যেসব সমালোচনা করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন সেগুলো নিয়ে ভাবতে পারতাম। হাঁ, সেগুলো নিয়ে আমি ভেবেছি এবং ভাবছিও। কিন্তু আমার মনে হল আপনার এমন আন্তরিক মন্তব্যের প্রেক্ষিতে আপনাকেও আমার কিছু লিখিত বক্তব্য দেওয়া উচিত। এই পদ্ধতি হয়ত আমাদের উভয়কেই সমৃদ্ধ করবে।

 

এবার আপনার পরামর্শ ও সমালোচনার জায়গাগুলো সম্পর্কে আমার প্রতিক্রিয়া এবং চিন্তা জানাই। আপনি ৪নং অধ্যায় সম্পর্কে যে মত ব্যক্ত করেছেন তা যথাযথ বলেই মনে হয়েছে। কাজী জাফর আহমদের মৌলিকত্ব বা শক্তির দিকগুলো সম্পর্কে আমি কম বলেছি। যেমন তাঁর অসাধারণ বাগ্মিতা এবং তাঁর সাংগঠনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক সততা (যেটা সেকালে ছিল) সম্পর্কে বলি নি। তবে তাঁর ঔদার্য, মুক্তদৃষ্টি, কর্মীদের প্রতি মমত্ব, সাহস ও আন্তরিকতা সম্পর্কে বলেছি। আপনার পরামর্শ অনুযায়ী আমি তাঁর সম্পর্কে আরও আলোচনা করব। আমার কাছেও মনে হয়েছে কিছু অসতর্ক বাক্য ও মন্তব্য আছে। সেগুলো বাদ দিব।

 

১১নং বা নারীর অধ্যায়ের উপর আপনার সমালোচনা হল যে, আমি নারীকে বা তার চেতনাকে আঘাত করার পদ্ধতি নিই নি। আপনার মত হল, ‘সে কারণে নারীর প্রতি সমবেদনা বা নির্যাতনের বিবরণ দিয়ে হবে না, তাকে আঘাত করা, ঘেন্যা দিয়ে বলা এবং শিক্ষিত মেয়েদের মধ্যে যাদের কিছু যোগ্যতা আছে তারাও কি করে অতি সহজে বাধ্য গৃহপালিত রমণী হয়ে ওঠে, সম্পদ, গহনা ইত্যাদির কাছে আত্মসমর্পণ করে তার বিরুদ্ধে ঘৃণা দিয়ে লেখা প্রয়োজন বলে আমার ধারণা।’

 

আপনার কথায় যুক্তি আছে। এমন পদ্ধতিও ক্ষেত্র বিশেষে লাগে বই কি! আর এও তো ঠিক যে, নারীর দুঃখে কাতর হলেও নারী পূজারী হওয়াও ঠিক নয়। কারণ নারীও যেহেতু মানুষ সেহেতু পুরুষের মত সুযোগ পেলে মানুষের সব দোষগুণ তার ভিতর দিয়েও প্রকাশ পেতে পারে। পুুরুষের মত করে না হোক নারীর মত করেই নারীও তার নৃশংসতা ও বর্বরতারও প্রকাশ ঘটাতে জানে বৈকি। নারীর স্বার্থপরতাও কি কম? তার ক্ষুদ্র দৃষ্টিও কি কম? আমি জানি নারীর অনেক দোষ আছে। যেমন আছে অনেক গুণ।


______________________________________________________________________
* পাণ্ডুলিপির নাম ছিল ‘আমার দৃষ্টিতে বাম-লীগ বিতর্ক ও রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’। পরে গ্রন্থের নাম করা হয় ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’- লেখক।
______________________________________________________________________

 

কিন্তু আমার প্রশ্ন আজ আমাদের সমাজে নারীর যে রূপ আমরা দেখতে পাই তার জন্য সবচেয়ে বেশী দায়ী কে? নারীকে এই আদলে গড়েছে কে? সে কি পুরুষ এবং পুরুষ শাসিত সমাজ ও রাষ্ট্র নয়? আমাদের সমাজে নারীকে যে ক্ষুদ্র ও সঙ্কুচিত মানুষরূপে আমরা দেখতে পাই তা কি পুরুষবাদের বর্বর পেষণের ফল নয়?

 

না, তার দৈহিক আকৃতির কথা বলছি না। পুরুষের তুলনায় নারী দেহে সাধারণত খর্ব এ ব্যাপারে বিতর্ক নেই। কারণ সেটা বাস্তব। কিন্তু দেহের আয়তনের ভিতরে যদি মানবিক মেধা, গুণ ও শ্রেষ্ঠত্ব নিহিত থাকত তাহলে হাতি পৃথিবীকে শাসন করত আর মানুষের স্থান হত কিছু চিড়িয়াখানায় আর সার্কাসের দলে। হয়ত হাতিরা করুণা পরবশ হয়ে বিলুপ্ত প্রায় প্রজাতি হিসাবে অভয়ারণ্যে কিছু সংখ্যক মানুষকে ছেড়ে রাখত। তা সেটা হয় নি দেহের আয়তনটাই শক্তি ও শ্রেষ্ঠত্বের চূড়ান্ত মানদণ্ড নয় বলে।

 

কিন্তু তবু নারী আমাদের সমাজে হীন অবস্থানে রয়েছে। এবং প্রকৃতপক্ষে সমস্ত পৃথিবীতেই। তা পৃথিবীর কথাটা থাক। আমাদের সমাজের দিকেই দৃষ্টি দেওয়া যাক। নারীর স্বাধীন মানুষ হিসাবে দাঁড়াবার, হাঁ, আমি বলতে চাই মানুষের সব দোষ এবং গুণ নিয়েই স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার, কোন সুযোগ কি রাখা হয়েছে? যদি না হয়ে থাকে তবে এর জন্য দায়ী কে? নারী? যাকে পুরুষ তৈরী করেছে নিজ ইচ্ছা ও প্রয়োজন অনুযায়ী, তার অধঃপতিত রূপের জন্য দায়ী সে?

 

আঘাত যে করব তা করব কাকে? যে জিয়ন্তে মরে আছে, সেই আধমরাকে ঘা মারব? ও কি তাতে বাঁচবে? যাকে সমাজে, সংসারে, পথে, প্রান্তরে অবিরাম ঘা মারছে পুরুষ, আর এইভাবে যার আত্মবিশ্বাস, মর্যাদাবোধ দলিত-মথিত করে যাকে এক পিণ্ডাকৃতি মানুষে পরিণত করেছে তাকে আরও ঘা মেরে জাগাব? এ কি ওঝার ঝাঁটা মেরে আর নাকে মরিচের ধোঁয়া দিয়ে মৃতপ্রায় রোগীর রোগ চিকিৎসার মত হবে না? হয়ত তাতে ২/৪টা রোগী প্রাণের দায়ে সেরে ওঠে। বাকীদের ভূত পালায় ঠিকই তবে সেটা রোগীদের প্রাণ সাথে নিয়েই।

 

অবশ্য আমাদের কবি রবি বলেছেন, ‘ওরে নবীন, ওরে আমার কাঁচা / আধমরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা।’ তা অনেক সময় আধমরাদের ঘা মারতে হয় বৈ কি! কিন্তু সেই ঘা মারার পদ্ধতি কি হবে সেটাও নির্ভর করবে স্থান-কাল-পাত্র ইত্যাদি অনেক বিষয় বিচারের উপর। ঘা পেয়েই যে আধমরা হয়ে আছে আরও ঘা মারলে সে বাঁচে কি না সে বিষয়ে আমার সংশয় আছে।

 

নারীরও সমালোচনার দিক থাকবে বৈ কি! সেটা আপনি যা বলেছেন তার জন্য। কিন্তু সেটা অন্তত আমার এই লেখায় তেমনভাবে আসা উচিত নয় বলে মনে হয়। কারণ এখানে তার মনুষ্যত্ব ও তার স্বাধীন সত্তার বিকাশের পথে যেটা প্রধান বাধা হয়ে আছে আমি সেটাকেই চিহ্নিত করতে এবং আঘাত করতে চেয়েছি। যে পুরুষতন্ত্র নারীর এই বিকৃতদশার জন্য দায়ী আগে সেটাকেই আঘাত করুন। সমাজ-রাষ্ট্র-পৃথিবীতে নারীর স্বাধীনভাবে দাঁড়াবার একটু জায়গা করে দিন। তারপর তার যথা ইচ্ছা নিন্দা-সমালোচনা করুন, তাকে আঘাত দিয়ে বলুন। এখন তার প্রতি পুরুষের মনে শ্রদ্ধা, মমতা, তার অধিকার সম্পর্কে বোধ এবং সেই সঙ্গে নারীর নিজেরও ভিতর নিজ অধিকার সম্পর্কে বোধ জাগাবার প্রয়োজনটাই সবচেয়ে বেশী। এ কাজ কি নারীকে আরও আঘাত আর ঘৃণা দিয়ে বললে হবে? তার তো দরকার এখন ভালবাসার আশ্রয়। যে পুরুষ তাকে এমন করেছে সেই পুরুষই যদি তাকে দাঁড়াবার জায়গাটুকু ছেড়ে না দেয় তবে কি সে কোনদিন দাঁড়াতে পারবে শুধু নিজের একার চেষ্টায়?

 

আসলে বাস্তবটাকে আমাদের মেনে নিতে হবে। পুরুষবাদী সমাজ নারীকে ক্ষমতাহীন করেছে। অর্থাৎ নারী-পুরুষ সমন্বিত সমাজের ক্ষমতার লাগামটা একা পুরুষেরই হাতে। পুরুষ যদি নারীর ক্ষমতার লাগামটা নারীর হাতে ছেড়ে না দেয় তবে ক্ষমতাহীন নারীর একার সাধ্য কি তা জোর করে কেড়ে নেয়? আমার মনে হয় ক্ষমতার ব্যাপারটা বুঝলে আমরা এই বক্তব্যের তাৎপর্য বুঝব। যুগে যুগে পৃথিবীতে যে পরিবর্তনগুলো হয়েছে সেগুলো কি কোনটাই প্রকৃতপক্ষে একেবারে নীচ তলার মানুষের দ্বারা সূচিত? একটু খোঁজ নিলেই দেখা যাবে যে, যারা এইসব পরিবর্তনের সূচনাকারী তারা কিন্তু কোন না কোনভাবে সমাজের উপর বা মধ্য স্তর থেকে আগত। এটা ঠিক যে, সমাজের নীচ তলার মানুষদের সমর্থন ও অংশগ্রহণে পরিবর্তনের সামাজিক শক্তি গড়ে ওঠে।

 

মার্কসবাদের কথাটাই ধরুন না! মার্কসবাদীরা মার্কসবাদকে সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণীর মতবাদ বলে। কিন্তু এ কি কোন সর্বহারার সৃষ্টি? মার্কস-এঙ্গেল্‌স কি সর্বহারা?


ক্ষমতার অবশ্য বিভিন্ন রূপ বা ধরন এবং তা সৃষ্টির বিভিন্ন পদ্ধতি থাকতে পারে। এই কারণে দরিদ্র পরিবারের সন্তান যীশুও প্রফেট হতে পারেন। কিন্তু সে কালের সেই সমাজের জনমানসে দেবদাসীদের সামাজিক মর্যাদা বিবেচনায় নিলে মেরীর পুত্র যীশুর ঈশ্বর-পুত্র হিসাবে উত্থানটা অসম্ভব মনে হবে না। অর্থাৎ আলোকবাদী ধর্মের প্রতি জনমানসের আনুগত্য ছিল তাঁর প্রধান অবলম্বন। আর তাই অর্থনীতির বিচারটা এখানে আদৌ মুখ্য নয়।

 

নারীর কিন্তু সামাজিক-রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে উত্থানের জায়গাটা তৈরী নেই। কারণ তার জন্য প্রয়োজনীয় মনস্তাত্ত্বিক বা মতাদর্শিক-সাংস্কৃতিক ভিত্তিটা তৈরী হয় নি। এটা ঠিক যে, আধুনিক সভ্যতার প্রভাবে সমাজের মনোজগতে পরিবর্তন অনেকটা ঘটেছে বলে আমাদের মত দেশেও পারিবারিক সূত্রে হলেও নারীরা এখন ক্ষমতা যন্ত্রের শীর্ষে যেতে পারছে। কিন্তু আমি আমার বইটাতে বলেছি যে, সেটা যথেষ্ট নয়। কারণ এই ব্যক্তিগতভাবে যাওয়াটা পুরুষতন্ত্রেরই প্রতিনিধিত্ব হিসাবে দেখা দেয়। এই কারণে আমি বলেছি নারীর হাতে সমাজ-রাষ্ট্রের ক্ষমতার অর্ধেকটা ছেড়ে দিতে। অর্থাৎ নারীর নিজস্ব ক্ষমতাযন্ত্র বা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি যা এক রাষ্ট্রের ভিতরেই নারীর ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা ও রক্ষা করবে।

 

যাইহোক, তবু আপনার কথাটাও আমি এইটুকু মানি যে, তাদের গৃহপালিত রমণী হওয়ার দিকটাকে আঘাত করার প্রয়োজন আছে। তবে সেটা আমার লেখাটাতে এখন কতটা কিভাবে আনা যাবে সে বিষয়ে আমি ভাবছি।

 

অবশ্য নারীদের প্রশংসা বা নিন্দা কোনটাই আমি খুব বেশী করতে চাই না। তাদের নিয়ে যে খুব বেশী বলতে চাই তাও নয়। কারণ আমার ধারণা তাতে পুরুষ হিসাবে আমার সিদ্ধান্তই তাদের উপর চাপানো হবে। তবে তাদের জায়গাটা আমি ছেড়ে দিতে চাই। তাদেরকে জায়গা ছেড়ে দিলে যে, তারা ধীরে ধীরে নিজেদের যোগ্য করে তুলতে পারবে এই ধারণা আমি পোষণ করি। আর তখন তাদের সীমানাটা কতটা বিস্তৃত হওয়া দরকার সেটাও তারা ক্রমে ঠিক করতে এবং বলতে পারবে। এই কারণে আমি নারীবাদ শব্দটাকে গ্রহণ করে নিয়েছি, যা নারীর স্বাতন্ত্র্য, স্বাধীনতা এবং নিজস্ব অগ্রগমনের দ্যোতক।

 

তবে আমার উপলব্ধির কথা বলি যে, নারীর পৃথিবীব্যাপী উত্থানের কাল সমাগত। হয়ত আমি নারীর প্রতি সহানুভূতি এবং মানবিক অনুভূতি দিয়ে তার সমস্যাকে বিচার করতে ও বুঝতে চেয়েছি। কিন্তু নারীর নিজস্ব ক্ষমতা যন্ত্র প্রতিষ্ঠা পুরুষের জন্যও অত্যাবশ্যক হয়ে উঠছে বলে আমি মনে করি। আর এটা বুঝতে হলে নারী-পুরুষের মৌল চরিত্র, বৈশিষ্ট্য এবং সেই সঙ্গে সভ্যতার সঙ্কটের গভীরে আমাদেরকে প্রবেশ করতে হবে।

 

নারী প্রধানত সৃষ্টির শক্তি। পুরুষ প্রধানত ধ্বংসের শক্তি। বিপরীত গুণ উভয়ের মধ্যে আছে। কিন্তু আমি প্রধান গুণ বা বৈশিষ্ট্যের কথা বলছি। নারীর প্রবণতা প্রধানত ইতিবাচক আর পুরুষের প্রবণতা নেতিবাচক। নারী প্রধানত আত্মরক্ষামূলক আর পুরুষ প্রধানত আক্রমণাত্মক।

 

হাঁ, সমাজ, সংস্কৃতি, সভ্যতার জন্য হাজার হাজার বৎসর ধরে বিশেষ করে পুরুষের ধ্বংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক প্রবণতাকে নিয়ন্ত্রণ করা এক প্রধান সমস্যা হয়ে থেকেছে। পুরুষের ধ্বংসাত্মক ও আক্রমণাত্মক প্রবণতার প্রাবল্য বোঝার জন্য পুরুষ-শিশুর দিকে দৃষ্টি দেওয়াই যথেষ্ট। একটা নারী-শিশু ও একটা পুরুষ-শিশুর আচরণগুলো লক্ষ্য করলে এবং তুলনামূলকভাবে বিচার করলে এটা সহজেই বোঝা যায়। সমাজ-সংস্কৃতি-সভ্যতা পুরুষের ধ্বংস শক্তিকে সংযত করার এবং নিয়ন্ত্রিত ভাবে ব্যবহার করার পদ্ধতিও গড়েছে।

 

কিন্তু সভ্যতা আজ এমন এক পর্যায়ে পৌছেছে যখন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রচণ্ড বিকাশ মানুষের হাতে ভয়ঙ্কর ধ্বংসের শক্তি এনে দিয়েছে। পরমাণু বোমার এই যুগে ধ্বংসের শক্তি হিসাবে পুরুষের হাতে ক্ষমতার নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ রাখা মানব জাতির অস্তিত্বকেই বিপন্ন করছে।

 

আপনি মানব জাতির সঙ্কটের কারণ হিসাবে আদর্শের যে সঙ্কটের কথা বলেছেন আমার বিবেচনায় সেটা মূলত পুরুষবাদী আদর্শের সঙ্কট। পুরুষের আর কোন মতবাদ বা আদর্শ এককভাবে মানব জাতিকে চূড়ান্ত ধ্বংস বা বিলয় থেকে বেশী কাল রক্ষা করতে পারবে বলে আমি মনে করি না।

 

মানব জাতিকে ধ্বংস থেকে এখন বাঁচাতে পারে সমাজ-সভ্যতা-ক্ষমতায় নারীর সমান অংশগ্রহণ। হয়ত নেতৃত্ব অনেকাংশে নারীর হাতেই যাবে। কারণ নিজের সৃষ্টি যে বিপুল ধ্বংসের শক্তির সামনে মানুষ এসে দাঁড়িয়েছে তাকে পুরুষ নিজেই ধ্বংসের শক্তি হয়ে কিভাবে সংযত করবে? এই ধ্বংসের শক্তি তো মূলত তারই সৃষ্টি। এটাকে সে কিভাবে একা নিজ শক্তি বলে সংযত এবং সৃষ্টির শক্তিতে পরিণত করবে? যতকাল মানবজাতি এমন বিপুল ধ্বংসের ক্ষমতার অধিকারী হয় নি ততকাল পুরুষদের মধ্য থেকেই একদল মানব দরদী, প্রেমিক ও আত্মত্যাগী নারীর ভূমিকাটা নিয়ে সমাজকে সংযত রাখার কাজটা চালিয়েছিল। তবু তো সন্ত্রাস, যুদ্ধ, ধ্বংস কম হয় নি। আর এগুলোতে প্রায় সম্পূর্ণ ভূমিকা পুরুষেরই। কিন্তু আগামী পঞ্চাশ¬একশত বৎসরে মানুষ যে জায়গায় পৌঁছবে সেখানে কোটি কোটি মানুষকে নিমেষে নিশ্চিহ্ন করার জন্য কয়েকজনের সিদ্ধান্তই যথেষ্ট হবে। আজকের রিমোট কন্ট্রোল বোমার চেয়ে সেই ধ্বংসের প্রযুক্তি আয়ত্ত করা যে তখন খুব জটিল বা কঠিন হবে তা নয়। এই অবস্থায় পুরুষকে সংযত করবে শুধু পুরুষ? হয়ত আত্মরক্ষার জন্যই পুরুষ সমাজ-রাষ্ট্রের নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণের এক বড় এমন কি প্রধান অংশই নারীর হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হবে।

 

অর্থাৎ পৃথিবীর জন্য এক নূতন মতাদর্শের যুগ আসছে। এই যুগের আদর্শে নারীর যে ভূমিকা ও গৌরব তা কি পুুরুষ হিসাবে আমাদের পক্ষে নেওয়া সম্ভব?

 

এত কথা আমার বইয়ে বলি নি। কারণ একবারে সব বলাটা ঠিক নয়। যেটুকু বলেছি সেটুকু গ্রহণ বা ধারণ করার মত মানুষ আগে তৈরী হোক। আর সবচেয়ে বড় কথা নারীর পূর্ণাঙ্গ মতবাদ বা আদর্শ নারীই দিবে। পুরুষের কাজ সেই প্রয়োজন বোধটা সৃষ্টি করা।

 

আমার উপরোক্ত উপলব্ধি আজকের নয়। নারীর ক্ষমতাযন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথাটা আমি আলোচনা করছি অন্তত ১৯৮২ থেকে। আপনাকে যে কথাগুলো বললাম সেগুলো ১৯৮৫-তে একটা প্রবন্ধে লিখেছিলাম যার কোন কপিই আর আমার কাছে নেই। অবশ্য সেটা কোথায়ও প্রকাশ করার চেষ্টা করি নি যদিও তা কয়েকজন পড়েছিলেন এবং কারো কারো কাছ থেকে (সবাই পুরুষ) উচ্ছ্বসিত প্রশংসা পেয়েছিল সেটা। খালেদা জিয়াকেও একটা কপি দিয়েছিলাম পড়ার জন্য। জানি না তিনি পড়েছিলেন কিনা। সেই সময় কয়েকবার দেখা এবং রাজনৈতিক আলোচনা হলেও ওটা নিয়ে কথা বলি নি। তবে মনে হয় না যে, তিনি পড়েছিলেন। লেখাপড়া করার অভ্যাস তাঁর ছিল বা আছে এমনটা কখনও শুনি নি।

 

ষাটের দশকে বিপ্লবী যুবশক্তির উত্থানের উপর আমার আলোচনা ও বিশ্লেষণের সূত্রে আপনি বলেছেন, ‘আমার ধারণা ’৬০-এর দশকের যুব উত্থান কিংবা বাষট্টির আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাম যুব শক্তির উত্থান পঞ্চাশ দশকে সোহরাওয়ার্দীর বিশ্বাসঘাতকতার জবাব। এর প্রধান অংশটি কমিউনিস্টদের দ্বারা লালিত। তারাই এ যুব শক্তির মাতা। কিন্তু এ সন্তানটি এমনই বৃহৎ কলেবর নিয়ে নিজের অস্তিত্ব ঘোষণা করল যে, মায়ের সীমাবদ্ধ আঁচল তাকে ছায়া দিতে অক্ষম। অনেকটা মাকড়সা বা কাঁকড়ার সন্তান লাভের মত ─ মায়ের আত্মবিনাশের মধ্য দিয়েই যারা পৃথিবীর আলোক দর্শন করে। কাজী জাফর বা আপনার মত সন্তানেরা তা বোঝেন নি বলেই মায়ের প্রাণহীন দেহ বল্লরির মাঝে আপনারা বারবার আশ্রয় খুঁজেছেন। আর বাংলার চিরায়ত মায়ের মতই মায়ের প্রেতাত্মারা আপনাদের পিছন থেকে টেনে ধরেছে, যুদ্ধ সাজে সাজিয়ে দিতে পারে নি। তথাপি, তাদের সে ভূমিকাকে স্বীকার না করলে যথাযথ বলা হয় না।’

 

আপনার এই বক্তব্যের সঙ্গে আমি কিছুটা একমত হলেও পুরোটা নই। আমাদের সেই যুগের সমস্যাটা ছিল ভয়ানক জটিল যাকে এত সহজে ব্যাখ্যা করা দুঃসাধ্য। আমার বইয়ে সেই সমস্যা কিছু বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করতে চেষ্টা করেছি। তবু আপনার কথা সমর্থন করে বলছি, ষাটের দশকে যুব শক্তির উত্থানের পিছনে কমিউনিস্ট পার্টির একটা লালনকারী ভূমিকা ছিল এটা যেমন সত্য তেমন সত্য হল কমিউনিস্ট পার্টিই ছিল তার এগিয়ে যাবার পথে প্রধান বাধা। বস্তুত কমিউনিস্ট নেতৃত্বের কারণে যুবশক্তি সে যুগে তার যথাযথ ভূমিকা পালন করতে পারে নি। তাদের ভূমিকাকে মেনে নিয়েও এ কথা বলতে হয়।

 

কিন্তু এটাও বুঝতে হবে যে, আমরা যারা স্বাধীনভাবে চিন্তা করতাম তাদের বিকাশে বা উত্থানে কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল না। বরং আমাদের বিকাশ বা উত্থান তাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই। অন্তত আমার নিজের বিকাশ তো হয়েছিল কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে। আমার লেখায়ও তো সেটা বেরিয়ে এসেছে। ছাত্র জীবনে যে সম্পর্কটুকু হয়েছিল তা খুব স্বল্প সময়ের জন্য। আমি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হই ১৯৬৯ সালে। অর্থাৎ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির।

 

তার পূর্ব পর্যন্ত সম্পর্কটা কিন্তু মূলত দ্বন্দ্বের। হাঁ, এ সময় অর্থাৎ ’৬৯-এ আমরা পুরাতন কমিউনিস্ট নেতৃত্বের একাংশের আশ্রয় নিয়েছিলাম। আজ সময়ের দূরত্বে দাঁড়িয়ে এবং দেশের এবং পৃথিবীরও কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই দুস্থ অবস্থায় দাঁড়িয়ে সেদিনের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের প্রবল প্রতাপ কল্পনা করাই কঠিন। ভাসানীর মত বিশাল নেতাও তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তেমন কিছু করতে পারেন নি। তাঁকেও আচরণ করতে হয়েছে অনেকটা অস্থির ছাত্রদের মত। আর ’৬৯ থেকে কমিউনিস্টরা যখন যে যার মত তাঁকে ত্যাগ করতে শুরু করে তখন তিনি ইসলামী রাজনীতির দিকে মোড় নিতে থাকেন এবং ১৯৭০-এর শেষ দিকে স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতি দিয়ে একটা নিজস্ব রাজনৈতিক ভিত্তি দাঁড় করাতে চেষ্টা করেন।

 

আপনি আমার লেখা থেকে জেনেছেন যে, ১৯৬৮-এর সম্ভবত জুন মাসে আমার উদ্যোগে ছাত্র-তরুণদের প্রতিনিধিত্বকারী ব্যক্তিদের নিয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গোপন সংগঠন ‘পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন’ গঠিত হয়, যার সাংগঠনিক কমিটিতে আবুল কাসেম ফজলুল হক, আমজাদ হোসেন, মাহবুব উল্লাহ, নূরুল হাসান এবং আমি ছিলাম। অবশ্য নূরুল হাসান সিরাজ শিকদারের এজেন্ট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে কয়েক দিন পরেই তাকে বাদ দিই। তবু আমরা চারজনই ছিলাম সেকালের বিপ্লবী ছাত্র-তরুণ প্রজন্মের ব্যাপকতম অংশের প্রতিনিধিত্বকারী।

 

কিন্তু ১৯৬৮-এর শেষ দিকে হক-তোয়াহা নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে দেবেন-মতিন-আলাউদ্দিন স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি নিয়ে ‘পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি’ গঠন করলে আমরা তাতে যোগ দিই ’৬৯-এর গোড়ার দিকে। আমার বইতেও বলেছি যে, এই যোগদানের প্রস্তাব এবং উদ্যোগ আমার ছিল। কিন্তু সব কথা বলি নি। এই প্রস্তাব পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন কিংবা ছাত্র-তরুণদের সবাই অত সহজে গ্রহণ করেছিল তা কিন্তু নয়। আমারও কি আস্থা ছিল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি যাঁরা গঠন করেছিলেন তাঁদের উপর? মতিন-আলাউদ্দিনকে তো বহু পূর্ব থেকেই জানতাম। আলাউদ্দিন ভাই এর সঙ্গে পরিচয় সম্ভবত ’৬০ কিংবা ’৬১ সালে।* তখন আমি ঢাকা কলেজে ইন্টারমিডিয়েটের ছাত্র। প্রথম আলাপটাই ছিল মতপার্থক্যপূর্ণ।

 

যাইহোক, তবু আমি মনে করেছিলাম এছাড়া উপায় নেই। আর যে আমজাদ হোসেনকে তাঁরা তাঁদের পার্টিতে যোগ দেবার পর পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে নিলেন অথচ আমাকে বাদ দিলেন সেই আমজাদ প্রকৃতপক্ষে আলাউদ্দিন-মতিনকে দারুণভাবে অশ্রদ্ধা করত। আমি তাঁদের সীমাবদ্ধতা বুঝতাম। কিন্তু সেটা ঠিক অশ্রদ্ধার পর্যায়ে পড়ত না। আমিই কিন্তু অনেক যুুক্তি দিয়ে আমজাদের মত যারা তাদেরকে দেখতে পারত না তাদের সবাইকে বুঝিয়ে রাজী করাই পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে।

______________________________________________________________________

* এই সময়টা ’৬২ কিংবা ’৬৩-ও হতে পারে। সেক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশের পর তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হতে পারে। ─ লেখক, ২১ নভেম্বর ২০০৬

______________________________________________________________________

 

একি মনে করেন সখ করে? আমি কি বুঝতাম না যে, দেবেন-মতিন-আলাউদ্দিনের কর্ম নয় বিপ্লবে নেতৃত্ব দেওয়া? হাঁ, বুঝতাম। কিন্তু ঐ সময়ে যদি আমরা তাঁদের সঙ্গে যোগ না দিতাম তাহলে কি হত? প্রথমত, সিরাজ শিকদারের উত্থান প্রতিহত করা যেত না, যেটা আমাদের প্রজন্মের জন্য ভয়ানক ক্ষতিকর হত। দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের মাধ্যমে ন্যাপ এবং গণ-সংগঠনগুলোর যে বিশাল এপারেটাসকে আমরা স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি বিস্তারের কাজে ব্যবহার করতে পেরেছিলাম সেটা আর হত না।

 

সেদিনও যেমন আমার ধারণা ছিল আজও তেমন ধারণা যে, পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠন না করলে যেমন সিরাজ শিকদারের বিদ্যুৎগতি উত্থান রোধ করা যেত না তেমন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ না দিলেও তার উত্থান রোধ করা সম্ভব হত না। আর সেটা যে শুধু আমাদের প্রজন্মের জন্য ধ্বংসাত্মক হত না তাই না উপরন্তু ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধও আর ঘটত না। কারণ তার মূল চালিকা শক্তি ছাত্র-যুব সম্প্রদায় সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে আগেই একটা অকাল ও গণ-বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ধ্বংস হয়ে যেত। আসলে ঐ কালটাতে আমি সিরাজ শিকদারকেই বিপ্লবী যুব শক্তির জন্য প্রধান বিপদ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলাম। আর তাকে প্রতিহত করার শক্তিটা মূলত আমারই ছিল বলে আমি সেটা করতে পেরেছিলাম। কিন্তু আমি সিরাজ শিকদারের উত্থান প্রতিহত করেছি কি আমার একার শক্তি বলে? না, আমি যেটা করেছিলাম সেটা হল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতাকামী ছাত্র-তরুণ প্রজন্মের আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটিয়ে শুধু সেটার মুখ ঘুরিয়ে দেওয়া গণ-বিচ্ছিন্ন সশস্ত্র সংগ্রাম থেকে গণ-আন্দোলন ও গণ-ভিত্তিক সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে।

 

আপনি ষাটের দশকে যুব শক্তির উত্থানকে পঞ্চাশের দশকে সোহ্‌রাওয়ার্দীর বিশ্বাসঘাতকতার জবাব বলেছেন। সোহ্‌রাওয়ার্দী-মুজিবের বিশ্বাসঘাতকতার জবাব শুধু ষাটের দশকে যুব শক্তির উত্থান নয়, বরং ১৯৫৭ সালে ন্যাপ বা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠনটাই তো তার জবাব। কিন্তু ষাটের দশকে কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণের কারণে, ন্যাপ যে দু’টি মৌলিক প্রশ্নে গঠিত হয়েছিল তার একটি স্বায়ত্তশাসনকেই গৌণ করে ফেলল। থাকল শুধু স্বাধীন ও জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি। শুধু সাম্রাজ্যবাদ বিরোধিতা থাকল, কিন্তু পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্রে রেখে ন্যাপ আর কোন কর্মসূচী দিল না। অথচ ১৯৬৬-তে আওয়ামী লীগ ৬ দফা দিল। ইতিহাসের কী পরিহাস!

 

এখন আমাদের প্রজন্মের উত্থান তো সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী ফাঁকা স্লোগান দিয়ে হয় নি, বরং আইয়ুব সরকার-বিরোধী বাস্তব আন্দোলন দিয়ে হয়েছিল। এই অবস্থায় এই প্রজন্মের চেতনায় ’৬২ থেকে শুরু হওয়া ঐ আন্দোলনের মর্মবস্তু গণতন্ত্র এবং পাকিস্তান বিরোধী বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ক্রম বিকশিত হতে বাধ্য ছিল। কিন্তু সে কালে পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতা আবদুল হক-মোহাম্মদ তোয়াহাদের যে প্রবল নিয়ন্ত্রণ ন্যাপ এবং বাম গণ-রাজনীতির উপর ছিল তাতে আর পূর্ব বাংলার জাতীয় কর্মসূচী দেওয়া সম্ভব হয় নি। আর যে আবদুল মতিন, আলাউদ্দিন আহমদরা পরে হক-তোয়াহাদের থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি নিয়ে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলেন তাঁরা কি পূর্ব বাংলার জাতীয় প্রশ্নে কোন প্রকাশ্য কর্মসূচী দেবার কথা কোনদিন বলতেন? আমার বইতেও তো এই প্রশ্নে ’৬৭ সালে আমার বিতর্ক সম্পর্কে বলেছি।* এ বিষয় আমার কাছে সুস্পষ্ট যে, আলাউদ্দিন-মতিনের পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠন ছিল নির্জলা সুবিধাবাদ এবং নেতৃত্ব লোভ থেকে। বাঙ্গালীর জাতি রাষ্ট্র গঠনে তাঁদের বিশ্বাস ছিল না। তাঁদের প্রয়োজন ছিল ঐ প্রজন্মের শক্তিটাকে নিজেদের হাতে নিয়ে গাঁয়ের মোড়লি মার্কা রাজনীতির হাতিয়ার করা।

______________________________________________________________________

* ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’-এর চতুর্থ অধ্যায়ে এই বিতর্ক সম্পর্কে বিশদ আলোচনা করা হয়েছে।-লেখক

______________________________________________________________________

 

তবু কি আমরা তাদের এড়িয়ে গিয়ে গণ-রাজনীতি বা জাতীয় রাজনীতিতে এগোতে পারতাম? না, এই বন্ধ্যা কমিউনিস্ট নেতৃত্বই সমগ্র বাম গণ-রাজনীতিকে অধিকার করে ছিল। আমরা তরুণ প্রজন্ম একা এদের ডিঙ্গিয়ে এবং এদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হিমালয়সম মওলানা ভাসানীকে ডিঙ্গিয়ে পূর্ব বাংলার প্রশ্নে জাতীয় আন্দোলনের স্বতন্ত্র প্রকাশ্য ধারা গড়ে তুলতে পারতাম?

 

জাতীয় রাজনীতিতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার সমস্যাগুলোকে বুঝতে হয়। আমি তো আমার বইয়ে এ সম্পর্কে আলোচনা করেছি। অনেক কিছু লাগে। সংবাদপত্র বা প্রচার মাধ্যম লাগে, অর্থ লাগে, মধ্যবিত্তের বৃহৎ অংশের সমর্থন লাগে। এগুলো কি আমাদের সেইভাবে ছিল? সংবাদপত্র ছিল না। অর্থ ছিল না। মধ্যবিত্ত তো বেশীর ভাগটাই আওয়ামী লীগের পক্ষে। একটা সংখ্যালঘু অংশ ন্যাপের পক্ষে। ন্যাপের প্রধান ভিত্তি অবশ্য ছাত্র-যুব সম্প্রদায়। এ ছাড়া ছিল শ্রমিক এবং কৃষক। কিন্তু এই বাম ধারার নেতৃত্ব ন্যাপ এবং তার পিছনের কমিউনিস্ট পার্টির হাতে।

 

অবশ্য কাজী জাফর ছিলেন ’৬২-এর ছাত্র আন্দোলনের সবচেয়ে জনপ্রিয় ছাত্র নেতা। কিন্ত তিনি তো ১৯৬৫-এর শেষ দিকেই পিকিংপন্থী কমিউনিস্ট নেতৃত্বের পথ গ্রহণ করে আইয়ুব বিরোধী জাতীয় রাজনীতি বাদ দিলেন। তারপর তিনি শ্রমিক নেতা হয়ে শ্রেণী রাজনীতি শুরু করলেন। হায়রে সর্বহারা শ্রেণীর রাজনীতি আর শ্রমিক শ্রেণীর চরিত্র অর্জন! এক জবরদস্ত্‌ সামরিক একনায়ক আইয়ুবের বিরুদ্ধে বিশাল ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যার উত্থান সেই জাঁদরেল ছাত্র নেতা কাজী জাফর অনেক পথ পাড়ি দিয়ে শেষে ’৮০-এর দশকে এক তৃতীয় শ্রেণীর সামরিক একনায়ক এরশাদের প্রধান মন্ত্রী হয়ে সর্বহারার শ্রেণী রাজনীতির মহা পরিণতিতে (!) পৌঁছলেন।

 

যাইহোক, ’৬০-এর দশকের শেষার্ধে কাজী জাফর শ্রমিক শ্রেণীকে ভিত্তি করে জাতীয় রাজনীতিতে ফ্যাক্টর হতে চাইলেন। আমাদের দেশে শ্রমিক-কৃষকের দুর্বলতা কোথায় তা তো আমার বইতে বলেছি। যারাই এই দুই শ্রেণীকে অগ্রাধিকার দিয়েছে এবং মধ্যবিত্ত ও ছাত্রদেরকে গৌণ কিংবা অগ্রাহ্য করেছে তাদের যে পরিণতি হবার সেটাই কিন্তু হয়েছিল কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ক্ষেত্রে। তবু কাজী জাফর ছিলেন ব্যবহারিক। আর এই ব্যবহারিক বুদ্ধি বশেই তিনি বুঝেছিলেন যে, হিমালয়ের ঐ সব অভ্রংভেদী শিখর তিনি নড়াতে পারবেন না।

 

তা, ধরে নেওয়া যাক কাজী জাফরকে রাজী করিয়ে আমরা যুব শক্তি একাই প্রকাশ্য রাজনীতিতে নেমে পড়লাম। তখন আমাদের শত্রু হত ন্যাপ এবং বামপন্থীরা। আওয়ামী লীগও বিরোধিতা করত আমাদের সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য। আর সরকার? বেশী বিপদের সম্ভাবনা দেখলে কাজী জাফরের মত ২/৪ জন নেতাকে ধরে জেলে পুরে রেখে দিত। তারপর কি হত? সংবাদপত্র প্রায় কোন সংবাদই কখনও দিত না। একমাত্র সাপ্তাহিক জনতা বামপন্থীদের খবর দিত। তাও সেটা আইয়ুব সরকার সমর্থক পিকিংপন্থীদের হাতে। কাজেই সে দরজাও বন্ধ। কাজেই জাতি জানতেই পারত না আমাদের সম্পর্কে তেমন কিছু। আর এ দিকে কাজী জাফরের বিরুদ্ধে এমনিতেই সমগ্র কমিউনিস্ট নেতৃত্ব ’৬৩ থেকে যে ভয়ঙ্কর প্রচারণা চালিয়ে আসছিল তার ফাঁদে শুধু তিনিই পড়তেন না, আমরাও সবাই পড়তাম। বলা হত যে এক উচ্চাভিলাষী অনভিজ্ঞ ছোকরার পিছনে আরও কতকগুলো উচ্চাভিলাষী এবং মাথা গরম ছোকরা গিয়ে জুটেছে। এর সঙ্গে পেটি বুর্জোয়া, সি, আই, এর এজেন্ট ইত্যাদি মধুর সম্ভাষণ তো থাকতই। এবং এ কথাগুলো বলত কারা? দীর্ঘ কালের সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে আসা প্রতিষ্ঠিত কমিউনিস্ট নেতারা। মস্কো-পিকিং সবাই। না, প্রচলিত নেতৃত্বকে ভিতর ও বাইরে থেকে নিঃশেষ না করে ওভাবে এগোনো যায় না। তাও আবার একই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী-মাওপন্থী রাজনীতি নিয়ে। তারপর সিরাজ শিকদারের উত্থান ঠেকাবার আর কোন উপায় থাকত? সিরাজ শিকদারের এই যুক্তিই সুপ্রতিষ্ঠিত হত যে, প্রকাশ্য রাজনীতি বর্জন করে শুধু গোপন রাজনীতিই পূর্ব বাংলার মুক্তির একমাত্র পথ।

 

সিরাজ শিকদার কি? সে তো শুধু ব্যক্তি নয়, একটা প্রজন্মের প্রতিক্রিয়াও। প্রকাশ্যে নিজ নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে তোলার পথ ঐ প্রজন্মের সামনে খোলা ছিল না। আমার বইয়ে বলেছি ভাসানী চাইলে ১৯৬৬-এর পরেও স্বায়ত্তশাসনকে কেন্দ্রে রেখে পূর্ব বাংলার জাতীয় কর্মসূচী দিতে পারতেন। কিন্তু মুজিবের বিশ্বাসঘাতকতার পর তিনি পরীক্ষিত কমিউনিস্টদের ছাড়া আর কাউকে বিশ্বাস করতেন এমনটা মনে হয় না। তিনি তো সংগঠকও তখন ছিলেন না। নির্ভরযোগ্য লোকজন পেলে হয়ত কর্মসূচী দিতেন। কিন্তু কমিউনিস্ট নেতারা তা দিতে দিবে না। তরুণদের ব্যাপক অংশ কর্মসূচী চাইছিল। কিন্তু ভাসানী এই অচেনা, অপরীক্ষিত ছেলে-ছোকরাদের বিশ্বাস করবেন বা পাত্তা দিবেন কেন? তা, এই ছেলে-ছোকরারা কি করবে? সিরাজ শিকদারের নেতৃত্বে যারা স্বাধীন উদ্যোগ নিতে চাইল তারা সমস্ত প্রকাশ্য রাজনীতি ও তার নেতৃত্বকে বাদ দিয়ে, এড়িয়ে গিয়ে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার লক্ষ্যে গোপন ও সশস্ত্র রাজনীতি নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইল।

 

আমার বইতেও বলেছি যে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার কর্মসূচী থাকা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা গোপনে। আর প্রকাশ্যে থাকা উচিত ছিল স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে জাতীয় কর্মসূচী, যেমন ২১ দফা ছিল ’৫৪ সালে।* কিন্তু সিরাজ শিকদার শুধু গোপনটাই করতে চাইল। আর আমি বা আমরা চেয়েছিলাম দু’টোর সমন্বয়। সমন্বয় ঘটাতে না চাইলে কিন্তু আমাদেরকেও সিরাজ শিকদারের পথেই যেতে হত। সেটা যেতে চাই নি। তো সেক্ষেত্রে কি করতে পারতাম? প্রকাশ্য জাতীয় নেতৃত্বের একাংশকে হলেও পক্ষে পেতে হত। সেই কারণে দেবেন- মতিন-আলাউদ্দিন প্রমুখ যখন সুখেন্দু দস্তিদার, আবদুল হক এবং মোহাম্মদ তোয়াহা নেতৃত্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) থেকে বেরিয়ে এসে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করলেন তখন আমি মনে করেছিলাম এইটুকুই এখন আমাদের দরকার। সুতরাং পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন বিলুপ্ত করে তাঁদের দলে যোগ দেবার পক্ষে মত দিলাম।** আমার বইতে বহু কথাই বলি নি। সব কথা একটা বইতেই বলতে চাওয়াও ঠিক নয়, আর সম্ভবও নয়। আমি মূল এবং একান্ত প্রয়োজনীয় বিষয়গুলো আনতে চেয়েছি। কারণ আমি চেয়েছি ঘটনাধারার উপর নূতন আলোকপাত হোক এবং একটা নূতন বিতর্ক শুরু হোক।

______________________________________________________________________

* একুশ দফা কর্মসূচী যুক্তফ্রন্ট কর্তৃক ১৯৫৪ সালের নির্বাচন উপলক্ষ্যে দেওয়া হলেও এটি প্রণীত এবং ঘোষিত হয় ১৯৫৩ সালের ডিসেম্বর মাসে। - লেখক

** ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ গ্রন্থের ওয়েব সংস্করণের ভূমিকায় এই যোগদান সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। - লেখক

______________________________________________________________________

 

তবে আমার মনে হয় পুরাতন নেতৃত্বের কাছে আমাদের যাবার বাধ্যবাধকতা কোথায় ছিল সেটা আমার বইতে অস্পষ্ট থাকে নি। তবু আপনি এই ব্যাপারে আমাদের প্রজন্মকে অভিযুক্ত করেছেন বলে কথাগুলো বললাম।

 

এবং আমি মনে করি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান আমাদের প্রজন্মের বিপ্লবী শক্তির এবং আমার নিজের জন্য যত ক্ষতিকরই হোক সেটা ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধকে আরেকভাবে অনিবার্য করেছিল। হাঁ আমার দিক থেকে আমার উদ্দেশ্যে আমি সফল ছিলাম। মার্কসবাদ, বিপ্লব ইত্যাদি বহু বিষয়েই আমার জিজ্ঞাসার অন্ত ছিল না। আমাদের দেশের বিপ্লবের সমস্যা এবং পদ্ধতি সম্পর্কে আমার কাছে তেমন কোন স্থির প্রত্যয় ছিল না। ফলে কাজ করা, আন্দোলন করা আর বোঝার চেষ্টা করা ছিল আমার কাছে আমার জন্য মূল করণীয়। কিন্তু একটা ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র দ্বিধা, সংশয় কিছুই ছিল না, সেটা হল পাকিস্তান-রাষ্ট্রের সঙ্গে বাঙ্গালী জাতির একটা জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ঘটানো, যেটা হবে জনযুদ্ধ এবং এই যুদ্ধের মাধ্যমে পাকিস্তানকে ধ্বংস করা। হাঁ, এই দিক থেকে আমি সফল।

 

কিন্তু বন্ধ্যা, সুবিধাবাদী, নীতিহীন কিংবা বুদ্ধিহীন যা-ই বলুন পুরাতন নেতৃত্বকে যদি স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতিতে আমাদের সঙ্গে না পেতাম তবে কি আমরা এই অসাধ্য সাধন করতে পারতাম? স্বাধীন পূর্ব বাংলাকে লক্ষ্য হিসাবে গ্রহণ করার সাথে সাথে কিন্তু দেবেন-মতিন-আলাউদ্দিন নেতৃত্ব আমাদের প্রজন্মের জাতীয়তাবাদী রাজনীতির অচেতন হাতিয়ারে পরিণত হলেন। এটা ঠিক, প্রকাশ্য রাজনীতিতে তাঁরা জাতীয় কর্মসূচী* দেবার কাজটাকে অগ্রাহ্য করেছেন। সেটা তো তাঁরা চিরকালই করেছেন। জাতীয় রাজনীতি তো তাঁরা করবেন পেশাগত বা অর্থনৈতিক শ্রেণী রাজনীতি করার জন্য। সুতরাং বাঙ্গালীর স্বায়ত্তশাসনের জাতীয় কর্মসূচী তাঁরা দিবেন না। কিন্তু তরুণ প্রজন্মের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার ক্রমবর্ধমান জোয়ার দেখে যখন তাঁরা নিজেদের নেতৃত্ব কায়েমের ঘুঁটি হিসাবে তাদেরকে ব্যবহার করতে চেয়ে স্বাধীন পূর্ব বাংলার রাজনীতি নিলেন সেই মুহূর্তে কিন্তু তাঁদের পাও ফসকালো। ’৭১ ঘটিয়ে দিয়ে তাঁদেরকে শেষ হতে হল।

______________________________________________________________________

* কথাটা একান্তভাবে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন কেন্দ্রিক কর্মসূচী অর্থে বলা হচ্ছে, যেটা ন্যাপের ১৪ দফা এবং এমন কি আওয়ামী লীগের ৬ দফাও ছিল না। - লেখক

______________________________________________________________________

 

এই বাম গণ-নেতৃত্বকে আমাদের সঙ্গে না পেলে কি আমরা জাতীয় রাজনীতিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের রাজনীতিতে নিতে পারতাম? রাষ্ট্রযন্ত্র আমাদের চিহ্নিত করে আটকে দিত না? আসলে প্রকাশ্য বামপন্থী রাজনীতির ঐ ডামাডোল, বিশৃঙ্খলা, বিভিন্নমুখী প্রবণতা, উল্টাপাল্টা বক্তব্য ও কাজ এইসব আমাদের জন্য ক্যামুফ্লাজ হিসাবেও কাজ করেছিল।

 

আমার বইতে আর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কিন্তু আমি বলেছি যেটা না বুঝলে ঐ দশকের সমস্যাটা ঠিক বোঝা যায় না। আমি এ কথা বলেছি যে, ষাটের দশকের দ্বন্দ্বটা শুধু রাজনীতির নয়, দু’টো প্রজন্মেরও দ্বন্দ্ব। নূতন এবং পুরাতন প্রজন্মের দ্বন্দ্ব। ন্যাপ-আওয়ামী লীগ উভয় ধারার নেতৃত্ব কিন্তু মূলত পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে সংযুক্ত ছিল কোন না কোনভাবে। হয় সমর্থক, নয় নেতা-কর্মী। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিও তো পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থন করেছিল। পাকিস্তানী শাসকদের সঙ্গে এই পুরাতন ও প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালী মুসলমান নেতৃত্বের একটা দ্বন্দ্ব উপস্থিত হয়েছিল এ কথা ঠিক। কিন্তু এটা ছিল মূলত মুসলমানে মুসলমানে দ্বন্দ্ব। পাকিস্তান ওরা কি ভাঙ্গতে চেয়েছিল মনে-প্রাণে? এ বিশ্বাস আমি করি না। কারণ অভিজ্ঞতা সে কথা বলে না। অবশ্য ভাসানীর ব্যাপারটা অত সহজে ব্যাখ্যা করা যায় না, যদিও তিনি পাকিস্তান আন্দোলনের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ছিলেন।

 

যাইহোক, পুরাতন প্রজন্ম পাকিস্তান ভাঙ্গতে চায় নি এটাই মনে করার সঙ্গত কারণ আছে। আর ভাঙ্গলেও সেটা আপোসে বিচ্ছিন্ন করে মুসলমানের আর একটা রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিল। মুজিবের ৬ দফা ফেডারেশন, ‘কনফেডারেশন’ এই সব অতিক্রম করে যদি বা কোনদিন স্বাধীনতায় পৌঁছত তবে আর একটা পাকিস্তান হত মাত্র। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান। তা নাম বাংলাদেশ দেওয়াই যাক আর যাই দেওয়া যাক আর একটা পাকিস্তানই হত। মূল লাহোর প্রস্তাবে যা করতে চাওয়া হয়েছিল। হাঁ, বাস্তবে হয়ত তা-ই হয়েছে। কিন্তু মাঝখানে ’৭১-এর ঐ জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের, লাহোর প্রস্তাবের গোটা ভাবাদর্শিক কাঠামোটাকেই তছনছ করে দিয়ে গেছে।

 

অবস্থাটা চিন্তা করুন! দক্ষিণ, বাম সমগ্র নেতৃত্ব কোন না কোন রূপে পাকিস্তানের ভাবাদর্শিক অথবা রাজনৈতিক কাঠামোর পক্ষে। আর মুষ্টিমেয় বুদ্ধিজীবী এবং আমাদের প্রজন্মের বড় অংশ বাদে গোটা জাতিই তখন পাকিস্তানের সমর্থক যদিও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে ঘৃণাও তীব্র হয়ে উঠছে। সেই ঘৃণা কিন্তু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়, পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। এবং পাকিস্তানে মুসলমান বাঙ্গালীর অধিকার কিংবা প্রাধান্য প্রতিষ্ঠার তাগিদটাই প্রধান। তাও এটুকু আওয়ামী লীগের প্রবণতা। আর বাম কমিউনিস্ট নেতৃত্বের ব্যাপক অংশ তো মনে-প্রাণে চাইছে পাকিস্তান থাকুক এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ নিপাত যাক। শ্রেণীর বাইরে তাদের কোন সীমান্ত নেই। কাজেই তারা চাইছে শ্রেণী সংগ্রাম করতে। গোটা পাকিস্তান জুড়ে। পারলে গোটা পৃথিবী জুড়ে। প্রথমে মস্কোকে, পরবর্তী কালে পিকিংকে হেডকোয়ার্টার করে। বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ এবং জাতি চেতনা ছিল তাদের কাছে আপদ এবং বিপদ দুই-ই। এর বিরুদ্ধে শ্রেণীতত্ত্ব ছিল তাদের হাতিয়ার।

 

যারা পাকিস্তান এনেছিল চাইলেই তাদের কাছ থেকে নেতৃত্ব ছুটিয়ে আনা যেত না। নেতা হতে চাইলেই পারা যায়? শুধু যোগ্যতা থাকলেই হয়? হাঁ, ষাটের দশকে এমন এক প্রজন্মের হঠাৎ বিশাল উত্থান হয়েছিল যাকে ধারণ করার ক্ষমতা শুধু যে ঐ কালের পুরাতন প্রজন্মের নেতৃত্বের ছিল না তা-ই না, উপরন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় কাঠামোর এবং সর্বোপরি পাকিস্তানের ইসলামী ভাবাদর্শিক কাঠামোরও ছিল না। তো, কি হতে পারত? এই প্রজন্মের জন্য তো অনিবার্য ছিল ধ্বংস। সে এক বিরাট বিস্ফোরণে পাকিস্তানের কাঠামোকে নাড়া দিবে ঠিকই, কিন্তু নিজে ধ্বংস হয়ে যাবে। সুভাষ বসুর মত। আর এইভাবে পুরাতন প্রজন্ম যারা পাকিস্তান এনেছিল তারা পাকিস্তানের ধর্ম-সংস্কৃতি-রাজনীতিটাকেই বৃহত্তর এবং ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে রেখে হোক আর ক্ষুদ্রতর এবং বিভক্ত পাকিস্তানের কাঠামোর ভিতরে রেখে হোক অব্যাহত রাখবে। তা সেই উপায়টাই আমাদের প্রজন্ম রাখে নি। পুরাতন প্রজন্মের নেতৃত্বকে সামনে রেখেও, তার সাথে থেকেও বাঙ্গালী জাতির একটা জনযুদ্ধ বাধিয়ে দিল পাকিস্তানের ধর্মীয়-আদর্শিক-রাজনৈতিক কাঠামোর বিরুদ্ধে; এবং পাকিস্তানকে ভেঙ্গে ফেলল। অবশ্য দিল্লীর এবং অন্যান্য শক্তির সাহায্য নিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব পাকিস্তানের কাঠামোটাকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে যতটা সম্ভব মেরামত করে দাঁড় করাল। কিন্তু অত জোড়াতালি দেওয়া জিনিসকে কতকাল টেকানো যায়? নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য ব্যগ্র না হয়ে ধৈর্য, কৌশল অথচ প্রবল সাহস ও তেজ নিয়ে যদি আমরা ঐ যুগের পরিস্থিতিকে ব্যবহার না করতাম তবে কি বাঙ্গালীর একটা লোকবাদী বা সেকিউলার রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ হত? যুদ্ধ একটা হত। সময়টা অনুকুল ছিল তার। সিরাজ শিকদার সেটা করত। যেমন শ্রীলঙ্কায় বিজয়ওয়ারার নেতৃত্বে জেভিপি বা জনতা বিমুক্তি পেরামুনা করেছিল। এবং সেই সঙ্গে সত্যিই আমাদের গোটা বিপ্লবী প্রজন্মের শক্তি ধ্বংস হয়ে যেত। ফলে সমগ্র বাঙ্গালী জনগণের জাতীয় মুক্তিযুদ্ধটা আর হত না, যে কথা বলেছি এর আগেও এবং আমার বইতেও। হাঁ, সব সময় নেতৃত্ব দিতে চাইতে নেই; এমন কি নিজ ব্যক্তিগত অনেক যোগ্যতা থাকলেও। নেতৃত্ব দেবার জন্য উপযুক্ত পরিস্থিতি তৈরী করেই তাতে নেতৃত্ব দিতে হয়। আশা করি এই ব্যাখ্যার পর আমাদের ভূমিকাকে বেশী একটা ভুল বলবেন না। আর আমার ভূমিকার গুরুত্ব নিজের কাছে কিছুটা স্পষ্ট থাকলেও বইটা লেখার পর ক্রমে যতটা স্পষ্ট হয়েছে ততটা স্পষ্ট ইতিপূর্বে ছিল না। সেটাও বলি। যে নূতন উপলব্ধিটা বইয়ে তখন আনতে পারি নি সেটা এখন বলি আপনার জানার এবং চিন্তার জন্য। এটা আমি লেখায় সংযোজন করব। আপনি বিষয়টা একটু গুরুত্ব সহকারে ভাবুন।

 

ইতিপূর্বে বলেছি যে, ১৯৬৮-তে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠন এবং ঐ সালের শেষেই পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ (যা কার্যকর হয় ১৯৬৯-এর গোড়ার দিকে*) ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য করার ক্ষেত্রে দু’টো গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। আসলে প্রথমটি দিয়ে আমি শুধু সিরাজ শিকদারের গ্রাস থেকে যুবশক্তিকে রক্ষায় ভূমিকা রাখি। ওটা ছিল জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার শক্তিটাকে রক্ষার ভূমিকা। কিন্তু পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান শুধু ঐ শক্তিকে রক্ষা করে নি উপরন্তু জাতীয় যুদ্ধের চেতনাকে সারা দেশে বিস্তৃত করেছিল।

______________________________________________________________________

* প্রকৃতপক্ষে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হয় ১৯৬৯-এর মে মাসে। - লেখক

______________________________________________________________________

 

এ পর্যন্ত ঠিক আছে। এই ব্যাখ্যা আমার বইয়ে পেয়েছেন। কিন্তু এখন আমার উপলব্ধি হল ’৭১-এর জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য করার সবচেয়ে নির্ধারক ঘটনাটা হল ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারীতে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে জাতীয় যুদ্ধ গড়ে তোলার লক্ষ্যে পার্টির অন্যতম লাইন হিসাবে চারু মজুমদারের লাইন গ্রহণ করানো। অর্থাৎ শ্রেণীযুদ্ধ বা শ্রেণীশত্রু খতমের মাধ্যমে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরু করা এবং পূর্ব বাংলা স্বাধীন করা। আমার লেখায় তথ্যটা আছে, কিন্তু উপলব্ধিটা নেই। কারণ ঐ সময় পর্যন্ত তা আমার উপলব্ধিতে আসে নি। বহুকাল তো বহু কিছু ভুলে থাকার চেষ্টা করেছিলাম। অনেক কিছু ভুলেও ছিলাম। কারণ তখনও আমার বলার সময় হয় নি। আর এসব মনে এলে, অথচ বলতে না পারলে নিদারুণ যন্ত্রণা হয়। এখন এত কাল পরে দেশে পরিস্থিতিটা তৈরী হয়েছে। এখন মানুষের মনে শোনার এবং বোঝার তাগিদটা তৈরী হচ্ছে। সুতরাং অনেক কিছু ভাবছি নূতন করে।

 

যাইহোক, আমার উপলব্ধিতে এটা এখন স্পষ্ট যে, ইয়াহিয়া-মুজিবের মধ্যে আপোসের সব রকম সম্ভাবনা বিনষ্ট হয় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিকে চারু মজুমদারের লাইন গ্রহণ করতে বাধ্য করার ফলে। হাঁ, এটা ছিল জাতীয় যুদ্ধকে অনিবার্য করায় আমার ঐ সময় সবচেয়ে নির্ধারক কাজ।

 

আপনি কল্পনা করুন অত বিশাল একটা গণ-ভিত্তিক পার্টি তার হাজার হাজার ক্যাডারকে হঠাৎ করে ঐ রকম এক মুহূর্তে গণ-আন্দোলন বর্জন করে গোপনে চলে যেতে এবং স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জনযুদ্ধ শুরুর জন্য শ্রেণীশত্রু খতম করতে বলছে। চারদিকে তখন ‍স্লোগান উঠছে ‘শ্রমিক-কৃষক অস্ত্র ধরো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’, ‘শ্রেণীশত্রু খতম করো, পূর্ব বাংলা স্বাধীন করো’!

 

লাইন পার্টিতে যা খুশী থাক কিংবা নেতৃত্বের মনে যাই থাক এর প্রচণ্ড প্রভাবটা কল্পনা করতে পারতে হবে। ’৭১-এর জানুয়ারী, ফেব্রুয়ারী, মার্চের সেই টালমাটাল দিনগুলোতে সারা দেশ জানছে যে, ন্যাপ, কৃষক সমিতি, ছাত্র ইউনিয়ন, শ্রমিক ফেডারেশন, কমিউনিস্ট পার্টি ─ সবাই মিলে পূর্ব বাংলা স্বাধীন করার জন্য যুদ্ধ শুরু করতে যাচ্ছে।

 

আর পার্টির ভিতরের বিতর্কগুলোর অন্তত কিছু রাষ্ট্র থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ের যাদের জানার তারা সবাই জানত। ঐ লাইন তো পার্টিতে আমিই উত্থাপন করি। ১৯৭০-এর জুলাইতে পার্টির প্রথম কংগ্রেসে। অবশ্য তখন ওটা বিবেচনার জন্য উত্থাপন করি। কিন্তু আমার বক্তব্য ছিল চারু মজুমদারের লাইনের সৃজনশীল প্রয়োগের মাধ্যমে শ্রেণীদ্বন্দ্ব থেকে জাতীয় দ্বন্দ্বে উত্তরণ ঘটাবার পদ্ধতি সম্পর্কে আমাদের ভাবতে হবে। আর ঐ কংগ্রেসে আমাকে প্রথম পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করে নেওয়া হয়। এটা অবশ্য আপনি বইতে পড়েছেন।

 

এই দ্বন্দ্ব প্রসঙ্গে আর একটা বিষয় বলি, যেটা আমার লেখায় আনি নি, তবে আনব। পার্টিতে একটা দীর্ঘ বিতর্ক ছিল প্রধান দ্বন্দ্বের প্রশ্নে। আমার কাছে সমস্যাটা ছিল কৃষকদের ভিত্তি করে সশস্ত্র গণবাহিনী গঠন করার। আমার বক্তব্য ছিল যে, গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে এই বাহিনী গঠনের সময় যখন পাকিস্তানী রাষ্ট্রযন্ত্র তথা পুলিশ বা সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংঘাত শুরু হবে সেই মুহূর্তে শ্রেণীদ্বন্দ্ব জাতীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হবে এবং জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান হবে। ’৬৯-এ আমরা পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেবার অল্প কিছুদিন পর কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং শ্রমিক নেতা বাশার ভাই পার্টিতে জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান বলায় আমি সিরাজ শিকদারের পরিণতিতে আমাদেরও যাবার বিপদটা দেখতে পাই। সিরাজ শিকদারই প্রথম জাতীয় দ্বন্দ্বকে প্রধান বলে। যাইহোক, বাশার ভাই মূলত সঠিক ছিলেন। কিন্তু সেটা প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচী থাকলে সঠিক। যেমন আওয়ামী লীগের ছিল ৬ দফা। অর্থাৎ স্বায়ত্তশাসন কেন্দ্রিক জাতীয় কর্মসূচী দিলে তাঁর কথা মেনে নেওয়া যেত। কিন্তু গণ-রাজনীতি বাদ দিয়ে গোপন কমিউনিস্ট পার্টিতে জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান ধরলে কি হত? প্রকাশ্যে স্বায়ত্তশাসনের কর্মসূচী এবং আন্দোলন আমাদের নেই। আছে গোপনে স্বাধীন পূর্ব বাংলার কর্মসূচী ও আন্দোলন। এখন এটাকে প্রধান করতে চাইলে কি হত? আসলে মূল ঝোঁক তো আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করা এবং তাতে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু এভাবে হয়? সিরাজ শিকদার যে ফাঁদে গিয়ে শেষ পর্যন্ত পড়েছিল আমরাও তো সেখানে গিয়েই পড়তাম।

 

এ দেশের কোন কমিউনিস্ট নেতাই আমার কোন সঠিক কিংবা একটু সহানুভূতিশীল মূল্যায়নও কোন কালে করেন নি। আপনি বাশার ভাইকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন আলাউদ্দিন-মতিন ভাইরা কিংবা আর কারো ক্ষমতা হত কি না সেদিন আমি যদি ওভাবে শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রধান এ কথা বলে না দাঁড়াতাম তবে তাঁরা কেউ বাশার ভাইয়ের যুক্তির মোকাবেলায় দাঁড়াতে পারতেন কি না? অথচ আমি কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলাম না ’৭০-এর জুলাই পর্যন্ত।

 

আমি কি সঠিক ছিলাম? আমার ধারণা আমি মূলত সঠিক না হলেও কমিউনিস্ট পার্টি এবং তার জায়গায় আমি ঐ সময় সঠিক ছিলাম। যদিও শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে আমার উপলব্ধির সঙ্গে পার্টির কারোরই মিল ছিল না। তবু আমি যেভাবেই শ্রেণী সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিতাম না কেন প্রকাশ্যে জাতীয় কর্মসূচী না রেখে জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান দ্বন্দ্ব করার পরিণতি সেই মুহূর্তে আমি ঠেকাতে চেয়েছিলাম শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রধান বলেই।

 

কিন্তু শ্রেণী দ্বন্দ্ব প্রধান বললেই তো হল না। শ্রেণী অভুøত্থানও তো চাই! ওটা কি প্রকাশ্য জাতীয় কর্মসূচী ও রাজনীতি ছাড়া সম্ভব? আর সেখানে ছাত্র ও মধ্যবিত্ত বিশেষ করে ছাত্রদের নেতৃত্বমূলক ভূমিকা ছাড়া সম্ভব? আর এদের ভূমিকার প্রশ্নে পার্টিতে নেতাদের সঙ্গে আমার যে বিতর্ক ও মত পার্থক্য হত সেগুলো তো নেতাদের ভোলার কথা নয়! ঐ যুগে উপলব্ধির জগতে আমি এক নিঃসঙ্গ মানুষ ছিলাম। সুতরাং প্রচলিত মতাদর্শিক ও সাংগঠনিক কাঠামোকে যতটা সম্ভব ব্যবহার করতে চেষ্টা করতাম। আর নিজেও তো বহু কিছু বুঝতাম না। ফলে ভুলও অনেক সময় হত।

 

সবচেয়ে বড় কথা নেতাদের সঙ্গে যত বিতর্কই করি আমি পার্টি ও নেতাদের প্রতি অনুগত থাকতে আপ্রাণ চেষ্টা করতাম এবং বাইরে পার্টির গৃহীত লাইনকেই নিয়ে যেতাম। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই আমার অবস্থা হয়েছিল ‘ধোবি কা কুত্তা না ঘরকা না ঘাটকা’। নেতারা আমাকে নিদারুণ অপছন্দ ও ভয় করত। ঘৃণাও করত ‘পেটি বুর্জোয়া’ জাতীয়তাবাদী হিসাবে। অন্যদিকে কর্মীরাও নেতৃত্বের লাইনের প্রতি অনাস্থা জাগলে আমার প্রতিও আস্থা হারাত বা আমাকে মনে করত নেতৃত্বেরই চিন্তা এবং কর্মের প্রতিনিধিত্বকারী। অবশ্য এর জন্য তাদের দোষ দিয়ে লাভ নেই। আর এটাও তো ঠিক যে, আমি নেতা না হলেও সারা দেশের বিশেষত ছাত্র-তরুণ কর্মীদের ব্যাপক অংশের প্রত্যাশাটা আমার কাছেই বেশী ছিল। তবে আমি সাধারণত যে ভূমিকাটা পালন করতাম সেটা হল নেতা এবং কর্মীদের মধ্যে এক ধরনের মধ্যস্থতাকারীর। কিন্তু আমার অবস্থাটা সত্যিই খুব করুণ হয়েছিল। এক ভয়ঙ্কর যন্ত্রণা ও আত্মদ্বন্দ্বের মধ্য দিয়ে চলতাম, যার প্রকাশ নিশ্চয় আমার কথা এবং কাজেও অনেক সময় কিছু না কিছু ঘটত। বিশেষত ’৭০-এর জুলাই মাসের পার্টি কংগ্রেসের পর থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ঐ কংগ্রেসে উপস্থিত হয়ে আমি স্পষ্ট হই নেতৃত্ব পার্টিকে কোথায় নিয়ে ফেলেছে। এবং দেশের রাজনীতিতে বিশাল পট পরিবর্তনের লক্ষণও তখন আমার কাছে স্পষ্টভাবে ধরা পড়েছে। অবশেষে ১৯৭০-এর ডিসেম্বরে গিয়ে বিদ্রোহ করি পার্টি নেতৃত্বের বিরুদ্ধে। এবং একটা ভুল লাইন নিয়েই। সেটা হল চারু মজুমদারের লাইন, যে লাইনের বিরুদ্ধে আমি পার্টির জুলাই কংগ্রেসের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত ছিলাম।

 

আমি অবশ্য জুলাই কংগ্রেসের কিছুদিন পর থেকেই এবং ডিসেম্বরের কিছু পূর্ব থেকে চারু মজুমদারের লাইন নেবার গুরুত্বের কথা বলতে থাকি। আমি তখন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সুতরাং সুবিধাটা তো ছিলই। এবং ডিসেম্বরে হুমকি দিই যে, যদি অনতিবিলম্বে পার্টিতে চারু মজুমদারের লাইনকে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পদ্ধতি হিসাবে না নেওয়া হয় তবে আমরা পার্টি ভাঙ্গব। ব্যাপক কর্মীরা তখন আমাকে সমর্থন দেয়। আর পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আমজাদ তো জুলাইয়ের পার্টি কংগ্রেস থেকেই আমার সমর্থক ছিল। তবে সে চারু মজুমদারের পন্থার অন্ধ অনুসারী হয়েছিল, যেটা আমি ছিলাম না। এটাও নিশ্চয় আমার লেখাটা থেকে জেনেছেন। যাইহোক, আমার হুমকি এবং চাপের ফলে পার্টির নেতৃত্ব (তখন আবদুল মতিন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সম্পাদক) বিশেষ কংগ্রেস ডাকতে বাধ্য হন, যা ১৯৭০-এর ৩০, ৩১ ডিসেম্বর এবং ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারীতে অনুষ্ঠিত হয়। আমার বইতে এ তথ্যটুকু দিলেও আমার হুমকির কথাটা বলি নি।

 

আমার বিবেচনার কথাটা আমার বইতে বলেছি, কেন আমি চারু মজুমদারের লাইন পার্টিতে আনতে চেয়েছিলাম এবং কিভাবে চেয়েছিলাম। সেটা আপনি পড়েছেন। হাঁ, আমি পার্টিকে জাতীয় যুদ্ধে যেতে বাধ্য করতে চেয়েছিলাম সেই সময়টাতে। কারণ আমি মনে করছিলাম এতদিনে তার সময় এসেছে। এতকাল ধরে তৈরী এবং মজুত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিশাল শক্তিটাকে আমি সেই মুহূর্তে শ্রেণী যুদ্ধের বা শ্রেণীশত্রু খতমের নামে মুক্ত করতে চেয়েছিলাম, যখন সারা দেশে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের উত্তাল বন্যা বইছে। এবং এইভাবে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য করে ইয়াহিয়া-মুজিবের আপোস ও সমঝোতার সমস্ত পথ বন্ধ করতে চেয়েছিলাম এবং যুদ্ধ শুরু হলে তাতে অংশ নিতে চেয়েছিলাম।

 

কিন্তু এতকাল আমার উপলব্ধিতে এটা ছিল না যে, আসলে আমার ঐ সিদ্ধান্তই আপোসের সব পথ বন্ধ করে জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ঘটায় ১৯৭১-এর ২৫ মার্চ তারিখে। কারণ আমাদের পার্টিকে কেন্দ্রীয়ভাবে আমি এর পরেও জাতীয় যুদ্ধে নিতে পারি নি। যারা গেছে বিচ্ছিন্নভাবে এবং খণ্ডভাবে গেছে। বরং এতকাল একটা মর্মপীড়ায় ভুগতাম যে, ঐ ভুল লাইনটা আমি পার্টিতে যে উদ্দেশ্যে নিলাম ফলটা হল তার উল্টো। পার্টিকে তো জাতীয় যুদ্ধে নিতে পারলামই না, বরং তা পার্টির ধ্বংসের কারণ হল। পরে বহু চেষ্টা করেও পার্টিকে আর সেখান থেকে ফেরাতে পারি নি। সবাই পরে এর জন্য আমাকে দায়ী করেছে। এবং আমিও নিজেকে দায়ী করেছি, যদিও জানতাম যে, এই লাইনের ঠিক এমন প্রয়োগ আমি চাই নি, এবং সেটা পার্টির অনেকেই জানে। মজার ব্যাপার হল এতকাল পর আমার উপলব্ধি হয়েছে যে, একটা ভুল পার্টিকে সঠিকভাবে ঐ ভুলটা দিয়েই জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ অনিবার্য করায় ইতিহাসের এক অচেতন অস্ত্রে পরিণত করেছিলাম আমি। হাঁ, পার্টি নেতৃত্ব আমার উদ্দেশ্যটা ঠিকই বুঝেছিল। কারণ আমার বক্তব্য ছিল, যে মুহূর্তে রাষ্ট্রের সঙ্গে কৃষক-শ্রমিক জনগণের সংঘাত হবে সেই মুহূর্তেই শ্রেণী দ্বন্দ্ব জাতীয় দ্বন্দ্বে পরিণত হবে। সমস্ত কর্মীরা কিন্তু এই চেতনা থেকেই আমার দেওয়া লাইন গ্রহণ করে। পার্টি নেতৃত্ব বুঝেছিল আমি পার্টিকে কোথায় কোন কৌশলে নিতে চাচ্ছি। সুতরাং শ্রেণী শত্রু খতমের লাইন যাতে জাতীয় যুদ্ধে পরিণত না হতে পারে সেইজন্য ১৯৭১-এর ১ জানুয়ারী তারিখে পার্টির বিশেষ কংগ্রেসে যেদিন তাঁরা পার্টিতে ঐ লাইনকে অন্তর্ভূক্ত করতে বাধ্য হলেন সেদিন আমাকে পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বাদ দিলেন। এবং আমি সেটা নির্বিবাদে মেনে নিলাম।

 

আজকে অবস্থাটা চিন্তা করা যাক। যদি ২৫ মার্চ পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ঐভাবে আক্রমণ শুরু না করত তবে কি হত? শ্রেণীশত্রু খতম এবং গ্রামাঞ্চল মুক্ত করার প্রক্রিয়ায় দ্রুত পার্টির নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী বা দলসমূহ গড়ে উঠত। ফলে অনিবার্যভাবে কোথাও না কোথাও রাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাত দেখা দিত। তখন জাতীয় দ্বন্দ্ব প্রধান এবং জাতীয় যুদ্ধ শুরু হয়েছে এই বোধ থেকে কি কর্মীদের আর সরিয়ে রাখা যেত? নেতারা সব ভেসে যেত। অবশ্য বাশার ভাইয়ের মত নেতাদের সঙ্গে পেতাম বলে মনে হয়।

 

হাঁ, নেতারা খুব ভালভাবে জানত আমার যুক্তিগুলো কী, শ্রেণীর ব্যাখ্যা কী। কৃষকের সব শত্রুই তো আমার বিচারে ছিল শ্রেণী শত্রু। গরুচোর, ডাকাত, গ্রামীণ দুর্বৃত্ত, অত্যাচারী জোতদার-মহাজন থেকে শুরু করে রাষ্ট্রযন্ত্র পর্যন্ত। আর কর্মীরাও আমার ব্যাখ্যাগুলোর জানত। হয়ত সবাই মানত না। কারণ কেতাবে এসব লেখা নেই। তা না থাক, জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ শুরু করার জন্য শ্রেণী ও শ্রেণী সংগ্রামের দৃষ্টি থেকে অমন একটা যৌক্তিক ব্যাখ্যা পাবার পর তাদের জাতীয়তাবাদী আবেগকে রোধ করার আর কোন উপায়ই তো পার্টির রইল না।

 

কিন্তু ক্ষতিটা হল আমাকে কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেওয়ায়। আমজাদকে তাঁরা রাখলেন। কারণ আমজাদ তখন চারু মজুমদারের অন্ধ ভক্ত। তার মাথায় তখন আর জাতি নেই, শুধু ‘শ্রেণী’, মার্কসবাদের অর্থনৈতিক শ্রেণী। আমাকে কেন্দ্র থেকে বাদ দেওয়া হলেও এবং আমি সেটা মেনে নিলেও ১৯৭১-এর জানুয়ারী থেকে মার্চ পর্যন্ত আমার দৃষ্টি থেকে যদি আমজাদ কাজ করত তবে হয় পার্টির নেতৃত্বে ২৫ মার্চের পূর্বেই জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ শুরু হত আর নয় ২৫ মার্চ তা শুরু হলে পার্টি তাতে একটা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে পারত।

 

যাইহোক, জাতীয়তাবাদের ঐ জোয়ারের মধ্যে শুরু করা জাতীয় যুদ্ধ কি সমগ্র জনগণকে টেনে নিত না? মুজিব প্রধানমন্ত্রী হয়ে কি এই জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ব্যবহার করতে পারতেন? কি করতেন মুজিব?

 

হ্যাঁ, পার্টিতে ঐ মুহূর্তে চারু মজুমদারের লাইন নেবার অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়িয়েছিল জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের সূচনা। সেটা যত দেরীতেই হোক।

 

আজ আমি অনুমান করি যে, এমন একটা মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্রের পরামর্শে এবং মুজিবেরও সম্মতিতে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী কাল বিলম্ব না করে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। মুজিব কিছুদিন আগেই জানতেন কী ঘটতে যাচ্ছে। তা না হলে ৭ই মার্চের ভাষণে ওসব কথা কেন? ‘আমি যদি হুকুম দিবার না পারি... ইত্যাদি।’ এ এক পাকা অভিনেতা! তবে ’৭১-এর এমন জনযুদ্ধটা তাঁর হিসাবে ছিল বলে মনে হয় না।

 

যাইহোক, এখন আমার অনুমান যে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেণীশত্রু খতমের নামে জাতীয় যুদ্ধ শুরুর প্রস্তুতি ও হুমকি ঐ মুহূর্তে সারা দেশে আওয়ামী লীগসহ সবাইকে এমন এক নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় ঠেলে দেয় যা যুদ্ধকে অনিবার্য করে। যেহেতু পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অক্রমণের মোকাবিলায় আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে জনগণের প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু হল সেহেতু নেতৃত্বের প্রতিযোগিতায় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি হেরে গেল। আর যখন হারল তখন আমারও হার হল পার্টিতে। সেই সঙ্গে পার্টির ভূমিকা ও প্রয়োজনটাও ফুরালো আমার কাছে, জাতিরও কাছে। তবে আমার জিৎ হল পার্টির বাইরে, জাতির মধ্যে। কারণ যে যুদ্ধটা ঘটাতে চেয়েছিলাম সেটা ঘটাতে পারলাম, যদিও আমাদের পার্টির নেতৃত্বে সেটা হল না। ফলে আমারও ভূমিকা পালনের সুযোগ আর রইল না।

 

হাঁ, হারার কথাটা খুব তাৎপর্যপূর্ণ। পার্টি প্রতিযোগিতায় হেরে গেল। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ জাতীয় যুদ্ধটা আগেই শুরু করল। সুতরাং পার্টির কাছে জাতীয় যুদ্ধটাই অচ্ছুৎ হল। আসলে ঐ পার্টি তো ব্রাহ্মণ! অচ্ছুৎ বা হরিজন আওয়ামী লীগ যা ছোঁয় তা-ই অচ্ছুৎ হয়ে যায়! জাতীয় যুদ্ধের নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের হাতে চলে যাওয়ায় পার্টি নেতৃত্ব নিজেদের জাতীয়তাবাদবিরোধী চক্রান্তের ফাঁদে পার্টিকে আটকে রাখতে পারল। এই অবস্থায় আমার ভূমিকাও ফুরালো। আমার তো লক্ষ্য ছিল পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার জন্য বাঙ্গালী জনগণের জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ ঘটানো। সেটা যেভাবে এবং যার নেতৃত্বেই হোক যখন হল তখন আমার একটা ঐতিহাসিক মিশন সম্পূর্ণ হল। হয়ত সম্পূর্ণ মিশন নয়। কিন্তু তার একটা পর্যায় তো বটেই। অর্থাৎ পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি ছাড়া জাতীয় যুদ্ধ হত না। অথচ তার তাতে নেতৃত্ব দোবার সামর্থ্য বা ইচ্ছা ছিল না। অথচ এই যুদ্ধের প্রতিশ্রুতি নিয়েই তার জন্ম ও বিকাশ। ফলে যুদ্ধ শুরু করিয়ে দেবার কাজ সম্পূর্ণ হলে তার প্রয়োজন আর থাকবার কথা নয়। এই বিচারে এটা এমন এক শক্তি যার প্রয়োজনটা ছিল জাতীয় মুক্তি যুদ্ধের চেতনা বিস্তারের জন্য। ইতিবাচক দিক তার এইটুকুই। অর্থাৎ চেতনার ক্ষেত্রে, আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে। কাজের ক্ষেত্রে নয়। কাজের ক্ষেত্রে তার ভূমিকা প্রধানতই নেতিবাচক। অর্থাৎ জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে বাস্তব ভূমিকা রাখার ক্ষেত্রে। সেখানে তা জাতি খণ্ডনকারী।

 

হাঁ, আমার এই উপব্ধি আমি আমার লেখায়* সংযোজন করব।

______________________________________________________________________

* ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’-এ। - লেখক

______________________________________________________________________

 

কিছু পুনরুক্তি হবে তবু বলি, সে কালে কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সঙ্গে দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই এক ধরনের ঐক্য করা ছাড়া আমাদের উপায় ছিল না। তবু তো অনেক দিন আমি পার্টির বাইরেই ছিলাম। আমি প্রকৃতপক্ষে ঐতিহ্যিক কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিই কখন এবং কখন তার সদস্য হই? সেটা তো ১৯৬৯-এর প্রথম দিকে। অর্থাৎ ১৯৬৮-এর শেষে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন সিদ্ধান্ত নেয় পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পাটিতে যোগ দেবার। কিন্তু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে ’৬৯ শুরু হয়।

 

বাস্তবে একটা দীর্ঘ ঐতিহ্যের উপর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্বকে একই ধরনের বা কাছাকাছি রাজনীতি নিয়ে এড়িয়ে গিয়ে ভিন্ন ধারা গড়া যায় না। করব মার্কসবাদ আর সেই ধারায় এবং মতবাদে দীর্ঘ ত্যাগ ও সংগ্রামে গড়ে ওঠা পার্টি ও তার নেতৃত্বকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে ভিন্ন পার্টি ও গ্রহণযোগ্য নেতৃত্ব দাঁড় করাব এটা হয় না।

 

আসলে আমি চিরকালই ঐতিহ্যকে যতটা সম্ভব ব্যবহার করে এগিয়ে যাবার পক্ষপাতী ছিলাম। আমি মনে করতাম এই মানুষগুলোর ভাল দিকগুলোকে যতটা সম্ভব বিকশিত করা ও কাজে লাগানো উচিত। না পারলে তাদের নিঃশেষ করা উচিত। সেটাও শুধু বাইরে থেকে হয় না। ভিতরেও যেতে হয়। ভিতর ও বাহির উভয় দিক থেকে কাজটা করতে হয়।

 

অবশ্য তার মানে এই নয় যে, সব সময় সব ধরনের ঐতিহ্যকে ব্যবহার করার চিন্তা করতে হয়। পুরাতন নেতৃত্বের সঙ্গে অন্তত আমার মৌলিক বা গুরুতর রাজনৈতিক পার্থক্য ছিল। আর সে কারণেই তো এত দীর্ঘ কাল আমি কমিউনিস্ট পার্টির বাইরে থেকেছিলাম। এবং নিজ উদ্যোগে ১৯৬৮-এর এপ্রিলে তরুণদের গোপন সংগঠন পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলন গঠন করলাম। কিন্তু ইতিপূর্বে বলেছি যে, তখনকার পরিস্থিতি আমাদের বাধ্য করেছিল পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিতে। এবং আমি বলেছি যে, সিরাজ শিকদারের বিপদ ছিলই। শুধু সেটাই নয়, পরিস্থিতির তখন বিদ্যুৎ গতি অগ্রগমন ঘটছিল। তখন আমাদের দরকার ছিল গোটা জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা পালনের সুযোগ। ’৬৮-এর ৬ ডিসেম্বর গণ-অভ্যুত্থান শুরু হয়।* তার অল্প কিছু দিন পূর্বে মাত্র আমরা সিদ্ধান্ত নিই পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে ঐক্যের আলোচনা শুরু করার। তখনকার পরিস্থিতিটা কল্পনা করুন। একটা বিশাল গণ-অভ্যুত্থান ঘটতে যাচ্ছে, আর তার পিছু পিছু আসছে বাঙ্গালী জাতির ইতিহাসের প্রথম বিশাল জাতীয় যুদ্ধ।

______________________________________________________________________

* প্রকৃতপক্ষে, ১৯৬৮-এর ৬ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী ঢাকার পল্টন ময়দানের জনসভা থেকে আইয়ুব বিরোধী যে গণ-আন্দোলনের সূচনা ঘটান সেটাই ১৯৬৯-এর জানুয়ারীতে গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হয়।

______________________________________________________________________

 

অবশ্য এটা বুঝি যে, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে আমাদের ওভাবে শুধু নীতিগত ঐক্যের ভিত্তিতে যোগদান করাটা ভুল হয়েছিল। এবং আরও সময় নেওয়া উচিত ছিল। রাজনৈতিক প্রশ্নগুলো এবং সংগঠনিক বিষয়গুলো নির্ধারণ করার পর ঐক্য ঘটানো উচিত ছিল। আসলে পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের ওভাবে বিলোপের সিদ্ধান্ত ছিল ভুল। যদি ধীর প্রক্রিয়ায় ঐক্য হত তবে ভাল হত। কিংবা হয়ত আমরা তাদের সঙ্গে এক ধরনের ঐক্য সত্ত্বেও নিজেদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে এগোতে পারতাম।

 

হাঁ, এবার আমি খুব স্পর্শকাতর প্রসঙ্গে যাব। সেটা আমার বইতে এভাবে বলি নি। কারণ এর সঙ্গে অনেকের সম্পর্কে অভিযোগ উঠে আসবে, যেটা আমি অন্তত ঐ বইতে উঠাতে চাই নি। তবে সেটা আপনাকে বলব। মার্কসবাদেরও সঙ্কটের জায়গায় আপনাকে নিতে। কারণ আপনি প্রশ্ন তুলেছেন ‘মার্কসবাদ কিংবা কমিউনিজম সম্পর্কে যা বলেছেন তা না লিখলেই কি না?’

 

এখন তখনকার তরুণ প্রজন্মের প্রধান অংশের প্রতিনিধিত্বকারী গোপন বিপ্লবী সংগঠন পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের তখন যা করা উচিত ছিল সে প্রসঙ্গে ফিরি। এবং ফিরেই প্রশ্ন করি ঐ কাজগুলো করবে কে? বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের সম্পাদক নির্বাচিত হন আবুল কাসেম ফজলুল হক। কিন্তু সম্পাদক হবার ইচ্ছা তাঁর থাকলেও কাজ করার ইচ্ছা ছিল না। কেন, তিনিই জানেন। এখন এই কাজগুলো করার মত দক্ষতা ও ক্ষমতা যেটুকু হোক তখন আমার ছাড়া আর কার ছিল? হাঁ, তৎকালীন বিশাল ছাত্র সংগঠন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল্লাহ্‌ বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক ছিল। সে ভাল বক্তা এবং মেধাবী ছিল। মার্কসবাদের উপর পড়াশোনাও তার ভাল ছিল। কিন্তু গণ-সংগঠনের নেতা হওয়া এবং গোপন বিপ্লবী সংগঠনের নেতা হওয়া যে এক জিনিস নয় সেটা আশা করি বুঝবেন। ছাত্র নেতা নূরুল হাসান তো তখনও সিরাজ শিকদারের এজেন্ট হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে নি। কিন্তু এই যোগ্যতা তারও কি ছিল? আপনি তো তাকে ভালভাবেই চেনেন। আর থাকে আমজাদ হোসেন। আমার কৈশোরের বন্ধু আমজাদ তখন কৃষক নেতা যশোরে। নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা তার স্থানীয় পর্যায়ে থাকলেও কেন্দ্রীয় বা জাতীয় পর্যায়ে যে ছিল না সেটা না বোঝার কোন কারণ আমার ছিল না।

 

তাহলে কেন্দ্রীয় সংগঠনী কমিটির পাঁচ জনের মধ্যে বাকী রইলাম আমি। আমি তখন দিনাজপুরের গ্রামে পড়ে থেকে কৃষকদের মধ্যে কাজ করছি। কিন্তু সেই সময় আমি বুঝলাম যে, এখন আমার ঢাকায় থেকে জাতীয় রাজনীতিতে ভূমিকা নেওয়ার দরকার। কারণ সত্যি বলতে কি ঐ দেড় দুই বৎসর গ্রামে কাজ করে আমি কৃষকদের সামর্থø সম্পর্কে মোহমুক্ত হয়েছিলাম। হাঁ, মাওবাদ এবং চীন-ভিয়েতনাম বিপ্লবের অভিজ্ঞতার প্রভাবে আমি গ্রামে গিয়েছিলাম কৃষকদের নিয়ে বিপ্লবী আন্দোলন গড়তে। আর গিয়ে অল্প দিনের মধ্যেই বুঝেছিলাম যে, কৃষকদের প্রধান ও সামনের সারির শক্তি করে বিপ্লব করতে চাইলে কি হবে। তা অনেক সময় দেখেছি কুড়ি বৎসরেও অনেকেই যেটা এমন কি নিজ অভিজ্ঞতা দিয়েও বোঝে না ওটুকু বুঝতে আমার এক দেড় বৎসরও লাগে না। অবশ্য এই দ্রুত বোঝা আমার সমস্যা হয়েছে। যাইহোক, জাতীয় রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ওভাবে গ্রামে পড়ে থেকে যে লাভ হবে না সেটা বুঝেছিলাম। আমাদের দেশে ছাত্রদের ভূমিকাটা যে কতটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা আরও ভালভাবে বুঝেছিলাম গ্রামে গিয়ে। আসলে আমার তখন উচিত ছিল ঢাকায় থেকে জাতীয় রাজনীতিতে নির্ধারক ভূমিকা পালনের চেষ্টা করা। তাহলে শ্রমিক এবং কৃষকদের মধ্যে আমাদের প্রজন্মের কাজগুলোকেও সমন্বিত করতে পারতাম। কিন্তু আমাকে দায়িত্ব দিলে না আমি কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করতে পারব এবং তার প্রয়োজনে ঢাকায় আসতে পারব!

 

আপনি কল্পনা করুন স্বাধীন পূর্ব বাংলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে গঠিত পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের উদ্যোক্তা আমি, সারা দেশে তার লোকদেরকে প্রধানত যোগাড় করছি আমি, তার ঘোষণাপত্র-কর্মসূচী তৈরী করছি আমি, তার মূল রাজনীতি ও কর্মপদ্ধতি দিচ্ছি আমি, কিন্তু কেন্দ্রীয় সংগঠনী কমিটি গঠনের পর আমি যখন একজনকে সম্পাদক নির্বাচন করার প্রস্তাব দিলাম তখন সবাই চুপ করে বসে থাকল। তার মানে আবার দায়িত্বটা আমার ঘাড়ে এসে পড়ল। সংগঠন বানালাম, রাজনীতি বানালাম, এবার নেতা বানাতে হবে! তা কি আমি নিজের নাম প্রস্তাব করব? আমি সব দিক বিবেচনা করলাম। ঢাকায় থাকত ফজলুল হক, মাহবুব উল্লাহ্‌, নূরুল হাসান। হক মাহ্‌বুব উল্লাহত্ম চেয়ে ভাল বুঝত আর সিনিয়ারও ছিল। মাহ্‌বুব উল্লাহর চেয়ে অবশ্য এক বৎসরের সিনিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের হিসাবে। অর্থাৎ ফজলুল হক ছিল আমার ইয়ারের ছাত্র। তবে আমাদের বিষয় ছিল আলাদা। তার বাংলা, আমার রাষ্ট্রবিজ্ঞান। আমি সব দিক বিচার করে ফজলুল হককে সম্পাদক করার প্রস্তাব দিলাম। সেটা সবাই গ্রহণ করল।

 

ফজলুল হক ছিল এই সমাজের একজন যথাযথ বুদ্ধিজীবী। এর তৎপর্য বোঝেন তো? এসব কথা বলতে খারাপ লাগে। দায়িত্ব পালনের তাগিদ নেই। কিন্তু চেয়ার অধিকার করতে ভাল লাগে! তিনি তো বাংলাদেশের একজন এমন নীতিবাদী দার্শনিক-বুদ্ধিজীবী, দীর্ঘকাল ধরে যিনি এ দেশে নীতি প্রতিষ্ঠার সমস্যাকেই সবচেয়ে বড় সমস্য হিসাবে বলছেন। আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও!

 

হাঁ, তা বলতে পারেন যে সভায় সংগঠনী কমিটির সম্পাদক নির্বাচন হয় সেখানে বসেই আমি আমার প্রজন্মের ভাগ্যলিপি পাঠ করেছিলাম। এর জন্য আমি কি ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম? না। শুধু বুঝেছিলাম আমার সময় হয় নি এবং আমাদের প্রজন্মেরও। আমাদের প্রজন্মের যে সময় হয় নি সেটা সম্পাদক না হয়েও কিছুদিন কেন্দ্রীয় দায়িত্ব পালন করে আরও ভালভাবে বুঝলাম।

 

সুতরাং এ কথাও বলি আমি দায়িত্ব পেলেও ইতিহাসের গতি কতটা ঘোরাতে পারতাম বলা কঠিন। তবে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে এক অর্থে ঐভাবে নিঃশর্ত বিলুপ্তি ঘটাতাম না। কিন্তু আমি আর কি করতে পারতাম? বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রীয় দায়িত্বে না থেকেও আমি কিছুদিন সেই দায়িত্ব পালন করলাম। কিন্তু বুঝলাম এভাবে হয় না; এবং আমার পক্ষে উচিতও নয় এভাবে কাজ করতে চেষ্টা করা। তখন ছাত্র-যুব সম্প্রদায়ের যে বিশাল অংশটা আমাদের সঙ্গে ছিল সেটাকে রক্ষা করাই আমার সামনে প্রধান করণীয় হয়ে দেখা দিল। তখনকার পরিস্থিতির দ্রুততায়, আমার সহকর্মীদের সীমাবদ্ধতায় এবং আমার নিজেরও সীমাবদ্ধতায় আমি নিঃসংশয় হয়েছিলাম যে, আমার যেমন নেতৃত্ব দেবার সময় হয়নি তেমন আমার প্রজন্মের পক্ষেও এখন আর সেটা সম্ভব নয়। না, তখনকার জটিল পরিস্থিতিটা এত অল্প কথায় ভালভাবে বোঝানো সম্ভব নয়। শুধু পূর্ব বাংলার বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের সূচনা ও সমাপ্তির সংক্ষিপ্ত পর্বের উপর যদি গভীর অনুসন্ধান চালানো যায় তবে বহু কিছু বেরিয়ে আসবে বলে মনে করি। এবং তখন বোঝা যাবে সঙ্কট শুধু প্রজন্মের নয়, শুধু মুসলমান বাঙ্গালী সমাজের নয়, শুধু কিছু ব্যক্তির নয়, উপরন্তু মাকর্সবাদেরও। না, নেতৃত্ব বা পদ পাই নি বলে ব্যক্তিগত ক্ষোভ থেকে যে এসব কথা বলছি তা নয়। যদিও এর মধ্যে যে একটা নীতিগত বা নৈতিক বিষয় আছে সেটা আশা করি আপনি অনুভব করবেন। এবং এক গভীর তাৎপর্য রয়েছে যা আপনাকে মার্কসবাদের সঙ্কটটাও দেখাবে।

 

হাঁ, চাইলে আমি পদ নিতে পারতাম। কিন্তু আপনি চিন্তা করুন, তৎকালীন পূর্ব বাংলার বৃহত্তম ছাত্র সংগঠন অবিভক্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদকের পদ নিতে ১৯৬৫ সালে কাজী জাফর আহমদ আমাকে রাজী করাতে পারেন নি, আর আমি এক গোপন সংগঠনের কয়েক জনের নেতৃত্ব দেবার জন্য ব্যগ্র হব! ঐ ব্যগ্রতা আমার ছিল না। কারণ আমার কাছে এ দেশে বিপ্লবের সমস্যাগুলো বোঝা এবং পথ বের করাটাই প্রধান সমস্যা ছিল। ফলে নিজেকে অনেকের চেয়ে অনেক দিক থেকে যোগ্যতর বুঝলেও বিপ্লবের নেতৃত্বদানের জন্য যোগ্য মনে করতাম না। আর আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য রাজনীতি করি নি বলে রাজনৈতিক প্রশ্ন ছাড়া অন্য কোন প্রশ্নে দ্বন্দ্বে অবতীর্ণ হই নি।

 

নেতারা আমার সম্পর্কে যত নিন্দাবাদই করে বেড়াক, পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী, অস্থিরচিত্ত ইত্যাদি অভিধায় যতই অভিষিক্ত করুক, আমি নেতৃত্বলোভী এমন কি নেতাত্বাকাঙ্ক্ষী এমন অপবাদ আমার বিরুদ্ধে কোথায়ও কোন দিন দিয়েছে এমনটা কি আপনার জানা আছে? না, সেটি তারা কোন দিনই দিতে পারে নি। কারণ ঐ অপবাদ দিলে ঐ কালটাতে তাদের নিজেদেরই দাঁড়াবার জায়গা থাকত না। আমাদের গোটা প্রজন্ম এবং বাম আন্দোলনের নেতা-কর্মীরা জানত যে, আমার নেতৃত্বাকাঙ্ক্ষা বলতে কোন বস্তুই নেই। অনেকে এই কারণেও আমার উপর আস্থা রাখতে পারত না। সাধারণ মানুষ তো নেতা চায়। এমন নেতা যার উপর অন্ধভাবে নির্ভর করা যায়। আমি জানতাম আমি নিজেই অন্ধ। আমি কি করে অন্ধদের পথ দেখাব? সুতরাং আমি নিজের দৃষ্টিটাকে যেমন খুলতে চাইতাম তেমন চাইতাম সবাই নিজেদের দৃষ্টিটা খুলুক, স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শিখুক। আর তাই কাজের পাশে নিজে যেমন পড়তাম তেমন সবাইকে পড়তে উৎসাহী করতাম। পড়তে এবং সেই পড়ার আলোয় বাস্তবকে বুঝতে আবার পড়াকে বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোয় যাচাই করতে বলতাম।

 

ফল কি হত? উল্লোটা। বিপ্লব করতে চেয়ে বিপ্লবের বিজ্ঞান হিসাবে তারা মার্কসবাদ রপ্ত করত। ফলে মার্কসবাদ পড়ে শুধু তার আলোয় বাস্তবকে যাচাই করতে শুরু করত। দেখার ভঙ্গীটা যারাই রাজনীতিতে আসত এবং মার্কসবাদ রপ্ত করত প্রায় সবারই, প্রায় প্রত্যেকেরই হত আমার থেকে উল্টোটা। আমি কর্মীদের হাত ধরে মার্কসবাদের বলয়ে নিয়ে আসতাম। মার্ক্‌স-এঙ্গেল্‌স-লেনিন-মাও পড়ার পর আমার মূল্য তাদের কাছে থাকত? আমজাদকে বিদ্যালয় জীবন থেকে হাতে ধরে রাজনীতি শেখালাম বললে কি এতটুকু ভুল হবে? এক কালে সে আমার অনেক চিন্তার এবং কাজের সাথী কিংবা সহযোগী ছিল। মার্কসবাদটা রপ্ত করার পর কি হল? কোথায় মার্কস-এঙ্গেল্‌স-লেনিন-স্তালিন-মাও, আর কোথায় মানিক! হাঃ!

 

না, আমজাদ একা নয়। আমজাদ তো সে কালে বিরাট ব্যক্তি হল। যুদ্ধের ভিতর তাকে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদকও করলেন আলাউদ্দিন-মতিন ভাইরা। কেন? সেটা এখানে অপ্রাসঙ্গিক। আমজাদের কথাটা আমি দৃষ্টান্ত হিসাবে দিলাম। মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র কথাটাই ধরুন। মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ কি কম বড় নেতা হয়েছিল? সে কালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর সাধারণ সম্পাদক। পরে পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেবার পর তাকে এবং আমজাদকে ঐ পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য করে নেওয়া হল। আজকের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভাইস চ্যান্সেলর মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র চেয়ে সে কালের ছাত্র ও কমিউনিস্ট নেতা মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌র গুরুত্ব ও মর্যাদা নিশ্চয় অনেক বেশী ছিল। সেই মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ কি এক সময় বলত না যে, তাকে রাজনীতিতে আমি এনেছি? কিন্তু পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হবার পর কি আমজাদ এবং মাহ্‌বুব উল্লাহ্‌ কোনদিন আর আমার অভাব বা প্রয়োজন অনুভব করেছিল? এর আগে বিপ্লবী কমিউনিস্ট আন্দোলনের সম্পাদক হিসাবে আমার প্রয়োজন যেমন তারা অনুভব করে নি তেমন পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হিসাবেও তারা আমার প্রয়োজন অনুভব করে নি। একটা রাজনীতি আমি গড়ছি। সেই রাজনীতিতে আমি সবাইকে নিয়ে আসছি। কাজ করছি ভূতের মত অথবা দৈত্যের মত শক্তি নিয়ে। নেতা না হলেও পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম থেকে দিনাজপুর, রংপুর পর্যন্ত সারা দেশে কর্মী সংগ্রহ করছি। তারপর একটা পর্যায়ে আমার মূল্য এবং গুরুত্ব আর কারো কাছে থাকছে না একজন বেগার খাটা কর্মী হিসাবে মূল্য এবং গুরুত্ব ছাড়া।

 

কিন্তু কেন? সে কালে অত যে মানুষ আমাকে তাদের রাজনৈতিক গুরু ইত্যাদি বলত তারপরেও তারা আর প্রায় কেউই আমার চিন্তার সাথী থাকত না। তারা সবাই আমাকে শ্রদ্ধা করত ঠিক। কিন্তু সেটা একজন নিরলস, নিঃস্বার্থ কর্মী হিসাবে। কিন্তু আমার প্রতি আস্থাও রাখত না। কারণ? কারণটা শুনবেন? কারণ তারা যখন খাঁটি মার্কসবাদী বা কমিউনিস্ট হতে চাইত তখন দেখত যে, আমার চিন্তা বা কর্ম ধারার সঙ্গে মার্কসবাদের কোথায় যেন একটা গরমিল আছে। সবাই আমার ভিতরের জিজ্ঞাসা বা চিন্তা জানত না। আমজাদের মত ২/১ জন ছাড়া আমার ভিতরের কিছু জিজ্ঞাসা নিয়ে প্রায় কারো সঙ্গে প্রায় কোন আলাপ করতাম না। হাঁ, আমজাদ জানত যে, মৌল মার্কসবাদ নিয়েই আমার প্রশ্ন আছে। কারণ আমার বিশ্বাসটা সমাজতন্ত্র পর্যন্ত ছিল। সাম্যবাদ বা কমিউনিজমকে আমি ইউটোপিয়া মনে করতাম।

 

আসলে মার্কসবাদের মধ্যে আমি বিপ্লবের এবং সমাজ পরিবর্তনের কতকগুলো প্রয়োজনীয় পদ্ধতি দেখতে পেতাম। এই অর্থে আমি এটাকে তখনও বিজ্ঞান বলতাম। কিন্তু এই বিজ্ঞানের (!) বহু কিছু নিয়ে আমার এমন সংশয় থেকেই গিয়েছিল যার সবকিছু নিয়ে আমি এমন কি আমজাদের সঙ্গেও আলোচনা করতাম না। ভাবতাম বিপ্লবী প্রয়োগের মধ্য দিয়ে, আন্দোলনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমি আমার জিজ্ঞাসার উত্তর পাব। সুতরাং কাজ করতাম নিরলসভাবে। আর হাঁ, লক্ষ্যটা ছিল একটা জাতীয় জন-যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পূর্ব বাংলায় বাঙ্গালী জাতির লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ওটাই ছিল আমার সেকালে সবচেয়ে বড় লক্ষ্য। যাইহোক, আমার ভিতরের চিন্তা সবার কাছে উন্মুক্ত ছিল না। কিন্তু শ্রেণী সংগ্রাম সম্পর্কে, জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে আমার চিন্তা তো সবার কাছেই স্পষ্ট ছিল কম-বেশী। বিশেষ করে বাঙ্গালী জাতির রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় আমার দৃঢ় সঙ্কল্পটা সবাই জানত। আর কমিউনিস্ট নেতারা তার ফলে সহজে পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী বলে আমাকে চিহ্নিত করতে পারত।


আপনি কি মনে করেন মার্কসবাদ সম্পর্কে আমার অন্ধ বিশ্বাস থাকলে সেকালে যে ভূমিকা আমি পালন করেছিলাম তা করতে পারতাম? আসলে মার্কসবাদের নামটা ব্যবহার করতাম। সেকালে সেটা আন্তরিক ছিল। কারণ আমি মনে করতাম এটা বিজ্ঞান। ফলে বিপ্লবের প্রয়োজনে এর যে কোন জিনিস বাদ দেওয়া যায়, নেওয়া যায়, বদলানো যায়। আর সবচেয়ে বড় কথা আমার কাছে এর চেয়ে উন্নততর বা এর বিকল্প আর কোন তত্ত্ব বা অভিজ্ঞতা ছিল না। ফলে আমি তার সাহায্যেই এগিয়ে যেতে চেয়েছিলাম। হাঁ, তা অনেকটা পেরেছি। কিন্তু এর মূল্যটা শুধু আমার জন্য নয়, আমাদের প্রজন্ম এবং কর্মীদের জন্যও কত ভয়ানক হয়েছে!

 

মার্কসবাদ সম্পর্কে আমার অভিজ্ঞতা তো একটু নয়। ষাটের দশকেই তো এ দেশে মার্কসবাদের চর্চাটা মুসলমান বাঙ্গালীদের মধ্যে প্রথম ব্যাপকভাবে শুরু হয়। মস্কোপন্থীদের শান্তিবাদী রাজনীতির বিপরীতে এ দেশে কমিউনিজম বা মার্কসবাদের বিপ্লবী ধারা নিয়ে আসায় আমার ভূমিকা কি কম মনে করেন? ছাত্ররাই তো এ ধারার প্রবল স্রোত এ দেশে প্রথম প্রবাহিত করে। আর সেই ছাত্রদের মধ্যে মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের মেরুদণ্ডহীন রাজনীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে গিয়ে বিপ্লব পন্থা হিসাবে মাও সে-তুং চিন্তাধারা এবং অন্যান্য বিপ্লবী ভাবনাগুলো সবচেয়ে প্রথম এবং সবচেয়ে জোরালোভাবে আমার জানা মতে আমি প্রথম প্রবর্তন করি। মনে হয় কাজী জাফর আহমদও সেটা স্বীকার করবেন। কারণ এটা তাঁর জানা ছিল।

 

তা, আমার দোষটা হল আমি প্রথম আনি, আবার আমিই প্রথম ছাড়ি। ঐ চারু মজুমদারের লাইনের মত। পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে সবার আগে লাইনটা আমি আনলাম। তারপর আমিই সবার আগে ওটার বিরোধিতা করলাম।

 

হাঁ, ভাই! অনেক শিক্ষা হয়েছে পরের বিদ্যা টানাটানি করে। জাতীয় যুদ্ধ শুরুর জন্য আমি চারু মজুমদারের লাইনকে সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করতে বললাম। আমজাদ আমার সমর্থক হল। তখন আমি তার গুরু। তারপর চারু মজুমদারের লেখাগুলো পড়ে এবং বুঝে আমাকে বলল, ‘আমাদের চারু মজুমদারকে অন্ধভাবে অনুসরণ করতে হবে।’ তার বিরোধিতা করলে সে আমাকে বলল, ‘চারু মজুমদারের লাইন সৃজনশীলভাবে প্রয়োগ করার মত যোগ্যতা আমাদের এখনও হয় নি। অন্ধভাবে প্রয়োগ করে অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমাদের সেই যোগ্যতা অর্জন করতে হবে।’ আপনি আমজাদ হোসেনকে জিজ্ঞাসা করে দেখতে পারেন।

 

হাঁ, গুরুরও গুরু হবার কী চমৎকার বুদ্ধি! মার্কসবাদ অযোগ্য অথবা কম যোগ্যদের নেতা হবার এমন শর্টকাট রাস্তাটা তৈরী করে রাখায় সে পথে হাঁটার লোকের অভাব হবে কেন?

 

তা, আমার অভিজ্ঞতাটা কী? প্রথমে কয়েক বৎসর মার্কসবাদ আর কমিউনিজম করলাম। তারপর মস্কোপন্থীদের সশস্ত্র সংগ্রাম ও বিপ্লব বিরোধী রাজনীতিকে প্রতিহত করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জীবনে ’৬৪-৬৫ তে মাও সে-তুং চিন্তাধারা এবং চীনের প্রতি সমর্থন নিয়ে এলাম। ওটা ছিল মার্কসবাদ-লেনিনবাদের নামে চালু মস্কোপন্থাকে প্রতিহত করার প্রয়াস। মাওবাদী হয়ে অনেকেই অন্ধ চীনপন্থী হল। তা চীনপন্থাকে প্রতিহত করতে ১৯৭০-এ আনলাম চারু মজুমদারের তত্ত্ব। সবই আনি সৃজনশীলভাবে প্রয়োগের দৃষ্টিভঙ্গী থেকে এবং পূর্ববর্তীর অন্ধত্বকে মোকাবিলা করতে। কিন্তু সৃজনশীলতাটা থাকে কোথায়? সৃজনশীলতা করতে গিয়ে আমি একা হই। আর বাকীরা সবাই সেখানে সমাজ-পৃথিবী-জীবনের সব সমস্যার সমাধান খঁুজতে লেগে পড়ে যায়!

 

হাঁ, এইখানে ছিল আমার সমস্যা। আমার প্রজন্মের কর্মীরা আমাকে যেমন কাছের মনে করত তেমন দূরেরও মনে করত। আমি তাদের পথ দেখাতাম। কিন্তু সেটা যে তত্ত্বের নামে সেইখানে গিয়ে তারা থেমে যেত। তখন তত্ত্ব তাদের কাছে আমার উপলব্ধির চেয়েও বড় হত। সেটাই স্বাভাবিক। কারণ তারা সব বিপ্লবের অথরিটির অনুসারী হতে চাইত। ফলে আমার সৃজনশীলতা তাদের কাছে তখন ভ্রান্তি মনে হত। আর তাই আমার প্রতি একাত্মতা অনুভব করত না, আস্থা পেত না।

 

আর আমার যে সৃজনশীলতা, তার উৎস কিন্তু ঐসব তত্ত্ব নয়, বরং সেগুলোর প্রতি সংশয়। অথচ ঐ সংশয় নিয়েই সেগুলোকে আমার প্রয়োগের হাতিয়ার হিসাবে যতটা সম্ভব প্রয়োগ করতে চাইতাম।

 

ঐ কালে আমার প্রবল এবং ব্যাপক প্রভাব ছিল একটু নীচ তলায়। ব্যাপক ছাত্র এবং তরুণ সম্প্রদায়ের মধ্যে। অথচ আমি কখনই কোথায়ও সামনের সারির নেতা হই নি। কিন্তু এই যে প্রভাবটা সেখানে ছিল সেটা কেন? কারণ তাদের মধ্যে মার্কসবাদের বোঝাবুঝিটা ছিল না। বা থাকলেও নগণ্য। ওটা একটু ভালভাবে হবার পর আমি তাদের হারাতাম।

 

হাঁ, আমি আপনার এই প্রশ্নের উত্তরই দিচ্ছি, ‘মার্কসবাদ কিংবা কমিউনিজম সম্পর্কে যা বলেছেন তা না লিখলেই কি না?’

 

মার্কসবাদ কিংবা কমিউনিজমই কি তাদের ঐ জায়গায় নিয়ে যায় নি? বৃহৎ স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আসা মানুষগুলোকে কি ক্ষুদ্র মানুষে পরিণত করে নি? এটা আমি আমার কৈশোরের বন্ধু আমজাদকে দিয়েও খুব ভালভাবে অনুভব করি। বহু বহু জনকে দিয়েই অনুভব করি। তবু আমজাদের কথাটাই বলছি। বলছি, কারণ তাকে আমি তিল তিল করে গড়েছিলাম; কিংবা বলা উচিত গড়তে চেষ্টা করেছিলাম। ছেলেবেলায় তার যে গুণাবলী ছিল কমিউনিস্ট হবার পর সেগুলোর বিকাশ হয়েছিল না ক্ষয় হয়েছিল তার সাক্ষী আমার চেয়ে বেশী আর কে আছে?

 

যুদ্ধের পর আমি নিঃসংশয় হয়েছিলাম মার্কসবাদে এমন কোন ত্রুটি আছে যা প্রাথমিক একটা পর্যায়ে নেবার পর মানুষের মানুষ হিসাবে বিকাশ ঘটাবার পরিবর্তে, তার চিন্তাশক্তির বিকাশ ঘটাবার পরিবর্তে উল্টোটাই করে। আমার সৌভাগ্য যে, আমি মার্কসবাদী হতে চাইলেও আসলে তা ছিলাম না। আমার বিশ্বাসটা সমাজতন্ত্র পর্যন্তই ছিল। দ্বন্দ্বহীন বা শ্রেণী দ্বন্দ্বহীন কমিউনিজমকে ইউটোপিয়া বা কল্পস্বর্গ মনে হত। এ কথা আমার ‘আমার দৃষ্টিতে বাম-লীগ বিতর্ক ও রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’-এ বলেছি। মার্কসবাদ প্রকৃতপক্ষে আমার লক্ষ্যে পৌঁছবার, সমাজ ও রাষ্ট্র বিপ্লব করার হাতিয়ার ছিল। কিন্তু ১৯৭২-এর শুরুতেই আমি নিঃসংশয় হই যে, এই হাতিয়ার বা মতাদর্শ আমাদের বিপ্লবের জন্য অনুপযোগী এবং ক্ষতিকর। হাঁ, মার্কসবাদের সমালোচনাটা আমার জীবন থেকে উঠে আসা অভিজ্ঞতার ফল।’

 

আপনি বলছেন, ‘... আমার বিবেচনায় মার্কসবাদের ধারাবাহিকতা হিসাবে সে দর্শন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেই তা সহজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।’ প্রকৃতপক্ষে আপনি বলছেন মার্কসবাদের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে মার্কসবাদের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে। এটা হল ইসলামের ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে ইসলামের বদ্ধতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাওয়ার মত। সুফীরা একটা উদার ইসলামের ভিতর প্রথমে মানুষদের নিয়ে আসে। তারপর ক্রমে ঐ মানুষগুলো কার হয়? সুফীদের সৃজনশীল ইসলামের, নাকি ইসলামের প্রতিষ্ঠাতা প্রফেট মোহাম্মদের ইসলামের? কোর্‌আন-হাদীস থাকতে ইসলামের নূতন ব্যাখ্যা দিবে সুফীরা? ওটা কয়দিন টেকে? মার্কসবাদের নূতন ব্যাখ্যা দিব আমি! তাহলে মার্কসবাদীরা কি করতে বসে আছে? মার্কস-এঙ্গেলস-লেনিন থেকে শুরু করে মাও পর্যন্ত এক একটা অথরিটির কোটেশনে আমাকে অতীতের মতই ধরাশায়ী করবে না? তারপরেও অবশ্য বুদ্ধির জগতে নয়া মার্কসবাদী কিংবা আর কোন লেবেল এঁটে নিয়ে লড়াই চালানো যায়। কিন্তু আমার কাজ কি বুদ্ধির কচকচানি চালিয়ে এক খ্যাতিমান বুদ্ধিজীবী (!) কিংবা পণ্ডিত (!) হিসাবে আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করা, নাকি এই সমাজের পরিবর্তন এবং জাতির মুক্তির পথটা তৈরী করা?

 

ভাই! ও কাজটা করে বেড়াবার জন্য বহু মানুষ আছে। সারা পৃথিবীতেই আছে। মার্কসের নাম ভাঙ্গিয়ে যদি তারা নূতন বুদ্ধির চমক তৈরী করতে চায় তো করুক। আমার তাতে আপত্তি নেই। তবে আমার কথা হল আমি আমার সমস্ত জ্ঞান, বুদ্ধি এবং অভিজ্ঞতাকে নিজ জাতি, সমাজ ও দেশের মুক্তি ও কল্যাণে নিয়োজিত করব। মার্কসবাদ কতটা সঠিক আর কতটা বেঠিক এবং তা থেকে আমরা কতটা কি নিতে পারব সেসব নিয়ে আরও অনেকের মত আপনারও সঙ্গে তর্ক এবং আলোচনা কম করি নি। মার্কসবাদের মৌল দার্শনিক সমস্যা নিয়েও খুব সহজবোধ্যভাবে ‘মার্কসবাদের সংকট ও বিপ্লবের ভবিষ্যত’ গ্রন্থে আলোচনা করতে চেষ্টা করেছি, যার প্রকাশক তো আপনি নিজে। কাজেই ঐ এক প্যাচাল আর নাই বা পাড়লাম।

 

তবে আমি যে কথাটা বলতে চাই সেটা হচ্ছে দৃষ্টিটা নিজ দেশের দিকে ফেরানো দরকার। আমার পৃথিবীর কেন্দ্রটা ইউরোপ নয়, আমেরিকা নয়, এমন কি মার্কসের ইউরোপও নয়, যেমন নয় লেনিনের রাশিয়া কিংবা মাও-এর চীন। এটা বাঙ্গালী জাতির বাংলা। এখানে দাঁড়িয়ে আমি এ দেশের জন্য নিজস্ব তত্ত্ব চাই। এ দেশে দাঁড়িয়ে আমি আমার দৃষ্টিটাকে ক্রমে প্রসারিত করব বাইরের দিকে। প্রথমে আমার জাতি, দেশ ও জনগণ। তারপর ভারতবর্ষ। তারপর ইউরোপ এবং সারা পৃথিবীর দিকে প্রসারিত হবে সেটা।

 

আর পাণ্ডিত্যের কথা বলছেন? মার্কস-এঙ্গেল্‌স যত বড়ই পণ্ডিত হন তাঁদের চেয়ে আমি নিশ্চয় আমার সমাজ, জাতি ও দেশকে, তার সমস্যাগুলোকে অনেক অনেক বেশী ভাল বুঝি। এবং বাইরের যে কোন পণ্ডিত, জ্ঞানী এবং বিপ্লবী নেতার চেয়েও। আমার দেশের সমস্যা বোঝার জন্য নিশ্চয় আমি মার্কস থেকে শুরু করে সমস্ত পৃথিবীর জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নিতে চেষ্টা করব। কিন্তু কার কতটা নিব সেটা নির্ধারণ করব আমি অর্থাৎ আমরা। আমার কথা হল আমাদের নিজস্ব তত্ত্ব চাই। আমাদের দেশ, জাতি ও জনগণের মুক্তির জন্য আমাদের বিপ্লবের নিজস্ব তত্ত্ব চাই। এ দেশে যারা ইউরোপের জ্ঞানের ফেরীওয়ালা-বুদ্ধিজীবী তারা বুদ্ধির ব্যবসা করুক, নিজেদের মধ্যে বুদ্ধির কুস্তি লড়ুক এ কথা প্রমাণের জন্য যে, কে কত বড় পণ্ডিত অর্থাৎ ইউরোপ-আমেরিকা থেকে আসা জ্ঞানতত্ত্বকে কে কত বেশী বুঝেছে। ওসবে আমি কৌতুক বোধ করি মাত্র।

 

আর মাঠের কমিউনিস্ট? যারা পশ্চাৎপদ চিন্তা নিয়ে ততোধিক পশ্চাৎপদ জনতার মধ্যে পড়ে থেকে কলুর বলদের মত ঘানি ঠেলে চলেছে তাদের নিয়ে আমার আর মাথা ব্যথা নেই। তাদের ঐ একটাকেই আমি শ্রদ্ধা করি, সেটা হল নিষ্ঠা নিয়ে জনতার মধ্যে থাকা। কিন্তু শুধু তাতেই হবে? তাহলে নোয়াখালীর সেই মৌলবীরা কী দোষ করেছে যারা সারা জীবন দেশের বাড়ীতে বৌ-ছেলে-মেয়ে ফেলে রেখে ভিন জেলার অজপাড়াগাঁর মসজিদে ইমামতি করে জীবন কাটায়? ও কি শুধু পেশা? তার সঙ্গে তার ধর্ম চর্চা আছে না? ঐ ব্রতটাই তো সে এক জীবনে বেছে নিয়েছিল? তা, এমন ব্রতটার ফল দেশের অগ্রগমনে সহায়ক হয়েছে, নাকি ক্ষতিকর হয়েছে? অনেক অভিজ্ঞতায় বুঝেছি ঐ মাঠের কমিউনিস্টরা মার্কসবাদের যে গহ্বরে পড়েছে সেখান থেকে ওঠার ক্ষমতা তাদের নিজেদের আর নেই। যদি কোন দিন সেই শক্তি আমাদের হয় তবে হাত বাড়িয়ে দিব। যদি উঠে আসতে চায় এবং পারে ভাল। নতুবা ওখানেই পড়ে থেকে মরবে এবং পচবে। এমন কমিউনিস্টের সংখ্যা কি একেবারে কম যাদের বক্তব্য হল, ‘আমি কমিউনিস্ট হিসাবে মরতে চাই।’ তা, তাঁরা সেভাবেই মরুন না! আবার মার্কসবাদের বাতাবরণ তৈরী করে এই লোকগুলোর মানসিক পঙ্গুত্বের ব্যাধির জীবাণু সমস্ত সমাজে ছড়াবার কাজটা করব?

 

এক কালে নিশ্চয় এই লোকগুলোর একটা প্রগতিশীল ভূমিকা ছিল এক নিদারুণ পশ্চাৎপদ, ভাগ্যনির্ভর এবং অলোকবাদী ধর্মাচ্ছন্ন সমাজের ভিতরে একটা গতি সঞ্চারের জন্য। সেই কাজটা তারা যেটুকু হোক করেছিল। এবং করেছিল নিজেদের জীবন দিয়েই। সেটার জন্য তারা শ্রদ্ধেয়। এবং এ ক্ষেত্রে তাদের মতাদর্শ মার্কসবাদ ছিল হাতিয়ার। সেই সঙ্গে সোভিয়েত-চীন ছিল এই মতাদর্শের বাস্তব ভিত্তি, যা বিপুল শক্তি ও প্রেরণা যুগিয়েছিল একটা কালের ইতিহাসকে অনেক পথ অবিশ্বাস্য গতিতে অতিক্রম করায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ঐ মানুষগুলো যত মহৎ হোক সেটা সে কালের জন্যই। নিশ্চয় তাদেরও বহু সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি ছিল। সেটা একটা কালেরও সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি, একটা বিশেষ সমাজ বাস্তবতারও সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি। মার্কসবাদকেও দেখতে হবে একইভাবে। ওটাও এক সময় ও সমাজ বাস্তবতার অধীন, তার সীমাবদ্ধতা ও ত্রুটি ঐ সময় ও সমাজ বাস্তবতারই। আজ আমাদের দেশের বাস্তবতার উপর দাঁড়িয়ে আজকের যুগের এবং আমাদের জাতির সমস্যা এবং প্রয়োজনের নিরিখেই আমাদের সবকিছু মূল্যায়ন ও বিচার করা দরকার। এক কালে না হয় আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা বলতে প্রায় কিছু ছিল না। সুতরাং শুরুর জন্য একটা কিছুর দরকার ছিল। তা, অভিজ্ঞতা কি কম হল? ’৫২ থেকেও না হয় হিসাব করুন না একটু! আর মার্কসবাদ নিয়েও কি এ দেশে পরীক্ষা-নিরীক্ষা-চেষ্টা কম হয়েছে?

 

আপনার নিজের অভিজ্ঞতা কি বলে? মার্কসবাদী হিসাবে মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগের ফলটা কেমন বুঝছেন? না, এর একেবারে ফল নেই তা বলি না। একটা প্রয়োগে এতকাল থাকলেন। নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবীর চেয়ে নিশ্চয় সেটা ঢের ভাল এবং শ্রদ্ধেয়। এবং সেটা অন্ধ মার্কসবাদী বা কমিউনিস্টের চেয়েও। কিন্তু ভিন্ন কিছু করুন! ভিন্ন কিছু গড়ে তুলুন! আবার কমিউনিস্ট আর কমিউনিজম সম্পর্কে কখন মোহমুক্ত হলে বুদ্ধিসর্বস্ব পুথি বাগীশ হয়ে পড়েন না যেন! কিংবা মার্কসবাদের সৃজনশীল বিকাশ (!) ঘটাতে গিয়েও যেন তা না হন!

 

কিন্তু একটা প্রশ্ন আমি তুলব? তাহল ইউরোপের জ্ঞানতত্ত্বের প্রতি আমাদের এত মোহ এবং আনুগত্য কেন? তাহলে সাম্রাজ্যবাদ কি? সাম্রাজ্যবাদ কি শুধু পাউণ্ড-ডলার, যন্ত্র, জাহাজ, বিমান আর বন্দুকের মাথায় চেপে ঘোরাফেরা করে? মানুষের মাথার ভিতর, চেতনায় যে সাম্রাজ্যবাদ লুকিয়ে থাকে ওটাকে কি চিনতে হবে না? ইউরোপের জ্ঞাততত্ত্ব কি পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্য সম্প্রসারণের হাতিয়ার হয়ে নেই? বরং সহজে চেনা যায় না বলে এটাই সবচেয়ে বিপদজনক হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু পাশ্চাত্যের শুধু বুর্জোয়া জ্ঞানতত্ত্ব পাশ্চাত্যের আধিপত্যের হাতিয়ার? মার্কসবাদটা কি? ওটা কি পাশ্চাত্যের আধিপত্য বিস্তারের আর এক রূপ নয়? ওটা কি? ওটা হল ইউরোপের সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদী জ্ঞানতত্ত্ব। ইউরোপের জন্য তার যে ভূমিকাই থাক আমাদের জন্য তা-ই। আর এই কারণে আমাদের দেশের পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত সুযোগ-সুবিধাভোগী নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবীদের হাতে মার্কসবাদটাও এতকাল এক মস্ত হাতিয়ার হয়ে ছিল। ওটা কি বিপ্লবের জন্য? সমাজ পরিবর্তনের বাস্তব সংগ্রামের সঙ্গে, দেশের মাঠ ও মাটির মানুষের সঙ্গে যাদের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই তারা সমাজ বিপ্লবের জন্য ঐ তত্ত্ব ফেরী করে বেড়াত? ওটা ছিল তাদের কেতাবী বিপ্লবের হুমকি ঝেড়ে আর বুদ্ধির নূতন চমক সৃষ্টি করে নিজেদের ব্যক্তি প্রতিষ্ঠা আর সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টির হাতিয়ার।

 

এদের জন্যও তো এ দেশে মার্কসবাদ থেকে কিছু নিয়ে আর কিছু বাদ দিয়ে নিজেদের নিজস্ব জাতীয় বিপ্লবী জ্ঞানতত্ত্ব গড়ার উপায় ছিল না। সব তো কোর্‌আনে হাফেজ! যে মাটি থেকে জ্ঞানতত্ত্ব উঠে আসে সেই মাটির সঙ্গে বিন্দুমাত্র যোগ নেই, সেখান থেকে শিক্ষা নেবার বিন্দুমাত্র তাগিদ নেই, ঘরে বসে বই পড়া আর কোটেশন ঝাড়া, বিপ্লবের পথ নির্দেশ করা! তা এরাও মুৎসুদ্দি। পাশ্চাত্য জ্ঞানতত্ত্বের মুৎসুদ্দি। যাদের চেতনাই স্বাধীন নয়, পরাধীন, বিদেশ নির্ভর তারা মুৎসুদ্দি ছাড়া আর কি? একদল বুর্জোয়া মুৎসুদ্দি, আর একদল না হয় মার্কসবাদী মুৎসুদ্দি। সবই সাম্রাজ্যবাদের দালাল। একদল পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের, আর একদল সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের। তা, সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের পতনের পর মার্কসবাদী মুৎসুদ্দিদের বড় দুর্দিন চলছে! এখন আবার কেউ কেউ দুই জ্ঞানতত্ত্ব মিলিয়ে নূতন ককটেল বানিয়ে বাজারে ফেরী করার চেষ্টা করছে মার্কসবাদের নামে। আহা বেচারারা! তা করুক! একটা কিছু করে খেতে হবে তো!

 

এক সময় সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের এই জ্ঞানতত্ত্বই আমাদের জন্য কিছুটা হলেও দরকার ছিল। সেটা পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদের জ্ঞানতত্ত্বকে মোকাবিলা করার জন্য। কারণ আমাদের নিজস্ব উন্নত জ্ঞানতত্ত্ব ছিল না আধুনিক যুগের সূত্রপাতটা আমাদের জাতির পূর্বসূরিরা ঘটাতে পারে নি বলে।

 

আপনার মন্তব্য পড়ে আমার মনে হয়েছে মার্কসবাদ নিয়ে আপনার নিজের ভিতরই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাজ করছে এবং আপনার বক্তব্যেও স্ববিরোধ আছে। আপনি নিজেই আপনার এই বাক্য কয়টি দেখুনঃ ‘মার্কসবাদ কিংবা কমিউনিজম সম্পর্কে যা বলেছেন তা না লিখলেই কি না? মার্কসবাদের যাথার্থø বিচার করতে গিয়ে আপনি যা কিছু মন্তব্য করেছেন তাতে যুক্তির তুলনায় আরোপিত সিদ্ধান্ত বেশী বলেই মনে হয়েছে।’

 

‘সময় যেমন মার্কসবাদের অনেক তত্ত্বকে বাতিল করে দিয়েছে তেমনই নতুন সময়কে ব্যাখ্যা করে শূন্যের ওপর স্থাপন করলে সে দাঁড়াতে পারে না। তার জন্য অতীত লাগে, শেকড় লাগে।’

 

‘আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মার্কসের দ্বন্দ্বতত্ত্বের ওপর দাঁড়ালেও মার্কস তার জীবন কালে বিভিন্ন বিষয়ে যে সিদ্ধান্তে এসেছিলেন অনেক বিষয়ে সম্পূর্ণ তার বিপরীত সিদ্ধান্তে আসতে হবে। তার মধ্যে জাতীয়তাবাদ একটি।’

 

‘দর্শনের ক্ষেত্রে আমরা যে শূন্যের ওপর দাঁড়িয়ে আছি সে শূন্যস্থানটা পূরণ করতে হবে মার্কসবাদের ভ্রান্তিগুলিকে প্রত্যাখ্যান করে এবং নতুন তত্ত্ব নির্মাণ করে সে সীমাবদ্ধতাকে পূরণ করার মাধ্যমে।’

 

আমি মার্কসবাদের ভ্রান্তির দিকগুলো আলোচনা করেছি। সেটা আপনি সঠিক মনে করেন নি। এবং সে সবই আপনার কাছে যুক্তির তুলনায় আরোপিত মনে হয়েছে। কিন্তু আপনার উপরোক্ত বক্তব্যগুলোও কি মার্কসবাদের পক্ষে যাচ্ছে?

 

প্রকৃতপক্ষে আমার বইতে আমি মার্কসবাদের তাত্ত্বিক সূত্রের আলোচনা দিয়ে কিছুই শুরু করি নি।

 

কমিউনিস্টদের ভ্রান্তিগুলো আলোচনা করে সেগুলো কোন তাত্ত্বিক সূত্র থেকে উঠে এসেছে সেই আলোচনায় গেছি। আর তখন এসেছে মার্কসবাদের কতকগুলো মৌল সূত্রের বিশ্লেষণ। তবে আপনার মন্তব্যের উত্তরে এই আলোচনায় আমি যেভাবে আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে প্রাধান্য দিয়েছি সেটা সেখানে করি নি। সামগ্রিক রাজনৈতিক প্রয়োগের ভ্রান্তি ও সমস্যাগুলোর কারণ বের করতে গিয়ে মার্কসবাদের ভ্রান্তি ও সমস্যাগুলোকে সেখানে অর্থাৎ বইটাতে দেখাতে হয়েছে। এখন সেটাও যদি আরোপিত হয় তবে তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে, কতকগুলো কমিউনিস্ট নামধারী লোক শুধু নিজেদের কতকগুলো মনগড়া ধারণা কিংবা অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই ওসব করেছে যেগুলোর সঙ্গে মার্কসবাদের মৌল সূত্রগুলোর কোনই সম্পর্ক নেই? অর্থাৎ মার্কসবাদ ভাল, মার্কসবাদীরা খারাপ এই কি বলব? এ কি মার্কসবাদের ভ্রান্তি ও সীমাবদ্ধতা খুঁজে বের করার প্রকৃত চেষ্টাকেই থামিয়ে দিবে না? অথচ মার্কসবাদে ভ্রান্তি যে আছে সে কথা তো আপনি নিজেই বলছেন। তাহলে সেটা কোথায়, কিভাবে আছে তা কি খুঁজে দেখতে হবে না?

 

আপনার মন্তব্য পড়ার পর তার উত্তরে এই আলোচনা করতে গিয়ে আমার মনে হল আমার অভিজ্ঞতাটা আরও একটু খুলে আপনাকে বলা দরকার। কারণ অনেক আলোচনা তো আপনার সঙ্গে হয়েছে অনেক তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে। আমার কিছু তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও যতদূর জানি পড়েছেন। যেমন ‘মার্কসবাদের সঙ্কট ও বিপ্লবের ভবিষ্যত’। এবং এই বইটাতেও* খুব বেশী না হলেও কিছু বিশ্লেষণ ও ব্যাখ্যা করেছি। তারপরেও আপনি তত্ত্বের সীমাবদ্ধতার জায়গাগুলোতে হাত দেওয়া পছন্দ করছেন না কেন সেটা বোঝা কঠিন আমার পক্ষে। সেইজন্য আমি এবার আপনাকে আমার ব্যক্তিগত কিছু অভিজ্ঞতার কথা বললাম। হাঁ, এসব জীবনের কথা। কিন্তু তত্ত্ব কি জীবনের বাইরের কিছু? আমি কিন্তু শুধু আমার অধ্যয়ন দিয়ে নয় সেই সঙ্গে আমার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়েও তত্ত্বকে যাচাই করতে চেষ্টা করেছি। আমি জানি না আমার অভিজ্ঞতার কিছু বিবরণ যা আপনাকে বললাম তা আপনাকে তত্ত্বের প্রকৃত সঙ্কটের জায়গাগুলোকে অনুসন্ধানে আরও উৎসাহী করবে কি না। যাইহোক, আপনি জাতীয়তাবাদকে যে গুরুত্ব দিয়েছেন সেটাও কিন্তু দর্শন বা তত্ত্ব হিসাবে মার্কসবাদের মৌল কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। তবু ওটাকে কমিউনিজমের পথে একটা অন্তর্বর্তী পদক্ষেপ হিসাবে ব্যাখ্যা করে মার্কসবাদের কাঠামোতে তাকে কিছু সময়ের জন্য রাখার একটা চেষ্টা করা যায়। যদিও আমি মনে করি বাঙ্গালী জাতির ক্ষেত্রে লোকবাদী, সংহত ও সচেতন জাতি গঠনের কাজের যে গুরুত্ব তাকে মার্কসবাদের শ্রেণী সংগ্রাম এবং সর্বহারার একনায়কত্বের ধারণা নিদারুণভাবে খর্ব করে। কারণ মার্কসবাদের শ্রেণী সংগ্রাম মানলে জাতি গঠনের কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়া সম্ভব নয়। যদি সংহত জাতি থাকে তবে আপনি শ্রেণী সংগ্রামের ঐ ধারণা প্রয়োগ করতে পারেন। তাতে জাতি গঠনের কাজের ক্ষতি হয় না। কারণ কাজটা হয়েই আছে। কিন্তু বর্ণজাতিভেদ এবং চূড়ান্ত পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল বিভিন্ন ধর্মের কারণে অববিকশিত এবং অসংগঠিত, অচেতন, খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে থাকা জাতিসত্তাকে লোকবাদী, সংহত ও সচেতন জাতিতে পরিণত করার ক্ষেত্রে ঐ ধরনের শ্রেণীতত্ত্বের প্রয়োগটাই ক্ষতিকর। আর শ্রেণী সংগ্রামকে যদি প্রাধান্য বা অগ্রাধিকার না দেন তবে মার্কসবাদকে রাখবেন কিভাবে?

______________________________________________________________________

* ‘রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’- লেখক

______________________________________________________________________

 

ঠিক আছে, আপনি মার্কসবাদও করবেন আবার সংহত ও সচেতন জাতি গঠনও করবেন। তা, সেক্ষেত্রে মার্কসবাদী হিসাবে আপনার ভূমিকাটা কি হবে? তত্ত্বগতভাবে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেণী সংগ্রাম আর একনায়কত্বের রাজনীতি তো বাদ দিতে এমন কি গৌণ করতেও পারবেন না। সুতরাং ওটাই আপনার কাছে প্রধান হবে। ফলে অপ্রধান হবে জাতি গঠনের কাজ। অথচ আপনি বাস্তবে বুঝছেন বা মনে করছেন যে, জাতি গঠন এখনকার প্রধান কাজ। কিন্তু তত্ত্বগতভাবে আপনি শ্রেণী সংগ্রামকে গৌণ করে তা করতে পারেন না। করলে আপনার নৈতিক ও আদর্শিক সঙ্কট দেখা দিবে। ফলে যারা শ্রেণী সংগ্রামকে গৌণ ক’রে কিংবা বিরোধিতা ক’রে জাতি গঠনকে প্রধান করতে চাইবে আপনি তাদের সহায়ক শক্তি হিসাবে ভূমিকা পালন করে আপনার শ্রেণী রাজনীতি ঠিক রাখবেন। মানেটা হল আপনার ভূমিকা হবে লেজুড়বৃত্তিকারীর। এক কালের মস্কোপন্থী কমিউনিস্টদের মত। তাহলে ঠিক করুন জাতি গঠনে নেতৃত্বমূলক ভূমিকা পালন করবেন, নাকি সহায়ক ভূমিকা পালন করবেন সেটা। এবং সেই অনুযায়ী আপনার তত্ত্ব বা মতাদর্শ নির্ধারণ কিংবা নির্মাণ করুন।

 

পাকিস্তান কালে অর্থাৎ ষাটের দশকে মার্কসবাদ নিয়ে জাতি-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে আমরা কিন্তু এই সঙ্কটে পড়েছিলাম। আমরা জাতি-রাষ্ট্র গড়তে চেয়েছিলাম। কারা? ছাত্র-তরুণরা। যখন মার্কসবাদ রপ্ত হয় নি, সেই প্রাথমিক অবস্থায় এসেছিল জাতীয়তাবাদ। যখন মার্কসবাদ রপ্ত হল তখন প্রায় সবাই কমিউনিস্ট নেতৃত্ব দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। তবু বিশাল তরুণ প্রজন্মের দিক থেকে জাতীয়তাবাদের প্রবল চাপ ছিল। সেটা ছিল জাতির দিক থেকেও। সেটাকে পার্টির মধ্যে অন্তত আমি ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছিলাম। আমি যেটুকু পেরেছিলাম সেটুকু কিন্তু শ্রেণী সম্পর্কে মার্কসবাদের উৎপাদন সম্পর্ক আর উৎপাদন শক্তির দ্বন্দ্ব বহির্ভূত ধারণার কারণেও। কারণ আমার মনে হত জাতিটাই নিপীড়িত। সুতরাং শাসক জাতির বিপরীতে এটাও একটা শ্রেণী। মোট কথা শ্রেণী সম্পর্কে আমার ধারণা একরৈখিক এবং অর্থনীতিবাদী ছিল না। এবং এক পাথুরেও নয়। এই ধারণা নিয়ে যে, আমি সেকালে দাঁড়াতে পারতাম তা নয়। আর এর তাত্ত্বিক সমাধান তখনও আমার কাছে ছিল না। তবে পাকিস্তান ধ্বংসের এবং বাঙ্গালী জাতির মুক্তি ও লোকবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তাগিদটা এত প্রবল ছিল যে, তাত্ত্বিক জিজ্ঞাসা আমার গতিকে রোধ করতে পারে নি।

 

আর কৃষকের গুরুত্ব বুঝতাম। অগ্রণী শক্তি হিসাবে নয়। কিন্তু বিপ্লবে যে তার বিরাট ভূমিকা আছে তা বুঝতাম। কারণ তারা হল জনগোষ্ঠীর ব্যাপকতম অংশ, উৎপাদন শক্তির সর্বপ্রধান উৎস, এবং শোষিত। অর্থাৎ কৃষককে ভিত্তি করতে চেয়েছিলাম এবং তাদের নিয়ে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের রাজনৈতিক সংগ্রাম গড়তে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমার চেতনায় ছাত্র-যুবকরাই ছিল প্রধান নেতৃত্বকারী শক্তি। আমার মনে হয় সেকালের নেতাদের কেউ কেউ এখনও আমার এই বক্তব্য বা ধারণাগুলো স্মরণ করতে পারবেন। যেমন আমজাদ হোসেন, আলাউদ্দিন আহমদ।

 

যাইহোক, আমি চেয়েছিলাম বিপ্লবী পার্টি হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টি জাতি গঠনে নেতৃত্বকারী ভূমিকা লালন করুক। আমি চাইলে কি হবে? পার্টি সেটা চায় নি। কারণ পার্টি নেতৃত্ব ঠিকই বুঝেছিল যে, তাহলে মার্কসবাদ থাকে না। থাকলে সেটা থাকবে নাম কা ওয়াস্তে। সুতরাং আমাকে পেটি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী হিসাবে চিহ্নিত করত। তা পেটি বুর্জোয়া, বুর্জোয়া যা-ই বলুন মার্কসবাদ বহির্ভূত চেতনা আমার ভিতরে প্রবলভাবে ছিল বলে আমি ’৭১-এর জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ অনিবার্য করার ক্ষেত্রে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ দিতে পেরেছিলাম। এবং পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামো ধ্বংস হলে আমাকে মার্কসবাদের বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে হয়। যাইহোক, এখন পুনরায় আপনার কথায় ফিরি। আপনি উদ্বৃত্ত মূল্য তত্ত্ব প্রসঙ্গে মন্তব্য করেছেন, ‘মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বও বাতিল হয়ে গেছে। কিন্তু নতুন কিছু সেভাবে এখনও দাঁড়ায় নি।’

 

কী সর্বনাশ! মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্ব বাতিল হলে মার্কসবাদ তো দূরের কথা মার্কসই কি থাকেন? এঙ্গেলসকে বাদ দিলে মার্কসবাদ অন্তত একটা বিপ্লবী মতবাদ হিসাবে থাকে না। কিন্তু তবু মার্কস থাকেন। অর্থাৎ মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বটা থাকে। থাকে তাঁর বিশাল কীর্তি ‘পুঁজি’। এবং এই ‘পুঁজি’র নির্যাসটা তো ঐটা। উদ্বৃত্ত মূল্য সৃষ্টি না হলে শোষণ হবে কিভাবে? সে শোষণের রূপ যেমনই হোক। সেটা ব্যক্তি পুঁজিবাদী হতে পারে। সমাজতান্ত্রিক বা রাষ্ট্রীয় পুঁজিবাদীও হতে পারে। তা যা-ই হোক আপনি এর পরেও মার্কসবাদের নামটা ধরে রাখতে চাইছেন?

 

আমি কিন্তু আমার ‘মার্কসবাদের সংকট ও বিপ্লবের ভবিষ্যত’-এ মার্কসের উদ্বৃত্ত মূল্যের তত্ত্বকে বিরাট অবদান হিসাবে উল্লেখ করেছি। মার্কস এক বিরাট সামাজিক সত্যকে তাঁর পুঁজি দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করেছেন। কিন্তু আমার বক্তব্যটা কি? তা হল সমস্ত সভ্যতা এই শ্রম শোষণের উপর কোন না কোন ভাবে প্রতিষ্ঠিত। এবং আমি কি বলেছি? যতদিন সভ্যতা থাকবে, সামাজিক উৎপাদন হবে তত দিন শোষণ থাকবে। যেমন যতদিন সমাজ আছে ততদিন শাসনও আছে। আমার মার্কসবাদের প্রতি সমালোচনাটা এসেছে কিন্তু শাসন ও শোষণহীন সাম্যবাদের কল্পস্বর্গ রচনার জন্য। অর্থাৎ তার লক্ষ্যটাই ভ্রান্ত।

 

আমার বক্তব্য হল সমাজ বাস্তবতাকে মেনে নেওয়া। তা হলে আমরা তাকে একটা সহনীয় এবং পরিবর্তিত রূপে নিতে পারব। আমার ধারণা আপনাকে আবার সংক্ষেপে বলি। শ্রেণী এবং শ্রেণী দ্বন্দ্বের মধ্যে অর্থনীতি আছে। কিন্তু সেটাই সব নয়। ওর মধ্যে ক্ষমতাও আছে। আছে চেতনার ভূমিকাও, যদিও তা বস্তুনিরপেক্ষ নয়। আসলে সমাজবদ্ধ মানুষ যেমন ঐক্যবদ্ধ হয় তেমন দ্বন্দ্বেও লিপ্ত হয় নিজেদের মধ্যে। এই দ্বন্দ্বেরই একটা রূপ শ্রেণী দ্বন্দ্ব। আমি তো আমার বিভিন্ন লেখায় আমার এ সংক্রান্ত ধারণাটা আনার চেষ্টা করেছি। সুতরাং বিশদ ব্যাখ্যা দিব না। তবু সংক্ষেপে বলি শোষণ আছে এবং থাকবে। যতদিন উৎপাদন আছে ততদিন। শাসন আছে এবং থাকবে। যতদিন সমাজ আছে এবং থাকবে ততদিন। এখন এই বাস্তবতা মেনে নিলে আমরা কি করব? এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম বাদ দিব? আমরা বাদ দিলেই শাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে দ্বন্দ্ব থেমে থাকবে? না। ওটা চলবে। সুতরাং শ্রেণী সংগ্রাম চলবে। এবং শ্রেণীও এক ধরনের কাঠামো বা সত্তা নয়। বিভিন্ন রূপের সেটা। এবং এই রূপগুলোর বিজড়নও আছে। সুতরাং শ্রেণী সংগ্রামের বিভিন্ন রূপ যেমন থাকবে তেমন এই রূপগুলোর মধ্যে বিজড়নও ঘটবে।

 

এখন বিপ্লবী হিসাবে আামদের করণীয় হল সমাজে শাসন ও শোষণের যে চরম স্বৈরতান্ত্রিক, বর্বর ও পশ্চাৎপদ রূপ বিদ্যমান তার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে তার অবসান ঘটানো। এবং শাসন ও শোষণের মাধ্যমে যে সমাজিক ক্ষমতা এবং উৎপাদনের উদ্বৃত্ত সৃষ্টি ও কেন্দ্রীভূত হয় তা যাতে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে পুনরায় ফিরে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করা। কিন্তু সেখানে গিয়েও তা থেমে গেলে সব থেমে যাবে। ক্ষমতার কেন্দ্র না থাকায় সমাজ যেমন থাকবে না তেমন উদ্বৃত্ত উৎপাদন বা পুঁজি না থাকায় পুনরুৎপাদনও থেমে যাবে, ফলে উৎপাদন থাকবে না। সুতরাং এ এক অব্যাহত চক্র। এই চক্রে সমাজ-সভ্যতা আবর্তিত হয়ে এগিয়ে থাবে। তো এটা বুঝলে না এই চক্রকে একটা মানবিক রূপ দিতে পারা যাবে! কিন্তু সেটাও এক নিরন্তর সংগ্রামের কাজ। যাইহোক, আমার বক্তব্য হল মানুষ মানুষই। সুতরাং মানুষে মানুষে দ্বন্দ্বও থাকবে। আমাদের কাজ এই দ্বন্দ্বকে মানবিক প্রগতি ও কল্যাণের স্বার্থে ব্যবহার করা।

 

মার্কসবাদ শ্রেণী দ্বন্দ্বের অবসানের নামে এটাকে বিলুপ্ত বা বিনাশ করতে চেয়েছে। অথচ সেটা পারা যায় না। কারণ তাহলে মানুষের সামাজিক সম্পর্ক তথা সমাজকেই বিলুপ্ত করতে হয়। কাজেই আমাদের মোহমুক্ত হয়ে বিচার করা দরকার। মার্কসবাদের নামে এক বিশাল ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতাও কি হয় নি কমিউনিস্ট রাষ্ট্রগুলোতে? শ্রেণীহীন ও শ্রেণী দ্বন্দ্বহীন সমাজটাকে স্তালিন কিভাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন সোভিয়েত ইউনিয়নে? শ্রেণী দ্বন্দ্ব তো সামাজিক দ্বন্দ্ব বা মানবিক দ্বন্দ্বের একটা রূপ। সেই দ্বন্দ্বের অস্তিত্ব কমিউনিস্ট সমাজে অস্বীকার করতে হলে অমন বর্বরতারই আশ্রয় নিতে হয়। নিশ্চয় ঐ ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতারও মানুষের প্রয়োজন ছিল। তা না হলে মানুষের মোহমুক্তি ঘটত না। এবং সবচেয়ে বড় কথা মার্কসবাদ এবং মার্কসীয় সমাজ বিপ্লব মানব জাতির অগ্রগমনেও এক বিরাট ভূমিকা পালন করেছে। কিন্তু তার ভুল-ক্রুটিগুলোকে সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করব না কেন? আর তা করতে গিয়ে যদি তত্ত্বটার অনেক কিছু নিলেও তার কাঠামোটাকে বর্জন করতে হয় তবে সেটা কেন করব না?

 

আমার মনে হয়েছে মার্কসবাদ না মানলেও ঐ নাম বা পরিচয়টার প্রতি মোহই আপনি ছাড়তে পারছেন না। যেন সমাজ বিজ্ঞান কিংবা বিপ্লবী বিজ্ঞান আর মার্কসবাদ সমার্থক! কিন্তু বিজ্ঞান মানে কি নিউটনবাদ বা আইনস্টাইনবাদ? একবার বিজ্ঞানকে নিউটনবাদ কিংবা আইনস্টাইনবাদ নাম দিলে কি আর বিজ্ঞানের এগিয়ে যাবার সাধ্য হত? পৃথিবীর তাবৎ শাস্ত্রকাররা কি নিউটন কিংবা আইনস্টাইনের সূত্রগুলোকে পাহারা দিয়ে বিজ্ঞানের অগ্রগমনকে অসম্ভব করত না? অবশ্য মুখে বলত সৃজনশীল প্রয়োগ করতে হবে।

 

তা, মার্কসবাদের সৃজনশীল প্রয়োগ করতে গিয়ে কি দেখি নি কি অবস্থা হত? রাশি রাশি উদ্ধৃতি আর সূত্র হাজির হত। আর সেগুলো দিয়ে প্রমাণ করা হত আমার চিন্তাগুলো পেটি বুর্জোয়া, জাতীয়তাবাদী, আরও কত কি! তখন কিন্তু তাদের সৃজনশীলতা থাকত না। অথচ তখনও তারা বলত তাদেরটাই সৃজনশীলতা। আর আমারটা বিচুøতি, সুবিধাবাদ। আর এই রকম তাত্ত্বিক কাঠামোর ভিতর নিজের চিন্তাকে রাখতে গিয়ে আমিও কি কম আত্মদ্বন্দ্বে ভুগতাম? ঐ তাত্ত্বিক ও সাংগঠনিক কাঠামোর সঙ্গে সঙ্গতি রাখতে গিয়ে আমার মধ্যে শুধু যে দ্বন্দ্ব থাকত তাই নয়, আমি নিজেও অনেক ভুল করেছিলাম। যতদিন আমি পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিই নি ততদিন আমি ছিলাম প্রকৃতপক্ষে এক স্বাধীন মানুষ। ফলে আমার নিজ চিন্তাগুলোকে মার্কসবাদের নামে হোক আর কোন নাম না দিয়ে হোক চালাতে পারতাম, ব্যাখ্যা করতে পারতাম। হাঁ, ততদিন পর্যন্ত আমার চিন্তা ছিল অনেক বেশী স্বচ্ছ, ধারালো। এবং কর্মের ক্ষেত্রেও আমি ছিলাম প্রচণ্ড গতিশীল। কিন্তু ১৯৬৯ থেকে আমার কী দশা হয়েছিল তা কি আমি জানি না বা আমার মনে নেই?

 

অবশ্য মার্কস নামে কোন ব্যক্তি যদি না থাকতেন কিংবা তাঁর লেখাগুলো যদি না থাকত তবে আমি সমাজ বিপ্লবের তত্ত্ব বা বিজ্ঞান কিংবা সমাজ বিজ্ঞানের নাম মার্কসবাদ বলতে আপত্তি করতাম না। কারণ তখন যার যেমন অভিজ্ঞতা, প্রয়োজন ও দৃষ্টিভঙ্গী অনুযায়ী তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রয়োগ করা যেত। যেমন গণতন্ত্র কিংবা সমাজতন্ত্র শব্দ নিয়ে আমার আপত্তি নেই। কারণ তার ব্যাখ্যা ও প্রয়োগ যার যার নিজ সমাজ বাস্তবতা অনুযায়ী হতে পারে। আপত্তি ঐ মার্কসবাদ নামটা ব্যবহারেই।

 

কিন্তু আপনি নিজেই আরও এমন কতকগুলো মন্তব্য করেছেন যেগুলো মার্কসবাদকে নিদারুণভাবে নাকচ করে। যেমন ধরুন আপনি বলছেন, ‘লেনিন নিজেই দিশা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দর্শন আসবে শ্রমিক শ্রেণীর বাইরে থেকে এ কথা বলে এক রকম তত্ত্বটাকে মানানসই করেছেন।’ হাঁ, লেনিন কাউৎস্কির বক্তব্যটা গ্রহণ করেছিলেন। আর ওখানেই লেনিন মার্কসবাদ থেকে সরেছিলেন। সরেছিলেন বলেই তিনি বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের নামে একটা রাজনৈতিক-আমলাতান্ত্রিক রাষ্ট্রের গোড়াপত্তন করে যেতে পেরেছিলেন। অর্থাৎ শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে আর কুলায় নি। শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের উৎকল্পনা বা ইউটোপিয়াকে বাস্তব ভিত্তি দিতে হয়েছে শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী হিসাবে কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্ব হাজির করে। হাঁ, লেনিনই প্রথম মার্কসবাদকে একটা সফল সমাজ বিপ্লবের জন্য হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন। সেটা পেরেছিলেন মার্কসবাদের অনেক কিছুকে নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী ছাটাই-বাছাই করে গ্রহণ-বর্জন করতে পারার ফলে। কিন্তু একটা ইউটোপিয়া দিয়ে আর কত দূর হতে পারে? তবু পৃথিবীর ইতিহাসে সোভিয়েতের অবদান কম নয়। ঐ বিপ্লব হয়েছিল বলেও মানব জাতি এতদূর পথ আসতে পেরেছে এভাবে, এত দ্রুত। কিন্তু ইউটোপিয়া নিয়ে আর কত দিন?

 

আপনি লেনিনের কথাটা বলে পরের বাক্যে বলছেন, ‘আজকের যুগে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিতে উৎপাদন সম্পর্কের বিমূর্ততাই তার শ্রেষ্ঠত্বকে অবদমিত করেছে, ফলে আদর্শই হয়ে উঠেছে যে কোন আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি।’ ‘তার শ্রেষ্ঠত্ব’ বলতে শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেষ্ঠত্ব তাই তো! এখন উৎপাদন সম্পর্কের বিমূর্ততার কারণেও যদি ধরে নেওয়া যায় যে, শ্রমিক শ্রেণীর শ্রেষ্ঠত্ব অবদমিত হয়েছে তা হলে মার্কসবাদও কি অবদমিত হয় না? শ্রমিক শ্রেণীর বস্তুগত শ্রেষ্ঠত্ব যদি না থাকল তবে তার শ্রেণী নেতৃত্ব আসবে কিভাবে? আর তার একনায়কত্বের ভিত্তিটাও বা থাকে কিভাবে? সর্বহারার একনায়কত্বের ধারণা ছাড়া তত্ত্ব বা মতবাদ হিসাবে যে, মার্কসবাদের অস্তিত্ব থাকে না এটা বোঝার জন্য কিন্তু মার্কসবাদ সম্পর্কে খুব প্রাথমিক ধারণাই যথেষ্ট। কারণ এই একনায়কত্বের মাধ্যমে তা কমিউনিজমে পৌঁছায়। আর কমিউনিজমের লক্ষ্যটাই কি মার্কসবাদের সমগ্র দর্শন ও কর্মকাণ্ডের অভিমুখ নয়?

 

আর আপনি প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদের শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বের তত্ত্ব ও ভূমিকাকেই নাকচ করে বলছেন ‘ফলে আদর্শই হয়ে উঠেছে যে কোন আন্দোলনের নিয়ামক শক্তি।’ আসলে এটা আজকে হয়ে ওঠে নি, বরং চিরকালই হয়ে থেকেছে। এবং আর দশটা আদর্শের কত মার্কসবাদও একটা আদর্শ। মার্কসবাদের লক্ষ্যটা হল কমিউনিজম। কিন্তু এই লক্ষ্যকে অনিবার্য প্রমাণ করতে চেয়ে উৎপাদন শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্বের সূত্র উপস্থিত করা হয়। এইভাবে সমস্ত সমাজ বাস্তবতা ও চেতনাকে অর্থনীতির অধীনে আনয়ন করতে চাওয়া হয়। গোলমালটা এই জায়গায়।

 

কিন্তু যে কোন সামাজিক আদর্শের মত মার্কসবাদ শুধু শ্রেণী বা অর্থনীতির নয়, উপরন্তু তার ঊর্ধ্বেরও অর্থাৎ সমাজেরও একটা আদর্শ। অথচ এটাকেই তা অস্বীকার করে উৎপাদন শক্তি আর সম্পর্কের তত্ত্ব দ্বারা। প্রকৃতপক্ষে মার্কসবাদ শ্রেণী চেতনা নয়, এটা একটা সামাজিক চেতনা। অর্থাৎ এর মর্মে আছে মানুষ, সামাজিক মানুষ; যে মানুষ ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চায়, যার ফলে শোষণ ও শাসন উচ্ছেদ হবে বলে তা মনে করে। কিন্তু তাতে বাস্তবে শোষণ এবং শাসনের ব্যক্তি পুঁজিবাদী রূপের অবসান হয় মাত্র, আর সর্বহারার একনায়কত্বের নামে ঐ মানুষের নূতন ধরনের একনায়কত্বিক শোষণ এবং শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। হয়ত ঐ মানুষের আকাঙ্খায় এই শোষণ এবং শাসন প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য থাকে না, কিন্তু বাস্তবে তা-ই হয়। সুতরাং শ্রমিক বা নিপীড়িতের বেদনা এবং মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও সংগ্রামকে ধারণ করলেও তা শ্রেণীগতভাবে শ্রমিকের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সব ধরনের কর্তৃত্বকে বিলুপ্ত করতে পারে না। কর্তৃত্ব রয়েই যায়। কর্তৃত্বকারী মানুষগুলোর পরিবর্তন হয় মাত্র, যার শীর্ষে থাকে তার একনায়কত্ব। কিংবা তার আকাঙ্ক্ষা ও চেতনার একনায়কত্ব। কিন্তু ব্যক্তির অর্থনৈতিক ভিত্তি বিলোপ এবং একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার ফলে গণতান্ত্রিক কর্তৃত্বের তুলনায় এ হয় আরও ভয়ানক নিপীড়নকারী। কমিউনিজম আর হয় না। কারণ ওটা হবার নয়।

 

মার্কসবাদ প্রায়োগিকভাবে ইউটোপিয়া। কারণ তা শুধু শ্রমিকের নেতৃত্বেই একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করার কথা বলে। লেনিনবাদ তুলনায় ব্যবহারিক। কারণ তা জানে যে, শ্রমিকের নেতৃত্বে সেটা হয় না। সুতরাং ঐ মতবাদে বিশ্বাসী এবং শ্রমিকের সঙ্গে সংযুক্ত শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী স্বরূপ পার্টির তত্ত্ব দিয়েই ঐ পার্টির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার সফল কর্মপদ্ধতি দিতে পেরেছে।

 

আমি ছাত্র-যুব শক্তির নেতৃত্বমূলক ভূমিকার উপর জোর দিয়েছি। কিন্তু সেটাও তার একনায়কত্ব এমন কি একক নেতৃত্ব হিসাবে নয় । যাইহোক, সমাজ পরিবর্তনে যুবশক্তির যে অপরিমেয় ভূমিকা তাকে আপনিও চিহ্নিত করেছেন। কিন্তু যুব শক্তির ভূমিকাকে কি শুধু উৎপাদন শক্তি আর উৎপাদন সম্পর্কের দ্বন্দ্ব সূত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? যদিও আমি মনে করি যে, মার্কসের এই সূত্রেও একটা সত্য আছে। তাবে সেটা চেতনার ভুমিকা বাদ দিয়ে নয়। আর ঐ চেতনা শুধু ঐ দ্বন্দ্বের সূত্রে আবদ্ধ কিংবা নিহিত নয়। যাইহোক, যুব শক্তির প্রসঙ্গেই বলি মার্কসবাদের কোন্‌ সূত্র দিয়ে তার ভূমিকাকে যৌক্তিকতা দিবেন? সর্বহারা বা শ্রমিক শ্রেণীর অগ্রবাহিনী বলবেন? সেটা তো আপনি পার্টিকে বলতে পারেন, যা এক দৃঢ়বদ্ধ সামরিক শৃঙ্খলার রাজনৈতিক রূপ। যুব শক্তিকে কি এমন কোন কাঠামোতে ফেলা যায়? আর ফেললে তার বহুমুখিতা, বিভিন্নতা, বৈচিত্র্যময় সৃজনশীলতাকে সেখানে ধারণ করবেন কিভাবে? আমার ধারণা আমাদের দেশে উৎপাদন শক্তি ও সম্পর্কের পশ্চাৎপদতার সঙ্গে অগ্রগামী সমাজ চেতনার অব্যাহত দ্বন্দ্ব, সমন্বয় ও মিথষ্ত্র্নিয়ার মধ্য দিয়ে সৃষ্ট সমাজের উৎক্ষিপ্ত লাভাস্রোতের তারা সবচেয়ে স্পর্শকাতর জ্বালামুখ। একটা বিপ্লবী পার্টি এই বাস্তবতাকে একটা নির্দিষ্ট গতিধারা ও অভিমুখ দিতে চেয়ে যুব শক্তির নেতৃত্বকারী অংশটাকে ধারণ করার পদ্ধতি দিতে পারে।

 

কিন্তু আমি যে কথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলব সেটা হল মানুষ শুধু কতকগুলো অর্থনৈতিক নিয়মের যোগফল নয়। অর্থনৈতিক নিয়ম বাদে সামাজিক মানুষ নেই। কিন্তু অর্থনৈতিক নিয়মের বাইরেও সমাজের আরও অনেক নিয়ম আছে যেগুলোর গুরুত্ব অর্থনৈতিক নিয়মের চেয়ে কম নয়, এমন কি অনেক ক্ষেত্রেই যেগুলো অর্থনৈতিক নিয়মকেও অধীনস্থ বা গৌণ করে। আসলে অর্থনীতির বাইরেও মানুষের এক স্বতন্ত্র সত্তা আছে। মানুষের চেতনা বা মন শুধু অর্থনৈতিক নয় আরও অনেক বস্তুগত নিয়মকে ধারণ করেও সেগুলোরও ঊর্ধ্বের হয়ে উঠতে পারে। বলুন, মানুষের আদি সম্পর্ক নারী-পুরুষের সম্পর্কটা কোন্‌ উৎপাদন সম্পর্ক আর উৎপাদন শক্তির দ্বন্দ্ব দিয়ে ব্যাখ্যা করবেন? কিংবা মানুষ যে এক প্রেমের স্মৃতি ধারণ করে আরও বহু প্রেম থেকে নিজেকে বঞ্চিত করতে পারে, বৃহত্তর স্বপ্ন, কল্পনা, আদর্শের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিতে কিংবা অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দিতে পারে একি শুধু অর্থনীতি কিংবা ক্ষমতার স্থূল নিয়ম দিয়ে ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

 

মার্কসবাদ যত অধিকাঠামো বা Superstructure-এর গুরুত্বের কথা বলুক, কলাশিল্প ও সাহিত্যের কথা বলুক, আদর্শের গুরুত্বের কথা বলুক সব কিছুর উদ্ভব ও বিকাশের ভিত্তি তথা অবকাঠামো বা Infrastructure হিসাবে শ্রেণী সংগ্রাম আর উৎপাদন শক্তির বিকাশের জন্য যন্ত্র শিল্পের সাধনাকে ঐভাবে উপস্থিত করে তার অনুসারীদের শেষ পর্যন্ত যন্ত্র মানুষে পরিণত করে। মনের সাধনা না থাকলে মনের বিকাশ হবে কি করে? শুধু শ্রেণী সংগ্রাম আর শিল্পায়ন দিয়ে মার্কসবাদ মানুষের চেতনাকে যে জায়গায় নামায় তার জন্য শুধু মানুষকে দোষ দিবেন? তাহলে স্থূল পুঁজিবাদের দোষ কি? সেটাও তো শেখায় শুধু পণ্য উৎপাদন আর পণ্য ভোগবাদ।

 

পাশ্চাত্য পুঁজিবাদ আর কমিউনিজম উভয়ই আমাদের উপর উন্নয়নের অর্থনীতিবাদী দৃষ্টিভঙ্গীটাই চাপিয়ে দিতে চাইছে। শুধু পদ্ধতিটা ভিন্ন। কিন্তু মূল উৎসটা এক। এক সময় ওগুলোরও একটা প্রয়োজন কিংবা ভূমিকা ছিল। কিন্তু ও নিয়ে আর কতদিন? আমরা কি আমাদের নিজস্ব বিকাশ ও উন্নয়নের পথ নির্মাণ করব না? আপনি বলছেন, ‘বিদ্যমান বিশ্বের আদর্শের সংকটকে পূরণ করতে পারে একটি নব্য দর্শন, আমার বিবেচনায় মার্কসবাদের ধারাবাহিকতা হিসাবে সে দর্শন প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলেই তা সহজে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হবে।’ হাঁ, নব্য দর্শনই আমি চাইছি। কিন্তু সেটাকে কেন মার্কসবাদের ধারাবাহিকতা হতে হবে? এটা ঠিক যে, মার্কসবাদে অনেক ভাল জিনিস আছে। সেগুলো নিব বৈ কি! তার মধ্যকার শ্রেণী সংগ্রামের ধারণা নিব, যদিও এটা মার্কস বা এঙ্গেলসের আবিষ্কার নয়। বস্তুবাদ ও দ্বান্দ্বিকতার ধারণা নিব। অর্থনীতিকে ব্যাখ্যা করার জন্য কিছু অর্থনৈতিক সূত্রও নিব। জনগণকে সংগঠিত করার জন্য মার্কসবাদ এবং মার্কসবাদীরা যে সব পদ্ধতি গড়ে তুলেছে সেগুলো থেকেও অনেক কিছু নিব। কিন্তু সবই নিব আমাদের প্রয়োজনে এবং আমাদের মত করে। তাহলে মার্কসবাদের ধারাবাহিকতা বলতে হবে কেন?

 

হাঁ, এক অর্থে ধারাবাহিকতা। কিন্তু শুধু মার্কসবাদের কেন? আরও অনেক কিছুর। মার্কসবাদকে আমাদের একটা উত্তরাধিকার হিসাবে বলব। কিন্তু সেই সঙ্গে তার সমালোচনাও রাখব। আমার বইটাতে কিন্তু সেভাবে আনতে চেয়েছি।

 

আসলে মার্কসবাদ বললে একটা কাঠামো বা frame উপস্থিত হয়। এটা না বুঝলে বারবার একই ফাঁদে পড়তে হবে। আর উত্তরাধিকারের কথা বলছেন! সেই উত্তরাধিকার কি আমার নেই? এমন কি বিগত পঁচিশ বৎসর আমি কমিউনিস্ট আন্দোলনের বাইরে থেকেও তার সঙ্গে যে দ্বন্দ্বমূলক সম্পর্কের মধ্য দিয়ে এসেছি তার ধরন কি অন্যদের মত? যারা মার্কসবাদ ও কমিউনিস্ট আন্দোলন পরিত্যাগ করেছে তাদের সঙ্গে কি আমার জীবনের ইতিহাসটাকে মেলানো যায়? আমার প্রতি কমিউনিস্টদের অমন সব আচরণের পরেও এই সুদীর্ঘ সময় তাদেরকে কিভাবে নূতন চেতনায় টেনে নিতে চেষ্টা করেছি সে কি কিছু হলেও আপনার জানা নেই? তাদের শত্রুরা তাদের যেভাবে দেখেছে আমি কি তাদেরকে সেভাবে দেখেছি? অথচ তারা কি আমার কম শত্রুতা বা বিরোধিতা করেছিল বা করেছে? আমি কি আমার অতীত মার্কসবাদী বিপ্লবী ঐতিহ্য নিয়ে গর্বও করি না, যদিও তার সঙ্কটের দিকটাও বলি? হাঁ, তারপরেও অনেক কাল থেকে বলছি আমাদের সমাজ বিপ্লবের নূতন তত্ত্ব, নূতন আদর্শ চাই। ফলে অতীত উত্তরাধিকারের অনেক কিছু ধারণ করলেও সেই উত্তরাধিকারের অনেক কিছুর সঙ্গে একটা ছেদও চাই।

 

এখন আমি ছেদের কাজটাকেই গুরুত্ব দিচ্ছি। সুতরাং সমালোচনা এবং বিরোধের দিককেই প্রধান করব এবং করছিও। তা না হলে সমাজ বিপ্লবের নূতন আদর্শ দাঁড়াবে না।

 

আর মার্কসবাদকে অস্বীকার করে দাঁড়াতে পারব না? আমি বিগত পঁচিশ বৎসর সময়কালে যে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করেছি সেগুলো কিন্তু মার্কসবাদকে অস্বীকার করেই। অন্যান্য কাজের কথা থাক। ’৮০-এর দশকে বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের কথাটাই বলি। আপনি তো জানেন জেনারেল এরশাদের সামরিক রাজনীতির বিরুদ্ধে বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ধারণাটা আমি বাংলাদেশ রাষ্ট্রে শুধু যে প্রথম প্রবর্তন করি তাই নয়, উপরন্তু সেটাকে একটা গণ-আন্দোলনের পরিণতির দিকেও এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হই। এর জন্য আমাকে মার্কসবাদ বা কমিউনিস্ট পার্টি করতে হয় নি। তা সত্ত্বেও এক কালের পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টির মূল তাত্ত্বিক নেতা আলাউদ্দিন আহমদ যিনি ছিলেন সে কালে আমার প্রবল বৈরী তিনিই কিন্তু ১৯৮২-’৮৩-এর ঐ দিনগুলোতে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলন গড়ে তোলায় আমাকে সবচেয়ে বেশী সহায়তা দিয়েছিলেন। অথচ সেই সময় আমি কমিউনিস্ট পার্টি তো দূরের কথা কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত নই। এই ঘটনার উল্লেখ তো আমার ‘আমার দৃষ্টিতে বাম-লীগ বিতর্ক ও রাজনীতির পুনর্বিন্যাস’ বইতে করেছি। আলাউদ্দিন ভাই তো তখন জানতেন যে, আমি মার্কসবাদের কঠোর সমালোচক। এবং সমস্ত কমিউনিস্টরাই জানত। তারপরেও তারাই কিন্তু আমাকে ঐ আন্দোলনে গড়ে তোলায় সহযোগিতা দেয় অনেক দিন পর্যন্ত।

 

একটা ইসলামী সমাজে সামরিক রাজনীতির বিরুদ্ধে বেসামরিক তত্ত্বাবধায়ক সরকার আন্দোলনের রাজনীতির যুগান্তকারী তাৎপর্যটা তো আপনার বুঝতে না পারার কথা নয়। হাঁ, এই কাজ আমি করেছি মার্কসবাদের ধারাবাহিকতায় ছেদ ঘটিয়েই। মার্কসবাদে আমার বিশ্বাস নেই এ কথা বলে। এবং তার ভুলগুলো বলেই। অনেক সময়ে মার্কসবাদের সূত্রগুলোর উপর তর্ক করেই। তারপরেও কিন্তু আমি কমিউনিস্টসহ অনেকেরই অন্তত ঐ আন্দোলনের প্রশ্নে অমন সহযোগিতা পেয়েছিলাম সেই সময়টাতে।

 

হাঁ, মার্কসবাদের ভিতরকার অনেক কিছু নিলেও তাকে বর্জন করেই তার বাইরে এক নূতন আদর্শ গড়ে তোলার কাজ আমি করছি। এটা করছি আমার মেধা দিয়ে, শ্রম দিয়ে, জীবন দিয়ে। আর এই জীবন দিয়ে করাটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আমার জীবনের একটা মৌল নীতি হল আপনি আচরি ধর্ম পরকে শেখাও। মতাদর্শ কি জীবনের সাধনা ও সংগ্রামের বাইরের কিছু? অমন মতাদর্শ তো নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবীদের ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের মতলবী হাতিয়ার। ঐ নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবীরা যারা এই সমাজের শূদ্র-ব্রাহ্মণ-বান্দা বুদ্ধিবৃত্তির আধুনিক প্রতিনিধি তাদের এতটুকু মূল্য ও মর্যাদা আমার কাছে নেই।

 

আমি বিশ্বাস করি আদর্শ গড়ে ওঠে জীবনাচরণের মধ্য দিয়ে, সংগ্রামের মধ্য দিয়ে। নব্য দর্শন প্রতিষ্ঠার কোন সহজ পথ কি আছে? যে সুদীর্ঘ এবং সুকঠিন পথ ধরে আমি আজ এখানে এসে পৌঁছেছি সেটা সম্ভব হয়েছে কিন্তু সহজ পথ নয় বরং সঠিক পথ সন্ধান থেকে। আমার জীবন দিয়ে আমি বুঝেছি বিরাট সত্যের জন্য, বিরাট মুক্তির জন্য সহজ কোন পথ নেই। দুঃখ-কষ্টের পরীক্ষা অনেক অনেক অনেক দিয়েছি। এখনও দিচ্ছি। প্রয়োজনে আরও দিব। এবং আমি জানি দুঃখ-কষ্টকে ভয় পাই নি বলেই আমার জীবনের অর্জনও কম নয়। হয়ত বস্তুগত অর্জন আপাত দৃষ্টিতে কিছু নেই। হয়ত প্রচার নেই, প্রকাশ নেই, প্রতিষ্ঠা নেই, স্বীকৃতি নেই। কিন্তু ওসবের জন্য সব সময় ব্যগ্র হতে নেই। তাতে ওসবের চাপে লক্ষ্যটাই হারিয়ে যায়। সবাই না জানুক আমি তো নিজে জানি আমি কী করেছি! নিজের কাছে জবাবদিহিতাই তো সবচেয়ে বড়। এই রকম এক জাতির অগ্রগমনে এতটা ভূমিকা পালন করতে পারার তৃপ্তি এবং গৌরববোধ কি কম আমার ভিতর? কিন্তু এসবই তো একটা লক্ষ্যে জাতি ও সমাজকে নিয়ে যাবার জন্য। যেদিন সেখানে নিয়ে যেতে পারব সেদিন বুঝব আমার কাজ সম্পূর্ণ হয়েছে। সেই লক্ষ্য আজও অনেক দূর। অর্থাৎ সংগ্রামের আরও অনেক দূর পথ আমাকে পাড়ি দিতে হবে। আর তত্ত্ব বলুন, আদর্শ বলুন, তৈরী হবে ঐ সংগ্রামের ভিতর দিয়েই। ওটা নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবীর পুথি পাঠে আর তত্ত্বের নিষ্ফলা বিতর্কে তৈরী হয় না।

 

না, আমার চিন্তাকে মার্কসবাদের ধারাবাহিকতা বলব না। কারণ সেটা হবে অসত্য। সেটাকে বড় জোর বলতে পারেন মার্কসবাদ থেকে উত্তরণ। আমি নিজেকে যখন মার্কসবাদের সন্তান বলি, তখন তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে, আমি শুধু মার্কসবাদের কোষে তৈরী? সন্তান শুধু কি তার পিতার কোষে তৈরী? অথবা শুধু মাতার কোষে? আবার সে কি শুধু দুই কোষে জোড়া লাগানো জীব? না, সে নূতন সৃষ্টি। হুবহু সে কারও নয়। হুবহু সে দুইজনের যোগফলও নয়। সে নূতন। পুরাতন জীবনের উত্তরাধিকার নিয়েও সে নূতন, সে ভিন্ন।

 

আর উত্তরাধিকার আমি যতটা বাইরে খুঁজব আর চেয়ে অনেক বেশী খঁুজব দেশের ভিতর, নিজ মাটি ও জাতির ভিতর। হাঁ, এখন আমার কাছে জাতীয়তাবাদ প্রধান। আগে নিজ জাতি। তারপর ভিন্ন জাতি। নিজের দাঁড়াবার জায়গা ঠিক না করে ঐ কমিউনিস্টদের মত পরের জায়গায় আশ্রয় খঁুজব? একবার সোভিয়েত ইউনিয়ন, একবার চীন! আবদুল হকরা তো দু’টোই হারিয়ে শেষে আলবেনিয়া পর্যন্ত দৌড়াল। তারপর কী হল? না, আমি জানি আমাকে দাঁড়াতে হলে এই বাঙ্গালী জাতির জমিতেই দাঁড়াতে হবে। এখানে শক্ত পায়ে দাঁড়াতে পারলে পাশ্চাত্য অথবা পৃথিবীর সব মতবাদ আর জ্ঞানতত্ত্বের আক্রমণকেই মোকাবিলা এবং পরাস্ত করতে পারব। ভিয়েতনামীরা যে পৃথিবীর অত বড় পরাশক্তি ফ্রান্স আর আমেরিকাকে পরাস্ত করল সে কি নিজ মাটিতে দাঁড়িয়ে নয়? ফ্রান্স আর আমেরিকায় অভিযান চালাতে গেলে কি তারা জিততে পারত? বলতে পারেন ওটা ছিল সশস্ত্র যুদ্ধ। তা, মতাদর্শের যুদ্ধটাও তো যুদ্ধ। এই যুদ্ধটা নিজ মাটিতে দাঁড়িয়ে অর্থাৎ নিজ দেশের অভিজ্ঞতা ও প্রয়োজনের ভিত্তিতে গড়ে তোলা মতাদর্শ নিয়ে করতে পারলে হারার কোন ভয় নেই। একা হয়ে যাবার ভয়? যার শক্তি থাকে, সেটা তত্ত্ব বা মতাদর্শও হতে পারে, তার মিত্রও জোটে। যেটা জাতীয় হতে জানে সেটা আন্তর্জাতিকও হতে জানে।

 

পরের বুদ্ধি ধার করে তো অনেক যুগ নিজেদের পথ তৈরীর চেষ্টা করলাম। তার ফলটা কি? তা, এক কালে সেটারও একটা প্রয়োজন ছিল। আধুনিক কালের বিপ্লবী জ্ঞানতত্ত্ব যাদের একেবারে জানা ছিল না তাদের প্রাথমিক শিক্ষার জন্য তার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা আর কত কাল? আমরা কি গল্পের আদু ভাই-এর মত চিরকাল এক ক্লাসেই পড়ে থাকব? আমরা কি চিরকালই নাবালক থাকব? সাবালক হব না? নিজস্ব জ্ঞানতত্ত্ব গড়ার সাহস থাকবে না কেন? হাঁ, ঐ সাহস আমার আছে। ওটা অর্জন করেছি নিজ জীবন দিয়ে। হাঁ, শিকড় লাগে। তবে সেই শিকড় সন্ধান করব নিজ জাতির অনেক হাজার বৎসরের ইতিহাস, ঐতিহ্যের মাটির ভিতর। অনেক অভিজ্ঞতার আগুনে পোড় খেয়ে কবি মধুসূদন যেমন নিজ ভূমি বঙ্গে ফিরেছিলেন বঙ্গভাণ্ডারের বিবিধ রতন সন্ধানে এবং সেই অমূল্য রত্নরাজি দিয়ে তাঁর অমর কাব্যের সৌধ রচনা করেছিলেন তেমন আমিও বঙ্গ ভাণ্ডারের অমূল্য রত্নরাজি দিয়ে এই জাতির বিপ্লবের ও মুক্তির জ্ঞানতত্ত্ব রচনা করতে চাই।

 

এখন আমি এঙ্গেল্‌স প্রসঙ্গে আপনার মন্তব্য সম্পর্কে সামান্য কিছু কথা বলব। আপনি বলেছেন, ‘তাছাড়া মার্কসের মৃতুøর পর এঙ্গেল্‌স যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করেছেন তার পূরণ এখনও হয় নি।’ তারপর মার্কস-এঙ্গেল্‌স-লেনিন-স্তালিন-মাও-এর নাম উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘তবে এঙ্গেলস-এর কিছু মারাত্মক বিভ্রান্তিমূলক লেখা ছাড়া বাকীদের সকল মৌলিক তত্ত্বকেই বিকশিত করা সম্ভব।’

 

বেচারা এঙ্গেলস! যিনি কি না মার্কসবাদের মূল দার্শনিক-রাজনৈতিক সৌধটা গড়েছেন তাঁকে বাদ দিলে মার্কসবাদের কিছু থাকে কি? আপনাকে একবার অনুরোধ করব ব্যবহারিক মতাদর্শ হিসাবে মার্কসবাদের মৌলিক সূত্রগুলো মার্কসের কতটা আর এঙ্গেলসের কতটা এটা একটু তুলনামূলকভাবে বিচার করতে। হাঁ, সমস্যাটা প্রধানত এঙ্গেল্‌সকে নিয়েই। কারণ তিনি মার্কসের মূল কয়েকটা অর্থনৈতিক ধারণা নিয়ে মার্কসবাদের নামে একটা ব্যবহারিক রাজনৈতিক তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন। মার্কসের শ্রেষ্ঠ কীর্তি তো ‘পুঁজি’। তা পুঁজিতে মার্কসীয় দর্শনের কতটুকু বা কি আছে? অথবা মার্কসের অন্যান্য লেখায়? আছে। কিন্তু কতটুকু? ইতিহাস ব্যাখ্যা, ঐতিহাসিক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা, দ্বান্দ্বিকতার তত্ত্ব এবং রাষ্ট্র-শাসন-গণতন্ত্রের শুকিয়ে মরা বা অপ্রয়োজনীয় হওয়ার তত্ত্ব, বিভিন্ন দার্শনিক ও ব্যবহারিক আন্দোলনের সমস্যাগুলো নিয়ে বিশদ ও স্পষ্ট লেখাগুলো প্রধানত কার? আমার ধারণা এঙ্গেল্‌সকে বাদ দিলে একটা মতাদর্শ বা ব্যবহারিক তত্ত্ব হিসাবে মার্কসবাদ শূন্যে পরিণত হয়। ঐ যে বললাম মার্কসের কিছু অর্থনৈতিক সূত্র থাকে। তখন মার্কসের বিচার হবে মূলত একজন অর্থনীতিবিদ হিসাবে। হয়ত সমাজতাত্ত্বিক হিসাবেও তাঁর মূল্য থাকবে। কিন্তু তবু তাঁর মূল শক্তিটা অর্থনীতিতে।

 

আমার দৃঢ় ধারণা মার্কসবাদের অর্থনীতি যদি প্রধানত মার্কস দিয়ে থাকেন তবে তার রাজনীতি দিয়েছেন প্রধানত এঙ্গেল্‌স। হাঁ, উভয় ক্ষেত্রে উভয়ের অবদান আছে। কিন্তু মৌলিক অবদানের দিকটা বলছি। এখন আমার প্রশ্ন মার্কসবাদের আবেদন প্রধানত অর্থনৈতিক নাকি রাজনৈতিক কারণে?

 

আসলে কমিউনিস্ট শিবিরের বিপর্যয়ের পর থেকে অনেকে এঙ্গেলসকে দোষারোপ করে মার্কসকে বাঁচাতে চাইছে। কেন সেটাও বোঝার চেষ্টা করা উচিত। সেটা কি মার্কসের কতকগুলো অর্থনৈতিক সূত্র নিয়ে কেতাবী বিতর্ক চালিয়ে মার্কসবাদের বাতাবরণে নিজেদের বাস্তবতা বর্জিত পাণ্ডিত্য জাহির করার জন্য? এই মুহূর্তে আমার মার্কস-এঙ্গেল্‌স-এর উপর নূতন করে অধ্যয়ন ও গভীর অনুসন্ধান করার সময় এবং সুযোগ নেই। তবে মনে হয় এক সময় এর প্রয়োজনটাও দেখা দিতে পারে। সেটা দেখা দিলে এ প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করব। যাইহোক, আপনাকে এঙ্গেলসের উপর লেনিনের লেখাটাও পড়তে অনুরোধ করব। আর বলি মার্কসবাদের ‘কিছু’ ভ্রান্তির জন্য এঙ্গেল্‌সকে দায়ী যদি করতে হয় তবে মার্কসকেও দায়ী করতে হয়। কারণ এঙ্গেল্‌স যখন রাজনৈতিক-সামাজিক দর্শনটা মার্কসের সঙ্গে এবং মার্কসের কয়েকটি অর্থনৈতিক-সামাজিক ধারণাকে অবলম্বন করে গড়ে তুলছিলেন তখনই মার্কসের তাতে বাধা দেওয়া উচিত ছিল। হয়ত তাঁর অর্থনীতির তত্ত্ব বিকাশে এঙ্গেলসেরও অবদান ছিল। কিন্তু এটা তো প্রধানত মার্কসের এবং এঙ্গেলস ঐ অর্থনীতির তত্ত্বকে ভিত্তি করে যে রাজনৈতিক ব্যাখ্যা এবং কাঠামো দিতে হয় মূলত সেটাই দিয়েছিলেন। সুতরাং মার্কস বাধা দিবেন কি করে? অত কেন? কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহার কার লেখা? দুই জনেরই কি না? পরবর্তী কালের মার্কসবাদ তো ঐ বীজেরই মহীরূহ। তাহলে দোষটা একজনকে বাঁচিয়ে আর একজনের ঘাড়ে চাপানো কেন?

 

হাঁ, তবু দোষটা এঙ্গেলসের। কারণ তিনি শুধু ব্যক্তি মার্কসকে লালন করেন নি, উপরন্তু তাঁর কীর্তি এবং চিন্তাকে মার্কসবাদের কাঠামোতে আবদ্ধ করেছিলেন। আমার ধারণা এই কাঠামোটা মূলত এঙ্গেল্‌সের অবদান। আর একটা কথা ভাবতে বলব। দুই জনেরই জীবনে বাস্তব সংগ্রাম এবং রাজনৈতিক কর্ম আছে। কিন্তু সেটা কার কতটা এটুকুও কি খোঁজ নিয়ে জানতে হবে না? হাঁ, যে কোন চিন্তা বা মতবাদের পিছনের ব্যক্তি বা শক্তিটাকে চিনতে বা বুঝতে চেষ্টা করতে হয়। তা না হলে আসলে বোঝা যায় না।

 

ছাত্র জীবন থেকেই আমার ভিতরে এই প্রশ্নটা কাঁটার মত বিঁধে আছে মার্কসের অকৃত্রিম বন্ধু ও অনুরাগী এঙ্গেল্‌স যখন তাঁর কিছু মৌল ধারণার সঙ্গে নিজেরও কিছু মৌল ধারণা মিলিয়ে মার্কসের নামে একটা মতবাদ গড়ে তুলছেন তখন মার্কস প্রতিবাদ করেন নি কেন? আর যদি মেনেই নিলেন তবে তিনি নিজের উচ্চারণেও এঙ্গেলসের নামটাও একই রকম শ্রদ্ধা ও অনুরাগের সঙ্গে উচ্চারণ করেন নি কেন? এ কেমন বন্ধু! কিংবা ন্যায়-নীতির মানদণ্ডেও এটা কি ঠিক? তাহলে হয়ত আমরা মার্কসবাদ-এঙ্গেলসবাদ নামে একটা মতবাদকে দেখতে পেতাম। নাকি দুইজনের নামে এক মতবাদ দিলে সেটা সর্বহারার একনায়কত্বের ধারণাটাকে আঘাত করে? একজনেরই তো নাম থাকতে হবে! লা শরীক আল্লাহ্‌! আল্লাহ্‌র অংশীদার নেই! সমস্ত ক্ষমতা, প্রভুত্ব, কীর্তি, প্রশংসা আল্লাহ্‌র! আর গোলমাল হলেই যত দোষ নন্দ ঘোষ শয়তানের!

 

জানি না মার্ক্‌স-এঙ্গেল্‌স কী বুদ্ধি করে কী ঠিক করেছিলেন। তবে এই নিরঙ্কুশ একত্ববাদী চিন্তা পদ্ধতিটা দ্বান্দ্বিকতাকে ব্যবহার করলেও মানুষের চিন্তাকে বড় একপেশে করে। কারণ শ্রেণী দ্বন্দ্ব ব্যবহার করলেও তার লক্ষ্যটাই শ্রেণী দ্বন্দ্বহীনতা। অর্থাৎ কমিউনিজম। আর সেই লক্ষ্যে পৌঁছবার হাতিয়ার হল একনায়কত্ব। নাম তার গালভরা সর্বহারার বা শ্রমিক শ্রেণীর দেওয়া হলেও ওটা একনায়কত্ব। জিনিসটাই নিরঙ্কুশভাবে বা absolutely অসহিষ্ণু। এখন এই রকম এক চিন্তা পদ্ধতির শিকার বা বলি হচ্ছেন এঙ্গেল্‌স, যিনি আমার বিচারে এই মতবাদের এমন অন্যতম নির্মাতা যাকে বাদ দিলে বিপ্লবের ব্যবহারিক মতবাদ হিসাবে মার্কসবাদের অস্তিত্ব থাকে না। হয়ত আর কিছু কাল পর তিনি মার্কসবাদের ঈশ্বর মার্কসের পাশে প্রফেটের পরিবর্তে শয়তান হিসাবে চিহ্নিত হবেন!

 

হাঁ, মার্কসবাদের ব্যবহারিক রাজনৈতিক দিকটা প্রধানত এঙ্গেলসের। সুতরাং ত্রুটি বা ব্যর্থতার দায়ভাগীও প্রধানত তাঁকে হতে হবে। তবে নীতি ও নৈতিকতার যে প্রশ্নটা আমি একটু আগেই তুলেছি সেটা অন্যের কাছে কী অর্থ বহন করবে জানি না। কিন্তু আমার কাছে বড় হয়ে থাকবে। জানি না বাংলা ও ভারতবর্ষের অনেক হাজার বৎসরের ঐতিহ্যের মাটিতে ব্রাহ্মণ্যবাদের বাইরেও ন্যায়-নীতিবোধের যে বৃক্ষটা বেড়ে উঠেছে তা তার শিকড় আমার চেতনারও অনেক গভীরে চালিয়েছে বলে পাশ্চাত্যের জ্ঞানতত্ত্ব ও ন্যায়-নীতিবোধের সব ব্যাপারকে মেনে নিতে আমার বাধে কি না। 

 

পুনশ্চঃ ১-এ আপনি ভাসানী প্রসঙ্গে যে প্রশ্ন করেছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন সেটা আমার জন্য মূল্যবান। তবে আমি কিন্তু ভাসানী সম্পর্কে ব্যাপক মূল্যায়ন ও ব্যাখ্যার চেষ্টা করি নি। বলতে পারেন তাঁর ভুমিকার উপর নূতন আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে চেয়েছি। সেইজন্য তাঁর মুল্যায়নে যে দৃষ্টিভঙ্গীটা সাধারণত অনুপস্থিত থাকে আমি সেটাকে আনতে চেয়েছি। আমি তাঁর মূল প্রবণতা এবং বৈশিষ্ট্যটা তাঁর অসংখ্য বৈপরীত্য ও জটিলতার ভিতর থেকে উঠিয়ে এনে দেখাতে চেয়েছি। আর তখন বোঝা যাবে কী বিশাল ঐতিহাসিক ভুমিকা তিনি পালন করেছিলেন। হাঁ, তথ্য প্রমাদ কিছু থাকতে পারে। সেগুলো ঠিক করে নিতে চেষ্টা করব। আর ’৬৯-এর জানুয়ারী থেকে ফেব্রুয়ারী প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তাঁর অজ্ঞাতবাসের কারণ এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তবে ভাসানীকে আমি যতটুকু বুঝেছি তাতে মনে হয়েছে ’৬৯-এর ৬ ডিসেম্বর গণ আন্দোলনের সূচনা ঘটিয়ে তিনি নিজেকে আড়াল করে নিয়েছিলেন তার গতিধারা বোঝার জন্য। হয়ত আন্দোলনকে নিজস্ব অভিমুখ দিতে চেয়ে। যাতে করে আন্দোলনের স্বরূপ বুঝে তিনি তাঁর পরবর্তী কার্যক্রম ঠিক করে নিতে পারেন।

 

আর আপনার জানা আছে নিশ্চয়, ন্যাপের ভিতর বা সঙ্গে থাকা কমিউনিস্ট নেতৃত্ব প্রায় পুরোটা আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিল। হক-তোহারা ছিলেন আন্দোলনের বিরুদ্ধে। আবদুল মতিনরাও কিন্তু আন্দোলনের সঙ্গে একাত্ম ছিলেন না। হাঁ, মূলত সমস্ত ন্যাপ নেতৃত্ব তখন আন্দোলন বিরোধী অথবা বিমুখ। ভাসানীর ঐ নিঃসঙ্গতার সমস্যা কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে। তিনি পাচ্ছেন শুধু ন্যাপের সঙ্গে থাকা ছাত্রদের আর শ্রমিকদের। সুতরাং তিনি হয়ত ঝুঁকিও এড়াতে চেয়ে কিছু সময় সরে ছিলেন।

 

যাইহোক, এত সব আলোচনা কি এই এক বইতেই আনা সঙ্গত হবে? তবে আমি ভাবছি। কিন্তু তথ্যের অভাবও অনেক রয়েছে। যাঁরা ঐ সময়ে ভাসানীর কাছে ছিলেন তাঁদের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। সবাই বেঁচে নেই। বাকীদেরও পাওয়া কঠিন হয়। আমি তো সাক্ষাৎকার নেবার চেষ্টা করেছি। তবে সময় এবং শ্রম দিতে পারলে নিশ্চয় ভাসানীর উপর আরও তথ্য ভিত্তিক মূল্যবান আলোচনা হতে পারে। তবে একটা কথা বলতে পারি আমি ভাসানীকে কাছ থেকে যেটুকু দেখেছি এবং বুঝেছি তা থেকেও কিন্তু আমার মূল্যায়নের অনেক উপকরণ উঠে এসেছে। আর ভিন্ন প্রসঙ্গে যাবার আগে বলি আমার জানা মতে ’৬৮-’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের উপর আপনার সমতুল্য অনুসন্ধান এবং কাজ আর কেউ করে নি। আপনার পিএইচডি-এর বিষয়বস্তুও তো ছিল ঐ গণ-অভ্যুত্থান। সুতরাং আমার প্রাসঙ্গিক দুর্বল জায়গা এবং ফাঁকগুলো পূরণের ক্ষেত্রে আপনার সহযোগিতা আমার প্রয়োজন।

 

পুনশ্চঃ এর ২নং প্রসঙ্গে কমিউনিস্টদের ব্যাপক ব্যর্থতার জন্য কমিউনিস্টরা কতটুকু দায়ী এবং তাদের দর্শন কতটা দায়ী এসব চুলচেরা বিচার আমি না করলেও মূল দিকগুলো কিন্তু দেখাতে চেষ্টা করেছি। কমিউনিস্টদের ভুলগুলো মোটামুটি বলেছি। এবং তাদের ঐ ভুলগুলোর পিছনে যে তাত্ত্বিক দৃষ্টিভঙ্গী ও বিচার পদ্ধতি ক্রিয়াশীল ছিল সেগুলোরও কিছু কিন্তু আলোচনা করেছি। তবে হাঁ, খুব বিশদ করি নি।

 

আসলে অত আলোচনা করার অবকাশ কি এই এক বইয়ে আছে? আমাকে কি পাঠকের দিকটাকেও ভাবতে হবে না? লেখার আগে আমি সাধারণত আমার পাঠক বা পাঠকগোষ্ঠী ঠিক করে নিই। অর্থাৎ আমি কাদেরকে কথাগুলো বলতে চাই বা বলছি সেটা ঠিক করেই লেখি। আমি তো একাডেমিকদের জন্য লেখি নি। যারা এক ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এসেছে, যারা এক সময় মাঠে ছিল কিন্তু এখন নেই অথবা অনেকে আছে বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে বইটা আমি মূলত তাদের জন্য লেখেছি। তাদের মনে যদি আমি নূতন উপলব্ধির জাগরণ ঘটাতে পারি এবং নূতন জিজ্ঞাসা আনতে পারি তবে বহু প্রশ্নের উত্তর দেবার জন্য আমাকে তৈরী হতে হবে। যেমন ধরুন আপনি। এই এক বই থেকে আপনার কিছু প্রশ্ন এবং মন্তব্য এসেছে। তার উত্তর দিতে গিয়ে আমি অনেক কথা বললাম। তাত্ত্বিক বিশ্লেষণও কিছু করলাম। আর এমন কিছু ঘটনার বিবরণ আপনাকে দিলাম যার কিছু অপ্রকাশ্য এবং অল্প লোকের জানার মধ্যে আর যার কিছু প্রায় কাউকেই বলি নি। হাঁ, এমন কিছু ঘটনার কথা বললাম যা প্রকৃতপক্ষে আমার মনের ভিতর চাপা ছিল এতকাল।

 

আসলে আমি চাইছি বইটি একটা নূতন বিতর্ক ও আলোচনার সূত্রপাত ঘটাক।

 

আমার কথা ফুরিয়ে এল। তবে শেষ করার আগে বলি আপনার মন্তব্য আমাকে বিরাটভাবে সমৃদ্ধ করেছে। এটা শুধু আমাকে যে অনুপ্রাণিত করেছে তাই নয় সেই সঙ্গে ভাবিয়েছেও। আর আপনার মন্তব্যে আসা বিভিন্ন কথার উত্তর খুঁজতে গিয়ে আমাকে অনেক কিছুর গভীরে যেতে চেষ্টা করতে হয়েছে। যেসব কথা আমার বইয়ে আনতে চাই নি তাও আপনার উত্তরে আনতে হয়েছে। কিন্তু এই সবই বলেছি আর একটি বিশেষ কারণে। আপনি নিষ্কর্মা বুদ্ধিজীবী নন। আপনার জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা পুথির চৌহদ্দিতে আবদ্ধ নয়। বাস্তব জীবন ও সংগ্রামের অভিজ্ঞতায় আপনি সমৃদ্ধ। আপনার জীবনে রয়েছে কৃষকদের নিয়ে সংগঠন, আন্দোলন ও যুদ্ধ করার ইতিহাস। আছে এরশাদ-বিরোধী ছাত্র আন্দোলন করার ইতিহাস। আজ আপনি একজন শুধু নিষ্ঠাবান গবেষক-বুদ্ধিজীবী-লেখক নন, সেই সঙ্গে লাঞ্ছিত-বঞ্চিত মানুষ এবং এই জাতির মুক্তির সংগ্রামের আপনি আজো একজন সাহসী সৈনিক ─ যোদ্ধা। হাঁ, এমন যোদ্ধাদের প্রতি আমার যে গভীর অনুরাগ ও শ্রদ্ধা বোধ আছে তা থেকেই কিন্তু এমনভাবে লেখলাম। কারণ আপনার উপলব্ধির মূল্য আমার কাছে খুব বেশী। আশা করি আপনার কিছু বক্তব্যের উপর যে আলোচনা ─ সমালোচনা করেছি তাকে সেইভাবে নিবেন ।

 

ইতি ─ আপনার

শামসুজ্জোহা মানিক

 

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ
Archive
 
সাম্প্রতিক পোষ্টসমূহ